অভিজ্ঞান
‘ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরোতে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট। বল তো কী?’ অভিকে প্রশ্ন করল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা একটা ছেলে। মানানসই রকমের চওড়া। একটু আগে যখন হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়েছিল, অভির মনে হয়েছিল ছেলেটার কবজি তার থাইয়ের মতো চওড়া।
‘জানি না।’ ঘাড় নাড়ল অভি। প্রথম দিন কলেজে ঢুকে এ কী বিড়ম্বনা! একেই কি ইন্ট্রো অথবা র্যাগিং বলে?
‘বলতে না পারলে আর এগোনো যাবে না গুরু। অ্যাট লিস্ট ইউ শুড ট্রাই।’ বলল সাড়ে ছফুট।
ইংরিজি? মনে মনে খাবি খেল অভি। ক্লাস ওয়ান থেকে বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে। গড়গড়িয়ে ইংরিজি পড়তে আর লিখতে পারে। বুঝতে পারাটাও সমস্যা নয়। কিন্তু ইংরিজি বলা? অসম্ভব ব্যাপার। এখন কী ভাবে উদ্ধার পাবে এই দানবের হাত থেকে?
‘আমাদের জীবন স্যার। আই মিন লাইফ।’ মিনমিন করে বলে অভি।
‘তুই আমাকে স্যার বললি?’ সরু চোখে তাকায় দানব। ‘নির্ঘাত বাংলা মিডিয়াম? লেখাপড়াই শুধু শিখেছিস। দুনিয়াদারি শিখিসনি। চল তোকে মুরগি করি।’
এক ঝটকায় অভিকে কোলে তুলে নেয় দানব। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম রিপুদমন কর। লোকে রিপুদা বলে ডাকে। তুই আমায় কী বলে ডাকবি?’
‘রিপুদা, আমায় নামিয়ে দাও। প্লিজ।’
অভিকে কাঁধে নিয়ে কলেজ ক্যান্টিনে ঢোকে রিপু। একটা লম্বা টেবিলের চারদিকে অনেক ছেলেমেয়ে বসে। পাঁজাকোলা করে অভিকে টেবিলের মাঝখানে শুইয়ে দেয়। অভি ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল। রিপু প্রকান্ড ঘুষি পাকিয়ে বলল, ‘উঠলে থোবড়া বিলা করে দেব। শুয়ে থাক। তোর এখন ডিসেকশান হবে।’ অভি চোখ বুঁজে শুয়ে রইল।
‘বাড়ি কোথায়?’ পায়ের কাছ থেকে প্রশ্ন করল মোটা একটা মেয়ে।
‘বেলুড়।’
‘কোন স্কুল?’
‘উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুল।’
‘ইঞ্জিনিয়ারিং-এ র্যাঙ্ক কত?’
‘তিনশো চার।’
‘মেডিক্যাল?’
‘দুশো পঞ্চাশ।’
‘বাবা-মা কী করে?’
‘বাবা চাকরি। মা কিছু না।’
‘তার মানে ফার্স্ট জেনারেশন ডাক্তার। বল তো, ‘ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরোতে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট’। এটা কী? বাই দ্য ওয়ে আমার নাম আপ্পু। সবাই আমায় আপ্পুদি বলে ডাকে। তুইও তাই বলবি।’
অনেককাল আগে, এশিয়াডের ম্যাসকট ছিল নৃত্যরত হাতি। নাম আপ্পু। এই আপ্পুর নাম যে-ই দিয়ে থাকুক, ঠিক দিয়েছে।
অভির মাথায় আপ্পুর বলা ধাঁধাঁ ঘুরপাক খাচ্ছে। একই ধাঁধাঁ একটু আগে রিপু জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন উত্তর দিতে পারেনি। এবার পারবে। কেন না ক্লু হিসেবে চলে এসেছে আপ্পুর ফার্স্ট জেনারেশান ডাক্তার সংক্রান্ত উক্তি।
‘ডাক্তারি।’ জবাব দেয় অভি। ‘মেডিক্যাল প্রফেশন। এখানে ঢুকতে যে খুব কষ্ট সেটা বোঝা হয়ে গেছে।’
টেবিলের চারদিকে চটরপটর হাততালি, হর্ষধ্বনি, শিস ইত্যাদি শোনা যায়। রিপু চিৎকার করে বলে, ‘জীবনদা, একে একটা ডবল ডিমের মামলেট খাওয়াও।’
অভি চোখ খুলে শবাসন থেকে উঠে বসে। এবার আপ্পু তাকে কোলে নেয়। এক ঝটকায় টেবিল থেকে মেঝেতে নামিয়ে বলে, ‘ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। বল তো, বর্ষাকালে ছাতা না থাকলে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কেন বেরোনো উচিৎ?’
এই রে! এ আবার কীরকম প্যাঁচালো প্রশ্ন? মাথা-টাথা চুলকে অভি বলল, ‘জানি না।’
‘কেন না, ‘ইয়ে ঘন্টো তক গিলেপন কা অ্যাহেসাস ভি না হোনে দে।’ বুঝলি?’ চোখ পাকিয়ে দাবড়ানি দেয় আপ্পু।
‘হ্যাঁ।’ লজ্জা লজ্জা মুখে বলে অভি।
‘ক্যান ইউ সি ইয়োরেনাস উইথ ইয়োর নেকেড আই?’ পাশ থেকে প্রশ্ন করে আর একজন। এ আবার কে রে বাবা? অবিকল টিনটিনের মতো দেখতে। গোল মুখ, পুঁটলির মতো নাক, গুল্লি গুল্লি চোখ, মাথার চুল জেল দিয়ে ওপরে তোলা। প্রশ্ন করছে ইংরিজিতে। অভি মনে মনে এর নাম দিল টিনটিন। সে টিনটিনকে স্মার্টলি বলল, ‘নো।’
‘আই সে ইয়েস।’ বলে টিনটিন।
অভি বলে, ‘হাউ?’
অভির প্রশ্ন শুনে টেবিলের চারপাশে বসে থাকা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। অভি বুঝতে পারে না কেন। সে আবার বলে, ‘হাউ?’
‘ইউ রিয়্যালি ওয়ান্ট টু নো?’ ফচকে হেসে টিনটিন বলে, ‘ওকে, স্টেপ ওয়ান। বেন্ড ইয়োর ওয়েস্ট অ্যাট নাইন্টি ডিগ্রি।’
নব্বই ডিগ্রিতে কোমর বাঁকাতে হবে? এটার মধ্যে কোনও একটা ফাঁদ আছে। এতক্ষণে বুঝতে পারে অভি। সে বলে, ‘আমি ক্লাসে যাচ্ছি। পরে হবে।’
‘শাটাপ ইউ অ্যাস হোল। যা বলছি কর। না করলে ক্যালাব।’ টিনটিনের ধমক শুনে অভি সামনের দিকে নব্বই ডিগ্রি ঝোঁকে। ভয়ের চোটে তার বুক দুরদুর করছে।
‘স্টেপ টু। বেন্ড ইয়োর নি-জ বাই ফর্টি ফাইভ ডিগ্রি।’
এই অবস্থায় হাঁটু পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকাতে হবে। সে তো অসম্ভব ব্যাপার! তাও চেষ্টা করে অভি। পেরেও যায়। এখন সে নিজের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বাকিদের দেখতে পাচ্ছে।
টিনটিন আপ্পুর কানে কী একটা বলল। আপ্পু নিজের ঝোলা থেকে গোল মতো একটা জিনিস বার করে টিনটিনের হাতে দিল। টিনটিন সেটা অভির হাতে ধরিয়ে বলল, ‘পুট দিস মিরর বিটুইন ইয়োর লেগস।’
আপ্পুর আয়না নিজের পায়ের ফাঁকে ধরে অভি। টিনটিন বলে, ‘ক্যান ইউ সি ‘ইয়োর অ্যানাস’? না প্যান্ট খুলতে হবে?’
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় অভি। আপ্পুকে আয়না ফেরত দিয়ে চোখ মোছে। আপ্পু বলে, ‘তুই কাঁদছিস? পাগল নাকি? এরপরে তো সুপারকে রিপোর্ট করবি যে র্যাগিং করা হয়েছে। অ্যাই টিনটিন, মাফ চা।’
এর নাম সত্যিই টিনটিন? হেসে ফেলে অভি। জীবনদা ওমলেট নিয়ে এসে বলে, ‘একইসঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে? আজব চিড়িয়া! একে পেলে কোথা থেকে?’
অভি মাথা নিচু করে ওমলেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সব্বাই তাকে মুরগি করছে। ক্যান্টিনের ওয়েটারও।
আপ্পু অভির মনের অবস্থা ধরতে পেরেছে। সে বলল, ‘মামলেট খেয়ে দৌড় দে। এলএলটিতে তোদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দিন দেরি করলে এনজি ঝাড় দেবে।’
‘এলএলটি মানে?’ ওমলেট খেতে খেতে প্রশ্ন করে অভি।
‘এলএলটি মানে লার্জ লেকচার থিয়েটার। এখান থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ইটের তৈরি যে লাল বাড়িটা দেখতে পাবি, সেটাই এলএলটি। আর মাঠের ওপারে ওই যে সাদা রঙের একতলা বাড়িটা দেখছিস, ওটার নাম এসএলটি। মানে স্মল লেকচার থিয়েটার। এখন এলএলটিতে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির এইচওডিরা তোদের জ্ঞান দেবেন। শেষ হলে সবাই মিলে এসএলটিতে আসবি। ওখানে আমরা তোদের জ্ঞান দেব। বুঝলি?’
‘বুঝলাম,’ ওমলেট শেষ করে অভি বলে, ‘ওমলেটের দাম কত?’
‘মামলেট না বলে ওমলেট বললি? তাহলে ওমলেট বানান বল।’ হুঙ্কার ছাড়ে রিপু, ‘ভুল বললে দশজনের মামলেটের দাম দিতে হবে।’
‘ও-এম-এল-ই-টি-টি-ই,’ জবাব দেয় ইংরিজিতে অল্পের জন্য লেটার মিস করা অভি।
‘ফোট।’ মাথায় রামগাঁট্টা লাগায় রিপু। ঝোলা কাঁধে এলএলটির দিকে দৌড় লাগায় অভি। ডাক্তারি পড়তে আসার প্রথম দিনে ক্লাস যেন মিস না হয়।
.
এলএলটির দরজায় শাড়ি পরে দু’জন সিনিয়র দিদি দাঁড়িয়ে। হাতে গোলাপ ফুল। অভি নিতে যাবে, এমন সময় কোত্থেকে দৌড়ে এল সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। ঘাড় পর্যন্ত চুল। গায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা। চোখে কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা। শাড়ি পরা দিদির হাত থেকে গোলাপ ফুল নিয়ে, অভিকে ডজ মেরে আগে ঢুকে গেল।
গোলাপ ফুল নিতে নিতে অভি বলে ফেলল, ‘আস্তে লেডিস! কোলে বাচ্চা!’ শাড়ি পরা দুই দিদি তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল এবং হাসল। ঝোলাওয়ালি ঘুরেও দেখল না। অভি তড়বড় করে এলএলটির ভিতরে ঢুকল।
আলো থেকে অন্ধকার ঘরে ঢুকলে আরও অন্ধকার লাগে। অভিরও তাই হল। আবছা আঁধারে বুঝতে পারল, এটা একটা গ্যালারি। অর্ধগোলাকৃতি বিশাল হলঘর জুড়ে কাঠের গ্যালারির বিস্তৃতি। গ্যালারির সামনে স্টেজ। স্টেজে দুজন মাঝবয়সি মহিলা বসে রয়েছেন।
‘এদিকে আয়।’ অভির হাত ধরেছে কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ঝোলাওয়ালি। ‘তোত-তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন করে অভি।
‘তুমি আবার কী? ক্লাসমেটকে কেউ তুমি বলে? আমার নাম দময়ন্তী সেনগুপ্ত। ডাকনাম দিঠি। তোর কী নাম?’ এক হ্যাঁচকায় অভিকে গ্যালারির প্রথম ধাপে তুলে নেয় দময়ন্তী, ‘চল। একদম পিছনে বসি। ওখান থেকে ভালো দেখা যাবে।’
পিছনের সিটে বসে অভি নিজের নাম বলে। প্রশ্ন করে, ‘তোর বাড়ি কোথায়?’
‘দিল্লি। কলকাতার বাড়িটা কেমন, এখনও দেখা হয়নি। ওসব ছাড়। ওই দ্যাখ কে আসছে।’ আঙুল নাড়ে দময়ন্তী।
মূল গেট দিয়ে ঢুকছে মিলিটারির মতো গোঁফওয়ালা, কালো, মোটা একটা লোক। পরনে প্যান্ট-শার্ট। কাঁধে ঝুলছে আস্ত কঙ্কাল। হাড়গুলো তার দিয়ে জোড়া। লোকটা প্যান্টশার্টের বদলে চোগা-চাপকান পরে থাকলে তাকে এবং তার কাঁধের প্রপকে বিক্রম আর বেতালের দৃশ্য বলে চালানো যেত। স্টেজে একটা কাঠের ফ্রেম রয়েছে। সেখানে আংটার সাহায্যে কঙ্কাল ঝুলিয়ে দেওয়া হল।
ক্লাসশুদ্ধ সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। অভি বলল, ‘ইনিই কি অ্যানাটমির এইচওডি?’
‘সিট ডাউন।’ স্টেজ থেকে চিল চিৎকার করলেন মাঝবয়সি এক মহিলা। আধো অন্ধকারে দেড়শো জন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে পড়ল। মোটা লোকটার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন মহিলা। তারপর বললেন, ‘শেম অন ইউ। ওর নাম কালুয়া। ও ডোম। তোমরা ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গ্রিট করলে। আমাদের দেখে একবারও ওঠোনি।’
‘সেটা আপনাদের সমস্যা। আমাদের নয়।’ বলল দময়ন্তী। কথাটা বলেই ডেস্কের নীচে লুকিয়ে পড়ল। ঠিক সামনের সিটে বসে থাকা একটা মেয়ে সেটা শুনে ফিশফিশ করে বলল, ‘আমিও এটাই ভাবছিলাম।’
এলএলটি জুড়ে পিনপতনের স্তব্ধতা। ‘কে বলল? কে বলল কথাটা?’ আবার চ্যাঁচালেন মহিলা। কেউ কোনও উত্তর দিল না।
সাদা জামা এবং সাদা প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক স্টেজে উঠছেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কাচের ফাঁকে ঝিকমিকোচ্ছে মেধাবী দৃষ্টি। কাউকে কিছু বলতে হল না। দেড়শো ছাত্রছাত্রী এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট নীলাক্ষ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে এনজিকে।
‘সিট ডাউন প্লিজ।’ পোডিয়ামের মাইক্রোফোনে মুখ রেখে মৃদু গলায় বললেন এনজি। সবাই বসে পড়ল। দময়ন্তীও ডেস্কের তলা থেকে উঠে বসল। সামনের সিটের মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে দময়ন্তীকে বলল, ‘ওয়েল সেড।’
‘ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, প্রিভিয়াসলি নোন অ্যাজ রবিনসন হসপিটাল। দিস কলেজ হ্যাজ গট আ চেকারড হিসট্রি অফ ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড ফিফটি ইয়ার্স…’
এনজির স্বাগত ভাষণের ফাঁকে দময়ন্তী সামনের মেয়েটার কাঁধে টোকা দিল। ‘নাম কী? কোন স্কুল?’
‘বৃন্দা ব্যানার্জি। মডার্ন হাই স্কুল।’ মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল মেয়েটা। অল্প আলোয় অভি দেখল, বৃন্দা মার্বেল পাথরের মতো ফরসা আর চকচকে। ভুরু দুটো তুলির টানে আঁকা। পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট। বারবি ডলের মতো দেখতে।
‘এমা, তুই তো সিকনির মতো ফর্সা! লজ্জা করে না?’ বলল দময়ন্তী।
‘তুইও তো আমারই মতো ফ্যাকাশে। তোর লজ্জা করে না?’ জানতে চায় বৃন্দা।
‘আর বলিস না।’ বিরক্তি ঝরে পড়ে দময়ন্তীর গলায়, ‘কলকাতার রোদে যদি কালো হওয়া যায়।’
এনজি-র কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘মিট ডক্টর পার্বতী মুখার্জি, হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট, ফিজিওলজি। অ্যান্ড ডক্টর আরতি মজুমদার, হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, বায়োকেমিস্ট্রি। এমবিবিএস শব্দটার ফুল ফর্ম ব্যাচেলার অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলার অব সার্জারি। তোমাদের চার বছরের এমবিবিএস কোর্সে তিনবার ইউনিভার্সিটি পরীক্ষা দিতে হবে। ফার্স্ট, সেকেন্ড অ্যান্ড ফাইনাল এমবিবিএস। ফার্স্ট এমবিবিএস এক বছরের কোর্স। এতে তোমাদের তিনটে সাবজেক্ট পড়তে হবে। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রি। সুতরাং আগামী এক বছরের জন্য তোমাদের ভাগ্য আমাদের তিনজনের হাতে। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘ইয়েস স্যার!’ ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে একটা হাত উঠল।
‘স্ট্যান্ড আপ অ্যান্ড গিভ ইয়োর ক্রেডেনশিয়াল।’ বললেন এনজি।
ছেলেটি উঠে দাঁড়াল কিন্তু কোনও কথা বলল না। সমস্যা বুঝতে পেরে এনজি বাংলায় বললেন, ‘নাম বলো। কোন স্কুলের ছাত্র সেটা বলো। তারপর প্রশ্ন বলো।’
‘চন্দন সরকার। স্যামিলটন হাইস্কুল। নতুনগ্রাম।’ মিলিটারি অর্ডারের কায়দায় হাঁফ পেড়ে ঘোষণা করল ছেলেটি। ক্লাসরুমে হাস্যরোল উঠল।
‘তোমার প্রশ্নটা কী?’ এনজি বললেন।
‘এমবিবিএস এর ফুল ফর্ম কী করে ‘ব্যাচেলার অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলার অব সার্জারি’ হয়? ‘বি-ও-এম-এ-বি-ও-এস’ নয় কেন?’
”’বোমা বস”’ বলছ?’ হাসলেন এনজি। ‘এমবিবিএস-এর পুরো কথাটা হল, ‘মেডিসিনে বাক্কালরিয়াস বাক্কালরিয়াস চিরারজি।’ এটা ল্যাটিন কথা। যার মানে ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি। কী ম্যাডাম, আপনি কী বলেন?’
এনজির আমন্ত্রণে উঠে দাঁড়ালেন যে মহিলা, তিনিই কিছুক্ষণ আগে চিল চিৎকার করেছিলেন। তিনি মাইকের সামনে এসে চ্যাঁচালেন, ‘আয়্যাম ডক্টর পার্বতী মুখার্জি, এইচওডি ফিজিওলজি। তোমরা এত হ্যাফাজার্ড ভাবে বসেছ কেন?’
অভি বুঝল মহিলার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে বাধা। মাইকেও চ্যাঁচাচ্ছেন। হালকা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছেন। বাঁহাতে সরু রিস্টওয়াচ। শাঁখা-পলা বা সিঁদুর নেই।
‘বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লজ অ্যাট দ্য বটম। মেয়েরা সামনের সারিতে চলে এসো। একসঙ্গে বসবে না। হারি আপ।’ চ্যাঁচালেন পার্বতী মুখার্জি বা পিএম। এই কথায় এলএলটিতে বেজায় গন্ডগোলের সৃষ্টি হল। টপ ও বটমের আইডিয়া নিয়ে খানিক হাসাহাসির মধ্যে অভি দেখল দময়ন্তী আর বৃন্দা ফার্স্ট বেঞ্চে চলে গেছে। তার পাশে এসে বসেছে ‘বোমা বস’ ওরফে চন্দন সরকার। অভি ফিসফিস করে বলল, ‘চন্দন সরকার? যে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে?’
চন্দন লাজুক মুখে ইতিবাচক ঘাড় নাড়ল।
অভির মনে পড়ল খবরের কাগজে দেখা চন্দনের ছবিসহ ইন্টারভিউ। চন্দনের বাবা কোর্টের করণিক এবং কৃষক। মা গৃহবধূ। স্বামীকে চাষের কাজে সাহায্য করেন। খেতের কাজ সেরে দু’বেলা পড়াশুনা করতে হতো চন্দনকে।
অভির প্রাথমিক অনুভূতি হল ঈর্ষার। সবুজ রঙের একটা ছোট্ট সাপ বুকের বাঁদিকে মৃদু ফনা দোলাচ্ছে। সে মফসসলের মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। জীবনে কোনও ক্রাইসিস নেই, কোনও স্ট্রাগল নেই। পাঁচজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া, করেসপন্ডেস কোর্স আর মকটেস্টের সাহায্যে সে যতদূর গেছে, এই চাষার ছেলেটা বিনা অস্ত্রে সেই দূরত্ব টপকেছে অনায়াসে। অভির পিছনে দারিদ্রের চালচিত্র নেই বলে সে মহান নয়? নাকি সে চন্দনের মতো যথেষ্ট প্রতিভাবান নয়? নাকি দুটোই?
স্টেজে বক্তব্য রাখছেন আরতী মজুমদার ওরফে এএম। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। পোশাক-আশাক নজরকাড়া। সাদা কালো কম্বিনেশনের কটকি শাড়ি আর টকটকে লাল রঙের ব্লাউজ। গলায় রূপোর হাঁসুলি। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। ‘বায়োকেমিস্ট্রি সাবজেক্ট হিসেবে তোমাদের ভালো লাগবে না। ফর্মুলা, কেমিক্যালস, ল্যাবরেটরি, রিঅ্যাকশন, ইকুয়েশান—এইসব দেখে ভীষণ বোর লাগবে। বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়টি চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা তোমরা ভবিষ্যতে একদিন বুঝতে পারবে। আজ নয়। ততদিন, কিপ অন ক্র্যামিং। পড়ে যাও!’
প্রাথমিক সম্বোধনের পর তিনজন হেড ডিপ স্টেজ থেকে নেমে এলএলটি থেকে বিদায় নিলেন। স্টেজে লাফাতে লাফাতে উঠল একদল ছেলেমেয়ে।
‘বস, আমরা সেকেন্ড ইয়ার, তোমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল টিনটিন। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম টিনটিন রায়। আজ ষোলই অগাস্ট। তোরা ভর্তি হলি। আগামী তিরিশে অগাস্ট তোদের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম দেওয়া হবে। তোদের একটা কোয়েশ্চেনেয়ার বিলি করা হচ্ছে। ফিল আপ কর।’
অভির হাতে চলে এল প্রশ্নপত্র। প্রথম দিকে মামুলি প্রশ্ন। নাম, ঠিকানা, বাবার নাম, মায়ের নাম, ইস্কুল-হ্যানাত্যানা। তারপর আস্তে আস্তে প্রিয় খাদ্য, প্রিয় পানীয়, প্রিয় নায়িকা-নায়ক, প্রিয় বই—এইসব। সব শেষে, একপাশে লেখা, আরএসভিপি।
ফর্ম ফিল আপ করতে করতে অভি চ্যাঁচাল, ‘আরএসভিপি মানে কী?’
ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে দময়ন্তী চ্যাঁচাল, ‘এটা একটা ফরাসি কথা। ইংরিজি অনুবাদ হল, ”রেসপন্স ইফ ইয়ু প্লিজ”। মানে, আমরা ওই দিন আসব নাকি আসব না—সেটা জানিয়ে দিতে হবে।’
আসার ঘরে টিক মেরে ফর্ম জমা দিল অভি। ইনট্রোডাকশান শেষ। এলএলটি পর্ব শেষ। কাঠের গ্যালারিতে দুমদাম জুতোর আওয়াজ তুলে সবাই দৌড় লাগাল স্মল লেকচার থিয়েটারের দিকে।
স্থাপত্যগত ভাবে এসএলটি একদম আলাদা। সাদা রঙের বাড়িটিকে হঠাৎ দেখলে মেট্রো সিনেমা হলের মিনিয়েচার সংস্করণ ভেবে ভুল হয়। এখানেও গ্যালারি। তবে লোহা ও কাঠের মিশ্রণে তৈরি। লম্বা লম্বা জানলাগুলো খোলা। দিব্বি রোদ আসছে। এলএলটির কাঠের অন্দরসাজের তুলনায় অনেকটাই গেরস্থ পোষা এসএলটি।
অভি ঢুকে দেখল অশ্বক্ষুরাকৃতি টেবিলের পিছনে একদল ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে দুজন তার চেনা। রিপুদা আর আপ্পুদি।
‘বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লস অ্যাট দ্য বটম’—এই নিয়ন্ত্রণ এখন নেই বলে সবাই মিলিয়ে মিশিয়ে বসেছে। এদিক ওদিক দেখে অভি বসল বৃন্দা আর চন্দনের মাঝখানে।
‘স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তোদের স্বাগতম জানাই। আমি সেক্রেটারি, রিপুদমন কর। সবাই রিপুদা বলে ডাকে। আর এ হল প্রেসিডেন্ট। অপরাজিতা বক্সি। সবাই আপ্পুদি বলে ডাকে।’ রিপু একে একে আলাপ করাল অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পোর্টস সেক্রেটারি, কালচারাল সেক্রেটারি, কমন রুম সেক্রেটারি এবং তাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট পোর্টফোলিও হোল্ডারদের সঙ্গে। অভি খেয়াল করল সেকেন্ড ইয়ারের টিনটিন এখানেও আছে। সে ইউনিয়নের কালচারাল সেক্রেটারি।
‘এখানে মোচার ইউনিয়ন, না?’ ডান পাশ থেকে প্রশ্ন করল চন্দন।
‘মোচা আবার কী জিনিস?’ প্রতিপ্রশ্ন বৃন্দার।
‘জনমোর্চার ছাত্র সংগঠন। নাম ছাত্রমোর্চা। সরকারপন্থী সংগঠন। আমি স্কুলে মোচার সাপোর্টার ছিলাম।’ চন্দন জানায়।
‘উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয় মোচা পার্টি করত? দেশের কী হবে রে!’ হেসে ফেলে বৃন্দা।
বৃন্দার কথার মাঝখানে ডায়াসিং শুরু করল রিপু। ‘আলাপ করিয়ে দিই কালুয়াদার সঙ্গে। কালুয়াদা আমাদের হেড ডোম।’
এলএলটিতে দেখা কালো, বেঁটে, মোটা, মোচওয়ালা মানুষটিকে দেখে আর কেউ উঠে দাঁড়াল না।
‘কালুয়াদের কাছ থেকে তোরা বোন সেট কিনতে পাবি। এক সেটের দাম পড়বে বারো হাজার টাকা। বোনসেট মানে মাথার খুলি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সমস্ত হাড়ের স্টক বিক্রি করে কালুয়াদা।’
সবাইকে নমষ্কার করে কালুয়া বেরিয়ে গেল। রিপু বলল, ‘একটা ইম্পর্ট্যান্ট টিপ দিই। কাজে লাগবে। তোরা যখন কলেজের জন্য ব্যাকপ্যাক বা ন্যাপস্যাক কিনবি তখন তার সাইজ কী হবে?’
সবাই চুপ। এ আবার কী প্রশ্ন?
বৃন্দা হাত তুলল।
‘উঠে দাঁড়া। নাম বল।’
‘বৃন্দা ব্যানার্জি ফ্রম মর্ডান হাই স্কুল।’ তুলতুলে গলায় বৃন্দা জানাল, ‘দ্য ব্যাগ সাইজ শুড বি বিগার দ্যান দ্য সাইজ অফ মাই থাই।’ গ্যালারি থেকে নেমে সবার সামনে এসে নিজের ব্যাগের কোনাকুনি দৈর্ঘ্য নিজের থাইয়ে ফেলে দেখাল সে।
‘হোয়াই?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করে রিপু।
‘আমাদের শরীরের সব থেকে বড় হাড়ের নাম ফিমার। ফিমার হাতে থাকলে কেউ বাসে উঠতে দেবে না। তাই এমন একটা ব্যাগ কিনতে হবে, যার মধ্যে ফিমার ঢুকে যায়।’
‘ইজ ইয়োর ফাদার আ ডক্টর?’ আপ্পু জিজ্ঞাসা করে।
এই প্রশ্নে বৃন্দা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হুড়মুড় করে গ্যালারিতে ফিরে আসার আগে বলে, ‘আমার এক আঙ্কল ডাক্তার।’
‘মেয়েটাকে কী সুন্দর দেখতে মাইরি। ঠিক যেন সোনাক্ষী সিনহা।’ বৃন্দাকে দেখে বলে চন্দন। অভির বুকের বাঁদিকে সবুজ সাপটা আবার মৃদু ফণা দোলায়। বৃন্দা ভালো দেখতে, তাতে তোর কী রে চাষার ব্যাটা?
‘বৃন্দা ঠিক বলেছে। ব্যাগ কিনবে তোমাদের ফিমারের সাইজের থেকে বড়। আর এবার তোমাদের দেওয়া হচ্ছে বুকলিস্ট।’ দশপাতার প্রিন্ট আউট সবার হাতে ধরাচ্ছে ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা। ‘অ্যানাটমিতে গ্রে, ফিজিওলজিতে গাইটন এবং গ্যানং, বায়োকেমিস্ট্রিতে হার্পার পড়তেই হবে। অ্যানাটমিতে ডিসেকশানের জন্য কানিংহাম পড়তে হবে। স্নেল-এর ক্লিনিকাল অ্যানাটমিও লাগবে।’
‘শুধু ফান্ডা ঝাড়ছে! ঢপবাজ।’ দাঁতের ফাঁকে বলে বৃন্দা। ‘অ্যানাটমিতে দাদু আর বিডি চৌরাসিয়ার নাম বলল না। ফিজিওলজিতে ডিপি বা দেবাশিস প্রামাণিকের নাম বলল না। বায়োকেমিস্ট্রিতে সত্যনারায়ণ বা বাসুদেবনের নাম বলল না। নিজেরা চোথা পড়ে পাস করেছে আর আমাদের কাছে বড়বড় বাতেলা।’
‘দাদুটা কে?’ আবার নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে অভি।
‘দাদু মানে ডক্টর মিত্র। ওনার তিন খণ্ড অ্যানাটমির বই মুখস্থ করতে পারলে, ইউ উইল বি ফার্স্ট ইন ফার্স্ট এমবিবিএস। চৌরাসিয়ার বইটাও খুব লুসিড।’
‘কী করে এত জানলি? তোর আঙ্কলের কাছে?’
‘হ্যাঁ। উনি দাদুর কাছে প্রাইভেটে পড়তেন।’
‘প্রাইভেট টিউশনি? আমাদের লাইনে হয় নাকি?’
‘সব হয়। দাদুর গোয়ালে নাকি শ’খানেক ছেলেমেয়ে পড়ে। আঙ্কল বলেছেন, দাদু পড়ান ভালো।’
রিপু বলল, ‘তোরা মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। আমরা চলে যাওয়ার পর এখানে উল্টোপাল্টা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তোদের মাথা খাওয়ার জন্য ডায়াসিং করতে আসবে সিনিয়র দাদাদিদিরা। ওদের ভবিষ্যত অন্ধকার। তোরা নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করিস না।’
সারিবদ্ধভাবে বেরিয়ে গেল রিপু, আপ্পু অ্যান্ড কোং। সারা ক্লাস দেখল, এসএলটির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। এদের মধ্যে একটি ছেলেকে অভি চেনে।
‘নমষ্কার বন্ধুরা। আমার নাম সব্যসাচী সেন। আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি।’ কথা বলা শুরু করল একগাল দাড়িওয়ালা, মোটা চশমা পরা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগওয়ালা একটা ছেলে। ‘আমার বাড়ি বীরভূমের আমোদপুরে। আমার মতো তোদের অনেকেই জেলা বা মফসসল থেকে জয়েন্ট এনট্রান্সে চান্স পেয়ে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসেছিস। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা যদি কোনও লিটমাস টেস্ট হয়, তা হলে তোরা তাতে পাস। কিন্তু এটাই একমাত্র লিটমাস টেস্ট নয়। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল তোদের ডাক্তার হতে শেখাবে। কিন্তু মানুষ হতে শেখাবে আমাদের চারপাশে বয়ে চলা জীবন। কেন টুইন টাওয়ার আত্মঘাতী বোমার আঘাতে ভেঙে যায়, কেন আমলাশোলের মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যায়, কেন গুজরাতে দাঙ্গা বাঁধে, কেন পেট্রল আর ডিজেলের দাম বাড়ে, কেন সরকার বদল হলেও আমাদের কোনও বদল হয় না-এইসব প্রশ্নের উত্তর শেখাবে জীবন। শুধু পড়াশুনো করলে, শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে, শুধু ফেসবুক আর টুইটার করলে, শুধু কানে আইপডের তার গুঁজে রাখলে, শুধু মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখলে আমাদের জীবনদর্শন অসম্পূর্ণ থাকে।’ সামান্য দম নেয় সব্যসাচী, ‘আমরা একটা ছোট্ট দল। নাম প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম বা পিএমএফ। পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক বই পড়ি, কলকাতার বস্তিতে আর গ্রামে গিয়ে ফ্রি মেডিক্যাল চেক আপ করি। তোদের আগ্রহ থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস। কোনও চাপ নিস না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে আমরা তোদের খেয়ে ফেলব না।’
অভি হাঁ করে সব্যসাচীর কথা গিলছে। সব্যসাচী বলছে, ‘আমার সঙ্গে যারা রয়েছে, তারা তোদের একটা পুস্তিকা দেবে। তাতে আমাদের ফোন নম্বর দেওয়া আছে। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করিস। যদি র্যাগিং হয়, অবশ্যই যোগাযোগ করিস। আমরা অ্যাকটিভলি ব্যবস্থা নেব।’
সব্যসাচীর কথা শেষ। দ্বিতীয় ছেলেটি বলল, ‘আমার নাম অনাবিল লাহিড়ী। আমি তোদের হাতে পুস্তিকা পৌঁছে দিচ্ছি।’
অন্য দুজন ছেলে আর একটি মেয়েও নিজের পরিচয় দিচ্ছে। অভি তাদের কথা শুনছে না। সে বিলুর দিকে তাকিয়ে। দাদা যখন তার হাতে পুস্তিকা ধরাল, অভি ফিসফিস করে বলল, ‘বাড়ি গিয়েই মাকে বলছি। তুই পলিটিকস করিস।’
বিলু পাল্টা জবাব দিল, ‘মাকে বললে একটা ক্যালানিও মাটিতে পড়বে না।’ তারপর হাসিহাসি মুখে পুস্তিকা বিলি করতে লাগল।
.
বৃন্দা
‘কী রে, সব ঠিক আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এইচওডি-দের ইনট্রো শেষ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মনোসিলেবলে কথা বলছিস কেন? আশে পাশে কেউ আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘সিনিয়র?’
‘হ্যাঁ।’
‘ক্যান্টিনে রয়েছিস? র্যা গিং পর্ব চলছে?’
‘আমি পরে কথা বলব।’ কুট করে ফোন কেটে মোবাইল ব্যাগে ঢোকায় বৃন্দা। সে এসএলটি থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে চলেছে। সঙ্গে একগাদা ব্যাচমেট। এখন বাবার সঙ্গে গপপো করা সম্ভব? বাবাটা এত কনট্রোল ফ্রিক না!
আজ সকালবেলা তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বৃন্দার। অন্যদিন সে সকাল সাড়ে সাতটার আগে বিছানা ছাড়ে না। প্লাস টু বা জয়েন্টের প্রিপারেশনের সময় যখন দিনে ষোল থেকে আঠারো পড়াশুনা করতে হতো, তখনও সকাল সাড়ে সাতটার আগে বিছানা ছাড়ত না। রাত জাগতে অসুবিধে না হলেও, ভোরে উঠতে বৃন্দার তীব্র অনীহা। বৃন্দা কখনও সূর্যোদয় দেখেনি। দেখেনি খবরের কাগজওয়ালাকে।
আজ সকালবেলা সূর্যোদয় না দেখলেও কাগজওয়ালাকে দেখতে পেয়েছে বৃন্দা। কেন না আজ ভোর ছটায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা এসির রিমোট হাতড়ে এসি বন্ধ করেছিল। চাদরে মাথা মুড়ি দিয়ে, জোর করে চোখ বুঁজে আরও কিছুক্ষণ ঘুমোনোর চেষ্টা করেছিল।
ঘুম আসেনি। সাইড টেবিলে রাখা ডিজিটাল ক্লকের টকটক শব্দে বোর হয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই ‘ধুত্তেরিকা’ বলে বিছানায় উঠে বসেছিল। বড়সড়ো আড়মোড়া ভেঙে নিজের ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়েছিল।
সমীরণ-মন্দিরার মাস্টার বেডরুমের লাগোয়া বৃন্দার ঘর। কুড়ি বাই কুড়ি ঘরটাকে বৃন্দা মনের মতো সাজিয়েছে। তিনদিকের দেওয়ালের রং বেবি পিঙ্ক। একদিকের দেওয়াল টমেটোর মতো লাল। টমেটো-লাল দেওয়ালের বিশাল জানলার গায়ে তার খাট। দুদিকে পড়ার টেবিল আর বুককেস। মাল্টিফাংশনাল ফারনিচারের রং, দেওয়ালের সঙ্গে মিলিয়ে, গোলাপি। কাঠের নয়। অদ্ভুত কোনও মেটিরিয়ালে তৈরি। সামান্য স্পর্শেই বুককেসের ঢাকনা ওপরে উঠে যায়, বক্স খাটের নীচের বাক্স বাইরে বেরিয়ে আসে, পোশাকের আলমারির দরজা খুলে যায়।
বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ের চাদর পাট করে খাটের তলার বাক্সয় ঢোকায় বৃন্দা। নানা রঙের প্যাচওয়ার্ক করা বেডকভার বার করে। বেডশিট টানটান করে, ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে, তার ওপরে বেডকভার পেতে দেয়। বাক্স থেকে বার করে নানা শেপ ও সাইজের একগাদা কুশন। কোনওটা বর্গক্ষেত্র, কোনওটা গোল, কোনওটা হার্ট শেপের। লাল, সাদা ও গোলাপির কম্বিনেশন। খাটের প্রান্তে, দেওয়ালের গায়ে কুশনগুলো সাজিয়ে দূর থেকে একবার দেখে নেয়। ধুস! পছন্দ হচ্ছে না। কাছে এসে কুশনগুলো অন্যভাবে সাজায়। এবারও কি ঠিক হল? কে জানে!
নিজের ওপরে বিরক্ত হয় বৃন্দা। এই হল মুশকিল। কোনটা যে তার ভালো লাগে, আর কোনটা লাগে না, আজও জানা হয়ে উঠল না। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত বাবা নিয়েছেন। কোন স্কুল? মডার্ন হাই। কোন স্ট্রিম? সায়েন্স। জয়েন্ট এনট্রাস কীসে বেশি গুরুত্ব? বায়োলজি। ইঞ্জিনিয়ারিং আর ডাক্তারি দুটোতেই চান্স পাওয়া সত্ত্বেও কোনটা পড়তে হবে? ডাক্তারি। স্যামি বলে দিয়েছেন আর বৃন্দা মেনে নিয়েছে। মেনে নিতে তার কি কোনও অসুবিধে হয়েছে? না। অন্তর থেকে কোনও প্রতিবাদ এসেছে? না। সে জানে, সমীরণ যা করছেন, ভালোর জন্যই করছেন। ফালতু মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?
কিন্তু জীবনের ছোট ছোট জিনিসগুলোতে ডিসিশন নিতে প্রবলেম হলে তো আর স্যামিকে ডাকা যায় না! আজ সে কলেজে স্যামির সঙ্গে গাড়িতে যাবে না বাসে করে যাবে—এইটা একটা প্রবলেম। কুশনগুলো ঠিকমতো সাজানো হল না, এটা আর একটা প্রবলেম। এসি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে গরম লাগতে শুরু করেছে—এটা তিন নম্বর প্রবলেম।
হাই তুলতে তুলতে বৃন্দা বুঝতে পারল, প্রথম সমস্যার সমাধান স্যামি করবেন। দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান করবে ঝুনুর মা। বৃন্দা কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে, প্যাচওয়ার্কের বেডকভার তুলে, বিছানা ঝেড়ে, সারা ঘর ডাস্টিং করে, রুম ফ্রেশনার ছড়িয়ে, এখানে ওখানে পড়ে থাকা বই, আইপড, টেডি বিয়ার, টি-শার্ট, ডায়েট কোকের ক্যান সরিয়ে ঘর সাফ করে দেবে শান্তিধামের উওম্যান ফ্রাইডে। ঝুনুর মা।
তিন নম্বর সমস্যার সমাধান করতে কাচের দরজা সরিয়ে বারান্দায় পা রাখে বৃন্দা। শান্তিধাম এস আর দাস রোডের এপারে। ওপারে রবীন্দ্র সরোবর। চলতি কথায় লেক। সকাল ছ’টার সময় দিব্যি রোদ উঠে গেছে। লেকের বাউন্ডারি বরাবর পোঁতা বট, অশ্বত্থ, জারুল, ছাতিম, কদম গাছের সতেজ সবুজ পাতা রোদ খেয়ে ঝিলমিল করছে। এস পি মুখার্জি রোড দিয়ে গুড়গুড় করে যাচ্ছে ট্রাম। স্টেশনে নেমে রাস্তা আর গলি বরাবর ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেয়ে-বউয়ের দঙ্গল। শহরের বাবুদের বাড়ির কাজের লোক। চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব দেখতে দেখতে হকারকে দেখতে গেল বৃন্দা। সাইকেলের কেরিয়ারে রাখা কাগজের বান্ডিল থেকে একতাড়া কাগজ আর গোটা পাঁচেক ম্যাগাজিন সুলতানের হাতে তুলে দিল ছেলেটা। সাইকেল চালিয়ে মুদিয়ালির ভেতরে ঢুকে গেল।
শান্তিধামে অনেক কাগজ আসে। নার্সিংহোমের প্রতি কেবিনে কাগজ দেওয়া হয়। সিস্টার, আরএমও, অন্যান্য স্টাফেদের জন্যও কাগজ আসে। বিলি বন্দোবস্ত হওয়ার পরে চারতলায় পৌঁছয় দুটো ইংরিজি কাগজ, তিনটি বাংলা কাগজ এবং অজস্র পত্রিকা। স্যামি ইংরিজি কাগজের ফ্রন্ট পেজ আর খেলার পাতায় চোখ বোলান। পাঁচটা কাগজ সারা দিন ধরে শেষ করেন মন্দিরা। এছাড়াও বাংলা ভাষায় যত রকমের পত্রিকা বেরোয় তা মন্দিরার হাতে চলে আসে। অবসরপ্রাপ্ত নায়িকা চূড়ান্ত গ্রন্থপ্রেমিক।
বৃন্দা দুটো ইংরিজি কাগজ আর একটা বাংলা কাগজ পড়ে। এটাও স্যামির নির্দেশ। ‘ইংরিজি কাগজের ট্যাবলয়েড সেকশন পড়া লো আই কিউ ইউথ’ স্যামির পছন্দ নয়। সুতরাং বৃন্দা আগাপাশতলা কাগজ পড়ে। একাধিক কাগজ পড়ে বলে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা আছে।
হকার ছেলেটির বয়স বৃন্দার আশেপাশে। জিনস আর সলিড চেকসের শার্ট পরা। পায়ে কাবলি জুতো। চারতলা থেকে উচ্চতা বোঝা যায় না। তবে সাইকেলের ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ কাগজ রাখা ছিল, তার যা হাইট, ছেলেটার হাইট তার সমান। অ্যারাউন্ড পাঁচ আট হবে। এই ছেলেটাকে এতদিন বৃন্দা কেন দেখেনি কে জানে?
বারান্দায় বেতের তৈরি একটা দোলনা আছে। আরাম করে বসার জন্য কুশন পাতা। সেখানে বসে আপনমনে কয়েকবার ঘুরপাক খেল বৃন্দা। আজ মনটা উড়ুউড়ু লাগছে। মনে হচ্ছে, আজ একটা কিছু হবে। একটানা ঘুরপাক খেতে থাকে সে।
ঝুনুর মা চা নিয়ে এসেছে। রঙিন পাথর বসানো কাঠের ট্রেতে বড় এক চা আর একটা কুকি। আর্চিজের স্টল থেকে কাপটা নিজে পছন্দ করে কিনেছিল বৃন্দা। হালকা গোলাপি রঙের কাপে গাঢ় লাল দিয়ে স্মাইলি আঁকা। দোলনার পাশের টেবিলে ট্রে রেখে ঝুনুর মা বলল, ‘অনেকক্ষণ উঠেছ নাকি? অন্যদিন তো ঘুম থেকে তোলার জন্য দশবার ডাকতে হয়।’
‘কুকি নিয়ে যাও। এখনও মুখ ধুইনি।’ ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলে বলল বৃন্দা, ‘হ্যাঁ, আজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। তখন হকার আমাদের কাগজ দিচ্ছিল।’
‘হকার?’ মুখে আঁচল গুঁজে একচোট হেসে নেয়ে নেয় ঝুনুর মা। ‘ওটা তো আমার ছেলে। ঝুনু!’
‘তাই?’ অবাক হতে গিয়ে নিজেও হেসে ফেলে বৃন্দা। ঝুনুর মা তাদের বাড়িতে থাকে। দু’সপ্তাহে একদিন বাড়ি যায়। সাউথ লাইনে গোচারণ নামের একটা স্টেশনে তার বাড়ি। ঝুনুর মায়ের যে নিজস্ব কোনও নাম থাকতে পারে, এটা কখনও মনে হয়নি। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলে, ‘ঝুনুর মা, তোমার আসল নাম কী?’
‘মাধবী!’লজ্জায় বেগুনি হয়ে কুকি সমেত ট্রে নিয়ে বারান্দা থেকে পালাল ঝুনুর মা।
আজ সকালে নানান নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে তো! ফিকফিক করে হাসে বৃন্দা। তাদের বাড়িতে যে কাগজ দেয় তার নাম ঝুনু। তাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার নাম মাধবী। এবং মাধবীই ঝুনুর মা। এতগুলো তথ্য সে জানত না। আশ্চর্য!
চা খেতে খেতে মাধবী নামটা নিয়ে সামান্য ভাবে বৃন্দা। মাধবীর সূত্র ধরে এসে গেল চারুলতা। মন্দিরা এই সিনেমাটা সুযোগ পেলেই ডিভিডিতে দেখেন। ছবিটার ইংরিজি নাম ‘দ্য লোনলি ওয়াইফ’। এই নামটা মন্দিরাকে দিব্যি মানায়। টালিগঞ্জ কাঁপানো অভিনেত্রী এখন লোনলি ওয়াইফ ছাড়া আর কী?
মায়ের যখন একটা নাম হল, তখন বাবারও একটা নাম দেওয়া জরুরি। এটা নিয়ে বিশেষ ভাবতে হল না। মনে মনে বৃন্দা বাবাকে ‘কনট্রোল ফ্রিক’ বলে ডাকে। যেমন ঝুনুর মাকে ‘উওম্যান ফ্রাইডে’ নামে ডাকে। ঝুনুর কোনও নাম দেওয়া যায় কি? অনেক ভেবেচিন্তে বৃন্দা ঝুনুর একটা বাংলা নাম রাখল। ‘সুপ্রভাত’। সকালে যে খবরের কাগজ সাপ্লাই করে ঘুম ভাঙায়, তার পক্ষে উপযুক্ত নাম।
বৃন্দার নামকরণ প্রকল্প থামিয়ে দিয়ে বারান্দায় এলেন মন্দিরা। বলল, ‘কাল রাতে তুই জিজ্ঞাসা করেছিলি কখন বেরোবি। তোর বাবা রাউন্ডে যাওয়ার আগে বলে গেছে রেডি হয়ে থাকতে। ও আজ সওয়া নটার সময় বেরোবে।’
খালি চায়ের কাপ মন্দিরাকে ধরিয়ে বৃন্দা বলে, ‘এখন সাতটাই বাজেনি।’
‘না বাজুক। তুই স্নান সেরে ফেল। প্রথম দিন কী পরে কলেজে যাবি? কিছু ভেবেছিস?’
‘কী পরব?’ গালে হাত দিয়ে ভাবে বৃন্দা। ‘রোজই তো জিনস আর টপ পরি। আজ অন্য কিছু পরতে যাব কেন?’
‘তোর বাবা বলছিল সালওয়ার কামিজ পরতে। খুব গডি কিছু না। সোবার টাইপের।’
‘বাবা যখন বলে দিয়েছে, তখন কী পরব এটা জিজ্ঞাসা করার কী দরকার ছিল?’ মৃদু প্রতিবাদ করে নিজের ঘরে ফিরে আসে বৃন্দা।
তিনটে কাগজ পড়ে, ল্যাদ খেয়ে, আর এককাপ চা খেয়ে বাথরুম ঢুকল বৃন্দা। তার বাথরুম বেশ বড়। বাথটাব আছে, তবে সেটা বছরে এক-দুবারের বেশি ব্যবহার করে না। বড্ড জল নষ্ট হয়। মুখ ধোওয়া থেকে শুরু করে স্নানপর্ব চুকোতে সময় লাগল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। চুল শুকোতে মিনিট পনেরো লাগবে। ততক্ষণে খেয়ে নেওয়া যাক। সালওয়ার কামিজ গলিয়ে, মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে খাবার টেবিলে বসে বৃন্দা। স্যামি আর মন্দিরা চা খাচ্ছেন।
স্যামি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। সপ্তাহে পাঁচদিন রোয়িং করতে যান। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছ’টা বাজে। স্নান ও ভারি প্রাতঃরাশ সেরে সাতটা থেকে শান্তিধামে ভরতি থাকা রোগীদের দেখাশোনা। সার্জিকাল পেশেন্টদের নানা সমস্যা থাকে। ড্রেসিং চেঞ্জ করা, ইনফেকশান থাকলে আবার কাটাছেঁড়া করে নতুন সেলাই দেওয়া, বিকেলবেলা অপারেশান থাকলে প্রি-অপারেটিভ চেক আপের বন্দোবস্ত করা, অ্যানাসথেটিসটের সঙ্গে যোগাযোগ—এইসব চুকিয়ে ওপরে আসতে সাড়ে আটটা বেজে যায়। এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে যান স্যামি।
আজ রুটিন ঢিলেঢালা। রাউন্ডের দায়িত্ব কুনাল আর তাপসীর ওপরে ছেড়ে দিয়ে স্যামি খাবার টেবিলে বসে রয়েছেন। এখনও স্নান করেননি। দাড়িও কামাননি। গতরাতে মদ্যপান বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে চোখ দুটো লাল টকটক করছে। চোখের নীচে কোহল-পাউচ। দেখে বিরক্ত হল বৃন্দা। স্যামিকে এইরকম হ্যাগার্ড চেহারায় দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। মনে মনে স্যামির তিন শিল্পী বন্ধু, সুদিন-বিপিন-মনোতোষের নাম দিল ‘থ্রি উইচেস’। ম্যাকবেথের তিন ডাইনির অনুকরণে। ওঁদের জন্যই স্যামি রোজ রাতে মদ খান। ডাইনিদের শান্তিধামে ঢোকা বন্ধ করতে হবে। বিরক্ত হয়ে বৃন্দা স্যামিকে বলল, ‘চা পরে খাবে। আগে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
স্যামি এইরকম একটা হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আধখাওয়া চা ফেলে বাথরুমে সেঁধোলেন। ঝুনুর মা টেবিলে রেখেছে বৃন্দার ব্রেকফাস্ট। সেদ্ধ সবজি, দুটো স্যাঁকা পাউরুটি আর ডিমসেদ্ধ। খেতে খেতে বৃন্দা মন্দিরার দিকে তাকাল। মন্দিরা মন দিয়ে পূজাবার্ষিকী পড়ছেন। তাঁকে না ঘাঁটিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করল। দেওয়াল ঘড়িতে নটা। এবার বেরোনো উচিত।
নিজের ঘরে ঢোকে বৃন্দা। চুল আঁচড়ে, সামান্য গন্ধ মেখে যখন বেরোয়, ঘড়িতে সওয়া ন’টা। স্যামি হাসপাতাল যাওয়ার জন্য রেডি। সদ্যস্নাত, সদ্য শেভ করা স্যামি আবার আগের চেহারায়। ঝকঝকে, তকতকে, স্মার্ট, ব্যক্তিত্ববান। তাঁকে দেখে থামস আপ করে বৃন্দা।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল স্যামি বৃন্দাকে মৌলালির মোড়ে নামিয়ে দেবেন। শান্তিধাম থেকে বেরোনোর সময় মেয়ের মস্তক-চুম্বন করে মন্দিরা বললেন, ‘প্রথম দিন। ওকে কলেজে ঢুকিয়ে দিও। মেয়েটা কোনও দিন রাস্তাঘাটে একা চলাফেরা করেনি।’
নিজের ক্যাবলামির কথা ভেবে লজ্জা হয়েছিল বৃন্দার। এস আর দাস রোড আর মডার্ন হাই স্কুল গাড়িতে যাতায়াত করা আর মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখা ছাড়া সে কলকাতা শহরের রাস্তায় কখনও একা বেরোয়নি। কী লজ্জার ব্যাপার!
স্যামি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের গেটের ভিতরে গাড়ি ঢুকিয়ে মেয়েকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। ঢোকার মুখেই সেন্টিনারি বিল্ডিং। ছ’তলা বাড়ি জুড়ে গাইনিকলজি আর অবস্টেট্রিক্স ডিপার্টমেন্ট। গর্ভবতী মায়েদের জন্য অপেক্ষারত বাড়ির লোকের ভিড়ে গেটটা মেছোবাজার হয়ে আছে। বৃন্দা গাড়ি থেকে নামার আগে স্যামি বলেছিলেন, ‘খানিকটা হেঁটে গেলেই এলএলটি। একা যেতে পারবি তো?’
ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল। তাও বৃন্দা বলেছিল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি কোরো না তো! আমার এখন আঠারো বছর বয়স। আমি এখন অ্যাডাল্ট।’
.
এখন, অন্য ব্যাচমেটদের সঙ্গে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বৃন্দার মনে হল, সিনিয়রদের হুকুমে ক্যান্টিনে তো যাচ্ছে! ওখানে র্যাগিং-এর নামে টর্চার হবে না তো? সমীরণের মুখে শুনেছে, মেডিক্যাল কলেজে র্যাগিং হয় না। সিনিয়ররা জুনিয়রদের সামান্য লেগপুল করে। যার অফিসিয়াল নাম ইন্ট্রো । সে তো যে কোনও জায়গাতেই নতুনদের নিয়ে মজা করা হয়। কলেজ বা অফিস আলাদা কিছু না। এখানেও সেইরকম কিছু হবে? না হিন্দি সিনেমায় বা বাংলা সিরিয়ালে যেমন দেখায়, সেইরকম আজেবাজে কাজ করতে বলবে? ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ সিনেমার র্যাগিং সিকোয়েন্সটা মনে পড়ে গেল বৃন্দার। জাঙিয়া পরা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেগুলো ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ গানের সঙ্গে নাচছিল। একটা মোটকা ছেলের ভুঁড়ি নাচানো দেখে খুব হেসেছিল বৃন্দা। আজ গিলটি ফিলিং হচ্ছে। এটাও মনে হচ্ছে, সিনেমায় ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেগুলোকে বাঁচাতে মামু ওরফে মুন্নাভাই এনট্রি নিয়েছিল। এখানে কোনও সঞ্জয় দত্ত নেই।
ক্যান্টিনের দরজায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে রিপুদমন কর। আঙুলের ইশারায় পুরো দলটাকে ডাকল। সঙ্গে কে কে এল খেয়াল না করে বৃন্দা রিপুর সামনে দাঁড়াল। রিপু বলল, ‘ভেতরে গিয়ে বোস।’
বৃন্দা ক্যান্টিনে ঢুকল। হিন্দি সিনেমায় যেমন ঝাঁ চকচকে, রঙিন, আর্চির কমিক স্ট্রিপ মার্কা ক্যান্টিন দেখা যায়, তার সঙ্গে এই ক্যান্টিনের কোনও মিল নেই। পুরনো দিনের দেওয়ালে হালকা হলুদ রং করা। অল্প কয়েকটা টিউবলাইটের মিটমিটে আলোয় অন্ধকার কাটেনি। দুটো ঘর জুড়ে ক্যান্টিন। ভিতরের ঘরের দেওয়াল চৌকো করে কেটে কাউন্টার বানানো হয়েছে। সেই কাউন্টার থেকে খাবার সাপ্লাই হচ্ছে। কাউন্টারের ওপারের রান্নাঘরটি কুচকুচে অন্ধকার। সেখানে কী সাপব্যাং রান্না হচ্ছে কে জানে! কাউন্টারের পাশে, ঢকঢকে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে রয়েছে মাঝবয়সি এক বুড়ো। প্যান্টশার্ট পরা বুড়ো বৃন্দাকে দেখে বলল, ‘ফার্স্ট ইয়ার? আমার নাম জীবনদা। এই ক্যান্টিনের নাম জীবনদার ক্যান্টিন। কী খাবে বলো।’
ক্যান্টিনের দেওয়ালে কালো স্লেটপাথর বসানো। তাতে চক দিয়ে আজকের মেনু লেখা। চাউমিন, ফ্রায়েড রাইস, পিজা—তিনরকম খাবারের ছটা করে ভ্যারিয়েশন। ভেজ, এগ, চিকেন, মাটন, এগ-চিকেন এবং এগ-মাটন। এছাড়া ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, পোনা মাছের কালিয়া আর চিলি চিকেন রয়েছে। চা, কফি, কোল্ড ড্রিংক্স, মিনারেল ওয়াটারের কথা বোর্ডে লেখা না থাকলেও সেগুলো দৃশ্যমান। এবং অবশ্যই সিগারেট। বসার জায়গা বলতে সানমাইকা লাগানো চেয়ার এবং বড় বড় টেবিল। দেখেশুনে বৃন্দার ভক্তি হল না। সে জীবনদাকে বলল, ‘এখন খাব না।’
জীবনদা অন্য লোকের অর্ডার নেওয়ায় ব্যস্ত। কথা কানে গেল না। বৃন্দা টুকটুক করে বাইরের ঘরটায় এল। এখানে কাউকে একটা খোরাক করা হচ্ছে। সিনিয়র দাদাদিদিরা বড় টেবিল জুড়ে গোল হয়ে বসে বেঁটে, কালো এক ফার্স্ট ইয়ারকে ব্যাপক রগড়াচ্ছে। একে চেনে বৃন্দা। একটু আগেই আলাপ হয়েছে। ‘বোমা বস’ ওরফে চন্দন।
আপ্পু চা খেতে খেতে হাঁক পাড়ল, ‘এই বৃন্দা, শোন এদিকে।’
বৃন্দা টেবিলের পাশে দাঁড়াল। রিপু চন্দনকে বলল, ‘একটা নন ভেজ জোক বল। মাইন্ড ইট, কোনও নোংরা কথা যেন না থাকে। তাহলে ক্যাল খাবি।’
চন্দন বলে, ‘একটা হোমো মরার পরে নরকে গেছে।’
‘অ্যাই! হোমো বললি কেন?’ চোখ পাকায় আপ্পু।
‘তাহলে সমকামী বলি?’ নিরীহ মুখে প্রশ্ন করে চন্দন।
‘ঠিক হ্যায়। আগে বাড়।’ রিপু ধমক দেয়।
‘হোমোকে দেখে যমরাজ বলল, ”পৃথিবীতে তোমার কিত্তিকলাপ তো সাংঘাতিক হে। চিত্রগুপ্ত, একে টগবগে গরম তেলে ভাজো।” চিত্রগুপ্ত বলল, ”আচ্ছা যমরাজ।” যমরাজ অন্য পাতকিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারঘণ্টা পরে, সব কাজ চুকিয়ে চিত্রগুপ্তর কাছে এসে যমরাজ দেখে, সে এখনও উনুনই ধরায়নি। যমরাজ খচে ফায়ার হয়ে বলল, ”কী ব্যাপার চিতু? এখনও তেল গরম হল না? হোমোটাকে ভাজবে কখন?” চিত্রগুপ্ত কাপড়চোপড় ঠিক করতে করতে বলল, ”তেল গরম করা অনেক দূরের ব্যাপার যমরাজ। হোমোটার জন্য আমি সামনে ঝুঁকে উনুনে কাঠ গুঁজতে পর্যন্ত পারছি না”।’
সিনিয়াররা হোহো করে হাসছে। বৃন্দাও একপ্রস্ত হেসে নিল। আপ্পু বলল, ‘বৃন্দা, এদিকে আয়।’ বৃন্দা আপ্পুর পাশে দাঁড়াল। এই টেবিলের চারদিকে কোনও বসার জায়গা নেই। সব বেঞ্চি এবং চেয়ার ভরতি।
‘বোস।’ বলল আপ্পু।
‘কোথায় বসব?’ সন্তর্পণে প্রশ্ন করে বৃন্দা।
‘কোথায় বসবি? ঠিক কথা…’ চিবুকে আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে আপ্পু। বলে, ‘তুই বরং তোর প্রেমিকের কোলে বোস।’
কথাটা শুনে বৃন্দার কান গরম হয়ে গেল। এ আবার কী ধরনের নোংরামি? তবে এখন রাগ করলে বিপদ। ঠান্ডা মাথায় ডিল করতে হবে। নিরীহ গলায় সে বলল, ‘আমাদের নতুন প্রেম। প্রথমেই কোলে বসব না। বরং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে বসি।’
‘এখানে ভিক্টোরিয়া পাব কোথায়?’ চোখ পাকায় আপ্পু।
‘তুমি আমার জন্যে একটা প্রেমিক বানিয়ে দাও, আমি তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বানিয়ে দেব।’ মুচকি হেসে বলে বৃন্দা।
‘আচ্ছা?’ আবার চিবুকে আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে আপ্পু। সাদা সালোয়ার কামিজ পরা বিশাল বপু দুলিয়ে বলে, ‘এই চন্দন ছেলেটা তোর প্রেমিক। নে, আমি তোর প্রেমিক বানিয়ে দিলাম। এবার তোর ডিউটি।’
বৃন্দা চন্দনের কাছে গিয়ে বলল, ‘চন্দন, প্রাণাধিকেষু, চলো আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় বসে লুডো খেলি।’
চন্দন আঁতকে উঠে বলল, ‘লুডো? সে তো বুলাদি খেলে।’ তার মুখের ভঙ্গি দেখে টেবিলের চারিদিকে বসে থাকা সিনিয়ররা হাসিতে ফেটে পড়ল।
‘তা হলে চলো, আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় বসে সাপসিঁড়ি খেলি।’ চন্দনকে হ্যাঁচকা টানে বেঞ্চি থেকে তোলে বৃন্দা। হাত ধরে টানতে টানতে আপ্পুর পাশে নিয়ে আসে। আর এক হ্যাঁচকায় চন্দনকে মেঝেতে বসিয়ে, নিজেও আপ্পুর পায়ের কাছে বসে পড়ে।
‘কী হল?’ আঁতকে উঠে বেঞ্চিতে পা তুলে বসে আপ্পু। ‘পাগল হয়ে গেলি নাকি?’
‘আসলে…’ মিনমিন করে বৃন্দা বলে, ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম যে ”তুমি আমার জন্যে একটা প্রেমিক বানিয়ে দাও, আমি তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে দেব।” তুমি তোমার কথা রাখলে, তাই আমিও আমার কথা রাখলাম। তোমাকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানিয়ে দিলাম। সাদা, বড়, গোল… তোমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল আছে।’
আপ্পু হোহো করে হাসতে হাসতে বেঞ্চি থেকে পা নামাল। টেবিলের চারদিকে বসে থাকা সিনিয়ররা চটরপটর হাততালি দিচ্ছে। চন্দন বলল, ‘প্রাণাধিকেষু বৃন্দা, আমি এবার ভিক্টোরিয়ার দোতলায় উঠতে চাই।’
‘ওরেববাস! এ ছোকরা মহা বদ তো!’ আপ্পু বেঞ্চির ওপরে পা তুলে নিয়েছে।
মেঝে থেকে উঠে সালোয়ার কামিজের পিছন দিকটা ঝেড়ে নেয় বৃন্দা। র্যাগিং অথবা ইন্ট্রো পর্ব শেষ!
.
চন্দন
‘দেখে নাও বস! এই হল আমাদের বয়েজ হোস্টেল! আগামী চার বছর তোমাকে এখানেই রগড়াতে হবে।’ চন্দনকে বলল বিলু।
চন্দন ঘাড় তুলে পাঁচতলা বিল্ডিংটার দিকে তাকাল। তারপর কোলাপসিবল গেট টপকে ভেতরে ঢুকল।
‘আদতে বাড়িটা ছিল ইউ শেপের। ইউ এর মাথাটা ফাঁকা। পরে স্টুডেন্ট বাড়ল। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ ইউএর মাথায় মাত্রা টেনে এটাকে বর্গক্ষেত্র বানিয়ে দিয়েছে। মাত্রাওয়ালা উইংটার নাম অ্যানেক্স।’ চন্দনকে বোঝায় বিলু। ‘ওটাই নর্থ উইং। আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকলাম সেটা সাউথ উইং। আমাদের বাঁদিকে ওয়েস্ট আর ডানদিকে ইস্ট উইং। চল, হোস্টেলের অফিসে চল। কশান মানি জমা দিতে হবে।’
গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোর ধরে বাঁদিকে এগোয় বিলু। সুটকেস হাতে চন্দন তার পিছন পিছন। তার মনে পড়ে যাচ্ছে ক্যান্টিনে সিনিয়রদের কাছে মুরগি হওয়ার কথা…
.
মুড়ির টিন আর সুটকেস ক্যান্টিনে রেখে ক্লাসে গিয়েছিল চন্দন। ক্লাসের শেষে ক্যান্টিনে ফিরে দেখল মুড়ির টিন বেদখল হয়ে গিয়েছে। জীবনদার থেকে পেঁয়াজ আর সরষের তেল জোগাড় করে, কোথা থেকে খোলায় ভাজা গরম বাদাম এনে মস্ত বড় একটা স্টিলের গামলায় মুড়ি মেখে তাই দিয়ে লাঞ্চ সারল সিনিয়ররা।
উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হওয়া গ্রামের ছেলের হাতে মুড়ির টিন—সবাই মিলে বেদম খোরাক করছিল। তখনই বৃন্দা এসে তাকে বাঁচিয়ে দিল। মেয়েটা নির্ঘাৎ কলকাতায় থাকে। তা না হলে ওরকম মোমের মতো ফরসা হয় না। আর কী স্মার্ট! ফট করে হাত ধরে টান মারল। তখনই চন্দনের প্যান্টের ভিতরে ফড়ফড়ানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস আজ জাঙিয়া পরা ছিল। এখানে আর নতুনগ্রামের মতো পপলিনের আন্ডার উইয়্যার পরে থাকা যাবে না।
কখনও কোনও মেয়ে তার গায়ে হাত দেয়নি। পরীক্ষার আগে মানসিক উত্তেজনা কমাতে বাথরুমে গিয়ে খারাপ কাজ করে নিত চন্দন। তখন চোখের সামনে ভেসে উঠত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কিংবা ক্যাটরিনা কাইফের মুখ। মমতাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েগুলোকে দেখে কখনও পছন্দ হয়নি চন্দনের। সবুজপেড়ে সাদা শাড়ি পরা পুঁটলি এক একটা। কিন্তু বৃন্দা? পুরো সোনাক্ষী সিনহা। মেয়েটার কথা ভাবতেই আবার শরীর শক্ত হয়ে গেল চন্দনের।
র্যাগিংপর্ব মেটার পরে বৃন্দা আপ্পুর সঙ্গে লেডিজ হোস্টেলের দিকে চলে গিয়েছিল। চন্দনকে পাকড়াও করেছিল রিপু। চন্দনের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক ভাট বকার পরেই বুঝে গেছে এ মাল তাদের দলের ছেলে। এর পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তার বদলে অন্য ফ্রেশারকে পাকড়ানো যাক। জীবনদার কাছ থেকে সুটকেস নিয়ে চন্দনের হাতে গছিয়ে বলেছিল, ‘ফোট রে! ছেড়ে দিলাম। রাতে হোস্টেলে দেখা হবে।’
সুটকেস নিয়ে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে টুকটুক করে বয়েজ হোস্টেলের দিকে আসছিল চন্দন, এমন সময় বিলু তাকে পাকড়াও করেছে। সব্যসাচীর ভাষণের সময় এই দাদাটার মুখ চিনে রেখেছিল চন্দন। র্যাগিং হলে হেল্প করবে এই আশ্বাসবাণী শুনে ওদের দেওয়া লিফলেট থেকে নিজের মোবাইলে যে চারটে নম্বর সেভ করেছে, তার মধ্যে বিলুর একটা।
ভোরবেলায় বাসে আর ট্রেনে মোবাইলটা ভালো করে দেখার ফুরসত পায়নি চন্দন। পরে দেখেছে। চায়নার মোবাইল। রংচঙে স্ক্রিন, লাউড স্পিকারের মতো আওয়াজ। এফএম রেডিয়ো, ব্লু টুথ, ক্যামেরা, টর্চ, অডিও এবং ভিডিও প্লেয়ার—কী নেই? চন্দন প্রথমে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা রিংটোন হিসেবে সেট করেছিল। এই গানটা বাজারে খুব চলছে। পরে মনে হল, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তাই ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটা রেখেছে। নরম, রোমান্টিক, মিষ্টি গান। কেউ বিরক্ত হবে না।
.
হোস্টেলের অফিসে একজন কর্মচারী বসে থাকলেও রুম অ্যালটের দায়িত্বে আছে মোর্চার সমর্থকরা। অর্থাৎ রিপুর চেলারা। বিলু অন্য দল হওয়া সত্ত্বেও এদের সঙ্গে যোগাযোগ ভালো। অফিসে ঢুকে এক ছাত্রকে বলল, ‘এই লাটু, একে একটা রুম অ্যালট কর। রিপুদা পাঠাল।’
কর্মচারী ভদ্রলোক অ্যাড্রেস প্রূফের ফোটোকপি নিলেন, পাসপোর্ট সাইজের দুটো ছবি নিলেন, কশান মানি জমা নিলেন, ছ’মাসের হোস্টেল ভাড়া অ্যাডভান্স নিলেন। ভাড়া হাস্যকর রকমের কম। ছ’মাসের জন্য দুশো টাকা। কশান মানি পাঁচশো টাকা। সাতশো টাকার রসিদ নিয়ে লাটুর সামনে দাঁড়াল চন্দন। তার দিকে তাকিয়ে লাটু বলল, ‘নতুনগ্রামের মাল? বাবা কোন পার্টি করে?’
লাটুকে মাপল চন্দন। সারাদিনের অভিজ্ঞতায় সে একটা জিনিস বুঝেছে। শহর আর গ্রামের লোকেদের মধ্যে কোনও তফাত নেই। দু’দল দু’রকমের বদমায়েশ। ডিল করার টেকনিকটা তাই আলাদা। গম্ভীর মুখে চন্দন বলল, ‘আমার বাবা পঞ্চায়েত প্রধান।’
‘গুড! তোকে একশো পঁচিশ নম্বর রুমে অ্যালট করলাম। আমার ঘরে। চার তলার একদম লাস্ট ঘর। ইস্ট উইং। ঘর থেকে বেলেঘাটা মেন রোড দেখতে পাবি। যা।’
থতমতো খেয়ে চন্দন বলল, ‘চাবি?’
পাশ থেকে বিলু বলল, ‘আমার সঙ্গে চল। তোকে পৌঁছে দেব।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিলু বলল, ‘তুই বাঘের ঘরে ঢুকলি।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল চন্দন।
‘ওটা ”হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি”-র অফিস ঘর। ”হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি” বল বা ”স্টুডেন্টস ইউনিয়ন” বল, সব এখন মোচা পার্টির দখলে। ওরা ইচ্ছেমতো রুম অ্যালট করে, রুম থেকে ছেলেপুলে ভাগিয়ে দেয়, মারধোর করে।’
‘মারধোর করে?’
‘হ্যাঁ। অ্যানেক্স ব্লকে ছেঁদোরা ব্লু ফিল্ম দেখছিল…’
‘ছেঁদো আবার কী? মোচা তো জানি…’
চন্দনের কথা শুনে মুচকি হাসে বিলুদা। ‘জাতীয়তাবাদী পার্টির স্টুডেন্ট উইঙের নাম ”ছাত্রদল”। ওটাকেইআদর করে ‘ছেঁদো পার্টি’ বলা হয়।’
‘এটা নতুন শিখলাম। তারপর?’
‘একদিন দশ-বারোজন ”ছেঁদো” মিলে একসঙ্গে রুমে বসে ব্লু ফিল্ম দেখছিল। তখন রিপু আর লাটু গিয়ে বেধড়ক ঠেঙিয়েছিল’।
বিলুর কথা শুনে চন্দন চুপ করে রইল। তিনতলায় পৌঁছে বিলুদা বলল, ‘কীরে, তোর কিছু বলার নেই?’
চন্দন একটানা সিঁড়ি চড়ে হাঁফাচ্ছে। সুটকেস নামিয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘মারধোর করাটা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু একসঙ্গে বসে ব্লু ফিল্ম দেখাটা কীরকমের নোংরামো?’
‘ব্লু ফিল্ম দেখা নিয়ে তোর রিজার্ভেশান আছে নাকি?’ ত্যারছা চোখে তাকায় বিলু।
‘যতই গ্রামে থাকি না কেন, যতই উচ্চমাধ্যমিক ফার্স্ট হই না কেন, যতই চাষার ছেলে হই না কেন বিলুদা, এটা দু’হাজার দশ সাল। আমার নিজের কম্পিউটার না থাকলেও বন্ধুবান্ধবের আছে। ইন্টারনেটের কারণে ব্লু-ফিল্ম এখন জল ভাত। আমি গুরুমশাইগিরি ফলাচ্ছি না। আমার বক্তব্য, ব্লু ফিল্ম দেখে উত্তেজনা হলে ওরা কী করবে?’
‘আমরা সবাই যা করি।’
‘সেটা কোথায় করবে?’
‘ওই ঘরের কোনেই চাদর দিয়ে ঢাকা একটা কিউবিকল করা ছিল।’
‘তাহলে রিপুদা ওদের পিটিয়ে বেশ করেছে।’ বিরক্ত মুখে বলে চন্দন। বিলু চন্দনের পিঠ থাবড়ে বলে, ‘এর মধ্যে রিপুর ফ্যান হয়ে গেলি? একটু সামলে চল। একশো পঁচিশ নম্বরে তোর রুমমেট কারা হবে জানিস?’
‘কারা?’
‘খোদ রিপু আর লাটু। এই হোস্টেলের প্রতি ঘরে চারটে করে বেড আছে। একশো পঁচিশ নম্বর ঘরটা বোর্ডার্স কমিটির অফিসঘর। দিনরাত্তির মিটিং আর পোস্টার লেখা হয়। যে পারে, হুটহাট ঢুকে পড়ে। পড়াশুনার পরিবেশ নেই। পারলে কিছুদিন বাদে রুমটা চেঞ্জ করে নিস।’
চারতলার করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন দেখল লম্বা টানা বারান্দা বরাবর পরপর ঘর। ঘরের দরজার মাথায় রুম নম্বর লেখা। বেশির ভাগ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার দুপাশে দুটো জানলা। খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের চারকোণে চারটে খাট রাখা রয়েছে। প্রতি খাটের পাশে একটা করে টেবিল, চেয়ার আর কাবার্ড। কোনও কোনও ঘরে এক্সট্রা ফারনিচার বলতে আলমারি। ঘরগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছেলেরা ঘরে বসে পড়ছে, আড্ডা মারছে অথবা ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এইসব দেখতে দেখতে চন্দন বলল, ‘রুম চেঞ্জ করে কোন ঘরে যাব? প্রোগ্রেসিভ মেডিকাল ফোরামের ঘরে? যেখানে তুমি আর সব্যসাচীদা রুমমেট?’
চন্দনের মাথায় গাঁট্টা মেরে বিলু বলল, ‘খুব বেঁড়ে পাকা হয়েছিস। আমি আর সব্যসাচী একরুমে থাকি না। সব্যসাচী অ্যানেক্স ব্লকে থাকে। ওর রুমমেট নর্থ ইস্টের কয়েকটা ছেলে। আমি দোতলায় থাকি। রুম নম্বর থার্টি সেভেন। পরে কখনও ঘুরে যাস। আর এই নে, তোর রুম।’
একশো পঁচিশের দরজা হাঁ করে খোলা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখে চন্দনের কান্না পেয়ে গেল। এই ঘরে তাকে থাকতে হবে? আগামী চার বছর?
অন্য ঘরের মতোই এ ঘরের চার কোণে চারটে খাট। কিন্তু ঘরে কোনও টেবিল নেই। নেই কোনও কাবার্ড। টেবিল আর কাবার্ডের অনুপস্থিতিতে যে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি হয়েছে, সেখানে গোটাদশেক মোল্ডেড প্লাস্টিকের লালরঙা চেয়ার মিটিং করার জন্য রাখা হয়েছে। ঘরের চারটে বিছানার মধ্যে যে দুটোতে গদি এবং চাদর পাতা রয়েছে। বাকি দুটো খাটে গদি নেই। খটখটে কাঠের তক্তপোশের ওপরে ডাঁই করে রাখা রয়েছে মোটামোটা ডাক্তারির বই আর পার্টির মুখপত্র ‘জনমত’-এর দিস্তে। দেওয়ালে লেনিন, মার্কস ও স্ট্যালিনের ছবি টাঙানো। হালকা নীল রঙের দেওয়ালে লাল রঙে বড় বড় হরফে লেখা, ‘তুমি আলো আমি আধাঁরের পথ ধরে, আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।’ এক কোণে প্রচুর লাঠি রাখা রয়েছে। লাঠির মাথায় লাল ফ্ল্যাগ লটকানো।
ঘরে বসে দুটো ছেলে ল্যাপটপে কীসব করছিল। চন্দন আর বিলুকে ঢুকতে দেখে একটা ছেলে বলল, ‘কী ব্যাপার বিলুদা?’
‘এর নাম চন্দন সরকার। লাটু এই রুমটা ওর নামে অ্যালট করেছে।’ বলল বিলু।
‘চন্দন সরকার? যে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে?’ ভুরু নাচাল ছেলেটি, ‘ওয়েলকাম বস। আমার নাম সুব্রত সরকার। আমি এই ফ্লোরের রিপ্রেজেনটেটিভ। এই ফ্লোরে কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের নিয়ম চলে না। শুধু সুব্রত সরকারের নিয়ম চলে।’
সুব্রতর কথা বলার ধরনে মিঠুন চক্রবর্তীর ছাপ পরিষ্কার। চন্দন হেসে ফেলে বলল, ‘সরকার বাহাদুর, রুমে পা রাখতে পারি?’
‘ঢুকে পড় বে। বেশি ন্যাকামো করিস না।’ কিবোর্ডে খটখট করতে করতে পাশ থেকে বলল অন্য ছেলেটি, ‘আমার নাম বান্টি গাঙ্গুলি। আমরা দুজনেই সেকেন্ড ইয়ার। কাজেই তোকে র্যাগ করার হক আমাদের আছে। কিন্তু আমরা সেটা করব না। কেন না ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি থেকে তোকে নিয়ে লেখা মেলটা এক্ষুনি এল। এই দ্যাখ।’ ল্যাপটপ খাটের ওপরে রেখে চন্দনকে ইশারায় ডাকে বান্টি। সুটকেস একপাশে রেখে চন্দন পিছন ফিরে তাকায়। বিলু আর নেই। নিজের কাজে চলে গেছে।
টুকটুক করে এগিয়ে সুব্রত আর বান্টির পাশে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকায় চন্দন। সুব্রত সরকারের মেলবক্সে খোলা রয়েছে। ইনবক্সের প্রথম মেলের সাবজেক্ট ম্যাটার হল, ‘সারপ্রাইজ গিফট ফর চন্দন সরকার’।
‘নিজেই পড়।’ ল্যাপটপ চন্দনের দিকে এগিয়ে দেয় বান্টি। চন্দন মেলের ওপরে কার্সার নিয়ে গিয়ে ডাবল ক্লিক করে। খুলে যায়, বৈদ্যুতিন চিঠি। চিঠির বক্তব্য হল—
শ্রী সুব্রত সরকার,
ফ্লোর রিপ্রেজেনটেটিভ,
হোস্টেল বোর্ডাস কমিটি,
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
মান্যবরেষু,
প্রতিবারের মতো এবারও আমরা রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম স্থানাধিকারিকে একটি উপহার দিতে আগ্রহী। বিশেষ সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে চন্দন সরকার, যিনি এবারের উপহারটি পাচ্ছেন, আপনাদের কলেজে ভরতি হবেন এবং আপনাদের পরিচালিত হোস্টেলে বসবাস করবেন। আমরা তাই অন্যান্য বারের প্রথা অনুযায়ী কলকাতা শহরের বিখ্যাত নগরনটি মিস কামিনীকে পাঠিয়ে দিলাম। শ্রী চন্দন সরকার একটি সন্ধ্যা মিস কামিনীর সাহচর্যে কাটান, এই আমাদের বাসনা।
ধন্যবাদান্তে,
রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষে,
গোষ্ঠচাঁদ।
চিঠি পড়ে অবাক হয়ে চন্দন বান্টির দিকে তাকাল। এরা মশকরা করছে নাকি? গ্রামের ছেলে বলে সে কি ছ্যাবলামোটা ধরতে পারছে না? মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ঠিক হয়েছে সে কোন ফ্লোরের কোন রুমে থাকবে। এর মধ্যেই রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির পক্ষে গোষ্ঠচাঁদ এই মেল সুব্রত সরকারকে করে দিল? ঢপবাজির একটা সীমা থাকা উচিত।
‘তুই কী ভাবছিস আমি জানি।’ গম্ভীর মুখে বান্টি বলে, ‘আসলে গত তিন বছর ধরেই উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়ে প্রথমে একশো পঁচিশে উঠেছে। মিস কামিনীর তাই রুটিনটা জানা। উনি একশো চব্বিশে অপেক্ষা করছেন। তুই যা।’
এইবারে চন্দন ধ্বস খেল। মিনমিন করে বলল, ‘বয়েজ হোস্টেলে তো মেয়েরা অ্যালাওড নয়।’
‘এই হল গ্রামের ছেলেদের সমস্যা। রামচাঁদ শ্যামচাঁদ গ্রুপ অব কোম্পানিজের নাম শুনেছিস? ওদের ইয়ারলি টার্নওভার জানিস? ওদের ফিল্যানথ্রপি নিয়ে কোনও ধারণা আছে? মিস কামিনীর বিজি স্কেজুল নিয়ে কোনও ধারণা আছে?’
‘স্কেজুল মানে কী?’
‘এটা একটা ইংরিজি শব্দ, ফার্স্ট বয়!’ চন্দনের কান মুলে বলে সুব্রত, ‘যাকে তোরা শিডিউল বলে থাকিস। এনিওয়ে, মিস কামিনী ভীষণ ব্যস্ত। ফালতু ঝামেলা করিস না। পাশের ঘরে যা।’ একশো চব্বিশ নম্বর ঘরের দিকে আঙুল দেখায় বান্টি।
এইবারে চন্দন সামান্য ঘাবড়াল। মিস কামিনীটা না হয় এদের ঢপ। কিন্তু কোনও মেয়েকে পাশের ঘরে এনে থাকলে বিরাট বিপদের কথা। বাংলা সিরিয়ালে চন্দন দেখেছে যে মোবাইলে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও তুলে এমএমএস ক্লিপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় সব মোবাইলে। সেখান থেকে ইউটিউবে। সেখান থেকে খবরের কাগজে। তখন কী হবে? ক্যান্টিনের র্যাগিং-এ বৃন্দা বাঁচিয়ে দিয়েছে। হোস্টেলের র্যাগিং-এ কে বাঁচাবে? অশালীন আচরণের জন্য হাজতবাস কপালে নাচছে। ডাক্তারি পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।
‘কী রে? যা!’ হুকুম করছে সুব্রত।
চন্দন আর একবার লড়াই দিল। ক্যাজুয়ালি বলল, ‘তোমরা বলছ যখন তখন ওঁর সঙ্গে একবার আলাপ করে আসি।’
একশো পঁচিশ নম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের সামনে দাঁড়াল সে। ঘরের দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে দরজায় নক করে চন্দন। সামান্য প্রতীক্ষার পরে ভিতর থেকে ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। যেন ঘুঙুর পরে কেউ হাঁটছে। রিনরিনে মহিলা কণ্ঠ প্রশ্ন করে, ‘কে?’
ভয়ের চোটে হৃৎপিণ্ড ব্যাঙের মতো লাফিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। হাত-পা মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডা। অ্যাবাউট টার্ন হতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল চন্দন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি চন্দন সরকার।’ তার মনে ক্ষীণ আশা, দরজা না খুলে ওপ্রান্ত থেকে কোনও ছেলে মেয়েলি গলায় আলাপ চালিয়ে যাবে।
‘আসুন। আমি মিস কামিনী।’ দরজার একপাল্লা খুলে উঁকি মেরেছে শাড়ি পরা একটি মেয়ে। রংচঙে শাড়ি, ঝকমকে ব্লাউজ, একগলা ঘোমটা, একহাত চুড়ি, মেয়েলি সুগন্ধ…
চন্দন এক দৌড়ে একশো পঁচিশে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘বান্টিদা, সুব্রতদা, আমি পারব না।’
‘কী পারবি না?’ টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বার করতে করতে বলল সুব্রত।
‘ওই ঘরে যেতে পারব না। প্লিজ। তুমি আমাকে অন্য কিছু করতে বলো।’ কেঁদে ফেলেছে চন্দন।
‘চাষার ছেলে একেই বলে,’ রাগরাগ চোখে বান্টি বলে, ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ এবং রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির ঐতিহ্য নষ্ট করছিস তুই। এবার কিন্তু র্যাগড হতে হবে। সেটা সামলাতে পারবি তো?’
‘যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব। শুধু ওই ঘরে যেতে বোলো না।’
‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ঐতিহ্য ভঙ্গ করার শাস্তি সাংঘাতিক। প্রিন্সিপালকে জানালে তোকে রাস্টিকেট করতে পারেন।’ ঘাড় বেঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বান্টি, ‘আমি এখন মিস কামিনীকে সোনাগাছি ফেরত পাঠাই কী বলে? ওঁর ঘণ্টা পিছু চার্জ দশ হাজার টাকা। দু-ঘণ্টার জন্য এসেছেন। কাজ না করে উনি রামচাঁদ শ্যামচাঁদ স্কলার কমিটির থেকে টাকা নেবেন না। আর গোষ্ঠচাঁদ যদি জানতে পারেন যে ওঁর বাপ-ঠাকুরদার টাকা এইভাবে নষ্ট হয়েছে, তাহলে আমাদের ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে আমাদের হাসপাতালের যে কটা ইউনিট চলে তার থেকে উনি নাম তুলে নেবেন।’
‘সিটি স্ক্যান, ইউএসজি, এমআরআই বন্ধ হয়ে যাবে।’ নতুন সিগারেটের প্যাকেটের ফয়েল ছিঁড়ছে সুব্রত।
‘কত গরিব পেশেন্ট মারা যাবে!’ কপাল চাপড়াচ্ছে বান্টি।
‘আমি ব্যাপারটা ম্যানেজ করব।’ চন্দনের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলে সুব্রত, ‘কিন্তু তোকে শাস্তি পেতে হবে। তুই এই সিগারেটের প্যাকেটটা আমাদের সামনে শেষ কর।’ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই চন্দনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে।
‘আমি সিগারেট খাই না।’ চোখের জল মুছে বলে চন্দন।
‘দুটো অপশন,’ চন্দনের নাকের ডগায় দু’আঙুল নেড়ে বলে সুব্রত, ‘হয় দশটা সিগারেট চেইন স্মোক করবি। অথবা আগামী দু’ঘন্টা মিস কামিনীর সঙ্গে কাটাবি। চয়েস ইজ ইয়োর্স।’
‘আম… আমি পারব না…’ একশো পঁচিশের দরজার দিকে তাকিয়ে বলে চন্দন।
‘গালে মারব এক থাবড়া!’ বাঘডাকা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সুব্রত। ‘খা শালা। খা!’ প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে চন্দনের ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দেয় সে। দেশলাই জ্বালিয়ে আগুনের শিখা সিগারেটের তলায় ধরে বলে, ‘ইনহেল কর বাঞ্চোত!’
কত লোক তো সিগারেট খায়। নিজেকে বোঝায় চন্দন। তারা প্রত্যেকেই কোনও একদিন শুরু করেছিল। তারও আজকে শুরু হল। এইভাবে নেওয়া যাক এই র্যাগিংকে। ধোঁয়া মুখে নিয়ে নাক দিয়ে বার করে দিলেই হল। তাহলে ফুসফুসে ঢুকবে না। এইটুকু পারবে না? পরপর দশবার? তাহলেই ঝামেলা থেকে মুক্তি! মুখের সিগারেট দাঁত দিয়ে চেপে হালকা প্রশ্বাস নেয় সে। ওমনি কুৎসিত, তিতকুটে, কষা স্বাদে মুখ ভরে যায়। কাঁপতে থাকা হাতে সিগারেট ধরে চন্দন। যে ভাবে অন্যরা সিগারেট ধরে, সেই কায়দায় তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে সিগারেট রেখে খকখক করে কাশতে থাকে।
‘আস্তে আস্তে খা। চাপ নিস না।’ সান্ত্বনা দিচ্ছে বান্টি। ‘আমাদের হাতে এখন অনেক সময় আছে।’
দু’আঙুল আবার ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে আসে চন্দন। এখনও তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তার কতটা নিকোটিনের জ্বালা আর কতটা অপমানের, বোঝা যাচ্ছে না।
পাঁচ মিনিটের ধস্তাধস্তিতে প্রথম সিগারেট শেষ হল। প্রকৃত চেইন স্মোকিং এর কায়দায় সিগারেট থেকে সিগারেট ধরাতে হল চন্দনকে। এখন আর অতটা খারাপ লাগছে না। দু’আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরাও রপ্ত হয়ে গেছে। ডান হাতের বদলে বাঁ হাতে সিগারেট নিয়ে টান মারে সে। বান্টি হাততালি দিয়ে বলে, ‘কেয়াবাত!’
তৃতীয় সিগারেটটা খারাপ লাগল না। সিগারেট নিয়ে লোকে এত বাড়াবাড়ি কেন করে? সে তো ইনহেল করছে না। কায়দা করে মুখের মধ্যে ধোঁয়া রেখে নাক দিয়ে বার করে দিচ্ছে। এইভাবেই আগামী সাতটা সিগারেট পোড়াতে পারবে না? আলবাত পারবে!
চতুর্থ সিগারেট ধরানোর সময় থেকে মাথাটা হালকা হল। টেনশান কমে গেছে। সুব্রত আর বান্টিকে আর তেমন খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, মিস কামিনীর সঙ্গে দেখা না করে সে সত্যিই অন্যায় করেছে। ঐতিহ্যভঙ্গের শাস্তি তার প্রাপ্য।
পঞ্চম সিগারেটের মাঝামাঝি সময় থেকে চন্দনের মাথা ঘুরতে শুরু করল। সারা শরীর জুড়ে ঝিমঝিম ভাব, চোখের সামনে লাল নীল বল নাচছে, জিভ শুকিয়ে আসছে, বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে, গা গরম। তাও আরও দুটো সিগারেট শেষ করল চন্দন।
অষ্টম সিগারেটে প্রথম টান মারতেই চন্দনের চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে এল। বসে থাকা অবস্থা থেকে মেঝেতে সটান পড়ে গেল সে। মেঝে আর মাথার খুলির সংঘর্ষের ফলে ঠনাত করে আওয়াজ হল। তবে চন্দন আওয়াজ শুনতে পায়নি। সে অজ্ঞান।
আওয়াজ শুনে একশো চব্বিশ থেকে দৌড়ে বেরোয় টিনটিন। শাড়ি খুলে ফেললেও এখনও ব্লাউজ পরে রয়েছে। মাথায় বিনুনির উইগ, হাতে একগাছা চুড়ি। বিরক্ত হয়ে সুব্রত আর বান্টিকে বলল, ‘লাটুর মাথায় কোনওদিনও বুদ্ধি হবে না। ছোকরাটাকে কাঠি করতে গিয়ে তোদের দিয়ে মেল চালাচালি করাল, আমাকে শাড়ি পরাল। কতখানি সময় নষ্ট বল তো? ফ্রেশার্স ওয়েলকামে আমাদের নাটকের ড্রেস রিহার্সালের জন্য আবার শাড়ি আয়রন করতে হবে।’
‘চল। আবার রিহার্সাল শুরু করি। ফ্রেশার্সের দিন সেকেন্ড ইয়ারের তরফ থেকে ‘ফিফটি ফিফটি’ নামের এই ওয়ান অ্যাক্ট প্লে-টা নামাতেই হবে।’ চন্দনকে পাঁজাকোলা করে খাটে শুইয়ে, হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে সুব্রত বলে। ‘বাইজির পোশাকে টিনটিনের মুজরা এই নাটকের প্রধান অ্যাট্রাকশান। নাটকের শেষে সবাই দেখবে নায়িকা আসলে ছেলে। কী আইডিয়া মাইরি!’
‘বেশি ভাটাস না। আধঘণ্টার নাটকে দু’বার ড্রেস চেঞ্জ। আমি শালা পাগল হয়ে যাচ্ছি। থেকে থেকেই ডায়ালগ ভুলে যাচ্ছি। কেন যে মরতে নাটকটা লিখেছিলাম।’ গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরোয় টিনটিন। পিছন পিছন সুব্রত।
বান্টি জাগ থেকে জল নিয়ে চন্দনের মুখে ঝাপটা দেয়। ছেলেটার এখনও হুঁশ এল না কেন? চন্দনকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের তলায় শুইয়ে দেবে নাকি? কনফিউজড হয়ে যায় সে। হঠাৎই মোবাইলের ঝনঝন। চন্দনকে ছেড়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। সবুজ বোতাম টিপে বলে, ‘বলো আপ্পুদি।’
‘মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসির পাঁচটা ছেলে ক্যান্ডিডেট বেছেছিস? না বাচ্চা ছেলেগুলোর পায়ুপ্রহারে ব্যস্ত?’ আপ্পু ঝাঁঝিয়ে ওঠে লেডিজ হোস্টেল থেকে। ‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম আর মাত্র সাতদিন বাকি। আজ এগারো তারিখ। শনিবার। সামনের শনিবার প্রোগ্রাম। ফার্স্ট ইয়ারের দশজন ছেলে মেয়ে নিয়ে এই বিউটি কনটেস্ট আইএমসির ফ্রেশার্স ওয়েলকামের ইনটিগ্রাল পার্ট। এটা যেন কেঁচে না যায়।’
‘আজই তো ছেলেগুলো হোস্টেলে ঢুকল। এখনও সবাইকে ছানবিন করার সময় পাইনি।’ আমতা আমতা করে বান্টি। থার্ড ইয়ারের দিদিটিকে সে বিলক্ষণ সমঝে চলে।
‘আমি দুটো মেয়ে সিলেক্ট করেছি। কালকের মধ্যে আরও তিনজন বাছব। হোস্টেলাইট আর ডে স্কলার মিলিয়ে পাঁচটা ছেলে জোগাড় কর। পাঁচ দশের ওপরে হাইট, স্মার্ট, ইংরিজি বলতে পারে, ভালো চেহারা। পাবি না এমন পাঁচটা ছেলে?’
‘আমার সামনে এখন যে হোস্টেলাইট রয়েছে তার হাইট পাঁচ দুই। ইংরিজি জানে না। চাষার ছেলে চলবে?’
‘ভ্যাট!’ ফোন কেটে দিয়েছে আপ্পু। শ্রাগ করে বান্টি একশো পঁচিশ থেকে বেরিয়ে যায়। চন্দন এখনও অজ্ঞান।
.
দময়ন্তী
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে পাখির চোখে দেখলে বৃত্তের মতো লাগে। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্রিটিশ স্থাপত্য, সেন্ট্রাল হল। তিনতলা সমান উঁচু বাড়িতে আদতে একটাই তলা। লাল ইটের তৈরি, ঢালু ছাদওয়ালা হলে ঢুকলে উচ্চতার কারণে নিজেকে লিলিপুট মনে হয়। শক্তিরূপা বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্য ও আমেরিকান জিআইদের র্যাশন রাখার জন্য সেন্ট্রাল হল তৈরি হয়েছিল। তাই গুদামঘরের মতো আর্কিটেকচার। দময়ন্তী খোঁড়াতে খোঁড়াতে হলটায় ঘুরছিল।
গোড়ালিতে চোটের কারণে অ্যাঙ্কল স্প্রেন হয়েছে। প্রথমদিন ঠিক সময়ে কলেজে পৌঁছবে বলে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা না শুনে বেলেঘাটা মেন রোড থেকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যে ঝাঁপ মেরেছিল দময়ন্তী। তার ফল এখনও ভুগছে। প্রথম দিন কোনও অসুবিধে হয়নি। শনিবার পেরিয়ে রবিবার আসতে না আসতেই পা ফুলে ঢোল। অগত্যা হাড়ের ডাক্তারের কাছে যেতে হল। এক্স-রে করানো, ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়ানো, ব্যথার ওষুধ খাওয়া, বিছানায় শুয়ে থাকা—হাজার ঝামেলা। প্রথম দিন নিয়মানুবর্তীতা দেখাতে গিয়ে পরের পাঁচদিন কলেজে আসতে পারেনি দময়ন্তী। আপ্পুর অনুরোধে আজ এল। আজ ফ্রেশার্স ওয়েলকাম।
আইএমসির যাবতীয় প্রোগ্রাম সেন্ট্রাল হলে অনুষ্ঠিত হয়। তার কারণ, কলেজ কর্তৃপক্ষ বেঢপ গুদামকে কীভাবে ব্যবহার করবে বুঝতে না পেরে অডিটোরিয়ামে বদলে দিয়েছে। যে স্থপতির প্ল্যানিং এ এই রূপান্তর ঘটেছে, হেরিটেজের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল। ব্রিটিশ গোডাউন আর সরকারি গণভবনের ভয়াবহ ফিউশন এখানে ঘটেনি। পিছন দিকে স্টেজ ও সামনের দিকে বসার আয়োজন করা ছাড়া অন্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাড়িটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলেও ছাদ থেকে অন্তহীন লম্বা রডে ঝোলানো চার ব্লেডের পাখাগুলো খোলা হয়নি। নতুন রং ও তেল পেয়ে তারা বনবন করে ঘুরছে। দেওয়ালের রং দুধসাদা। ওপর দিকের অজস্র স্কাইলাইট এবং ঘুলঘুলি ফলস রুফিং দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। গাদাগাদা আখাম্বা দরজা জানলা সাউন্ডপ্রূফ মেটিরিয়াল দিয়ে বন্ধ। এই পরিবর্তনের ফলে অডিটরিয়ামের ধ্বনি প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা খুব সুন্দর।
স্টেজের দু’পাশে এবং পিছন দিকে অনেকগুলো ঘর আছে। ছোট এবং কেজো ঘরগুলোর কোনওটা থেকে আলো নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনওটা থেকে শব্দ। সেন্ট্রাল হল রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে একটা ঘর আছে। দময়ন্তী উঁকি মেরে দেখল ঘরটা ঝাঁটা, মপ, ঝুলঝাড়ু, ফিনাইল, ফ্লোর-কিনার, রুম ফ্রেশনারে ঠাসা। সেন্ট্রাল হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে যথেষ্ট অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করা হয়। এই ঘরের পাশের ঘরের দরজায় তালা মেরে বাইরে চেয়ার পেতে যে ছেলেটা সিরিয়াস মুখে বসে আছে, তার নাম লাটু। একটু আগে দময়ন্তীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এই ঘরে মদের বোতল রাখা আছে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে ডিজে ও মিউজিকের সঙ্গে নাচানাচি হবে। তখন এইসব কাজে লাগবে। দিল্লিতে এইসব দেখে চোখ-কান পচে গেছে দময়ন্তীর। নাচগানের আগে আছে ‘মিস্টার ও মিস আইএমসি কনটেস্ট’। এটা এই কলেজের পুরনো সংস্কৃতি। আশির দশক থেকে চলে আসছে। তখনও সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হননি, ঐশ্বর্য রাই মিস ওয়ার্ল্ড হননি, বিপাশা বসু তিলোত্তমা হননি। বিউটি কন্টেস্টের কালচারটাই বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। অল ইন্ডিয়া এনট্রান্স এক্সামিনেশানে চান্স পেয়ে দিল্লি ও মুম্বইয়ের যে সব ছেলেমেয়েরা কলকাতায় পড়তে আসত, তারা এটা চালু করে। সেই ট্র্যাডিশন দিব্যি চলছে।
দেড়শো জন ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে পাঁচজন ছেলে ও পাঁচজন মেয়ে প্রতিযোগী বেছে নেওয়ার কাজটা কারা করেছে, কোন প্যারামিটারের ভিত্তিতে করেছে, সেটা দময়ন্তীর অজানা। গত তিনদিন ধরে আপ্পু তাকে ফোনে অনুরোধ করেছে আজ আসার জন্য। কেন না সে একজন কনটেস্ট্যান্ট। মোবাইলে দময়ন্তী আপ্পুকে বুঝিয়েছিল, পায়ের চোটের কারণে তার পক্ষে ফ্রেশার্স ওয়েলকামে আসা বা মিস আইএমসিতে যোগদান করা অসম্ভব। আপ্পু নাছোড়বান্দা। গতরাতে গোলমহলে গিয়ে হাজির। শক্তিরূপা আর ড্যানিয়েলের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দময়ন্তীর বাড়ি ছাড়ার পারমিশান জুটিয়ে ফেলেছে। অগত্যা আসতে হয়েছে!
দময়ন্তীকে বাদ দিলে বাকি চারজন মেয়ে প্রতিযোগী হল শ্রীপর্ণা, বৃন্দা, জেমসি আর সাবিনা। বৃন্দার সঙ্গে গত শনিবার আলাপ হয়েছিল। বাকি তিনজনকে দময়ন্তী চেনে না। সেন্ট্রাল হলে ঢোকার আগে আপ্পুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পায়ে ক্রেপ বাঁধা অবস্থায় দময়ন্তীকে আসতে দেখে বলল, ‘আট্টাগার্ল! স্টেজে উঠে ব্লন্ড বিমবোর মতো আচরণ করিস। ইউ উইল বি দ্য পারফেক্ট আন্ডারডগ।’
‘আন্ডারবিচ বলতে পারো।’ মুচকি হেসে বলেছিল দময়ন্তী, ‘তোমার কথা মতো ব্যাগে করে শাড়ি নিয়ে এসেছি। আমি কিন্তু শাড়ি হ্যান্ডল করতে পারি না। স্টেজে খুলে গেলে কেলেঙ্কারি হবে।’
‘তাহলে মিস আইএমসির ক্রাউন তোর জন্য বাঁধা।’ চোখ টিপে বলেছিল আপ্পু। ‘বাই দ্য ওয়ে, বাকি কনটেস্ট্যান্টদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?’
‘গত শনিবার বৃন্দার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।’
‘শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি ব্যারাকপুরের মেয়ে। আর্মি স্কুলে পড়াশুনো। জেমসি ডিসুজা গোয়ার মেয়ে। অল ইন্ডিয়া এনট্রান্স দিয়ে কলকাতায় চান্স পেয়েছে। সাবিনা কৈরালা নেপালের মেয়ে। রয়্যাল ব্লাড আছে। অল আর ড্যাম গর্জাস।’
‘মেয়ে নিয়ে আমার কোনও ফ্যাসিনেশান নেই। চিকনাগুলো কেমন বলো।’
‘আচ্ছা? কলেজে সদ্য ঢুকেই চিকনার খোঁজ?’ টক করে চোখ মারে আপ্পু, ‘আমাদের কলেজের ট্রাডিশন হল, মিস্টার আইএমসির ক্রাউন নিয়ে যায় নর্থ ইন্ডিয়ার ছেলেরা। আর মিস আইএমসির খেতাব পায় বাংলার মেয়েরা। এইবারে মেয়েদের ক্ষেত্রে কী হবে বলা শক্ত, তবে ছেলেদের মধ্যে মুম্বইয়ের সুরজ মলহোত্র ন্যাশনাল লেভেলের ম্যানহান্ট কম্পিটিশনে নাম দেওয়ার মতো চিকনা। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম, ওয়েল গ্রুমড।’
‘অন্য ছেলেগুলো কে?’
‘কলকাতার তিনটে ছেলে আছে। দীপ সেনগুপ্ত, প্রবাল সান্যাল আর সঞ্জয় ত্রিপাঠি। ত্রিপুরার এক ছোকরা আছে। নাম সবুজ দেববর্মন। দেখতে শুনতে ভালো। এনিওয়ে, আমাকে আর বকাস না। সেন্ট্রাল হলের পিছনে মেয়েদের জন্য একটা রুম অ্যালট করা আছে। ওখানে ব্যাগ রেখে অডিয়েন্সে বোস। ক্রাউন রাউন্ড শুরু হওয়ার একঘণ্টা আগে সাজুগুজু করে নিস।’
সাজুগুজু করার ঘরটা এতক্ষণে দেখতে পেল দময়ন্তী। বাইরে ‘ফর হার’ লেখা রয়েছে। শব্দদুটোর মাথায় ঝকঝকে টায়রা আঁকা। বাইরে এক সিনিয়র দাদা বসে রয়েছে। এর সঙ্গেও আজই আলাপ হল। নাম বান্টি।
সে দময়ন্তীকে দেখে বলল, ‘ভেতরে ব্যাগ রেখে অডিয়েন্সে যা। ঠিক সময়ে চলে আসবি।’
ঘরে ঢুকে দময়ন্তী দেখল পাঁচটা টেবিল আর পাঁচটা চেয়ার পাতা রয়েছে। প্রতিটি টেবিলে একটা আয়না। ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি নেই।
ব্যাগ টেবিলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে অডিয়েন্সে এল দময়ন্তী। সেন্ট্রাল হল এখন, ক্রিকেট কমেন্টি^্রর ভাষায়, ‘খচাখচ ভরা হুয়া হ্যায়’। মঞ্চে বসে রয়েছেন এনজি দাস, এএম এবং পিএম। স্বাগত ভাষণ দিচ্ছেন ফরেনসিক মেডিসিনের এইচওডি এবং কলেজের প্রিন্সিপাল ডক্টর রেবতীভূষণ পট্টনায়ক। নাম ও পদবির আদ্যক্ষর জুড়ে এঁকে ছাত্ররা রেপ স্যার নামে সম্বোধন করে। উনি নাকি সেটা জানেনও।
মঞ্চের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিপু আর আপ্পু। দর্শকাসনের সামনের দিকে বসে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা। পিছন দিকে সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টারের ছেলেমেয়েরা। তাদের থেকে সিনিয়াররা কেউ নেই। তারা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। তবে মোচাপার্টি, ছেঁদোপার্টি আর পিএমএফের পান্ডাদের দেখা যাচ্ছে।
এদিক সেদিক দেখে দময়ন্তী চন্দনের পাশে বসে বলল, ‘দু’জন সিনিয়র মিলে নাকি তোকে বেধড়ক র্যাগ করেছে?’
চন্দন দময়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অবশেষে বলল, ‘একটা ফালতু ঘটনা নিয়ে বড্ডো ফাটছে।’
‘তোকে নাকি জোর করে গাঁজা খাইয়েছে? তুই নাকি চারতলা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলি? সুব্রতদা আর বান্টিদা তোকে আটকেছে?’
শুকনো হেসে চন্দন বলে, ‘গাঁজা নয়, সিগারেট। আমি স্কুল লাইফ থেকেই স্মোক করি। কাজেই কোনওরকম জোর খাটানো হয়নি। আর ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার গপপোটা কে রটাল বল তো? আমি পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘আমি গত শনিবারের পরে আজই এলাম। এসব আমার জানার কথা নয়। আপ্পুদি বলছিল।’ দময়ন্তীর কথা শেষ হওয়ার আগেই তুমুল হাততালি। প্রিন্সিপালের ভাষণ শেষ হয়েছে। ডক্টর পট্টনায়ক চেয়ারে বসার পরে রিপু তিন এইচওডি-কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করল। এনজি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আজ আমাদের এখানে থাকা মানে তোমাদের বোর করা। টোকেন প্রেজেন্স দিয়ে গেলাম। তোমরা প্রোগ্রাম শুরু করো।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার!’ পিছন থেকে সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টার হাততালি দিয়ে সেন্ট্রাল হল কাঁপিয়ে দিল।
পিএম চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘অ্যাই রিপু, কোনও অসভ্যতা যেন না হয়!’
‘না ম্যাডাম। আমরা খুব লক্ষ্মী স্টুডেন্ট। আপনার কথা মনে রাখব। বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লস অ্যাট দ্য বটম।’ বিনয়ের সঙ্গে মাইকে ঘোষণা করল রিপু। সেকেন্ড আর থার্ড সেমিস্টারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনরাও এবার হাততালি দিল।
‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম বলতে পারিস, নবীন বরণ বলতে পারিস, ইন্ট্রো বলতে পারিস। হোয়াটস ইন আ নেম? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই কথা বলে গেছেন।’ মাইকে ঘোষণা করল রিপু। তার ঠোঁটের কোণে মিচকেমির হাসি।
‘রবীন্দ্রনাথ না। ওটা ওয়র্ডসওয়র্থ বলেছেন।’ সংশোধন করে আপ্পু। তার ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি।
‘সব ভালো ভালো কথাই ওয়ার্থলেস সাহেবরা বলবে নাকি? আমি তো বললাম, ‘হোয়াটস ইন আ নেম’? মোদ্দা কথা হল, আজ এখানে তোদের স্টেজে তুলে ব্যাপক মুরগি করা হবে। অ্যালফাবেটিকাল অর্ডারে ডাকব। তোরা এক এক করে আসবি। তোদের একটা টপিক দেওয়া হবে। তার ওপর না ভেবে তোদের এক মিনিট ভাটাতে হবে। যে পারবে না, সে বেদম আওয়াজ খাবে। সেকেন্ড আর থার্ড সেম পচা টমেটো আর ডিম কিনে রেখেছে। সেগুলো ছুঁড়ে মারবে। আর যে ভালো বলবে, তার জন্য টাটকা টমেটো আর ডিম আছে। যে দশজন ছেলেমেয়ে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসি’ খেতাবের জন্য লড়বে, তারা এই গ্রিলিং-এর বাইরে। কেন না তাদের জন্য আলাদা সেশন আছে।’
দর্শকাসনের সামনের দিকে নীরবতা। পিছন দিকে থেকে বেদম হাততালি। রিপু বলল, ‘দেড়শো জনকে মুরগি করা ইজ নট অ্যান ইজি জব। একদম সময় নষ্ট নয়। ফটাফট চলে আয়। নাম্বার ওয়ান, অভিজ্ঞান লাহিড়ী।’
সামনের সারি থেকে অভি মঞ্চে উঠল। পরনে জিনস, টি-শার্ট আর কনভার্স শু। টি-শার্টে লেখা, ‘আই হেট মেসেজ টি-শার্টস!’ রিপু টিশার্ট দেখে বলল, ‘শুরুতেই এই জিনিস! ব্রাভো! তোর টপিক হল, ”শেক ওয়েল আফটার ইউজ”। স্টার্ট।’
অভি টপিকটা বুঝতে দশ সেকেন্ড সময় নিল। সেকেন্ড সেমের গোটা দশেক ছেলে মঞ্চের একদম সামনে চলে এসেছে। তারা হাতে টমেটো নিয়ে গর্জন করছে, ‘বল! তাড়াতাড়ি বল! না হলে তোর টি-শার্ট ভোগে পাঠাব।’
অভি মিনমিন করে বলল, ‘ইয়ে… মানে… ওষুধের শিশি।’
‘কী?’ গর্জন করে রিপু, ‘ওষুধের শিশির গায়ে লেখা থাকে ‘শেক ওয়েল বিফোর ইউজ’। তোর টপিক হল ‘শেক ওয়েল আফটার ইউজ’। ব্যবহারের পর কোন জিনিস ভালো করে ঝাড়িস?’
‘না…মানে…থার্মোমিটার।’ তড়বড় করে বলে অভি, ‘থার্মোমিটার আমরা টেম্পারেচার মাপতে ব্যবহার করি। মাপা হয়ে গেলে পারদকে নামাতে থার্মোমিটার ঝেড়ে নিই।’
‘আর কোনও উদাহরণ? বাথরুমের জন্য?’ আপ্পু পাশ থেকে ফুট কাটে। অভি এখন আর একটু সাবলীল। সে বলে, ‘গামছা। বাথরুমে স্নান করে গা মোছার পর ভিজে গামছা ঝাড়তে হয়।’
‘গুড।’ অভির পিঠ থাবড়ে রিপু বলে, ‘দ্যাট ওয়াজ অভিজ্ঞান লাহিড়ী ফ্রম হাওড়া। এবার আসবে অপলক বিশ্বাস…’
দময়ন্তী বেজায় বোর হচ্ছে। এই জাতীয় ‘জাস্ট আ মিনিট’ বা ‘জ্যাম’ সেশন সে ক্লাস ফাইভ থেকে করে এসেছে। ভীষণ বোকা বোকা লাগে। অধিকাংশ ছেলে আনস্মার্ট। তারা তুতলোচ্ছে। অধিকাংশ মেয়ে বোকা। তারা ন্যাকামি দিয়ে ম্যানেজ করছে। পাশে বসে থাকা চন্দন মঞ্চে ওঠার আগে থরথর করে কাঁপছিল। তাকে রিপু টপিক দিল, ‘তুমি না, একটা ইয়ে!’ চন্দন প্রাথমিক ভাবে ধ্যাড়ালেও ম্যানেজ দিল চমৎকার। ইয়েকে ‘ই-এ’ অর্থাৎ ‘এক্সেপশনাল অ্যানিম্যাল’-এর অ্যাব্রিভিয়েশান বানিয়ে কথা বলা মেয়ে বাঁদরের সঙ্গে নিজের ফুলশয্যার কথা বলল। দাঁত খিঁচুনি থেকে লেজ নাড়া, হুপহাপ করা থেকে লম্ফ দিয়ে খাটে ওঠা—সব অভিনয় করে দেখাল। সেকেন্ড আর থার্ড সেম হাততালি আর শিস দিয়ে অভিনন্দন জানাল।
ঘণ্টাখানেক এইসব সহ্য করার পরে অডিয়েন্স থেকে উঠল দময়ন্তী। বোকাবোকা অনুষ্ঠান দেখার থেকে মিস আইএমসির জন্য রেডি হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
‘ফর হার’ লেখা রুম ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে বান্টি আর বসে নেই। দরজায় নক করল দময়ন্তী।
‘কে?’ ভেতর থেকে আওয়াজ এল। গলার আওয়াজ শুনে দময়ন্তী আন্দাজ করল এটা বৃন্দা।
‘আমি দময়ন্তী।’
‘ও! হাই!’ দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাল বৃন্দা। বাকি সবাই চলে এসেছে। দময়ন্তী একে একে আলাপ করল শ্রীপর্ণা, জেমসি এবং সাবিনার সঙ্গে। এই কনটেস্টে কে ফার্স্ট হবে সেটা বোঝা না গেলেও কে লাস্ট হবে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল দময়ন্তীর কাছে। সে নিজে। বাকি চারজন সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বে তার থেকে অনেক যোজন এগিয়ে। বৃন্দা ‘গার্ল নেক্সট ডোর’ টাইপ। শ্রীপর্ণা টিপিক্যাল ‘বেঙ্গলি বমশেল’। সাবিনার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি সারল্য। তবে মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দরী হল জেমসি ডিসুজা। কালো শিফনের শাড়ি, লাল ব্যাকলেস চোলি, চোখের পাতায় ধেবড়ে দেওয়া কোহল, পার্লারে গিয়ে স্ট্রেট করা চুল—’সেক্সি’ শব্দটা জেমসিকে ভেবেই তৈরি হয়েছে। দময়ন্তী ভাবল, আপ্পুর ভবিষ্যদবাণী মিথ্যে প্রমাণিত হবে। মিস আইএমসির ক্রাউন এবার বাংলায় থাকবে না।
দময়ন্তী জানে সে সুন্দরী। বাবা-মায়ের সঙ্গে চিত্রশিল্প এবং সাংবাদিকতার হাই প্রোফাইল সার্কেলে ঘোরাঘুরি করে কোন অনুষ্ঠানে কী রকম পোশাক পরতে হয়ে বা সাজতে হয়, এটা খুব ভালো করে জানে। সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে সে ভালো করে মুখ ধুয়ে নিল। স্কিন কালারের সঙ্গে মিলিয়ে মুখে, ঘাড়ে, গলায় আর দু’হাতে হালকা ফাউন্ডেশান লাগাল। ফাউন্ডেশান শুকিয়ে যাওয়ার পরে ভিজে স্পঞ্জ দিয়ে থুপে নিল। বাকি মেকআপ পরে করা যাবে। আপাতত পোশাক বদলানো থাক।
মায়ের কালেকশান থেকে মভ রঙা একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে দময়ন্তী। জেজে ভালায়া-র ডিজাইন। ডিজাইনারের গুরুত্ব এখানে কেউ বুঝবে না। শাড়িটা দময়ন্তীর পছন্দ, কেন না দিল্লিওয়ালাদের পছন্দসই হেভি এমব্রয়ডারির কাজ শাড়িটায় নেই। পাড়ে আর আঁচলে হালকা ভার্টিকাল এমব্রয়ডারি। এইরকম প্লেন শাড়ির সঙ্গে পরার জন্য সে নিয়ে এসেছে সাদা কালো ব্লক প্রিন্টের স্লিভলেস জ্যাকেট। চোখ ধাঁধিয়ে যাবে কম্পিউটারাইজড প্রিন্ট দেখলে।
প্যাডেড ব্রায়ের ওপরে জ্যাকেট পরে ওপরের তিনটে বাটন খুলে রাখল দময়ন্তী। পায়ে গলাল চার ইঞ্চির ব্ল্যাক স্টিলেটা। বাঁ হাতে পরল অক্সিডাইজড সিলভারের একগাদা চুড়ি। কানে ড্যাঙ্গলার। চুলটা ঘুরিয়ে এক দিকে ফ্রেঞ্চ রোল করে অক্সিডাইজড সিলভারের বড় পিন লাগল। পোশাক পরা কমপ্লিট। এবার মেকআপ।
ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক লাগিয়ে চোখটা যত্ন করে আঁকল। গালে সামান্য রুজ আর গ্লিটার। চশমা খুলে সি-গ্রিন কনট্যাক্ট লেন্স পরে নিল। সাজ কমপ্লিট। এবার বাইরে যাওয়া যাক।
বাকি চারজন দময়ন্তীকে দেখে চিল চিৎকার জুড়ল। শ্রীপর্ণা চেঁচাল, ‘ওরে বাপরে! এই রকম কম্পিটিটর আছে জানলে আমি নাম দিতাম না।’
বৃন্দা বলল, ‘মরে যাই! মরে যাই!’
জেমসি কড়া গলায় বলল, ‘ইউ হ্যাভ গট নো রাইট টু বি সো সেক্সি।’
বিনা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় আপ্পু ঘরে ঢুকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি স্টেজের বাঁ পাশে গিয়ে দাঁড়া। তোদের প্রোগ্রাম এক্ষুনি শুরু হবে।’
মঞ্চের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে উইংসের আড়াল থেকে অন্য দিকে তাকাল দময়ন্তী। এখান থেকেই ডান দিকের উইংসের আড়ালে দাঁড়ানো সুরজ মলহোত্রকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ছেলেটার হাইট অন্তত ছ’ফুট দু’ইঞ্চি। মডেলদের মতো গুড লুকিং। সুরজের আড়ালে দীপ, প্রবাল, সঞ্জয় আর সবুজকে দেখা যাচ্ছে না।
এই অনুষ্ঠানের এমসি বা মাস্টার অব সেরিমনি টিনটিন। ছেলেটা বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি, তিনটে ভাষাতেই সাবলীল। দুর্দান্ত সেন্স অব হিউমার। কথা বলে ভীষণ ভালো। গানের গলা চলনসই। মঞ্চে ওঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যে অডিয়েন্সের পালস হাতের মুঠোয়।
দময়ন্তীর ভয় ছিল যে আর পাঁচটা বিউটি কনটেস্টের কায়দায় ক্যাটওয়াক করতে হবে। টিনটিনের ইনট্রোডাকশানে ভুল ভাঙল। অনুষ্ঠানটির নামেই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার ছায়া। আসলে সেজেগুজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইনট্রো দেওয়া আর কিছু একটা পারফর্ম করা—এর ওপরে ভিত্তি করে মিস্টার অ্যান্ড মিস আইএমসি-র ক্রাউন মাথায় ওঠে।
টিনটিনের আহ্বানে বাঁদিক থেকে মঞ্চে এন্ট্রি নিল পাঁচ মেয়ে। আপ্পু হাইটের হিসেবে ওদের সাজিয়েছে। সাবিনা সবচেয়ে বেঁটে। সে ঢুকল প্রথমে। তারপর যথাক্রমে শ্রীপর্ণা, দময়ন্তী, বৃন্দা এবং জেমসি। হাততালির চোটে কানে তালা লাগার জোগাড়। অনেক কষ্টে অডিয়েন্সকে থামিয়ে টিনটিন ছেলেদের ডাকল। একে একে মঞ্চে এল সবুজ, প্রবাল, দীপ, সঞ্জয় এবং সুরজ। আবার কান-ফাটানো হাততালি।
মুখে প্লাস্টিকের হাসি সেলাই করে, চড়া আলোর মধ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী খেয়াল করল, মঞ্চের ঠিক সামনে টেবিল পেতে তিন বিচারক বসে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় স্কোরশিটে টিক মারছে। আপ্পু, রিপু এবং লাটু। মনটা হালকা হল দময়ন্তীর। এটা খুব চাপের কোনও ব্যাপার নয়!
প্রথম রাউন্ডে সকলের ইনট্রো হয়ে গেল মসৃণভাবে। দ্বিতীয় রাউন্ডে পারফরম্যান্সের পালা।
সাবিনা গিটার বাজিয়ে গান গাইল, ‘মুসু মুসু হাসি দেও মা লাই লাই…’ মেয়েটার গিটারের হাত চমৎকার। গানটাও মন্দ গায় না। মাথা নিচু করে তিন বিচারক নম্বর লিখল। টিনটিন প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা সাবিনা, তুই বল দেখি, হাসব্যান্ড তার প্রেগন্যান্ট স্ত্রীকে নিয়ে নার্সিংহোমে না গিয়ে পিৎজা হাটে গেল কেন?’
‘জানি না।’ সামান্য চিন্তা করে হাল ছেড়ে দেয় সাবিনা।
টিনটিন বলে, ‘উত্তরটা হল, ফ্রি ডেলিভারির জন্য। এনিওয়ে, তুই একপাশে দাঁড়া। শ্রীপর্ণা আয়। বল, তুই কী করবি?’
শ্রীপর্ণাও গান গাইল। একটা নয় তিনটে। কারাওকে চালিয়ে আশা ভোঁসলের তিনটে গানের মিশ্রণ। তিনটেই ক্যাবারে নাম্বার। হাততালি আর শিস বুঝিয়ে দিল দর্শক শ্রীপর্ণাকে পছন্দ করেছে।
এবার প্রশ্নের পালা। টিনটিন বলল, ‘ছেলেদের সঙ্গে টিভি কমার্শিয়ালের মিল কোথায়?’
‘একটা কথাও বিশ্বাস করা যায় না।’ একগাল হেসে বলে শ্রীপর্ণা।
টিনটিন বলল, ‘আমাদের নিয়ম হল তোকে আউট না করা পর্যন্ত প্রশ্ন করে যেতে হবে। এবার তুই বল, হোয়াট কমন বিটুইন মেগা সিরিয়ালস অ্যান্ড গার্লস?’
‘দুজনেই শুরু করলে থামতে চায় না। বোথ গো অন অ্যান্ড অন অ্যান্ড অন…’
‘এটাও পেরে গেলি। তাহলে বল, ছেলেদের সঙ্গে ব্যাটারির তফাত কোথায়?’
‘ব্যাটারির পজিটিভ সাইড আছে।’ তুরন্ত উত্তর শ্রীপর্ণার।
টিনটিন বিরক্তির অভিনয় করে বলল, ‘বড্ড ফুটেজ খাচ্ছিস। এবার তোকে ফোটাব। বল, একটা বোকা মেয়ে কিছু না পরে অতিথিদের খাবার পরিবেশন করছিল কেন?’
অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শ্রীপর্ণা হাল ছেড়ে দিল। টিনটিন বলল, ‘যাওয়ার আগে উত্তরটা শুনে যা। রান্নার বইতে লেখা ছিল, ”সার্ভ উইদাউট ড্রেসিং”।’
হাততালির মধ্যে শ্রীপর্ণা সরে দাঁড়াল। এবার দময়ন্তীর পালা। সে গান জানে না। নাচও জানে না। ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছে। রিপু বিচারকের আসন থেকে মাইক্রোফোনে বলল, ‘তোকে পারফর্ম করতে হবে। ধরে নে তুই আমাদের হাসপাতালের হেল্পলাইনের টেলিফোন অপারেটার। তোর কাছে ফোন আসছে। তুই কী ভাবে ডিল করবি?’
একটু ভেবে দময়ন্তী বলল, ‘সাইকায়াট্রির হেল্পলাইন হলে হবে?’
‘হবে। অ্যান্ড ইয়োর টাইম স্টার্টস নাও।’
‘মানসিক রোগের বিভাগে আপনাকে স্বাগতম।।’ এয়ার টাইম প্রোভাইডারদের হেল্পলাইনে ফোন করলে রেকর্ডেড ভয়েস যেভাবে কথা বলে, অবিকল সেই কায়দায় বলতে থাকে দময়ন্তী, ‘আপনি যদি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে এক নম্বর বাটন বারবার টিপতে থাকুন। আপনি যদি মানসিক ভাবে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হন বা ”কো-ডিপেন্ডেন্ট” হন তা হলে কাউকে বলুন দু’নম্বর বাটন টিপে দিতে। আপনি যদি মালটিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে তিন, চার, পাঁচ এবং ছয় নম্বর বাটন টিপুন।’
অডিয়েন্স হো-হো করে হাসছে। একদম পিছনের সিটে বসে সব্যসাচী আর বিলুও হাসছে। সব্যসাচী বলল, ‘এটা পুরনো জোক। মেয়েটার কমন পড়ে গেছে।’
বিলু বলল, ‘ভালোই তো। ঠিক জায়গায় ব্যবহার করছে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু ইনটেলিজেন্স বা উইট দিয়ে মিস আইএমসি জেতা যায় না। যে বেশি লাজুক হবে, ফ্লার্ট করবে, ব্রেনলেস বিউটির অ্যাক্টিং করবে, সে ফার্স্ট হবে।’
বিলু সব্যসাচীর কথা শুনছে না। সে একদৃষ্টিতে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটা দেখতে ভালো। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ আছে। পারসোনালিটিও স্ট্রং। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্মার্টলি যান্ত্রিক গলায় বকে চলেছে, ‘আপনি যদি প্যারানয়েড হন, তা হলে জেনে রাখুন যে আপনি এখন কোথায় আছেন সেটা কিন্তু আমরা জানি। আপনি কী করছেন, সেটাও জানি। আপনি ওখানেই থাকুন। আমরা আপনাকে খুঁজে নেব।’
আবার হাততালি। দয়মন্তী বলছে, ‘আপনি যদি স্কিতসোফ্রেনিক হন, তা হলে মন দিয়ে শুনুন। একটা সরু কণ্ঠস্বর আপনাকে নির্দেশ দেবে, কোন বাটনটা টিপতে হবে। আপনি যদি ম্যানিক ডিপ্রেসিভ হন তা হলে কোনও বাটন টিপে লাভ নেই। কেউ আপনার কল গ্রহণ করবে না। আপনি যদি ডিসলেক্সিক হন তা হলে ছয়নয়ছয়নয়নয়ছয়নয়নয়ছয় টিপুন।’
সব্যসাচী পেটে হাত চেপে বলল, ‘এই মেয়েটা কে রে? হাসতে হাসতে পেট ফেটে গেল।’
সব্যসাচীর কথায় বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল বিলু। মহা ঝামেলা তো! শুনতেও দেবে না!
‘আপনি যদি ডিলিউসনাল হন তা হলে সাত টিপুন। আপনার কল অন্য গ্রহের স্পেসশিপে ট্রান্সফার করা হচ্ছে। আপনি যদি অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাংজাইটিতে ভোগেন, তা হলে টেলিফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করুন। আমাদের প্রতিনিধি আপনাকে খুঁজে নেবেন। আপনি যদি বাই-পোলার ডিজঅর্ডারের রোগী হন, তা হলে ”বিপ” শোনার পরে আপনার বক্তব্য জানান, অথবা ”বিপ” শোনার আগে আপনার বক্তব্য জানান, অথবা ”বিপ”-এর জন্য অপেক্ষা করুন।’
‘ন’নম্বর বাটনটা বাকি আছে।’ বিচারকের আসন থেকে চেঁচাল রিপু। মিষ্টি হেসে রিপুর দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বাটন টিপুন।’
‘এটা বোঝা গেল না।’ চ্যাঁচাল আপ্পু।
যান্ত্রিক গলায় দময়ন্তী বলতে লাগল, ‘আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন। আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন। আপনার যদি অ্যামনেসিয়া বা মেমরি লস হয়ে থাকে তা হলে ন’নম্বর বোতাম টিপুন…’
অডিয়েন্স হাসিতে ফেটে পড়ছে। রিপু হাসতে হাসতে বলল, ‘উফফ! এবার শেষ কর।’
দময়ন্তী অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যদি ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের রোগী হন, তা হলে অবিলম্বে ফোন রেখে এখান থেকে কেটে পড়ুন। আপনাকে নিয়ে আমরা ফালতু সময় নষ্ট করব না।’
টিনটিন এগিয়ে এসে বলল, ‘তুইও প্রচুর ফুটেজ খেয়েছিস। তোর জন্য কোনও প্রশ্ন নেই। একপাশে সরে দাঁড়া। বৃন্দা এদিকে আয়। তুই কী করবি?’
সবাই হাততালি দিচ্ছে। বৃন্দা মঞ্চের মাঝখানে আসছে। সেদিকে না তাকিয়ে বিলু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দময়ন্তীর দিকে। কোনও মেয়েকে দেখে আজ পর্যন্ত সে এতটা পাগল-পাগল হয়নি। এই অনুভূতি প্রথম। একে কি ভালোলাগা বলে? একে কি ভালোবাসা বলে? এই কি প্রেম?
নাঃ! আপন মনে মাথা ঝাঁকায় বিলু। এটা পাগলামি। থিয়োরিটিক্যালি সে এই মেয়েটির প্রতি সেক্সুয়ালি অ্যাট্রাকটেড। তার লেখাপড়া শেখা শিক্ষিত মন যৌন আকর্ষণকে প্রেম বলে চালাবার চেষ্টা করছে। দাবাং সিনেমায় ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানের সঙ্গে মালাইকা অরোরাকে নাচতে দেখে তার যেমন প্রেম পেয়েছিল, দময়ন্তীকে দেখে তেমনই প্রেম পাচ্ছে।
তাই কি? নিজেকে প্রশ্ন করে বিলু। উত্তর না পেয়ে সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়ে আসে। বেশ রাত হয়েছে। এবার এখানে টিনটিনের লেখা ‘ফিফটি ফিফটি’ নাটকটা হবে। তারপরে মোচ্ছব শুরু হবে। তার আগে হোস্টেলে ফেরা যাক। বেশি রাতে আবার আসতে হবে। মাল খেয়ে ছেলেমেয়েগুলো এখানে ওখানে পড়ে থাকবে। তাদের পাঁজাকোলা করে হস্টেলে পৌঁছে দিতে হবে অথবা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিতে হবে। পিএমএফের সদস্য ও নেতা হিসেবে এটা তার কর্তব্য।
হাঁটতে হাঁটতে আবার দময়ন্তীর মুখটা মনে পড়ে বিলুর। ধুস! কী যে হচ্ছে!