অভিজ্ঞান
লালগঞ্জ। উত্তরপ্রদেশের এক ছোট্ট গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামে থাকে পান্ডে পরিবার। পরিবারের কর্তা প্রজাপতি পান্ডে, বউ নয়না দেবী, এবং তাদের দুই ছেলে। ছোট ছেলের নাম মাখনচাঁদ ওরফে মাখখি। মাখখির দাদার নাম চুলবুল পান্ডে।
বড় হয়ে চুলবুল পান্ডে লালগঞ্জের পুলিশ অফিসার হল। ভয়ডরহীন, ফিয়ারলেস, দাবাং পুলিশ অফিসার। ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়লে ঠেঙিয়ে পাট করে দেয়। কিন্তু ডাকাতির টাকা ব্যাঙ্কে ফেরত না দিয়ে নিজের পকেটে রাখে। আধুনিক রবিন হুড।
নির্মলা নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে ছোট ছেলে মাখখি। নির্মলার বাবা মাস্টারজির এই প্রেমে তীব্র আপত্তি। ওদিকে পুলিশি এনকাউন্টার করতে গিয়ে চুলবুল পান্ডের মোলাকাত হয়েছে রাজজো নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। আপেলের মতো লালচে গাল, বড়বড় চোখ, রেশমের মতো একঢাল চুল, ঘাগরা চোলি পরা ‘গাঁও কি গোরি’ রাজজোকে দেখে চুলবুল পান্ডে গেয়ে উঠল, ‘তেরে মস্ত মস্ত দো নয়ন, মেরে দিল কা উড় গ্যায়া চ্যয়েন!’
‘উফ! সোনাক্ষী সিনহাকে কী দেখতে মাইরি! বিশ্বাসই হয় না যে শত্রুঘ্ন সিনহার মেয়ে এত সুন্দর হতে পারে।’ উত্তেজিত হয়ে বলল বিলু ওরফে অনাবিল লাহিড়ী।
বিলুর বয়স একুশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। গড়ন রোগার দিকে। এক মাথা না-আঁচড়ানো চুল। গালে না কামানো দাড়ি। পরে আছে টি-শার্ট আর নোংরা জিনস, পায়ে ফ্লোটার্স। টি-শার্টে চে গেভারার ছবি। বসা গাল, উঁচু হনু, সিগারেট খাওয়া কালো ঠোঁট আর জ্বলজ্বলে চোখের কারণে তাকে সত্তর দশকের বিপ্লবীদের মতো দেখতে লাগে। পড়াশুনোয় ভালো যে সব ছেলেরা কম বয়সে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল।
‘সোনাক্ষীর মধ্যে ওর মায়ের ফিচার্স রয়েছে। শত্রুঘ্ন সিনহার জিন নেই বললেই চলে।’ তিন বছরের বড় দাদার দিকে ফিরে বলল অভিজ্ঞান লাহিড়ী ওরফে অভি।
আঠেরো বছরের অভি সদ্য টুয়েলভ পাস করেছে। বিলুর থেকে সে এক ইঞ্চি খাটো হলেও গায়ের রঙে চার পোঁচ এগিয়ে আছে। বিলুর মতোই অভির গড়ন রোগার দিকে। তবে সে ক্লিন শেভড। বিলুই তাকে দাড়ি কামানো শিখিয়েছে। বিলুর মতো সেও পরে আছে জিনস আর টি-শার্ট। পায়ে স্নিকার্স।
অভি বিলুকে দাদা হিসেবে দেখে না। দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তবে বিলু ছোড়নেওয়ালা নয়। অভির ওপরে নিয়মিত দাদাগিরি ফলিয়ে থাকে। সে শিয়ালদার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল ওরফে আইএমসিএইচ-এর থার্ড ইয়ারের ছাত্র। বেলুড়ের মফসসলি কুয়ো থেকে বেরিয়ে কলকাতার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে গত তিন বছর। ভাইয়ের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় তার প্রাপ্য। ভাইকে ধমক দিয়ে সে বলে, ‘এখনও কলেজ শুরু হল না, এর মধ্যে জেনেটিক্স বুঝে গেলি? খামোশ!’
‘আমাদের বারো ক্লাসে জেনেটিক্স পড়তে হয়েছে। তুই বাজে না বকে সিনেমাটা দেখতে দে।’ বিরক্ত হয়ে বলে অভি। বিলু ভুলে যাচ্ছে যে ছোট ভাইটিও এই বছর জয়েন্ট এনট্রান্সের মেডিক্যালে একশো সত্তর র্যাঙ্ক করেছে। সেও ভরতি হয়েছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আজ থেকে ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। ইদের ছুটি বলে আগামিকাল থেকে শুরু হবে।
দাবাং সিনেমাটা নিয়ে দুই ভাইয়ের প্রবল উৎসাহ ছিল। সোনাক্ষী সিনহা এই ছবিটার মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেছে। সলমন খান অভিনয় করেছে চুলবুল পান্ডে ওরফে রবিন হুড পান্ডের ভূমিকায়। মালাইকা অরোরা ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ আইটেম সং-এর সঙ্গে নেচেছে। তার ঠুমকা দেখে পুরো ইন্ডিয়া দিওয়ানা।
বেদম ঝাড়পিটের একটা সিন হল। লিলুয়ার চন্দন সিনেমা হলের অডিয়েন্স হাততালি দিয়ে হল ফাটিয়ে দিচ্ছে। চেয়ারের ওপরে উঠে নাচা, জামা খুলে শূন্যে ওড়ানো, পয়সা ফেলা, সলমনের নামে জয়ধ্বনি—এটা সিনেমা হল না কুম্ভীপাক নরক, বোঝা দায়। এই গন্ডগোলের মধ্যে হাফটাইম হল।
হলের বাইরে বেরিয়ে পান-বিড়ির দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনল বিলু। জ্বলন্ত দড়ি থেকে সিগারেট ধরিয়ে অভিকে বলল, ‘মাকে বলবি না কিন্তু!’
চোখ গোলগোল করে অভি বিলুর দিকে তাকাল। দাদা সিগারেট খায়? কই বাড়িতে কখনও দেখেনি তো! তার মানে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে নেশা ধরেছে! অভি মনে মনে ঠিক করে নেয়, বাড়ি গিয়েই মা অরুণার কানে তুলতে হবে। বাবা মনোজের কানে তুললে তো মার খেয়ে মরে যাবে!
অভি-বিলুর বাবা মনোজ লাহিড়ী রাইটার্স বিল্ডিং-এর ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের আপার ডিভিশন ক্লার্ক। অভি অনেকবার মনোজের সঙ্গে মহাকরণে গেছে। সাহেবদের তৈরি বাড়ির ব্যাপারই আলাদা। উঁচু উঁচু সিলিং, মোটা মোটা থাম, লম্বা চওড়া জানলা-দরজা, রান্নাঘরের মতো বড় লিফট। তার সঙ্গে রয়েছে বোলতার চাকের মতো ঝুল, কার্পেটের মতো পুরু ধুলো, মাহুতের মতো উঁচু ফাইলের স্তুপ।
মনোজ লাহিড়ী জনমোর্চা পার্টির সক্রিয় কর্মী। জনমোর্চা গত সাতাশ বছর ধরে সরকার চালাচ্ছে। অন্যান্য সব দফতরের মতো ফিনান্স ডিপার্টমেন্টেও জনমোর্চার ইউনিয়ন। মনোজ তার কালচারাল সেক্রেটারি। ডিপার্টমেন্টে একটা নাটকের দল আছে। নাম, ‘জীবন সংগ্রাম’। রিহার্সাল আর কল শো নিয়ে মনোজ সারা বছর ব্যস্ত থাকেন।
বিলুর সিগারেট ফোঁকা শেষ। হাফটাইমও খতম। দুই ভাই দুদ্দাড়িয়ে সিনেমা হলে ঢুকল। ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা এইবার আছে।
জীবন সংগ্রামের রিহার্সাল চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনোজের রাত নটা বেজে যায়। চান করে, ফ্রেশ হয়ে, পাজামা পাঞ্জাবি পরে দোতলার বসার ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করেন মনোজ। অভির কাজ হল দোতলার ফ্রিজ থেকে হুইস্কির বোতল আর টক-ঝাল-মিষ্টি চানাচুর এনে দেওয়া। হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে জনমোর্চার দলীয় মুখপত্র ‘জনমত’ পড়েন মনোজ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত, জয়েন্ট এনট্রান্সের জন্য পড়াশুনা করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়ে বসার ঘরের বুক শেলফ ঘাঁটত অভি। কালো চামড়ায় বাঁধানো ‘কমপ্লিট ওয়র্কস অব স্ট্যালিন’, লাল-সাদা প্রচ্ছদের ‘লেনিন রচনাবলী’, ‘অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন’-এর তিন খন্ড, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’, ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’, রাশিয়ান প্রবন্ধের ইংরিজি অনুবাদের বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই। বইগুলোর মলাটে ধুলোর পাতলা আস্তরণ পড়েছে। জ্ঞানত মনোজকে কখনও বইগুলো পড়তে দেখেনি অভি। এইরকম একটা লোক কালচারাল সেক্রেটারি হয় কী করে?
যদিও, একথা সত্যি যে মনোজের সূত্রেই বইপত্রে আগ্রহ অভির। ছোটবেলায় পুজোর সময়ে মনোজের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরোত সে। প্যান্ডেলের পাশে লালশালু দিয়ে তৈরি জনমোর্চার স্টলে বসে মনোজ কমরেডদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। দুয়েকটা ‘সোভিয়েত দেশ’-ও কিনতেন। অভি কিনত ‘পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার’, ‘উভচর মানুষ’, ‘গল্প আর ছবি’, ‘সাগরতীরে’। ননী ভৌমিকের অনুবাদে সেই সব অসামান্য শিশুসাহিত্য পড়ে গ্রন্থপ্রীতি জন্মায় অভির। এখনও বইগুলো চিলেকোঠার আলমারিতে রাখা আছে। চিলেকোঠায় অভির নিজস্ব লাইব্রেরিতে রাশিয়ান বইয়ের পাশাপাশি অন্য বইয়ের সংখ্যা পরবর্তীকালে বেড়েছে। ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকার সুবাদে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই তার স্টকে অনেকদিন ধরে আছে। আছে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন, রূপসী বাংলা, ধূসর পাণ্ডুলিপি। ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন জুড়ে উপহার পাওয়া এইসব বই অভি কখনও উল্টেও দেখেনি। কবিতার বই আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে হয়, এইরকম ধারণা ছিল। রাশিয়ান শিশু সাহিত্যের পাট চুকিয়ে অভি তখন গোগ্রাসে গিলত সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা আর পরাশর বর্মা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাধু কালাচাঁদ, শিবরামের হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, ইনিড ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভ বা সিক্রেট সেভেন, টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, ইন্দ্রজাল কমিকস। মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হওয়ার পরে বিলু অভির কবিতার বই নিয়ে টানাটানি শুরু করে। বিরক্ত হয়ে অভি বলেছিল, ‘মড়া কাটার সময় ছড়াও কাটতে হয় বুঝি?’
বিরক্ত বিলু শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার একটা পাতা খুলে বলেছিল, ‘এটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়। নিজের মতো করে।’
অভি পড়েছিল। ধীরে ধীরে, ছন্দ ধরতে গেলে যে ভাবে সন্তর্পণে এগোতে হয়, সেই ভাবে।
‘যুবতী কিছু জানেনা, শুধু প্রেমের কথা বলে
দেহ আমার সাজিয়েছিল প্রাচীন বল্কলে।’
‘বল্কলে’ শব্দটিকে ‘বল’ আর ‘কলে’—এই দুই ভাগে ভেঙে দিতে পেরে জিভ যেন কানকে আরাম দিয়েছিল। অভি পড়েছিল,
‘আমিও পরিবর্তে তার রেখেছি সব কথা
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি আগুন, প্রবণতা।’
‘যাহ! ফোট!’ ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বগলদাবা করে তরতরিয়ে নেমে গিয়েছিল বিলু। অভি তখন আপন মনে আওড়াচ্ছে, ‘আমিওপরি, বর্তেতার, রেখেছি সব, কথা। শরীরভরে, দিয়েছিঢেলে…নানা…ঢেলেদিয়েছি, আগুনপ্রব, ণতা’। শরীর ভরে ঢেলে দেওয়া আগুনের চিত্রকল্প অভির লিঙ্গোত্থান ঘটিয়েছিল।
সেই থেকে শব্দ আর অক্ষর, যতিচিহ্ন আর স্পেস, অর্থ আর অনর্থ অভিকে সম্মোহিত করে রেখেছে। কবিতা ও গদ্যপাঠ চলছে সমান তালে। নাইন টেন ইলেভেন টুয়েলভের ঘাম ঝরানো লেখাপড়ার বাইরে যাবতীয় পত্রিকার পুজোসংখ্যা বেরনো মাত্র পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে আদি থেকে অন্ত পড়ে ফেলেছে। গপপো, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি—কিছুতে অরুচি নেই।
তিনতলার চিলেকোঠার লাইব্রেরিতে বই বাড়ছে। আগামিকাল থেকে আরও বাড়বে। শেয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিট পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। বই কিনে কলেজ স্ট্রিট ফাঁকা করে দেবে অভি।
‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ শুরু হয়েছে। অডিয়েন্সের তালি, সিটি আর চিৎকারে কিছু শোনা যাচ্ছে না। লিলুয়ার বিজলি কোয়ার্টারের বিহারি ছেলেগুলো চেয়ারের ওপরে উঠে নাচছে, জামা খুলে ওড়াচ্ছে, ঝনঝন করে পয়সা ফেলছে। মালাইকা অরোরার পতলি কোমরের ঠুমকা আর তিরছি নজরের আহ্বানে সবাই প্রচণ্ড উত্তেজিত।
আগামিকাল কলেজ শুরু হওয়া নিয়ে অভির কোনও উত্তেজনা নেই। কারণ ডাক্তারি পড়ার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। যাদবপুর ইউনিভারসিটির কমপ্যারেটিভ লিটারেচার আর প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরিজিতে অনার্সের ফর্ম নেট থেকে ডাউনলোড করেছিল। সেটা দেখে বিলু মাকে খবর দিয়েছে। এ-ফোর সাইজের কাগজ দুটো খ্যাঁসখ্যাঁস করে ছিঁড়ে অরুণা বলেছিলেন, ‘মেডিক্যাল এনট্রান্সে একশো সত্তর র্যাঙ্ক করে ধাষ্টামো হচ্ছে? বড় হয়ে ডাক্তার হবে না মোক্তার, সেটা তোর বাবা-মা ঠিক করবে। তুই না।’
তথাস্তু! অভি মেনে নিয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও অপশন নেই। একসময় শঙ্খ ঘোষ যাদবপুরে পড়াতেন। ওখানকার ছেলেমেয়েরা ‘শঙ্খদা’কে ‘স্বয়ং খোদা’ বলে। সেই ‘স্বয়ং খোদা’ রিটায়ার করেছেন। তা সত্ত্বেও যাদবপুর ইউনিভারসিটি মানে স্বর্গ। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর থেকে গ্র্যাজুয়েশান করার পরে সেন্ট স্টিফেন্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান—এই প্ল্যান কবে থেকে ছকা আছে! কিন্তু, এখন সব শেষ। স্বর্গ হইতে বিদায়।
ডাক্তারি পড়ার প্রথম বছরটা অভির দাদা বিলু বাড়ি থেকে যাতায়াত করেছিল। শিয়ালদা তেমন কিছু দূর নয়। বেলুড় থেকে বাসে করে বালিঘাট স্টেশনে আসতে সময় লাগে দশ মিনিট। ডানকুনি লোকালে শেয়ালদা পৌছতে লাগে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ শিয়ালদা স্টেশন থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। সব মিলিয়ে বড় জোর একঘণ্টার মামলা। সমস্যা একটাই। ডানকুনি লাইনে ট্রেনের সংখ্যা ভীষণ কম। প্রতি ঘণ্টায় একটা। কখনও কখনও দেড় ঘণ্টা। যার ফলে ট্রেনে অসহ্য ভিড় হয়। তাছাড়া ট্রেনের টাইম টেবিল মেনে কলেজে ক্লাস হয় না। দেরিতে ক্লাসে পৌঁছনো আর ভিড়ের অজুহাত দিয়ে বিলু হোস্টেলে চলে গিয়েছিল। প্রথম দিকে সপ্তাহে দু’বার বাড়ি আসত। সপ্তাহান্তে আর সপ্তাহের মাঝখানে। এখন শনিবার রাতে এসে সোমবার ভোরবেলা চলে যায়। অরুণা বলেন, ‘প্যাখনা গজিয়েছে।’ মনোজ বলেন, ‘কলকাতার হাওয়া গায়ে লেগেছে।’
সিনেমা শেষ। চুলবুল রবিন হুড পান্ডের সঙ্গে রাজজোর বিয়ে হয়ে গেল। ক্রেডিট টাইটেল রোল করছে। পাবলিক এখনও সিট ছেড়ে উঠছে না। ক্ষীণ আশা, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা আবার দেখাবে।
মোবাইলে সময় দেখে অভি। সন্ধে ছটা বাজে। এতদিন তার মোবাইল ছিল না। ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার পরে মনোজ কিনে দিয়েছে। সিনেমা হল থেকে বেরোল দু’জনে। হলের গায়েই লিলুয়া স্টেশন। অভিদের বাড়ি বেলুড়ে। সেটা লিলুয়ার পরের স্টেশন।
স্টেশনে উঠতে না উঠতে ব্যান্ডেল লোকাল চলে এল। বাড়ি ফেরা অফিসযাত্রীর ভিড়ে কামরা থইথই করছে। তাদের মধ্যে কোনওরকমে নিজেকে গুঁজে দিল অভি। বিলুও উঠে পড়েছে। দরজার হাতল ধরে হাওয়া খাচ্ছে আর পাশের যাত্রীর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছে।
এক মিনিটের মধ্যে বেলুড় স্টেশন। ট্রেন থেকে নামল প্রচুর যাত্রী। দুই ভাইও নেমে পড়ল। প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার পরে, রেল লাইন টপকে দু’জনে স্টেশন রোডে চলে এল। দোকান থেকে সিগারেট কিনে সেটা ধরিয়ে বিলু আবার বলল, ‘মাকে বলবি না কিন্তু। এবার বলে দিলাম।’
‘বাড়ি ফিরেই বলছি।’ হেস্তনেস্ত করার ভঙ্গিতে বলল অভি।
‘এখন আমি শুধু আর তোর দাদা নই। কলেজের দুব্যাচ সিনিয়র। আগামিকাল সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা র্যাগিং করতে এলে বাঁচাব না। তখন বাপের নাম খগেন হয়ে যাবে।’
‘মেডিক্যাল কলেজেও র্যাগিং হয়?’ আঁতকে ওঠে অভি।
‘র্যাগিং বলা হয় না। ইন্ট্রো বলা হয়। কিন্তু কেসটা এক। কালকে বুঝবি।’ দোকানদারকে বিলু বলে, ‘দুটো কোলা দেখি।’
দোকানদার দুটো বোতল এগিয়ে দিল। বোতলে চুমুক দিয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিলু বলে, ‘তা হলে, ফাইনাল ডিসিশন কী হল?’
কোলায় চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে অভি বলে, ‘ঠিক আছে। বলব না।’
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে স্টেশান রোড ধরে জিটি রোডের দিকে এগোচ্ছে। রিকশার প্যাঁকপ্যাঁকানি, চাউমিনের স্টল থেকে চিলি চিকেনের গন্ধ, তেলেভাজার দোকানির ‘পেঁয়াজি শেষ হয়ে গেল’, ‘তেলেভাজা ফুরিয়ে গেল’ চিৎকার, ফুচকাওয়ালার সামনে মেয়েদের লাইন, ওষুধের দোকানের সামনে ব্যাজার মানুষের ভিড়, ম্যাক্সির দাম নিয়ে বউদিদের সঙ্গে হকারের গলাবাজি—সব মিলিয়ে স্টেশন রোড জমজমাট। এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে, জিটি রোডের বাস-মিনিবাস, লরি-ট্রাক, টেম্পো-ট্যাক্সির নাছোড়বান্দা ট্র্যাফিক জ্যাম টপকালে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা একটি রাস্তায় পৌঁছনো যায়। সেই রাস্তার নাম পান্নালাল রাস্তা। বিলু বলে, ‘কোনও রাস্তার নামে যে ”রাস্তা” শব্দটা থাকতে পারে, সেটা হাওড়ায় না জন্মালে জানা হতো না। ম্যাপে কত কিছু থাকে। হাইওয়ে, রোড, স্ট্রিট, লেন, অ্যাভিনিউ, সরণি, বীথি, গলি। কিন্তু রাস্তা? বাপের জন্মে শুনিনি।’
জিটি রোড আসার আগে সিগারেট শেষ করে বিলু বলল, ‘আগামিকাল কলেজ যাওয়ার জন্যে আমার সঙ্গে বেরোলেও একসঙ্গে কলেজে ঢুকবি না।’
‘কেন?’ রাস্তা টপকাতে টপকাতে প্রশ্ন করে অভি।
‘শাটাপ,’ পান্নালাল রাস্তা ধরে হাঁটছে বিলু। রাস্তার দুদিকে অজস্র গাছ। রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কদম, বকুল, জারুল, দেবদারু। এই পাড়ায় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির হিড়িক এখনও শুরু হয়নি। দোতলা, তিনতলা মধ্যবিত্ত বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এই রাস্তার ওপরে অভি-বিলুর বাড়ি। নাম লক্ষ্মী নিবাস। সামনে একফালি বাগান। সেখানে দোপাটি, গোলাপ, অপরাজিত, ঝাউ, নাইন ও ক্লকের রংবাজি। গেটের মাথায় বুগেনভেলিয়ার ঝাড়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একশো পা হাঁটলেই গঙ্গা।
লক্ষ্মী নিবাসের গেট খুলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে বাড়িতে ঢুকল দু’জনে। লক্ষ্মী নিবাসের দোতলায় বসার ঘর, রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, মনোজ-অরুণার শোওয়ার ঘর, বিলুর শোওয়ার ঘর, গেস্টরুম। তিনতলার চিলেকোঠায় অভি থাকে। একতলায় একগাদা ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ছোট দুটো ঘরে থাকে রাধা আর মানদা। দুই কাজের লোক।
রাধা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং চরিত্র। বেঁটে, ফরসা, মাথার কদমছাঁট চুল ধবধবে সাদা। সাদা শাড়ি পরে, ব্লাউজ পরে না। বছর ষাটের মহিলার মাথার ব্যামো আছে। নিজের মনে বিড়বিড় করে। ইংরিজিতে লম্বা লম্বা চিঠি লেখে। মাঝে মধ্যেই মাসখানেকের জন্য বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে যায়।
অরুণার কাছে অভি শুনেছে, রাধার বাড়ি ছিল বরিশালের অশথতলা গ্রামে। দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হয়ে নতুন দেশে আসার সময়ে ওর স্বামী মারা যায়। রাধা ধর্ষিতা হয়। তারপর থেকে ও পাগলাটে ধরনের।
রাধার মেয়ে ছায়ার বিয়ে হয়ে গেছে। সে সোনারপুরের দিকে থাকে। রাধা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কেউ চিন্তা করে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তখন সে ছায়ার কাছে আছে।
রাধা কীভাবে লক্ষ্মী নিবাসে এসে পৌঁছল, এ বিষয়ে অরুণা কিছু জানেন না। বিয়ের পর থেকেই তিনি রাধাকে এই বাড়িতে দেখছেন। মনোজও মুখ খোলেন না। চারবেলা খাওয়াদাওয়া আর থাকার বিনিময়ে বাড়ির কাজ করে দেয়। বেশি অতীত জেনে লাভ কী?
মানদা সম্পর্কে বিলু বলে, ‘মেয়েটা কেমন যেন!’ শুনে অরুণা আর মনোজ মুচকি হাসেন।
মানদার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। মাথায় একঢাল কালো চুল, গলার আওয়াজ বাজখাঁই। লম্বাচওড়া চেহারা। সাজতে খুব ভালোবাসে। কালো চেহারায় একগাদা পাউডার মেখে, জবাকুসুম তেল দিয়ে টানটান করে চুল আঁচড়ে, মাথায় লাল-নীল ফিতে বেঁধে, ঝলমলে শাড়ি পরে থাকে। রাধার মতো সেও এই বাড়ির পুরনো বাসিন্দা। কোথা থেকে এসেছে, এই নিয়ে অরুণা বা মনোজ মুখ খোলেন না। বিলু অবশ্য মানদার ব্যাকগ্রাউন্ড জানে। সে অভিকে বলেওছে। সবটা শুনে বিলু বুঝতে পারে, কেন অরুণা আর মনোজ চুপ করে থাকেন।
একতলায় ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। টপাটপ সিঁড়ি টপকে দুই ভাই দোতলায় এল। মনোজ টিভিতে স্কুপ চ্যানেলে খবর শুনছেন। অরুণা রান্না করছেন। দুই ছেলেকে দেখে বললেন, ‘হাত-মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বোস। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’
নতুনগ্রাম নামে এক পঞ্চায়েত এলাকায় আন্তর্জাতিক হেলথ হাব খোলার জন্য সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণ নিয়ে চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছে। জনমোর্চা পার্টির সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্ত সাংবাদিক সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। নতুন তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল ‘নবযুগ পার্টি’-র প্রধান মৃন্ময় চ্যাটার্জি টিভির আলোচনাচক্রে সেই সিদ্ধান্তকে তুলোধোনা করছেন।
‘যত্তোসব ছেঁদো কথা!’ রিমোট টিপে চ্যানেল বদলান মনোজ, ‘এরা ভুলে গেছে যে খোদ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এইসব ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা’। কিসসু জানবে না, পড়বে না, খালি ছাগলের মতো চ্যাঁচাবে! ভুঁইফোঁড় পার্টিগুলো কীভাবে যে গজায়, কে জানে? এর পেছনে আমেরিকার ফান্ডিং আছে।’
‘রবি ঠাকুর আবার কবে থেকে তোমাদের পছন্দের লোক হল?’ ডাল সাঁতলাতে সাঁতলাতে প্রশ্ন করেন অরুণা, ‘তিনি তো বুর্জোয়া কবি।’
‘যা বোঝো না তাই নিয়ে কথা বোলো না। ডাল রাঁধছ, সেটা মন দিয়ে করো।’ মনোজ স্কুপ চ্যানেলে ফেরত যান।
বিলু দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। তিনতলার খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে অভির মনে হল, কাল কলেজের প্রথম দিন। যাদবপুর ইউনিভারসিটি নয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ নয়, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে বইয়ের তাক থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কোথাকার তরবারি, কোথায় রেখেছে!’ বইটা পাড়তে গিয়ে অভির চোখে পড়ে যায় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। পাতা উল্টোতে উল্টোতে সে খুঁজে পায় প্রিয়তম কবিতা, ‘আট বছর আগের একদিন’।
বহুবার পড়া কবিতাটি আরও একবার পড়তে পড়তে আপন মনে হেসে ফেলে অভি। শ্লেষের হাসি। পাঠকের মুড অনুযায়ী কবিতার কত রকম মানে যে বেরোয়! গলা খুলে অভি পড়ে, ‘শোনা গেছে লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে।’
অ্যানাটমির ডিসেকশন রুমে কালই একবার উঁকি দেবে নাকি? কবিতার এই পংক্তি তো তাকে নিয়ে লেখা!
.
বৃন্দা
শান্তিধাম। এস আর দাস রোডে, রবীন্দ্র সরোবরের গায়ে সাদা রঙের চারতলা প্রাসাদ। রাত নটার সময়ে পাঁচিলঘেরা, লোহার গেট লাগানো প্রাসাদের সামনে জনাপঞ্চাশ মানুষের ভিড়। এস আর দাস রোডে দাঁড়িয়ে একাধিক দেশি-বিদেশি গাড়ি। ফুটপাথে সিগারেট ফুঁকছে চিন্তিত মানুষজন।
লোহার গেটটি খোলা। শান্তিধামের ভিতরে ‘ধূমপান নিষেধ’ বলে ধূমপায়ীরা বাইরে পায়চারি করছেন। যাঁদের এই বদভ্যাস নেই, তাঁরা গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা রিসেপশনের সোফায় বসে রয়েছেন ডক্টর সমীরণ ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করার জন্য।
স্যামি ব্যানার্জি। এমবিবিএস (ক্যাল), এমএস (ক্যাল) এফআরসিএস (এডিনবরা), গোল্ড মেডালিস্ট। শান্তিধাম নার্সিং হোমের প্রাণপুরুষ স্যামির নেমপ্লেটে এত কথা লেখা রয়েছে। যা লেখা নেই তা হল, বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করার জন্য তিনি অগ্ন্যাশয়ের কর্কট রোগে শল্য চিকিৎসার ভূমিকা নিয়ে যে থিসিস পেপার লিখেছিলেন, তা নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকেও আদর্শ থিসিস পেপার হিসেবে ওই দেশে পড়ানো হয়।
স্যামি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির বিভাগীয় প্রধান। চাকরির দায়বদ্ধতার পরে শান্তিধামের প্রধান। পঞ্চাশ শয্যা বিশিষ্ট নার্সিং হোমটিতে শুধু শল্য চিকিৎসার রোগীরা ভরতি হয়। কিছুদিন আগে স্যামি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন ক্যান্সার সেন্টার থেকে খাদ্যনালির ক্যান্সারের শল্য চিকিৎসার বিশেষ কোর্স করে এসেছেন। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ক্যানসার সার্জারি নিয়মিত করলেও শান্তিধামে শুরু করেননি।
শান্তিধাম অর্থবানদের জন্য। এখন এখানে ভরতি আছে টালিগঞ্জের নামকরা অভিনেত্রী চন্দ্রিমা সেন। অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাইশ বছরের চন্দ্রিমা ওটিতে ঢোকার আগে পঞ্চাশ বছর বয়সি স্যামিকে অনুরোধ করেছিল, ‘পেটে যেন সেলাইয়ের দাগ না থাকে। পরের ছবিতে বিকিনি পরতে হবে।’
চন্দ্রিমা আজ বাড়ি ফিরবে। তার তলপেটের ডানদিকে একটা ছোট সেলাইয়ের দাগ আছে। বিকিনি পরলে সেই দাগ ঢাকা পড়ে যাবে। কেতাবি ভাষায় একে বলা হয় ‘বিকিনি ইনসিশন’ বা ‘বিকিনি ক্ষত’।
স্যামির আর একটা বড় পরিচয় তাঁর বন্ধুগোষ্ঠী। শল্য চিকিৎসক হওয়ার ফলে ডাক্তার সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অফুরন্ত। শল্য চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘অ্যাসিকন’-এর তিনি প্রেসিডেন্ট, সর্বভারতীয় জার্নালের সম্পাদক। কিন্তু ওগুলো কেজো পদ, কেজো সম্পর্ক। কলকাতার নামকরা কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁর আসল বন্ধু। ঔপন্যাসিক বিপিন দত্ত, কবি সুদিন চক্রবর্তী, ফিল্ম মেকার মনোতোষ ঘোষ রাত ন’টার পরে গুটিগুটি জড়ো হন শান্তিধামে। সমীরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারটি বদলে যায় স্যামিজ বারে। উপনিষদ থেকে ফ্রয়েড, মার্কস থেকে ফেলিনি, জেমস জয়েস থেকে শাকিরাকে নিয়ে আলোচনা করতে করতে এখানে মদ্যপান হয়।
ঔপন্যাসিক বিপিন ও কবি সুদিন মদের পিপে। মনোতোষও কম যান না। কিন্তু এঁরা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। দশ পেগ ভদকা চড়াবার পরে পা না টলিয়ে বাড়ি চলে যান। সমস্যা হয় স্যামির। রাত্তিরে শান্তিধামের কলবুক থাকলে ‘রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার’ বা ‘আরএমও’ কুনাল রায় সামলে দেয়। তাও কখনও সখনও উঠতে হয়। ঘুম ভালো না হওয়ার কারণে পরদিন হ্যাংওভার থাকে। হাসপাতালের চেয়ারে সম্প্রতি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন স্যামি।
এই স্যামিই ছাত্রদের সার্জারি পড়ানো শুরু করার আগে বলেন, ‘সার্জারি মিনস ইউজ অব বোথ হ্যান্ডস। শব্দটার এটিমোলজি ঘাঁটলে দেখা যাবে উৎসে অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন এবং গ্রিক শব্দ। যার মানে ”ডান বাই হ্যান্ড”। বাংলায় ”সব্যসাচী” বলে একটা শব্দ আছে। সব্যসাচীর অর্থ, যার ডান ও বাঁহাত সমান ভাবে চলে। সব্যসাচীর ইংরিজি হল ”অ্যাম্বিডেক্সট্রাস”। সার্জারি তাই। আমার কাছে, একই সঙ্গে ডান এবং বাঁ হাতের খেলা।’
আরএমও কুনাল রায় চন্দ্রিমার ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে রেখেছিল। মেয়েটা নিজের ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দোতলার কেবিনে বসে কুনালের সঙ্গে গল্প করছিল। পাশে দাঁড়িয়ে শান্তিধামের মেট্রন তাপসী নস্কর। স্যামি কেবিনে ঢুকে বললেন, ‘চলো চন্দ্রিমা, তোমায় নিচে ছেড়ে দিয়ে আসি।’
‘চলুন।’ নিজের ব্যাগ স্যামির হাতে গছিয়ে চন্দ্রিমা বলে, ‘আমার ভারী জিনিস বওয়া বারণ। আপনিই বলেছেন।’
মেট্রন তাপসী নস্কর হাঁহাঁ করে ব্যাগ নিতে আসছিল। স্যামি মুচকি হেসে বললেন, ‘নো প্রবলেম।’ লিফটের দরজা খুলে বললেন, ‘লেডিজ ফার্স্ট।’
‘বাববাহ! কী শিভালরাস! আপনার বয়স কুড়ি বছর কম হলে আপনাকে বিয়ে করতাম।’ লিফটের দরজা বন্ধ হতে বলল চন্দ্রিমা।
‘আমি কুড়ি বছর আগে যা যা পারতাম, এখনও সে সব পারি। কয়েকটা জিনিস বেশি ভালো পারি।’ চন্দ্রিমার চোখে চোখ রেখে বলেন স্যামি।
‘দেখুন, আমি আপনার থেকে দশ বছরের সিনিয়ার একজনের সঙ্গে শুয়েছি। ফিফটি প্লাস লোকজন কী পারে আর কী পারে না, এ নিয়ে আমার পরিষ্কার ধারণা আছে। আমি বলতে চেয়েছিলাম, ইউ আর নট মাই কাপ অফ টি।’
‘শুয়েছ মানে? তোমার হাজব্যান্ড বিশাল কপুরই তো ষাটের কাছাকাছি।’ একতলায় লিফট পৌঁছলে দরজা খুলে বলেন স্যামি। বাইরে দুজন প্রেস ফোটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে রয়েছে। একজন বলল, ‘ম্যাডাম, একটা ফোটো।’
‘জাস্ট আ সেক!’ স্যামির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে চন্দ্রিমা শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে স্যামির হাত ধরে হাসিমুখে বলে, ‘আমি বিশালের কথাই বলছি। হি ইজ ফ্যান্টাস্টিক ইন বেড। বম্বেতে ওর বউ-বাচ্চা আছে। ওর ছেলে ভিকি কপুর আমাকে মা বলে ডাকে। কিন্তু হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে দ্বিতীয় বউ মানে ‘কেপ্ট’। ও সব ভাবলে চলে না। আপনাদের ফোটো হল?’ শেষ বাক্যটি ফোটোগ্রাফারের উদ্দেশে বলা।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম।’ বিনয়ী হেসে সরে যায় দুই ফোটোগ্রাফার।
‘তা হলে বিয়ে করলে কেন?’ অবাক হয়ে বলেন স্যামি।
ফক্সভাগেন গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে ড্রাইভার। পিছনের সিটে বসার আগে চন্দ্রিমা বলে, ‘ওটা প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। বিশাল কপুর বলিউডের এক্স হিরো। বলিউড কানেকশানের জন্য ওকে পাকড়েছি। আমার যা লাইফস্টাইল, সেটা বাংলা ছবি করে উঠবে না। বিয়ে অথবা হোরশিপটাকে ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রকল্প হিসেবে ধরতে পারেন।’
চন্দ্রিমার কথা শেষ হতেই গাড়ির দরজা বন্ধ করে ড্রাইভার ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়। নিখুঁত চক্কর কেটে গাড়ি শান্তিধাম থেকে বেরিয়ে যায়।
যাঁরা ভিতরে বা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা এতক্ষণ স্যামির কাছে ঘেঁষেননি। এঁরা কলকাতার বিত্তশালী সম্প্রদায়। সিনেমা তারকা দেখে লাফালাফি করা এঁদের স্বভাব নয়। চন্দ্রিমা চলে যাবার পর সবাই একে একে রিসেপশনে জড়ো হল। এখন স্যামি রোগীদের সম্পর্কে বাড়ির লোকদের খোঁজখবর দেবেন। কে ভালো আছে, কার অবস্থা আগের থেকে খারাপ হল। কাকে কাল ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে—এইসব।
বছর চল্লিশের রোগাপাতলা কুনাল রিসেপশানে নেমে এসেছে। সাড়ে পাঁচফুট লম্বা, চোখে বাইফোকাল চশমা, সুস্বাস্থ্য ও একমাথা কোঁকড়া চুলের অধিকারী কুনালের বাড়ি জগদ্দলে। স্ত্রী ও কন্যা সেখানে থাকে। কুনাল সপ্তাহান্তে একবার বাড়ি যায়। সার্জারিতে হাউসস্টাফশিপ করার পরে কুনাল এমএস করে উঠতে পারেনি। শান্তিধামের আরএমও হয়ে এতদিন কাটিয়ে দিল। চল্লিশে এসে আর কোনও রিস্ক নেবে না। এখানেই থেকে যাবে।
কুনালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেট্রন তাপসী। তার বাড়ি নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাঁজাপলাশ গ্রামে, হেলথ সেন্টারের পাশে। তাপসী আর স্যামি সমবয়সি। তবে তাপসীকে অনেক বুড়ি লাগে। শান্তিধামের ম্যানেজমেন্ট চালায় কুনাল আর তাপসী। রোগীদের যাবতীয় তথ্য এদের ঠোঁটের ডগায়।
গত দু’দিনে দশটি অপারেশন হয়েছে। বাড়ির লোককে রোগীর সাম্প্রতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে সময় লাগল একঘণ্টা। দশটা নাগাদ শান্তিধাম ফাঁকা হল। এসআর দাস রোডে আর কোনও গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। রিসেপশন ফাঁকা। স্যামি কুনালকে বললেন, ‘অতঃকিম?’
‘আমি শুতে চললাম। কাল দুপুরে বাড়ি যাব। এখন তোমার কী প্ল্যান?’
‘আমি একটু চেম্বারে বসব,’ সামান্য চিন্তা করে স্যামি বললেন, ‘কাল দুপুরে বাড়ি যাবে? আচ্ছা, যাও।’
‘প্রত্যেক সপ্তাহেই তো যাই। শনিবার হাসপাতালে তোমার কোল্ড ডে। দুটোর মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে।’
তাপসী মাঝখান থেকে বলল, ‘কাল বৃন্দার কলেজের প্রথম দিন। স্যার বোধহয় পুরো সময় কলেজে থাকতে চাইছেন।’
‘ওঃ হো!’ কপাল চাপড়ায় কুনাল, ‘বৃন্দা কি তোমার সঙ্গে কলেজে যাবে? তাহলে আমি তোমার ফেরা অবধি থেকে যাচ্ছি।’
‘এখনও কোনও কথা হয়নি। আজকালকার মেয়েরা কেমন হয়, সে তো জানো!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যামি বলেন, ‘তুমি দেরিতে বাড়ি যাবে এই রকম মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে রাখো। তেমন হলে সোমবার বাড়িতে কাটিয়ে মঙ্গলবার সকালে এসো। প্ল্যান চেঞ্জ হলে আমি কাল সকালে জানিয়ে দেব।’
‘সোমবার বিকেলে তিনটে গল ব্লাডার অপারেশান আর তিনটে হার্নিয়া অপারেশান রাখা আছে।’ কড়া গলায় বলে তাপসী। ‘কুনাল স্যার না থাকলে অ্যাসিস্ট কে করবে?’
‘ওফ! তুমি ঠাকুরমার ঝুলি এবার বন্ধ করো।’ হাত জোড় করে কুনাল।
‘তা হলে কী খুলব? ঠানদিদির হলে?’ মুচকি হেসে বলে তাপসী।
‘বাপরে! ইনকরিজিবল!’ কুনাল লিফটের দিকে দৌড়োয়। সে দিকে একপলক দেখে তাপসী স্যামিকে বলে, ‘আপনার বন্ধুরা অনেকক্ষণ বসে আছেন। ওঁদের এবার যেতে বলুন।’
‘কেন?’ গম্ভীর গলায় বলেন স্যামি।
‘সেটা আপনি ভালো করে জানেন। আমি ভালো করে জানি। মন্দিরাও ভালো করে জানে। জ্ঞানপাপী সেজে কোনও লাভ আছে?’ তড়বড় করে সিঁড়ির দিকে এগোয় তাপসী।
মন্দিরা মানে স্যামির স্ত্রী। বৃন্দার মা। আটের দশকের ডাকসাইটে অভিনেত্রী। সমীরণকে বিয়ে করে অভিনয় জগৎ থেকে পুরোপুরি সরে আসেন। নব্বই দশকের পরে তাঁর কোনও ছবি মুক্তি পায়নি।
রিসেপশানের বিশাল বেলজিয়ান গ্লাসে নিজেকে মেপে নেন স্যামি। ছ’ফুট লম্বা, অ্যাথলেটিক চেহারা। পঞ্চাশ পেরিয়েও ভুঁড়ি হয়নি। কেন না স্যামি লেকে নিয়মিত রোয়িং করেন। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের তিনি পুরনো মেম্বার। এ ছাড়া সপ্তাহে তিনদিন জিম করেন। আরমানির স্যুটে ব্যক্তিত্ব ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাথা ভরতি চুল সঠিক মাত্রায় নুন মরিচ, পুরু গোঁফেও তাই। পড়াশুনার সময় ছাড়া স্যামি চশমা ব্যবহার করেন না। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে খুশিই হলেন। কপিবুক চিকিৎসকের চেহারা। এই চেহারা দেখেই মজেছিলেন মন্দিরা।
মন্দিরা আদতে নবদ্বীপের মেয়ে। ফরসা, ডল পুতুলের মতো দেখতে। চিত্রপরিচালক মনোতোষ ঘোষের ‘বেপাড়ার মেয়ে’ ছবিতে বারবণিতার চরিত্রে অভিনয় করে বিরাশি সালে তাঁর আত্মপ্রকাশ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রচুর পুরস্কার জিতে নেয়। সেরা ছবি হিসেবে ভারতেও ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়। জনগণ ছবিটি খুব পছন্দ করেছিল। ‘বেপাড়ার মেয়ে’ পঞ্চাশ সপ্তাহ পার করেছিল। পরবর্তী ছ’বছরে মন্দিরা ন’টি ছবিতে অভিনয় করেন। শেষ ছবি ‘অচেনার ডাক’-এর পরিচালকও মনোতোষ।
মন্দিরার সঙ্গে স্যামির আলাপ মনোতোষের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। আলাপ এবং প্রেম। বাংলা গানের লিরিক উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘কিছুতেই পাই না ভেবে, কে প্রথম ভালোবেসেছিল। তুমি না আমি।’
স্যামি সদ্য বিলেত ফেরত। যৌবন গমগম করছে শরীরে। মন্দিরা ডগমগ করছেন সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যে। আগুন ও ঘি পরস্পরকে জ্বালিয়ে দিল। মন্দিরা নিজের কেরিয়ার ছেড়ে, আর কোনও ছবি না করে গৃহবধূ হয়ে গেলেন।
বৃন্দার জন্ম উনিশশো বিরানব্বই সালে। বাবা ও মায়ের যাবতীয় গুণ তার মধ্যে বর্তেছে। সে লম্বা, ফরসা, সুন্দরী। একমাথা রেশমের মতো চুল। ঈষৎ ফোলা গালে এখনও বেবি ফ্যাট। ঠোঁট দুটো কমলালেবুর কোয়ার মতো। হাসলে গালে মিষ্টি টোল পড়ে। পড়াশুনায় বৃন্দা আগাগোড়া ব্রিলিয়্যান্ট। মডার্ন হাই স্কুল থেকে বারো ক্লাস পাস করে, মেডিক্যাল এনট্রান্সে চান্স পেয়ে কলকাতার এক নম্বর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি না হয়ে ইন্ডিয়ান মেডিকাল কলেজ বেছে নিয়েছে, কেন না তার বাবা এই কলেজের সার্জারির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। আগামিকাল বৃন্দার কলেজ জীবনের প্রথম দিন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে স্যামি চেম্বারের দিকে এগোলেন। চারতলা শান্তিধামের একদম ওপরের তলা ব্যানার্জি পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট। মাস্টার বেডরুম, বৃন্দার নিজস্ব ঘর, দুটো বড় গেস্ট রুম, দুটো কিচেন, ফুটবল মাঠের মতো ড্রইং রুম, টেরেস গার্ডেন, মন্দির—সব মিলিয়ে এলাহি ব্যবস্থা। তিনতলায় আরএমও আর সিস্টারদের কোয়ার্টার, নার্সিংহোমের কিচেন ও স্টোর রুম। দোতলায় অপারেশান থিয়েটার, রিকভারি রুম, ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট, পেশেন্টের কেবিন ও ডরমিটারি। একতলায় রয়েছে স্যামি এবং অন্য সার্জেনদের চেম্বার, ফার্মাসি, রেডিওলজি এবং প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট, ওয়েটিং রুম, রিসেপশান। অন্য সার্জনরাও শান্তিধামে রোগী ভরতি রেখে অপারেশন করেন।
স্যামির চেম্বারটি রাজকীয়। বড় ঘরের একপ্রান্তে ঘোড়ার খুরের মতো টেবিলের ওপারে বসেন স্যামি। এপারে বসে রোগী ও তাঁর বাড়ির লোক। রোগী দেখার জন্য এক্সামিনেশন বেড পাতা আছে। একদিকের দেওয়ালে অজস্র সার্টিফিকেট ও মানপত্র ঝুলছে। উল্টোদিকের দেওয়ালে যামিনী রায়ের একটি পেইন্টিং। অন্যান্য সময়ে এই ঘরে চড়া আলো থাকে। আপাতত আলো-আঁধারি। সুদিন, মনোতোষ ও বিপিন বড় এক বোতল হুইস্কির অর্ধেক শেষ করে এনেছেন। মনোতোষ এক্সামিনেশান বেডে চিত হয়ে শুয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে গান গাইছেন আর সুদিন টেবিলে তাল ঠুকছেন। স্যামিকে দেখে বিপিন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এটা আসার সময় হল? আমরা কতক্ষণ বসে আছি জানিস?’
টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা গেলাসের অর্ধেক হুইস্কি ভরতি করে, বরফ ঠেসে স্যামি বললেন, ‘আজ চন্দ্রিমা সেনের ছুটি হল।’
‘উফ! গুরু! তোমার হাতটা দাও!’ সুদিন লাফিয়ে উঠে স্যামির হাতে চুমু খেলেন।
‘চন্দ্রিমার জিনিসপত্তর কেমন রে?’ এক চুমুকে গেলাস শেষ করে বোতল থেকে ঢকঢক করে হুইস্কি ঢেলে প্রশ্ন করেন বিপিন।
‘নাথিং স্পেশাল। দে আর অল দ্য সেম আন্ডার ক্লোদ।’ মাছি তাড়ান স্যামি। ‘হ্যাঁ রে বিপিন, নতুন কী লিখছিস?’
‘আবার লেখালেখির কথা কেন?’ এক মুঠো বাদাম মুখে দিয়ে বিপিন বলেন, ‘আমি লেখক নই, টেখক।’
‘মানে?’ জানতে চান মনোতোষ।
‘চাকরি করি ”আজ সকাল” খবরের কাগজের রবিবারের পাতায়। যার বিভাগীয় সম্পাদক আমাদের সুদিন। সাংবাদিকতার কাজ মানে বিজ্ঞাপনের ফাঁক ভরানো। ”সব রাঁধুনির মনের কথা এমপি গুঁড়ো মশলা”-র বিজ্ঞাপন আর ”ঢালাইয়ের গোড়ার কথা মহারাজ সিমেন্ট”-এর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে যে স্পেস আছে, সেটার জন্য হাজার শব্দের মেটিরিয়াল লাগবে। বিষয়, ”বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ”। ”দুষ্টুমিতে ভরা বুলবুলি ব্রা” আর ”গুন্ডামিতে ভরা বিশাল জাঙিয়ার” বিজ্ঞাপনের ফাঁকে যে স্পেস আছে সেটার জন্য আটশো শব্দের লেখা লাগবে। বিষয়, ”বাংলার মিষ্টি”। নামিয়ে দিই। একে কি লেখা বলে? এ হল ”টেখা”। আর আমি হলাম ”টেখক”। ওসব বাদ দে।’
‘বাংলার মিষ্টি বলতে বাংলা সিনেমার নতুন হিরো দুটোর কথা মনে পড়ল। দেখেছিস? পুরো রসগোল্লা আর পান্তুয়া।’ টিপ্পনি কাটেন মনোতোষ।
‘তা তুমি বাবা একটা সেন্সিবল সিনেমা বানাও না। শুয়ে শুয়ে বাতেলা করে, মদ খেয়ে আর বড় বড় বুকনি ঝেড়ে কতদিন চলবে?’
বিপিন চেয়ার থেকে উঠে মনোতোষের হাত থেকে খালি গ্লাস নিয়ে বলেন, ‘ ”আমার বিধবাপুকুর” উপন্যাসটা গত পুজোয় শারদীয়া ”আজ সকাল”-এ বেরোনোর দিন বিকেলবেলা ফোন করে বললি, আমি যেন লেখাটা কাউকে না দিই। নয়া পয়সা না ঠেকিয়ে চিত্রসত্ত্ব বগলে পুরে বসে আছিস। সেটা নিয়ে ছবি কর। ওর যে প্রট্যাগনিস্ট, ওই যে, কী যেন নাম, মাঝবয়সি বেধবা মাগিটার…’
‘বোঝো কারবার! ঔপন্যাসিক তার চরিত্রের নাম ভুলে গেছে।’ ফোড়ন কাটেন সুদিন।
‘আমি কি বাংলা ভাষার অধ্যাপক নাকি যে নিজের লেখা সব চরিত্রের নাম মুখস্থ রাখব?’ দাঁত খিঁচিয়ে বিপিন বলেন, ‘মনে পড়েছে। বেদানা দাসি। ওই বেদানার বেদনা নিয়ে ছবি কর। পিরিয়ড পিস। বহুবিবাহের পটভূমি। জমবে ভালো। নে, মাল খা।’
বিপিনের হাত থেকে ভরতি গেলাস নিয়ে উঠে বসে মনোতোষ বলেন, ‘ছবি করতেই পারি। প্রোডিউসারও আছে।’
‘তা হলে আর দেরি কেন?’ নেশাগ্রস্থ গলায় বিপিন বলেন, ‘তুই ছবিটা বানিয়ে ফেল। চন্দ্রিমা সেনকে বেদানা দাসির রোল দে।’
‘মাঝবয়সি বিধবার রোলে চন্দ্রিমাকে মানাবে না।’ অন্যমনস্কভাবে গেলাসে চুমুক দেন মনোতোষ, ‘তা ছাড়া ওর বিউটিটা বড্ড আরবান। ভোলেভালা, গ্রাম্য, ঢলোঢলো সৌন্দর্যওয়ালা মাঝবয়সি নায়িকা একজনই আছে। সে না করলে ওই ছবি আমি করব না।’
‘কের্যা? তোর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যাটি কে?’ সুদিনের নেশা হয়ে গেছে।
‘স্যামি, তোর বউকে আবার অ্যাক্টিং করতে দিবি?’ মনোতোষ প্রশ্ন করেন।
‘মন্দিরা?’ গ্লাসের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করেন স্যামি, ‘সেটা আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছিস? ওকে জিজ্ঞাসা কর। আমি তো কখনও মন্দিরাকে অ্যাক্টিং করতে বারণ করিনি। বিয়ের পর ও নিজে থেকেই সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে। এখনও নিয়মিত টিভি সিরিয়াল আর যাত্রার অফার আসে। রাজি হয় না।’
‘সেন্সিবল লোকজন ভাঁড়ামো করতে রাজি হবে না এটাই স্বাভাবিক।’ হাতের গ্লাস ঠক করে টেবিলে রেখে মনোতোষ বলেন, ‘তুই একবার কথা বলে দেখ। আমার স্ক্রিপ্ট রেডি আছে। দরকার হলে একদিন এসে মন্দিরাকে শোনাব। রাজি হলে ভালো। রাজি না হলে ”বিধবাপুকুর” আমি করব না। বেদনা দাসীর চোখের যে বর্ণনা বিপিন লিখেছে, আর আমি যেভাবে ভিশুয়ালাইজ করেছি—তাতে মন্দিরা ছাড়া অন্য কারও মুখ মাথায় আসে না।’
সুদিন কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বললেন, ‘এগারোটা বাজে। আমি যাব সেই বরানগর। এত রাতে কোনও ট্যাক্সি যেতে চায় না।’
‘আমার গাড়িতে তোকে শেয়ালদা পর্যন্ত ছেড়ে দিতে পারি।’ বিপিন প্রস্তাব দিলেন।
‘উপন্যাসের রয়্যালটির টাকায় রোয়াবি হচ্ছে? জানিস, তুই কবি সুদিন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলছিস? আজ থেকে তিরিশ বছর বাদে যার লেখা কবিতা বাঙালি পাঠক অল্পবিস্তর বুঝতে পারবে।’
‘তার মানে দু’হাজার চল্লিশ সালে?’ আঙুলের কড় গুণে বিপিন বলেন, ‘শব্দের গতিবেগ আলোর থেকে কম। লিখিত শব্দের গতি কচ্ছপের থেকেও কম দেখছি।’
হাহা করে হাসতে হাসতে বিপিন আর মনোতোষ চেম্বার থেকে বেরোলেন। অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে তাদের ধাওয়া করেছেন সুদিন। গেটের পাশে বেঞ্চিতে বসে দারোয়ান-কাম-ড্রাইভার সুলতান সিং ঝিমোচ্ছিল। মালিকের বন্ধুদের দেখে তড়াক করে উঠে সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল।
মনোতোষ বেনেপুকুরে থাকেন। তিনি নিজে গাড়ি চালান। বিপিন থাকেন বেলেঘাটার রানি রাসমণি বাজারে। তাঁর ড্রাইভার আছে। সুদিন বিপিনের গাড়িতে উঠলেন। দুটো গাড়ি বেরিয়ে যাবার পরে মুচকি হাসলেন স্যামি। বিপিন সুদিনকে বরানগরে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে বেলেঘাটা ফিরবেন। যদি না দুজনে কোনও চুল্লুর ঠেকে আটকে পড়েন। বাইরে যতই ঝগড়া করুক না কেন, দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।
সুলতান গেট বন্ধ করে দিয়েছে। রিসেপশান ফাঁকা। লিফট করে স্যামি চারতলায় উঠে এলেন। বসার ঘরে বৃন্দা টিভিতে আমেরিকান সিরিয়ালের রি-রান দেখছে।
‘খাবি না?’ প্রশ্ন করেন স্যামি।
‘খাব।’ সংক্ষিপ্ত জবাব বৃন্দার।
‘মা কোথায়?’
‘খাবার টেবিলে।’ টেলিভিশন থেকে চোখ না সরিয়ে উত্তর দেয় বৃন্দা।
‘আমি পোশাক বদলে আসছি। তুই আয়।’ মেয়ের চুল ঘেঁটে বাথরুমে ঢুকে যান স্যামি। স্নান করে, পাজামা পাঞ্জাবি পরে খাবার টেবিলে বসেন। চেয়ারে বসে গত বছরের পুজো সংখ্যা ‘আজ সকাল’ পড়ছিলেন মন্দিরা। পত্রিকা চেয়ারে রেখে বললেন, ‘লুচি আর পাঁঠার মাংস করেছি।’
পোর্সোলিনের থালায় গরম গরম লুচি আর বাটিতে মাংস এগিয়ে দেন মন্দিরা। একটা বড় থালায় টমেটো, পেঁয়াজ আর শসা কেটে স্যালাড বানানো রয়েছে। সেটাও এগিয়ে দেন। নিজের জন্য একটা লুচি আর এক পিস মাংস নিলেন।
‘আর নেবে না?’ কচকচ করে পেঁয়াজ চিবিয়ে জানতে চাইলেন স্যামি।
‘না।’ খাবার খুঁটতে খুঁটতে শারদীয় হাতে তুলে নিয়েছেন মন্দিরা। বৃন্দা টুকটুক করে এসে স্যামির পাশে বসেছে। নিজেই মাংস আর লুচি নিল। পত্রিকা রেখে মন্দিরা বললেন, ‘বৃন্দা কলেজে যাতায়াত করবে কীভাবে? তোমার গাড়িতে?’
এক টুকরো মাংস মুখে ফেলে স্যামি বললেন, ‘কলেজে নানারকমের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছেলেমেয়েরা আসে। চাষার ছেলে, মজুরের ছেলে, কেরানির মেয়ে, মন্ত্রীর মেয়ে। প্রথম দিন থেকেই গাড়ি করে কলেজে যাওয়া উচিৎ না। মেলামেশায় অসুবিধে হয়। বৃন্দা আমার সঙ্গে বেরোবে। আমি ওকে মৌলালিতে নামিয়ে দেব। বাকিটা হেঁটে কলেজে ঢুকবে। কয়েকদিন এইরকম চলুক। রুট চেনা হয়ে গেলে বাসে যাতায়াত করবে।’
‘ও কি পারবে? কখনও তো বাস-টাসে চড়েনি…’ কিন্তু কিন্তু করেন মন্দিরা।
‘পারব।’ বৃন্দা বলল।
‘সেকেন্ডলি,’ আর একটা লুচি মুখে পুরে স্যামি বৃন্দাকে বললেন, ‘কলেজে কখনও বলবি না যে তুই সার্জারির এইচওডি-র মেয়ে। বিভিন্ন সাবজেক্টের টিচার বা ইউনিয়নের ছেলেরা প্রথম দিন এসে কী নাম, কোন স্কুল—এই সব জিজ্ঞাসা করবে। তোর র্যাঙ্ক দেখে জানতে চাইবে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে না গিয়ে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে কেন এলি। নিজের মতো উত্তর দিবি। আমাকে টানবি না।’
‘আচ্ছা।’
‘কেন? তোমার নাম বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?’ খাওয়া শেষ করে বলেন মন্দিরা। কাজের লোক ঝুনুর মা এসে থালা তুলে নিয়ে যায়।
‘অ্যাডভান্টেজ নেওয়া হবে। সিনিয়র বা ব্যাচমেটরা ওর সঙ্গে সহজভাবে মিশবে না। এনিওয়ে, ওসব বাদ দাও। বৃন্দা, তুই শুতে যা। কাল সাড়ে আটটায় বেরোব।’ বেসিনে মুখ ধুলেন স্যামি। শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মন্দিরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে অ্যান্টি-রিঙ্কল ক্রিম লাগাচ্ছেন। খাটে শারদীয়া ‘আজ সকাল’ পত্রিকা রাখা রয়েছে।
‘এত মন দিয়ে কী পড়ছ?’ গাবদা পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেন স্যামি।
‘তোমার বন্ধু বিপিন দত্ত একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। নাম ‘বিধবাপুকুর’। সাধুভাষায় লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস দেখে এতদিন হাত দিইনি। আজ পড়তে বসে আটকে গেলাম। অসাধারণ উপন্যাস।’
‘তাই? ইন্টারেস্টিং নাম তো!’ পত্রিকা হাতে নিয়ে বলেন স্যামি। ‘এই কাগজটা মায়া কমিউনিকেশানস থেকে বেরোচ্ছে না? বিবস্বান সান্যাল যার মালিক?’
‘আমি অত জানি না বাবা। লেখকের নাম জানি। মালিকের খবর রাখি না।’ মুখে ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলেন মন্দিরা। একটু পরে ফুরফুর আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন বুকের ওপরে পত্রিকা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন স্যামি। পুজোসংখ্যা পড়ার জন্য রিডিং গ্লাস পরেছিলেন। সেটা নাকে আটকে রয়েছে। ঠোঁটদুটো আধখোলা। সেখান দিয়ে বাতাস বেরিয়ে ফুরফুর আওয়াজ করছে।
স্যামির চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন মন্দিরা। বুক থেকে বই সরিয়ে টেবিলে রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অ্যাই! সোজা হয়ে শোও। আমার শোওয়ার জায়গা দখল করে নিয়েছ।’
স্যামি গভীর কোহলঘুমে আচ্ছন্ন।
‘মা! একবার আসব?’ বাইরে থেকে বৃন্দা বলে।
বন্ধ দরজা খুলে মন্দিরা বলেন, ‘কী হল রে?’
‘বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে?’ ইতস্তত করে বৃন্দা।
‘কেন রে? কলেজের প্রথম দিন বলে টেনশান হচ্ছে?’ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খাটের একপাশে বসালেন মন্দিরা।
‘বাবা সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। আমার ক্লাস দশটা থেকে শুরু। অত আগে বেরিয়ে আমি কী করব?’
‘কাল সকালে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে নিবি। এখন ঘুমিয়ে পড়।’ মন্দিরা মতামত দিলেন। মায়ের সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বৃন্দা।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে বিছানার কাছে এসে মন্দিরা দেখলেন, স্যামি ভব্যিযুক্ত হয়ে খাটের একপাশে শুয়ে। নাক আর ডাকছে না। মশারি গুঁজে স্বামীর পাশে শুয়ে তিনি আলো নিবিয়ে দিলেন। শারদীয়া ‘আজ সকাল’ পত্রিকার কথা তাঁর আর মনে নেই।
পুজো সংখ্যাটি আপাতত স্যামির বালিশের তলায় রাখা রয়েছে।
.
চন্দন
ভোর চারটের সময় সূর্যদেব ঘুম থেকে ওঠেননি। তারার আলো আর জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে রূপনারায়ণের জল। এত ভোরেও অনেক মানুষ স্নান সারছেন স্টিমারঘাটে। অধিকাংশই বয়স্ক এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। চন্দনের মতো উনিশ বছরের ছেলে একজনও নেই।
রূপনারায়ণে এখন ভাঁটা। জলে টান নেই। সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে জল তেমন ঠান্ডাও নয়। গুপগুপ করে গোটাকয় ডুব দিয়ে নদীর পাড়ে বসল চন্দন। তার মা পারুল নতুন সাবান দিয়ে বলেছেন ভালো করে মাখতে। ধুঁধুলের ছোবড়াও দিয়েছেন গা ঘষার জন্য।
শুকনো গামছা ঘাটে রেখে সিঁড়িতে বসল চন্দন। মোড়ক খুলে সবুজ রঙের সাবান গায়ে ঘষতে লেবু লেবু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। আহ! কী আরাম!
বাড়িতে বরাবর হাফপ্যান্ট পরে থাকে চন্দন। স্যামিলটন হাই স্কুলে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত হাফপ্যান্ট পরেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হাফপ্যান্ট পরে দিয়েছে। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষাও।
জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার দিন সকালে প্রথমবার ফুলপ্যান্ট পরে চন্দন। কুঁচকির কাছে সুড়সুড়ি লাগছিল। জয়েন্ট এনট্রান্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার দিন পোশাক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাবে না। আবার হাফপ্যান্ট গলিয়েছিল সে।
ভাগ্যিস গলিয়েছিল! সুড়সুড়ি নিয়ে পরীক্ষা দিলে মেডিক্যালের মেরিট লিস্টে তার পঁচানব্বই র্যঙ্ক হতো? উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হতো সে?
পরীক্ষার পর থেকে ফুলপ্যান্ট পরা অভ্যাস করছে চন্দন। এখন ব্যাপারটা সড়োগড়ো হয়ে গেছে। তবে জাঙিয়া পরতে অসুবিধে হয়। প্যান্টের নীচে ঢলঢলে পপলিনের আন্ডারউইয়্যার বা হাফপ্যান্ট পরে চালিয়ে দেয়। কিন্তু কলকাতার হোস্টেলে ওই সব পরলে গাঁইয়া বলবে। ওখানে হাল ফ্যাশানি জিনিস পরতে হবে।
মাঠে হাল চালিয়ে, বীজ ছড়িয়ে, শ্যালোর জলে চান করে, টিউব ওয়েলের হ্যান্ডেল টিপে টিপে চন্দনের চেহারাটি হয়েছে ছোট ভীমের মতো। সাড়ে পাঁচফুট হাইট। হাত, পা ও বুকের পেশি গুলিগুলি। বুক ভরতি বাড়াবাড়ি রকমের লোম। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। গোঁফদাড়ি গজানোর পরে তার বাবা পবন সরকার প্রথমবার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিলেন। তবে গোঁফটা রেখে দিয়েছিলেন। সেই গোঁফ এখনও রয়ে গেছে। রোদ্দুরে কাজ করে করে চন্দনের গায়ের রং কুচকুচে কালো। পারুল অপত্য স্নেহে বলেন, ‘কেষ্ট ঠাকুর!’
ধুঁধুল দিয়ে হাত, পা, বুক, মুখ, বগল ঘষে জলে ঝাঁপ দেয় চন্দন। পবন বলে দিয়েছেন, সাতটার মেচেদা লোকাল ধরবেন। তার জন্য বাড়ি থেকে ছ’টায় বেরোতে হবে। তার আগে বর্গভীমার মন্দিরে পুজো আছে। তমলুকের স্টিমারঘাটে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে গা ঘষতে থাকে চন্দন।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকে নানা গ্রন্থে তমলুকের উল্লেখ পাওয়া যায়। নানান নামে। যেমন তাম্রলিপ্ত, তাম্রলিপ্তি, তামালিপ্ত, তমোলিপ্ত, দামলিপ্ত। প্রাচীন তমলুকের নাম সম্ভবত দামলিপ্ত। অতীতে বাংলাদেশে দ্রাবিড় জাতির প্রাধান্য ছিল। দ্রাবিড়, তামিল, তামল বা দামলদের আবাস স্থল হিসেবে এই নাম। পরে আর্যরা এই অনার্য এলাকায় নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে নতুন নাম দেয় তাম্রলিপ্ত। এখানে বিশাল বন্দর ছিল। জাহাজ তৈরি হতো।
এই যে স্টিমারঘাট, এখানেই কি ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দর? যেখান থেকে বাংলার ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করেছিলেন? চন্দন জানে না। সে শুধু জানে, তমলুক থানার অন্তর্গত নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নিরুপদ্রব জীবনযাপন ছেড়ে সে কলকাতার জনসমুদ্রে ঝাঁপাতে যাচ্ছে। অস্ত্র বলতে মেধা। আর কিছু নেই।
পারবে না সে? ওই শহরকে জিতে নিতে?
সূর্যদেব মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছেন। ঘাটে স্নানার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ভিজে গামছা কোমরে জড়িয়ে, লেবু সাবানে হাতে নিয়ে চন্দন দৌড় লাগায়। তার বাবা-মা, পবন আর পারুল বর্গভীমার মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করছেন।
পবন হাওড়া কোর্টের করণিক। প্রতিদিন ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে নতুন গ্রাম থেকে বাস ধরে মেচেদা স্টেশন যান। সেখান থেকে ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশন। মিনিট দশেকের হাঁটাপথে হাওড়া কোর্ট।
কোর্টে চাকরি করার সুবিধে হল, লম্বা লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। সেই সময়ে প্যান্টশার্ট পরা কোর্টের ক্লার্ক পবনবাবু হেটোধুতি পরা পবনচাষি হয়ে যান। চন্দনকে নিয়ে আগাছা নিড়ানো, জমি তৈরি করা, শ্যালোর জল দেওয়া, এনড্রিন মারা চলতে থাকে।
পবনের বাড়িটি বেশ। মেচেদা-নতুনগ্রাম সড়কের ওপরে, বিজয় মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডের উল্টোদিকে, চৌমাথার বাসস্ট্যান্ড থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে গেলেই ‘আবাসবাড়ি’। হ্যাঁ, পবনের বাড়ির এটাই নাম। এইরকম কাব্যি করা নামের গোপন রহস্য হল, পবন অ্যামেচার সাংবাদিকতা করেন। স্যামিলটন হাইস্কুলের মাস্টারমশাই গোপাল নস্কর তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। মাস্টারির পাশাপাশি গোপাল একটা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। চারপাতার কাগজের নাম ‘বেলাকূল’। সেই কাগজের অবৈতনিক এবং আন-অফিশিয়াল সম্পাদক হলেন পবন। নিয়মিত খবর লেখা ছাড়াও বিজ্ঞাপন জোগাড় করা, ডিটিপি করা, ছবি বাছা, পাতা সাজানো, প্রেসকে ম্যাটার পাঠানো, প্রেস থেকে কাগজ আনা, জেলার দশটা পয়েন্টে কাগজ ডিসট্রিবিউশানের ব্যবস্থা করা—সবটাই পবন দেখেন।
বেলাকূলের জন্যে পবন প্রচুর সময় দেন। লেখেন অনেক। পড়েন তারও বেশি। বাংলা ও ইংরিজি সংবাদপত্র পড়ে তার থেকে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও রাজ্যের খবর বেছে নিয়ে স্থানীয় রুচি অনুযায়ী সাজাতে হয়। জেলার খবর বড় করে দেওয়া বাধ্যতামূলক। উচ্চমাধ্যমিকে চন্দন ফার্স্ট হওয়ার পরে সেই খবর গত সংখ্যার বেলাকূলের প্রথম পাতায় ছবিসহ ছাপা হয়েছে। কাগজটার সার্কুলেশান এক হাজার থেকে বারোশোর মধ্যে থাকে। গত সংখ্যাটি রিপ্রিন্ট করতে হয়েছে।
এডিটোরিয়াল পলিসি ঠিক করা আর সম্পাদকীয় লেখা ছাড়া গোপাল কাগজের জন্যে আর কিছু করার সময় পান না। শিক্ষকতার বাইরে অতিবাম রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি নামের একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের তিনি রাজ্য সেক্রেটারি। এদিকে পবন সরকারপন্থী জনমোর্চা পার্টির গণ সংগঠনে চাঁদা দেন। নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্ত বনধ ডাকলে কোর্টে না গিয়ে বাড়িতে চাষের কাজ করেন। বিরোধী নেতা মৃন্ময় চ্যাটার্জি বনধ ডাকলে কোর্টে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও তড়বড় করে মেচেদা লোকালে ওঠেন।
গোপালের ধাঁচ অন্য। সম্পাদকীয়তে ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ ছাড়া অন্য বিষয়ে আলোচনাই করবেন না। ‘কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ’কে ধিক্কার জানাবেন না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটালিজম নিয়ে কথা বলবেন না! ঘুরে ফিরে সেই চাষিদের আত্মহত্যা, পাট্টা বিলি নিয়ে জনমোর্চার দুর্নীতি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে দলবাজি, মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্তর ঔদ্ধত্য—এইসব নিয়েই লিখে যাবেন।
নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাঁজাপলাশ গ্রামে গোপালের বাড়ি। গ্রামের একপ্রান্তে, সমুদ্রের ধারে। দোতলা বাড়িটির চারিদিকে পাঁচিল ঘিরে দুর্গ বানিয়ে রেখেছেন গোপাল।
গোপাল বিয়ে করেননি। তাঁর বোন তাপসী নস্কর পেশায় সেবিকা। সে কলকাতার নার্সিংহোম শান্তিধামে চাকরি করে। ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি আসে। কাজেই গোপালের বাড়িতে আর কারও থাকার কথা নয়। অথচ গোপালের বাড়িতে সবসময় জনাদশেক ছেলেমেয়ে থাকে। তারা হিন্দি বা দক্ষিণ ভারতীয় কোনও একটি ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে। বাংলা প্রায় জানেই না। তারা কারা, আন্দাজ করতে পারেন পবন। তবে কখনও এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।
পবনের বউ পারুলের মতো জেদি এবং একগুঁয়ে মহিলা কম দেখা যায়। করণিকবৃত্তি, চাষের কাজ ও সাংবাদিকতার নামে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ত্রিমুখী আক্রমণের সামনে সংসারের হাল একা ধরে রেখেছেন ছোটখাটো চেহারার এই মহিলা। বাড়ির হাজারটা সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত পারুলের সবচেয়ে বড় সমস্যার সাইজ খুব ছোট। সমস্যাটির নাম নন্দন। তাঁর বড় ছেলে।
নন্দন বামন। বাইশ বছর বয়সে তার উচ্চতা তিনফুট। হাত-পা ছোট ছোট। তুলনায় মুখটা বেঢপ বড়। চোয়াল সামনের দিকে এগোনো। বুদ্ধি অবশ্য স্বাভাবিক। দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনোর পরে স্যামিলটন হাইস্কুলে সহপাঠীদের অত্যাচারে সে ইশকুলে টিকতে পারেনি। নতুনগ্রামেও সে খোরাকের পাত্র।
বাঁজাপলাশ গ্রামের ঘরে ঘরে বামন। জেলে-সম্প্রদায় অধ্যুষিত গ্রামটিতে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটি থেকে একাধিক রিসার্চ হয়েছে শুধু এইটা জানতে, যে এই ছোট্ট গ্রামে এত বামন কেন? কিন্তু নন্দন তো আর বাঁজাপলাশ গ্রামে থাকে না! তার বাড়ি নতুনগ্রামে। এখানে সে একা। বাঁজাপলাশের বামনদের সঙ্গে সে মেশে না। পারুল মিশতে দেন না। বিজয় মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে প্রতি বছর শীতকালে সার্কাস আসে। বাঘ-সিংহর ওঠাবসা বা সিলমাছের নাকে বল ব্যালান্স করা—এই সব খেলা এখন উঠে গেছে। চোখ বেঁধে ট্রাপিজ, এক চাকার সাইকেল চালাতে চালাতে রাশিয়ান মেয়েদের কাপডিশ লোফালুফি—এই সবের খেলার মধ্যে ক্লাউনদের হট্টগোল থাকে। মুখে রং মেখে, নাকে লাল বল লাগিয়ে, মাথায় শঙ্কু আকারের টুপি চড়িয়ে, ববি প্রিন্টের পোশাক পরে তারা লোক হাসায়। সকালবেলা দেখা যায় রাশিয়ান মেয়েরা আসলে নেপালি মেয়ে। রিংমাস্টার নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছে। ক্লাউনরা লুঙি পরা বামন। রোদে পিঠ দিয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছে।
এই বামনদের সঙ্গে নন্দনের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। যেভাবে একজন প্রান্তিক অন্য প্রান্তিকের সঙ্গে জোট বেঁধে ঘেটো তৈরি করে, সেভাবেই এদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পবন এবং পারুল পুরোটাই খেয়াল করেছিলেন এবং প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। পরিণতি যা হওয়ার তাই হল। সার্কাসের মালিক আপ্পারাও একদিন পবনকে সার্কাসের গেস্ট কার্ড দিতে এসে বলল, নন্দন সার্কাসে যোগদান করতে ইচ্ছুক। পবনের মতো আছে কি?
পবন-পারুল আপত্তি করেননি। নন্দনকে মানুষ করা নিয়ে বরাবরই সংশয় ছিল। বামন, স্কুলছুট ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুজনেই গোপনে চোখের জল ফেলেছেন। এ বরং শাপে বর। পাকাপাকি রোজগারের ব্যবস্থা হল। ‘দ্য গ্রেট অলিম্পিক সার্কাসে’ নন্দন জয়েন করে গেল। আপ্পারাও বলেছে, সার্কাসে অনেক বামন মেয়ে আসে। বামনদের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে, সন্তান উৎপাদন সবই হয়। সেই সব সন্তান বামন হয়, এমনটা নয়।
নন্দন সারা বছর দ্য গ্রেট অলিম্পিক সার্কাসের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। গরম আর বর্ষাকালে সার্কাস বন্ধ থাকে। তখন বাড়িতে আসে। নতুনগ্রামে এখন তার আলাদা খাতির। আবাসবাড়িতে আলাদা ঘর আছে। সেই ঘরে আছে মাপসই খাট, আলমারি, চেয়ার টেবিল। তারই উপার্জনের টাকায় সেসব কেনা হয়েছে।
নন্দন এখন নতুনগ্রামে বর্ষাকালের ছুটি কাটাতে এসেছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সেও বর্গভীমার মন্দিরে হাজির।
বর্গভীমা মন্দির সম্পর্কে বলা হয় এটি এগারোশো বছরেরও বেশি পুরনো। বিশ্বকর্মা এই মন্দিরের নির্মাণকার। বিষ্ণু যখন সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবী পার্বতীকে একান্ন টুকরো করে দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বাম গুলফ পড়েছিল এখানে। এই মন্দির একান্ন পিঠের এক পিঠ। যার অন্য নাম বিভাস। মন্দির সংলগ্ন একটি বিশাল পুকুর আছে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় সিনেমার সেট।
সেই মন্দিরের সামনে পবন, পারুল আর নন্দন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চন্দন ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘আমার দেরি হয়ে গেল?’
পবন কোনও কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে তড়বড় করে উঠে গেলেন পুরোহিতের খোঁজে। নন্দন ভাইকে বলল, ‘ভয় করছে?’
‘ভ্যাট!’ ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পারুলের দেওয়া ফতুয়া গলিয়ে নেয় চন্দন। ভিজে হাফপ্যান্টের ওপরে পায়জামা চড়ায়। হাওয়াই চপ্পল খুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে।
সংক্ষিপ্ত পুজো। মিনিট দশেকের মামলা। এখানে প্রতিমাটি কালির। তারারূপিণী দেবী বর্গভীমাকে প্রণাম করে, প্রসাদ নিয়ে চারজনে বেরিয়ে এল।
‘একটা রিকশা নিয়ে নেব?’ হাতঘড়ি দেখে চিন্তিত মুখে বলেন পবন, ‘পাঁচটা বাজতে যায়।’
‘বাবুয়ানি কোরোনি কো!’ স্বামীকে মুখঝামটা দিয়ে বাজারের সংকীর্ণ রাস্তা বেয়ে চৌমাথার বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোন পারুল। পিছন পিছন বাকি তিনজন।
আবাসবাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে চারদিকে চোখ বোলায় চন্দন। গত চার বছর, ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত, পড়াশুনার জন্য সে আলাদা ঘর পেয়েছিল। ছোট্ট, কিন্তু নিজের। একদিকে বইয়ের তাক। তাতে সারিসারি বই রাখা রয়েছে। ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত কোনও বই সে নষ্ট করেনি। খবরের কাগজের মলাট দিয়ে বছরওয়ারি সাজিয়ে রেখেছে। ইলেভেনে ওঠার পর পড়ার চাপ বেড়ে গিয়েছিল। স্যামিলটন স্কুলের টেক্সট বইয়ের বাইরে অনেক রেফারেন্স বই পড়েছে। গোপালস্যার বাবাকে বলে দিতেন আর বাবা কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনতেন। সেই সব বই আর কাজে লাগবে না।
পরীক্ষার এক মাস আগে থেকে সে ঘড়ি ধরে টেস্ট পেপার সলভ করেছে। দিস্তে কাগজ পরীক্ষার পাতার মাপে কেটে রাখতেন পারুল। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে, হাতমুখ ধুয়ে, দুধমুড়ি খেয়ে চন্দন টেস্ট পেপার সলভ করতে বসত। পারুল তিনঘণ্টা পরে পেপার নিয়ে নিতেন। সারাদিনে চারটে পেপার সলভ করত চন্দন। রাতে বাড়ি ফিরে খাতা দেখে নম্বর দিতেন পবন। সত্তর পার্সেন্টের কম কখনও পায়নি, পঁচাত্তর পার্সেন্টের বেশিও না। উচ্চ মাধ্যমিকে ওটাই দাঁড়িয়েছিল পঁচানব্বই পার্সেন্টে।
সেইসব সলভ করা উত্তরমালা থাকে থাকে সাজানো। মায়াভরে টেক্সট বই, খাতা, টেস্ট পেপার, রেফারেন্স বই, নোট, পেন্সিল রাখার বাক্সর ওপরে হাত বোলায় চন্দন। ফিশফিশ করে বলে, ‘সাবধানে থাকিস। কাল সন্ধেবেলাই আমি ফিরছি!’
‘ওরে, তোর হল? হুমগড়ের এক্সপ্রেস বাস সাড়ে ছ’টায় চৌমাথা পেরোয়। ওটা না পেলে লোকাল বাসে যেতে হবে। তা হলে আর মেচেদা লোকাল পাওয়া যাবে না। মেদিনীপুর লোকালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।’ দরজা থেকে হাঁক পাড়েন নন্দন। চন্দন শুনতে পায় পবন পারুলকে বলছেন, ‘এত বড় ট্রাঙ্ক আর মুড়ির টিন নিয়ে ট্রেনে ওঠা যাবে না। টিনটা থাক!’
‘তুমি থামো তো!’ চন্দনের হাতে কাঁসার থালায় দুধ-মুড়ি এগিয়ে দিয়ে পারুল বলেন, ‘নতুন জায়গায় যাচ্ছে। খেতে পাবে কি না ঠিক নেই। তুমি উল্টো না গেয়ে রেডি হয়ে নাও।’
কালো রঙের ট্রাঙ্কটা চন্দনের জন্যেই কেনা হয়েছে। ট্রাঙ্কের গায়ে পবন সাদা তেলরং দিয়ে লিখে দিয়েছেন, ‘চন্দন সরকার। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।’ লেখার দু’পাশে দুটো গোলাপ ফুল আঁকা রয়েছে।
হাপুশ হুপুশ করে দুধমুড়ি খেয়ে নেয় চন্দন। টেলারিং শপ থেকে কাটিয়ে আনা নস্যিরঙা প্যান্ট আর লাল-নীল চেক শার্ট পরে। নস্যি রঙা মোজা পরে নতুন বুটে পা গলায়। এই বুট পরে দু’দিন থাকতে হবে? বিরক্ত হয়ে চন্দন বলে, ‘মা, চপ্পল দিয়েছ?’
‘তিনজোড়া শার্টপ্যান্ট, তিনজোড়া জাঙিয়া-গেঞ্জি-মোজা, দু’জোড়া পাজামা-ফতুয়া, হাপ্প্যান্ট, গামছা, গায়ের চাদর, চপ্পল—সব দেওয়া আছে। তোষক আর বালিশ তোর বাপ দিতে দিল না। বলল, শিয়ালদায় সস্তায় পাওয়া যায়। এখন তো বলছে মুড়ির টিনও নেবে না।’ হরি মন্দিরে প্রণাম করতে করতে বলেন পারুল। মায়ের দেখাদেখি চন্দনও কপাল ঠেকায়।
‘পেন্নাম করে নে। কলকাতায় হরি মন্দির পাবি না। হরি মন্দির এখানকার কালচার। কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে ঠাকুর ঘরও থাকে না।’ টিপ্পনি কাটে নন্দন।
‘চ চ! অনেক হল।’ এক হাতে ট্রাঙ্ক নিয়ে তড়িঘড়ি আবাসবাড়ি থেকে বেরোয় পবন, ‘হুমগড়ের বাস আসতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।’
চারজনে মিলে বাড়ি থেকে বেরোয়। নতুনগ্রাম-মেচেদা সড়ক এখন ফাঁকা। রিকশা বা তিনচাকার ভ্যানের উপদ্রব শুরু হয়নি। লোকাল বাসের প্যাঁকপ্যাঁকানি শোনা যাচ্ছে না। ভোরে যারা হাঁটতে বেরোয় তারা ছাড়া জনমানব নেই। পুলিশ লাইনের ছোকরা পুলিশরা এই সময় দৌড়তে বেরোয়। তেমন একটা দল তাদের পেরিয়ে চলে গেল। নীল ট্র্যাক স্যুট আর কেডস পরা ছেলেগুলোকে দেখে চন্দনের মনে হল, ওইরকম একটা ট্র্যাক স্যুট থাকলে ভালো হতো। কলকাতায় নিশ্চয় পাওয়া যায়!
রাস্তা দিয়ে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে একজন বললেন, ‘কীরে পবন, এত সকালে?’ চন্দন দেখল, শক্তিধর মাইতি।
চন্দন শক্তিধরকে শক্তিকাকু বলে ডাকে। উনি বিশাল বড়লোক বাড়ির ছেলে। প্রচুর জমিজমা আছে। নতুনগ্রামের সবচেয়ে বড় গয়নার শো-রুম ‘মাইতি জুয়েলার্স’-এর মালিক। ওদের পুরো পরিবার আগে ‘জাতীয়তাবাদী পার্টি’-র কট্টর সমর্থক ছিল। সম্প্রতি রাজ্যস্তরের জনপ্রিয় নেতা মৃন্ময় চ্যাটার্জি ‘জাতীয়তাবাদী পার্টি’ ছেড়ে নতুন দল গঠন করেছে। নাম ‘নবযুগ পার্টি’। শক্তিধর নিখুঁত পালটি খেয়ে নবযুগ পার্টিতে যোগদান করেছেন। পবন বলেন, ‘নবযুগ নয়, ওটা ন্যাবাযুগ পার্টি। শক্তিধরের ন্যাবা হয়েছে।’
এখন অবশ্য ওইসব কথা বলার সময় নয়। শক্তিধরের প্রশ্ন শুনে পবন বললেন, ‘ছেলেটাকে কলেজ পৌঁছতে যাচ্ছি।’
‘আজ তা হলে কোর্টে যাচ্ছিস না?’ উত্তরের আশা না করে দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে যান শক্তিধর।
‘না। এক্কেবারে সোমবার।’ চেঁচিয়ে বলেন পবন।
বাস স্ট্যান্ডে জনাপাঁচেক যাত্রী দাঁড়িয়ে। বাক্সপ্যাঁটরা দেখে অনুমান করা যায়, এরা দূরপাল্লার যাত্রী। অফিসযাত্রীদের ভিড় শুরু হবে আরও পরে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পবন চা খাবার জন্য পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করছিলেন। পারুল বললেন, ‘বাস আসছে।’
সত্যিই তাই। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের পাশ দিয়ে কর্কশ এয়ারহর্ন বাজাতে বাজাতে আসছে হুমগড়গামী লালরঙা বাস।
কন্ডাক্টরের সাহায্য নিয়ে পবন বাসের খোলে ট্রাঙ্ক আর মুড়ির টিন ঢোকাচ্ছেন। পারুল চন্দনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সাবধানে যাবি।’
‘আচ্ছা।’ নিচু হয়ে মা আর দাদাকে প্রণাম করে চন্দন। নন্দন একটা পুঁচকে মোবাইল ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা রাখ। সিম কার্ড ভরে অ্যাক্টিভেট করা আছে।’
‘মোবাইল? নতুন?’ চোখ গোল করে চন্দন বলে, ‘কোত্থেকে পেলে?’
‘বেশি কথা বলিস না। রাখ!’ পুঁচকে কিন্তু তাগড়াই হাত দিয়ে চন্দনের পিঠ থাবড়ে দেয় নন্দন। ‘ওতে আমার আর বাবার নম্বর সেভ করা আছে।’
পবন মালপত্র রেখে সিটে বসে চ্যাঁচাচ্ছেন, ‘উঠে আয়। বাস ছাড়বে।’
পারুল আবার চন্দনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সাবধানে যাস। কাল বাবার সঙ্গে ফিরে আসিস।’
কোনওরকমে মায়ের বেড় থেকে নিজেকে মুক্ত করে বাসে উঠে চন্দন বলল, ‘কাল শনিবার। বাবার ছুটি।’
‘তা হলে?’ আঁতকে ওঠেন পারুল।
উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। লাল রঙের বাস একগাদা যাত্রী গিলে, পিলে চমকানো হর্ন বাজাতে বাজাতে মেচেদার দিকে ছুটে যাচ্ছে। চৌরাস্তার বাস স্ট্যান্ড এখন শুনশান। বামন বড়ছেলের হাত ধরে চোখের জল মুছতে মুছতে পারুল আবাসবাড়ির দিকে হাঁটা লাগালেন।
.
নতুনগ্রাম থেকে মেচেদা আসতে সময় লাগল আধঘণ্টা। ট্রাঙ্ক আর মুড়ির টিন চন্দনের জিম্মায় রেখে পবন দৌড় দিয়েছেন ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য। কাউন্টারের বাইরে লম্বা লাইন।
এমনটা নয় যে চন্দন আজ প্রথম কলকাতা যাচ্ছে। হাওড়া কোর্টে পবনের কাছে বহুবার গেছে। গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা গেছে বারপাঁচেক। তার মধ্যে একবার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হওয়ার জন্য। কিন্তু কলকাতায় কখনও একা রাত কাটায়নি। একটু ভয় করছে। পবন অবশ্য বলেছেন, আজ হোস্টেলের ব্যবস্থা না হলে ব্যাগপত্তর নিয়ে ফিরে আসবেন। আবার সোমবার যাবেন।
চন্দন বিরক্ত হয়ে ভাবল, শনিবারে কখনও কেউ কলেজে ভরতির দিন ফেলে?
টিকিট নিয়ে পবন হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘চল। মেচেদা লোকালের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে।’
‘তোমার টিকিট?’ জানতে চেয়ে জিভ কাটল চন্দন। পবনের মান্থলি কাটা আছে।
স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু হচ্ছে বলে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। সামনের কামরা ছেড়ে দ্বিতীয় কামরায় উঠে জানলার দিকের দুটো সিট নিয়ে বসে, ট্রাঙ্ক আর টিন সিটের তলায় ঢুকিয়ে পবন বললেন, ‘হাওড়ায় নেমেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়তে হবে। তাই সামনের দিকে বসলাম।’
আস্তে আস্তে কামরা ভরতি হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত। দাশনগর আর টিকিয়াপাড়ার লেদ মেশিন ফ্যাক্টারিতে শ্রমিকের কাজ করে। কামরায় বসেই বিড়ি ধরাল। চারজন সহযাত্রী জুটিয়ে টুয়েন্টি নাইন খেলতে বসে গেল।
কোলাঘাট স্টেশনে আর এক দঙ্গল লোক ওঠার পরে আর কোনও বসার জায়গা খালি রইল না। পরের স্টেশনগুলোয় শুধুই লোক উঠছে। কেউ নামছে না। কামরায় ঠাসাঠাসি ভিড়। দম আটকে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা!
আন্দুলের পর থেকে অবস্থা বদলাল। ট্রেন একটু একটু করে খালি হচ্ছে। সাঁত্রাগাছিতে চা-ওয়ালার কাছ থেকে দুভাঁড় চা নিলেন পবন। একটা ভাঁড় ছেলেকে ধরিয়ে অন্য ভাঁড় নিজে নিয়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আহ! ফাসক্লাস।’
চা খেতে খেতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে চন্দন। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে রামরাজাতলা, দাশনগর, টিকিয়াপাড়া। ট্রেন খালি হয়ে যাচ্ছে। এখন এই কামরায় ফেলে ছড়িয়ে জনাতিরিশেক লোক রয়েছে। এরা সবাই হাওড়া যাবে? তারপর নদী পেরিয়ে কলকাতা শহরে? এরা কি জানে যে তাদের সঙ্গে যাচ্ছে চন্দন সরকার? যে আজ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হতে যাচ্ছে?
‘ভ্যাবলার মতো বসে রয়েছিস কেন?’ পবনের ধমক খেয়ে চটকা ভাঙে চন্দনের। খালি ভাঁড় জানলা দিয়ে ফেলে দেখে, ট্রেন কারশেডে দাঁড়িয়ে।
‘প্ল্যাটফর্ম পায়নি।’ হাই তুলে পবন বলেন, ‘হাওড়া স্টেশনে থেকে ইস্টার্ন আর সাউথ ইস্টার্ন রেলের দুটো লাইন বেরিয়েছে। রেল লাইনের ওপর দিয়ে যেখানে জিটি রোড গেছে সেখানে একটা ব্রিজ আছে। ব্রিজটার নাম ”বাঙালবাবুর ব্রিজ”। ওই জায়গাটা ভীষণ সরু। ইংরিজিতে যাকে বলে ”বটল নেক”। অত সরু জায়গা দিয়ে বেশি লাইন পাঠানো যায় না। ব্রিজের আগে-পরে রেল ইয়ার্ডে প্রচুর জায়গা থাকলেও বটল নেকের জন্য সব ট্রেন এইখানে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। এই রুটিন হল্টকে ডেলি প্যাসেঞ্জাররা কী নামে ডাকে জানিস?’
‘না।’ ঘাড় নাড়ে চন্দন। হর্ন দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল।
‘হালুয়া। হাওড়া আর লিলুয়ার সন্ধি।’
‘হিঃহিঃ!’ হেসে ফেলে চন্দন।
‘হাওড়া আর টিকিয়াপাড়ার মধ্যেকার এই রুটিন হল্টেরও একটা ডাকনাম আছে। সেটা কী বল তো?’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও! বলছি।’ উত্তেজিত হয়ে বলে চন্দন, ‘হাকিয়াপাড়া। নানা! এটার কোনও মানে নেই। তুমি বলে দাও।’
‘সব সময়েই কি আর সন্ধি হয় রে!’ সিটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক আর মুড়ির টিন বার করে পবন বলেন, ‘বলা হয়, ”টিকিয়াপাড়া, একটু দাঁড়া”।’
‘দারুণ তো!’ চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্ম লাফিয়ে নেমেছে চন্দন।
‘আর কথা নয়। তাড়াতাড়ি চল। হাওড়া ময়দান-শিয়ালদার স্টেট বাস ধরতে হবে।’ হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে বলেন পবন। ‘পৌনে নটা বাজে। তোর ফার্স্ট ক্লাস দশটার সময়।’
চন্দন পবনের পিছনে দৌড় দেয়।
.
দময়ন্তী
দিল্লি-কলকাতা ফ্লাইটের দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর সময় সকাল সাড়ে আটটায়। কেন কে জানে, দমদমের আকাশে অকারণে চার-পাঁচবার চক্কর কেটে প্লেন টাচ ডাউন করল সওয়া নটার সময়। দময়ন্তী বসেছিল প্লেনের মাঝ বরাবর, আইল সিটে। প্লেন থামার আগেই সে সিটবেল্ট খুলে লফট থেকে হ্যান্ড লাগেজ পাড়তে শুরু করল। হাঁহাঁ করে দৌড়ে এল বিমানবালা। ‘ম্যাডাম, ইউ আর নট অ্যালাওড টু ওপন দ্য লফট হোয়াইল দ্য প্লেন ইজ রানিং।’
‘আই নো দ্যাট!’ খটাং করে লফটের দরজা নামিয়ে পিছনের দরজার দিকে এগিয়েছে দময়ন্তী।
উইনডো সিটে বসে থাকা দময়ন্তীর মা, শক্তিরূপা সেনগুপ্ত বললেন, ‘দিঠি, বিহেভ ইওরসেলফ।’
‘আই উইল। ইন দ্য ইভনিং।’ কাপড়ের ঝোলা কাঁধে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে দময়ন্তী।
মাঝখানের সিটে ধ্যানস্থ হয়ে বসে রয়েছেন ড্যানিয়েল আর্চার, দময়ন্তীর বাবা। শক্তিরূপা তাঁকে বললেন, ‘তোমার মেয়ে কীরকম অসভ্যতা করছে দেখো।’
চোখ না খুলে ড্যানিয়েল বললেন, ‘সন্ধেবেলা দেখব। ভারতীয় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে মেয়ে ফেরার পরে। এখন যা করছে ঠিক করছে। ওর প্রথম পাঠ সকাল দশটায় শুরু হবে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
‘ ”ক্লাস”-এর বাংলা ”পাঠ”? তোমার বাংলা শুনে আমিই মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।’ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়েছেন শক্তিরূপা।
‘হয়নি, না?’ লাজুক হেসে চোখ খোলেন ড্যানিয়েল।
প্লেনের সিঁড়ি মাটি স্পর্শ করেছে। মুখে যান্ত্রিক হাসি লেপ্টে দরজার সামনে নমষ্কারের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বিমানবালা। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে সবার আগে কলকাতার মাটিতে পা রেখেছে উনিশ বছরের দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার ওরফে দিঠি। উঠে পড়েছে বিমান কোম্পানির লোগো লাগানো ছোট্ট বাসে। বাবা-মা আসছে কিনা দেখার প্রয়োজনও বোধ করছে না।
দময়ন্তীর উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। সে ব্রিটিশ বাবার উচ্চতা পেয়েছে। সেই সঙ্গে পেয়েছে ব্রিটিশদের মতো ফ্যাকাশে ত্বকের রং। লম্বায় এবং চওড়ায় তাগড়াই হলেও মুখ মায়ের মতো। উঁচু হনু, সরু চিবুক, টিকোলো নাক। মাথা ভরতি কালো, ঢেউ খেলানো চুল। দময়ন্তী জানে সে সুন্দরী। রূপকে আড়াল করার জন্য সে কালো, মোটা ফ্রেমের কুচ্ছিত চশমা পরেছে। কাঁধে নিয়েছে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। পরেছে সালওয়ার কামিজ। যদিও লন্ডন বা নিউ দিল্লিতে জিনস-টি-শার্টেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ।
বাস ভরতি হয়ে গেল। দমদম বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক লাউঞ্জের চেক আউট পয়েন্টে বাসের প্যাসেঞ্জাররা নামল। সবার প্রথমে দময়ন্তী। কাচের দরজা পেরিয়ে, করিডোর বরাবর দৌড়ে, ছেলে ও মেয়েদের বাথরুম টপকে, কনভেয়র বেল্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাগেজসন্ধানী যাত্রীদের কাটিয়ে, কাচের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিআইএসএফ-এর জাঠ জওয়ানকে ডজ করে বাইরে বেরোল। এক ট্যাক্সি ড্রাইভার দেঁতো হেসে বলল, ‘আলিপুর ম্যাডাম?’
‘শিয়ালদা।’ পিছনের সিটে বসে, ঝোলা পাশে রেখে পরিষ্কার বাংলায় দময়ন্তী বলল, ‘পৌনে দশটার মধ্যে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে দিলে মিটারে যা উঠবে তার ডবল দেব।’
‘সক্কাল বেলা মা লকখি!’ ইঞ্জিনে চাবি দিয়ে, ক্লাচ টিপে, নিউট্রাল থেকে ফার্স্ট হয়ে সেকেন্ড গিয়ারে পৌঁছে যায় ড্রাইভার। শুনশান এয়ারপোর্টের রাস্তা দিয়ে শাঁশাঁ করে দৌড়ে, ভিআইপি রোডে পড়ে বিকট এক ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায়।
‘ফাঁক!’ দাঁত চিপে কিশকিশ করে বলে দময়ন্তী।
‘এখানে ফাঁক পাওয়া যাবে না লকখি ম্যাডাম। একটু ধৈযযো ধরতে হবে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ড্রাইভার।
.
প্লেন থেকে টুকটুক করে নামছেন শক্তিরূপা। পিছন পিছন ড্যানিয়েল। দুজন যাত্রী ড্যানিয়েলের দিকে কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অটোগ্রাফ প্লিজ।’
ড্যানিয়েলের বয়স পঞ্চাশ বছর। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতা। থলথলে চেহারা। চোখের মণির রং অ্যাকোয়া মেরিন ব্লু। চুলে পনিটেল। পরনে ঢোলা পাজামা ও পাঞ্জাবি। কাঁধে শান্তিনিকেতনের পাশঝোলা। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। বাঁ কানে হিরের ইয়ার স্টাড।
ড্যানিয়েল ইস্ট লন্ডনের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন আর্ট হিস্টোরিয়ান। মা আর্ট রেস্টোরার। দু’জনেই সদবিজে চাকরি করতেন। একদিকে বাড়ি জোড়া আর্ট হিসট্রির বই, অন্যদিকে সারা পৃথিবীর শিল্পীদের ফোটোগ্রাফ রোজ প্রজেক্টরে দেখা হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার পরিবেশে বড় হন ড্যানিয়েল। তাঁর বরাবরের ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে।
ছবি আঁকার প্রথাগত চর্চা করতে আর্ট কলেজে ভর্তি হন ড্যানিয়েল। কিন্তু আঁকার বদলে নেশার সঙ্গে ভালোবাসা জন্মায়। মাতাল একদল আর্টিস্টের সঙ্গে নেশা এবং শিল্পচর্চা চলছিল। কবে যেন শিল্পচর্চা বন্ধ হয়ে গেল। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্যানিয়েল আবিষ্কার করলেন গত দুবছরে তিনি কোনও ছবি আঁকেননি। বাবা মারা গেছেন। মা সংসার চালাচ্ছেন। তাঁরও চাকরি থেকে অবসরের সময় এল বলে। পাশাপাশি শরীরে অস্টিওপোরোসিস। যখন তখন হাড়ে চিড় ধরছে।
একদল নেশাখোর মেঝেতে পড়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে খোঁয়াড়ি কাটাতে ড্যানিয়েল ঢকঢক করে এক বোতল জল খেলেন। শুনতে পেলেন, সাউন্ড সিস্টেম থেকে গান ভেসে আসছে, ‘জয় গুরু দেবা! ওম!’
বিটলসের গান। ভারতবর্ষে এসে মহর্ষি মহেশ যোগীর কাছে ‘ট্রানসেন্ডেন্টাল মেডিটেশান’ শিখেছিলেন জন লেনন। সেতার শিখেছিলেন রবিশঙ্করের কাছে। সেই অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি এই গান।
‘ইর্সান মিস্টিসিজম’ বলে কিছু আছে কি না কে জানে! ড্যানিয়েল ভাবলেন, ‘এই জীবন লইয়া আমি কী করিব?’ এবং আত্মানুসন্ধানের জন্য এক বস্ত্রে, কাঁধে ন্যাপস্যাক ও পকেটে কিছু পাউন্ড নিয়ে ভারতবর্ষের প্লেনে চেপে বসলেন।
এরপর যেমন হয়। কিছুদিন বেনারস, কিছুদিন গোয়া, কিছুদিন রাজস্থান… এইসব চক্কর কাটা। অবশেষে ড্যানিয়েল এসে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। মহেশ যোগী বা রবিশঙ্কর যা পারেননি, রবি ঠাকুর সেটা পারলেন। ড্যানিয়েল থিতু হলেন। আধখ্যাপা সাহেব দেখতে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দারা অভ্যস্ত। আর এ তো নিপাট ভদ্রলোক।
জনৈক আশ্রমিক আদিনাথ সেনগুপ্তের আগ্রহে ড্যানিয়েল মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন। বিদেশি আঁকার ডিগ্রি ছিল। শিক্ষকতার কাজও জুটে গেল। এমন মজার মাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীরা দেখেনি। অ্যানাটামি জ্ঞান প্রখর, পার্সপেকটিভ নিয়ে নিখুঁত ধারণা, ইউরোপিয়ান মাস্টার্সদের কাজ গুলে খেয়েছেন। কিন্তু ওরিয়েন্টাল আর্ট, ভারতবর্ষের চিত্রকলার ইতিহাস, বেঙ্গল স্কুল অব পেইন্টিং সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য। ড্যানিয়েলের ক্লাসগুলো হতো ইন্টারেস্টিং। কে ছাত্র আর কে শিক্ষক বোঝা যেত না। রোজই দেখা যেত ড্যানিয়েল জলরঙে সাঁওতাল রমনীর শরীর আঁকতে গিয়ে হেসে ফেলছেন, আর ছাত্রছাত্রীরা মহানন্দে ইতালিয়ান রেনেসাঁর ছবিতে রং বুলোচ্ছে।
এই সময় ড্যানিয়েলের জীবনে প্রেম এল। আদিনাথের কন্যা শক্তিরূপা ড্যানিয়েলকে বাংলা শেখাতেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনাতেন। শ্লেটে পেনসিল দিয়ে লেখাতেন, ‘আজ মঙ্গলবার। জঙ্গল সাফ করার দিন।’
রবীন্দ্রনাথের ঘটকালিতে প্রেম হল।
বিপত্নীক আদিনাথ সবই দেখছিলেন। কোনও বাধা দেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘পড়াশুনাটা শেষ কর। নিজের পায়ে দাঁড়া। তারপর এইসব নিয়ে ভাবিস।’
কখনও বরিশালে না গেলেও বাঙাল জিন শক্তিরূপার মধ্যে অতি সক্রিয়। ড্যানিয়েলকে ভালোবাসতে গিয়ে পড়াশুনায় কখনও ব্যাঘাত ঘটেনি। শান্তিনিকেতন থেকে বারো ক্লাস পাস করে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে পড়াশুনা করতে। রেজাল্ট, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কলকাতা শহর নকশাল আন্দোলনে উথাল পাথাল। আদিনাথের পরামর্শ মেনে মাস্টার্স করতে শক্তিরূপা চলে গেলেন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। কলকাতা, শান্তিনিকেতন বা অশান্ত বাংলা থেকে অনেক দূরে।
শক্তিরূপা নিজেকে একা সামলাতে পারলেও ড্যানিয়েল পারলেন না। শান্তিনিকেতনের চাকরি থেকে প্রথম দিকে ছুটি নিয়ে তিনি প্রতি মাসে দিল্লি যেতে লাগলেন। এত ছুটি নিলে মাইনে পাওয়া যায় না। পরের দিকে অবৈতনিক শিক্ষক হয়ে গেলেন। এবং একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন দিল্লি।
নেশার দাস যারা হয়ে পড়ে, তাদের ব্যক্তিত্বে কোথাও একটা সংকট থাকে। নেশাহীন জীবন কাটানোর জন্য তাদের একটা ঠেকনা লাগে। নেশার দাসত্ব কাটাতে ড্যানিয়েলের ঠেকনা ছিল দুজন—রবীন্দ্রনাথ আর শক্তিরূপা। ড্যানিয়েলের রবীন্দ্রচর্চা তথা বাংলা-ভাষাচর্চা শক্তিরূপার হাত ধরে। শক্তিরূপা চলে যাওয়া মানে শান্তিনিকেতন ড্যানিয়েলের কাছে রবীন্দ্রশূন্য। থাকা সম্ভব নয়।
এমএ করার আগেই শক্তিরূপা বিয়ে করলেন। উপস্থিত ছিলেন আদিনাথ। ড্যানিয়েলের মা আসতে পারেননি। অস্টিওপোরোসিসের রুগির পক্ষে প্লেনে লন্ডন থেকে ভারতে আসা অসম্ভব ব্যাপার।
পুরনো দিল্লিতে, পরাঠা গলির মধ্যে, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এক কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকতে থাকতে ড্যানিয়েল প্রথম তাঁর চিত্রভাষা খুঁজে পেলেন। মুঘল মিনিয়েচার, পুরনো হাভেলির জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা আলো আর ছায়ার তৈরি কিয়ারোসকুয়োরো, বোরখার আড়ালে চঞ্চল চোখ, কিমা-ফিরনি-কাবাব-পরটার গন্ধ, গাজর কা হালুয়ার উষ্ণতা, কেসরি ঠান্ডাই এর মিঠাস, রাতের মেহফিলের দমদার ঠুমরির মুখড়া—ভেঙেচুরে নবনির্মিত হয়ে দেখা দিল ড্যানিয়েলের ছবিতে। টানা এক বছর পরিশ্রম করে উনিশশো পঁচানব্বই সালে, অয়েলে আঁকা বিশালাকৃতি চল্লিশটা ছবির সিরিজ শেষ করলেন ড্যানিয়েল। যখন শক্তিরূপা গর্ভবতী। যখন স্বামী-স্ত্রী কেউ কোনও কাজ করেন না। সিরিজটার নাম ছিল, ‘দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড’।
হজ খাসের ‘বাই দ্য ওয়ে’ আর্ট গ্যালারির মালিক-কাম-কিউরেটর হৈমবতী সান্যাল ছবিগুলো নিয়ে দশ দিনের একটা এক্সিবিশন করলেন। হৈমবতীর স্বামী বিবস্বান সান্যাল ‘মায়া কমিউনিকেশান’ বা ‘মায়াকম’ নামে কনট প্লেসে একটা নন-ব্যাঙ্কিং অর্গানাইজেশান খুলেছেন। একচিলতে অফিস। ছোট, কিন্তু চেহারায় আপমার্কেট এবং পশ। আধুনিক চেয়ার-টেবিল ও আখাম্বা কম্পিউটার দেখে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় জাগে। নন-ব্যাঙ্কিং অর্গানাইজেশানের মূলধন হল গ্রাহকের বিশ্বাস। তারা দেখতে চায়, যে কোম্পানিতে টাকা ইনভেস্ট করছি, তার কলজের জোর কত। এই কলজের জোর দেখাতে গেলে অন্যান্য ইনভেস্টমেট লাগে। যেমন রিয়্যাল এস্টেট, ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি, মিডিয়া, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি—এইসব। উঠতি শিল্পপতি বিবস্বান সান্যাল ‘মায়া কমিউনিকেশান’-এর কোর বিজনেস এরিয়া দেখেন। অর্থাৎ নন-ব্যাঙ্কিং সেক্টর। তাঁর স্ত্রী হৈমবতী দেখেন আনুষঙ্গিক। যার মধ্যে অন্যতম বাই দ্য ওয়ে আর্ট গ্যালারি। দিল্লি ছাড়াও মুম্বইতে এর একটা শাখা আছে। তরুণ শিল্পীদের ছবির জন্য অলটারনেটিভ স্পেস হিসেবে নিজেকে প্রোমোট করে এই আর্ট গ্যালারি।
হৈমবতী ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেক থেকে ইকনমিক্স নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহ শিল্পকলায়। সারা ভারতের নবীন শিল্পীদের কাজের খবর রাখেন। তিনি যোগাযোগ করেন ড্যানিয়েলের সঙ্গে। চুক্তিপত্র সই হল। বিক্রি হলে কত শতাংশ ড্যানিয়েলের, কত শতাংশ গ্যালারি মালিকের—এইসব ঠিক হল। এক পয়সার আশা না করে ড্যানিয়েল চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন।
সাতদিনের মধ্যে চল্লিশটা ছবি বিক্রি হয়ে যায়। গ্যালারি মালিক ও মধ্যস্থতাকারীদের কমিশন দিয়ে যে টাকাটা হাতে থাকে তাতে ড্যানিয়েল ও শক্তিরূপা চিত্তরঞ্জন পার্কে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে আসেন।
এমএ-র রেজাল্ট বেরোনোর পরে দেখা গেল শক্তিরূপা আবারও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তিনি চাকরি পেলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি বিক্রির ইংরিজি সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়ান নিউজ’-এ, দিল্লির সংবাদদাতা হিসেবে। এই সময়ের আশেপাশে ড্যানিয়েলের মা মারা গেলেন।
চাকরিতে যোগদান করার আগে একমাসের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন শক্তিরূপা। ড্যানিয়েল মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া সারবেন। তাছাড়া ড্যানিয়েল চেয়েছিলেন ইস্ট লন্ডনের বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তাঁরা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন।
শক্তিরূপার প্রি-ম্যাচিয়োর লেবার শুরু হল। লন্ডনের মাটিতে জন্মাল দময়ন্তী। ন্যাচারাল সিটিজেন বাই বার্থ। সেটা বিরানব্বই সালের ডিসেম্বর মাস।
ড্যানিয়েল-শক্তিরূপা ঠিক করলেন, লন্ডনের বাড়ি বেচবেন না। দূর সম্পর্কের এক বোনপোর হাতে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে তিনজন দিল্লি ফিরে এলেন। মায়ের সূত্রে দময়ন্তী পেল ভারতীয় নাগরিকত্ব। দু-তিন বছর অন্তর সে বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডন ঘুরে আসে।
দময়ন্তীর জন্মের পরবর্তী আঠারো-উনিশ বছর নিস্তরঙ্গ জীবন। ড্যানিয়েল ক্রমাগত ছবি এঁকে যাচ্ছেন, শক্তিরূপা ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরিতে ক্রমাগত উন্নতি করছেন, দময়ন্তী বড় হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন পার্কের ভাড়া বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি করা, গাড়ি কেনা, দুবছরে একবার পৃথিবীর কোনও একটা দেশভ্রমণ ও বছরে একবার ভারতের কোনও একটি রাজ্য ভ্রমণ—এইভাবে চলছিল। ড্যানিয়েল মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত শান্তিনিকেতন যেতেন আদিনাথের সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতাও যেতেন। ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরির চাপে শক্তিরূপা অতটা সংসারি হয়ে উঠতে পারেননি। আদিনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনের শেষকৃত্যে উপস্থিত হয়েছেন শুধু।
চিত্তরঞ্জন পার্কে বাঙালি আবহাওয়া থাকলেও বাংলায় পঠনপাঠনের চর্চা কমতির দিকে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি সন্তানরা বাংলা চর্চা করে না। দময়ন্তীর বাড়ির পরিবেশ আলাদা। শক্তিরূপা সারাদিন ইংরিজি ভাষা অধ্যুষিত অফিসে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলেন না।
ক্লাস টেন পাশ করার পরে ড্যানিয়েল মেয়েকে ভর্তি করেন শান্তিনিকেতনের স্কুলে। দু’বছর ওখানে থেকেই পড়াশুনো করেছে সে। শক্তিরূপা আসতে পারেননি। তবে ড্যানিয়েল আগাগোড়াই মেয়ের সঙ্গে ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রী হিসেবে সর্বভারতীয় ডাক্তারি এন্ট্রান্স এক্সামিনেশান দেয় দময়ন্তী। তারপরে বাপ-মেয়ে দিল্লি ফিরে যায়।
দুহাজার দশ সালের অগাস্ট মাসের এক সকালবেলা শক্তিরূপার মুখে দময়ন্তী কলকাতার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার খবর শোনে। সাফল্যের খবরে তার হেলদোল হয়নি। কলকাতা শহর তার অচেনা নয়। ড্যানিয়েলের সঙ্গে কয়েকবার গেছে।
দময়ন্তীর হেলদোল না হলেও ড্যানিয়েলের হয়েছে। তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন, কলকাতায় শিফট করবেন। শান্তিনিকেতনের বাড়ি এখন তালাবন্ধ। সেটা যেমন আছে থাক। কলকাতায়, শিয়ালদার আশেপাশে একটা পুরনো বাড়ি কেনা যেতে পারে। ড্যানিয়েলের ছবির বাজার অনেকদিন ধরে জাতীয় স্তরে। কিছুটা আন্তর্জাতিকও। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, ছবি বিক্রি হবে। অন্য একটা ইস্যুও আছে। ড্যানিয়েল অনেক শহরকে নিয়ে সিরিজ এঁকেছেন। যেমন ‘দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড’, ‘বেনারস মনসুন’, ‘কেরালা কালেকশন’, ‘গোয়া নাগেটস’, ‘মুম্বই আনবাউন্ড’। কিন্ত কলকাতা শহর নিয়ে কোনও সিরিজ নেই। অপত্য স্নেহ, না ছবির প্রতি প্যাশন, নাকি দুটোই—সেটা বলা শক্ত। শক্তিরূপা ও দময়ন্তীকে না জানিয়ে ড্যানিয়েল কলকাতা শিফট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রায় একই সময় শক্তিরূপার কাছে পূর্ব ভারতের মিডিয়া হাউজ ‘মায়া কমিউনিকেশন’ ওরফে ‘মায়াকম’ থেকে একটা অফার এল। মায়া কমিউনিকেশানসের হেড অফিস এখন কলকাতা। পঁচানব্বই সালের ছোট্ট নন-ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান এখন পূর্ব ভারতের এক নম্বর। ‘স্কুপ চ্যানেল’ নামের টিভি চ্যানেল, ‘আজ সকাল’ এবং ‘বেঙ্গল নিউজ’ নামের দুটো খবরের কাগজ, ‘ফিল্মডম’ নামের একটা পাক্ষিক ফিল্ম ম্যাগাজিন বার করে মায়াকম। বাই দ্য ওয়ে আর্ট গ্যালারি কলকাতাতেও শাখা খুলেছে। ভবিষ্যতে অডিও-ভিজুয়াল মিডিয়ায় শিফট করার ইচ্ছে আছে।
মায়াকম ‘উইকেন্ড’ নামে একটা ইংরিজি সংবাদ সাপ্তাহিক লঞ্চ করছে। এই বিষয়ে কথা বলতে বিবস্বান শক্তিরূপার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। টেলিফোনে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, গোলাপ ফুলের ‘বুকে’ নিয়ে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে আসেন।
বিবস্বান নিপাট ভদ্রলোক। পত্রিকা সম্পর্কিত আলোচনার সময়ে একবারের জন্যও ড্যানিয়েল বা হৈমবতী বা বাই দ্য ওয়ে-র প্রসঙ্গ তুললেন না। যে কাজটা নিয়ে এসেছেন সেটা বর্ণনা করে ইতি বা নেতিবাচক উত্তর চাইলেন। চাকরির ‘টার্মস ও কন্ডিশনস’ লেখা একটি আইনি ডকুমেন্ট এনেছিলেন। সেটা রেখে নমষ্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।
বিবস্বান চলে যাওয়ার পরে শক্তিরূপা ড্যানিয়েলের স্টুডিওয় ঢুকলেন। অর্থাগম হওয়ার পরে দোতলা বাড়িটির তিন নম্বর তলা ঢালাই করা হয়েছে। বিম কলাম স্ট্রাকচার। কোমর অবধি ইটের গাঁথুনি দেওয়ার পরে উপরটা ফাঁকা। ছাদ থেকে পাঁচিল পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ উইনডো লাগানো। ন্যাচরাল লাইটে দিনের বেলা ঘর ঝলমল করে। কাচের জানালা খুলে দিলে হাওয়ার দাপটে তিষ্ঠনো দায়।
ড্যানিয়েল আলো পছন্দ করলেও হাওয়া পছন্দ করেন না। জানলা তাই বন্ধ থাকে। মেঝেতে রাখা থাক থাক বই আর সিডি। অজস্র সাদা ক্যানভাস একদিকে পাঁজা করে রাখা। তিনটে মাঝারি ছবি ইজেলে লটকানো। ড্যানিয়েল এখন অবশ্য ছবি আঁকছেন না। আরামকেদারায় বসে গান শুনছেন। হোম থিয়েটারে রবি ঠাকুর গাইছেন,
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।’
জিনসের হাফপ্যান্ট পরা, খালি গা ড্যানিয়েল হাঁটুতে তাল দিয়ে গেয়ে উঠলেন,
‘এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।’
ড্যানিয়েল চোখ বুঁজে গান গাইছেন। শক্তিরূপা স্বামীকে মন দিয়ে দেখলেন। এক সময় অসম্ভব বলশালী, পেশিবহুল পুরুষমানুষ ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নেশাভাং করার কারণে শরীরে চর্বি জমেছে। বয়সের তুলনায় বুড়োটে লাগে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ভারতীয় মার্গসঙ্গীত বা ওয়ের্স্টান ক্লাসিকাল শোনার সময়ে ড্যানিয়েল নিজের মধ্যে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকেন যে মনে হয় ট্রান্সে চলে গেছেন।
রবি ঠাকুরের গান শেষ হওয়ার পরে চোখ খোলেন ড্যানিয়েল। রিমোট টিপে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করেন। এটা তাঁর অভ্যেস। তিনি কখনও পরপর দুটো গান শোনেন না। মাঝখানে মিনিট পাঁচেকের বিরতি নেন।
বিরতির মুহূর্তে শক্তিরূপা ড্যানিয়েলকে বললেন, ‘বিবস্বান সান্যাল এসেছিলেন।’
‘বিবস্বান মানে হৈমবতীর স্বামী? আমার খোঁজ করতে?’
‘না। তাহলে তো আমি তোমায় ডাকতাম। বিবস্বান আমার খোঁজ করতে এসেছিলেন।’
‘কেন?’
‘মায়াকম একটা উইকলি নিউজ ম্যাগাজিন লঞ্চ করছে। ইংরিজিতে, ফ্রম ক্যালকাটা। আমাকে তার এডিটর হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন।’
‘হুম!’ আবার রিমোট কনট্রোল টেপেন ড্যানিয়েল। শুরু হয় দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে পরের রবীন্দ্রসঙ্গীত।
‘এলেম নতুন দেশে
তলায় গেল ভগ্নতরী কূলে এলেম ভেসে…’
শক্তিরূপার গানের গলা চমৎকার। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন গান শিখেছেন। আর ড্যানিয়েল তাঁর ব্যারিটোন দিয়ে যে কোনও গানকে অকুতোভয়ে আক্রমণ করতে পারেন। লজ্জাশরম নেই বলে গলা কাঁপে না। গান উতরে যায়।
তাসের দেশের গানের অন্তরায় শক্তিরূপা দেবব্রতর সঙ্গে গলা মেলালেন,
‘নাম না জানা প্রিয়া
নাম না জানা ফুলের মালা নিয়া
হিয়ায় দেবে হিয়া…’
চোখ বুঁজে থাকা ড্যানিয়েল স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে চোখে খুলে বললেন, ‘অনেকদিন বাদে গান গাইলে। মনটা খুশি খুশি মনে হচ্ছে?’
‘গান শোনার মাঝখানে তুমি কথা বললে? এ তো স্যাক্রিলেজ!’ মুচকি হেসে বলেন শক্তিরূপা। রিমোটের পজ বাটন টিপে রবীন্দ্রসঙ্গীত থামিয়ে ড্যানিয়েল বলেন, ‘তুমি ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরিটা ছাড়ছ। তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’ কনফিডেন্টলি বলেন শক্তিরূপা।
‘কলকাতায় চলে যেতে চাইছ। মেয়ের কাছাকাছি থাকবে বলে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাকে আমি একটা কথা বলিনি, জানো। কীভাবে যে বোঝাই…আমি একটা কথা তোমার থেকে গোপন করেছিলাম…’ কথা থামিয়ে ড্যানিয়েল শক্তিরূপার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
শক্তিরূপা বলেন, ‘তুমি যদি ভাবো যে আমি তোমাকে বলব, ”হ্যাঁ গো, গোপন কথাটা কী?” তাহলে খুব ভুল ভাবছ। ইউ কিপ দ্য সিক্রেট টু ইয়োরসেলফ। আমার ওতে আগ্রহ নেই।’
‘আমি তা ভাবছিলাম না রূপা। আমি ভাবছিলাম, যে ঈশ্বরের কাছে কোনও জিনিস অন্তর থেকে চাইলে তা সত্যিই পাওয়া যায়। ভারতীয় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে দিঠি সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আমি ভাবছিলাম দিল্লির পাট চুকিয়ে কলকাতায় স্থানান্তরিত হব। কলকাতায় জমিবাড়ির মধ্যস্থতা করে এমন একজন পেশাদারকে শেয়ালদার মৌলালি অঞ্চলে বাড়ি দেখতে বলেছি। তোমাকে কথাটা বলিনি। কেন না আমি জানতাম তুমি দিল্লি ছাড়বে না। তোমার কাগজের কোনও কলকাতা সংস্করণও বেরোয় না যে তুমি বদলির জন্য আবেদন করবে। আমি কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে থাকতাম, ছবি আঁকতাম, সপ্তাহান্তে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতাম। ভাবলাম এক, আর হল আর এক।’
ড্যানিয়েলের কথা শুনতে শুনতে শক্তিরূপার ভুরু কুঁচকে গেছে। টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে তিনি বললেন, ‘তোমার এই গোপন ইচ্ছার কথা কতজন জানে?’
খুকখুক করে হেসে ড্যানিয়েল বললেন, ‘চুপিসাড়ে তো আর কলকাতায় বাড়ি কেনা যায় না। ওই মধ্যস্থতাকারী জানে। আরও দুয়েকজন জানে।’
‘ওফ! তোমার শক্ত বাংলা শুনলে ঘাবড়ে যাই। জমিবাড়ির দালালকে মধ্যস্থতাকারী বললে শুনতে কেমন লাগে।’
‘দালাল? ওটা অপশব্দ।’ আপত্তি জানালেন ড্যানিয়েল।
‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি। ওই মধ্যস্থতাকারী আর তার চেলাচামুণ্ডা ছাড়া আর কে জানে? হৈমবতী সান্যাল জানেন?’
‘না,’ আপনমনে ভুঁড়িতে হাত বোলালেন ড্যানিয়েল। ‘তুমি ভাবছ যে আমার আর দময়ন্তীর কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার খবর জেনে বিবস্বান তোমার কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে? যদি সেটা হয়েও থাকে, তা হলে অসুবিধে কোথায়?’
‘তোমার সন্নিসি মাথায় সাপ্লাই-ডিমান্ড থিয়োরি ঢুকবে না। কোম্পানির মালিকের আমাকে দরকার না আমার কোম্পানির মালিককে দরকার, এই পাওয়ার ইকুয়েশনটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। বিশেষত এডিটরের মতো ভালনারেবল, ডিসিশন মেকিং পোস্টে। অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকলে মিটিং-এ বডডো ল্যামপুনড হতে হয়। এই কাগজে দেখছি তো। মার্কেটিং হেড আর এডিটোরিয়াল হেডের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। মালিক সবসময় মার্কেটিং হেডের পক্ষ নেন। বিকজ দ্যাট ফেলো ব্রিংস অ্যাডস।’
‘এগুলো আমার পক্ষে বোঝা শক্ত।’ আবার রিমোট টেপেন ড্যানিয়েল, ‘এক্ষুনি সিদ্ধান্ত জানিও না। চাকরির সুযোগটির ওপরে বসে ভাবো। তোমার এই চাকরি তো চলে যাচ্ছে না।’
চোখ গোলগোল করে শক্তিরূপা বললেন, ”চাকরির সুযোগের ওপরে বসে ভাবব?’ এটা কি, ‘সিট অন দ্য অফার অ্যান্ড থিঙ্ক’-এর বাংলা?’
লাজুক হেসে ঘাড় নেড়ে ড্যানিয়েল বললেন, ‘হয়নি, না?’
‘হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।’ হাসতে হাসতে ড্যানিয়েলের গাল টিপে দেন শক্তিরূপা। আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে ড্যানিয়েল সাউন্ড সিস্টেমের রিমোট টেপেন। ‘এলেম নতুন দেশে’ আবার শুরু হয়।
ড্যানিয়েলকে একা ছেড়ে শোওয়ার ঘরে যান শক্তিরূপা। বিবস্বানের রেখে যাওয়া আইনি ডকুমেন্ট মন দিয়ে পড়তে থাকেন।
মায়াকম! কনট প্লেসের সেই ছোট্ট নন-ব্যাঙ্কিং কিশলয় এখন মহীরুহ। ভারতবর্ষ থেকে প্রকাশিত ইংরিজি দৈনিকের সার্কুলেশানের হিসেবে ‘বেঙ্গল নিউজ’-এর অবস্থান তিন নম্বরে। এক নম্বরে আছে ইন্ডিয়ান নিউজ। ফিল্মডম ভারতবর্ষের এক নম্বর ফিল্ম, গসিপ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন। আজ সকাল বরং নড়বড়ে। অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশানের হিসেব অনুযায়ী তার অবস্থান পাঁচে।
উইকেন্ড প্রকাশের মাধ্যমে মায়াকম রাজনীতির মাস মার্কেটে ঢুকছে। শক্তিরূপা দিল্লির কাগজে বাংলার রাজনীতি ও তার সর্বভারতীয় প্রভাব নিয়ে লেখালেখি করেন। এবং এই ফিল্ডে তিনি এক নম্বর। কে যেন বলেছিলেন, জার্নালিস্টদের ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস অ্যান্ড মাস্টার অব ওয়ান’ হতে হয়। সেই তত্ত্ব মেনে, শক্তিরূপা বাংলার রাজনীতিতে মাস্টার হলেও, ইন্দো-অ্যাংলিয়ান লিটারেচার, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন, ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, আধুনিক চিত্রকলা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন। বাংলা থেকে যে ম্যাগাজিনই বার করা হোক না কেন, কালচার-এর ছোঁয়া থাকতেই হবে। সেই হিসেবে শক্তিরূপা সেনগুপ্ত উইকেন্ডের সম্পাদক হিসেবে এক নম্বর চয়েস। সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন আছে, প্রবাসী বাঙালি কিন্তু শান্তিনিকেতনের চালচিত্র আছে। তিনি সুন্দরী, তাঁর স্বামী ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী ড্যানিয়েল আর্চার। সবক’টি বাক্সয় টিক মেরেই বিবস্বান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবু দ্বিধা যায় না। সন্দেহ যায় না। মায়াকম পেশাদার সংস্থা। যতদিন কাজে লাগবে, খাটাবে। কাজ ফুরোলে নিঃশব্দে সরিয়ে দেবে। মায়াকমের প্রাক্তন কর্মচারীদের কখনও নিজের অফিসকে প্রশংসা করতে শোনেননি শক্তিরূপা। আইনি ডকুমেন্ট পড়তে পড়তে ব্যক্তিগত উকিলকে ফোন করেন তিনি। ইন্ডিয়ান নিউজেও লিগাল সেল আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না।
.
অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত ড্যানিয়েলের দিকে তাকিয়ে শক্তিরূপা ভাবছেন, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে কত ঘটনা এই কদিনে ঘটে গেল। দু’দিন পরে বিবস্বানের ফোন আসতে তিনি মৌখিক ভাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। চাকরির ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’ নিয়ে দর কষাকষি হল। ইতিমধ্যে ড্যানিয়েল কলকাতার মৌলালিতে বাড়ি কিনে ফেলেছেন। বাড়ির নাম ‘গোলমহল’। একদিকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। অন্যদিকে জোড়া গির্জা পেরিয়েই মায়াকমের সাততলা বিল্ডিং। হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। নিত্যযাত্রায় কলকাতার ট্রাফিক জ্যামের চক্করে পড়তে হবে না।
পুরনো দিনের তিনতলা বাড়িটি শক্তিরূপার খুব পছন্দ হয়েছে। সার্কুলার রোডের একদম ওপরে নয়। সামান্য ভেতরে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ আসে না। জনৈক রাজস্থানি কাপড় ব্যাবসায়ী গোলমহল তৈরি করেছিলেন। মার্বেল ও স্যান্ডস্টোনের ব্যবহারে দুর্গ ও হাভেলির স্থাপত্য ম-ম করছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে দময়ন্তীর কাউন্সেলিং-এর সময় ওই বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চির খুঁটিনাটি বিল্ডিং সুপারভাইজারকে বলে গেছেন শক্তিরূপা। ড্যানিয়েল বলেছেন তার স্টুডিওর স্পেসিফিকেশনস। মিস্ত্রিদের কাজ শেষ। ইনটিরিয়ার ডেকরেশন ড্যানিয়েল নিজের হাতে করেছেন। বাড়িটার একটাই সমস্যা। একতলায় অজস্র দোকান। তাদের তোলা যাবে না। তিনতলা বাড়ির ওপরের দুটি তলা কিনেছেন ড্যানিয়েল।
ইন্ডিয়ান নিউজে ইস্তফা দেওয়া হয়ে গেছে শক্তিরূপার। উইকেন্ডে যোগদানের কাগুজে নিয়মকানুন চুকেবুকে গেছে। আজ শনিবার। সোমবার থেকে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব বুঝে নেবেন।
কনভেয়র বেল্ট থেকে নিজেদের লাগেজ তুলে বাইরে বেরোলেন ড্যানিয়েল আর শক্তিরূপা। সামনেই প্ল্যাকার্ড হাতে এক ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘শক্তিরূপা সেনগুপ্ত আর্চার, ড্যানিয়েল আর্চার অ্যান্ড দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার’।
শক্তিরূপা ড্রাইভারকে বললেন, ‘আমাদের লাগেজগুলো নাও।’
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি বেরোচ্ছে। শক্তিরূপা ঘড়ি দেখে বললেন, ‘পৌনে দশটা বাজল। মেয়েটা এখন কোথায় বল তো?’
.
‘শিট!’ বেলেঘাটার জ্যামে আটকে পড়ে কপাল চাপড়াচ্ছে দময়ন্তী। ‘এখান থেকে আর কতদূর?’
‘রাস্তা তো একটুখানি লকখি ম্যাডাম। ওইততো, ব্রিজের বাঁ-পাশে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আর কুড়ি ফুট পাঁচিল টপকাতে পারবেন না। শিয়ালদার এই অখাদ্য জ্যাম পেরিয়েই যেতে হবে।’
‘পাঁচিল টপকাতে পারব না?’ ট্যাক্সি থেকে টপ করে নেমে বেলেঘাটা ব্রিজের পাঁচিলে উঠে দাঁড়ায় দময়ন্তী। ড্রাইভার আঁতকে উঠে বলে, ‘লকখি-ম্যাডাম, আমার ভাড়াটা দিয়ে যান। ডবল দিতে হবে না। ন্যাজজো পাওনা ফাঁকি দিয়ে ছুইছাইড করবেন না। পিলিজ!’