হৃত কৌতূহলী মগজ
মানুষ জানতে চায় তার বিস্ময় থেকে জানতে চায় তার কৌতূহল থেকে। জানতে চায় কী আছে সেথায়? কী আছে। ওখানে? এই বিস্ময়, কৌতূহল, আগ্রহ থেকে মানুষ পৃথিবীকে জেনেছে। জেনেছে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহদের কথা। জেনেছে মহাবিশ্বের। কথা। মানুষের আগ্রহের চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধতম আর কিছু নেই। সে আগ্রহ ও জিজ্ঞাসা থেকে, কৌতূহল থেকে সভ্যতা এসেছে এত দূর।
সম্প্রতি একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। বক্তাদের কয়েকজন নাসার বিজ্ঞানী। তন্ময় হয়ে তাদের বক্তব্য শুনলাম। জগৎ নিয়ে তাঁদের কত জিজ্ঞাসা! কত বিস্ময়, কত কৌতূহল! আমি নিজের ভাবনার ক্ষুদ্রতাকে উপলব্ধি করলাম। বড়র সান্নিধ্যে গেলে, মানুষ তার নিজের ক্ষুদ্রতাকে উপলব্ধি করে। সে উপলব্ধি মানুষকে বড় হওয়ার ধাক্কা দেয়। যা-ই হোক, বক্তারা বললেন, আমাদের। ভবিষ্যৎ গৃহের নাম মঙ্গল। ৫০ বছর আগে মানুষ চন্দ্র বিজয় করেছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে মানুষ মঙ্গলে পা রাখতে। চায়। মঙ্গল সম্পর্কে অনেক জেনেছে মানুষ। আরও জানছে। সেখানে গেলে একটা প্রাণ কী করে টিকে থাকবে, সে নিয়ে শত শত প্রশ্ন আর কৌতূহলের সঠিক জবাবের জন্য বহু মানুষ কাজ করছে পৃথিবীজুড়ে। মঙ্গলের যত প্রতিকূল পরিবেশ আছে, সেটা পৃথিবীতে তৈরি করে, সে পরিবেশে মানুষকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলের বৃহত্তম গিরিখাদের নাম ভ্যালেস মেরিনেরিস। (Valles Marineris)। গ্রেন্ডক্যানিয়নের চেয়ে অনেক বড়। বস্তুত সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গিরিখাদ সেটা। মঙ্গলের গাঁজা সহ আগ্নেয়গিরি। আছে কত কত খাদ। গ্রহাণুদের প্রচণ্ড আঘাতে সেসব খাদ তৈরি হয়েছে। অর্কাস প্যাটেরা সেসব খাদের একটি সন্দরতম! আমরা প্রায় পুরো মঙ্গলের ছবিটা নিয়েছি। সেখানের। পরিবেশ নিয়ে জেনেছি। প্রাণের চাষাবাদের জন্য ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছি।
মাত্র ৬০ বছর আগে এই পৃথিবীর বহু কিছু ছিল কল্পনা। মোবাইলে কথা বলা, দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রিয়জনকে দেখা–এসব ছিল কল্পনার চেয়েও অধিক কিছু। মানুষ। সে কল্পনাকে বাস্তব করেছে। মানুষ জেনেছে সিন্ধুতলের কথা। মানুষ জেনেছে ক্ষুদ্র বস্তুর জগতের বিশালতার কথা। যে অণ পরমাণুকে আমরা খালি চোখে দেখি না, সেই ক্ষুদ্র বস্তুর জগৎ মহাবিশ্বের মতোই অসীম, অতল। সে জগৎকে প্রতিনিয়তই নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনছে মানুষ। কৌতূহলের মগজ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দুনিয়া।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর একটি লেকচার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। স্টকহোমের সবচেয়ে বড় পাবলিক হলে, হাজারো মেধাবীর ভিড়ে হিমালয়সম প্রাণশক্তি নিয়ে ঢুকলেন। তিনি। সবাই দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালিতে তাঁকে আমন্ত্রণ। জানালেন। তিনি বললেন : Look up at the stars and not down at your feet. Try to make sense of what you see, and wonder about what makes the universe exist. Be curious (পদতলে নয়, নক্ষত্র পানে তাকাও। মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্মিত হও, যা দেখো তা নিয়ে ভাবো। কৌতূহলী হও!)। যে মানুষটি জীবনের প্রায় ৫০ বছর কাটিয়েছেন চেয়ারে বসে, তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল কৌতূহল।
বিস্ময়হীন, কৌতূহলহীন, প্রশ্নহীন মানুষেরা হয় নৈরাশ্যবাদী। রতিয়ে পড়া গাছের ডগার মতো হয় তারা। বাংলাদেশের বহু। তরুণের মাঝে আমি সেই নেতিয়ে পড়া দেখেছি। তাদের প্রশ্ন। এছ গিয়ে লাভ কী? কী হবে মঙ্গলে গিয়ে? কী লাভ এসব। গবেষণায়? বিজ্ঞানীরা একেক দিন একেক কথা বলেন! এমন সব ভাবনা তাদের মগজে। একটা প্রজন্মের মধ্যেই এমন নেতিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে যাওয়া মন কখন তৈরি হয় জানেন? যখন সেখানে কঠোর কঠিন প্রতিযোগিতাময় শিক্ষা থাকে না। যখন তাদের পথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানটুকু দেওয়া যায় না। তাদের যখন দেখানো যায় না পৃথিবীর মানুষেরা কোথায় ছুটছে, কী ভাবছে, কী উলট পালট করে দিচ্ছে। যখন তারা ঘর থেকে প্রশ্ন জেনে গিয়ে পরীক্ষা দেয়। বেশি নম্বরের আশায় সব অনৈতিকতার আশ্রয় নেয়। হৃত কৌতূহলের মগজ নিয়ে তারা অন্ধত্বকে আলোক ভাবে। কূপমণ্ডুকের মতো কুয়োকে সমুদ্র ভেবে দিন কাটায়। ক্ষুদ্রতম জগৎ দেখা তরুণদের বিশালতম ভাবনা স্পর্শ করে না। নাড়া দেয় না। আন্দোলিত করে না। নৈরাশ্যবাদের মালা পরে, তারা নুয়ে থাকে তুচ্ছতমের বন্দনায়। আমাদের দেশটার অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও একুশ শতকে একটা আধুনিক তারুণ্য গড়ে উঠছিল। সেটা ছিল এক আশাবাদ। তাদের স্পৃহা, তাদের জগঞ্জয়ের নেশা, সৃষ্টির জন্য তাদের ছুটে চলা ও কৌতূহল ইত্যাদি ছিল আলোকময়। কিন্তু এই আলোকও ক্ষীণ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। একটা সমাজে যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস। হতে থাকে ক্রমাগত, সেখানে আর জিজ্ঞাসু প্রাণ থাকে না। কৌতূহলভরা মগজ থাকে না। তরুণদের ভেতর তৈরি হয়। নিস্পৃহা।হৃত কৌতূহলের মগজ দিয়ে আমরা বড়জোর খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে পারব। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ঠাই পাওয়া সহজ হবে না।