হুণ্ডী-ঝুণ্ডী-শুণ্ডী
গুপী-বাঘা ভূতের রাজার কাছ থেকে বর পেয়ে নদীর ধারে বসে ভরপেট খেয়ে সবে হাত মুখ ধুয়েছে, এমন সময় এক বাহারের ডুলিতে চড়ে কোথাকার কোন এক গানের ওস্তাদ সঙ্গে বাজনদার পেয়াদা বরকন্দাজ নিয়ে গলা সাধতে সাধতে তাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। কোথায় যাচ্ছে তারা? গুপী বাঘা জিগ্যেস করে জানে—শুণ্ডী। কারণ সেখানে রাজবাড়িতে গানের বাজি হবে, ওস্তাদমশাই তাতে যোগ দেবেন।
দল চলে যাবার খানিকক্ষণের মধ্যেই গুপী-বাঘার খেয়াল হল—তা হলে আমরাই বা গানের বাজিতে যোগ দেব না কেন? আমরা তো গান বাজনা জানি; যদি বাজি জিতি তা হলে রাজা হয়তো আমাদের সভাগায়ক করে রেখে দেবেন। বরের জোরে যে কোনও জায়গার নাম করে দু’জনে এ-ওর হাতে তালি মারলেই তো হুশ করে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।
তা যায় ঠিকই, কিন্তু মুস্কিল হয়েছে কী, ওস্তাদের গানের ঠেলায় জায়গার নামটা দু’জনের কারুর কানেই ঠিক করে ঢোকেনি; বা ঢুকলেও এরই মধ্যে তারা সে নামটা ভুলে বসে আছে। গুপী বলে ‘ঝুণ্ডী’, বাঘা বলে ‘হুণ্ডী’। তা হলে কোন জায়গার নাম করে তালি দেবে তারা? ঠিক হল গুপীর কথামতো প্রথম ঝুণ্ডীতেই যাওয়া যাক।
যারা গুপী গাইন ফিল্মটা দেখেছে তাদের হয়তো মনে থাকবে এর পরের ঘটনা। এবার ঝুণ্ডী বলে তালি দিতেই চোখের নিমেষে তারা হাজির হল বরফের দেশে। হু-হু কাঁপুনির মধ্যে আবার হাততালি দিয়ে গরম পোশাক আনতে হল। সেই পোশাক পরে দু’জনের লেগে গেল ঝগড়া। বাঘার ধমকের চোটে শেষটায় গুপী বলে ‘চলো তা হলে হুণ্ডীই চলো’।
ওমা, এবারে তালির ফলে তারা পৌঁছল একেবারে ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যিখানে। বরফের দেশের পোশাক তখন গায়ে আগুন ছুটিয়ে দিচ্ছে—দু’জনে সেগুলো গা থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়। আর গুপী বাঘাকে গাল দিতে গিয়ে হঠাৎ দু’জনেরই একসঙ্গে মনে পড়ে যায় শুণ্ডী নামটা।
প্রথম হাততালি থেকে শুণ্ডী নাম মনে পড়া পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাটা ফিল্মে দেখতে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিট। এই তিন সাড়ে তিন মিনিটের দৃশ্য তুলতে আমাদের কত হাঙ্গামা করতে হয়েছিল সেটাই আজ তোমাদের বলব।
প্রথমে বলে রাখি গুপী গাইনের প্রথম দিকের দৃশ্য তোলা হয়েছিল বীরভূমের রামপুরহাট থেকে বিশ মাইল দূরে একটা গ্রামে। তার নাম নতুন গ্রাম। গুপী বাঘার প্রথম ভোজ, ডুলিতে ওস্তাদ যাবার দৃশ্য, আর ‘ঝুণ্ডী’ বলে প্রথম হাততালি—সবই এই গ্রামের এক নদীর ধারে তোলা হয়েছিল।
হাতে তালি দেবার পরেই দেখা যায় গুপী বাঘা শূন্যে উঠে গেল। এই ব্যাপারটা করতে অবিশ্যি একটা কারসাজির প্রয়োজন হয়েছিল। একটা আট ফুট বাঁশের মাচা তৈরি করে ক্যামেরাটাকে তার নীচে বসানো হয়, তারপর গুপী-বাঘাকে মই দিয়ে মাচায় তুলে বলা হয় ঠিক ক্যামেরার সামনে বালির উপর লাফিয়ে পড়তে। এই ব্যাপারটার ছবি তোলার সময় ক্যামেরার মধ্যে ফিল্ম চলবে উল্টো দিকে—সে ব্যবস্থাও আগেই করে রাখা হয়েছে। এই উল্টো-তোলা ছবি সোজা ভাবে চালালেই পর্দায় সেটা আবার উল্টে গিয়ে হয়ে যাবে গুপী বাঘা উপর থেকে নীচে না নেমে, নীচ থেকে হুশ্ করে উপরে উঠছে।
এর পরেই দর্শক দেখবে দৃশ্য একেবারে পাল্টে গেছে। কোথায় বাংলার গ্রাম!—মাঠ ঘাট ঘাস নদী গাছ বালি সব উধাও। তার জায়গায় খালি বরফ আর বরফ। এই বরফের দৃশ্য কোথায় তোলা হবে সেটাই এখন ঠিক করা দরকার। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ফেব্রুয়ারি মাসে সিমলায় বরফ থাকে। আর সিমলা থেকে আট মাইল দূরে আরও এক হাজার ফুট উপরে এমন জায়গা আছে যেখানে শুধুই বরফ, ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। এই জায়গার নাম নাকি কুফরি। এই কুফরিতেই ছবি তোলা হবে স্থির করে আমরা দল নিয়ে ট্রেনে করে হাজার মাইলের পাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু লোক দিল্লিতে রয়ে গেল, কারণ আমরা সিমলা থেকে দিল্লি হয়ে যাব রাজস্থানে। সেখানে শুণ্ডী আর হাল্লার দৃশ্য তোলা হবে। সিমলা যাবার দলে গুপী বাঘা সমেত সবশুদ্ধ জন দশেক লোক।
আমি সিমলা আগেও গিয়েছি একবার গরমের সময়। এবারে শহরটাকে দেখে চেনা মুশকিল। মনে হয় সমস্ত শহরের গায়ে শ্বেতী হয়েছে। রাস্তার উপর, ঘর বাড়ির ছাতে, পাহাড়ের গায়ে, পাইন গাছের ডালে পুরু বরফ জমে আছে। পথের বরফ গলে পিছল হয়ে আছে, হাঁটতে গেলে সাবধানে পা ফেলতে হয়।
আমাদের হাতে সময় কম, তাই দুপুরের খাওয়া সেরে তিনটে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কুফরির উদ্দেশে। প্রথম কাজ হল কোথায় শুটিং হবে সেই জায়গা খুঁজে বার করা। মনের মতো জায়গা বাছাই করে কাল আবার আসতে হবে শুটিং-এর লটবহর সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে ক্যামেরা তো থাকবেই, তা ছাড়া থাকবে আট ফুট উঁচু মাচা—যদিও এ মাচা বাঁশের নয়, ইস্পাতের। এখানেও গুপী বাঘাকে হাততালি দিয়ে শূন্যে নিতে হবে—তাই মাচা ছাড়া গতি নেই।
মাত্র আট মাইল পথ, কিন্তু যেতে লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। পাহাড়ের গা ঘেঁসে এঁকে বেঁকে চলা পুরো রাস্তাটাই বরফে ঢাকা। প্রায় আট দশ ইঞ্চি পুরু বরফ, তাতে খাদ কেটে গাড়ির চাকা এগিয়ে এগিয়ে চলেছে। গলা বরফে চাকা মাঝে মাঝে এগোতে চায় না, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে বরফ ছিটিয়ে বন্ বন্ করে ঘুরতে থাকে।
পথে মেঘ করেছিল, ফলে ঠাণ্ডাও বেড়েছিল বেশ, কিন্তু কুফরি পৌঁছনোর অল্পক্ষণের মধ্যেই রোদ উঠল। কুফরি আসলে একটি গ্রাম, কিন্তু এখানে শীতকালে বহু লোক ski-ing করতে আসে। তাদের জন্য সরকার একটি ক্লাব, একটি বাংলো, আর একটি রেস্ট হাউস তৈরি করে দিয়েছেন। আমাদের এ সবের দরকার নেই, তাই আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের কল্পনায় যে বরফের রাজ্য রয়েছে, তার সন্ধানে। রাস্তার ধারেই জায়গা পেতে হবে, কারণ দুর্গম জায়গা হলে সেখানে শুটিং-এর মালপত্র নিয়ে পৌঁছনো মুশকিল হবে।
আরও শ’দু-এক ফুট উপরে উঠতেই এমন একটি জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে তিন দিক একেবারে খোলা, চোখ ঘোরালে স্তরের পর স্তর বরফে ঢাকা পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। আমাদের ডাইনে রাস্তার ঠিক পাশ দিয়েই উঠে গেছে তুষারাবৃত পাহাড়ের গা। আমরা গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরোলাম, আর বেরিয়েই বুঝলাম যে, চারিদিকে বরফ সত্ত্বেও ঠাণ্ডা বেশি লাগছে না। বিশেষতঃ রোদ যখন উঠল তখন তো দিব্যি আরামই লাগছিল।
এই রোদের মধ্যেই আবার হঠাৎ বরফ পড়া শুরু হল। মিহি পাউডারের মতো বরফ আকাশ থেকে হেলে দুলে নেমে আসছে, হাত পাতলে হাতের তেলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাদা হয়ে যায়। বরফ পড়ায় কোনও শব্দ নেই বলেই যেন ব্যাপারটা ভারি রহস্যময় মনে হয়। তা ছাড়া আকাশে মেঘ, নেই অথচ আকাশ থেকে কিছু পড়ছে ভাবতেও অবাক লাগছে।
এই মিহিদানা তুষার বরফের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে এক জায়গায় লক্ষ করলাম রাস্তা থেকে হাত দশেক উপরে পাহাড়ের গায়ে একটা স্বাভাবিক প্ল্যাটফর্ম গোছের জায়গা হয়ে আছে, সেখানে গুপী বাঘা বেশ স্বচ্ছন্দে দাঁড়াতে পারবে। তখনই ঠিক করলাম যে, তালির জোরে বাংলাদেশের গ্রাম থেকে সটান ওখানেই এসে হাজির হবে তারা। চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম যে, কাছাকাছির মধ্যে কেবল বরফ আর তারই ফাঁকে কালো পাথর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
জায়গা তো পাওয়া গেল, কিন্তু এবার আর এক সমস্যা। বাংলাদেশের গ্রামে গুপী বাঘাকে দেখানো হয়েছে পরনে পিরেন, কাঁধে চাপানো দোলাই, আর খাটো করে পরা ধুতি। এই অবস্থাতেই তারা হাততালি দিয়ে বরফের দেশে হাজির হয়েছে। তার মানে তাদের যখন প্রথম দেখতে পাচ্ছি বরফের উপর, তখন তাদের গায়ে এই গ্রামের পোশাকই থাকবে। অথচ এই ঠাণ্ডায় এ পোশাক চলবে কী করে? গুপী বাঘার অবিশ্যি উৎসাহের শেষ নেই। তারা বলল গ্রামের পোশাকেই বরফে নামবে। কিন্তু আমাদের কাছে এটা একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, পিরেনের তলায় তারা পরবে হাতকাটা পুলোভার, আর পায়ে চাপাবে নাইলনের তৈরি লম্বা মেয়েদের মোজা। এই মোজার রঙ চামড়ার রঙের থেকে তফাত করা যাবে না—আর তাই একটু দূর থেকে আর মোজা বলে মনে হবে না। এ ছাড়া দু’জনেরই পায়ে থাকবে ভূতের রাজার দেওয়া জাদু জুতো। এই জুতো আমাদের ছবির জন্য তৈরি করা স্পেশ্যাল জুতো।
দৃশ্যটি যাতে জমে ভাল তাই ঠিক করা হল যে, বরফের প্ল্যাটফর্মের উপর পড়েই গুপী বাঘা ঠাণ্ডায় এবং ভড়কানিতে লাফাতে শুরু করবে, আর তার ফলে তারা ওই বারো হাত উঁচু থেকে পা হড়কে বরফের গা দিয়ে গড়িয়ে সটান একেবারে নীচে এসে পড়বে। আইডিয়াটা ভাল, আর গুপী বাঘাও রাজি, কিন্তু মনে ষোলো আনা ভরসা আসছে না। এই ভাবে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে কী ধরনের বিপদ হতে পারে তা আমাদের জানা নেই।
এ নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি, এমন সময় একজন স্থানীয় লোক আমাদের কথাবার্তা শুনে আশ্বাস দিল যে, এতে কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। আমরা পাহাড়ের যে অংশ পেয়েছি সেখানে নাকি বরফের তলায় লুকনো কোনও গর্তটর্ত নেই, বা এবড়ো খেবড়ো পাথরও নেই। কথা শুনে মনে হল, লোকটি নির্ভরযোগ্য। তারই উপর ভরসা করে ক্যামেরা খাটানো হল আর গুপী বাঘাও বরফের ফাঁকে ফাঁকে পাথরের উপর পা ফেলে উপরে উঠে সেই সমতল জায়গাটায় গিয়ে হাজির হল। শট্টা নিতে মিনিট পাঁচেকের বেশি সময় লাগল না। এটা বোধহয় না বললেও চলবে যে এ ধরনের শট্-এর রিহার্সাল নেওয়া সম্ভব নয়, একেবারে সরাসরি দুর্গা বলে ক্যামেরা চালিয়ে দিতে হয়—তারপর যা হয় হবে।
বরফের গা দিয়ে গুপী বাঘার গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য হয়তো তোমাদের মনে আছে। কিন্তু শট্টা শেষ হবার পরেই যে ঘটনাটা ঘটল সেটা তোমাদের জানার কথা নয়।
দুই মূর্তিমান গড়াগড়ি অবস্থা থেকে কোনও মতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বলল, ‘আমাদের চটি হারিয়ে গেছে।’ কী ব্যাপার? কখন হারাল? জানা গেল একেবারে শট্-এর শুরুতেই। দুটো লাফ মারতেই নাকি দু’জনের চটি খুলে বরফের তলায় তলিয়ে গেছে।
আধ ঘণ্টা বরফ খোঁড়াখুঁড়ি করেও সে চটির আর কোনও হদিশ পাওয়া গেল না। গ্রীষ্মকালে বরফ গলার আগে আর সে চটি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেই ভূতের চোখ আঁকা চটিগুলো কবে কী ভাবে কুফরির কোন অধিবাসীর চোখে পড়বে, আর পড়লে তখন তার মনের ভাব কী হবে কল্পনা করতে বেশ মজা লাগছিল। যাই হোক, চটি তৈরি করানোর সময়ই এক জোড়া করে এক্সট্রা করিয়ে রাখা হয়েছিল তাই রক্ষে।
এর পরের শট্গুলো বেশ ভালভাবেই উতরে গেল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে গুপী বাঘা হাতে তালি মেরে গরম জামা চায়, আর তৎক্ষণাৎ তাদের গায়ে এসে যায় তিব্বতী পশমের পোশাক। এই পোশাক আমরা জোগাড় করেছিলাম, কলকাতারই এক সাহেবের কাছ থেকে। গায়ে গরমজামা চাপামাত্র বাঘা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। গুপীর দিকে মুঠো মুঠো বরফ ছুড়ে মারতে মারতে বলে—‘এই তোমার ঝুণ্ডী? এইখানে হবে তোমার গানের বাজি? অগত্যা গুপীকে বলতে হয়, ‘তা হলে চলো হুণ্ডীই যাওয়া যাক’| নতুন গ্রামের বালির উপর বাঁশের মাচার বদলে এবার কুফরির বরফের উপর লোহার মাচা খাটানো হয়। ক্যামেরা তার নীচে বসে, আর গুপী বাঘা মাচায় চড়ে ক্যামেরার সামনে বরফের উপর লাফিয়ে পড়ে। ব্যস, কুফরি-পর্বের শুটিং শেষ। এবার চলো, মরুভূমির দেশে।
আমাদের দেশে একমাত্র মরুভূমি হল পশ্চিম রাজস্থানের থর। গুপী গাইনের ভাল রাজার দেশ শুণ্ডী আর দুষ্টু রাজার দেশ হাল্লা—এই দুটো জায়গার জন্য রাজস্থানের দুটো শহর বুঁদি আর জয়সলমির বাছা হয়েছিল। গাছপালা ফুল ফসল হ্রদ পাহাড় সব মিলিয়ে বুঁদির মতো এমন সুন্দর শহর রাজস্থানে কমই আছে। আর ঠিক উল্টো হল জয়সলমির—সেখানে সবুজ নেই বললেই চলে, আর তার সৌন্দর্যের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর রুক্ষ ভাব আছে। জয়সলমিরে কিন্তু যাকে মরুভূমি বলে ঠিক সে জিনিস নেই। সেটা পেতে হলে নাকি মাইল পঁচিশেক পশ্চিমে যেতে হয়। কাজের ফাঁকে আমরা একদিন গুপী বাঘাকে নিয়ে তাদের শুণ্ডীতে আসার দৃশ্য তোলার জন্য মরুভূমির সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।
যে জায়গায় আমরা হাল্লারাজার মেলার দৃশ্য তুলেছিলাম, সেটাকে পাশ কাটিয়ে জয়সলমির পিছনে ফেলে মাইলখানেক গিয়ে একটা পাথরে ভরা নালা পেরিয়ে আমরা যে অঞ্চলটায় পৌঁছলাম সেখানে জিপ ছাড়া আর কোনও গাড়ি চলবে না। আমরা অবিশ্যি জিপেই চলেছি, তবে সব সময় যে পথ দিয়ে চলেছি তা নয়। ড্রাইভারের গতিবিধি দেখে মনে হয় সে এ তল্লাটের নাড়ীনক্ষত্র জানে, আর না হয় কিছুই জানে না, তাই চোখ কান বুজে যে দিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই পাড়ি দিচ্ছে আল্লার নাম করে| এদিকে বালির চিহ্ন যেন ক্রমে কমে আসছে। দশ মিনিট অন্তর মরুভূমি কোথায় জিগ্যেস করাতে সে খালি বলে ‘মিল যায়গা’। এটুকু জানি যে আমাদের মোহনগড় বলে একটা জায়গা পেরোতে হবে। গড় বললেই কেল্লার চেহারা ভেসে ওঠে, তাই মনে একটা আগ্রহের ভাব রয়েছে—বিশেষ করে এই কারণে যে, রাজস্থানের কোনও বইয়ে মোহনগড়ের কোনও উল্লেখ পাইনি।
দশ-বারো মাইল যাবার পর এমন একটা জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে রাস্তা বলে সত্যিই আর কিছু নেই। শুধু রাস্তা নয়, গাছপালা, ঘর বাড়ি, টিলা পাহাড়, সব উধাও, আর সেই সঙ্গে বালিও উধাও। এটুকু বলতে পারি যে, ভারতবর্ষে অনেক ঘুরেও এমন দৃশ্য এর আগে কোথাও দেখিনি। আর দৃশ্য যে একই রকম তা নয়। একবার দেখছি নুড়ি পাথরের রাজ্য; কিছু দূর গিয়ে দেখছি সেটা হয়ে গেল খোলামকুচির রাজ্য, আর তার পরেই এসে গেলাম ঝামার রাজ্যে। আর এ সব রাজ্যের কোনওটাই সমতল নয়। গাড়ি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আবার ধীরে ধীরে ঢাল দিয়ে নেমে যাচ্ছে। যেদিকে দু’চোখ যায় কেবল বিশাল জমাট বাঁধা ঢেউ। অদ্ভুত দৃশ্য ঠিকই, কিন্তু এতে আমাদের কাজ চলবে না। কারণ আমাদের দরকার মরুভূমি। বরফের পর মরুভূমি হলে তবেই না মজা, দেখেই মনে হবে গুপী বাঘা প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দেশ থেকে প্রচণ্ড গরমের দেশে এসে পড়েছে।
যে পথ দিয়েই যাওয়া হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত মোহনগড় পৌঁছানো গেল। গড় একটা আছে বটে, কিন্তু এ সেই রাজস্থানের ঐতিহাসিক কেল্লা নয়। এ হল একটা আধুনিক খুদে কেল্লা, দেখলে রোমাঞ্চর চেয়ে হাসিই আসে বেশি। তবু কেল্লা বলে কথা, একবার ভিতরে যাওয়া দরকার। গিয়ে দেখি কেল্লার উঠোনে পাঠশালা বসেছে। যুদ্ধ যে এখানে কস্মিনকালেও হয়নি সেটা আর বলে দিতে হয় না।
এদিকে বিশ মাইল এসে গেছি তবু মরুভূমির কোনও চিহ্ন নেই। এত মেহনত, এত পেট্রোল খরচা, জিপের এত হাড় নড়বড় করা ঝাঁকুনি সব কি মাঠে মারা যাবে?
শেষে মোহনগড়েরই একজন লোক বলল যে, আমরা নাকি গোড়াতেই ভুল রাস্তা ধরেছি—মরুভূমি পেতে হলে অমুক দিকে যেতে হয়—এদিকে নয়। কথাটা শুনে মাথায় হাত দেব কিনা ভাবছি, এমন সময় আমাদের জিপের ড্রাইভাররা বললেন যে, এত দূরে এসে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। আরও খানিকটা পশ্চিমে যাওয়া হোক। এই শেষ চেষ্টায় যদি ফল না হয় তা হলে জয়সলমির ফিরে যাওয়া হবে।
তাদের কথায় আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম, আর এবার কয়েক মাইল যেতেই এমন একটা জায়গায় এসে পড়লাম যেটাকে হয়তো মরুভূমি বলা ঠিক হবে না, কিন্তু আমার ছবির পক্ষে এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কল্পনা করা যায় না। এ জায়গার কোনও নাম যদি থেকেও থাকে সেটা জানা হয়নি। এখানে বালি আছে, কিন্তু মরুভূমির শুকনো ঢেউ খেলানো বালি নয়। এ বালি চাপ বেঁধে সমতল হয়ে বিছিয়ে আছে, চারিদিকে দিগন্ত পর্যন্ত, পা ফেললে বোঝা যায় তার ভিতরটা জোলো। তারই মধ্যে আবার ফাঁকে ফাঁকে একেবারে শুকনো অংশও আছে, সেখানে বালির রং একটু ফিকে। সমস্ত প্রান্তরের উপর দুপুরের রোদ এসে পড়েছে, আর সে রোদ প্রতিফলিত হয়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে। আসলে ফেব্রুয়ারির শেষে এখানে গরম নেই, কিন্তু ক্যামেরার চোখে এটা যে সাহারার সামিল হয়ে দাঁড়াবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
জায়গাটায় পৌঁছনোমাত্র জিপ থামাতে বললাম। অনেক খোঁজার পর মনের মতো জায়গা পেয়ে কেমন যেন একটা দম বন্ধ করা উত্তেজনা হয়; এখনও তাই হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে পশ্চিম দিকে চাইতেই এক মুহূর্তের জন্য হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। কোথায় এসে হাজির হয়েছি আমরা। রাজস্থানের এ অঞ্চলে এত বিশাল একটা হ্রদ আছে এ কথা তো কেউ বলেনি আমাদের। হ্রদ না বলে সমুদ্রও বলা যেত, কিন্তু জলে ঢেউ-এর চিহ্নমাত্র নেই দেখে সেটা আর বলতে পারলাম না। সারা পশ্চিম দিকটা জুড়ে বালু প্রান্তরের শেষ মাথায় স্পষ্ট দেখছি জলের রেখা। তাতে ছায়া পড়েছে আকাশের মেঘ আর ডান দিকে বহু দূরে একসার গাছের। এ দৃশ্য প্রথমে আমাদের সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিলেও পরে বুঝতে বাকি রইল না যে হ্রদ নয়, মরীচিকা। আর এমনই মরীচিকা, যেমন সচরাচর দেখা যায় না।
গুপী বাঘাকে নিয়ে আমাদের দেড় মিনিটের দৃশ্য তুলে সন্ধ্যায় জয়সলমির ফিরে এসে স্থানীয় লোকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম যে এই আশ্চর্য জায়গা আর সেখানকার মরীচিকার কথা অনেকেই জানেন। তাঁরাই বললেন যে এই মরীচিকা শুধু মানুষ কেন, জন্তু-জানোয়ারদেরও নাকি বোকা বানিয়ে দেয়। প্রতি বছর পালে পালে তৃষ্ণার্ত হরিণ জল ভেবে এরই দিকে হাঁটতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জলের নাগাল না পেয়ে প্রাণ ত্যাগ করে।