হুঁশিয়ার
আমরা মফস্বলের লোক। কলকাতা শহরে কী হয়, না হয় আমাদের পক্ষে খবর রাখা সম্ভবপর নয়। বয়সও হয়েছে; ছেলে-ছোকরাদের মতিগতি, কর্ম-কারবারের সঠিক খবরও কানে এসে পৌঁছায় না।
মাসকয়েক পূর্বে পূর্ব-পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়েছিলুম। সেখানকার এক কাগজে পড়লুম ইউয়েনেস্কো নাকি কিছুদিন পূর্বে পৃথিবীর বড় বড় শহরে মদ্যপান কোন বহরে বাড়ছে; তার একটা জরিপ নেন এবং ফলে একটি মারাত্মক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটি এই : পৃথিবীর বড় বড় শহরের যে কটাতে মদ্যপান ভয়ঙ্কররূপে (ইন্ অ্যান এলার্মিং ডিগ্রি) বেড়ে যাচ্ছে, কলকাতা তার মধ্যে প্রধান স্থান ধরেন।
বাঙালি সব দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অন্তত একটা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুনে আমার উল্লাসবোধ করা উচিত ছিল, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও পারলুম না। ঢাকার এক আমওয়ালাকে যখন বলেছিলুম যে, তার আম বড় ছোডো ছোড়ো তখন সে একগাল হেসে দেমাক করে বলেছিল, কিন্তু, কত্তা, আডি (আঁটি) গুলাইন বরো আছে! সবক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবার আম ছোট, আর মদ্যপানের আড্ডা মোডা এ-চিন্তাটা রসাল নয়– কোনও অর্থেই!
ফেরার মুখে কলকাতাতে ডেকে পাঠালুম দ্বিজেনকে। কলেজের ছোকরা অর্থাৎ কলেজ যাওয়ার নাম করে কফি হৌস যায়– বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, শুনেছি এদের মাথায় পেরেক পুঁতলে ইন্ড্রু হয়ে বেরোয়– মগজে অ্যাসন প্যাঁচ! তদুপরি আমার শাগরেদ!
তাকে আমার অধুনালব্ধ মাদকীয় জ্ঞানটুকু জানিয়ে বললুম, আমি তো জানতুম ইন্ডিয়া শনৈঃ শনৈঃ ড্রাই হয়ে যাচ্ছে- এ আবার কী নতুন কথা শুনি?
গুরুকে জ্ঞানদান করতে পারলে শিষ্যমাত্রই পুলকানুভব করে কাবেল, নাবালক যাই হোক না কেন। ক্ষণতরেও চিন্তা না করে বললে, মদ্যপান কলকাতাতে কারা বাড়াচ্ছে জানিনে, তবে একটা কথা ঠিক ঠিক বলতে পারি, কলেজের ছোকরাদের ভিতরও জিনিসটা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভয়ঙ্কর ভীষণ দারুণ কথাগুলো আমরা না ভেবেই বলে থাকি, কিন্তু ইউয়েনেস্কো যখন এলার্মিং শব্দটি ব্যবহার করেছে, তখন সঠিক ভয়ঙ্করই বলতে চেয়েছেন। দ্বিজেন সেটা কনফার্ম করলে। (কলেজের ছোকরারা আমার ওপর সদয় থাকুক; এটা আমার মত নয়, দ্বিজেনের।)*[* বিখ্যাত সাহিত্যিক গজেন্দ্র মিত্রও এই মত পোষণ করেন। কথাসাহিত্য, অগ্রহায়ণ ১৩৬৭ পৃ. ২৭৯, পশ্য।]
বললে, এবার যে মধুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি, তার কারণ আমি আদপেই মধুপুর যাইনি– যখন শুনলাম, ইয়াররা যাচ্ছেন বিয়ার পার্টি করতে সেখানে। ওদের চাপ ঠেকানো আমার পক্ষে অসম্ভব হত– এদিকে মায়ের পা ছুঁয়ে কিরে কেটেছি মদ খাব না।
শ্রাদ্ধ তা হলে অনেকখানি গড়িয়েছে।
সে সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে দেখি, মেলাই কলেজের ছেলেমেয়ে এসেছে। আমার ভাতিজির ইয়ারি-বক্সিনি, বন্ধুবান্ধব। মাঝে-মধ্যে ওদের সঙ্গে বসলে ওরা খুশিই হয়।
ইচ্ছে করেই ফুর্তি-ফাৰ্তির দিকে কথার নল চালালুম। চোর ধরা পড়ল। অর্থাৎ মদ্যপানের কথা উঠল।
সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল। একের অজ্ঞতা যে অন্যের জ্ঞান সঞ্চয়ের হেতু হতে পারে, সে-কথা এতদিন জানতুম না।
এক গুণী হঠাৎ বলে উঠল, বিয়ারে আবার নেশা হয়!
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, বলিস কী রে? ইয়োরোপের শতকরা ৮৫ জন লোক যখন নেশা করতে চায়, তখন তো বিয়ারই খায়। ওয়াইন খায় কটা লোক, স্পিরিট
বাধা দিয়ে বললে, বিয়ারও তো ওয়াইন।
আমি আরও আশ্চর্য হয়ে বললুম, তওবা তওবা! শুনলে গুনাই হয়। ওয়াইনে কত পার্সেন্টেজ এলকহল, আর বিয়ারে কত পার্সেন্ট, স্পিরিটে
এলকহল?
বাই উয়েইট অথবা ভলুম। দিশিটা মানে ভদ্কার পড়তুতো ভাই তার হিসেব আন্ডার প্রুফ, অভার ফে। লিক্যোর
মানে লিকার?
আমি প্রায় বাক্যহারা। লিকোর তো আবিষ্কার করেছে প্রধান ক্যাথলিক সাধুসন্ন্যাসীরা (মঙ্ক) বেনিডিটিন
সাধুসন্তরা আবিষ্কার করলেন মদ!
***
পূর্বেই বলেছি, সেদিন আমার বিস্তর জ্ঞানার্জন হয়েছিল। ওদের অজ্ঞতা থেকে।
তারও পূর্বে বলা উচিত ছিল যে, আমি মদ্যপানবিরোধী। তবে সরকার যে পদ্ধতিতে এগোচ্ছে, তার সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না। সেকথা আরেকদিন হবে।
ঔষধার্থে ডাক্তাররা কখনও কখনও মদ দিয়ে থাকেন। ব্র্যান্ডির চেয়েও শ্যাম্পেন মিলিয়ে দিলে ভিরমি কাটে তাড়াতাড়ি। কিন্তু ব্র্যান্ডির চেয়ে শ্যাম্পেনে খরচ বেশি পড়ে বলে কন্টিনেন্টের ভালো ভালো নার্সিং হোম ছাড়া অন্য কোথাও বড় একটা ব্যবহার করা হয় না। কৃত্রিম ক্ষুধা উদ্রেকের জন্যও শেরি বা পোর্ট ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যাপার সম্বন্ধে আমার হ্যাঁ, না, কিছু বলার নেই। তবে শীতের দেশে ব্র্যান্ডি না খেয়ে গুড়ের সঙ্গে কালো কফি খেলেও শরীর গরম হয় এবং প্রতিক্রিয়াও কম। বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান কবরেজ হেকিমের আদেশ সত্ত্বেও সুরাপান করেননি ভয়ঙ্কর একটা কিছু ক্ষতি হতেও শুনিনি।
মোদ্দা কথায় ফেরা যাক।
বিয়ারে নেশা হয় না, এর মতো মারাত্মক ভুল কিছুই নেই। পূর্বেই বলেছি, ইয়োরোপে শতকরা ৮৫ জন লোক বিয়ার খেয়েই নেশা করে, মাতলামো করে।
ওয়াইন বলতে যদিও সাধারণত মাদকদ্রব্য বোঝায়, তবু এর আসল অর্থ, আঙুর পচিয়ে যে সুরা প্রস্তুত হয়, তারই নাম ওয়াইন। দ্রাক্ষাসব-এর শব্দে শব্দে অনুবাদ (অবশ্য বাজারে যেসব তথাকথিত দ্রাক্ষাসব আছে, তার ভিতর কী বস্তু আছে আমার জানা নেই)।
বিয়ারে ৪ থেকে ৬ পারসেন্ট এলকহল থাকে– বাদবাকি প্রায় সবটাই জল। নেশা হয় এই এলকহলেই। ওয়াইনের পার্সেন্টেজ দশ থেকে পনেরো। তবু বিয়ার খেয়েই নেশা করে বেশি লোক। ওয়াইন খান শুণীরা– এবং ওয়াইন মানুষকে চিন্তাশীল ও অপেক্ষাকৃত বিমর্ষ করে তোলে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো ওয়াইন হয় ফ্রান্সে। বোর্দো (Bordeaux) অঞ্চলে তৈরি হালকা লাল রঙের ওয়াইনকে ইংরেজিতে বলা হয় ক্ল্যারেট। তাছাড়া আছে বার্গেন্ডি, এবং শ্যাম্পেন অঞ্চলের বিখ্যাত ওয়াইন। এসব ওয়াইন আঙুর পচিয়ে ফার্মেন্ট করার সময় যদি কার্ব ডায়োসাইড বেরিয়ে না যেতে দেওয়া হয়, তবে সেটাকে সফেন ওয়াইন (এফারভেসেন্ট) বলা হয়। বোর্দো বার্গেন্ডি বুজবুজ করে না– শ্যাম্পেন করে। শ্যাম্পেন খোলামাত্রই তাই তার কর্ক লাফ দিয়ে ছাতে ওঠে, এবং তার বুদ্বুদ পেটের ইনটেসটিনাল ওয়ালে খোঁচা মারে বলে নেশা হয় তাড়াতাড়ি (ভিরমি কাটে তড়িঘড়ি) এবং স্টিল (অর্থাৎ ফেনাহীন) ওয়াইনের মতো কিছুটা বিমর্ষ-বিমর্ষ সে তো করেই না, উল্টো চিত্তাকাশে উড়ুক্কু উড়ুকু ভাবটা হয় তাড়াতাড়ি।
জর্মনির বিখ্যাত ওয়াইন রাইন (ইংরেজিতে হ) ও মোজেল। রাইন ওয়াইনের শ্যাম্পেনও হয়, তবে তাকে বলা হয় জেন্টু। শ্যাম্পেনের তুলনায় জেট নিকৃষ্ট। অথচ এই জেকট ফ্রান্সে বেচে হের ফনরিবেনট্রপ প্রচুর পয়সা কামান। হিটলার নিজে মদ খেতেন না, কিন্তু যখন শুনলেন রিবেট্রপ শ্যাম্পেনের দেশে ওঁচা জেট বিক্রি করতে পেরেছেন, তখন বিমোহিত হয়ে বললেন, যে ব্যক্তি জেটের মতো রদ্দি মাল ফ্রান্সে বেচতে পারে সে পয়লা নম্বরি সেলসমান। একে আমার চাই– এ আমার আইডিয়াজ ইংলন্ডে বেচতে পারবে। সবাই জানেন, ইনি পরে হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন ও সর্বশেষে নরনবের্গে ফাঁসিকাঠে ঝুলেছিলেন।
হাঙ্গেরির বিখ্যাত ওয়াইন টকাই ও ইতালির কিয়ান্তি।
কাশ্মীরের আঙুর দিয়ে ভালো ওয়াইন হওয়ার কথা। তাই তৈরি করে চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় চালান দেওয়ার আমি পক্ষপাতী। অবশ্য ওরা যদি কখনও ড্রাই হতে চায়, তবে অন্য কথা।
আপেল ফার্মেন্ট করে হয় সাইডার, মধু ফার্মেন্ট করে হয় মিড (সংস্কৃত মধু থেকে মধ্বী, গ্রিকে মেথু মানে মদ, জৰ্মনে মেট–সব শব্দই সংস্কৃত মধু থেকে)। আমের রস ফার্মেন্ট করে মদ খেতেন বিখ্যাত কবি গালিব। আনারস ও কালোজাম পচিয়েও নাকি ভালো ওয়াইন হয়, সাঁওতাল আদিবাসী ও বিস্তর পার্বত্য জাতি ভাত পচিয়ে বিয়ার বানিয়ে খায়; কিন্তু ফার্মেন্ট করার ভালো কায়দা জানে না বলে তিন সাড়ে তিনের চেয়ে বেশি এলকহল পচাইয়ে তুলতে পারে না। এদের সর্ব, এদের জরুগোরু এমনকি সরল আত্মার পর্যন্ত সর্বনাশ করেছে। ইংরেজ চোলাই (ডেসটি) ধান্যেশ্বরী কালীমার্কা এদের মধ্যে চালু করে। এই ধান্যেশ্বরী একেবারে সম্পূর্ণ বন্ধ না করা পর্যন্ত এদের উদ্ধার নেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে উড়িষ্যার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নবকৃষ্ণ চৌধুরীকে শুধোবেন। ইনি আদিবাসীদের জন্য বহু আত্মত্যাগ করেছেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত অনুগুল আশ্রমে আদিবাসীরাও শিক্ষালাভ করে। ইনিও আদিবাসীদের ড্রাই করতে চান; কিন্তু সরকার যেভাবে এগোচ্ছেন তার সঙ্গে তার একদম মতের মিল হয় না।
জাপানিদের সাকে মদ ভাতেরই পচাই, চীনাদের পচাই, চু-য়ে কিঞ্চিৎ ভুট্টা মেশানো থাকে।
ভারতবর্ষের তাড়ি (ফার্মেন্টেড খেজুর কিংবা তালের রস) বস্তুটিকে ওয়াইন পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। পৃথিবীর তাবৎ মাদকদ্রব্যের ভিতর এই বস্তুটিই অনিষ্ট করে সবচেয়ে কম। একমাত্র এই জিনিসটাই সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত কি না সে বিষয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ আছে। তবে খাঁটি তাড়ি সচরাচর পাওয়া যায় না; লোভী শুড়িরা তাড়ির সঙ্গে দিশি চোলাই মদ (ধান্যেশ্বরী) মিশিয়ে তার এলকহল বাড়িয়ে বিক্রি করে। মাতালরাও সচরাচর নির্বোধ হয়।
***
এতক্ষণ পচাই অর্থাৎ ফার্মেন্টেড বস্তু সম্বন্ধে বর্ণনা হচ্ছিল। এবার ডেসটিলড বা চোলাই। চোলাই বস্তুর নাম স্পিরিট– যদিও শব্দটি সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্যের জন্যও ব্যবহার হয়।
আঙুর পচিয়ে ওয়াইন বানিয়ে সেটাকে বকযন্ত্র দিয়ে চোলাই করলে হয় ব্র্যান্ডি–অর্থাৎ ব্র্যান্ড করা বা পোড়ানো হয়েছে। একমাত্র ফরাসি দেশের ব্র্যান্ডিকেই (তা-ও সব ব্র্যান্ডি নয়) বলা হয় কন্যা (Cognac)। মল্ট-বার্লিকে পচিয়ে হয় বিয়ার; সেটাকে চোলাই করলে হয় হুইস্কি। তাড়ি চোলাই করলে হয় এরেক (শব্দটা আসলে আরক কিন্তু আরক অন্য অর্থেও ব্যবহৃত হয় বলেই এস্থলে এরেক প্রয়োগ করা হল)। সেটাকে দু বার চোলাই করে খেতেন বদ্ধ মাতাল বাদশা জাহাঙ্গীর। এরেকে ষাট পার্সেন্ট এলকহল হয়– ডবল ডেসটিল করলে আশি পর্যন্ত ওঠার কথা। সেইটে খেতেন নির্জলা! আখের রস ফার্মেন্ট করার পর চোলাই করলে হয় রাম্। সংস্কৃতে গৌড়ী–গুড় থেকে হয় বলে। জামেকার রাম্ বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু ভারতীয় রাম্ যদি সযত্নে তৈরি করে চালান দেওয়া হয়, তবে জামেকাকে ঘায়েল করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। আমি ফরেন এক্সচেঞ্জ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখি বলেই এই প্রস্তাবটি পাড়লুম। রামে এত লাভ যে তারই ফলে চিনির কারবারীরা চিনি সস্তা দরে দিতে পারে। জাভার চিনি একদা এই কারণেই সস্তা ছিল। জিন তৈরি হয় শস্য দিয়ে এবং পরে জেনিপার জামের সঙ্গে মেশানো হয়। খুশবাইটা ওই জেনিপার থেকে আসে।
এসব চোলাই করা স্পিরিটসে ৩৫ থেকে আরম্ভ করে ৮০ ভাগ এলকহল থাকে। হুইস্কি ব্র্যান্ডির চেয়ে রামে এলকহল বেশি, তার চেয়ে বেশি ডবল-চোলাই এরেকে এবং সবচেয়ে বেশি আবৃস্যাঁতে। তাই ওটাকে সবুজ শয়তান বলা হয়। শুনেছি, ও জিনিস বছর তিনেক নিয়মিতভাবে খেলে মানুষ হয় পাগল হয়ে যায়, না হয় আত্মহত্যা করে, কিংবা ডেলিরিয়াম ট্রেমেনসে মারা যায়। ইয়োরোপের একাধিক দেশে এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
সচরাচর মানুষ এসব স্পিরিটস নির্জলা খায় না। হুইস্কিতে যে পরিমাণ সোডা বা জল মেশানো হয় তাতে করে তার এলকহল ডাইলুটেড হয়ে শক্তি কমে যায়। ফলে এক গেলাস-সোডাতে যতখানি নেশা হয়, দু গেলাস বিয়ারে তাই হয়। অবশ্য নির্জলা হুইস্কি যতখানি খেয়ে স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করা যায়, বিয়ারে প্রচুর জল আছে বলে ততখানি পেটে ধরে
বলে খাওয়া যায় না। তবে অবশ্য কেউ যদি অতি ধীরে ধীরে হুইস্কি খায় এবং অন্যজন সাত তাড়াতাড়ি বিয়ার খায় দ্বিতীয় জনেরই নেশা হবে আগে।
অতএব বিয়ারে নেশা হয় না, এ বড় মারাত্মক ভুল ধারণা। বন-বিখ্যাত মনিক-বিয়ারে তো আছে কুল্লে তিন, সাড়ে তিন পারসেন্ট এলকহল। যারা রাস্তায় মাতলামো করে, তারা তো এই খেয়েই করে।*[*আশ্চর্যের বিষয় ইয়োরোপের সব শহরের মধ্যে মনিকই সবচেয়ে বেশি দুধ খায়। আমাদের গডাডরের মতো।]
এদেশে আরেকটা বিপদ আছে। আঙুর সহজে পাওয়া যায় না বলে এদেশের অনেক ব্রান্ডিতেই আছে ডাইলুটেড এলকহল এবং তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্রান্ডির সিনথেটিক সেন্ট– অর্থাৎ আঙুরের রস এতে নেই। অনেক সরল লোক ফ্লু-সর্দি সারাবার জন্যে কিংবা দুর্বল রোগীর ক্ষুধা বাড়াবার জন্য এই ব্রান্ডি খাইয়ে রোগীর ইস্টের পরিবর্তে অনিষ্ট ডেকে আনেন। এ-বিষয়ে সকলেরই সাবধান হওয়া উচিত–বিশেষ করে যেসব লোক নিজে নিজের বা আত্মীয়-স্বজনের ডাক্তারি করেন।
ফ্রাসে অত্যধিক মদ্যপান এমনি সমস্যাঁতে এসে দাঁড়িয়েছে যে, তার একটা প্রতিবিধান করা বড়ই প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেউ সাহস করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাদেজ ফ্লস চেষ্টা করেছিলেন; অনেকে বলেন প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান তিনি প্রধানত এবং গুহ্যত এই কারণে। আমেরিকা ও নরওয়েও চেষ্টা করেছিল, সফল হয়নি। রাজা যদিও আইনের বাইরে তবু নরওয়ের রাজা একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, দেখা যাচ্ছে, মদ না-খাওয়ার আইন একমাত্র আমিই মানি– আর সবাই তো শুনি বে-আইনি খেয়ে যাচ্ছে।
বৈদিক, বৌদ্ধ ও গুপ্তযুগে মাদকদ্রব্য সেবন করা হত ও জুয়াখেলার রেওয়াজ ছিল। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস শঙ্করাচার্য যে নব-হিন্দু দর্শন প্রচার করলেন সেই সময় থেকেই জনসাধারণের মদ্যপান ও জুয়াখেলা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় (অবশ্য মুনিঋষিরা মাদকদ্রব্য ও ব্যসন বারণ করেছিলেন খৃস্টের পূর্বেই) এবং পাঠান মোগল যুগে রাজা-রাজড়া এবং উজির-বাদশারাই প্রধানত মাদকদ্রব্য সেবন করেছেন। চরমে চরম মিশে বলেই বোধ হয় অনুন্নত সম্প্রদায় ও আদিবাসীরাও খেয়েছে। ভারতবর্ষ কোন অবিশ্বাস্য অলৌকিক পদ্ধতিতে এদেশে একদা মদ জুয়া প্রায় নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল সেটা আমি আবিষ্কার করতে পারিনি। পারলে আজ কাজে লাগানো যেত। ইংরেজ আমলে মদ্যপানের কিছুটা প্রচার হয়– মাইকেল ও শিশির ভাদুড়ী নীলকণ্ঠ হতে পারলে ভালো হত। ওই সময় ব্রাহ্মসমাজ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গাঁধী যে জীবন ও আদর্শ সামনে ধরেন তার ফলে মদ্যপান প্রসার লাভ করতে পারেনি। শুনলুম, এখন নাকি কোনও কোনও তরুণ ঝাবো-ব্লাবো ভেরেরেন ভেরেরেন করে এবং ওদের মতো উত্তম(?) কবিতা না লিখে অন্য জিনিসটার সাধনায় সুখ পায় বেশি। ইতোমধ্যে কলকারখানা হওয়ার দরুন চা-বাগানে, জুটমিলে মদ ভয়ঙ্কর মূর্তিতে দেখা দিল। মাঝিমাল্লারা অর্থাৎ সেলাররা মাতলামোর জন্য বিখ্যাত– কিন্তু আশ্চর্য, ভারতীয় ও পাকিস্তানি খালাসিরা মদ খায় না। আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যেটুকু মদ্যপান হয় তা-ও তুচ্ছ। কলকাতার শিখেদের দেখে কেউ যেন না ভাবেন যে, দিল্লি-অমৃতসরে সম্ভ্রান্ত শিখরা মদ খান। ধর্মপ্রাণ শিখ মদ্যপানকে মুসলমানের চেয়েও বেশি ঘৃণা করেন ও বলেন, ইংরেজ শিখকে পল্টনে ঢুকিয়ে মদ খেতে শেখায়।
হিন্দু বৌদ্ধ জৈন ধর্ম ও ইসলামে মদ্যপান নিন্দিত– ইহুদি খৃস্টান ও জরথুস্ত্রী ধর্মে পরিমিত মদ্যপানকে বরদাস্ত করা হয়েছে। এবং ওইসব ধর্মের বহু প্রগতিশীল গুণী-জ্ঞানীরা অধুনা মদ্যপান-বিরোধী।
মদ্যপান এখনও এদেশে কালমূর্তিতে দেখা দেয়নি, কিন্তু আগের থেকে সাবধান হওয়া ভালো। কিন্তু পূর্বেই বলেছি– সরকার যেভাবে এগোচ্ছেন তার সঙ্গে আমার মত মেলে না। একটা উদাহরণ দি। কয়েক বৎসর পূর্বে দিল্লি শহরে পাব্লিক ড্রিংকিং, অর্থাৎ বার রেস্তোরাঁতে মদ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল। হুকুম হল, যারা খাবে তারা মদের দোকান থেকে পুরো বোতল কিনে নিয়ে অন্যত্র খাবে। অন্যত্র মানে কোথায়? স্পষ্টত বোঝা গেল বাড়িতে। কারণ পার্কে বা গাছতলায় বসে খাওয়াও বারণ। আমার প্রশ্ন, এটা কি ভালো হল? একদম বন্ধ করে দাও, সেকথা বুঝি; কিন্তু যে দেশে মদ খাওয়াটা নিন্দনীয় বলে ধরা হয়– বিশেষত মা-বোনেরা এর পাপ-স্পর্শের চিন্তাতেও শিউরে ওঠেন– সেখানে ওই জিনিস বাড়ির ভিতর প্রবর্তন কি উত্তম প্রস্তাব শুনেছি দিল্লিতে একাধিক পরিবারে এই নিয়ে দাম্পত্য কলহ হয়েছে। খুবই স্বাভাবিক। এতদিন বাইরে বাইরে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। ছেলেমেয়েরা
অধিকাংশ স্থলেই কিছু জানত না। এখন দাঁড়াল অন্য পরিস্থিতি। ওদিকে ব্যাচেলারদের বৈঠকখানাতে যে হট্টগোল আরম্ভ হল তার প্রতিবাদ করতে প্রতিবাসীরা সাহস পেলেন অল্পই মাতালকে ঘ্যাঁটোনো চাট্টিখানি কথা নয়।
দ্বিতীয়ত, যে ব্যক্তি বারে ঢুকে সামান্য একটু খেয়ে ক্লান্তি দূর করে বাড়িতে এসে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ত, তাকে এখন কিনতে হল পুরো বোতল। প্রলোভনে পড়ে তার মাত্রা বেড়ে গিয়ে শেষটায় তার পক্ষে উচ্ছল হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব নয়।
তৃতীয়ত– এবং এইটেই সবচেয়ে মারাত্মক বাড়িতে বাপের মদ্যপান ছেলেমেয়েরা দেখবেই। অনুকরণটাও অস্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ নতুন কনভার্ট করবার ব্যবস্থা করলুম।
শুনলুম, হালে নাকি কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের ওপর চাপ দিয়েছেন যে পাবলিক ড্রিংকিং বন্ধ কর। উত্তরে নাকি পশ্চিমবঙ্গ সরকার উপরের কয়েকটি যুক্তি ব্যবহার করে আপত্তি জানিয়েছেন। ফল হবে বলে মনে হয় না, কারণ পূর্বেই বলেছি, কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিক বার এসব যুক্তি শোনানো হয়েছে।
***
মোদ্দা কথা এই :
যে দেশে মদ্যপান নিন্দনীয়, যে দেশে মদ্যপান জনসাধারণে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়, সেখানে মদ্যপান একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যদি
যদি নতুন কনভার্ট না হয়, অর্থাৎ তরুণদের যদি মদ্যপানের কোনও সুযোগ, কুযোগ কোনও যোগাযোগ না দেওয়া হয়।
আমাদের সর্বপ্রচেষ্টা ওইদিকে নিয়োজিত করা উচিত।
.