হীরক রহস্য – মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
বেলা তখন আন্দাজ একটা; খাওয়া দাওয়ার পর হুকা-কাশি বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এমন সময় বেয়ারা অমৃত একখানা ভিজিটিং-কার্ড এনে উপস্থিত করল। একবার সেদিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন নামটা অচেনা। “সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে এসো” – বলে খবরের কাগজখানা তিনি এক পাশে সরিয়ে রাখলেন।
একটু পরেই প্রৌঢ়-বয়সী যে বাঙালী ভদ্রলোকটি ভিতরে ঢুকে হুকা-কাশিকে অভিবাদন জানালেন, তাঁর পানে মুহূর্তকাল তাকে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকতে হল। বাস্তবিকই কার্ডে লেখা নামটা আগে থেকে দেখা না থাকলে ইনি যে বাঙালি তা বুঝতে হুকা-কাশির মতো লোকেরও কষ্ট হত। প্রায় সাহেবের মতোই ধবধবে রঙ, পা থেকে গলা পর্যন্ত নিখুঁত সাহেবী পোশাক, চলবার এবং কথা বলবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত সাহেবি ধরণের। ভদ্রলোকের মুখখানা কিন্তু বড়ই মলিন, চোখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। আগন্তুকটিই প্রথম আলাপ শুরু করলেন, বললেন, “আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না, কিন্তু আমাদের ফার্মটার নাম সম্ভবত আপনি শুনেছেন।”
“কোন ফার্ম?” হুকা-কাশি প্রশ্ন করলেন।
“সেন এণ্ড সরকার লিমিটেড – জুয়েলার্স।”
হ্যাঁ, এ নাম হুকা-কাশি শুনেছেন বটে। সাধারণত জুয়েলার্স বা মণিকার বলতে যা বুঝায় এঁরা তা থেকে একটু স্বতন্ত্র রকমের। অবশ্য হীরা-জহরত এঁরাও বেচেন বটে, কিন্তু কারবারের প্রধান কাজ হীরা পালিশ এবং কাটাই করা। কিছুদিন এঁরা দমদমে ছোটখাটো একটা কারখানা খুলেছেন,, সে খবরও হুকা-কাশি রাখেন। ঠিক বিলাতি কায়দায় না হলেও কারখানাই বটে।
আগন্তুক – তাঁর নাম মিস্টার সেন – আবার বললেন, “আমিই এ কারবারের সিনিয়ার পর্টনার। হল্যাণ্ডের আমস্টার্ডামে কুড়ি বছর হাতে-কলমে কাজ শিখে এসে এখানে ব্যবসার পত্তন করেছি। কাজকর্ম চলছিলও ভালোই, কিন্তু মিস্টার হুকা-কাশি, হঠাৎ আমার এক বিপদ উপস্থিত হয়েছে।”
হুকা-কাশি একটু নড়ে চড়ে বললেন, “সব কথা আমায় খুলে বলুন।”
“বিঘউনির রাজার নাম শুনেছেন বোধ করি, তিনি আমাদের একজন বাঁধা খদ্দের। দিন কতক আগে তাঁর কাছ থেকে একখানা হীরা আসে, সেখানাকে হালফ্যাসান অনুযায়ী কেটে পালিশ করে দিতে হবে। কালকে কারখানায় আমাতে আর আমার পার্টনার সরকারেতে এই নিয়ে কথাবার্তা হয়, হীরাখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমি বেশ করে দেখিয়ে দিই যে কি ভাবে কাটলে ওখানার জলুস সব চাইতে বেশি খুলবার সম্ভাবনা। ঠিক হয় আমার উপদেশমতো, আমার সম্মুখে আজ ওটা কাটা হবে। কাল আমার সময় ছিল না, কাজের তাড়ায় বার হতে হয়েছিল। দিনের শেষে কাল যখন কারখানা বন্ধ করা হয় তখনও ওখানা ঠিক জায়গাতেই ছিল। তারপর হীরার কেস বন্ধ করে চাবি দেওয়া হল। কিন্তু আজ কারখানায় এসে দেখতে পেলাম কেসে হীরাখানা নেই, তার খোলটা খালি পড়ে রয়েছে – অর্থাৎ রাত্তির বেলায় হীরাটি চুরি গেছে। অথচ কি ভাবে যে হীরা চুরি যেতে পারে আকাশ-পাতাল ভেবেও আমরা তার কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না। সমস্ত কারখানাটির একটি বর্ণনা দিলেই ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারবেন। যে প্রকাণ্ড হলঘরটাতে আমাদের কাজ হয় – হীরা থাকে – সেটা থেকে বাইরে বেরোবার একটি মাত্র দরজা, সারা ঘরে আর দ্বিতীয় দরজা নেই। ল্যাচ-কী দিয়ে সে দরজা খোলা হয়, বন্ধও হয় সেইভাবেই আমার আর মিঃ সরকারের হতেই শুধু তার চাবি, আর কারও হাতে সে চাবি কখনই পৌঁছুতে পায় না। দরজার পরেই বাইরে শক্ত লোহার কোলাপসিবল গেট, তারও চাবি শুধু আমাদের দু-জনার কাছে। কারখানা ছুটি হলে প্রত্যহ আমি নিজ হাতে প্রথমে ভেতরের দরজা, তারপর কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিই। হলের ভেতর আলো আসবার জন্য অনেকগুলি জানালা অবশ্য রাখতে হয়েছে, তবে সেগুলো মানুষের নাগালের অনেকখানি উঁচুতে। সবগুলো জানালাতেই প্রথমত মোটা মোতা লোহার শিক, তার ওপর আগাগোড়া মিহি তারের জালে ছাওয়া। মাছিটিরও গলবার জো নেই। জানালার পাল্লা আগাগোড়া লোহার, কাজ বন্ধ হয়ে গেলে ভেতর থেকে সেগুলো এঁটে দেওয়া হয়। ঘরের ভেতর কাজ চলবার সময় যে-সব আবর্জনা জঞ্জালের সৃষ্টি হবে তা পর্যন্ত একটু নড়চড় হবার উপায় নেই। হলের সঙ্গে লাগানো চৌবাচ্চার মাপের প্রকাণ্ড উঁচু আর একটা ঘর আছে – শুধু একটা নর্দমা দিয়েই হলঘরের সঙ্গে তার যোগাযোগ। এটাকে আমরা বলি চৌবাচ্চা-ঘর। ঐ নর্দমা পথে সমস্ত জঞ্জাল চৌবাচ্চা-ঘরে এসে জড় হয়। এই চৌবাচ্চা-ঘরে ঢোকবারও শুধু একটিমাত্র দরজা, চাবি থাকে কেবল আমার আর মিঃ সরকারের কাছে। আমরা দু-জনা ছাড়া এ ঘরে অন্য কারও ঢুকবারই হুকুম নেই। রোজ বিকাল পাঁচটায় কারখানা বন্ধ হলে আমি এসে জঞ্জালগুলো পরীক্ষা করে দেখে আবার বন্ধ করে চলে যাই। হলঘরে তবুও জানলা রয়েছে, এখানে সে বালাইও নেই, থাকবার মধ্যে আছে কেবল বাতাস প্রবেশের জন্য কাছাকাছি দেওয়ালের গায়ে দুটো ছোট ছোট ফোকর – মোটা শিক সেখানেও এমনিভাবে বসানো যে মানুষের সাধ্য কি সেখানে কোন রকম দন্তস্ফুট করে। মেঝের ওপর থেকে চৌবাচ্চা-ঘরের ছাদ চোদ্দ ফুট। দিন রাত বন্দুক কাঁধে বরকন্দাজ পাহারা দিচ্ছে – একজন চৌবাচ্চা-ঘরের কাছে, একজন ঠিক তার উলটো দিকে। একতলায় কারখানা, দোতলায় আমার কোয়ার্টার। আজ বেলা দশটায় কারখানা খোলবার সময় বরাবরকার মতোই বিশেষ লক্ষ করে গেছি, দরজা-জানালা কোথাও এতটুকু আঁচড়ের দাগ নেই। হীরার কেসগুলোও দিব্যি তালাবন্ধই আছে। কাজেই কিভাবে যে হীরাখানা খোয়া যেতে পারে তা বাস্তবিকই একটা প্রকাণ্ড রহস্য। আপনি হয়তো বলবেন, কাজ করাবার সময় কারিগরদের ভেতরেই কেউ হয়তো এ-দুষ্কর্মটি করেছে। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, মিস্টার হুকা-কাশি, তা একেবারেই অসম্ভব। অসম্ভব এই জন্য যে আমাদের ওখানকার নিয়মই হল যে, এই একবার কাজের ঘরে ঢুকলে কারখানা বন্ধ হবার আগে আর কেউ সে ঘর থেকে বাইরে আসতে পাবে না। টিফিনের সময়ও জলখাবার খেতে হবে ঐ ঘরেরই ভেতরে -যার যা খেতে অভিরুচি বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারে। ঘরের এক পাশে কাঠের পার্টিশন দিয়ে জলের কল, বাথরুম সমস্তই করে রাখা হয়েছে। বাইরে আসবার কোন দরকার নেই। কাজের ঘণ্টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের একমাত্র ভিতর দরজাটা আমরা বন্ধ করে দিই, আর সেই বন্ধ দরজার এপাশে সারাক্ষণ একটা দরোয়ান মোতায়েন থাকে। মিঃ সরকার এবং আমি ছাড়া সারাদিনের ওঘরে আর কোনও প্রাণীর ঢোকবার উপায়ও নেই, হুকুমও নেই। তারপর ছুটির ঘণ্টা বেজে গেলে কারিগরদের একে একে দরজার সামনে আনা হয়, তন্নতন্ন করে তাদের দেহ তালাস করে তবে আমি ফটকের বাইরে যেতে দিই। বিশ বছর আমস্টার্ডামে চাকরি করে এসেছি, হীরা সরিয়ে নেবার যত রকম সম্ভব-অসম্ভব ফন্দি-ফিকির আছে কোনটাই আমার জানতে বাকি নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমার চোখে ধুলো দিয়ে কেউ যে সরে যেতে পারেনি, এ কথা ধ্রুব সত্য। আর তাছাড়া তার তো প্রত্যক্ষ প্রমাণই রয়েছে – দিনের শেষে কেস বন্ধ করবার সময় হীরা তো কেসেই ছিল দেখা গেছে। এক ভৌতিক কাণ্ড ছাড়া এ রহস্যের তো আর কোনও সমাধানই আমি দেখতে পাই না। অথচ সময়মতো রাজাবাহাদুরকে তাঁর হীরা রিরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের দশা কি হবে একবার ভেবে দেখুন আপনি।” ভদ্রলোক হাতের তেলোর ওপর কপালের ভর রেখে ম্রিয়মানভাবে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
হুকা-কাশি ধীরে ধীরে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, “হুঁ, হীরা চুরির ব্যাপারটা আজকাল কলকাতায় একটু সংক্রামক হয়ে দেখা দিয়েছে দেখতে পাচ্ছি। শুধু আপনি নন, আরও দু-একজন মণিকার এ-বিষয়ে আমার পরামর্শ চেয়ে পাঠিয়েছেন। …আচ্ছা আপনি এখন দমদমায় ফিরে যান, ঘণ্টাখানেক বাদেই আমি আসছি।”
মিস্টার সেন গিয়ে মোটরে উঠতেই হুকা-কাশি টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলেন, “হ্যাল্লো, …কে রণজিতবাবু? ভারি ইন্টারেস্টিং – আর একটা হীরা চুরির কেস! হ্যাঁ, এবারে দমদমার সেন এণ্ড সরকার কোম্পানি থেকে। হাতে সময় আছে? একবারাটি যেতে পারবেন আমার সঙ্গে ওখানে? – আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসছেন? আচ্ছা, আমি তাহলে তৈরি হয়ে থাকি।”
যথাসময়ে, রণজিতকে সঙ্গে করে হুকা-কাশি দমদমার সেন এণ্ড সরকারের কারখানায় এসে উপস্থিত হলেন। মিঃ সেন ফটকের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন, অল্প পরে মিঃ সরকারও এসে জুটলেন। হুকা-কাশি বললেন, “সময় নষ্ট না করে প্রথমেই চলুন অকুস্থানে যাওয়া যাক, মানে যেখান থেকে হীরাখানা অদৃশ্য হয়ে গেছে সেখানে।”
দরজা খোলা হল, চারজনেই প্রকাণ্ড হলটার ভিতরে এসে ঢুকলেন। সে-সময়টা টিফিনের, কারিগরেরা কাজকর্ম ছেড়ে ঘরের মধ্যেই যে যার টিফিন খেতে বসে গেছে – কেউ ক্যারিয়ারের বাটি থেকে রুটি-তরকারি বের করছে, কেউ বা গুড় দিয়ে চিড়া খাচ্ছে। কারও কারও আবার স্বাস্থ্যকর জিনিসের ওপর ততটা লক্ষ নেই, মুখরোচক হলেই হল। তারা ন্যাকড়ার পুঁটুলি খুলে বের করছে ঝুরিভাজা। কেউ বা দুনিয়ার একমাত্র সার বস্তুটাকেই শুধু চিনেছে, অর্থাৎ সেই প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও থার্মোফ্লাস্ক খুলে ফেলেছে কেবল বাটি বাটি চা।
রণজিত একটু হেসে মিঃ সেনকে লক্ষ করে বলল, “নাঃ, আপনার কারিগরদের ভোজন-বৈচিত্র্য আছে বলতেই হবে; কেউ কেউ স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বেজায় সতর্ক, আবার কেউ কেউ সে বিষয়ে কোন তোয়াক্কাই রাখে না।
হুকা-কাশি টিপ্পনী কাটলেন, “অর্থাৎ খাদ্য-বিজ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞ, এই তো? কিন্তু কেউ কেউ আবার বিশেষ অজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ – দুই-ই। এই দেখুন, পাছে বাতাস না লেগে খাবার নষ্ট হয়ে যায় সেই ভয়ে ঐ লোকটা খাবারের বাক্সে ছোট ছোট কতকগুলি ফুটো করে নিয়েছে। অথচ খাবার বেলায় খাচ্ছে তেলেভাজা বেগুনি – এককথায় যাকে সদ্য বিষ বললেই চলে।”
মুখে রসিকতা করতে থাকলেও হুকা-কাশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সমস্ত ঘরখানাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেছিলেন; গলার স্বর নামিয়ে বললেন, “বাস্তবিকই আপনারা একটি অভেদ্য দুর্গই তৈরি করে রেখেছেন, মিঃ সেন। কোন বাইরের লোকের পক্ষে এখানে ঢুকে কোন কিছু সরিয়ে নেওয়া যেমন অসম্ভব; তেমন ভেতর থেকেও যে-কোনও লোকের পক্ষেই বাইরে কোন জিনিস চালান দেওয়াও দুঃসাধ্য ব্যাপার! ওপরের ঐ জানালার পাল্লাগুলি তো দেখছি খাঁটি স্টিলের। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে নিশ্চয় ও-গুলোকে ভেতর থেকে এঁটে দেওয়া হয়। …এই গুলোই বুঝি হীরার কেস?
“আজ্ঞে, হ্যাঁ, এ-গুলিও খাঁটি স্টিলের তৈরি। কেসের ভেতর প্রত্যেকটি হীরার জন্য আলাদা আলাদা খোপ আছে, গায়ে নম্বর আঁটা। এখন কাজ চলছে, তাই কেসের ডালা খোলা, মিঃ সরকার এগুলোর কাছে কাছেই থাকেন। ছুটির সময় প্রত্যেকটি খোপে হীরা আছে কিনা দেখে নিয়ে ডালা বন্ধ করে চাবি এঁটে দেবেন। তার মানে লোহার সিন্দুকের মধ্যেই এগুলো রাখা হল।”
“বুঝেছি, এখন চলুন, পার্টিশনটার ওধারটা একবার দেখে আসা যাক। বাঃ, এদিকেও তো দেখেছি আপনাদের সতর্কতার সীমা নেই – একেবারে দুর্গ।” পার্টিশনের এধারে এসে হুকা-কাশি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “আপনার কারিগরেরা কি মাঝে মাঝে খিচুড়ি দিয়েও টিফিন করে নাকি মিঃ সেন?”
“খিচুড়ি? কই, দেখিনি তো কখনও। তা খেতে পারে, আশ্চর্য কি?”
“আমি কিন্তু রান্নাকরা খিচুড়ির কথা বলছি না – কাঁচা খিচুড়ি।”
“কাঁচা খিচুড়ি! সে আবার কি?”
“নইলে এগুলো এখানে এল কোত্থেকে? এই দেখুন।” বলিয়া তিনি গুটিকয়েক ডাল এবং চাল মেঝে হইতে তুলে মিঃ সেনের হাতে দিলেন।
এগুলির দিকে কিন্তু আর কারোরই নজর পড়ে নাই। সেন এবং সরকার পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন, ব্যাপারটা তাঁদের কিছুই বোধগম্য হল না। কিন্তু হুকা-কাশির আর তখন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই, একখানা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের সাহায্যে ততক্ষণ তিনি ঘরের মেঝে পরীক্ষা করতে বসে গেছেন। পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ রণজিতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখুন তো রণজিতবাবু, মেঝের ওপর ছড়ানো এগুলি কি?”
রণজিৎ খানিকটা দেখে নিয়ে বলল, “এ তো দেখছি বালি।”
“কিন্তু সাধারণ বালি নয় নিশ্চয়ই। না না, হাতে করে অত জোরে রগড়াবেন না, কি রকম খরখরে দেখছেন তো, হাত ছড়ে যাবে যে!”
মিঃ সেনেরও কৌতূহল হয়েছিল, হাতে করে জিনিসটা তুলে নিয়ে বললেন, “এ তো দেখছি কাঁচের গুড়ো, কারখানায় এ-জিনিস আনলে কে?”
হুকা-কাশি বললেন, “আমার এ-দিকটা দেখা হয়ে গেছে, আর কোন জায়গা যদি দেখাবার থাকে তো চলুন মিঃ সেন।”
“আর কোন জায়গা?”
হল হতে বের হয়ে সকলে চৌবাচ্চা-ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মিঃ সেন পকেট হতে চাবি বের করে দরজাটি খুলে দিলেন – ভিতরে এত অল্প জায়গা যে চারজন লোকের স্থানসংকুলান হওয়াই শক্ত; তার উপর আলোর অভাবও যথেষ্ট। মিঃ সেন পকেট থেকে খুব দামি একটা টর্চ বের করে এ-ধার ও-ধারে টর্চের তীব্র আলোক ফেলতে লাগলেন। এক কোণে ছোট্ট সাদা মতো কি একটু জিনিস দেখা গেল; আঙুলে করে সেটুকু তুলে এনে মিঃ সেনকে হুকা-কাশি জিজ্ঞাসা করলেন, “দেখুন তো এটা কি আপনাদের হীরা কাটার কোন কাজে আসে?”
মিঃ সেন দুই হাতে জিনিসটা একটুকাল নাড়াচাড়া করে বললেন, “এ তো দেখছি তুলো, কিন্তু সাধারণ তুলো এ তো নয়, এ-যে প্রায় রেশমের শামিল – এ আমাদের কারখানায় ঢুকলো কোত্থেকে?”
“ঠিক বলছেন, কাঁচের গুড়োও যেমন অসাধারণ তুলোও ঠিক তাই! বাজারে এ-ধরণের তুলো আপনি কিনতে পাবেন না। চলুন, এবারে বার হওয়া যাক, আমার কাজ হয়ে গেছে।”
দরজা বন্ধ করতে মিঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপারটা কিছু আঁচতে পারছেন?”
“তা পারছি বই-কি, বারো আনা রহস্যই পরিষ্কার হয়ে গেছে।”
“বটে নাকি?” মিঃ সেন যেন আকাশ থেকে পড়লেন, পলকের জন্য আশার আলোকে তাঁর সমস্ত মুখ ভরে উঠল, বললেন, “মহারাজের হীরা তবে ফিরে পাবার সম্ভাবনা আছে?”
“তা নেই, একথাই বা বলি কি করে! কাল আর আমার দেখা হয় তো আপনি পাবেন না, তবে পরশু নাগাদ আমার কাছ থেকে একটা টেলিফোন আপনি আশা করতে পারেন। এখন যাবার আগে একটা কথা – কারখানা-ঘরের দারোয়ানটাকে আমি একটু আড়ালে ডেকে গুটি দুই প্রশ্ন করতে চাই, অবশ্য আপনাদের যদি তাতে কোন আপত্তি না থাকে।”
“সে কি কথা, আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন, আমাদের আবার কি আপত্তি।”
“বেশ তবে চলুন এবার তার কাছে আমায় নিয়ে।”
হুকা-কাশি ঠিকই বলেছিলেন, বাস্তবিকই পরদিন সারাবেলা তাঁর আর কোনই পাত্তা পাওয়া গেল না। তারপর সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ তিনি ঝড়ের মতো রণজিতের বাড়ি এসে উপস্থিত, বললেন, “চট করে জামাটা গয়ে চড়িয়ে নিন তো রণজিতবাবু, একবার ‘বঙ্গ-বিশ্লেষণ’ আপিসে যেতে হতে।”
“কেন? সেখানে কি দরকার?”
“ডাট এণ্ড ডাট জুয়েলার্স একটা বিজ্ঞাপনের কপি আমার হাতে দিয়েছে, কালকের ‘বঙ্গ বিশ্লেষণ’ পত্রিকায় সেটা বার হওয়াই চাই। আমার কথায় এত দেরিতে ওরা যদি বিজ্ঞাপনের কপিটা নিতে আপত্তি করে, তাই আপনাকে সঙ্গে নেওয়া। খবরের কাগজ-মহলে আপনার খুব খাতির, আপনার অনুরোধ ওরা কেউ ঠেলতে পারবে না।”
খবরের কাগজের আপিস হতে বের হয়ে হুকা-কাশি আবার ডুব মারলেন, পরদিন বিকাল পর্যন্ত আর তাঁর কোন খবরা-খবর নাই। রণজিত অদম্য কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে অনবরত ঘর-বার করছিল, এমন সময় ক্রিং-ক্রিং করে টেলিফোনের ঘণ্টা বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সে রিসিভারটা কানে দিল; তারপর চোঙার কাছে মুখ লাগিয়ে বলল, “হ্যাল্লো, ওঃ মিস্টার হুকা-কাশি? খবর কি? আমার আর আপনার দু-জনারই সন্ধ্যার পর মিঃ সেনের ওখানে নেমন্তন্ন? হঠাৎ এত আনন্দোৎসবের কারণ কি? বলেন কি, বিঘাউনি-রাজের হীরার উদ্ধার এর মধ্যেই হয়ে গেছে? আপনি মানুষ নন মিস্টার হুকা-কাশি, কিছুতেই মানুষ নন – হ্যাঁ অপদেবতা, তাই বটে! আমায় ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যাবেন? আচ্ছা!”
রণজিত ট্যাক্সিতে এসে উঠলে হুকা-কশি বলতে শুরু করলেন, “একেবারে বৈজ্ঞানিক চুরি মশাই, এ-দেশে এমনতর ব্যাপার বড় দেখা যায় না। অক্ষয় নামে এক নামজাদা ঝানু জোচ্চোর সম্প্রতি জেল থেকে বেরিয়ে এক নতুন ধরণের জোচ্চুরি শুরু করেছিল। ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্ণের অনেকগুলো নকল হীরা জোগাড় করে – সে সব কোথায় পাওয়া যায় আপনি না জানলেও জোচ্চোরেরা তার খবর রাখে – সে কলকাতার দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াত। খদ্দের সেজে দোকানের কাউণ্টারের ওপর হীরা পরখ করবার ছুতোয় নকল হীরা বাক্সে চালান দিয়ে, আসলখানা বার করে এনে বলত, ‘না মশাই, পছন্দ হল না।’ তারপর দোকানির চোখের সামনেই খুট করে বাক্সটিপে দিয়ে চলে আসত। চোখের সামনে হীরা বন্ধ করা হয়েছে দেখে দোকানির আর কোন সন্দেহ হত না। তারপর আসল ব্যাপারটি যখন খোলসা হত তখন খদ্দের একদম ভেগে পড়েছে। এই রকম বার দু-তিন ঘটতেই মণিকার-মহল সাবধান হয়ে গেল। দু-একজন আমাকেও খবর দিলে। অক্ষয়ও বুঝল, ঘন ঘন এক ফিকির বেশিদিন চালানো নিরাপদ নয়, একটু অন্যপথে যাওয়া দরকার। হঠাৎ তখন তার মনে পড়ল সেন এণ্ড সরকার কোম্পানির কথা। শোনা যায় ওদের হীরা নাকি বাজারে চলতি হীরার চাইতে ঢের বেশি দামি। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? টাকা কবলে বনমালী নামে সেন এণ্ড সরকার কোম্পানির এক কারিগরকে অক্ষয় হাত করে ফেললে। এবার প্ল্যান হল সম্পূর্ণ নতুন ধরণের। ঝানু জোচ্চর কিনা, হরেক রকম জোচ্চুরিরই সাজ-সরঞ্জাম ওর কাছে আছে। এই সরঞ্জামের মধ্যে আছে গুটিকয়েক শেখানো পায়রা। আপনি নিশ্চয় জানেন শিক্ষিত পায়রাকে কোন জায়গা থেকে ছেড়ে দিলে সে উঠে গিয়ে ঠিক তার মালিকের বাড়িতেই হাজির হবে। আগেকার দিনে সেনাপতিরা এদের পায়ে চিঠি বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজধানীতে পর্যন্ত খবর পাঠাতেন। এ-রকম একটি শেখানো পায়রা বনমালীকে দেওয়া হল। সেন এণ্ড সরকারের কারখানা-ঘরে কর্মচারীদের ঢোকবার বেলায় কোন রকম ‘দেহ তলাস’ করা হয় না, কেননা তা অনাবশ্যক, ওটা করা হয় শুধু বার হবার সময়তেই। বনমালী তার টিফিনের বাক্স হাওয়া চলাচলের উপযোগী গুটিকয়েক ছ্যাঁদা করে পায়রাটিকে তারই ভেতর পুরে ফেললে, তারপর টিফিন বলে চালিয়ে বাক্সটাকে নিয়ে এল কারখানা-ঘরের মধ্যে। ভেল্কিওয়ালার পায়রার মতো অক্ষয়ের পায়রাও ডাকে না, চুপচাপ পড়ে থাকে। বনমালী আগেই খবর পেয়েছে পাকা জহুরী মিঃ সেনের উপস্থিতি ছাড়া বিঘাউনি-রাজের হীরা কাটা হবে না, আর সেদিনই টিফিনের সময় মিঃ সেনকে কাজের তাগাদায় বেরুতে হবে: ফিরবেন তিনি কারখানা বন্ধ হবার সময় – ‘দেহ-তালাসি’ করতে। কাজেই টিফিনের পরই সে সুযোগ বুঝে অক্ষয়ের দেওয়া একখানা জুতসই নকল হীরা কেসে রেখে আসল হীরাখানা তুলে নিল। যেমন গহনাগাটির দোকানে সচরাচর হয়ে থাকে – কাজের খাতিরে সকলকেই সর্বদা কেসের কাছে যেতে হচ্ছে, সন্দেহের কোনই কারণ নেই। পার্টিশনের এধারে বাথরুমে এসে অন্যের অলক্ষ্যে পায়রার পায়ে বিঘাউনি-রাজের হীরা বেঁধে দিতে তার কোনই কষ্ট হয় নি। তারপর বাক্সে ফের পায়রা পুরে সে আবার চলে এল হল ঘরে, যেখানে জঞ্জাল ফেলবার নর্দমা ঠিক তারই মুখে। এ নর্দমাটিও সর্বদাই ব্যবহার হচ্ছে, কাজেই হুঁসিয়ারির সঙ্গে চারদিক দেখে নিয়ে কৌশলে সে যখন পায়রাটিকে এই নর্দমার ভেতর ঢুকিয়ে দিলে তখনও আরও কোনও সন্দেহ হবার কারণ ঘটেনি। পায়রা এসে পড়ল চৌবাচ্চা-ঘরে; সে ঘরের খুব উঁচুতে আলো ঢুকবার ফোকরগুলিতে মোটা মোটা লোহার শিক লাগানো। চোর আটকাবার পক্ষে তা পর্যাপ্ত বটে, কিন্তু পায়রার পক্ষে সে পথে গলে যাওয়া কিছুই কষ্টকর নয়। শিক্ষিত পায়রা সেই পথেই উঠে এসে অক্ষয়ের হাতে বিঘউনি-রাজের হীরা পৌঁছে দিল।”
“এদিকে এক মুহূর্তও হীরার খোপ খালি পড়ে থাকে নি বলেই ওদিকে কারুর নজর যায় নি, আর বনমালীও এতটা সাহস পেয়েছিল। ছুটির সময় প্রত্যেকটি খোপই ভর্তি আছে দেখে মিঃ সরকারও কিছু খুঁটিয়ে দেখা আবশ্যকও মনে করেননি, কেস বন্ধ করে ফেলেছেন। সকলেরই ধারণা বিঘউনি-রাজের হীরা সারারাত কেসেই ছিল।
পরদিন বনমালী এসে প্রথমেই সেই নকল নীরা, মানে কাঁচের টুকরোটা কেস থেকে তুলে এনে পেষাই কলে ফেলে এক মুহূর্তে বালির মতো মিহি করে ফললে। তারপর সেই কাঁচের গুড়ো পার্টিশনের ওধারে ফেলে দিল – যাতে জলের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়িতে কাজ সারতে যাওয়ায় অল্প একটু গুঁড়ো কিন্তু মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছিল। নকল হীরাটাকে এভাবে নষ্ট করার অর্থ এই যে, মিঃ সেনের মনে দৃঢ় ধারণা জন্মাবে রাত্তিরেই বাইরের কোন চোর এসে বিঘাউনি-রাজের হীরাখানা আত্মস্যাৎ করেছে, ভেতরের কোন কারিগরের এর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। অর্থাৎ একদম উলটোদিকে অনুসন্ধানের মুখটা ঘুরিয়ে দেওয়া।”
রণজিত অবাক হয়ে সমস্ত ঘটনা শুনছিল, হুকা-কাশির বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সে একটুকাল চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “বাস্তবিক, এ যে আপনি কি করে বার করলেন ভেবে ভেবে কিছুই কূল কিনারা পাচ্ছি না।”
হুকা-কাশি হেসে বললেন, “আচ্ছা শুনুন তবে, কুল-কিনারা পাইয়ে দিচ্ছি।…”
“সেন এণ্ড সরকার কোম্পানির কারখানায় এসে গোড়াতেই একটা জিনিস একদম পরিষ্কার হয়ে গেল – রাত্রিযোগে বাইরের কোন চোর ভেতরে এসে যে হীরা চুরি করেনি সেটা সুনিশ্চিত। এমন একটা সুরক্ষিত দুর্গে তাদের আসাই যে শুধু দুরূহ ব্যাপার তাই নয়, দরজা অথবা জানালা কোথাও তাদের আসবার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই, এমন কি হীরার কেসটি পর্যন্ত বন্ধ অবস্থাতেই দেখা গেছে। কাজেই প্রথম হতেই সে সম্ভাবনাটা একদম বাতিল করে বিচারের বিষয়টি সীমাবদ্ধ করে আনলাম।”
“বাইরে থেকে কেউ যখন আসেনি তখন নিশ্চয়ই ভেতর থেকে হীরা চালান দেওয়া হয়েছে। কারখানা-ঘরটাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেও এও বেশ বোঝা যায় যে হীরা তো দূরের কথা, একটা মাছি গলানো যেতে পারে এমন ঐ নর্দমাটা। শুধু ঐ নর্দমার পথেই হীরা আসতে পারে হলঘরথেকে চৌবাচ্চা-ঘরে। কাজেই নর্দমাটাই হবে আমার অনুসন্ধানের প্রধান লক্ষ্য। বিচারের বিষয় আরও সীমাবদ্ধ হয়ে এল।”
“তারপর বিবেচ্য, চৌবাচ্চা-ঘরে মিঃ সেন ভিন্ন আর কারও ঢোকবার উপায় নেই, কাজেই সেখান থেকে হীরাখানাকে ফের কোথাও চালান দিতে হলে তার একমাত্র পথ – প্রায় চোদ্দ ফুট উঁচুতে আলোবাতাস ঢোকবার উদ্দেশ্য লোহার শিক দেওয়া যে দুটো ফোকর রয়েছে তারই কোনও একটা। এ-অবস্থায় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে হীরা চালান দেওয়া কোন লোকের পক্ষে শুধু নিজের চেষ্টায় অসম্ভব, হয় তাকে কোন যন্ত্রের সাহায্য নিতে হবে, নতুবা কোন জীবের। এতখানি বোধসম্পন্ন যন্ত্র থাকতে পারে বলে আমি নিজে বিশ্বাস করি না, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোকই বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। কাজেই সাহায্য নেওয়া হয়েছে নিশ্চয় কোন জীবের। সে জীবটি এত ছোট হওয়া চাই যে একটা নর্দমার পথ দিয়ে অনায়াসে সে গলে যেতে পারে, একটা টিফিন বইবার বাক্সে করে অনায়াসে তাকে কারখানা-ঘরে আনা চলে, কেননা ও ভাবে আনা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই তাকে কারখানা ঘরে আনা সম্ভব নয়। কাজেই অন্যসব চিন্তা ছেড়ে আমার শুধু দেখতে হবে ঘরের কোথাও এ-হেন কোন জীবের কিছুমাত্র চিহ্ন পড়ে আছে কিনা। বিচারের বিষয়টা কতখানি ছোট্ট হয়ে গেছে লক্ষ্য করেছেন?”
“ঘরে ঢুকেই একজন কারিগরের বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সম্বন্ধে আমি একটু কটাক্ষ করেছিলাম মনে আছে? খাবার নষ্ট হবার ভয়ে খাবারের বাক্সে ছোট ছোট ছ্যাঁদা করে নিয়েছিল বলে! খাবার টাটকা রাখবার উদ্দেশ্যে এ কাজ সে করেছে এ-কথা কিন্তু তখনও বিশ্বাস করিনি, ঘোরতর সন্দেহ হয়েছিল যে জীবটিকে বাক্সে পোরবার পর তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়া সরবরাহের জন্যই এ-ব্যবস্থা। পার্টিশনের এ-পাশে মেঝের ওপর চাল আর ডাল দেখতে পেয়ে আপনারা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, আমি কিন্তু হই নি। এগুলো সে জীবটিরই খাবার – এ পাশে এনে তাকে খোলবার সময় বাক্স থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে তা আমি তক্ষুণি বুঝতে পেরেছিলাম। কি ধরণের জীব, খাবার দেখে তাও কিছুটা আন্দাজ হল – যদিও আমার মনে মনে ঐ রকমেরই ধারণা ছিল।”
“তারপর চৌবাচ্চা-ঘরে তুলো জাতীয় জিনিসটা দেখে মিঃ সেনের মনেও সন্দেহ হয়েছিল যে সাধারণ তুলো ওটা নয়। আমি কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছি – সাধারণ অসাধারণ কোন তুলোই ওটা নয় সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, একটা সাদা পায়রার পালক। নর্দমার পথে ঘষা-ঘষিতে পায়রার রোঁয়া ওপর-ওপর উঠে এলে সেটা ঠিক রেশমি তুলোর মতই মনে হওয়ার কথা। সমস্ত ব্যাপারটার এখন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল – পায়রার পায়ে বেঁধে কারখানারই একজন কারিগর হীরা চালান দিয়েছে, এবং সে কারিগরটি কে তা আঁচ করতেও কষ্ট হল না – ছ্যাঁদাওয়ালা খাবারের বাক্সের মানিক যিনি তিনিই – অর্থাৎ খাকি হাফপ্যাণ্ট পরা লোকটা।”
“পার্টিশনের ও-ধারে মেঝের ওপর আরও একটি রহস্যময় জিনিস পাওয়া গেল, মিঃ সেন ঠিকই এঁচেছিলেন, ওগুলো সত্যিই কাঁচের মিহি গুঁড়ো, হীরার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই, থাকলে মিঃ সেনের মতো পাকা জহুরি কখনই ভুল করতে না। কাঁচের গুঁড়ো তাঁর কারখানায় কি করে এল ভেবে মিঃ সেন আশ্চর্য হচ্ছিলেন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ব্যাপারটাতো এই – কোন কারণে হীরা-চোরের একখণ্ড কাঁচ কারখানার ভেতরে আনার দরকার হয়েছিল, তারপর দরকার চুকে গেলে সেটাকে আর কোনও মতে লুকোবার উপায় নেই দেখে গুঁড়িয়ে উড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।”
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি জন্য কাঁচের টুকরোটাকে কারখানায় আনার প্রয়োজন হতে পারে। একটু বিবেচনা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন, বিঘাউনি-রাজের নম্বর আঁটা হীরার খোপটা খালি রেখে পায়রার পায়ে সেটি বাঁধবার চেষ্টা করা বিশেষ দুঃসাহসের কাজ, – কেন না তাতে তো কিছু সময় লাগবে। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। কাজেই কারিগর স্বভাবতই চেষ্টা করবে এক টুকরো নকল হীরা সেই খোপে রেখে সবার চোখে ধুলো দিতে। পরদিন একটু সকাল সকাল এসে সেই কাঁচখানা উড়িয়ে দিলেই হল, কারিগরের সম্বন্ধে কর্তাদের কোন সন্দেহ হবে না, পুলিশ তাকের পেছনে লাগবে না। সুযোগ বুঝে কাঁচখানাকে পেষাইকলে চূর্ণ করতে আধ মিনিটও সময় লাগে না – এ অতি সহজেই সমাধান হতে পারে।”
“এর পরের ঘটনা আর বেশি করে বলবার দরকার নেই, সংক্ষেপে বললেই চলবে। আপনাকে বিদায় দিয়ে আমি কারখানার কাছে কোনও একটা জায়গায় অপেক্ষা করে থাকলাম। তারপর ছুটির পর বনমালী বার হতেই গোপনে তার পিছু নেওয়া গেল।”
“সে এসে উপস্থিত হল বাগবাজারের একটা বাড়ির দরজায়। বারকতক কড়া নাড়তেই যে লোকটা এসে দরজা খুলে দিল তাকে দেখে আমায় দস্তুরমতো চমকে যেতে হল – বছর কয়েক আগে এক জোচ্চুরির ব্যাপারে ধরতে পেরে আমিই ওকে জেলে পুরেছিলাম। লোকটার নাম অক্ষয়; জোচ্চোরের ধাড়ি। ভাবলাম জেল থেকে বেরিয়ে ও আবার ‘হীরার ব্যবসা’ ধরেছে নাকি? হালে কলকাতার মণিকার-মহলে আসল হীরার জায়গায় মাঝে মাঝে যে নকল হীরা চালানো হচ্ছে সেগুলির মূলে এই মহাত্মাটি নেই তো। একটু খোঁজ নিতে হচ্ছে তো। ফলে পরদিন অনেকটা সময় আমায় বাগবাজারেই কাটাতে হল।”
“বিশেষ লক্ষ করে দেখেছিলাম, অক্ষয়চন্দ্র আমাদের ‘বঙ্গ বিশ্লেষণ’ কাগজের একজন নিয়মিত পাঠক। আমার মক্কেল মেসার্স ডাট এণ্ড ডাট জুয়েলার্সের সঙ্গে পরামর্শ করে সেদিন তাদেরই নামে ‘বঙ্গ-বিশ্লেষণ’ কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বার করে দেওয়া গেল – কয়েকখানা হীরা তাদের ওখানে অল্প দামে বিক্রি হবে, শো কেসে আছে যে কোন লোক এসে দেখে যেতে পারেন।”
“বেশ জানতাম, ভয়ের চাইতে লোভটাই অক্ষয়চন্দ্রের বেশি। ‘বঙ্গ-বিশ্লেষণ’ -এ বিজ্ঞাপন পড়বার পর সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না, একটা-না-একটা জোচ্চুরির মতলব মাঠায় নিয়ে থিক এসে হাজির হবে। হলও ঠিক তাই। যেমনি সে দোকানে এসে ঢুকল, আমিও অমনি ক্যাঁক করে ওকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে ওর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। বেরিয়ে এল খান পনেরো নানান সাইজের নানান প্যাটার্ণের হীরা।”
“এর পর আর বেশি কিছু বলবার নেই, – শুধু এটুকু ছাড়া যে আমার টেলিফোন পেয়ে অক্ষয়চন্দ্রেরই বিছানার তোষক কেটে মিঃ সেন পুলিশের সাহায্যে বিধাউনি-রাজের হীরাখানা উদ্ধার করে এনেছেন, অক্ষয়চন্দ্র এবং বনমালী দু-জনাই এখন হাজতে।”
“এই যে আমরা দমদমায় মিঃ সেনের বাড়ি এসে পড়েছি – এ পাঁয়েজি, রোখকে রোখকে!”
—
মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (১৯০৪ – ১৯৩৯) ছিলেন অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘রামধনু’ পত্রিকায় ‘পদ্মরাগ’ গল্পে জাপানী ডিটেকটিভ হুকাকাশি’র সঙ্গে উনি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন। পড়ে মুগ্ধ হয়েছিল নবীন পাঠকরা এবং বড়রাও। হুকাকাশি সেকালে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন বোঝা যায়, যখন হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী ডিটেক্টিভ কল্কেকাশিকে নিয়ে গল্প লেখেন। মনোরঞ্জন রামধনু পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।