হিরে চোর হবুচন্দ্র – অদ্রীশ বর্ধন

হিরে চোর হবুচন্দ্র – অদ্রীশ বর্ধন

হবুচন্দ্রের গায়ের রং আর আলকাতরা রং হুবহু এক। দেখতেও কদাকার। কিন্তু বলিষ্ঠ বলতে যা বোঝায়, অক্ষরে-অক্ষরে সেতাই। সেনিজেও বড়াই করে বলে, ‘কার্তিক দুলের নাম জানা আছে? নদিয়ার সেই বিখ্যাত জোয়ান ডাকাত? সেই রক্তই তো আছে আমার মধ্যে। দেখতেও তো তার মতোই হবই।’

কার্তিক দুলের ব্যাপার যারা জানে, তারা তখন বলে, ‘তা হলে তোর নাম হওয়া উচিত লোহার কার্তিক।’

একগাল হেসে হবুচন্দ্র বলে, ‘তা তো বটেই!’

এই হবুচন্দ্রকেই হিরে চুরির জন্য সন্দেহ করে বসল ইন্দ্রনাথ। কিন্তু নাকের জলে চোখের জলে হয়ে গেল তার কারসাজি ধরতে গিয়ে।

উত্তরপ্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় হিরে পাওয়া গেছে, ভারত সরকার এই খবর পেয়েই হিরের খনি গড়ে তোলবার ভার দিয়েছিল লণ্ডনের এক কোম্পানিকে। একদিন একটা পাঁচশো ক্যারাটের বিরাট হিরে পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে জমা দেওয়া হয় দফতরে। সেদিন ছিল শনিবার। লোহার সিন্দুকে রাখা হয় সেই হিরে। রবিবার ছুটির দিন। সোমবার সকালে সিন্দুক খুলে দেখা গেল হিরে নেই।

সিন্দুকে চাবি দিয়েছিলেন সেক্রেটারি আর ম্যানেজিং ডিরেক্টর। দু-জনের কাছে দুটো চাবি। দুই চাবি পাশাপাশি না লাগালে হিরের সিন্দুক খোলা যায় না। কিন্তু দু-জনই রবিবার আসেননি।

হিরের খনির অফিসে পাহারার বড়ো কড়াকড়ি। অফিস থেকে বেরোবার সময়ে সার্চ করা হয় প্রত্যেককেই, শনিবার সন্ধ্যায় সার্চ করা হয়েছিল সেক্রেটারি আর ম্যানেজিং ডিরেক্টরকেও। হিরে তাঁদের কাছে ছিল না। আরও যারা বেরিয়েছে, তাদেরও কারও কাছে ছিল না। রবিবার তো কেউ কাজেই আসেনি, অফিস ছিল বন্ধ।

অতবড়ো হিরেটা কি তা হলে উবে গেল? না কি, বন্ধ সিন্দুকের মধ্যে থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে পাহারাদারদের নাকের ডগা দিয়ে, ডানা মেলে উড়ে গেল?

পুলিস এসেছিল। অনেক হম্বিতম্বি করার পর তারা বলল, ‘সিন্দুকের মধ্যে হিরেটাকে আদৌ রাখা হয়েছিল কি?’

মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল সেক্রেটারি আর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মশাইয়ের।

অস্বাভাবিক কর্কশ গলায় বলে উঠেছিলেন বড়ো কেমিস্ট, ‘‘আমার সামনেই রাখা হয়েছিল। রেখেছিল এই হবুচদ্র, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।’’

পুলিস অফিসার ভীম সিং গলাবাজিতে কম যান না। বড়ো কেমিস্টের বাজখাঁই গলার জবাবে তিনি কিন্তু আশ্চর্য নরম গলায় বললেন, ‘শুনেছি মালোয়ারাজ রাজবাহাদুর এই রকম চাপা কড়া গলায় কথা বলতেন। পুলিসের লোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, শিগগিরই তা শিখিয়ে দেব।’

এই বলে গোটা অফিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও হিরে না পেয়ে মুখ অন্ধকার করে চলে গেলেন ইন্দ্রনাথের কাছে।

কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। ইন্দ্রনাথের অবস্থা হল তাই। সেবেচারি ভীম সিংয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে কবজি ডুবিয়ে খেতে গিয়েছিল। ভীম সিং তার কলেজ-ফ্রেণ্ড। কালো মুখে তাকে অসময়ে বাড়ি ফিরতে দেখে ইন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেছিল ‘কী হয়েছে রে?’

সব কথা শুনে ইন্দ্রনাথ বলল, ‘চল তো যাই।’

ফের গোটা অফিসবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল দু-জনে। তেরিয়া মেজাজি বড়ো কেমিস্টের ল্যাবরেটরি ঘরটা কিন্তু বেশি ভালো লাগল। শিশি-বোতল, বার্নার, টেস্টটিউব, ওজন একটা টুল টেনে বসে গেল ক্লান্ত ভীম সিং। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে চেয়ে রইল ধোঁয়ার কুন্ডলির দিকে। ধোঁয়া তালগোল পাকিয়ে ভেসে গেল দূরের পাহাড়ের দিকে। অতদূর অবশ্য গেল না। একটু গিয়ে গলে-গলে মিশে গেল বাতাসে।

কিন্তু চোখ দুটো চকচক করে উঠল চাপা উত্তেজনায়। মনটা যে খুশিতে ভরে উঠেছে, তাও বোঝা গেল ঘুরে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময়ে। স্ফূর্তির সুরে বলল লোহার কার্তিককে, ‘তোমার নাম হবুচন্দ্র?’

‘আজ্ঞে,’ বিগলিত গলায় বলল হবুচন্দ্র।

‘কেমিক্যাল-টেমিক্যাল নাড়াচাড়া করতে করতে কেমিস্ট্রিও নিশ্চয় শিখে গেছ?’

‘কিছু কিছু।’

‘হিরে উড়িয়ে দেওয়ার বিদ্যেটা শিখেছ?’

‘আজ্ঞে, ওইটাই শিখিনি বলে এই কাজটা পেয়েছি।’

লোহার কার্তিকের বোকা-বোকা চোখ দুটোর দিকে কিছুক্ষণ হাসি চোখে চেয়ে থেকে বড়ো কেমিস্টের দিকে তাকিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, ‘আপনার এই শাগরেদটি আপনার ছাঁচেই ঢালাই হয়েছে। ভাঙবে তবু মচকাবে না।’

‘কী বলতে চান?’ বড়ো কেমিস্টের গলায় আবার সেই মেঘের ডাক।

‘সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি হোক তা হলে,’ বলে, অমায়িক হেসে বেরিয়ে এসেছিল ইন্দ্রনাথ।

অফিসের বাইরে এসেই ইন্দ্র বলল ভীম সিংকে, ‘ঢেঁকিশালের যদি মানিক না পাই, তবে পর্বতে যাই।’

খেঁকিয়ে উঠল ভীম সিং ‘মানে?’

‘লোহার কার্তিককে যতটা বুদ্ধির ঢেঁকি ভাবছিস, ততটা না। ওর গুরু বড়ো কেমিস্ট একটা মস্ত ঘুঘু।’

‘তুই বুঝেছিস, হীরে কে নিয়েছে, কোথায় আছে?’

‘সিগারেটের ধোঁয়া দেখেই বুঝেছি।’

‘তবে সেটা আমাকে বলা হচ্ছে না কেন?’

‘হিরেচোরকে দিয়েই হিরে উদ্ধার করাব বলে। মেজাজ গরম না করে যা বলি, তাই কর। বড়ো কেমিস্ট আর হবুচন্দ্র, এই দু-জনের পেছনেই আঠার মতন লোক লাগিয়ে রাখ। দিনে-রাতে, সব সময়ে।’

তিনদিন পরে ভীম সিং বলল, ‘রোজ বিকেল নাগাদ ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যেত বড়ো কেমিস্ট, সোমবার থেকে আর যাচ্ছে না।’

‘গুড। আর ওই রামঢেঁকিটা?’

‘হবুচন্দ্র? সে-ব্যাটাও গোয়াল থেকে বেরোচ্ছে না।’

‘রবিবার কি বড়ো কেমিস্ট পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল ঘোড়া নিয়ে?’

‘গিয়েছিল।’

‘বা:। বাড়িতে আর কে থাকে?’

‘হবুচন্দ্র আর ওই গবুচন্দ্র। মানে, ওই বিদঘুটে বড়ো কেমিস্ট।’

‘কাজের লোক?’

‘ঠিক কাজের একজন ব্যাটাছেলে আছে। সকালে আর সন্ধ্যায় আসে।’

‘তার পেছনে লোক লাগিয়েছিস?’

‘না তো!’

‘যা, যা, এক্ষুনি লোক লাগা। পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে দেখলেই পেছু নেয় যেন।’

রাত দশটার সময়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে ভীম সিং বলল, ‘কেয়াবাত! কেয়াবাত!’

‘মানে?’

‘ভাগ্যিস তুই বললি! আজই প্রথম পাহাড় বেড়াতে যাচ্ছিল কাজের লোকটা। পেছনে লোক লেগেছে বুঝেই পালাতে গিয়েছিল। পারেনি। পকেটে পাওয়া গেছে এই নকশাটা।’

‘তা হলে হীরে পাহাড়ে আছে — এই সেই নকশা। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রের বাড়িটা সার্চ করবই ভাবছিলাম — দরকার নেই। চ’।’

‘কোথায়?’

‘পাহাড়ে।’

পরের দিন সকালে বড়ো কেমিস্টের ল্যাবরেটরি ঘরে ঢুকল ইন্দ্রনাথ আর ভীম সিং। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্র দু-জনেই হাজির ছিল সেখানে।

বাজখাঁই গলায় বলল বড়ো কেমিস্ট, ‘ফের জ্বালাতে এসেছেন?’

‘জ্বালাতে আসিনি। জানতে এসেছি,’ বললে ইন্দ্রনাথ।

‘কী জানতে চান?’

‘হাইড্রোজেন গ্যাস সিসের পাইপের মধ্যে ঠেসেঠুসে কমপ্রেস করে রাখা যায়?’

‘যায়,’ বড়ো কেমিস্টের বাজখাই গলা একটু কেঁপে গেল যেন!

দাঁড়িপাল্লা আর দেয়ালের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে একটা সিসের নল টেনে বের করল ইন্দ্রনাথ। লম্বায় তিন ইঞ্চি, ব্যাস এক ইঞ্চি। দুটো মুখ সিসে গালিয়ে বন্ধ করা। এক মুখে একটা পেতলের কল। সব মিলিয়ে বেশ ভারী।

‘সোমবার সকালে বাক্সের আড়ালে এই নল দেখেও দেখিনি। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছিলাম। ধোঁয়া উড়ে গেল পাহাড়ের দিকে। ভীম সিংকে পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, সন্ধের দিকেও হাওয়ার টান থাকে পাহাড়ের দিকে। শনিবার সন্ধে পর্যন্ত এই ঘরে ছিল তো হবুচন্দ্র, তাই না?’

‘ছিলাম,’ বলল লোহার কার্তিক।

‘তোমার ‘বস’ তখন বাড়িতে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তোমাকে। খুব সোজা কাজ। কেমিস্ট্রির অ-আ-ক-খ জানা থাকলেই তা করা যায়। কী করেছিলে হবুচন্দ্র?’

হবুচন্দ্র ভীষণ বোকা হয়ে গিয়ে শুধু চেয়েই রইল।

সিসের পাইপটা তুলে ধরে ইন্দ্র বলল, ‘বেলুনটা কলের মুখে লাগিয়ে দিয়ে কল খুলে দিলে, গ্যাস বেলুন ফুলে উঠল, হালকা নাইলন জালের মধ্যে হিরে রাখা ছিল আগে থেকেই। জানলা গলিয়ে উড়িয়ে দিলে বেলুন। হাওয়ার টানে পাহাড়ের দিকে গেল বেলুন আর হিরে — হিসেব করাই ছিল — সে-হিসেব তোমার গুরুদেবের — মোটামুটি কোথায় গিয়ে নামবে বেলুন পরের দিন ঘোড়া নিয়ে সেদিকেই গেলেন তিনি। বেলুনটা ছিল লাল রঙের, তাই না?’

শেষ প্রশ্নটা করা হল বড়ো কেমিস্টকে। তাঁর বাজখাঁই গলা হঠাৎ বিগড়ে গিয়েছিল বলেই জবাব দিলেন না।

পকেট থেকে একটা রবারের লাল বেলুন বের করল ইন্দ্রনাথ, ‘এই সেই বেলুন — যাতে সবুজ গাছে লটকে থাকলেও চিনতে পারেন, তাই লাল, চিনেও ফেললেন। গাছ থেকে চুপসানো বেলুন নামালেন। সেই গাছের তলাতেই বেলুন, নাইলন জাল আর হিরে পুঁতে রেখে দিলেন — নকশা বানিয়ে রাখলেন, পুলিসি ঝামেলা কমলে বের করে নেবেন বলে। কিন্তু সেসুযোগ আর পেলেন কই? ভীম সিং এমন স্পাই লাগাল আপনার পেছনে — নকশাটা? আপনার কাজের লোককে পাঠিয়েছিলেন তো নকশা দিয়ে হিরে উদ্ধার করবেন বলে। দুঃখের বিষয় হিরে উদ্ধার হয়েছে, আমি আর ভীম সিং-ই গিয়ে নিয়ে এলাম আপনার সুন্দর নকশার পথ ধরে।

…. এই সেই হীরে।’

পাঁচশো ক্যারাট ওজনের সুবৃহৎ ক্রিস্টালাইজড কার্বনখন্ডকে ঠক করে টেবিলের ওপর রাখল ইন্দ্রনাথ।

সঙ্গে-সঙ্গে কড়-কড়-কড়াত করে যেন বাজ পড়ল ঘরে মধ্যে। মানে, বাজখাঁই চিৎকার ছাড়লেন বড়ো কেমিস্ট, ‘দুশমন!’

ভীষণ থতমত খেল ইন্দ্রনাথ, ‘কে?’

‘আপনি! হিরেচোর কোথাকার! দোসর এই জাম্বুবান পুলিস অফিসার!’

ভীম সিং ভীমের মতোই ফুলে উঠেছে দেখে এবার এমন একখানা অট্টহাসি হাসল ইন্দ্রনাথ রুদ্র, যা অনায়াসেই পাল্লা দিতে পারে বড়ো কেমিস্টের বজ্রগর্জনের সঙ্গে। হাসিটা শেষ করার পর বলল মিঠেকড়া গলায়, ‘হে বন্ধু আপনি কি আগে ম্যাজিশিয়ান ছিলেন? হাতসাফাইয়ের ওই খেলাটা যে আমিও জানি,’ বলতে-বলতে হিরেটাকে ডান হাতে তুলে নিয়ে পাশের লম্বাটে চুরুটের বাক্সে রেখে ডালাবন্ধ করে দিল ইন্দ্রনাথ, ‘আপনার চুরুটের বাক্স আপনাকেই দিলাম হিরে সমেত। খুলুন, ডালা খুলুন।’

ডালা খুললেন না বড়ো কেমিস্ট মনে হল, এবার মূর্ছা যাবেন।

ইন্দ্রনাথ বাক্স দিল ভীম সিং-এর হাতে, ‘খোলো হে চন্দ্রবদন, খুলে দ্যাখো সাত রাজার ধন এক তো মানিককে।’

ছোঁ মেরে বাক্স নিয়ে ধাঁই করে ডালা খুলে ‘বুরবক’ বলায় ভীম সিং বলল, ‘কোথায় হিরে! এই তো রাখলি।’

‘মোটেই রাখিনি। এই দ্যাখ হিরে,’ চেটো খুলে দেখাল ইন্দ্রনাথ, ‘হাতেই রেখেছি। অথচ স্পষ্ট দেখলি, হিরে রাখলাম বাক্সের মধ্যে। ঠিক এমন হাতসাফাই দেখিয়েছিল নষ্টচন্দ্র এই হবুচন্দ্র। শিখিয়ে রেখেছিলেন অবশ্য এই বড়ো কেমিস্ট — সেক্রেটারি আর ম্যানেজিং ডিরেক্টর দু-জনকেই বোকা বানিয়েছিলেন — চোরের মায়ের গলা বড়ো বলেই পুলিসের সামনে একাই অত তড়পে যাচ্ছেন। কী বুঝলি চন্দ্রবদন ভীম সিং? হিরে সিন্দুকে যায়নি, এখানেই এনে রেখেছিল গ্রেট হবুচন্দ্র — সন্ধে ঘনাতেই উড়িয়ে দিয়েছিল বেলুন বেঁধে। সেই হিরে দিলাম তোর হাতে। পুলিশি হাঙ্গামায় আমি আর নেই — আমার খিদে পেয়েছে।’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *