হিরে উধাও রহস্য
ছোটমাসির বাড়ির ছাদে দারুণ এক পিকনিক হল লক্ষ্মীপুজোর রাত্তিরে৷ প্রত্যেক বছরই হয় এরকম, তবে এ বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমাদের ছোটমামা আসায় আরও জমে গিয়েছিল, ছোটমামা গল্প করতে পারেন৷
ছোটমাসির বাড়ির ছাদটা প্রকাণ্ড৷ তার একটা কোণ তেরপল দিয়ে একটুখানি ঘিরে দিয়ে সেখানে পাতা হয় ইটের উনুন৷ আর ছাদের অন্যদিকে সতরঞ্জি পেতে হারমোনিয়াম নিয়ে গানবাজনা আর আড্ডা৷ সে-রাতে কিন্তু কোনো আলো জ্বালা হয় না৷ কোজাগরী পূর্ণিমায় এমন জ্যোৎস্না থাকে যে তখন অন্য কোনো আলো জ্বাললেই বিচ্ছিরি দেখায়৷ আর সেই জন্যই তো ছাদে পিকনিক৷ প্রায় তিরিশ-পঁয়তিরিশজন এসেছিল সেই পিকনিকে! ছোটমাসির দুই মেয়ে হাসি আর খুশির সাত-আটজন বন্ধু৷ ওদের ভাই বাবলুর চার-পাঁচজন বন্ধু৷ বড়মাসি আর সেজোমাসির ছেলেমেয়েরা৷ অর্থাৎ ছোটরাই বেশি৷ ছোটমাসি আর ছোট-মামার চেনাশুনা কয়েকজন এসেছিলেন, তাঁদের সবাইকে আমি চিনতাম না আগে৷
দু’তিনজন কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে রান্নার দিকটা সামলাচ্ছেন আমাদের বড়মাসি৷ তাঁর হাতের রান্না চিংড়িমাছের মালাইকারি যে একবার খেয়েছে সে আর জীবনে ভুলবে না৷
ওদিক থেকে রান্নার চমৎকার গন্ধ ভেসে আসছে, আর এপাশে জমে উঠেছে আনন্দের আড্ডা৷
প্রথমে হাসি আর খুশি আর তার বন্ধুরা কয়েকখানা গান শোনাল কোরাসে৷ ছোটমামার এক বন্ধু সুজিতবাবু ম্যাজিক দেখালেন কয়েকটা৷ অদ্ভুত ম্যাজিক জানেন তিনি৷ একেবারে খালি হাত, কোনো যন্ত্রপাতি নেই, এক জায়গায় বসে বসে তিনি অত্যাশ্চর্য কাণ্ড দেখাতে লাগলেন৷ রান্নার জয়গা থেকে দুটো ডিম আনতে বলে তিনি সেই ডিম দুটো তাঁর সামনে রেখে রুমালে ঢেকে দিলেন৷ একটু বাদেই রুমাল তুলে নিতেই দেখা গেল ডিমের বদলে সেখানে রয়েছে একদম বাচ্চা দুটো মুর্গির ছানা৷ আবার সে দুটোকে রুমালে ঢেকে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন এখানে কী আছে?
আমরা সবাই বললুম, মুর্গির ছানা৷
উনি বললেন, ঠিক? আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে যে-কোনো একজন রুমালটা তোলো৷
খুশি রুমালটা তুলেই বলে উঠল, ও মা!
আমরা অবাক হয়ে দেখলুম, মুর্গির ছানা নেই, সেখানে ডিম দুটো আবার ফিরে এসেছে!
আরও কত সব চমকানো খেলা৷ তার মধ্যে আর একটা খেলাতে আমি খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলুম৷
একটা দশ টাকার নোট অনেকগুলো ভাঁজ করে সুজিতবাবু ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে বললে, যাঃ!
নোটটা আর নীচে পড়ল না৷ কী যে হল, আমরা কেউই বুঝতে পারলুম না৷
আমি জিজ্ঞেস করলুম, টাকাটা কোথায় গেল? একেবারে উড়িয়ে দিলেন৷
সুজিতবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? তুমিই তো টাকাটা নিলে৷ ডান পকেটে হাত দিয়ে দেখ—৷
সত্যিই আমার পকেটে সেই ভাঁজ করা দশ টাকার নোটটা৷ সবাই হাসতে লাগল আমার দিকে চেয়ে৷
আমি সুজিতবাবুর থেকে অনেকটা দূরে বসেছিলাম৷ তবু ওই টাকাটা আমার পকেটে গেল কী করে? ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি?
ম্যাজিকের পর হল ধাঁধা, তারপর মেমারি গেম, তারপর আবার গান৷ শেষকালে ছোটমামা যেই অস্ট্রেলিয়ার গল্প শুরু করেছেন, অমনি বড়মাসিমা এসে তাড়া দিলেন, এবার খেতে বসো সবাই, ঠান্ডা হয়ে যাবে খাবার! তা ছাড়া একটু বাদেই হিম পড়বে!
খবরের কাগজ পেতে বসা আর কলাপাতায় খাওয়া৷ এক ব্যাচে হল না, দু’ব্যাচে৷ ভাত, নারকেল দিয়ে রান্না মটর ডাল, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, আর চিংড়িমাছের মালাইকারি৷ কী অপূর্ব যে খেতে লাগল কী বলব! খেতে খেতে সিদ্ধার্থ নামের একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, থ্রি চিয়ার্স ফর বড়মাসি…হিপ…হিপ…৷ সবাই বলল, হু-র-রে! তারপর ছোটমাসির নামেও থ্রি চিয়ার্স দেওয়া হল৷
প্রথম ব্যাচ খাওয়া শেষ হবার পর দ্বিতীয় ব্যাচ সবেমাত্র বসেছে, আমার ওপর পড়েছে পরিবেশন করার ভার, এই সময় একটা কাণ্ড হল৷
কোথা থেকে ছাদে উঠে এল একটা কুকুর৷
রাস্তার নেড়িকুত্তা নয়, বড় বড় লোমওয়ালা একটা সাদা কুকুর, অনেকটা জার্মান স্পিৎস ধরনের৷ কুকুরটা ছাদে এসেই দারুণ জোরে দৌড়াতে লাগল এদিক-ওদিকে৷ সবাই এ কি, বলে উঠে দাঁড়াল৷
ছোটমাসির সাঙ্ঘাতিক কুকুরের ভয়৷ যত ছোট কুকুরই হোক না৷ ছোটমাসি উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় নাচের মতন তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে বলতে লাগলেন, ওমা, একি! একি! এটা কোথা থেকে এল রে!
ছোটমাসির মেয়েরা কিন্তু কুকুরকে ভয় করে না৷ হাসিই ধরে ফেলল কুকুরটাকে৷ কোলে নিয়ে বলল, বাঃ কী সুন্দর কুকুরটা! কাদের এটা!
এ বাড়িতে কুকুর নেই৷ সত্যি, কোথা, থেকে এল?
ছাদের কার্নিশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেল যে রাস্তায় একজন বুড়ো মতন লোক একটা চেন হাতে নিয়ে এ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কুকুরটা নিশ্চয়ই ওঁরই৷ কোনোরকমে চেন ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছে৷ একজন নীচে গিয়ে কুকুরটা ফেরত দিয়ে এল৷
যাক, বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি৷ কুকুরটা দুটো কলাপাতা মাড়িয়ে দিয়েছিল৷ সে দুটো বদলে দিয়ে আবার খেতে বসল দ্বিতীয় ব্যাচ৷
রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ছোটরা প্রায় সবাই চলে গেল৷ বড়রাও গেছে অনেকে৷ আমরা সাত-আটজন তখনও বসে ছোটমামার ক্যাঙারু ধরার গল্প শুনছি, এমন সময় হঠাৎ ছোটমাসি বলে উঠলেন, এ কী, আমার নাকছাবি?
ছোটমাসি সেদিন নাকে একটা সুন্দর হিরের নাকছাবি পরেছিলেন, আমরা সবাই লক্ষ করেছি৷ এখন সেটা নেই!
ছোটমামা বললেন, নিশ্চয়ই এখানে কোথাও খুলে পড়েছে, খুঁজে দ্যাখ!
বড়মাসি বললেন, কুকুরটা দেখে তুই যেমন তিড়িং বিড়িং করে লাফালি তাতে নাকছাবি খুলে পড়বে, সেটা আর আশ্চর্য কী!
এবার আর জ্যোৎস্নার আলোর ওপর ভরসা করা যায় না৷ খুশি দৌড়ে নীচ থেকে নিয়ে এল টর্চ৷ ছোটমাসি যেখানে বসেছিলেন খুঁজে দেখা হল৷ হিরের নাকছাবি সেখানে নেই৷
তখন আরও টর্চ আনা হল, জ্বেলে দেওয়া হল ছাদের আলো৷ সবাই মিলে আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু সেটা পাওয়া গেল না৷
ছোটমামা জিজ্ঞেস করলেন, তুই এর মধ্যে নীচে গিয়েছিলি? মনে করে দ্যা তো!
ছোটমাসির স্বভাব খুব ছটফটে৷ এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না৷ আমি যতবারই এ বাড়িতে এসেছি, ততবারই দেখেছি যে ছোটমাসি চটি পায়ে দিয়ে ফটফটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা বাড়ি৷ ছোটমাসির দারুণ স্বাস্থ্যবাতিক৷ কিছু একটাতে হাত দিলেই অমনি হাত ধোওয়া চাই৷ তাঁর চটিও অনেকগুলো! রান্নাঘরের চটি, শোবার ঘরের চটি, ছাদের চটি—সব আলাদা আলাদা৷
কিন্তু আজ ছোটমাসি অন্তত দু’ঘণ্টার মধ্যে নীচে যাননি, সবাই বলল৷
হাত ধুয়েছেন মোটে তিনবার৷ ছাদেই একটা কল আছে, সেখানে৷ তবে কি হাত ধোয়ার সময় নর্দমা দিয়ে জিনিসটা চলে গেল? সেখানটায় খোঁজা হল ভালো করে৷ নর্দমার ঝাঁঝরিতে শ্যাওলা জমে আছে, জল যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সেখান দিয়ে একটা নাকছাবি চলে যাবে, এমন বিশ্বাস হয় না৷
ম্যাজিশিয়ান সুজিতবাবু বললেন, কিন্তু যখন কুকুরটাকে দেখে আপনি নাচলেন, তখন আপনার নাকে নাকছাবি ছিল না৷ আমি লক্ষ করেছি৷ আমার একটু খটকা জেগেছিল, কিন্তু ভেবেছিলাম আপনি নিজেই খুলে রেখেছেন৷
হাসি আর খুশি বলল, কিন্তু মা, মেমারি গেমের সময় যখন তুমি হেরে গিয়ে খুব হাসছিলে, তখন তোমার নাকে ওটা চকচক করছিল, আমরা দেখেছি৷ তারপর তো তুমি আর নীচে যাওনি!
ছোটমাসি হঠাৎ বড় বড় চোখ মেলে সুজিতবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওটা লুকিয়ে রেখেছেন, তাই না!
সুজিতবাবু বললেন, আরে না, না! ওরকম প্র্যাকটিক্যাল জোক আমি করি না৷
সবাই মিলে সুজিতবাবুকে চেপে ধরা হল, তিনি বারবার ওই কথাই বলতে লাগলেন৷
তখন ছোটমাসি বললেন, আপনি ম্যাজিক জানেন, আপনি ওটা খুঁজে বার করে দিন৷ জিনিসটা আমার খুব প্রিয়…৷
সুজিতবাবু বললেন, সে ক্ষমতা আমার নেই৷ সবাই যেমন খুঁজছে, কিন্তু পেলাম না তো!
এঁটো কলাপাতাগুলো বাইরে ফেলা হয়নি, ছাদের এককোণে জড়ো করা ছিল, তার প্রত্যেকটি আবার উলটে-পালটে ভালো করে দেখা হল৷ খবরের কাগজ, সতরঞ্জি—কিছুই দেখা বাদ রইল না৷
ছাদের নর্দমাটার ঝাঁঝরি খুলে, সেখানে এক বালতি জল ঢেলে নীচে যেখানে জলটা পড়ে, সেখানেও দেখা হল সবাই মিলে৷ নাকছাবিটা নেই৷
রাত বারোটার সময় ছোট-মেসোমশাই বললেন, যাক, আর খোঁজবার দরকার নেই, যা হবার তা তো হয়েই গেছে৷
পরদিন সকালেই আমি এলুম আবার ছোটমাসির বাড়িতে, ছোটমাসির মুখে একটা কান্না কান্না ভাব৷ নাকছাবির হিরেটার দাম দু’হাজার টাকার বেশি৷ শুধু সেজন্য নয়, ওটা ছোটমাসিকে দিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি, সেই জন্যই ওটার একটা বিশেষ মূল্য আছে৷ সেইজন্যই ছোটমাসি ওটার দুঃখ ভুলতে পারছেন না৷
আমি বললুম, ছোটমাসি পুলিশে খবর দেবে নাকি?
ছোটমাসি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, না, থাক৷ সবাই চেনাশুনো…
অর্থাৎ পিকনিকে যারা এসেছিল, তারা সবাই চেনাশুনো, তাদের মধ্যে যদি কেউ নিয়ে থাকে কিংবা ইচ্ছে করে লুকিয়েও রাখে, তা হলেও তাদের কাছে পুলিশে গিয়ে ঝামেলা করবে, এটা ঠিক নয়৷
একটু বাদেই এসে হাজির হলেন ছোটমামা৷
তিনি বললেন, আমি কাল রাত্তিরে অনেক ভাবলুম, বুঝলি? কে নিতে পারে? ছোটরা কেউ নেবে না, তারা বাদ!
আমি বললুম, কেন? ছোটরা কেউ নিতে পারে না কেন? ছোটরা বুঝি সবাই সাধু?
ছোটমামা বললেন, ছোটরা অন্য কোনো জিনিস হলেও নিতে পারত৷ কিন্তু একটা নাকছাবি নিয়ে কী করবে? কোনো বাচ্চা মেয়ে আজকাল নাকছাবি পরে না৷ আর ছোট ছেলেরা কেউ পেলে তক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে কৃতিত্ব নিত৷ যাই হোক, বড়দের মধ্যে রইলুম আমরা সাত-আটজন৷ তোর সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয় কাকে বল তো?
আমি বললুম, যাই বল, ছোটমামা, ওই ম্যাজিশিয়ান সুজিতবাবুকেই আমার সন্দেহ হয়৷
ছোটমামা হাসতে হাসতে বললেন, আর ওই সুজিত আমায় সকালে টেলিফোনে কী বলল জানিস? সুজিত বলল তার সন্দেহ হয় তোকে৷
আমাকে?
হ্যাঁ!
ছোটমাসি বললেন, নীলুকে সন্দেহ? তুমি কী যা তা বলছ ছোড়দা?
ছোটমামা বললেন, বাঃ নীলুর পকেট থেকে সেই দশ টাকার নোটটা পাওয়া গিয়েছিল না!
আমি বললুম, ছোটমামা, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি৷ তোমার ওই বন্ধুকে সাবধান করে দিও! ওসব ম্যাজিশিয়ান-ফ্যাজিশিয়ানদের আমি গ্রাহ্য করি না!
ছোটমামা আবার হেসে গড়িয়ে পড়লেন৷ তারপর বললেন, তুই অত রাগছিস কেন? ও কি সত্যি তোর নামে দোষ দিয়েছে নাকি? আমি এমনি বানিয়ে বললুম! ওই সুজিত কিন্তু ম্যাজিশিয়ান নয়৷ ও একজন বড় এঞ্জিনিয়ার, ম্যাজিক দেখানো ওর শখ৷ ও কেন একটা হিরের নাকছাবি নিতে যাবে? সুজিত সত্যি সত্যি আমাকে আজ সকালে যা বলল টেলিফোনে, তা শুনবি?
শুনি?
তার আগে দেখা যাক, আর কে কে নিতে পারে৷ নীলু নেয়নি৷ আমি নিইনি৷ বড়দি-মেজদিদের তো কথাই ওঠে না৷ তোর বরই বা নেবে কেন? রতন আর প্রিয়ব্রত আগে খেয়ে চলে গেছে, তারপর মেমারি গেম হয়েছিল৷ সুতরাং ওরাও নিতে পারে না৷ তাহলে বাকি রইল ওই সাদা কুকুরটা!
ছোটমাসি বলল, একটা কুকুর নাকছাবি নিয়ে যাবে? যত সব পাগলের মতন কথা!
ছোটমামা বললেন, কুকুরটা নেবে না বলছিস? তা হলে আর বাকি রইলি তুই! সুজিতও সেই কথাই বলেছে৷ তোর নাকছাবি তুই চুরি করেছিস!
ছোটমাসি চোখ কপালে তুলে বললেন, আমি করব আমার নিজের জিনিস চুরি? ভদ্রলোক গাঁজা খান বুঝি?—তুই ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করতে পারিস!
আমার আর খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই? শোনো ছোড়দা, তোমার ওই ম্যাজিক দেখানো বন্ধু যেন আর কোনোদিন আমাদের এ বাড়িতে না ঢোকে! তাহলে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেবো!
আহা অত চটে যাচ্ছিস কেন? তুই লুকোসনি তাহলে, এই তো? তা হলে অন্য কেউ লুকিয়েছে৷ দেখিস, দু’একদিনের মধ্যেই ফেরত দিয়ে যাবে৷
এরপর সাতদিন কেটে গেল৷ কেউ সেই নাকছাবি ফেরত দিল না৷ দিনের আলোয় ছাদটা খুঁজে দেখা হল অনেকবার৷ সেটা যেন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে৷
তারপরের সাতদিনেও কেউ ফেরত দিল না৷ তারপরের সাতদিনেও না৷ অনেকে ব্যাপারটা ভুলেই গেল৷
মাসখানেক বাদে একদিন রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ছোটমাসির হঠাৎ খুব রাগ হল৷ মনে পড়ে সেই ম্যাজিশিয়ান সুজিতবাবুর কথা৷ লোকটা কেন বলল, আমার জিনিস আমি নিজেই লুকিয়ে রেখেছি? ও কি বলতে চায়? মনের ভুলে ওটা খুলে কোথাও রাখব?
ধড়মড় করে উঠে পড়ে ছোটমাসি আলমারি খুললেন৷ যেখানে গহনা থাকে সেখানটায় খুঁজে দেখলেন আবার৷ আগেও অনেকবার দেখেছেন৷ সেখানে থাকবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ তাছাড়া হাসি আর খুশি জোর দিয়ে বলেছে ওটা মেমারি গেমের সময় মায়ের নাকে দেখেছিল৷ তারপর ছোটমাসি আর নীচে নামেননি৷
তাহলে কি মনের ভুলে ছাদেই কোথাও ওটা রেখে দিয়েছেন? তাও তো অসম্ভব৷ সারা ছাদ কতবার দেখা হয়েছে তার ঠিক নেই৷
মনটা খারাপ হয়ে গেল ছোটমাসির৷ আর ঘুম আসছে না৷ তিনি একা একা উঠে এলেন ছাদে৷
আজ উঠেছে সুন্দর জ্যোৎস্না৷ এখন অনেক রাত৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ একা একা ছাদে ঘুরতে ছোটমাসির বেশ ভালোই লাগছে৷
হঠাৎ এই সময় ভূতে ধাক্কা মারল তাঁকে৷
ওগো মাগো বলে চিৎকার করে দড়াম শব্দে পড়ে গেলেন ছোটমাসি৷ ভাবলেন, বুঝি ভূতে তাঁর গলা টিপে মেরে ফেলবে৷
কিন্তু আর কিছুই হল না৷ ছোটমাসির চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি! পা থেকে একপাটি রবারের চটি ছিটকে গেছে দূরে৷ আস্তে আস্তে উঠে বসতেই একটা ঝকঝকে জিনিসে তাঁর চোখ আটকে গেল৷ জিনিসটা পড়ে আছে তাঁর পায়ের কাছে৷ হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে দেখলেন, সেই হিরের নাকছাবি!
তবে কি ভূত এসে একমাস বাদে এই নাকছাবিটা উপহার দিয়ে গেল?
কী করে ছোটমাসি ওইভাবে রাত্তিরবেলা হিরের নাকছাবিটা ফিরে পেলেন, ‘সেটা যদি আমি না বলে দিই, তোমরা পাঠক-পাঠিকারা পারবে সেই রহস্যের সমাধান করতে?
একটু ভেবে দেখ৷
ছোটমাসির হিরের নাকছাবিটা কোনো একসময় খুলে পড়ে গিয়ে তাঁর পায়ের রবারের চটিতে গেঁথে গিয়েছিল৷ সেইজন্য সবই খুঁজে দেখা হয়েছে, শুধু নিজের পায়ের চটি উলটে দেখা হয়নি৷ ছাদের চটি যেহেতু আলাদা, তাই ওটা ছাদেই সিঁড়ির পাশে রাখা থাকে, সব সময় ব্যবহার হয় না৷ একলা ছাদে এসে ঘুরবার সময় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই চটির তলা থেকে হিরের নাকছাবিটা খুলে বেরিয়ে আসে৷
—