হিমেল রাতের শব – রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

হিমেল রাতের শব – রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

বিমল প্রথমে না বোঝার ভান করে নিঃশব্দ হয়েই কথাটা শুনল, যেন সে খুব তাজ্জব বনে গেছে এমনি একটা ভাব মুখচোখে ফোটাল, কিন্তু ডাক্তার তালুকদার যখন প্রসঙ্গটার গভীরে গিয়ে বেশ গাম্ভীর্য বজায় রেখেই কথাগুলো বলে চলল, বিমল তার কাঁটাচামচ রেখে কৌতূহলী চোখে একবার লক্ষ করল ডাক্তারকে।

কী রকম? হঠাৎ সে শুধাল।

আসলে সবাই—ই শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় এসে হাত—পা গুটিয়ে বসে থাকে, অর্থাৎ কিনা ‘লাশটা’র ব্যবস্থা কী করবে সেইটেই তখন হয়ে দাঁড়ায় মস্তবড় সমস্যা!

কথাটা শেষ করেই কাঁটায়—গাঁথা মাংস টুকরোটা সোজা মুখের ফাঁকে গলিয়ে দিল ডাক্তার।

বিমল জানত, কী অসম্ভব বুদ্ধি আর কৌশল খাটিয়ে সে ডাক্তারের মুখ থেকে প্রসঙ্গান্তর এই মন্তব্যগুলো বের করে আনতে পেরেছে। কিন্তু নিজে এমন ভাবটা দেখাল যেন এরকম যে একটা প্রসঙ্গ উঠবে সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে,—ডাক্তার তালুকদার বলে চলল, পুরো জিনিসটাই হচ্ছে একটা জটিল সমস্যার বান্ডিল! এটা এতটা কঠিন ব্যাপার যে এক এক সময় অবাক হয়ে ভাবি কেন মানুষ বোকার মতন হঠাৎ খুন—খারাপি করে বসে!

কঠিন বলছেন?

নয়তো কী! লাশটার শেষ ব্যবস্থা হিসাবে কী করা যাবে তাহলে? কিছুই না, মাথায় হাত দিয়ে শুধু প্ল্যানের পর প্ল্যান! কিন্তু প্ল্যানগুলো টেঁকসই হওয়া চাই তো শেষ পর্যন্ত?

তা তো বটেই!

অস্পষ্ট স্বরে মন্তব্যটা করেই বিমল তার মনের অন্দরের অতলে সেঁধিয়ে গিয়ে ভাবতে লাগল : পথে এসেছো তাহলে বাছা—এস, বলতেই হবে তোমায় শেষতক— ভাবল বিমল। কিন্তু তার মনের এই ভাবটা মুখের ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলে কোনো সন্দেহের ছায়া জাগিয়ে তোলার চেষ্টাই করল না। ওহে আত্মসন্তুষ্ট গর্দভ বেচারা, বলে যাও বলে যাও! কিন্তু তোমার হয়তো জানা নেই কী ভয়ঙ্কর এক মানসিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল বলেই না কত কৌশল করে তোমার এই পথে আনলাম!

হ্যাঁ, আমারও কথাটা দু—একবার মনে যে না এসেছে তা নয়! বিমল গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল।

হ্যাঁ! ডাক্তার তালুকদার বলে চলল, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘বডি’ই অর্থাৎ দেহটাই একটা সমস্যার সৃষ্টি করছে। যদি দেখা যায় বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে—অর্থাৎ যদি তেমনি সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে তাহলে সন্দেহভাজন মানুষটাকে ফাঁসিতে লটকে দেওয়াও সম্ভব! এবং সেই সন্দেহটা, ওয়েল, অবশ্য আমার পেশার একটা অঙ্গই হল লাশের শরীরে বিষ আছে কিনা তা খুঁজে বের করা। এবং সত্যি বলতে কি আজকাল বিষ দিয়ে কাউকে হত্যা করে খুব সহজে কেউ পার পেয়ে যায় না—

আমি পুরোপুরি এ ব্যাপারে একমত আপনার সঙ্গে! বিমল তেমনি গম্ভীর স্বরে বলল। সে অবশ্য সত্যিই কাউকে বিষ দিচ্ছে না বা সেরকম কোনো মতলবও নেই তার।

বেশ! ডাক্তার তালুকদার বলল, তাহলে বিষের কথাটা যদি বাদই দেন তাহলে মৃত ব্যক্তি যে স্বাভাবিকভাবে মরেছে এমন প্রমাণও আপনি দেখাতে পারছেন না, তাহলেও তো সেই একই সমস্যা থেকে যাচ্ছে অর্থাৎ ‘বডির’ কী করবেন? আর একটা উপায় আছে, যদি দেখা যায় ‘বডিটা’ই আপনার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রমাণ হিসাবে জলজ্যান্ত পড়ে রয়েছে তাহলে সোজা মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বলতে হবে যে এটা একটা আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু সমস্যা হল, আমরা উভয়েই জানি এটা প্রমাণ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়!

অবশ্যই নয়! বিমল কোনোরকমে বলল।

স্যুইসাইড কেসের প্রথম করণীয় বিষয়টাই হল, খুব তীক্ষ্নভাবে লাশটাকে পরীক্ষা করে দেখা। এবং এমন লোক খুব কমই আছে যে এই পরীক্ষার সঠিক ফলটাকে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আপনি নিজে একজন আইনজ্ঞ। সম্ভবত আপনি নিজেও এমন অনেক কেসের বিবরণ পড়েছেন যাতে দেখা গেছে খুনি এরকম চেষ্টা করে পার পাবার চেষ্টা করেছে। তাদের ভাগ্যে পরে কী ঘটেছে নিশ্চয়ই তাও আপনার অজানা নেই!

হ্যাঁ! বিমল ঢেকুর তুলে বলল।

এই বিষয়টার দিকেই বিমল খুব জোর দিয়ে ভেবেছিল। বিমলও মনে মনে এমনিতর একটা ধারণাকে আশ্রয় দিয়েছিল যে রেবতী সাহাকে যদি শেষ পর্যন্ত হত্যা করেই ফেলে, তাহলে তার লাশটাকে এমনভাবে সাজিয়ে রাখতে যাতে লোকটা যে আত্মহত্যা করেছে এমনি একটা ধারণাই যেন সবার চোখে প্রবল হয়ে উঠতে পারে।

তাহলে,—কিছুক্ষণ থেমে তালুকদার আবার শুরু করল, তাহলে যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, দেখা যাচ্ছে সেইখানেই আবার গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা!

তাই তো?

তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি মাত্র পথই রয়েছে হত্যাকারীর কাছে, তা হল লাশটাকে একেবারে গুম করে অর্থাৎ অদৃশ্য করে ফেলা। এবং ঠিক সেই কথাতেই আসছি— কাজটা সাংঘাতিক কঠিন এবং চূড়ান্ত অসুবিধের!

তা ঠিক! কথাটা বলেই বিমল জানলার দিকে মুখ ফেরাল। যেন এ বিষয়ে আর বেশি কিছু শোনার ধৈর্য তার নেই। আসলে সে ভাবছিল, লাশটাকে কীভাবে অদৃশ্য করে দেবে এ বিষয়ে বেশ নিখুঁত একটা প্ল্যান অনেক আগেই করে রেখেছে সে।

একটা মানুষের শব, ডাক্তার তালুকদার বলল, তা সে খুনই করেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই মরে যাক, তার কোনো ব্যবস্থা না করে পার পাওয়া অসম্ভব। লাশটার ব্যবস্থা যেমন করে হোক করতেই হবে। অসকার ওয়াইলডের সেই বিখ্যাত ‘ডোরিয়ান গ্রে’র কাহিনি জানেন তো? সেখানেও লাশটাকে কেমিক্যালের সাহায্যে ব্যবস্থা করে একজন উদ্ধার পেতে চেয়েছিল। আমিও তো একজন কেমিস্ট এবং সেই সঙ্গে ডাক্তার, কিন্তু ওই ব্যবস্থাটা আমার মোটেই মনঃপুত হয়নি।

সত্যি? খুব নরম স্বরে বিমল বলল।

না, ডাঃ তালুকদার লোকটা খুব ধূর্ত টাইপের নয়—একেবারে সরল, বোকাটে—বিমল ভাবল মনে মনে।

শবটাই তাহলে হল গিয়ে প্রধান সমস্যা! তালুকদার এবার মাংসের প্লেটটা একধারে সরিয়ে রেখে বলল, শবটা যেমন বড় তেমনি আড়ষ্ট ও ভারী, তারপর ক্রমশই এটা পচনক্রিয়ার দিকে এগোতে থাকে। এবার চিন্তা করে দেখুন, হত্যাকারীরা এই শবকে লুকোবার জন্যে কোন কোন জিনিসের সাহায্য নেয়—কেউ কেউ ট্রাঙ্কের ভেতরে রেখে দেয়, কেউ মাটির নীচে কবর দেয়, কেউ আবার পাথর বেঁধে নদীর গভীরে তলিয়ে দেয়। কিন্তু এত করেও শেষ পর্যন্ত সেই লাশ উদ্ধার করা অসম্ভব হয় না—অবশ্য আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন একবার!

লোকটা বলে কী! সত্যিই কি আমি পারব না? তাহলে তো বাছা সবই তুমি জানো, বিমল ভাবল মনে মনে। কিন্তু মুখে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার। ব্যাপারটা নিয়ে আমি আগে এতটা কখনো ভাবিনি।

না না, আপনি এতটা ভাববার অবকাশই বা পাচ্ছেন কোথায়? বেশ চিন্তান্বিত সুরে ডাক্তার বলল, অনুভূতিশীল মানুষ মাত্রই এসব নিয়ে খুব একটা ভাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের নিজেদের জীবনে এরকম কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে।

তাহলে? বিমলের গলায় বিমর্ষ সুর।

কিন্তু তা সত্ত্বেও, আপনি জেনে রাখুন, ডাক্তারের গলায় তেমনি চিন্তার সুর, এখানে বেশ সুচিন্তিত পদ্ধতিতে লাশটার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটিই মাত্র পথ রয়েছে। তাহলেই আপনি নিরাপদ, কেউ আপনার কিছু করতে পারবে না! একজন আইনজীবী হিসাবে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনার কৌতূহল জেগে উঠবে—হয়তো আমার চাইতেও বেশি মাত্রায়। এটা হল আইনের একটা অস্পষ্ট সূক্ষ্ম পয়েন্ট—কিন্তু আমার ধারণায় আইনের সংজ্ঞায় নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে একটা কিছু নির্দেশ দেয়া রয়েছে। বিষয়টা আমি কোনদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তা অনুমান করতে পারছেন তো?

না। কিছুই বুঝতে পারলাম না! বেশ আশ্চর্য হয়ে বিমল বলল।

খুনের কোনো মামলাই আপনি আদালতে ওঠাতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি দেখাতে পাচ্ছেন যে খুনের ‘শিকার’টা আপনার জিম্মায় রয়েছে। ডাক্তার বলে চলল, এখানে অবশ্যই আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে ‘করপাস ডেলিকটি’ অর্থাৎ আপনারা আইনজ্ঞ হিসাবে লাশের যে ল্যাটিন নাম রেখেছেন, তা সশরীরে বর্তমান। কিংবা অন্য ভাষায় যাকে ‘লাশ’ বলা চলে সেটা আপনার হাতেই রয়েছে। এমন কী লাশের অঙ্গের কোনো অংশ থাকলেও কেস চলতে পারবে। কিন্তু যেখানে লাশ নেই সেখানে মামলাও নেই! আমার তো মনে হয়, আইনের এ ব্যবস্থাটা ভালোই। নয় কী?

ঠিক! আপনি ঠিকই বলেছেন। বিমল বলল, আমি অবাক হয়ে চিন্তা করছি ঠিক এই কথাটিই আমি আগে ভেবে দেখিনি কেন!

ফস করে কথাটা মুখ দিয়ে বের হতেই মনে মনে বিমল দারুণ অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। না, ডাক্তারের বক্তব্যের উত্তরে চট করে তার মনের ভাবটা প্রকাশ করে ফেলা উচিত হয়নি। তার চোখমুখের উত্তেজনার ভাবটাকে শান্ত করবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল বিমল। তার আশঙ্কা ছিল, রেবতী সাহাকে হত্যা করার যে প্ল্যানটা করেছে সে, পাছে তার এই চাপা উৎফুল্ল উত্তেজনার মুহূর্তে সেই ভাবটা কিঞ্চিৎ প্রকাশ হয়ে পড়ে।

কিন্তু ডাঃ তালুকদার সেসব কিছুই লক্ষ করল না।

তারপর ডাক্তার আবার শুরু করল, তাহলে দেখা যাচ্ছে খুন যাকে করা হয়েছে, তার মৃতদেহ না পেলে কোনো কেসই হতে পারছে না। তাৎক্ষণিক মুহূর্তে একটা লাশকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা খুবই অসম্ভব। কিন্তু ধরে নিলাম, কেউ এটা করতে পারল, সে অবশ্যই রেহাই পেয়ে যাবে। তা তার বিরুদ্ধে যতবড় সন্দেহই হোক না কেন, লাশ না পেলে পুলিশের কোনো ক্ষমতাই নেই তাকে আটকে রাখে। যদি আমি কিংবা আপনি দুজনের কেউ লেখক হতাম তাহলে এ নিয়ে বেশ কিছু লেখা যেত—ঠিক গল্পের মতন করে।

হ্যাঁ। কেমন নির্জীব কণ্ঠে বিমল বলল। গলার স্বর কেমন ভাঙা ভাঙা।

না না, রেবতী সাহার হত্যার ঘটনা নিয়ে কোনো গল্পই লেখা হবে না, হতে পারে না। কেউ জানবেই না। ওই উদ্ধত পাজিটার শেষ পরিণতির কথা কেউ জানতেই পারবে না।

বেশ মজাই হল, কী বলেন? ডাক্তার হেসে বলল, সারা সন্ধেটা আমরা এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম যেটা খুবই বিভীষিকাময় নয় কী? এবং দেখা যাচ্ছে, পুরো আলোচনার ভেতরে একমাত্র বক্তা আমিই। আপনি আমায় নেমন্তন্ন করে এনে এই যে সব সুখাদ্য খাওয়ালেন, বোধহয় তারই ফলশ্রুতি এটা। হাঃ হাঃ! এবার তাহলে ওঠা যাক—কারণ বাইরের আবহাওয়াটা আর বেশিক্ষণ এখানে বসে গল্প করার মতন মোটেই প্রসন্ন থাকবে না!

না মোটেই নয়। বিমল জানলা দিয়ে দেখল, বাইরে রাস্তায় অপেক্ষমাণ গাড়িতে গিয়ে ডাক্তার উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। ঝড়ের আগমনী ঘোষণা অবশ্য বিকেল থেকেই শোনা গিয়েছিল। সারাটা বিকেল—সন্ধে আকাশ কালো হয়ে গুরু গুরু গর্জন শোনা যাচ্ছিল।

ঝড়বৃষ্টির দাপট দেখে বিমল অন্তরে অন্তরে বেশ খুশি হল। তার মানে হচ্ছে এই যে, এই ঝড়বাদলার দুর্যোগের রাতে রাস্তায় লোকজন একদম বেরোবেই না। তারপর নদীতীরের সেই বালির চর, যেখানে গিয়ে সে তরুণ রেবতী সাহাকে একদম লোপাট করে ফেলতে চায় সেখানেও এই প্রচণ্ড দুর্যোগের রাতে অন্য কাউকে দেখা যাবে না।

ড্রইংরুমে ফিরে এসে দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাল বিমল। না, একটি ঘণ্টার মতন সময় এখনও হাতে আছে। এই একঘণ্টা সময়ের মধ্যেই ধীরেসুস্থে বসে সে চিন্তা করার অবকাশ পাবে যে তার সেই নিখুঁত প্ল্যানের ভেতরে কোথায়ও কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা।

থাকলে এই স্পেয়ার সময়টুকুর মধ্যে তা শুধরে নিতে পারবে।

টেবিলের স্তূপীকৃত ছড়ানো আইনের বইগুলোর একপাশে পড়েছিল একখানা জলবায়ু সংক্রান্ত বিশেষ ধরনের বই। তার ভেতরে নদীর জোয়ার—ভাটার সঠিক সময় পরিমাপ করে একটা পঞ্জিকাও আছে। সেটার পাতার মধ্যেই একটা পেন্সিল দিয়ে বিমল ইতিপূর্বে কিছু চিহ্নিত করে রেখেছিল। এখন দেখল, তার আন্দাজই ঠিক। হ্যাঁ ঠিকই অনুমান করেছিল সে।

বর্ষার জোয়ার—ভাটার বিবরণ ওগুলো। বালুচরের উপরে জলের উচ্চতা এখন সবচেয়ে কম। সেদিক দিয়ে অদৃষ্ট খুব প্রসন্ন নয়। তবে যার জন্যে এতটা ভাবনা সেই রেবতী সাহা প্রতি বুধবার রাত বারোটার ভেতরে শেষ ট্রেনে ফিরে আসে এবং খুব কাছেই হোক কিংবা পরেই হোক, বুধবার রাতের সেই সময়টার পর জোয়ার ঠিক আসবেই। একেবারে ভরা কোটাল। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হল এইটেই যে আজ সেই বুধবারের রাতেই শুরু হয়েছে ঝড়জল। তারপর সৌভাগ্যের বিষয় হল, রাতের যে সময়টাকে সে বেছে নিয়েছে ঠিক সেই সময় পর্যন্ত বালুচরের নীচ দিয়ে জলের স্রোত বয়ে যাবে খুব নীচু হয়ে।

আর তারপরই শুরু হবে জোয়ারের কলকল ধ্বনি।

ড্রইংরুমের দরজা খুলে সন্তর্পণে সে কান পেতে রইল। না, কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না কোথায়ও থেকে। পিসিমা অনেকক্ষণ হল তাঁর ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন—তাছাড়া উনি কানেও শোনেন কম। ছোকের মা, এ বাড়ির রান্নাবান্নার ভার যে মহিলার উপর, সেও অনেকক্ষণ হল চলে গেছে। পিসিমা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাঁর ওই কালা কান নিয়ে নিশ্চয়ই তার বেরিয়ে যাবার শব্দ শুনতে পাবেন না। তারপর সে যখন রেবতীকে নিরুদ্দেশ করে দিয়ে নিশ্চিন্তে ফিরে এসে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকবে—সে শব্দও পিসিমার কানে যাবে না।

মনে হল যেন ঘড়ির কাঁটা খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। খুবই দ্রুত। এই মুহূর্তে তার দৃঢ় নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার যে সব কিছুই ঠিক মতন চিন্তা করে রেখেছে সে। লাঙল—শেকল এবং অন্যান্য ভারী লোহার জিনিসগুলো অনেক আগেই সে রেখে এসেছে গাড়ির পেছনের সিটের নীচে। এসব সে করেছে ডাঃ তালুকদার ডিনারের নেমন্তন্ন খেতে আসার কিছু সময় আগেই। পুরনো ওভারকোটটা টেনে এনে গায়ে জড়াল এবার বিমল। ঝড়ের সঙ্গে প্রথম দিকে শিলাবৃষ্টি হওয়াতে এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। যদি সারারাত এমনি দুর্যোগ চলে তাহলে আবহাওয়া আরও ঠান্ডা হবে। শেষরাতের দিকে হিমার্ত বাতাসে ভরে যাবে নদীর চর।

ওভারকোটে শরীরটাকে বেশ আঁটোসাঁটো করে ঢেকে নিল বিমল।

তারপর ওভারকোটের লম্বা পকেট থেকে এমন একটা বস্তু বের করে আনল যেটাকে দেখতে ঠিক একটা যন্ত্রের মতন, সেই যন্ত্রটা দেখতে ঠিক যেন একটা গোল হাত—গুলতি। ছ—ইঞ্চি মাপের লম্বা একটা কাঠের দু’দিকে শক্ত গিঁট দিয়ে বাঁধা রয়েছে আঠারো ইঞ্চি মাপের একটা পাকানো দড়ি। জিনিসটার দিকে খুব তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে বেশ ভালো করে পরীক্ষা করে নিল বিমল। তারপর আবার সেটা পকেটে পুরল। তারপর মনে মনে দু—একবার কী যেন আওড়াল, প্রাচীনকালে ভারতের গভীর জঙ্গলে ওতপেতে থেকে ঠগীরা এই ফাঁস গুলতির সাহায্যে কীভাবে পথিকদের শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত সেইগুলোই মনে মনে আউড়ে নিল।

রেবতী সাহাকে ধরাধাম থেকে অদৃশ্য করে দেবার জন্যে সবকিছু ব্যবস্থাই সে আগে থেকে বের করে রেখেছিল। রেবতী যে শুধু একজন সুদখোর সলিসিটর তাই নয়—মারাত্মক সংক্রামক রোগের মতনই যখন—তখন সে অন্যের ব্যাপারে নাক গলিয়ে থাকে। বিমল জানে, এই রেবতী যদি এখন বেঁফাস কিছু বলে দেয় তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য। জেলে তো তাকে যেতে হবেই সেই সঙ্গে চিরদিনের মতো প্র্যাকটিস থেকেও তাকে সরে আসতে হবে।

রেবতীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যারা তা শোধ দেয়নি তাদের মর্মান্তিক পরিণতির কথাটা জানত বিমল। কিন্তু না, জেলে সে যেতে চায় না কিংবা রাস্তায় ভিক্ষে করেও তার অন্ন জোটাতে রাজি নয় সে। বেশ খানিকটা কাঁপুনি জেগে উঠল বিমলের শরীরে—কিন্তু পরমুহূর্তেই মনকে শক্ত করে উত্তেজিত হয়ে উঠল, না না, কিছুতেই সহ্য করা হবে না রেবতীকে—কোনোমতেই না!

তার মতন একজন বয়স্ক আইনজ্ঞ, চুলের রেখায় রেখায় যার স্পষ্ট ধূসরতার চিহ্ন সজাগ, এবং রেবতী যেখানে তার চেয়ে অনেক জুনিয়র, কোন অধিকারে সে তাকে ধ্বংস করার ইচ্ছে পুষে রাখতে পারে? রেবতীকে প্রতিহত করতে গিয়ে যদি তাকে মৃত্যুর গহ্বরেও ফেলে দিতে হয় তবে তাও করতে হবে বাধ্য হয়ে তাকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে শক্ত মুঠিতে ধরে রইল সে দড়িটাকে। তার মুখের পেশিগুলো দ্রুত নড়েচড়ে উঠল।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল, তার বেরিয়ে পড়ার মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। আলো নিবিয়ে ঘরের বাইরে এসে দরজা বন্ধ করল বিমল। খুব আস্তে আস্তে পা ফেলে নীচের রাস্তায় নেমে এল। তীব্র শীতার্ত হাওয়ার সঙ্গে কুচি কুচি বরফ কণার মতন যে বৃষ্টির ছাঁট এসে তার মুখে লাগছে সেটা সে লক্ষ করেও দেখল না।

গ্যারেজে ঢুকে গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তায় নামাল। এটা তার বাবার আমলের পুরোনো গাড়ি। তারপর একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গ্যারেজের দরজাটায় তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিল। না, কাউকেই বিশ্বাস নেই, গ্যারেজের দরজা খুলে রেখে গেলে কেউ যদি দেখে ফেলে গ্যারেজে গাড়িটা নেই, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ঘন দুর্যোগের রাতে গাড়ি নিয়ে বিমল দত্ত গেল কোথায়?

খুব সতর্ক চেষ্টায় রাস্তা ধরে গাড়িটাকে চালিয়ে নিয়ে চলল বিমল। অবশ্য, এই দুর্যোগের মধ্যে রাস্তায় কোনো জনপ্রাণীরও দেখা মিলছিল না, তারপর রাস্তার আলোগুলো মাঝে মাঝেই নিভে গিয়ে অন্ধকারে ভরে গিয়েছিল পথ। বিমলের সুবিধেই হল সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে। যদিও প্রতিমুহূর্তেই আশঙ্কা ছিল রাস্তার জলে ডোবা কোনো গর্তে গাড়িটা হড়কে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটবার। কিন্তু সেদিকেও তার চোখ ছিল সতর্ক।

ব্রিজের উপর দিয়ে যেতে যেতে স্টেশনের আলো চোখে পড়ল তার। অনেক আলো। যেন রাত বারোটা কুড়ির ট্রেনটা এসে পৌঁছোবে বলেই আলোগুলো প্রতীক্ষা করে আছে এবং কে বলতে পারে, হয়তো তারপরই সব নিভে যাবে। তারপর ঝোড়ো বাতাস আরও ঠান্ডা, আরও উদ্দাম হয়ে উঠবে। রেবতী সাহা ওই ট্রেনেই আসছে। প্রতি বুধবারই কোর্টের কাজ সেরে বিকেলের দিকে সে বড়বাজারে তার একটি ব্রাঞ্চ অফিসে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কাজকর্ম চেক করে দেখাশোনা করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়। তারপর লাস্ট ট্রেনটা ধরে কোলাঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়।

ব্রিজের নীচে নেমে স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা গলির ভেতরে মোটর নিয়ে চলতে লাগল বিমল। তারপর গাড়িটাকে ঘুরিয়ে এমন একটা পজিশনে দাঁড় করাল যাতে মনে হবে সে স্টেশনের দিক থেকেই আসছে। সাইড লাইট দুটো নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল গাড়ির ভেতরে—পকেটের ভেতরে হাতড়ে হাতড়ে গুলতির ফাঁসটাকে স্পর্শ করে গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগল।

ট্রেনটা সামান্য কিছু লেট করে ঢুকল স্টেশনে। গলির অন্ধকারে থেকেই বিমল ট্রেনের আলো দেখতে পেল। তারপর ট্রেনটা যে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে রইল তাও লক্ষ করল। ঝড় আর বৃষ্টির জন্যে যদিও প্ল্যাটফর্মের সব কিছুই ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল এবং ঝড়ের শব্দের জন্যে ট্রেনের কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছিল না তবুও বিমল অনুমানে বুঝে নিল যাত্রীরা সবাই এতক্ষণে নেমে পড়ে যে যার গন্তব্যস্থলের দিকে চলে গেছে। তারপর খুব অস্পষ্টভাবে কানে এল ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে ব্রিজের তলার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতেই স্টেশনের আলোগুলো একে একে নিভে যেতে শুরু করল।

বিমল খুব সতর্ক চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কান পেতে রইল।

আর ঠিক তারপরই, তার তীক্ষ্ন শ্রবণেন্দ্রিয় যন্ত্রে এসে পৌঁছোল পিচ্ছিল পথের উপরে কারো পায়ের শব্দ।

তরুণ উকিল রেবতী সাহা গলির পথ ধরে ছপ ছপ করে হেঁটে আসছে। ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুষারকণার মতন বৃষ্টির ছাঁট থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই মাথা নীচু করে হাঁটছিল রেবতী। গলির ভেতরে একদিকে যে জমাট ঘন ছায়ার মতন একটা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেটা লক্ষই করল না রেবতী….হয়তো গাড়িটার পাশ দিয়েই পথটা অতিক্রম করে যাবে সে।

এবং করলও তাই। গাড়িটা থেকে কয়েক গজ ব্যবধান রেখে বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে একটা কুঁজো ছায়ার মতনই এগিয়ে গেল রেবতী—তেমনি মাথা নীচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে।

এক দুই তিন করে দুশো পর্যন্ত মনে মনে গুনল বিমল, খুবই ধীরে ধীরে। আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই সুইচ টিপে আলোগুলো জ্বালিয়ে দিল, ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল, তারপর গাড়ি চালিয়ে দিল রেবতীকে ধরবার উদ্দেশ্যে। হেড ল্যাম্পের আলোয় একটু পরই রেবতীর চেহারা ভেসে উঠল তার চোখে। পরের সেকেন্ডেই রেবতীর পাশে গাড়ি নিয়ে গিয়ে থেমে পড়ল।

আরে রেবতীবাবু না? গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বিমল ডাকল, আসুন না, আপনাকে একটু লিফট দিচ্ছি, ইস ভিজে যে চুপসে গেছেন দেখছি!

ধন্যবাদ! রেবতী সাহার ভিজে নিস্তেজ গলা ভেসে এল, কী জঘন্য আবহাওয়া দেখুন তো! এই অবস্থায় দু—মাইল পথ হেঁটে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! তা এই রাত বারোটার পর স্টেশনে গাড়ী—ঘোড়াও মিলল না।

আমার গাড়িটাই বোধহয় ভগবান মিলিয়ে দিয়েছেন আপনার জন্যে!

ধন্যবাদ!

রেবতী সাহা বোধহয় ফ্যাসফেসিয়ে একটু হেসে উঠল—হাসির শব্দটা ঝড়ো বাতাসের গোঙানির শব্দে শোনা গেল না। দরজা খুলে গাড়িতে উঠে পড়ল সেই মুহূর্তেই। তারপর সিটে বসে খটাস করে দরজাটা বন্ধ করল। না, কেউই দেখতে পায়নি তার গাড়িতে ওঠা। আর কেউ কখনো জানবেও না এটা। ক্লাচ ছেড়ে দিল বিমল। গাড়ি চলতে লাগল আস্তে আস্তে রাস্তা ধরে।

আপনার সঙ্গে এভাবে দেখা হওয়াতে ভালোই হল! বিমল বলল, স্টেশনের পাশে মিঃ মৈত্রের বাংলোয় বসে তাস খেলতে খেলতে রাত হয়ে গেল। তারপর গাড়ি চালিয়ে যখন ব্রিজ থেকে নামছি তখন ট্রেনটাকে স্টেশনে ঢুকতে দেখে মনে পড়ল, আজ বুধবার এবং প্রতি বুধবারই তো বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন আপনি। ভাবলাম এই দুর্যোগের রাতে একটু লিফট দিলে হয়তো উপকারই হবে আপনার!

সত্যিই যা উপকার করলেন আপনি! ওঃ ধন্যবাদ! রেবতী সাহা তেমনি ঠান্ডা চোপসানো স্বরে বলল।

একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল! খুব আস্তে কথাটা বলল বিমল; সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাও খুব আস্তে চালাল। যদিও কথাটা খুব একটা যে নিঃস্বার্থ তা মোটেই নয়। যখন আপনাকে একটু নিরালায় পাওয়াই গেছে তখন কথাটা বলেই ফেলি। অবশ্য কথাটা পুরো ব্যবসায়িক।

ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলার পক্ষে সময়টা অত্যন্ত যাচ্ছেতাই! রেবতী মুখ ঘুরিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকাল, আচ্ছা, কালকে বললে হত না?

না, কালকে নয়। বিমল বলল, কথাটা হল লেডি হৈমবালা ট্রাস্ট সম্পর্কে! আপনিই তো ওই ট্রাস্টের অছি?

ওঃ হ্যাঁ! গত সপ্তাহে আমি একটা চিঠি দিয়ে আপনাকে জানিয়েছিলাম যে টাকাটা জমা দিয়ে দিন। অনেকদিন হয়ে গেল!

হ্যাঁ। আমি চিঠি পেয়েছি। কিন্তু তার আগে আমি আপনাকে বলেছিলাম যে ইদানীং খুব অসুবিধের মধ্যে যাচ্ছে আমার। টাকাটা শোধ দিতে দেরি হবে—তাছাড়া নির্মল বিদেশে রয়েছে।

বুঝলাম না কিছুই! সামান্য খানিকটা চাপা বিরক্তি ফুটে বেরুল রেবতীর স্বরে, এ টাকার সঙ্গে আপনার ছেলে নির্মলের কী সম্পর্ক রয়েছে তাও বুঝতে পারলাম না! ট্রাস্টের অছি হিসাবে টাকাটা ধার দিয়েছি আমি—অনেকটা লগ্নির মতনই বলতে পারেন, আর সেটা শোধ দেবেন আপনি! পঁচিশ হাজার টাকা সোজা কথা নয়—টাকাটা না পেলে কোনোকিছুই করে ওঠা যাচ্ছে না! আর আপনি টাকাটার ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু না বললে আমিও সোজাসুজি কিছু করতে পাচ্ছিনে।

ওই যা বলেছি, ভারী অসুবিধের মধ্যে যাচ্ছে এখন!

কিন্তু ট্রাস্টের অনারারি সভ্যরা এটা জানতে পারলে বিপদ ঘটতে পারে!

আমার অসুবিধেটাও তো দেখতে হবে! ঘড় ঘড় শব্দ করে বিমল বলল। তারপর গাড়িটাকে এনে দাঁড় করাল রাস্তার একধারে। ক্লাচ চেপে বসে শক্ত আড়ষ্ট হয়ে রইল।

শুনুন রেবতীবাবু, কোনোদিন কখনো আপনার কাছ থেকে এতটুকু সুবিধে চাইনি আমি। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি অন্তত কিছুকালের জন্যে টাকাটার কথা আর ওঠাবেন না। তিন মাস আরও আমায় সময় দিন!

অন্ধকারে রেবতী সাহার মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার ছোট্ট চোখদুটো যে জ্বলছে তা টের পেল বিমল। সেই সঙ্গে রেবতীর দিক থেকে যে কী উত্তর আসবে তাও অজানা ছিল না বিমলের। রেবতী যে তার এই অনুরোধের কোনো সম্মান রাখবে না সে বিষয়ে বিমল এতই সচেতন ছিল যে রেবতীর দিকে তাকাতেও তার ঘৃণা হচ্ছিল।

সত্যিই ঘৃণাটা তার মনের ভেতরে এতটা চেপে বসেছিল যে কখন যে সে পকেট থেকে গুলতির ফাঁসটা এক হাতে তুলে এনেছে তা তার খেয়ালই ছিল না। গুলতি থেকে দড়ির ফাঁসটা এদিককে ঝুলে পড়েছে—আর সেটা হাতে নিয়েই বিমল তার হাতটা বাড়িয়ে দিল রেবতীর আসনের পেছনে।

না অসম্ভব! সত্যিই পারব না আমি! রেবতীর গলায় ঠান্ডার জমাট উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, মক্কেলদের যে দায়দায়িত্ব আমার কাঁধে রয়েছে তার প্রতি আমার একটা কর্তব্য রয়েছে। আমি খুব দুঃখিত যে অনুরোধটা রাখা সম্ভব হল না। আপনি তো জানেন মক্কেলদের প্রতি আমার সেই কর্তব্যটা কী?

জানি! বিমল বলল, কিন্তু আমার সকাতর অনুরোধ এই, আরও কিছুটা সময় দিন আমায়! আমি অনুনয় করছি রেবতীবাবু—দয়া করে অনুরোধটা রাখুন!

আই সি! মুহূর্তখানেক নীরব থেকে রেবতী উত্তর করল।

মাত্র তিনটি মাস সময় চাইছি। বিমলের গলায় জেদের সুর, মাত্র তিনটি মাস। এই তিন মাসের ভেতরে নিজেকে খাড়া করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ পাব আমি!

রেবতী চুপ করে রইল। টাকা সে অনেক মানুষকে দিয়েছে—সেই সব লোকের কথা মনে পড়াতে বিদ্রুপের হাসি পেল তার। অন্ধকারে সেই বিশ্রী হাসিটা চোখে পড়ল না বিমলের। টাকা যারা নিয়েছিল সবারই এক কথা, একটু সময় দিতে হবে—আর সেই সময়ের ভেতরেই তারা নিজেদের খাড়া করে তুলতে সমর্থ হবে, আর রেবতীর টাকাও দিয়ে দেবে।

না! রেবতীর গলার স্বরটা যেন হাওয়ার গোঙানির ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, না, তেমন কোনো অনুরোধ রাখব বলে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। তাছাড়া এ ধরনের আলোচনাকে এখন আর জিইয়ে রাখতে চাইনে আমি। বরং এখানেই আমি নেমে যাই—বাকি পথটা হেঁটেই বাড়ি চলে যাব!

ল্যাচটা ধরবার জন্যে রেবতী যেই হাত বাড়িয়ে দিল, বিমল সেই মুহূর্তে গুলতির ফাঁসটা ছুড়ে দিল তার মাথার উপরে। ফাঁসটা রেবতীর মাথা গলিয়ে গলার কাছে নামল। বিমলের বুড়ো হাড়ের পাতলা শীর্ণ হাতটা সামান্য একটা ঝাঁকুনি দিতেই দড়িটা পাক খেয়ে রেবতীর গলায় আঁটোসাঁটো হয়ে লেগে গেল। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না রেবতী—কিন্তু এটা বুঝতে পারছিল যে বিমলের ওই শীর্ণ হাতটা যেন স্টিলের চাইতেও কঠিন হয়ে তাকে আকর্ষণ করতে চাইছে।

দুলে উঠেই ঘুরে গিয়ে নিজের সিটে বসল বিমল, তারপর দু—হাত দিয়ে গুলতির দু—ইঞ্চি কাঠটাকে সজোরে ধরে, ঠিক উন্মাদের মতনই মোচড়াতে শুরু করল। তার উষ্ণ উত্তেজিত শ্বাস—প্রশ্বাস হিসহিসিয়ে উঠল দু—সারি দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে—কিন্তু রেবতীর শ্বাস—প্রশ্বাসের কোনো শব্দই পাওয়া গেল না। চেতনা হারিয়ে যাবার অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। শুধু তার গলায় বিমলের হাতের মোচড়ানো—পাকানো দড়ির দৃঢ় আঁকড়ে থাকাটাই দেহটাকে নীচে পড়ে যাবার অবস্থা থেকে সিটের ভেতরে কোনোরকমে বসিয়ে রেখেছে।

না, কেউই দেখেনি। কেউ দেখতেও পাবে না। সত্যি, প্রাচীনকালের জঙ্গলের ঠগীরা যে পদ্ধতিতে পথিকদের শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত বলে বইতে যা লেখা ছিল—তা সত্যিই অপূর্ব। একেবারে নিখুঁত!

যা প্ল্যান করে রেখেছিল ঠিক তেমনিভাবেই কাজটা শেষ হল। এবার বিমল নিশ্চিন্ত। কোনো বাধা আর রইল না—কেউ আর তাকে জ্বালাতে আসবে না টাকা টাকা করে। স্বচ্ছন্দে আবার পায়ে ভর করে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে সে—তার ছিন্নভিন্ন আর্থিক টালমাটালতাকে আবার সে স্থির সোজা করার চেষ্টায় আপ্রাণ খেটে যাবে। ট্রাস্ট থেকে পঁচিশ হাজার টাকা সে ঋণ নিয়েছিল সত্যি—কিন্তু কেউ কি জানে কীভাবে টাকাটা সে দু—মাসের ভেতরে ফুঁকে দিয়েছে? না কেউ জানে না। লোকে বলে মন্দিরা তার রক্ষিতা—কিন্তু ওই রক্ষিতার সন্তান নির্মলকেই তো সে বিদেশে পাঠিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবার জন্যে। বিমল জানে, মন্দিরার জেদাজেদির জন্যে যদিও নির্মলকে বাধ্য হয়ে পাঠাতে হয়েছে তাকে এবং বিদেশে যাবার পুরো খরচটাই দিয়েছিল মন্দিরা, কিন্তু ওই পঁচিশ হাজার টাকার প্রায় তিন ভাগই যে মন্দিরা তাকে ভুলিয়ে—ভালিয়ে আদায় করে নিয়েছিল সেটা আর ক’জনে খবর রাখে? কেউ না।

অন্ধকারে পাশে সিটের দিকে তাকাল বিমল। তার চেতনা ভাঙল। রেবতীর দেহটা এলিয়ে আছে সিটে। এক্ষুনি এই দেহটার ব্যবস্থা করতে হবে। বিমল সবই আগে থেকে প্ল্যান করে রেখেছিল—এখন সে সব মনে হতেই বেশ খুশি হল।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিমলের যেন মনে হল এতক্ষণ ধরে সে যেন উত্তেজনাভরা কোনো স্বপ্নের জগতে ছিল, কিংবা কোনো বিশ্রী আড়ষ্ট দুঃস্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু অন্ধকারে অস্পষ্ট মৃতদেহটার দিকে লক্ষ করে এবার যেন বাস্তবে ফিরে এল। সেই সঙ্গে মনে মনে যে প্ল্যানটা করে রেখেছিল সেটা একবার যাচাই করে নিল।

রেবতীর পা দুটো টেনে তুলে ছড়িয়ে দিল সে সিটের উপরে, ঠিক যেন লম্বা হয়ে দু—সিটের পেছনটায় শুয়ে পড়েছে কেউ এমনি ভাবে। তারপর গিয়ারটা চালু করল, ক্লাচ ছেড়ে দিল। গাড়ি চালিয়ে দিল উদ্দাম বেগে। স্টেশনের বিপরীত দিকে ছুটতে লাগল গাড়ি। বালুচর এখান থেকে পুরো পাঁচ মাইল—খুব জোরে ছুটে না গেলে তলার স্রোতের সুবিধেটা এ রাতের মতন হারিয়ে যাবে। বালুচর ছাড়িয়ে নদীর কিনারায় অনেক নীচ দিয়ে যে স্রোত বয়ে যায় তার স্থিতিকাল মাত্র ঘণ্টাখানেকের কিছু কম। আর তারপরই জোয়ার। কিন্তু জোয়ার আসবার আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছোনো দরকার।

ঝড়ের গোঁয়ার্তুমিভরা তীব্র ঠান্ডার রাত তেমনি ছিটছিটে হিমেল বৃষ্টি। বিমল প্রচণ্ড জোরে গাড়ি ছুটিয়ে চলল। রাস্তায় কোনো প্রাণেরই সাড়া নেই। পথটা প্রায় মুখস্থই ছিল বিমলের, প্ল্যানটা খাটাবার জন্যে এর আগে বারকয়েক এ পথে গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করেছিল নদীর চর পর্যন্ত।

রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে গাড়িটা লাফিয়ে উঠেই থেমে গেল—কাদাজল ছিটল আশেপাশে। এখান থেকেই বালুচর আরম্ভ হয়েছে। গাড়ি থেকে নামল বিমল।

পিচের মতো ঘন অন্ধকার রাত্রি, মেঘে মেঘে আকাশ থমকানো কালো, আর সেই আকাশের নীচে গর্জে চলেছে ঝড়ো বাতাস, কান্নার মতন ঝরছে হিমেল বৃষ্টির ছাঁট। কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার গর্জনের মধ্যেও বিমল শুনতে পেল বালুচরের শেষ সীমায় নদীর ঢেউয়ের শব্দ। বালুচর ধরে আধমাইলের মতন হাঁটলেই নদী। আর সেই নদী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে।

গাড়িটার বিপরীত দিকের দরজার কাছে চলে এল বিমল। তারপর দরজাটা খুলতেই রেবতীর দেহটা টলে পড়ল একপাশে। হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরল সে দেহটা।

বেশ কিছুটা চেষ্টা করে দেহটাকে সোজা করে বসাল, তারপর একহাত দিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে ভারী লোহার জিনিসগুলো টেনে আনল। সেই সঙ্গে লাঙল—শেকলটাও টেনে আনতে ভুলল না। লোহার ভারী জিনিসগুলো একে একে শবদেহটার পকেটগুলোয় ভরে ফেলল, বেশ গাদা গাদা করে। তারপর লাঙল—শেকলটাকে জড়িয়ে বেঁধে দিল শবের দেহের চারদিকে, শুধু লাঙলটাকে ঝুলিয়ে রাখল পায়ের দিকে। এই ভারী ভারী লোহাগুলো দেহটাকে জলের তলায় এমনভাবে সেঁধিয়ে রাখবে যে কোনোদিনই এটাকে উপরে ভেসে উঠতে কেউ দেখবে না এবং তলার নীচু স্রোতে দেহটা ধীরে ধীরে চলে যাবে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রে গিয়ে পড়লে ওই লাঙলটা দেহটাকে একেবারে গভীরে তলিয়ে নিয়ে গিয়ে চিরদিনের মতন আটকে রেখে দেবে।

বিমল এবার চেষ্টা করল দেহটাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে উপরে তুলতে, যাতে এটাকে কাঁধে বয়ে বালির উপর দিয়ে চলতে পারে। প্রথমবার চেষ্টা করেই মাথা ঘুরে উঠল, যেন অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সত্যি, খুব একটা শক্তিশালী চেহারার পুরুষ নয় সে। পাতলা রুগ্ন চেহারা—তারপর বয়সটাও পঞ্চাশের ঘরে এসে ঠেকেছে। তার কপাল বেয়ে ঘাম ছুটল, শীতল বাতাসে ঠান্ডা সেই ঘাম।

মুহূর্তের জন্যে থমকাল, অনেকটা হতবুদ্ধির মতন, যদি সত্যিই এটাকে ঘাড়ে তুলে নেবার মতন শক্তি তার না থেকে থাকে তাহলে পুরো প্ল্যানটাই যে ভেস্তে যাবে। কী সর্বনাশ! কিন্তু পরমুহূর্তেই পরিস্কার ভাবে সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা করতে গিয়ে সে তার মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রভুর আসনে বসিয়ে দেহটাকে হুকুম করাতে বাধ্য করল, যাতে আপ্রাণ পরিশ্রম করে সেটা ওই শবটাকে তুলে নিতে পারে।

ঘুরে দাঁড়াল বিমল। হাত দিয়ে তখনও ধরে রেখেছে মৃতদেহটাকে, এমনি ভাবেই হঠাৎ সে ঘাড় নীচু করল। তারপর একটা ঝটকা মেরে কাত হয়েই দেহটাকে তুলে নিল ঘাড়ের উপরে। শবের হাত দুটো টেনে নিয়ে সে তার গলায় জড়িয়ে নিল এবং বারদুয়েক খিঁচুনি খেয়ে খানিকটা চেষ্টার পর মৃতের পা দুটো জড়িয়ে নিল তার কোমর বরাবর। অন্ধকারে মনে হচ্ছিল শবটা যেন জীবন্ত হয়ে তার ঘাড়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

প্রচণ্ডভাবে স্বভাবতই বিমল বেশ ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে এবং অনুভব করল, এইভাবে ঝুঁকে পড়েই তাকে বালুচর দিয়ে এগোতে হবে। দুটো শীতল হাত জড়িয়ে ধরেছে তার গলা এবং সেইসঙ্গে দুটো আড়ষ্ট কঠিন লম্বা পা শক্ত করে বেষ্টনীর মতন জড়িয়ে রয়েছে তার কোমরে।

চলতে শুরু করল বিমল। ঝুঁকে পড়ে টলতে টলতে ঢালু নরম বালুচরের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে দূর থেকে ঢেউয়ের ফেনার আছড়ে পড়ার শব্দ। তার পায়ের তলার বালি খুবই নরম। এত নরম বলেই বালুচরের এই আধমাইল পথটা গাড়ি চালিয়ে আনতে সাহস পায়নি বিমল। বালির গর্তে গাড়ির চাকা বসে গিয়ে একটা ডেডবডি নিয়ে সে বুদ্ধু হয়ে বসে থাকবে এটা চায়নি বিমল।

হিমেল ঝড়ো হাওয়া তীক্ষ্ন সুরে গর্জে চলেছে। আর সেই হিমেল বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার শরীর—যেন কেউ তীক্ষ্ন মুখ ছুরি দিয়ে খোঁচা মেরে যাচ্ছে তাকে। বালুচরের শেষ সীমায় যেখানে তলানি স্রোত বয়ে যাচ্ছে সেখানটা এখনও অনেক দূরে। ঠিক এই কারণেই বালুচরের এই জনমানবহীন দিকটা পছন্দ করেছিল বিমল। পুরো শীতের সময়টায় এই নির্জন বালুচর দিয়ে হেঁটে কেউই নদীর কিনার পর্যন্ত যায় না—কোনোদিন কেউ গিয়েছে বলেও শোনা যায়নি।

টলতে টলতে একসময়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল বালির উপরে,—টাল সামলে অনেক কষ্টে শবের হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখল। হাত দুটোকে আরও ঘন করে জড়িয়ে নিল গলায়। তারপর প্রাণপণে এগোতে লাগল সামনের দিকে,—না কোনো বিশ্রাম নয়, জোয়ার আসার আগে যেমন করেই হোক নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছোতে হবেই। সে আরও জোরে চলতে লাগল, তার মুখের কষ বেয়ে ফেনা বেরুল, চোখের দৃষ্টি অন্ধকারের মধ্যে ফুটকি ফুটকি মতিভ্রম আলোর বিন্দু লক্ষ করল কিন্তু পরমুহূর্তেই সেগুলো মিলিয়ে গেল।

তারপর, একসময়ে সে দেখতে পেল অন্ধকারের ভেতরে উজ্জ্বল একটা সাদা রেখা চলে গেছে বহু দূরে। ওইটেই নদীরেখা। উত্তাল ঢেউ ভেঙে পড়ছে বালির উপরে। নদীর মাঝ বরাবর ওপারের দৃশ্য অন্ধকারে মগ্ন। শুধু ঢেউয়ের উত্তাল গর্জন সব কিছু শব্দকে ছাপিয়ে কানে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

সমস্ত ব্যাপারটাতেই সে এত নিশ্চিন্ত ছিল যে বালুচর থেকে সে সোজা নেমে গেল ঢেউয়ের ভেতরে। তারপর জলের মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে লাগল। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নদীর এমন একটা জায়গায় গিয়ে থামবে যেখান থেকে দেহটাকে জলে ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তলার স্রোত সেটাকে নীচে টেনে নিতে পারবে। হ্যাঁ, তাহলেই সে নিশ্চিন্ত। আর ওইখানেই জলের গভীরতা সবচেয়ে বেশি। বিমল তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে হড়কে হড়কে আরও এগোল, ক্রমে তার হাঁটু ডুবল, তারপর কোমর ডুবল, বরফের মতন হাড় কাঁপানো জল তাকে যেন সাদরে আঁকড়ে ধরল। সে একটু স্থির হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল সেই হিমঠান্ডা জলের মধ্যে। যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। অন্ধকারের মধ্যে হাঁফাতে লাগল সে।

একদিকে কাত হয়ে পড়ে এবার মৃতদেহটাকে গড়িয়ে ফেলে দিতে তৎপর হল বিমল। বেশ খানিকটা নীচু হয়ে তারপর কাত করল ঘাড়টা। কিন্তু শবটা নড়ল না একটুও। সে এবার গলার দিকে হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে আড়ষ্ট শীতল হাত দুটো ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু শবের সেই হাত দুটো যেন একগুঁয়ে অবাধ্য। সামান্য একটুও শিথিল হল না হাত দুটো। প্রচণ্ড বেগে নাড়া দিল বিমল এবার নিজেকে—ঠিক মাতালের মতনই। তবুও এক চুলও নড়ল না দেহটা। সবেগে আবার একবার গা ঝাড়া দিল। রেবতীর শব যেন আরও জোরে আঁকড়ে ধরল তাকে।

কোমরের দিকে হাত বাড়িয়ে হিমশীতল পা দুটো ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ধাক্কা মারল বার দুই। কিন্তু কোনো ফলই হল না। দেহটা যেন সাপটেই রইল জোঁকের মতন। আতঙ্কে ও ভয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে বিমল এবার ছুড়ে দিল নিজেকে যাতে শবদেহটা আলগা হয়ে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তার ঘাড়ের সেই শীতল ভারী বোঝাটা তেমনি তাকে আঁকড়েই রইল, যেন ওটা জীবন্ত কোনো শরীর। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বিমল সেই কঠোর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না।

ঠিক সেই সময়ে প্রকাণ্ড একটা ঢেউ এসে সব কিছু যেন তছনছ করে দিল। ছিটকানো জলের তোড়ে সারা শরীর তার ভিজে গেল। নাকের ভেতরে জল ঢুকে বিষম খেল সে। জলের স্রোত এবার ঘুরে চলেছে। জোয়ার এসেছে। বানের শব্দ জেগে উঠছে সব কিছুকে ছাপিয়ে। বালুচরের দিকে জলের স্রোত প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ডুবে যাবে গোটা বালুচর। সর্বনাশ!

আরেকবার চেষ্টা করল সে বোঝাটা ফেলে দেবার জন্যে, কিন্তু বোঝাটা যখন এক চুলও নড়ল না, বরং আরও জোরে সাপটে ধরল তাকে, সে তখন তার নার্ভের জোর হারিয়ে ফেলেছে, স্নায়ু তার চূর্ণ হয়ে গেছে, মরণপণ চেষ্টায় সে পা বাড়াল বালুচরের দিকে। কিন্তু শক্তিহীন দুর্বল শরীর তার থমকে পড়ল। শবদেহের ভার এবং সেই সঙ্গে ভারী ভারী লোহা আর লাঙল—শেকলের ওজন সহ্য করতে পারল না তার দুর্বল দেহটা। সে পড়ে গেল জলের মধ্যে।

অন্ধকার নদীর মধ্যে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল একবার। টলে উঠে দু—এক পা এগোলও, কিন্তু আবার পড়ে গেল, তারপর আর উঠতে পারল না। শবের হাত দুটো তখন তার গলা আর কোমরে আরও জোরে চেপে বসেছে, ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়া যেমন শিকারের শরীর আঁকড়ে ধরে। হাত দুটো যেন তার গলায় চেপে বসে শ্বাস বন্ধ করে মারতে চাইছে তাকে, ঠিক যেমনিভাবে গুলতির মোচড় দিয়ে দিয়ে সে হত্যা করেছিল রেবতীকে।

জোয়ারের জলে ডুবে গেছে গোটা বালুচর। বিমল আড়ষ্ট হয়ে ঝুঁকে পড়ল নদীর মধ্যে—ওদিকে তখন শবের শীতল রাইগার মরটিস এমন কঠিন পেষণে তার গলাটাকে মুচড়ে ধরে আছে যে আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *