কলকাতা থেকে দেশ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়৷ একটা পত্রিকা কতদূর ক্ষমতাধর তা দেশ পত্রিকা না দেখলে আমি জানতাম না৷ বলা হয়ে থাকে যেকোনো অগা মগা বগা লেখককে এই পত্রিকা আসমানে তুলে দিতে পারে৷ মহান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ আবার সত্যিকারের মহান কোনো লেখককেও ধরাশায়ী করতে পারে৷ এই পত্রিকায় কারও লেখা ছাপা হওয়ার মানে (বিশেষ করে শারদীয় সংখ্যায়) লেখক হিসেবে কপালে স্থায়ী সিল পড়ে যাওয়া৷ এই সিলের কালি অলেপনীয়, ধুলেও যাবে না৷ কপালে জ্বলজ্বল করতে থাকবে৷
এক সকালে দেশ পত্রিকার এক প্রতিনিধি আমার বাসায় উপস্থিত৷ তার সঙ্গে নানা গল্প হচ্ছে৷ গল্প তিনি করছেন আমি শুনছি৷ আমি ক্লাসে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছি না৷ হাজার হলেও বিদেশি মেহমান৷ এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা আপনার একটা উপন্যাস শারদীয় সংখ্যায় ছাপাব৷ তবে দেশে ছাপাব নাকি আনন্দবাজারে ছাপাব, নাকি সানন্দায় ছাপাব তা বলতে পারছি না৷ সাগরময়দা ঠিক করবেন৷
ভদ্রলোক হয়তো ধারণা করেছিলেন তার কথা শুনে আনন্দে আমি এমন লাফ দেব যে সিলিংয়ে মাথা ঠেকে যাবে৷ আমি তা না করে শুকনো গলায় বললাম, হুঁ৷ ভেবে দেখি৷
কী ভাববেন? পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কত বড় সুযোগ৷
আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ভাই আমি সুযোগ সন্ধানী মানুষ না৷ আমি লেখক৷ লেখক কখনো সুযোগের সন্ধান করে না৷ সুযোগ লেখকদের সন্ধান করে৷
তার মানে আপনি লিখবেন না?
আমি বললাম, শুধুমাত্র দেশ পত্রিকা যদি তার শারদীয় সংখ্যায় লেখা ছাপে তাহলেই পাণ্ডুলিপি পাঠাব৷ দেশ পত্রিকা ছাড়া না৷
ভদ্রলোক মোটামুটি হতভম্ব অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, যাই৷ নমস্কার৷
আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই বিষয়ে আর কিছু শুনব না৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, পনেরো দিনের মাথায় দেশ পত্রিকার সম্পাদক চিঠি দিয়ে জানালেন তারা আমার একটি উপন্যাস শারদীয় দেশ পত্রিকায় ছাপাতে চান৷ হিমুকে নিয়ে লেখা একটা উপস্যাস পাঠালাম৷ ছাপা হলো৷ পরের বছর আবার চিঠি এবারও তারা একটি উপন্যাস ছাপাবেন৷ পাঠালাম আরেকটা হিমু৷
পর পর ছয় বছর কিংবা সাত বছর আমি শারদীয় দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি৷ বেশির ভাগই হিমুবিষয়ক রচনা৷ পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা আমার সাহিত্য প্রতিভা (?) সম্পর্কে কোনো ধারণা পেয়েছেন কি না জানি না৷ হিমু বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়েছেন৷ তার প্রমাণও পেলাম৷
কলকাতায় গিয়েছি কোনো এক বইমেলায়৷ সে দেশে চেহারা দেখে আমাকে কেউ চিনবে না, কাজেই লেখকসুলভ নকল গাম্ভীর্য নিয়ে হাঁটাহাঁটি করার প্রয়োজন নেই৷ আমি মনের সুখে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একজন আমার পা ছুঁয়ে বলল, দাদা আমি হিমু৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ধুতি পরা হিমু দেখছি৷ পাঞ্জাবি হলুদ রঙের৷ পায়ে জুতা নেই – খালি পা৷ লক্ষণ বিচারে হিমু তো বটেই৷
আপনি কত দিন ধরে হিমু?
দুই বছরের উপর হয়েছে দাদা৷
আমি বললাম, পাঞ্জাবির কি পকেট আছে?
পকেট নেই৷
টাকা-পয়সা রাখেন কোথায়?
ভদ্রলোক পাঞ্জাবি উঠিয়ে দেখালেন, কেমারের কালো ঘুনসির সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ লাগানো – টাকা-পয়সা সেখানেই থাকে৷
দাদা, আমি দুজনের ভক্ত৷ আপনার এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের৷ আপনাদের দুজনের ছবি ঠাকুরঘরে আছে৷
আমি চমৎকৃত৷ সাত বছর দেশ পত্রিকায় লেখালেখির কারণে যদি কারও ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতে পারি সেটা কম কী? গলায় সুর থাকলে গাইতাম অকত অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি৷
বিদেশে বেশ কিছু হিমুর দেখা পেয়েছি৷ বিদেশের হিমুরা কঠিন প্রকতির৷ একশ পার্সেন্ট খাঁটি ভেজালবিহীন হিমু৷ জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের হিমুর কথা বলি৷ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা৷ বরফ পড়বে পড়বে করছে, এখনো পড়া শুরু করেনি৷ এই ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে একজন উপস্থিত৷ গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলল, স্যার আমি হিমু৷
কতদিন ধরে?
তিন বছরের বেশি হয়েছে৷ দেশেও হিমু ছিলাম৷
ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যে হিমু একটা ধর্ম৷ সে ধর্ম পালন করছে৷ এর বেশি কিছু না৷ আমি হিমু ধর্ম প্রচারক৷
গত বইমেলায় এক কাণ্ড ঘটল৷ মধ্যবয়স্ক একজন ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, আমি ঠিক করেছি মার্চের তিন তারিখ থেকে হিমু হব৷ হিমু হওয়ার নিয়মকানুন কী?
আমি বললাম, মার্চের তিন তারিখ থেকে কেন?
আমার জন্মদিন মার্চের তিন৷ এখন স্যার নিয়মকানুন বলেন৷
আমি নিয়মকানুন কী বলব? ভদলোকের দিকে তাকিয়ে আছি৷ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না৷ আমাকে উদ্ধারের জন্য অন্যপ্রকাশের কমল এগিয়ে এল৷ সে গম্ভীর গলায় বলল, নিয়মকানুন সব বইয়ে দেওয়া আছে৷ বই পড়ে জেনে নিন৷ হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাঁটবেন৷ এইটাই প্রাথমিক বিষয়৷
প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা দেখতে জঙ্গলে যেতে হবে?
গেলে ভালো হয়, তবে দু-একটা মিস হলেও ক্ষতি হবে না৷