হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার

হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার

আয়োজন করে গল্প লিখতে বসেছি। এক বৈঠকে গল্প শেষ করব এই কারণেই আয়োজন। বল পয়েন্টের প্যাকেট, কাগজ, চায়ের কাপ, সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বল পয়েন্টের প্যাকেট নিয়ে বসেছি কারণ কলমগুলো এমন যে সামান্য লিখলেই কালি আটকে আসে। আমার স্বভাব যে কলমে একবার কালি আটকালে সে কলম দূরে ছুঁড়ে ফেলা। লেখার কাগজের ব্যাপারেও আমার কিছু সৌখিনতা আছে। খুব দামী কাগজে লিখতে পছন্দ করি। যখন হত দরিদ্র অবস্থা ছিল তখনো রেডিও বণ্ড নামের কাগজ ব্যবহার করতাম। অমৃত ধারণ করতে হয় স্বর্ণভাণ্ডে, মাটির হাঁড়িতে না। লেখা আমার কাছে ‘অমৃতসম’।

এক বৈঠকে লেখা শেষ করতে হবে। কারণ সন্ধ্যাবেলা লেখা নিতে পত্রিকার অফিস থেকে লোক আসবে। আজই শেষ দিন। ঈদ সংখ্যায় আমার গল্প যাচ্ছে এ রকম বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে।

আয়োজন করে বসার কারণেই দুপুর পর্যন্ত একটা লাইন লেখা হল না! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম– মাথায় কোনো গল্প নেই। গল্প দূরের কথা কোনো চরিত্র পর্যন্ত নেই। চারটা পাতা নষ্ট করেছি প্রতিটিতে একটা শব্দ লেখা “আম’। এত কিছু থাকতে আম কেন লিখেছি তাও বুঝতে পারছি না। রাজশাহী থেকে আমার কাছে একজন এক ঝুড়ি আম পাঠিয়েছে এটাই কি কারণ?

দুপুরে ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কি মাথায় গল্প আসবে? আসতেও পারে। তাই করলাম। খেয়ে দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম। ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যার পর। জেগে উঠে শুনি গল্প নেবার জন্যে লোক এসেছে। তাকে বসিয়ে রেখেই লেখা শুরু করলাম। ‘আম’-কে করলাম আমরা। প্রথম বাক্য–“আমরা পাঠকদের কথা দিয়েছিলাম ঈদ সংখ্যায়…”

লেখা যা দাঁড়াল তাকে আর যাই বলা যাক গল্প নিশ্চয়ই বলা যাবে না তবে ঈদ সংখ্যা যুগান্তরে গল্প হিসেবেই ছাপা হয়েছে। পাঠকরা চমকে উঠবেন কুড়ি বছর আগে আমি একটি কবিতার বইয়ের সমালোচনা লিখে সাপ্তাহিক রোববারে পাঠিয়েছিলাম। সেখানেও সমালোচনাটা ছাপা হয়েছে গল্প হিসেবে।

*

আমরা পাঠকদের কথা দিয়েছিলাম ঈদ সংখ্যায় হিমু এবং মিসির আলি সাহেবের একান্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, মিসির আলি অসুস্থ হয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল, তবে তিনি এখন ভালো আছেন। তারপরেও তার চিকিৎসকরা তাকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলছেন। তার কোনো সাক্ষাৎকার এ কারণেই প্রকাশ করতে পারছি না।

হিমুর সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হলো। তার কোনো ছবি দেওয়া গেল না। আমাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার সৈয়দ সদরুল তাকে নিয়ে ফটোসেশন করিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কারণে একটি ছবিও প্রিন্ট হয়নি। আমরা পাঠকদের আশ্বস্ত করছি, অতি শিগগিরই হিমুকে নিয়ে আরেকটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সেখানে তিনি পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। শ্রেষ্ঠ প্রশ্নকর্তা পাবেন এক হাজার টাকার প্রাইজবও। এর সঙ্গে তিনি পাবেন আমাদের পত্রিকার ছয় মাসের ফ্রি গ্রাহক সুবিধা। একজন প্রশ্নকর্তা একটির বেশি প্রশ্ন করতে পারবেন না। সেই প্রশ্ন হতে হবে শালীন। প্রশ্ন পাঠানোর শেষ তারিখ ১৭ নভেম্বর ২০০৭। প্রশ্নকর্তা অবশ্যই তার পূর্ণ ঠিকানা পাঠাবেন। ঠিকানাবিহীন প্রশ্ন গণ্য করা হবে না।

.

প্রতিবেদকের ভাষ্য

হিমুর সন্ধানে ঢাকা শহরের অলিগলিতে এক সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধান চালানো হয়। যে মেসে হিমু থাকেন বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল, সেখানেও কয়েক দফা অনুসন্ধান চালানো হয়। মেসের পরিচালক জনাব আজিজুর রহমান জানান, হিমু কখন আসে কখন যান তা কেউ বলতে পারেন না। হিমুর পরিচিত জন, যেমন মাজেদা খালা এবং মিস রূপার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। মিস রূপা টেলিফোনে জানান, গত তিন বছরে হিমুর সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। টেলিফোনে মিস রূপা অসহযোগিতামূলক আচরণ করেন এবং এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে আমাকে ‘ইউ স্টুপিড’ বলেও গালাগাল করেন।

মাজেদা খালা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন। আমাকে এবং আমাদের ফটোজার্নালিস্ট সৈয়দ সদরুলকে চা এবং নিজের হাতে বানানো ডিমের হালুয়া দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তার সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয় তা সংক্ষেপে আপনাদের জানানো হচ্ছে :

প্রশ্ন : মাজেদা খালা, কেমন আছেন?

মাজেদা খালা : বাবা, ভালো আছি।

প্রশ্ন : আমরা হিমু বিষয়ে আপনার কাছে জানতে এসেছি।

মাজেদা খালা : বলো, কী জানতে চাও?

প্রশ্ন। : তার পছন্দের খাবার কী?

মাজেদা খালা : যা দিই তাই তো খায়। আলাদা কোনো পছন্দের খাবার আছে কি-না জানি না।

প্রশ্ন : নাটক-সিনেমা এইসব নিয়ে তার কোনো আগ্রহ আছে?

মাজেদা খালা : অবশ্যই আছে। একবার দুপুরে আমার বাসায় এসেছে আমার সঙ্গে পুরো একটা বাংলা ছবি দেখেছে।

প্রশ্ন : ছবির নাম বলতে পারবেন?

মাজেদা খালা : অবশ্যই বলতে পারব। ছবির নাম ‘বাবা কেন ড্রাইভার?’ সোশ্যাল অ্যাকশন ছবি।

প্রশ্ন : হিমুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?

মাজেদা খালা : অবশ্যই ভাবছি। আমি ছাড়া হিমুর আর কে আছে! তাকে জোর করেই বিয়ে দিতে হবে। একটা মেয়েকে মনে মনে পছন্দ করে রেখেছি, তার নাম কনা।

প্রশ্ন : হিমু কি মিস কনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন?

মাজেদা খালা : এই বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। দেখা যাক কী করে! বাবা, তোমরা যদি তার দেখা পাও তাহলে যেভাবেই হোক আমার এখানে নিয়ে আসবে। তোমাদের দোহাই লাগে।

মাজেদা খালার কাছ থেকে মিস কনার ঠিকানা নিয়ে আমরা তার কলাবাগানের বাসায় উপস্থিত হই।

মিস কনা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে বর্তমানে ইন্টারে পড়ছেন। আমরা যখন তার বাসায় উপস্থিত হই, তখন তিনি কদবেলের ভর্তা খাচ্ছিলেন। তার পরনে ছিল ফিরোজা রঙের একটা কামিজ। মিস কনার উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। ওজন ৫৮ কেজি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। তিনি ধনু রাশির জাতিকা। তার পছন্দের রং সবুজ। পছন্দের খাবার শুঁটকি। চলচ্চিত্র জগতে তার পছন্দের নায়ক রিয়াজ। নায়িকা পূর্ণিমা। নাট্যজগতে তার প্রিয় অভিনেতা মাহফুজ, অভিনেত্রী শমী কায়সার। তিনি লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। থার্ড রাউণ্ডে দর্শকদের এসএমএসে বাদ পড়ে যান। তার প্রিয় কবি শেক্সপিয়ার। প্রিয় ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন। হিমুর সঙ্গে তার বিবাহ বিষয়ে যে কথাবার্তা হয় তা পত্রস্থ করা হলো :

প্রশ্ন : হিমুর সঙ্গে আপনার বিয়ের বিষয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে তা কি জানেন?

কনা : কেন জানব না? মাজেদা খালা আমার বাবার সঙ্গে কথা বলেছেন।

প্রশ্ন : বিয়েতে আপনার মত আছে?

কনা : পাগল হয়েছেন? হিমুকে বিয়ে করে সারারাত আমি খালি পায়ে পথে পথে হাঁটব? আমি থাকব কোথায়? মেসে? সে আমাকে খাওয়াবে কী? সে এর-ওর বাড়িতে খেয়ে আসে। আমিও কি তাই করব? আমি ফকিরনি না।

প্রশ্ন : কী ধরনের স্বামী আপনার পছন্দ? অর্থাৎ আপনার স্বপ্নের পুরুষ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।

কনা : সে হবে একজন হৃদয়বান আদর্শ সৎ মানুষ। তার সেন্স অব হিউমার থাকবে। বুদ্ধি থাকবে। আমাকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। আমার ইচ্ছাই হবে তার ইচ্ছা। আমি ফাস্টফুড খেতে পছন্দ করি, সেও আমার সঙ্গে ফাস্টফুড খাবে। তাকে বেড়াতে পছন্দ করতে হবে। প্রতি বছর আমাকে নিয়ে একবার সে দেশের বাইরে যাবে।

প্রশ্ন : আপনার স্বপ্নের পুরুষ সম্পর্কে যেসব গুণের কথা আপনি বলেছেন তার কোন কোনটি হিমুর মধ্যে আছে?

কনা : ওই পাগলা হিমুর বিষয়ে দয়া করে কোনো প্রশ্ন করবেন না।

আমরা মিস কনার কিছু ছবি তুলতে চাইলাম। তিনি মাথায় জবজব করে তেল দিয়েছেন বলে ছবি তুলতে রাজি হলেন না। আমাদের অন্য আরেকদিন টেলিফোন করে আসতে বললেন। পত্রিকার পাঠকের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বললাম। তিনি বললেন—’সৎ হও। এদেশে সৎ মানুষের বড়ই অভাব।’

পাঠকদের নিশ্চয়ই হিমুভক্ত বাদলের কথা মনে আছে। আমরা বাদল সাহেবের ইন্টারভিউ নিতে তার ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হলাম। আমাদের বসার ঘরে বসানো হলো। দীর্ঘ সময় (প্রায় ৫০ মিনিট) বসে থাকার পর বাদলের বাবা (হিমুর খালু সাহেব) উপস্থিত হলেন। আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি শুনেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তিনি বললেন, এই বাড়িতে হিমুর নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ, এটা কি তোমরা জানো না? এ মুহূর্তে তোমরা যদি বাসা থেকে বের না হও, তাহলে তোমাদের কুত্তা দিয়ে কামড় খাওয়াব।

রাগী এই ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরের গর্জন শোনা গেল। বাদলের বাড়িতে কুকুর থাকে এমন কোনো তথ্য আমরা হিমুর কোনো বইয়ের পাইনি। আমরা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেট দিয়ে বেরুচ্ছি– বাদলের বাবার রাগ তখনো কমেনি। তিনি উঁচু গলায় হম্বিতম্বি করছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তিনি দারোয়ানকে বললেন, এই দুই গাধাকে কাপড়-চোপড় খুলে নেংটা করে রাস্তায় ছেড়ে দাও। শিক্ষিত ভদ্র সমাজের একজন প্রতিনিধি এমন ভাষা ব্যবহার করবেন আমরা তা কখনোই কল্পনা করিনি। এ জন্যই হয়তো দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান বলেছেন—’উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’।

যা হোক আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল কোতোয়ালি থানার ওসি জনাব কামরুল সাহেবের কাছে। পাঠক মাত্রই জানেন, হিমু অনেকবার এই থানা হাজতে রাত কাটিয়েছে। ওসি কামরুল সাহেব সুদর্শন মানুষ। গাত্রবর্ণ গৌর এবং হাস্যমুখী। তিনি অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করলেন। আমাদের চা-শিঙ্গাড়া এবং বিস্কিট খাওয়ালেন। ওসি সাহেবের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হলো :

প্রশ্ন : ওসি সাহেব স্নামালিকুম। ভালো আছেন?

ওসি : পুলিশের চাকরি করে ভালো থাকা কি সম্ভব?

প্রশ্ন : হিমু অনেকবার থানা হাজতে রাত কাটিয়েছেন, এটা কি সত্য?

ওসি : অনেকবার না, দু’তিনবার হতে পারে। থানার রেকর্ড না দেখে বলতে পারব না।

প্রশ্ন : হিমুকে প্রচুর মারধর করা হয়েছে, এটা কি সত্য?

ওসি : পুলিশ সম্পর্কে আপনাদের একটা ভুল ধারণা আছে। আপনারা ধরেই নেন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া মানেই শারীরিক নির্যাতন। পুলিশ জনগণের সেবক।

প্রশ্ন : হিমুকে কখনোই শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি?

ওসি : অবশ্যই না। তদন্তের স্বার্থে আমরা জেরা করি, এর বেশি কিছু নয়।

প্রশ্ন : ডিবি পুলিশের পানির ট্যাংকিতে একবার একটা ডেডবডি পাওয়া গেল–এই বিষয়ে কিছু বলবেন?

ওসি : কেন বলব না? ওই লোকটা পানির ট্যাংকি পরিষ্কার করতে গিয়ে পা পিছলে ট্যাংকির ভেতর পড়ে যায়। এই ছিল ঘটনা। বাকিটা পত্রিকাওয়ালাদের বাড়াবাড়ি।

প্রশ্ন : হিমু সম্পর্কে কিছু কি বলবেন?

ওসি : এখন বলতে পারব না ভাই। কিছু মনে করবেন না। জরুরি কাজে যেতে হবে। সরি।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত বইমেলায় জনৈক বিশালদেহী যুবক এবং একজন লাক্স সুন্দরী হিমু এবং হিমুর স্ত্রী সেজে অনেক ক্যারিকেচার করেছিল। মেলার ভাবগাম্ভীর্য এবং পরিবেশ নষ্ট করেছিল। আমরা এই দু’জনের ইন্টারভিউ নেওয়ার চেষ্টা করি। লাক্স সুন্দরীকে পাওয়া যায়নি। তিনি চ্যানেল আইয়ের শুটিংয়ে ব্যাংকক ছিলেন (নাটকের নাম ‘যদি মন কাঁদে’ নায়ক ফেরদৌস)। বিশালদেহী যুবককের দেখা পাই। তিনি ‘উন্মাদ’ অফিসে বসে পরাটা, গরুর মাংস খাচ্ছিলেন। ‘উন্মাদ’ পত্রিকার সম্পাদক কার্টুনিস্ট আহসান হাবিবও তখন উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাকে দু’ একটা প্রশ্ন করি। কারণ হিমুর লেখক আহসান হাবীবের বড় ভাই।

প্রশ্ন : আপনি কি হিমুর স্রষ্টা বিষয়ে দু-একটা কথা বলবেন?

উত্তর : উনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিষয়ে আর কিছু বলব না।

প্রশ্ন : পাঠকরা শুনতে চায় একটা কিছু বলুন।

উত্তর : আমার বড় ভাইয়ের হাতে একটা দামি ক্যামেরা আছে। এই ক্যামেরায় তিনি শুধু জন্মদিনের ছবি তোলেন এবং জানেন না যে, তার ক্যামেরায় ফিল্ম নেই।

প্রশ্ন : এটা কি আপনার কথা?

আহসান হাবীব : জি না, আমার মেজো ভাইয়ের কথা। উনি আবার অনেক জ্ঞানী।

আমরা বিশাল বপু যুবকের সঙ্গে কথা বললাম। তার খাওয়া তখনো শেষ হয়নি। তিনি দ্বিতীয় দফায় গোশত-পরাটা আনিয়েছেন।

প্রশ্ন : ভাই কী করছেন?

উত্তর : দেখতেই তো পাচ্ছেন, গোশত-পরাটা খাচ্ছি। অকারণে প্রশ্ন করেন কেন?

প্রশ্ন : হিমু কি আপনার মতো মোটা?

উত্তর : হিমু আণ্ডার ওয়েট, তার ওজন ৫০ কেজির নিচে, এমন কথা কি কোনো বইয়ে লেখা আছে? প্রশ্ন

প্রশ্ন : ভাই রেগে যাচ্ছেন কেন?

উত্তর : খাওয়ার সময় বিরক্ত করছেন, এ জন্য রেগে যাচ্ছি। খাওয়ার সময় কোনো ইন্টারাপশান আমি পছন্দ করি না।

প্রশ্ন : বইমেলায় হিমু সেজে আপনি গেলেন, কেন গেলেন হিমুর প্রতি মমতাবশত?

উত্তর : আমি একজন কবি। কবিতা লিখি। একটা কবিতার বই বের করা দরকার। প্রকাশক পাচ্ছি না। হিমু সেজে হৈচৈ করার জন্য প্রকাশক সাহেব খুশি হয়ে আমার কবিতার বই ছাপবেন, এই আশায় ফালতু কাজটা করেছি।

প্রশ্ন : বই কি উনি ছেপেছেন?

উত্তর : জি না। এখন উনি আমাকে চিনতেই পারেন না।

প্রশ্ন : আপনার কবিতার বইয়ের নামটা জানতে পারি?

উত্তর : পারেন—’একটা কালা বিড়াল আমার সিম কার্ডটা দুধে ভিজিয়ে খেয়ে ফেলেছে’। প্রশ্ন : নাম তো খুব আধুনিক।

উত্তর : আমি আধুনিক কবি, আমার কবিতার নাম কি ঐতিহাসিক হবে?

প্রশ্ন : ভাই, আপনি কোন রাশির জাতক?

উত্তর : আমি মোটা রাশির জাতক।

প্রিয় পাঠক! আধুনিক কবি সাহেব আমার সঙ্গে তামাশা করলেন। তিনি বললেন, আমি মোটা রাশির জাতক। অনুসন্ধানে জেনেছি তিনি মেষ রাশির জাতক। এই দেশে সৎ সাংবাদিকতা করা কত কঠিন তা কি বুঝতে পারছেন? আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ কারণেই বলেছেন, ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’।

আমরা হিমু গ্রন্থের লেখকের বাড়িতে এক সকালে উপস্থিত হলাম। লেখক সাহেব খালি পায়ে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা তাকে কয়েকটি প্রশ্ন করে বড়ই আহত হয়েছি। আপনাদের কাছে পুরো কথোপকথন তুলে দিচ্ছি–বিচারের ভার আপনাদের।

প্রশ্ন : স্যার, ভালো আছেন?

লেখক : কী বলতে এসেছ, বলে বিদায় হও। ভালো আছি না মন্দ আছি দিয়ে কী করবে? তুমি ডাক্তার না। তোমার সঙ্গী কম্পাউণ্ডার না।

প্রশ্ন : হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে কেন?

লেখক : হিমু খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করে বলে প্রায়ই বিষ্ঠায় পা দেয়। বিষ্ঠার রং হলুদ। হিমু বিষ্ঠা পছন্দ করে বলেই হলুদ তার প্রিয় রং। বিষ্ঠা কি জানো তো? বিষ্ঠা হলো ‘গু’।

এই ধরনের উত্তরের পর আর কিছু বলার থাকে না। তারপরেও আমি অতি ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম স্যার, আপনার তিন মেয়ের মধ্যে বড়টির বিবাহ হয়ে গেছে বলে শুনেছি। যে দু’জন বাড়ি আছে তাদের কারো সঙ্গে কি আপনি হিমুর বিবাহ দিতে রাজি আছেন? আপনি হিমুর শ্বশুর ভাবতেই ভালো লাগছে।

লেখক খানিকক্ষণ কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, গাধা মানুষকে কী বলে তুমি জানো?

আমি বললাম, জানি না স্যার।

লেখক বললেন, গাধা মানুষকে বলে গা-মানুষ। তুমি একজন গা-মানুষ। আমি নিজেও একজন গা-মানুষ। গা-মানুষ না হলে কেউ হিমুকে নিয়ে এতগুলো বই লেখে না। এত যন্ত্রণা মাথায় নেয় না। এখন বিদায় হও।

এই পর্যায়ে লেখকের স্ত্রী (দ্বিতীয় স্ত্রী) শাওন ম্যাডাম আমাদের অন্য ঘরে নিয়ে চা-নাশতা খেতে দেন এবং বলেন, লেখকের কথায় কিছু মনে করবেন না। সকালবেলায় তার মেজাজ খারাপ থাকে। শাওন ম্যাডামকে চিনেছেন তো? তাকে নিয়ে আমি একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপিয়েছিলাম। শিরোনাম ‘কালনাগিনীর প্রেমকথা’। আশা করি আপনাদের চোখে পড়েছে, যদিও অনেক দিন আগের কথা।

অত্যন্ত বিষণ্ণ হৃদয়ে আমরা লেখকের বাসস্থান ত্যাগ করি এবং ‘অন্যরাত’ প্রকাশনার কর্ণধার জনাব আজহারুল ইসলাম সাহেবের অফিসে উপস্থিত হই। তিনি সমস্ত ঘটনা শ্রবণ করে দুঃখভারাক্রান্ত হন। তিনি লেখকের উগ্র মেজাজের কঠিন সমালোচনা করেন। তার বক্তব্য ছিল বাস্তব এবং যুক্তিসম্মত। তিনি বলেন, হিমুবিষয়ক বই আমাদের চালু আইটেম। হিমুকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। লেখককে আমরা অনেক অনুরোধ করেছি যেন অন্তত বর্ষাকালে হিমু রাবারের জুতা পরতে পারে এই ব্যবস্থা করা হয়। বর্ষাকালে নগরীর নালা নর্দমার দূষিত পানির ওপর খালি পায়ে কেউ হাঁটে না। একবার পা কেটে গেলে গ্যাংগ্রিন ফ্যাংগ্রিন কত কিছু হতে পারে। তখন পা কেটে ফেললে কী অবস্থা হবে লেখক স্যার কি বুঝতে পারছেন? ল্যাংড়া হিমুর বই কেউ পড়বে?

পৌষ-মাঘ মাসের শীতে হিমু বেচারাকে একটা পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে হয়। ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া বাধালে উপায় আছে? লেখক স্যারকে আমরা কত বুঝিয়েছি পৌষ-মাঘ মাসের শীতে তিনি যেন হিমুর জন্য চাদর বা কোটের ব্যবস্থা করেন। তিনি তাতেও রাজি না।

আমি আজহারুল ইসলাম সাহেবের প্রতিটি কথায় একমত হয়েছি। উনার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পেরেছি, লেখক স্যার হিমুকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কীভাবে মারবেন ঠিক করতে পারছেন না বলে এখনো মারেন নি। তার মাথায় যে কোনো সময় আইডিয়া চলে আসবে হিমুর জীবনাবসান হবে। কী ভয়ঙ্কর কথা!

প্রিয় পাঠক! স্থানাভাবে হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার এবার দিতে পারছি না। আগামী যে কোনো বিশেষ সংখ্যায় সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা হবে। পাঠক সমাজের অবগতির জন্য জানাচ্ছি আপনারা হিমু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। যেমন তার রাজনৈতিক মতাদর্শ (বিএনপি না আওয়ামী লীগ)। রূপচর্চা বিষয়েও তিনি আমাদের মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। অতিরিক্ত রোদে ঘোরাঘুরি করে চামড়ার যে ক্ষতি হয় সেই ক্ষতিপূরণে কী করা উচিত ইত্যাদি।

হিমু-রূপার প্রণয় বিষয়েও তিনি মুখ খুলেছেন। যদিও তিনি বলেছেন, এই বিষয়টা অফ দ্য রেকর্ড, তারপরেও কিছু কাটছাঁট না করে আমরা আপনাদের জানাব। পাঠকের কৌতূহল মেটানো আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *