হিপি-বিটনিক-বিদ্রোহ
আধুনিক যন্ত্রযুগের সমাজ—সভ্যতার বিকট দানবীয় ব্যাদানের বিরুদ্ধে আজ যাঁরা কতকটা উদ্ভ্রান্ত আউল—বাউলের বেশে অনুচ্চার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, তাঁদের বিদ্রোহকে এ যুগের সহজিয়া বিদ্রোহ বলা যায়। তাঁদের বলা হয় ‘হিপ’—জেনারেশন বা ‘বিট’—জেনারেশন। সারা পৃথিবীতে, নিউ ইয়র্ক—লন্ডন থেকে কলকাতা মহানগর পর্যন্ত, তাঁরা হিপি—বিটনিক—বিটল নামে পরিচিত, ইদানীং কলকাতায় ‘হিপি’ নামটাই বেশি জনপ্রিয়। হিপি—দার্শনিকদের মতে, আজকের পৃথিবীতে মানুষের সমাজে ও জীবনে শান্তি নেই, প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, এককথায় হ্যাপিনেস নেই বলে চারদিকের মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিসের মতো হিপিনেস গজিয়ে উঠছে। কিন্তু কেন হিপিদের বিদ্রোহ সহজিয়া বিদ্রোহ, এবং হিপিরা সহজিয়া বা সহজপন্থীদের সগোত্র?
বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়ারা ধর্মসাধনে মূলত শাস্ত্রাচার বিরোধী। শাস্ত্রীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধেই তাঁরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বৈষ্ণব সহজিয়াদের সাধনায় প্রেম ও রস প্রধান আশ্রয় এবং স্বকীয় ও পরকীয় দু—রকম রসের মধ্যে পরকীয় রসের আশ্রয় শ্রেষ্ঠ। নরনারীর সহজ স্বাভাবিক রতিসম্পর্ক যে স্বামী—স্ত্রী—র শাস্ত্রীয় সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এই সত্যই সহজিয়ারা স্বীকার করেন। ভাবাশ্রয় ও প্রেমাশ্রয়ও তাঁদের সাধনার বড় কথা। এ যুগের হিপিদের সঙ্গে বৌদ্ধ—বৈষ্ণব সহজিয়াদের অনেকদিক থেকে মিল আছে। প্রেম—ভালোবাসা হিপি—জীবনের বড় আদর্শ। হিপিদের আস্তানায় ও জমায়েতে ‘লভ’ কথাটা তাই বড় করে ব্যানারে লেখা থাকে। ভাবাশ্রিত হবার জন্য হিপিরা ‘পট’—ধুম (কতকটা গাঁজা—সিদ্ধির মতো), নানা রকমের ড্রাগ ও সুরাপান করেন, সহজিয়ারাও গঞ্জিকা—সিদ্ধিসেবনে অভ্যস্ত। উভয়েরই মতে তা ছাড়া নাকি ‘ভাব’ আসে না এবং ভাবের বায়ুলোকে বিচরণ করা যায় না। সহজিয়ারা সমাজ—পরিবার বর্জন করতেন এবং কোনো বাহ্যাচার বা নীতিবন্ধন মানতেন না। হিপিরাও তা—ই, তাঁরা বর্তমান সমাজ ও পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে যত্রতত্র সহজিয়াদের মতো চলেফিরে বেড়ান। নিজেদের আহার—বিহারে ও মেলামেশায় স্ত্রী—পুরুষ হিপিরাও ভ্রাম্যমাণ বাউলদের মতো কোনো সামাজিক নীতিবন্ধন মানেন না। সহজিয়াদের মতো হিপিরাও গুরুবিশ্বাসী এবং মাথার চুল—দাড়ি পোশাক—পরিচ্ছদের দিক থেকেও তাঁদের বাউলসাদৃশ্য লক্ষণীয়। হিপি বিদ্রোহকে তাই আধুনিক ধনতান্ত্রিক যন্ত্রযুগের সহজিয়া বিদ্রোহ বলা যায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, হিপিরা বর্তমান ‘সিক সোসাইটি’ বা ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের ব্যারোমিটার। কিছুদিন আগে (জানুয়ারি ১৯৬৯) ডক্টর জন ইগান নামে একজন খ্যাতনামা আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী কলকাতা শহরে এসেছিলেন। দলে দলে আজ হিপিরা কেন সুদূর আমেরিকা থেকে, সেখানকার অ্যাফ্লুয়েন্ট বা ভূরিসমাজের ভোগলালসা ও গণিত প্রলোভন ছেড়ে, ভারতের হিমালয় থেকে কলকাতা—হাওড়ার দিকে ধাবমান হচ্ছেন, গুরু মহেশ যোগী থেকে কৃষ্ণপ্রেমিক ভক্তিবেদান্ত ও চিরঞ্জীবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করছেন, সেই প্রশ্ন তাঁকে করা হয়। প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানী ইগান বলেন যে হিপিরা আজ এক অতীন্দ্রিয় জীবনানুভূতির জন্য লালায়িত এবং ধ্যান—যোগসাধনা ইত্যাদির ভিতর দিয়ে সেই অনুভূতি আস্বাদনের অমরাবতী হল ভারতবর্ষ। কাজেই হিপিরা আজ ভারতাভিমুখী এবং হিমালয়ের গুহাগহ্বর থেকে কলকাতা—হাওড়ার অলিগলি পর্যন্ত তাঁদের বিচরণক্ষেত্র বিস্তৃত। ইগান অবশ্য এ কথাও উল্লেখ করেন যে ভূরিসমাজের ভোগবিলাসিতা ও সুখোচ্ছ্বাসের (ইউফোরিয়া) প্রতি হিপিদের যে বীতরাগ ও অনাসক্তি তা আন্তরিক এবং তার কারণ হল যন্ত্রজর্জর, নিরেট আমলা—অধ্যুষিত সমাজের ব্যক্তিসত্তানাশ, কপটতা ও অত্যুৎকট কৃত্রিমতার বিরুদ্ধেই হিপিদের বিদ্রোহ। আমেরিকার তরুণ ছাত্র বিদ্রোহ ও হিপি বিদ্রোহের সামাজিক উৎস যে কতকটা একই, সে কথাও ইগান ইঙ্গিত করেন।
বিষয়টা ভাববার মতো। অন্তত সমাজ বিষয়ে যাঁরা চিন্তা করেন তাঁরা আজ হিপি—বিটল—বিটনিকদের আন্দোলন—আচরণ যতই বিসদৃশ হোক, তাচ্ছিল্যভরে তাঁদের উপেক্ষা করতে পারেন না। যদি তাঁরা মধ্যবয়সি বা বৃদ্ধদের একটি গোষ্ঠী হতেন, তাহলে এটা না—হয় তাঁদের জীবনের তৃতীয়াশ্রম বানপ্রস্থ অথবা চতুর্থাশ্রম সন্ন্যাসেরই একটা রূপ বলে ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু হিপিরা অধিকাংশই বয়সে তরুণ বলে তাঁদের বিদ্রোহী ও আপাতোদ্ভট জীবনদর্শন রীতিমতো চিন্তনীয়। মানবসমাজের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনোকালে সমাজমঞ্চে এরকম বিচিত্র অভিনয় দেখা যায়নি, যেখানে অভিনেতারা সকলে তরুণ—তরুণী, নাট্যবস্তু চলমান সমাজজীবন এবং সমাজদর্শন পরিবর্জন। এ বিদ্রোহের মৌল প্রকৃতিও অনন্য। তাই যেটা যার কাছে যত কিমাকারই মনে হোক, তার স্বরূপ বোঝার সামাজিক দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়—সারা পৃথিবীব্যাপী ‘ইয়ুথ রিভোল্ট’ বা তরুণ বিদ্রোহ আজ দুটি ভিন্নমুখী ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। একটি ধারা ‘ছাত্র বিদ্রোহ’—যার ভিতর দিয়ে সমাজ এক নতুন ছাত্রশক্তির (যাকে ‘স্টুডেন্ট পাওয়ার’ বলা হয়) অভ্যুদয় হচ্ছে। এটি ‘পজিটিভ’ ধারা। অন্য ধারাটি হল—হিপি—বিটল—বিটনিকদের আত্মান্বেষী আন্দোলনের ধারা—জীবনবিদ্রোহ বলা যায়। এটি ‘নেগেটিভ’ ধারা। সমাজ—রাষ্ট্রজীবনের একই প্রদাহী পরিবেশ এই বিশ্বব্যাপী তরুণ বিদ্রোহের উভয় ধারার উৎস ও ইন্ধন।
হিপ— জেনারেশনের আলোচনায় এই সামাজিক পশ্চাদভূমি মনে রাখা প্রয়োজন। মনে রেখে হিপিদের সঙ্গে আরও একটু ঘনিষ্ঠ পরিচয় করা যাক। ক্যালিফোর্নিয়ায় হিপিদের একটি বিখ্যাত আড্ডায় একবার কোনো কৌতূহলী দর্শক উপস্থিত হন, হিপি—জগৎ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই তিনি প্রশ্ন করেন: ‘আমার জানতে ইচ্ছে করে, এইভাবে জীবনযাপন করার ও বেঁচে থাকার ব্রত আপনারা গ্রহণ করেছেন কেন?’ দলের ভিতর থেকে একজন এলোকেশী তরুণী হিপি, কণ্ঠমালার গুটি নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এসে, ছিমছাম শহুরে ভদ্রলোকটির মুখের দিকে মিনিট দুই নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে (হিপনোটাইজ করার ভঙ্গিতে) বলেন, একটু উত্তেজিত সুরে:
‘আপনার নিজের দিকে চেয়ে দেখেছেন, কে আপনি? বেশ ভালো করে চেয়ে দেখুন। কোনো মানুষের সঙ্গে সহজভাবে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেন না আপনি, বলতে গেলে দু—তিন পেগ সুরাপান করে নিজের মুখোশটা ফেলে দিতে হয়। কেন হয়? যে—কোনো নীতি, যে—কোনো মানবিক গুণ, কড়ির মূল্যে আপনারা কিনতে পারেন, নারীর নারীত্ব, ব্যবসায়ীর সততা সবই কড়ির স্পর্শে উবে যায়। আপনারা শান্তির কথা, অহিংসার কথা, মানবতার কথা, মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতার কথা দিনরাত বেতারে সংবাদপত্রে এবং হাজার হাজার বইতে প্রচার করেন, অথচ ভিয়েতনামের নিরীহ মানুষ হাজারে হাজারে হত্যা করতে আপনাদের সংকোচ হয় না। যন্ত্রের মহিমাকীর্তনে আপনারা পঞ্চমুখ, অহরহ বলছেন যে যন্ত্র দিয়ে এ পৃথিবীকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তবু কেন আজও এপৃথিবীর অধিকাংশ অসহায় মানুষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করছে, খুনোখুনি—মারামারি করছে? মানুষের স্বাভাবিক অধিকার ও মর্যাদা আজও আপনারা গায়ের সাদা—কালো রং দেখে বিচার করেন, অথচ আপনাদের বড় বড় আদর্শের বুলির ধ্বনিতে কানের পরদা ফাটার উপক্রম। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী আজ আপনাদের টাকার গোলাম, আপনাদের মুনাফা বিকট হাড়িকাঠে উৎসর্গিত। সেই বিজ্ঞান দিয়ে আজ আপনারা সর্বসংহারক মারণাস্ত্রের পরীক্ষায় পৃথিবীর আলো—জল—বাতাস পর্যন্ত বিষিয়ে তুলছেন, মানুষের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন করছেন। এই তো আপনাদের সমাজ ও সভ্যতা, এবং এই সভ্যতারই একজন প্রতিমূর্তি আপনি। আপনি কি বলতে চান, আপনার বা আপনাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে—কেমনভাবে বেঁচে থাকতে হয়, এবং কেমনভাবে জীবনযাপন করা উচিত? ‘And you think you’re going to tell us how to live?’
মুক্তকেশী হিপি তরুণীর এই উত্তর শুনলে জ্যঁ পল সার্ত্রের ‘নসিয়া’ গ্রন্থের সেই হতভাগ্য হিউম্যানিস্টের কথা মনে হয়, যে হিউম্যানিস্টের প্রয়োজন আজকের মানুষের ফুরিয়ে গেছে, যে চিরদিনের মতো তাই নির্জনতার রাজ্যে প্রবেশ করেছে—কারণ অকস্মাৎ আজ তার চোখের সামনে সব ভেঙে পড়েছে, সংস্কৃতির সব স্বপ্ন, মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ও প্রীতির সব স্বপ্ন :
That poor humanist whom men don’t want any more… Now he has entered into solitude–forever. Everything has collapsed at once, his dreams of culture, his dreams of an understanding with mankind.
হিপিদের এই হতভাগ্য হিউম্যানিস্ট বলা যেতে পারে। আজকের হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে অহিংসা, প্রেম—ভালোবাসাই হিপিদের কাম্য। ‘Why can’t everybody live in peace? Then the whole world can be happy Love, that’s what we all need. More love. That’s what we hippies want to give to the world.’
যন্ত্রযুগের মানুষ হৃদয়ের আবেগ—অনুভূতিকেও যন্ত্রের স্পন্দন মনে করে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার বন্ধন নেই, প্রীতির বন্ধন নেই, অর্থসর্বস্ব পণ্যময় জগতে কেবল টাকার বন্ধন আছে, ‘ক্যাশ নেক্সাস’। ধনিকতন্ত্রের কী—বা মাহাত্ম্য! মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতি স্থাপন করাই হিপিদের লক্ষ্য। তাই হিপিরা বলেন যে গৌতম বুদ্ধ একজন আদি—অকৃত্রিম হিপি, এবং যিশুখ্রিস্টও একজন হিপিশ্রেষ্ঠ—‘Buddha was one of the original hippies…Jesus was the first hippie you know.’
বুদ্ধ ও যিশু উভয়েই হিপিদের মতে আদি—অকৃত্রিম হিপি হলেও, খ্রিস্টধর্মের প্রতি হিপিদের আকর্ষণ বিশেষ নেই, তার চেয়ে ভারতীয় বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের প্রতি আকর্ষণ তাঁদের অনেক বেশি। তাঁরা বলেন যে, খ্রিস্টধর্ম যিশুর কোনো আদর্শ মেনে চলেনি এবং ধর্মের নামে সারা পৃথিবীতে খ্রিস্টানরা যত অধর্ম ও অন্যায় করেছেন, অশান্তি হিংসা—বিদ্বেষ অত্যাচার যুদ্ধবিগ্রহাদির প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাতে ক্যাথলিক—প্রোটেস্ট্যান্ট কোনো চার্চের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাভক্তি হয় না। বরং বৌদ্ধ, হিদু প্রভৃতি ধর্মের নীতি আদর্শ ও আচরণের মধ্যে একটা আন্তর সংগতি আছে এবং তার যোগসাধন ধ্যান—তপস্যা জপ—মন্ত্রাদির মধ্যে আত্মোপলব্ধির ও আত্মশক্তি বিকাশের সুযোগ আছে। তাই হিপিরা এই যোগ—ধ্যান—জপ—মন্ত্রের অনুগামী। তাঁদের বিশেষ কোনো ধর্মমত বলে কিছু নেই, তবে ধর্মাচরণের বাহ্যাড়ম্বরে তাঁরা বিশ্বাসী নন। ধর্মের ভিতর দিয়ে তাঁরা সমাহিত প্রশান্তি চান। কোথাও কোথাও তাঁরা এক নতুন ধরনের চার্চল গড়েছেন আমেরিকায়, যেখানকার যাজকরা বৌদ্ধ শ্রমণ ও হিন্দু যোগীর মতো এবং তাঁদের বলা হয় বু—উ—হু—উ। কিছুই না, শুধু একটা শব্দ, যার ধ্বনি আছে কিন্তু অর্থ নেই, যেমন তাঁরা সূর্যস্তব করেন, সমবেত কণ্ঠে ‘ওঁ’ ধ্বনি করেন এবং অর্থহীন বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্ত্র (তান্ত্রিক বীজমন্ত্রের মতো) উচ্চারণ করেন। এতেই নাকি হিপিরা একটা অতীন্দ্রিয় আনন্দের আস্বাদ পান, যা গির্জার গতানুগতিক যিশুর প্রার্থনায় পাওয়া যায় না। ‘আজ আমাদের রুটি খেতে দাও, হে যিশু, লোভের পথে ঠেলে দিয়ো না’—এই প্রার্থনার পাশে ‘ওঁ হ্রীং ক্রীং হুঁ ফট স্বাহা’ মন্ত্রের গভীর অনুরণনের কোনো তুলনাই হয় না। একটি উৎকট নিরেট গদ্য, আর—একটি বাচ্যাতিরিক্ত অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় ধ্বনিতরঙ্গ, যেতরঙ্গের উত্থান—পতনের ভিতর দিয়ে নিজ সত্তার গহন অন্তঃস্থল পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়া যায়। হিপিরা এইভাবে আত্মসত্তার গহনে ডুবে যেতে চান বলে জপ—তপ—ধ্যান—মন্ত্র ও যোগসাধনের পথ, ধর্মের ক্ষেত্রে, তাঁরা বেছে নিয়েছেন। এই পথেই তাঁদের শ্রেষ্ঠ কাম্য প্রশান্তি।
এই সমাহিত প্রশান্তির যাত্রাপথে হিপিকুলের অন্যতম সহায় হল নেশা। নেশার মধ্যে অ্যালকোহলের পরেই হল মারিজুয়ানা পট—স্মোকিং, কতকটা চরস—গাঁজা—সিদ্ধির মতো এবং তারপর এল—এস—ডি, হেরোইন ও নানা রকমের সব ড্রাগ। পট—স্মোকিং, মনে হয়, ভারতীয় যোগী—সাধুপুরুষদেরই প্রভাব। মারিজুয়ানা ধূমপানের অভ্যাস আমেরিকান হিপিদের মধ্যে এত দ্রুত বিস্তারলাভ করছে যে স্কুলের অল্পবয়স্ক বালক—বালিকারাও ‘থ্রিল’—এর সন্ধানে এইদিক দিয়ে হিপিপন্থী হয়ে উঠেছে। ড্রাগের আকর্ষণও যথেষ্ট। পট—ধূমপান বা ড্রাগসেবন ছাড়া নাকি, হিপিদের মতে, অতীন্দ্রিয় অনুভূতির রাজ্যে বিচরণ করা যায় না। স্যানফ্রান্সিসকোর এক হিপিচক্রাধিপতি মারিজুয়ানা ড্রাগসেবনের গুণ ব্যাখ্যা করেছেন :
I float up and up and up until I’am miles above the earth. Then I begin to come apart. My fingers leave my hands, my hands leave my wrists, my arms and legs leave my body and I just floooooooat all over the universe.
মনে হয় যেন আমি উপরে, আরও উপরে, আরও উপরে ভেসে বেড়াচ্ছি, পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক মাইল উপরে। আরও কিছুক্ষণ পরে মনে হয় যেন আমি খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেসে যাচ্ছি। আমার আঙুলগুলো হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, হাত দুটো কবজি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে, হাত—পা সব একে একে দেহের মায়াবন্ধন ছিন্ন করে ফেলছে, এবং আমি কেবল ব্রহ্মাণ্ডের উপর দিয়ে উ—উ—উ—উ—উ—উ—উড়ছি।
খণ্ড খণ্ড দেহ নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের উপর দিয়ে এরকম উড়ে ও ভেসে চলার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি আজ পর্যন্ত আমেরিকা বা সোভিয়েট রাশিয়ার কোনো নভশ্চরের চন্দ্র গ্রহ অভিযানের পথেও হয়েছে কি না সন্দেহ। যদিও বা হয়ে থাকে, তার জন্য কত হাজার কোটি টাকা যে অপব্যয় হয়েছে তার ঠিক নেই। হয়তো হিপিরা এই অঢেল অপব্যয়ের প্রতিবাদ করে বলতে চান, কত সামান্য খরচে কিছু মারিজুয়ানা অথবা ড্রাগ সেবন করলে চন্দ্রলোক অভিযানের এই অভিনব অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়।
সে যা—ই হোক, পট—স্মোকিং ও ড্রাগ সেবন করে হিপিদের উড়ু—উড়ু ভাবসঞ্চারের প্রয়াস বিশেষ প্রশংসনীয় না হলেও, এ বিষয়ে কোনো সমালোচনা তাঁরা একদম সহ্য করতে পারেন না। কিছু বললেই তাঁরা বলেন, ‘বাইরের সমাজে বার—রেস্তরাঁয় হোটেলে—মোটেলে নাইটক্লাবে ককটেল পার্টিতে এবং এরকম অজস্র আড্ডায় আপনাদের যে পান—ভোজন—নৃত্যের উৎসব চলতে থাকে তাতে যদি কারও কোনো ক্ষতি না হয়, তাহলে আমাদের হিপিদের পট—স্মোকিং ও ড্রাগসেবনের জন্য আপনারা নীতিবাগীশের মতো চোখ রাঙান কেন? আমাদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য চিন্তা করতে হবে না, নিজেদের কথা চিন্তা করুন।’ এই মনোভাবের জন্য প্রিস্ট
মর্যালিস্ট বা সাইকোলজিস্ট কারও সমালোচনা বা সমবেদনা হিপিদের উপর একটুও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বর্তমান সমাজের মর্যালিস্টদের হিপিরা অত্যন্ত অশ্রদ্ধার চোখে দেখেন।
বেশভূষায়, নারী—পুরুষের সম্পর্কে, মেলামেশায় ও আচরণে তাঁরা সমাজের কোনো তোয়াক্কা করেন না। কলকাতা, হাওড়া ও শহরতলিতে হিপিদের মধ্যে মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তাঁদের আস্তানাও কয়েকটা এইসব অঞ্চলে আছে এবং এ দেশি গুরুও আছেন। পুরুষরা আঁটসাঁট ট্রাউজারস বা কাটা জিন পরলেও, অনেক সময় খালি পায়ে চলেন। চুল—দাড়ি অপরিচ্ছন্ন ও এলোমেলো, তার সঙ্গে মালা ও ঘণ্টা থাকে। মেয়ে—হিপিদের চুল বাঁধা থকে না, সোজা করে পিঠের উপর ফেলা থাকে। বেশির ভাগ মেয়ে—হিপি খুব উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরেন, লাল গোলাপি বা গেরুয়া, এবং শাড়ি পরার ভঙ্গিও তাঁদের বিচিত্র, কোমরের অনেক নীচে পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়া। এর নাম হয়েছে ‘হিপি—স্টাইল’। আমাদের দেশের কাপড়ের মিল মালিকরা ইদানীং এই হিপি—স্টাইলে শাড়ি পরা মেয়েদের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেও আরম্ভ করেছেন। তাতে নাকি শাড়ির কাটতি হয় ভালো এবং হিপি—স্টাইলে শাড়ি—পরা বাইরের মেয়েদের মধ্যেও ‘পপুলার’ হয়। হিপি—মেয়েরাও ‘বিড’ ও ‘বেল’ ব্যবহার করেন। অবিন্যস্ত কেশ সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করলে তাঁরা জবাব দেন, এইটাই স্বাভাবিক। যা স্বাভাবিক ও যেটা স্বভাবধর্ম তা—ই তাঁরা দৈনন্দিন জীবনে বেশভূষার আচার—ব্যবহারে পালন করতে চান। অর্থাৎ প্রকৃতি—বিরোধী কোনো কাজ করতে চান না।
আমেরিকার বড় বড় শহরে মধ্যে মধ্যে হিপিদেরও মিছিল বেরুতে দেখা যায়। কালো নিগ্রোদের মিছিলের মতো, বিক্ষুব্ধ তরুণ ছাত্রদের মিছিলের মতো, হিপিদের মিছিলও বিদ্রোহী তরুণদের এক রকমের মিছিল। মিছিলে নানা রকমের ব্যানার ও স্লোগান থাকে—
‘লিগালাইজ পট’ ছাড়া বোধহয় হিপিদের বর্তমানে আর কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রিক দাবি নেই। বাকি সবই তাঁদের আদর্শের কথা—’জন্ম ও মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি নেই, কাজেই মধ্যের ক—টা দিন আনন্দ করো’, ‘প্রেম—ভালোবাসা’, ‘শান্তি’, ‘অহিংসা’ ও আরও সব ভালো ভালো কথা। বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত, রুক্ষ চুল—দাড়ি, পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন, সমাজ সভ্যতার প্রতি আন্তরিক অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা চোখে মুখে পরিস্ফুট, সমবেত কণ্ঠে ওংকার ধ্বনি হ্রীং ক্রীং হুঁ ফট—এর মতো কোনো তান্ত্রিক বীজমন্ত্রের আড়ষ্ট উচ্চারণগত—এরকম তরুণ—তরুণী দলে দলে যখন আমেরিকার মতো যান্ত্রিক ধনতান্ত্রিক স্বর্গরাজ্যের বড় বড় মহানগরের স্কাইস্ক্রেপার অটোমোবিলের ভিড়ের ভিতর দিয়ে মৌন শোভাযাত্রা করে চলতে থাকে, তখন মনে হয় হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফার মহাযজ্ঞে আহুতি দিয়ে চন্দ্রলোকযাত্রার চেয়ে মর্ত্যলোকের এই বিচিত্র বিদ্রোহী তরুণদের শোভাযাত্রার সামাজিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
আর যা—ই হন, তামাশার পাত্র নন হিপিরা। মানবসমাজের ইতিহাসে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এ একটা অত্যাশ্চর্য বিদ্রোহ—বর্তমানের ঘুণ ধরা ধনতান্ত্রিক পরিবার সমাজ রাষ্ট্র ও যান্ত্রিক জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে তরুণদের বিদ্রোহ। তবে ‘নেগেটিভ’ বিদ্রোহ যে তা আগেই বলেছি। সমাজের প্রচলিত নীতিবোধ, মূল্যবোধ, বিচারবোধ—সমস্ত কিছু মূল্যায়নের মানদণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের কারণ কী? আগেই বলেছি, যে কারণে পৃথিবীব্যাপী তরুণ ছাত্রসমাজের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ, সেই কারণেই তরুণসমাজের একাংশ হিপি—বিটনিকদের বিদ্রোহ। যে জীর্ণ জরাগ্রস্ত শ্রেণিশোষিত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহুকালের অন্যায়—অবিচার বিকার—ব্যভিচার পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছেন যে আমেরিকার সমাজ ও জীবনযাত্রার প্রতি হিপিরা হলেন ‘রেড ওয়ানিং লাইট’—এর মতো। ক্যালিফোর্নিয়ার একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন যে আমাদের অসুস্থ ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের ব্যারোমিটার হলেন হিপিরা। বয়সে তাঁরা তরুণ তো বটেই, বেশির ভাগই দশের কোঠার মধ্যে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই বেশি, তবে নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ের সংখ্যাও কম নয়। যুদ্ধবিগ্রহ, বিশেষ করে ভিয়েতনামের যুদ্ধ, পারমাণবিক মারণাস্ত্রের পরীক্ষা, পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধে সমগ্র মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা, জাতিবিদ্বেষ—বর্ণবিদ্বেষ, হিংসা, কপটতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে হিপিদের বিদ্রোহ। উক্ত সমাজবিজ্ঞানীর ভাষায় হিপিদের সম্বন্ধে বলা যায় :
They have rebelled against society and turned away from its hypocrisy, shams and frauds. They are against the organization man, mass society, this computerized world we live in. They are against competition in business.
এ যুগের শিল্পোন্নত যান্ত্রিক সমাজের স্বরূপ যিনি বৈজ্ঞানিক দার্শনিকের দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ করেছেন, এবং যিনি নাকি বর্তমানকালে, ইউরোপের তরুণ বিদ্রোহের অন্যতম আদর্শগুরু বলে স্বীকৃত, সেই হারবার্ট মারকিউসে তাঁর বিখ্যাত ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান’ গ্রন্থে এই হিপিবিটনিকদের বিদ্রোহের তাৎপর্যের কথা ইঙ্গিত করতে ভোলেননি। পরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একটি সম্মেলনে (কংগ্রেস অন দ্য ডায়েলেকটিকস অফ লিবারেশন, ১৫—৩০ জুলাই ১৯৬৭) হারবার্ট মারকিউসে তরুণ হিপি—বিদ্রোহের তাৎপর্য আরও স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলেছেন :
I would like to say my bit about the Hippies. It seems to me a serious phenomenon. If we are talking of the emergence of an instinctual revulsion against the values of the affluent society. I think here is a place where we should look for it.
পণ্যপ্লাবিত যান্ত্রিক ভূরিসমাজের জীবনবোধ ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে হিপিদের বিদ্রোহকে মারকিউসে ‘সাহজিক বিদ্রোহ’ বলেছেন। আমাদের ভাষায় আমরা হিপিদের সহজপন্থী বলতে পারি এবং তাঁদের বিদ্রোহকে বলা যায় ‘সহজিয়া বিদ্রোহ’।
জ্যাক কেরুয়াক (বিটনিকদের ‘প্রিন্স’ বলা হয়) তাঁর একটি রচনায় (‘ভিজনস অফ জিরার্ড অ্যান্ড ট্রিসটেস’ ১৯৬৪) প্রশ্ন করছেন : ‘মানুষকে এত দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয় কেন? কেন আমরা আশায় উদ্ভাসিত মানুষের প্রশস্ত ললাট লক্ষ্য করে তপ্ত লৌহশলাকা ছুড়ে মারি?’ উত্তরে একজন বলছেন : ‘জিরার্ড, তুমি ছেলেমানুষ, তাই এখনও জানো না—জীবনটা একটা জঙ্গল, যেখানে মানুষ খাচ্ছে মানুষকে—হয় তুমি খাবে, না—হয় তোমাকে ভাবে, যেমন বেড়াল—ইঁদুর খাচ্ছে, ইঁদুর পোকা খাচ্ছে, পোকা চিল খাচ্ছে, আবার শেষে সেই পোকা মানুষকেও খাচ্ছে।’
There’s no explaining your way out of the evil of existence–‘In any case, eat or be eaten’–we eat now, later on the worms eat us.
‘কেন যে জন্মেছি এবং বেঁচে আছি তা বাস্তবিক ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না। যেটা বোঝা যায় সেটা হল—হয় তুমি কাউকে খাবে, না—হয় তোমাকে কেউ খাবে, এবং আমাদের এই খাওয়াখাওয়ি শেষ হলে অবশেষে পোকায় খাবে আমাদের।’
শ্রেণিশোষিত মানবসমাজের এই হিংস্র আরণ্যক মূর্তির বিরুদ্ধে তরুণ হিপিদের বিদ্রোহ। সভ্যতা—সংস্কৃতির নামে কপটতা, শঠতা ও বর্বরতার যে তাণ্ডব পৃথিবীব্যাপী চলেছে, তার বিরুদ্ধে আবেগ—উদবেল তরুণ চিত্তের বিদ্রোহ। ব্যারিকেড, গেরিলা যুদ্ধ, হিংসার বদলে হিংসার বিদ্রোহ হল তরুণসমাজের ‘পজিটিভ’ বিদ্রোহ। হিপি বিদ্রোহ ‘নেগেটিভ’ হলেও একই সামাজিক পরিবেশ থেকে উৎসারিত এক অভিনব সহজিয়া বিদ্রোহ। পৃথিবীব্যাপী তরুণ বিদ্রোহের বিপুল তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই হিপি—বিটনিক—বিদ্রোহকেও একটি তরঙ্গ বলে স্বীকার করতে হয়, যদিও সেই তরঙ্গের মধ্যে আঘাত হানার বা ভাঙনের উদ্দামতা নেই—আছে সহজ পথে, সমস্ত নোঙর—বন্ধনছিন্ন সহজিয়ার বেপরোয়া গতি।
১৯৬৯