হিন্দুস্তানের শাসক

৪. হিন্দুস্তানের শাসক

তার বিশাল সাম্রাজ্য সুরক্ষা করা

শাহ জাহান সপ্তাহে এক দিন দরবার আয়োজনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সত্যনিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিময় ছিলেন, কারোরই তার কাছে অভিযোগ জানানোর প্রয়োজন হতো না। এখন আওরঙ্গজেব দিনে দুবার দরবারের আয়োজন করেন এবং অভিযোগের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব প্রশাসনের হিন্দু সদস্য, ফারসিতে লিখিত

আওরঙ্গজেব একটি বিশাল সাম্রাজ্যের তত্ত্বাবধান করতেন। ফলে একটি বিরাট আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। তিনি সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অংশে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না, বরং নিজের শাসনামলের প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সময় দিল্লিতে ও শেষার্ধ প্রধানত দাক্ষিণাত্য অভিযানে ব্যয় করেছেন। মোগল সাম্রাজ্য পরিচালনার দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাঁধে। অবশ্য ন্যায়বিচারের প্রতি নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে আওরঙ্গজেবের শারীরিক দূরত্ব তাকে অনেক প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত না ।

আওরঙ্গজেব বিপুলসংখ্যক নিউজ বুলেটিনের (আখবারাত, যুবরাজদের দরবারগুলোর খবরাখবর নিয়ে এগুলো প্রতিদিন তার কাছে আসত। এতে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তথ্য থাকত) মাধ্যমে তার রাজ্যের সব প্রান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত থাকতেন। ওই সময়ের সব নেতাই এ ধরনের সংবাদ বুলেটিনের ওপর নির্ভর করতেন। এসব বুলেটিন আওরঙ্গজেবের দরবারে কী ঘটছে, সে সম্পর্কিত তথ্যও তার শত্রু ও মিত্র সবাইকে অবগত করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডাচ দূত হার্বার্ট ডি জ্যাগার জানিয়েছেন, ১৬৭৭ সালে শিবাজি সংবাদ প্রতিবেদন দিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে তিনি বৈঠক করার সময় পর্যন্ত বের করতে সমস্যায় পড়তেন ।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মোগল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের আচরণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন শুনতেও অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন আওরঙ্গজেব। এসব ক্ষেত্র প্রায়ই অতি বিশাল সাম্রাজ্যটি শাসন করার আওরঙ্গজেবের প্রয়াসের ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে দিত।

আওরঙ্গজেব মোগল ভূখণ্ড জুড়ে মৌলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। তিনি বারবার তার ছেলে ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতদেরকে রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে লিখতেন, সাধারণ প্রজাদের বিরুদ্ধে চুরি ও অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে না পারার জন্য তাদের তিরস্কার করতেন। অবশ্য, আওরঙ্গজেবের প্রয়াস সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা জটিল হয়েছিল মোগল ভারতে, তার রাজত্বের শেষ দিকে সম্ভবত আরো অবনতি ঘটেছিল। এই পর্যায়ে মোগল বাহিনী শিথিলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কয়েক দশকের সঙ্ঘাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক নতুন সৈনিকের মধ্যে মোগল স্বার্থের প্রতি আনুগত্য ছিল দুর্বল। ১৬৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির গেমেলি ক্যারেরি অভিযোগ করেছিলেন যে মোগল ভারত চোরদের থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, যেমনটা পারে সমসাময়িক সাফাভি ও উসমানিয়া সাম্রাজ্য । আওরঙ্গজেব নিজে আর্তনাদ করে বলেছেন যে বুরহানপুর ও আহমদাবাদের মতো বড় বড় নগরীতে পর্যটকদের ওপর ডাকাতি হয়। এতে বোঝা যায়, পল্লী এলাকায় আরো সাংঘাতিক হামলা হতো ।

আওরঙ্গজেবকে মিশ্র মানসম্পন্ন তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেও হিমশিম খেয়েছিলেন। মোগল প্রশাসকেরা নিয়মিত ঘুষ নিতেন, আওরঙ্গজেব যদিও এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি অষ্টাদশ শতকের একটি ইন্দো-ফারসি গ্রন্থের ভাষ্যানুযায়ী খাবলে ধরা ও টেনে আনার জন্য প্রধান কাজি (এই সুবাদে তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের নৈতিক নির্দেশনাদাতা) আবদুল ওয়াহাবের ‘হাতটি ছিল দীর্ঘ, তিনি বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।’ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসকেরা আওরঙ্গজেবকে হতাশ করেছিলেন, বাদশাহ তাদের অন্যায় পন্থার সমালোচনা করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাতি বিদার বখতকে লেখা এক চিঠিতে কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে তাকে উপদেশ দেন : “শান্তি অনুপস্থিতি থাকলে সার্বভৌমত্ব থাকতে পারে না।’ তবে সম্রাট তার লোকদের প্রতি ক্ষমশীলতাও প্রদর্শন করতেন। তিনি রাজকীয় কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে তিরস্কার করার জন্য তার ছেলেদের ধমক দিতেন, এবং অনেক সময় শাস্তি পরিবর্তন করে দিতেন ।

আওরঙ্গজেবের ক্ষমতাশীলতা অনেক সময়ই তার পরিবার সদস্যের প্রতি সম্প্রসারিত হতো না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতাকারীদের তিনি শাস্তি দিতেন, এমনকি স্রেফ ভুল করলেও নিস্তার মিলত না। উত্তরাধিকার লড়াইয়ের সময় এই বিষাদময় প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে, তবে তার পুরো আমলে তা অব্যাহত থাকে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মামা শায়েস্তা খানকে আওরঙ্গজেব দক্ষিণে পাঠিয়েছিলেন ১৬৫৯ সালে শিবাজির সামরিক বিরোধিতা প্রতিরোধ করতে। শিবাজি তখন দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছিলেন। শায়েস্তা খান পুনেতে সুন্দর সুন্দর ভবন ও উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, পুরো অঞ্চলের সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলেন। খাদ্যের দাম কম থাকে, শায়েস্তা খানের বদান্যতায় লোকজন উপকৃত হয়। পুনেতে শায়েস্তা খানও আয়েসী ও বিলাসী জীবনযাপন করছিলেন, মেয়ের বাগদানের মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি তার প্রধান লক্ষ্য তথা শিবাজিকে দমন করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির কথাই ভুলে গিয়েছিলেন।

শিবাজি কিন্তু শায়েস্তা খানকে ভোলেননি। তিনি ১৬৬৩ সালের বসন্তে তার প্রাসাদে গুপ্তহামলা চালান। মাত্র কয়েক ডজন লোক নিয়ে রাতের অন্ধকারে শিবাজি চুপি চুপি প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। মারাঠারা হঠাৎ করে শায়েস্তা খানের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও তার একটি আঙুল কাটা পড়ে। তিনি তার পরিবারকেও রক্ষা করতে পারেননি। তার কয়েকজন স্ত্রী শেষ হয়ে যায়। শিবাজি ও তার লোকজন চলে আসার আগে শায়েস্তা খানের ছেলেকে হত্যা করেন বলে অনেক সূত্র জানিয়েছে। তারা তাকেই শায়েস্তা খান মনে করে তার বিছানায় তাকে হত্যা করে। এই লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা শুনে আওরঙ্গজেব তার মামাকে মোগল সাম্রাজ্যের শাস্তিমূলক বদলির স্থান হিসেবে পরিচিত বাঙলায় পাঠিয়ে দেন। এমনকি তাকে পূর্ব দিকে গমনপথে ভাগ্নের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

কয়েক দশক পর আরো কম নাটকীয় তবে বর্ণাঢ্য ঘটনায় আওরঙ্গজেব তার ছেলে আযম শাহকে তিরষ্কার করেন সুরাত মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থতার কারণে। আযম শাহ প্রতিবাদ করে বলেন যে এলাকাটি তার নয়, বরং অন্য এক কর্মকর্তার আওতাধীন। জবাবে আওরঙ্গজেব তার ছেলের মনসব মর্যাদা হ্রাস করে উল্লেখ করেন, ‘যদি কোনো যুবরাজের বদলে অন্য কোনো কর্মকর্তার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকত বিষয়টি, তবে তদন্তের পর এই নির্দেশ জারি করা হতো। যুবরাজের জন্য তদন্ত ছাড়াই শাস্তি।’

আওরঙ্গজেব তার চতুর্থ ছেলে যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহের সময় আরো কঠোর হয়েছিলেন। ১৬৮১ সালে রাজস্থানে রাঠোর ও সিসোদিয়াদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাঠানোর পর আকবর বিদ্রোহ করে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই তার রাজপুত মিত্রদের সমর্থন হারিয়ে শিবাজির ছেলে ও ওই পর্যায়ে আওরঙ্গজেবের চরম শত্রু শম্ভুজির দরবারে পালিয়ে যান। কয়েক বছর পর ১৬৮৭ সালে আওরঙ্গজেব তার ছেলেকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন। যুবরাজ আকবর পারস্যে আত্মগোপন করেন, সেখানেই ১৭০৪ সালে ইন্তিকাল করেন ।

আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে রাজপুত শাসকদের মতো আরো কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়েছিলেন। রাজপুতেরা দীর্ঘ সময় মোগলদের অধীনে কাজ করেছিল, তবে আকবরের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রথম একীভূত হওয়ার পর থেকে বিদ্রোহ করা যেন প্রথাই হয়ে পড়েছিল।

আওরঙ্গজেবের আমলে একটি অবাক করা ঘটনা ছিল ১৬৭৯-৮১ সময়কালে মারওয়ার ও মেবারের রাজপুত পরিবারগুলোর বিদ্রোহ। এ ঘটনাটি দুই রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখা দেয়। ১৬৭৮ সালের ডিসেম্বরে যশোবন্ত সিং রাঠোর মারা গেলে ঝামেলার সূত্রপাত ঘটে। ওই সময় আওরঙ্গজেব দক্ষিণ পশ্চিম রাজস্থানের রাঠোর রাজ্যের উত্তরাধিকারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপকে রাঠোরের রাজপরিবার, বিশেষ করে মারওয়ারের দুই নাবালক রাজপুত্রকে সাম্রাজ্যের দরবারে লালন-পালন করা নিয়ে তার পরামর্শ ও যোধপুর দখল করার জন্য তার সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেয়নি। প্রতিবেশী মেবারের সিসোদিয়া রাজপুতদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয় যে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তাদের বেলাতেও। তারা তখন মারওয়ারের সাথে জোট গঠন করে।

আগেই বলা হয়েছে, রাঠোর-সিসোদিয়া যৌথ বিদ্রোহ দমন করার জন্য ছেলে যুবরাজ আকবরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আকবর এতে সফল হন। কিন্তু রাঠোর ও সিসোদিয়াদের কাছ থেকে প্রকাশ্য সমর্থন লাভ করে সুযোগ পেয়েছেন মনে করে তিনি ১৬৮১ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে রাজস্থানের নাদোলে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। রাজকীয় চাপে যুবরাজ আকবর বিদ্রোহ আরো দক্ষিণে নিয়ে যান। এদিকে আওরঙ্গজেবের আরেক ছেলে আযম শাহ ১৬৮১ সালের জুনে রাজপুতদের সাথে কূটনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করেন। এর ফলে ১৬৮১ সালের জুন মাসে রাজসমুদ্র নামে একটি চুক্তি হয়। এটি চুক্তি মেবার ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে এটা স্থায়ী ও ফলপ্রসূ শান্তির পথ দেখায়। তবে মারওয়ারে কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহ দেখা যায়। এর কারণ ছিল প্রত্যক্ষ রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হতাশা ।

এই পুরো ঘটনাকে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ‘রাজপুত বিদ্রোহ’ এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু বৈরিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই সাম্প্রদায়িক পাঠ ভুল প্রমাণিত হয় রাঠোর ও সিসোদিয়া উভয়ের মুসলিম যুবরাজ আকবরকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তে, রাজসমুদ্র চুক্তির ব্যাপারে তাদের ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কথা না-ই বা উল্লেখ করা হলো। মেবার আওরঙ্গজেবের সাথে চুক্তিটি গ্রহণ করেছিল, আর মারওয়ার অব্যাহতভাবে মোগল জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম করেছে। এই ঘটনা আসলে একটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কয়েক শ’ বছর ধরে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিমেরা আরো যেসব বিদ্রোহ করেছিল সেগুলোর মতোই ।

আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি নিরসনে সবসময় কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন না। আর যেসব ব্যক্তি সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ করতেন, তারা প্রায়ই নিজেদেরকে তার সহিংসতার সামর্থ্য এবং এমনকি অনেক সময় নৃশংসতার শিকার হতে দেখতে পেতেন ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর যুদ্ধের পর ১৬৮৯ সালে মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর বন্দী হিসেবে আনা শিবাজির ছেলে শম্ভূজি কোনো ধরনের করুণা লাভ করেননি। শম্ভুজি ও তার ব্রাহ্মণ উপদেষ্টা কবি কলাশকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করার জন্য তাদেরকে ভাঁড়ের টুপি পরতে বাধ্য করতে এবং উটে করে দরবারে নিয়ে আসতে আদেশ দেন আওরঙ্গজেব । তারপর তিনি কাঁটা দিয়ে শম্ভুজির চোখ দুটি উপড়ে ফেলতে বলেন। এক ইতিহাসবিদ কাব্যে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, ‘তার কাঁধ আর তার মাথাটির ভার বহন করতে পারছিল না।’ কোনো কোনো ইতিহাসে বলা হয়েছে যে শম্ভুজি ও কবি কলাশের লাশ কুকুরদের সামনে নিক্ষেপ করা হয়, আর তাদের মাথা খড়ে ভর্তি করে দাক্ষিণাত্যের নগরীগুলোতে ঘুরিয়ে অবশেষে দিল্লির কোনো একটি ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হয় ।

তবে আদর্শ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে কিছু ধরনের নৃশংসতাসহ সহিংস পন্থা অবলম্বনের দিক থেকে ওই সময় আওরঙ্গজেব প্রথাবিরুদ্ধ ছিলেন, এমন নয়। আওরঙ্গজেবের কাছে সহিংসতা কেবল অনুমোদনযোগ্যই ছিল না, তা প্রয়োজনীয় ছিল এবং তা যদি মোগল সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা উৎসাহিত করে থাকে, তবে তা যৌক্তিকও ছিল। অবশ্য রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের দিক থেকে ওই সময়ের মানুষ হিসেবে আওরঙ্গজেব তার ভূমিকা পালন করেছেন, এই যুক্তি তাকে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর তীব্র সমালোচনা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আওরঙ্গজেবের সহিংসতার একটি একটি মর্মভেদী উদাহরণ হলো নবম শিখ নেতা তেগ বাহাদুর। বর্তমান সময়ের অনেক অস্বস্তির সাথে এ ঘটনাটি সম্পর্কিত।

পাঞ্জাবে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে মোগল সাম্রাজ্য ১৬৭৫ সালে তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। অনেক শিখ তাদের ধর্মের আদি সময়টিকে কিভাবে বিবেচনা করে, এই ঘটনা তার অন্যতম বিষয়। অথচ মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল স্রেফ একটি গতানুগতিক কাজ। আওরঙ্গজেবের আমলের কোনো ফারসি গ্রন্থে এই মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ নেই। এতে মনে হয়, মোগলদের কাছে এটিকে বিশেষ কোনো ঘটনা বিবেচিত হয়নি। পরবর্তীকালের ফারসি সূত্রগুলো নানা সাংঘর্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি কোথায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল, তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী তথ্য উপস্থাপন করা হয় । মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান হিসেবে কেউ দাক্ষিণাত্য, কেউ লাহোরের কথা বলেছেন । আর শিখ দলিল-দস্তাবেজে দিল্লিতে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল বলে বলা হয়ে থাকে। শিখ নথিপত্রে অনেক পরের এবং সেগুলোতেও ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় । আধুনিক পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বারবার উল্লেখ করা লোকরঞ্জক কাহিনীতে বলা হয় যে তেগ বাহাদুর কাশ্মিরি ব্রাহ্মণদের বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরের প্রতিবাদ করছিলেন। অথচ মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে আদিতম নথি-পত্রে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলে না ।

বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয় ফারসি ও শিখ উভয় সূত্রগুলোতে : আওঙ্গেজেবের দৃষ্টিতে তেগ বাহাদুর মোগল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতা করেছিলেন সামরিকভাবে এবং এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড ছিল যৌক্তিক পদক্ষেপ । তার ধর্মীয় মর্যাদা রাষ্ট্রের শত্রুদের মৃত্যুদণ্ডসহ শাস্তি প্রদান করার ব্যাপারে আওরঙ্গজেব প্রশাসনের সর্বব্যপ্ত প্রতিশ্রুতি লঘু করতে কিছুই করেনি। আর তেগ বাহাদুরের ভাইয়ের ছেলে ও সপ্তম শিখ গুরু হর রাইয়ের উত্তরাধিকার লড়াইয়ে দারা শুকোহর প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন বলে যে গুঞ্জন রয়েছে, তাও এতে সহায়ক হয়নি। একই সময় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপের (যেমন সাতনামি) প্রতিও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।

মূল্যবান হিন্দু অভিজাত

হে সম্রাট দুনিয়া আপনার হুকুমে চলুক;
শুকরিয়া আর সালাম ঝরুক ঠোঁট থেকে;
আপনার আত্মা যেহেতু সব মানুষকে রক্ষা করছে,
তাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন!
-–চন্দর ভান ব্রাহ্মণ, আওঙ্গজেবের অধীনে কর্মরত এই হিন্দু কবির রচনার মাধ্যম ছিল ফারসি

আওরঙ্গজেবের বিশাল আমলাতন্ত্রে হিন্দুরা ভালো অবস্থায় ছিল, তারা চাকরি ও পদোন্নতির সুযোগ পেয়েছিল। আকবরের আমল থেকে রাজপুত ও অন্য হিন্দুরা মোগল প্রশাসনের পূর্ণ সদস্য হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের মুসলিম প্রতিপক্ষদের মতো মনসব নামে পরিচিত আনুষ্ঠানিক পদবি (এটিই ছিল রাজকীয় পদপরম্পরায় তাদের মর্যাদা) পেত। তারা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য লড়াই করত। মোগল অভিজাতদের মধ্যে মুসলিমেরা সংখ্যায় বেশি হলেও হিন্দুরাও মর্যাদাসূচক অবস্থায় এগিয়ে আসছিল, তারাও অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করত। আওরঙ্গজেবও মোগল আমলাতন্ত্রে হিন্দুদের একীভূত করার জন্য বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালানোর সময় তিনি হৃদয়, মন ও ভূখণ্ড জয় করতে চেয়েছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। তিনি তাদের প্রশাসনিক দক্ষতার দিকেই নজর দিতেন।

শাহ জাহানের ছেলেদের উত্তরাধিকার যুদ্ধের (১৬৫৭-৫৯) সময় মোগল প্রশাসনের হিন্দু সদস্যদের সমর্থন আওরঙ্গজেব বনাম দারার প্রতি সমর্থনে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। রাজপুতদের বেশির ভাগ সমর্থন করেছিল দারাকে, আর মারাঠারা (মধ্য সপ্তদশ শতক থেকে তারা পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেছিল) সমর্থন দিচ্ছিল আওরঙ্গজেবকে। তবে সার্বিকভাবে ২১ জন উচ্চ পদস্থ হিন্দু অভিজাত (অর্থাৎ যারা এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি মনসবধারী ছিলেন) আওরঙ্গজেবের পক্ষে লড়াই করেছেন, আর ২৪ জন ছিলেন দারার সমর্থক। অন্য কথায় বলা যায়, আওরঙ্গজেব ও দারার শুকোহ প্রায় সমান হারে হিন্দু অভিজাতদের সমর্থন পেয়েছিলেন ।

হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মোগল অভিজাতদের অনেক সদস্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ছিলেন চৌকষ বাজি। কবি চন্দর ভান ব্রাহ্মণের মতো মোগল দরবারের অন্যান্য হিন্দু সদস্যের কাছে আওরঙ্গজেবের বিজয় ছিল গ্রহণযোগ্য ঘটনা, কারণ এতে মোগল রাষ্ট্রের মূলনীতি বদলায়নি ।

প্রত্যাশা মতো, আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের সূচনায় মোগল প্রশাসনে হিন্দুদের অংশে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবরের আমলে সব মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দুরা ছিল ২২.৫ ভাগ। শাহ জাহানের আমলে ও আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম ২১ বছর শাসনকালে (১৬৫৮-৭৯) তা ২১.৬ ভাগেই থাকে। তবে ১৬৭৯ থেকে ১৭০৭ সময়কালে আওরঙ্গজেব মোগলদের অভিজাত পর্যায়ে হিন্দু অংশগ্রহণ বাড়িয়ে প্রায় ৫০ ভাগ করেন। মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দু বাড়ে ৩১.৬ ভাগ । দাক্ষিণাত্যজুড়ে সম্প্রসারণশীল মোগল সার্বভৌমত্বের কৌশলগত বিষয় হিসেবে এই নাটকীয় বৃদ্ধি মারাঠাদের ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহকে ফুটিয়ে তুলেছে।

সংখ্যা ছাড়াও রাজা রঘুনাথের কাহিনীর মতো স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মূল্যবান হিন্দু অভিজাতদের কথা ধরে রেখেছে।

রাজা রঘুনাথ মাত্র পাঁচ বছর সম্রাটের সেবা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। শাহ জাহানের আমলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে রাজকীয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রঘুনাথ। সমুগড়ে দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব পর্যুদস্থ করার পর একদল প্রশাসকের সাথে রঘুনাথও আওরঙ্গজেবের আনুগত্য স্বীকার করেন। রঘুনাথকে আওরঙ্গজেব তার দিওয়ান (সাম্রাজ্যের মুখ্য অর্থমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োগ করেন। এই উচ্চ মর্যাদা এক শ’ বছর আগে সম্রাট আকবরের মুখ্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে টোডর মলকে নিয়োগ করার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আওরঙ্গজেব তার দ্বিতীয় অভিষেকের সময় তার হিন্দু দিওয়ানকে রাজা পদবি প্রদান করেন, মনসব আড়াই হাজার করার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হয়। তারপর থেকে রঘুনাথ দক্ষ হাতে সাম্রাজ্যের কোষাগার পরিচালনা করেন ।

কয়েক বছরের মধ্যে দরবারে রঘুনাথের প্রভাব এমনকি তার দফতরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার তাকে সাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত উজিড় হিসেবে অভিহিত করেছেন। চন্দর ভান এই মূল্যায়নের সাথে একমত পোষণ করেছেন, প্রশংসা করে রঘুনাথকে ‘হিন্দুস্তানের জ্ঞানী লোকবিষয়ক গ্রন্থের প্রচ্ছদপট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রঘুনাথের জীবনের অবসান ঘটে ১৬৬৩ সালে। তিনি তখন মোগলদের প্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র কাশ্মিরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছিলেন আওরঙ্গজেবের সঙ্গী হয়ে । অবশ্য আওরঙ্গজেব তার প্রিয় হিন্দু দিওয়ানকে ভোলেননি ।

এমনকি কয়েক দশক পর বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর সময়ও আওরঙ্গজেব তার কথা মনে করেছেন, তার প্রথম অর্থ কর্মকর্তার প্রতি স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ করেছেন । শেষ বয়সে অন্যান্য প্রশাসকের কাছে লিখা চিঠিতে দক্ষ সরকার পরিচালনায় রঘুনাথের উপদেশমালার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উজিড় আসাদ খানকে লেখা চিঠিতে রঘুনাথের প্রাজ্ঞ বাণী উল্লেখ করেছেন আওরঙ্গজেব : সরকারি কাজের দায়িত্ব কোনো লোভী লোকের কাছে নয়, বরং খুবই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও কর্মদক্ষ লোকের ওপর ন্যস্ত করা উচিত।’ মৃত্যুর ৪০ বছর পরও রঘুনাথ তার পৃষ্ঠপোষকের মনে বিশাল আকারে বিরাজ করছিলেন, এবং তা কেবল আর্থিক বিষয়েই নয়, বরং সাধারণভাবে মোগল রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও। মোগল সাম্রাজ্যের মহান কর্মকর্তা হিসেবে সজীব স্মৃতির কাছে রঘুনাথের ধর্মীয় পরিচিতি আওরঙ্গজেবের কাছে ছিল অপ্রাসঙ্গিক ।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের দ্বিতীয় অংশে প্রতিরোধের মুখেও অনেক বেশি হারে রাজকীয় আমলাতন্ত্রে হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ১৬৭৯-১৭০৭ সময়কালের মধ্যে মোগল কর্মকর্তাদের মধ্যে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব অর্ধেক বেড়ে গিয়েছিল। হিন্দু অভিজাতের এই বৃদ্ধি নিয়ে অনেক কর্মকর্তা আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে ভীমসেন সাক্সেনার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হিন্দু সৈনিক কয়েক দশক আওরঙ্গজেবের অধীনে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি ফারসিতে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, ‘ওই সময়ের রেওয়াজ ছিল যে [পদোন্নতির জন্য] হিন্দুদের নাম কখনো সুপারিশ করা হতো না।’ খুবই সম্ভব যে মারাঠাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অভিজাতদের মধ্যকার নির্দিষ্ট কিছু গ্রুপ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। ওই পর্যায়ে মোগল অভিজাতদের মধ্যে মারাঠারা রাজপুতদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর ফলেই হিন্দু কর্মকর্তাদের হ্রাস করার (যদি ব্যর্থও হয়ে থাকে) চেষ্টা হয়েছিল ।

পরের দিকেও আওরঙ্গজেব জোরালোভাবে বলে যাচ্ছিলেন যে মোগল চাকরির জন্য ধর্মীয় লিটমাস টেস্টের প্রয়োজন নেই। একবার বুখারা থেকে আগত এক মুসলিম (তিনি ১৬৮০-এর দশকের শেষ দিকে মোগল চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন) এই যুক্তিতে ইরানিদের রাজকীয় চাকরিতে পদোন্নতি দেওয়া বন্ধ করতে সম্রাটের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে তারা সুন্নি নয়, শিয়া। আওরঙ্গজেব এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অভিমত প্রকাশ করেন যে “দুনিয়াদারির বিষয়ের সাথে ধর্মের সম্পর্ক কী? গোঁড়ামি দিয়ে প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করার যুক্তি কী আছে? ‘কারণ তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমারটি।’ এই শাসন [তোমার প্রস্তাবিত] যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে আমার কর্তব্য হবে সব (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুসারীদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করা। বিজ্ঞ লোকেরা সক্ষম কর্মকর্তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ নাকচ করে।”

শিবাজি ও আওরঙ্গজেব

দিল্লি থেকে সুবেদারগিরি করাটা পতিতাকে প্রলুব্ধ করার মতো । তার সৌন্দর্য দেখে, কে না তাকে কামনা না করে থাকতে পারে?
তার ছলাকলা তো বিশ্ব জয় করার ।
সে যার পানেই তাকাবে, তাকে সে সাথে সাথে কর্পদহীন করে ফেলবে।
ভুষণ বলে, তার সাহচর্যে সময় ব্যয় করায় কোনোই লাভ নেই ।
-–ভূষণ ত্রিপাঠী, হিন্দু কবি, তিনি কাজ করতেন শিবাজির সাথে, ১৬৭৩

আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার বিরোধিতা করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন শিবাজি ভোঁসলে। মারাঠা যোদ্ধা শিবাজি শেষ পর্যন্ত নিজের শক্তিতে রাজা হয়েছিলেন। মোগল সম্রাট কয়েক দশক ধরে সাম্রাজ্যের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে শিবাজির ধ্বংস সৃষ্টিকারী হামলা দমন করার, অনেকটাই অসফলভাবে, চেষ্টা করেছিলেন ।

আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণের আগে থেকেই শিবাজি ছিলেন একটি কাঁটা। শিবাজি ১৬৫০-এর দশকটি ব্যয় করেছিলেন পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকায় (আধুনিক কালের পুনের কাছে) একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠায়। তিনি প্রথম সরাসরি আওরঙ্গজেবের বিরোধিতা করেন ১৬৫৭ সালে। এ সময় শাহ জাহানের নির্দেশে যুবরাজ আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু মোগল সিংহাসন লাভের লড়াইয়ের জন্য আওরঙ্গজেব যখন মধ্য ভারতে চলে গেলেন, তখন শিবাজি তার এলাকা বাড়ানোর সুযোগটি গ্রহণ করেছিলেন।

শিবাজি ১৬৬০-এর দশকে ছিলেন ১০ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্যের অধিকারী। তিনি তার বাহিনীকে হয়ে মোগল লক্ষ্যবস্তুগুলোতে মোতায়েন করলেন। শিবাজি ছিলেন গেরিলা যুদ্ধ ও হামলায় পারদর্শী। ক্ষিপ্র অভিযানে বিপুলাকার মোগল সেনাবাহিনীর তুলনায় তার বাহিনী ছিল দক্ষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে ১৬৬৩ সালের এপ্রিলে তিনি মাত্র কয়েক ডজন লোক নিয়ে আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানের বাড়িতে প্রবেশ করে তার কয়েকজন স্ত্রী ও তার ছেলেকে হত্যা করেন। ১৬৬৪ সালের জানুয়ারিতে সুরাত হামলা করেন শিবাজি। এটি ছিল পশ্চিম উপকূলের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। এর জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ। শিবাজি কয়েক দিন ধরে নগরীতে লুটপাট চালান। এ সময় মোগল গভর্নর ভয়ে কাছের এক দুর্গে লুকিয়ে ছিলেন ।

এ ধরনের বিপর্যয় অসহ্যকর মনে হওয়ায় ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার লঙ্ঘনের কারণে ১৬৬৫ সালের প্রথম দিকে শিবজিকে পাকড়াও করার জন্য মির্জা রাজা জয় সিংকে নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব। জয় সিং ছিলেন কাজওয়াহা রাজপুত ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যে কয়েকজন রাজপুত উত্তরাধিকার লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। জয় সিংয়ের দুই মাস ধরে পুরান্দার পাহাড়ের দুর্গ অবরোধের পর শিবাজি আত্মসমর্পণ করেন। তিনি মোগল রাষ্ট্রের জায়গিরদার হয়ে জমি, দুর্গ সমর্পণ করতে, খাজনা দিতে, মোগলদের জন্য যুদ্ধ করতে রাজি হন। শিবাজি যখন বশ্যতাস্বীকার ও সহযোগিতা করতে সম্মতি প্রদর্শন করছিলেন, আসলে তখনই মোগলদের প্রতি তার বিরোধিতা সবেমাত্র শুরু হয়।

শিবাজি ১৬৬৬ সালের মে মাসে সাক্ষাত করতে আগ্রায় আওরঙ্গজেবের দরবারে যান। সম্প্রতি তিনি শত্রু থেকে অভিজাতে পরিণত হয়েছিলেন। প্রত্যাশা মতোই তিনি মোগল সম্রাটকে নজরানা দেন, আনুগত্যসূচক নতজানুও হন । কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়। দুজনের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাতের এটিই একমাত্র লিখিত ঘটনা। তবে তখন কী ঘটেছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা যায়। তবে বেশির ভাগের অভিমত হলো, কিছুটা কল্পিত উপেক্ষায় শিবাজি কষ্ট পেয়েছিলেন। সেটা হতে পারে সম্রাট তার গুরুত্ব স্বীকার না করায় কিংবা তাকে নিম্ন মর্যাদার অভিজাতদের মধ্যে দাঁড়াতে বলায়। এর ফলে প্রকাশ্য দরবারেই বিরোধ দেখা দেয়। কাফি খান নামের এক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, শিবাজি ‘আহত পশুর মতো’ চিৎকার করতে করতে ভূমিতে পতিত হলেন। আরেক ইতিহাসবিদ ভীমসেন স্যাক্সেনা বলেছেন, তিনি ‘অর্থহীন প্রলাপ বকছিলেন, ফালতু জিনিস নিয়ে কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন তিনি পাগলামিতে আক্রান্ত হয়েছেন।’ সৌজন্যবিধিতে এ ধরনের লঙ্ঘন বরদাস্ত করেননি আওরঙ্গজেব। ফলে শিবাজিকে পাহারায় দরবার থেকে বাইরে নিয়ে গৃহবন্দী করা হয়।

শিবাজি তার ক্রোধপ্রকাশের অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আগ্রা থেকে তার ৯ বছরের ছেলে শম্ভুজিকে নিয়ে পালিয়ে যান। খুব সম্ভবত, বের হওয়ার জন্য প্রহরীদের ঘুষ দিয়েছিলেন শিবাজি। তবে কাল্পনিক অনেক কাহিনীতে বলা হয় যে ব্রাহ্মণদের দান করার জন্য আনা বিশাল বিশাল ঝুড়িতে করে পালিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি। মোগল ভূখণ্ড থেকে বের হওয়ার আগে পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীর বেশ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এক ইতিহাসবিদ বলেছেন, তার ছেলেও একই পোশাক গ্রহণ করেছিলেন। তবে একটি বর্ণনায় দেখা যায়, ভ্রমণের সময় যাতে তাকে চেনা না যায়, সেজন্য তিনি ব্রাহ্মণের স্ত্রীর ছদ্মবেশ গ্রহণ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে সমর্পণ করা দুর্গগুলো পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শিবাজি ১৬৬৯ সালে নতুন করে হামলা চালানোর মাধ্যমে মোগল কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কথা ঘোষণা করেন ।

শিবাজির সাথে সম্পর্ক যে কারণেই নষ্ট হয়ে থাকুক না কেন, মোদ্দা কথা হলো, আওরঙ্গজেব তাকে মোগল পতাকার নিচে সামিল করতে পারেননি। আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যর্থতাকে ধাঁধা মনে হতে পারে। কারণ, রাজপুতেরা কয়েক প্রজন্ম ধরেই মোগল আভিজাত্যে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিচ্ছিল। অবশ্য, এই উদাহরণ সব হিন্দু সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যগুলো দেখতে তথা আওরঙ্গজেবের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনায় শিবাজি কেন বেঁকে বসলেন, তার ব্যাখ্যা করতে বাধা দেয়। ওই সময়ের অনেক রাজপুত শিবাজিকে মনে করত অসভ্য ভুঁইফোড়, মোগল পরিভাষায় যার আদবে ঘাটিত ছিল। বস্তুত বেশির ভাগ রাজপুতের তুলনায় ফারসি দরবারি আদব কায়দায় পিছিয়ে ছিলেন শিবাজি। তার বাবা বিজাপুরের আদিল শাহি রাজবংশের অভিজাত হলেও তিনি শৈশব কাটিয়েছিলেন তার মা জিজাবাইয়ের কাছে। সেখানে দরবারি জীবন ছিল অনুপস্থিত। সম্ভবত এই অবস্থার কারণে (এ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তার দক্ষতাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে না) শিবাজির পক্ষে মোগল অভিজাত হিসেবে তার ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারেননি, যেমনটা পেরেছিলেন অনেক রাজপুত। শিবাজি বরং আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রেই অবতীর্ণ হওয়াকেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন ।

শিবাজির বিদ্রোহে প্রত্যাবর্তন মোগলদের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল। ১৬৭০ থেকে শিবাজি সুরাত ও অন্যান্য স্থান বারবার লুটপাট করেন। পরের চার বছর তিনি মহারাষ্ট্রে খানদেশ, বেরার ও বেগলানের মতো মোগল ঘাঁটিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন, মোগল ও বিজাপুরি উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই সময়ে আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম পাবর্ত্য এলাকায় পাঠান গোত্রগুলোর বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ছিলেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৭৪ সালের জুনে ব্যক্তিগতভাবে যখন খাইবার পাসের কাছে পার্বত্য এলাকায় আফ্রিদি গোত্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন শিবাজি নিজেকে রাজা তথা ছত্রপতি ঘোষণা করেন। তার এই স্বাধীন মারাঠা রাজ্য ওয়েস্টার্ন ঘাট ও কোনকান উপকূলের অংশবিশেষজুড়ে বিস্তৃত ছিল। শিবাজি পরের ছয় বছর ব্যয় করেন মারাঠা এলাকা সম্প্রসারণে । তিনি সংস্কৃতভিত্তিক রাজনৈতিক রীতিনীতির মাধ্যমে ইন্দো-ফারসি আদব কায়দার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৭৭ সালে তিনি রাজাবিবাহারকোষ (রাজকীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শব্দকোষ) নামে পরিচিত একটি সংস্কৃত গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে ১৫০০ ইন্দো-ফারসি প্রশাসনিক পরিভাষার সংস্কৃত প্রতিশব্দ স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের গ্রন্থ গবেষণাসুলভ মনে হলেও এটি মোগল শাসক সংস্কৃতি দমনে তার প্রয়াস সফল করতে সহায়ক হয়েছিল। শিবাজির শাসনকালের শেষ দিকে মারাঠা সরকারি নথিপত্রে সংস্কৃত পরিভাষা ব্যাপকভাবে বেড়ে ছিল ।

শিবাজি ১৬৭৮ সাল থেকে একের পর এক রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন । দুই বছর পর ১৬৮০ সালে তিনি বিছানায় পরলোকগমন করেন। শিবাজির মৃত্যু নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত রয়েছে। এর একটি হলো তার দ্বিতীয় স্ত্রী সূর্যবাই তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন শম্ভুজির বদলে তার ১০ বছর বয়স্ক ছেলে রাজারামকে সিংহাসনে বসানোর জন্য। শম্ভুজি ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। বিষ প্রয়োগের কাহিনী সম্ভবত সত্য নয়। তবে রাজারাম ও শম্ভুজির মধ্যে সংক্ষিপ্ত উত্তরাধিকার লড়াই হয়েছিল। এতে শম্ভুজি জয়ী হয়ে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের বিরুদ্ধে উৎপাত অব্যাহত রেখেছিলেন ।

শিবাজি ও আওরঙ্গজেব যদিও মাত্র একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন (১৬৬৬ সালে দরবারে) তারা একে অপরকে তাচ্ছিল্য করতেন। শিবজির অন্যতম রাজকবি ভূষণ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে কুম্ভকর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রামায়ণে এই নামে একটি বিপুলাকায়, অতিভোজী দানব চরিত্র আছে। আওরঙ্গজেব ‘পার্বত্য মুষিক’ বলতেন শিবাজিকে। মোগল সূত্রগুলো গালিগালাজ করে তাকে বলত শিব, সম্মানসূচক জি কখনো যোগ করা হতো না। আওরঙ্গজেবের আমলের অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের এক ইতিহাসবিদ শিবাজির মৃত্যুর তারিখটি লিপিবদ্ধ করেছেন বেশ রূঢ়ভাবে : ‘কাফিরটি দোজখে গেল।’ (কাফির বিজাহান্নাম রাফত)।

মোগল-মারাঠা সঙ্ঘাত দানা বেঁধেছিল কৌশলগত, পরিবর্তনশীল মিত্ৰতা দাবিকারি পাশবিক শক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে । শিবাজি বিজাপুর, গোলকোন্ডা এবং প্রয়োজনীয় সময়ে মোগলসহ (অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে) অনেক ইসলামি রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করেছেন। শিবাজি তার সেনাবাহিনীতে মুসলিমদের স্বাগত জানাতেন; তার বেতনভুক কাজি (মুসলিম বিচারক) ছিল, তার শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মুসলিম। মোগল মিত্রতা ও রাজকীয় বাহিনীও ছিল বৈচিত্র্যময়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পুরান্দারে শিবাজিকে অবরোধ করার জন্য আওরঙ্গজেব পাঠিয়েছিলেন জয় সিং নামের এক হিন্দুকে। রাজপুত ও মোগল শাসনের বিরোধিতাকারী মারাঠারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধকারী ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় দানের আধুনিক ধারণাটি নিছকই আধুনিক কালের। মোগল বা মারাঠা কোনো পক্ষের লেখকেরাই (বিশেষ করে মারাঠারা) এই সঙ্ঘাতকে ধর্মীয় যুদ্ধের আবহে আখ্যায়িত করতে কোনোভাবেই কুণ্ঠিত ছিলেন না। তবে বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার তৃষ্ণা থেকেই আওরঙ্গজেবের শাসনের বিরোধিতা ও মোগল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *