হিন্দুরাষ্ট্র ও বিজেপি
বিগত নির্বাচন-সাফল্যে সঙ্ঘপরিবারে যে-অংশটি প্রাধান্য পেয়েছে, সেটি হল ভারতীয় জনতা পার্টি। এদের উদ্ভবের বহু পূর্বে ১৯২০ সালে হিন্দু মহাসভা, পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (১৯২৫) দল বাঁধে। এই শেষোক্ত দলটিই বিজেপির রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করত। ইদানীং লতায়-পাতায় আরও কয়েকটি সংগঠন এদের সহচারী; তার মধ্যে প্রধান বিশ্ব হিন্দু-পরিষদ, শিবসেনা ও বজরং দল। রাজনীতি ক্ষেত্রে বিজেপি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চারটি রাজ্যে এরা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং আগামীদিনে অন্য রাজ্যেও এদের ক্ষমতা বাড়বার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
বিশের দশকে নিপীড়িত নিম্নবর্গের মানুষের স্বীকৃতি ও মর্যাদা আদায় করতে যখন আম্বেদকরের অভ্যুত্থান ঘটে ও বিস্তার লাভ করতে থাকে তখন তাকে ঠেকাবার চেষ্টাতেই সৃষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। জন্মক্ষণ থেকে এ সংস্থাটি বর্ণ হিন্দুর মুখপাত্র, মানবতাবিরোধী। বিজেপি এবং সমগ্র সঙ্ঘ পরিবারের উচ্চারিত নীতি হল: হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনা; বলাই বাহুল্য, সর্বভারতীয় পরিসরেই। অতএব হিন্দুরাষ্ট্র সম্বন্ধে এরা কী বলে সেটা প্রথমে প্রণিধান করে দেখা দরকার। ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ইশতেহারে পড়ি, ‘আমাদের জাতীয় দৃষ্টি ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক সত্তা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, এর সংজ্ঞা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের দ্বারা নির্ণীত। এই প্রত্যয় থেকেই আমাদের ‘সংস্কৃতির জাতীয়ত্বে’ বিশ্বাস প্রবাহিত হয়, এইটিই হিন্দুত্বের কেন্দ্রবস্তু। আমরা বিশ্বাস করি, এটিই আমাদের প্রাচীন জাতীয় সত্তা। …হিন্দুত্বই সেই একমাত্র সংযোগসূত্র যা আমাদের জাতির ঐক্য এবং সংহতি রক্ষা করতে পারে… হিন্দুত্ব কোনও একটি অংশের অন্য অংশের স্বার্থের মূল্যে সুবিধা ভোগ করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টার প্রতিষেধকও বটে।’ (পৃ. ১৫) প্রসঙ্গত ধর্মীয় সম্প্রদায় অর্থে ‘হিন্দু’ নামটি প্রথম পাওয়া যায় ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের দ্বিতীয় কৃষ্ণদেব রায়ের ‘সত্যমঙ্গল’ তাম্রপট্টে। সেখানে পড়ি, ‘পররাজ্যভয়ংকরঃ হিন্দুরায়-সুরতানো বন্দিবর্গেণ বর্ণতে’ অর্থাৎ, ‘বন্দীরা হিন্দুরাজ সুলতানকে শত্রুরাজ্যের পক্ষে ভয়ংকর বলে বর্ণনা করে।’ [এপিগ্রাফিয়া ইণ্ডিকা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৬] অর্থাৎ, ‘হিন্দু’ নামে হিন্দু ভারতবর্ষে প্রথম দেখা দিল খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে, ব্রাহ্মণ্যধর্মকে যজ্ঞাশ্রয়ী ধর্মরূপে বিজয়নগর যখন প্রতিষ্ঠা করছে, তখন। পাশেই মুসলমান বাহমনি রাজ্য, তাই শত্রু রাজ্য অর্থটা গৌণ থাকে না। মজা হচ্ছে, হিন্দুরাজার গৌরববর্ধন করছে, ‘সুরতান’ অর্থাৎ ‘সুলতান’ শব্দটি। ‘যে যাই বলুন ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনের মূলধারা মানে হিন্দু ধারা।’ (ইশতেহার পৃ. ২৩) ‘অর্ধশিক্ষিত কলমবাজদের বলা বৃথা যে কোনও গোঁড়া ব্রাহ্মণ কোনও দিন ‘হিন্দু’ নামে গর্ববোধ করেনি।… হিন্দু আসলে নিপীড়িত ও নির্যাতিতের নাম।’ (ঐ পৃ. ৪২) গোঁড়া ব্রাহ্মণ বহুজনকেই গর্ব করে হিন্দু পরিচয় দিতে বহুবার সব রাজ্যেই দেখা গেছে, কাজেই ওই উক্তিটি সত্যের অপলাপ। আর সঙ্ঘ পরিবারের বর্তমান প্রতাপের যুগে ‘হিন্দু’ যদি নিপীড়িত, নির্যাতিতের নাম হয় তো মুসলমানের কী নাম? ‘ন্যূনতম লক্ষণের হিন্দুরাষ্ট্র হচ্ছে হিন্দুরক্ষার রাষ্ট্র।’ (সংবিধানের ২৫–৩০ ধারা সম্বন্ধে) ‘প্রত্যেকটি ধারাই বিগত ৪০ বছর ধরে হিন্দুঘাতী ধারা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রত্যেকটি ধারার অবলুপ্তি ঘটিয়ে এমন একটি ধারা বসানোর দরকার আছে যে, ভারতরাষ্ট্রে আপন আপন ধর্ম পালন করতে পারবে সব ধর্মের লোকই, কিন্তু রাষ্ট্রিক সুরক্ষার ফলভোগ করবে শুধু হিন্দরাই।… রঙরুটি ধর্মগুলির রঙরুটের ব্যবসা ঐ রাষ্ট্র নিবারণ করবে।’ (ঐ ৪৩-৪৪) যে রাষ্ট্রে অহিন্দু রাষ্ট্রিক সুরক্ষা পায় না সেখানে তার অবস্থা সহজেই কল্পনীয়। আপন আপন ধর্ম পালন করতে গেলে হিন্দুর কাছে তার আচরণ অপ্রিয় বোধ হলে সুরক্ষা সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পাবে না; কোনও সংঘাত ঘটলে সংখ্যাগুরু হিন্দুরই শুধু অধিকার থাকবে সুরক্ষায়। সংখ্যালঘু মানুষেরা নির্যাতিত নিপীড়িত হবে ঘোষিত এই হিন্দুরাষ্ট্র নীতি অনুসারেই।
‘হিন্দুর নামে যে রাজনীতি করে তাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ বলে মানি। কারণ হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক নয়।’ (মসজিদ ধ্বংস প্রসঙ্গে) ‘ওগুলির ধ্বংস কেবলমাত্র হিন্দুমন্দির ধ্বংসের প্রতিশোধেই ঘটে। হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কখনোই মসজিদ ধ্বংস করে না। কিছু বালক কেমন ফূর্তি করার জন্যে মসজিদ ভাঙে। …কোনো নিরপরাধ লোকই মরেনি। যারা মরেছে তারা সকলেই অপরাধী।’ (স্বামী মুক্তানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বামীজির উক্তি) মেনস্ট্রিম ৩০ অক্টোবর, ১৯৯৩) লক্ষণীয়, এ সাক্ষাৎকার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সওয়া এক বৎসর পরের, তখনও সঙ্ঘপরিবারের এই মুখপাত্র অম্লানবদনে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে সঙ্ঘবদ্ধ হিন্দুশক্তির এই পৈশাচিক কার্যটিকে ‘কিছু বালকের ফূর্তির জন্যে ভাঙা’ বলছে, কারণ ‘হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক নয়’! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। লখনউ ধর্মসভার গৃহীত প্রস্তাব ছিল, ‘যখনই হিন্দুসম্প্রদায়ের শক্তির প্রকাশের সম্মুখীন হয়, সরকার শুধু তখনই কথা শোনে।’ অর্থাৎ সরকারকে হিন্দু সম্প্রদায় শক্তির প্রকাশের দ্বারা পরাভূত করেছে এবং করবে (এ হল তাদের নিজেদের ঘোষিত নীতি)। জি সি পান্ধেরি পাণ্ডে একটি প্রচার পুস্তিকায় বলেন, ‘হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বহু প্রাচীনকাল থেকে এ দেশ হিন্দুস্থান বলে পরিচিত। আমাদের সংবিধানে এর নাম ইণ্ডিয়া অর্থাৎ ভারত’ এটিও একমাত্র আমাদের দেশেরই প্রাচীন সংজ্ঞা। বিশ্ব হিন্দু-পরিষদের কর্মসচিব শ্রীওঙ্কার ভাবে বলেন, ‘হিন্দুত্ব ও ভারত অবিচ্ছেদ্য।’ গোরক্ষপুরের মোহন্ত অবৈদনাথ বলেন, ‘অখণ্ড ভারতের দাবি ক্রমেই বাড়ছে। বলা বাহুল্য, এ ভারতে মুসলমানের স্থান নেই। বম্বের দাঙ্গার কয়েক মাসের মধ্যেই বাল ঠাকরে ওই দাঙ্গা শিবসেনার কৃতিত্ব বলে স্বীকার করে। হিন্দুরাষ্ট্র সম্বন্ধে ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তি যে সহিষ্ণুতা দেখিয়েছে তার ফলে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের গলার সুর ক্রমশ চড়ছে। এই জাতীয় সহিষ্ণুতা হয়তো গণতন্ত্রে আবশ্যক, কিন্তু কখনও কখনও সেটা গণতন্ত্রের পক্ষেও আত্মঘাতী হয়ে ওঠে।’ নাৎসি অভ্যুত্থান সম্বন্ধে পড়ি, ‘যখন ভবিষ্যৎ (নাৎসি) নেতারা তাদের আন্দোলন শুরু করে, তখন যদি গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা প্রত্যাহার করা হত, তাহলে মানবজাতি আউউইৎস এবং একটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা পেত।’ (আর পি উলফ; বি মূল ও এইচ মার্কুজা সম্পাদিত ‘অ ক্রিটিক অব পিওর টলারেন্স’)। ১৯৪৯-এর জুলাইয়ে দক্ষিণপন্থীদের ওপরে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। স্নায়ু চিকিৎসার একটি শান্ত প্রতিষ্ঠানে লোকচক্ষুর অন্তরালে তখনই প্যাটেল-গোলওয়লকরের পরে শরদ পাওয়ার ও বাল ঠাকরের একটি আঁতাত তৈরি হয়; ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাসে এই বিষবৃক্ষটি ফলধারণ করতে শুরু করে। মাত্র একজন বিচারকের ট্রাইব্যুনালে দিল্লি হাইকোর্ট রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও বজরংদলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। একই সময়ে অনুরূপ একটি ট্রাইব্যুনাল মৌলবাদী মুসলিম প্রতিষ্ঠানের (আইএসএস) ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এঁদেরই একজন ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করাতে বিজেপির অধিকার সমর্থন করেন। এই সব সহিষ্ণু কর্মসূচির ফল সুদূরপ্রসারী হয়; সাধারণ দেশবাসী, যারা মৌলবাদী নয়, এবং রাষ্ট্রনীতির সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে উদাসীন, তাদেরও একদিন আগ্রাসী মৌলবাদের শিকার হতে হয়। কারণ যথাকালে মৌলবাদী সংস্থাগুলির যথেচ্ছ আচরণের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। রাষ্ট্রনীতির কর্ণধারদের এ বিষয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
গোলওয়লকরের ‘আ বাঞ্চ অব থটস’-এর ভূমিকায় দেখি ‘ভারতীয় অথবা হিন্দু’ (পৃ. ২৮) বেদান্তে বিশ্বাসের প্রসঙ্গে— ‘সমস্ত দল, যারা এই দৃষ্টি এবং নিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করে তারা সমান ভাবে দেশবাসী হতে পারবে, অন্য কেউ নয়।’ (ভূমিকা পৃ. ৩০) ‘একমাত্র হিন্দুদের এই মহৎ বিশ্ব-ঐক্য-সাধনী চিন্তাই মানবজাতির সৌভ্রাত্রের বন্ধন হয়ে উঠতে পারে। … এটি একটি দিব্য প্রত্যাদেশ… নিয়তি একমাত্র হিন্দুদের ওপরেই এটি অর্পণ করেছে।’ (পৃ. ৭) ‘আমরা আমাদের সুচিরকালীন সমস্ত প্রিয় আদর্শগুলির বর্ণচ্ছটার কেন্দ্র হবার আশা রাখি, সূর্য থেকে যেমন অবর্ণনীয় শক্তিরশ্মি স্ফুরিত হয়।’(পৃ. ৭৪) ‘আমরা যেন ভারতমাতাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে স্থির থাকি।’ (পৃ. ৭৫) এখানে লক্ষণীয়, শব্দটি হল ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’, প্রশ্ন হল, ভারতবর্ষ কবে পৃথিবীর সংস্কৃতিকে পথ দেখাল? বিশ্ব-সংস্কৃতি বলে কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে কি? থাকলেও ভারতবর্ষের কোনও স্বীকৃত ভূমিকা সেখানে কোন অতীতে ছিল যে, বিজেপি তাকে সেই আসনে ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ করার স্বপ্ন দেখে? ইতিহাসকে অনুসরণ করা যায় মাত্র, কল্পনায় তাকে নির্মাণ করা যায় না। এ চেষ্টা ইচ্ছাপূরক মাত্র।
‘এইটিই (ভারতবর্ষ) ভগবদ উপলব্ধির জন্যে পূর্বনির্বাচিত ভূমি।’ (পৃ. ৮৪) ‘মহম্মদ কোনোদিন ঈশ্বরকে মুখোমুখি দেখেননি।’, ‘এই ভূখণ্ডের মহান সন্তানদেরই এই সৌভাগ্য যে, তারা ভগবানকে তাঁর পূর্ণ উজ্জ্বল মহিমায় প্রত্যক্ষ করবে।’ (পৃ. ৮৫) প্রথমত, মুখোমুখি ঈশ্বরকে দেখার দাবি না করার মধ্যে যে একটি আত্মিক নম্রতা আছে, তা গ্রন্থকারের গোচরেই এল না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, ভগবান বলে কেউ আছেন, তা হলে একমাত্র ভারতীয় হিন্দুই তার পূর্ণ উজ্জ্বল মহিমা প্রত্যক্ষ করলে ভগবান তো পক্ষপাতদুষ্ট হতেন। তৃতীয়ত, ‘বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্’ (সেই মহান পুরুষকে জেনেছি) ধরনের কথা যেমন প্রাচীন শাস্ত্রে ইতস্তত আছে, তেমনই ‘আরামমস্য পশ্যতি ন তং পশ্যতি কশ্চন’ (লোকে তাঁর লীলাই দেখে, তাঁকে কেউ দেখে না)। অথবা ঋগ্বেদের সেই বিখ্যাত ‘কো দদশ’ ‘কো বেদ’ (কে দেখেছে, কে জেনেছে) ইত্যাদি বিস্তর শাস্ত্রবাক্য আছে যার প্রতিপাদ্য হল: কেউ সেই ‘পরমপুরুষ’কে জানেনি, দেখেনি। কাজেই দু’-একটি ইতিবাচক শাস্ত্রোক্তির বিরুদ্ধে যেখানে বিস্তর নেতিবাচক উক্তি আছে সেখানে ওই চেষ্টা টেকে না। তা ছাড়া ভগবানকে কে সাক্ষাৎ ভাবে দেখল আর দেখল না এর ওপরে কোনও রাষ্ট্রের গৌরব নির্ভর করতে পারে না। বিশেষত, এখানে এই হত-দরিদ্রের দেশে, যেখানে দেশবাসীর বিরাট একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। মনে পড়ে গান্ধীজির সেই অমর উক্তি: ‘ক্ষুধার্তের সামনে স্বয়ং ঈশ্বরও খাদ্য ছাড়া অন্য রূপে আসতে সাহস করেন না’ (Before the hungry even God dares not come except in the shape of bread)। এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর অন্নবস্ত্র সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ভগবদ্দর্শনের দিকটা স্থগিত রাখাই দেশপ্রেমিকের কর্তব্য। ধর্মের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বেষহিংসা ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ বাড়ছে। কারণ, সাধারণ মানুষের জীবন পার্থিব সমস্যায় জর্জরিত, সদর রাস্তায় অভাব না মেটার ফলে খিড়কির রাস্তায় গিয়ে তারা ধীরে ধীরে অসামাজিক দুষ্কৃতকারীতে পরিণত হচ্ছে। এ পরিণতি ঠেকাবার জন্যে ভগবদ্দর্শন কোনও সম্ভাব্য প্রতিকারই নয়, এবং যারা সেই দাবিতে হিন্দুরাষ্ট্রের গৌরব ঘোষণা করছে, দেশের বাস্তব থেকে বহু দূরে তাদের অবস্থান।
‘আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় মানেই হল হিন্দু’, ‘ভারতের ইতিহাস হল একটি দীর্ঘায়ত হিন্দু যুগ।’ (ঐ পৃ. ১৩৭, ১৪০) এ সব কথার সুর হল ফতোয়া দেওয়ার সুর। যুক্তি, তথ্য, ইতিহাস এ সব কিছুরই প্রয়োজন হল না, একে একে বজ্রনির্ঘোষে প্রচার করা হল আপ্তবাক্য। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে যাচাই যে করতে যাবে, তাকে তৎক্ষণাৎ ‘অহিন্দু অর্থাৎ অভারতীয় বলে’ চিহ্নিত করা হবে। এ সব অনুশাসন যেন স্বতঃসিদ্ধ, যেন কোনও মহামহিম সম্রাটের ঘোষণা, প্রজারা যা নিষ্প্রতিবাদে মেনে নেবে। কিন্তু মুশকিল হল, শ্রোতাদের স্বতন্ত্র বুদ্ধিবৃত্তি সক্রিয় হয়ে পদে পদে বহু বুদ্ধির ফাঁক ও যুক্তির ফাঁকি ধরে ফেলে। যদিও এরা জোর গলায় হেঁকে বলছে, আমাদের হিন্দু জাতীয়ত্ব সত্য, যুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত, তবুও আমরা দেখব ঠিক এই তিনটি জায়গাতেই সঙ্ঘপরিবারের সমস্ত প্রতিপাদ্য ফুটো এবং ঝুটো বলে প্রমাণিত হবে।
হিন্দু ভারতবাসী সম্পর্কে গোলওয়লকর বলেন, ‘এরাই মাতৃভূমির পবিত্রতা ও সংহতি রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছে। কেবলমাত্র হিন্দুই যে এ সব করেছে এই সত্যের সপক্ষে ভারতবর্ষের হাজার বছরের মুখর সাক্ষ্য রয়েছে। এর অর্থ হল, এই ভূখণ্ডের সন্তান হয়ে কেবলমাত্র হিন্দু এখানে বাস করে আসছে।’ (ঐ, পৃ. ১২৩-২৪) ঐতিহাসিক ভাবে এ কথা মিথ্যা যে, বিগত সহস্র বৎসর ধরে একমাত্র হিন্দুই ভারতবর্ষে বাস করেছে; এই কালসীমার মধ্যে মুসলমান, বৌদ্ধ এবং পরে শিখ ও খ্রিস্টানও এ দেশে বাস করেছে। তা ছাড়া ভারতবর্ষের জনসংখ্যার বেশ বড় একটি অংশ অহিন্দু, প্রত্যন্তবর্তী আদিবাসী। জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্যে রক্ত দিয়েছে বহুতর অহিন্দুও। কিছু পরে সে প্রসঙ্গে আসব। আপাতত দেখা যাচ্ছে সত্য, যুক্তি এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। অহিন্দু ভারতবাসী সম্বন্ধে অযৌক্তিক ও উদ্ধত মন্তব্য শুনি, ‘ঐ সব বিভিন্ন (অহিন্দু) জনগোষ্ঠীকে কেমন করে ভারতভূমির সন্তান বলা যায়, কেবলমাত্র একটি আপতিক ঘটনার বলে যারা এক সাধারণ শত্রুর অধীনে একটি সাধারণ ভূখণ্ডে বাস করেছে—।’ (ঐ পৃ. ১৪২) আবার শুনি, ‘হিন্দুরাই ভারতের জাতীয় সমাজ।’ (ঐ পৃ. ১৫৭) বা ‘পবিত্র ভারতভূমিতে একমাত্র সত্য, স্থায়ী, গৌরবময় জাতীয় জীবন হিন্দুদেরই।’ (ঐ পৃ. ১৬২) আরও প্রবল উচ্চারণে, ‘যে ধর্মপ্রস্থানের, উপাসনা প্রস্থানেরই হোক না কেন, হিন্দুরা একটি সংহত সমাজ নির্মাণ করেছিল এবং মুসলমান ও খ্রিস্টানরা একটি সম্পূর্ণ বিজাতীয়, এমনকী শত্রু শিবিরের অন্তর্ভুক্ত।’ (ঐ পৃ. ২১০) মনে পড়ে, ১৯৮০ সালে যখন দিল্লিতে প্রথম বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অনুষ্ঠিত হয়, তখন সারা দিল্লি শহরে এক হাত চওড়া কাপড়ে চড়া রঙে লেখা ঘোষণা ‘সমস্ত অহিন্দুই বিজাতীয়’ (All non-Hindus are aliens)। শুধু হিন্দুই ভারতীয়, এমন একটা অযৌক্তিক, অমানবিক, অনৈতিহাসিক উক্তি শুধু গায়ের জোরে চড়া গলায় সর্বত্র বারেবারে বললেও কথাটা মিথ্যাই থেকে যায়, সত্য হয়ে ওঠে না।
মজা হচ্ছে, এরা একই সঙ্গে গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে। তাই এ বইয়েই গোলওয়লকর লেখেন, ‘গণতন্ত্রের ভাবের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যা ব্যক্তিকে বাক্য, চিন্তা ও ক্রিয়ার স্বাধীনতা দেয় তা সুপ্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যে যেমন স্বীকৃত এবং আচরিত হত এমন আর কোথাওই নয়।’ (ঐ পৃ. ৩২৪) প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি মনু, কৌটিল্য ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে যার নির্দেশ আছে তাকে হাজার চেষ্টাতেও গণতন্ত্র বলা যাবে না। তা হল বিশুদ্ধ রাজতন্ত্র। একটি রাজা কী ভাবে প্রজাপালন করবে ও ক্রমান্বয়ে চেষ্টা করে চলবে আশপাশের রাজ্যগুলিকে জয় করে সাম্রাজ্যবৃদ্ধি করবার, তারই নির্দেশ এ সব গ্রন্থে। এ রাষ্ট্রনীতি গণতন্ত্র থেকে শত যোজন দূরে। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় দণ্ডনীতি ছিল বর্ণ, জাতি অনুসারে; একই অপরাধে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের ভিন্ন ভিন্ন দণ্ডের বিধান ছিল। প্রাচীন রাষ্ট্রনীতিতে নারীর কোনও রাষ্ট্রিক বা সামাজিক অধিকার ছিল না। অন্তঃপুরের নেপথ্যেই তার স্থান ছিল। সমাজ বা রাষ্ট্র সংবিধানে সে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতই ছিল না। গণতন্ত্রে ব্যক্তির অধিকারের নীতির সঙ্গে এর আকাশপাতাল প্রভেদ। হিন্দু রাষ্ট্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব করা মাত্রই গণতন্ত্ৰ থেকে বহু দূরে সরে এল, গণতন্ত্রের কোনও সংজ্ঞাই এর সম্বন্ধে আর প্রযোজ্য রইল না।
এই হিন্দুরাষ্ট্রের বহু শত্রু, বিদেশি মুসলমান রাষ্ট্রশক্তি, অভ্যন্তরীণ মুসলমান ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং কম্যুনিজম। বহিঃশত্রু সম্বন্ধে এক জায়গায় গোলওয়লকর বলছেন (চীন, পাকিস্তান যুগপৎ ভারতকে আক্রমণ করুক)… ‘এমন একটা যুদ্ধের জন্যে আমরা সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করব… স্বাধীনতা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তির জন্যে এই মূল্যই আমাদের দিতে হবে এবং সে মূল্য যত তাড়াতাড়ি দিই ততই মঙ্গল।’ (ঐ পৃ. ৩১২)
এই গোলওয়লকর তাঁর ‘আমরা ও আমাদের জাতীয়ত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ’ (We and our Nationhood Defined, নাগপুর, ১৯৩৮) গ্রন্থে বলেছেন, ‘হিন্দুস্থানের অহিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সাংস্কৃতিক রীতি আয়ত্ত করতে হবে, হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি শিখতে হবে, হিন্দু জাতির মহিমাবর্ধন ছাড়া অন্য কোনও চিন্তাকে ঠাঁই দিতে পারবে না তারা, অর্থাৎ এই দেশ ও এখানকার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি কেবল যে তাদের অসহিষ্ণুতা ও অকৃতজ্ঞতা বর্জন করতে হবে তাই নয়, তাদের (বর্তমান মনোভাবের) পরিবর্তে প্রেম ও ভক্তি অর্জন করতে হবে। তাদের বিজাতীয় হওয়া থেকে নিরস্ত হতে হবে, অথবা এ দেশে তাদের হিন্দু জাতির সম্পূর্ণ অধীন হয়ে থাকতে হবে, কিছুই দাবি না করে, কোনও সুবিধায় যোগ্যতাবোধ বর্জন করে। পক্ষপাতপূর্ণ ব্যবহার তো নয়ই, এমনকী নাগরিক অধিকারও তারা পাবে না।’ (ঐ পৃ. ৫২) এত স্পষ্ট উচ্চারণের পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অথবা ভারতীয় জনতা পার্টি কেমন করে আশা করে যে, সুস্থ বুদ্ধির নাগরিক একাধিক প্রাচীন সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব যেখানে অস্বীকৃত হচ্ছে সেই বিকৃত, অমানবিক হিন্দুরাষ্ট্রকে সমর্থন করবে?
সঙ্ঘ পরিবার তার বিবিধ সদস্য নিয়ে ভয়াবহরূপে স্ফীত হবার একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা মুসলমান ধর্মের মতো হিন্দু ধর্মের কোনও প্রবক্তা বা প্রতিষ্ঠাতা নেই এবং চার্চ বা সঙ্ঘ বা পুরোহিত-মৌলভি-মৌলানা পরিচালিত সংগঠন নেই বা ছিল না এতদিন। এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি, বজরং দল আর শিবসেনা মিলে যা নির্মিত হচ্ছে তা হল দক্ষিণপন্থী হিন্দু মৌলবাদের একটি বহুজন-
-স্বীকৃত ধর্ম-প্রতিষ্ঠান। যার অনুজ্ঞা সব সভ্যের অবশ্য পালনীয়, যার সুনিয়িন্ত্রত, ক্রমবর্ধমান শক্তি ব্যাপক ও স্থায়ী ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠানিক হয়ে উঠল। একতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো এই হিন্দু রাষ্ট্র তার প্রজাবৃন্দের ওপরে সর্বময় কর্তৃত্ব চালাবে, বিরোধী দণ্ডিত হবে এবং একনায়কতন্ত্র জাঁকিয়ে রাজত্ব করার পথে সুনিশ্চিত পদক্ষেপে এগোচ্ছে। এই ভাবে সংগঠিত হিন্দুত্বের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ হল: বহু সংস্থার সন্ন্যাসীদের সঙ্গে এর যোগাযোগ। এই সন্ন্যাসীরা মৌলবাদের প্রবক্তা, সমর্থক। স্থানে অস্থানে প্রযোজ্য অপ্রযোজ্য শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করে এরা ফতোয়া দেয় অসহযোগী ও বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে। যেহেতু এই নবহিন্দুত্বের কোনও সংগঠিত রূপ আগে ছিল না, গত কয়েক দশকেই মাত্র ধীরে ধীরে তা নির্মিত হচ্ছে, তাই এর মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয় আপ্তবাক্যের; তখন নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মুখপাত্রের দ্বারস্থ হয় এরা এবং সন্ন্যাসীরা শাস্ত্র বাক্য এবং নিজেদের বাক্য দিয়ে এই নবহিন্দুত্বের সংকটে এদের পাশে দাঁড়ায়। ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের কাছে সন্ন্যাসী, গেরুয়া, জটা, দণ্ড, রুদ্রাক্ষ, কমণ্ডলু এ সব সুদীর্ঘকাল ধরেই একটা বিমূঢ় সম্ভ্রম ভোগ করে এসেছে। এর দ্বারা এমন একটি মোহময় পরিবেশ রচিত হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিকে সাময়িক ভাবে আচ্ছন্ন রেখে কৃত্রিম একটি জ্যোতির্বলয়ে মণ্ডিত করে সন্ন্যাসীদের। এরা তখন হয়ে ওঠে নবহিন্দুত্বের সর্বহিন্দুস্বীকৃত প্রবক্তা। খ্রিস্টান, মুসলমান, জৈন, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মের মানুষ প্রতিষ্ঠাতা ছিল, হিন্দুত্বের তা ছিল না। সন্ন্যাসী আমদানি করে অনেকাংশে এ অভাব পূরণ করবার চেষ্টা করছে এরা। তাই এই সব তর্কাতীত (?) ব্যক্তিত্ব ও তাদের বচনকে নবহিন্দুত্ব পুরোপুরি ব্যবহার করছে হিন্দুশক্তি প্রতিষ্ঠার কাজে।
প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিকল্পনা কংগ্রেসের থেকে প্রায় অভিন্ন। বৈদেশিক ব্যবসায়ের জন্যে মুক্তদ্বার নীতি সমর্থিত এখানে, ফলে ক্ষতির বহর এ রাষ্ট্রে কংগ্রেসের চেয়ে কম হবে না। জনসাধারণের মঙ্গল বিধান করার যে সব বাণী নির্বাচনী ইশতেহারে উচ্চারিত, তা কংগ্রেসের বাণীর মতোই শ্রুতিসুখকর মিথ্যা আশ্বাসে পরিণত হবে। ১৯৯৬-এর ইশতেহারে বলা আছে, ‘অর্থনীতি ক্ষেত্রে পুরনো ছকটি যাতে শ্রমিক ও মৌলিক ধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছিল, তা নতুন ছকের দ্বারা পরাভূত হচ্ছে। এই ছক মানবিক মূলধন, কৃৎ-কৌশল এবং প্রযুক্তিবিদ্যার ওপরে প্রতিষ্ঠিত।’ (ইলেকশন ম্যানিফেস্টো ১৯৯৬, পৃ. ১৭) মৌলিক শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থ লগ্নি করার নীতি বিজেপি সমর্থন করে; কিন্তু কোন হারে অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাতীয় মূলধনের সঙ্গে শতকরা কত অংশ পার্থক্য থাকবে তা বলে না; এ সম্বন্ধে একেবারেই নীরব। অর্থাৎ, কংগ্রেসের মতোই রাশি রাশি বিদেশি টাকা এনে আপাত চাকচিক্য বাড়িয়ে কিছু চোখ-ধাঁধানো বিলাসদ্রব্য তৈরি করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করাই এদের অর্থনীতির মূল কথা। এই প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের নীতির অনুসরণে দেশটাকে ধীরে ধীরে বিদেশিদের কাছে বন্ধক রেখে অবশেষে বিক্রি করে দেবার পরিকল্পনা। ব্যাপারটা এত ধীরগতিতে ঘটবে, লোকে হঠাৎ টেরই পাবে না, ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে একটা জৌলুস, যেন শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। তারই সঙ্গে মৃদু গুঞ্জনে শোনা যাবে, বৈদেশিক ঋণভার চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে। এবং এর শেষ পরিণাম কী তা ভাবলেও আতঙ্ক হয়। সব্যসাচী বাগচির ইকনমিক পার্সপেক্টিভ অ্যাণ্ড দা বিজেপি’ বইতে পড়ি, ‘লাইসেন্স, পারমিট নিয়ন্ত্রণ ও ইন্সপেক্টর রাজ উঠিয়ে দেওয়া হবে।’ (পৃ. ৫, পাদটীকা) এই অর্থনীতিতে ধনী ব্যবসায়ীর বাণিজ্যে অবাধ নিরঙ্কুশ লাভের পথ খুলে দেওয়া হবে, তা বোঝা শক্ত নয়। অভ্যন্তরীণ ধনী ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে সব বাণিজ্য-সংস্থা লাভজনক ব্যবসা করছে তাদের সরকারকে দেয় রাজস্ব ন্যূনতম যেন হয় সে আশ্বাস আমরা দেব। (ঐ পৃ. ২০) স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, হিন্দুরাষ্ট্র হবে ধনীর অনুকূলে, বণিকের কাছে বেশি রাজস্ব দাবি না করলে করের বোঝা স্বভাবতই মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রের ওপরে আসবে। ধনিক ও বণিক-তোষণের দ্বারা এ সমাজ যে অর্থনীতির বিভেদ সৃষ্টি করছে তার শিকার হবে স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। এ ইশতেহারে আরও বলা আছে, ‘গণবণ্টন মাধ্যমগুলির দ্বারা (রেশনে) কংগ্রেস যেমন সহজলভ্য করেছে খাদ্যশস্য, তা করব না। তা না করে আমরা বরং উচ্চমানের খাদ্যশস্য বণ্টন করব।’ (ঐ পৃ. ২১) এতে অবশ্যই কিছু ধনী মানুষ সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু উচ্চমানের চেয়ে বেশি পরিমাণের জন্যে যারা আগ্রহী, তাদের অবস্থা যথাপূর্বই থেকে যাবে অথবা আরও খারাপ হবে।
বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে এদের ঘোষিত নীতি হল, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে সদ্ভাব, চীন যে পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যবিধ সাহায্য করছে সে সম্বন্ধে উদাসীন হলে চলবে না।’ (ঐ পৃ. ৩২) একই কাজ আমেরিকা ও প্রথম বিশ্বের অন্যান্য দেশও করছে সে সম্বন্ধে এ ইশতেহার নীরব। কারণ এদের নির্দেশিত শত্রুকুলের মধ্যে কম্যুনিস্ট শক্তি একটি প্রধান শত্রু। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল সম্বন্ধে প্রচুর আপ্যায়নের ভাষা: ‘বিজেপি নেপালের সঙ্গে উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, কারণ নেপালের সঙ্গে ভারত দৃঢ়তম সাস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বন্ধনে আবদ্ধ।’ এরা বলে নেপাল থেকে একটি মুসলমানকে পালাতে হয়নি।’ (বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনী ঘোষণা পত্র, পৃ. ৪) কথাটা সর্বশ সত্যের অপলাপ। মুসলমান নেপালে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। (ঐ পৃ. ৩৩)
জম্মু-কাশ্মীর সম্বন্ধে নীতি হল, ‘স্থানীয় পুলিস-বাহিনীকে দুর্নীতি-মুক্ত করা এবং রাষ্ট্রশক্তি যা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ এবং পাকিস্তান-পন্থী, তাকেও দুর্নীতিমুক্ত করা।’ (ঐ পৃ. ৩৫) ‘ডোডা-কে বিপর্যস্ত অঞ্চল ঘোষণা করে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ শক্তি)-র আইন প্রবর্তন করা, যাতে ওই জেলাটি ভাড়াটে বাহিনী ও অন্তর্ঘাতিদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠা প্রতিরোধ করে।’ (ঐ পৃ. ৩৫) ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে তাদের বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীরা দুই দেশের সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলছে।’ (ঐ পৃ. ৩৩) ‘আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে বিশেষত বাংলাদেশ থেকে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের নিরাপত্তার ওপরে সরাসরি প্রভাব ফেলছে এবং আমাদের জনসংখ্যার অনুপাত এতে ভারসাম্য হারাচ্ছে।’ (ঐ পৃ. ৩৯) ‘বে-আইনি অনুপ্রবেশের সন্ধান নিয়ে নির্বাচক তালিকা থেকে তাদের নাম মুছে দেওয়া হোক এবং অবিলম্বে তাদের এখান থেকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হোক।’ (ঐ পৃ. ৪০) শ্রীলঙ্কার তামিল উদ্বাস্তুদের (১) উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠানো হোক এবং (২) তাদের গতিবিধির প্রতি নিয়মিত লক্ষ্য রাখা হোক।’ (ঐ পৃ. ৬৭) ‘স্বদেশে তাদের কী নিষ্ঠুর পরিণতি হবে সে কথা উপেক্ষা করেই (চট্টগ্রামের বৌদ্ধ চাকমাদের) ভারত সরকার তাদের দেশে পাঠাবার জন্যে নিষ্প্রয়োজন দ্রুততা অবলম্বন করছে— এটি কংগ্রেসের নীচ রাজনীতির দ্বারাই প্রবর্তিত। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু এদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারছে না, তাই বিজেপি এই ভাবে জোর করে পাঠাবার বিপক্ষে।’ (ঐ পৃ. ৬৯) বৈদেশিক নীতির এ অংশে যা স্পষ্ট তা হল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্বন্ধে নীতি এক রকম ও অন্যদের সম্পর্কে অন্য রকম। মুসলমান রাষ্ট্রগুলি শত্রুপক্ষ। হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল শুধুমাত্র হিন্দুত্বের জোরেই বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রের পরম সুহৃৎ। অর্থাৎ, বৈদেশিক নীতি নির্ধারিত হচ্ছে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রয়োজনকে প্রাধান্য না দিয়ে কেবলমাত্র হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দুত্বের বিচারেই। বলা বাহুল্য, কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাষ্ট্রই রাজনীতিতে ধর্মের এই ধরনের অনুপ্রবেশ সমর্থন করবে না।
মানবিক অধিকারের প্রসঙ্গে ওই ইশতেহার বলে, ‘আমরা জাতি, বিশ্বাস, ধর্ম ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মানবিক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু যারা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করে এই অঙ্গীকারে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করে তাদের এটিকে ঢালের মতো ব্যবহার করতে দেব না। তারা মানবিক অধিকার হারাবে।’ (ঐ পৃ. ৬৫) বাবরি মসজিদ ভাঙা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ নয়? ১৯৯০-এ দিল্লিতে নিজামুদ্দিনে, ১৯৯০-৯১-এ খুজাতে দাঙ্গায় হিন্দু নিষ্ঠুর আচরণ করেনি? রেড্ডি, বিয়াঠায়াথিল ও বেণুগোপাল কমিশন— তিনটিরই ঘোষিত সিদ্ধান্ত হল, দীর্ঘ কয়েক বৎসরের মুসলমান ও খ্রিস্টান-বিরোধী দাঙ্গার পিছনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সক্রিয় প্ররোচনা ছিল। অতএব হিন্দুর রাষ্ট্রিক ও মানবিক অধিকারের দাবিও তো স্বীকার করা যায় না। সে ক্ষেত্রে আগে ঘর সামলিয়ে দাঙ্গায় হিন্দু প্ররোচনাদাতাদের রাষ্ট্রিক ও মানবিক অধিকারের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা উচিত নয় কি? এই ধরনের ঘোষণার বিপদ হচ্ছে, এর মধ্যে ঘোষকও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিন্তু উদ্ধৃতিটি থেকে উদ্দেশ্য স্পষ্ট: রাষ্ট্রিক ও মানবিক অধিকার থেকে শুধু মুসলমান ও খ্রিস্টানকেই বঞ্চিত করা। কারণ, এরা বলে, ‘প্রত্যেকেই জানে, সংবিধান প্রদত্ত protection-এর ব্যবস্থাপুঞ্জকে চূড়ান্ত ভাবে কাজে লাগিয়েছে ইসলাম ধর্ম আর খ্রিস্টান ধর্ম।’ (সুহাস মজুমদার ‘যারা বলে আমরা ‘হিন্দু’ নই আমরা মানুষ’, ১৯৯৩, পৃ. ১১)। ‘ইসলাম তার অনুগামীদের হাতে বিধর্মী প্রতিবেশীদের জন্য খঞ্জর ধরিয়ে দিয়েছে আর খ্রিস্টধর্ম প্রতিবেশী সম্বন্ধে শিখিয়েছে ভ্রূক্ষেপহীন বেইমানির অভ্যাস।’ (ঐ পৃ. ৩৮) প্ৰমাণ, যুক্তি নিষ্প্রয়োজনবোধে কি বর্জিত? হয়তো এই ফতোয়া তাই।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে বিজেপির ঘোষিত নীতি হল, ‘উত্তরাঞ্চল, বিদর্ভ ও ছত্তিসগঢ়কে পূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হবে।’ (ইশতেহার ১৯৯৬, পৃ. ১০) ‘মেনস্ট্রীম’ পত্রিকার পক্ষ থেকে বিশ্ব হিন্দু-পরিষদের স্বামী মুক্তানন্দের সঙ্গে দুই গবেষকের এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত হয় পত্রিকার ১৬ অক্টোবর ১৯৯৩ সালে। ইনি অক্টোবর ১৯৯২-এ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সন্ত সমিতির নেতা ছিলেন। এঁদের সঙ্গে বিজেপির মতগত পার্থক্য বেশি নেই। জাতিভেদ প্রসঙ্গে জগজীবন রাম সম্বন্ধে এঁর উক্তি ‘তুই ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ছিলি, তাও, শালা তুই হরিজন? শালা তুই চামারদের জন্য অধিকার চাস, আবার ব্রাহ্মণদের পাশে বসতেও চাস’ (পৃ. ১৫) যারা আচরণে অস্পৃশ্যতানীতি মেনে চলতে চায় তাদের সম্বন্ধে স্বামীজির উক্তি— ‘হ্যাঁ, তাদের সে অধিকার দেওয়া উচিত।’ (ঐ পৃ. ১৭) তপশিলি জাতি, গোষ্ঠী ও অন্যান্য অধিকার বঞ্চিতদের জন্যে সংরক্ষণের প্রশ্নে উত্তর— ‘কেন তাদের জন্যে সংরক্ষণ থাকবে? (ঐ পৃ. ১৮) ‘জাতিভেদকে আবার পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।’ (ঐ পৃ. ১৫) গোলওয়লকর স্বয়ং জাতিভেদ সম্বন্ধে বলেছেন— জাতিভেদ-প্রথা সামাজিক সংহতির একটি বিশিষ্ট বন্ধন।’ (আ বাঞ্চ অব থটস, পৃ. ১০৮) জাতিভেদ ও ‘তথাকথিত’ নিম্নবর্গের মানুষের বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রে স্থান কোথায় হবে সে কথা এ সব উক্তিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসারত্যাগী ধর্মপ্রাণ স্বামীজির ‘নিম্নবর্গের’ মানুষ সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা কোন রুচিবর্জিত আক্রোশে পৌঁছেছে, তা তাঁর ভাষা প্রয়োগেই স্পষ্ট। পৃথিবীর অহিন্দু অধিবাসী সম্বন্ধে এদের জ্ঞান ও মনোভাব হঠাৎ উগ্রভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। সুশিক্ষিত গোলওয়লকরও অর্ধ-শিক্ষিতের মতো মন্তব্য করেন যে, চীনারা নানা প্রাণীর মাংস খায়, আর মানুষ যা খায় তাই হয়…তেমন মানুষের মধ্যে মানবিক গুণ প্রত্যাশা করা ভুল।’ (ঐ পৃ. ২৭০)
এই হিন্দুরাষ্ট্রে নারীর স্থান কী? ১৯৯৬-এর বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহার বলে, ‘মহিলা শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হবে। কারণ প্রত্যেক মা-কে সাক্ষর করলেই প্রত্যেক শিশুও সাক্ষর হবে।’ (পৃ. ১২) নারীর নিজের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে উঠেছে তার সন্তানের সাক্ষরতার প্রয়োজন। তা ছাড়া সাক্ষরতা তো শিক্ষার প্রথম ধাপ মাত্র, নারীর শিক্ষার প্রয়োজন বা অধিকার সম্বন্ধে কোনও কথাই নেই ইশতেহারে। মুক্তানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে দু’জন গবেষকের আরও একটি সাক্ষাৎকার ২৩ অক্টোবর ১৯৯৩-এর ‘মেনস্ট্রীমে’ প্রকাশিত হয়। সেখানে নারীর সম্বন্ধে নানা প্রসঙ্গে স্বামীজি স্পষ্ট উচ্চারণে নানা কথা বলেন, বিজেপি’র সাধ্বী ঋতম্ভরাকে উদ্ধৃত করেন। ‘হিন্দুরা কেন পঁচাত্তরটি নারীকে বিবাহ করতে পারবে না?’ (পৃ. ২৪) বলা বাহুল্য, মুসলমান পুরুষের যুগপৎ চারটি পর্যন্ত স্ত্রী থাকার প্রতিবাদে এ উক্তি; কেননা বহুবিবাহের ফলে মুসলমানের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে এমন একটা আশঙ্কা সঙ্ঘ পরিবারকে আতঙ্কিত করে এবং সত্যমিথ্যা বিজড়িত পরিসংখ্যানে তারা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত এবং উদভ্রান্ত করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
পিতামাতার নিরূপিত পাত্রপাত্রীর বিবাহ সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর ছিল তাই সে প্রথা গৃহীত হয়েছে। প্রেমের বিবাহ, যাকে স্বামীজি স্বয়ম্বর-প্রথা বলেছেন, তার সম্বন্ধে তাঁর উক্তি— ‘কে স্বয়ম্বর-প্রথায় বিবাহ করে? কেবলমাত্র হারামখোর, বেকার ও চোর ডাকাতরাই করে। এর কারণ তাদের কোনও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নেই।… যারা খেটে খায় তারা স্বয়ম্বর-প্রথায় বিয়ে করে না।’ (ঐ পৃ. ২৩) প্রথমত, তথ্যগত ভাবে এর সবটাই ভুল; খেটে-খাওয়া বহু মানুষই স্বেচ্ছানির্বাচনে বিবাহ করে। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেই বরং স্বয়ম্বর-প্রথার স্বীকৃতি ও প্রচলন ছিল। মুসলমানরা হারামখোর নয়, এটা বোধ হয় স্বামীজি সাময়িক ভাবে বিস্মৃত হয়েছিলেন। অন্যত্র ঋতন্তরা বলেন, ‘নারীকে নারী হতে হবে। তাকে মা হতে হবে।’ মাতৃত্বের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার আড়ালে কুমারী ও সন্তানহীনা নারীর প্রতি সমাজের অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়; এর সমর্থন আছে সঙ্ঘপরিবারের নারী সম্বন্ধে আদর্শেও। বিধবাবিবাহ কি অন্যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি বলেন— ‘হ্যাঁ এটা অন্যায়ই বটে।’ প্রসঙ্গত তিনি বলেন, ‘আমার এ কথা বলবারও অধিকার থাকা উচিত যে সতীপ্রথাও চলতে দেওয়া উচিত।’ (ঐ পৃ. ২৩) প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘বাড়ির বাইরে নারীর কাজ করা সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?’ উত্তর— ‘এটা ঠিক নয়; কারণ এতে পরিবারের গঠন নষ্ট হয়।… বাল্যবিবাহ প্রথা প্রবর্তন করতে হলে তা আমরা করব।… সম্পত্তিতে নারীকে অধিকার দিলে সামাজিক সংহতি নষ্ট হয়। দুই বর্ণের মধ্যে বিবাহে সামাজিক সংহতি নষ্ট হয়ে যায়, কারণ প্রত্যেক বর্ণ বা জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য আছে।’ (ঐ পৃ. ২৪) এই সব মতামত বিংশ শতকের শেষভাগে উচ্চারিত হচ্ছে। এর সবটাই বিজেপি আক্ষরিক ভাবে সমর্থন করে না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ও সংকটে এই সব মত তাদের দিক-দর্শন করায়। প্রশ্ন আসে, এই বহু-ঘোষিত সামাজিক সংহতির যে চেহারা আমরা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত রাজ্যগুলিতে দেখতে পাই, সেখানে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন নেই। মাতৃত্ব ছাড়া নারীর আত্মবিকাশ বা আত্মপ্রকাশের আর কোনও সমাজ-সমর্থিত পথ নেই, বিধবাবিবাহ অকল্পনীয় এবং মধ্যেমধ্যেই রূপ কানোয়াররা পুড়ে মরে। নারী সেখানে সম্পত্তির ওপরে কোনও রকম অধিকারই পায় না, পাবার স্বপ্নও দেখতে সাহস পায় না। এক কথায়, নারীর সামাজিক অবস্থান মধ্যযুগীয় অন্ধকারে; সমাজে তার ব্যক্তিসত্তা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকৃত। হিন্দুরাষ্ট্রে এই হল নারীর স্থান। আজকে যখন বিজেপি তার ক্ষমতাবিস্তারে তৎপর, তখন দেশের লোকের ভেবে দেখার সময় হয়েছে, হিন্দুরাষ্ট্রে নারীর এই স্থান তাদের বুদ্ধি, যুক্তি বা মানবিকতার সমর্থন পায় কি না। গোলওয়লকরও তাঁর ‘আ বাঞ্চ অব থটস’-এ লেখেন— ‘মেয়েদের স্বাধীনতা দেবার ফলেই প্রতি পরিবারে বিরোধ বাড়ছে। মেয়েরা অনেক অধিকার পেয়েছে বলেই এখন পরিবারগুলি ভেঙে যাচ্ছে।… হিন্দু মেয়েদের অধিকার প্রদানের আইনগুলি, যেমন বিধবা আইন (১৮৫৬), হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তিতে অধিকার সংক্রান্ত আইন (১৯৩৭), বিশেষ বিবাহ আইন (১৯৫৪) এবং হিন্দু বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন (১৯৫৫) সবগুলিই হিন্দু সমাজে ও হিন্দু পরিবারে শুধুমাত্র ভাঙন ও বিশৃঙ্খলা আনতেই সাহায্য করেছে।’ (পৃ. ৩৩০) এই মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজয়রাজে সিন্ধিয়া রূপ কানোয়ারের ‘সতী’ হওয়া সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘এ হল মহিমান্বিত হিন্দু নারীত্বের পুনরুত্থান।’
এই মনোভাবের একটি ন্যক্কারজনক প্রমাণ সম্প্রতি পাওয়া গেছে: রূপ কানোয়ারকে যারা ‘সতী’ হতে বাধ্য করেছিল, বিচারে তারা সকলে বেকসুর ছাড়া পেয়েছে। নারীর মানবিক অধিকারগুলি সম্বন্ধে বিগত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে সারা পৃথিবীতে বহু সহস্র নারীর যে আন্দোলন অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, বিজেপি প্রবক্তাদের মতে তা শুধু নিষ্প্রয়োজন নয়, দেশের সমাজ ও পরিবারের সংহতির পক্ষে বিধ্বংসী। বর্তমানের নারী এই ধরনের পশ্চাদমুখী মতকে মেনে নিয়ে অন্তঃপুরচারিণী, সর্বতো ভাবে পুরুষের কর্তৃত্বাধীন অবস্থান ও নিজের ব্যক্তিসত্তার সম্পূর্ণ বিলোপ কি মেনে নিতে প্রস্তুত? সুহাস মজুমদার তাঁর বই ‘যাঁরা বলে আমরা ‘হিন্দু’ নই আমরা মানুষ’-এ বলেন, ‘বধূহত্যার ঘটনা ঘটে সমাজের এমন একটা স্তরে যার উপর হিন্দুত্বের দাগ কখনো জলের উপর দাগের চেয়ে গভীর হয় না।’ (পৃ. ১৩-১৪) পাঠক মাত্রেরই পরিচিত জগতে সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা প্রকাশিত বধূহত্যা সংক্রান্ত তথ্যের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়বে এ উক্তিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। বস্তুত, হিন্দুত্ব-প্রণোদিত পরিবারে এবং হিন্দুত্ব প্রভাবমুক্ত ধনী পরিবারে বধূ-হত্যা সমানেই ঘটে, তবে প্রথমটি সংখ্যায় বহুগুণ বেশি এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। হিন্দু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যারা হিন্দুত্ব দ্বারা প্রভাবিত এমন বিস্তর পরিবারে পণ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় বিবাহের অল্পকালের মধ্যেই। এবং চাপ বাড়তে বাড়তে হয় প্রত্যক্ষ বধূহত্যা ঘটে, নয় নিরুপায় বধূটি প্ররোচনায় বা অসহ্য মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নে আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হয়। প্রায় প্রত্যহ সংবাদপত্র এমন ঘটনা প্রকাশ করে। তা ছাড়া পণপ্রথা, যা অধিকাংশ বধূহত্যার পশ্চাতে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি, তা তো হিন্দু শাস্ত্রে সম্পূর্ণ অনুমোদিত। পরবর্তী পুরাণগুলি ‘কন্যাবিক্রয়ী’কে নিন্দা করেছে, পুত্রবিক্রয়ী অর্থাৎ, পণগ্রহণকারী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। ভুলে গেলে তো চলবে না যে, পণ শব্দটির অর্থ ‘মূল্য’ এবং পুত্রের পিতার পণ নেওয়ার অর্থ মূল্য গ্রহণ করে পুত্রকে বিক্রয় করা। পণপ্রথা না থাকলে এত ভয়াবহ সংখ্যায় বধূহত্যা ঘটত না, এবং এ প্রথা হিন্দুশাস্ত্রসম্মত। হিন্দুরাষ্ট্রে বাস করলে নারী কখনও এই ধরনের অপঘাত মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাবে না। গোলওয়লকর লেখেন, ‘ইদানীং প্রায়ই নারীর জন্যে পুরুষের সমান অধিকারের দাবি শোনা যায়। পুরুষের আধিপত্য থেকে তাদের মুক্তির দাবি। ভিন্ন লিঙ্গের ভিত্তিতে নানা ক্ষমতার আসনে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণের দাবি শোন যাচ্ছে; ফলে জাতিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, ভাষাভেদবাদ ইত্যাদির সঙ্গে আরও একটা ‘বাদ’ যুক্তি হচ্ছে লিঙ্গবাদ।’ (আ বাঞ্চ অব থটস, পৃ. ১১) এ মন্তব্যের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট: নারীর স্থান পুরুষের অধীনে, তা-ই থাকা উচিত, তার ব্যতিক্রমের চেষ্টা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। ক্ষমতার আসনগুলিতে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার, সেখানে নারীর অনুপ্রবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষা, সাক্ষরতার জন্যে নারীকে সাক্ষর হতে হবে এ কথা যারা বলে, তারা প্রকারান্তরে নারীর উচ্চশিক্ষা এবং বহির্জগতে আপন শক্তি ও কুশলতার জোরে সম্মানের ও ক্ষমতার স্থান অধিকার করা আদর্শ হিন্দুরাষ্ট্রে অচল বলে মেনে নেন। বলা বাহুল্য, সন্ন্যাসিনী উচ্চশিক্ষিতা হতে পারে, কিন্তু কুলবধূ? নৈব নৈব চ। বিজেপির যে নারী-সংগঠন, রাষ্ট্রসেবিকা দল, তাদের কার্যক্রমের মধ্যে গৃহবধূর ভূমিকায় থেকে অন্যের সাহায্য ও সংগঠন করা অনুমোদিত, কিন্তু সমস্ত ছকটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনুগত। স্বাধীনতা, উচ্চশিক্ষা, সম্পত্তিতে অধিকার, বিধবাবিবাহ, নারী হিসেবে ব্যক্তিসত্তার সামাজিক স্বীকৃতি, নারী হিসেবে যখন তার স্বার্থ ও সত্তা অবদমিত তখনও কোনও সরব, সংগঠিত প্রতিবাদ বা আন্দোলন এদের নারী সম্পর্কে আদর্শের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, পুরুষপ্রধান সমাজে ব্যক্তিসত্তার অবদমন মেনে নিয়েই নারীদের যে ‘রাষ্ট্রসেবিকা’ সংগঠন তা, বর্তমান নারী আন্দোলনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। হিন্দুশাস্ত্র নারীকে যে ভূমিকায় দেখেছে, রেখেছে ও রাখতে চায়, হিন্দুরাষ্ট্রেও নারী সেইখানেই থাকবে। শাস্ত্র যে লক্ষণের গণ্ডি এঁকে রেখেছে, তার মধ্যেই সীতার অনুগামিনীরা চলাফেরা করবে, বাইরে যাবার চেষ্টাই করবে না। কার্যত বিজেপির কিছু সভ্যা বাইরের জগতে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু এঁরা ব্যতিক্রমী। হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় সাধারণ নারী অন্তঃপুরচারিণী ও মৌলিক মানবিক অধিকারে অনেক পরিমাণে বঞ্চিত।
হিন্দুরাষ্ট্রে শিক্ষার ব্যবস্থা কী রকম হবে? সুহাস মজুমদারের ‘যারা বলে আমরা ‘হিন্দু’ নই আমরা মানুষ’ বইটিতে পড়ি, ‘দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কেন বিশেষ ভাবে হিন্দুশিক্ষা হবে না, আজ পর্যন্ত কোনও পণ্ডিতই সে কথা আমাদের বোঝাতে পারেননি।’ (পৃ. ৪৯) প্রথমত, বিশেষ ভাবে হিন্দুশিক্ষা ব্যাপারটা কী তা কোথাও বলা হল না। তার পর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কোথায় তার পার্থক্য তা-ও বোঝা গেল না। অঙ্ক, ভূগোল, বিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার মধ্যে হিন্দু ও অহিন্দু শিক্ষা কোথায় পৃথক হতে পারে? হিন্দু শিক্ষা মানে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা যদি এঁরা মনে করেন তবুও প্রশ্ন থাকে কত প্রাচীন সে যুগ— বৈদিক না আদিমধ্যযুগীয়? সে সব যুগের মাধ্যমিক স্তরের (১০-১২ বা ১৭-১৮ বছর বয়সের) শিক্ষার পাঠক্রম কী ছিল তা তো জানাই যায় না। তা ছাড়া সর্বভারতীয় পরিসরে নিশ্চয়ই তা চলিত ছিল না। তা হলে ‘হিন্দু’ শব্দটির প্রয়োগের সার্থকতা কী? কিছু আছে বইকি, তবে সেটা বুঝতে গেলে বিজেপি পরিচালিত বিদ্যালয়গুলির পাঠ্যতালিকা ও বৈশিষ্ট্য জানতে হবে। এই হিন্দুশিক্ষার ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদে যা বাকি থাকে তা প্রত্যক্ষ ভাবে বোঝা যায় প্রধানত, এদের ইতিহাসের পঠনপাঠন এবং পাঠ্যসূচি থেকে। ধর্মীয় অনুষঙ্গ হল, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ভাবতে হবে প্রথমত সে হিন্দু, তার পর অথবা সেই কারণেই সে ভারতীয়, তার পরে সে তার রাজ্য ও পরিবারের সদস্য। হিন্দুসভার প্রাথম্য কৈশোরের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রছাত্রীদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়; ফলে পৃথিবীকে দেখবার দৃষ্টিটা হিন্দুত্বের মোহে আচ্ছন্ন থাকে। মুশকিল হল, ইতিহাস শিক্ষা যথাসম্ভব নির্ব্যক্তিক ও তথ্যনিষ্ঠ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এইখানে বিজেপি বিশেষ একটি পাঠ্যসূচি প্রবর্তন করেছে যা তথ্যনিষ্ঠ নয়। বিজেপির ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হয়, ‘লক্ষ লক্ষ বছরের ঐতিহ্যসম্পন্ন পৃথিবীর সবচেয়ে সৎ শুভ্র এবং পবিত্র জীবনদর্শনের উজ্জ্বল উত্তরসূরী হিন্দু জাতির ভবিষ্যৎ আমরা কিছু কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজনীতিক বালখিল্য বুদ্ধিজীবী অথবা ভণ্ড ধার্মিকের হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’ (শিবপ্রসাদ রায় ‘দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই’ পৃ. ২৪) ঐতিহাসিকের প্রথমেই চোখে পড়বে তথ্যগত ভাবে সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক কথাগুলি, ‘লক্ষ লক্ষ বছরের ঐতিহ্যসম্পন্ন’, ভারতবর্ষের ইতিহাস এখনও পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হাজার ছয়েক বছরের, তারও প্রথমাংশ সম্বন্ধে প্রত্নবস্তুগত তথ্য সামান্যই পাওয়া গেছে। তার পর ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সৎ শুভ্র এবং পবিত্র জীবনদর্শন’ ইত্যাদি বলার দাবি তাঁরই থাকে যাঁর পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতা সম্বন্ধে গভীর তথ্যগত জ্ঞান থাকে, যা ওই লেখকের যে নেই তা তাঁর বাক্যের শুরুতেই মনগড়া ‘লক্ষ লক্ষ বছরের’ আমদানি থেকে বোঝা যায়। ইচ্ছাপূরক উক্তি কখনও তথ্য হয়ে ওঠে না, এখানে সে চেষ্টাই করা হয়েছে। বিকৃত ইতিহাস শেখাবার প্রচেষ্টায় ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে যে ইতিহাস শিক্ষার আয়োজন হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে ও মধ্যপ্রদেশে তার প্রতিবাদে কিছু সুস্থমনা শিক্ষক ‘একলব্য’ নামে সংস্থার প্রবর্তন করে যথাযথ তথ্যসংবলিত সম্পূর্ণ নতুন ও আশ্চর্য মনোজ্ঞ প্রণালীতে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেন। বিজেপি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সেগুলিকে বাতিল করে। পরে দীর্ঘ সংগ্রামের পরে সেগুলি পুনর্বার প্রচলিত হয়। তথ্যবিকৃতির দ্বারা এখনও বিজেপি তাদের অধিকারভুক্ত স্কুলে হিন্দুত্বের জয়ঘোষক বহু পুস্তক চালিয়ে যাচ্ছে। একটি পুরো প্রজন্ম নানা পাঠ্যবই ও শাখার নেতাদের কাছে ইতিহাস বলে যা শিখছে, তা আর যাই হোক, ইতিহাস নয়।
এই ধরনের মূঢ়তা থেকেই হিন্দুত্ব দাবি করে, প্রাচীন ভারতে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তি সবই ছিল, এমনকী এরোপ্লেনও ছিল। মুশকিল হচ্ছে, এরোপ্লেন তৈরির জন্যে যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল বীজগণিত, বলবিদ্যা ও উচ্চমানের পদার্থবিদ্যার প্রয়োজন তার কোনওটাই এ দেশে চর্চিত হয়নি; হয়ে থাকলে মানুষের দৈনন্দিন বহু প্রয়োজনে কার্যকর এ সব বিদ্যা কখনওই লুপ্ত হয়ে যেত না। এরোপ্লেনও অব্যাহত ভাবে নির্মিত হয়েই চলত। তুলসীপাতার রসে সর্দির উপকার হয়, বহু প্রাচীন এই আয়ুর্বেদিক জ্ঞানটি যখন আজও লুপ্ত হয়নি তখন মানবজাতির পক্ষে প্রভূত হিতকর এ সব বিদ্যাও লুপ্ত হত না। অথর্বপরিশিষ্টের ষোলোটি গাণিতিক সূত্রে উন্নততর আধুনিক পদার্থবিদ্যার পরিপোষক কোনও সূত্রের সন্ধান মেলেনি। প্রাচীন ভারতে অনেক বিষয়ে জ্ঞান খুব উচ্চমাত্রাকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু যেখানে তা ঘটেনি সেখানে তাকে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা অবৈজ্ঞানিক, ছাত্রদের তা শেখানো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ। এমনই শোনা যায় আধুনিককালের একটি তথ্যবিকৃতি; গোলওয়লকর লেখেন, ‘বহু দশ সহস্র স্কোয়ার মাইল ভূমি চীনা আক্রমণে অধিকৃত হয়েছিল।’ (Tens of thousands of square miles’) ‘আ বাঞ্চ অব অব থটস’ পৃ. ৯৪)। ভারতবর্ষের যে সামান্য পরিমাণ জমি অতি স্বল্পকাল চীন দখল করেছিল, তাকে অতিরঞ্জিত করা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা ওই ‘বহু দশ সহস্র স্কোয়ার মাইল’ থেকেই বোঝা যায়।
গোলওয়লকরের এবং ওই মতাবলম্বী অন্যদেরও লেখায় পাই, ‘আর্য জাতি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুসভ্য জাতি।… এই ভারতবর্ষ থেকেই তারা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।’ প্রথম দাবিটি পৃথিবীর সব প্রাচীন জাতির সম্বন্ধে গভীর গবেষণালবদ্ধ জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে যে-শ্রেণির ঐতিহাসিক সঙ্ঘপরিবারে নেই। দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। প্রমাণ এর সপক্ষে নেই। এবং আর্যরা কোনও ‘জাতি’ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন না, ভাষা ও সংস্কৃতিগত ভাবে সংহত কোনও জনগোষ্ঠীকে আর্য বলা হয়। পরবর্তী কালে প্রাগার্যদের সঙ্গে মিশ্রণে যে সংমিশ্র জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি, ভিন্ন ভিন্ন জাতি-সংস্কৃতির অধিকারী তারাই আজ ভারতবাসী।
একটি বহুল-প্রচারিত তথ্যবিকৃতি এঁরা করে থাকেন। ‘ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজকোষাগার নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারে। তাঁর সময়ে হিন্দুরা কোনও চাকরি পেত না। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি হিন্দুদের ওপরে জিজিয়া কর চাপিয়েছিলেন।’ অথচ, হিন্দু জনসংখ্যার মাত্র পনেরো শতাংশ জিজিয়া কর দিত, আর জিজিয়া কর বসাবার আগে আরও অনেকগুলি কর থেকে হিন্দুদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া জিজিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটি কর প্রবর্তন করা হয়, যা শুধু মুসলমানদেরই দিতে হত। পিতা শাহজাহানের আয়ের অনুপাতে অত্যধিক ব্যয়ের ফলে ঔরঙ্গজেব যখন সম্রাট হন তখন রাজকোষ শূন্য-প্রায়। কাজেই সেটা পূরণ করবার জন্যে বিভিন্ন কর বসানো যে-কোনও সম্রাটের পক্ষে অত্যাবশ্যক ছিল। আকবর, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের হিন্দু বেগম ও একাধিক হিন্দু আমির, ওমরাহ ও সেনাপতি ছিল; ঔরঙ্গজেবের চারটি হিন্দু সেনাপতি ছিল। রাজ্য চালনার পক্ষে সেনাপতির পদ কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনায়াসেই বোঝা যায়। ঔরঙ্গজেব সম্বন্ধে বহু তথ্য সচরাচর গোপন বা বিকৃত করা হয়; তিনি হিন্দুর অনেক ক্ষতি করেছেন, কিন্তু তাঁর আমলে বহু মুসলমান ছোট ছোট রাজা ও জায়গীরদারও বিদ্রোহ করেন।
বিজেপি যে সব ইতিহাসের পাঠ্যগ্রন্থ চালু করেছে তার মধ্যে বিস্তর অনৈতিহাসিক হিন্দুত্বসমর্থক কথা আছে। গোলওয়লকর স্পষ্ট বলেন, ‘মুসলমান যুগের ইতিহাস পুনর্বার রচনা করতে হবে।’ (‘অ বাঞ্চ অব থটস’ ভূমিকা, পৃ. ২৯)-এর একটি উদ্দেশ্য হিন্দুর সপক্ষে এবং মুসলমানের বিপক্ষে তথ্যের বিকৃতি ঘটানো। যেমন, আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করলে ভারতীয়রা প্রচণ্ড পিটিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, পৃথ্বীরাজ মহম্মদ ঘোরীকে পরাজিত করে হত্যা করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের নির্মিত বিষ্ণুস্তম্ভই কুতুব মিনার, রাজপুতরা ভারতবর্ষে বহিরাগত। এনসিইআরটি’র পাঠ্যপুস্তক থেকে এই শেষোক্ত মিথ্যাটি যে অনুচ্ছেদে ছিল তা কালি দিয়ে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যগ্রন্থগুলিতে বারবার বলা হয়েছে যে, ভারতবর্ষের জ্ঞানভাণ্ডারে যা কিছু প্রাচীন, সমগ্র বিশ্বের কাছে আজ সে সব অত্যাধুনিক। মিথ্যাগুলি না হয় ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে দেখানো যায় সত্যের বিকৃতি হিসাবে; কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারই এখন পৃথিবীতে সর্বাধুনিক জ্ঞান ও তথ্য এ কথা বলে প্রতিপন্ন হয় যে, বিগত আড়াই-তিন হাজার বছরে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে কিছুই সংযোজিত হয়নি। বাকি পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় লব্ধ সমস্ত ফলকে নস্যাৎ করা হবে হিন্দু সভ্যতার কাল্পনিক গৌরব কীর্তনের জন্যে। যে কথাটা এরা কখনওই বলে না তা হল, সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে আর্যসভ্যতা হল সর্বকনিষ্ঠ ও অর্বাচীন। চীনা, মিশরীয়, সুমেরীয়, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, ইরানীয় এ সব সভ্যতার যে ইতিহাস প্রত্নতত্ত্বের প্রমাণে এখন দেখা যাচ্ছে তাতে এরা প্রত্যেকেই ভারতীয় আর্যসভ্যতার থেকে দেড়-দুই-তিন হাজার বছরের প্রাচীন। ভারতবর্ষের মিথ্যা গৌরব প্রচার করলেই ছাত্রছাত্রীরা একটা ভ্রান্তির ভিত্তিতে স্বদেশভক্ত হয়ে উঠবে (?), কিন্তু ইতিহাসে যে তথ্যনিষ্ঠার প্রয়োজন তার অভাবে কতকগুলি ভুল তথ্য আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হাতে তুলে দিয়ে যাব। ইংরেজি ও হিন্দিতে, উত্তরপ্রদেশের সমস্ত বিদ্যানিকেতনে সমাজবিজ্ঞানের যে-গ্রন্থটি পাঠ্য, তার রচয়িতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ড. নীরজা শর্মা। সমস্ত সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য স্থলেই হিন্দু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। পাঠগ্রন্থ সম্পর্কে তথ্যগুলি পাওয়া যাবে ‘ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি অন টেক্সট বুক ইভ্যালুয়েশন’ রিপোর্ট থেকে। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তথ্যকে বিকৃত করে সত্যকে হত্যা করে যে অবৈজ্ঞানিক অনৈতিহাসিক তথ্যসমাবেশ ধরে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের সামনে, তাতে ক্ষতি হচ্ছে আগামী প্রজন্মেরই। এরাই দাবি করে, ‘দেশের মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা কেন বিশেষ ভাবে হিন্দু শিক্ষা হবে না, আজ পর্যন্ত কোনও পণ্ডিতই সে কথা আমাদের বোঝাতে পারেনি।’ অথচ কারণটা বোঝা খুবই সহজ, বিজেপি শিক্ষাব্যবস্থা ঘোরতর ‘হিন্দু’ হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা ‘শিক্ষা’ হয়ে উঠবে না। নিজেদের সম্বন্ধে সঙ্ঘপরিবারের ধারণা যে, তাঁরা একটি বিদ্বদ গোষ্ঠী। মুম্বইয়ের স্বামী চিন্ময়ানন্দ ধর্মাচার্যদের এক সভায় বলেন, ‘যথাইই এই (সভা) যেন একটি পার্লামেন্ট, দেশের মনীষীদের এই পার্লামেন্ট সমবেত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে।’ অথচ এঁদের কথা তথ্য ও তত্ত্বে কত না কুযুক্তি ও সত্যের অপলাপ!
বিজেপির আর একটি ঘোষিত নীতি— সংস্কৃত ভাষার প্রসার। ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ইশতেহার বলে তাদের নীতি হল, ‘সংস্কৃত ভাষা চর্চায় উৎসাহ দেওয়া এবং স্কুলে ত্রিভাষানীতি কঠোর ভাবে চালু করা।’ (পৃ. ৬৯) সব্যসাচী বাগচির লেখা (ইকনমিক প্রস্পেক্ট অব দ্য বিজেপি, পৃ. ৩৯) ‘সংস্কৃত ভাষার প্রসারের জন্য সংস্কৃত ও হিন্দিকে সংযুক্ত ভাবে উৎসাহ দেওয়া।’ (ঐ) এই উৎসাহের একটা হাস্যকর প্রকাশ দূরদর্শনে পাঁচ মিনিট সংস্কৃতে খবর পড়া। এটা কার জন্যে? যারা সংস্কৃত বোঝে এমন অসংস্কৃতভাষী ভারতীয়ের জন্যে! জানি, আদমসুমারিতে আঙুলে গোনা কিছু পরিবার নিজেদের সংস্কৃতভাষী বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এরা আলু-পটল কেনে অন্য ভাষায়, ট্রেনের টিকিট কাটে স্থানীয় ভাষায়, খবরের কাগজও পড়ে এবং কর্মস্থলে বৃত্তির জন্যে কাজ চালায় অন্য ভাষায়। সংস্কৃত বুঝতে বা বলতে পারলেই সংস্কৃতভাষী হওয়া যায় না। আর হবার দরকারই বা কী? সংস্কৃত চৰ্চা? প্রাচীন গ্রিক ল্যাটিনের চর্চার যে মান আজ পৃথিবীতে, এ দেশের সংস্কৃত চর্চা এখনও সে পর্যায়ে ওঠেনি; অথচ বিদেশি গ্রিক পণ্ডিত কখনওই নিজেকে গ্রিকভাষী বলে ঘোষণা করেন না, যদিও তিনি অনর্গল গ্রিক লিখতে পড়তে ও বলতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত চর্চা হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেটা হবে আধুনিক বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক মনোভাব নিয়ে এবং এটা জেনে ও মেনে যে, বস্তুত সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা। ‘মৃত’ সংজ্ঞার অর্থ হল, যে ভাষায় স্বভাবত কেউ কথা বলে না। কৃত্রিম চর্চার ফলে কথা বললেই কেউ সে ভাষা-ভাষী হয়ে ওঠে না। কোনও প্রাচীন ভাষাকে শ্রদ্ধা করে চর্চা করবার জন্যে তাকে জোর করে ‘জীবিত’ বলার প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান করতে হলে জোর করে বলতে হবে তিনি ‘জীবিত’? প্রপিতামহকে জীবিত না বললে তাঁর সম্বন্ধে শ্রদ্ধা রক্ষা করা যায় না? সংস্কৃতে যে জ্ঞানভাণ্ডার আছে তা বহুমূল্য, অতএব এ ভাষার একনিষ্ঠ বিজ্ঞানসম্মত চৰ্চা অত্যাবশ্যক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে হিন্দুত্বের বিন্দুমাত্র যোগ নেই। হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য-সমাজের শাস্ত্রগুলি এ-ভাষায় রচিত হয়েছিল, যেমন পুরাণ, উদ্ভিদতত্ত্ব-প্রাণিতত্ত্ব, বাস্তুবিদ্যা, কোষগ্রন্থ, বিজ্ঞানসংক্রান্ত চর্চা, ভাষাতত্ত্ব ব্যাকরণ সবই এ ভাষায় রচিত হয়েছিল। এগুলির কিছুই হিন্দুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সংস্কৃতচর্চা হলে এ সবের ও অন্য বহু বিষয়ের সম্বন্ধে, এ ভাষার কাব্য সাহিত্য অলংকার সম্বন্ধে, বিবিধ ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য, নাস্তিক দর্শন প্রস্থান সম্বন্ধে চর্চা হবে। এটা হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এটা হবে হিন্দুত্ববর্জিত, ধর্মনিরপেক্ষ মনোবৃত্তি নিয়ে। নতুবা সংস্কৃত মারফত হিন্দুত্বের গৌরব কীর্তনই হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা এক কণাও বাড়বে না।
গোলওয়লকর বলেছেন, ‘আন্তর্দেশীয় ভাষা’র সমস্যা সমাধান হিসাবে যতদিন না সংস্কৃত ওই স্থানটি (লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা, আন্তর্দেশীয় ভাষা) গ্রহণ করছে, ততদিন পর্যন্ত হিন্দিকে প্রাথম্য দিতে হবে।’ (‘আ বাঞ্চ অব থটস, পৃ. ১১৩) প্রথমত, সংস্কৃত সার্বজনীন কথ্যভাষা হয়ে উঠছে ভারতবর্ষে এ একটা মূঢ় কল্পনা বিলাস; শুধু অসম্ভবই নয়, অসঙ্গতও বটে। কেন সংস্কৃত সর্বভারতীয় ভাষা হতে যাবে? আর হিন্দির প্রাথম্য ভাবতে গেলে গোটা দক্ষিণ ভারতের হিন্দিবিরোধিতার কথাও মনে রাখতে হবে। ‘অ বাঞ্চ অব থটস’-এ গোলওয়লকর লেখেন, ‘সমস্ত ভারতীয় ভাষার শত্রু হল ইংরেজি ভাষা।’ (পৃ. ১১৪ ওই বইটি কিন্তু ইংরেজিতেই লেখা) এ মন্তব্যের সুদূরপ্রসারী ব্যঞ্জনা বোঝবার জন্যে বিশেষ চিন্তা করতে হয় না। বিংশ শতকের ভারতবর্ষে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইংরেজি ভাষাকে বিতাড়ন করার অর্থ সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা, অগ্রগতিকে মধ্যযুগে ঠেলে দেওয়া। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি এখনও বহুবিধ বিদ্যার বাহন। মানবিক বিষয়গুলির অনেকগুলিতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সবগুলিতেই। মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দানের চেষ্টা অভিনন্দনীয় হতে পারে, কিন্তু এ দরিদ্র দেশে যে বিপুলসংখ্যক পাঠ্য এবং সহপাঠ্য গ্রন্থ ইংরেজিতে পাওয়া যায় সেগুলিকে হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করাতে যে পরিমাণ ব্যয় হতে পারে, তা শুধু হিন্দুত্ব-নেশাগ্রস্ত স্বপ্নদর্শীরা ছাড়া কেউই সমর্থন করবে না। জাপানে একটাই রাষ্ট্রভাষা, আঞ্চলিক ভাষার সমস্যা সেখানে নেই। জাপান দীর্ঘকাল পাঠ্যতালিকা থেকে ইংরেজি বাদ দিয়ে বা স্বল্প পরিমাণে শিক্ষার ব্যবস্থা করার পরে তার কুফল সম্বন্ধে মর্মান্তিক ভাবে অবহিত হয়ে ইদানীং স্কুল শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজিকে অপরিহার্য পাঠ্যে পরিণত করেছে। ওই একই ভুল করতে উদ্যত বিজেপি। এর মূল্য দিতে হবে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীকে অগ্রস্রিয়মাণ উন্নতিশীল দেশগুলির জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ফল থেকে বঞ্চিত রেখে এবং এ ভাবে বঞ্চিত রাখলে সে বঞ্চনা কঠিন মূল্যে শোধ করতে হবে। তখন ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের পরে একেবারে পিছনের সারিতে ঠাঁই পাবে।
হিন্দুরাষ্ট্রের শত্রু তিনটি: মুসলমান, কম্যুনিজম ও খ্রিস্টান; এই ক্রমেই। ইতিবাচক দিকে বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল, ‘ধর্মের প্রদীপটিকে পুনর্বার সম্পূর্ণ ভাবে প্রজ্জ্বলিত করা। সেই সনাতন চিন্তা যা আমাদের ঋষিরা মানবসমাজের জন্য উত্তরাধিকাররূপে রেখে গেছেন, করুণা, সহযোগিতা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য এবং সহিষ্ণুতার ওপরে প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজব্যবস্থা।’ (১৯৯৬ নির্বাচনী ইশতেহার, পৃ. ১) মুসলমান-বিদ্বেষের ওপরে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সহযোগিতা, স্বাধীনতা, সাম্য ও সহিষ্ণুতার কতটুকু অবকাশ থাকবে তা অচিরেই আলোচিত হবে। ওই নির্বাচনী ইশতেহারই বলে, ‘সংখ্যালঘু কমিশন তুলে দেওয়া হবে, তার করণীয়গুলি রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশনের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (পৃ. ৫) ‘ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ ও বহিষ্কার করবে।’ (নির্বাচনী ঘোষণাপত্র ১৯৯১, পৃ. ১০) ‘ভারতীয় জনতা পার্টি এ-ও মনে করে যে হিন্দু শরণার্থী ও মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের এক চোখে দেখা চরম রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভণ্ডামি।’ (ঐ ১০) ‘ভারত আবার খণ্ডিত হতে পারে। বিদেশি অর্থে পুষ্ট হয়ে অধিকাংশ মুসলমান সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছে।’ (শিবপ্রসাদ রায়: ‘দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই’ পৃ. ২) বশিষ্ঠ আশ্রমের ড. রামবিলাস বেদান্তী বলেন: ‘খুন কা বদলা খুন সে লেঙ্গে। মুসলমানকো ভারতমে রহনেকা কোই হক নহী হৈ।’ ‘মুম্বই’-র স্বামী চিন্ময়ানন্দ বলেন, ‘মুসলমান ও খ্রিস্টানদের পৃথক সম্প্রদায় বলে আমরা স্বীকার করি না। ভারতবর্ষে কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই নেই।’ হরিদ্বারের স্বামী চিন্ময়ানন্দ বলেন, ‘পাকিস্তান নহী রহেগা, বাংলাদেশ নহী রহেগা। ফির দেখতে হৈ কি মন্দির বনায়েগা ইয়া মসজিদ রহেগা।’ এটি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে বলা। মুসলমান সম্পর্কে আতঙ্কের একটি কারণ হল, ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘ একটি সমীক্ষায় হিসাব কষে দেখিয়েছে, মুসলমানদের অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার এবং বিপুল অনুপ্রবেশ দু’হাজার সালের মধ্যে ভারতে হিন্দুদের সংখ্যালঘু করে দেবে। ভারতে হিন্দু সংখ্যালঘু হয়ে গেলে ভারত আর ভারত থাকবে?’ (ঐ পৃ. ৬) বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রসঙ্ঘের এমন কোনও সমীক্ষাই প্রকাশিত হয়নি। শেষ উক্তিটির প্রতিপাদ্য হল হিন্দুত্বই ভারতীয়ত্ব। ‘(নেতারা) শুধু মুসলমানদের তুষ্ট করে তোষণ করে। হিন্দু কোড বিল চালু রাখে। গোহত্যার পক্ষে কথা বলে। …রামের মন্দির ভেঙে বাবরের তৈরি মসজিদ বিলুপ্ত হলে সবাই বৎসহারা গাভীর মতো হয়ে যায়’ (ঐ পৃ. ১৭) বাবরি মসজিদ তা হলে ‘বিলুপ্ত’ হয়েছিল ভূমিকম্পে? রামের মন্দির যে ওখানে ছিল না, তা বহু প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক বলেছেন। যে-বাবার মৃত্যুর পূর্বে পুত্র হুমায়ুনকে শেষ চিঠিতে লিখে যান— ‘যে দেশে তুমি সম্রাট হবে সেখানে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে বাস করে। দু’জনকেই সন্তানবৎ দেখতে হবে তোমাকে’– সেই বাবরের নামের মসজিদ সম্পর্কে শুনি, দীর্ঘদিনের কলঙ্ক কালিমা বাবরি মসজিদ হিন্দুরা ধুলিসাৎ করে দিয়েছে।’ প্রসঙ্গত এই মসজিদ ধ্বংস হয় ৬ ডিসেম্বর, যেটি সংবিধানের রচয়িতা আম্বেদকরের জন্মতিথি। তাঁর সৃষ্ট বর্তমান সংবিধানে মুসলমান ও নিম্নবর্গীয় মানুষের সমানাধিকার আছে, যা বিজেপির কাছে অবাঞ্ছিত। (ঐ পৃ. ২৫) এ সম্বন্ধে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন যে তথ্য শোনা যায় তা হল, ‘‘৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে হাজার হাজার হিন্দুমন্দির ধ্বংস করা হল।’ (ঐ পৃ. ১১) কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে এই অবাস্তব উক্তির সমর্থন নেই। ‘হিন্দু কোড বিল তুলে দেবার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিন।’ কেন? হিন্দু বহুবিবাহে অধিকার পেলে ভারতবর্ষে হিন্দুর সংখ্যালঘু হবার আশঙ্কা থাকবে না, তাই; তারও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য শোনা গেল। পঞ্চাশ লাখ মুসলমান এবং পাঁচ লাখ খ্রিস্টান হিন্দুসমাজে ফিরে এসেছে। কবে? কেন?
গোলওয়লকর অনায়াসে লিখেছেন, ভারতবর্ষে দাঙ্গা মুসলমানরাই বাধায় (‘আ বাঞ্চ অব থটস’, পৃ. ১৬৭) অযোধ্যায় হনুমানসটির মোহন্ত তুলসীধারী সত্যভাষণেব ব্রতগ্রহণ করেছেন, কিন্তু পরিষ্কার বলেন হিন্দুশাস্ত্রে যে কোনও সময়ে মিথ্যা বলতে পারেন। মুসলমান গোহত্যার জন্যে পশুকে নিয়ে যাচ্ছে দেখলে অনায়াসে তার জন্যে মিথ্যা বলতে পারেন।
স্বামী মুক্তানন্দের সঙ্গে দুই গবেষকের অন্য একটি সাক্ষাৎকার ‘মেনস্ট্রীম’ পত্রিকায় ৩০ অক্টোবর ‘৯৩-তে প্রকাশিত হয়। তাঁর মত হল: ‘সব মুসলমানের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া উচিত। ভারতবর্ষে মুসলমানদের স্বতন্ত্র সত্তা রক্ষা করতে দেওয়া উচিত নয়। মুসলমানরা বলে যে, বাবর ও ঔরঙ্গজেবের নির্মিত মসজিদগুলি সংরক্ষিত হওয়া উচিত। এ কাজ ভারতবিরোধী… (এ দেশে) বহু জাত আছে, মুসলমান ও খ্রিস্টানরাও সেই রকম জাত হয়ে যেতে পারে। জাতিব্যবস্থার মধ্যে তাদের স্থান হবে।’ (ঐ পৃ. ১৬) ‘মুসলমান সাম্রাজ্যের সমস্ত অবশিষ্ট চিহ্ন নষ্ট করে দেওয়া উচিত… যা কিছু মুসলমান সাম্রাজ্যবাদের বর্বরতার পরিচয় সেই সমস্তই এ দেশ থেকে সরানো উচিত।… লালকেল্লা, কুতুবমিনার, ও জামা মসজিদের অনেকগুলিই হিন্দু রাজাদের দ্বারা নির্মিত ও পরে মুসলমানেরা ঘোষণা করে যে, এগুলি তারা নির্মাণ করেছে।’ (ঐ পৃ. ১৬) এখানেও মুসলমানদের হীন প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে যথেচ্ছ বিকৃত করা হয়েছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নীচ রুচির বিষোদগার করা হয়েছে। মুসলমান সংস্কৃতির অনেকটাই সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত, সে-সব শিল্পসংস্কৃতি দেশ থেকে লুপ্ত করে দিলে অধুনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্রকলায়, সঙ্গীতে কতটা দীন হয়ে যাবে তা কি এই সব ঘোরতর হিন্দুদের খেয়াল আছে?
সেই সাভারকারের (হিন্দুইজম, হু ইজ আ হিন্দু, ১৯২৩) সময় থেকেই হিন্দুত্বের তথা ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা ক্রমবিকশিত হয়ে গোলওয়লকর, বলরাজ মাধোক, বাল ঠাকরে, বালাসাহেব দেওরাস এঁদের মধ্যে পরিণতি লাভ করে এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হল, যার জন্মভূমি, কর্মভূমি এবং পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ, শুধু সেই হিন্দু। অতএব সে-ই রাষ্ট্রীয় অধিকার পাবে। অর্থাৎ মুসলমান, খ্রিস্টান ও কম্যুনিস্টরা ভারতীয় নয়, এদের জন্মভূমি, কর্মভূমি ভারতবর্ষে হলেও পুণ্যভূমি হল যথাক্রমে মক্কা-মদিনা, জেরুসালেম ও রাশিয়া (!) গোলওয়লকর বলেন, ‘এরা ভারতের বাইরে কোনও অঞ্চলকে পুণ্যভূমি মনে করে।’ (আ বাঞ্চ অব থটস, পৃ. ১২৮)।
‘মুসলমানদের তুষ্ট করার জন্যেই ‘বন্দে মাতরম’-এর কতকাংশ পরে বাদ দেওয়া হল।’ (ঐ পৃ. ১৪৯) শুধু মুসলমান কেন, খ্রিস্টান, পারসিক, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এঁরা কেউই দেশকে দুর্গাপ্রতিমা-রূপে ভক্তি জানাতে সম্মত হবেন না। কেনই বা হবেন? হিন্দুর পক্ষে যা কিছু গ্রহণযোগ্য, তার সবই বাকি সমস্ত ভারতীয়কে নিজেদের ধর্মীয় সংস্কার বর্জন করে মেনে নিতে হবে? এই জুলুমের নাম হিন্দুরাষ্ট্র? ঠিক এমনই কথা শুনি বিজেপি-র ধ্বনিতে জাকে পিয় ন রামবৈদেহী/তজিয়ে তহি কোটি বৈরি সম/যদ্যপি পরম সিনেহী।।’ মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখের কাছে হঠাৎ রামসীতা প্রিয় হয়ে উঠবেন কেন? এ সব কথা যারা বলে তারা ভুলে যায়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, যার প্রতি তাদের আনুগত্য থাকে। হিন্দু যখন অন্য ধর্মের আরাধ্য দেবতার প্রতি আনুগত্য দেখায় না বরং মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্বন্ধে বিষাক্ত বিদ্বেষ পোষণ করে, তখন তারা কেন রামসীতা নিয়ে উচ্ছ্বাস করবে, বোঝা যায় না!
মুসলমান বিদ্বেষের একটা প্রকাশ, ‘মহম্মদ ঘোরী থেকে দেশের নিদারুণ দুর্দশা শুরু হল।’ (‘অ বাঞ্চ অব থটস’, পৃ. ১২৬) এতে অনৈতিহাসিকতার সঙ্গেই আছে বিদ্বিষ্ট উদ্দেশ্য। এই মর্মেই গোলওয়লকর বলেন, ‘গত এক সহস্রাব্দ ধরে বিজাতীয়দের বিষাক্ত প্রভাব’, (ঐ পৃ. ১২৫) ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মুসলমান রাজত্বকালে ভারতবর্ষের নানাবিধ সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল এবং মহম্মদ ঘোরী আসার আগে যে ভারতবর্ষে স্বর্ণযুগ ছিল এমন সাক্ষ্য ইতিহাসে একেবারেই মেলে না। ভুলে গেলে তো চলবে না যে, ইংরেজ রাজত্বে যেখানে কোটি কোটি টাকা ভারতবর্ষ থেকে প্রতি বছর ইংলণ্ডে যেত রাজস্ব বাবদে ও অবসরপ্রাপ্ত বুড়ো বড়লাটদের তাদের স্বদেশে দুধকলা দিয়ে পুষতে (হোম চার্জেস), সেখানে মুসলমান রাজত্বে একটি পাই-পয়সাও আরবে, তুরস্কে যায়নি। এবং স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীত, চিত্রশিল্পে নতুন সংমিশ্রণে যে শৈলীর প্রবর্তন ঘটেছে তাতে যা সমৃদ্ধ হল তার নাম ভারতীয় সংস্কৃতি।
মুসলমান এ দেশে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছে, অবশ্যই সেই দীর্ঘকালে বেশ কিছু হিন্দু অত্যাচারিত হয়েছে, অনেক মুসলমানও নিপীড়িত হয়েছে, অবশ্যই কিছু মন্দির ভেঙে দিয়েছে কখনও কখনও অসহিষ্ণু মুসলমান রাষ্ট্রশক্তি। কিন্তু ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ যত বৌদ্ধ মঠ সঙ্ঘ বিহার এ দেশে দেখে গিয়েছিলেন তার অনেকগুলিই তো ধ্বংস করেছে হিন্দু রাষ্ট্রশক্তি। মন্দির বিগ্রহ নিয়ে আজ এত উচ্ছ্বাস, কাশ্মীরের হিন্দু রাজত্বের ইতিহাস লিখেছেন হিন্দু কবি কলহণ। তিনি লিখেছেন, একটি পদ ছিল সে রাজত্বে যার নাম ‘দেবকুলোৎপাটনায়ক’– মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙায় নিযুক্ত কর্মচারী। অর্থসংগ্রহের জন্যে হিন্দু কৌটিল্য হিন্দু রাজাদের পরামর্শ দিয়েছেন রাজকোষে অর্থাভাব ঘটলে বিগ্রহ গলিয়ে বিক্রি করার। নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে দেখলে সরষের মধ্যেই ভূতের সন্ধান পাওয়া যাবে। অবশ্য বিজেপির দৃষ্টি তো নিরক্ষেপ নয়ই, বলে-কয়েই তো হিন্দুত্বের দৃষ্টি।
মুসলমানদের একটি বিশেষ দোষ— সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টানদেরও— সে গোখাদক। এই কথা উচ্চারিত হচ্ছে ভারতবর্ষে যেখানে আর্যগরিমা অহরহ সগৌরবে কীর্তিত হচ্ছে। এই আর্যদের প্রধান খাদ্যই ছিল গোমাংস। গোমাংস ছাড়া যজ্ঞ হত না, আতিথ্য হত না। কারণ মধুপর্কে গোমাংস দেওয়ার রীতি ছিল অতিথিকে। বাড়িতে অতিথি এলে গোমাংস দিয়ে খাওয়ানো হত, যে কারণে অতিথির একটি প্রতিশব্দই ছিল ‘গোঘ্ন’, অর্থার যার জন্যে গোহত্যা করতে হয়। হিন্দু ভবভূতির লেখা নাটকে পড়ি, ‘ঐ আসছে ব্রাহ্মণেরা, আমাদের বাছুরটাকে কাটতে হবে।’ (উত্তররামচরিত, ৪র্থ অঙ্ক, সৌধাতকি ও ভাণ্ডায়নের সংলাপ)। তবে পৃথিবীর কোথাও গাভীমাংস খাওয়া হয় না, লোকে ষাঁড় ও বলদের মাংসই খায়। কাজেই গোমাংস ভক্ষণে গাভীর প্রাণ যায় না, ‘গোমাতা’ নিরাপদেই থাকে। একদা যে দেশে গোমাংস উপাদেয়বোধে খাওয়া হত (শতপথ ব্রাহ্মণে যাজ্ঞবন্ধ্যের মত), কৃষিতে যখন টান পড়ল ষাঁড় বলদের, তখনই সেখানে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করা হল। এই জন্যেই ওই সময়ে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে, যখন লোহার লাঙলের ফলার প্রবর্তনে অল্প সময়ে বেশি চাষ করা সম্ভব হল, তখনই যজ্ঞে শত শত বৃষ-বলীবর্গের অপচয়ে চাষের বলদে টান পড়ল এবং তখনই বৌদ্ধ, জৈন এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মে সর্বত্রই গোধন রক্ষার জন্যে অহিংসা ধর্ম প্রবর্তিত হল। আজ অধিকাংশ মুসলমান গোমাংস খায় অভাবে। কারণ এটিই শস্তায় তার প্রোটিনের উপাদান। তার থেকে তাকে বঞ্চিত করার জন্যে এই অমানবিক নিষ্ঠুর আন্দোলনের পিছনে ধর্ম নেই, আছে নির্মম অন্ধবিদ্বেষ
কথায় বলে, ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’, এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। বিদ্বেষ চরিতার্থ করার জন্যে তথ্য ঝেঁটিয়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার মতো। তা নইলে গোলওয়লকর কী করে বলেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে রক্তপাত, মৃত্যুবরণ ‘বিগত এক হাজার বছরের মধ্যে কেবলমাত্র হিন্দুই করেছে।’ (‘আ বাঞ্চ অব থটস’, পৃ. ১২৩) ১৮৫৮-র সিপাহী বিদ্রোহে বহু মুসলমান যে অকাতরে ভারতবর্ষের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন, সে কথা ইতিহাসের নথিপত্রে এত সুপ্রতিষ্ঠিত যে, আজ তাকে অস্বীকার করতে পারে মূর্খ কিংবা অন্ধ মুসলমান-বিদ্বেষী। মুসলমান দেশপ্রেমিক যাঁরা এ দেশের জন্যে শহিদ হয়েছেন, ইংরেজ সরকারের মহাফেজখানায় তাঁদের বিস্তর নাম পাওয়া যায়। অল্প কিছু উল্লেখ করা যায়। ১৮৩১ তিতুমীরকে বেয়নেট পুড়িয়ে তাই দিয়ে মারা হয়, ওই বছরেই গোলাম মাসুমকে শূলে দেওয়া হয়। আগে ১৯২০-তে বার্লিনে ব্রিটিশ এজেন্ট দোষারোপ করে বরকৎ-উল্লা ভোপালীর প্রাণদণ্ড হয়। ওই দশকেই আয়েদুল্লা প্রাণ দেন। ১৯২১-এর কংগ্রেসে প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেন মৌলানা হসরৎ মোহানি। প্রথম মোপলা আন্দোলনে ১৯২২-তে দেশের জন্যে প্রাণ দেন আলি মুসলিয়া, ১৯২০–২৩-এ প্রাণ দেন আকবর শাহ, রফিক আহমেদ। ফজল ইলাহি কুরযানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি হয় আসফাক উল্লার ১৯২৪-এ। ১৯৪৬ আবিদ হোসেন নেতাজির সহচর থেকে সাবমেরিনে প্রাণ দেন। এরও আগে ১৭৬১–১৮০০ সালের মধ্যে ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহে শহিদ হন মুসা শাহ (১৭৭৬) মজদুর শাহ ফকির (১৭৮১)। এর পরে নাম পাই আবদুল খান, হাবিলদার রহমাত আলি, সেপাই হাকিম আলি ও চিশতি খানের। সুবাদার দণ্ডে খানকে ২৩ মার্চ, ১৯১৫-য় কোর্ট মার্শালে গুলি করে মারা হয় শ্রীরামপুর জেলের বাইরে, কারণ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইনি বিদ্রোহ করেছিলেন। আবদুল্লাহ নামে একজনের ফাঁসি হয় আম্বালা জেলে ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫-এ। আবদাল্লাহ শফিজ নামের একজনের ফাঁসি হয় লাহোর জেলে ২৯ মার্চ। আবদুল রশিদের ফাঁসি হয় ১ সেপ্টেম্বর পেশোয়ার জেলে। আবদুল রসুল কুরবান হোসেনের যারবেদা জেলে ফাঁসি হয় ১২ জানুয়ারি ১৯৩১। ২২ মার্চ ১৯১৫-এ আবদুল রেজাক খানকে সিঙ্গাপুর জেলে গুলি করে মারা হয়। ১৯০৪ সালে ফাঁসি হয় আফজল খানের, আলি আহমেদ সাদিকের প্রাণদণ্ডাজ্ঞা হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯১৭, পরে সেটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত হয়েও এঁকে আন্দামানে পাঠানো হয়। আলি ইমতিয়াজকে গুলি করে মারা হয় ২২ মার্চ ১৯১৫-এ সিঙ্গাপুর জেলে। হাবিলদার সুলেমান নায়েক, মুন্সীখান নায়েক, জাফর আলি প্রভৃতির কোর্ট মার্শাল হয় ২ মার্চ ১৯১৫ সিঙ্গাপুর জেলে। আবদুল কাদিরকে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩-এ মাদ্রাজে ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রতীম খানকে আন্দামানে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯৩০ সালে। মনসুর কাশিম ইশমাইলকে ১৯১৫-র জুন মাসে সিঙ্গাপুরে ফাঁসি দেওয়া হয়। মহম্মদ মুজতবা হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হয় ৬ জুলাই ১৯১৭ সালে। তালিকা বিস্তর বাড়ানো যেত, কিন্তু যেটুকু দেওয়া হল তাতেই কি বোঝা যায় না যে, বহু দেশপ্রেমী মুসলমান এই ভারতভূমির জন্যই প্রাণ দিয়েছেন? অথচ আজ ভারতবর্ষের প্রতি মুসলমানের আনুগত্যকে প্রশ্ন করা হচ্ছে; তাঁরা প্রত্যক্ষ বা গৌণ ভাবে দেশদ্রোহী। এবং মাতৃভূমির জন্যে এত মুসলমান শহিদ হবার পরেও এদেশ মুসমানের মাতৃভূমি হল না, মুসলমানরা ভারতীয় বলে স্বীকৃতি পেলেন না। কারণ তাঁরা হিন্দু নন। ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় ১৯১৭-এর ২০ জুন লেখা হয়েছিল, ‘মুসলমানরা রামকে তাদের নায়ক বলে স্বীকার করলেই সব সমস্যা শেষ হয়ে যাবে।’ কিন্তু কেন মুসলমান রামকে নায়ক বলে স্বীকার করবে? ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কোনও অহিন্দুকে সভ্যপদ দিতে অস্বীকার করে। আজ শেয়ালপণ্ডিতের কুমিরছানা দেখানোর মতো নিজেদের দলে দু’-চারজন মুসলমানকে স্থান দিয়ে বিজেপি প্রমাণ করতে চায় যে, তারা অসাম্প্রদায়িক।
মুসলমান সম্বন্ধে বিজেপির কর্মপন্থা কী? দেশ থেকে বিতাড়ন ও হত্যা। এদের বাণী হল, ‘রণচণ্ডী খালি খপ্পর লিয়ে গলিগলি বিরাজ রহী হ্যায়।’ এদের আফশোস হল, ‘যে-কোনো হিন্দুবাড়িতে এক দঙ্গল ঠাকুর দেবতা আছেন। একগাছা লাঠি নেই।’ (শিবপ্রসাদ রায়, দিব্যজ্ঞান হয়, কাণ্ডজ্ঞান চাই, পৃ. ১৩) একগাছা লাঠির উদ্দিষ্ট শিকার কে, সে বিষয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ এরা রাখেনি। ১৯৯০-এর অক্টোবর থেকেই অযোধ্যার মন্দিরগাত্রে, ফৈজাবাদের বাড়ির পাঁচিলে লেখা দেখা যাচ্ছিল, ‘গো-ঘাতককে হত্যা করা হিন্দুর আবশ্যিক ধর্মীয় কর্তব্য।’ কাজেই মুখে যতই বলা হোক না ‘হিন্দুরাষ্ট্রকে হতে হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’, (সুহাস মজুমদার, ‘যারা বলে আমরা ‘হিন্দু’ নই আমরা মানুষ’, ১৯৯৩, পৃ. ৪২) কার্যত গণতন্ত্রের প্রথম অঙ্গীকার— সমস্ত নাগরিকের সমান অধিকার— তা স্বীকার করার সাধ্যই এদের নেই। ওই বইয়ের ওই পৃষ্ঠাতেই আছে ‘ন্যূনতম লক্ষণের হিন্দুরাষ্ট্র হচ্ছে হিন্দুরক্ষার রাষ্ট্র’। যে-দেশে শতকরা পনেরোজন মানুষ মুসলমান, সে দেশে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে তা আর যা-ই হোক গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র প্রবর্তন করা এদের সাধ্যের বাইরে। কারণ সেটা তাদের লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। আজ পৃথিবীতে গণতন্ত্র সর্বত্রই প্রশংসিত, তাই দেশবাসীকে যে মিথ্যাটি দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা হল গণতন্ত্র প্রবর্তন করার ভণ্ড অঙ্গীকার।
যে মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে এদের এত তীব্র বিষাক্ত বিদ্বেষ, বাস্তবে ভারতবর্ষে তাদের অবস্থানটা অনুধাবন করলে সমস্ত বিষয়টা হাস্যকর মনে হবে। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত এনএসএস-এর গোপাল সিং কমিশনের রিপোর্টে দেখি, এ দেশে মুসলমানদের ৫২.৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন, এঁদের গড় মাসিক আয় মাসে ১৫০–১৬০। এঁদের মধ্যে ৫০.৫ শতাংশ অশিক্ষিত, শতকরা চারজন মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাপ্রাপ্ত, শতকরা ৪.৪ জন সরকারি চাকরি করেন, সরকারি অনুদান পান শতকরা ৩.৭ জন। শিল্পক্ষেত্রে সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পান শতকরা পাঁচজন, সরকার থেকে ঋণ পান শতকরা দু’জন। ১৯৪৭ সালে প্রতিরক্ষা বিভাগে মুসলমান ছিলেন শতকরা ৩২জন। এখন শতকরা দু’জন মাত্র। এই যাঁদের আর্থসামাজিক, শিক্ষা, উপার্জন ও বৃত্তিগত অবস্থা, তাঁদের কাছ থেকে আশঙ্কার কী থাকতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ, বিত্তগরিষ্ঠ, শিক্ষাগরিষ্ঠ ও সরকারের প্রসাদপুষ্ট হিন্দুর? কাজেই বাধ্য হয়েই বলতে হয়, সব মুসলমানদের চারটি করে স্ত্রী ও অগণ্য সন্তান! তাই বলতে হয় যবন-সর্পরা অসহযোগিতার দুগ্ধে পুষ্ট হয়ে তাদের তীব্র বিষনিঃশ্বাসে এ দেশের দিকে দিকে দাঙ্গায় উসকানি দিচ্ছে। মুসলমানদের দরগাগুলি তিরুপতির কায়দায় সরকারি ট্রাস্ট বোর্ড-এর আওতায় আনতে হবে এমন কথা বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহার (১৯৯৬)-এ বলেছে। (পৃ. ৯) এতে অবশ্যই মুসলমানের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে।
আক্রোশ শুধু মুসলমানের বিরুদ্ধে নয়— কম্যুনিজমের ওপরেও। বস্তুত কম্যুনিজম সঙ্ঘ পরিবারের এবং প্রধানত বিজেপির কর্মপ্রণালী ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে— সচেতন ভাবে, নীতিগত ভাবে। ফলে কম্যুনিজমকে এরা জীবিত ব্যক্তিশত্রুর মতো মনে করে। পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে এদের প্রগাঢ় হতাশা। কারণ ‘প্রায় পঞ্চাশ বছরের কংগ্রেসি এবং বামপন্থী অবহেলায় ও অপশাসনে পশ্চিমবঙ্গ আজ জর্জরিত, অবসাদগ্রস্ত এক কুৎসিত অবস্থায় পতিত।’ (ভারতীয় জনতা পার্টির ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ঘোষণাপত্র পৃ. ৬) সুহাস মজুমদার তাঁর পুস্তিকায় বলেছেন, ‘ওই দুই প্রতিষ্ঠানই (প্যান ইসলাম ও মিশনারি খ্রিস্টানি) যেহেতু নেহরু মার্ক্সবাদী, কাজেই নেহরু মার্কসবাদকেই হিন্দুর চরমতম অভিশাপ বলা যায়।’ (পৃ. ৭) নেহরু নিজেকে মার্কসবাদী বলতেন না, মার্কসবাদীরাও কখনও তাঁকে সহযাত্রী মনে করেনি। কিন্তু এখানে যেটা মুখ্য বক্তব্য তা হল, মার্ক্সবাদ হিন্দুত্বের পক্ষে চরমতম অভিশাপ। কেন? কারণ, এই বস্তুবাদী দর্শন যে ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখে সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রিক সংহতি ধর্মের ওপরে নির্ভর করে না, এবং রুটি-রুজির সংগ্রাম ও যথার্থ মানসিক বিকাশ ওই রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক অঙ্গীকার। বিজেপি সুহাস মজুমদারের জবানিতে বলে, ‘এ দেশের সভ্যতা সংস্কৃতির প্রধান শত্রুর এ দেশে হিন্দুত্ব নয়— কোনও কালেই তা ছিল না— আসল শত্রু হচ্ছে বামপন্থী nihilism, মিশনারি খ্রিস্টানি আর জেহাদি ইসলাম।’ (পৃ. ১৩) এই প্রসঙ্গে গোলওয়লকরের বক্তব্য আরও সূক্ষ্ম। তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতীয় সমাজ দর্শনের আর একটা সুবিধা হল যে, এটি শ্রেণিসংগ্রামকে সম্পূর্ণ পরিহার করে।’ (‘আ বাঞ্চ অব থটস’ ভূমিকা, পৃ. ৩২) এর কারণ হল, ‘যখন বিশ্বাস চলে যায়, তখনই কম্যুনিজম আসে।’ (ঐ একই অনুচ্ছেদের শিরোনাম, পৃ. ১৮৯) অর্থাৎ, কম্যুনিজম কোনও বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েই নেই। যেন ঈশ্বর-বিশ্বাসই একমাত্র বিশ্বাস, মানুষ ও মানুষের সংহত চেষ্টায় নূতনতর উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষমতায় বিশ্বাস কোনও বিশ্বাস নয়। শ্রেণিসংগ্রামকে সম্পূর্ণ পরিহার করা হিন্দু-ভারতীয় সমাজদর্শনের বৈশিষ্ট্য। সমস্ত প্রাচীন সমাজদর্শনেই তো শ্রেণিসংগ্রাম সম্বন্ধে সচেতনতার অভাব দেখা যায়; এখানে ভারতীয় সমাজদর্শনের কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। আসলে শ্রেণিসংগ্রামকে সযত্নে পরিহার করে দেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থাকে রক্ষা করাই এদের উদ্দেশ্য। সাধারণ মানুষ যাতে চিরদিনই নির্যাতিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকে সে বিষয়ে এরা দায়বদ্ধ। কারণ সুবিধাভোগী শ্রেণি বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্রপরিমাণ ভূমি দরিদ্রকে দান করবে না। এ বিষয়ে বিগত পাঁচ-ছ’হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বিধাহীন। কম্যুনিজম যাদের জন্যে সংগ্রামে প্রবৃত্ত, তারা এ রাষ্ট্রপরিকল্পনায় অবহেলিত। যদিও মাঝে মাঝে বিজেপি বলে, সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটবে তাদের হিন্দুরাষ্ট্রে, তথাপি কী উপায়ে সে উন্নতি ঘটবে সে সম্বন্ধে এরা সম্পূর্ণ নীরব। এবং মার্ক্সবাদীরা এ সম্বন্ধে শুধু সরব নয়, সক্রিয়। কাজেই এ রামরাজ্যে রাবণ মার্ক্সবাদ, সে কথা এদের বই, প্রচারপুস্তিকা, গণমাধ্যম, চলচ্চিত্র সবেতেই সুস্পষ্ট ভাবে বিবৃত।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়টি ছোট, জনসংখ্যায় মাত্র চার শতাংশ, কিন্তু বিজেপির দৃষ্টিতে তারাও প্রতিপক্ষ, দেশের শত্রু, প্রধানত মিশনারিরা, হিন্দু ও উপজাতিদের ধর্মান্তরিত করে থাকেন বলে। সুহাস মজুমদার তাঁর পূর্বোক্ত বইতে লেখেন, ‘খ্রীস্টধর্ম প্রতিবেশী সম্বন্ধে শিখিয়েছে ভ্রূক্ষেপহীন বেইমানির অভ্যাস।’ (পৃ. ৩৮) ‘রঙরুটি ধর্মগুলির রঙরুটের ব্যবসা ঐ রাষ্ট্র (হিন্দুরাষ্ট্র) নিবারণ করবে।’ (পৃ. ৪৪) ‘একেশ্বরবাদের মতো বিধর্মীগ্রাসী ধর্মকে বৈষ্ণব শৈব, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি বহুদেবকে ধর্মের সঙ্গে সমান ভাবে দেখার ফল অতি বিষময়।…. একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে একটা সারা দেশজোড়া বিচারের লড়াই খাড়া করা অত্যাবশ্যক।’ (পৃ. ৫৩) ‘আজকের ভারতে গণতন্ত্রের পরম শত্রু হচ্ছে একেশ্বরবাদ।’ (পৃ. ৫৫) গোলওয়লকর উল্লিখিত বইতে লেখেন, ‘মুসলমান খ্রিস্টান ধর্মান্তরণের পরে এ দেশকে দেশ বলে মনে করে না।’ (পৃ. ১২৭) মধুসূদন দত্ত, রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রেভারেণ্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং অখ্যাত আরও অনেক অনেক খ্রিস্টান ছিলেন ও আছেন যাঁরা সম্পূর্ণতই দেশপ্রেমিক। খ্রিস্টান ডিরোজিও-র রচিত মাতৃভূমি-তে ভারতের স্তবের কথা মনে পড়ে। গোলওয়লকর ওই বইয়ের অন্যত্র লিখেছেন, ‘প্রকৃত ধর্মে অন্যকে ধর্মান্তরিত করার কোনও প্রয়োজনই থাকে না।’ (পৃ. ১৮১) খ্রিস্টান মিশনারি এখনও ধর্মান্তকরণ করে থাকে এ তারই প্রতিবাদ, যেমন মুসলমান সাম্রাজ্যে জোর করে ধর্মান্তকরণের বহু নজির ছিল। কিন্তু বহু খ্রিস্টান (ও পূর্বে মুসলমানও) স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তার মধ্যে কখনও কখনও বৈষয়িক উন্নতির প্রলোভন ছিল, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষেত্রে ছিল হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রধায় নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদ। এঁরা স্বেচ্ছায় জাতিবাদহীন সমাজে এসে জন্মসূত্রে পাওয়া নিম্নবর্ণ বা অন্ত্যজের কলঙ্ক ও তার জন্য অমানবিক অত্যাচার থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। এই সেদিনও বহু হিন্দু বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করেছেন। বিজেপি জাতিভেদ-প্রথা থেকে আজ নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে, কিন্তু জাতিভেদ যে হিন্দুধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত তা তো অস্বীকার করা যায় না। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু দু’টি সম্প্রদায় মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্বন্ধে বিজেপির শুধু অসহিষ্ণুতা নয়, বিদ্বেষ রয়েছে। আর্যসমাজ অহিন্দুকে আর্য-হিন্দুতে ধর্মান্তরিত করে থাকে, তাদের সম্বন্ধে বিজেপি নীরব। বিজেপি নিজেও কি অহিন্দুকে সংস্কারের দ্বারা হিন্দুতে পরিণত করে না?
এই যে বহুবিঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র, এর মূল চরিত্র হল রাম— এই রামের কল্পিত জন্মস্থান অযোধ্যায় কল্পিত হিন্দুমন্দির বিনষ্ট করে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভাঙা এদের একটি অক্ষয় কীর্তি। ভারতবর্ষে সব প্রদেশেই সুদীর্ঘকালের প্রথা, সন্তানসম্ভবা নারী অন্তত প্রথম সন্তানের জন্মের পূর্বে পিতৃগৃহে যান। সেই প্রথা অনুসারে কৌশল্যা কোশলরাজগৃহে গিয়েছিলেন, রাম জন্মেছিলেন সেখানেই, অযোধ্যায় নয়। তবু ভাঙল বাবরি মসজিদ। কারণ পঞ্চাশ বছর আগে রামলালার একটি মূর্তি কৌশলে মসজিদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করানো হয়, তদবধি ওটি অংশত রামমন্দির। মসজিদের উপাসনার সঙ্গে সহাবস্থান করছিলেন রামলালা, হঠাৎ একদিন এই সহাবস্থানে ভক্তদের সহিষ্ণুতা টলে গেল। ভাঙতে হল ছ’শো বছরের পুরনো মসজিদ, সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে শাবল গাঁইতি চালিয়ে। বিজেপি মন্দিরে, দোকানে, পুস্তিকায়, বিজ্ঞাপনে, গণমাধ্যমে যে রামের মূর্তি প্রধান ভাবে পাওয়া যায় তা হল বালক কিশোর রাম, (রামলালা) আর ধনুর্ধর রাজা রাম। বিজেপি সমাজে যে কিশোরবাহিনী নির্মাণ করে এক বিপুল সৈন্যদল সৃষ্টি করছে তাদের প্রতিভূ ওই রামলালা এবং সে শক্তির বিমূর্ত আদর্শায়িত রূপ হিন্দুরাষ্ট্রের কেন্দ্রশক্তির প্রতিভূ ওই ধনুর্ধর রাজা রাম। বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার পরিষদ সেনার নাম ‘ভগবান রাম কি সেনা।’ কিশোরবাহিনী রোজ সকালে বিজাতীয় পোশাক, খাকি হাফপ্যাণ্ড, পরে কুচকাওয়াজ করে থাকে, পরে কিছু তত্ত্বকথা শোনে এবং অবশেষে ভাগোয়া ঝাণ্ডার নবতর রূপ যা বিজেপির পতাকা, তাকে নমস্কার করে। লক্ষণীয়, এরা মুখে সিয়ারাম বললেও রাম-সীতার যুগ্মমূর্তিকে এরা আমল দেয় না কোথাও। রাষ্ট্রসেবিকার কোনও ভাবমূর্তি স্বীকৃত নয়। মনে পড়ে, অশ্বমেধ যজ্ঞকালে রামেরও সীতাকে দরকার পড়েনি, সোনার পুতুল গড়েই কাজ চলেছিল।
এ ব্যাপারটা খুবই মিলে যায় রামের জীবনের সঙ্গে। বিজেপি রামকে বলেছে, ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যে-হিন্দুরাষ্ট্র রামরাজ্যরূপে বহুধা-বিঘোষিত, তার তিনটি মূল স্তম্ভ যা বিজেপির ধ্বনিতে বিজ্ঞাপনে জনসভার আবেদনে শোনা যায়— রাম, রোটি, ইনসাফ, অর্থাৎ রাম, খাদ্য আর ন্যায়বিচার। খাদ্য-উৎপাদন ও বণ্টন সম্বন্ধে এদের নিজস্ব কোনও বক্তব্য নেই। আগেই দেখেছি, কংগ্রেসের বন্ধ্যানীতিরই অনুসরণ, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি, বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে আমন্ত্রণ জানানো এই সবই বলে এরা। ইনসাফ বা ন্যায়বিচার সংযুক্ত আছে রামরাজ্যের কেন্দ্রচরিত রামের সঙ্গে। সেখানে নারীপুরুষ জাতিধর্ম নির্বিচারে ন্যায়বিচার কে কতটা পাবে তা পরবর্তী রামচরিত্র-বিশ্লেষণে অনেকটা স্পষ্ট হবে। এরা বলে ‘রাম হল ভয়মুক্তির ডাক। আশপাশের শত্রুভাবাপন্ন দেশের চক্রান্তে যখন দেশ দ্বিতীয়বার ভাগের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তখন ভারতের একতার প্রতীক শ্রীরামচন্দ্রের নাম এই ভাগে ভয় দূর করবে। অপশাসন থেকে, মুক্তিই রামরাজ্য। কংগ্রেসি-কম্যুনিস্ট রাজত্বে এতদিন ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যে সর্বনাশ চলছে ন্যায় তারই মুক্তির ডাক।’ (পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনী ইশতেহার, ১৯৯৬, পৃ. ১৫) ভারতের কোন ধরনের একতার প্রতীক রাম? যেখানে অহিন্দু শতকরা ত্রিশজনেরও বেশি (মুসলমান পনেরো শতাংশ, খ্রিস্টান প্রায় পাঁচ শতাংশ এবং উপজাতীয় অহিন্দু শতকরা বারোজন), সেখানে তারা, অহিন্দুরা কেন রামকে ভারতীয় একতার প্রতীক বলে মেনে নেবে? ভয়মুক্তি? বামফ্রন্টের শাসনের ভয় থেকে মুক্তি, যে মুক্তি দেশকে উত্তীর্ণ করে দেবে স্বার্থসংকীর্ণ হিন্দুদের হাতে? এই রামই যখন প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রের কেন্দ্রচরিত্র, তখন এ চরিত্র কিছু বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে; রামায়ণে রামের কিছু কিছু কুকীর্তির সাফাই গাইতে হয়েছে।
গোলওয়লকর রামের শক্তি শৌর্য সম্বন্ধে পঞ্চমুখ। কিশোরবাহিনী কুচকাওয়াজ ও শরীরচর্চা করে রামের শৌর্য অর্জন করবে। ‘অ বাঞ্চ অব থটস’-এ পড়ি, ‘মানবজীবনের উচ্চতম আদর্শ ধারণ করেছিলেন রাম, এটি এবং শক্তিকে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া, একটি চরিত্রের এই দুটি দিক মিলেই তাঁকে মর্যাদা পুরুষোত্তমে পরিণত করেছে।’ (পৃ. ২৫১) তাড়কা নারী, তাকে হত্যা করা স্ত্রীহত্যা যা শাস্ত্রে গর্হিত, সে সম্বন্ধে গোলওয়লকর লেখেন, ‘রাক্ষসীকে বধ করলে স্ত্রীহত্যা হয় না।’ আড়ালে থেকে বালীকে বধ করা ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে হীনতা, সম্মুখসমরে বধ করতে পারতেন না এ কথাই প্রকারান্তরে স্বীকৃতি পেল। সে সম্বন্ধে গোলওয়লকরের উক্তি, শত্রু হিসেবে রণনীতি নিরূপিত হয়।… ছলে-বলে-কৌশলে জয়ই দরকার।’ (পৃ. ২৬৫-৬৬) এ ছাড়া রামের যেটি সবচেয়ে বড় অপরাধ, সম্পূর্ণ নির্দোষ, সম্পূর্ণ সচ্চরিত্রা স্ত্রীকে তিনবার প্রত্যাখ্যান করা, সে সম্বন্ধে বিজেপি নীরব। মর্যাদা পুরুষোত্তম বলে মেনে নিলে তার দোষ বোধহয় আর দোষ থাকে না। লঙ্কায় অযোধ্যায় প্রজা একজনও ছিল না, সেখানে নিষ্ঠুর মিথ্যাবাক্যে রাম সীতাকে ত্যাগ করবার সময়ে যা বলেছিলেন, সে সম্বন্ধে বাল্মীকি বলেন— হৃদয়ান্তর্গত ভাব তিনি বলতে উদ্যত হলেন। সে পরুষ বাক্য শুনে সীতা জীবনে বীতস্পৃহ হয়ে লক্ষ্মণকে চিতা প্রস্তুত করতে বললেন, রামের বিশ্বাস হারিয়ে বাঁচতে চান না বলে। ওই অগ্নিপ্রবেশ মৃত্যুবরণেরই আয়োজন, কোনও মতেই তাকে অগ্নিপরীক্ষা বলা যায় না। পরে দেবতারা তাঁর চরিত্র নিষ্কলঙ্ক ঘোষণা করলে রাম সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেন, ‘আমি জানতাম সীতা নির্দোষ, লোকের বিশ্বাসের জন্যেই সীতাকে বাধা দিইনি। কোন লোক? অযোধ্যার প্রজা সেখানে লক্ষ্মণ ছাড়া কেউই ছিল না এবং লক্ষ্মণ সীতার নিষ্কলুষতায় বিন্দুমাত্র সন্দিহান ছিলেন না। পরে অযোধ্যায় সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ‘সাধপূরণের জন্যে বনে পাঠাচ্ছেন’ এমন মিথ্যা বলে সীতাকে শেষ বিদায় দিলেন লোকরঞ্জনের আশায়। বিবাহের সময়ে সীতার প্রতি কিছু কিছু নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করেছিলেন, ভেসে গেল সে-অঙ্গীকার। পরে লবকুশের গান শুনে সীতাকে সভায় আনিয়ে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। তখন ঋষি বাল্মীকি শপথ করে বললেন, ‘জ্ঞানে কখনও মিথ্যা বলিনি। আমি সহস্র সহস্র বছর কঠোর তপস্যা করেছি। সীতা যদি নিষ্পাপ না হন, তা হলে যেন সে সব পুণ্যের কোনও ফল না পাই।’ বাল্মীকি সারা অযোধ্যার অত্যন্ত সম্মানিত ঋষি, তাঁর কথা শুনেও রামের সাহস হল না সীতাকে নির্দোষ বলে স্বীকার করতে। এ বার সীতা সমস্ত নারীজাতির প্রতিভূ হয়ে পরীক্ষা না দিয়ে শপথবাক্য উচ্চারণ করলেন, ধরিত্রী দেবী তাঁর অনুরোধমতো তাঁকে নিয়ে অদৃশ্য হলেন।
প্রস্তাবিত রামরাজ্যে এই হল নারীর স্থান। ‘পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই/তবে মেয়ের গুণ গাই।’ ভিত্তিহীন সন্দেহে বারবার নিষ্পাপ স্ত্রীকে ত্যাগ করা চলে মর্যাদা পুরুষোত্তম পদে উন্নীত হলে।’ সন্দেহ থেকেই গিয়েছিল বোধহয়, কারণ, রামায়ণ বলে অযোধ্যার সিংহাসন লবকুশকে দেননি রাম, দিয়েছিলেন ভরতকে। এ ছাড়াও আর্য সমাজের বাইরে দু’টি চরিত্রের সঙ্গে রামের আচরণ খুব অর্থবহ। বনে যাবার সময় ‘বন্ধু’ গুহক তাঁদের খাবার দিলে রাম প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমরা ফলজল খেয়েই থাকব, কারণ এখন আমরা বনবাসী, তুমি ঘোড়াগুলোকে খাবার দাও।’ অথচ বনে থাকবার সময়ে ভরদ্বাজ, অত্রি ইত্যাদি ঋষির আতিথ্য দিব্যি নিতে পেরেছিলেন। অতএব সিদ্ধান্ত একটাই: বন্ধু হলেও গুহক চণ্ডাল, তাই তার দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করা গেল না। আর শম্বুক সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার জন্যে তপস্যা করছে জেনে তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেললেন রাম। কারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের নাকি এই পাপের জন্যেই অকালমৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ রামরাজ্যে ব্রাহ্মণের প্রাণের বাজারদর চণ্ডালের প্রাণের চেয়ে বেশি।
যে রামরাজ্য প্রবর্তনের জন্যে এত তৎপর বিজেপি, সেখানে প্রতিপক্ষকে আড়াল থেকে মারা যায়, চণ্ডালের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করা যায়, উচ্চাভিলাষী চণ্ডালকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা যায় এবং নারী সম্পূর্ণ নির্দোষ হলেও বারবার প্রকাশ্যে তাকে অপমান এবং প্রত্যাখ্যান করা যায়। এমন রাষ্ট্র সমাজের নিপীড়িত নিম্নবর্গ এবং সমগ্র নারীজাতির পক্ষে প্রচণ্ড আতঙ্কের। আজ চণ্ডালের স্থান নিয়েছে মুসলমান, খ্রিস্টান ও কম্যুনিস্ট, কিন্তু নারীর অবনমন ও অবদমন অব্যাহতই আছে।
এই রাষ্ট্র প্রবর্তনের জন্যে প্রবাসী ভারতীয়দের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগৃহীত হচ্ছে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনী ইশতেহার বলে, ‘কোটি কোটি প্রবাসী ভারতীয়দের বিজেপি দেশের সম্পদ বলে বিবেচনা করে। প্রবাসী ভারতীয়রা যাতে এ দেশে প্রভূত পরিমাণ অর্থ লগ্নি করে, সে জন্যে পরিকল্পনা করা হবে। দুই দেশের নাগরিক হওয়ার বিষয়টি বিজেপি পুনর্বিবেচনা করবে।’ (পৃ. ১২) ‘ভারতীয় জনতা পার্টি নিজের সম্পদের ব্যবস্থা করেছে— মানুষ এবং সম্পত্তি— যার দ্বারা সরকারি ঔদাসীন্য ও সন্ত্রাসবাদীদের অত্যাচারের প্রতিকার করা যায়।’ (ঐ পৃ. ৬৬) আমেরিকা ও ইয়োরোপ থেকে কোটি কোটি ডলার সঙ্ঘ পরিবারের নানা সংস্থায় নিয়মিত ভাবে এসে পৌঁছচ্ছে। ওদের নানা পত্রিকায় এ-সম্বন্ধে বিস্তর খবর থাকে। ড. এস আর কুলকর্ণী সম্পাদিত দিল্লির পুসা রোডের অফিস থেকে প্রকাশিত ‘হিন্দুইজম টু-ডে’ পত্রিকাটি ন’টি দেশের পাঁচ-ছ’টি ভাষায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। গ্রাহক সংখ্যা ওদের বয়ানে ‘প্রায় একশো কোটি’ প্রবাসী ভারতীয়দের বোঝানো হয়েছে ভারতবর্ষে হিন্দুত্ব বিপন্ন হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন আশু প্রয়োজন, অযোধ্যায় রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ, অন্যত্র রামমন্দির স্থাপন বারাণসী, বৃন্দাবন, মথুরায় ‘মুসলমান-অধিকৃত’ মন্দিরগুলির পুনরুদ্ধার, শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান ও কম্যুনিস্টদের সঙ্গে প্রয়োজনমতো দাঙ্গা ও লড়াই (যেমন মিরাট, মালিয়ানা, ভাগলপুর, আহমেদাবাদ, মুম্বই, বারাণসী ও কানপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে) ঘটাবার জন্যে সুশিক্ষিত সৈন্যদল ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন— অতএব প্রবাসী ভারতীয়রা যেন মুক্তহস্তে এই পুণ্য উদ্যমের জন্যে অর্থসাহায্য করেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা অকৃপণ ঔদার্যে তা করছেন। ফলে বিজেপি বৈদেশিক ও প্রবাসী ভারতীয়দের অর্থে পুষ্ট ও বিপুল ধনের অধিকারী। হিন্দুরাষ্ট্রের সম্ভাবনা আজ যতই কাছে আসছে, ততই এর আতঙ্ক বাড়ছে এবং প্রায়-ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিরোধ আজ প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠছে।