হিন্দুধর্ম ও অন্যান্য ধর্ম
ধর্মের দুটো দিক আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিশ্বাসের দিক, আর একটি হচ্ছে আচার-অনুষ্ঠানের দিক। এই উভয় দিক থেকেই হিন্দুধর্মের সাথে অন্যান্য ধর্মের বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বোঝা যায় হিন্দুধর্মের তুলনায় অন্যান্য ধর্ম অনেক বেশি সমরূপী (ইউনিফরম) বা একমুখী। বিপরীতে হিন্দু একমুখী তো নয়ই বরং বৈচিত্র্যময়। দু’একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন হিন্দুরা পঞ্চোপাসক বা পাঁচ দেবতার পূজারী (শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, বৈষ্ণব ও সৌর) বলে পরিচিত। একেক জন একেক দেবতাকে পূজা করে আবার অনেক হিন্দু আছে যারা পূজাতে বিশ্বাস করে না। দেখা যায় তাদের একজন একেশ্বরবাদী তো, আর একজন বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী। আবার তাদের মধ্যে নিরীশ্বরবাদীর সংখ্যাও প্রচুর। অন্যদিকে বেদ ও গীতাকে হিন্দুদের কেউ কেউ ধর্মগ্রন্থ মনে করে। কিন্তু অগণিত হিন্দু বেদ-গীতাকে ধর্মগ্রন্থ বলে স্বীকারই করে না। এই গেলো বিশ্বাসের দিক।
বিশ্বাসের দিক বাদ দিলে বাকি থাকে আচার-অনুষ্ঠানের দিক। আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দেখা যায় হিন্দু বৈচিত্র্যময়। কিছু কিছু অনুষ্ঠান সাধারণভাবে পালিত হয় বটে! কিন্তু প্রচুর সংখ্যক অনুষ্ঠান রয়েছে যেগুলো স্থান ও সম্প্রদায় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানে অন্যান্য ধর্মের অবস্থা কিন্তু হিন্দুদের মত নয়। তাদের বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান সাধারণভাবে একটি ছকে বাধা। এই ছকের বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এমতাবস্থায় অন্যান্য ধর্মের সাথে হিন্দুর পার্থক্যগুলো বিবেচনা করা দরকার। এই পার্থক্যগুলো অনুধাবন করতে পারলেই বোঝা যাবে : ক. কেন ও কিভাবে হিন্দু অন্যদের থেকে পৃথক এবং খ. কেন হিন্দু এত বৈচিত্র্যময় হওয়া সত্ত্বেও এক।
সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে (ভারত সংস্কৃতি : মিত্র ও ঘোষ : কলকাতা, ১৪০০) হিন্দুধর্মের সাথে অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য কি তার একটা রূপরেখা দিয়েছেন। চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক চিহ্নিত পার্থক্য ছাড়াও অনেক পার্থক্য আছে। এর কোনোটিকেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। কারণ অনেকগুলো পার্থক্য মৌলিক। নিম্নে হিন্দুধর্মের সাথে অন্যান্য ধর্মের প্রধান প্রধান পার্থক্যগুলো উল্লেখ করা হল:
১. হিন্দুধর্ম ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতামূলক একটি ধর্মমত। সিন্ধু সভ্যতাকে আশ্রয় করেই এই ধর্মের উৎপত্তি। এর সাথে আরও অনেক ধর্ম মত পরবর্তীকালে যোগ হয়ে এই ধর্মটি পরিপুষ্ট হয়েছে। আজও এই পরিপুষ্টির কোনো বিরাম নেই। অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য নয়।
২. মুসলমানের কোরান শরীফ, খ্রিস্টানের বাইবেল ও বৌদ্ধদের ত্রিপিটকের মত হিন্দুর কোনো সর্বজনীন ও সর্বজনগ্রাহ্য ধর্মগ্রন্থ নেই। রাষ্ট্রের উদাহরণের সাথে তুলনা করলে হিন্দুকে অনেকটা যুক্তরাজ্যের মত মনে হয়। যুক্তরাজ্যের কোনো লিখিত সংবিধান নেই, তবু সে গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ। হিন্দুও তাই।
৩. হিন্দুধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত কোনো ধর্ম নয়। কোনো মহামানবকে ঘিরেও এ ধর্মের উৎপত্তি হয় নি। তাই এর কোনো প্রবর্তক বা প্রতিষ্ঠাতা নেই। অন্যান্য ধর্মকে ইংরেজিতে যে অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ বা সংগঠিত ধর্ম (অর্গানাইজড রিলিজিয়ন) বলা হয় হিন্দুধর্মকে সেই অর্থে ‘রিলিজিয়ন’ বলা যায় না। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত ধর্ম। এই দুই ধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত দুই মহামানবকে ঘিরে সৃষ্ট হয়েছে। তাঁরা ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন। অপরদিকে বৌদ্ধধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত নয়। কিন্তু ধর্মটি গৌতম বুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। তাই যীশু খ্রিস্টের অনুসারীরা খ্রিস্টান। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা বৌদ্ধ। একই কথা মুসলমানদের বেলায়ও সত্য। কিন্তু হিন্দু নামটি কোনো মহামানবের নাম থেকে উদ্ভূত নয়।
৪. হিন্দু বিবর্তনশীল ধর্ম। অবিরাম এক বিবর্তন প্রক্রিয়া এতে ক্রিয়াশীল। তাই হিন্দুর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হলে বা কোনো মহামানবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হলে এই বিবর্তন বা ক্রম বিকাশ সম্ভব ছিল না। কারণ ঈশ্বরের বাণী পরিবর্তন করা যায় না। বিপরীতে অন্যান্য ধর্ম বিবর্তনশীল ধর্ম নয়।
৫. হিন্দু নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে না। কারণ এই অঞ্চলের কোনো ধর্মমতকে বাদ দিয়ে একটি মাত্র ধর্মমতকে নিয়ে হিন্দুধর্ম গঠিত হয় নি। বরং এ অঞ্চলের মাটি থেকে উদ্ভূত সকল ধর্মমতকে আত্মসাৎ করেই হিন্দুধর্মের বিকাশ। এ কারণে অনেকেই হিন্দুধর্মকে অনেক ধর্মমতের একটি ‘কনফেডারেশন’ হিসেবে গণ্য করে। অবশ্য এ মতটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
৬. অন্যান্য ধর্মের ‘ক্রিড’ (ধর্মবীজ) আছে অর্থাৎ মূল কতগুলো বিশ্বাস আছে। কিন্তু হিন্দুর কোনো ‘ক্রিড’ নেই।
৭. অন্যান্য ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কতগুলো স্তম্ভ আছে। যেমন ইসলাম ধর্মের স্তম্ভ হচ্ছে : নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাত। বৌদ্ধদের রয়েছে পঞ্চশীল ও তিন স্তম্ভ অর্থাৎ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ। হিন্দুর এ ধরনের কোনো স্তম্ভ নেই।
৮. হিন্দুর সর্বজনীন বা সকলের জন্য প্রযোজ্য কোনো উপাসনালয় নেই। তাদের রয়েছে গৃহ দেবতা। এঁরা ইষ্ট দেবতা হিসেবে গৃহেই পূজিত হয়। হিন্দুরা শৈব (শিব), শাক্ত (শক্তি), বৈষ্ণব (বিষ্ণু), গাণপত্য (গণপতি) ও সৌর (সূর্য) ইত্যাদি মতে বিভক্ত। এসব দেবতার মন্দিরও হয় ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু দেবতা দর্শনে কোনো বাধা নেই। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীকে নির্দিষ্ট সময়ে যার যার নির্দিষ্ট উপাসনালয়ে যেতে হয়। যেমন প্রতি শুক্রবারে মুসলমানরা মসজিদে যায়। খ্রিস্টানরা গির্জায় যায় প্রতি রোববার। হিন্দুদের এমন কোনো ব্যবস্থা নেই।
৯. হিন্দু যেহেতু বহু ধর্মীয় মতের একটি সম্মিলিত রূপ তাই তার বিশ্বাস ‘যত মত তত পথ’। ‘একের মধ্যেই বহু, বহুর মধ্যেই এক’ এই হচ্ছে হিন্দুর বিশ্বাস। এই বিশ্বাসেরই ফল হচ্ছে ‘ঈশ্বর এক কিন্তু তার রূপ অনেক’ এই চিন্তা। অপর দিকে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম একেশ্বরবাদী ধর্ম।
১০. হিন্দু ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাস করে না। কারণ হিন্দুধর্ম সভ্যতা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক। জন্মগতভাবেই একজন হিন্দু। কিন্তু অন্যান্য ধর্ম ধর্মান্তরকরণে বিশ্বাস করে।
১১. হিন্দু জৈন ও বৌদ্ধ পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। হিন্দু মনে করে মোক্ষলাভের পূর্বে তাকে বহুবার জন্ম গ্রহণ করতে হয়। কৃত কর্মের গুণে তাকে পুনর্জন্মের এই বৃত্ত থেকে মুক্ত হতে হয়। কিন্তু ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে শেষ বিচারে (ফাইন্যাল জাজমেন্ট)।
১২. হিন্দু প্রতিমা পূজা করে। দেব-দেবীর প্রতিকৃতিই (ইমেজ) প্রতিমা। প্রতিমা মাটির তৈরি, জলে হয় তার বিসর্জন। এই প্রতিমা কল্পনায় সৃষ্ট। প্রতিমা কিন্তু মূর্তি নয়। তাই হিন্দু পৌত্তলিক নয়। বৌদ্ধরা শুধু গৌতম বুদ্ধের পূজা করে। বাকিদের কাছে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ।
ওপরের তুলনা থেকে অন্যান্য ধর্মের সাথে হিন্দুর পার্থক্য কী ও কেন তার একটা আভাস পাওয়া যায়। এ পার্থক্য থেকে বোঝা যায় হিন্দু কেন বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যকে অনৈক্য ভেবে অনেক হিন্দু দুর্ভাবনার পড়ে। তাদের ধারণা বুদ্ধের মত একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকলে হিন্দুর ভাল হতো। এতে বৃদ্ধি পেত তাদের শক্তি। বোঝা যায় হিন্দুর অন্তঃস্রোতে বহমান ঐক্যের শক্তিকে তারা লঘু করে দেখে। হিন্দুর ‘ডিনামিজম’ বা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার শক্তিকেও তারা গুরুত্ব দেয় না। অথচ এই দুটোও হিন্দুর শক্তি।
হিন্দুর আর একটি শক্তির দিক হচ্ছে তার উদারতা। দেখা যায় মতের দিক থেকে হিন্দু বেশ উদার। হিন্দুর একই পরিবারে একজন শৈব, একজন শাক্ত এবং একজন বৈষ্ণব মতের লোক থাকতে পারে। তাতে কোনো সংঘর্ষের কারণ ঘটে না। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সাথেও হিন্দু সহাবস্থান করতে পারে। এ সহিষ্ণুতা হিন্দুর মজ্জায়। কোনো কিছুতে অবিশ্বাসের কারণে কোনো হিন্দুকে তার ঘর থেকে বহিষ্কৃত করা হয় না। এমনকি নিরীশ্বরবাদীও হিন্দুর ঘরে স্থান পায়। বিশ্বাস যাই হোক না কেন হিন্দুর ঘরে তার স্থায়ী আসন। অবিশ্বাসের জন্য তাকে নিজঘরে অথবা সমাজে নির্যাতন ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয় না। এ নিরিখে বলা যায় ধর্মীয় মত ও বিশ্বাস হিসেবে হিন্দু খুবই ঢিলেঢালা।
দেখা যায় পূজা করলেও হিন্দু, পূজা না করলেও হিন্দু। বেদে বিশ্বাস করলেও হিন্দু, না করলেও হিন্দু। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে হিন্দু, বিশ্বাস না করলেও হিন্দু। এর ফলে কোরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদ করতে তার অসুবিধা হয় নি। রামকৃষ্ণের ইসলাম ধর্ম অনুশীলনেও কোনো সমস্যা হয় নি। অপরপক্ষে অনেক ধর্মই মতের দিক থেকে খুবই কঠোর। কোনো ব্যতিক্রম তারা সহজে সহ্য করে না। বিশ্বাস তাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবিশ্বাসে ধর্মচ্যুত হওয়ার আশংকা।
হিন্দুর অবশ্য অনেক প্রকট সমস্যাও আছে। সে প্রথা, আচার ও সংস্কারে অত্যন্ত কঠোর। দৈনন্দিন আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হিন্দুর একটি বজ্র আঁটুনি আছে। সেখানে কোনো বিচ্যুতি হিন্দু সহ্য করতে চায় না। হিন্দুর রয়েছে হাজারো আচার-অনুষ্ঠান। হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠানের একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর গ্রন্থে (হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান: সম্পাদনা: প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য: কলকাতা, প্যাপিরাস: ২০০১)। চক্রবর্তী হিন্দুর অবশ্য কর্তব্য হিসেবে যে অনুষ্ঠানগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে আছে আহ্নিক, প্রার্থনা, পূজা (পৌরাণিক ও তান্ত্রিক), দশ সংস্কার (নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ অর্থাৎ মস্তকমুণ্ডন ও কর্ণবেধ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, পুংসবন অর্থাৎ গর্ভের তৃতীয় মাসের অনুষ্ঠান, সীমন্তোন্নয়ন অর্থাৎ গর্ভের চতুর্থ, ষষ্ঠ অথবা অষ্টম মাসের অনুষ্ঠান এবং জাতকর্ম অর্থাৎ পুত্র জন্মমাত্র অনুষ্ঠেয় কর্ম ইত্যাদি)।
এদিকে ঐচ্ছিক অনুষ্ঠান হিসেবে অঞ্চল ভেদে প্রচলিত ১১টি অনুষ্ঠানের পরিচিতি আছে চক্রবর্তীর গ্রন্থে। এর মধ্যে আছে ব্রত, নববর্ষোৎসব, জামাই ষষ্ঠী, রথযাত্রা, অম্বুবাচী, ঝুলন যাত্রা (রাখি বন্ধন), নষ্টচন্দ্র, হোলি ও দোলযাত্রা ও চড়ক পূজা ইত্যাদি। তিনি তাঁর গ্রন্থে ১০১টি আচার-অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে এখনও প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান হচ্ছে অধিবাস, অন্ত্যেষ্টি, অশৌচ, আকাশ-প্রদীপ, একাদশী, কালবেলা, জপ, তর্পণ, দক্ষিণা, দীক্ষা, নবান্ন, প্রায়শ্চিত্ত, মহালয়া, রাসযাত্রা, সংক্রান্তি, হবিষ্য ও হাতেখড়ি ইত্যাদি। বলা বাহুল্য আচার- অনুষ্ঠানের অনেকগুলো আস্তে আস্তে তিরোহিত হয়েছে। অনেকগুলো জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনে রয়েছে জটিল, বিস্তারিত ও অলঙ্ঘনীয় বিধিমালা। মুষ্কিল হচ্ছে হিন্দু এই আচার ও প্রথাকেই ধর্ম হিসেবে গণ্য করে। বস্তুত এটি তার গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে (কালান্তর : বিশ্বভারতী : কলকাতা, ১৪০০) এই গোঁড়ামির শুরু হিন্দুযুগে। হিন্দুযুগ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার যুগ। কারণ এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ প্রাকার তুলে একে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল।
আচার-অনুষ্ঠানগত এই গোঁড়ামি ও বাহুল্য বাদে হিন্দুর আর একটি প্রথা আছে যা এক্ষুণি বর্জনীয়। এটি হচ্ছে জাতিভেদ প্রথা। দেখা যায় জন্মগত জাতিভেদে (কাস্ট) হিন্দুর সামাজিক কাঠামো খুবই নিষ্ঠুর। অন্যদের ক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। সেখানে জন্মগত কোনো জাতিভেদ নেই। গুণ ও মেধার ভিত্তিতে যে কেউ সমাজের শীর্ষে উঠতে পারে। এইসব দিক বিচার করলে হিন্দুকে একটি সংস্কারাবদ্ধ জীব বলে মনে হয়। কিন্তু তার সভ্যতা ও দর্শন নিশ্চিতভাবে উচ্চমানের। অর্থাৎ বলা যায় হিন্দুর হৃদযন্ত্রটি (হার্ট) ভালো, কিন্তু তার কাঠামো অথবা শরীরটি কুৎসিত। এই শরীরের জন্য কেউ তাতে আকৃষ্ট হয় না। যারা আছে তারা জাতিগত (কাস্ট) বৈষম্যের শিকার। তাহলে প্রশ্নঃ হিন্দু টিকছে কী করে? হিন্দু টিকছে সংস্কৃতি ও সভ্যতার জোরে। অতীতে অসংখ্য বিদেশি আক্রমণ সত্ত্বেও হিন্দু বিলুপ্ত হয় নি। বৈচিত্র্য ও লোকায়ত সংস্কৃতির শক্তি তাকে আক্রমণ থেকে বার বার রক্ষা করেছে। জাতিভেদ প্রথা তাকে টিকিয়েছে এই ধারণা অমূলক ও বিভ্রান্তিকর।
পরিশেষে প্রশ্ন: এমতাবস্থায় হিন্দুর করণীয় কী? আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে বাহুল্য বর্জিত ও সর্বজনীন করা হিন্দুর আশু কর্তব্য। সর্বোপরি উচিত তার শরীর বা কাঠামোটিকে শক্তিশালী হৃদযন্ত্রের উপযোগী করে গড়ে তোলা। অর্থাৎ জন্মগত জাতিভেদ প্রথাকে উচ্ছেদ করা। কারণ এই প্রথার ফলে হিন্দুর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করা দরকার। যেহেতু হিন্দুর সম্পর্ক মাটির সাথে তাই তার মাটির বৈশিষ্ট্য অর্জন করা দরকার। মাটি যেমন সকলকে গ্রহণ করে, হিন্দুরও উচিত সকল হিন্দুকে সমানভাবে গ্রহণ করা।
বাইরের কালো রূপ (জাতিভেদ) বর্জন ও জাতিভিত্তিক অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ পরিহার করতে পারলে হিন্দুর মঙ্গল। কারণ জাতিতে জাতিতে ভেদ অর্থাৎ সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভেদ কার্যত সাম্প্রদায়িকতার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। এতে দেশ বা জাতি গঠন ব্যাহত হয়। বিঘ্নিত হয় ঐক্য। উপরন্তু হিন্দুদের নিজেদের মধ্যকার সম্প্রদায়ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার মূল ও স্থায়ী বীজ ‘জাতিভেদ’ টিকিয়ে রেখে আন্ত :ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দূর করা অসম্ভব। কারণ যিনি সাম্প্রদায়িক তিনি সকল ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক। নিজধর্মের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক অথচ আন্তঃধর্মীয় ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক এটি একটি স্ববিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক হিন্দু মনে হয় এই স্ববিরোধিতারই শিকার। এই স্ববিরোধিতার বিষয়টি হিন্দুরা উপলব্ধি করতে পারলে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণও সহজ হতে পারে বলে বিশ্বাস।