হিন্দি
সেই কবে কিশোর বয়সে লিখেছিলাম যে দশরথের চার ছেলের হিন্দি অনুবাদ হল দশরথকা চৌবাচ্চা, এরপর আর বিশেষ ভাল করে হিন্দি শেখা হয়নি।
আজ কিছুকাল হল আবার নতুন করে হিন্দি শেখা আরম্ভ করেছি। দূরদর্শনের পর্দায় সপ্তাহান্তিক হিন্দি সিনেমার প্রতি আমার একটা আসক্তি জন্মেছে। প্রথম দিকে খুব ভাল বুঝতে পারতাম না কিন্তু ভাব-ভাষা ঠিক বুঝি-না-বুঝি আসল ব্যাপারটা এখন বেশ ধরতে পারছি। আমি এখন বুঝে গেছি শেষ দৃশ্যে জীবনপণ লড়াইয়ের পরে যে জীবিত থাকে সেই হল কাহিনীর নায়ক, আর শেষ দৃশ্যের আগের দৃশ্যে যে মারা পড়ে সে হল খলনায়ক।
এসব বোঝা ছাড়াও হিন্দি সিনেমা দেখে ক্রমশ আমার শব্দের স্টক বাড়ছে। এখন পর্যন্ত যে কয়টি নতুন শব্দ আমি আয়ত্ত করেছি তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল হল, খামোশ।
খামোশ শব্দটির শেষ অংশটি ‘শ’ না ‘স’ নাকি ‘ষ’, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। শব্দটির মানেটাও যে ভাল বুঝতে পেরেছি তা নয়। কিন্তু ‘খামোশ’ একটি চমৎকার ধমক, বাংলাতেও এর ব্যবহারে চমৎকার কাজ হয়।
ময়দানে আমার কুকুর নিয়ে বেড়াতে গিয়ে স্বভাব-বদমাইশ কুকুরটি সামান্য চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেই আমি তাকে ধমক দিই, ‘খামোশ’, সে সঙ্গে সঙ্গে লেজ গুটিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
আজকাল রাস্তায় ট্যাক্সি ধরতে হলে আর কাতর স্বরে ‘ট্যাক্সি, ট্যাক্সি’ করে মরীচিকার পিছনে ছুটে ক্লান্ত হই না। আমার কম্বু-বিনিন্দিত কণ্ঠে একবার জোর খাঁকারি দিয়ে ট্যাক্সিওয়ালার চোখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠি, ‘খামোশ’, ট্যাক্সিওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়, ‘স্যার’ বলে পিছনের সিট খুলে যত্নে তুলে নেয়।
‘খামোশ’ কিংবা অন্য যে কোনও শব্দের মানে না জেনে এই লাভজনক ব্যবহার, এটা যে কখনও যথেষ্ট পরিমাণ বিপজ্জনক হতে পারে, সে বিষয়ে আমি সচেতন।
শিবরাম চক্রবর্তীর অসামান্য একটি গল্পে শব্দের ভুল ব্যবহারের পরিণতি দেখানো আছে। গভীর রাতে শিশু কাঁদছে, শিশুকে ঘুম পাড়াতে হবে। নব নিযুক্তা হিন্দুস্থানি আয়াকে নির্দেশ দেওয়া হল, ‘যাও, ইসকো ঘুমাকে লে আও।’ নির্দেশক বলতে চাচ্ছেন যে শিশুটিকে ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে এসো। কিন্তু হিন্দিতে ঘুমাকে মানে ঘুরিয়ে বা বেড়িয়ে নিয়ে এস। ফলে নির্দেশ পাওয়া মাত্র আয়াটি বাচ্চাটিকে নিয়ে গভীর রাতের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
অবশ্য স্বর্গীয় শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পে কাজের লোকের ভুল বোঝা এই প্রথম বা নতুন নয়। ঘটনাটি হিন্দি-জড়িত নয় কিন্তু স্মরণীয়। কাজের লোককে বলা হয়েছে দরজা ভেজাতে অর্থাৎ দরজাটা কুলুপ না দিয়ে টেনে দিতে কিন্তু সে ধরতে পারেনি। এক বালতি জল তুলে এনে দরজা জল দিয়ে ভেজাতে লেগে গেল কাজের লোকটি।
কাজের লোকটি নিয়ে অন্য একটা বিদ্যাবুদ্ধি হয়ে যাবে। আপাতত শিবরাম চক্রবর্তীর হিন্দি ব্যাপারটুকু সেরে নিয়ে আমার নিজের হিন্দিপ্রমাদে প্রবেশ করব।
শিবরামের সেই গল্পটা বোধহয় নকুড় কাকাকে নিয়ে। সেই নকুড়কাকা যার সম্পর্কে শিবরাম চক্রবর্তীর অহংকার ছিল। একশো একার জমি আমার নকুড়কাকার একার। নকুড়কাকা যেমন বড়লোক, তেমনি কৃপণ; যাকে বলে কৃপণ-কুলচূড়ামণি। সেই নকুড়কাকা পোস্টাফিসে টাকা জমান হিন্দিতে সই করে। কারণ খুব স্পষ্ট। একে পোস্টাফিসে কখনওই সই মেলে না এবং সেই জন্য টাকা তোলা যায় না, তার উপরে অধিকতর নিরাপত্তার জন্য নকুড়কাকা হিন্দিতে নাম সই করেন এমনিতেই সই মেলে না, তার উপরে হিন্দি সই, ফলে ইচ্ছে বা প্রয়োজন থাকলেও কখনওই নকুড়কাকার পক্ষে পোস্টাফিসে একবার রাখা টাকা আর তোলা সম্ভব হয় না। সুতরাং জমা টাকা আর খরচ হয় না। একেবারে অকাট্য যুক্তি। পোস্টাফিসে নকুড়কাকার টাকা জমার উপরে জমা পড়তে থাকে, কখনওই সেটা তোলা যায় না।
শিবরাম চক্রবর্তীর ঠিক পরেই আমার নিজের কথায় চলে আসা খুবই গর্হিত আচরণ হবে, একটু ঔদ্ধত্যও হয়তো হবে তাই আমি সরাসরি না এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারফত আসছি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার নামে এই গল্পটা লিখেছিলেন তাঁর ‘মায়াকাননের ফুল’ নামক স্মৃতিময় উপন্যাসে। সেটা হয়তো সবাই পড়েছেন। আমি সেই জন্য কিঞ্চিৎ বিস্তৃত ও আলাদা করে নিবেদন করছি।
কাল্পনিক ঘটনাটি ঘটেছিল হাজারিবাগের একটা গ্রামে। তখন তাতাইয়ের বয়স পাঁচ-ছয়ের বেশি হবে না। আমরা সেবার পুজোর ছুটিতে হাজারিবাগের ওই গ্রামে মাসখানেক ছিলাম। এরই মধ্যে একদিন তাতাইকে একটি বোলতা কামড়ায়। কপালের পাশে কামড়েছিল, কিছুক্ষণ পরে চোখমুখ ফুলে উঠল। মিনতি প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু করে দিল, আমি যত বলি, ‘আমাকে ছেলেবেলায় বহুবার বোলতা কামড়িয়েছে, হঠাৎ একটা বোলতার কামড়ে কিছু হয় না। আধখানা অ্যাসপিরিন দিয়ে দাও;’ মিনতি তত উত্তেজিত হয়ে পড়ে, তার সঙ্গে তাতাইয়ের আকুল ক্রন্দন।
রাস্তার মোড়েই বসেন এক দেহাতি ডাক্তার। দুঃখের বিষয়, ভদ্রলোক ভাল বাংলা বোঝেন না। তাঁর কাছে তাতাইকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী গেলাম বটে কিন্তু আমার সামান্য হিন্দিজ্ঞানে তাঁকে বোঝাতে পারলাম না কী হয়েছে। বোলতার হিন্দি কী ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম। মধুমক্ষি, মৌমাচ্ছি, মৌমক্ষি কত কী বললাম কিন্তু ডাক্তারবাবু আর বোঝেন না।
পাশেই এক হিন্দুস্থানি ভদ্রলোক বসেছিলেন। দু’দিন আগে রাস্তায় পরিচয়, হাজারিবাগ সদর শহরে এই ভদ্রলোক এক সময় কিছুদিন ছিলেন, কিছুটা বাংলা জ্ঞান আছে। অগত্যা তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাইয়া, হামলোক তো বোলতাকে বোলতা বোলতা হ্যায়, আপ লোক বোলতাকো ক্যায়া বোলতা হ্যায়।’
অনুগ্রহ করে কোনও পাঠক-পাঠিকা আমার এ প্রশ্নের কী উত্তর পেয়েছিলাম এবং অতঃপর কী হয়েছিল অনুমান করে নেবেন। ততক্ষণে আমি আমার এক সরকারি বন্ধুর হিন্দি সংকটের কথা বলি।
বন্ধুটিকে চাকরি পাকা হওয়ার আগে যথারীতি কয়েকটি বিভাগীয় পরীক্ষা পাশ করতে হয়েছিল, তার মধ্যে একটি হল হিন্দি। লিখিত এবং মৌখিক দু’রকম পরীক্ষাই পাশ করতে হবে।
লিখিত পরীক্ষা বন্ধুবর কোনওভাবে পাশ হলেন। এবার মৌখিক পরীক্ষা। খুব সোজা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন হিন্দির পরীক্ষক, ‘কলকাতার বাইরে থেকে একজন বেড়াতে এসেছেন, তাঁকে আপনি কোথায় কোথায় নিয়ে যাবেন, কী কী দেখাবেন হিন্দিতে বলুন।’
সোজা প্রশ্ন পেয়ে বন্ধুটি গড়গড় করে বলে চললেন, রাজভবনমে লে যায়গা, চৌরঙ্গিমে লে যায়গা, জাদুঘরমে লে যায়গা, চিড়িয়াখানামে লে যায়গা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালমে লে যায়গা…’। হিন্দি পরীক্ষক তাঁকে নিরস্ত করে বললেন, ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ইংরেজি হয়ে গেল, ওটা হিন্দি করে বলুন।’
বন্ধুবর অনেক ভাবলেন, কিন্তু কিছুতেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের হিন্দি প্রতিশব্দ মনে এল না। তখন দু’বার ঘাড় চুলকে বললেন, ‘হাম উসকো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালমে নেহি লে যায়গা, উসকো পরেশনাথকা মন্দিরমে লে যায়গা।’
বন্ধুর আর সেবার পাশ হওয়া হল না। ছয় মাস পরে আবার বিভাগীয় পরীক্ষা। সেই একই পরীক্ষক, একই ছাত্র। এবার প্রশ্ন আরও সোজা, ‘যাট থেকে সত্তুর পর্যন্ত হিন্দিতে বলুন।’ বন্ধুটি কিঞ্চিৎ চিন্তা করে নিয়ে, সংখ্যাগুলিকে হিন্দিত্ব দেওয়ার জন্য ‘ষ’ এবং ‘স’ এই দুটি বর্ণকে ‘ছ’ করে অর্থাৎ ষাট, একষট্টি, বাষট্টির জায়গায় ছাট, একছট্টি, বাছট্টি করে বলে গেলেন।
নিরুত্তাপ পরীক্ষক ছত্তুর পৌঁছানোর পরে থামালেন, তারপর বললেন, ‘এবার বাংলায় বলুন।’ ‘ষ’ বা ‘স’ বদল করে দিলে বাংলায় যে ব্যাপারটি একই এবং সেটা হিন্দি নয় সেটা বুঝতে বন্ধুবরের এক সেকেন্ড লাগল। তিনি ‘বহুৎ শুকরিয়া’ বলে বিদায় দিলেন।