হিডজিভাই পি মরিস
একদা ‘স্ট্র্যানড’ পত্রিকা একটি নতুন ধরনের অনুসন্ধানের সূত্রপাত করে সাহিত্যের মহা মহা মহারথীদের শুধোয়, তাঁরা সর্বজন-সম্মানিত, সর্বশিক্ষিতজনের অবশ্যপাঠ্য কোন কোন পুস্তক যে কোনও কারণেই হোক, পড়ে উঠতে পারেননি। উত্তরে এমন সব তথ্য আবিষ্কৃত হল যাকে ‘মোহনে’র ভাষায় লোমহর্ষক বলা যেতে পারে; যেমন, কথার কথা কইছি– বার্নার্ড শ পড়েননি অলিভার টুইস্ট, কিংবা মনে করুন–রবীন্দ্রনাথ পড়েননি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’?
কাজেই বিখ্যাত সাহিত্যিকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে এই অখ্যাত সাহিত্যসেবক তাঁরা যেন তড়িঘড়ি শ্রীযুক্ত বিশী মহাশয়ের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে বইখানা পড়ে নেন।
এই পুস্তকে ‘কাব্যের উপেক্ষিত’ জাতীয় দু-চারটি চরিত্রের উল্লেখ করে বিশী মহাশয় বহু প্রাক্তন শান্তিনিকেতনবাসীদের সাধুবাদ পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন হিডজিভাই মরিস্।
তাঁর পুরো নাম হিডজিভাই পেস্তনজি মরিসওয়ালা। গুজরাতিদের প্রায় সকলেরই পারিবারিক নাম থাকে; যেমন গাঁধী, জিন্না (আসলে ঝিঁড়া ভাই), হটিসিং ইত্যাদি। পার্সিদের অনেকেরই ছিল না বলে কেউ কেউ তাঁদের ব্যবসার নাম পারিবারিক নামরূপে গ্রহণ করতেন। যেমন ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি। এই নিয়ে পার্সিরা ঠাট্টা করে একটি চরম দৃষ্টান্ত দেন– সোডা-ওয়াটারবটলওপনারয়ালা!
বোম্বাইয়ের পতিত পরিবার বিখ্যাত। এঁরা ফরাসি ‘পতি’ (Petit) ফার্মে কাজ করতেন বলে প্রথমে পতিতওয়ালা ও পরে পতিত্ নামে পরিচিত হন। ঠিক সেইরকম মরিস কোম্পানিতে কাজ করে আমাদের অধ্যাপক মরিসওয়ালা পরে শুধু মরিস নামে বোম্বাই অঞ্চলে নাম করেন।
অত্যুত্তম ফরাসি ও লাতিন শেখার পর না জানি কোন যোগাযোগে তিনি শান্তিনিকেতন পৌঁছে সেখানে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন।
দুটো বিষয়ে তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি– সেন্টিমেন্টাল এবং আদর্শবাদী। আমার আশ্চর্য লাগত, কারণ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেসব গুজরাতি ছেলেরা এবং পাঠিকারা অপরাধ নেবেন না, মেয়েরাও শান্তিনিকেতন আসে, তারা পর্যন্ত টাকা আনা পাই হিসাব করত; শুনেছি, ছাত্রেরা আকছারই আদর্শবাদী হয়। (নইলে অত নিঃস্বার্থ ট্রাম-বাস পোড়ানোর সকর্মটা করে কে? কিন্তু এ সম্বন্ধে আর কথা নয়। হক কথা কইলে পুলিশ ধরবে।) তাই গুজরাতি মরিস সাহেবের আদর্শবাদ আমাকে বিস্মিত করেছিল।
সামান্য বাংলা শেখার পরই মরিস সাহেবের প্রেম উপচে পড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি এবং তিনি সম্মোহিত হলেন,
“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার” শুনে।
অন্যত্র আলোচনা করেছি, ভারতের বাইরে কোনও ভাষাই ‘ত’ এবং ‘ট’-র উচ্চারণে পার্থক্য করে না; এমনকি ভারতীয়দের ভিতর যাদের গায়ে প্রচুর বিদেশি রক্ত তাঁরাও এ দুটোতে গুবলেট করেন। উদাহরণস্থলে, গুজরাতের বোরা সম্প্রদায় এখানকার রাধাবাজারে এদের ব্যবসা আছে–ব্রহ্ম উপত্যকার আসামবাসী ও পার্সি সম্প্রদায়।
তাই মরিস সাহেবের উচ্চারণে ছত্র দুটি বেরুতো;
“টাহাটে এ জগটে ক্ষটি কার
নামাটে পারি যডি মনোভার।”
আমরা আর কী করে ওঁকে বোঝাই যে ‘ত’ ‘দ’-এর অনুপ্রাস ছাড়াও গুরুদেবের গান আছে।
মরিস সাহেব নতুন বাংলা শেখার সময় যে না বুঝে বিশীদাকে ‘বেটা ভূত’ বলেছিলেন, তার চেয়েও আরও মারাত্মকতম উদাহরণ আমি শুনেছি। তিনি আমাদের ফরাসি শেখাতেন এবং শ্রদ্ধেয় বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন এবং আরও কিছু অধ্যাপকও তাঁর ক্লাসে যেতেন। আমার হাসি পেত তখন গুরু মরিস ছাত্র বিধুশেখরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন ও ছাত্র বিধুশেখর তাঁকে ‘তুমি’ বলে। একদিন হয়েছে, ফরাসি ব্যাকরণের কী একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলেছেন অধ্যক্ষ বিধুশেখর। মরিস সাহেব বললেন, ‘চমৎকার! শাস্ট্রী মশায়, সট্যি, আপনি একটি আস্টো ঘুঘু।’
শাস্ত্রী মশাইয়ের তো চক্ষুস্থির! একটু চুপ করে থাকার পর গুরু, গুরু– যদ্যপি ছাত্র, তথাপি গুরু-কণ্ঠে শুধালেন, ‘মরিস, এটা তোমাকে শেখালে কে?’
নিরীহ মরিস বোধ হয় কণ্ঠনিনাদ থেকে বিষয়টার গুরুত্ব খানিকটে আমেজ করতে পেরে বললেন, ‘ডিনডা (দিনদা, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর)। উনি বলেছেন ওটার অর্ট “অসাডারণ বুডডিমান।” টবে কি ওটা ভুল?’
শাস্ত্রী মশাই শুধু ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দিনেন্দ্রনাথকে বোঝাব।’
দিনুবাবু নাকি বিদেশিকে ভাষা শেখাবার সময় কর্তব্যবোধহীন চপলতার জন্য বেশ কিছুটা ভালোমন্দ শুনেছিলেন শাস্ত্রী মশাইয়ের কাছ থেকে।
ওই সময় প্যারিস থেকে অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসেন। উভয়েই একাধিকবার বলেন, মরিস সাহেব উল্লেখ না করা পর্যন্ত তারা কখনও বিশ্বাস করতে পারেননি, ফ্রান্স না গিয়ে মানুষ কী করে এরকম বিশুদ্ধ ফরাসি শিখতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে বড়ই কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে রলাঁর ‘যিশুজীবনী’ পড়ান।
এ বই আমার মহদুপকার করেছে এবং করছে।
বলা বাহুল্য এই সরল সজ্জন যুবা পণ্ডিতটি সকলেরই হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন। গুরুদেবের তো কথাই নেই, মরিস সাহেব ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথেরও অশেষ স্নেহ পেয়েছিলেন। বড়বাবু বিদেশি পণ্ডিতদের সঙ্গে বাক্যালাপ কালক্ষয় বলে মনে করতেন; বলতেন, ‘এরা সব তো জানে কোন শতাব্দীতে প্রজ্ঞাপারমিতা কিংবা একাক্ষরপারমিতা প্রথম লেখা হয়, প্রথম ছাপা হয়। ওসব জেনে আমার কী হবে? তার চেয়ে নিয়ে আস না ওদের। কোনও একজন, যে কান্টের দর্শন সমর্থন করতে পারে, আর আমি নেব বিরুদ্ধ মতবাদ, কিংবা সে নেবে বিরুদ্ধ মতবাদ, আমি নেব কান্টপক্ষ–তার যেটা খুশি’; মরিস সাহেব তাঁকে তখন অনুনয়-বিনয় করে সম্মত করাতেন বিদেশি পণ্ডিতকে দর্শন দিতে। অবশ্য দু-মিনিট যেতে না যেতেই বড়বাবু সব ভুলে গিয়ে কোনও কিছু অন্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় তন্ময় হয়ে যেতেন। আমাদের মতন ছেলে-ছোকরাদের কিন্তু তাঁর কাছে ছিল অবাধ গমন। আমার মনে পড়ত খ্রিস্টের কথা; তিনি যেহোভার মন্দির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিস্তর তথাকথিত কুলাঙ্গার ভিআইপি-কে, এবং আদেশ দিতেন ‘লেট দি চিলড্রেন কাম্ আনটু মি’!
বস সাহেব প্রথমটায় সম্মত ছিলেন না; আর সকলের চাপাচাপিতে তিনি প্যারিসের সরবনে গিয়ে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হতে রাজি হলেন।
প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তার সঙ্গে আমার অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা। আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করাতে আমি দুঃখ প্রকাশ করলুম। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন বড় হয়েছ; জর্মনিতে ডক্টরেট করবে। আমিও এখানে তাই করছি। আমরা এখন এক-বয়েসি।’ আমার বয়েস তখন চব্বিশ, তাঁর বত্রিশ। তার পর আমাকে রেস্তোরাঁয় উত্তমরূপে খানদানি ডিনার খাওয়ালেন। বিনয় এবং সঙ্কোচের সঙ্গে পরের দিন বললেন, ‘তোমাকে ভালো করে এন্টারটেন করতে পারলুম না। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, আমার এ মাসের টাকাটা এখনও দেশ থেকে আসেনি।’ আমি তারস্বরে প্রতিবাদ জানালুম। বহু বৎসর পরে ওই সময়কার এক প্যারিসবাসী ভারতীয়ের কাছে শুনতে পাই মরিস সাহেব অন্যান্য দুস্থ ভারতীয় ছাত্রদের টাকা ‘ধার’ দিয়ে মাসের বেশিরভাগ দেউলে হওয়ার গহ্বর-প্রান্তে পড়ি পড়ি করে বেঁচে থাকতেন। আসলে তাঁর পরিবার বিত্তশালী ছিল।… তাঁর সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। কিন্তু এখনও তার সেই শান্ত সংযত প্রসন্ন বদনটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
কিন্তু তার পূর্বের একটি ঘটনা চিরকাল ধরে আমার ও আমার সতীর্থদের চিত্তে কৌতুকরস এনে দেবে, প্রতিবার সেটার স্মরণে।
গুরুদেব শারদোৎসবের মোহড়া নিচ্ছেন। তিনি স্বয়ং, দিনুবাবু– এমনকি জগদানন্দবাবুর মতো রাশভারী লোক– অজিন ঠাকুর এঁরা সব অভিনয় করবেন। এক প্রান্তে বসে আছেন শুষ্কাস্য বিবদন মরিস সাহেব। আমি হোমটাসক না করলে তাঁর মুখে যে বিষণ্ণতা আসত তিনি যেন তারই গোটাদশেক ‘হেলপিং’ নিয়েছেন। মোহড়ার শেষে দিনুবাবু কাঁচুমাচু হয়ে গুরুদেবকে অনুরোধ জানালেন, মরিস সাহেবকে ড্রামাতে একটা পার্ট দিতে।
গুরুদেবের ওষ্ঠাধর প্রান্তের মৃদুহাস্য সবসময় ঠাহর করা যেত না। এবারে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে সব পার্টেরই বিলিব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। গুরুদেব বললেন, ‘ঠিক আছে। একে শ্রেষ্ঠীর পার্ট দিচ্ছি।’ হয় মূল নাটকে শ্ৰেষ্ঠীর পার্ট আদৌ ছিল না, ওইটে মরিস সাহেবের জন্য ‘ইসপিসিলি’ তৈরি হয় কিংবা হয়তো তখন মাত্র বড় বড় পার্টগুলোর বণ্টনব্যবস্থা আছে।
তা সে যা-ই হোক, শ্রেষ্ঠীর অভিনয় করবেন ‘নটরাজ’ মরিস– শাস্ত্রী মশাই তাঁর নাম দিয়েছিলেন মরীচি (ব্রহ্মার পুত্র, কশ্যপের পিতা ও তিনি সূর্যকিরণও বটেন)––মরিসও সগর্বে কাঁচা-হাতে সেই নামই সই করতেন। এবারে শুনুন, পার্টটি কী?
রাজা : ওগো শ্ৰেষ্ঠী!
শ্ৰেষ্ঠী : আদেশ করুন, মহারাজ!
রাজা : এই লোকটিকে হাজার কার্যাপণ গুনে দাও।
শ্ৰেষ্ঠী : যে আদেশ!
ব্যস্! ওইটুকু! আমার শব্দগুলো ঠিক ঠিক মনে নেই, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে মরিসকে ওই পাঁচটি শব্দ বলতে হবে, গুরুদেব সায়েবের বাংলা উচ্চারণ সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিলেন বলে। কিন্তু মরিস সাহেব বেজায় খুশ, জান্ তররর — ড্যামগ্ন্যাডে– হোক না পার্ট ছোট, তাতেই-বা কী? বলেননি স্বয়ং গুরুদেব, ‘The rose which is single need not envy the thorns which are many?’ কিন্তু এইবারে শুরু হল ট্রবল। গুরুদেবের ভাষাতেই বলি, মরিসকে শুতে হল কন্টকশয্যায়, গোলাপ-পাপড়ির আচ্ছাদিত পুষ্পশয্যায় নয়– যদিও থর্ন মাত্র একটি। গুরুদেব যতই বলেন ‘আদেশ করুন, মহারাজ’ মরিস বলেন, ‘আডেস করুন, মহারাজ।’ মহা মুশকিল! মরিস আপন মরীচ-তাপে ঘর্মাক্তবদন। শেষটায় গুরুদেব বরাত দিলেন দিনুবাবুকে, তিনি যেন সাহেবের ‘ত টর জট ছাড়িয়ে দেন। আফটার অল– তিনিই তো খাল কেটে কুমির এনেছেন; বিপদ, এক্সকিউজ মি– বিপডটা টাঁরই টৈরি।
মরিস সাহেব ছন্নের মতো হয়ে গেলেন। সেই প্রফেট জরথুস্ত্রের আমল থেকে কোন পার্সি-সন্তান এই ‘তো’ ‘ট’য়ের গর্দিশ মোকাবেলা করেছে– এই আড়াই হাজার বছর ধরে যে আজ এই নিরীহ, হাড্ডিসার মরিস বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা এই’ ত’য়ের তাবৎ ‘দ’য়ের দানব আই মিন ডানব, টাবড ডানবের সঙ্গে লড়াই দেবে?’
মরিস ছন্নের মতো আশ্রমময় ঘুরে বেড়ান দৃষ্টি কখনও হেথায় কখনও হোথায়, আর ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। আমি বললুম, ‘নমস্কার, স্যার।’ সম্বিতে এসে বললেন, ‘আ! সায়েড (সৈয়দ))’ ও হরি! এখনও ‘সায়েড’! তবে তো আডেশ এখনও মোকামে কায়েম আছে, রাজাদেশেরই মতো– ‘শোনো টো ঠিক হচ্ছে কি না “আডেশ করুন, মহারাজ”।’ আমি সন্তপ্ত চিত্তে চুপ করে রইলুম। বার দশেক আডেশ আডেশ করে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে এগিয়ে গেলেন।
একটা ডরমিটরি-ঘরের কোণ ঘুরতেই হঠাৎ সমুখে মরিস– বিড়বিড় করছেন ‘আডেশ আডে’। রেললাইনের কাছে নির্জনে ‘আডেশ–!’ দূর অতি দূর খোয়াইয়ের নালা থেকে মাথা উঠছে সায়েবের, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রালোকে, খেলার মাঠে মরিস, আসন্ন উষার প্রদোষে শ্মশানপ্রান্তে কার ওই ছায়ামূর্তি? মরিস। হিন্দি কবি সত্যি বলেছেন, গুরু তো লাখে লাখে, উত্তম চেলা কই। আশ্রমের ছেলেবুড়ো এখন সবাই সায়েবের শুরু।
এস্তেক শিশু-বিভাগের কানাই, সাগার কেউ বাদ পড়েনি। পড়ে থাকলে তাদের দোষ। সবাইকে টেস্ট করতে অনুরোধ করেন তার আডেশ আডেশানুযায়ী হচ্ছে কি না। ইতোমধ্যে এক সন্ধ্যায় মোহড়া শেষে দিনুবাবু গুরুদেবকে ভয়ে ভয়ে অনুরোধ জানালেন, আদেশের বদলে অন্য কোনও শব্দ দিতে, যেটাতে “ত” “দ” নেই। গুরুদেব বললেন, না; মরিসকে “ত” “দ” শিখতেই হবে।’
এরপর দ্বিতীয় পর্ব। হঠাৎ সক্কলের সামনে একদিন বেরিয়ে গেল “আদেশ” অত্যুত্তম ‘দ’ সহ। আমি ‘ইয়াল্লা’ বলে লম্ফ দিলুম। কেউ ‘সাধু সাধু’, কেউ-বা কনগ্রাচুলেশন বললেন, কিন্তু হা অদৃষ্ট! আমরা বন থেকে বেরুবার পূর্বেই হর্ষধ্বনি করে ফেলেছি! সায়েব পরক্ষণে আডেশ-এ ল্যাপস করেছেন। তার পর তাঁর ক্ষণে আসে ‘দ’ ক্ষণে ‘ড’। কলকাতার বাজারে মাছ ওঠা-না-ওঠার মতো বেটিঙের ব্যাপার। এই করে করে চলল দিন সাতেক। সম্মুখে আশার আলো।
এরপর তৃতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের মতো এটাও অপ্রত্যাশিত। সায়েব এখন চাঁচাছোলা, ভোরবেলার নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক শিশিরবিন্দুর ন্যায় ‘দ’ বলতে পারেন। পয়গম্বর জরথুস্ত্র এবং তাঁর প্রভু আহুর মজদাকে অশেষ ধন্যবাদ!
আমরাও আমাদের সঙ্কটটা ভুলে গেলুম। মোহড়ায় প্রতিবার ঋষি মরীচি বৈদিক পদ্ধতিতে ‘দ’ উচ্চারণ করেন।
মরিস সাহেব স্টেজে নামলেন পার্সি দস্তুর বা যাজকের বেশ পরে। সবকিছু ধবধবে সাদা। শুধু মাথার টুপিটি দাদাভাই নোরজি স্টাইলের লেটার বস্ প্যাটার্নের কালোর উপর সফেদ বুট্টাদার। গুরুদেব এই বেশই চেয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা পার্সিরা বাপু এ দেশের শ্রেষ্ঠী। তোমরা যা পরবে তাই শ্ৰেষ্ঠীর বেশ।’
নাট্যশালা গম গম করছে। ওহ, সে কী অভিনয়! শুরুদেবকে দেখাচ্ছে দেবদূতের মতো। অজিনের চেহারা এমনিতেই খাপসুরত, এমন দেখাচ্ছে রাজপুত্রের মতো। গুরুমশাই জগদানন্দ রায়ের কী বেত্রাস্ফালন! আশ্রমে বেতের বেসাতি বিলকুল বে-আইনি। এ মোকায় জগদানন্দবাবু যেন হৃতোপবীত-দ্বিজ লুণ্ঠিত যজ্ঞোপবীত ফিরে পেয়েছেন। তাঁর কঠিনদর্শন মুখচ্ছবি ঈষৎ স্নিগ্ধতা ধরেছে।
মরিস সাহেব প্রবেশ করলেন রঙ্গমঞ্চে।
রাজা দিলেন ডাক।
মরিস সাহেব– হে ইন্দ্র, তোমার বজ্র কেন তৎপূর্বেই অবতীর্ণ হল না?
উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় মরিস বলে ফেলেছেন, ‘আ ডে শ।’
অট্টহাস্যে ছাদ যেন ভেঙে পড়ে। তিনি কিন্তু ওই একই উত্তেজনার নাগপাশে বন্ধ বলে সে অট্টহাস্য শুনতে পাননি।
সে সন্ধ্যার অভিনয়ের জন্য অধ্যাপক হিডজিভাই মরিসই পেয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনন্দন। আমাদের বিবেকবুদ্ধি সেই আদেশই দিয়েছিল– খুব সম্ভব আডেশই।(১)
———- ১. মরিস সর্বদাই ঈষৎ বিষণ্ণ বদন ধারণ করতেন– খুব সম্ভব এটাকেই বলে ‘মেলানকলিয়া’। প্যারিস থেকে ফেরার পথে তিনি জাহাজ থেকে অন্তর্ধান করেন। আমার মতো আর পাঁচজন তার কারণ জানে না। শুনেছি, তিনি উইল করে তাঁর সর্ব বিশ্বভারতাঁকে দিয়ে যান।