হিটলারের প্রেম

হিটলারের প্রেম

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে জর্মনির জনসাধারণ পেল তার মোক্ষমতম শক্‌– যেন দেশবাসী আবালবৃদ্ধবনিতার মস্তকে স্বয়ং মুষ্টিযোদ্ধা ক্লে একখানি সরেসতম ঘুষি মেরে তাদের সবাইকে টলটলায়মান পড়পড়ায়মান করে দিলেন। ঘুষিটা এল হামবুর্গ বেতারকেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে মিত্রশক্তি আকাশ থেকে জর্মনির বৃহৎ বেতারকেন্দ্রগুলো, বিশেষ করে শর্টওয়েভের প্রায় সবগুলোকেই খতম করে দিয়েছেন।

বেতারে তখন সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেই অনুষ্ঠান ক্ষণতরে বন্ধ করে বলা হল, আপনারা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য তৈরি থাকুন; কিছুক্ষণ পরেই বেতারে ঘোষিত হল, আমাদের ফ্যুরার আডলফ্‌ হিটলার ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

এর পর যে শকটা পেল সেটা তাদের খুলি ভেঙে দিল না বটে, কিন্তু মাথার মগজ দিল ঘুলিয়ে। যেন ওমলেট বানাবার কল ব্রেনবক্সটার মধ্যিখানে তুর্কিনাচন লাগিয়ে দিল।

হিটলার মৃত্যুর চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে শ্রীমতী এফা ব্রাউন নাম্নী- তাবৎ জর্মনদের কাছে অজানা-অচেনা এক কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। সমস্ত জৰ্মনি যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট-জনের মতো একে অন্যকে শুধাল, সে কী! গত বারোটি বছর ধরে যে ফুরারের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, সে তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ছবি। যিনি সুখময় নীড় নির্মাণ করেননি, বল্লভার সন্ধান করেননি, এমনকি বংশরক্ষা করে উত্তরাধিকারীরূপে কাউকে স্বহস্তনির্মিত ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের সিংহাসন বিনিন্দিত সহস্ৰায়ু রাইষের (নাৎসি রাজ্যের) সিংহাসনে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাননি। অথচ তিনি কী ভালোই-না বাসতেন শিশুদের যখনই জনসাধারণের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেয়েছেন, তখনই দেখেছি তিনি কী হাসিমুখে শিশুদের আদর করে বাহুতে তুলে নিয়েছেন, তাদের মাতাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন, দেশের শ্রেষ্ঠা নর্তকী, অভিনেত্রী, নায়িকা, সুন্দরীদের জন্মদিনে তাঁদের বাড়িতে দেশি-বিদেশি বিরল ফুলের স্তবক পাঠিয়েছেন। প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গ্যোবেলস আমাদের বেতারে কতশত বার বলেছেন, এই সন্ন্যাসীর হৃদয়কন্দরে কিন্তু নিভতে বিরাজ করেন সৌন্দর্যের দেবতা। এ তপস্বী সেই বিশ্বকল্পনাময়ী চিন্ময়ীর উপাসক। সে চায়, নিভৃতে নির্জনে একাগ্র মনে তাকেই রঙে রেখায় ফুটিয়ে তুলতে, তোমাদের গৃহ সুন্দরতররূপে নির্মাণ করে তারই প্রতিষ্ঠা করে তোমাদেরই গৃহ মধুময় করে তুলতে। কিন্তু হায়, তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। জর্মনির ভাগ্যবিধাতা তার স্কন্ধে তুলে দিলেন বিরাট বিশাল রাইষের শুরুভার। তাকে বিরাটতর, বিশালতর এবং সর্বোপরি তাকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে নির্মাণ করার গুরুভার। এবং সে রাষ্ট্র এমনই প্রাণবন্ত, দীর্ঘজীবী হবে যে, এ যাবৎ পৃথিবীতে যে সকল সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র আপন নাম ইতিহাসে রেখে গেছে তাদের সবারই হতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের তুলনায় বালখিল্যবৎ– এ রাষ্ট্রের পরমায়ু হবে সহস্র বছর– থাউজেন্ড-ইয়ার-রাইষ।

আরও অনেক কথা বলেছেন ফুরার সম্বন্ধে, অনেক ছবি এঁকেছেন অ্যাডল হিটলারের তিনি, একের পর এক বিজয়মুকুট পরে ফুরার যখন মস্কোর দ্বারপ্রান্তে যেন রাশার মৃত্যুদূত এসেছে তার আত্মাকে শয়তানের অতল গভীরে চিরতরে বিলীন করে দিতে– তাঁর সে বিজয়-গর্বিত ছবি; এবং তার পর যখন পরাজয়ের পর পরাজয় দ্রুততর গতিতে চারিদিক থেকে বজ্রমুষ্টিতে তাকে ধরতে গেছে তখনও চির আশাবাদী গ্যোবেলস তাঁর বীণাযন্ত্র ভেঙে ফেলেননি, উচ্চতর কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন তার প্রভু, তার ফুরারের প্রশস্তি-সঙ্গীত। যেখানে ফুরার কৃসাধনরত যযাগী। তিনি সর্বসুখ বিসর্জন করে, সর্বধ্যান নিয়োজিত করে নির্মাণ করছেন সেই ব্রহ্মাস্ত্র (প্রায় শব্দার্থ, প্রথমা বিজয়িনী Victory one, অনুজা বিজয়িনী VII)–এবারে দধীচির অস্থি নিষ্প্রয়োজন (অর্থাৎ অন্য কোনও মিত্রশক্তির সাহায্যে জয়লাভ নয়, কারণ ইতোমধ্যে তার মিত্র ইতালি ও জাপান তাদের অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ রণাঙ্গনেও কোনও বিজয়চিহ্নের আভাস দেখতে পাচ্ছে না)। তিনি এই বার্লিন নগরী ত্যাগ করবেন না। এই ধ্যানপীঠের সম্মুখে এসেই শক্রসঙ্ হবে অবলুপ্ত, লীন হবে মহাশূন্যে!

এবং বিশ্বের ইতিহাসে এই অতুলনীয় ধর্ম প্রচারক বক্তা, জনগণমনজয়ের বীর গ্যোবেলস প্রায় প্রতিবারই তাঁর ভাষণ শেষ করতেন এই বলে, বিশ্বের ইতিহাসের এই সর্বোত্তম আত্মত্যাগ বিশ্ববিধাতা কর্তৃক লাঞ্ছিত হবে না। (কানে কানে বলি গ্যোবেলস ছিলেন নিরঙ্কুশ নাস্তিক; বরঞ্চ তার প্রভু হিটলার অন্তত অদৃশ্য অজ্ঞেয় অন্ধ নিয়তিতে–  শিঞ্জাল–বিশ্বাস করতেন)।

আজ হিটলার চিতাশয্যায় (বস্তৃত তাঁর ও পত্নী এফার দেহ তাঁরই সর্বশেষ আদেশানুসারে দেশাচারানুযায়ী গোর না দিয়ে পেট্রল দিয়ে পোড়ানো হয়) প্রবেশকালের প্রাক্কালে বিবাহ করলেন তার রক্ষিতাকে– যার সঙ্গে তিনি লোকচক্ষুর অগোচরে সর্ববিলাসবৈভবে পরিপূর্ণ সুসজ্জিত শৈলাবাসে কাটিয়েছেন কত-না ক্লান্তিহীন দিবস, নিদ্রাহীন রভস যামিনী, বছরের পর বছর, অন্তত চৌদ্দটি বছর অর্থাৎ দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করার প্রায় দু-বছর আগে থেকে!

কই, গ্যোবেলসের অঙ্কিত সেই বিলাসবিমুখ জিতেন্দ্রিয় সর্বত্যাগী রাইষের মঙ্গলকামনায় ধ্যানমগ্ন তপস্বীর সঙ্গে তো বেতারে প্রচারিত, একগুণকে শতগুণে বর্ধিত করে বিজয়ী মার্কিন সেনা উপস্থিত তারা জর্মনিতে থানা গেড়ে তার উপর সার্বভৌম রাজত্ব করছে এবং তাদের অভ্যালার্জিত কেলেঙ্কারি কেচ্ছা বর্ণনের সুমেরু শিখরে তথাগত তথাকথিত জার্নালিস্টের প্রকাশিত জর্মন এবং ইংরেজি ভাষাতে প্রচারিত দৈনিক, সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হিটলারের ছবি আদৌ মিলছে না।

বেৰ্ষটেশগাডেনে হিটলারের শৈলাবাস ছিল দশাধিক বছর ধরে সর্ব ধার্মিক নাৎসি, এমনকি মধ্যপন্থী সরলহৃদয় লক্ষ লক্ষ জর্মনেরও পুণ্যতীর্থভূমি। হিটলার সচরাচর থাকতেন নীরস বিরস বৈশ্যভূমি বার্লিনে; সম্মুখে কৃষ্ণকঠিন প্রস্তর-নির্মিত অপ্রিয়দর্শন বস্তুতান্ত্রিক রাজবর্ত্ম, চতুর্দিকে অভেদ্য পাষাণ প্রাচীর, পাষাণতর হৃদয়নির্মিত, বদনমণ্ডলে সর্বপ্রকারের অনুভূতি প্রকাশবর্জিত, শীতল কৃষ্ণধাতুতে নির্মিত অস্ত্রহস্তে রক্ষীদল, পাত্র-অমাত্যের স্বতশ্চল শকটের যন্ত্রীরব-বিষোষ নিনাদ, সদাই ফুরারের পরিদর্শনের জন্যে বিকটতম শব্দ করে দ্রুতগতিতে গমনাগমনরত দৈত্যসম পর্বতপ্রমাণ ট্যাঙ্ক-বর্ম পরিহিত সাঁজোয়া যান, আরও কত না নবীন নবীন বৃহৎ বৃহৎ মারণাস্ত্র, এবং ফুরার ভবনের প্রশস্ত মর্মর সোপান বেয়ে উঠছেন নামছেন অভিজাত শ্রেষ্ঠদের মুকুটমণি রাজদূতরাজি– তাদের বেশভূষার দিকে তাকালে অন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা। বেশের উত্তমার্ধ স্বর্ণাস্তরণে এমনই অলঙ্কৃত— যে তার পটভূমি চীনাংশুক, পট্টবস্ত্র, না কিংখাপে নির্মিত সে তত্ত্ব নির্ণয় করা অসম্ভব। প্রত্যেকেরই সেই স্বর্ণাস্তরণের উপর হীরকখচিত ভিন্ন ভিন্ন মহার্ঘ্য ধাতুনির্মিত সারি সারি মেডেল বিজয়-লাঞ্ছন– মনে হয় তার যে কোনও একটা সারির উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে একটিবার আঙুল চালিয়ে নেওয়া মাত্রই বেজে উঠবে যেন জলতরঙ্গে স্বরসপ্তক।

মানুষের ভক্তি যতই গভীর হোক, সেটা অতল নয়- গভীরতম মহাসমুদ্রের তল আছে। যতই গগনচুম্বী হোক গৌরীশঙ্কর নয় এবং তিনিও চুম্বন করেন মহাউর্ধ্বের পদরেণুকণা অভ্রংরাশিমাত্র। কাজেই সেই ভক্তি বার্লিনের ওই মারণাস্ত্র যক্ষপুরীকে পুণ্যতীর্থ ভূমিতে পরিণত করতে পারেনি।

তারা ছুটে আসত বেৰ্ষটেশগাডেনে। তার পরিবেশ, তার বাতাবরণ, তার চতুর্দিকে দীর্ঘশির অভিজাত শ্যামল বনস্পতি, উচ্চতায় সেইসব বনবৃক্ষের তুলনায় সহস্রগুণে উচ্চ পর্বত, মেখলাকার শৈলমালা, তাদের অনেকেই শীতে-গ্রীষ্মে তুষারাবৃত, আর শীতকালে হিটলার ভবনের চতুর্দিকে হয়ে যায় ধবল বরফাচ্ছন্ন। গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনে বনস্পতিরাজি নিরবচ্ছিন্ন বন্য বিহঙ্গসঙ্গীতে পরিপূর্ণ।

লক্ষ লক্ষ নরনারী শোভাযাত্রা করে লাইন বেঁধে হিটলারের সামনে দিয়ে গৃহীর সরলতামাখা –অর্থাৎ কর্কশ মিলিটারি কেতায় নয়–মার্চ পাস করত– হিটলার বিদেশাগত লয়েড জর্জ, জন স্যামুয়েল, অ্যান্টনি ইডেন জাতীয় অভ্যাগতদের আপ্যায়নে বা চপেটাঘাত প্রদানে অত্যধিক তৎপর না থাকলে পর।(১) নইলে এমনিতে দৈনন্দিন গেরস্তালি জীবনে হিটলার ছিলেন আদর্শ অতিথিসেবক, এবং এসব অপরিচিত লক্ষ লক্ষ অতি সাধারণ তীর্থযাত্রীদের প্রতি মাত্রাধিক সদয়। হিটলারের সেই বাড়ি নতুন জমিতে গড়া হয়েছিল বলে তখনও ছায়া দেবার মতো বিস্তৃত ও দীর্ঘ বৃহৎ বৃক্ষ একটিও ছিল না। সেই কঠোর রৌদ্রে (উঁচু পাহাড়ের উপর রোদ বড় কড়া হয়। কখনও কখনও তিনি পুরোপাক্কা দু ঘন্টা ধরে হিটলারি হাইল সেলুটে ডান হাত সম্মুখ দিকে প্রসারিত করে স্কন্ধাবধি উত্তোলিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন– পুরো প্রসেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। একদিন তার সখা ওস্তাদ ফটোগ্রাফার হফমান (এঁর নামটি মনে রাখবেন, পাঠক, ইনি হিটলারের প্রেমমঞ্চে বিদূষক–বিশুদ্ধ সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রানুযায়ী তিন অঙ্ক নাটিকার শেষে দুই অঙ্কে এবং সেই দুই অঙ্কে অভিনেতা মাত্র তিনজন– নায়ক, নায়িকা ও বিদূষক হফমান) হিটলারকে শুধোন, তিনি কী করে পুরো দু ঘন্টা ধরে, এরকম হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। হিটলার উত্তরে বলেন, নিছক মনের জোরে।

দ্বিতীয় শকের পর এইসব লক্ষ লক্ষ তীর্থ-প্রত্যাবর্ত ও ভগবান হিটলারের শ্রীমুখ দর্শনপ্রাপ্ত নরনারী বিহ্বল, সামান্য দুটি অসংলগ্ন বাক্য সংযোজিত করতে সম্পূর্ণ। অক্ষম, কর্তাভজাদের ন্যায় শুরু কাণ্ডারিতে যারা সর্ব প্রত্যয় সর্ব আত্মোৎসর্গ করে আপন আপন নোঙর ভবনদীতে অবহেলায় বিসর্জন দিয়ে বসেছিল, তারা তখন কী ভেবেছিল?

এই গম্ভীর মার্চ পাস, হিটলারের সৌম্যস্মিত বদন (অবশ্য তাঁর টুথ ব্রাশ মুস্টাশ বাদ দিয়ে এফা ব্রাউনও ছিলেন এটির জন্মবৈরী–কিন্তু ভক্তের কাছে তো বিটকেল গোপো গুরু ট্যারা চোখে চায়। তথাপি সে মোর গুরু নিত্যানন্দ রায় ॥), স্বস্তিবাচক আশীর্বাদসূচক অভয়মুদ্রার উত্তোলিত দক্ষিণ বাহু তার পিছনের পূত শান্ত সজ্জন ভবন, যেখানে গুরু অহোরাত্র জর্মন-মঙ্গল-কামনায় অহরহ তপস্যামগ্ন তার পিছনে ছিল এত বড় ধাপ্পা! একটি রক্ষিতা রমণী নিয়ে সঙ্গোপনে ঢলাঢলি! তার জন্য অতিশয় সযত্নে জর্মনির সর্বশ্রেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে নির্মিত হয়েছে ওই বাড়ির একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আস্ত wing!

মার্কিনরা মেতে উঠেছে, এবং রুচিবিহীন একাধিক জর্মন যোগ দিয়েছে সেই ভূতের নৃত্যে (আমি দোষ দিচ্ছিনে, জর্মনি তখন চরমতম দৈন্যপঙ্কে এমনি নিমগ্ন যে বেটাবেটির দু মুঠো অন্ন যোগ করার জন্য অনেক কিছু করতে সে প্রস্তুত আমার আপন দেশের দৈন্য কি আমি চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে দেখিনি, পরে বুঝিনি? এখন ঘাড় ফেরাই) হিটলারের ব্যক্তিগত জীবনের অন্তরঙ্গতম গোপন কথা বের করে রগরগে পর্নোগ্রাফি ছেড়ে টু ক্রোর পাইস্ কামাতে।

আর জর্মনি খায় শকের পর শক্। অবশ্য তখন জর্মনির এমনই দুরবস্থা যে প্রেস নেই, নির্জলা মিথ্যার বিরুদ্ধেও প্রকৃত সত্য দিবালোকে প্রকাশ করার উপায় নেই। এবং সমূহ বিপদও তাতে আছে। লেখককে যে কোনও মুহূর্তে বি-ওয়ারেন্টে যদিও সে নাৎসি ছিল না– ধরে নিয়ে যাবে denazification (of delousing) কোর্টে,(২) এবং অন্য কিছু সাক্ষীসাবুদ না নিয়ে, তুমি যে পাঁড় নাৎসি ছিলে সেইটে মার্কিন জংলি পদ্ধতি প্রমাণ করে পাঠিয়ে দেবে শ্রীঘরে (অবশ্য তখন সেই বীভৎস খাদ্যাভাবের করাল কালে জেলে ভালো হোক, মন্দ হোক দু মুঠো জুটত)।

কিন্তু সুইটজারল্যান্ডের বৃহত্তম অংশের ভাষা জর্মন। বহু নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এবং জেলমুক্ত নাৎসিবৈরী লেখক সেখানে গিয়ে আপন আপন বই বের করতে লাগলেন। তখন পরিপূর্ণ সত্য জানার ফলে জর্মনরা ধীরে ধীরে আপন আপন শমুক্ত হতে লাগল। এদের অনেকেই যদ্যপি হিটলার-যুগে মানব-দুর্লভ সাহস দেখিয়ে নাৎসি-বিরোধিতা করার ফলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও জেলবরণ করেন, (এবং সেখানে প্রায় সকলেই অসহ্য যন্ত্রণা ভোগের পর মারা যান) আজ তারা সত্য বলতে গিয়ে অনেক স্থলে নাৎসিবিরোধী এবং মিথ্যা হিটলার কেলেঙ্কারি প্রচারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার হিটলারের প্রাইভেট লাইফ সম্বন্ধে অনেক তথ্য ও তত্ত্ব বেরুল, 6706nosy American and peeping British- and some French thrown in the bargain for good measure- বহু পরিশ্রম করেও বের করতে পারেনি।

তারই অন্যতম, হিটলারের প্রেম সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য বেরুল যা দিয়ে প্রকৃত সত্য আজ হয়তো কিছুটা নিরূপণ করা যেতে পারে। এই যে মৃত্যুর চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে ১৪-১৫ বছরের রক্ষিতাকে হিটলার বিয়ে করলেন, সেটা কেন? সত্যই কি তিনি তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, যাকে আমরা বাংলায় প্রেম বলতে পারি, কিংবা এফা কি নিম্নস্তরের হাপূগেরস্ত (দেমি মদেন), তাঁর সঙ্গে হিটলার কি প্ল্যাটনিক প্রেম করেছিলেন (When just nothing happens), তাদের যৌন-জীবন কি সম্পূর্ণ নরম্যাল ছিল, হিটলার পারভার্স ছিলেন না কি না, এফাঁকে যদি সত্যই ভালোবাসতেন তবে তাকে বহু পূর্বে বিয়ে করলেন না কেন এবং জর্মনির জনসাধারণ বিশেষ করে মাতারা তো চাইতেনই যে ফুরার হোন আর যাই হোন, ফুরার হলেই তো আর দেহ পাষাণ হয়ে যায় না। (এটা বিদ্যাসাগরের নকল; তিনি বলেছেন, বিধবা হলেই তো তার দেহ পাষাণে পরিণত হয় না. তার পূর্বের সমাজসংস্কারকরা বলতেন, বিধবা হইলেই তো আর হৃদয় পাষাণে পরিণত হয় না), অতএব তারও বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা উচিত। এস্থলে বলা বাহুল্য সেটা পূর্বেই বলেছি যে এফার সঙ্গে হিটলারের প্রকৃত সম্পর্ক এতই মাত্রাধিক মিলিটারি টপ সিক্রেটের মতো তিনি লুকিয়ে রাখতেন, এবং তাঁর নিত্যসঙ্গীদের এবং চাকর-বাকরদের হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে তারাও প্রাণের ভয়ে এ বিষয়ে ঠোঁট সেলাই করে রাখতেন। এবং সর্বশেষ প্রশ্ন, এফাই কি তাঁর প্রথম প্রেম, না এ বিষয়ে তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতাও ছিল? সেইটাই আজকার বিষয়বস্তু।

ন্যুরনবের্গের মোকদ্দমার সময় (মিত্রপক্ষ বনাম নাৎসি রাইষের প্রধান প্রধান প্রতিভূ, যেমন হিটলারের পরের সম্মানিত জন ফিল্ড মার্শেল গ্যোরিং– হিটলার হঠাৎ মারা গেলে হিটলারের ফরমান অনুযায়ী তিনি ফুরার হতেন; তাবৎ জঙ্গি বিভাগের বড়কর্তা– হিটলারের পরেই কাইটেল, তার পরের জন মোড়ল, ইত্যাদি ইত্যাদি সর্বসুদ্ধ ডজন দুই) আদালতের সামনে প্রাগুক্ত প্রশ্নগুলো আসামিরা দোষী না নির্দোষ সে বিচারে অল্পের চেয়ে বিস্তর অবান্তর ছিল বলে সেগুলো আদালত সাতিশয় সংক্ষেপে সারেন। (অথচ পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কেন কোটি কোটি লোক বললেও আমি সংখ্যাটাকে অম্মদ্দেশীয় গঞ্জিকা-নিৰ্গত বলে পত্রপাঠ বাতিল করে দেব না– জানতে চেয়েছিল হিটলারের প্রেম সম্বন্ধে এবং আজও জর্মনির ভিতরে-বাইরে বিস্তর লোক এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন।) সৌভাগ্যক্রমে মার্কিনরা তাঁদের দেশের রীতি অনুযায়ী তাঁদেরই গুটিকয়েক সর্বোত্তম সাইক্রিয়াট্রিস্টকে সঙ্গে এনেছিলেন। আসামিদের একাধিকজন হিটলার ও এফাঁকে অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন– হিটলারের বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়ি বেহফে এঁরা হিটলারের অতিথিরূপে একাধিকবার গিয়েছেন এবং নিতান্ত বাইরের (বেগানা) লোক না থাকলে তারা হিটলার ও এফার সঙ্গে খেয়েছেন, বেড়াতে গিয়েছেন, পিকনিক করেছেন, বাড়ির প্রাইভেট ফিল্ম শো প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই একসঙ্গে বসে দেখেছেন।

তাই মার্কিন ডাক্তাররা মোকদ্দমায় অবান্তর হিটলারের যৌনজীবন সম্বন্ধে আপন আপন কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য এঁদের শুধিয়েছেন অনেক প্রশ্ন। যেমন ডাক্তার গিলবার্টের প্রশ্নের Tech Comp Cay fasters 267 766169a, Of course, he was normal like any one of us, অর্থাৎ হিটলার ছিলেন এসব বাবদে আর পাঁচজনের মতোই নর্মাল।

সেই সময়ই জর্মন জনগণ অবশ্য প্রধানত জর্মন সাক্ষীদেরই মারফতে একটি তরুণীর কথা জানতে পায়, নাম, গেলি (Angelika এবং Geli এঁর ডাকনাম) রাউবাল।

আমার ব্যক্তিগত মতে হিটলার ভালোবেসেছিলেন 1/2 + 1 + 1/2 হাফ প্লাস ওয়ান প্লাস হাফ) অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে দু-বার।

প্রথম হাফটা সচরাচর রোমান্টিক কাফ ল অর্থাৎ বাছুরের মতো করুণ নয়নে তাকানো, ম্যা-ম্যা রব ছাড়া যার অর্থ গোপনে অজস্র অশ্রু বর্ষণ করা, এবং সবচেয়ে বড় কথা বাছুর যে-রকম শিং গজাবার সময় যত্রতত্র ঢু মেরে নিজের মস্তকদেশই জখম করে, বেশি চ্যাংড়ার বেলাও অবিচারে যত্রতত্র প্রেমে পড়ে নাস্তানাবুদ হওয়া।

কিন্তু হিটলারের কাফ লভ প্রচলিত প্যাটার্ন নকল করেনি– এমনকি তার প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত বাল্যজীবনের একমাত্র জীবনীলেখক, হিটলারের অতি প্রিয় একমাত্র বাল্যসখা– তিনি যা লিখেছেন সেখানে অনেকগুলো লক্ষণ দেখা যায় যেগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে, এ স্থলের নায়ক কিন্তু অসাধারণ প্রেমিক। আমি আজ সে কাহিনী কীর্তন করব না, আমার উদ্দেশ্য সেই কাহিনী কিঞ্চিৎ শুনিয়ে দেওয়া যেটাকে হিটলারের স্যুনিক যুগের (১৯২০ থেকে ১৯৩৩) সর্ব অন্তরঙ্গ জন– সংখায় অতিশয় কম– এক বাক্যে হিটলারের ওয়ান অ্যান্ড গ্রেট লভ বলেছেন–গ্রেটেস্ট বলেননি কারণ তা হলে অন্যগুলো অর্থাৎ যেগুলোকে আমি উপরে প্রথম হাফ ও দ্বিতীয় হাফ রূপে চিহ্নিত করেছি, ও ওই একমাত্র গ্রেট লভের সঙ্গে একাসন না পেলেও একই শ্রেণিতে বসবার অনর্জিত সম্মানলাভ করে। কিন্তু সেই কাহিনীর নান্দী গাইবার পূর্বে, পাঠকের কৌতূহল কিঞ্চিৎ প্রশমিত করার জন্য উল্লেখ করি, হিটলার তার প্রথম প্রেমের নায়িকাকে চার বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন রাস্তায় অন্তত দু বার করে দুরুদুরু বুকে ক্রস করেছেন, হ্যাট তুলে ভিয়েনার ভদ্রজনসম্মত পদ্ধতিতে গভীরতম বাও করেছেন তিনি (জীবনী-লেখক– সে মহিলা এখনও জীবিতা এবং বিধবা, এখন বয়স প্রায় পঁচাত্তর– তাই ছদ্মনামে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন) যেদিন মৃদুহাস্য সহকারে প্রতিনমস্কার করেছেন সেদিন অষ্টাদশবর্ষীয় হিটলার

আশার বাতাসে করি ভর ফিরে যেত অ্যাডলফ কুটিরে।

 আর যেদিন প্রিয়া সঙ্গের আর্মি-অফিসার উমেদার নাগরের প্রতি ঈষৎ সম্মোহিত বলে হিটলারের প্রতি ভ্রু-কুঞ্চিত করতেন সেদিন হিটলার–ইংরেজিতে যাকে বলে saw red, অর্থাৎ তিনি মহাপ্রলয় ডেকে এনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিনষ্ট করার জন্য সেই শিঙাটি খুঁজছেন। বাল্যবন্ধু বলছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে সে কী চিৎকার! অভিসম্পাত দিচ্ছে সবাইকে, আর বিশেষ করেই ওই হতভাগা আর্মি-র পাপাত্মা অফিসারদের।(৩) বন্ধু বলছেন, বুর্জুয়া সম্প্রদায়ের প্রতি হিটলার অতি বাল্য বয়স থেকে সমস্ত সত্তা দিয়ে নিকৃষ্টতম ঘৃণা প্রকাশ করতেন এবং বিশেষ করে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সম্রাট-সেনাবাহিনীর অফিসারদের এবং তাদের উদ্ধত ভাব, দাম্ভিক আচরণের প্রতি যত্রতত্র সর্বোত্তম সর্বোক্তৃষ্ট বস্তু, আদর-আপ্যায়ন যেন তাদেরই সর্বপ্রথম প্রাপ্য, যেন স্বর্গ থেকে স্বয়ং সেন্ট পিটার স্বহস্তে তাদের জন্যে যে শাহ্-ই-শাহী। ফরমান লিখে দিয়ে নিজেই ধন্য হয়েছেন– এই ভাব। (৪)

পুষ্পোৎসবের প্রভাতে হিটলার তার সর্বোত্তম সজ্জা পরে পথপার্শ্বে অপেক্ষা করছেন, তাঁর প্রিয়ার জন্যে, তিনিও আসবেন শব্দার্থে, পুরথে, পুষ্পভরণ পরিধান করে। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। অবশেষে তিনি এলেন। হিটলার হ্যাট তুলে অন্য দিনের তুলনায় প্রচুরতর সসম্ভ্রম অভিবাদন জানালেন। সেই ভিড়ের মধ্যেও প্রিয়া তাকে লক্ষ্য করে তার হাতের পুষ্পগুচ্ছ থেকে একটি ফুল তুলে নিয়ে তাঁর দিকে ছুঁড়ে ফেলে প্রসন্ন মৃদুহাস্য করলেন।

সপ্তম স্বর্গে আরোহণ করে– বরঞ্চ বলা ভালো সে মহালগনে তিনি সপ্তম স্বর্গেও যেতে সম্মত হতেন না। হিটলার বাড়ি ফিরলেন।

এই চার বছরের ভেতর হিটলার ওই তরুণীটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাঁর সখার কাছে, তিনিও যতখানি পারেন উপদেশ দিয়েছেন, কিন্তু হিটলার তার কোনও উপদেশ, কিংবা নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী কোনও কৌশলই হাতে-কলমে ফলপ্রসূ করার চেষ্টা দেননি! এ বড় আশ্চর্যের কথা। এ নিয়ে প্রাগুক্ত জীবনীকার বিস্তর গবেষণা, বিস্তর চিন্তা করেছেন, কিন্তু এস্থলে তার স্থানাভাব এবং ঈষৎ অবান্তর বলে বর্জন করতে অনিচ্ছায় বাধ্য হলুম। শান্তি, সময় ও সুযোগ পেলে পরে চেষ্টা করব। কারণ যদিও দু-জনাতে কোনও কথা হয়নি, পত্রবিনিময় পর্যন্ত হয়নি, তবু ঘটনাটি সত্যই চিত্তাকর্ষণ করে– কারণ হিটলার তার স্বর্গীয় প্রেমের অভিব্যক্তি, এই প্রিয়াকে এক শুভদিনে দাম্পত্যবন্ধনে বন্ধন করার শুভেচ্ছা, সবই বন্ধুকে বলতেন। গৃহনির্মাণের স্কেচ আঁকাতে হিটলার সেই তরুণ বয়সেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন (ফুরার রূপে পরবর্তী জীবনে তিনি শতকর্মের মাঝখানে, এমনকি আত্মহত্যার কয়েকদিন পূর্বেও বহু অভূতপূর্ব বিরাট প্রাসাদ, সৈন্যদের জন্য য়ুনিফর্ম, মেডেল, নৌবহরের জন্য সাবমেরিন ইত্যাদি নানা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর স্কেচ করেছেন এবং প্রায় সব স্কেচই কর্মে পরিণত করা হয়েছিল) এবং তাই বিবাহের পর যে ভবনে কপোত-কপোতী বাস করবেন তার অসংখ্য স্কেচ আঁকতেন হিটলার সমস্ত দিন ধরে।

হিটলার যখন স্কেচের উচ্চতম নভঃলোকে উডডীয়মান তখন কিন্তু তার সখা, জীবনী-লেখক প্রখর ব্যবসায়-বুদ্ধিধারী– তাঁর পিতাও ব্যবসায়ী– ঘোর বস্তুতান্ত্রিক গুস্তাফ–এককথায় স্বপ্নলোক নিবাসী ডন কুইকসোটের যেমন হুবহু উল্টো কড়া সংসারী তামসিক সাঙ্কো পাজা, এস্থলে হিটলারের সাঙ্কো পাজা, ভিন্ন গোত্রের বসওয়েল, স্কেচের পাশে দাঁড়িয়ে বলত, হুঃ! সবই বুঝলুম, কিন্তু সেই বস্তুটি টাকা! তিনি জানতেন হিটলারের বৃদ্ধা মাতার অতি ক্ষুদ্র পেনশন ভিন্ন সে পরিবারে একটি কানাকড়িরও আমদানি ছিল না।

হিটলার স্বপ্নভঙ্গে বিরক্ত হয়ে বলতেন, আখ তোমার শুধু টাকা, টাকা।(৫)

 কিন্তু এ কাহিনী এখানেই থাক। আমি শুধু ভাবি, কবিসম্রাট দান্তের কথা।

তাঁর প্রিয়া বেয়াত্রিচে সখীজনসহ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে শুধু একবার মাত্র প্রেম-বিহ্বল কবির দিকে স্মিতহাস্য করেছিলেন। আরেকবার পুষ্পের জন্য বিখ্যাত ফ্লরেন্স (Flora) নগরীর পুষ্পেসবে যখন সবাই সবাইকে পুষ্পেহার দিচ্ছেন, এমনকি অচেনা জনকেও তখন হয়তো কিছুমাত্র না ভেবেচিন্তেই প্রেমোন্মাদকে একটি ফুল এগিয়ে দেন। ব্যস! আর তো কিছু জানবার উপায় নেই। তাই বোধ হয়, তথ্য যেখানে যত কম, কিংবদন্তি সেখানে, সেই অনুপাতে তত বেশি। সেই শত শত কিংবদন্তির মাঝখানে একটি সত্য প্রোজ্জ্বল; দান্তের সুপ্ত কবিসত্তা তাকে সচেতন করে দিয়ে বলল, তোমার প্রেমে আর এই নগরীর শত শত প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমে পার্থক্য কোথায়? বিনয়ভরে যেন সেই পরমাত্মার সম্মুখে মস্তক নত করে দান্তে রচনা করলেন তার স্বর্গীয় কাব্য (দভিনা কম্মেদিয়া= ডিভাইন কমেডি)।

দান্তে আপন জন্মের নগর থেকে বিতাড়িত হন– রাজনীতির জুয়াখেলাতে হেরে গিয়ে। হিটলার স্বেচ্ছায় (বা অনিচ্ছায়) স্বদেশ অস্ট্রিয়া ত্যাগ করে জনি গিয়ে সেখানে পূর্ণ বারোটি বছর রাজমুকুট পরার পর নিজ হাতে আপন প্রাণ নিলেন। আমি শুধু ভাবি হিটলার যদি রাজনীতিতে দান্তের মতো নিষ্ফল হতেন তবে হয়তো তিনিও তার বেয়াত্রিচেকে কাব্যলক্ষ্মীর স্বর্ণমন্দিরে অজরামর করে রেখে যেতেন, অবশ্য হিটলার নিশ্চয়ই দান্তের ইফেরননা (নরক) অধ্যায়টা লিখতেন বেশি ফলাও করে। কিংবা হয়তো কাব্যলক্ষ্মীর নবীন মন্দির নির্মাণ করে– স্থাপত্যেই হিটলারের সর্বাধিক প্রতিভা ছিল, এ সত্য তাঁর শক্ৰমিত্র সবাই স্বীকার করেন।

———–

১. আমার আশ্চর্য বোধ হয় এইসব ডিপ্লোমেটরা সেই নরঘাতক হিটলারের সম্মুখে তখন কী বেহদ বেহায়া, বেশরম, বেইজ্জৎ বাঁদর-নাচ, আবার বলছি, কোমরে ছিটের ঘাগরা পরে বাঁদর-নাচ নেচেছেন! পরে এঁদের অনেকেই বলেছেন– শিশুর মতো গদ্গদ সরল কন্ঠে আমরা তখন জানতুম না, মাইরি, লোকটা ও-রকম একটা আস্ত নর-পিশাচ। বটে! ন্যাকামির জায়গা পাওনি? তোমরা Fool তো বটেই তদুপরি knave! তোমরা বুকে হাত দিয়ে বল, তোমরা জানতে না, হিটলার রাজাসনে বসার প্রথম দিনই কম্যুনিস্টদের ওপর কী অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করে, তার পর ইহুদিদের নিয়ে, তার পর ২০ জুলাই ১৯৩৪-এ তাঁর সহকর্মীদের রোম্ এর্নস্ট, হাইস (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এরা ছিল নির্দোষী)- mass murder, without any trial (শব্দার্থে নির-বিচারে পাইকারি হারে খুন) তোমরা তো তখন নিতম্ব বাজিয়ে নৃত্য করেছ! কণ্টক কণ্টকে নাশ! মুখে যতই ধানাইপানাই কর, ইহুদিদের প্রতি তোমাদের মনোভাব অন্তত আমার অজানা নয়। আর যদি এ-সব না জানতে তবে নিজেদের ডিপ্লোমেট বলে পরিচয় দাও কেন? রাস্তার মেথরানি আর তোমাতে তা হলে কী তফাত!

২. এরা যখন মার্কিন জেল থেকে মুক্তিলাভ করল, ততদিনে আবার জর্মনিতে আপন আধা-স্বাধীন সরকার, মায় আদালতসুদ্ধ বসে গেছে। এই আদালত এদের এবং অন্য বহু লোককে ধরে আবার আরম্ভ করলে denazification (অর্থাৎ দেশকে ভূতপূর্ব নাৎসিমুক্ত করা) মোকদ্দমা গণ্ডায়-গণ্ডায়। এনারা আবার ওয়াদের চেয়ে এককাঠি সরেস। কারণ জজদের অনেকেরই সামনে এসে দাঁড়ালেন এমন সব নাৎসি যাদের হাতে বিচারকরা নাৎসি-রাজত্বে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। (অবশ্য লাঞ্ছিত হওয়ার সময় তাঁরা জজ ছিলেন না, কিংবা ডিসমিস হয়েছিলেন) এঁরা নিলেন তাদের পূর্ণ প্রতিহিংসা– জেল, নাগরিকাধিকার লোপ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল বহু লোকের এমনকি যাদের মার্কিন কোর্ট কোনও প্রমাণ না পেয়ে বেকসুর ছেড়ে দিয়েছিল। আবার উল্টোটাও হল। যেখানে জজ নির্বাচিত হলেন কোনো প্রচ্ছন্ন নাৎসি তখন তিনি পাঁড় নাৎসিদের অনেককেও ছেড়ে দিলেন কিংবা দিলেন মোলায়েমতম সাজা। তার পর হল আরেক ফার্স। জর্মন আইনে নিয়ম (এ আইন রোমান আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ আইন তা নয়) কোনও অপরাধের বিশ বছর পরে সন্দেহযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও মোকদ্দমা হতে পারে না। হিটলার আত্মহত্যা করেন ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। মোটামুটি বলা যেতে পারে হিটলার নির্বাচিত নবীন চ্যান্সেলর মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন ৮ মে। অতএব লেগে গেল ধুন্ধুমার। তা হলে ৮/৫/৬৫ তারিখে দেশে-বিদেশে লুক্কায়িত খুনিয়া খুনিয়া সব নাৎসি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে আবার নবীন নাৎসি সঙ্ তৈরি করবার চেষ্টা করবে। হয়তো-বা এই কুড়ি বছরে যারা নাৎসিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কড়াকড়ি ব্যবস্থা করেছিল তারা প্রাণ দেবে গুপ্ত নাৎসি ঘাতকের হাতে, অন্ততপক্ষে গোপনে অপমানিত লাঞ্ছিত এবং প্রহৃত হবে। কারণ এদের অনেকেই ছিলেন পয়লা নম্বরি নাৎসি, যেমন হিটলারের সেক্রেটারি মার্কিন বরমান, এবং ইহুদি নিধনের গ্যাসঘর তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চোপদার (ন-টি ল্যাজওলা চাবুক মারনেওলা), কমান্ডান্ট, কয়েদিদের ওপর মারাত্মক (এদের ৯৫% মারা যায়) সব ব্যারামের experiment করনেওলা ডাক্তার, অথবা পাঁড় নাৎসি সম্পূর্ণ বিবেকহীন, আইন বাবদে পরিপূর্ণ অজ্ঞ নাৎসি কর্তাদের মেহেরবানিতে নিযুক্ত জজ যারা কারও বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ (নাসি) মোকদ্দমা আনা মাত্র আসামিকে অপমানিত লাঞ্ছিত করে– মুক্ত অথবা গুপ্ত আদালতে হয় ফাঁসির হুকুম, নইলে চৌদ্দ বছরের জেল। এদের অনেকেই-বা অজ্ঞাতবাস থেকেই বেনামিতে নাৎসিবৈরীদের শাসিয়েছে। তাই বহু আন্দোলনের পর এমনকি ক্যাবিনেটে এ-বাবদে দ্বিধা ছিল– যে, যদ্যপি ৮/৫/৪৫-এর পর কোনও নাৎসিরাজ ছিল না, এবং ফলে তার পর কোনও নাৎসি অপরাধ হয়নি এবং বিশ বছর পর সব খতম হওয়ার কথা। তবু আরও দশ না কুড়ি বছর ধরে (আমার ঠিক মনে নেই) পূর্ব-নাসরা ধরা পড়লে মোকদ্দমা চলবে।

৩. ওই সময় থেকেই হিটলার আর্মি-অফিসারদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন বললে হয়তো অত্যুক্তি তথা বিনা যুক্তিতে জটিল সমস্যাকে অত্যধিক সরল করে ফেলার ওভার সিমপ্লিফিকেশন অকর্ম করা হবে। তবে এ কথা সত্য, পরবর্তীকালে জর্মন আর্মি ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় প্রতিষ্ঠান– except the army officers, এবং এটাও বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য যে, আত্মহত্যা করার ঠিক ২২ ঘণ্টা পূর্বে তিনি তার জীবনের যে সর্বশেষ পত্র লেখেন সেটি আর্মির সর্বপ্রধান কর্তা– অবশ্য তার পরে–কাইটেলকে। সে চিঠির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জর্মন আর্মি-অফিসারমণ্ডলীকে, আমাদের ভাষায় যেন পৈতে ছিঁড়ে, উচ্ছন্ন যাও, উচ্ছন্ন যাও বলে ব্রহ্মশাপ দেওয়া। সে পত্রে তিনি বলেন, গত (প্রথম) বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পাই, এ যুদ্ধের জর্মন অফিসারগণের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধের অফিসারদের কোনও তুলনাই হয় না। এ যুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে সংগ্রামকারী জোয়ানদের সাফল্যের তুলনায় অফিসারগণ যেটুকু সামান্য করতে পেরেছেন সেটা জোয়ানদের কর্মসিদ্ধির তুলনায় অতিশয় তুচ্ছ।

৪. হিটলারের খাস চাকর– valet– ছিলেন জনৈক হাইনৎস লিঙে। ইনি হিটলারের জামাকাপড় দুরস্ত রাখা, ঔষধ-পত্র হামেহাল হাজির রাখা, এসব শত কাজ তো করতেনই– এমনকি ইভনিং ড্রেস পরার সময় বো-টিও তিনি বেঁধে দিতেন। কিন্তু তাঁর সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ এবং গরিমাময় কর্মও বটে– জর্মনির ফুরার ও তার প্রিয়া এফার বিছানা তৈরি করা। একদা তিনি দুজনকে এমন অবস্থায় পান হিটলার ব্যত্যয়-বিহীন অভ্যাসমতো মাত্র সেই এক দিন দোরে চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন যে তার চাকরি যাবার যোগাড় হয়েছিল। এই কর্মের জন্যে তাকে বাছাই করা হিটলারের অতিশয় খাস সেনাবাহিনীর (এস এস = শুৎসৃস্টাফেল) সর্বশ্রেষ্ঠ এক হাজার সৈন্য থেকে। প্রভুকে পূর্ণ দশটি বছর সেবার পর যখন হিটলার মিত্রশক্তির নিপীড়নে বার্লিনে প্রায় অবরুদ্ধ হতে যাচ্ছেন তখন অবশ্য মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি দেবার জন্য হিটলার তাঁকে ডেকে আপন পরিবারে চলে যাবার অনুমতি দেন। প্রভুভক্ত লিঙে যাননি। ফলে হিটলারের শেষ পর্বের আত্মহত্যার বুলেটশব্দ পর্যন্ত তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনতে পান, তাঁর মৃতদেহ চিতাস্থলে বয়ে নিয়ে যেতে, চিতাতে অগ্নিসংযোগ করতে সাহায্য করেন। এফাও এঁকে বড়ই বিশ্বাস করতেন এবং প্রাণের কথাও খুলে বলতেন।

 হিটলারের ভূগর্ভস্থ, বিরাটতম বোমার আক্রমণেও নিরাপদ বুঙ্কার তিনি প্রভুর শবদাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিত্যাগ করেননি। সে কর্ম সমাধান করে তিনি যখন রুশ সেনানী ভেদ করে– রাশানরা তখন বুঙ্কার থেকে তিনশো গজ দূরে মার্কিন অধিকৃত এলাকায় আপন পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করেন তখন বার্লিনেই রুশদের হাতে বন্দি হন। পূর্ণ দশটি বছর তিনি ওই দেশে ডাকসাইটে সব কারাগারে– (কিছুকালের জন্য সাইবেরিয়া বাস করে তিনি বিশ্ববন্দিমণ্ডলীতে যেন সোনার তাজ পেয়েছেন!)– বহু যন্ত্রণা ভোগ করে ১৯৫৫-এ পশ্চিম বার্লিনে ফিরে আসেন। এসেই তিনি হিটলার সম্বন্ধে প্রচলিত বহুবিধ গুজব বিনাশার্থে একখানা চটিবই লেখেন। তার এক স্থলে আছে, বিদেশের কোনও হোমরা-চোমরা তার সঙ্গে দেখা করে তার পদলেহন করার পর তিনি অতিশয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন, দেখলে লিঙে, (ইনি কোনও কোনও সময় অভ্যাগতের জন্য পানাদি নিয়ে যেতেন– লেখক) ব্যাটারা কীরকম গত যুদ্ধের সামান্য এক জোয়ানের (হিটলার কর্পোরেল ছিলেন) সামনে হাঁটু নিচু করছে। আর বিদেশি কোনও জঙ্গিলাট হলে তো কথাই নেই। বস্তুত হিটলার প্রকৃত মহাপুরুষদের মতো এসব বুর্জুয়া সুবদের উপেক্ষা না করে তাদের সাষ্টাঙ্গ প্রণামে পরিতৃপ্ত হতেন– যেন তাঁর তরুণ বয়স ও যৌবনকালে আহত আত্মাভিমান সান্ত্বনাপ্রলেপ পেয়ে বেদনা-দাগটা (তখনও!) লাঘব করে দিত। লিঙে সম্বন্ধে আমি হিটলারের শেষ দশ দিন নামক প্রবন্ধে, দু হারা গ্রন্থে ঈষৎ সবিস্তারে লেখার সুযোগ পেয়েছিলুম।

৫. আসলে কিন্তু এই সখা অতিশয় সদাশয় ভদ্র নির্লোভ ব্যক্তি। ওঁদের বয়স যখন প্রায় কুড়ি (১৯১০-১১ গোছ) এবং একসঙ্গে একই কামরায় ভিয়েনায় বাস করতেন তখন হিটলার দৈন্যপঙ্কে নিমজ্জিত হতে হতে শেষটায় এমন অবস্থায় পৌঁছলেন যে, অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী সখা গুস্তাফকে বিব্রত না করার জন্যে হিটলার আমৃত্যু ছিলেন এমনই আত্মাভিমানী, touchy, যেটাকে নিশ্চয়ই morbid বলা চলে– একদিন সখাকে কিছু না বলে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেলেন। তার প্রায় ২৫ বছর পর হিটলার লোকচক্ষের সম্মুখে রাজনৈতিক নেতারূপে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তখন গুস্তাফ খবরের কাগজ মারফত, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারলেন। তার পর ১৯৩৩-এ যখন হিটলার চ্যান্সেলর হলেন তখন দীর্ঘ ২৩ বছর পর গুস্তাফ তাঁকে চিঠি লিখলেন। উত্তরও পেলেন। ১৯৩৪-এ হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে যখন বিজয়ী বীরের মতো লিৎসে পৌঁছলেন তখন দুই সখাতে দেখা হল। গুস্তাফ ছোট্ট সরকারি চাকরি করতেন এবং অল্পেই সুখী ও সন্তুষ্ট ছিলেন বলে হিটলারের big offer তিনি গ্রহণ করলেন না। তবে প্রতি বছর দু-একবার হিটলারের নিমন্ত্রণে প্রধান প্রধান সঙ্গীতের জলসা উৎসবে একসঙ্গে যেতেন। বস্তুত হিটলারের সর্বজীবনীকার একবাক্যে বলেছেন, গুস্তাফই একমাত্র হিটলার-সখা যিনি তাদের বন্ধুত্ব পৌন্ড-শিলিঙে পরিবর্তিত করেননি। জলসাতে যে যেতেন তার একমাত্র কারণ এক জলসাতেই আপন ছোট শহরে তাঁদের প্রথম পরিচয় হয়– সঙ্গীতই ছিল উভয়ের প্রাণতুল্য প্রিয়। গুস্তাফের ভদ্র আত্মবিসর্জন কতখানি, পাঠক এর থেকেই বুঝতে পারবেন যে, তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন সঙ্গীত, কিন্তু সে পথে সুযোগ না পেয়ে একটি ছোট্ট দফতরে চাকরি নেন। হিটলার তাকে বলেন, যেখানে খুশি বল, আমি সরকারি সঙ্গীতালয়ে তোমাকে প্রধান সঙ্গীতচালক করে দিচ্ছি। তুমি পাবে, সর্বসময়, সর্বাবস্থায় আমার প্রটেকশন! শুস্তাফ সে লোভও সংবরণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *