হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস চর্চা
হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীস পূর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি, অগ্রগতি, প্রসারতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। এই হাদীস একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার এক-একটি বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়।
এই শতকের মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীসের সন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেন; মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রে খুঁজিয়া আঁতি-পাতি করিয়া ছাড়েন। এক-একটি শহর, এক-একটি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছিয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহকে এক করেন। পূর্ণ সনদ সম্পন্ন হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেন। সন্দ ও বর্ণনা সূত্রের ধারাবাহিকতা এবং উহার বিশুদ্ধতার উপর পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন। এই প্রয়োজনে ‘আসমা-উর-রিজাল’ এর স্বতন্ত্র জ্ঞান-বিভাগ হিসেবে সংকলিত ও বিরচিত হয়। হাদীস যাচাই-পরীক্ষা, ছাঁটাই-বাছাই ও সত্য মিথ্যা নির্ধারণের সূক্ষ্ম তত্ত্ব একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে। প্রখ্যাত ‘সিহাহসিত্তাহ’ (ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ)-ও এই শতকেই সংকলিত হয়।
এই শতকে একদিকে যেমন হাদীস সংগ্রহ, সংকলন, গ্রন্হ প্রণয়ন ও হাদীস-সম্পর্কিত জরুরী জ্ঞানের অপূর্ব উদ্ভাবন হয়, অপরদিকে মুসলিম জনগণের মধ্যে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার অদম্য উৎসাহ এবং বিপুল আগ্রহ ও পরিলক্ষিত হয়। এক-একজন হাদীস শিক্ষাদাতার সম্মুখে দশ দশ হাজার ছাত্র হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে সমবেত হইত ও আসন গ্রহণ করিত। হাফেয যাহবী অষ্টম পর্যায়েরএকশত ত্রিশজন মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহাদেরই সমপর্যায়ের বড় এক জামা’আত হাফেযে হাদীস- এর কথা উল্লেখ করিলাম না।এই সময় এক-একটা দরসে হাদীসের বৈঠক দশ হাজার কিংবা ততোধিক দোয়াতএকত্র হইত। লোকেরা রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ করিতেন এবং এইরূপ মর্যাদা সহকারেই তারা ইহার প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য দিতেন। তাহাদের মধ্যে দুইশত লোক ছিলেন হাদীসের ইমাম। তারা যেমন হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য ছিলেন, তেমনি তারা প্রকাশ্যভাবে ফতোয়া দেওয়ার কাজও শুরু করিয়াছেন।
[********************]
উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যে দশ সহস্র ছাত্র উপস্থিত থাকার কথা বলা হইয়াছে, তাহা অতি সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র সম্পর্কেই প্রযোজ্য হইতে পারে। কেননা হাদীসের বড় ও বিশিষ্ট ইমাম এবং হাফেযদের দরসের মজলিসে ইহাপেক্ষাও বহুগুণ বেশী- এক লক্ষ পর্যন্ত হাদীস শিক্ষার্থী সমবেত হইত এরূপ উল্লেখ পাওযা যায়। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ছাত্র ইমাম হাফেজ আবুল হাসান আলী ইবনে আসেম ওয়াস্তীর দরসে হাদীসের মজলিসে ত্রিশ সহস্রাধিক ছাত্র একত্র হইত।
[********************]
হাসান ইবনে আসিমের হাদীস শিক্ষা লাভের পশ্চাতে এক ঘটনার উল্লেক করা হয়। তাঁহার পিতা তাঁহাকে এক লক্ষ মুদ্রা দিয়া বলিয়াছিলেনঃ
******************************************************
তুমি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা কর; অন্তত এক লক্ষ হাদীস শিক্ষা করিয়া না আসা পর্যন্ত আমি তোমার মুখ দেখিতে চাই না।
অতঃপর তিনি বিদেশে চলিয়া যান ও হাদীস শিক্ষার এতদূর ব্যুৎপত্তি লাথ করেন যে, শেষ পর্যন্ত হাদীস-পারদর্শিতার প্রতীক হিসাবে ‘মুসনাদুল ইরাক’ ও ‘আল-ইমামুল হাফেজ’ প্রভৃতি খেতাব লাভ করিয়া পিতার নিকট প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতেও হাদীস শিক্ষা করিয়াছিলেন।
[********************]
তাঁহারই পুত্র ইমাম আবূ হুসাইন আসিম ইবনে আলী ওয়াস্তী (মৃঃ ২১২ হিঃ) ইমাম বুখারীর ওস্তাদ। বুখারী শরীফে তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। তাঁহার সম্পর্কে হাফেয যাহবী লিখিয়াছেনঃ
তিনি বাগদাদে উপস্থিত হইয়া হাদীস লিখাইতে শুরু করিলেন।ফলে তাঁহার নিকট শিক্ষার্থী জনতার এক বিরাট ভীড় জমা হইয়া গেল।
[********************]
আবূল হুসাইন ইবনুল মুবারক (র) বলেনঃ তাঁহার দরসের মজলিসে লক্ষাধিক লোক জমায়েত হইত। হারূন নামক এক ব্যক্তি খেজুর গাছের মাথায় উঠিয়া দূর দূর পর্যন্ত তায়হার আওয়াজ পৌঁছাইবার কাজ করিতেন। এই মজলিসে লোকের সংখ্যা অনুমান করিয়া বুঝা গেল যে, এক লক্ষ বিশ হাজারের কম হইবে না।
[********************]
ইয়াযীদ ইবেন হারূন ইমাম আজম আবূ হানীফার অপর একজন ছাত্র। তিনি হাদীসের একজন বিশেষজ্ঞ ও বিপুল সংখ্যক হাদীসের হাফেয ছিলেন। তিনি বাগদাদে হাদীসের দরস দিতেন। তাঁহার দরসের মজলিসৈ সত্তর হাজার ছাত্র সমবেত হইত।
[********************]
বাগদাদের প্রসিদ্ধ ‘হাফেযে হাদীস’ সূলায়মান ইবনে হারব (মৃঃ ২২৪ হিঃ)। তাঁহার দরসের বৈঠকে চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী উপস্থিত হইত। বাদশাহ মামুনের প্রাসাদের সন্নিকটে একটি উচ্চ মিম্বর নির্মাণ করা হইয়াছিল। সুলায়মান উহার উপর আসন গ্রহণ করিয়া হাদীসের দারস দিতেন। বাদশাহ ও রাজন্যবর্গ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক জনতা মজলিসে উপস্থিত থাকিতেন।
[********************]
‘সুনান’ প্রণেতা হাফেজ আবূ মুসলিম কাজী (মৃঃ ২৯২ হিঃ) যখন বাগদাদের ‘গামান’ চকে হাদীস লিখাইবার মজলিস অনুষ্ঠান করিতেন, তখন এত বিপুল জনতা সমবেত হইত যে, সাত ব্যক্তিকে পরস্পরের সাহায্যে বহু দুরবর্তী লোকদের নিকটে আবূ মুসলিমের মুখ-নিসৃত কথা পৌঁছাইবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইত। মজলিস শেষ হইয়া যাওয়ার পর একবার কেবলমাত্র দোয়াত-কলম সহ লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে আগত লোকদের সংখ্যা গণনা করিয়া দেখা গেল যে, তাহারাই ছিল অন্যূন্য চল্লিশ হাজার। আর যাহারা শুধু শ্রবণের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাদের সংখ্যা ছিল অগণিত।
[********************]
হাফেজ জাফর ফরইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) বাগদাদের ‘মানার’ রাজপথে দরসে হাদীসের যে মজলিস করিয়াছিলেন,তাহাতে কমপক্ষে ত্রিশ সহস্র জনতা উপস্থিত হইয়াছিল।
[********************]
ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী যখন কূফা নগরে হাদীসের দরস দিতেন তখন জনতার ভীড়ে নগরীর রাজপথ বন্ধ হইয়া যাইত।
[********************]
ইমাম ইবন মাজাহ (র)-এর ওস্তাদ হাফেয আবূ বকর ইবনেস আবূ শায়বাহ এবং তাঁহার ভ্রাতা উসামান ইবনে আবূ শায়বাহ উভয়েই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহাদের হাদীসের দরসেও অন্যূন্য ত্রিশ সহস্র লোক একত্র হইত।
[********************]
বস্তুত তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীস শিক্ষালাভের জন্য ইসলামী জনতার মনে যে কি বিপুল উৎসাহ এবং উদগ্র পিপাসা বিদ্যমান ছিল, তাহা পূর্বোল্লেখিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হইতে সুস্পষ্টরূপে ধারণা করা চলে। উপরন্তু এই যুগে হাদীসে পারদর্শী ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানকারী লোক যে মুসলিম জাহানে কত ছিলেন, তাহার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নহে। ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী লিখিয়াছেনঃ ‘তৃতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে ইবরাহীম ফরাহীদী (মৃঃ ২২২ হিঃ) প্রায় এক হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; কিন্তু এইজন্য তাঁহার নিজ শহরের বাহিরে বিদেশ সফর করার কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নাই।
[********************]
এই কারণে এই যুগের মুহাদ্দিসগণের উস্তাদের সংখ্যা বিপুল ও অত্যাধিকই। এক একজন মুহাদ্দিসের উস্তাদের সংখ্যা সহস্রাধিক হইয়াছে। অনেকে আবার চার হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘আমি চার হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছি। তন্মধ্যে মাত্র এক হাজার মুহাদ্দিসের সনদে আমি হাদীস বর্ণনা করিয়াছি।
[********************]
হাফেয শামুসুদ্দীন যাহবী তাঁহার গ্রন্হ তাযকিরাতুল হুফফাজ-এ নবম পর্যায়ের একশত ছয়জন হাদীসের হাফেয সম্পর্কে আলোচনা করার পর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
এই যুগে এবং ইহার কাছাকাছি সময়ে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হাদীস পারদর্শী বহু সংখ্যক ইমাম বর্তমান ছিলেন। আমি তাঁহাদের একদশমাংশেরও এখানে উল্লেখ করিতে পারিলাম না। আমার লিখিত ইতিহাস গ্রন্হে তাঁহাদের অধিকাংশেরই উল্লেক করা হইয়াছে।
[********************]
ইমাম বুখারীও এই তৃতীয় শতকেই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি এক হাজার আশি জন উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছি। তাঁহাদের প্রেত্যেকেই বড় বড় মুহাদ্দিস ছিলেন।
[********************]