॥ ৭০ ॥ ‘কিউ-চে-লো’ বা গুর্জর
বল্লভী থেকে উত্তরমুখো কম বেশি ১৮০০ লি যাবার পর গুর্জ্জর দেশে পৌঁছানো যায়।
দেশটির আয়তন ৫ হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর নাম পি-লো-মো-লো (রাজপুতানার বালমের, 25° 48′′N 71° 16′E) 30 লি এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কৃষিজাত দ্রব্যাদি ও লোকজনের চালচলন সুরাষ্ট্রের মতোই। ঘন জনবসতি। পরিবারগুলি বেশ অবস্থাপন্ন। বেশির ভাগ লোকই অন্যধর্মী। বৌদ্ধ ধর্মীরা সংখ্যায় বেশ অল্প।
একটি মাত্র সংঘারাম আছে এ দেশে। শতখানেক ভিক্ষুর বসবাস সেখানে। সকলেই হীনযানের অনুরাগী। সর্বাস্তিবাদ শাখার নির্দেশ মতো চলে। দেবমন্দিরের সংখ্যা অনেক (কয়েক দশ) বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীরা সেখানে থাকেন।
রাজা ক্ষত্রিয় বর্ণের লোক। তাঁর বয়েস সবে মাত্র কুড়ি বছর। তিনি একজন প্রজ্ঞাবান লোক। সাহসীও। বুদ্ধের মতবাদে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাসী। বিশিষ্ট প্রতিভাবানদের তিনি বিশেষভাবে কদর দেখান।
॥ ৭১ ॥ ‘উ-শে-ইয়েন-ন’ বা উজ্জয়িনী
এবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে যাত্রা করা গেলো। কমবেশি ২৮০০ লি পথ ভাঙার পর আমরা এসে থামলাম ‘উ-শে-ইয়েন-ন’ বা উজ্জয়িনী।
এরাজ্যটি পরিসরে ছয় হাজার লির মতো। রাজধানীর পরিধি ৩০ লি হবে। ঘন লোকবসতি ভরা। পরিবারগুলি বিত্তবান।
এখানে অনেকগুলি সংঘারাম থাকলেও বেশীর ভাগেরই ভাঙাচোরা অবস্থা। গুটি চার পাঁচ যা খাড়া অবস্থায় আছে। সেখানে শ’তিনেক ভিক্ষু থাকেন। তাঁরা হীনযান ও মহাযান দু’য়েরই চর্চ্চা করেন। দেবমন্দির রয়েছে অনেক (কয়েক দশ)। নানা সম্প্রদায়ের বিধর্মীরা সেখানে থাকেন।
রাজা ব্রাহ্মণ বর্ণের লোক। অন্যধর্মী শাস্ত্রাদিতে তাঁর গভীর জ্ঞান রয়েছে। সত্য-ধর্মের প্রতি কোন আকর্ষণ বা বিশ্বাস নেই।
শহর থেকে খানিক পথ গেলেই একটি স্তূপের দেখা পাওয়া যাবে।
॥ ৭২ ॥ চি-কি-তো
এখান থেকে এক হাজার লি মতো উত্তর-পূর্বমুখো যাবার পর ‘চি-কি-তো’ রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।
এ দেশটি কমবেশি চার হাজার লি অঞ্চল নিয়ে। রাজধানীটি ১৫-১৬ লি মতন হবে। এখানকার মাটি উর্বরা বলে খ্যাতি রয়েছে। নিয়মিত চাষ-আবাদ, ফসল বোনা হয়। ফলনও যথেষ্ট। এখানে বিশেষভাবে ডাল ও যবের চাষ হয়ে থাকে। ফল, ফুল অপর্যাপ্ত ফলানো হয়।
আবহাওয়া চলনসই, লোকজনেরা সহজাতভাবে সদগুণবান ও শান্তশিষ্ট। বেশির ভাগই অন্য ধর্মে বিশ্বাসী। বৌদ্ধধর্মানুরাগী খুব কম লোকই। অনেকগুলি সংঘারাম থাকলেও মাত্র কিছু ভিক্ষু সেখানে থাকেন। দশটির মতো দেবমন্দির রয়েছে। কয়েক হাজার অনুগামী সেখানে থাকেন।
রাজা ব্রাহ্মণ বর্ণের লোক। তিনি ত্রি-রত্নে গভীর বিশ্বাসী। সদগুণাবলীর জন্য যারা বিশিষ্ট তাদের তিনি সম্মান করেন পুরস্কার দেন। দূর দূর দেশ থেকে এখানে প্রচুর শিক্ষিত ও জ্ঞানী লোকের সমাবেশ ঘটে।
॥ ৭৩ ॥ ‘মো-হি-শি-ফ-লো-পু-লো’ বা মহেশ্বরপুর
এখান থেকে এবার আমরা উত্তরের দিকে চলতে শুরু করলাম। যাবো মো-হি-শি- ফ-লো-পু-লো বা মহেশ্বরপুর। প্রায় ন’শো লি অতিক্রম ক’রে এখানে এলাম।
এ রাজ্যটি ৩০০০ লি মতো অঞ্চল জুড়ে। রাজধানীর ঘের তিরিশ লির কাছাকাছি।
এখানকার জমির ফল-ফসলাদি, লোকজনের আচার ব্যবহার সব কিছুই উজ্জয়িনীর মতো। এরা অন্য ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই।
অনেক দেবমন্দির এখানে (কয়েক দশ)। পাশুপত সম্প্রদায়ের লোকই সব থেকে বেশী।
রাজা ব্রাহ্মণ বর্ণের লোক। বুদ্ধদেবের মতবাদের প্রতি তার কোন অনুরাগই নেই।
॥ ৭৪ ॥ ‘সিন-তু’ বা সিন্ধু
এখান থেকে এবার গুর্জ্জর ফিরে গেলাম। তারপর উত্তরমুখো চলতে থাকলাম। ধু ধু প্রান্তর, নানা বিপদজনক গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে ১৯০০ লি মতো পথ ভাঙলাম। বিরাট সিন্ধু নদ পার হয়ে এলাম সিন্ধু রাজ্যে।
রাজ্যটির পরিধি প্রায় ৭০০০ লি। রাজধানী শহরের নাম পি-শেন-পো- পুলো। ৩০ লি খানেক এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে। মাটি খাদ্যশস্য ফলনের পক্ষে উপযোগী। প্রচুর গম ও জোয়ারের ফলন হয়। সোনা, রূপা ও দেশী তামা এখানে প্রচুর মেলে। গরু, ভেড়া, উট, খচ্চর ইত্যাদি পশু পালনের পক্ষেও অঞ্চলটি উপযোগী। উটগুলি আকারে ছোট, একটি মাত্র কুঁজ রয়েছে। এখানে প্রচুর পরিমাণে লবণ পাওয়া যায়। দেখতে ‘চিন্নবর’ (chinnabar)-এর মতো লালচে। সাদা, কালো ও পাথুরে লবণও আছে। কাছের ও দূরের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সব লবণ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মানুষজনের প্রকৃতি কঠোর ও খেয়ালী। কিন্তু বেশ সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ তারা। ঝগড়া ঝাঁটি ও কথায় কথায় প্রতিবাদ ও অস্বীকার করার অভ্যাস রয়েছে। জ্ঞানচর্চ্চা করে বটে, কিন্তু বিশিষ্টতা অর্জনের দিকে কোন চেষ্টা নেই। বুদ্ধের মতবাদের প্রতি অনুরাগ রয়েছে।
এখানে কয়েক শো সংঘারাম রয়েছে। সেখানে হাজার দশেকের মতো ভিক্ষু থাকেন। সম্মতীয় শাখার হীনযান অনুগামী তারা। যাঁরা একান্তভাবে ধর্মানুরাগী তাঁরা পাহাড় ও বনাঞ্চলের মধ্যে নির্জনে বসবাস করেন। সেখানে তাঁরা দিনরাত অবিরামভাবে অহতত্ব অর্জনের জন্য সাধনা ক’রে চলেছেন।
তিরিশটির মতো দেবমন্দির আছে। নানান সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সেখানে বাস করেন।
দেশের রাজা শূদ্রবর্ণের লোক। স্বভাবে তিনি স্বতঃই সৎ ও আন্তরিক। বুদ্ধের মতবাদকে শ্রদ্ধা করেন।
তথাগত প্রায়ই এ দেশ ভ্রমণ করেছেন। এজন্য রাজা অশোক এখানে অনেকগুলি (কয়েক দশ) স্তূপ বানিয়েছেন। পরম অর্হৎ উপগুপ্ত এ রাজ্যে প্রায়ই ধর্ম প্রচারের জন্য আসতেন। তিনি যে সব জায়গায় থেকেছেন, সেখানেই সংঘারাম বা স্তূপ বানানো হয়েছে। যেদিকে যাও ওই স্মারক চোখে পড়বে।
সিন্ধু নদের পাশে কয়েক শো লি ব্যাপী নিচু জলাভূমি অঞ্চল জুড়ে কয়েক লক্ষ পরিবারের বসবাস। এদের হৃদয় বলে কিছু নেই। অতি উগ্র ও তড়বড়ে স্বভাবের। রক্তপাতের দিকে প্রবল ঝোঁক। এরা বিশেষভাবে গো-পালন করে নিজেদের ভরণপোষণ চালায়। এদের কোন শাসক বা প্রভু নেই। পুরুষ বা মেয়েই হোক এরা ধনীও নয়, দরিদ্রও নয়। এরা মাথা কামায়, ভিক্ষুদের ‘কাষায়’ বস্ত্র পরে। এ শুধু তাদের বাইরের পোষাকই, ভিতরে তারা সাধারণ গৃহী মানুষের মতোই আচরণ করে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীকেই এরা সমর্থন করে ও মহাযানকে কথায় কথায় আক্রমণ করে।
॥ ৭৫ ॥ মু-লো-সান-পু-লু’ বা মূলস্থানপুর (মুলতান )
এ রাজ্য পেরিয়ে চললাম পূর্বদিকে। সিন্ধু নদ ডিঙিয়ে তার পূর্ব তীর বরাবর ন’শো লি মতো পথ চলার পর পৌঁছলাম এসে মু-লো-সান-পু-লু বা মূলস্থানপুর (মুলতান)।
এ দেশটির পরিসর মাত্র চার হাজার লি মতো। রাজধানীর ঘের তিরিশ লির কাছাকাছি। ঘন বসতি ভরা। পরিবারগুলি বেশ সমৃদ্ধ। এ রাজ্যটি চেক (সে- কিঅ) রাজ্যের অধীন। জমি বেশ রসালো ও উর্বরা। জলবায়ু স্নিগ্ধ ও মনোরম। লোকজনের আচার ব্যবহার সততা ও সরলতা ভরা। বিদ্যার দিকে অনুরাগ রয়েছে, সদগুণের কদর করে। বেশির ভাগই দেব-পূজায় বিশ্বাসী। সামান্য কিছু বৌদ্ধধৰ্মী।
রাজ্যে দশটির মতো সংঘারাম রয়েছে, তার বেশির ভাগেরই ভাঙাচোরা অবস্থা। সামান্য কতক ভিক্ষু আছেন। তাঁরা বিদ্যাচর্চ্চা করেন বটে, তবে আত্মোন্নতির কোন স্পৃহা নেই। ৮টি দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্য ধর্মীরা সেখানে থাকে। এখানে একটি সূর্য বা আদিত্য মন্দির আছে। এটি অতি চমৎকার ও যথেষ্ট জাঁকালো করে সাজানো। সূর্যদেবের প্রতিমাটি হলদে সোনায় গড়া ও নানা দুর্লভ রত্নাদি দিয়ে সাজানো। স্ত্রীলোকেরা এখানে গান-বাজনা করে, প্রদীপ জ্বালিয়ে ফুল ও ধূপ ও ধুনা সুগন্ধি দিয়ে সম্মান জানায়। আদি থেকেই এই রীতি চলে আসছে। পঞ্চসিন্ধুর রাজা ও অভিজাত পরিবারেরা এই দেবতার নিকট নানা দামী দামী পাথর ও রত্নাদি নিবেদন করেন।
এঁরা একটি পুণ্যশালা বানিয়েছেন। এখানে গরিব, রুগ্ন প্রভৃতিকে খাদ্য, পানীয় ও ওষুধ বিতরণ করা হয়, জীবন ধারনের উপায় করে দেয়া হয়। সব দেশের লোক এখানে পূজা দিতে আসেন। সব সময়েই শত শত লোকের ভিড়। মন্দিরটির চারিদিকে পুকুর ও ফুলের বাগান রয়েছে। সেখানে বিনা বাধায় যে কোন লোক ঘুরে বেড়াতে পারেন।
॥ ৭৬ ॥ ‘পো-ফ-তো’ বা পর্বত রাজ্য
এখান থেকে উত্তর-পূর্বদিকে চললাম এবার। সাতশো লি পথ ভাঙার পর এসে থামলাম ‘পো-ফ-তো’ বা পর্বত রাজ্যে।
প্রায় পাঁচ হাজার লি জুড়ে এই রাজ্যটি। রাজধানীর আয়তন কুড়ি লি মতো। দেশটি ঘন বসতিপূর্ণ ও চেক রাজ্যের অধীন। শুকনো জমিতে ফলন হয় এমন ধান এখানে প্রচুর পরিমাণে হয়। এ দেশের মাটি ডাল ও গম চাষের পক্ষেও অনুকূল।
আবহাওয়া না বেশি গরম না বেশি ঠাণ্ডা। লোকজন সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ। কিছুটা তড়বড়ে ও ব্যস্তবাগীশ। এদের ভাষা নিচু মানের। সাধারণ রচনা ও সাহিত্যে বেশ পারদর্শী। বৌদ্ধধর্মী ও অন্য ধর্মী দুই-ই রয়েছে এখানে।
দশটির মতো সংঘারাম এ রাজ্যে। ভিক্ষু হাজারখানেক হবে। হীনযান ও মহাযান দু’য়েরই চর্চ্চা করেন।
রাজা অশোকের তৈরী চারটি স্তূপ রয়েছে এখানে। কুড়িটির মতো দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন মতের অন্য ধর্মীরা এখানে থাকেন, সমবেত হন।
রাজধানী শহরের কাছেই একটি বড়ো সংঘারামের দেখা পেলাম। শ’খানেক ভিক্ষু আছেন। মহাযানের চর্চ্চা করেন। শাস্ত্রাচার্য জিনপুত্র এখানে থেকে যোগাচার্যভূমি শাস্ত্রকারিকা বইখানি লেখেন। শাস্ত্রাচার্য ভদ্ররুচি ও গুণ প্রভ এখানেই ধর্মজীবনে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এ সংঘারামটি অগ্নিকাণ্ডের ফলে নষ্ট হয়েছে, এজন্য বর্তমানে পুরোপুরি পরিত্যক্ত অবস্থা।
॥ ৭৭ ॥ ‘ও-তিন-পো-চি-লো’ বা অত্যনবকেল
সিন্ধুদেশ পিছনে ফেলে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে পনের শো থেকে ষোলো শো লি গিয়ে আমরা ও-তিন-পো-চি-লো বা অত্যনবকেল রাজ্যে পৌঁছালাম।
এ দেশটির পরিসর পাঁচ হাজার লি মতো। প্রধান শহরের নাম খিএ-ৎসি-শি- ফ-লো। আয়তনে তিরিশ লি খানেক। শহরটি সিন্ধু নদ ও মহাসাগর সঙ্গমে। এখানকার বাড়িঘরগুলি খুব অলংকৃত করা। দামী দামী আসবাব ও দুর্লভ জিনিসপত্রে বোঝাই। বর্তমানে এখানকার কোন স্থানীয় শাসক নেই, রাজ্যটি সিন্ধুর অধীন।
এখানকার জমি নিচু ও স্যাঁতসেঁতে, মাটি নোনা (বেশীর ভাগ এলাকাই বুনো লতাপাতা গুল্ম ভরা অনাবাদী জমি)। খুব অল্প জমিতেই চাষ হয়। ডাল আর গমের ফলন হার প্রচুর। অন্যান্য কয়েক ধরনের ফসলের উৎপাদন সাধারণ রকমের।
আবহাওয়া ঠাণ্ডা, প্রচণ্ড জড়-বাত্যার প্রকোপ। গরু, ভেড়া, উট, গাধা এইসব ধরনের পশু পালনের পক্ষে বেশ অনুকূল জায়গা।
লোকজন মারমুখী ও ব্যস্তবাগীশ। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে কোন আগ্রহ নেই। মধ্য ভারত থেকে এদের ভাষা কিছুটা পৃথক। আচার ব্যবহারের দিক থেকে সৎ ও আন্তরিকতাপূর্ণ। ত্রিরত্নের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।
আশিটির মতো সংঘারাম আছে। ভিক্ষুর সংখ্যা সেখানে হাজার পাঁচেক। বেশীর ভাগ ভিক্ষুই সম্মতীয় শাখানুবর্তী হীনযানপন্থী। দশটির মতো দেবমন্দির। সবাই প্রায় পাশুপত সম্প্রদায়ের।
রাজধানীতে শহর মধ্যে একটি শিবমন্দির রয়েছে। মন্দিরটি খুব উঁচু দরের ভাস্কর্য মণ্ডিত। দেব-প্রতিমার অলৌকিক ক্ষমতার খ্যাতি রয়েছে। পাশুপত অনুগামীরা এ মন্দিরটিতে বাস করেন। তথাগত প্রায়ই এ রাজ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য আসতেন। তাঁর স্মারক হিসাবে রাজা অশোক এখানে ছয়টি স্তূপ গড়ে গেছেন।
॥ ৭৮ ॥ ‘লঙ-কিও-লো’ বা লঙ্গলা
এবার পশ্চিমদিকের পথে চললাম। দু হাজার লি যাবার পর এসে উঠলাম ‘লঙ- কিও-লো’ বা লঙ্গলা।
এ দেশটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে কয়েক হাজার লি, উত্তর-দক্ষিণেও ওই রকম। রাজধানীটি ৩০ লি খানেক এলাকা জুড়ে। নাম-সু-নু-লি-চি-ফ-লো (সূনুরিশ্বর?)
এখানকার মাটি সরস ও উর্বরা। ফসলের ফলন প্রচুর। জলবায়ু ও লোকের আচার আচরণ অত্যনবকেল-র মতোই। ঘন লোকবসতি ভরা। দামী দামী পাথর ও রত্ন প্রচুর। দেশটি সমুদ্রকূলে। পশ্চিমী প্রমীলা রাজ্য যেদিকে এ রাজ্যটি সেদিক পানে। এখানকার কোন প্রধান শাসক নেই। লোকেরা এক বিরাট উপত্যকা জুড়ে বসবাস করে চলেছে। কেউ অন্য কারো ‘পরে নির্ভরশীল নয়। এরা পারস্য সরকারের অধীন। বর্ণমালা প্রায় ভারতের বর্ণমালার আকার। ভাষা সামান্য কিছুটা পৃথক। বৌদ্ধধর্ম ও অন্য ধৰ্মী দুই-ই আছে।
শ’খানেক সংঘারাম রয়েছে। বোধহয় হাজার দুয়েক ভিক্ষু সেখানে আছেন। তাঁরা হীনযান ও মহাযান দু’য়েরই চর্চ্চা করেন। কয়েক শো দেবমন্দির চোখে পড়বে। পাশুপাত সম্প্রদায়ের অনুগামীরাই সব থেকে বেশি। শহরে একটি মহেশ্বর দেবের মন্দির রয়েছে। এটি সুন্দরভাবে কারুকার্য ও ভাস্কর্য করা।
॥ ৭৯ ॥ ‘পি-তো-শি-লো’ বা পীতশিলা
অত্যনবকেল রাজ্য থেকে আমরা পা বাড়ালাম উত্তরদিকে। প্রায় সাতশো লি এগোবার পর পি-তো-শি-লো বা পীতশিলা রাজ্যে পৌছালাম।
রাজ্যটির আয়তন কম হলেও হাজার তিনেক লি। রাজধানীর পরিধি ২০ লি জায়গাটি লোক বসতিতে ভরপুর। কোন স্থানীয় রাজা নেই, সিন্ধুর অধীন।
লবণ ও বালিভরা মাটি। হিমেল ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়। ডাল ও গমের যথেষ্ট ফলন। ফুল ফল বলতে গেলে বিরল।
মানুষজনের আচার ব্যবহার উগ্র ও রুক্ষ। এদের ভাষা মধ্য ভারতের তুলনায় সামান্য ভিন্ন। বিদ্যাচর্চ্চার দিতে ঝোঁক নেই। তবে যতটুকু জানে তার পরে তাদের গভীর আস্থা রয়েছে। পঞ্চাশটির মতো সংঘারাম আছে। হাজার তিনেক ভিক্ষু থাকেন সেখানে। সম্মতীয় শাখার হীনযান উপাসক সকলে। কুড়িটির মতো দেবমন্দির দেখতে পাওয়া যাবে। পাশুপত মতবাদের প্রাধান্যই সেখানে বেশী।
নগরীর উত্তরদিকে ১৫-১৬ লি গেলে একটি বিরাট বনের মধ্যে কয়েক শো ফুট উঁচু একটি স্তূপ দেখা যাবে। এটি রাজা অশোকের তৈরী।
এর কিছু পূর্বে একটি পুরানো সংঘারাম। বিশিষ্ট অর্থৎ মহা-কত্যায়ন এটি গড়েন। কাছেই চার বুদ্ধের স্মারক হিসেবে একটি স্তূপ আছে।
এখান থেকে উত্তর পূর্বমুখো তিনশো লি যাবার পর আমরা দেখা পাই ‘ও- ফন-চ’ বা অবণ্ড রাজ্যের।