স্বপ্নমঙ্গল স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ , অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ । শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাঁদরে উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে । একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় , চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় । সহসা মিলাল তারা , এল এক বেদে , ‘ পাখি উড়ে গেছে ' ব ' লে মরে কেঁদে কেঁদে ; সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে , ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে । নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়্থুড়ি হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়্সুড়ি । রাজা বলে , ‘ কী আপদ! ' কেহ নাহি ছাড়ে , পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে । পাখির মতন রাজা করে ঝট্পট্ , বেদে কানে কানে বলে — ‘ হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়-সাত চোখে কারো নিদ্রা নাই , পেটে নাই ভাত । শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির । ছেলেরা ভুলেছে খেলা , পণ্ডিতেরা পাঠ , মেয়েরা করেছে চুপ — এতই বিভ্রাট । সারি সারি বসে গেছে কথা নাহি মুখে , চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে । ভুঁইফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে , সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে । মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট হঠাৎ ফুকারি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । চারি দিক হতে এল পণ্ডিতের দল — অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল । উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস কালিদাস-কবীন্দ্রের ভাগিনেয়বংশ । মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা , ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা । বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত । কেহ শ্রুতি , কেহ স্মৃতি , কেহবা পুরাণ , কেহ ব্যাকরণ দেখে , কেহ অভিধান । কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ , বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ । চুপ করে বসে থাকে বিষম সংকট , থেকে থেকে হেঁকে ওঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ , ‘ ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পণ্ডিত-সমাজ , তাহাদের ডেকে আনো যে যেখানে আছে — অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে । ' কটাচুল নীলচক্ষু কপিশকপোল , যবন পণ্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল । গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি , গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে , ভারি উগ্রমূর্তি । ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয় — ‘ সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময় , কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্ । ' সভাসুদ্ধ বলি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ' ‘ স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে , আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে । হানিয়া দক্ষিণ মুষ্টি বাম করতলে ‘ ডেকে এনে পরিহাস ' রেগেমেগে বলে । ফরাসি পণ্ডিত ছিল , হাস্যোজ্জ্বলমুখে কহিল নোয়ায়ে মাথা , হস্ত রাখি বুকে , ‘ স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে ; হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে । কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান । অর্থ চাই , রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি রাজস্বপ্নে অর্থ নাই , যত মাথা খুঁড়ি । নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট , শুনিতে কী মিষ্ট আহা , হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্ ধিক্ — কোথাকার গণ্ডমূর্খ পাষণ্ড নাস্তিক! স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক-বিকার , এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার । জগৎ-বিখ্যাত মোরা ‘ ধর্মপ্রাণ ' জাতি স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে! — দুপুরে ডাকাতি! হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ — ‘ গবুচন্দ্র , এদের উচিত শিক্ষা হোক । হেঁটোয় কণ্টক দাও , উপরে কণ্টক , ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বণ্টন । ' সতেরো মিনিট কাল না হইতে শেষ , ম্লেচ্ছ পণ্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ । সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে , ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে । পণ্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট পুনর্বার উচ্চারিল — ‘ হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলা । নগ্নশির , সজ্জা নাই , লজ্জা নাই ধড়ে — কাছা-কোঁচা শতবার খসে খসে পড়ে । অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণ খর্বদেহ , বাক্য যবে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ । এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয় দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময় । না জানে অভিবাদন , না পুছে কুশল , পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যত মুষল । সগর্বে জিজ্ঞাসা করে , ‘ কী লয়ে বিচার , শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই-চার , ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট-পালট । ' সমস্বরে কহে সবে — ‘ হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া , ‘ নিতান্ত সরল অর্থ , অতি পরিষ্কার , বহু পুরাতন ভাব , নব আবিষ্কার । ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ । বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী । আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি । কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত । ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট — সংক্ষেপে বলিতে গেলে , হিং টিং ছট্ । ' স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । ‘ সাধু সাধু ' রবে কাঁপে চারিধার , সবে বলে — পরিষ্কার অতি পরিষ্কার । দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল , শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল । হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ , আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে , ভারে তার মাথাটুকু পড়ে বুঝি ছিঁড়ে । বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে , হাবুডুবু হবু-রাজ্য নড়িচড়ি উঠে । ছেলেরা ধরিল খেলা , বৃদ্ধেরা তামুক , এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ । দেশজোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট্ , সবাই বুঝিয়া গেল — হিং টিং ছট্ । স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান । যে শুনিবে এই স্বপ্নমঙ্গলের কথা , সর্বভ্রম ঘুচে যাবে নহিবে অন্যথা । বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে , সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে । যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে , এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে । সবাই সরলভাবে দেখিবে যা কিছু , সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু । এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত , অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত — জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময় , স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় । স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান , গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।