হাস্যকবি সম্মেলন
সুকুমার রায় লিখেছেন না, ‘লাল গানে নীল সুর হাসি-হাসি গন্ধ’, বারবার সেই লাল গান, নীল সুরের কথা ভাবছিলাম।
ব্যাপারটা খুলেই বলি।
‘হাস্যকবি সম্মেলন’ মানে হাসির কবিতার লেখকদের সম্মেলন। দিল্লি, মুম্বই, পটনায় খুবই চালু অনুষ্ঠান এটা। জনপ্রিয় বটে।
আমাদের কবি সম্মেলনের মতো নীরস নয়।
বাংলা ভাষায় লঘু মেজাজের সঙ্গে গভীর অনুভূতির হালকা হাসির কবিতা লিখে গেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, সুকুমার রায়। আমাদের কালে অজিতকৃষ্ণ বসু কিংবা আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত ফেলনা নন। কিন্তু এঁরা কেউ কি কখনও ভাবতে পেরেছেন হাসির কবিতার সঙ্গে খোল, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল। এমনকী এস্রাজ, বেহালা।
ডি এল রায়ের গানের সঙ্গে বাজনা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু হাস্যকবি সম্মেলন তো গান নয় পুরোই কবিতা। হিন্দি বলয়ের সংস্কৃতি জগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।
একজন কবিতা পড়ছেন। সঙ্গে দু’-একজন তাল দিচ্ছেন। আবার তিনি একই কবিতায় ফিরছেন প্রতি অনুচ্ছেদ অন্তর। এবার তিনি গান গেয়ে একই দু’পঙ্ক্তি নিবেদন করছেন, সঙ্গে হরেক রকম দিশি-বিদিশি বাদ্যযন্ত্র। আমি এসেছিলাম একটা আমন্ত্রণ পেয়ে। কিন্তু অনুষ্ঠানটি ঠিক হজম করতে পারিনি। এইসব পদ্য-গীতের ফাঁকে ফাঁকে ছিল টুকরো টুকরো হাসির গল্প। তার কিছু কিছু উপভোগ করেছি।
দিল্লিওয়ালা এক কবি, বোধহয় তাঁর নাম ভগবতীপ্রসাদ একটা মজার গল্প বললেন। তিনি কোনও কাজে এক ডাকঘরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাঁকে একটি পোস্টকার্ড দিয়ে বললেন, ‘আমার হাতে বাতব্যথা, আপনি যদি আমার চিঠিটা লিখে দেন।’
ভগবতীবাবু কী আর করবেন, তিনি ঠিকানাসমেত চিঠিটা লিখে দিলেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক পোস্টকার্ডটা হাতে নিয়ে বেশ একটু উলটেপালটে দেখলেন, তারপর পোস্টকার্ডটি ভগবতীপ্রসাদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নীচের দিকে একটু জায়গা আছে। যদি আরেকটা লাইন লিখে দেন।’
বাধ্য হয়ে ভগবতীবাবু বললেন, ‘কী লিখতে হবে বলুন।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘লিখুন, খারাপ হাতের লেখার জন্যে দুঃখিত।’
সত্যিই চমৎকার গল্প। আরও দুয়েকটি রীতিমতো ভাল গল্প শুনেছিলাম। আর একটি বলছি।
ঝাঁঝা থেকে এসেছেন এক কাব্যরত্ন। শ্রীযুক্ত মুরারি ঝা। অতিরিক্ত সুরসিক ব্যক্তি।
মুরারিবাবু বললেন যে তিনি ঠিক ঝাঁঝার লোক নন। তবে তাঁর পদবি ঝা হওয়ায় তিনি ঝাঁঝাকেই তাঁর বাসস্থান বলে বেছে নিয়েছেন। এটা বলার সময় ভদ্রলোকের মুখচোখের ভাব দেখে মনে হল, কথাটা বোধহয় সত্যি নয়।
স্বাস্থ্যবান, কৃষ্ণকায়, গাট্টাগোট্টা ভদ্রলোককে কেউ ঘাঁটাল না।
এরপর মুরারিবাবু বললেন যে তাঁর নামের অর্থ হল কালো মানুষদের শত্রু। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, মুরারি = মুর + অরি, স্বরসন্ধি, আর মুর মানে হল কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো মানুষ, যেমন শেক্সপিয়ার সাহেবের ‘ওথেলো দ্য মুর।’
অভিধানে অবশ্য ‘মুর’ শব্দের মানে একটু অন্যরকম বলছে, সে যা হোক মুরারিবাবু শ্রোতাদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমি কালোদের শত্রু নই, আমি নিজেই কালো।’
মুরারিবাবু কাব্যরত্ন হলেও কাব্যচর্চা করলেন না। তিনি গুটিকয় মজার গল্প করলেন। দু’-একটি বেশ ভাল, তারই একটি মনে পড়ছে।
মুরারিবাবু রেলগাড়িতে কোথাও যাচ্ছিলেন, তাঁর পাশের সিটে বসেছিলেন সর্দারজি। সহসা মুরারিবাবু লক্ষ করলেন যে সহযাত্রী সর্দারজির একপায়ে লাল মোজা, অন্য পায়ে সাদা মোজা।
এ রকম মজার/মোজার ব্যাপার দেখে মুরারিবাবু কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পারলেন না। তাঁর মনে হল এটা হয়তো নতুন কোনও স্টাইল।
শেষ পর্যন্ত মুরারিবাবু সর্দারজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিংজি, আপনার দু’পায়ে দু’রকম মোজা। আগে কখনও এ রকম কোথাও দেখিনি।’ সর্দারজি নাকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার আরও এক জোড়া মোজা আছে, কিন্তু দেখলাম সেটারও এক পাটি লাল আর অন্যটা সাদা।’
মুরারিবাবুর প্রকাশভঙ্গি চমৎকার। সেদিন খুব হেসেছিলাম। কিন্তু আজ লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ঠিক এই রকম একটা গল্প আগেও শুনেছি।