হাসি-কান্না
তরুণ লেখককে সাবধান করে দিই, তিনি যদি ইহজগতের অজরামর যশ অর্জন করতে চান তবে যেন তিনি হাস্যরসের বেসাতি না করে ঢালেন অঢেল করুণ রস। আর বাঙালির হৃদয়ের উপর যদি জগরনটের মতো তিনি মোক্ষম আসন চেপে বসে থাকতে চান তবে যেন সেটিকে চেপটে, থেতলে, নিংড়ে, একদম সমূহ তিক্তের চেয়েও তেতো করে পরিবেশন করেন। দেবদাস রক্তবমি করছে আর গাড়োয়ানকে বার বার শুধাচ্ছে আর কত বাকি, কিংবা অরক্ষণীয়ার সাজ দেখে বাচ্চা বলছে, পিসিমা সঙ সেজেছে- ছাড়ন এরকম কিছু মাল, আর দেখতে হবে না, আপনি আমাদের ডিহি শ্রীরামপুর সেকেন্ড বাইলেন কম্বল বিতরণী সভা থেকে যাত্রা আরম্ভ করে ভায়া মাদরা কালীবাড়ি প্রসাদ বিতরণী সমিতি হয়ে নাক বরাবর পৌঁছে যাবেন পদ্মশ্রী, আকাঁদেমি প্রাইজে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। আহা, বাঙালি বড়ই কোমলহৃদয়। শুনেছি, এক বাঙালি ছোকরা লন্ডনে বাসকালীন তিনটি বছর মাত্র অবশ্যকর্তব্য ব্যারিস্টারি ডিনারটি খাবার জন্য ভুল বললুম, খাবার জন্য নয়, নিছক এটেন্ড করার জন্য হোস্টেল থেকে বেরুত; ফিরে এসে ফের ধুতি-গেঞ্জি পরে লেপের তলায় ঢুকে দেবদাস পড়ত আর তার তলায় যতখানি সম্ভব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে কুমড়ো-গড়াগড়ি দিত।
আল্লা-রসুলের কসম খেয়ে আমি মুসলমানের ব্যাটা বাঙালি মুসলমান ফের বলব, রাজশেখরের খ্যাতি-প্রতিপত্তির কারণ তার গড্ডলিকা কজ্জলী নয়। তাঁর খ্যাতির কারণ চলন্তিকা এবং রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ। অথচ চলন্তিকার চেয়ে বহুগুণে শ্রেয় অভিধান ইংরেজি-জর্মনে আছে, ইংরেজিতে গ্রিক কাব্যের অনুবাদ করে একাধিক লেখক রাজশেখরকে আগের থেকেই ছাড়িয়ে বসে আছেন। অথচ হাস্যরসে রাজশেখরের যে কৃতিত্ব তার সঙ্গে তুলনা করি কার সঙ্গে। সেরভান্তেস, মলিয়ের, জেরম, উডহাউস কেউই কাছে দাঁড়াতে পারেন না। গ্রিক সাহিত্যের কথা আর তুলছিনে, সেখানে আছে ব্যঙ্গ, স্যাটায়ার বিশুদ্ধ হাস্যরস নয় এবং সেগুলোও রাজশেখরের কাছে আসতে পারে না। এটা ডবল কসম খেয়ে বলছি।
বাঙলা কথা শুনুন। আপনাকে একটা সোনার মোহর দিলে আপনি খুশি হবেন, কিন্তু ভুলে যাবেন দু দিন বাদেই। ওদিকে কেউ যদি পাঁচ টাকা হাওলাত নিয়ে শোধ না করে তবে সে কলিজার ঘা দগদগ করবে বহু-বহুকাল অবধি। শারীরিক স্তরে নেবে বলতে পারি, আপনাকে কেউ সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতে চাইলে আপনি বিরক্ত হবেন কিন্তু কেউ যদি শরীরে পিন ফোঁটায় তবে মারমুখো হবেন।
আরেকটি কথা; করুণ রস বুঝতে হলে বিদ্যেবুদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন নেই। হাস্যরসের বেলা ভাষাজ্ঞান (বিশেষ করে পান্ বোঝবার বেলা) ভিন্ন ভিন্ন সমাজের আচার-ব্যবহার, অনেক কিছুই জানতে হয়। যেমন মনে করুন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে এই ছোট হাস্যরসের চুটকিলাটি।
একটি ছোট্ট মেয়ে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কড়ে আঙুলটি বাড়িয়ে দিলেন, সে যেন ওটা ধরে সোজা হয়ে চলে। মেয়েটি খপ করে তার গোটা হাত ধরে নিল। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, দেখলে, মেয়েকে একটি আঙুল দিয়েছি কি না, সে তখখুনিই পাণিগ্রহণ করতে চায়। এস্থলে পাণিগ্রহণের অর্থ যদি কেউ না জানে তবে সে বুঝতেই পারবে না, এর রস কোথায়।
এরই পিঠ-পিঠ একটি মার্কিন রসিকতা আছে, কিন্তু অতখানি সূক্ষ্ম নয়। তারা বলে, গিভ এ ডেম এন ইঞ্চ… অ্যান্ড শি উয়োন্টস টু বি এ রুলার। মেয়েছেলেকে এক ইঞ্চি (লাই) দিয়েছ, কি সে অমি রুলার হতে চায়। এখানে রুলারের যে দুটো অর্থ আছে সে তত্ত্বটি যদি শ্রোতার জানা না থাকে তবে সব গুড় বরবাদ।
এদেশে উত্তম ক্লাস রসিকতা করে গেছেন আরেকটি ব্যক্তি। তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর– পুণ্যশ্লোক, সায়ংসন্ধ্যা স্মরণীয়। তিনি তার ঠাট্টা-মস্করা ছদ্মনাম কস্যচিৎ ভাইপোস্য নিয়ে করেছেন বলে অনেকেই এ তত্ত্ব জানেন না। তার একটি গল্প অতুলনীয়– দুর্ভাগ্যক্রমে বিদ্যাসাগরের গ্রন্থাবলি হাতের কাছে নেই। মোটামুটি যা বলেছেন তা এই, অমুককে আমি নদীয়ার চাঁদ উপাধি দেওয়ার পর শুনিতে পাইলাম অন্য অমুককে ইহার পূর্বেই নদীয়ার চাঁদ উপাধি দেওয়া হইয়া গিয়াছে। আমি মহা ফাঁপরে পড়িলাম– কারণ আকাশে একসঙ্গে দুইটি চাঁদ কখনই দেখা যায় না। এক্ষণে এই উপাধি লইয়া দুইজনে হাতাহাতি গুতাগুতি হউক তাহা আমি চাহি না। বিদ্যাবুদ্ধিতে অবশ্য দুইজনই একই প্রকার (অর্থাৎ দুটোই আস্ত পাঁঠা–লেখক)। অতএব, স্থির করিয়াছি আকাশের চাঁদটি লইয়া, সেইটিকে দুই ভাগ করিয়া, দুইজনকে দুইটি অর্ধচন্দ্র দিয়া বিদায় করিব।
অর্ধচন্দ্র এস্থলে কেউ যদি শুধু ক্রেজ মুন অর্থে নেন তা হলেই তো চিত্তির!
এ পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে যত হইচই হয়েছে–অর্থাৎ ধর্ম যে রকম সম্মান পেয়েছে সেরকম গালাগাল খেয়েছেও সে বিস্তর– অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান নিয়ে অতখানি হয়েছে বলে জানিনে। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনেকখানি খুঁটিনাটি না জানলে তাদের নিয়ে একে অন্যকে যে ব্যঙ্গন্দ্রিপ করছে সেগুলো ঠিকমতো রসিয়ে রসিয়ে চাখা যায় না।
প্রথম একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিই।
মোল্লার দৌড় মসজিদ তক। শ্রীযুক্ত সুশীল দে এটিকে বাঘে মোষে (রাজায় রাজায়) যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, এরই সমার্থে ধরেছেন! শ্ৰীযুত দে তার বাংলা প্রবাদ গ্রন্থখানা রচনা করে আমাদের যে কী উপকার সাধন করেছেন সেটি অবর্ণনীয়; কাজেই আমি যদি এস্থলে আমার জানা অন্য অর্থটি নিবেদন করি তবে তাঁর পাণ্ডিত্যজ্যোতি কিছুমাত্র ম্লান হবে না।
মোল্লাকে কড়া কথা শোনালে বা তার ওপর চোটপাট করলে সে তো আর জমিদার নয় যে, সঙ্গে সঙ্গে তার দাদ নেবে। সে বেচারা ছুটে যায় মসজিদে। সেখানে গিয়ে আল্লার কাছে সে তার ফরিয়াদ জানায় ও অপরাধীর সাজা কামনা করে। কিন্তু কথায় বলে, শকুনির শাপে কি গরু মরে (সুশীল দে, ৭৮১১)– অপরাধীর কিছুই হয় না। মোদ্দা কথা তা হলে দাঁড়ায়, মোল্লার আর কী মুরদ! সে ওই মসজিদ ত ছুটে গিয়ে চেল্লাচেল্পি মাত্রই করতে জানে; তাতে কারও ক্ষয়ক্ষতি হয় না।
ঠিক ওই রকম শাক্ত-বৈষ্ণবের ঝগড়াঝাটি জানা না থাকলে নিচেরটা বুঝবেন কী করে?
(শাক্ত-বৈষ্ণব উভয়ের কাছে সবিনয় ক্ষমা-ভিক্ষা করতঃ)
বৈষ্ণব : আচ্ছা ভাই, তোমরা তো বল, যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা– তবে পাঁঠাটাকে যখন বলি দাও তখন তার ভিতরের শক্তিটাকে কি বলি দেওয়া হয় না? লক্ষ করনি পাঁঠার কী অসাধারণ প্রাণশক্তি– লম্ফঝম্প!
শাক্ত : না, ভাই, তা নয়। পাঁঠাকে যখন ধরে-বেঁধে হাড়িকাঠে পুরি তখন সে নির্জীব। তখন আর তার শক্তি কই? আছে শুধু চৈতন্য। তখন শুধু ওইটুকুকেই বলি দিই।
.
এ বছরে প্রতিটি লেখার সময় স্বামীজির কথা মনে পড়ে। তিনি যে শুষ্ককাষ্ঠ অরসিকজন ছিলেন না সেইটে এই সুবাদে মনে পড়ল। নিম্নের রসিকতাটি ঈষৎ দীর্ঘ কিন্তু জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দীর্ঘতর শুনতেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
(মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে গোস্তাকির বেহ মাফ চেয়ে)
লক্ষ্ণৌ শহরে মহরমের বড় ধূম। বড় মসজিদ ইমামবাড়ায় জাঁকজমক রোশনির বাহার দেখে কে। বেসুমার লোকের সমাগম। হিন্দু-মুসলমান, কেরানি য়াহুদি ছত্রিশ বর্ণের স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা, ছত্রিশ বর্ণের হাজারো জাতের লোকের ভিড় আজ মহরম দেখতে। লক্ষ্ণৌ শিয়াদের রাজধানী। আজ হজরত হাসান-হোসেনের নামে আর্তনাদ গগন স্পর্শ করছে- সে ছাতি-ফাটানো মর্সিয়ার কাতরানি কার না হৃদয় ভেদ করে? হাজার বছরের প্রাচীন কারবালার কথা আজ ফের জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই দর্শকবৃন্দের ভিড়ের মধ্যে দূর গ্রাম থেকে দুই ভদ্র রাজপুত তামাশা দেখতে হাজির। ঠাকুর সাহেবদের যেমন পাড়াগেঁয়ে জমিদারের হয়ে থাকে– বিদ্যাস্থানে ভয়েবচ।
সে মোসলমানি সভ্যতা, কাফ-গাফের বিশুদ্ধ উচ্চারণ সমেত লস্করি জবানের পূবৃষ্টি, আবা কাবা চুস্ত পায়জামা তাজ মোড়াসার রঙ্গ-বেরঙ্গ শহরপসন্দ ঢঙ অতদূর গ্রামে গিয়ে ঠাকুর সাহেবদের স্পর্শ করতে আজও পারেনি। কাজেই ঠাকুররা সরল সিধে, সর্বদা শিকার করে জমামরদ কড়াজান আর বেজায় মজবুত দিল।
ঠাকুরদ্বয় তো ফাটক পার হয়ে মসজিদের মধ্যে প্রবেশোদ্যত, এমন সময় সিপাহি নিষেধ করল। কারণ জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিল যে, এই যে দ্বারপার্শ্বে মুরদ খাড়া দেখছ, ওকে আগে পাঁচ জুতা মার তবে ভিতরে যেতে পাবে। মূর্তিটি কার? জবাব এল– ও মহাপাপী ইয়েজিদের মূর্তি। ও হাজার বছর আগে হজরত হাসান-হোসেনকে মেরে ফেলে; তাই আজ এ রোদন, শোকপ্রকাশ। প্রহরী ভাবল, এ বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর ইয়েজিদ-মূর্তি পাঁচ জুতার জায়গায় দশ তো নিশ্চিত খাবে। কী কর্মের বিচিত্র গতি! উল্টা সমঝলি রাম ঠাকুরদ্বয় গললগ্নীকৃতবাস ভূমিষ্ঠ হয়ে ইয়েজিদ-মূর্তির পদতলে কুমড়ো-গড়াগড়ি আর গদগদ স্বরে স্তুতি- ভেতরে ঢুকে আর কাজ কী? অন্য ঠাকুর আর কী দেখব? ভালা বাবা আজি দেবতা তো উঁহি হ্যায়, অস্ মারো শারোকো কী অভিত রোবত। (ধন্য বাবা ইয়েজি, এমনি মেরেচো শালাদের কি আজও কাঁদছে!!) [বেসুমার = অগুনতি; আদমশুমারি তুলনীয়। মর্সিয়া = শোকগীতি। কাফগাফের উচ্চারণ = কাফ আরবি বর্ণমালার অক্ষর ৷ আরব ইহুদি ছাড়া অন্যের পক্ষে উচ্চারণ কঠিন। গাফ উচ্চারণ সহজ। তবে কাফ-গাফ সংযুক্তভাবে সমষ্টি অর্থে ব্যবহার হয়। জবান = ভাষা। আবা কাবা = ঝোলা জামা। চুস্ত = টাইট। তাজ মোড়াসা = বাঁধা তৈরি পাগড়ি। শহরপসন্দ = শহরের সকলেই যে বস্তু পছন্দ করে। জম মরদ = জওয়ান মর্দ। ইয়েজিদ = আজকাল এজিদই লেখা হয়, কিন্তু ইয়েজিদ মূল উচ্চারণের অনেক নিকটবর্তী।]
রস তো পেলেনই, কিন্তু পাঠক স্বামীজির গল্প বলার টেকনিকটি লক্ষ করুন।