হাসন রাজার গান

হাসন রাজার গান

আইল রে, আইল রে বন্ধু, কোলে আইল রে।
আরে চান্দমুখ দেখিয়া হাসন রাজা পাগল হইল রে ॥

তাঁরা জিনি দুইটি আঁখি, সূর্য জিনি অঙ্গ।
হাসন রাজা দেখিয়ে বলে ছাড়ব না তোর সঙ্গ রে ॥

নূপুরেরই পুতুলা বন্ধু, জিনে পূর্ণ শশী।
দেখা মাত্র হাসন রাজা, হইল উদাসী রে ॥

কি কব রূপের শোভা, ঝলমল ঝলমল করে।
চাইতে, চাইতে রূপে কত রঙ্গ ধরে রে ॥
দেখিয়া রূপের বাহার, আঞ্জা করিয়া ধরে।
হাসন রাজা বলে আর কি, ছাড়িয়া দিব তোরে ॥

হাসন রাজা কোলে লইয়া, বুচা দেয় গালে।
প্রেমতরঙ্গে হাসন রাজা, নাচে ফালে ফালে রে ॥

ফালায় ফালায় হাসন রাজা আর দেয় লম্ফ।
দেশের লোকের সকলেরই, দেখিয়া উঠিল কম্প রে ॥

হাসন রাজার ফাল দেখিয়া, লোকের হইল ভয়।
পাগল হাসন রাজা বলিয়া সর্বলোকে কয় ॥

হাসন রাজা প্রাণবন্ধু রে কোলে লইয়াছে।
নাচিব আজীবন ভরিয়া, যতদিন বাঁচে রে ॥

হাসন রাজা বন্ধুছাড়া থাকবই না রে আর ।
মনের জিঞ্জির দিয়া বান্ধছে, চরণে তাঁহার রে ॥

আইসো পর্দা খুলিয়া গো মা, আইস পর্দা খুলিয়া গো।
হাসন রাজার প্রাণ যায়, তোমার লাগি জ্বলিয়া গো ॥

তোমার আমার বাড়ির মধ্যে আছে একখানা টাটি।
কাটিয়া কুটিয়া টাটিখান, করিয়াছি বাঁটি গো ॥

টাটির আঁড়ে থাকিয়া তুমি, বসিয়া রঙ্গ করো।
আড় নয়নে চাও কেন, বসিয়া একই ঘর গো ॥

হাসন রাজায় দেখিয়ে তোরে, মুস্করিয়া হাসে।
অন্তরের সহিতে তোরে, বড়ো ভালোবাসে গো ॥

আইসো হাসন রাজা এই তোর ঘরবাড়ি রে।
হাসন জানে ডাকতে আছে, তাড়াতাড়ি রে ॥

তোমার ঘর তোমার বাড়ি, তোমার বাগিচা।
যে দেখিল সত্য দেখছে যে না দেখছে মিছা
বাগিচায় বানাইছ, ফুল টঙ্গি ঘর।
সে ঘরে বসিয়া আমি ডাকি নিরন্তর ॥

খিড়কি দিয়া দেখি আমি বাগিচার মাঝে।
দেখিয়া রঙের ঝলক, মন মোর মজে ॥

হাসন জানে বলে দেখিয়া, রূপের ছটক।
চিরকালের জন্যে মন মোর, হইল আটক ॥

আগুন লাগাইয়া দিল কোণে, হাসন রাজার মনে।
নিবে না দারুণ আগুন জ্বলে দিল জানে ॥

ধাক ধাক করিয়ে উঠিল আগুন
ধৈল আমার প্রাণে।
সুরমা নদীর জল দিলে নিবে না সে কেনে ॥

লাগাইল লাগাইল আগুন আমার মনমোহনে।
বাঁচি না বাঁচি না গো প্ৰাণবন্ধু বিহনে ॥

জ্বলিয়া জ্বলিয়া যায় রে আগুন, কিসে নাই মানে।
বুঝিয়া দেখ রে হাসন রাজা, ধরাইল না তোর ধনে ॥

আকুল কইল কইল রে, প্রাণের বন্ধে রে।
হাসন রাজা বন্দি হইল প্রেমের ফান্দে রে ॥

কিবা ক্ষণে হইল দেখা, প্রাণবন্ধের সনে।
ভুলিতে না পারি রূপ উঠে মনে মনে রে ॥

চন্দ্র জিনিয়া মুখখানি, ঝলমল করে।
সে রূপ দেখিয়া আমি, কেমনে থাকি ঘরে ॥

চান্দ মুখ দেখাইয়া মোর, আকুল কৈল হিয়া।
অন্তরে ছাপিয়া গেল, পরদা লাগাইয়া রে ॥

ছটফট করে হিয়া তাহার কারণ।
অন্তরে হইল মম, প্রেমের হুতাশন রে ॥

হাসন রাজার গলে লাগিল, এই যে প্রেমের ফাঁস।
জন্মে জন্মে হইয়াছি, প্রাণবন্ধের দাস রে ॥

আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো স্বরূপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখো বন্ধুয়ার রূপ রে ॥

কাজলকোঠা ঘরের মাঝে, বসিয়াছে কালিয়া।
দেখিয়া প্রেমের আগুন উঠিল জ্বলিয়া ॥

কিবা শোভা ধরে ওরে রূপে দেখতে চমৎকার।
আরে বলা নাহি যায় বন্ধের রূপের বাহার ॥

ঝলমল ঝলমল করে ওর রূপে বিজলীর আকার।
মনুষ্যের কি শক্তি আছে, চক্ষু ধরিবার ॥

হাসন রাজার রূপ দেখিলা, হইয়া ফানাফিল্লা।
হু হু হু হু ইয়াহু, ইয়াহু, বলো আল্লা আল্লা ॥

আল্লা ভব সমুদ্রে ভব সমুদ্রে তরাইয়া লও মোরে।
তরান বরান চাই না আমি কেবল চাই তোরে ॥

তরাও মারো যাই করো এর লাগি কে ঝুরে।
হাসন রাজার মনের সাধ দেখিত তোমারে ॥

চিত্তে কেন তোমার লাগি সদায় ধড়ফড় করে।
হাসন রাজার মনে কেবল থাকত তোর হুজুরে ॥

না চাই ধন, না চাই জন, না চাই জমিদারি।
হাসন রাজার মনবাঞ্ছা থাকত চরণ ধরি ॥

পূর্ণ করো আকাঙ্ক্ষা প্রভু, ভক্তি করি তোরে।
পদতলে রাখো আসিক হাসন রাজা রে ॥

আপন সাধন আমার হইল না।
আমার পাগলা মনে কি বুঝিল, আপন সাধন কইল না ॥

আমার মাঝে কোন জন, তাঁরে খুঁজল না।
ঠাকুরচান্দ যে ঘরের মাঝে তাঁরে চেয়ে দেখল না ॥

ঘরে থাকতে ধরো তাঁরে, গেলে পাবে না।
গেলে পরে সে যে আর, ফিরিয়া আসবে না ॥

কি বুঝিয়া বসিয়া রইলে, কেন ধরো না।
ঘর থাকিয়া বাহির হইলে খুঁজিয়া পাবে না ॥

বুড়া হইলায় হাসন রাজা, তেও কি বুঝো না।
ঘরে থাকতে ঠাকুর ধরো ছাড়িয়া দিও না ॥

আমার মনের মাঝে আছে ধন,
বুঝতে পারবে যে ভাই রে সুজন।

মনের মাঝের, ধনো তারে জান না রে মন।
গুরুর পদে করো রে সাধন।
ওরে গুরুর বাক্য ঠিক রাখিলে পাবে রে তুই নিরঞ্জন ॥

শোনো রে মনকানা, ও তুই দেখিয়া দেখলে না,
মায়াজালে বন্দি হইয়ে, আপনা চিনলে না।
আরে ভক্তি করলে মুক্তি পাবে বলে রে হীন হাসন

১০

আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।

শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী ॥

আমি যখন উঠি রেগে, দেখে যমদূত ভাগে।
আসে না মোর মায়ের আগে, দেখো যেয়ে লক্ষণছিরি ॥

হাসন রাজার সন্ধান আছে, যম কি আসবে তার কাছে।
প্রাণ দিয়েছি হরির কাছে, যম কারে নিবে ধরি ॥

১১

আমি আমার পরিচয় করিয়েছি।
সবই তুই; আমিত্ব ছাড়িয়ে দিয়েছি ॥

আমি তো কিছুই নই, কিছু নহে তুই বই।
তুমি বিনে কিছু নহে আমি বুঝিয়েছি ॥

আমি আমি একটি নাম দিয়া, খেলা খেল ভবে আসিয়া।
কত রঙ্গ ঢঙ্গ করো, দেখি তোমার নাচানাচি ॥

তুমি ঘরে, তুমি বাইরে, তুমিই সবার অন্তরে।
কে বুঝিতে পারে প্রভু, তোমারও যে পেছাপেছি ॥

হাসন রাজার এই উক্তি, সকলই তুই মা শক্তি।
তুমি আমি ভিন্ন নহি, একই হইয়াছি ॥

১২

আমিই মূল নাগর রে,
আসিয়াছি খেইড় খেলিতে, ভবসাগরে রে ॥

আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিবশঙ্করী।
অধরচাঁদ হই আমি, আমি গৌরহরি ॥

খেলা খেলিবারে আইলাম এ ভবের বাজারে।
চিনিয়া না কোন জনে আমায় ধরতে পারে ॥

আমিই মূল, আমিই কোল, আমি সর্ব ঠাঁই।
আমি বিনে এ সংসারে আর কিছু নাই ॥

নাচো নাচো হাসন রাজা, কারে করো ভয়।
আমিত্ব ছাড়িয়া দিয়া, যাতে হইছ লয় ॥

১৩

আমি করি রে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।
কিরা দেই কসম দেই আমার বই হাতে নিবে না ॥

বারে বারে করি মানা বই আমার পড়বে না।
প্রেমের প্রেমিক যেই জনা, এ সংসারে হবে না ॥

অপ্রেমিকে গান শুনিলে কিছুমাত্র বুঝবে না।
কানার হাতে সোনা দিলে লাল ধলা চিনবে না ॥

হাসন রাজায় কসম দেয় আর দেয় মানা।
আমার গান শুনবে না যার প্রেম নাই জানা ॥

১৪

আমি যাইমু রে যাইমু রে আল্লার সঙ্গে,
ও আমি যাইমু রে যাইমু রে আল্লার সঙ্গে।
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে ॥

আল্লার রূপ দেখিয়ে হাসন রাজা, হইয়াছে ফানা।
নাচিয়ে নাচিয়ে হাসন রাজায়, গাইতেছে গানা ॥

আল্লার রূপ, আল্লার রঙ্গ আল্লারও ছবি।
সুরের বদন আল্লার, কি কব তার খুবি ॥

হাসন রাজা দিলের চক্ষে আল্লাকে দেখিয়া।
নাচে নাচে হাসন রাজা প্রেমের মাতয়াল হইয়া ॥

উন্মাদ হইয়া নাচে, দেখিয়া আল্লার ভঙ্গি।
হুঁশ ঘুস কিছু নাই, হইছে আল্লার সঙ্গী ॥

আদম সুরত আলার জানিবায় বেসক।
খল্‌কা আদমা আলা সুরতেহি হক ॥

রূপের ভঙ্গি দেখিয়ে হাসন রাজা হইছে ফানা।
শুনে না রে হাসন রাজায়, মোল্লা-মুনশির মানা ॥

১৫

আমি মরিয়া পাই যদি, শ্যামের রাঙা চরণ।
আরে তবে সে রঙিনী রাধার, সাফল্য জীবন ॥
মরিয়া মরিয়া যদি, শ্যামের লাগাল পাই।
রাঙা চরণে ধরি জনম গোওয়াই ॥

ছাড়াইলে না ছাড়িমু, ধরিমু চরণ।
যাহা করে জগন্নাথ, জগৎমোহন ॥

হাসন রাজায় বলে জান যাইবে যখন।
সে সময়ে দেখতে চাই যুগল চরণ ॥

১৬

আর কতদিন ভাঙা বজরা ঠেলিব।
বজরা যে পুরান হইছে, রূক কাঠ পচে গেছে,
হুতারগিরি নাহি জানি কেমনে গড়িব ॥

বজরা যে পুরানা মোর, কেমনে থাকি তার আন্দর।
বজরা দেখি লোকে হাসে, ছাড়িয়া যাইব ॥
হাসন রাজার মনে কইছে, বজরা ফেলিব।
সুন্দর দেখে নতুন জাহাজ খরিদ করিব ॥

১৭

আর জুদা রাখব না, বন্ধু রে! আর জুদা রাখব না
জুদাইমে কত ছদমা, তায় তো কেহ জানে না ॥

বন্ধে যদি ছুড়তে চাহে, আমি তায় দিব না।
আঞ্জা করিয়ে ধরিয়ে রাখব, যাইতে তো পারব না ॥

তাহারে ছাড়িয়ে আমি, কখনও থাকব না।
সইতে না পারব আমি, প্রেমেরও যাতনা ॥

হাসন রাজা কা হতা, হেয় হকে কানা।
নিজে নেস্থ হকে, আয়নুল হক কাহনা ॥

১৮

আরে তোরে লইয়া করেন খেলা আমার ঠাকুর কানাইয়ে
কেমনে খেলা করো গো রাধে, ভাগিনাকে লইয়ে ॥

শুনো গো রাধে বলি তোমারে, তোমার এ কি রীতি।
 ভদ্রের মাইয়া তুমি গো হইয়া, কেন গো অসতী ॥

লাজ কি নাই তোর, নির্লজ্জা রাধে যাও কদমতলে।
নন্দের সুতে গাঁথিয়া হার, দেয় তোমার গলে ॥

অখ্যাতি জগতে গো রাধে হইল প্রচার।
স্বদেশে-বিদেশে কলঙ্ক রহিল, রাধে গো তোমার ॥

এখন হাসন রাজায় তোমায় বুঝায়, তুমি নাহি বুঝো।
মায়াদয়া নাই গো তাঁর, তুমি কেন খোঁজো ॥

১৯

আরে দেখিলাম রে বন্ধু!
জিগরের চান্দ দেখিলাম রে।
সাক্ষাতে আসিয়া বন্ধু দাঁড়াইল রে ॥

বন্ধু! সাক্ষাতে দাঁড়াইল বন্ধু নুরেরই বদন।
দেখিয়া তাঁহার রূপ মন করে কেমন ॥

ক্ষণে মনে ধড়ফড় করে, ক্ষণে ছটফট করে।
দেখিয়ে তাঁহার রূপ মন বঞ্চে না ঘরে ॥

প্রেমে মত্ত হইয়া কেবল, নাচা কুদা করি।
কি কব রূপেরই বাহার, বলিতে না পারি ॥

হাসন রাজার মনপ্রাণ তো, লইয়া গেল হরি।
দেখিয়া রূপের ভঙ্গী, হইলাম প্রেমভিখারী ॥

২০

আহা রে সোনালি বন্ধু! শুনিয়ে যা মোর কথা।
হাসন রাজার হৃদকমলে, তোমার চান্দ মুখ গাঁথা ॥

হেরি যবে তব মুখ, এ জনমের যায় দুখ।
উপজিয়ে মনের সুখ, জনমের যায় ব্যথা ॥

হাসন রাজা হুতাশ হইয়া, আছে তব পানে চাইয়া।
মনপ্রাণ সব নিয়া, ছাড়িলে মমতা ॥

হাসন রাজা প্রেমিক বলে, আইস প্রেমনাগরী কোলে।
তোমার লাগি প্রাণ জ্বলে, প্রেমেরও বিধাতা ॥

২১

এ দেশে মানুষ নাই রে, প্রায়ই অহুঁশ।
ভবের মায়ায় ভুলিয়ে আছে, বেহুঁশ ॥

মায়াজালে ভুলিয়া না চিনিলায় আপন।
চিনিবায়, চিনিবায় যখন যখন, পরিবায় কাফন ॥

কেবা আসে কেবা যায়, এ দেহের মাঝার।
গেলে না পাইবায় দেখা এ জনমে আর ॥

বুঝাইলে না বোঝে লোকে, সমজাইলে না সমজে।
বন্ধের দিশা বাতাইয়া দিলে, তবুও না খোঁজে ॥

দুনিয়া দুনিয়া করিয়া হইছে, শয়তানের চেলা।
কেমনে কারে ঠগিয়া খাইব, এই তাদের খেলা ॥

হাসন রাজায় কান্দন করে, লোকের লাগিয়া।
সকলকে তরাও গো প্ৰভু, সুমতি দিয়া ॥

কত মতে বুঝাইলাম নাহি হয় হুঁশ।
কারে কি বলিব আমার কপালেরই দোষ ॥

হাসন রাজা কান্দন করে, ধরিয়া প্রভুর পাও।
লোকের বদলা মারিয়া মোরে, সকলকে তরাও ॥

২২

একদিন তোর হইবে মরণ রে হাসন রাজা
একদিন তোর হইবে মরণ।
মায়াজালে বেড়িয়া মরণ, না হইল স্মরণ রে হাসন রাজা
একদিন তোর হইবে মরণ ॥

যমের দূতে আসিয়া তোমায়, হাতে দিয়ে দড়ি।
টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে, যমেরও পুরি রে ॥

সে সময় কোথায় রইব তোমার সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।
কোথায় রইব রামপাশা, কোথায় লক্ষণছিরি রে ॥

করবায় নি রে হাসন রাজা রামপাশার জমিদারি।
করবায় নি রে কাপনা নদীর পারে ঘুরাঘুরি রে ॥

আর যাইবায় নি রে হাসন রাজা, রাজাগঞ্জ দিয়া।
করবায় নি রে হাসন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে ॥

ছাড়ো ছাড়ো হাসন রাজা, এ ভবের আশা।
প্রাণবন্ধের চরণতলে, করো গিয়া বাসা রে ॥

গুরুর উপদেশ শুনিয়া, হাসন রাজায় কয়।
সব তেয়াগিলাম আমি, দেও পদাশ্রয় রে ॥
হাসন রাজা একদিন তোর হইব মরণ ॥

২৩

এগো মা! তব সম রূপ রঙ্গ কার।
ঝিলিমিলি করে রূপে দেখি যে তোমার ॥

দিবাকর নাহি ধরে রূপ যে তোমার।
বলা নাহি যায় তব, রূপেরই বাহার ॥

সেই রূপে ঘর বানাইল, কলিজায় আমার।
সব ছাড়িয়ে তব রূপ, করিয়াছি সার ॥

রূপেতে মিশিব তব, কিছু চাই না আর।
এই মনে সাধ হইয়াছে, হাসন রাজার ॥

২৪

এগো সুন্দরী গো তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা।
তুমি বিনে হাসন রাজা, কেউ রে মানে না।
সুন্দরী গো, তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

সরম-ভরম ছাড়িয়া হাসন রাজা হইছে ফানা।
তোমার বাড়ির উপরে দিয়া, করে আনা জানা।
সুন্দরী গো, তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

তোমায় দেখলে হাসন রাজা গায় রঙ্গের গানা।
তুমি দেখলে তারে, কেন করো টানা মানা।
সুন্দরী গো, তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

এই কথা আরশী-পড়শির হইয়াছে জানা।
তোমার বাড়ি হাসন রাজার, হইয়াছে থানা।
সুন্দরী গো, তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

দিলারামে গায় রে গান, করিয়ে তানা না না।
হাসনজানের লাগি হাসন রাজা যে ফানা সুন্দরী গো,
তোর লাগি হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

২৫

ও জান বাহির হইলে, যাইব বন্ধের বাড়ি
জান বাহির হইলে রে ॥

হাসন রাজার জান যাইবে, আল্লার কাছে উড়ি।
নমাজিরা বেহেস্তে পড়ি যাইবা গড়াগড়ি ॥

দুনিয়াদারের জানিবায় দোজখে বসিত।
দিনে রাইতে দুনিয়ার লাগি যার আছে মতি ॥

নমাজ রোজা নাহি করে, দুনিয়ার মায়া নাই।
নিশ্চয় জানিও তার, এরাফেতে ঠাঁই ॥

আসিক লোকের জান থাকবে, আল্লার আরশের তলে।
নাচিয়া নাচিয়া, আসিক হাসন রাজায় গান বলে ॥

২৬

ও প্রাণবন্ধু রে! বৃথা জন্ম গেল আমার।
আসিয়া ভূতলে নাম না লইলাম তোমার ॥

কি বুঝিয়ে বসিয়া আছি কি করতে কি করতে আছি।
বৃথা ভবের কাজে নাচি করি কারবার ॥

হাসন রাজা জন্ম লইয়া বৃথা গেল দিন গইয়া।
লইলায় না আল্লাজির নাম বাঁচবে কয়দিন আর ॥

হাসন রাজা বলি তোরে কেন বসিয়ে রইলে ঘরে।
দিন গেল শীঘ্র চলো, প্রেমেরই বাজারে ॥

২৭

কতদিন আর খেলবে হাসন, ভবেরই খেলা।
খেলতে খেলতে হাসন রাজার না লাগে ভালা ॥

এই যে দেখো ভবের বাজার, কেবল এক জ্বালা।
স্ত্রী-পুত্র কেহ নয় তোর, যাইতে একেলা ॥

হাসন জানে, হাসন রাজায় মাইল এক ঠেলা।
চলো চলো শীঘ্র করিয়ে, চলো শালার শালা ॥

২৮

কতদিন থাকিবায় লক্ষণছিরি রে হাসন রাজা
ও রাজা কতদিন থাকিবে লক্ষণছিরি।
আখেরেতে যাইতে হইবে একদিন মরিবে।
হাসন রাজা কতদিন থাকিবে লক্ষণছিরি ॥

এই যে দেখো আশয় বিষয়, করিতেছ বাহাদুরি।
সব ছাড়ি যাইবায় হাসন রাজা একাশ্বরী রে ॥

আবাল কাল গেল খেলে, যৌবন গেল মেলে।
বৃদ্ধ কাল সাক্ষাৎ এবে রহিলে রে ভুলে ॥

ছাড়ো ছাড়ো হাসন রাজা, এই ভবের আশ।
এক মনে চিন্তা করিয়ে হও তাঁর দাস ॥

পূর্ণ ব্রহ্মা আজ্ঞা এ গান শুনিয়া।
হু হু হু হু বজুজ ইয়াহু মনেতে টানিয়া ॥

আল্লা আল্লা, আল্লা আল্লা, আল্লা আল্লা সার।
আল্লা বিনে কিছু নাই দেখো মন আমার ॥
হাসন রাজা কতদিন থাকবে লক্ষণছিরি ॥

২৯

কপাল পোড়া মনে মরে মাইল গো,
কিসে কি যে মনে করে, স্বাধীন নাহি হয় গো ॥

মন যার ভালো হয় সবে ভালো কয় গো।
মন যার দুষ্ট হয়, সবে মন্দ কয গো ॥

মনেতে আউলিয়া হয় মনেতে দরবেশ গো।
মনে চোর চুট্টা হয় আর হয় ডাকাইত গো ॥

হাসন রাজায় বলে মন, হইয়াছে মূল গো।
মনেতে ঈশ্বরে মিশে, মনেতে শয়তান গো ॥

ভালোমন্দ মাবুদ আল্লায়, মনের মাঝে দিছে।
মনেতে পার হইয়া যাবে, মনে ডুবিবে গো ॥

৩০

কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে?
রঙ্গের রঙ্গিয়া কানাই
কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে?
এই কথাটা হাসন রাজার উঠে মনে মনে ॥

স্বর্গপুরী ছাড়িয়া কানাই আইলায় এ ভুবনে।
হাসন রাজায় জিজ্ঞাস করে আইলায় কি কারণে ॥

কানাইয়ে যে করো রঙ্গ রাধিকা হইছে ঢঙ্গ।
উড়িয়া যাইব জুংরার পতঙ্গ খেলা হইব ভঙ্গ ॥

হাসন রাজায় জিজ্ঞাস করে কানাই কোনজন।
ভাবনাচিন্তা করে দেখি কানাই যে হাসন ॥

৩১

কালা! আয় রে আয় কুঞ্জে আয়
প্রাণী কান্দে তোমার দায়।
সুখের রজনী গইয়া যায় ॥

সাজাইয়া ফুলেরই শয্যা, কুঞ্জবাসী হইল রে।
আইল না মোর প্রাণবন্ধু, দিলাম না কুল রাঙা পায় ॥

প্রাণনাথের প্রেমে মন, উদাস হইল রে।
হীন হীন হাসনে বলে, লাগল না প্রেম আমার গায় ॥
সুখের রজনী গইয়া যায় ॥

৩২

কারে তুমি বুঝাও রে বন্ধু,
তোমার পাগলা হাসন নাহি বোঝে।
পাগলা তোর হাসন জানো তো,
কেমন তুমি বিনে কিছু বোঝে না সোজা রে বন্ধু ॥

তোমার যে মক্কর, আমার যে চক্কর, হাসন রাজায় তারে জানে।
যেখানে যা করো হাসন রাজা থাকে খোঁজে রে ॥

তুমি যে কেমন, আমি কি তেমন, তোমার কি এসব সাজে।
দেখিয়ে তোমার কীর্তি-নীর্তি, হাসন রাজা মরে লাজে রে ॥

তোমার যে হাসন, করে রে নাচন, তোমায় মন মোর মজে।
হাসন রাজার মনে তোমায়, রাখি হৃদের মাঝে রে ॥
বন্ধু! তোমার পাগলা হাসন নাহি বোঝে ॥

৩৩

কিসের ভাবনা ভাবো হাসন রাজা, দিন তো গেল তোর গইয়ে।
কি ভাবিয়ে বসিয়াছ কার পানে আছো চাইয়ে ॥

দিন তো গেল দিনের পথে, রাত্রি আইল সাক্ষাতে।
আন্ধাইর হইলে পারবে নারে, পড়বে রে পাছাড় খাইয়ে ॥

রাত্রি তো আসবে যখন, হাসন কি করবে তখন।
বাড়িত যাইতে পারবে না রে, শীঘ্র হাসন চলো ধাইয়ে ॥

৩৪

কিসের বাড়ি কিসের ঘর রে কিসের জমিদারি।
সঙ্গের সঙ্গিয়া কেহই নাই তোর, কেবল একাশ্বরী ॥

ঐ যে তোমার ধনজনে, সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।
কেহনি যাইবে সঙ্গে যমে নিতে ধরি ॥

কিসের আশা, কিসের বাসা, কিসের লক্ষণছিরি
আরে কিছুই কিছুই নয় রে, সকলি গৌরহরি ॥

শোনো রে হাসন আমার বচন, তুমি যে আমারি।
ভবের মায়া ছাড়িয়ে সদায় থাকো চরণ ধরি ॥

হাসন রাজায় প্রভুয়ে বুঝায় হস্তের মধ্যে ধরি।
তোমার আমার এমনি বন্ধন ছাড়াইতে না পারি ॥

৩৫

কী হইব মোর হাশরের দিন রে ভাই মমিন।
মমিন হায় রে কি হইবে মোর হাশরের দিন।
এই ভাবনায় মরে হাসন বন্ধেনি বাসে ভিন ॥

আল্লাতালা কাজি হইয়া বসিবা ছঙ্গা সনে।
নেকি বদি তৌলাইবা এ কথা উঠে মনে রে
ভাই মমিন ॥

বিচার করিবা গো আল্লায় নেকি বদি তৌলিইয়া।
কি হুকুম হইবে আমার মরি তাই ভাবিয়া।
রে ভাই মমিন ॥

এই কথা মনে হইয়া, হাসন রাজা আউলা ঝাউলা।
লক্ষণছিরির লোকে বলে হাসন রাজা বাউলা।
রে ভাই মমিন ॥

হাসন রাজা কান্দন করে কি হইবে উপায়।
কেবল দয়া করিয়া বন্ধে যদি রাখে রাঙা পায়।
রে ভাই মমিন ॥

৩৬

খোদা মিলে প্রেমিক হইলে।
পাবে না পাবে না খোদা নমাজ রোজা কইলে ॥

খোদা যদি ধরতে চাও, তার সঙ্গে পিরিত বাড়াও।
মিলিবে মিলিবে খোদা প্রেমে তাঁর মজিলে ॥

মিলিবে না রে প্রাণের খোদা তসবি টনকাইলে।
মিলিবে না মিলিবে না খোদা নাম তাঁর লইলে ॥

আল্লা আল্লা কইলে কিবা কলমা ও পড়িলে।
পাইবে না রে প্রাণের খোদা, মাথা কুটিয়া ম‍ইলে ॥

অন্য পন্থে না যাইয়া, প্রেমপন্থে গেলে।
পাইবায় পাইবায় খোদা হাসন রাজায় বলে ॥

৩৭

গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতে ডুরি।
হাসন রাজা রে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি ॥

মৌলার হাতে আছে ডুরি, আমি তাতে বান্ধা।
যেমন ফিরায়, তেমনে ফিরি, এমনি ডুরির ফান্দা ॥

গুড্ডি যে বানাইয়া মোরে, বাতাসে উড়াইয়া উড়াইয়া।
খেইড় খেলায় মোরে দিয়া, কান্না মুণ্ডা দিয়া ॥

রঙে রঙে মোরে দিয়া, খেইড় খেলাইয়া।
হাউস মিটাইয়া, মুই গুড্ডি রে, ফেলিব ফাড়িয়া ॥

গুড্ডি হাসন রাজায় কান্দে, না লাগব তার দয়া।
মাটিতে মিশাইব আমার, সোনার বরণ কায়া ॥

হাসন রাজায় মিন্তি করে, মৌলার চরণ ধরি।
চরণছায়ায় রাখো মৌলা, দাসকে তোমারি ॥

৩৮

চিরকালের দাস হইয়ে মনিবের কাজ করি না রে।
কেমনে মোরে ভালোবাসিতে, আমি কি তায় বুঝি না রে ॥
হইয়ে চিরকালের দাস, করি আমি অন্যের আশ।
থাকি না ঠাকুরের পাশ, ঠাকুরের কথা শুনি না রে ॥
আমারও দুষ্টমতি, কি হইবে আমার গতি।
ছাড়িয়া আমি নিজ পতি, উপপতি ছাড়ি না রে ॥
হইকি আমি বুদ্ধিহারা, লাগিয়াকে সংসারি বেরা।
দিনে দিনে হইজি সারা, দেখিরে তো দেখি না রে ॥
ওরে ওরে হইছি সারা, দেখিরে তো দেখি না রে ॥
ওরে ওরে হাসন রাজা, কেন হইলে অবুঝা।
অন্যের সাথে করো রাজা, ঠাকুরের পূজা করিস না রে ॥

৩৯

জ্বালাইল কে পিরিতের আগুন মন মনে রে।
মানে না মানে না মনে প্রাণবন্ধু বিহনে রে ॥
যে জ্বালাইল প্রেমানল, সে যদি করে শীতল।
তবে রব এ ভূতল, নয়তো প্রাণ যাবে রে ॥

দাবানল যে দিয়াছে, সে বিনে প্রাণ না বাঁচে।
দেখা দেয় না আয় না কাছে মন চুরি করিয়ে রে ॥

হাসন রাজার মনচোরা, ধরতে গেলে না যায় ধরা।
লাগাইছে পিরিতের বেরা আড়ালে থাকিয়া রে ॥

৪০

ঝিলিমিলি, ঝিলিমিলি, করে তাঁর বদনে।
কেমনে মিলি, কেমনে মিলি, খাইল দুই নয়নে ॥

দেখিয়া গো তার চান্দ বদন, মন করে মোর কেমন কেমন।
অন্য কিছু চায় না মনে, কেবল, চায় সে ধনে ॥

হেরিয়ে গো তার রূপের ছটক
হাসন রাজার মন হইল আটক।
মাইল, মাইল, মাইল, মাইল গো মদনে ॥

8১

তরে কেউ ধরিতে না পারে, ধরিতে না পারে।
সকল রঙ্গের মানুষ একটি থাকে মোর ঘরে ॥

ঘরে থাকে বাইরে থাকে, থাকে সে অন্তরে।
তাঁর লাগিয়া পাগল হইয়া, হাসন রাজা ফিরে ॥

রঙ্গ করে, ঢঙ্গ করে, আরও করে খেলা।
সেই মানুষে লাগাইয়াছে ভবার্ণবের মেলা ॥

হাসন রাজা হইছে পাগল, দেখিয়া তাঁর লাগি
তাঁরে যদি ধরতে চাও রাত্রি থাকিও জাগি।

৪২

তুমি কে আর আমি বা কে, তাই তো আমি বুঝি না রে।
এক বিনে দ্বিতীয় আমি, অন্য কিছু দেখি না রে ॥

তুমি হে জগতের কর্তা, আমি শব্দটিই মিথ্যা।
একা তুমি বিধাতা, তব শরিক অন্য নাই রে ॥

আমি আমি বলে যারা, বুঝে না বুঝে না তারা।
লাগিয়াছে সংসারি বেরা, মূর্খতা ছুটিছে না রে ॥

মিছামিছি বলি আমি সর্বব্যাপী হও রে তুমি।
সকলই তুই অন্তর্যামী, তুমি ভিন্ন কিছু নয় রে ॥

হাসন রাজা নামটি দিয়ে, রহিয়াছ ছাপাইয়ে
সবই করো পরদা দিয়ে, দোষের ভাগী হও না রে ॥

বুঝিয়ে দেখি তুই বই, হাসন রাজা কিছু নই।
হাসন রাজা যারে কই, সেও দেখি তুমি ঐ রে ॥
তুমি কে আর আমি বা কে, তাই তো আমি বুঝি না রে ॥

৪৩

তোরা দেখছো নি গো, ঘরের গিরি রে।
হাসন রাজা জিজ্ঞাসে, আরিপরি রে ॥

লাল ধলা নয় রে সে তো, আজব রঙের মানুষ রে।
দেহার মাঝে চাইয়া দেখো, কত রঙ্গ করে রে ॥

নাচে কুদে, ফালায় ফুলায়, এই কাম করে রে।
সুন্দর নারী দেখলে পরে, টান দিয়া কাপড় ধরে রে ॥

হাসন রাজা দেখিয়া তার, লাগিয়া মনটা যায় রে।
দিলে চায় সর্বদা থাকিতাম তাঁর হুজুরে রে ॥

৪৪

দয়াল কানাই! দয়াল কানাই রে;
পার করিয়া দেও কাঙালি রে।

ভবসিন্ধু পার হইবার পয়সাকড়ি নাই।
দয়া করি পার করিয়া দেও বাড়ি চলি যাই ॥

অকূল সমুদ্রের পাড়ি, পার করে দেও তাড়াতাড়ি।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, মনে ভয় পাই ॥

দয়াল বলিয়ে নাম তোর, জানে সংসারে।
মুই অধম রে পার করিয়া দেও, চলি যাই ঘরে ॥

হাসন রাজার ব্যগ্র দেখে, দয়া লাগে কানাইর বুকে।
আইসে ত্বরিয়ে কানাই ডাকে, তোমায় নিয়া যাই ॥

৪৫

দয়াল বন্ধু, দয়াল বন্ধু ও দয়া ধরিয়ে লও মোরে কোলে।
কাকুতি মিনতি করিয়ে ও তোমার হাসন রাজায় বলে ॥

তোমার লাগি দিনে রাইতে মনপ্রাণ জ্বলে।
পরদা দিয়া ঘরের মাঝে কেন বইসে রইলে ॥

পরদা খুলিয়া আইসো একবার দেখি চান্দ মুখ।
দেখিলে যাইবে আমার আজীবনের দুখ ॥

কান্দে কান্দে হাসন রাজা প্রেমের হুতাশ হইয়া।
প্রেমের হুতাশ ঠাণ্ডা করো মোরে কোলে লইয়া ॥

হাসন রাজার মনের আশা চরণতলে।
ছাড়ব না ছাড়ব না তোমায় কোলে তুলিয়া লইলে ॥

৪৬

দুনিয়ার লাগি কান্দি ফির, দুনিয়া নি যাইব সঙ্গে।
কি বুঝিয়া বসিয়া আছ স্ত্রী-পুত্রের রঙ্গে ॥

কার লাগিয়া কান্দ তোরা, দুনিয়ার লোক।
হাসন রাজায় দেখতে চায় না, দুনিয়াদারের মুখ ॥

কান্দে কান্দে যেই জন, দুনিয়ার লাগিয়া।
হাসন রাজায় যায় তাদের মুখেতে হাগিয়া ॥

তোরা দেখো হাসন রাজায়, দুনিয়ার কারবার করে।
দুনিয়ার মুখে সেফ দিয়া, বন্ধের লাগিয়া ঝুরে ॥

যাইবায় নি রে এ দুনিয়া, কেউরির সঙ্গে।
কি বুঝিয়া মজিয়ে আছ, এ দুনিয়ার রঙ্গে ॥

যখন আসিবে যমরাজ, হাতে লইয়া দড়ি।
বান্ধিয়ে নিয়ে যাবে তোরে, যেমন মেড়ামেড়ি ॥

হাসন রাজায় হাসিয়ে বলে, তখন কি উপায়
ছাড়াইয়া নি রাখতে পারব, স্ত্রী পুত্র মায় ॥

দুনিয়ার লাগি ঝুর কেন, দুরন্তর সাক্ষাৎ।
কি আক্কলে দুনিয়ার লাগি করো উৎপাত ॥

এক কড়ার আক্কল নাই, পরের লাগিয়া ঝুর।
আপনা বন্ধু বসিয়া রইছে, আপনার ঘর ॥

আপন বন্ধু আপনার উরে, তার পানে না চাও।
নাকিছ আক্কল তোদের, বৃথা দিন গোয়াও ॥

দুর, দূর, দূর, দুর, দূর, দূর, দুনিয়ার মায়াদার।
খবর না রাখে তারা, আপন প্রিয়ার ॥

হাসন রাজায় বলে, যার প্রিয়ার মায়া নাই।
মুতিয়া দে তার বাপের মুখে, তার মুখে দে ছাই ॥

৪৭

দেখা দেও দেখা দেও বন্ধু রে ভুবনমোহন।
দেখা দিলে থাকে হাসন রাজার জীবন রে ॥
দেখা দেও দেখা দেও বন্ধু রে ॥

দেখা দেও দেখা দেও বন্ধু, হৃদয়ের চান।
দেখা দিলে বাঁচে তোমার হাসনের পরাণ রে ॥

প্রেমানলে জ্বলিয়া আমার তনু ঝরঝর।
এব নাকি প্রাণের বন্ধে বাসো মোরে পর রে ॥

কাকুতি করিয়ে ডাকি আইসো বন্ধু কোলে।
গাঁথিয়া রেখেছি হার পরাইব তোর গলে রে ॥

ঘরখানি সাজাইয়ে আছি কত রঙ্গ দিয়া।
পবিত্র করিয়াছি ঘর গোলাব ছিটাইয়া রে ॥

হাসন রাজার মনের আশা পুরাও দেখা দিয়া।
তোমার লাগি হাসন রাজার প্রাণ যায় জ্বলিয়া রে ॥

৪৮

দেখিয়ে নুরি অঙ্গ, আর দেখিয়ে ঝলমলা রঙ্গ।
হাসন রাজা পাগল হইয়ে, লইল রে তোমার সঙ্গ ॥

তোমার মতো রূপের বাহার, সংসারেতে আছে কাহার।
রূপটি তোমার কি চমৎকার, আচানক তোর রঙ্গ ঢঙ্গ ॥

কি কব তোমার খুবি, জিনিয়ে দেখি ইন্দ্ৰ দেবী।
আরো জিনে শশী রবি, দেখিয়ে ঠেকলাম প্রেম ফঙ্গ ॥

হাসন রাজা দেখিয়ে তোরে, হায় হায়, হায় হায় করে।
প্রাণ যায় প্রাণ যায়, আমি তো হইলাম সাঙ্গ ॥

৪৯

নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।
হাসন রাজা প্যারীর প্রেমে মজিল রে ॥

ছটফট করে হাসন, দেখিয়া চান্দ মুখ।
হাসনজানের মুখ দেখি, জন্মের গেল দুখ ॥

হাসনজানের রূপটা দেখি, ফালদি ফালদি ওঠে।
চিড়াবারা হাসন রাজার বুকের মাঝে কুটে ॥

৫০

পাগল রে তরাইও নিজে নিজে,
তোমার পাগল হাসন রাজায় না বুঝে।
পাগল রে তরাইও নিজে নিজে ॥

ঘরে-বাইরে বাড়িয়ে বাড়িয়ে, তোমারে খোঁজে।
তার কাছে ছাপিয়া থাকা, তোমার নাহি সাজে ॥

অন্যখানে খুঁজি কেন, তুমি আমার মাঝে।
বুকেতে রাখিমু তোরে, কি ধরাইব লাজে ॥

হাসন রাজায় ভক্তি করে নিজে, নিজেরে পূজে।
আমি তো কিছুই নই, সকলই তুই যে ॥

৫১

পিরিত করিয়ে, পিরিত করিয়ে মোর মন উদাসী।
প্রাণ গেল প্রাণ গেল, বন্ধু রে ভালোবাসি ॥

কথা কয় প্রাণবন্ধে, যখন হাসি হাসি।
দেখিয়ে তাঁর রূপের বাহার, আইসে মোর বেহুঁশী ॥

পিরিতি আজব চিজ জগতের প্রধান।
পিরিত করো প্রেমিকেরা, ছাড়িয়ে কুলমান ॥

পিরিত রত্ন করো যত্ন, পিরিত জানিয়া সার।
পিরিত ভাবে পাইবায়, বন্ধুয়ার দিদার ॥

হাসন রাজায় পিরিত করিয়া, বন্ধুয়ারে পাইয়া।
এই কথা হাসন রাজা, ফিরে গাইয়া গাইয়া ॥

৫২

পিরিতের উদাসী হাসন রাজা রে।
প্রিয়া বিনে থাকতে না রে এক লহজা রে ॥

না চায় ধন, না চায় জন, না চায় সিংহাসন রে।
হাসন রাজায় চায় কেবল, বন্ধের দরশন রে ॥

প্রিয়া প্রিয়া করিয়া করে, নিশি অবসান রে।
আমায় ছাড়িয়া কোথায় রহিলে, প্রাণের প্রাণ রে।
দেখা দিয়ে প্রাণ নিয়ে কোথায় লুকাইলে রে ॥

হাসন রাজা বলে বন্ধু, মম নিবেদন রে।
তুমি বিনে অন্য কেও রে, না লাগে মোর মনে রে ॥

কেমনে বাঁচিব আমি, তুমি ছাড়া হইয়া রে।
দিনে রাইতে প্রেমের আগুন, জ্বলে গইয়া গইয়া রে ॥

লাগিয়াছে পিরিতের আগুন, সহ্য নাহি যায় রে।
হাসন রাজায় জ্বলিয়ে জ্বলিয়ে কেবল চিল্লায় রে ॥

৫৩

পিরিতের কি এত যন্ত্রণা, আগে জানি না।
জানিলে তাহার পিরিতে, আমি মজতাম না ॥

পিরিত করিয়ে হাসন রাজা, হইল দেওয়ানা।
নাচে কুদে ফালায় ফুলায়, হইয়া ফানা ॥

নাচি নাচি চলছে হাসন রাজা মস্তানা।
খেমটা তালে গাইয়া যাইছে, পিরিতের গানা ॥

৫৪

পিরিতের মানুষ যারা, আউলা-ঝাউলা হয় রে তারা।
হাসন রাজায় পিরিত করিয়া, হইয়াছে বুদ্ধিহারা ॥

পিরিতের এমনি ধারা, মনপ্রাণ করে সারা।
আরও করে কারা কারা, লাগল যার পিরিতের বেরা ॥

হাসন রাজা আউলা হইয়ে, ডাকাতে আছে মৌলা বলিয়ে।
নাচতে আছে ফালাইয়ে, হইয়ে প্রেম প্রিয়সীর মারা ॥

৫৫

প্রেমানলে হাসন রাজা জ্বলিল।
জ্বলিয়া যাইতে হাসন রাজা এই বলিল ॥

আমি যে জ্বলিয়া মরি এর নাই মোর দুখ।
জ্বলিয়া পুড়িয়া নি দেখিমু বন্ধের মুখ ॥

হাসন রাজা জ্বলিয়া মরতে নাচা কুদা করে।
প্রেমের আগুন ধরিয়াছে সকল শরীরে ॥

নিবাইলে না নিবে আগুন ধাক ধাকিয়া উঠে।
লুটন কবুতরের মতো, হাসন রাজা লুটে ॥

ছটফট করে হাসন, চতুর্দিকে চায়।
মম দুঃখ দেখিয়ানি মোর, প্রাণবন্ধু আয় ॥

৫৬

প্রেমের আগুন, প্রেমের আগুন রে বড়োই কঠিন।
ধড়পড়াইয়া মরে লোক, জানিবায় একিন ॥

যার অন্তরে লাগিয়াছে প্রেমেরই অনল।
নিবে না দারুণ আগুন দিলে সুরমার জল ॥

সেই আগুন ধরিয়াছে হাসন রাজার গায়।
ফাল দিয়া ফাল দিয়া উঠে হাসন করে হায় হায় ॥

৫৭

প্রেমের আগুন লাগল রে, হাসন রাজার অঙ্গে।
নিবে না হৃদয়ের আগুন, ডুবলে সুরমা গাঙ্গে ॥

ধা ধা করিয়া উঠছে আগুন, কিসে কি করেঙ্গে।
আনিয়া দে গো প্রাণের বন্ধে রে গলেতে ধরেঙ্গে ॥

হাসন রাজা বন্ধু বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।
বন্ধুর আশায় নাচে হাসন, প্রেমেরই তরঙ্গে ॥

হাসন রাজায় বলে আমি, খাইমু বন্ধের সঙ্গে।
আমিত্ব ছাড়িয়া দিয়া মিশব তার রঙ্গে ॥

৫৮

প্রেমের বাজারে বিকে মানিক সোনা রে।
যেই জনে চিনিয়া কিনে লভ্য হয় তার দুনা রে ॥

সুবুদ্ধি ও সাধু যারা, প্রেমবাজারে যায় তারা।
নির্বুদ্ধিরা ভববাজারে, বেগার খাটিয়া মরে রে
প্রেমবাজারে বিকে রত্ন ভববাজারে নাই।
সাধু যারা শীঘ্র তাঁরা খরিদ করা চাই রে ॥

সাধু যারা কিনে তারা আনন্দিত হইয়া।
কুবুদ্ধিরা বইয়া রইছে ভবের বাজার চাইয়া রে ॥

মানিকরত্ব না কিনিলাম, প্রেমবাজারে যাইয়া।
ভববাজারে বোকার মতো রইয়েছি বসিয়া রে ॥

হাসন রাজা বলে আমার কি লিখছে ললাটে।
যা লিখিয়াছে নিরঞ্জন সে কি আর মিটে রে ॥

৫৯

প্রেমের মানুষ নয় যারা,
হাসন রাজার গান শুনিস না তারা ॥
অপ্রেমিক তো মানুষ নয় রে, জীবিত থাকতে সে মরা ॥

প্রেম নাই যার, আইছ না ধার, ঘরত মোর শীঘ্র বাহির হ
কাষ্ঠের মূর্তি ভূতের মতো করিছ না কারা কারা ॥

হাসন রাজা প্রেমে নাচে, প্রেমিক পাইলে বসায় কাছে,
আঞ্জা করিয়া দেয় বুছে হাসন রাজার এই ধারা ॥

৬০

প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না।
তোমারেও হাসন রাজায় দুই জানে না।
প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না ॥

তুমি আমি দুই নয় এক বিনে জানি না।
এক বিনে দুই থাকা আমি মানি না।
প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না ॥

হাসন রাজা জাতে মিশতে হইয়াছে ফানা।
হাসন রাজায় এক বিনে দুই জানে না।
প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না ॥

হাসন রাজা মিশতে জাতে গাইতে আছে জানা।
আল্লা বিনে কিছু নাহি হাসন রাজার জানা।
প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না ॥

তোমারেও হাসন রাজায় দুই জানে না।
প্রাণবন্ধু মোরে আলগ রাখিও না ॥

৬১

বন্ধের রূপ দেখো রে, নিরখিয়া,
দিলালপুরে বসিয়াছে প্রাণবন্ধু প্ৰিয়া ॥

দিলালপুরে দিল্লির শহর তাতে বাদশার তক্ত।
এবে না দেখিল যেই, নিতান্ত কমবক্ত ॥

প্রেমের বাতি জ্বালাইয়া দেখো বন্ধের মুখ।
চান্দমুখ দেখিলে যাবে আজীবনের দুখ ॥

চান্দমুখ দেখিল যেই, গেল দুঃখ গম।
সাফল্য হইল তারি, এই যে জনম ॥

হাসন রাজায় বন্ধের রূপ, স্বপনে দেখিয়া।
নাচে নাচে হাসন রাজা, আনন্দিত হইয়া ॥

আলাপ করিল বন্ধে, সাক্ষাতে আমার।
আমার সঙ্গে কইল বন্ধে, ভালো ব্যবহার ॥

আমি তোমার তুমি আমার, বন্ধে যে বলিয়া।
অন্তরে সামাইয়া বইসে আনন্দিত হইয়া ॥

নাচে কোঁদে হাসন রাজা, বন্ধু কোলে লইয়া।
রাখিয়াছি জীগ রে বন্ধুরে, না দিব লামাইয়া ॥

৬২

বাউলা কে বানাইল রে হাসন রাজা রে
বাউলা কে বানাইল রে ॥

বানাইল বানাইল বাউলা তার নাম হয় মৌলা।

দেখিয়া তার রূপের ছটক হাসন রাজা হইল আউলা ॥

হাসন রাজা হইছে পাগল, প্রাণবন্ধের কারণে।
বন্ধু বিনে হাসন রাজার অন্য নাহি মনে ॥

হাসন রাজা গাইছে গান হাতে তালি দিয়া
সাক্ষাতে দাঁড়াইয়া শুনে হাসন রাজার প্রিয়া ॥

৬৩

বাড়ৈ কই লুকাইল রে, ঘরখানি বানাইয়া রে
বাড়ৈ কই লুকাইল রে।
আরে ঘরে বাইরে হাসন রাজায় তাঁরে তুকাইল রে ॥

বরুয়া বাঁশের ঘরখানি, রাখাল বাঁশের আড়া।
ডলুয়া বাঁশ দিয়া দিছে, চতুর্দিকের বেড়া রে ॥

উলুছন দিয়া দিছে ঘরের, এই না ছানি।
মেঘ আনিলে চুয়াইয়া চুয়াইয়া, পড়ে ঘরে পানি ॥

সকল ঘর বিচারিয়া দেখি, টুলিয়ে দুয়ার।
সেইখানে বসিয়া আছে, বন্ধুয়া আমার ॥

আর বন্ধুয়া রে দেখিয়া আমার, চিত্ত ব্যাকুল।
হাসন রাজায় গায় গান বাজাইয়া ঢোল ॥

৬৪

বাত্তি জ্বালাইয়া দেখো শ্যাম, রাধার ঘরে করে কাম।
কেহই বলে রাধার কানু হাসন রাজায় বলে দিলারাম ॥

আন্ধাইর-গুন্ধাইর হুড় হুড় করে,
কেও রে নাহি সে যে ছাড়ে।
প্রেমের উতালা হয়ে, লাগাইছে ধুমধাম ॥

প্রেমের বাতি জ্বালাইয়া দেখো তারে নিরখিয়া।
হৃদমন্দিরে বিরাজ করে, হাসন রাজা ধরে নাম ॥

৬৫

বালা নাচিয়ে নাচিয়ে প্যারী যায় রে।
হাসন রাজার পানে চায় রে ॥

ঠমকাইয়া ঠমকাইয়া যায় ফিরিয়া ফিরিয়া ফিরি চায়
খেমটা তালে গান গায় রে ॥

পায়ের ঘুঙ্গুর বাজে, প্রাণ নিল গায়ের সাজে।
দেখিয়া মম মন মজে কি ধরাইব লাজে রে ॥

দেখিয়া প্যারীর তারাবারা হাসন রাজা হইল মারা।
সুন্দর দেখলে ভুলিয়া যায় হাসন রাজার ধারা রে ॥

৬৬

বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি।
সোনা মামি! সোনা মামি গো! আমারে করিলায় বদনামি ॥

আমি হইতে আল্লা রসুল, আমি হইতে কুল।
পাগলা হাসন রাজা বলে, তাতে নাই ভুল ॥

আমা হইতে আসমান জমিন, আমি হইতেই সব।
আমি হইতে ত্ৰিজগত, আমি হইতে রব ॥

আমি আউয়াল, আমি আখের, জাহের বাতিন।
না বুঝিয়া দেশের লোকে, বাসে মোরে ভিন ॥

আমা হইতে পয়দা হইছে, এই ত্ৰিজগত।
গউর করি চাইয়া দেখো হে, আমারও মতো ॥

আক্কল হইতে পয়দা হইল, মাবুদ আল্লার।
বিশ্বাসে করিল পয়দা, রসুলউল্লার ॥

মম আঁখি হইতে পয়দা, আসমান জমিন।
কর্ণ হইতে পয়দা হইছে, মুসলমানী দিন ॥

আর পয়দা করিল যে, শুনিবারে যত।
সবদ সাবদ আওয়াজ ইত্যাদি যে কত ॥

শরীরে করিল পয়দা, শক্ত আর নরম।
আর পয়দা করিয়াছে, ঠাণ্ডা আর গরম ॥

নাকে পয়দা করিয়াছে, খুসবয় আর বদবয়।
আমি হইতে সব উৎপত্তি, হাসন রাজা কয় ॥

মরণ জিয়ন নাই রে আমার, ভাবিয়া দেখো ভাই।
ঘর ভাঙিয়া ঘর বানানি, এই দেখতে পাই ॥

পাগলা হইয়া হাসন রাজা, কিসেতে কি কয়।
মরব মরব দেশের লোক, মোর কথা যদি লয় ॥

জিহ্বায় বানাইয়াছে, মিঠা আর তিতা।
জীবের মরণ নাই রে দেখো সর্বদাই জিতা ॥

আপন চিনিলে দেখো, খোদা চিনা যায়।
হাসন রাজায় আপন চিনিয়ে, এই গান গায় ॥

৬৭

মন চিনলায় না আপন, কোন দিন কোন সময় পরিবায় কাফন।
করলায় না, করলায় না তুমি আল্লার নাম জপন ॥

তনের মাঝে ছিল তোমার মূল মহাজন।
বেভুলে মজিয়া রইলে না করিলে দর্শন ॥

হইতে না পারিলে রে মন জমির ও রওশন।
দেখিতে না পাইলায় তুমি তনে কোন জন ॥

শোনো রে বলি আমি তোরে নির্বুদ্ধি হাসন।
চিনিয়া না ধরলে বন্ধুরে থাকিতে জীবন ॥

ধরতে নাহি পারবে তারে করিলে গমন।
শীঘ্র হাসন রাজা তার কারো অন্বেষণ ॥

গুষ্টি কুটুম লইয়া তোমায় করিবা কান্দন।
সবে মিলি গোর খুদিয়া করিবা দাফন ॥
তোমার মাঝে থাকিয়া আমি বলি রে বচন ॥

৬৮

মন তুমি কার ভাবে রে হইয়াছ পাগল।
যুক্তি করি পাগেলা মন, আমার কাছে বলো রে মন।
তুমি কার ভাবে রে ॥

কোথায় ছিলায় কোথায় আইলায় কোথায় তোমার ঘর।
কোনখানে থাকো তুমি জানো নি খবর রে ॥

নিতি হাসো নিতি খেলো নিতি আছ রঙে।
মরণকালে পাগেলা মন কে যাইব তোর সঙ্গে রে ॥

না যাইব মাও সঙ্গে না যাইব তিরি।
যখন আসি পাগলা মন যমে নিব ধরি।

হীন হাসন রাজায় কইন, বুঝিতে না পারি গো আল্লা
আমি কি বুঝিব গো আল্লা, তোমার কারিকরি ॥

৬৯

মনবাউল ও বাউল তোর মতি, তোর মতি।
লাঙ্গের সঙ্গে মন মজাইয়া, হারাইলায় নিজ পতি ॥

দেশে খেসে লোকে বলে, তুমি যে অসতি।
হাশরের বিচারের কালে, কি হইবে তোর গতি ॥

পতি সেবা না করিলায়, একি তোমার রীতি।
কুলটা জগতে হইলায়, ধরিয়া উপপতি ॥

লাঙ্গের সঙ্গ হইলে তোমার, হইবে দুর্গতি।
বুদ্ধি হারাইয়া তুমি হইয়াছ বেপথি ॥

হাসন রাজায় কান্দিয়া বলে, করি রামপাশার উন্নতি।
চিরকাল করিবায়নি, রামপাশা বসতি ॥

৭০

মন মনিয়া রে ও মোর মন মনিয়া।
কোনদিন যাইবায় মনিয়া, তুমি উড়িয়া রে ॥

তুমি তো হাওই মনিয়া, শূন্যে যাইবায় উড়িয়া।
আমি তো মাটির মনিয়া, মাটিতে রইমু পড়িয়া ॥
আমারে থুইয়া মনিয়া, যাইবায় কোন শহর।
আর না পাইবায় মনিয়া, আমার খবর ॥

মায়াদয়া নাই রে মনিয়া, তোমার অন্তরে।
কি বুকে ছাড়িয়া যাইবায়, আমি অভাগীরে ॥

তুমি যে ছাড়িয়া যাইবায়, এই ভাবনা ভাবিয়া ভাবিয়া
হাসন রাজা ফিরতে আছে, কান্দিয়া কান্দিয়া ॥
মন মনিয়ারে ও মোর মন মনিয়ারে ॥

৭১

মন যাইবায় রে ছাড়িয়া।
কেহ না পাইব তোমার সংসার ঢুরিয়া ॥

কিসের আশা, কিসের বাসা, কিসের সংসার।
মইলে পরে ভাবিয়া দেখো কিছু নয় তোমার ॥

কিসের আশয় কিসের বিষয়, কিসের জমিদারি।
কিসের হয় রামপাশা, কিসের লক্ষণছিরি ॥

ছাড়ো ছাড়ো হাসন রাজা এই ভবের আশা।
এই চিন্তা করো পাই তায় বন্ধের চরণতলে বাসা ॥

৭২

মরণ কথা স্মরণ হইল না হাসন রাজা,
তোর মরণ কথা স্মরণ হইল না ॥

যখনে মরিয়া যাইবায়, মাটিতে হইব বাসা।
তখনে কোথায় রইব রঙের রামপাশা ॥

হাড় খাইব হাড়য়া পোকে, মাড়ইল খাইব ঘুণে।
পুণ্য পন্থ না চিনিলায় যৌবনের গুমানে ॥

না রহিব ঘরবাড়ি না রহিব সংসার।
না রহিব লক্ষণছিরি নাম পরগণার ॥

কান্দিয়া হাসন রাজায় বলে, আল্লা করো সার।
কি ভাবিয়া নাচো হাসন শূন্যের মাঝার ॥

৭৩

মরণকালে রে, কে যাইবে তোর সঙ্গে।
তুমি তো ভুলিয়া আছ, স্ত্রী-পুত্রের রঙ্গে ॥

কিসে কি করো রে মন আঙ্গে আর ডাঙ্গে।
স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইব নি লাঙ্গে ॥

স্বামীর সেবা না করিলায়, দিন গেল গইয়া।
বেভুলে মজিয়া রইলায়, কার দিকে চাইয়া ॥

আমারে ভাসাইলায় গো আল্লা সুরমা নদীর গাঙ্গে।
ভাসিয়া ভাসিয়া হাসন রাজা, তোমার চরণ মাঙ্গে ॥

৭৪

মমিনা রে ভাই
আমি না লইলাম আল্লাজির নাম।
না কইলাম তার কাম
বৃথা কাজে হাসন রাজায় দিন গুয়াইলাম ॥

ভবের কাজে মত্ত হইয়া দিন গেল গইয়া।
আপন কার্য না করিলাম রহিলাম ভুলিয়া ॥

নাম লইব নাম লইব করিয়া আয়ু হইল শেষ।
এখনও না করিলাম প্রাণবন্ধের উদ্দেশ ॥

আশয় বিষয় পাইয়া হাসন তুমি করো জমিদারি
চিরকাল থাকিবে নি হাসন রাজা লক্ষণছিরি ॥

কান্দে কান্দে হাসন রাজা, কি হবে উপায়
হাশরের দিন যখন পুছিবে খোদায় ॥

ছাড়ো ছাড়ো হাসন রাজা, এই ভবের আশ।
কেবল এক মনে চিন্তা করো, হইতায় বন্ধের দাস ॥

৭৫

মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে,
কান্দে হাসন রাজার মন মনিয়া রে ॥

মায়ে বাপে বন্দি কইলা, খুশির মাঝারে।
লালে ধলায় বন্দি হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে।

উড়িয়া যায় রে ময়না পাখি, পিঞ্জিরায় হইল বন্দি।
মায়ে বাপে লাগাইলা, মায়াজালের আন্দি ॥

পিঞ্জিরায় সামাইয়া ময়নায় ছটফট করে।
মজবুদ পিঞ্জিরা ময়নায়, ভাঙিতে না পারে ॥

উড়িয়া যাইব শুয়া পক্ষী, পড়িয়া রইব কায়া।
কিসের দেশ কিসের খেশ, কিসের মায়াদয়া ॥

ময়নাকে পালিতে আছি দুধকলা দিয়া।
যাইবার কালে নিষ্ঠুর ময়নায় না চাইব ফিরিয়া ॥

হাসন রাজায় ডাকব তখন ময়না আয় রে আয়।
এমন নিষ্ঠুর ময়নায়, আর কি ফিরিয়া চায় ॥

৭৬

লাগল রে পিরিতের নিশা, হাসন রাজা হইল বেদিশা।
ছাড়িয়া দিব লক্ষণছিরি, আর রামপাশা ॥

ছাড়িয়া যাব আরিপরি, আর ছাড়িব লক্ষণছিরি।
বন্ধু কেবল মনে করি জঙ্গল করব বাসা ॥

হাসন রাজার এই মনে, থাকি সদা শ্রীচরণে।
অন্য কিছু চায় না প্রাণে, বলে হাসন রাজা দাসা ॥

৭৭

লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার।
কি ঘর বানাইব আমি শূন্যের মাঝার ॥

ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর।
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার ॥

এই ভাবিয়া হাসন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে।
কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে ॥

হাসন রাজায় বুঝতো যদি বাঁচব কত দিন।
দালানকোঠা বানাইত করিয়া রঙিন ॥

৭৮

লোকে বলে, লোকে বলে রে, হাসন রাজা তুমি কে?
আমি যে মাবুদের খেলা, বানাইয়াছে সে ॥

আমারে বানাইয়া মাবুদ, অন্তরেতে থাকে।
অন্তরে থাকিয়া আল্লা, সয়েয়াল সংসার দেখে ॥

আল্লা বিনে দুই নাই, আছে সব মিশে।
লোকে বলে, বলে রে, হাসন রাজা তুমি কে?
এক বিনে দুই নাই, হাসন রাজা হাসে।
আল্লা আমি দুই নই পাগল লোকে দোষে ॥

৭৯

রঙিলা বাড়ৈ এই ঘর বানাইয়াছে কলে।
রঙে রঙে ঘর বানাইয়া, বসি ঘরে খেলে ॥

মাটি দিয়া ঘর বানাইয়া, চামড়ার দিছে ছানি।
পত্তন করিয়াছে ঘর মূলধন তার পানি ॥

আর মণির চেরাগ দিছে টুল্লির নিচে দিয়া।
সর্বকার্য করে সে যে, সেই রওসনী দেখিয়া ॥

কত কোঠা বানাইয়াছে, দেখতে মনোহর।
সারি সারি কোঠা সব দেখিতে সুন্দর ॥

কোঠার মাঝে প্যাদা পাইক আছে সারি সারি।
কোঠায় কোঠায় বসাইয়াছে কত যে প্রহরী ॥

মলকুতে, মেকাইল দিছে, ঘুসে আজরাইল।
নাছুতে ইছরাফিল খাঁড়া, মুখে জব্রাইল ॥

ঘরখানি বানাইয়া ঘরে বসিয়া রঙ্গ চায়।
ছায়টি রিপু দিছে ঘরে কেমনে খেইড় খেলায় ॥

হাসন রাজায় বলে আমার, বাড়ৈর হাতে তালা।
ঘরের মাঝে বসিয়া কত রঙ্গে করে খেলা ॥

৮০

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।
আমার মাঝত বাহির হইয়া, দেখা দিল মোরে ॥

দেখা দিয়া প্রাণ লইয়া, সামাইল ভিতরে।
আদম সুরত দেখা দিল, ধরিয়া আমারে ॥

আয়নার মধ্যে যেমন, মুখ দেখা যায়।
সেই মতে আমার রূপে, দেখা দিল আমায় ॥

নুরের বদনখানি, জিনে কাঞ্চা সোনা।
আপনার রূপ দেখিয়া, আপনে হইলাম ফানা ॥

আপনার রূপ দেখিয়া, আপনে পাগল।
ত্রিভুবন জুড়িয়া রূপে, করে ঝলমল ॥

চন্দ্রসূর্য নাহি হয় রে, ঐ রূপের সমান।
সেই রূপ দেখিয়া আমার, বাঁচে না পরান ॥

দিলের চক্ষে দেখলাম রূপ, নয়ন ভরিয়া।
কুলুবে বসিল আমার, দিলাসাও দিয়া ॥

তুমি আমার, আমি তোমার প্রাণবন্ধে বলিয়া।
হৃদয়কমলে বন্ধু বসিলও গিয়া ॥

ভাবনাচিন্তা দূর হইল, বন্ধু কোলে লইয়া।
নাচে নাচে হাসন রাজায়, বন্ধুয়া রে পাইয়া ॥

৮১

সুন্দরী রাধে গো তোর, কানাইয়া যাইব ছাড়ি।
তাই ভাবিয়া হাসন রাজা, ফিরে বাড়ি বাড়ি ॥

কানাইয়া ছাড়িয়া গেলে, লোকে বলবে এড়ি।
কানাইয়ারে বান্ধিয়া রাখো, পায়ে দিয়া দড়ি ॥

মধুপুরে যাইব কানাই, আমার আছে জানা।
গেলে পরে না আসিব, হইবায় তুমি ফানা ॥

শীঘ্র করি বান্ধ রাধে, পায়ে দেও তার বেড়ি।
বান্ধবার লাগি হাসন রাজায়, করে লড়ালড়ি ॥

গেলে না আসিব আর, ফিরিয়া লক্ষণছিরি।
হাসন রাজায় কান্দন করে, যাইও না রে হরি

৮২

সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল।
দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল ॥
আরে না জানি কি মন্ত্র পড়িয়ে, যাদু করিল ॥

কিবা ক্ষেণে হইল আমার, তার সঙ্গে দেখা।
অংশীদার নাই রে তার সে তো হয় একা ॥

রূপের ঝলক দেখিয়ে তার, আমি হইলাম ফানা।
সে অবধি লাগল আমার, শ্যাম পিরিতের টানা ॥

হাসন রাজা হইল পাগল, লোকের হইল জানা।
নাচে নাচে ফালায় ফালায় আর গায় গানা ॥

মুখ চাইয়া হাসে আমার যত আরিপরি।
দেখিয়াছি বন্ধের রূপ ভুলিতে না পারি ॥

মন সন্দ যাই বলো তার লাগিয়া না ডরি।
লাজ-লজ্জা ছাড়িয়া বন্ধের থাকব চরণ ধরি ॥

দেওয়ানা হইয়া হাসন, কিসেতে কি বলে।
মারো কাটো যাই করো থাকব চরণতলে ॥

৮৩

সোনা বন্ধের লাগিয়া হাসন রাজা হইল ফানা।
রঙ্গে রঙ্গে গাইতে আছে কতই যে গানা ॥
প্রেমে মত্ত হাসন রাজা, হইল রে দেওয়ানা।
হাসন রাজায় মানে না তোর কটমুল্লার মানা ॥

নাচে নাচে হাসন রাজা, হাত দেয় রে তালি।
বন্ধের বাড়ির মানুষ পাইলে করে কোলাকুলি ॥

৮৪

সোনা বন্ধের লাগিয়া, হাসন রাজার প্রাণ গেল রে।
বন্ধু নাহি আইল রে, সোনা বন্ধের লাগি হাসন রাজার
প্রাণ গেল রে ॥

প্রাণ গেল প্রাণ গেল হইল একি দায়।
দিনে রাইতে হাসন রাজায় করে হায় হায় ॥

প্রেমানলে জ্বলিয়া মরি, বন্ধু নাহি আয়।
আমি যে জ্বলিয়া মরি ফিরিয়া না চায় ॥

কাকুতি করি রে বন্ধু দেখা দেও আমায়।
তোমার লাগিয়া এখনই আমার প্রাণ যায় ॥

হাসন রাজায় বলে বন্ধু করো তার উপায়।
প্রেমজ্বালা ঘুচাইয়া রাখো রাঙা পায় ॥

৮৫

সোনাদিদি, ঠাকুরদিদি গো, বন্ধের লাগিয়া কী মোর করে।
বাবরি ছাটা চুল দেখিয়া, মন তো জাতিয়া ধরে ॥

গোয়াইল ঘরের পিছে দিয়া, সদায় আসে যায়।
আমায় দেখলে কেন গো সে, ফিরিয়া ফিরিয়া চায় ॥

ঠমকাইয়া ঠমকাইয়া যায়, মুচকি হাসা হাসে।
অন্তরের সহিতে মোরে বড়ো ভালোবাসে ॥
রঙ্গ ঢঙ্গ দেখিয়া তাঁর, প্রাণ যায় ধরা।
হাসনজান তো হইয়াছে, হাসন রাজার মারা ॥

৮৬

হায় রে বন্ধু কালাচান্দ, তোমার লাগিয়া গেল প্রাণ রে।
হায় রে! তোমার লাগিয়া, গেল মোর জান রে ॥

তোমার মায়ায় মজিয়া, তোমার চরণ ভজিয়া।
গেল গেল কুলমান রে ॥

হইলাম তোমার কলঙ্কিনী, লোকের হইল জানাজানি।
আরে ঘরে ঘরে করে কানাকানি রে ॥

দেশে দেশে মুখ চাইয়া হাসে, কেহ নাহি ভালোবাসে।
লজ্জায় না যাই, তাদের পাশে রে ॥

চাই না আমি ভাই বন্ধু চাই না মসুলমান হিন্দু।
কেবল চাই তোমার চরণ রে ॥

হাসন রাজার মনের আশ, থাকতাম আমি তোমার পাশ।
চিরকালের হইতাম দাস রে ॥

৮৭

হাসন রাজা বাউলা, মনে সদায় রাখিও আল্লা।
আর কিছু মনে আসলে, পড়িও নওজবিল্লা ॥

দিলের মাঝে সর্বদাই, রাখিও ইল্লালাহ।
আর মনে রাখিও, এক আল্লা এক আল্লা ॥

হাসন রাজা বাউলা, মনে সদায় রাখিও আল্লা।
আর কিছু মনে আসলে, পড়িও নওজবিল্লা ॥

এই মত দিলে রাখলে, কোলে লইবা মৌলা।
আল্লার জাতে মিশিবায়, হাসন রাজা আউলা ॥

৮৮

হাসন রাজা ভাবিয়া দেখো মনে।
এ ভবে আসিলায় ওরে তুমি কেনে?
আরে সব কথা পাসরিলায়, আসিয়া এ ভুবনে ॥

কি করিতে কি করয়ে, আসিয়া এই স্থানে।
পূর্বকথা ভুলিয়াছ, মজিয়ে ভবের ধনে ॥

কি কার্যেতে আসিয়াছিলাম, কিবা কাজ করো।
লইতায় আছিল আল্লার নাম, বেভুল হইয়ে ফিরো ॥

হাসন রাজা ভুলিয়াছ, জমিদারি পাইয়া।
কোনদিন আসিয়া যমে তোরে, নিবে রে ধরিয়া ॥

৮৯

হাসন রাজা প্রেমানলে জ্বলে।
প্রাণপ্রেয়সী মোরে, তুলিয়া লও কোলে ॥

বাসনা করিয়া হার, গাঁথিয়াছি ফুলে।
কোলে লইলে হার পরাইব, তুই প্রেয়সীর গলে ॥

এই মনে করিয়ে হাসন রাজায় তাল বাজায়।
নাচিয়া নাচিয়া হাসন রাজায় প্রেমের গান গায় ॥

মনের সাধ পূর্ণ করো, কোলে লইয়া মোরে।
এই বলিয়া প্রেয়সীরে আঞ্জা করিয়া ধরে ॥

আঞ্জা করিয়া ধরিয়া বুকে বুক মিলাইয়া।
হাসন রাজা নামটি তার দিল মিটাইয়া ॥

হাসন রাজা মিটিয়া বলে আল্লাই আল্লা।
কিছু নাই কেবলই ইল্লাল্লা ইল্লাল্লা ॥

৯০

হাসন রাজা প্রেমের মানুষ, প্রেমের নাচন নাচন করে।
হরি বল মন, হরি বল মন, বিকিয়ে হরির প্রেমবাজারে ॥

হাসন রাজা বিকিয়ে আছে হরির নামে প্রেমবাজারে।
হরির নামে কীর্তন করিয়ে, সব বেড়ায় ঘুরে ঘুরে ॥

হাসন রাজা নিমন্ত্রণ করে, আইসো রে ভাই প্রেমবাজারে।
তুমি আমি সব মিলিয়ে প্রেম বিলাব ঘরে ঘরে ॥

হাসন রাজা যুক্তি করে, প্রেমিক চলো যাই নগরে।
অপ্রেমিক পাইলে পরে, ধরিয়ে আনব প্রেমবাজারে ॥

হাসন রাজায় নাচন করে, ধরিয়ে হরির শ্রীচরণে।
হরি বল মন হরি বল মন, হরির চরণ ছাড়ব না রে ॥

৯১

হাসন রাজা হইয়াছে বাউলা,
মাবুদ আল্লার লাগি হাসন রাজা যে আউলা।
হাসন রাজা হইয়াছে বাউলা ॥

হাসন রাজা পাগল হইয়া, ডাকে মৌলা মৌলা।
ডাক শুনিয়ে আসব মৌলা, হাসন রাজা চাইয়ে রইলা ॥

মৌলা আসিয়া হাসন রাজারে কোলে তুলিয়া লইলা।
কোলে থাকি লামাইমু না এই কথা বলিলা ॥

এই কথা বলতে হাসন রাজা, চাইয়ে, রইলা।
লাইল্লাহা ইলল্লাহু, বলিতে লাগিলা ॥

মাবুদ আল্লার লাগি হাসন রাজা যে আউলা।
হাসন রাজা হইয়াছে আল্লার লাগি বাউলা ॥

৯২

হাসন রাজায় কয়, আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়।
অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময় ॥

প্রেমেরই বাজারে হাসন রাজা হইয়াছে লয়।
তুমি বিনে হাসন রাজায় কিছু না দেখয় ॥

প্রেম জ্বালায় জ্বলি মইলাম আর নাহি সয়।
যে দিকে ফিরিয়ে চাই বন্ধু দেখি ময় ॥

তুমি আমি, আমি তুমি ছাড়িয়াছি ভয়।
উন্মাদ হইয়া হাসন নাচন করয় ॥

৯৩

হাসন রাজায় কয়, নমাজ রোজা ছাড়িয়া দিছি
বেহেস্তে যাইবার ভয়।
নমাজ রোজা করলে বেহেস্তে যাইবে রে নিশ্চয় ॥

পরের মন্দ ছাড়িয়াছি দোজখেরি ডরে।
বেহেস্তে দোজখ এরাফে প্রভু নিও না গো মোরে ॥

বন্ধু ছাড়িয়ে থাকব না গো, এই মনে কয়।
চরণ ধরিয়ে থাকি আমি এই মনে লয় ॥

বন্ধু ছাড়িয়ে থাকতে নারি প্রাণে নাহি সয়।
তিলেক মাত্র না দেখিলে মনপ্রাণ দয় ॥

নাচে নাচে হাসন রাজা দেখিয়ে জগত্ময়।
পুরাও আকাঙ্ক্ষা তব অঙ্গে করিয়ে লয় ॥

৯৪

হাসন রাজায় কান্দে কান্দে রে, আল্লাজির লাগিয়া।
স্বপনে দেখিলাম তাঁরে, না দেখি জাগিয়া ॥

চন্দ্র জিনি মুখখানি, ঝলমল ঝলমল করে।
দেখাইয়া নুরের বদন মন চুরি করে রে ॥

নিশিভাগে দেখিয়া গো রূপ, হইলাম উদাসী।
ভালোবাসি গেল গো প্রাণ, দেখিয়ে ভালোবাসি রে ॥

হেরিয়া সে চন্দ্রবদন, মন হইল চঞ্চল।
সদায় নয়নে দেখি, ইহার কিবা কল রে ॥

স্বপনে তো প্রাণনাথ এই কথা বলিল।
তোমায় আমি আমার তুমি, এ বাক্য বলিল ॥

মমতা করিয়া বন্ধে ভালোও বাসিল।
হৃদয়কমলে ভ্রমর উড়িয়া বসিল ॥

হাসন রাজায় কান্দে, ভ্রমর দেখা দেও আমারে।
ভ্রমর বলে পুষ্পে মোরে লেপটিয়া ধরে ॥

হাসন রাজায় নাচে এখন, নয় রে ভ্রমর ভিন।
পুষ্পে ভ্রমর মিশিয়া না রইয়াছে চিন ॥

৯৫

হাসন রাজায় কান্দে, হাসন রাজায় কান্দে রে,
এই তন ছাড়িয়া গেলে, কই নিব ঠাকুরচান্দে।
বেরা লাগিয়া মইলাম আমি এই ভাবের ফান্দে ॥

আর তন ছাড়িয়া মন যখন করি বে গমন।
ভবের লোকের শক্তি নাহি করিতে দমন ॥
এই ভবের মাঝে লোক, আছে লাখে লাখে।
কেহর নাহি সাধ্য আছে প্রাণরে বান্ধিয়া রাখে ॥

এই ভাবিয়া হাসন রাজা করেরে কান্দন।
না জানি কপালে মোর লিখছে নিরঞ্জন ॥

হাসন রাজায় বলে গো আল্লা এই আমার মনে।
হতভাগা হাসন রাজা থাকত তোর চরণে ॥

এই ভিক্ষা চাহে তোমার আশিক হাসনে।
করিম রহিম নাম তোমার দেখি যে কোরানে ॥

৯৬

হাসন রাজায় বলে, পরিচয় দে রে
মাটির তলে খেইড় খেলাছ তুই কে রে।
শীঘ্র করি উত্তর দে মূল বাটী তোর কই রে ॥

নাই আমার ঘরবাড়ি নাই রে আমার ঠাঁই।
যেখানে প্রেমিক থাকে, তাঁর কাছে দাঁড়াই রে ॥

যেখানেতে প্রেমিকেরা প্রেমের আলাপ করে।
আমি যে বসতি করি তাদের অন্তরে রে ॥

প্রেমিকের অন্তরেতে আমার নিবাস।
আমি তার সে আমার, থাকি তার পাশ রে ॥

মূল কথা বলিয়া দিলাম তোমারও ঠাঁই।
প্রেমিক ছাড়িয়ে আমি, কোনখানে না যাই রে ॥

হাসন রাজা বলে আমি তোমার প্রেমিক হইয়া।
হৃদয়েতে ঠাঁই দিয়াছি না যাইও ছাড়িয়া রে ॥

৯৭

হাসন রাজারে কয়দিন কয়দিন তোর আর বাকি।
এখনও নাচ তুমি লইয়ে সব সখি ॥

পুতের দাড়ি পাকিয়ে গেল নাতির উঠিল রেকি,
এখনও সংসারী কামে রহিলায় ঠেকি ॥

দিন গেল দিন গেল কেবল দেখি দেখি,
চিরকালই এই মতে কাল কাটাইবায় নাকি ॥

আনন্দ করিতে আছ করিয়াছি সুখি।
পাছে দিয়া নাহি চাও কি রাখিয়াছি লেখি ॥

পরমাত্মা জীবাত্মা সঙ্গে করে ডাকাডাকি।
পিছে দিয়া ফিরিয়া চাও না হইবায় দুঃখী ॥

হাসন রাজায় শুনিয়া বাক্য ফিরাইল আঁখি।
বন্ধের সনে মিলত গিয়া করে উঁকি বাকি ॥

৯৮

হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই।
কোথা থাকিয়া আসিয়াছি, কোথায় আসিয়া রই।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

তন ছাড়িয়া মন কোথায় শূন্যে যাবে উড়ি।
এই যে তোমার সোনার তন মাটিতে রইব পড়ি
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

মন যাইব শূন্যে উড়িয়া, তন রইব এথা।
কার সঙ্গে কহিবায় তুমি হাসি রসির কথা।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

কার সঙ্গে করিবায় তুমি রঙ্গ আর ঢঙ্গ।
আর নি ঘুমাইবায় তুমি উড়িয়া পালঙ্গ।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

এই দেশের আশ ছাড়ি করিবায় গমন।
ইষ্টিকুটুম কেউর সঙ্গে না হইব দরশন।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

একেলা যাইবায় তুমি না জানি কোন্ ঠাঁই।
সেই সময়ে আল্লা বিনে গতি কেউ নাই।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

ভবের মায়া ছাড়ো হাসন আল্লা আল্লা করো সার।
আল্লা বিনে তোমার সঙ্গী কেউ নাই আর।
হাসন রাজা রে মইলে বসতি হবে কই ॥

৯৯

হেরিয়ে হরি মুররীধারী, গৃহে রইতে নারি রে।
ভুলি ভুলি করি মনে ভুলিতে না পারি রে ॥

ময় গো গেয়া কদমতলা, দেখা বাঁকা চিকনকালা।
গলেতে ফুলের মালা, মুখে মধুর হাসি রে ॥

কপালে চন্দন মাখা আর শ্যামের নয়ন বাঁকা।
হেরিয়ে প্রাণ না যায় রাখা প্রাণ নিল হরি রে ॥

হাতে বংশী মাথে পাখা, জুলফওছে কান আছে ঢাকা।
মম প্রাণ নিয়ে সখা, কৈল উদাসিনী রে ॥

আরে রে রঙিলা শ্যাম শ্রীকৃষ্ণ যে ধরো নাম।
হাসন রাজা রূপে তোর হইল পাগলিনী রে ॥

১০০

হে মা করুণাময়ী কৃপা করো মুই অধমে রে।
কাকুতি মিনতি করি ডাকি মা তোমারে ॥

ঘিরিয়াছে মায়াজালে এখনি মারিবে কালে।
তুলিয়া লও গো ও মা কোলে তব সন্তানেরে ॥

পড়িয়ে মা বিষম বিপাকে হাসন রাজায় তোমায় ডাকে।
ত্বরা করি করো রক্ষে মা ওগো আমারে ॥

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *