হাসনোহনা

হাসনোহনা

বছর বারো পূর্বে ভারতীয় একখানা জাহাজ সুয়েজের কাছাকাছি লোহিত সাগরে আগুন লেগে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। কাপ্তেন সারেঙ মাঝিমাল্লা বেবাক লোক মারা যায়। আশপাশের জাহাজ মাত্র একটি অর্ধদগ্ধ জীবন্ত খালাসিকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। তাকে সুয়েজ বন্দরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবরের কাগজে মাত্র কয়েক লাইনে সমস্ত বিবরণটা প্রকাশিত হয়, এবং সর্বশেষে লেখা ছিল, সেই অর্ধদগ্ধ খালাসিটি কাতরকণ্ঠে জল চাইছে কিন্তু বার বার জল এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও জল খাচ্ছে না।

অলস কৌতূহলে আমি আর পাঁচজনের মতো খবরটি পড়ি। কিন্তু হঠাৎ মগজের ভিতর ক্লিক্ ক্লিক করে কতকগুলি এলোপাতাড়ি ফেলে-দেওয়া টুকরো টুকরো তথ্য একজোট হয়ে কেমন যেন একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলল।

প্রথমত, সুয়েজ বন্দরের কাছে-পিঠে আমি আমার প্রথম যৌবনের একটি বছর কাটিয়েছিলুম। সেখানে জল-কে মা-ই বলা হয়; যদিও খাঁটি আরবিতে জলকে মা-আ বলা হয়। দ্বিতীয়ত ভারতীয় জাহাজের খালাসি পুব বাঙলার মুসলমান হওয়ারই কথা। এবং পুব বাঙলায়, বিশেষ করে সিলেট মৈমনসিং অঞ্চলে মা-কে মা-ই বলে।

অতএব খুব সম্ভব ওই অর্ধ-দগ্ধ খালাসি বেচারি আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে কাতরকণ্ঠে আপন মাতাকে স্মরণ করে বার বার যে মা-ই মা-ই বলছিল তখন সে সুয়েজের আরবিতে জল চাইছিল না। তাই জল দেওয়া সত্ত্বেও সে সে-জল প্রত্যাখ্যান করছিল।

অর্থাৎ একই শব্দ একই ধ্বনি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ধরতে পারে।

তাই একটি শব্দ নিয়ে আমি হালে অনেক চিন্তা করেছি।

 হাসুনোহানা। রাজশেখরবাবু এইভাবেই বানান করেছেন। কিন্তু বানান নিয়ে আমার মাথাব্যথা নয়। শিরঃপীড়া শিকড়ে। অর্থাৎ শব্দটার রূট কী? ব্যুৎপত্তি কী?

রাজশেখর বলছেন, জিাপানি।=পদ্মফুল) সাদা সুগন্ধ ছোট ফুল বিঃ (অশুদ্ধ কিন্তু সুপ্রচলিত)।

সুবল মিত্র বলছেন, জাপানি। একরকম ছোট সুগন্ধি ফুল।

বাঙলায় আর যে দু-খানা উত্তম অভিধান আছে তার প্রথম, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ এবং দ্বিতীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙলা ভাষার অভিধান। উভয় অভিধানেই শব্দটি নেই। এটা কিছু বিচিত্র নয়। পঞ্চাশ-ষাট বছর মাত্র হল শব্দটা লেখাতে ঢুকেছে- আমার যতদূর জানা।

শুনেছি, বাঙলা থেকে সংস্কৃতাগত শব্দ বাদ দিলে শতকরা ষাটটি শব্দ আরবি ফারসি কিংবা তুর্কি। ডজন দুত্তিন পর্তুগিজ এবং শ-কয়েক ইংরেজি। ফরাসি ইত্যাদি নগণ্য। জাপানি আর কোনও শব্দ বাঙলাতে আছে বলে জানিনে। আমরা শান্তিনিকেতনের লোক কিমোনো— জাপানি আলখাল্লা শব্দটা ব্যবহার করি, কিন্তু সেটি কোনও অভিধানে ঢুকেছে বলে জানিনে, সাহিত্যে তো নয়ই। কিমোনো পরিহিত সত্যপ্রকাশ ও রবীন্দ্রনাথের ছবি রবীন্দ্ররচনাবলীতে পাওয়া যায়।

তাই প্রশ্ন, হঠাৎ দুম্ করে একটা জাপানি শব্দ বাঙলায় ঢুকল কী করে? তবে কি জাপান থেকে এসেছে হাসনোহানা ফুল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা চিত্রকর বিনোদ মুখুজ্যে, নন্দলালের নন্দন বিশ্বরূপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জাপান দেখে এসেছেন। অন্ধ্রের বীরভদ্র রাও, মালাবারের হরিহরণ। এরা সবাই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র। তাই এদের চিনি। এঁরা সবাই অজ্ঞতাবে মাথা নেড়ে বলেন হাসনোহনা ফুল জাপানে নেই- অর্থাৎ আমরা এদেশে যেটাকে হাসনোহনা বলে চিনি এবং শব্দটার ব্যুৎপত্তি জাপানি এ সম্বন্ধে সকলেই গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেন। তার অন্যতম কারণ এরা সকলেই বাঙলা জানেন– বীরভদ্র হরিহরণ শান্তিনিকেতনে নন্দলালের সাহচর্যে অত্যুত্তম বাঙলা শিখেছেন এবং জাপানি আর কোনও শব্দ হুট করে বাঙলায় ঢুকে গিয়ে থাকলে তারা এ প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

কলকাতার উর্দুভাষী, তথা বাঙলা এবং উর্দু দোভাষীরা বলেন, হুসন্-ই-হিনা। হুসন শব্দটি আরবি, অর্থ সৌন্দর্য, খুবসুরতি যার থেকে আমাদের মহরমের হাসন হোসেন জিগির শ্লোগান শব্দদ্বয় এসেছে। হিনা শব্দ বাঙলায় হেনা। রবীন্দ্রনাথের গান আছে হেনা, হেনার মঞ্জরি। হেনা শব্দের অর্থ মেহদি। হাসনোহানার পাতা অনেকটা মেহদিপাতার মতো। তা হলে দাঁড়াল এই– হেনার সৌন্দর্য। অর্থাৎ সুন্দরতম হেনা। অর্থাৎ হেনা par excellence। কিন্তু জিনিসটা তো আর হেনা নয়।

উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু বিহার, উত্তরপ্রদেশ লক্ষ্ণৌ-দিল্লি, আজমির-বরদা সর্বত্রই এ ফুলটি ডাকা হয় রাতকি রানি নাম ধরে। গুজরাতে অবশ্য রাত-নি রানি ধরে। অর্থ, রাতের রানি। হস-ই-হিনা সমাস এরা চেনেন না। দিল্লিতে আপনি হাসনোহনার আতর কিনতে পাবেন। কিন্তু চাইবার সময় বলতে হবে, রাতকি রানির আতর। হাসনোহনা বা হুস-ই-হিনা বললে চলবে না। খাস হেনার আতর আলাদা।

কাবুল কান্দাহার ব্রিজ তেহরানে এ ফুল নেই। ত্রিশ বছর পূর্বে ছিল না একথা আমি বুক ঠুকে বলতে পারি। হেনা অর্থাৎ মেহদিপাতা অবশ্য আছে। এই ইরানের কবিরা ভারতের মেহদির প্রচুর গুণ-গান গেয়েছেন। যথা

পরিপূর্ণতা পাবে তুমি কোথা
ইরান দেশের ভূঁয়ে,
মেহদির পাতা কড়া লাল হয়
ভারতের ভূঁই ছুঁয়ে।
নিস্ত দরু ইরান, জমিন সমান-ই
তহসিল-ই কামিল
তা নিয়ামি সেই হিন্দোস্তান
হিনা রঙিন ন শুদ্।(১)

 হাসনোহনা গাছ ইরান-তুরানে নেই কিন্তু শব্দটা তো অভিধানে থাকতে পারে যেমন আকাশ কুসুম কিংবা অশ্ব-ডিম্ব ত্রিভুবনে নেই বটে (যদিও তার অনুসন্ধান চলে, যেমন পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শোপেনহাওয়ার দর্শনচর্চার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, অমাবস্যার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্ব অরে অনুসন্ধান) তবু অভিধানে শব্দগুলো পাওয়া যায়। হাতের কাছে রয়েছে স্টাইনগাস্ সাহেবের অত্যুকৃষ্ট –এমনকি সর্বোকৃষ্ট বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না– অভিধান। আর রয়েছে ক্যাথলিক পাদ্রি হাভা সাহেবের আরবি কোষ, বেইরুৎ থেকে প্রকাশিত। এই ফারসি আরবি কোনও কোষেই হুসনু-ই-হিনা নেই। হুসন ও হিনার মাঝখানে যে ই আছে এটি খাঁটি ফারসি। কাজেই এই সমাসটি আরবি অভিধানে থাকার কথা নয়। তবু, যেহেতু আরবরা ইরান বিজয়ের পর বহু ফারসি শব্দ আপন ভাষায় গ্রহণ করে, তাই ভাবলুম, হয়তো শব্দটা থাকতেও পারে। বিশেষ করে ফুলের মামেলা যখন রয়েছে। কারণ ল ফারসিতে ফুল।

আপ (সংস্কৃত অপ) ফারসিতে জল। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি গোলাপ ফুল। আসলে কিন্তু গোলাপ (শুলাপ) অর্থ রোজওয়াটার। আরবিতে গ এবং প ধ্বনি নেই বলে গোলাপ হয়ে গেল জুলাব। গোলাপ জল বিরেচক। তাই বাঙলাতে জোলাপ গোলাপ দুটি সমাসই প্রবেশ করেছে।

তা সে যাই হোক, আরবরা যখন গুল নিয়েছে তখন হাসনোহানা নিতে আপত্তি কী?

 কিন্তু আরবি অভিধান নীরব। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় উর্দু অভিধানও শব্দটির উল্লেখ করে না। উত্তর প্রদেশের উর্দুভাষীরা হাসনোহানাকে রাতকি রানি বলেন বলুন, কিন্তু কোষকার কলকাতায় প্রচলিত হুসন-ই-হিনা তার অভিধানে দিলে ভালো করতেন।

তাই আমার সমস্যা:

১, হয় শব্দটা জাপানি থেকে এসেছে।

২. নয়, এটি কলকাতার উর্দুভাষীদের নিরবদ্য অবদান।

পাঠক ভাববেন না আমি রাজশেখরের ভুল দেখাবার জন্য এ আলোচনা তুলেছি। রাজশেখর শত ভুল করলেও তার অভিধান চলন্তিকাশতায়ু-সহস্ৰায়ু। চলন্তিকা চলে এবং চলবে।

আমার নিবেদন, বাঙলা দেশে এখন গোটা চারেক বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলোতে বাঙলা ভাষা পুরো সম্মান পাচ্ছে। বাঙলায় আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ নিয়ে পয়লারি গবেষণা হওয়া উচিত।

ইতোমধ্যে কোনও পাঠক-পাঠিকা যদি বিষয়টির উপর আলোকপাত করেন তবে বড় উপকৃত হই।(২)

————

১. উর্দুতে হেনা নিয়ে অজস্র দোহা কবিতা আছে। হেনা বলছে

পিস্ গয়ি তো পিস্ গয়া,
ঘুঁ হো গয়া তো হো গয়া
নাম তো বর্গে হিনাকা।
দুলহিনোঁ মে হো গয়া

‘আমায় পিষে ফেললে তো ফেললে, আমি রক্তাক্ত হয়ে গেলুম তো গেলুম। কিন্তু কনেদের ভিতর তো মেহদি পাতার নাম রাষ্ট্র হল। ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান কনেদের মেহদি দিয়ে হাত রাঙা করতে হয়। আরেক কবি বলেছেন, হেনার পাতার উপর হৃদয়-বেদনা লিখি; হয়তো পাতাটি একদিন প্রিয়ার হাতে পৌঁছবে।‘

হাসনোহানা যখন দেশে বেরোয় তখন এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায় একাধিক পত্র আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বাড়ির লোক আমার লেখার কাটিং রাখে, আলোচনার রাখে না। যতদূর মনে পড়ছে, একাধিক লেখক আগ্রাণ চেষ্টা দেন, আমাকে বোঝাবার জন্য; হাসনোহনা ও হেনা ভিন্ন। আমার রচনাটি একটু মন দিয়ে পড়লে আমি যে দুটোতে ঘুলিয়ে ফেলিনি সেটা পরিষ্কার হবে। হেনা-par excelance এস্থলে ওই দুটি ফরাসি শব্দ বোঝায় যে par excellance রূপে যে বস্তু ধারণ করে, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্র ও বর্ণের হতে পারে। একটি মহিলা সুদূর দ্রৈাবাদ থেকে হেনা ও হাসনোহনার পাতা আলাদা করে, নিশ্চয়ই অনেকখানি কষ্ট স্বীকার করে পাঠান। তাকে ধন্যবাদ। দুটি গাছই আমার বাগানে আছে … অন্য একজন লেখেন, সুনীতিবাবু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, হাসনোহনা জাপানি শব্দ। সুনীতিবাবু দৃঢ় না ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন সেটা গুরুত্বব্যঞ্জক নয়, গুরুত্ব ধরত যদি পত্রলেখক সুনীতিবাবুর যুক্তিগুলোর উল্লেখ করতেন। কারণ আমার এক সহকর্মী হিন্দি ও উর্দু বাদে তার আপন কর্মক্ষেত্রে, সুনীতিবাবুরই মতো যশস্বী পণ্ডিত (নাম বলে কাউকে বুলি কার কী দরকার!) দৃঢ়তর কণ্ঠে বলেন, সমাসটা ফারসি এদেশে নির্মিত।… তবে এস্থলে বিশ্বকোষের শ্রীযুত পূর্ণ মুখুয্যে আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি লেখেন যে, যে সময়ে এদেশে হাসনোহনা ফুল বিদেশ থেকে আসে তখন জাপানিরা কলকাতার বাজারে হাসনোহনা নাম দিয়ে একটি সুগন্ধি পদার্থ (সেন্ট) ছাড়ে। তার চিঠির ভাবার্থ এই ছিল। তাই আমার মনে হয়, সেই সেন্টের নাম নিয়ে ওই সময় আগত বিদেশি ফুলকে হাসনোহনা নাম দেওয়া হয়। এটা অসম্ভব নয়। প্রাগুক্ত উর্দু পণ্ডিত সেটা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, তিনি ছেলেবেলা থেকেই হুসন-ই-হিনা শুনেছেন। ওই সেন্ট কলকাতা আগমনের বহু পূর্ব থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *