হালুম হুলুম – সুনীল জানা
এক বাঘের দুই বাচ্চা। একজনের নাম হালুম আর একজনের নাম হুলুম। হালুম পাঁচ মিনিটের বড়ো, আর হুলুম ঠিক সাত মিনিটের ছোটো। হিসেবে কোনো ভুল নেই। সিঙ্গিমামা নিজেই ওদের জন্মের সময়টা হিসেব করে দিয়েছে। সিঙ্গিমামা একবার ঘড়িপরা একটা আস্ত মানুষ খেয়ে ফেলেছিল কিনা, সেই থেকে সে ঠিক-ঠিক সময় বলে দিতে পারে।
পাঁচ-সাত মিনিটের ছোটো-বড়ো হলে কী হবে, দু-জনের মধ্যে ভারি ভাব কিন্তু! হালুমের হাঁচি পেলে হুলুমেরও তক্ষুনি হাঁচি পায়। হুলুমের পেট কামড়ালে হালুমেরও অমনি পেট কামড়াতে থাকে। হালুম মনের আনন্দে গান গায় তো হুলুম ফুর্তির চোটে নাচ জুড়ে দেয়। আর খিদে পাবার বেলায়? তখন তো কোনো কথাই নেই। দু-ভাই মিলে খাই-খাই করতেই আছে সব সময়। হালুম বলে, কী খাই—কী খাই? তো হুলুম বলে, হাতি-ঘোড়া যা পাই। ওদের খাওয়াতে-খাওয়াতে বাঘ শেষকালে ফতুর হয়ে গিয়ে ওদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিলে।
হালুম হুলুম মহা-আনন্দে মামার বাড়ি এসে হাজির।
মামার বাড়ি ঢুকতে-না-ঢুকতেই হালুম চেঁচাতে লাগল, ‘ও মামা গো, খুব খিদে পেয়েছে।’ হুলুমও সমানে চেঁচাতে লাগল, ‘ও মামি গো, আগে খেতে দাও।’
সিঙ্গিমামা-সিঙ্গিমামি তো ভাগনেদের দেখে খুব আদর-টাদর করল, পেটভরে কত কী খেতে দিল। খাওয়া-দাওয়ার পর আরামে গল্পগুজব করতে লাগল। ওমা—গল্প করতে-করতে একটু বাদেই আবার খিদে পেয়ে গেল হালুমের। দেখতে-দেখতে হুলুমেরও।
হালুম বলে, ‘আবার যে একটু একটু খিদে পাচ্ছে, মামা।’
হুলুম বলে, ‘আবার যে জোর খিদে পাচ্ছে, মামি।’
ব্যাস, গল্প করা অমনি মাথায় উঠল। সিঙ্গিমামা বনে দৌড়োল শিকার ধরতে। বাড়িতে আর কিচ্ছুটি নেই। সিঙ্গিমামি একথা-সেকথা বলে ততক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করল ওদের। কিন্তু অত সহজে ভোলার পাত্র নয় ওরা। মিনিটে-মিনিটে ওরা চেঁচাতে লাগল, ‘ও মামি গো—মামা কোথায় গেল? ও মামি গো, খিদের চোটে যে মরে গেলাম।’
শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল সিঙ্গিমামির। ভাগনেদের খিদের বায়না মেটাতে মেটাতে দু-দিনেই মামা-মামির অবস্থা কাহিল। সিঙ্গিমামি একদিন চুপিচুপি সিঙ্গিমামাকে বলল, ‘চলো, এ-বন ছেড়ে পালাই। নইলে আমাদেরও খেয়ে সাবাড় করবে।’
সিঙ্গিমামা বলল, ‘ঘাবড়াও কেন? ওদের আমি ঠাণ্ডা করছি। ওরাও যেমন ভাগনে, আমিও তেমনি মামা।’
তারপর সিঙ্গিমামা ভাগনেদের ডেকে বলল, ‘ওরে হালুম, ওরে হুলুম, তোদের নিন্দের চোটে বনে আর কান পাতা যায় না যে রে।’
হালুম বলল, ‘কেন, মামা?’
হুলুম বলল, ‘কী হয়েছে মামা?’
সিঙ্গিমামা কেশে-টেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘বাঘের বাচ্চা তোরা, দেখতে-দেখতে এই এত বড়োটা হলি, অথচ আজ অব্দি একটা মানুষ মারতে পারলি না? লজ্জায় কাউকে যে আর মুখ দেখাতে পারছি না। মানুষ না মারলে যে তোদের অন্নপ্রাশনই হবে না।’
ওহো, এই কথা! হালুম হুলুম অমনি লাফিয়ে ওঠল, ‘ঠিক আছে মামা। বাঘের বাচ্চা কাকে বলে, আজ দেখিয়ে দেব সবাইকে, মানুষ মেরে আজ অন্নপ্রাশন করবই করব।’
এই না বলে লেজ পাকিয়ে থাবা বাগিয়ে হালুম হুলুম মানুষ শিকার করতে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু মানুষ কাকে বলে? সে আবার কোন ধরনের জানোয়ার? জন্ম থেকে একটাও যে মানুষ দেখেনি তারা।
হালুম জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষগুলো কীরকম দেখতে মামা?’
সিঙ্গিমামা মুখ বেঁকিয়ে বললে, ‘ভারি বিচ্ছিরি দেখতে মানুষগুলো। কেমন লম্বা লম্বা লিকলিকে চেহারা, গায়ে একটুও লোম নেই, পেছনের পা দুটো টেনে-টেনে হাঁটে, আর সামনের পা দুটো সঙের মতো দু-পাশে ঝুলিয়ে রাখে। দেখলে তোদের ভক্তি হবে না। কিন্তু খেতে যা চমৎকার—কী বলব! একবার কামড়ে ধরলে আর ছাড়তেই ইচ্ছে করে না! ওঃ—সেই যে কবে একবার মানুষ খেয়েছিলাম—’
বলতে বলতে সিঙ্গিমামা বারবার ঠোঁট চাটতে লাগল। তাই দেখে লোভের চোটে হালুম হুলুমের জিভ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে আর কী!
হুলুম জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষগুলো কোথায় পাওয়া যায় মামা?’
সিঙ্গিমামা বললে, ‘এই বন পেরিয়ে সোজা চলে যা যেদিকে দু-চোখ যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ দেখতে পাবি। কিন্তু খুব সাবধানে যাস বাপু। ভারি হিংসুটে হয় মানুষগুলো।’
হালুম হুলুম লেজ ফুলিয়ে বলে উঠল, ‘বাঘের বাচ্চা আমরা। মানুষ তো আমাদের কাছে নস্যি!’
এই না বলে আনন্দে লাফাতে-লাফাতে হালুম হুলুম চলল মানুষ শিকার করতে। কী ফুর্তি তখন দুজনের ফুর্তির চোটে খিদে পাওয়ার কথা কারুর মনেই ছিল না। লাফাতে-লাফাতে একসময় তারা বনের একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছোল।
হালুম বলল, ‘এবার আমি ডান দিকে যাই।’
হুলুম বলল, ‘এবার আমি বাঁ-দিকে যাই।’
তখন হালুম চলল ডান দিকে। হুলুম চলল বাঁ-দিকে। আলাদা-আলাদা শিকার ধরবে দু-জনে।
হালুম বেচারা তারপর ডানদিকে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। যাওয়ার আর শেষ নেই। যেতে যেতে অনেক মাঠঘাট পেরিয়ে বনবাদাড় পেরিয়ে সকাল দুপুর সন্ধ্যে পেরিয়ে শেষকালে এক গ্রামে এসে পৌঁছোল। তখন একেবারে মাঝরাত্তির। সবাই তখন দিব্য নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে যে যার বাড়িতে। হালুম আর মানুষ পাবে কোথায়? খিদের চোটে এদিকে বেচারার পেট চুঁই-চুঁই করছে। মানুষ খুঁজতে-খুঁজতে হালুম একসময় এক গেরস্থের বেগুন-খেতের কাছে এসে হাজির।
এদিকে গেরস্থ করেছিল কী, কাক তাড়ানোর জন্যে একটা কাকতাড়ুয়ার মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে রেখেছিল বেগুন-খেতের মধ্যে। খড় দিয়ে বাঁধা লম্বা লম্বা হাত-পায়ের ওপর একটা ঢোলা জামা পরানো, মাথার দিকে একটা কালো হাঁড়ি উপুড় করে চুন দিয়ে তার ওপর চোখ-মুখ আঁকা। অবিকল মানুষের মতো। তাই দেখে দেখে হালুম তো আহ্লাদে আটখানা। এতক্ষণে একটা মানুষ পাওয়া গেছে। মামার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। খিদের মুখে গোটা মানুষটাকে চিবিয়ে এক্ষুনি অন্নপ্রাশন করে ফেলবে সে।
এই না ভেবে পেছন থেকে গুটি-সুটি মেরে এগোতে এগোতে হালুম করল কী, লেজ বাঁকিয়ে থাবা বাগিয়ে সোজা মারল এক তিড়িং লাফ। ক্যাঁক করে কামড়ে ধরল মানুষটার এক পায়ে। ইসস—ওয়াক-থু-থু! কীসব গজগজ করছে তার মুখের মধ্যে। তাড়াতাড়ি পা ছেড়ে দিয়ে প্রাণপণে থুতু ফেলতে লাগল হালুম। মুখটা তার বিচ্ছিরি বিস্বাদ হয়ে গেছে একেবারে। রেগেমেগে মেজাজ খারাপ করে হালুম তখন আর একটা পা কামড়ে ধরল। ওমা—সেই একইরকম যে, কোনো রসকষ কিচ্ছুটি নেই। দুর দুর, এমন অখাদ্য হয় নাকি মানুষগুলো? কিন্তু সিঙ্গিমামা যে বলেছিল এত করে? ভেবেচিন্তে হালুম তখন মাথা লক্ষ করে মারল আর এক তিড়িং লাফ। অমনি হল কী, হালুমের মাথার জোর ধাক্কা লেগে কাকতাড়ুয়ার মাথার কালো হাঁড়িটা ফটাস করে ফেটে ছড়িয়ে পড়ল চারধারে।
ব্যস, আর যায় কোথা! মানুষ খাওয়া তো হালুমের মাথায় ওঠল। কোত্থেকে কীসে যে কী হয়ে গেল কে জানে! কিছুই তার মাথায় ঢুকল না। বিলকুল ঘাবড়ে গিয়ে হালুম তক্ষুনি এক লাফে পগার পার। ভয়ের চোটে কোনদিকে যে চোঁচা দৌড় মারল, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
এদিকে হুলুমও বাঁদিকে যেতে যেতে এদিক পেরিয়ে ওদিক পেরিয়ে সেদিক পেরিয়ে মাঝরাত্তিরে এক শহরের কাছে এসে হাজির। যেখানে এসে পৌঁছোল, সেখানে এক বড়োলোকের বিরাট বাগানবাড়ি। হুলুম অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল। এ আবার কোথায় এলাম রে বাবা! যাহোক, বাড়ির চারপাশের বাগানে অনেক গাছপালা দেখে হুলুম তো সাহস করে ঢুকল ভেতরে। ঢুকে গাছের আড়ালে আবডালে এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করতে লাগল। এখন তাড়াতাড়ি একটা মানুষ জোগাড় করা দরকার। কোথায় যে থাকে হতচ্ছাড়া মানুষগুলো! খিদের চোটে এদিকে যে পেটে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে সব।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গায় হুলুমের চোখ আটকে গেল। ওই তো একটা মানুষ না? হ্যাঁ, ঠিক—মামার বর্ণনার সঙ্গে কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাচ্ছে একেবারে। ওই যে ওখানে লম্বা মতন একটা দেখা যাচ্ছে। ব্যস, অমনি হুলুমকে আর পায় কে! খিদের জ্বালায় হুলুমের আর তর সইল না। মানুষটাকে যেই না দেখা, সঙ্গেসঙ্গে পাগলের মতো ছুটে গেল হুলুম। গিয়ে একটা মোক্ষম কামড় বসিয়ে দিল মানুষটার পায়ে।
আর দেখতে হল না! বাগানের সেই মানুষটা তো আসলে মানুষ নয়, পাথরের পরীর মূর্তি একটা। কিন্তু হুলুম অতশত বুঝবে কী করে? খিদের মুখে যেই না হুলুম কামড় মেরেছে তার পায়ে, অমনি তার কচি-কচি দাঁতগুলো একেবারে মট মট মটাস—আর কী! আর ভাঙা দাঁত দিয়ে গলগল করে সে কী রক্ত! বাবা রে—মামা রে—হালুম রে—গেলুম রে—বলতে বলতে হুলুমের তো মূর্ছা যাবার জোগাড়। কিন্তু মূর্ছা গেলে চলবে কেন? কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে তো। দাঁতের যন্ত্রণা ভুলে হুলুম তখন আর পালাবার পথ পায় না।
পরের দিন ভোরবেলা হালুম হুলুমের আবার দেখা হল সেই বনের ধারে। কিন্তু কেউ কাউকে তখন আর চিনতেই পারে না। কাকতাডুয়ার হাড়ি ভেঙে ভুসো কালি লেগেছে হালুমের মুখ জুড়ে। আর হুলুমের সারা মুখ তো রক্তে মাখামাখি। বাঘের বাচ্চা বলে আর তাদের চেনার জো নেই।
দু-জনেই অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দু-জনের দিকে।
হালুম বললে, ‘তুই কে রে?’
হুলুমও বললে, ‘তুই কে রে?’
হালুম বলে, ‘আমি হালুম।’
হুলুমও বললে, ‘আমি হুলুম।’
তারপর দুজনে দুজনের গলা জড়াজড়ি করে সে কী কান্না! কাঁদতে কাঁদতে হালুম হুলুম যে সেখান থেকে কোথায় চলে গেল, কে জানে! তবে সিঙ্গিমামার বাড়িতে আর তারা ফিরে যায়নি।