হালুইকর ও জোগাড়ে
আমি মনে করি সংসারের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করা উচিত। স্ত্রী নিশ্চয় ক্রীতদাসী নয়। সারাদিন ফাইফরমাশ খেটে মরার জন্যে সেই ভালোমানুষের মেয়েটিকে সংসারে আনা হয়নি। পঞ্চাশ বছর আগে বাঙালি পরিবারে যা হত সেটাকে আদর্শ করে বসে থাকলে চলবে না। এতে প্রাচীন পন্থীরা রেগে গেলে আমার কিছু করার নেই। সংসারে স্বামী-স্ত্রী হল টু কমরেডস। আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা রচিব গো ধরণীতে।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই আমার প্রথম কাজ হল গ্যাস জ্বেলে কেটলিতে জল চাপানো; তারপর মুখটুকু ধুয়ে জলসিক্ত ঠান্ডা হাতটা স্ত্রীর গলার কাছে রাখা। সে অমনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। আমি দাঁত বের করে হাসতে থাকি। ইংরেজিতে বলে, ‘অলওয়েজ ওয়্যার এ স্মাইলিং ফেস।’ সকালের সূর্য ও সকালের হাসিমুখ জীবনের ভার হালকা করে দেয়। এরপর আমি একটু ছেলেমানুষি করি। ছেলেমানুষ স্বামীকে মৃত্যুর পর স্ত্রীরা অনেক দিন মনে রাখে। সে বাথরুম ঢোকামাত্র বাইরে থেকে বাথরুমের দরজার ছিটকিনিটা আটকে দি। দিয়ে চিৎকার করতে থাকি, বন্দি, বন্দি। সে দরজায় দুমদাম ধাক্কা মারতে থাকে। পাড়ার লোক চমকে চমকে ওঠে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘মরনিং শোজ দি ডে’। সকালটা মজা করে শুরু করি যাতে সারাটা দিন মজায় কাটে। এরপর আমি নেমে পড়ি গৃহকর্মে। প্রথামতো সেই ঠোঁঠে সিগারেট, হাতে ব্যাগ, বাজার কাম মরনিং ওয়াক কাম ফাঁকিবাজি নয়। ও তো সব স্বামীই করে। হালুইকরের জোগাড়ের মতো রান্নাঘরে আমার তৎপরতা শুরু হয়। যেমন প্রেশার কুকারে ভাত চাপিয়ে আমার স্ত্রী স্নানে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, ‘একটা সিটি মারলেই নামিয়ে একপাশে রেখে দেবে। তারপর দুধের প্যাকেট দুটো খুলে গ্যাসে চাপিয়ে দেবে। গরম হয়ে গেলে, নামিয়ে চাপা দিয়ে, আর একটা জায়গায় গোটাচারেক আলু সেদ্ধ করতে হবে।’
নারী জাতির সঙ্গে জল আর সাবানের যেমন প্রীতি, পুরুষজাতির সঙ্গে সেইরকম সকালের সংবাদপত্রের। সকালে সময় খুব কম; ফলে, বিলিতি নিয়মে একই সঙ্গে দু-তিনটে কাজ চালাতে হয়। আধুনিক গৃহবিন্যাসে, বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, রান্না ঘর, বাথরুম সব পাশাপাশি। একটি চতুষ্কোণে মাপজোক করে বসানো। কাগজে ত্রিপুরা, মেঘালয়; গ্যাসে প্রেশার কুকার। কখন প্রেশার কুকার রকবাজ বখাটের মতো স্ত্রীজাতির উদ্দেশ্য প্রথম সিটিটি মারবে, আমার আর সে খেয়াল থাকে না। কাগজের মুখরোচক রাজনৈতিক মেনু আমার মন কেড়ে নেয়। ওদিকে সিটির পর সিটি শুনে, শ্যামসুন্দরের বাঁশির ডাকে বিগলিত রাধিকার মতো আমার সুন্দরী সিক্ত বসনে বাথরুম থেকে তেড়ে বেরিয়ে আসে। রাধিকে ছুটতেন যমুনার দিকে, ‘আর বাঁশি বাজায়োনা শ্যাম’ বলে। আমার স্ত্রী লেডি টারজান কিমি কাতকারের মতো রান্নাঘরের দিকে ছোটে এই বলতে-বলতে—’যা:, সর্বনাশ হয়ে গেল। এই লোকটাকে দিয়ে যদি কোনও একটা কাজ হয়, ভগবান।’ তখন আমিও ছুটে যাই কাগজ ফেলে। বেড়ালের মিউমিউ স্বরে বলতে থাকি, ‘ক’টা সিটি মারল গো। ক’টা সিটি মারল!’
‘গলে পাঁক হয়ে গেল। কোন জগতে ছিলে?’
পাঁক নয়। কি যে হল, বোঝা যায় আহারে বসে। পুরো একটা চাকা মতো বরফি বেরিয়ে এল। রাইস কেক। উলবোনার কাঁটা দিয়ে ফুটোফুটো করে ডাল ঢোকাতে হল। সেও তো এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা। এই তো জীবন। তারপর একদিন মাছ কুটেছিলুম। ডিসেকসানে সামান্য ভুলচুক হওয়ায় সেই মাছ হয়ে গেল করলা। টু ইন ওয়ান, মাছও হল সুকতোও হল। রান্নায় নতুন দিগন্ত খুলে গেল। রুটি আর লুচি আজীবন সবাই গোলই দেখে এসেছেন, আমিও আমার প্রতিভায় তার গঠনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আকৃতি আনতুম। কোনওটা অ্যামিবার মতো, কোনওটা একটোপ্লাজম, প্রাোটোপ্লাজমের মতো। আমার জীবনসঙ্গিনী বলতেন, ‘সাহায্য করতে এসে কেন আমার কাজ বাড়াচ্ছ। কুচুটে মনের লোকেরা দুটো জিনিস কিছুতেই পারবে না, সরলরেখা টানতে আর গোল করে রুটি আর লুচি বেলতে।’ আমি হাসতুম। মর্ডান আট সম্পর্কে মহিলার কোনও জ্ঞানই নেই। আধুনিক গান, আধুনিক শিল্প হল ফ্রিস্টাইল ব্যাপার। আমি একবার সরষে বেটে সাহায্য করতে চেয়েছিলুম। সেই প্রথম আর সেই শেষ। মনে হচ্ছিল, অফিস টাইমে শেয়ালদা স্টেশানের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওপর নোড়া চালাচ্ছি। যত চাপ দি ততই হাত গড়িয়ে যায়। নোড়া স্লিপ করে যায়। সরষে নয় তো অসংখ্য বলবেয়ারিং। শেষে আরও শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে নোড়া হড়কে শিলের ওপর কুপোকাত। টেনে তুলতে তুলতে আমার স্ত্রী বলেছিল, ‘গায়ের জোরে পেষা যায় না, নরম করে, সোহাগ করে পিষতে হয়।’ এরপর ‘তোমাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি’ বলে সামনে হাজির হলেই, সে ভয় পেয়ে যেত ‘না, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।’
আমার সেই রান্নাঘর আছে। গ্যাস আছে। প্রেশার কুকার আছে। বাথরুমটিও আছে। নেই সেই ভেতরে বন্ধ করে রাখার মানুষটি। মহাকাল হালুইকরটিকে নিয়ে চলে গেছে। জোগাড়ে এখন আর কাকে জোগাড় দেবে।