হালচাল
প্রত্যাশা কাকে বলে?
আমার জন্যে কেউ কিছু করবে। নেতাকে ভোট দিয়ে গদিতে বসালুম। নেতা এমন একটা কিছু করবেন, যাতে আমার ছেলে শিক্ষা পায়। বেঁচে থাকার মতো একটা জীবিকা পায়। আমার পরিবারের মাথার ওপর নীল আকাশ নয়, সর্ব ঋতুর উপযোগী একটা ছাদের ব্যবস্থা হয়। যাক, নেতার কাজ নেতা করলেন না। নেতাদের না-হয় এইটাই স্বভাব—কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি। কিন্তু আমার সহোদর। তিনি কী করলেন? কোর্টে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিলেন। ভালোই করলেন। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘আরে, এইটাই তো জগতের নিয়ম, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। তুমি শোনোনি বুঝি, আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বন ভালো।’ তা সে না-হয় হল। দুজনেই উকিলের পকেট ভরাই। ভায়ে-ভায়ে কাজিয়া করে, উকিল দালান গড়ে। কিন্তু আমার বউ কী করলে! স্বামীর সেবা চুলোয় দিয়ে, চুল ছেঁটে, ঠোঁটে লিপস্টিক মেরে নারী জাতির বন্ধন উন্মোচনে লেগে গেল। আমার জামায় তিনটে বোতাম নেই। এক গেলাস জল চেয়ে পাই না। সকালের চা দোকানে গিয়ে খেতে হয়। সামান্য অসুখেও সেবা করার ভয়ে নার্সিং হোমে পাঠাতে চায়। জ্ঞানী বললেন, ‘তাই না কি! তুমি তো তাহলে জাতে উঠলে, হাই সোসাইটিতে এই রকমই হয়। সেবাধর্ম এখন নীচের তলার নীচু জাতের ব্যাপার। তা ভালো, হাই যখন হয়েছি তখন বোতলে-গেলাসে এক করে আরও হাই হয়ে যাই। তা আমার ছেলে কী করলে। কোথা থেকে এক পরী জুটিয়ে বুড়ো বাপকে ফেলে উড়ে চলে গেল। জ্ঞানী বললেন, তাই নাকি? তাহলে তো আরও ভালো হল। তুমি তো সায়েব হয়ে গেলে। সায়েবদের দেশে এই রকমই হয়। বাপ-মাকে ফেলে ছেলেরা বউ নিয়ে পালায়। কী আনন্দ!
কই, আনন্দ তো হচ্ছে না। হতাশায় মন ভরে যাচ্ছে। জ্ঞানী বললেন, তাই নাকি? হতাশা আসছে। তাহলে একটা সাধনা করো—কোনও প্রত্যাশা আর রেখো না। প্রত্যাশা থেকেই হতাশা আসে। এসেছ একলা, যাবে একলা। থাকবে একলা, ভাববে একলা।
নো প্রবলেম।
প্রতিশ্রুতি কাকে বলে?
যে কথা কেউ কোনও দিন রাখে না। নির্বিচারে একে তাকে কথা দিয়ে যাও, আশা দিয়ে যাও; কিন্তু বাস্তবে তা কোনও দিন পালন কোরো না। যা বলবে, কদাচ তা করবে না; তাহলেই প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রাখা হবে। মাকে বললুম, ‘মা, এবারের শীতে তোমাকে একটা নরম কম্বল কিনে দেব। যেমন হালকা তেমন গরম। সারারাত একটানা তুমি গায়ে রাখতে পারবে না। মাঝে-মাঝে গা থেকে একবার করে সরিয়ে দিতে হবে, নয় তো ফোস্কা পড়ে যাবে। বিলিতি কম্বল। দুধের মতো সাদা। ধবধবে। তুমি ওই একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকো আমার ভালো লাগে না।
সেই প্রতিশ্রুত কম্বল সত্যিই কি আমি কিনেছিলুম।
না। আমি বউয়ের জন্যে জর্জেট কিনেছি। নেকলেস কিনেছি। কিনেছি বিদেশি কসমেটিকস। নিজের জন্যে তৈরি করিয়েছি তিন প্রস্ত শুট। আমার পয়সার অভাব ছিল না। তবু কিনিনি; কারণ, কথা দিয়ে কথা রাখলে সে আর কথা থাকে না, হয়ে যায় কাজ। কাজে আর কথায় যোজন-প্রমাণ ব্যবধান রাখতে হয়। কথা হল আত্মিক, অনেক উঁচু স্তরের, কাজ হল কায়িক, অনেক নীচু স্তরের। কথামতো কাজ করলে কথা খেলো হয়ে যায়। মুরগিতে আর তন্দুরে যা তফাত।
কম্বলের কথা ভাবতে- ভাবতে কাঁথা গায়ে দিয়েই মা আমার আরও তিনটে বছর পার করে দিলেন। তাঁর সমবয়সি যাঁরাই আসেন সকলকেই বড় মুখ করে বলতে থাকেন, ছেলে আমাকে একটা সাদা সায়েবি কম্বল এনে দেবে। সে না-কি সারারাত গায়ে রাখা যায় না। মাঝে-মাঝে খুলে গা জুড়োতে হয়। মা বলেন, আমি শুনি। ভীষণ ভালো লাগে। যাঁরা শ্রোতা, তাঁদের চোখেমুখে বিস্ময়। কল্পনায় কম্বল তৈরি হচ্ছে। বাস্তবে এমন কম্বল আছে কিনা আমার জানা নেই। এইভাবেই একদিন মা আমার চলে গেলেন। তাঁর সাততালি মারা কাঁথাটি পড়ে রইল এই পৃথিবীতে; যে পৃথিবীতে, যে পৃথিবীর একটিই মাত্র সত্য—এই আছি রে বাপ, এই নেই।
মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। এ আমি কী করলুম! জ্ঞানী বললেন, ‘ধুর বোকা, নিজের জীবনের দিকে তাকাও। তোমাকে যে যা কথা দিয়েছিল, তা কি রেখেছে? আমি বসে গেলুম নিজের হিসাব মেলাতে। অবাক হয়ে গেলুম, কেউ কথা রাখেনি। সেই ছেলেবেলা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কেউ কথা দিয়ে কথা রাখেনি। সামান্য প্রতিশ্রুতি তাও কারোর পক্ষে রাখা সম্ভব হয়নি। আমার মামার কুকুর ছিল অনেক রকম। বলেছিলুম, ‘আমাকে একটা বাচ্চা দেবেন?’ বলেছিলেন, ‘পুষবি? নিশ্চয় দেব। এক-একবার সাত-আটটা বাচ্চা হয়। এ আর এমন কী?’ বছরের পর বছর গেল। বাচ্চার পর বাচ্চা হল। আমাকে কিন্তু একটাও দিলেন না। যাঁদের দিলে তাঁর ব্যাবসার সুবিধে হবে, তাঁদেরই দিলেন। মহাদেবদা বলেছিলেন, ‘তোকে কুড়িখানা ঘুড়ি কিনে দেব। আনন্দে সে রাতে ঘুম হল না। সারারাত কল্পনায় নানা রঙের কুড়িখানা ঘুড়ির কল খাটালুম। মহাদেবদা রোজই ফিরে আসেন খালি হাতে। এক-একদিন এক-এক রকম গল্প ফাঁদেন। ঘুড়ি নিয়ে বাসে উঠেছিলেন। মানুষের চাপে সব ছিঁড়ে গেল। সব-সব মিথ্যে কথা। সেই ছেলেবেলাতেই আমি মিথ্যে কথার আর একটা নাম দিয়েছিলুম, মহাদেবদা। কেউ মিথ্যে কথা বললে, বলতুম, মহাদেবদা বলছে। আমার মনে খুব ধাক্কা লেগেছিল। প্রাণের বন্ধু বিলেত গিয়েছিল। বলেছিল, আসার সময় আমার জন্যে একটা কলম আনবে। ফিরে এল আমার জন্যে একগাদা বড়-বড় বিদেশের গল্প নিয়ে। কলমের কথা আর তুললেই না। কলেজের সহপাঠিনী বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অচল হয়ে যাবে। সে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি সচল আছে। আমার এক সরকারি বন্ধু বলেছিল, নেকস্ট টাইম তোকে একটা ফ্ল্যাট পাইয়ে দেব। সেই নেকস্ট টাইম আর এ জীবনে এল না। একজন বলেছিলেন, আমার মেয়ে বি. এ. পাশ করলেই তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। এমনও বললেন, ”তোমার মেয়েটিকে দেখে রেখে গেলুম।”চোখের সামনেই দেখলুম, ছেলেটির অন্য জায়গায় বিয়ে দিলেন। আমাকে হাসিমুখে নিমন্ত্রণ করে গেলেন। কোনও কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। বৃষ্টি পড়ছে। বন্ধু বললেন, ফোনে, বসে থাকো। আমি ফেরার পথে তোমাকে লিফট দেব। আমি আমার অফিসে বসেই আছি। বসেই আছি। সাতটা বাজল, আটটা বাজল। সবাই চলে গেল। বাইরে দুর্যোগ বাড়তেই লাগল ক্রমশ। শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে যখন পথে এসে নামলুম, চারপাশ অন্ধকার। ঝোড়ো বাতাস। তিরের ফলার মতো ছুটল বৃষ্টির খোঁচা। কোনও যানবাহন নেই। জনপ্রাণী নেই। যখন আর সবাই বেরিয়ে গেল, তখন আমিও বেরোতে পারতুম। বেরোলে এই অসহায় অবস্থা হত না। আধমরা অবস্থায় প্রায় মাঝরাতে প্রাণ হাতে করে বাড়ি ফিরে এলুম।
ফেরার পথে বন্ধুর বাড়িতে হাঁক মারলুম, বৃষ্টিভেজা শীতের কাঁপা-কাঁপা গলায়। কে একজন বিরক্তি মেশানো গলায় বললে, ‘মাতালটা আবার কে। সে এখুনি ঘুমোল।’
এখন কেউ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলে, আমি চোখের সামনে দেখতে পাই ঝোড়ো, কালো, সূচের মতো বৃষ্টি। পিচকালো নির্জন পথ আর দিশাহারা একটি মানুষ। জ্ঞানী বললেন, ‘নিজেকে ছাড়া আর কারোকে বিশ্বাস কোরো না।’
।। বুলেটিন এক ।।
আবার ধেড়িয়েছে, স্যার?
এবার কী গেল?
আবার সেই জল। পাইপ মাইপ ফেটে, জলের বারোটা বেজে গেছে। কল যেন ছুনু করছে। এইভাবে চললে স্যার ইলেকসানেও বারোটা বেজে যাবে। মানুষ আর কত সহ্য করবে। আলো নেই। শহরটা হয়ে গেছে চাঁদের পিঠের মতো। সেদিন ঘূর্ণি ঝড়ে সাফোকেসানে কজন পটল তুলেছে কে জানে! পাতালের গর্ভ থেকে স্তম্ভের মতো ধুলো উড়ে, কি সিন, যেন টেকসাস ছবি। মিষ্টির দোকানে রসগোল্লার রং পালটে গেল। প্লেটে একজোড়া ফেললে মনে হচ্ছে, ব্লাডপ্রেসারের রুগির ছানাবড়া চোখ। ফিসফিস করে বলছে, হাত বাড়ালেই মেরে লাশ ফেলে দেব।
বাজে বোকো না, বাজে বোকো না। ধুলো মানে কী? শুকনো মাটি। মনে নেই কবি বলছেন, যে মানুষ আছে মাটির কাছাকাছি, তারি লাগি। তারি লাগি কী? বলো না?
কী স্যার?
তোমার মাথা। মানুষ মাটির কাছে যাচ্ছে না বলেই, মাটিকে আমরা মানুষের কাছে আনতে চাই। সেই গানটা মনে আছে, মাখি সর্ব অঙ্গে ভক্ত পদধূলি, স্কন্ধে লয়ে চির বৈরাগ্যের ঝুলি। তারপর কী?
কী স্যার? আমি একটা গানই জানি, মুক্তির মন্দির সোপান তলে, ধাম্পু ধাম্পু।
ধাম্পু, ধাম্পুটা কী জিনিস?
ওটা মিউজিক স্যার। এখন ডিসকোর যুগ চলেছে। ডিসকো প্যান্ট, ডিসকো জামা, ডিসকো লাইট, ডিসকো নাইট, ডিসকো পলিটিকস।
ডিসকো পলিটিকস কী?
এই যা হচ্ছে, স্যার। জ্বলছে, নিবছে, জ্বলছে, নিবছে। খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, বন্ধ হচ্ছে, খুলছে। যাকে বলে চকাচম।
কোথা থেকে এই সব ভাষা শিখছ?
রক থেকে।
হ্যাঁ, কী বলছিলে? জল নেই? নেই তো কী হয়েছে? সারা জীবন সব কিছু থাকতে হবে? মামার বাড়ি না কি? ঠিক মতো জনসংযোগের কাজ হলে মানুষ কখনই বিগড়োবে না, বিগড়োতে পারে না। নাও, একটা স্টেটমেন্ট ছাড়ো, লেখো, জলের অপকারিতা।
হ্যাডিং স্যার?
হ্যাডিং নয়, হেডিং জলের অপকারিতা। বাঙালির সর্দিকাশির ধাত। আমার মা-বোনেরা টনসিলে বড় ভোগেন। টনসিলের কাশি শুকনো কাশি, রসকসহীন, খ্যানখেনে। মেয়েরা কাশলে ছেলেরা বড় অসন্তুষ্ট হয়। বিচানায় শুয়ে নববধূ যদি খ্যাঁক-খ্যাঁক করে শেয়ালের মতো কাশতে থাকে, তাহলে স্বামী বেচারার কী অবস্থা হয়! প্রেমে সব সহ্য হয়, কাশি সহ্য হয় না। মাথায় খুন চেপে যায়। পাশের ঘরে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির বিরাগভাজন হতে হয়। ননদরা বিরক্ত হয়। বিরক্ত হলে কী হয়। দুপুরবেলা স্বামীর অবর্তমানে ধোলাইয়ের ব্যবস্থা হয়। বাঙালি শিক্ষিত, শান্তিপ্রিয়, প্রেমিক জাত হলেও রেগে গেলে জ্ঞান থাকে না। জ্ঞান না থাকলে কী হয়? অজ্ঞান শিশুর মতো আঁচড়ায় কামড়ায়। আঁচড়ালে কামড়ালে মায়েরও জ্ঞান থাকে না, শিশুকে দু-এক ঘা লাগায়। শ্বশুর, শাশুড়ি আর ননদে ধোলালে বধূমাতাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। প্রতিরোধে প্রতিরোধ বাড়ে। বাঙালির সংসার শান্তির সংসার। ধূপ, ধুনো, গঙ্গাজল, জপের মালা, সত্যনারায়ণ, কথামৃত, মন্দির গমন, তা হলেও, পরের মেয়ে এসে বোলচাল মারলে প্রেস্টিজে লাগে। শ্বশুরও তো বাপ, শাশুড়িও তো মা। বাপকে ‘বাপরে বাপ’ বললে কোন ভদ্রসন্তান সহ্য করবে! প্রেমে ভেড়া জন্মায় না। প্রেমে মানুষের আত্ম-দর্শন হয়। শ্রীকৃষ্ণ গরু চরাতেন, শয়ে-শয়ে গোপিনীর সঙ্গে প্রেম করতেন, কিন্তু গরু ছিলেন না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সুদর্শন চালিয়ে কচাকচ কৌরব মেরেছিলেন। শ্রীচৈতন্য প্রেমিক ছিলেন, কিন্তু কী তেজ? ডিসকো দিওয়ানা হয়ে নবদ্বীপের পথে-পথে ঘুরতেন না। তিনি সেই প্রেম বিতরণ করতেন, যে প্রেমে মানুষ জগৎ ভোলে। যে প্রেমের উদয় হলে, মানুষের আলো-আঁধারের জ্ঞান থাকে না, ব্যান্ডেলে কী হল, সাঁওতালডিতে কী হল, টিটাগড়ে কী হল বলে বাজে মাথা ঘামায় না। পলিটিক্যাল জগাইমাধাইরা হ্যান্ডবল ছুঁড়লে, সমালোচনা করে না। বরং বলে, মেরেছে কলসির কানা তা বলে কি ভোট দেব না। তা সেই প্রেমিক স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি খামচানো বউকে কী করবে? পুজো করবে? আজ্ঞে না। বাঙালি ভোটের ব্যাপারে, নেতাদের ব্যাপারে উদার হলেও, কেশো কোনও বউয়ের ব্যাপারে উদার হতে পারে না। রাষ্ট্রভাষায় বলে, জরু আর গরু, তার মানে দুটোকেই পেটানো যায়। টু আর ইজ হিউমান, টু ফরগিভ ডিভাইন। সেটা আমাদের বেলায়। তার মানে উদ্ধত বউয়ের বেলায় নয়। পেটাইয়ের দলে স্বামীও নাম লেখাতে পারে এবং কম্বল ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। শুধু তাই নয়, আরও খেপে গেলে আগুনে সেঁকতেও পারে। পরে ‘সরি’ বলে বলেই আবার ভদ্রসমাজে স্থান পায়। এক টনসিল থেকে এত কাণ্ড! টনসিল হয় বাথরুমে ঢুকে স্ত্রী হস্তির মতো জল নিয়ে মাতামাতি করলে। রাজস্থানে জলাভাব। ফলে, মেয়েদের টনসিল নেই। ফলে কাশি নেই। ফলে, দাম্পত্যজীবন সুখের। ফলে, স্ত্রী-হত্যার নজির কম। ডির্ভোস কেসও নেই। জলাভাব শাপে বর। জলে বাত, জলে হাজা, জলে শ্যাওলা, স্লিপ, দুম, ফ্র্যাকচার। জল পানীয়। আরে, বোকা, বিয়ারও তো পানীয়। বিয়ার খাও, ভুঁড়ি বাড়াও।
।। বুলেটিন দুই ।।
আবার জল। ও অন্ধকার ফন্দকার কিছু যায় আসে না। মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। জলাভ্যাস এক বদ অভ্যাস। পি এ?
বলুন, স্যার?
দারজিলিং-এ কি কেলোর কীর্তি হয়েছে, দেখেছ তা কাগজে। নো ওয়াটার। সব শুকিয়ে গেছে। অ্যান্টিওয়াটার ক্যাম্পেন, অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ক্যাম্পেনের মতো জোরদার করতে হবে। নাও লেখো—স্লোগান নম্বর এক—বোম নয় জল নয়। জলও নয় বোমও নয়। ওঁ শান্তি। ওঁ শান্তি!
জলে জনডিস হয়। পরিশ্রুত জল একটা বড় রকমের ধাপ্পা। বন্ধুগণ, ধাক্কা খেও না। মানুষের মত যেমন পরিষ্কার করা যায় না, জলও তেমনি পরিষ্কার করা যায় না। জল হল সেকসের প্রতীক। কামে যেমন সব শুদ্ধভাব দ্রব হয়ে যায়, জলেও তাই। লক্ষ লক্ষ অদৃশ্য ব্যাকটিরিয়া হিলিহিলি, কিলিকিলি, বিলিবিলি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পি এ?
বলুন, স্যার?
একটা করে মাইক্রসকোপ ফ্রি সকলকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? এক ফোঁটা করে জল তলায় ধরবে আর ভয়ে আঁতকে-আঁতকে উঠবে।
রাজকোষে অত অর্থ নেই, মালিক। ভাঁড়ে মা ভবানী তাহাতে আপনি। তা ছাড়া শরৎচন্দ্র বলে গেছেন, তৃষ্ণার সময় এক অঞ্জলি ভালো জল না পেলে, মানুষ নর্দমার জল তুলে পান করে।
সেটা জল নয় গোবেট! সেকস সেকস। উপমা বোঝ না। পলিটিকস করে করে গাধা হয়ে গেছ!
এই তো বললেন, জল হল সেকস, সেকস হল জল।
আরে বোকা, আমি বলব কেন? পলিটিস্যানদের কথা আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না। ধাপ্পা মেরে মেরে এমন ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে! কহতব্য নয়। ও কথা আমার নয়, মনস্তত্ববিদের। জলের স্বপ্ন ক-এ আকার ম। যাক বাজে কথা থাক। জনসাধারণকে এতকাল হাইকোর্ট দেখিয়েছি, এইবার একটু ট্রেনিং দেওয়া দরকার। লেখো, জলের ব্যবহার-বিধি।
কম জলে স্নান-পদ্ধতি : এই পদ্ধতি আমাকে শিখিয়েছেন একজন ন্যাভাল অফিসার। সাবান না-মাখাই ভালো। কারণ সাবানের ফেলা ধুতে বেশি জল লাগে। বাঙালির আর সে ত্বক নেই। পেটে ঘি, তেল, দুধ, ছানা না ঢুকলে তেলা চেহারা হবে কী করে! সাবানে গায়ে খড়ি ফোটে। তবু যদি মাখতে হয়, বাড়তি জলের দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। তবে নৌবাহিনীর অফিসারের পদ্ধতিতে স্নান করা যেতে পারে।
প্রয়োজন ছোট এক বালতি জল। একটি মাঝারি মাপের প্ল্যাস্টিকের মগ। একটি ডিশওয়াশিং ক্লথ বা পুঁচকে তোয়ালে। যেকোনও সাবান একখণ্ড। একটি বড় মাপের গামলা।
পদ্ধতি : গামলায় থেবড়ে বসুন। সাবধান, গামলা যেন পেছনে আটকে না যায়। কেনার সময় এক সাইজ বড় কেনাই ভালো। সাবধানের মার নেই। মারের সাবধান নেই। এক মগ জল মাথার ব্রহ্মতালুতে ঢালুন। টাক থাকলে, কেয়া বাত! না থাকলে বড় চুল কদম ছাঁট করুন। বড় চুলে বেশি জল টানে। মায়েরা সব ‘মোক্ষদাপিসী’ কাটে চুল ছাঁটুন। যস্মিন দেশে যদাচার:। এইবার ‘ডিশওয়াশিং ক্লথ’ জলে ভিজিয়ে, তাইতে সাবান মাখান। গায়ে নয়। অত:পর সেই সাবানচর্চিত কাপড়ের টুকরোটি গায়ে ঘষুন। ঘর্ষনান্তে, গায়ে কয়েক মগ জল ঢেলে, গামলা থেকে উঠে পড়ুন। গামলার সঞ্চিত জল বালতিতে ফিরিয়ে দিন, পরবর্তী ব্যবহারের জন্যে। এই পদ্ধতির নাম, স্বল্প জলে পৌন:পুনিক স্নান। স্নান না-করা স্বাস্থ্যের পক্ষে আরও ভালো। ঘামের সঙ্গে এক রকম ইয়ে বেরোয়। কি বেরোয় পিএ?
নুন, স্যার।
তোমার মাথা, আর একটি কি বেরোয় যেন। আমি একটা ফরেন ম্যাগাজিনে পড়েছিলুম। যাক গে, মরুক গে! যার ঘাম, সেই মাথা ঘামাক। নাও, লেখো। ঘামের সেই ইয়ে ত্বকের ওপর একটা ব্যাপার করে, একটা আবরণ তৈরি করে, যাকে বলে প্রাোটেকসান, তার একটু আকর্ষণীয় গন্ধ হয়, যাকে বলে গন্ধগোকুল। ফুলের গন্ধ আছে, গন্ধ আছে মাটির, বনস্পতির, আলোচালের, বাঘের, বনতুলসীর। মানুষের কেন থাকবে না। ফ্লেভরওয়ালা চায়ের কী কদর! মানুষ বোঝে চরিত্রের ফ্লেভার। চরিত্র এক অদৃশ্য বস্তু, সাপের পাঁচপা, ডুমুরের ফুলের মতো, স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতো। আমরা বুঝি দেহ, আমরা দেখি দেহ। সেই দেহ গন্ধময় রূপময় হোক।
বাসন ধোয়ার পদ্ধতি : ছোট পরিবার হলে একটি। বড় পরিবার হলে দুটি কুকুর পুষুন। তাদের আধপেটা খেতে দিন। এঁটো বাসন পড়লে চেন খুলে ছেড়ে দিন। দেখুন, কেমন চেটেপুটে পরিষ্কার করে দেয়। একবার এসে বাসনগুলো কেবল উলটে দিয়ে যান। কুকুরের হাত নেই। সাংঘাতিক জিভ আছে। স্টিলউলের বাবা। লালায় আছে ডিটারজেন্ট। এই পদ্ধতিতে গেরস্থের কাজের লোকের খরচ বাঁচবে। সেই পয়সার শাড়ি কেনা যাবে। সারা মাস ফুচকা খাওয়া যাবে। খেচাখেচি কমবে। বাসনে টোল পড়বে না, আঁচড় পড়বে না। ঘেন্না? ঘেন্নার কি আছে! কুকুরকে চুমু খাওয়া যায়, তাকে বাসন চাটতে দেওয়া যায় না!
পানীয় : সকালে প্রকৃতি ঠান্ডা থাকে। সেই সময় খামোকা জল খাবার মানে হয় না। অনেকে ঊষাপান করেন। আমাদের জীবনে ঊষা আবার কী। কোনও ভদ্রলোকের সাতটার আগে বিছানা থেকে ওঠা উচিত নয়। বেলার দিকে খুব তেষ্টা পেলে এক গেলাস খাওয়া যেতে পারে। তবে সাবধান, জলবিয়োগ করা চলবে না। চেপে বসে থাকো কুম্ভক করে। নো লস, টোটাল গেন।
স্যার ইউরেমিয়া হয়ে যাবে।
মরুকগে, যার হবে তার হবে, তোমার আমার কী।
।। বুলেটিন তিন ।।
আমাদের সমস্ত সমস্যার একটা লিস্টি তৈরি করেছ?
করেছি, স্যার।
অনুগ্রহ করে পড়ে ফ্যালো।
এক, আলো। দুই, জল। তিন, যানবাহন। চার, পথঘাট। পাঁচ, পথ-দুর্ঘটনা। ছয়, ল অ্যান্ড অর্ডার। সাত, প্রশাসনিক শৈথিল্য। আট, ইনটেলিজেনস গ্যাপ। নয়, দলগত সংঘর্ষ। দশ, উলটপালটা স্টেটমেন্ট।
ব্যস, ব্যস। আর না, আর না। সমস্যার সিকসটি ফোর কোর্স লাঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছ। অত খাবে কে! আলো নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। ওটি ঈশ্বরের দান। তিনি বলেছিলেন, লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট। এখন তিনিই আবার বলেছেন, লেট দেয়ার বি ডার্কনেস অ্যান্ড দেয়ার ইজ ডার্কনেস। ঈশ্বরের এলাকায় আমি অনধিকার প্রবেশ করতে চাই না। জলের ব্যাপারে আমি সব জলবৎ তরলং করে দিয়েছি। আমি এখন পথ আর যানবাহন সমস্যাকে একটু প্রাঞ্জল করতে চাই। নাও, লেখো :
বাঙালি এতকাল সমতল ভূমিতে হেঁটে হেঁটে, বেতো ঘোড়া, আরও ভালো ধোপার গাধার স্বভাবপ্রাপ্ত হয়েছে। বাঙালি নিতান্তই ভারবাহি জীব। সংসারের জোয়াল কাঁধে টুকুসটুকুস করে হাঁটছে তো হাঁটছেই। মাঝে-মাঝে গাধার মতো ঘাড় গোঁজ করে থমকে দাঁড়ায়। পেছন থেকে ঠ্যালা মারলেই আবার চলতে শুরু করে। বাড়ি থেকে অফিস, অফিস থেকে বাড়ি। বাড়ি থেকে দুধের ডিপো, ডিপো থেকে বাজার, বাজার থেকে বাড়ি। বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ি। পায়ে-পায়ে চটি টেনেটেনে যাচ্ছে আর আসছে, আসছে আর যাচ্ছে। বৈচিত্র্যহীন জীবন। সমতলের প্রাণীদের চরিত্র ওই জন্যে এলিয়ে যায়।
আমরা পাহাড় পাব কোথায়! কোথায় পাব চড়াই, উতরাই আর খাদ। এতকাল আমাদের সব পরিকল্পনাই ছিল, সমতল, ফ্ল্যাট, চরিত্রহীন। হয় কৃষি, না-হয় পশুপালন, না-হয় শিল্প। অনেক চেষ্টায় আমরা সমতলকে অসমতল করেছি। দুটো পা কখনই যাতে এক লেভেলে না থাকে, সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। এখন কুঁচকি আউরেছে বলে নাকে কাঁদলে হবে না। ভগবান যা করেন সব মঙ্গলের জন্যে। চলতে, চলতে কিংবা গাড়িতে যেতে-যেতে এই ওঠো, এই পড়ো। কেন, বাঙালি, গান শোনোনি, ওঠা পড়া প্রেমের তুফানে। যত উঠবে, যত পড়বে, তত প্রেম বাড়বে। নিশ্ছিদ্র বাসে, ট্রামে, মিনিতে, ট্রেনে বাঙালি নরনারীর ঠাস বুনোন। ট্রাম আর ট্রেন লাইনে চলে, তাই তেমন ঢেউ খেলে না। বড় আফশোশ। ঠেসে দিলে, ঠাসাঠাসি ছাড়া আর বিশেষ কোনও অনুভূতি হয় না। ঠুসঠাস চলতে পারে, কিন্তু সেই গানটি আর আসে না, প্রেম-যমুনায় হয়তো বা কেউ, ঢেউ দিল ঢেউ দিল রে! অকুল হিয়ার দু-কূল বুঝি ভাঙল রে! বাসে আর মিনিতে বাঙালির অনেক সুযোগ। কখনও মনে হচ্ছে, চাঁদের আলোয় সহস্র গোপিনীসহ নৌকাবিহারে চলেছি। কখনও মনে হচ্ছে ওয়েলার ঘোড়া চেপে যুদ্ধে চলেছি। প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে এ ওর ঘাড়ে ঢলে-ঢলে পড়ছে। বাঙালি রে! এত প্রেম তোর কোথায় ছিল রে! ও রে ভাই! মুখে একবার হরি নাম বলো। কীর্তনের সুরে না পারিস ভাই, ডিসকো সুরেই বল। সেই পাঁচশো বছর আগে একবার নদে ভেসে গিয়েছিল যে নামে, যাঁর নামে, তাঁকে একবার স্মরণ করো। প্রেমদাতা নিতাই বলে, গৌর হরি, হরি বোল। সে যে গান গেয়ে গেয়ে পড়ে ঢলে ঢলে। আহা কী দৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে যায়। চার চাকার প্রেমরঙ্গ। জাগো বাঙালি। ব্রিফকেসের খোঁচা মারায় জাগো। ঘুমায়ে থেকো না আর।
সমতলবাসী নিরীহ বাঙালির চরিত্র বড় এলিয়ে ছিল। কোনও বীরত্ব ছিল না। পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, মামলা, তেল মালিশ আর বুট পালিশ করে বাঙালি দুশো বছর কাটিয়েছে। কবি দু:খ করেছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবি! একবার এসে দেখে যান, বাঙালিকে আমরা মানুষ করেছি। পাহাড়ি জাত তৈরি হয়েছে। চোখ মুখ কটমট। দাঁত কিড়িমিড়ি। কোলের শিশুটি পর্যন্ত বলতে শুরু করেছে, মেরে লাশ ফেলে দেব। ঘুনশিতে পাঁউরুটি কাটা ছুরি বেঁধে ঘুরছে। বলছে, প্র্যাকটিশ করছি। এই তো চাই। এরই নাম হাইল্যান্ডার। মন শক্ত হচ্ছে, চামড়া কর্কশ হচ্ছে। বাপ বললে শালা বলছে। কথায়-কথায় কোতল করছে। আগে ছিল, স্যাকরার ঠুকঠাক, এখন হয়েছে কামারের এক ঘা। চাপে থাকলে বাড়ার ইচ্ছে হয়। মাথা হেঁট করে থাকলে মাথা তোলার ইচ্ছে হয়। বাসে কি মনে হয় বাঙালি? মিনিতে ঘাড় হেঁট অবস্থায় কি মনে হয় বাঙালি? গাছের ফলটিকে ন্যাকড়া বেঁধে রাখলে আয়তনে বাড়ে। বঙ্গবৃক্ষের বাঙালি ফলসমূহকে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছি, এবার তোমরা বড় হও। দেহে নয়, মেদে নয়। মনে।
ভাই সব, ইওরোপ, আমেরিকার কথা তুলো না। স্বাধীনতার এত বছর হল, অত বছর হল, ও সব অঙ্ক নাই বা করলে। শুধু শুধু নিজেদের উত্তেজিত করা। উত্তেজনা মোটেই ভালো জিনিস নয়রে বাপ! শরীর খারাপ হয় মানিক। ভোগ যে কত বড় দুর্ভোগ, আমরা জানি। হার্ট ঝুলে পড়ে, রক্ত জমাট বেঁধে যায়, চিনি বাড়ে, চোখে চালসে ধরে। মালাই এক ধরনের খাপে মালাইওয়ালার হাঁড়িতে নুন মেশানো বরফে কেমন ঠাস থাকে দেখেছ! কি তার বাঁধুনি। খোল থেকে বেরোল, তো আতুরি সোনার মতো গলে গেল। আমাদের প্রশাসনিক উদাসীনতা হল সেই নুন-মেশানো শীতল বরফ, তোমরা হলে ঠুঙির মালাই। ভাই সকল, টাইট থাকো, টাইট। গলে যেও না। তোমরা আমাদের বড় আদরের ভাই। প্রেমে থাকো, প্রেম। প্রেম একটা ফ্রেম অফ মাইন্ড। বলো, একবার বলে ফ্যালো, সেই সুপ্রাচীন উক্তি, মেরেছ কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না।
।। বুলেটিন চার।।
আমার প্রাণাধিক প্রিয়তম ভোটদাতাগণ! আপনারা সংখ্যায় কমে গেলে বড় দু:খ পাব। যেমন করেই হোক বালবাচ্চা নিয়ে আপনারা জীবিত থাকুন। আপনাদেরও প্রয়োজন আছে। গরুর জন্যে যেমন বিচিলি, গুরুর জন্যে যেমন শিষ্য, ডাক্তারের জন্যে যেমন রোগী, আকাশের জন্যে যেমন নক্ষত্র, ছাগলের জন্যে যেমন বটপাতা, শিশুর জন্যে যেমন মাতৃদুগ্ধ, ঠিক সেই রকম নির্বাচনের জন্যে আপনারা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আপনাদের সংখ্যা হিসেবে আসে। একটি তালিকায় দেখবেন জ্বলজ্বল করছে, আপনাদের নাম, পিতার নাম, স্ত্রীর নাম, স্বামীর নাম। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে পাওয়া কত বড় সৌভাগ্য, কী ভীষণ উত্তেজনা। লেখকরা জানেন। প্রথম লেখাটি প্রকাশের জন্যে তারা যা করেন, ইংরেজি থেকে বাংলা করলে দাঁড়ায় কোনও পাথরই ওলটাতে বাকি রাখে না। ছাপার অক্ষরে নাম দেখার জন্যে কত লোক আত্মহত্যা করে। কাগজে পড়েননি বিনয়কুমার একস, ওয়াই, জেড, বয়েস সাতাশ, পাখার ব্লেড থেকে ঝুলছে। আত্মহত্যার কারণ অজ্ঞাত। লেখা হয় অজ্ঞাত। মোটেই অজ্ঞাত নয়, ভেতরের কারণ ছাপার অক্ষরে নাম দেখার ইচ্ছা। সেদিন একটি কাগজ বেশি বিক্রি হয়। কে কিনেছে ধরা যায় না, কারণ তিনি অদৃশ্য। কার্য আছে কারণ নেই।
শুনেছি, আপনাদের ভীষণ কষ্ট। নানা রকম সামাজিক ব্যাধিতে ভুগছেন। আমার বুক ফেটে যায়। বিশ্বাস করুন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও আমরা মানুষ। আমাদের হাত আছে, পা আছে, চোখনাক, মুখকান সবই আছে ঠিক আপনাদেরই মতো। কেটে গেলে রক্ত বেরোয়। বদহজম হলে পেটে ব্যথা করে, ঠান্ডা লাগলে সর্দি হয়। খিদে পেলে খাবার ইচ্ছে হয়। কানের কাছে বোমা ফাটলে বুক ধড়ফড় করে। প্রিয়জনের মৃত্যু হলে দু:খ হয়। মাঝে মাঝে নি:সঙ্গও বোধ করি। বিবেকের গান শুনি নিদ্রাহীন মধ্য রাতে—মনে করো, শেষের সেদিন কী ভয়ঙ্কর। শুনি কিন্তু কিছু করতে পারি না। কারণ কিছু করা বড় শক্ত। গড়গড়ায় তামাক খাওয়া চলে, গড়গড়া নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া চলে, না। চটি পরে প্যাটপ্যাট করে অফিস যাওয়া চলে কুচকাওয়াজ করতে হলে বুট চাই। আপনারা আমাদের ভুল বুঝবেন না। আমরা হলাম আপনাদের প্রত্যাশার ছায়া। আমাদের কায়া নেই। অনেকটা ভূতের মতো।
যাক, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন কাজের কথায় আসা যাক। কিছু টোটকা শিখিয়ে দি। মুষ্টিযোগও বলতে পারেন। এর নাম সর্প হয়ে দংশ তুমি ওঝা হয়ে ঝাড়ো। সেই অলমাইটির খেলার মতো। সন্ধের ঘূর্ণিঝড়ে সব উড়ে গেল সকালে হেসে উঠল সোনালি রোদ। মারব আবার বাঁচার কৌশলও শেখাব।
ঘাড় বাঁচাও : বাঙালির ঘাড়ের ওপর সকলের বড় বেশি নজর। প্রথম নজর নরসুন্দরের। অন্যমনস্ক হলেই ক্লিপ চালিয়ে ক্ষুর বুলিয়ে শাঁস বের করে দেবে। ঘাড় চাঁচায় বড় আনন্দ। ইদানিং বিটলে চুল রাখার রেওয়াজ এসে বাঙালির ঘাড় বাঁচিয়েছে। একেই বখাটে তার ওপর বকমার্কা গলা। সে যা ছিড়ি হত। এখন আর সে দৃশ্য দেখতে হয় না। পেছন থেকে দেখে বোঝা দায় ম্যাড না ম্যাডাম। ঘাড় ঢেকেও কি ঘাড় বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। হয়নি। ঘাড় ধাক্কা ঘাড়ে রদ্দা সমানে চলেছে।
রদ্দা : রদ্দা কাকে বলে? কুস্তিগিরের ভাষা। পুরো বাহু দিয়ে গদাম করে মারা। হাতেও মারা যায়, ভাতেও মারা যায়। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্র থেকে মার খেয়ে ফিরে আসা, খেলার জগৎ থেকে ন্যাজে-গোবরে হয়ে ফিরে আসা, এক ধরনের রদ্দা। আর-এক ধরনের রদ্দা একেবারে জাতীয় জিনিস। বাঙালি পরস্পর পরস্পরকে মেরে চলেছে, বাসে-ট্রামে-ট্রেনে। ঘাড় তুলতে গেলেই কনুইয়ের চাপ। পেছনের জন-সামনের জনকে মাথা সোজা করতে দেবেন না। একে বলে দমিয়ে রাখা। যার অন্য নাম ন্যাজ টেনে ধরা। ইতিহাস বলছে এই এক জাত, যার পরস্পর পরস্পরের ন্যাজ টেনে ধরে টাগ অফ ওয়ার খেলছে। দড়ি বাঁধা ছাগল যেমন উলটো দিকে হিড়হিড় করে ছোটে। এক হাত এগোয় তো তিন হাত পেছোয়। বাঙালির অগ্রগতিও অনেকটা সেইরকম। সকলেই ভাবছেন এগোবি কি টেনে ধরে আছি। সোজ হবি কি দুমড়ে রেখেছি। ওই ধরনের রদ্দার টোটকা আমি বাতলাতে পারব না। স্বভাব শুনেছি চিতায় উঠলে তবেই পালটায়। তবে বাসে ট্রামে যা চলছে, সে-ও কম অস্বস্তিকর নয়। এর হাত থেকে বাঁচার জন্যে একটি কবচের কথা বলি।
কবচ : যুদ্ধে যাওয়ার সময় বীরেরা মহাভারতের কালে, কবচকুণ্ডল ধারণ করতেন। জীবিকা যুদ্ধে যাওয়ার সময় আপনারাও ঘাড়ে এক ধরনের কলার ব্যান্ড পরতে পারেন। যেকোনও হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে বেশ মোটাদানার স্যান্ড পেপার সংগ্রহ করতে হবে। চাইলেই পাওয়া যাবে। দাম বেশি নয়, গলার বেড় অনুসারে এক টুকরো ভেলভেটে, আধুনিক আঠা দিয়ে মসৃণ দিকটি সেঁটে দিতে হবে। খড়খড়ে দিকটি থাকবে ওপরে। ভেলভেট লাইনিং লাগানো এই কণ্ঠলেঙ্গুটিটি গলায় ধারণ করে বাসে ট্রামে, ট্রেনে উঠলে ঘাড়, মনে হয়, বাঁচবে। কেন বাঁচবে, যার কনুই কি পুরোবাহু লাগবে, এক পর্দা ছালচামড়া উঠে যাবে, দাদা হাত সরান, দাদা হাত সরান বলে সারাটা পথ আর চুলোচুলি করতে হবে না। সায়েবরা যদি নেকটাই পরতে পারেন, স্পন্ডিলাইটিসের রুগি যদি গলবন্ধনী পরতে পারেন সাধারণ মানুষ ঘাড়ের স্বার্থে বালি কাগজের বকলশ কেন পরতে পারবেন না! এই বকলশ পরিধান করলে বাঙালিকে আর ঘাড় হেঁট করতে হচ্ছে না। নীচু করলেই চিবুক ঘষে ছালচামড়া উঠে যাবে। খরচ অতি সামান্য? ফলাফল অসামান্য।
হাঁটু : মিনির আসনে বসলে হাঁটু বাঁচানো দায়। ধারের আসনে বসলে ব্রিফকেসের খোঁচায় মালাইচাকি ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা। হাঁটুতে মাপ মতো দুটি স্টেনলেসস্টিলের বাটি ফিট করে নিন। অফিসে গিয়ে হাঁটু থেকে খুলে ওতে একশোগ্রাম চিঁড়ে ভিজিয়ে দিন। টিফিনের সময় দই দিয়ে মেরে দিন।
পায়ের আঙুল : পায়ের আঙুলে লোহার ঠুলি পরুন। ফুটবোর্ডে দাঁড়ালে পায়ের ওপর লোক চাপবেই। চলমান বাসের পাদানিতে হুলোর ঝগড়া বড় অসম্মানজনক। ছি: বাঙালি ছি:। বয়েস হচ্ছে না?
।। বুলোটিন পাঁচ ।।
অনেক কিছু শেখার আছে। সে যুগ আর নেই, বাঙালিবাবু। তেল, চুকচুকে শরীর। সামনে টেরি। দিশি ধুতির কোঁচাটি লুটোচ্ছে পদপ্রান্তে। মুখে একটি ছাঁচি পান। হাতে চুন-লাগানো পানের বোঁটা। মাঝে মাঝে বকনা গরুর মতো গুরু ভোজনের উদগার। দুর্গা দুর্গা বলে গায়ে ফুরফুরে বাতাস মেখে সেরেস্তায় গমন। পুন: প্রত্যাবর্তন। দুগ্ধধবল পাথরের গেলাসে সরবত সেবন। সন্ধ্যায় বেলফুলের সুবাস-সহ ইয়ার-বন্ধুদের সঙ্গে বসে, গোলাপ জাম, ভিজে মুগ, আদার কুঁচিসহ, খরমুজা নতুন আখের গুড় সহ ভক্ষণ। বাবু বাঙালি, যুগটি পালটে গেছে, মানিক। নিজেকে তৈরি করো।
শিক্ষা মানে এ. বি. ডি নয়। আই অ্যাম আপ, আমি হই ওপরে, ইউ গো ইন, তুমি যাও ভিতরে—নয়। শিক্ষা হল বেঁচে থাকার কৌশল শিক্ষা। পরাধীন যুগে স্বদেশিরা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, বোমবাঁধা, চাঁদমারী ইত্যাদি শিখতেন। কেন শিখতেন? বিদেশি শাসকদের সঙ্গে লড়ায়ের জন্যে। শাসক সে বিদেশিই হোক আর স্বদেশিই হোক, শাসনযন্ত্রের সঙ্গে লড়াই না করলে কোনও কালেই বাঁচা যায় না। আমরা মাঝে-মাঝে নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডেকে বসি। মেপে-মেপে মিছিল ছাড়ি। লড়াই লড়াই বলে মাথা ঝাঁকাই।
শিক্ষার ধরনটা তাহলে কী হবে?
এই জগৎটা হল নাট্যমঞ্চ। জীবন হল নাটক। পৌরাণিক পালা নয়। আধুনিক নাটক। নাটক না বলে সার্কাস বলাই ভালো। সার্কাসের কলাকৌশলই শিখতে হবে। তাহলে শেখাই। মন দিয়ে শুনুন।
এক নম্বর পাঠ : একটা নড়বড়ে বেঞ্চি কি লগবগে চেয়ার জোগাড় করুন। কারুর সাহায্য ছাড়াই চটিপরা পায়ে তড়াক-তড়াক করে লাফিয়ে উঠুন।। উঠুন আর নামুন, নামুন আর উঠুন। টাল খেয়ে পড়ে গেলে চলবে না। পড়ে গেলেই শাস্তি হিসেবে দুহাতে নিজের দু-কান ধরে সর্বসমক্ষে দশবার ওঠবোস। বেশ রপ্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয় পাঠ।
দ্বিতীয় পাঠ : স্ত্রী অথবা পুত্র কন্যার সাহায্য নিতে হবে। দুর্দান্ত স্বভাবের একটি কিশোর থাকলে বড় ভালো হয়। একাধিক হলে তো আরও ভালো। তারা ওই নড়বড়ে বেঞ্চিটিকে মনের আনন্দে হিড়হিড় করে টানতে থাকবে, আর আপনি সেই চলমান বেঞ্চিতে বারেবারে লাফিয়ে উঠবেন, আর নামবেন। আরোহণে ডান পা, অবরোহণে বাঁ-পা।
তৃতীয় পাঠ : আরোহণের সময় ধাক্কা মারতে বলবেন এই ধাক্কা মারার দায়িত্বটি স্ত্রীকে দিলে তিনি আনন্দ পাবেন। ধাক্কা বহুপ্রকার। পাশ থেকে পেছন থেকে বেঞ্চির ওপর থেকে। মাঝে-মাঝে পা জড়িয়ে কাঁচি এই বাধা অতিক্রম করে ওই চলমান লগবগে বেঞ্চিতে উঠে দাঁড়াতে হবে।
চতুর্থ পাঠ : পরিবারস্থ সকলকেই এই পাঠে অংশ নিতে হবে। বড় পরিবার হলেই ভালো হয়। ছোট হলে চালিয়ে নিতে হবে। প্রত্যেকেরই হাতে কিছু না কিছু জিনিস নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ান। সুটকেস, ডেকচি, টিফিন ক্যারিয়ার, হাতা খুন্তি, ফোল্ডিং ছাতা। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়। কোনও বাছবিচারের প্রয়োজন নেই। রেশন ব্যাগে ভাঙা কাঠকুটো এমনকী একটি কাটারি ভরে হাতে ঝোলানো যেতে পারে।
এইবার যে কেউ একজন ‘ওই আসছে’ বলে একটা চমক তুলে হরির লুঠের বাতাসা যে ভাবে সংগ্রহ করতে হয় সেই কায়দায় সবাই মিলে তালগোল পাকিয়ে জড়াজড়ি গোঁত্তাগুঁত্তি করে বেঞ্চিতে ওঠার চেষ্টা করুন। ওরই মধ্যে একজনকে বলে রাখুন, এই চেষ্টা যখন চলছে তখন আচমকা বেঞ্চি ধরে মারবে হাঁচকা টান। এই পাঠ নেওয়ার সময় কেউ কাউকে আপনজন ভাবলে চলবে না।
এই চারটি পাঠ একসঙ্গে ভালো ভাবে রপ্ত করতে পারলে আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড বেড়ে যাবে। সামান্য কাটাছেঁড়ার দিকে আর মন যাবে না। অনায়াসে বলা যাবে জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। রোজ অফিস বেরোবার সময় প্যানপ্যান করে কাঁদতে হবে না। বেঁচে ফিরতে পারব কিনা, জানি না, মাধু। আমার নাম করে মাছের টুকরোটা আর তুলে রেখো না, যদি চাকার তলায় চলে যাই।
পঞ্চম পাঠ : এর জন্যে প্রয়োজন আস্ত একটি সুপুরি বা নারকেল পাতা। শৈশবে ফিরে যান। মনে পড়ে পাতার ওপর থেবড়ে বসে আছে শিশু গোপাল আর বলাই পাঁঠা টানছে হিড় হিড় করে। ধেড়ে বয়েসে সেই মজাটিকেই ফিরিয়ে আনুন। বসবেন না, প্রান্তভাগে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকুন। স্ত্রী পুত্র পরিবারকে বলুন আগা ধরে টানতে। হঁ্যাচকা টান। টাল সামলান। আবার হ্যাঁচকা টান, টাল সামলান। লাগাতার টান। কদম কদম টান। স্থির হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করুন। পয়সা বের করে অদৃশ্য কন্ডাকটরকে ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করুন। ব্যালেন্স বুঝে নিন। এই পাঠটি রপ্ত হয়ে গেলে চলমান বিশৃঙ্খলাকে মনে হবে স্থির শয্যা। অনন্ত নাগের মতো কারণ-সলিলে ভাসমান।
ষষ্ঠ পাঠ : ভাঁড়ার ঘর বা খুপরি ঘরের শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান। পরিবারকে বলুন যাবতীয় বস্তু—লেপ, কাঁথা, তুলোর বস্তা, চেয়ার টেবিল কাঠকুটো, ঘুঁটের বস্তা, জলের ড্রাম যা পাওয়া যায়, সব দিয়ে আপনাকে প্যাক করে দিক। এইবার আপনি ধীরে-ধীরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। বেরোন আর ঢুকুন, ঢুকুন আর বেরোন। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে ভিড় বাস থেকে ওঠা আর নামা মনে হবে নস্যি, নস্যি।
সপ্তম পাঠ : এক আঙুলে জানালার গরাদ ধরে একপায়ে গোবরেট থেকে তারে আটকানো চাঁদিয়াল ঘুড়ির মতো লাট খান, পাক খান, আর চিৎকার করুন, ড্যালাহাউসি, ড্যালাহাউসি, মনে রাখবেন, ট্রেনিং-এ যেমন মানুষ তৈরি হয়, ট্রেনিং-এ তেমনি বাঁদরও তৈরি হয়।