হার
উচ্চশিক্ষা, উচ্চসভ্যতা, সংস্কৃতি, সর্বোপরি অর্থ মানুষকে কি একটু অসভ্য করে তোলে? কী জানি। মনে হয়, করে। ব্যবহারে একটা শীতলতা বোধহয় আসে। ইংরেজিতে বললে লক্ষণটা আরও ভালো বোঝা যাবে। কোল্ড ফিলিংস, কোল্ড অ্যাটিচিউড। আন্তরিকতার ভাবটা আর থাকে না। মানুষ, শিক্ষায়, দীক্ষায়, অর্থে প্রাচুর্যে যত বড় হতে থাকে, ততই সে দূরে সরে যেতে থাকে। ইচ্ছে করেই সরিয়ে নিতে থাকে নিজেকে। তখন তার সঙ্গী হয় তার নিজের অহংকার। যেমন, এমনি ঘর আর রুমকুলার-লাগানো ঘর। দুটোই ঘর কিন্তু একটার খোপে বসেছে যন্ত্র। মধুবাবু আগে ওই ঘরেই থাকতেন, অবস্থা ফেরায় তিনি এখন এই ঘরে থাকেন। চারপাশ বন্ধ। দরজায় স্প্রি লাগানো। অল্প ফাঁক করে ঢুকে পড়তে হয়, তা না হলে ওই জগতের ভাষায় ঠান্ডা এসকেপ করবে। মধুবাবু এখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চড়া রোদের দিকে তাকিয়ে বলেন, এই দেশটার কিছু হল না, স্রেফ ওয়েদারের জন্য। স্বামীজিও বলতেন, আমিও বলছি। কোথায় স্বামী বিবেকানন্দ আর কোথায় মধু মণ্ডল। পয়সার জ্যাক ঠেলে এমন এক উচ্চতায় তুলেছে, যেখানে উঠে মনে হচ্ছে, আমি আর আইনস্টাইন এক কিসিমের মানুষ।
অনেককেই বলতে শুনি, দাদা খুব বড় চাকরি করেন তো, তাই তিনি আর সাবেক বাড়িতে থাকলেন না। দক্ষিণ কলকাতায় উঠে গেছেন। গাড়ি আছে। কোনও প্রবলেম নেই। পনের মিনিটে সাঁ সাঁ করে অফিসে। ভালো-চাকরি আর পোজিসান হলেই সর্বনাশ। গ্যাস বেলুন। এমনি বেলুন আর গ্যাস -বেলুনে তফাত হল এ পড়ে থাকে ভুঁয়ে, ও ঠেকে থাকে সিলিং-এ। একজনের মাটিতে পা আর একজনের ছাতে মাথা। ওই সেই রুমকির বিয়েতে দাদার সঙ্গে আলাপ হল। এই যে আমার দাদা। জেনারেল ম্যানেজার, গবলেট অ্যান্ড হবলেট কোম্পানির। আমি দু-হাত তুলে নমস্কার জানালুম। তিনি সিঙ্গল হাত সামান্য একটু তুলে ছেড়ে দিলেন। আমি দিলুম স্যান্ডউইচ। দুহাত জোড় যদি স্যান্ডউইচ নমস্কার হয়, তিনি দিলেন একহাতে বিস্কুট নমস্কার। চোখের কোণটা খুচুক করে কুঁচকে উঁচু জাতের ক্লাস হাসি এক রাউন্ড। সাধারণ মানুষের হাসি হল ভাল্লুকের শাঁকালু খাওয়া হাসি। দাঁতটাঁত বেরিয়ে গালগলা কুঁচকে, কন্ট্রোলের হাসি নয়, খোলা বাজারের হাসি। সে হাসি আবার সহজে মেলাতে চায় না। বড় মানুষের হাসি হল ব্রিফকেস হাসি। খট করে খুলল, খট করে বন্ধ হল। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হাসি হল জিপ ফাস্টনার হাসি। টেনে বন্ধ করতে হয়।
দাদা সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব গাম্ভীর্য নিয়ে সরে গেলেন আর এক পাাশে। কাকে যেন বললেন, কাল মরনিং ফ্লাইটেই দিল্লি যেতে হবে। সকালের বিমান বললেন না। জীববিজ্ঞানীরা যেমন মানুষ বলতে চান না, বলেন হোমো স্যাপিয়েন। বোট্যানিস্টরা বললেন, করিয়েন্ডাম ল্যাজারা ইর্যাসমাস। সে আবার কি রে বাবা! অনেকে কষ্টে জানা গেল কচুরিপানা। সহযাত্রী জিগ্যেস করেছিলেন, পরের স্টেশান কি বংশবাটি। সহযাত্রী বললেন, না, না, পরের স্টেশন বাঁশবেড়ে? সেই অনুষ্ঠান বাড়িতে দাদা কিছুতেই মেলাতে পারলেন না নিজেকে। এরই মধ্যে কে একজন বলে বসলেন, আমার ছেলেটার যা-হয়-একটা ব্যবস্থা করে দিন না। পাসটাস করে বসে আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সরে পড়লেন। মানে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। টাঁস করে স্টার্ট নেওয়ার শব্দ। লাল আলো ক্রমশ দূর থেকে দূরে চলে গেল। প্রবীণরা বলতে লাগলেন, ভাবা যায়, সেই ছেলে আজ এই ছেলে হয়েছে। আমরা একটু দেখেছি, ল্যাল-ল্যাল করে ঘুরে বেড়াত। কার যে কখন কী হয়। গাড়িটা দেখলে বিলিতি গাড়ি।
একজন আপত্তি জানালেন, আরে, না রে বাবা, দিশি গাড়ি। আজকাল অনেক ভালো ভালো গাড়ি বেরিয়েছে।
আর-একজন ছেলের চাকুরিপ্রার্থীকে খুব বকতে লাগলেন, ‘হেলদার তোমার যে কবে একটু আক্কেল হবে!’
ওই অভিজ্ঞতা জীবনে ভোলার নয়। যখন সেই ভদ্রলোকের বহুতল বাড়ির সর্বোচ্চ ফ্ল্যাটে গেলুম। তখন বৃষ্টি নেই। বসতে-না-বসতেই এসে গেল তেড়ে। বহুতল বাড়ির ওপর থেকে বৃষ্টি দেখতে বেশ ভালোই লাগে। এদিকে বাসে দুই বাঙালির ঝগড়ার মতো বৃষ্টি আর থামে না। হচ্ছে তো হচ্ছে। বুঝতেই পারছি, বাইরে শহর ডুবছে জলে। যেতে হবে বহু দূর। মনে-মনে ভাবছি, জলে তো আর পড়ে নেই। তেমন হলে বসার ঘরের এই ডিভানটায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব। সেইজন্যে আর ওঠার চেষ্টা করলুম না। উঠলেও যাওয়া যাবে না। রাত দশটা। হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, যেতে হলে এখুন উঠে পড়ুন। আপনার বাড়ি তো আবার সেই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে।
আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল। রান্নাঘর থেকে ভালোমন্দ রান্নার গন্ধ আসছে। ভেবেছিলুম, গৃহস্বামী এই বুঝি বলেন, আজ বাড়ি ফেরার আশা ছাড়ুন। এইখানেই যা হয় কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ুন। কাল সকালে বাড়ি ফেরার কথা ভাবা যাবে। আমি হতবাক হয়ে বাইরের দিকে তাকালুম। বিদ্যুতের আলোয় আকাশ মাঝে-মাঝে ঝলসে যাচ্ছে; আর তেমনি বৃষ্টি হচ্ছে তোড়ে। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, যাবেন কী করে! আজ বরং এখানেই থেকে যান।
ভদ্রলোক আঁতকে উঠলেন, তুমি বুঝছ না মাধু, এর বাড়িতে ফোন নেই। দিনকাল ভালো নয়, বাড়ির সবাই খুব উৎকণ্ঠায় থাকবে।
ফোন নেই বলে আমাকে উঠে পড়তে হল। ভদ্রমহিলা বললেন, তাহলে একটা ছাতা।
ভদ্রলোক বললেন, আরে ধুর। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। এ কি তোমার ছাতার বৃষ্টি। এ বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে।
তারপর বিদায় জানাবার সে কি ঘটা। সুর করে বাই। সি ইউ সামটাইম। পাছে ফিরে আসি। সাততাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি নীচে নেমেই বুঝে গেলুম, বাড়ি ফেরা অসম্ভব। লিফটের একপাশে সিঁড়ির ধাপে বসে রইলুম দেওয়ালে পিঠ দিয়ে। মনে-মনে গুনগুন করে করে গাইতে লাগলুম, এই পথেই জীবন, এই পথেই মরণ আমাদের। ঘণ্টাখানেক পরে ধড়াস করে লিফটের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ভদ্রলোক সঙ্গে চেনে বাঁধা কুকুর। প্রাকৃতিক কর্ম সারাতে এনেছেন। কালো রঙের বিশাল সেই কুকুর, আমারই আশেপাশে ঘুরে-ঘুরে ছিড়িক ছিড়িক ছাড়তে লাগল। ভদ্রলোক ক্রমান্বয়ে বলতে লাগলেন, কুইক,কুইক। ফিনিশ ইট কুইক। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে, অথচ চিনতে পারছেন না। কী মজা!
আমি বললুম, নমস্কার বাবু।
ভদ্রলোক বলেন, কবে ফিরলে দেশ থেকে?
আজ সুবে।
ফিনিশ ইট কুইক। কুইক কুইক।
বাবু, কুকুর, লিফট তিনটেই কুইক কুইক করতে-করতে উঠে গেল ওপরে। এখন গণিতজ্ঞরা বলতে পারবেন, কতটা ওপরে উঠলে মানুষের এই হাল হয়। আমাকে ঝাড়ুদার ভেবে চলে গেলেন। এদের পৃথিবীতে মানুষের দুটি শ্রেণি—মালদার আর ঝাড়ুদার।