হার-জিত

হার-জিত

শেখরের সহিত তাহার স্ত্রী অরুণার কলহ বাধিয়াছে। শাস্ত্রকারেরা বলেন দম্পতিদের মধ্যে এ জাতীয় ঘটনা নাকি বিপজ্জনক নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে যেন একটু চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিতেছে, কারণ অরুণা কথায় কথায় বলিয়া বসিল, “আমি চললাম বাপের বাড়ি— আজই।”

শেখর নিশ্চয়ই একটু ভয় পাইল, কথাটাকে হাল্কা করিয়া ফেলিবার জন্য একটু রসিকতা করিবার চেষ্টা করিল, বলিল, “বেশ, তাই চল।”

কিন্তু ফল হইল উল্টা। স্ত্রী রসিকতার জবাব না দিয়া আরও গম্ভীর হইয়া বলিল, “আর মন্টু ডলি কেউ সঙ্গে যাবে না। ভোগো। কেন, আমিই বা সর্বত্র টাঙিয়ে নিয়ে বেড়াব কেন?”“

শেখর বলিল, “না, ওদের মাসি তো আসছেই, ভালও বাসে। কথাটা আমার মনেই ছিল না। তা হ’লে তোমার সঙ্গে যাবার আমারও আর তাড়া নেই।”

অরুণা আজ সকালে ছোট ভগ্নীকে আসিবার জন্য শ্বশুরালয়ে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইয়াছিল। স্বামীর দিকে কড়া চোখে চাহিয়া বলিল, “আমি নেই, অথচ সে এসে থাকবে? বুদ্ধিসুদ্ধি কি লোপ পেল নাকি?”

শেখর ঠোঁটে হাসি চাপিয়া বলিল, “আমি তো মনে করি, তুমি থাকবে না ব’লেই তার থাকাটা আরও দরকার। একজন প্রতিভূ দিয়ে না গেলে আমারই বা—”

অরুণা আর শেষ করিতে দিল না, সংক্ষেপে অথচ দৃঢ়তার সহিত বলিল, “স্ত্রী আর দাসী নেই।”

শেখর বলিল, “না, আমি অভিভাবকের কথাই বলছিলাম। স্বামী এখনও নৌকোটিই হয়ে আছে কি না, তার অষ্টপ্রহর একটি কর্ণধার না থাকলে—”  

“কান নেহাত চুলকোয়, স্ত্রী যখন এর পর আসবে দেখা যাবে। এখন রসিকতা থাক্। আমি চললাম আজ। সেখানে ডাকতে গিয়ে যেন বেহায়াপনা না করা হয়। ঝি!”

“তার সূত্রপাত তো তুমিই করছ। একে তো সেখানে যাওয়ার কোনও সঙ্গত কারণ নেই, ঝগড়ার সন্দেহ করবেই সব। তবু যেন গেলেই। তারপর তারা যদি দু দিন থাকবার জন্যে জিদ করে, তখন তোমার আমার ওপর টান ধরবে। চোখ রাঙালে তো হয় না, সত্যি কথাই বলছি। আমার এই আকর্ষণের ক্ষমতাটাতে গৌরব আছে বটে, কিন্তু—”  

অরুণা আরও জোরে ডাকল, “ঝি! কানের মাথা খেয়েছিস?”

ঝি আসিতেই ছিল; একটু পা চালাইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। অরুণা বলিল, “শোফারকে ডেকে দে নীচে, আর দেখ, ডলি আর মন্টুকে একটু সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখ্, ওদের মামার বাড়ি যাবে।”

ঝি চলিয়া গেলে শেখর বলিল, “এই না অন্য রকম হুকুম হয়েছিল?”

“খুশি। এতে টিপ্পনীর কোনও দরকার নেই। যদি ভাল না লেগে থাকে “না, মতটা যে কথায় কথায় বদলায়, সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম।”

“বদলাবার উদ্দেশ্য থাকলে বদলায়। যে দুটোর জন্যে টান, তারা সঙ্গেই থাকবে—”  

ব্যাস্,—নির্ঝঞ্ঝাট। আর কারুর জন্যে আমি ভাবি না, একটুও না। এইবারে ভুল ধারণাগুলা বেশ ভাল ক’রে ভেঙে দিতে চাই। এই চাবির থোলো—সব জায়গার চাবি এতেই আছে। আর আমায় জ্বালাতন করবার কোনই দরকার নেই।”

টেবিলের উপর চাবির গুচ্ছটা ঝনাৎ করিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল। পর্দার বাহির হইতে কি খবর দিল, শোফার নীচে দাঁড়াইয়া আছে।

শেখর বিনীতভাবে বলিল, “কি বলব?”

“আমি বলতে জানি, উপকারে দরকার নেই।”

বারান্দায় গিয়া শোফারকে বলিল, “পাঁচটার সময় গাড়ি তোয়ের থাকবে, চন্দননগর যাবে। দরোয়ানকে তোয়ের থাকতে বল; আর চট ক’রে বাগবাজারে সরীর বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসুক—বিশেষ কাজ থাকায় আমি চন্দননগর যাচ্ছি। আবার না এসে পড়ে, বরং দরোয়ানকে পাঠিয়ে দাও, একটা চিঠি নিয়ে যাক।”

ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, শেখর চাবির গুচ্ছটা হাতে লুফিতে লুফিতে মৃদু মৃদু হাসিতেছে! সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করিল, “কি?”

শেখর সহজভাবে বলিল, “কই, কিছু না তো!”

দ্বিগুণ সন্দেহে অরুণা বলিল, “নিশ্চয় কিছু, বলতে হবে।”

“আজ আমি হুকুমের বাইরে এসে পড়েছি না?”

অরুণা রাগের উপর আবার অভিমান করিয়া বলিল, “ও! আচ্ছা থাক্।”

“তবু দয়া করে বলতে পারি।”

“কিছু দরকার নেই। উঃ, দয়া!”

“শুনলে যাওয়ার শখটা আর থাকত না। অনেক হাঙ্গামা পোয়ানো থেকে বাঁচা যেত— উভয় পক্ষেরই।”

অরুণা ভ্রু-কুঞ্চিত করিয়া ক্ষণমাত্র চিন্তা করিল। বোধ হয় এখানে হাঙ্গামা পোহানোর অর্থ কি হইতে পারে, নিজের আন্দাজমত স্থির করিয়া লইল; তাহার পর বলিল, ““থাক্ হাঙ্গামার ভয় করি না; যার ভয় আছে, সে সাবধান হোক।”

“তা হ’লে দয়া করে শোনই না হয়। আর কিছু নয়, কথাটা হচ্ছে-

“না না, আমি দয়া করতে চাই না কাউকে। আমার শরীরে কি দয়ামায়া আছে? আমি কি একটা মানুষের মধ্যে? তা হলে কি আমার কথায় কথায় এত হেনস্থা হয়? দয়ামায়া যে মানুষ জীবনে পেয়েছে কখনও, সেই জানে, দয়ামায়া কি! আমি কি কারুর কাছে কখনও-–”

অরুণা চক্ষে দিবার জন্য হাতে আঁচলের একটা কোণ তুলিয়া লইল। শেখর উদগ্রীব হইয়া চাহিয়া রহিল, কারণ এসব স্থলে কান্না নামিলে অনেকটা আশা, কিন্তু সে শান্তিজল বর্ষিত হইবার পূর্বেই দারোয়ান আসিয়া বাহিরে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল।

অরুণা বলিল, “দাঁড়াও, চিঠি দিই।”

পাশের ঘর হইতে চিঠি লিখিয়া আনিয়া দরোয়ানের হাতে দিয়া তাহাকে দুই-একটা

উপদেশ দিয়া বিদায় করিল।

শেখর বলিল, “তা হলে পাকা হয়ে গেল।”

অরুণ তাহার দিকে না চাহিয়াই বলিল, “আমার সব কাজই পাকা।”

“কিন্তু চাণক্য বলেছেন—দাম্পত্যকলহে চৈব, খুব পাকাপাকি হ’লেও নাকি—”  

অরুণা সেই ভাবেই বলিল, “চাণক্য ঠিকই বলেছেন, পুরুষেরা গায়ে পড়ে মিটিয়ে নেয়।” বোধ হয় কোনও বিশেষ দিনের ঘটনা স্মরণ করাইয়া দিবার জন্য স্বামীর দিকে কটাক্ষ করিয়া বলিল, “কখনও কখনও পায়ে ধ’রেও।”

“কে পায়ে পড়ে এইবার, তার বড় রকম সাক্ষী রাখব—কথাটা মনে থাকে যেন।”

শেখর নীচে নামিয়া গেল। বৈঠকখানায় টেবিলের দেরাজ হইতে টাইমটেব্লটা বাহির করিয়া একবার দেখিয়া লইল।

তিনটা চল্লিশ হইয়া গিয়াছে। চারটা পাঁচে একটা গাড়ি, সেটা পাইবার কোনও আশা নাই। তাহার পরের গাড়িটা পাঁচটা পনরোয়। অরুণার মোটর যদি পাঁচটার সময়ই ছাড়ে তো তাহার প্ল্যানটা আর খাটে না।

একটু চিন্তা করিল, তাহার পর টেবিলের উপর একটা নিষ্পত্তিসূচক আঘাত দিয়া অস্ফুটভাবে বলিল, “হয়েছে।”

উপরে গিয়া শোফারকে নীচের উঠানে ডাকিয়া পাঠাইল। অরুণাকে শুনাইয়া শুনাইয়া বলিল, “যেতে আসতে প্রায় পঞ্চাশ মাইল। গাড়িটা ঠিক আছে তো?”

অরুণা আসিয়া উৎকর্ণ হইয়া দুয়ারের নিকট দাঁড়াইল।

মোটর জিনিসটা একেবারে ঠিক কখনও থাকে না। শোফার একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “চ’লে যাবে হুজুর।”

অরুণা “তা হ’লে” বলিয়া কি বলিতে যাইতেছিল, শেখর তাহার কথা চাপা দিয়া বলিল, “চ’লে যাওয়া-যাওয়ি নয়। খালি মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছ। এরা সব জিদ করছে বটে, কিন্তু আমি সঙ্গে যেতে পারছি না। এখুনি বিশেষ কাজে বেরুতে হবে, বেশ ক’রে ভেবে দেখ। কিছু হ’লে বাড়িতে যদি টেলিগ্রামও কর তো ঘণ্টা-ছয়েকের আগে আমি পাব না।” এরূপ কথার উপর ছোটখাটো খুঁত থাকিলেও প্রকাণ্ড হইয়া পড়ে। শোফার বলিল, ‘ব্রেকটা একটা চাকায় যেন একটু আলগা ধরছে, তাতে তো বিশেষ ক্ষতি নেই, আর খুলতে গেলেও ঘণ্টা-দুয়েকের কমে হবে না।”

“পৌনে চারটে, হয়েছে পৌনে ছটা, ধর ছটাই।”—হিসাবটুকু সারিয়া স্ত্রীর দিকে চাহিয়া আস্তে বলিল, “এক ঘণ্টা দেরি হ’লে মশাইয়ের রাগ প’ড়ে যাবার ভয় আছে কি? আমি তো ব্রেকটাকে বিশেষ ছোট ব’লে মনে করি না। সেদিন বউবাজারের মোড়ে যা কাণ্ড দেখলাম, মনে হ’লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, এক গাড়ি মেয়েছেলে ঠাসা, হঠাৎ—”

অরুণা ভয় চাপিবার চেষ্টা করিয়া সিধা শোফারকেই বলিল, “না না, তুমি একবার খুলে ঠিকঠাক ক’রে নাও, হোকগে একটু দেরি।”

শেখর অধর দংশন করিয়া অনেক কষ্টে হাস্য সংবরণ করিল। অরুণা অস্বস্তির সহিত

প্রশ্ন করিল, “কোথায় যাওয়া হবে বাবুর?”

উত্তর না পাইয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কখন আসা হবে?”

“দেখি কখন ছাড়ে, সেখানে তো জোর নেই নিজের।”

“কোন্‌খানে?”

“কোনখানেই নয়। যার নিজের স্ত্রীর ওপরেই জোর রইল না—”

ধাঁধার মধ্য পড়িয়া অরুণা উষ্ণ হইয়া উঠিতেছিল, বলিল, “স্ত্রীর ওপর জোর না করতে পারলে বাবুরা সব হাঁপিয়ে ওঠেন। ইস, জোর! জোরটা কিসের শুনি?”

“খোসামোদের।”

অরুণা হাসিয়া ফেলিল; কিন্তু রাগের সময় হাসিয়া ফেলাটা একটা পরাজয় বলিয়া রাগটা বাড়িয়াই যায়। তাই নিজেকে কষ্টে সংবৃত করিয়া লইয়া বেশি রকম চটাচটি করিবার জন্য বলিল, “যেখানে খুশি যাও, আমার দেখা আবার ছ মাস পরে।”

শেখর ফিরিয়া বলিল, “ছ ঘণ্টার মধ্যে সেধে দেখা করবে।”

অরুণা আরও রাগিয়া বলিল, “তা হ’লে ছ বছরের ভেতর যদি এ বাড়ি মাড়াই তো—”  

শেখর বলিল, “আর ছ ঘণ্টা পরে যদি ফিরে না আসতে হয় তো—”

অরুণা রাগে গরগর করিতে করিতে দুইটা ঘর পার হইয়া গিয়াছিল, সেইখান হইতেই চেঁচাইয়া বলিল, “দেখা যাবে।”

শেখর আর জবাব দিল না, বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকিয়া মিটিমিটি হাসিতে লাগিল।

.

চন্দননগরে গঙ্গার ধারে বাড়িটা, পিছনে গঙ্গা, সামনে রাস্তা, বাড়ির সামনে খানিকটা বাগান।

শেখর আধ ঘণ্টা হইল আসিয়াছে। হাত-পা ধুইয়া জিয়া হঠাৎ এই অভ্যুদয় সম্বন্ধে শ্বশুর-শাশুড়িকে একটা মনগড়া কারণ দর্শাইল, খানিকটা এ-কথা সে-কথা লইয়া গল্প করিল, তাহার পর বড় শ্যালিকাকে বলিল, “চল শচীদি, বাগানে একটু পায়চারি করিগে।” শ্বশুর বলিলেন, “তার চেয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলে পার, হু-হু করে বাতাস দিচ্ছে।”

রাস্তার দিকে থাকাই শেখরের দরকার, বলিল, “হ্যাঁ, তাও মন্দ নয়।”

কথার মধ্যে অনিচ্ছার রেশটি লক্ষ্য করিয়া শ্যালিকা বলিল, “তাহ’লেও বাগানটা একটু ঘুরে আসি, এস; কতকগুলো নতুন গোলাপ বসানো হয়েছে। একটা ব্ল্যাক্‌প্রিন্স যা আনিয়েছি, এ তল্লাটে ও-রকম নেই, না বাবা?”

আট-নয় বছরের ছোট শ্যালী মলিনা ভগ্নীপতির হাত ধরিয়া টানিতেই শুরু করিয়া দিল; বলিল, “আর আমার করবীর ঝাড়ও দেখবেন চলুন জামাইবাবু, গাছ আলো ক’রে আছে। বলতে হবে, কারটা ভাল, হ্যাঁ! ম্যাগ্‌গে, কালো আবার গোলাপ! প্রিন্স তো রাজকুমার, আমি সে জানি, তা রাজকুমারই হোক আর কোটালপুত্তুরই হোক, কালো আবার নাকি ভাল হয়! কি পছন্দ দিদির! ম্যাগ্‌গে!”

শচী লজ্জায় রাঙিয়া উঠিতেছিল, মা মুখ ফিরাইলেন, পিতা বিশেষ কিছু না বুঝিয়াই সরল প্রাণে হাসিতে লাগিলেন। শেখর কথাটা আর বাড়িতে না দিয়া বলিল, “চল, তোমার করবী দেখিগে।”

আসিতে আসিতে আবার মলিনা ব্ল্যাক্‌প্রিন্স সম্বন্ধে তর্ক তুলিতে যাইতেছিল, দিদি ধমক দিয়া বলিল, “আচ্ছা তুই চুপ কর্, ভেঁপো মেয়ে।” শেখরকে জিজ্ঞাসা করিল, “এত কাছে রয়েছো, মুখুজ্জে, অথচ মাঝে মাঝে যে এক-আধবার আসবে—”

শেখর, মলিনা যে কথাটি বলিতে যাইতেছিল, তাহারই উত্তর দিল, “কি জান গো মলিনাসুন্দরী, যে যেটাকে ভালবাসে, তার কাছে—”  

বড় শ্যালিকা রাগিয়া বলিল, “ওই বাজে কথাই হ’ল বড়, আর আমার প্রশ্নের বুঝি—”  

“এর মধ্যেই তোমারও জবাব আছে দিদি, তোমার বোনের ভালবাসার অত্যাচারে আর বেরুবার জো আছে! কি চোখেই যে অধমকে দেখেছেন, দু দণ্ড চোখের আড়াল হবার জো নেই! অমনই জবাবদিহি কর। তাও যদি মনঃপূত না হ’ল তো কান্নাকাটি, রাগ, অভিমান—”  

“কই, এমন তো ছিল না! একটু আবদারে বরাবরই ছিল বটে, কিন্তু—”

“আজকাল হয়েছে। বন্ধুরা বলে—লাকি ডগ, তোকে দেখে হিংসে হয়।’ বলি— ক্ষ্যামা দাও ভাই; একদণ্ড বাড়ি ছেড়ে বেরুবার জো নেই, এ ভালবাসা, না কোণঠাসা ক’রে মারা?”

শ্যালিকা ভগ্নীর এইরূপ আদর্শ অনুরাগ সমর্থন করিয়া দুঃখিতভাবে বলিল, “তোমাদের ভাই প্রাণ খুলে দিলে তোমরা সন্তুষ্ট হও না, আর সঙ্গোপনে দিলে তোমরা তা অনুভব করতে পার না। ভালবাসা দেওয়ার আর উপায়ই বা আছে কি, স্ত্রী বেচারীরা তো আর ভেবে পায় না।”

শেখর বলিল, “বুঝলাম শচীদি, সব আমাদেরই দোষ। ইট-পাথরের মত আমরা যে হৃদয়হীন—এ বদনামটা তো চিরদিনই আছে। কিন্তু ধর, এই এখানে এসেছি, কাজটা সারতে চার-পাঁচ দিন লাগবে! ভেবেছি, রোজ যাওয়া-আসা না ক’রে এ কটা দিন এইখানেই থেকে যাই। হঠাৎ তোমার বিরহিণী ভগ্নী বাড়ি-ঘরদোর বন্ধ ক’রে সব নিয়ে এসে হাজির হলেন, ডবডব করছে চোখ, মুখ ভার, কি রকম আতান্তরে পড়ি বল তো?”

শ্যালিকা হাসিয়া বলিল, “আমাদের তো লাভই ভাই! অনেক দিন দেখি নি তাদের, তোমাদের যদি কানের টানে মাথা আসে তো মন্দ কি?”

শেখর মাঝে মাঝে গোপনে রাস্তার দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিল, বলিল, “তা সত্যিই তিনি যদি এসে হাজির হন তো আমি মোটেই আশ্চর্য হব না!”

মলিনা সব না বুঝিলেও দিদির আসিবার সম্ভাবনায় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিল, প্রশ্ন করিল, “কিসে ক’রে আসবেন জামাইবাবু? মোটরে?”

শেখর বলিল, “তিনি জানেন। চাই কি জ্ঞানশূন্য হয়ে ‘হা নাথ, হা নাথ’ করতে করতে ছুটেও আসতে পারেন।”

মলিনা অকৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ দুইটা বড় বড় করিয়া বলিল, “ও বাব্বা!”

দিদি তাহার রকম দেখিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, “মর, পোড়ারমুখী, দিদি কি তোর পাগল হয়েছে নাকি?”

শেখর বলিল, “আমি ভাবছি, যদি সত্যিই এসে পড়ে তো বাবা মা কি ভাববেন?”

“কি আর ভাববেন? বললেই হবে, ওরা মোটরে বেড়াতে বেড়াতে এসেছে, তোমার রেলপথে একটু কাজ ছিল। কিন্তু কোথায় কি তার ঠিক নেই, মিছে মাথা ঘামানো।”

“তার আসবার কথা তো তাঁদের বলা হয় নি!”

“ভুলে গিয়েছিলে। চল্ মলি, তোর করবী দেখাবি চল্।”

“আগে তোমার গোলাপ দেখুন। তুলে আনি একটা?”

দিদি ধমকাইয়া বলিল, “না।”

শেখর বলিল, “পরের জিনিসে এত লোভ কেন মলিনা? ছিঃ!”

মলিনা হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল, “ওমা, দিদির জিনিস বুঝি পরের জিনিস হ’ল? বুদ্ধি যা হোক!”

শেখর উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল, এবং লজ্জিতা হইয়া পড়িলেও মলিনার দিদি না হাসিয়া পারিল না। বলিল, “কি হচ্ছে ছেলেমানুষের সঙ্গে?”

শেখর বলিল, “খুব সলা দিলে তো দিদি! ওদের বলব, ভুলে গিয়েছিলাম? নিজের স্ত্রী সম্বন্ধে এত ভুল, আর সে স্ত্রী আবার ওঁদেরই মেয়ে! তার চেয়ে বললেই হয়—”

শচী বিরক্তির ভান করিয়া বলিল, “দেখ দেখি পাগলামি! কে আসছে তার ঠিক নেই, ক্রমাগতই বাজে কথা! আমার বোনটিরই দোষ দিচ্ছ, কিন্তু আসা পর্যন্ত তো দেখছি, তার কাছে মনটি প’ড়ে আছে, টান কার বেশি, তা তো বুঝতেই পারলাম না।”—বলিয়া মুখের দিকে চাহিয়া একটু ক্রুরভাবে হাসিল।

কথাটা সত্য। মোটরের ভাবনাটা মনের মধ্যে জাঁকিয়া থাকায় শেখর যে ক্রমাগত স্ত্রীর প্রসঙ্গ চালাইয়া আসিতেছে, সে বিষয়ে তেমন সতর্ক ছিল না, একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িল।

মলিনা ফুলের তোড়া বাঁধিতেছিল, গম্ভীর মুখে বলিল, “মা বলছিলেন না দিদি- আহা, দুটিতে মনের বেশ মিল আছে, ভগবানের ইচ্ছেয়।

শেখরের লজ্জার পালা পড়িয়াছে।

স্নেহভরে ভগ্নীর কাঁধে একটি হাত দিয়া দিদি বলিল, ‘আর বলছিলেন—মলিনারও ওই রকম একটি মনের মিলের বর হয়!”

“ধ্যাৎ”!…বলিয়া মলিনা মাথা নিচু করিল।

শচী বলিল, “চল, এবার গঙ্গার ধারে যাই, বাবা বোধ হয় ওই দিকে গিয়েই বসেছেন।”

মলিনা বলিল, “বাঃ, আর তোমার ব্ল্যাক্‌প্রিন্স দেখালে না? তা হ’লে কি ক’রে বলবেন যে—”

সরলপ্রাণা ভগ্নী ও চতুর ভগ্নীপতি মিলিয়া শখের ফুল দেখাইবার মত তাহার আর অবস্থা রাখে নাই। শচী লজ্জিতভাবে বলিল, “নাঃ, থাক্‌গে।”

ভগ্নী আবদার ধরিয়া বলিল, “না না, দেখাবে চল। আচ্ছা বাপু, আমি বলছি, আমার হিংসে হবে না, ভয় নেই।”

দিদির ব্রীড়াভারাক্রান্ত চোখ দুইটা অবাধ্যভাবেই একবার ভগ্নীপতির মুখের উপর পড়িল। চকিতে সে দুইটাকে ভূমিনত করিয়া বলিল, “পোড়ার বাঁদর মেয়ে!”

শেখর হাসিতে হাসিতে বলিল, “তোমার হিংসের ভয় করছেন না মলিনা, উনি ভয় করছেন বোধ হয় আমাদের হিংসের!”

“না, আমি চললাম। তোমরা দুই রসিকে থাক।”—বলিয়া কৃত্রিম রাগ দেখাইয়া শচী যাইবার জন্য পা বাড়াইতেই, উপস্থিতির একটা দীর্ঘ হর্ন দিয়া গেটের সামনে একটা মোটর আসিয়া দাঁড়াইল।

“কে এল?”—বলিয়া শচী গ্রীবা ঘুরাইয়া দাঁড়াইল। মলিনা “ওমা, মেজদিদি যে!” বলিয়া আগে সংবাদ দিবার জন্য বাড়ির দিকে ছুটিল। শেখর বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিল, “দেখলে তো দিদি?”

শ্যালিকা রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিয়া একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানিল। পর-মুহূর্তেই বলিল, “দাঁড়াও ভাই, আগে নামাইগে ওদের।”—বলিয়া দ্রুতপদে আগাইয়া গেল।

শেখর দুই-একটা গাছের আড়ালে আড়ালে একটু গা-ঢাকা দিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল।

শচী অরুণার কোল হইতে ডলিকে লইল, মন্টুর হাত ধরিয়া নামাইল, তাহার ভগ্নীকে বলিল, “এস, অগ্রদূত তোমার হাজির।”

অরুণা মোটর হইতে নামিল, ভগ্নীর রসিকতা বুঝিবার কোন চেষ্টা না করিয়া “সবাই ভাল আছ তো দিদি?” বলিয়া ভগ্নীর পদধূলি গ্রহণ করিবার জন্য প্ৰণত হইল।

এই সময়টিতে শেখর ঝোপের অন্তরাল হইতে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। মুহূর্তের মধ্যে মন্টু, “বাবা, বাবা! ও মা, বাবা গো!” বলিয়া আহ্লাদে চিৎকার করিয়া উঠিল এবং ডলিও মাসির কাঁধ বাহিয়া বাপের কোলে যাইবার জন্য ব্যগ্রভাবে দুইটি কচি হাত বাড়াইয়া দিল।

অরুণা চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং স্বামী-স্ত্রীতে চোখাচোখি হইল।

.

দুইজনে দাঁড়াইয়া রহিল যেন বায়স্কোপের দুইখানি ছবি, মুখে রা নাই, উগ্র বিস্ময়ের ভাব মুখ এবং সমস্ত শরীর দিয়া যেন ফুটিয়া বাহির হইতেছে। বিশেষ করিয়া শেখরের বিস্ময়টা চেষ্টাপ্রসূত বলিয়া আর্ট যেন তাহার মধ্যে মূর্তি ধরিয়া উঠিয়াছে। লোকটির থিয়েটারে নাম আছে, এই অরুণাই কত প্রশংসা করিয়াছে।

শেখর প্রথমে কথা কহিল, “তুমি হঠাৎ?”

অরুণা বেচারীর মুখে কোন কথাই যোগাইতেছিল না। অসহায়ভাবে বলিল, “হঠাৎ কি?”

শেখর একবার বক্র ইঙ্গিতে শ্যালিকার দিকে চাহিল। তাহার পর স্ত্রীর দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, “না, ঠিক হঠাৎ না বটে; কিন্তু তোমায় অত ক’রে বারণ ক’রে এলাম

স্ত্রী বিমূঢ়ভাবে বলিল, “কি বারণ করলে?”

মলিনা আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, শেখর এবার তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, “এই দেখ মলিনা, একেই বলে জ্ঞানশূন্য হওয়া, তোমায় এক্ষুনি বলছিলাম না। অর্থাৎ আমার আসবার কথায় তোমার দিদির মনটা এমনই বিকল হয়ে গিয়েছিল যে, এক ঘণ্টা ধরে যে ওকে বোঝালাম, সে সব কথা এক্কেবারেই মনে নেই।”

মলিনা আশ্চর্যে হাঁ করিয়া বলিল, “ও বাব্বা! হ্যাঁ দিদি?”

অরুণা শচীর দিকে চাহিয়া বলিল, “কি ব্যাপার বল দেখি দিদি?”

শচী স্পষ্ট কিছু না বুঝিলেও কিছু একটা কৌতুকের আভাস পাইয়া বলিল, “ব্যাপার তোমরাই জান ভাই। এখন চল, বাবা মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, পরে বোঝাপড়া হবে’খন।”

অরুণার চলিবার অবস্থাই ছিল না। স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিল, “তুমি এখানে হঠাৎ যে?”

স্বামী অবিচলিতভাবে বলিল, “এটা আমার শ্বশুরবাড়ি।”—যেন ভূতগ্রস্তের সঙ্গে কথা বলিতেছে, “মেলা কথা বলবার দরকার নাই।”

দুইজন মুখোমুখি হইয়া চুপ করিয়া রহিল। শেখরই মৌনতা ভঙ্গ করিল, “যাক, যখন এসে পড়েছ উপায় নেই। মেলা লজ্জা পেয়েই বা আর কি হবে? দিদিকে অনেকটা ব’লে রেখেছি তোমার রোগের কথা।”

অরুণা সোৎসুক নেত্রে তাহার দিদিকে প্রশ্ন করিল, “কি রোগের কথা দিদি?”

শেখর আবার কহিল, “তোমায় গিয়ে—–আসবার সময় চাবি কার কাছে—”

অরুণা গ্রীবা বাঁকাইয়া কহিল, “চাবি? চাবি তো তোমার হাতেই দিলাম তখন!”

শেখর ঈষৎ হাসিয়া মলিনার দিকে চাহিয়া কহিল, “দেখছ তো মলিনা? স্বামীকে না দেখতে পেলে এই রকমই হয়। অবশ্য তোমাদের বোনের একটু বাড়াবাড়িই দেখছি।”

স্ত্রীকে বলিল, “তুমি আসবার সময় আমার হাতটাই যে সেখানে ছিল না। অবশ্য মনটা কিছু কিছু ছিল,–কিন্তু—”

অরুণা দিদির দিকে চাহিয়া ব্যাকুলভাবে কহিল, “কি রোগের কথা বলেছে বল না দিদি? আমি বাপু, এ লোকের সঙ্গে আর পেরে উঠি না।”

দিদি তাহার হাতটা ধরিয়া আসিয়া বলিল, “বলছি। আরে, চল্ ওদিকে, বাবা মা এগিয়ে আসছেন, কি ভাবছেন জানি না।

চলিতে চলিতে বলিল, “রোগ আবার কি? বাবুদের ওটুকু না হলেও দিশেহারা হন, অথচ ঠাট্টা করা চাই। তুই একলাটি থাকতে না পেরে চ’লে আসবি, সেই কথাই আমায় বলা হচ্ছিল। তা এতে আর দোষ কি হয়েছে? আর তা ছাড়া সে ভালই করেছিস ভাই, আমায় একলা পেয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপে–-”

অরুণা গালে চারটি আঙুল চাপিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ক্ষণমাত্র চিন্তা করিল, স্বামীর দিকে সরোষ নেত্রে চাহিল। তাহার পর দিদির দিকে ফিরিয়া বলিল, “ও হরি! বুঝেছি। এতক্ষণ পরে সব কথা বুঝতে পেরেছি। কি মতলববাজ লোক ভাই! এইজন্যেই তখন বললে—ছ ঘণ্টার মধ্যে দেখা হবে।”

শেখর শ্যালিকাকে মধ্যস্থ মানিয়া বলিল, “কি করব শচীদি? যে রকম কাতরানি, চোখের জল। কাজেই ব’লে আসতে হয়েছিল—আজ রাত্রেই ফিরে আসব, ছ ঘণ্টার বেশি দেরি হবে না। একেবারেই কাছছাড়া হতে দেবে না।”

একটা কুটিল জবাব ঠোঁটে আসিল এবং কোন সঙ্গত উত্তর দিতে না পারায় রাগের মাথায় অরুণা সেইটাই দিয়া বসিল, বলিল, “হ্যাঁ ঠিকই তো, এক দণ্ড তোমাদের বিশ্বাস করে ছাড়া চলে না, তোমরা এমনই।”

শেখর দুঃখের অভিনয় করিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলিল, “ছি অরুণা, এটা এক হিসেবে ‘যে শচীদিদিকেও বলা হ’ল। কি মনে করবেন উনি বল দেখি।”

বিদ্রূপটা বুঝিতে না পারিয়া অরুণা বিস্ময়ে এবং ভয়ে চক্ষু বড় করিয়া কহিল, “ওমা, দিদিকে আবার কি বললাম! দেখ দেখি!”

দিদি বুঝিয়াছিল, ওদিকে বাবা মা কাছে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, আস্তে আস্তে বলিল, তোরা একটু চুপ কর বাপু, মুখুজ্জের মুখের কি কোন আড় আছে যে, ওর সঙ্গে তর্ক করছিস অরু?”

মন্টু গিয়া দিদিমার কোল দখল করিয়াছিল। অরুণার পিতা লাঠিতে ভর দিয়া আস্তে আস্তে আসিতেছিলেন, একটু দূর হইতেই বলিলেন, “বাঃ, অরুণাও এসেছে! বেশ হয়েছে। কিন্তু কই, শেখর আমায় কিছু বল নি তো?”

শচীই উত্তর দিল, “অরুর আসবার কোন ঠিক ছিল না বাবা তাই বলেন নি। ওর এক বন্ধু বেড়াতে এসেছিল, তাকে বিদায় ক’রে সময় থাকলে অরু মোটরে আসবে—এই রকম কথা ছিল।”

এর পরে যে প্রশ্ন হইবে, তাহার উত্তর শেখর পূর্ব হইতেই দিয়া রাখিল, “আমিও সঙ্গেই আসতাম। বিকেলে বদ্যিবাটিতে একটু কাজ ছিল, তাই আগেই বেরিয়ে পড়ি।”

তাহার জন্যই এইসব মিথ্যার সৃষ্টি—বিশেষ করিয়া দিদির তরফ হইতে। অরুণা লজ্জায় যেন পা উঠাইতে পারিতেছিল না। স্বামীটি পূর্বে আসিয়া আরও কি সব গাহিয়া রাখিয়াছে, সে কথা ভাবিয়া সে নিতান্ত অস্বস্তি বোধ করিতেছিল। দিদির তো একরকম ধারণাই জন্মাইয়া দিয়াছে যে, সে স্বামীর টানেই পিত্রালয়ে আসিয়াছে। ছি ছি সাংঘাতিক লোক—সব পারে!

কথাবার্তা, স্বামীর দিকে কখন মিনতির নরম চোখে চাহিয়া, কখন রাগের কড়া চোখ দেখাইয়া খুব সন্তর্পণে চালাইয়া গেল! শ্বশুর-শাশুড়ির কাছেও একটু-আধটু বেহায়াপনার ইঙ্গিত করিয়া দেওয়া ওর পক্ষে আশ্চর্য নয়। মনে মনে বলিল, “ঘাট হয়েছে বাপু, আর তোমার সঙ্গে লাগব না।”

জিরাইয়া কিঞ্চিৎ জলযোগের পর সকলে গঙ্গার ধারে বসিল। পিতা কিছুক্ষণ পরে উঠিয়া আসিলেন—জ’লো হাওয়া তাঁহার লাগানো মানা। মাতাও একটু পরে উঠিলেন। শেখর হাঁপাইয়া উঠিতেছিল, এইবার মুখ খুলিবার একটু সুযোগ পাইল।

কহিল, “আমাদের হিন্দু-ললনাদের সুখ্যাতি এতদিন ধ’রে যে কীর্তিত হয়ে এসেছে—”

অরুণা একবার মুখের দিকে সন্ধিগ্ধভাবে চাহিয়া বলিল, “আচ্ছা, হয়ে আসুকগে, তুমি থাম।”

“না, তোমার এই পাতিব্রত্যের নিদর্শনটুকু রেখেও যদি সেটুকুর কদর না করি তো ঘোর অকৃতজ্ঞতা—”

অরুণা উত্যক্ত হইয়া বলিল, “ওগো, আমি হার মানলাম, আমার ঘাট হয়েছে, আর দিদির সামনে বেহায়াপনা করো না, তোমার পায়ে ধরি।”

শেখর মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল; আস্তে আস্তে—যেন নিজের মনেই বলিল, “পায়ে ধরাটা শুনেছি নাকি আমাদেরই একচেটে হয়ে গেছে।”

আজ বিকালেরই কথা।

অরুণা একটু আড়ে না চাহিয়া পারিল না। কথাগুলা চাপা দেওয়ার জন্য বলিল, “আর তোমাদের অন্য কথা নেই দিদি?”

শচী বলিল, “মুখুজ্জে আজ আমাদের অতিথি, শুধু তোর চর্চা করতেই যদি আজ পছন্দ হয়ে থাকে তো কি ব’লে নিরাশ করি, বল?”

অরুণা বলিল, “কেন? আমিও তো এইটুকু এসেই কথা কইবার অনেক পেয়েছি। এই জায়গাটার কথাই ধরা যাক না—কেমন সুন্দর জ্যোৎস্না, খোলা গঙ্গার তীর, কি সুন্দর হাওয়া, আমার তো এই জায়গাটুকুর জন্যে

শেখর তাড়াতাড়ি বলিল, “তা ব’লে তুমি যেন আমাদের দুজনকে রেখে টপ ক’রে উঠে যেয়ো না শচীদি। অরুণা সে ভেবে বলছে না নিশ্চয়।”

সে হাসিতে লাগিল। শচীও হাসিয়া মুখ ফিরাইল। অরুণা হঠাৎ থমকিয়া দুইজনের দিকে চাহিল, তাহার পর স্বামীর গূঢ় বিদ্রূপ বুঝিতে পারিয়া লজ্জায় ও রাগে বলিয়া উঠিল, “না বাপু আমি চললাম। কোনখানে গিয়ে একটু সোয়াস্তি নেই। কে জানত বল, এখানেও আগে থাকতে এসে ব’সে আছে?”

শেখর শ্যালিকার দিকে চাহিয়া বলিল, “ওই কথাটি বোঝাবার জন্যে অরুণা কি রকম ব্যস্ত, দেখছ শচীদি? আমি তখনই ওকে বলেছিলাম—যেয়ো না, বড্ড লজ্জায় পড়ে যাবে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। বলে—সে আমি সামলে নোব’খন, কেউ বুঝতে পারবে না।”

অরুণা জ্বালাতন হইয়া বলিল, “বাবা বাবা! তোমার কি লজ্জা-শরম কিছু নেই গা?”

শেখর কহিল, “খুব আছে। তবে কিনা আসল কথাটা যদি না ব’লে দিই তো শচীদির মনে হতে পারে, এদের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। মিছিমিছি ভাবতে পারেন, মুখুজ্জে বোধ হয় ঝগড়াঝাঁটি ক’রে চ’লে এসেছে, তাই বোনটি পেছন পেছন ছুটে এসেছে।”

অরুণা ভিতরে ভিতরে যেন জর্জরিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার হার তো হইয়াছেই, যদি স্বীকার করিলে স্বামী অব্যাহতি দেয় তো সে রাজী। কিন্তু তাহার সুবিধা কই। আর ইতিমধ্যে অসহায়ভাবে সে কত বিদ্রূপবাণ সহ্য করিবে?

স্বামীর কথায় দম্ভ করিয়া বলিল, “ইস, ছুটে আসবে!” সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু দিদির দৃষ্টি এড়াইয়া একবার সকরুণ মিনতির নেত্রে চাহিল।

স্বামী নিষ্ঠুর বিজেতারই মত হাস্যকুটিল দৃষ্টি দিয়া তাহার মৌন উত্তর দিল। এই সময় পরাজয় স্বীকারের একটু সুবিধা হইল।

মলিনা ডলি আর মন্টুকে লইয়া অদূরে ছুটাছুটি খেলা করিতেছিল, ডলি কোল হইতে পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল। শচী মলিনাকে ধমক দিয়া ডলিকে তুলিয়া লইবার জন্য ছুটিয়া গেল।

অরুণা একবার চকিতে দেখিয়া লইল, আঘাত কিছু লাগে নাই। তারপর স্বামীর হাতটা খপ করিয়া ধরিয়া বলিল, “আমি হার মানছি গো, দয়ামায়া কি নেই একেবারে?”

স্বরটা ভারী হইয়া উঠিল।

হাতটা ছাড়িয়া দিয়া একটু সরিয়া গেল, অনুযোগের সুরে বলিল, “কি রকম বেহায়াপনা করছ বল দেখি তখন থেকে?”

শেখর বলিল, “ফিরে যেতে রাজী তো?”

“কখন?”

শেখর হাসিয়া বলিল, “ছ ঘণ্টা পরে।”

অরুণা অভিমান করিয়া বলিল, “এক্ষুনি চল না তার চেয়ে, বাবা-মার সঙ্গে ভাল ক’রে কথাবার্তাও হয় নি! আমার আবার বাপের বাড়ি আসা!’

বেশ কখন যাবে তুমিই বল না হয়—কাল সন্ধ্যেয়?”

“পরশু। অনেক দিন আসি নি।”

“এই কি হারের লক্ষণ?”

অরুণা চোখের কোণে চাহিয়া বলিল, “ইস, একজনের কাছে আমার হার আছে নাকি?”

শেখর একটু হাসিল, বলিল “বেশ তাই হবে; পরশুই রইল।”

মলিনা, মন্টু ও ডলিকে লইয়া শচী রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াইয়া ছিল। গঙ্গার নৌ- স্টীমার দেখাইয়া ডলিকে ভুলাইতেছিল—এদিকে দম্পতিকে একটু সুবিধা করিয়া দেওয়াই বোধ হয় মুখ্য উদ্দেশ্য।

খানিকক্ষণ চুপ করিয়া সামনের দিকে চাহিয়া শেখর বলিল, “বড় চমৎকার জ্যোৎস্নাটি।”

স্ত্রী ঘাড় বাঁকাইয়া একটু আড়ে চাহিয়া বলিল, “নাঃ, সে সব হবে না—দিদি এক্ষুনি যদি ফিরে চান?”

শেখর পত্নীর কাছে একটু সরিয়া গিয়া তাহার কাঁধ স্পর্শ করিয়া মৃদু স্বরে বলিল, “দিদি অতবড় বোকা নন—এটা বেশ জেনো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *