হার চোর – চঞ্চলকুমার ঘোষ

হার চোর – চঞ্চলকুমার ঘোষ

কথায় বলে, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। হরিপুর থানার বড়বাবুর ছেলের বউয়ের চার ভরির হার চুরি হয়েছে। বড়বাবু রাগে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো পায়চারি করছেন। থানার মেজবাবু আর ছোটবাবু যেখানে যত চোর, ছ্যাঁচোড়, সিঁধেল, ছিচকে, গাঁটকাটা, রোগা, ঢ্যাঙা, মোটা, পাতলা সকলকে থানায় এনে পুরেছেন।

বড়বাবু চার মাস হল হরিপুর থানায় বদলি হয়ে এসেছেন। ছেলে, ছেলের বউ কলকাতায় থাকে। আগের দিনই তারা হরিপুরে এসেছে। সকালে জানলার পাশে টেবিলের উপর হার খুলে স্নান করতে গিয়েছিল রমা, বড়বাবুর ছেলের বউ। চার ভরির পাথর বসানো সোনার হার। বিয়ের সময় ওই হার দিয়ে রমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন বড়বাবু। ইচ্ছে করলে ওই রকম আর-একটা হার কিনে দেওয়া কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু ঘর থেকে চোর এভাবে হার চুরি করে নিয়ে যাবে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বড়বাবু। তা ছাড়া, এর পর লোকের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে। সকলে বলবে, লোকটা নির্ঘাত থানায় বসে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। নয়তো নিজের ঘর থেকে চুরি হল আর চোর ধরা পড়ল। না। নতুন থানায় এসে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে। এস পি সাহেবের কানে গেলে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হবে।

সকাল থেকে ঘন ঘন সিগারেট টানছেন আর মাঝে মাঝে টেবিল চাপড়াচ্ছেন তিনি। গোটা থানা তটস্থ। লকআপে জায়গা নেই। মুরগির খাঁচার মতো অবস্থা। থিকথিক করছে চোর। মেজবাবু রীতিমতো ধমকধামক দিতে শুরু করেছেন, “কে চুরি করেছিস, বল। না হলে সব ক’টার পিঠের চামড়া গুটিয়ে ডুগডুগি বাজাব।”

সকলের মুখ আমসি। একটা বুড়ো চোর বলে, “বিশ্বাস করুন স্যার। চোর কখনও পুলিশের বাড়িতে চুরি করে না। আমাদেরও করে খেতে হয়। জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়ুল মারব?”

একটা ফচকে চোর পিছন থেকে বলে ওঠে, “গুরুর নিষেধ আছে, কখনও সেমসাইড করবে না। পুলিশ আর চোর মাসতুতো, পিসতুতো ভাই-ভাই। দু’জনে দু’দিক থেকে হাত সাফাই করে।”

মেজবাবু হাতের মোটা লাঠিটা তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওসব বাজে কথা অন্য সময় বলবি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বড়বাবুর হার চাই।”

“বড়বাবুর হার।” একজন ফিকফিক করে হেসে উঠল, “বড়বাবু কবে থেকে হার পরা শুরু করলেন স্যার?”

“বড়বাবুর হার নয়। বড়বাবুর ছেলের বউয়ের হার। পুরো চার ভরি, মাঝখানে মুক্তো বসানো।”

“ইস, কত দাম নিয়েছিল স্যার? যে ঝেড়েছে, ছ’মাস পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খাবে।”

“খাওয়াচ্ছি,” পিছন থেকে বড়বাবুর ডাক পেয়ে এগিয়ে গেলেন মেজবাবু।

মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন বড়বাবু। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু সন্ধান পেলেন?”

“পেয়ে যাব স্যার, আপনি কিছু চিন্তা করবেন। না। বাড়ি গিয়ে স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম করুন। হার পেলেই পৌঁছে দিয়ে আসব।”

“ততক্ষণ বউমার কাছে মুখ দেখাই কী করে বলুন তো? তারপর মনোরমা রয়েছে। তাকেই বা কী জবাব দেব?”

ছোট দারোগা গণেশ হাজরা নতুন চাকরি পেয়েছেন। সব ব্যাপারেই তাঁর উৎসাহ একটু বেশি। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, “আমি একবার আপনার বাড়ি ঘুরে আসব স্যার?”

মেজবাবু আড়চোখে একবার গণেশের দিকে তাকালেন, ভাবখানা, হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।

বড়বাবু বললেন, “দ্যাখো চেষ্টা করে।”

থানার গেট থেকে মিনিট চার-পাঁচ গিয়েই বড়বাবুর বাড়ি। বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক, বুড়োবুড়ি হাঁটুর ব্যথায় কাত। তাঁরা একতলায় থাকেন। দোতলায় বড়বাবু।

গণেশ হাজরা গেট খুলে বড়বাবুর বাড়ি ঢুকলেন। দোতলায় সিঁড়ির দরজা বন্ধ। বারকয়েক কড়া নাড়তেই বেজার মুখে দরজা খুলে দিলেন বড়বাবুর বউ মনোরমা।

“কী দরকার?” একেবারে বাঁশচেরা গলার। আওয়াজ।

“আজ্ঞে, স্যার পাঠালেন হার চুরির ইনকোয়ারি করতে।”

মুখ বেঁকিয়ে বড়বাবুর বউ বলে ওঠেন, “নিজের মুরোদে কুলেল না, তাই চেলা-চামুণ্ডাদের পাঠাল। শুধু মুখে হম্বিতম্বি।”।

গণেশ হাজরার পুলিশি সাহস উবে যাওয়ার অবস্থা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনোরমা। দু’বার ঢোক গিলে বললেন, “কার হার হারিয়েছে?”

মনোরমার পাশে এসে দাড়াল অল্পবয়সি একটি বউ। মনোরমা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, “এই আমার ছেলের বউ রমা। ওর হার চুরি হয়েছে।”

“বুঝেছি, হারটা ঠিক কোথায় ছিল?”

রমা বলে, “আমার শোওয়ার ঘরে।”

“একবার যাওয়া যাবে?”

“আসুন।”

মনোরমার পিছন পিছন ঘরে ঢুকলেন গণেশ। গোটা ঘরটাই লন্ডভন্ড।

“ঘরের এ অবস্থা করল কে?”

“কে আবার করবে? আমরা শাশুড়ি-বউ করেছি। যার সোনা হারায়, সে বোঝে।”

চাপা গলায় গণেশ বললেন, “সে আমরা ভাল বুঝি। স্বামী হারালেও এমন করে খোঁজে না। তা হারটা কীসের উপর ছিল।”

জানলার পাশে ছোট একটা টেবিল। রমা বলল, “এই টেবিলের উপর ছিল।”

গণেশ হাজরা তাকালেন। জানলার গায়ে লাগানো টেবিল। বাইরে থেকে হাত বাড়ালেই তুলে নেওয়া যাবে। দোতলার জানলা। বাইরে দাঁড়াবার কিছু নেই। ঘরে ঢোকার সময়ই লক্ষ করেছিলেন। “তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, জানলা দিয়ে কেউ হাত বাড়িয়ে গয়না নেবে না। একমাত্র যদি কেউ মই লাগিয়ে ওঠে।”।

কথাটা বলতেই মনোরমা রেগে ওঠেন, “এতদিন জানতাম, আমার কর্তাটির মাথায় গোবর পোরা। এখন দেখছি, যারাই পুলিশে চাকরি করে সকলের মাথায় গোবর পোরা। দিনের বেলায় চোর একটা বড় মই নিয়ে আসবে, জানলায় উঠবে, তারপর গয়না নেবে, মই ঘাড়ে করে নিয়ে আবার চলে যাবে। চোর কী করে জানবে, আমার বউমা ওই সময় গয়না খুলে বাথরুমে চান করতে যাবে? চোর কি জ্যোতিষী না গনতকার?”

“আমি চান করে এসেই দেখি হার নেই।”

“সেই সময় বাইরের কেউ ঢোকেনি তো?”

“সিঁড়ির দরজা বন্ধ। লোক ঢুকবে কী করে?”

“আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

“পুলিশের বউ বলে কি আমিও পুলিশ যে, দুনিয়াসুদ্ধ লোককে সন্দেহ করব?” ভেটকি মাছের মতো ঝটকে উঠলেন মনোরমা।

গণেশ হাজরা বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন, “আচ্ছা, এ বাড়িতে আর কে থাকেন?”

“আমরা কর্তা, গিন্নি আর বউমা। ছেলে কাল বউমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছে।”

“কাজের লোক?”

“একটা ঠিকে কাজের মেয়ে আছে, সে সকালে কাজ করে দিয়ে চলে যায়।”

“সে হার নেয়নি তো?”

রমা তাড়াতাড়ি বলে, “কী করে নেবে? হার তখন আমার গলায়।”

পুরো ব্যাপারটাই কেমন জটিল হয়ে আসছিল গণেশ হাজরার কাছে।

“তা হলে হারটা চুরি করল কে?”

মনোরমা বিরক্ত মুখে বলেন, “সেটা যদি আমরাই খুঁজে বের করতে পারব, তবে সরকার বাহাদুর গুচ্ছের টাকা দিয়ে আপনাদের পুষছেন কেন?”

গণেশ হাজরা বুঝতে পারছিলেন, এখানে আর সুবিধে হবে না। তাড়াতাড়ি বললেন, “আমি আসি বউদি। যা দেখার, দেখে নিয়েছি।” আর কিছু শোনার আগেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলেন। বুকের মধ্যে তখনও ধড়াস ধড়াস করছে। এই মহিলাকে নিয়ে কী করে বড়বাবু এত বছর সংসার করছেন, ভাবা যায় না। সাক্ষাৎ মা কালী। একেবারে খড়গহস্ত। দরজা ভেজিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। গণেশ হাজরা। গোটা বাড়িটা একবার চক্কর দিয়ে নিলেন। চারদিকে পাঁচিল, সামনে বড় রাস্তা। মই দিয়ে উঠবে, সে উপায় নেই। কেউ মই লাগালে লোকের চোখে পড়বেই। জানলার ধারে পাশাপাশি দুটো ঝাউ গাছ রয়েছে। এক সরু কাঠবিড়ালি ছাড়া কেউ সেখানে উঠতে পারবে না। সব যেন গোলকধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। এখন থানায় গিয়ে বড়বাবুকে কী বলবেন! মেজবাবু সেঁতো হেসে জিজ্ঞেস করবেন, “তদন্তের কাজ কত দূর এগোল?”

বেলা দুপুর। মাথার উপর রোদ ঝাঁঝাঁ করছে। ঘেমেনেয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। থানায় না গিয়ে বাড়ি ঢুকে পড়লেন গণেশ হাজরা। স্নান-খাওয়া সেরে একেবারে থানায় যাবেন। ঘরের সামনে আসতেই শ্যালকবাবুর গলার আওয়াজ পেলেন। মাসের শেষ। এই সময় পকেট প্রায় গড়ের মাঠ। এর আগেও গণেশ দেখেছেন, বেছে বেছে এই সময়টাতেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসে। কিছু বলার উপায় নেই। বউয়ের ভাই বলে কথা। একেবারে মুখ হাঁড়ি হয়ে যাবে বউয়ের। দরজা খোলা। ঘরে ঢুকতেই শ্যালকবাবুর মুখে হাসি।

“আসুন জামাইবাবু, আপনার জন্যই বসে আছি।”

রাগে গা জ্বলতে থাকে। আমার বাড়িতে আমাকেই অভ্যর্থনা করা হচ্ছে! সে-কথা বলার উপায় নেই। কষ্ট করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “কখন এলে!”

শ্যালকবাবু কিছু জবাব দেওয়ার আগেই গণেশের বউ সুলতা বলল, “সকালেই রন্তু এসেছে।”

রন্তুর ভাল নাম রন্তিস রায়। বি এসসি পাশ করে ব্যোমকেশের মতো এখন শখের গোয়েন্দা। দু-চারটে রহস্য ভেদ করে অল্পস্বল্প নামও করেছে। যদিও শ্যালকের গোয়েন্দাগিরিতে এতটুকু বিশ্বাস নেই গণেশের।

রন্তু একপলক গণেশের দিকে তাকিয়ে বলল, “জামাইবাবুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ছোটখাটো কোনও গাড্ডায় পড়েছেন।”

“ছোটখাটো নয়। একেবারে বড় গাড়ায় পড়েছি।”

“ব্যাপারটা কী? খুলে বলুন তো দেখি, আপনাকে কোনও সাহায্য করা যায় কি না।”

অন্য সময় হলে শ্যালকবাবুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন। আজ আর সাহস হল না। ফ্যানের তলায় ধপ করে বসে পড়লেন। সামনে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিক জল খেয়ে বললেন, “বড়বাবুর ছেলের বউয়ের সোনার হার চুরি গিয়েছে।”

হাততালি দিয়ে ওঠে রন্তু, “ব্ৰেভো। চোরের এলেম আছে বলতে হবে। দেখা হলে পায়ের ধুলো নিতাম।”

“তুমি ঠাট্টা করছ। এদিকে বড়বাবু একেবারে ফায়ার হয়ে গিয়েছেন।”

“ব্যাপারটা খুলে বলুন তো।”

একটু চুপ করে থেকে আগাগোড়া গোটা বৃত্তান্তটা বলে গেলেন গণেশ। কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকে রন্তু।।

“কেসটা একটু জটিল বলেই মনে হচ্ছে। বাইরের কেউ নিশ্চয়ই ঘরে ঢুকেছিল। না হলে হারটা আপনাআপনি ভ্যানিশ হতে পারে না।”

“বাইরের লোক ঢুকবে কেমন করে? দরজা বন্ধ। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নেওয়ার উপায় নেই।”

“আমি একবার বড়বাবুর বাড়ি যেতে পারি?”

আঁতকে উঠলেন গণেশ, “বাঘের খাঁচায় যেতে রাজি আছি। ওখানে আর না।”

পাশ থেকে সুলতা বলল, “যত সব ভিতুর ডিম। আমি তোকে নিয়ে যাব।”

গণেশ বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সেই ভাল হবে। দুঃখের সময় একটু সমবেদনা জানাতে পারবে।”

দুপুরবেলায় শুয়ে ছিলেন মনোরমা। পাশের ঘরে রমা শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, কী করে শ্বশুরের কাছ থেকে ওই রকম আর-একটা হার বাগানো যায়।

সুলতা আগেও কয়েকবার এসেছে বড়বাবুর বাড়ি। দরজা খুলে দিয়েই বিরক্ত মুখে তাকালেন মনোরমা। কিছু বলার আগেই সুলতা বলল, “খবরটা শুনেই মনটা এমন খারাপ হয়ে গেল দিদি।”

বিড়বিড় করেন মনোরমা। যত সব আদিখ্যেতা। জিনিস হারাল আমার, মন খারাপ হল ওর। মনের রাগ মনে চেপেই বললেন, “এসো ভাই, কপাল খারাপ, না হলে ঘর থেকে পাখা মেলে হার উধাও হয়ে গেল! তোমার সঙ্গে এই ছেলেটি কে?”

“আমার ছোট ভাই রন্তু।”

ঝপ করে প্রণামটা সেরে ফেলল রন্তু। জানে, প্রণাম করলে সবাই সন্তুষ্ট।

“দিদির কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। মনে হল, এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাড়ানোটা আমাদের কর্তব্য। চুরিটা ঠিক কোন জায়গায় হয়েছিল?”

“কেন, তুমিও কি তোমার জামাইবাবুর মতো ইনকোয়ারি করবে?”

“না, সেরকম কিছু নয়, তবে একটা সন্দেহ হচ্ছে, দেখা যাক সেটা সত্যি কি না। যখন হারটা খুলে রেখে বউদি চান করতে গেলেন, তখন আপনারা ছাড়া ঘরে আর কেউ কি ছিল?”

“না।”

“ঘরে ঢোকার সদর দরজা ছাড়া আর কোনও দরজা আছে?”

“ছাদের একটা দরজা আছে। তবে সেটা বন্ধ থাকে।”

ভিতর থেকে রমা বের হয়ে এসেছিল। পরিচয় করিয়ে দিতেই রন্তু জিজ্ঞেস করল, “বউদি, আপনি যখন চান করে এসে দেখলেন হার নেই, তখন অস্বাভাবিক কিছু কি আপনার চোখে পড়েছিল?”

“খেয়াল করিনি।”

“ভালভাবে মনে করার চেষ্টা করুন। জানলা থেকে কিছু দেখেছিলেন?”

রমা তাড়াতাড়ি বলল, “মনে পড়েছে। হারটা না পেয়ে সামনে গেলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে ঝাউগাছটা খুব দুলছিল।”

“আর কিছু?”

“মনে হল, কেউ একটা জানলার কারনিসের উপর লাফ দিল।”

রন্তু এগিয়ে গিয়ে জানলার উপর নাক রেখে কিছু শোকার চেষ্টা করল। পিছনে তিনজন হাঁ করে চেয়ে থাকল। শুধু সুলতা জিজ্ঞেস করল, “হার কি পাওয়া যাবে?”

কোনও জবাব দিল না রন্তু। জানলার উপর ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। তারপর দু’আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে কিছু একটা তুলে ধরল। সবাই বড় বড় চোখে তাকাল, একটা আঙুল খানিক লম্বা চুল।

“এই চুলটা কার?”

মনোরমা বলেন, “আমাদের কারও হবে।”

মাথা নাড়ে রন্তু, “আমার মনে হচ্ছে না। এ চুলের রং বাদামি।”

সুলতা গম্ভীর গলায় বলল, “হার খুঁজতে এসে তুই চুল খুঁজে বের করলি!”

রন্তু চুলটা দেখতে দেখতে বলল, “আসল গোয়েন্দারা এই সব ছোটখাটো জিনিস থেকেই রহস্য ভেদ করে।”

“তার মানে ওই চুল থেকেই তুই রহস্য ভেদ করবি?”

দিদির কথার কোনও জবাব দিল না রন্তু। জানলা দিয়ে এক পলক বাইরে চারদিকে তাকিয়ে বলল, “চোর এই জানলা দিয়ে হার নিয়েছে।”

“নিল কেমন করে?”

“ধীরে ধীরে সব জানতে পারবি। এখন একটা বড় মই দরকার। বাইরে থেকে এই জানলায় উঠতে হবে।”

মনোরমা আর রমার কৌতুহল বাড়ছিল। মনোরমা বললেন, “থানায় বড় মই আছে। দাঁড়াও, আমি ফোন করে দিচ্ছি।”

রমা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “হার পাওয়া যাবে তো?”

রন্তু মুচকি হেসে জবাব দিল, “হার না পাওয়া গেলেও চোরের সন্ধান পাওয়া যাবে।”

রমা ঠোঁট উলটে বলল, “তাতে আমার কী লাভ হবে?”

মনোরমা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তখন বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু ছুটবেন চোর ধরতে।”

সুলতা বলল, “আর, চোরকে পাওয়া গেলেই হার পাওয়া যাবে।”

রন্তু মাথা নাড়ে, “হুঁ-হুঁ, এ চোরকে ধরা থানার কর্তাদের কম্মো নয়। দিদি, এখন তাড়াতাড়ি মইটা আনতে বলুন।”

খানিক পরেই একসঙ্গে বড়বাবু, মেজবাবু,। ছোটবাবু এসে হাজির। পিছনে লম্বা মই নিয়ে চারজন পেটমোটা পুলিশ। তার পিছনে বন্দুক নিয়ে আরও চারজন। ঘরে ঢুকেই বড়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “চোর কোথায়? চোর কোথায়?”

মনোরমা মুখ ভেঙান। “চোর যেন আমার আঁচলের তলায় বসে আছে। উনি আসবেন আর সঙ্গে সঙ্গে বের করে দেব। এই বুদ্ধি নিয়ে থানার বড়বাবু হয়েছেন!”

বউয়ের সামনে এলেই বড়বাবু যেন কেমন কুঁকড়ে যান। আমতা আমতা করে বললেন, “তবে মই কী হবে?”

“এর দরকার।”

রন্তুর দিকে চোখ পড়তেই বড়বাবু বললেন, “তুমি কে হে ছোকরা?”

তাড়াতাড়ি গণেশ জবাব দিলেন, “স্যার, আমার শ্যালক।”

“মই দিয়ে কী করবে?”

“তোমার অত খোঁজে কী দরকার?” ধমকে উঠলেন মনোরমা।

রন্তু জানলার সামনে এসে বলল, “এইখানটায় মই লাগান। আমি উপরে উঠছি।”

দেওয়ালের গায়ে মই। চারজন পুলিশ মই ধরে আছে। চারজন পুলিশ অ্যাটেনশন হয়ে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু উর্ধ্বমুখী হয়ে চেয়ে আছেন। মেয়েরাও বেরিয়ে পড়েছেন, রাস্তায় লোক জমতে শুরু করেছে।

মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল রন্তু। কারও চোখের পলক পড়ে না। মইয়ের মাথায় উঠে একবার চারদিকটা দেখে নিল। মাথার উপরে কারনিস। সোজা কারনিসের উপরে হাত বাড়িয়ে দিল। নীচে সকলে উত্তেজনায় টানটান। কী হয়, কী হয় ভাব!

দু’-চারবার হাতটা এদিক-ওদিক করেই চেঁচিয়ে উঠল রন্তু, “পেয়েছি পেয়েছি।”

তারপরই হাতটা সামনে আনতেই বড়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওই তো বউমার হার।”

রন্তু হার নিয়ে নীচে নামতেই বড়বাবু বললেন, “পুলিশে ঢুকলে তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।”

“ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়। বলো, একেবারে ঝাঁঝরা, ঠিক তোমার মতো।”

বউয়ের দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন বড়বাবু।

সুলতা ভাইয়ের হাত ধরে বলে ওঠে, “তুই কী করে জানলি, ওখানে হার আছে?”

রন্তু মুখটা গম্ভীর করে বলল, “যখন জানলাম চোর জানলা দিয়ে ঢুকেছে, তখনই সন্দেহ হল। এটা মানুষের কাজ নয়, একমাত্র বাঁদরই পারে ওই রকম সরু গাছ বেয়ে উঠে আসতে। আর গাছটা জানলার গায়ে। গাছ দোলার কথা শুনে আর লোমটা দেখে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। মনে হল, হারটা যখন খাওয়ার জিনিস নয়, বাঁদরটা ওটাকে কাছাকাছি কোথাও ফেলে দেবে। অনুমান করে কারনিসে উঠলাম।”

মনোরমা বললেন, “ক’দিন ধরে দেখছিলাম, একটা বাঁদর এ পাড়ায় ঘুরছে। এ তা হলে ওই বাঁদরব্যাটার বাঁদরামি৷”

বড়বাবুর মুখে মুচকি হাসি। পাশে দাঁড়িয়ে মেজবাবু। বড়বাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে স্যার যাদের লকআপে রেখেছি?”

“চা-বিস্কুট খাইয়ে ছেড়ে দিন।”

“আর বাঁদরটাকে?” কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।

“তাকেও চা-বিস্কুট খাইয়ে দিক,” মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠেন মনোরমা, “ভাগ্যিস ছেলেটা এসেছিল! হলে হারটা পাওয়া যেত না। বিনা দোষে লোকগুলো সারাদিন আটকা পড়ে থাকত। যত সব অপদার্থের দল।”।

৫ জুন ২০১১

অলংকরণ : অনুপ রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *