হারানো চিঠি
সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা-কাচ্চারা বড় টেবিলটা ঘিরে পড়তে বসেছে। এই বাসায় বাচ্চা কাচ্চাদের অন্য কোনো নিয়ম নেই, শুধু এই একটা নিয়ম রয়েছে–সন্ধেবেলা সবাইকে পড়তে বসতে হবে। পড়তে বসে আসলেই পড়ার বই পড়ছে নাকি রগরগে ডিটেকটিভ বই পড়ছে সেটা কেউ খোঁজ করে দেখে না। তবে যারা বড় তারা ছোটদের দিকে নজর রাখে যেন কেউ বেশি বেলাইনে চলে না যায়।
টেবিলে টুনি বিশাল একটা ইংরেজি বই নিয়ে বসেছে, সেটা দেখে শান্ত ধমক দিয়ে বলল, “এই টুনি তুই কী পড়ছিস?’
টুনি বইয়ের মলাটটা দেখে বলল, “হিউম্যান সাইকোলজি।”
শান্ত আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, “পড়ার সময় পাঠ্যবই পড়ার কথা। আলতু ফালতু বই পড়ার কথা না।”
টুনি বলল, “আমার পড়া শেষ। হোমওয়ার্ক কমপ্লিট।”
“সেইজন্যে আলতু ফালতু বই পড়বি?”
“এটা মোটেও আলতু ফালতু বই না।”
টুনি গম্ভীর গলায় বলল, “এটা সাইকোলজির ওপরে ক্লাসিক একটা বই।”
“কোথায় পেয়েছিস এই বই?”
“আম্মু এনেছে।”
“তোর আম্মু নিজে পড়ার জন্যে এনেছে। তোর জন্যে তো আনে নাই? তুই পড়ছিস কেন?”
বাসার কেউই শান্তর কথাবার্তা শুনে কখনোই অবাক হয় না, তাই টুনিও অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করল, “কেন? পড়লে কী হয়?”
শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, “অনেক কিছু হয়। সিস্টেম নষ্ট হয়।”
টুনি কখনোই কোনো কিছুতে বেশি অবাক হয় না, তার পরেও আজকে সে বেশ অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সিস্টেম নষ্ট হয়?”
“হ্যাঁ।” শান্ত গলার স্বর আরো গম্ভীর করে বলল, “সিস্টেম হচ্ছে ছোটরা পড়বে ছোটদের বই। বড়রা পড়বে বড়দের বই। তুই পড়িস ক্লাস ফাইভে–”
টুনি বাধা দিল, বলল, “সেভেন।”
“একই কথা।”
“মোটেও একই কথা না। দুই বছরের পার্থক্য।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে। তুই পড়িস ক্লাস সেভেনে, তুই কেন এত মোটা ইংরেজি উওম্যান সাইকোপ্যাথি বই পড়বি।”
“উওম্যান সাইকোপ্যাথি না। হিউম্যান সাইকোলজি।”
“একই কথা।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “একই কথা না। হিউম্যান সাইকোলজি হচ্ছে মানুষের ব্রেন আর মন কীভাবে কাজ করে তার ওপরে বই।”
“ঠিক আছে।”
শান্ত মেঘস্বরে বলল, “তুই কেন এত অল্প বয়সে এরকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়বি?”
“পড়লে কী হয়?”
“তুই জানিস না কী হয়?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না।”
“এখন যদি বড়রা কেউ হাজির হয় তাহলে কী দেখবে?” শান্ত মুখ ভেংচে, বলল, “দেখবে আমাদের এই ছোট টুনি চোখে চশমা পরে এরকম মোটা কঠিন একটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছে। তখন আমাদের বলবে, তোরা এত বড় দামড়া হয়েছিস এখনো আলতু-ফালতু ডিটেকটিভ বই পড়িস, আর এই দ্যাখ আমাদের জ্ঞানী-গুণি টুনি মহারানি এখনই কত মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়া শুরু করেছে।”
শান্ত কথাটা শেষ করার সময় জ্ঞানী-গুণী টুনি মহারানি’ কথাটার ওপর আলাদা করে জোর দিল।
টুনি একটু অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত তার গলায় আরো কয়েক কেজি বিষ ঢেলে বলল, “বড় মানুষেরা তখন বলবে আমাদের টুনি এখনই এই রকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়ছে, যখন আরেকটু বড় হবে তখন নির্ঘাত আস্ত ডিকশনারি পানিতে ভিজিয়ে কোঁৎ করে গিলে ফেলবে–”
টুনি এই বারে শান্তকে কথার মাঝখানে থামাল, বলল, “না, বলবে না।”
“বলবে না?”
“না।”
“কেন বলবে না?”
“তার কারণ আমি এই মোটা মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছি না। শুধু এর ছবি দেখছি।”
“শুধু ছবি দেখছিস?”
“হ্যাঁ।”
মনে হলো শুধু ছবি দেখছে শুনে শান্ত একটু শান্ত হলো। কিন্তু তারপরেও সে ছেড়ে দিল না, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শুধু ছবি দেখলে পড়ার মতো ভান করছিস কেন? সবার সামনে ভাব দেখাচ্ছিস?”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, একটা ছবি দেখলে ছবিটা কিসের বোঝা যায় না। ছবিটার নিচে লেখা থাকে ছবিটা কীসের। সেই লেখাটা পড়তে হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি তখন বইটা তুলে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল, “এই দেখো একটা বাচ্চার ছবি। এটা দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে না। যদি এর নিচে কী লেখা আছে সেইটা পড় তাহলে বুঝবে এইটা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম অটিস্টিক বাচ্চার ছবি।”
“দেখি দেখি–” বলে সবাই টেবিলে ঝুঁকে পড়ে পৃথিবীর প্রথম পাওয়া অটিস্টিক বাচ্চার ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখল।
টুনি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আরেকটা ছবি বের করে দেখিয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে মিলগ্রাম আর এইটা হচ্ছে মিলগ্রামের মেশিন।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “মিলগ্রামের মেশিন কী করে।”
টুনি বলল, “ইলেকট্রিক শক দেয়।”
টুম্পা বলল, “সত্যি? ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মেশিন আছে?”
টুনি বলল, “সত্যি সত্যি ইলেকট্রিক শক দেয় না। শক দেওয়ার ভান করে।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন ভান করে।”
টুনি গম্ভীর মুখে বলল, “সেইটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। কিন্তু শান্ত ভাইয়া, তুমি বলেছ আমার মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়া নিষেধ।”
শান্ত একটু থতমত খেয়ে গেল কিন্তু টুনির কথার উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না। এতক্ষণে আরো অনেকে টুনির মোটা ইংরেজি বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, টুম্পা একটা ছবির ওপর আঙুল রেখে বলল, “এইটা কীসের ছবি?”
টুনি বলল, “এটা একটা ক্লাসরুমের ছবি। একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে।”
“কেন একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে?”
“এটাও ভান। ছাত্রটা একটিং করছে, দেখার জন্য কতজন ঘটনাটা ঠিক করে দেখে।”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “কতজন ঠিক করে দেখে মানে কী? সবাই তো ঠিক করে দেখবে।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্! কেউই ঠিক করে দেখবে না।”
“মানে?”
“মানে সবাই নিজের মতো করে দেখবে। যার যেটা দেখার ইচ্ছা সে সেইটা দেখবে।”
“কী বলছিস তুই? তোর বইয়ে তাই লেখা?”
“হ্যাঁ। সেইজন্যে যখন কোনো ঘটনা ঘটে যায় আর অন্যেরা বলে আমি স্পষ্ট নিজের চোখে দেখলাম, তাদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না।”
শান্ত টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “তোর বইটা বিশ্বাস করা ঠিক না। উল্টাপাল্টা কথা লিখা।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
টুনি এত সহজে শান্তর কথা মেনে নেবে শান্ত সেটা আশা করে নাই, সে ভাবছিল টুনি শান্তর সাথে এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে। তর্ক করা শান্তর খুব প্রিয় কাজ। একা একা তর্ক করা যায় না কিন্তু শান্ত তবু চেষ্টা করল, গলা উঁচু করে বলল, “যে বইয়ে লেখা যে একটা ঘটনা নিজের চোখে দেখলেও সে ঠিক জিনিস দেখবে না, তার যেটা ইচ্ছা সেইটা দেখবে–সেই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আগুন ধরানো উচিত।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আগুন দেওয়ার আগে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে নিও। আম্মু অনেক টাকা দিয়ে বইটা কিনেছে।”
“কেমন করে এই বইটা লিখল?”
শান্ত তবুও গজর গজর করতে থাকে, “একটা জিনিস চোখের সামনে হবে কিন্তু কেউ দেখবে না?”
শান্তর কথাকে কেউই বেশি গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যেহেতু অনেকক্ষণ থেকে সে বকর বকর করছে, শাহানা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “শান্ত, কেউ যখন একটা বই লিখে তখন সে বুঝে-শুনে লিখে। কী লিখেছে, কেন লিখেছে সেটা যদি জানতে চাস বইটা পড়ে দ্যাখ।”
“কক্ষনো না।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এরকম উল্টাপাল্টা বই আমি পড়ব? আমি কী এত বোকা নাকি।”
শাহানা বলল, “না তুই মোটেও এত বোকা না। সেইটাই হচ্ছে সমস্যা।
টুনি এরকম সময় বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কই যাস?
“পানি খেতে।”
শান্ত হা হা করে হাসল, বলল, “এই মোটা জ্ঞানের ইংরেজি বই পড়তে গিয়ে তোর গলা শুকিয়ে গেছে!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয়।”
পানি খেতে যেটুকু সময় লাগার কথা টুনির তার থেকে বেশ খানিকটা সময় বেশি লাগল। বোঝা গেল সে শুধু পানি খায়নি আরো কিছু করে এসেছে। তবে কী করে এসেছে সেটা তখন কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।
শান্তর যেহেতু পড়ায় মন নেই তাই সে কিছুক্ষণ টুম্পাকে জ্বালাতন করে মুনিয়ার পেছনে লেগেছে, ঠিক তখন হঠাৎ বাইরে ঝুমু খালার চিৎকার শোনা গেল, “মার! মার, ইবলিশের বাচ্চারে মার!” তারপরে আঁটার ঝপাং ঝপাং শব্দ শোনা গেল।
ঝুমু খালা কাকে এভাবে ঝটা পেটা করছে দেখার জন্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঝুমু খালা ঝাঁটা দিয়ে কিছু একটাকে পেটাতে পেটাতে তাদের ঘরে ঢুকে গেল। যে প্রাণীটাকে ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে ঝুমু খালা মারার চেষ্টা করছে সেটা নিশ্চয়ই ঘরের ভেতর এঁকে বেঁকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ ঝুমু খালা নিজেও এঁকে বেঁকে সেটাকে মারার চেষ্টা করে চিৎকার করতে লাগল, “মার। মার বদমাইশের বাচ্চারে মার! খুন করে ফেলব আমি!”
যাকে খুন করার চেষ্টা করছে প্রাণীটা নিশ্চয়ই অনেক চালু, কারণ সেটা এঁকে বেঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঝুমু খালা সেটাকে ঝাঁটাপেটা করার চেষ্টা করতে করতে পিছু পিছু বের হয়ে গেল। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ঝুমু খালা ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছে।
আবার যখন সবাই টেবিলে এসে বসেছে শান্ত বলল, “বাপরে বাপ, কত বড় ইন্দুর দেখেছিস?’
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ইন্দুর অনেক ভয় করে।”
“ভয়ের কিছু নাই, ঝুমু খালা নিশ্চয়ই ইন্দুরকে সাইজ করে ফেলবে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “হঁদুরটা কী কালো ছিল, নাকি ছাই রংয়ের ছিল?”
শান্ত বলল, “কালো কুচকুচে কালো।”
টুম্পা বলল, “সাদা।”
প্রমি বলল, “ছাই রংয়ের।”
শাহানা মুচকি হেসে বলল, “শান্ত দেখেছিস। ঘটনাটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, ইঁদুরটার রং কী ছিল!”
শান্ত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “পারব না কেন? এক শবার পারব। কালো রংয়ের। বললাম তো।”
“সবাই কালো বলছে না। একেকজন একেকটা বলছে।”
“কেউ যদি ভালো করে না দেখে সেটা আমার দোষ?”
টুনি, “ঠিক আছে, তাহলে বলো ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল?”
শান্ত একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “ইয়ে মানে আমি আসলে ইন্দুরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম তো তাই শাড়ির রংটা খেয়াল করি নাই।”
“তবুও নিশ্চয় দেখেছ। মনে করার চেষ্টা করো।”
শান্ত চোখ সরু করে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “তুই কী করার চেষ্টা করছিস?”
টুনি বইটা দেখিয়ে বলল, “এই বইটা বলেছে মানুষের সামনে কোনো ঘটনা ঘটলেও মানুষ নিজের মত করে দেখে। তারা মনে করে যে দেখেছে, আসলে দেখে না। সেইটা সত্যি কীনা এক্সপেরিমেন্ট করছি। বল ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল।”
টুম্পা বলল, “সবুজ।”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হুম মনে হয় সবুজ।
টুনি বলল, “ঠিক আছে চল, ঝুমু খালার কাছে গিয়ে দেখি কী রংয়ের শাড়ি পরে আছে।”
“চল।” সবাই উঠে দাঁড়াল কিন্তু তাদের আর যেতে হলো না কারণ ঝুমু খালা নিজেই তখন চলে এসেছে। কোনো একটা কারণে তার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি। ঝুমু খালার পরনে একটা হলুদ ডোরা কাটা শাড়ি, সেটা মোটেও সবুজ না।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, এখন তোমার বিশ্বাস হলো যে তোমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে কিন্তু তবু তুমি সেটা ঠিক করে দেখ নাই।”
শান্ত তবুও মানতে রাজি হলো না, বলল, “আসলে আমি ইন্দুরটার দিকে তাকিয়েছিলাম সেই জন্যে ঝুমু খালার শাড়িটার রং খেয়াল করি নাই।”
“ঠিক আছে। ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল?”
“কালো। কুচকুচে কালো।”
টুনি ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে ঝুমু খালা, তুমি বলো ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল। কালো?”
ঝুমু খালা হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগল। শান্ত একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো ঝুমু খালা, তুমি হাসো কেন? বল, ইন্দুরটা কী রংয়ের ছিল?”
ঝুমু খালা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “কোনো ইন্দুর আছিল না। আমি খালি একটিং করছি। ভাব দেখাইছি একটা ইন্দুর মারতাছি।” তারপর আবার হি হি করে হাসতে লাগল।
শান্ত হা করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কোনো ইন্দুর ছিল না?”
“না। এই বাসায় ইন্দুর নাই।”
“তাহলে—তাহলে–”
“টুনি গিয়া আমারে জিগাইল আমি কী একটা ইন্দুর মারার একটিং করবার পারমু কী না। সেই জন্যে কইরা দেখাইলাম। কেমন হইছে আমার একটিং?”
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “অনেক ভালো হয়েছে ঝুমু খালা।” তারপর কেমন জানি বোকার মতো হাসতে লাগল।
ঝুমু খালার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠে, “ভালো হইছে?”
“হ্যাঁ।” শান্ত মাথা নাড়ল, “ঝুমু খালা, তুমি টেলিভিশনের নাটকে একটিং করতে পারবে।”
অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, কথাটি সত্যি। ঝুমু খালার ইঁদুর মারা নাটকের অভিনয় অনবদ্য। ইচ্ছে করলেই সে টেলিভিশনে একটিং করতে পারবে। বিশেষ করে কাউকে ঝাড়পেটা করার চরিত্রে।
একটু পর টুনি যখন আবার তার মোটা ইংরেজি বইটা খুলে বসেছে তখন শান্ত গলা নামিয়ে বলল, “টুনি।”
“বলো শান্ত ভাইয়া।”
“দেখা শেষ হলে তোর জ্ঞানের বইটা আমাকে একটু দিবি?
টুনি হাসল, বলল, “দেব না কেন! এক শবার দেব। অনেক মজার মজার জিনিস আছে এই বইয়ে।”
টুনি তখনো জানত না এই বইয়ের বিচিত্র জ্ঞানটুকু আর কয়দিন পরেই একটা অন্য কাজে লেগে যাবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে এভাবে:
দাদি টেলিভিশন দেখছেন। তার পায়ের কাছে বসে ঝুমু খালাও টেলিভিশন দেখছে। এতদিন ঝুমু খালা শুধু কাহিনিটা দেখত, অভিনয় করার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে ঝুমু খালা চরিত্রগুলোর অভিনয় খুবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ সময়েই তাদের অভিনয় দেখে সে হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে থাকে। কোন ডায়ালগটা কীভাবে বলা উচিত ছিল সে ব্যাপারেও এখন ঝুমু খালার একেবারে সুনির্দিষ্ট মতামত আছে।
দাদি এবং ঝুমু খালা ছাড়াও বাসার বেশির ভাগ বাচ্চারাও আশেপাশে আছে। পচা আলু নামে একটা নতুন খেলা আবিষ্কার হয়েছে। শরীরের চামড়ার খানিকটা দুই আঙুল দিয়ে চিপে ধরে মাঝখানে খোঁচা দিয়ে একটা পচা আলুর অনুভূতি আসবে দাবি করে সবাই যন্ত্রণায় আহ্-উহ্ এবং আনন্দে হি হি করে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এরকম সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকল এবং সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু! আজকে কী এনেছ?”
ছোটাচ্চু একটা ধমক দিয়ে বলল, “তোদের সমস্যাটা কী? দেখা হলেই কী এনেছ কী এনেছ? আমি কী আনব?”
প্রায় সবাই একসাথে বলল, “খাবার।”
“তোরা খেতে পাস না নাকি? সবসময় খাই খাই করিস।”
একজন বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের এখন বাড়ন্ত বয়স। আমাদের বইয়ে লেখা আছে বাড়ন্ত বয়সে অনেক কিছু খেতে হয়।”
ছোটাচ্চু ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝুমু, রান্নাঘরে কী গাজর আছে?”
ঝুমু খালা বলল, “গাজর শেষ। খালি মূলা আছে।”
“ঠিক আছে তাহলে সবার হাতে একটা করে মূলা ধরিয়ে দাও। বসে চাবাতে থাকুক। মূলাতে অনেক ভাইটামিন আছে।”
বাচ্চাগুলো মুখ বিকৃত করে চিৎকার করতে লাগল।
একজন বলল, “বুঝেছি। ছোটাচ্চুর তো চাকরি নাই, বেকার মানুষ সেইজন্যে কিপটেমি করছে।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “বেকার হয়েছি তো কী হয়েছে? আমার কী কাজের অভাব আছে?” বলে ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে উঁচু করে ধরল। বলল, “এই দ্যাখ, আজকেই একজন একটা কাজের অফার দিয়েছে। সাথে এডভান্স পেমেন্ট।”
বাচ্চাগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “কত টাকা? কত টাকা?”
ছোটাচ্চু চোখ সরু করে বলল, “তোরা সব সময় টাকার এমাউন্ট নিয়ে মাথা ঘামাস কী জন্যে?”
একজন লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি। টাকা এত কম যে ছোটাচ্চু বলতে লজ্জা পাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “মোটেও না। আমি ইন প্রিন্সিপাল বাচ্চাদের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলি না। নেভার।”
বাচ্চারা মুখ টিপে হাসল, ধরেই নিল টাকার পরিমাণ কম বলে বলছে না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তোমার কাজটা কী?
ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে বসে হাসি হাসি মুখে বলল, “কাজটা খুবই ইন্টারেস্টিং। একটা চিঠি খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ, একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ চিঠি একজন বয়স্কা মহিলার কাছে এসেছে সেই চিঠিটা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“চিঠিটা কোথায় আছে?”
“ভদ্রমহিলার বাসাতেই আছে। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে সেটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“তুমি সেটা কীভাবে খুঁজে বের করবে?”
ছোটাচ্চু দাঁত বের করে হাসল। বলল, “এর জন্য আমি একজন প্রফেশনালের সাহায্য নেব।”
“প্রফেশনাল?”
“হ্যাঁ।”
একজন জানতে চাইল, “কে প্রফেশনাল?”
ছোটাচ্চু একটা অঙ্গভঙ্গি করে বলল, “তোরাই বল জিনিসপত্র খোঁজার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট কে?”
প্রায় সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “ঝুমু খালা।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ঝুমু হচ্ছে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমি ঝুমুকে নিয়ে যাব। ঝুমু খুঁজে বের করে দেবে। সে জন্যে তাকে প্রফেশনাল ফী দেওয়া হবে।”
ঝুমু খালা যে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট সেই কথাটি অবশ্যি সত্যি। বড় চাচা যখন বলেন, ‘আমার চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না’ ঝুমু খালা সাথে সাথে বাথরুমে গিয়ে টুথপেস্টের পাশ থেকে চশমা বের করে দেয়। মেজো খালা যখন বলে, ‘আমার লাল ব্লাউজটা যে কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা বালিশের তলা থেকে লাল ব্লাউজ বের করে আনে। দাদি (কিংবা নানি) যখন বলে আমার মোবাইলটা কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা সেটা সোফার চিপা থেকে বের করে আনে। স্কুলে যাবার আগে বাচ্চারা যখন চিৎকার শুরু করে ‘আমার অঙ্ক হোমওয়ার্ক! অঙ্ক হোমওয়ার্ক!’ ‘তখন ঝুমু খালা টেবিলের তলা থেকে সেটা উদ্ধার করে দেয়। ছোটাচ্চু যখন বলে, ‘আমার কলম! আমার কলম!’ তখন ঝুমু খালাকে বেশির ভাগ সময়েই কিছু করতে হয় না। কোনো দিকে না তাকিয়েই বলে, ‘ছোডু ভাই, কানের ওপরে দেখেছেন?’ বেশির ভাগ সময়েই সেটা সেখানে পাওয়া যায়।
ঝুমু খালাকে প্রফেশনাল হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি বের করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে ঝুমু খালার আনন্দ হবে বলে সবাই ভেবেছিল। কিন্তু ঝুমু খালাকে মোটেও সেরকম আনন্দিত দেখাল না। বরং ঝুমু খালা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “না ছোডু ভাই আপনি আমাকে দিয়া এই কাম করাবার পারবেন না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“এই বাসার জিনিসপত্র খুঁইজা বার করা খুবই সোজা। হের কারণ হচ্ছে আমি সবার চরিত্র জানি। কে কুনখানে কুন জিনিসটা ফালাইয়া রাখে আমার থাইকা ভালো করে কেউ জানে না। বড় ভাইজান সবসময় চশমা এইখানে হেইখানে ফালায়া রাখে। আফা আর ভাবিদের সমস্যা বেলাউজ আর কানের দুল। খালার মোবাইল ফোন থাকে সোফাসেটের চিপায়। পোলাপানদের বই খাতা কুনো সময় ঠিক জায়গায় থাকে না; টেবিলের নিচে, বিছানার নিচে, বালিশের নিচে–আমি ধরেন না খুঁইজাই বার করতে পারি। কিন্তুক অন্য বাড়িতে তো সেইটা হইব না।”
ছোটাচ্চু বলল, “কেন হবে না?”
“আমি অন্যের বাড়িতে গিয়া তার মাল সামানে হাত দিমু? কক্ষনো না। এই বাসা আমার নিজের বাসা; আমি এর ড্রয়ার খুলি, হের আলমারি খুলি কেউ আমারে কিছু কয় না। অন্য বাড়িতে কোনো জিনিসে হাত দিলেই বুড়ি হ্যাঁৎ করে উঠব।”
ছোটাচ্চু বলল, “না, না, হ্যাঁৎ করে উঠবে কেন? আমাকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে চিঠিটা খোঁজার জন্য। পুরো বাসা ওলট পালট করে ফেললেও কিছু বলবে না।”
ঝুমু খালা গম্ভীর গলায় বলল, “জে না। মানুষজনের মাল-সামানা খুবই পেরাইভেট। অন্যের পেরাইভেট জায়গায় হাত দিতে হয় না।”
ছোটাচ্চুকে এবারে খানিকটা অসহায় দেখাল, মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে ঝুমু–আমি তোমার ওপর ভরসা করে রাজি হয়েছি। এখন তুমি যদি বেঁকে বস বিপদে পড়ে যাব। প্লিজ রাজি হয়ে যাও।”
শান্ত বলল, “ঝুমু খালা, তোমার ফি’টা ডাবল করে দাও। এই সুযোগ। আমি তোমার সেক্রেটারি হয়ে যাব।”
ঝুমু খালা বলল, “জে না। কাজটা ঠিক হবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “তুমি একবার গিয়ে শুধু দেখ। আমাকে বলো কীভাবে কী করতে হবে। তুমি না চাইলে তোমার নিজের করতে হবে না।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা রাজি হয়ে যাও। দরকার হলে আমি থাকব তোমার সাথে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একবার গিয়া বাসাটা দেখতে পারি, তার বেশি কিছু না।”
সবাই তখন আনন্দের একটা শব্দ করল, ছোটাচ্চুর গলা উঠল সবার ওপরে।
.
দুই দিন পর বিকেল বেলা ছোটাচ্চু এসে ঝুমু খালাকে ডেকে বলল, “ঝুমু, তুমি রেডি হয়ে নাও।”
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “কি জন্য?”
“মনে নাই একটা চিঠি খুঁজে দিতে হবে?”
ঝুমু খালাকে কেমন যেন একটু বিপর্যস্ত দেখাল। আমতা আমতা করে বলল, “আমি একলা?”
“আর কে যাবে তোমার সাথে? “পোলাপান কাউরে নেই সাথে?”
“কাকে নেবে?”
“দেখি কারে পাই।”
ঝুমু খালা টুনিকে পেয়ে গেল। অন্য বাচ্চাদের থেকে টুনিকেই ঝুমু খালার বেশি পছন্দ। মেয়েটার মাথার মাঝে মনে হয় বুদ্ধি গিজ গিজ করছে। কাজকর্ম কথাবার্তাতেও ধীর-স্থির।
টুনি খুব আনন্দের সাথে যেতে রাজি হলো। যাবার আগে সে একটা সিল করা খাম নিল, খামের ওপর তার নিজের নাম ঠিকানা লেখা। খামটা কেন নিল, খামের ভেতর কী আছে কেউ জানে না।
খানিকক্ষণ পর ঝুমু খালা আর টুনি ছোটাচ্চুর সাথে নিচে নেমে দেখে বাসার সামনে একটা ঢাউস গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির সামনে একজন মাঝবয়সী মানুষ, মানুষটার মাথার সামনে চুল হালকা হয়ে আসছে, সেই জন্যে মনে হয় কপালটা অনেক বড়। ঝুমু খালা বলেছে বড় লোকদের কপাল এরকম হয়। মানুষটা একটা সাদা রংয়ের হাফ হাতা শার্ট পরে আছে। ছোটাচ্চুকে দেখে বলল, “থ্যাংক ইউ শাহরিয়ার সাহেব, আপনি রাজি হওয়ার জন্য। এই চিঠিটা খুবই দরকারী চিঠি, মা কীভাবে যে হারিয়ে ফেলল। খুঁজে পাওয়া না গেলে অনেক বড় ঝামেলায় পড়ব। প্রোপার্টি নিয়ে ঝামেলা।”
ছোটাচ্চু কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা তখন একটু জিজ্ঞাসার ভঙ্গি করে ঝুমু খালা আর টুনির দিকে তাকাল, ভদ্রভাবে জানতে চাইছে এরা কারা। ছোটাচ্চু বলল, “আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে ঝুমু, হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট। তাকেও সাথে নিচ্ছি।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এ হচ্ছে টুনি। ঝুমু যেন একা একা বোরিং ফিল না করে সেজন্যে যাচ্ছে। আমার ভাতিঝি।”
মানুষটা বলল, “বেশ বেশ। তাহলে গাড়িতে উঠে যাই।”
গাড়ির ড্রাইভার নেই মানুষটা নিজেই গাড়ি চালাবে। ছোটাচ্চু তার সাথে সামনে বসল। টুনি আর ঝুমু বসল পেছনে।
গাড়িটা যখন বড় রাস্তায় উঠে একটা ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেল তখন মানুষটা কেমন যেন একটু অপরাধীর মতো গলায় বলল, “আমার মায়ের বাসায় নেওয়ার আগে আপনাদের মনে হয় একটু সাবধান করে নেয়া ভালো।”
ছোটাচ্চু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সাবধান? কী নিয়ে সাবধান।”
“আমার মাকে নিয়ে।”
“আপনার মাকে নিয়ে? কী হয়েছে আপনার মায়ের?”
“মানে আমার মা একটু একসেনট্রিক টাইপ, মানে বাতিকগ্রস্ত বলতে পারেন। যত বয়স হচ্ছে সেটা আরেকটু বেড়ে যাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করেন আপনার মা?”
“এমনিতে বেশ হাসি-খুশি। কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি আছে।”
“জিনিসপত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি?”
“হ্যাঁ। বাইরে গেলেই কিছু একটা কিনে ফেলেন–টাকা-পয়সার তো অভাব নেই, যেটা ইচ্ছা সেটা কিনতে পারেন। জিনিসপত্র কিনে কিনে বাসাটা বোঝাই করে রেখেছেন, কিছু ফেলতেও পারেন না, তাই আস্তে আস্তে বাসাটা দরকারি বেদরকারি জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে। এখন এমন অবস্থা–” মানুষটা কথা শেষ না করে থেমে গেল।
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কি অবস্থা?”
“বাসার ভেতরে বলতে গেলে হাঁটার জায়গা নেই।”
“আপনারা আপনার মা’কে কিছু বলেন না?”
“কতবার বলেছি!” মানুষটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, “সবাই মিলে হাজার বার বলেছি, যে জিনিসের দরকার নেই সেগুলো ফেলে দিই কিংবা কোথাও দান করে দিই। মা রাজিও হন কিন্তু সত্যি সত্যি বাসা খালি করার সময় হলে তখন আর উৎসাহ দেখান না। জিনিসপত্র বাড়তেই থাকে।”
পেছন থেকে ঝুমু খালা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “কেরোসিন।”
মানুষটা চমকে উঠে বলল, “কী? কী বললেন?”
“বলছি অবস্থা কেরোসিন।”
“মানে? কেরোসিন মানে?”
টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “ঝুমু খালা বলতে চাইছে অবস্থাটা একটু জটিল।”
মানুষটা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ জটিল তো বটেই। যে চিঠিটা এতদিন থেকে খুঁজছি কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না তার এক নম্বর কারণ বাসা বোঝাই জিনিসপত্র। এত জিনিসপত্র থাকলে জিনিস কী খুঁজে পাওয়া যায়?”
ঝুমু খালা আবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবস্থা আসলেই কেরোসিন।”
কথাটার মানে কী এইবারে আর মানুষটাকে বোঝাতে হলো না। মানুষটাও লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তবে এই চিঠিটা খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়ার কথা। চিঠিটা একটা বড় খামে। খামটা লাল রংয়ের। ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা।”
ছোটাচ্চু বলল, “চিঠিটা কে পাঠিয়েছে?”
“এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার। তাদের ফার্ম থেকে। ফার্মের নাম সিনহা এন্ড সমাদ্দার।”
টুনি নামটা কয়েকবার আওড়ে নিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করল।
.
ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে শেষ পর্যন্ত তারা একটা বাসায় পৌঁছাল। বড় কম্পাউন্ড নিয়ে একটা বাসা, বড় লোকদের বাসা যেরকম হয়। দারোয়ান গেট খুলে দিল। মানুষটা বাসার সামনে গাড়িটা থামাল। নামার আগে ঝুমু খালা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আংকেল আপনারে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
মানুষটা বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই।”
“আপনারা আমাগো কী খালি চিঠিটা খোঁজার জন্য আনছেন নাকি বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে আনছেন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাসা খালি না করে চিঠিটা বের করা যাব না।”
মানুষটা ভালো মানুষের মতো হেসে ফেলল। বলল, “না, বাসা খালি করে দেবার জন্য আনিনি, কারণ মনে হয় সেটা সম্ভব না। তবে কেউ যদি আসলেই মাকে বুঝিয়ে বাসাটা খালি করে দিতে পারত তাকে আমরা একটা গোল্ড মেডেল দিতাম। স্যালুট করতাম।”
ঝুমু খালা বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে শব্দ করে বলল, “কেরোসিনের ওপরে ডিজেল!”
বাসার দরজায় শব্দ করতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। একজন কাজের মহিলা দরজাটা খুলে দিয়েছে। মানুষটা তাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কী করে?”
“টেলিভিশন দেখে।”
“যাও। মাকে ডাকো। বল গেস্ট এসেছেন।”
মানুষটা তখন ছোটাচ্চু, টুনি আর ঝুমু খালাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই টুনি একটা ধাক্কা খেলো। এটা বসার ঘর কিন্তু এটাকে মনে হচ্ছে একটা গুদামঘর। গতবার ঈদের আগে একবার তাকে নিয়ে তার আম্মু কাঁচা বাজারে গিয়েছিল। সেই কাঁচাবাজারে একটা দোকান বোঝাই ছিল জিনিসপত্রে, দোকানের মানুষটা কোনোভাবে একটা কোনায় বসেছিল মনে হচ্ছিল একটু নাড়াচাড়া করলেই তার ওপর চাল-ডাল মসলা-ঘি, সেমাই সব হুড়মুড় করে পড়বে। এখানেও তাই–চারিদিকে শুধু জিনিস আর জিনিস, মনে হলো এক্ষুনি বুঝি সবকিছু তাদের ওপর পড়বে।
দেওয়ালে নানা ধরনের পেইন্টিং। যতগুলো আঁটে তার থেকে বেশি, উপরে নিচে-ডানে-বামে শুধু পেইন্টিং আর ফ্রেম। কিছু ছবি ভালো কিছু কুৎসিত। কিছু দামি কিছু সস্তা। বসার ঘরে অনেকগুলো শো-কেস, প্রত্যেকটা শো-কেস বোঝাই নানা ধরনের পুতুল কিংবা শো-পিস দিয়ে, ভেতরে ঢুকিয়ে ঠেসে কাঁচের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। দরজাটা খুললেই শো-পিসগুলো নিচে পড়বে। শো কেসের ওপরেও নানা ধরনের জিনিসপত্র একেবারে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঘরের ভেতর বড় শেলফ। শেলফ বোঝাই নানা রকম বই। শেলফে বই আঁটে না বলে অনেক বই মেঝেতে।
বসার ঘরে সাধারণত একটা সোফা সেট থাকে কিন্তু এই বসার ঘরে মনে হয় তিন থেকে চার সেট সোফা। কিছু দামি, কিছু অতি কুৎসিত! সোফার ওপর নানারকম জিনিস, মানুষ কেমন করে এখানে বসবে সেটা একটা রহস্য। সোফার সামনে টেবিল, টেবিলের ওপর রাজ্যের জিনিস, টেবিলের নিচে জিনিসপত্র আরো অনেক বেশি। এখানে-সেখানে অসংখ্য ফুলদানি এবং সেই ফুলদানিতে ক্যাটক্যাটে রংয়ের প্লাস্টিকের ফুল। চারিদিকে নানা ধরনের বাক্স, বাক্সের ভেতর কী আছে কে জানে, অনেক বাক্স মনে হয় জীবনেও খোলা হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে ঘরের ভেতর কেমন জানি গুমোট একটা গন্ধ।
টুনি আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মানুষটির বয়স্কা মা এসে ঢুকলেন। জিনিসপত্রের ফাঁকে ফাঁকে চড়ইপাখির মতো পা ফেলে থুড়থুড়ে বুড়ো মহিলাটি কাছে এসে বললেন, “ও খোকা এসেছিস? বউমা ভালো আছে? নিয়ে আসলি না কেন? বুবাই কী করে? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে? বিন্তী না ইন্ডিয়া যাবে? গিয়েছিল? কেমন লেগেছে?”
অনেকগুলো প্রশ্ন করে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বললেন, “কয়দিন থেকে মাথাটা কেমন জানি উড়া উড়া লাগছে। এক বোতল জবা কুসুম তেল কিনে এনেছি এখন বোতলটা আর খুঁজে পাই না। কোথায় যে রেখেছি।”
বুড়ো মহিলার ছেলে, যার নাম খোকা কিংবা ভদ্রমহিলা যাকে খোকা বলে ডাকেন, মাথা নেড়ে বলল, “মা তুমি এই বাসায় কিছু খুঁজে পাবে না। কেমন করে পাবে; দেখেছ কত জিনিস?”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “খুচরা মাল।”
মানুষটা এবারে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর তার মাকে বলল, “মা তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এই যে এরা এসেছেন তোমার চিঠিটা খুঁজে বের করতে।” ছোটাচ্চুকে দেখিয়ে বলল, “ইনি শাহরিয়ার সাহেব, অনেক বড় ডিটেকটিভ!”
বুড়ো মহিলা খিক খিক করে হেসে বললেন, “আসল টিকটিকি! হি হি হি।”
ছোটাচ্চু কী আর করবে, টিকটিকি হয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা ঝুমু খালাকে দেখিয়ে বলল, “ইনি মিস ঝুমু। জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট আর তার সাথে ছোট মেয়েটা টুনি। এসেছে সাথে থাকার জন্য!”
বুড়ো মহিলা চোখ বড় বড় করে তাদের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “খুঁজে বের করা একটুও কঠিন হবে না। লাল রংয়ের খাম, ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পেয়ে যাবে।”
ঝুমু খালা আবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “এই বাসার মইধ্যে এক খুচরা মাল যে একটা একটা করে জিনিস সরায়া খুঁজতে কম পক্ষে দশ বছর লাগব! বেশিও লাগতে পারে।”
ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কী বলছ ঝুমু। তুমি কী একটা একটা জিনিস সরিয়ে খুঁজবে? তুমি খুঁজবে মাথা খাঁটিয়ে। তোমাকে এনেছি কী জন্যে?”
ঝুমু খালাকে মাথা খাটানো নিয়ে খুব উৎসাহী দেখা গেল না।
কিছুক্ষণ ভদ্রতার কথাবার্তা বলে ছোটাচ্চু চলে গেল। অবশ্যি চলে গেল না বলে পালিয়ে গেল বলাই ঠিক হবে। ভদ্রমহিলার ছেলেও সরে পড়ল, ঘরের মাঝে রইল শুধু ঝুমু খালা আর টুনি।
ঝুমু খালা তার শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে বলল, “নানি, এইবারে বলেন দেখি আপনি আপনার চিঠিটা কুন ঘরে কুন জায়গায় রাখছিলেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলাকে এক সেকেন্ডের জন্যে একটু বিভ্রান্ত দেখাল কিন্তু তারপরেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “আস, আমার সাথে, তোমাকে দেখাই।”
ঝুমু খালা আর টুনি ভদ্রমহিলার পিছু পিছু ভেতরে গেল। একটা বড় ঘরের ভেতর দিয়ে তারা ভেতরে ভদ্রমহিলার বেডরুমে পৌঁছালো। এখানে একটা বিছানা আছে সে জন্যে বোঝা যাচ্ছে এটা বেডরুম তা না হলে ঘরটা এমনভাবে জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই যে এটা যে একটা বেডরুম সেটা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। ঘরের এক পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা বড় আলমারি, শেলফ, কাপড় রাখার একটা আলনা এবং প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর নানারকম জিনিসপত্র। শেলফের ওপরে এবং নিচে বই। আলমিরার ওপরে কম্বল এবং বিছানার চাঁদর। আলনার ওপর নানা ধরনের কাপড়। ঘরে ছড়ানো-ছিটানো নানা সাইজের নানা আকারের পুতুল। এ ছাড়াও আছে তেল-শ্যাম্পু ক্রিম এবং কসমেটিকস। শুধু এই ঘরে যে জিনিস আছে সেই জিনিস দিয়ে নিউ মার্কেটে তিনটা দোকান বোঝাই করা সম্ভব।
সাবধানে পা ফেলে বুড়ো মহিলা তার বিছানার কাছে গিয়ে বললেন “এই বিছানায় বসে আমি চিঠিটা পড়েছি। উঁকিলের চিঠি। পড়ে কিছু বুঝি নাই। কিন্তু মনে হয় চিঠিটা খুব দরকারি। তাই বিছানা থেকে ওঠে চিঠিটা–” ভদ্রমহিলা থেমে গিয়ে তার ধবধবে সাদা চুলে ঢাকা মাথাটা চুলকালেন, তারপর একটু অপ্রস্তুতের মত হাসলেন। হেসে বললেন, “তারপরে মনে হয় এই ঘরে কোনো এক জায়গায় চিঠিটা সাবধানে রাখলাম।”
“কোন জায়গায়? চিন্তা করেন? চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। মনে পড়ছে না।” ড্রেসিং টেবিলের ওপর হতে পারে। শেলফের উপর হতে পারে। আবার আলমারির ভেতর হতে পারে। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা আবার খিক খিক করে একটু হাসলেন। টুনি লক্ষ করল তাঁর হাসিটা খুবই মজার।
ঝুমু খালা কী আর করবে, চিঠি খোজার জন্যে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে তার ওপরে রাখা জিনিসপত্র খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। এদিক-সেদিক দেখল, একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে তাকাল। দুই-একটা জিনিস বের করে আবার ঢুকিয়ে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে এই বাসায় সত্যি সত্যি কোনো একটা জিনিস খুঁজে বের করা অসম্ভব।
টুনি তখন বুড়ো মহিলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো মহিলার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়।”
টুনি নাম বলল, ক্লাস বলল। বুড়ো মহিলা তখন মাথা নেড়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বললেন, “তোমাদের দেখে আমার মায়া হয়। চাও আর না চাও তোমাদের লেখাপড়া করতে হয়। আমাদের সময় লেখাপড়া না করলে নাই! বাবা-মা ধরে বিয়ে দিয়ে দিত। আমার যখন বিয়ে দিয়েছিল তখন আমার বয়স চৌদ্দ।”
“আপনার হাজব্যান্ড কোথায়?”
“মরে গেছে। আজ প্রায় বিশ বছর–”
“এতদিন?”
“হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বেচারা মরে যাবার পর একা হয়ে গেছি। সময় কাটে না তাই দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াই। জিনিসপত্র কিনি। সময়টা কাটে।”
“আপনি এই বাসায় কতদিন থেকে আছেন?”
“পঞ্চাশ বছর তো হবেই। বেশিও হতে পারে।”
টুনি চারিদিকে তাকাল। অর্ধশতাব্দীর জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়ানো। তখন হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, “নানি। আমার এই চিঠিটা আমি হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম।” টুনি তার হাতে ধরে রাখা খামটা–যেটা বাসা থেকে এনেছে সেটা দেখাল। তারপর বলল, “এই খামটা খুবই দরকারি। আপনার হাতে একটু দিই? কোনো এক জায়গায় সাবধানে একটু রাখবেন? যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। আমি ঝুমু খালাকে একটু সাহায্য করি?”
বুড়ো মহিলা বললেন, “আমি? আমি রাখব?”
“হ্যাঁ। প্লিজ।” বলে বুড়ো মহিলা কিছু বলার আগে তার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে ঘরে ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য জিনিসপত্রের ভেতরে সাবধানে পা ফেলে ঝুমু খালার কাছে হাজির হয়ে বলল, “ঝুমু খালা। আমি তোমাকে সাহায্য করি?”
ঝুমু খালা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আর আমাকে কী সাহায্য করবা?” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “এর থেকে খেড়ের গাদার মাঝে সুই খোজা সোজা।”
টুনি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করছিল বুড়ো মহিলা তার চিঠিটা কী করেন। এটাকে সাবধানে রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রাখবেন। কোথায় রাখেন সেটাই টুনি দেখতে চায়।
টুনি দেখল বুড়ো মহিলা তার জিনিসপত্রের ওপর দিয়ে সাবধানে চড়ই পাখির মতো পা ফেলে শেলফের কাছে গেলেন। তারপর শেলফের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে সেই বইয়ের ভেতর চিঠিটা রেখে বইটা আবার শেলফের ওপর রেখে দিলেন। তার মানে এটা হচ্ছে এই ভদ্রমহিলার দরকারি কাগজপত্র রাখার সিস্টেম। তাঁর হারিয়ে যাওয়া লাল খামটি এই বইগুলোর ভেতর খুঁজে দেখতে হবে। দেখা যাচ্ছে বইগুলোর ভেতর নানা ধরনের কাগজপত্র গুঁজে রাখা আছে।
টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, ভদ্রমহিলা যখন একটু সরে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন তখন সে তাড়াতাড়ি শেলফের কাছে গিয়ে বইগুলোর ভেতর খুঁজতে থাকে। অনেকগুলো বইয়ের ভেতরেই নানা ধরনের কাগজ, খাম, চিঠি, ফটো আছে, তবে লাল খাম একটিও নেই। টুনি হতাশ হয়ে চলে আসার আগে আবার বইগুলোর ভেতর তাকায়। তার হঠাৎ মনে পড়ল সেদিন সে শিখেছে মানুষ প্রায় সময়েই ভুল জিনিস দেখে। ভুল জিনিস মনে রাখে। ভদ্রমহিলা সারাক্ষণই লাল খামের কথা বলেছেন, এমন কী হতে পারে খামটা লাল না, সেটা সাদা কিংবা হলুদ? মনে রেখেছেন লাল হিসেবে?
টুনি যখন দ্বিতীয়বার বইগুলোর ভেতর দেখে তখন হঠাৎ একটা বইয়ের ভেতর হলুদ একটা খাম পেল।
ভদ্রমহিলার ঠিকানায় লেখা চিঠি। খামের কোনায় লেখা “এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার” তার নিচে লেখা “সিনহা এন্ড সমাদ্দার” ঠিক যেরকম ভদ্রমহিলার ছেলে বলেছিল। খামটা মোটেও লাল নয়। খামটা হলুদ। এই বাসায় সারাক্ষণ সবাই লাল খাম খুঁজেছে সেজন্যে কেউ কখনো পায়নি।
টুনি খামটা নিয়ে তার ভেতরের চিঠিটা বের করে পড়ার চেষ্টা করল। কটমটে আইনি ভাষা পড়ে কিছু বোঝা যায় না। শুধু অনুমান করতে পারল এখানে বেশ কিছু তথ্য, দলিলের কপি এইসব আছে। খুবই জরুরি কিছু কাগজপত্র। এগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এই চিঠিটাই এতদিন থেকে সবাই মিলে খুঁজছে। লাল খাম হিসেবে খুঁজেছে বলে কেউ খুঁজে পায় নাই।
টুনি খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তারপর যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিয়ে ঝুমু খালার কাছে ফিরে এলো। ঝুমু খালা টুনিকে দেখে আবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল, টুনি তার আগেই ফিস ফিস করে বলল, “ঝুমু খালা, পেয়ে গেছি।”
ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “কী পায়া গেছ?”
“ঐ চিঠিটা।”
ঝুমু খালার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, টুনি কোন চিঠির কথা বলছে। যখন বুঝতে পারল তখন একটা চিৎকার দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। তারপর টুনির মতোই ফিস ফিস করে বলল, “কোন খানে পাইছ?”
টুনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ শেলফের ওপর বইয়ের ভেতর।”
“তুমি বুঝলা কেমন করে যে ঐ শেলফের বইয়ের ভেতরে থাকব?”
“আন্দাজ করেছি। উনি সব দরকারি কাগজ ঐখানে রাখেন দেখলাম।”
ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “এতদিন ধইরা কেউ তাইলে খুঁইজ্জা পাইল না কেন?”
“সবাই লাল খাম খুঁজেছে। খামটা আসলে লাল না। হলুদ।”
“হলুদ?’
টুনি মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা সন্দেহের চোখে বলল, “আসল চিঠিই পাইছ নাকি ভুলভাল?”
“আসল চিঠি, খুলে দেখেছি।”
ঝুমু খালা তখন টুনির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল, “তোমার মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”
“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।”
“একই কথা।” ঝুমু খালা সবগুলো দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে বুড়ি নানিরে ডাকি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আগেই না। চিঠিটা তো সহজ ছিল, এই বাসার জিনিসপত্র খালি করার একটা বুদ্ধি বের করা যাবে? তাহলে এই নানির একটা উপকার হয়।”
ঝুমু খালা ঠোঁট সুচাল করে ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, “তারপর মুখ হাসি হাসি করে বলল, “একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“কী জিনিস?”
“আমার কিছু একটিং করতে হইতে পারে।”
“একটিং? কী একটিং?”
“আমি তো একটা একটিংই পারি। সেইটা হলো ইন্দুর মারার একটিং।”
“ইঁদুর মারার একটিং?”
“হা। এই দেখো–” বলে টুনি কিছু বোঝার আগেই ঝুমু খালা একটা গগণবিদারী চিৎকার দিল। সেই চিৎকার শুনে মনে হলো কেউ বুঝি ঝুমু খালাকে খুন করে ফেলছে।
চিৎকার শুনে প্রথমে বাসার কাজে সাহায্য করার মহিলা ছুটে এলো। তার পিছু পিছু বুড়ি নানি ছুটে এলেন, এবারে আর চড়ুই পাখির মতো পা ফেলে নয় শালিখ পাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। ঝুমু খালার মতোই চিৎকার করতে লাগলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
ঝুমু খালা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রথমে এদিক সেদিক কয়েকটা লাফ দিল, তারপর নিচু হয়ে একটা পিতলের ফুলদানি তুলে সেটা দিয়ে দমাদম করে অদৃশ্য একটা ইঁদুরকে পিটাতে লাগল। ইঁদুরের পিছু পিছু ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি করতে করতে ঝুমু খালা চিৎকার করতে লাগল, “মার! ইন্দুরের বাচ্চারে মার।”
বয়স্ক বুড়ি নানিও আতংকে চিৎকার করতে করতে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে সেখানেই লাফাতে লাগলেন। ঝুমু খালা পিতলের ফুলদানি দিয়ে অদৃশ্য ইঁদুরকে মারার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে হাপাতে লাগল। বুড়ি নানি বিছানার ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ছিল? ইঁদুর?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই মোটা ইন্দুর। কুচকুচা কালা।” ঝুমু খালা হাত দিয়ে উঁদুরের যে সাইজটা দেখিয়েছে সেই সাইজের বিড়াল হতে পারে, ইঁদুর হওয়া সম্ভব না।
ঝুমু খালা পিতলের বড় ফুলদানিটা হাতে অস্ত্রের মতো ধরে রেখে এদিক সেদিক সতর্কভাবে তাকাতে তাকাতে বলল, “এই বাসায় ইন্দুর আছে তার মানে কী বুঝছেন নানি?”
ভদ্রমহিলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কী?”
“তার মানে হচ্ছে এই বাড়িতে সাপও নিশ্চয়ই আছে।”
“সাপ।”
“হে।” ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “যে বাড়িতে ইন্দুর থাকে সেই বাড়িতে সাপ থাকে। আর যে বাড়িতে সাপ থাকে সেই বাড়িতে বেজী থাকে। সে বাড়িতে বেজি থাকে সেই বাড়িতে শিয়ালও থাকতে পারে।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে কেমন জানি অসহায় দেখায়। কাঁপা গলায় বললেন, “কী বলছ এইসব?”
ঝুমু খালা হাতের ফুলদানিটা অস্ত্রের মতো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, “নানি, আপনি এই বাড়ি পরিষ্কার করেন। তা না হলে–”
“তা না হলে কী?”
“আপনি রাত্রে যখন ঘুমাবেন। তখন এই মোটকা মোটকা ভোটকা ভোটকা কালা কালা ইন্দুর আইসা আপনার হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল কামড়াইয়া কামড়াইয়া খায়া ফালাইব। সকালে উইঠা দেখাবেন হাতের দুইটা আঙুল নাই।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলা ঝুমু খালার এরকম ভয়ংকর বর্ণনা শুনে কী রকম জানি শিউরে উঠলেন।
ঝুমু খালা নির্দয়ের মতো বলতে থাকল, “প্রথমে একটা দুইটা ইন্দুর আসব। তারপর আট-দশটা। তারপর এক রাত্রে শত শত কালা কালা ইন্দুর কিলবিল কিলবিল কইরা আপনার ওপর ঝাঁপায়া পড়ব।” কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঝুমু খালা সেটা অভিনয় করে দেখাল, সেটা দেখে টুনিও রীতিমতো শিউরে উঠল।
ভদ্রমহিলা কাঁপা গলায় বললেন, “পরিষ্কার তো করতে চাই, কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এত জিনিস হয়ে গেছে এখন কোন দিক দিয়ে কী পরিষ্কার শুরু করব বুঝে উঠতে পারি না।”
ঝুমু খালা এইবার বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, “আমার ওপর ছাইড়া দেন।”
“তোমার ওপর ছেড়ে দেব?”
“জে। আমার ওপরে ছাইড়া দেন। আমি আপনারে দেখাই কেমন করে এই খুচরা মাল দূর করতে হয়।”
“তুমি দেখাবে?”
“জী। আপনে বিছানার ওপর বালিশ ঠেস দিয়া বসেন।”
ভদ্রমহিলা বুড়ি নানি ঝুমু খালার কথামতো বিছানার ওপর বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ঝুমু খালা তখন নিচু হয়ে একটা চাঁদর টেনে বের করে এনে সেটা কোনোভাবে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে ঘরের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জিনিসের মাঝ থেকে একটা শাড়ি বের করে এনে বুড়ি নানিকে দেখিয়ে বলল, “এই শাড়িটা আপনি শেষ বার কুনদিন পরেছেন?”
ভদ্রমহিলা মাথা চুলকালেন, বললেন, “মনে করতে পারছি না। অনেক আগে হবে।
“আবার কুনদিন পরবেন? আজকে? কালকে?”
“না, না, এখন পরব না।”
“তাহলে এরে বিদায় দেন।”
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, “বিদায় দেব?”
“হ্যাঁ। শাড়িটা বুক চেপে ধরে বলেন, আমার আদরের শাড়ি! তোমাকে কতদিন পরছি। এখন তোমারে বিদায়। যেখানে থাকো সুখে থাকো আমার প্রিয় শাড়ি।”
বুড়ি নানি চোখ বড় বড় করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। ঝুমু খালা
রীতিমত ধমক দিয়ে বলল, “বলেন।”
বুড়ি নানি একটু ভয় পেয়ে বিড় বিড় করে বললেন, “আমার প্রিয় শাড়ি, তোমাকে কতদিন পরেছি। এখন তোমাকে বিদায়।”
ঝুমু খালা মনে করিয়ে দিল, “যেখানে থাকো, সুখ থাকো।”
ভদ্রমহিলা বললেন, “যেখানো থাকো সুখে থাকো।”
ঝুমু খালা তখন শাড়িটা মেঝেতে বিছানা চাঁদরের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে নিচ থেকে একটা ফুলদানিতে তুলে নিল। ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলল, “এই ফুলদানি আপনি কুনদিন ব্যবহার করছেন?”
“অনেক আগে।”
“এখন আবার ব্যবহার করবেন?”
“না।“
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন। একটা চুমা দিয়ে বিদায় দেন। বলেন সোনার চান ফুলদানি বিদায়।”
বয়স্ক মহিলা সোনার চান ফুলদানি বলে চুমা দিয়ে ফুলদানিকে বিদায় দিলেন। ঝুমু খালা ফুলদানিটাকে চাঁদরের উপর ফেলে দিল। এবারে নিচ থেকে একটা টেবিল ল্যাম্প তুলে নিল। সেটা বুড়ি নানির হাতে দিয়ে ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “এইটা? এই টেবিল ল্যাম্পটা কী ব্যবহার করবেন?”
বুড়ি নানি মাথা চুলকে বলল, “ঘরে এত ল্যাম্প লাইট–এইটা আর কেমন করে ব্যবহার করব?”
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন, ভালো কিছু বলেন যেন টেবিল ল্যাম্পটা মন খারাপ না করে।”
“মন খারাপ না করে?”
“জে নানি।”
বুড়ি নানি একটু সময় চিন্তা করে বলল, “আমার প্রিয় টেবিল ল্যাম্প। কত রাত তোমাকে জ্বালিয়ে বই পড়েছি এখন আর আগের মত বই পড়তে পারি না। তোমাকে তাই বিদায়।”
ঝুমু সাহায্য করল, বলল, “বলেন, মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।”
বুড়ি নানি বললেন, “মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।” ঝুমু খালা তখন টেবিল ল্যাম্পটাও চাঁদরের ওপর রাখল।
প্রথম প্রথম বুড়ি নানির জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দেওয়ার জন্যে কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হয় একটু ইতস্তত করছিলেন, একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তার লজ্জা কেটে গেল, তখন নিজেই উৎসাহ নিয়ে নানারকম কথা বলে জিনিসগুলোকে বিদায় দিতে লাগলেন। একটা পুতুলকে বললেন, “ওরে আমার আদরের পুতুল! এই ভিড়ের মাঝে থেকে থেকে তুমি নিশ্চয়ই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছ? যাও এখন মনের সুখে ঘুরে বেড়াও।” একটা শ্যাম্পুর শিশিকে বললেন, “ভাই শ্যাম্পু, তোমাকে মাথায় দিইনি দেখে তুমি নিশ্চয় আমার ওপরে রাগ করেছ। রাগ করো না ভাই, অন্য কারো কালো চুলে তুমি আনন্দ করো। বুড়ো মানুষের চুলে কোনো আনন্দ নাই।”
দেখতে দেখতে চাঁদরটা নানা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে উঠল, তখন ঝুমু খালা চাঁদরটাতে বেঁধে সব জিনিসপত্র একেবারে বাইরে নিয়ে ঢেলে এলো। তারপর আবার চাঁদরটা বিছানো হলো, আবার এর ওপর জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দিয়ে দিয়ে রাখা হলো। দেখতে দেখতে আবার সেই চাঁদরটা বোঝাই হয়ে গেল। ঝুমু খালা তখন আবার চাঁদরটা বাইরে খালি করে আবার ফিরে এলো। এইভাবে চলতেই থাকল।
সন্ধ্যেবেলা বুড়ি নানির ছেলে যখন ছোটাচ্চুকে নিয়ে ঝুমু খালা আর টুনিকে নিতে এলো তখন সে গাড়িটা ভেতরে ঢোকাতে পারল না, কারণ বাইরের পুরো জায়গাটা জিনিসপত্রের স্থূপে বোঝাই হয়ে আছে। গাড়ি বাইরে রেখে ছোটাচ্চু বুড়ি নানির ছেলের সাথে ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে তুলে বলল, “এখানে কী হচ্ছে?”
টুনি বলল, “ঝুমু খালার বাসা পরিস্কার প্রজেক্ট।”
ছোটাচ্চু বলল, “বাসা পরিষ্কার প্রজেক্ট? ঝুমুর না চিঠি খুঁজে বের করার কথা?”
টুনি এক গাল হেসে বলল, “চিঠি অনেক আগে বের করা হয়ে গেছে।”
ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “চিঠি বের করা হয়ে গেছে?”
ছোটাচ্চুর চিৎকার শুনে বুড়ো নানির ছেলে এগিয়ে এল। টুনি তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, “দেখবেন, এটাই সেই চিঠি নাকি?”
মানুষটি খাম খুলে ভেতরে এক নজর দেখেই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ। এইটাই সেই চিঠি। কী আশ্চর্য!”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি ভেবেছিলাম চিঠিটা লাল রংয়ের খামে হবে।”
টুনি বলল, “সবাই তাই ভেবেছিল তাই কেউ কোনোদিন খুঁজে পায় নাই।”
“মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, খামটা যদি লাল না হয়ে থাকে তাহলে মা লাল খাম লাল খাম বলছিল কেন?”
টুনি বলল, “আমি বইয়ে পড়েছি। মানুষ সবসময় এরকম করে। দেখে একটা বলে আরেকটা।”
ছোটাচ্চু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী আশ্চর্য!”
সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে টুনি ছোটাচ্চর সাথে বাসায় চলে এলো। চিঠিটা খুঁজে পাওয়া গেছে বলে ছোটাচ্চুর মেজাজ খুবই ভালো। ঝুমু খালা তাদের সাথে এলো না, তার বাসায় ফিরতে অনেক রাত হলো। পঞ্চাশ বছরের বাসা এক রাতে খালি করা সোজা কথা না!
.
দুদিন পর সন্ধেবেলা বাসায় দরজায় বেল বেজেছে। টুম্পা দরজা খুলে দেখে একজন ফর্সা মানুষ হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি বুড়ি নানির ছেলে। টুম্পাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন, “শাহরিয়ার সাহেব বাসায় আছেন?”
টুম্পা ভুরু কুচকে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব?”
“হ্যাঁ। ঐ যে বিখ্যাত ডিটেকটিভ?”
“ও। ছোটাচ্চু!”
টুম্পা মানুষটিকে সোফায় বসিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।
ছোটাচ্চু তার ময়লা গেঞ্জিটার ওপর পরিষ্কার একটা শার্ট পরে বসার ঘরে হাজির হলো, মানুষটাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “আরে! আপনি? কী মনে করে?”
মানুষটি বলল, “আমাদের সব রকম ঝামেলা মিটে গেছে তাই ভাবলাম আপনাকে একটা থ্যাংকস দিয়ে যাই। তার সাথে জিনিস খুঁজে বের করার স্পেশাল প্রফেশনাল ঝুমুকেও একটা থ্যাংকস–আমার মায়ের বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে! উনাকে একটা গোল্ড মেডেল দেওয়ার কথা ছিল। ভাবলাম মেডেলের বদলে একটা চেক দিই। নিজে গিয়ে মেডেল কিনে নিবেন। উনি কোথায় থাকেন জানি না, উনার চেকটা আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”
বাসায় কেউ এসে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বললে অন্যরা জানালার নিচে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে।
ঝুমু খালার জন্য একটা চেক আছে শুনে বাচ্চাদের উত্তেজনা থামিয়ে রাখা গেল না, তারা একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল!
ছোটাচ্চু বললেন, “ঝুমু আমাদের সাথেই থাকে। আমি ডাকছি আপনি নিজের হাতে দেন, ও খুশি হবে।”
ঝুমু খালার চেক নিতে আসতে একটু দেরি হলো, কারণ সে তার ফেবারিট গোলাপি শাড়ি পরে এলো, চুলগুলো বেঁধে নিতে হলো এবং কপালে একটা টিপ দিল। চেক হস্তান্তরের সময় সব বাচ্চারা ঝুমু খালার পাশে থাকল এবং অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। ঝুমু খালা চেকটা হাতে নিয়ে পরিমাণটা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আংকেল ভুলে শূন্য একটা বেশি দিছেন মনে হয়!”
মানুষটি হাসি মুখে বলল, “না, শূন্য বেশি দিইনি। ঠিকই আছে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ হা করে চেকটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “নানি কেমন আছেন?”
মানুষটি বলল, “ভালো আছেন। বাসা খালি হওয়ায় এখন হাঁটা-চলা করা যায়। শুধু একটা বিচিত্র ব্যাপার–”
“কী বিচিত্র ব্যাপার?”
“মা এখন দিন-রাত জিনিসপত্রের সাথে কথা বলেন। সেদিন মায়ের সাথে খেতে বসেছি। টেবিলে আলুর ভর্তা ছিল। মা আলু ভর্তা প্লেটে নিয়ে সেটাকে বলতে থাকলেন, “ভাই আলু তুমি কেমন আছ? মন মেজাজ ভালো? তোমাকে টিপে টিপে এরকম ভর্তা করে দিয়েছে সেইজন্যে আমি খুবই দুঃখিত।”
বাচ্চারা অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রাখল। তখন মানুষটা বলল, “সেদিন পাবদা মাছ খেতে দিয়েছি। মা একটা পাবদা মাছ মুখের কাছে নিয়ে বলতে থাকেন, ভাই মাছ, তুমি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন। এইভাবে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি তোমাকে খাব কেমন করে?”
বাচ্চারা এবারে আর পারল না, সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে দিল!