ভলিউম ৪ – হারানো উপত্যকা – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯৮৯
এক
কিশোর, তোর চিঠি, ডেকে বললেন মেরিচাচী, অ্যারিজোনা থেকে।
বারান্দায় ছিল কিশোর, স্যালভিজ ইয়ার্ডের কাঁচেঘেরা ছোট্ট অফিস ঘরটায় ঢুকল। কই, দেখি?
কার চিঠি রে? ওখানে কাকে চিনিস?
কি জানি, বুঝতে পারছি না, খাম ছিঁড়ে চিঠিটা খুলল কিশোর। আরে, ভিকিখালা।
ভিকি? কোন ভিকি? একজন তো আছে বলেছিলি টুইন লেকসে।
জবাব না দিয়ে নীরবে পড়তে শুরু করল কিশোর:
কিশোর,
নিশ্চয় অবাক হচ্ছ, এতদিন পর লিখলাম। সেই যে খনির রহস্য ভেদ করে দিয়ে এসেছিলে, তারপর টুইন লেকসে তো আর একবারও এলে না। সত্যি, রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা আছে বটে তোমার।
চিঠি থেকে মুখ তুলে বলল কিশোর, হ্যাঁ, চাচী, সেই ভিকিখালাই।
ভাল আছে তো ও? আর মিস্টার উইলসন?
দেখি পড়ে।
আবার পড়তে লাগল কিশোর,
আমরা এখন টুইন লেকসে নেই। মিস্টার উইলসন ওখানকার সব কিছু বেচে দিয়েছেন, উন্নতি হচ্ছিল না তেমন, তাই। তারপর ফিনিক্সের পুবে এসে সুপারস্টশন মাউনটেইনের কাছে লস্ট ভ্যালিতে পুরানো এক র্যাঞ্চ কিনেছেন। ফিটনেস হেলথ রিসোর্ট করবেন। কাজ চলছে, খুব কাজের চাপ আমাদের। আগামী শীতের গোড়ায় টুরিস্ট সীজনের শুরুতেই স্টার্ট করার ইচ্ছে। কিন্তু সে-আশা পূরণ হবে কিনা সন্দেহ।
র্যাঞ্চটার প্রধান আকর্ষণ একটা পুরানো বিল্ডিঙ। ওটাকেই মেরামত-টেরামত করে আধুনিক একটা হোটেল করা হবে। জায়গার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাড়িটার নামও রাখা হয়েছে লস্ট ভ্যালি। এটা নতুন নাম। আগে নাম ছিল ইনডিয়ান হাউস। মাঝখানের বড় একটা হলরুমে ইনডিয়ানদের তৈরি অসংখ্য পুতুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কাচিনা পুতুল। খুব সুন্দর। আগের মালিক জোগাড় করেছিল। মিস্টার উইলসনের কাছে বিক্রি করে গেছে সব।
বাড়ির ভেতরটা সারিয়ে নিয়ে গত বড়দিনেই এখানে উঠেছি আমরা। তারপর শুনলাম কাচিনার অভিশাপের কথাটা। আমরা বাড়িতে ওঠার পর থেকেই অদ্ভুত কিছু কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছে এখানে, নানারকম গোলমাল হচ্ছে। জিনা মানতে চায় না-এখানেই আছে ও–কিন্তু টনির দৃঢ় বিশ্বাস বাড়িতে ভূত আছে। আরও অনেকেই একথা বিশ্বাস করে, ভয় পায়। ভূতের কথা কিছুতেই পুলিশকে বোঝানো যাচ্ছে না। তুমি যদি সাহায্য না করো, লস্ট ভ্যালি হেলথ রিসোর্টের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
অনেক কামরা আছে বাড়িতে, জায়গার অভাব নেই। স্কুল নিশ্চয় ছুটি এখন তোমাদের, মুসা আর রবিনকে নিয়ে চলে এসো না। বসন্তে মরুভূমি কিন্তু খুব সুন্দর হয়, এলেই দেখতে পারবে। ভালই লাগবে তোমাদের।
তোমাদের আশায় রইলাম। কাচিনার অভিশাপ থেকে মুক্ত করো লস্ট ভ্যালিকে, প্লীজ।
শুভেচ্ছা,
– ভিকিখালা।
কিশোরের পড়া শেষ হলে মেরিচাচী জানতে চাইলেন, কি লিখেছে?
চিঠিটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কিশোর বলল, নাও, পড়ো। একটা চেয়ার টেনে বসল সে।
চাচীও পড়লেন। চিঠির কোনায় হাতে আঁকা একটা ছবি দেখালেন, এটা কি? ক্যাচিনা?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। অনেক দিন আগে পড়েছিলাম, কাঠ কুঁদে পুতুল বানায় দক্ষিণ-পশ্চিমের ইনডিয়ান উপজাতিরা। ওগুলোর ছবিও দেখেছি। যেমন সুন্দর, তেমনি দামী।
এটা তেমন সুন্দর লাগছে না, মুখ বাঁকালেন মেরিচাচী। চিঠিটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, তা কি করবি?
যাব। অ্যারিজোনায় যাওয়ার এমন সুযোগ হাতছাড়া করব নাকি? তাছাড়া ভিকিখালা এত করে অনুরোধ করেছে।…দেখি, চাচাকে জিজ্ঞেস করে, কি বলে। রবিন আর মুসাও যেতে পারবে কিনা জানা দরকার।
টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল কিশোর, এই সময় দেখা গেল মুসাকে। স্ট্যাণ্ডে সাইকেল তুলে অফিসের দরজায় উঁকি দিল।
এই যে, একেবারে সময়মত এসে পড়েছ, হাত নেড়ে ডাকল। কিশোর। এসো।
কি ব্যাপার? কোন খবর আছে নাকি?
খবর মানে? হাসলেন মেরিচাচী। ক্যাচিনা ভূতের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছ এবার। যাই দেখি, বোরিস কি করছে।
বিস্মিত মুসাকে চিঠিটা দেখাল কিশোর। পড়ো।
যাচ্ছ তাহলে? চিঠি পড়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মেরিচাচী যখন আপত্তি করেনি, আর ঠেকায় কে? তুমি যাবে? ইচ্ছে আছে?
বলে কি লোকটা? অ্যারিজোনা র্যাঞ্চে ছুটি কাটানো…
তোমার আম্মা যদি রাজি না হন…
রাজি না হলে বাড়ি থেকে পালাব না! বাবাকে আগে বলব। বাবা মাকে রাজি করাগে। কিন্তু, ভাই, ওই ভূতটুতের ব্যাপারটাই ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
আগেই এত ভাবছ কেন? দেখিই না গিয়ে।
বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে রবিনের বাবা-মায়ের আপত্তি কোন সময়ই খুব একটা থাকে না।
শুক্রবার সকালের প্লেনে সীট বুক করা হলো। ছুটির সময়, ভিড় বেশি, আগে থেকে টিকেট কেটে না রাখলে পরে সীট পাওয়া যায় না। ভিকিখালাকে খবর পাঠিয়ে দিল কিশোর, ওরা যাচ্ছে।
টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। বাজারে গিয়ে কিনে নিল তিন গোয়েন্দা।
রকি বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে পার্টটাইম চাকরি করে রবিন, বুধবারে গিয়ে ছুটি নিল ওখান থেকে। রেফারেন্স বই ঘেঁটে ক্যাচিনার ওপর কিছু তথ্য জোগাড় করে লিখে নিল নোটবইতে।
অদ্ভুত সব কাঠের পুতুলের অসংখ্য ছবি রয়েছে বইটাতে।
হোপি ইনডিয়ান আর আরও কয়েকটা ইনডিয়ান উপজাতির ধর্মে রয়েছে ক্যাচিনার উপাখ্যান। পুতুলগুলো আসলে ইনডিয়ানদের কল্পিত প্রেতাত্মার প্রতিমূর্তি। বাস্তব-অবাস্তব জিনিস আর জীবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ওগুলো। ক্যাচিনা নানারকম আছে, যেমন, মেঘ-ক্যাচিনা, জন্তু-ক্যাচিনা, উদ্ভিদ আর পাখি-ক্যাচিনা। কল্পিত ভয়াবহ দৈত্যদানবের ক্যাচিনাও আছে অনেক।
জরুরী যা যা জানার, কিশোরের কথামত বই পড়ে সব জেনে নিল রবিন। কিন্তু বইয়ের কোথাও কাচিনার অভিশাপের কথা লেখা নেই। কিচ্ছু না।
যাত্রার আগের দিন আরেকটা চিঠি এল কিশোরের নামে।
অ্যারিজোনা থেকেই! ভুরু কোঁচকাল কিশোর। খাম ছিঁড়ে চিঠি খুলল। কাগজের কোনায় বড় করে একটা ক্যাচিনা পুতুল আঁকা, পিঠে তীর বিদ্ধ। তার তলায় কয়েকটা শব্দ, খবরের কাগজ কেটে অক্ষরগুলো নিয়ে আঠা দিয়ে পর পর সেঁটে দেয়া হয়েছে, দাড়ি-কমা কিছু নেই:
কিশোর পাশা
অ্যারিজোনা থেকে দূরে থাকবে।
দুই
এয়ারপোর্ট টারমিনাল বিল্ডিঙ থেকে বেরোতেই যেন মুখে আগুনের ছ্যাকা দিল রোদ।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। বিকেলেই এত কড়া! দুপুরে কি অবস্থা?
বুঝবে কালই, বলল জিনা। বিমান বন্দর থেকে বন্ধুদের এগিয়ে নিতে এসেছে। তবে ভাল জিনিসও অনেক আছে। একটু পরেই দেখতে পাবে লেবু বাগান। যা মিষ্টি গন্ধ!
একটা স্টেশন ওয়াগনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ, ওদের দেখে সোজা হলো। মাথায় লম্বা কালো চুলের বোঝা, নীল চোখ। বয়েস বিশের বেশি না।
টনি, পরিচয় করিয়ে দিল জিনা। চাচার র্যাঞ্চে কাজ করে।…টনি, ওরা তিন গোয়েন্দা। ওদের কথাই বলেছিলাম।
হাউ ডু ইউ ডু-র পালা শেষ হলো। গাড়িতে চড়ল সবাই। টনি। বসল চালকের আসনে।
জিনা, কিশোর বলল, তোমার চেহারাই বলছে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে? ঘটনাটা কি?
চাচা, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল জিনা, হাসপাতালে। গতরাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ক্যাচিনার অভিশাপ, গাড়ি চালাতে চালাতে বলল টনি। আগে কিছুটা সন্দেহ ছিল, কিন্তু এ-ঘটনার পর আর অবিশ্বাস করতে পারছি না।
কিসের অবিশ্বাস? কিশোরের প্রশ্ন।
ভূত নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আরে না, ভূতফুত কিছু না, মাথা নাড়ল জিনা। পাহাড়ের ওপর আগুন দেখেছে।
ভ্রুকুটি করল কিশোর। খুলে বলল।
গতরাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘটেছে ঘটনাটা, ঝাড়া দিয়ে মুখের ওপর থেকে তামাটে চুলের গোছা সরাল জিনা। মরুভূমির রোদে পুড়ে গাঢ় হয়ে গেছে চামড়ার রঙ। চাচার নাকি ঘুম আসছিল না। ছাতে গিয়েছিল হাঁটাহাঁটি করতে। হঠাৎ পাহাড়ে উজ্জ্বল আলো দেখতে পেল।
আলো না বলে বরং বলল আগুন, শুধরে দিল টনি। আগুন। জ্বেলে সঙ্কেত দিয়েছে, কোন সন্দেহ নেই।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল জিনা। গতরাতে পূর্ণিমা ছিল, তাই ঘরের আলো সব নিভিয়ে দিয়েছিল চাচা। আলো দেখে ছাত থেকে নেমে বাইরে বেরোচ্ছিল। হলঘর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল ক্যাচিনাটাকে…
শুধু ক্যাচিনা নয়, ক্যাচিনা ভূতটাকে, আবার শুধরে দিল টনি। বিমান বন্দর ছাড়িয়ে শহরে ঢুকেছে গাড়ি, রাস্তার দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাকে।
কি দেখেছে কে জানে, নাকমুখ বিকৃত করে বলল জিনা। আলো ছিল না। অন্ধকারে সিঁড়িতে কিসে যেন পা বেধে গিয়ে-কার্পেটেই হবে হয়তো, আছাড় খেয়ে পড়েছে। হলরুমে সিঁড়ির গোড়ায় পেয়েছি তাকে।
মাথা ঝাঁকাল টনি। হ্যাঁ। সিঁড়ি থেকে পড়েছে। কব্জি ভেঙেছে, গোড়ালি মচকেছে। ডাক্তার বলল, ভাল হতে হপ্তাখানেক লাগবে।
সমবেদনা জানাল মুসা আর রবিন, কিন্তু কিশোর চুপ। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কয়েকবার। আচ্ছা, ওই ক্যাচিনা ভূতটাকে কি আগেও দেখা গেছে?
কেউ কেউ নাকি দেখেছে, জিনা জবাব দিল। আমি দেখিনি।
উইলসন আংকেল বিশ্বাস করেন?
না।
ওই ভূতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তথ্য কে দিতে পারবে?
এক মুহূর্ত চুপ রইল জিনা। বোধহয় জুলিয়ান। দিনরাত টই টই করে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ে, মরুভূমিতে।
জুলিয়ান?
ভিকিখালার ভাইপো। নিজের কাছে নিয়ে এসেছে খালা। তার স্বামী, মানে আঙ্কেলও চলে এসেছে তার কাছে। আঙ্কেল স্কুল-মাস্টার। জুলিয়ানকে পড়ানোর ভার নিয়েছে। আশা করছে, বসন্তের শেষে স্কুল খুললেই ভর্তি করে দেবে।
কদ্দিন হলো এসেছে?
এই মাস দুয়েক। ভিকিখালার ভাই ভিয়েতনামে চলে গিয়েছিল, বিয়ে করেছিল ওখানেই। জুলিয়ানের মা ভিয়েতনামী মহিলা। ভালই ছিল তারা, কিন্তু হঠাৎ কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল জুলিয়ানের বাবা।
আহ্হা! আফসোস করল মুসা। চুকচুক করল জিভ দিয়ে।
তারপর? জিজ্ঞেস করল রবিন।
বিদেশীকে বিয়ে করায় জুলিয়ানের মায়ের ওপর তার আত্মীয় স্বজনরা চটা ছিল। জুলিয়ানের বাবা মারা গেলে আবার বিয়ে করতে বাধ্য করল মহিলাকে। সত্বাপ ভাল চোখে দেখল না ছেলেটাকে। শেষে ভিকিখালার কাছে চিঠি লিখল মহিলা। ওই এক ফুফু ছাড়া বাপের কুলের আর কোন আত্মীয় নেই জুলিয়ানের।
বয়েস কত ওর? জানতে চাইল কিশোর।
বারো, জবাব দিল টনি। কণ্ঠে বিরক্তির ছোঁয়া।
জিনাও বিরক্ত হলো। তুমি ওকে দেখতে পারো না তাই এমন করো। ও তোমার কি ক্ষতি করেছে?
ক্ষতি কি আর আমার করে? করছে তো তোমাদের। মিস্টার উইলসনের দুর্ঘটনার জন্যে ও-ই দায়ী, কাচিনা নয়।
মানে? রহস্যময় চিঠিটার কথা ভাবল কিশোর।
মিস্টার উইলসন হলে নেমেছিলেন বাইরে বেরোনোর জন্যে, আগুন দেখে। আর ওই আগুনের জন্যে ছেলেটা দায়ী। দুটো বড় ক্যাকটাস আর একটা প্যালো ভারডে গাছ ইতিমধ্যেই পুড়িয়ে ছাই করেছে।
সেটা তোমার অনুমান, প্রতিবাদ করল জিনা। আগুন যে জুলিয়ান লাগিয়েছে, তুমি শিওর হয়ে বলতে পারবে?
দ্বিধা করল টনি। এ ছাড়া আর কে লাগাবে? সারাক্ষণ র্যাঞ্চের চারপাশে ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়, আগুন জ্বালে…
আমি বিশ্বাস করি না। ভিকিখালাও না।
কিন্তু আগুন তো একবার সে লাগিয়েছিল, নাকি?
তা লাগিয়েছিল, তবে সেটা এমন কোন ব্যাপার না। কিশোরের দিকে ফিরল জিনা। এ দেশের লোক আর তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী জুলিয়ান। হাজার হোক, বাপের কুলের লোকদের কথা কে না জানতে চায়? সিনেমা আর টেলিভিশন থেকে নানারকম আইডিয়া নেয় ও। একটা পুরানো ফিল্মই তার মাথায় ঢুকিয়েছে স্মোক সিগন্যালের ব্যাপারটা। পাহাড়ের ওপর চড়ে ধোয়ার সিগন্যাল দিতে গিয়েছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে…এ রকম আর কখনও করবে না, কথা দিয়েছে।
তোমার চাচা যে আলো দেখল, ওটা কিসের আলো?
জানি না।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দেখতে গিয়েছিলাম, জিনার কথার পিঠে বলল টনি। আগুনের কোন চিহ্ন দেখলাম না। মরুভূমিতে হয় এ রকম। জ্বলে ছাই হয়ে যায় জিনিস, বাতাসে বালি উড়িয়ে এনে তার ওপর ফেলে ঢেকে দেয় সব নিশানা।
চাঁদের আলোর কারসাজিও হতে পারে। মনে ভূতের ভাবনা থাকলে কত কিছুই তো দেখে মানুষ, জিনা বলল।
জুলিয়ানের তাহলে বদনাম হয়ে গেছে খুব, না? আনমনে বলল কিশোর।
হ্যাঁ। ও আসার পর থেকেই অদ্ভুত কিছু কাণ্ড ঘটেছে। কয়েক জায়গায় আগুন লেগেছে। ভূতটাও ঘনঘন দেখা দিচ্ছে। কিশোর, আমি বলছি ছেলেটা নির্দোষ। অনুরোধের সুরে বলল জিনা, তুমি ওর বদনাম ঘোচাও।
আমি? ভুরু কোঁচকাল কিশোর। কিভাবে? অকাজগুলো যদি সত্যি সত্যি করে থাকে সে? আগুন লাগিয়ে থাকে?
শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে গাড়ি। পথের দু-ধারে পামের সারি, তার ওপাশে খানিক পর পরই লেবু বাগান। সেদিকে চেয়ে মাথা নাড়ল জিনা, ও করেনি। তুমি তদন্ত করলেই বুঝতে পারবে। কিছু একটা রহস্য রয়েছে লস্ট ভ্যালি রিসোর্টে। কিশোরের দিকে ফিরল। জুলিয়ান স্বীকার করেছে, সে একবার আগুন জ্বেলেছে সিগন্যাল দেয়া প্র্যাকটিস করার জন্যে। কিন্তু রাতে গেট খুলে রাখা, ঘোড়ার বাধন খুলে ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া, ও সব শয়তানীর কোনটাই সে করেনি। ভিকিখালা তার কথা বিশ্বাস করে, আমিও করি। অনেক রকমে চেষ্টা করেছে ভিকিখালার স্বামী; ভয় দেখিয়ে বলেছে, মিথ্যে কথা বললে আবার তাকে ভিয়েতনামে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। কেঁদে ফেলেছে জুলিয়ান। কসম খেয়ে বলেছে, সে ওসব কিছুই করেনি।
ঠিক আছে, দেখা যাক, নিচের ঠোঁটে জোরে একবার চিমটি কাটল কিশোর। আগে ভেবেছিল, একটা রহস্য, এখন দেখা যাচ্ছে। দুটো। অ্যারিজোনা মরুভূমিতে ছুটি ভালই কাটবে মনে হচ্ছে।
র্যাঞ্চ আর কদ্দূর? প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে বলল মুসা।
দূর আছে এখনও, জানাল টনি। ওই যে, দূরে, সুপারস্টিশন মাউনটেইন, পুবে দেখাল সে। মরুর বুক থেকে উঠে গেছে উঁচু গিরিশৃঙ্গ।
নীল চুড়া এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব কিছু ছাড়িয়ে, মনে হয় সাদা মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায়, আকাশের কোণটিতে। কোথা পাবে পাখা সে…
হেই, কি বিড়বিড় করছ? কনুই দিয়ে তো লাগাল মুসা।
বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর। অ্যাঁ! ও, না, একটা বাংলা কবিতা অ্যাডাপ্ট করছিলাম।
আচ্ছা, সুপারস্টিশন মাউনটেইনের বাংলা কি হয়?
কুসংস্কার পর্বত। উদ্ভট নাম।
আর লস্ট ভ্যালি? রবিন জিজ্ঞেস করল।
হারানো উপত্যকা।
জিনা, রসিকতার সুরে বলল মুসা, কুসংস্কার পর্বতের হারানো উপত্যকায় পোড়ো খনিটনি আছে নাকি, ওই যে, টুইন লেকসের মৃত্যুখনির মত? রহস্যটা জমে তাহলে ভাল।
আছে, লস্ট ডাচম্যান মাইন, হাসল টনি। অ্যাপাচি জাংশনে গেলেই দেখবে, টুরিস্টদের কাছে ম্যাপ বিক্রি করছে ফেরিয়ালারা, ওখানে যাওয়ার।
পথে পড়বে নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ। ছোট একটা টাউন। তার পরেই আমাদের র্যাঞ্চ।
আরিব্বাবা, কত দূরে চললাম! মুসা বলল।
তাতে কি? টিপ্পনী কাটল জিনা। আমরা সব্বাই ঘিরে রাখব। তোমাকে, ক্যাচিনা যাতে তোমাকে ধরতে না পারে।
আমি কি ভয় পাই নাকি? বললাম, সভ্য জগৎ থেকে কত দূরে চলে এসেছি…একেবারে ওয়াইল্ড ওয়েস্ট…
বুনো পশ্চিম, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
প্রথম প্রথম এসে আমারও খারাপ লাগত, বলল জিনা। এখন তো আর এ জায়গা ছেড়ে যেতেই মন চায় না। আহ, কমলা বাগান। এসে পড়েছে! কি সুন্দর গন্ধ!
মরুর হালকা বাসন্তী বাতাসকে ভারি করে তুলেছে কমলা ফুলের মিষ্টি সুবাস।
জোরে শ্বাস টেনে গন্ধ নিল কিশোর। আউফ, সত্যি চমৎকার!
এটাকে চমৎকার বলছ, আরও আগে এলে বুঝতে, চমৎকার কাকে বলে, বলল টনি। ফুল তো এখন অনেক কম, মৌসুম প্রায় শেষ। ভরা। মৌসুমে রাশি রাশি ফুল ফোটে, কমলা আর পাকা আঙুরের গন্ধে মৌ মৌ করে বাতাস। আমাদের র্যাঞ্চেও আছে কিছু গাছ। ফলও ধরেছে। পাকা আঙুর আর কমলা নিজেরাই ছিঁড়ে নিয়ে খেতে পারবে।
খাইছে! তাই নাকি? তর সইছে না আর মুসার। তা, ভাই, তাড়াতাড়ি করো। দিলে এমন এক কথা শুনিয়ে, ধৈর্য রাখতে পারছি না। আর।
অধৈর্য করে দেয়ার আরও অনেক কিছু আছে, মুসা আমান, হেসে বলল জিনা। ভিকিখালা তো তোমাকে চেনে, তোমরা আসার সংবাদ শুনেই খাবার বানাতে লেগে গেছে। আধমণী একখান ভুড়ি তৈরি করে। দিয়ে তারপর তোমাকে রকি বীচে ফেরত পাঠাবে এবার।
পথের একটা বাঁক ঘুরল স্টেশন ওয়াগন। গাড়িটাকে টনি দেখল আগে, তারপর রবিন; চেঁচিয়ে উঠল, আরে আরে, কানা নাকি!
উল্টো দিক থেকে নাক সোজা করে গুঁতো লাগাতে ছুটে আসছে। একটা কার।
তিন
সাঁই করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পাকা রাস্তার পাশের মাটিতে গাড়ি নামিয়ে আনল টনি। অসমতল জায়গায় পড়ে নাচতে শুরু করল স্টেশন ওয়াগন, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। নানারকম সুরে চেঁচামেচি জুড়ল আরোহীরা। আতঙ্কিত চোখে তাকাল ঢালের দিকে। কঠিন পাথুরে মাটির ঢাল নেমে গেছে প্রায় দশ-বারো ফুট, তারপর শুরু হয়েছে মাঠ, তাতে বড় বড় কাটাঝোঁপ।
রুখতে পারল না টনি, ঢালে নেমে গেল গাড়ির সামনের চাকা। এরপর আর আটকানোর উপায় নেই, ব্রেক করলে উল্টে যাবে।
লাফাতে লাফাতে মাঠে নামল গাড়ি, ঝোঁপঝাড় ভেঙে এসে থামল। ইঞ্জিন গেল বন্ধ হয়ে। হুইল শক্ত করে চেপে ধরে আছে এখনও টনি, আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল শব্দ করে। ব্যাটা মনে হয় গলা পর্যন্ত টেনেছে। এভাবে গাড়ি চালায় কেউ?
মুসার বাহু খামচে ধরে রেখেছিল জিনা, আস্তে করে ছেড়ে দিল।
বাপরে বাপ, বাঘের নখ; না না, বাঘিনীর! রক্ত বের করে ফেলেছে, বাহু ডলছে মুসা। তা, টনি, এখানে লোকে এভাবেই গাড়ি চালায় নাকি, হে?
ইচ্ছে করে করেছে শয়তানিটা, গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। ঠেলে ফেলে দিতে চেয়েছিল আমাদের। অ্যাক্সিডেন্ট করাতে চেয়েছিল। রহস্যময় চিঠিটা ফালতু শাসানী বলে আর মনে হচ্ছে না এখন।
আমারও তাই মনে হলো, একমত হলো রবিন। কিন্তু কেন?
ক্যাচিনা রহস্যের সঙ্গে কোন যোগাযোগ আছে হয়তো, চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে।
ফিরে চাইল টনি। লাইসেন্স নাম্বার দেখেছ?
এত তাড়াতাড়ি ঘটেছে ঘটনা, দেখার সময়ই পায়নি কেউ।
হুঁ, স্টার্টারের চাবিতে হাত দিল টনি। এখন এটার ইঞ্জিন চালু হলেই বাঁচি। কয়েকবারের চেষ্টায় চালু হলো ইঞ্জিন। ঝোঁপঝাড়ের কিনার দিয়ে গাড়ি চালাল সে। কিছুদূর এগোনোর পর মাঠের সঙ্গে এক সমতলে এসে গেল পথ। রাস্তায় উঠল গাড়ি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আরোহীরা।
মেসা ছাড়িয়ে এল ওরা। পাতলা হয়ে এসেছে, পথের দু-ধারের ঝোঁপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বাড়িঘর। নির্মেঘ নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে উঁচু উঁচু স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস। বিচিত্র ডালপাতা। বসন্ত, তাই ফুল ফুটেছে। ডালের মাথায় মাখনরঙা ফুলের মুকুট।
অ্যাপাচি জাংশন পেরোল। সরু হয়ে এল পথ।
হাত তুলে দূরে বাড়িটা দেখাল জিনা।
একেবারে তো দুর্গ, মুসা বলল।
হাসল জিনা। প্রথমবার দেখে আমিও তাই বলেছিলাম।
দুর্গের বাড়া, বলল টনি। কয়েক ফুট পুরু দেয়াল। এভাবে বানানোর কারণ আছে। ইনডিয়ানদের রাজত্ব ছিল তখন এখানে। নিরাপত্তা চেয়েছিলেন মিস্টার লেমিল।
দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়েরই অংশ, রবিনের মন্তব্য।
সুপারস্টিশন থেকে এসেছে বেশির ভাগ পাথর। বাইরেটা যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়েছেন মিস্টার উইলসন, কিছুই বদলাননি। পুরানো গন্ধটা রাখতে চেয়েছেন আরকি। টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন বাড়বে।
ফ্যানটাসটিক! মুগ্ধ হয়ে দেখছে মুসা। এরকম বিল্ডিঙ আছে, ভাবিনি।
অন্য বাড়িগুলো কোনটা কি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ডানের ছোটটা আস্তাবল, বলল জিনা, ওই যে পাশেই কোরাল। উল্টোদিকের ছোট ছোট বাড়িগুলো বাড়তি বাংলো। লোক বেশি হয়ে গেলে ওখানে জায়গা হবে। মেইন হাউসের পেছনে বিশাল স্নানের ঘর আছে, সুইমিং পুল আছে। কাছাকাছি টেনিস কোর্ট, র্যাকেটবল কোর্ট তৈরি হচ্ছে। দম নিয়ে বলল, অনেক কিছুই তৈরি বাকি এখনও।
হুঁ, খুব বড় কাজ হাতে নিয়েছেন, মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
তোমার চাচাকে সাহায্য করার কে কে আছে?
ভিকিখালা আর তার স্বামী, মিস্টার ডিউক। উনি আছে, প্রায় সব কাজই দেখাশোনা করে। আর আছে ডক্টর জিংম্যান, হাসল জিনা। ডক্টর জিংম্যান আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। বাড়ি ওই-ই দিকে, পর্বতের দিকে হাত তুলে দেখাল সে। খুব সাহায্য করে চাচাকে।
দশ-পনেরোজন মেহমানকে এখনই জায়গা দিতে পারি আমরা, জানাল টনি। বাংলোগুলো হয়ে গেলে আরও বিশ-বাইশজনকে দিতে পারব।
আসলে হচ্ছেটা কি এখানে? জিজ্ঞেস করল রবিন। সরু পথের দুই ধারে ফ্যাকাসে সবুজ গাছগুলো ছোট ছোট হলুদ ফুলে বোঝাই, সেদিকে চেয়ে আছে সে। লোক দেখানো…মানে ডিউড র্যাঞ্চ, নাকি সত্যি সত্যি র্যাঞ্চ এটা?
তারমানে র্যাঞ্চ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছে তোমাদের, ভাল, মাথা কাত করল টনি। এটাকে র্যাঞ্চ না বলে হেলথ রিসোর্ট বলা উচিত। মিস্টার উইলসন চান, বদ্ধ জায়গায় থাকতে থাকতে যারা বিরক্ত হয়ে গেছেন, তারা এখানে এসে খোলা হাওয়ায় একটু দম নেবেন, সেই সঙ্গে কিছুটা ব্যায়াম, কিছুটা বিশ্রাম আর খাওয়া-দাওয়াটা ঠিকমত করবেন। তাজা হয়ে ফিরে যাবেন আবার শহরে।
ঠিকমত খাওয়া? শঙ্কিত হলো মুসা। ডায়েট কন্ট্রোলের ব্যাপার। স্যাপার না তো?
আরে না, হাসল জিনা, তার হাসিতে যোগ দিল সবাই। ওজন কমানোর কোন ব্যাপার নেই। ভিকিখালার পাল্লায় পড়ে বরং তালপাতার সেপাইরা নাদুস নুদুস হয়ে ফিরে যাবে। তবে কেউ যদি ভুড়িটুরি কমাতে চায়, তাহলেও অসুবিধে নেই। ওই কাজেও ভিকিখালা ওস্তাদ। নাচ, ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার,
সব কিছুরই ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
শুনতে ভাল লাগছে, বলল কিশোর। টুরিস্ট আকর্ষণের চমৎকার ব্যবস্থা। সাধারণ রিসোর্টের চেয়ে আলাদা।
হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল জিনার ঠোঁটে। যদি ক্যাচিনার অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে। ভূতের উপদ্রব ঘটতে থাকলে একজন লোকও আসবে না।
ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কি বলল টনি, বোঝা গেল না। রাস্তা শেষ, ড্রাইভওয়েতে পড়েছে গাড়ি। গাড়িপথের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও, এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। এগিয়ে গেছে পুরানো বাড়িটার দিকে। মেসকিট ঝোঁপ আর ক্যাকটাস ঘন হয়ে জন্মেছে সামনের দিকে। গাড়িপথ ধরে বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে মোড় নিতেই সামনের দৃশ্য দেখে প্রায় চমকে গেল তিন গোয়েন্দা।
পেছনে রুক্ষ মরুর বিশাল বিস্তার, তাতে পুষ্পশূন্য ধূলিধূসরিত ক্যাকটাস, মাঝে পাতাবাহারের নিচু বেড়া। বেড়ার এপাশে সবুজের সমারোহ, ঝিক করে চোখে লাগে। ঘন সবুজ রসাল ঘাসে ঢাকা লন, রঙিন ফুলের ঝাড়, কমলা লেবুর বাগান। কমলার গন্ধ ভুরভুর করছে। গরম বাতাসে। বিরাট বাগানের ঠিক মাঝখানে সুইমিং পুল, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানিতে আকাশ দেখা যায়, মনে হয় পানির রঙই বুঝি ঘন নীল। তার পাশে ধবধবে সাদা একটা বাড়ি। সব কিছুই সাজানো গোছানো, যেন ছবি। এখনও নাকি পুরোপুরি তৈরিই হয়নি। হওয়ার পর কি হবে ভেবে অবাক হলো ওরা।
আরিব্বাবা, দারুণ! সহজে প্রশংসা করে না যে কিশোর পাশা, তার মুখ দিয়েও বেরিয়ে গেল এই কথা।
পছন্দ হয়েছে, না? হেসে বলল টনি। তারমানে সফল হয়েছি। আমরা। দর্শককে চমকে দিতে পেরেছি।
রূপকথার রাজ্য মনে হয়, বিড়বিড় করল রবিন।
মরুভূমিতে মরূদ্যান, মুসা বলল।
গাড়ি রাখল টনি। নামল সবাই।
সাঁতারের পোশাক এনে তো ভালই করেছি দেখা যায়, সুইমিং পুলটার দিকে লোভাতুর নয়নে তাকিয়ে আছে মুসা। কি, রবিন, খুব তো হাসাহাসি করেছিলে, মরুভূমিতে ব্যাদিং সুট দিয়ে কি করব বলে বলে; এখন?
জিনা, টনি বলল, তুমি ওদের নিয়ে এসো। আমি ভিকি আন্টিকে খবর দিচ্ছি। দুই হাতে বিশাল দুই সুটকেস তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল সে।
ওদিকে আরও গোটা তিনেক বাংলো বানানোর ইচ্ছে আছে চাচার, মরুভূমির দিকে দেখিয়ে বলল জিনা। আরও ছয়জনের জায়গা হবে তাহলে।
ভালই প্ল্যান করেছেন তিনি, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। লোকে ভাববে মরুভূমিতে যাচ্ছে, দেখবে শুধু বালি আর বালি। এসে যাবে চমকে, আমাদের মত। মরুভূমিও আছে, আবার সবুজও আছে। কষ্ট করতে হবে এটা ধরে নিয়েই আসবে, এসে পাবে এই আরাম। ফলে আরামটা আরও বেশি মনে হবে।
ইচ্ছে করলে ঘোড়ায় চড়ে চলে যাওয়া যায় পর্বতের ওদিকে, জিনা বলল। চাইলে ওখানে রাত কাটানো যায়। আহ, কি যে মজা! আমি একবার গিয়েছিলাম। রাতে আগুনের কিনারে শুয়ে মনে হলো, দেড়শো বছর পিছিয়ে চলে গেছি সেই বুনো পশ্চিমে… দরজা খুলতে দেখে থেমে গেল সে।
ভিকি বেরিয়ে ছুটে এল দু-হাত বাগিয়ে। তোমরা এসেছ। যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। সূক্ষ্ম একটা দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা গেল তার চেহারায়।
কোনরকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল কিশোর, কি হয়েছে, খালা? খারাপ কিছু?
খানিক আগে ডাক্তার এসেছিল, জানতে, জুলিয়ান একটা অ্যাপলুসা নিয়ে এসেছে কিনা।
কী? ভুরু কোঁচকাল জিনা।
অস্বস্তি ফুটল ভিকির চোখে। ডেনিংদের আস্তাবলে নাকি একটা ঘোড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কে জানি জিংম্যানকে বলেছে, একটা মাদী ঘোড়াকে টেনে আনতে দেখা গেছে একটা ছেলেকে। এদিক-ওদিক তাকাল। সাদাকালো পিন্টো ঘোড়ায় চেপেছে ছেলেটা।
ওটায় চড়ে এখানে এসেছিল নাকি?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ভিকি। বাড়িই আসেনি সারাদিন। গতরাতে মিস্টার উইলসন হাত-পা ভাঙায় ভীষণ ঘাবড়ে গেছে সে। মনমরা হয়ে আছে তারপর থেকে। সকালে খেয়ে সেই যে বেরিয়েছে, আর দেখিনি তাকে।
কোথায় দেখা গেছে তাকে, জিংম্যান কিছু বলেছে?
মাথা নাড়ল ভিকি।
ডিনারের দেরি আছে। মেহমানদের দেখিয়ে বলল জিনা, ওদেরকে ওদের ঘরে দিয়ে আসি। তারপর দেখি, আমি আর টনি খুঁজতে বেরোব। তুমি কিছু ভেব না, খালা। ওই চেরিই একমাত্র সাদাকালো পিন্টো ঘোড়া না এখানে, আরও আছে। আর জুলিয়ানের বয়েসের ছেলেও আছে। অন্য কাউকেও দেখে থাকতে পারে ওই লোক।
হাসল ভিকি, কিন্তু ভাবনার কালো ছায়া দূর হলো না চেহারা থেকে।
সাদাকালো ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখা গেল একটা ছেলেকে। দড়িতে বেঁধে টেনে আনছে একটা ছাইরঙ মাদী অ্যাপলুসা ঘোড়া, পেছনটা ভারি সুন্দর, সাদার ওপর ছাই রঙের ফোঁটা। চকচকে চামড়া থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে।
অ্যাই, ফুপু, দূর থেকেই ডেকে বলল ছেলেটা, দেখো, কি এনেছি। মরুভূমিতে ঘুরছিল, ধরে নিয়ে এলাম। সুন্দর, না?
জুলিয়ান, কেঁদে ফেলবে যেন ভিকি, কেন…
হাত তুলে ভিকিকে চুপ করাল কিশোর। জুলিয়ান আরও কাছে এলে জিজ্ঞেস করল, মরুভূমিতে পেয়েছ? এগিয়ে গেল সে।
লাজুক হাসি হাসল জুলিয়ান, অনেকটা মেয়েলি চেহারা। অ, তোমরা এসে পড়েছ। তোমাদের কথা শুনেছি ফুপুর কাছে। তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা!
হ্যাঁ। আর ও…
বোলো না, বোলো না। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।…হা, কি যেন বলছিলে…মরুভূমিতে পেয়েছি নাকি ঘোড়াটাকে? হ্যাঁ, পেয়েছি। ছাড়া পেয়ে ঘুরছিল। ডাকতেই কাছে চলে এল। বড় রাস্তায় চলে গেলে তো আর পাওয়া যেত না, ডাকলেই যখন কাছে যায়, কে না কে ধরে নিয়ে যেত। আমি নিয়ে এলাম, ভাল হলো না?
নিয়ে সোজা আস্তাবলে গেলে ভাল করতে, জিনা বলল। যাকগে, এসেছ এসেছ, এখন চলে যাও। আমি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি ওদেরকে, তুমি ঘোড়াটা খুঁজে পেয়েছ।
আচ্ছা, মাথা কাত করে সায় জানাল জুলিয়ান। পিন্টোর মুখ ঘুরিয়ে অ্যাপলুসাটাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।
সেদিকে চেয়ে অস্বস্তিভরে মাথা নাড়ল ভিকি। ঠিক ওকে চোর ভাববে ওরা! তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরল সে। কি যে করব, বুঝি না! একটা সমস্যা! এসেই এসব ঝামেলা দেখে নিশ্চয় বিরক্ত হচ্ছ। এসো, ঘরে এসো।
পাথরের বাড়িটার ছায়ায় এসে অকারণেই গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের। অথচ বাতাস গরম এখানেও। অবচেতন মন বলছে, হুঁশিয়ার! বিপদ আসছে!
চার
বিশাল বাড়ির ভেতরটাও চমকে দেয়ার মত। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে এগোলে সামনে পড়বে মস্ত এক ঘর, সাজানো-গোছানো সোফা আর চেয়ার, বসে কথা বলার জন্যে। এক কোণে একটা টেলিভিশন সেট। পেছনের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে ঢুকলে, অতি-আধুনিক রান্নাঘর। ওরা ঢুকল সেখানেই। বাতাসে খাবারের লোভনীয় গন্ধ।
নাক কুঁচকে গন্ধ শুকল মুসা। খাইছে! কমলা ফুলের গন্ধের চেয়ে ভাল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ে যাবে, ভিকি বলল। রাধছিলাম, এই সময় এল ডাক্তার।
তুমি লেগে যাও আবার, খালা, জিনা বলল। জিংম্যানের সঙ্গে আমি কথা বলব। ডেনিংদেরও ফোন করব।
আচ্ছা। চুলার দিকে এগোল ভিকি।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে খোলামেলা একটা ডাইনিং রুমে ঢুকল জিনা। অন্যান্য ঘরের মতই এটাও বিরাট। চার কিংবা ছয় চেয়ারের অনেকগুলো খাবার টেবিল। কিশোর আন্দাজ করল, জায়গা যা আছে, তাতে এর ডবল চেয়ার-টেবিল জায়গা হবে। ছোট ছোট ইনডিয়ান কম্বল আর চাদর দিয়ে দেয়াল সাজানো। বেশ কয়েকটা পেইন্টিং রয়েছে, সবই মরুভূমির দৃশ্য। ইনডিয়ান ঝুড়িতে কায়দা করে সাজানো রয়েছে শুকনো ফুল, পাপড়ি শুকিয়ে গেলেও ঝরে যায়নি। ইচ্ছে করেই পুরানো ওয়েস্টার্ন পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে।
এসো, তোমাদের ঘর দেখিয়ে দিই, জিনা বলল। তারপর জুলিয়ানের ব্যাপারটা দেখতে হবে। ভাবছি, বিকেলটা তোমাদের সঙ্গে কাটাব…
তোমার কি মনে হয়, জিনা? প্রশ্ন করল কিশোর। জুলিয়ান ঘোড়াটা চুরি করে এনেছে?
সে কথা ভাবতেও খারাপ লাগে, ঘুরিয়ে জবাব দিল জিনা। কি আর বলব?, ভিকিখালার কাছে শুনলাম, ভালই কাটছিল এখানে তাদের। জুলিয়ান ঘোড়ায় চড়া শেখার পর থেকেই নানারকম গোলমাল…
আমার কাছে কিন্তু বেশ চালাক ছেলে মনে হলো, রবিন বলল।
ইংরেজি তো ভাল বলে। এখানে এসে এত তাড়াতাড়িই শিখে ফেলল?
ওর মা ইংরেজি জানে। সেজন্যেই শিখতে পেরেছে। বাবা তো মারা গেছে ওর তিন বছর বয়েসের সময়। বাবার চেহারাই ভালভাবে মনে করতে পারে না।
ডাইনিং রুম থেকে ওদেরকে আরেকটা হলরুমে নিয়ে এল জিনা।
আরে! ওগুলো ক্যাচিনা? অবাক হয়েছে মুসা। সাজানো দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে সে।
চাচার প্রাইভেট গ্যালারি এটা, হেসে বলল জিনা। এবং আমাদের ঘরোয়া ভূতের বাসস্থান।
এসব কিচ্ছা নিশ্চয় বিশ্বাস করো না তুমি? বলে উঠল কেউ।
ফিরে তাকাল সবাই। উল্টোদিকের একটা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। লম্বা, বলিষ্ঠদেহী এক লোক।
ও, ডাক্তার আঙ্কেল, এসে পড়েছেন, বলল জিনা। আপনার কথাই ভাবছিলাম। ফোন করতাম। জুলিয়ানের ঘোড়া নিয়ে আসার সংবাদ সংক্ষেপে জানাল ডাক্তারকে।
ঠিক আছে, ডাক্তার বলল, তোমার আর ফোন করার দরকার নেই। ডেনিংদের আমিই জানিয়ে দেব।
এতক্ষণে যেন তিন গোয়েন্দার ওপর চোখ পড়ল ডাক্তারের।
পরিচয় করিয়ে দিল জিনা।
অ, তোমরাই তাহলে সেই বিখ্যাত তিন গোয়েন্দা। কিশোরের দিকে ফিরল জিংম্যান। ভিকি আর জিনার ধারণা, তুমি এলে ওই ভূত রহস্যের সমাধান হবেই হবে।
হাসল শুধু কিশোর, কিছু বলল না।
তা তো হবেই, জোর গলায় বলল জিনা। কিশোর পাশার কাছাকাছি থাকলে ভূতের আরামের দিন শেষ।
বাড়িয়ে বলছ, বলল কিশোর। পারব কিনা জানি না, তবে ভূত তাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমরা। বদনাম যে কোন রিসোর্টের জন্যে মারাত্মক।
আমিও, তো সে কথাই বলি, সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ধরল ডাক্তার।
ওই ছেলেটাকে নিয়েই যত ভয়। যে হারে গোলমাল পাকাচ্ছে…জিনা, তোমার চাচার স্বার্থেই বলি, ছেলেটা ওরকম করতে থাকলে কিন্তু সাংঘাতিক বদনাম হয়ে যাবে। আর পড়শীদের সঙ্গে তোমার চাচার সম্পর্ক ভাল না থাকলে, এই রিসোর্ট চালাতে পারবে না।
জুলিয়ানের কথা বলছেন তো? কিন্তু ওর বয়েসী একটা ছেলে কি আর এমন গোলমাল পাকাবে, যে সবাই অস্থির হয়ে থাকবে? জল জুলিয়ানের লজ্জিত হাসি, বড়বড় বাদামী চোখ আর ঘোড়ার পিঠে
গুলমাল পাকবে জড়সড় হয়ে বসে থাকার দৃশ্য কল্পনা করল কিশোর। নাহ, ওই ছেলে খারাপ কিছু করবে বলে ভাবা যায় না।
যা করছে তা-ই যথেষ্ট, গম্ভীর হয়ে বলল ডাক্তার। অ্যাপলুসাটার অনেক দাম। শুধু চুরিই নয়, আরও অনেক শয়তানী সে করেছে। এ-যাবৎ তো শুধু গাছ জ্বালিয়েছে, কোনদিন গোলাঘর আর খড়ের গাদায় আগুন লাগায় কে জানে। না, জিনা, হেসে উড়িয়ে দেয়ার কোন মানে হয় না। এসব ব্যাপার সিরিয়াসলি নেয়া উচিত।
ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে অবাক হলো জিনা। কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় ঘরে ঢুকল টনি। এই যে, ডাক্তার আঙ্কেল, আপনাকেই খুঁজছি।
র্যাঞ্চ সংক্রান্ত কাজের কথায় মশগুল হলো দু-জনে।
দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে ঘুরল জিনা। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এগোল। খুব সুন্দর, না? কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছে ওগুলো ফেলে দিতে। তাহলে নাকি ভূত চলে যাবে।
মাথা খারাপ, বলল রবিন। রিআল আর্ট ওগুলো।
কি, ক্যাচিনা? জিজ্ঞেস করল কিশোর। দেখে তো কিছু বোঝা যায় না।
লাল, সাদা আর হলুদে আঁকা একটা ছবি দেখিয়ে জিনা বলল, ওটা মেঘ-ক্যাচিনা। ওই যে, পালকের পাখার মত মনে হচ্ছে, ওটা ঈগল-ক্যাচিনা। এই যে, সাদা রোমশ, এটা ভালুক-কাচিনা। নীল মুখোশ আর সাদা কিম্ভুত শরীর দেখিয়ে বলল, প্রিকলি-পার ক্যাকটাস ক্যাচিনা। কয়েকটা অদ্ভুত ছবি দেখাল, ওগুলো কি, কেউ বুঝতে পারেনি। চেনা যায় না।
হুঁ, অচেনা ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল রবিন, টুরিস্টরা পছন্দ করবে।
আমারও তাই মনে হয়। হাসল জিনা। আচ্ছা, বলো এখন, কে কোথায় থাকবে? এ ঘরের পাশেই দুটো ঘর আছে। ওখানে থাকলে যখন খুশি এসে ছবিগুলো দেখতে পারবে। ঘর আছে দুটো, কোনটাতেই দু-জনের বেশি জায়গা হবে না। একলা কে শুতে চাও?
আমিই থাকি, কি বলো? মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল কিশোর।
থাকো। হাত নাড়ল মুসা। আমি বাপু ভূতের ঘরের কাছে একলা থাকতে পারব না।
দুটো ঘর থেকেই দরজা দিয়ে হলঘরে ঢোকা যায়।
বাড়ির সামনের অংশ ছেড়ে দিতে হয়েছে লবি আর অফিসের জন্যে, জিনা জানাল। তাই সমস্ত বেডরুমের দরজা হলের দিকে করা। হয়েছে। আমার আর টনির ঘর তোমাদের ঘরের কাছেই। চাচার ঘরও। সব কিছু ঠিকঠাক হলে এ ঘর মেহমানদের ছেড়ে দিয়ে চাচা চলে যাবে ওপরে।
ভিকিখালারা কোথায় থাকছে?
আপাতত দোতলায়, আঙুল তুলে মাথার ওপরের ছাত দেখাল জিনা।
ভূতটাকে কোন্ জায়গায় দেখেছেন তোমার চাচা?
এ ঘরেই। প্রথমে ভাবল চোরটোর কিছু, ধরার জন্যে দৌড় দিতে গিয়ে কার্পেটে পা বেধে খেল আছাড়।…ভূতটাকে মিলিয়ে যেতে দেখল ওই ছবিটার ভেতর… নাম-না-জানা একটা ক্যাচিনা দেখাল জিনা।
স্থির চোখে ছবিটার দিকে চেয়ে রইল কিশোর। যেন ছবির মুখোশে ঢাকা মূর্তিটা মূল্যবান তথ্য জানাবে তাকে।
কিন্তু আগের মতই রইল ছবিটা, দুর্বোধ্য। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। চলল, ঘর দেখাও। হাতমুখ ধুয়ে রেডি হইগে। ভিকিখালা ডাকলে…
না, অত তাড়াহুড়ো নেই। রান্না শেষ হতে সময় লাগবে। ইচ্ছে করলে ছোট্ট একটা নিদ্রাও দিয়ে নিতে পারো।
আরে না, এখন কি ঘুমায়, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। পেট ঠাণ্ডা না করলে ঘুম আসবে না।
ছেলেদের সুটকেস আর অন্যান্য মালপত্র সব একই ঘরে রেখেছে টনি। সুটকেসের হাতলে এয়ারলাইনসের নাম ছাপা ট্যাগ লাগানো, ট্যাগের উল্টোপিঠে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর।
নিজের সুটকেসটা তুলে নিয়ে এল কিশোর। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। সুটকেসের খোপ থেকে চাবি বের করে তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিল। খোেলা!
তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল?–নিজেকেই প্রশ্ন করল সে। রওনা হওয়ার আগে তাড়াহুড়ো করেছে, ঠিক, তবু তালা না লাগিয়ে..সুটকেস খুলে কাপড় বের করতে শুরু করল। কোটা কোথায় রেখেছিল, মনে। করার চেষ্টা করছে। ঠিকমত আছে তো সব? নাকি ঘাটাঘাটি হয়েছে?
মনে হলো ঠিকই আছে।
কিন্তু নতুন কেনা শার্টটা টান দিতেই ভেতরে কি যেন নড়ে উঠল। হাত সরিয়ে নিল ঝট করে। ভাঁজ করা শার্টের এক কোনা দুই আঙুলে আলতো করে ধরে তুলে একটা হ্যাঁঙার দিয়ে খোঁচা দিল ফুলে থাকা জায়গায়। আরও জোরে নড়ে উঠল জায়গাটা। ভেতর থেকে টুপ করে মাটিতে খসে পড়ল কি যেন।
হাঁ হয়ে গেল কিশোর। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে!
প্রায় আড়াই ইঞ্চি লম্বা এক কাঁকড়াবিছে! ভীষণ ভঙ্গিতে নাড়ছে। বাঁকানো লেজটা-ডগায় বেরিয়ে আছে মারাত্মক বিষাক্ত হুল।
পাঁচ
বোবা হয়ে কুৎসিত জীবটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। কিলবিল করে এগিয়ে আসছে ওটা। হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল সে। পায়ে শক্ত সোলের জুতো, লাফ দিয়ে গিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা করে ফেলল বিছেটাকে।
সুটকেসে এল কিভাবে? বিড়বিড় করল আপনমনে। রকি বীচ থেকে সঙ্গে আসেনি, শিওর।
লেজ ধরে থেঁতলানো দেহটা তুলে নিয়ে ফেলে দিল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে।
ভাবছে, এয়ারপোর্টে কোনভাবে ঢুকল, নাকি এখানে আসার পর রহস্যময় চিঠিটার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে?
তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে ইচ্ছে করেই সুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ। কে ঢোকাল? সেই ড্রাইভারটা, যে অ্যাক্সিডেন্ট করতে চেয়েছিল? চিঠিটাও কি ওই ড্রাইভারই পাঠিয়েছে?
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কেউ একজন চাইছে না, ভূত-রহস্যের তদন্ত হোক। শুরু থেকেই সে জানে-ভিকিখালা চিঠি দেয়ার সময় থেকেই, তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করে আনা হচ্ছে তদন্ত করার জন্যে। রহস্যের কিনারা হলে নিশ্চয় তার কোন অসুবিধে আছে। তাই ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে?
কিন্তু অসুবিধেটা কি? যা-ই হোক, হুঁশিয়ার থাকতে হবে, নিজেকে বলল কিশোর। কাপড় পাল্টাতে শুরু করল।
ডিনার শেষে রান্নাঘরের লাগোয়া বৈঠকখানায় বসল ছেলেরা। জিনা আর টনিও রয়েছে সঙ্গে।
কাঁকড়াবিছের কথা শুনে দু-জনের কেউই অবাক হলো না।
এখন তো নেইই, বলল টনি। বাড়িটাতে যখন প্রথম ঢুকলাম তখন এলে বুঝতে। যেখানেই হাত দিতাম, বিছে বেরোত। মেরে সাফ করেছি। তবু, সকালবেলা না দেখে জুতোয় পা ঢুকিও না।
বাপরে, মুসা বলল। রাতে কম্বলের মধ্যে ঢুকবে না তো?
ঘরে থাকলে ঢুকতেও পারে, হাসল টনি। তবে মনে হয় নেই। গত হপ্তায় আরেকবার ঘর ঝাড়া দিয়েছি।
তাহলে কিশোরের সুটকেসে এল কোত্থেকে?
বোধহয় বাইরে থেকে।
ঠিক, আমিও একমত, আঙুল তুলল কিশোর, বাইরে থেকেই এসেছে। তবে, নিজে নিজে ঢোকেনি। ঢোকানো হয়েছে।
মানে? ভুরু কোঁচকাল টনি।
মানে সুটকেস তালা দেয়া ছিল। পরে খোলা পেয়েছি। বিছেটাকে ঢুকিয়ে রেখে তালা আটকানোর কথা মনে ছিল না বোধহয়, আর, আড়চোখে টনির দিকে তাকাল কিশোর।
কে ঢোকাতে যাবে? কেন?
এই চিঠিটা দেখলেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে, কেন ঢুকিয়েছে, এক লাইনের চিঠিটা বের করে দিল কিশোর। তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে টনিকে।
হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল টনির। হু! অ্যাক্সিডেন্টও তখন ইচ্ছে করে ঘটাতে চেয়েছে।
তাই কি মনে হয় না?
জবাব দিল না টনি।
সারাদিন অনেক ধকল গেছে তিন গোয়েন্দার ওপর দিয়ে। ভ্রমণের পরিশ্রম আর উত্তেজনা চাপ দিতে আরম্ভ করেছে শরীরের ওপর। ক্লান্তি বোধ করছে ওরা। তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করছে। তিনজনেই।
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সবাই। অবশেষে জিনা বলল, ভাবছি, এখানকার কয়েকজন বন্ধুকে দাওয়াত করব কাল। আজ গিয়ে ঘরেই শোও, কাল মরুভূমিতে রাত কাটাব। আগুনের পাশে। আস্ত ভেড়া রোস্ট হবে…
তাই নাকি? সোফার হাতলে চাপড় মারল মুসা। দারুণ হবে।
যদি অবশ্য কাঁকড়াবিছে না থাকে ওখানে, রবিন যোগ করল।
থাকুক, রসিকতা করল মুসা। বিছেকেই কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলব।
তা অবশ্য তুমি পারো, হাসন রবিন।
জিনাও হাসল। যাও, তাগাদা দিল সে, আর বসে থেকে লাভ নেই। সকাল সকাল গিয়ে শুয়ে পড়ো।
খুশি হয়েই উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না কিশোরের। ঘরের একটিমাত্র জানালা, চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। জানালার লাগোয়া প্যালো ভারডে গাছটা কেমন ভূতুড়ে লাগছে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়। জুলিয়ানের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, কিন্তু খানিক আগে গলা শুনেছে তার। আচ্ছা, ওইটুকুন ছেলে এত্তসব গোলমাল পাকিয়েছে? নাহ, বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ওর সঙ্গে শত্রুতা করেই বা কার কি লাভ? আগুন লাগানো, ঘোড়া চুরির দায় ছেলেটার ওপর কেন চাপাতে চাইবে?
ক্যাচিনা পেইন্টিংগুলোও অস্থির করে তুলেছে তার মনকে। সুন্দর। এ ধরনের রিসোর্টের জন্যে মানানসই। কিন্তু বড় বেশি বিষণ্ণ। মন খারাপ করে দেয়। ঘরের পরিবেশই কেমন যেন বদলে দিয়েছে। ওখানে ভূত আছে বললে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারবে না কিশোর। চোখ মেলে জানালার দিকে চেয়েই বুঝল, অনেক সময় পেরিয়েছে। সরে চলে গেছে। চাঁদ, জ্যোত্স আর ঘরে আসছে না এখন। কেন হঠাৎ ঘুম ভাঙল? দীর্ঘ এক মুহূর্ত চুপচাপ পড়ে রইল সে, তারপর আবার শুনল শব্দটা। ও, এ জন্যেই ভেঙেছে! ঘুমের মধ্যেও ওই শব্দ কানে ঢুকেছে। হলরুমে বিচিত্র শব্দ।
আস্তে করে উঠে বসে অভ্যাস মাফিক পা ঢুকিয়ে দিল, জুতোতে। দিয়েই চমকে উঠল, টনি না বলেছিল ভালমত না দেখে না ঢোকাতে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পরক্ষণেই, না, নেই। বিছে-টিছে কিছু লাগল না পায়ে। পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে। নিঃশব্দে খুলল। দু-দিকে ছড়ানো হলরুম, জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। তাতে জানালার কাছে অন্ধকার কিছুটা কেটেছে বটে, কিন্তু আসবাবপত্রের আশপাশে, দেয়ালের ধারে, আর ঘরের কোণে চাপ চাপ অন্ধকার।
দেয়ালের ছায়া থেকে বেরোল ওটা। বেগুনি আলোর একটা ঘূর্ণিমত, পাক খেতে খেতে এগোচ্ছে কিশোরের দিকে। ঘরের মাঝামাঝি এসে থমকে গেল। অদ্ভুত সব রূপ নিতে লাগল। একবার। মনে হলো কোন মহিলার ছায়া, তারপর পুতুল, পরক্ষণেই আবার গাছ কিংবা ভালুক, সবশেষে হয়ে গেল আকাশের ভাসমান মেঘের মত। তবে রঙের কোন পরিবর্তন হলো না কখনওই। অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে, বোধহয় আজব জিনিসটাই করছে বিচিত্র গান। বিটকেলে সুর। কথা কিছুই বোঝা যায় না।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। কি করবে বুঝতে পারছে না। এই সময় সিঁড়িতে শোনা গেল পদশব্দ। নেমে আসছে কেউ। ক্লিক করে অন হলো সুইচ, আলো জ্বলল।
ম্লান হলো বেগুনি আলো, দেয়ালের দিকে ছুটে গিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কি, কিশোর? জিজ্ঞেস করল ভিকি। সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অবাক হয়ে।
দেখলেন না?
বেগুনি আলোর মত কি যেন চোখে পড়ল। ভালমত দেখিনি।
রান্নাঘরে চলুন না? এখানে কথা বললে অন্যরাও জেগে যাবে। জাগিয়ে লাভ নেই। ঘুমাক।
বেশ, চলো। : রান্নাঘরে ঢুকে ভিকি বলল, চা খাবে? এক ধরনের ভেষজ সুগন্ধী দিয়ে চা বানাতে শিখেছি, ইনডিয়ানরা বানায়। খেয়ে দেখো, ভাল লাগবে। যেদিন ঘুম আসতে চায় না, বানিয়ে খাই।
বানান। একটা চেয়ারে বসল কিশোর। খালা, বোধহয় ক্যাচিনা ভূতটাকেই দেখলাম।
অবাক হলো না ভিকি। যেন এটাই স্বাভাবিক, এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝকাল। দু-কাপ চা বানিয়ে এনে রাখল টেবিলে। হাতে বানানো কয়েকটা বিস্কুট দিল একটা প্লেটে করে।
চায়ে চুমুক দিল কিশোর। বাহ্, সত্যিই তো! দারুণ সুগন্ধ।
ভূতটাকে দেখেছ তাহলে?
হ্যাঁ। আপনি দেখেছেন?
আবার মাথা ঝাঁকাল ভিকি, দেখেছি। আরও অনেকেই নাকি দেখেছে। লোকে বলে বহুদিন ধরে আছে এটা এ-বাড়িতে। একেক সময় একেক রূপে দেখা দেয়, পূর্ণিমার সময়।
ভয় পান না?
মাথা নাড়ল ভিকি। কারও কোন ক্ষতি তো করে না। ভয় পাব কেন? আমার আশঙ্কা অন্যখানে। গুজব ছড়িয়ে গেলে টুরিস্টরা আসবে না।
এ বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে কেন বলতে পারেন?
ঘন ঘন কয়েকবার কাপে চুমুক দিল ভিকি। এ বাড়ি যে বানিয়েছে, তারই প্রেতাত্মা হয়তো ওটা। স্বাভাবিক মৃত্যু তো হয়নি বেচারার।
কেন, কি হয়েছিল?
সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেছে।
খুলেই বলুন না।
ওর নাম ছিল ডানকান লেমিল। ভাল আর্টিস্ট ছিল। এখানকার সমস্ত, কাচিনা সে-ই এঁকেছিল। শোনা যায়, লেমিল নাকি হোপি ইনডিয়ানদের কাছ থেকে খুব মূল্যবান একটা জিনিস চুরি করেছিল, লুকিয়েছিল এনে এই বাড়িতে। ইনডিয়ানদের সর্দার এসে জিনিসটা ফেরত চাইল, দিতে রাজি হলো না লেমিল। ভয় দেখাল সর্দার, না দিলে পুড়িয়ে মারবে। কিন্তু দিল না লেমিল। সে সময় তার ছবির এক ভক্ত ছিল এ বাড়িতে। যেদিন সর্দার শাসিয়ে গেল তার পরদিন সকালে সিঁড়ির গোড়ায় মৃত পাওয়া গেল লেমিলকে। শরীরের কোথাও কোন ক্ষত নেই। তার ভক্তকেও খুঁজে পাওয়া গেল না, একেবারে গায়েব। লেমিল কিভাবে মরল সেটা এক রহস্য। কেউ বলে ইনডিয়ানদের ভয়ে হার্টফেল করে মরেছে, কেউ বলে তার ভক্তই তাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে রেখে পালিয়েছে। কোনটা ঠিক কে জানে! কোনটাই প্রমাণিত হয়নি।
হুঁ, তারপর?
তারপর আর কি? ভূতের গল্প চালু হলো। লেমিলের মৃত্যুর জন্যে ভূতকে দায়ী করল কেউ।
ঠাণ্ডা হয়ে আসা বাকি চা-টুকু দুই ঢোকে শেষ করে পিরিচে কাপটা নামিয়ে রাখল কিশোর। কি জাতের ভূত? ক্যাচিনা?
হতে পারে। আমরা আসার পর থেকে তো ক্যাচিনাই দেখা যাচ্ছে, অন্য কিছু না।
চুপ করে ভাবল কিশোর। আচ্ছা, অভিশাপ যে আছে, কিসের অভিশাপ?
ইনডিয়ানদের। লেমিলের মৃত্যুর জন্যে শেষ পর্যন্ত ইনডিয়ান সর্দারকে দায়ী করে বসল এখানকার কিছু র্যাঞ্চার। রেগে গিয়ে দেশছাড়া করে ছাড়ল সর্দারকে। পালিয়ে মেকসিকোয় চলে যেতে বাধ্য হলো সে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে একা একা খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে বেচারা। তার স্ত্রী অনেক কেঁদেছে। লেমিলকে অভিশাপ দিয়েছে।
সেজন্যেই ক্যাচিনা ভূত এসে আস্তানা গেড়েছে এখানে?
মাথা নাড়ল ভিকি। জানি না। শুধু সর্দারই নয়, আরও কিছু হোমরা চোমরা ইনডিয়ানও বিপদে পড়ে গিয়েছিল। কেউ লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে, কেউ সর্দারের মত দেশছাড়া হয়েছে। তারাও
অভিশাপ দিয়েছে লেমিলকে।
কিন্তু শুধু এই বাড়িতেই কেন ভূতের আনাগোনা?।
কারণ এই বাড়িতেই অপঘাতে মরেছে লেমিল, এই বাড়িতেই জিনিসটা লুকিয়েছিল সে, এবং তার মৃত্যুর পরও আর ওটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তার মানে, কিশোরের ভুরুজোড়া সামান্য কাছাকাছি হলো, বলতে চাইছেন, জিনিসটা এখনও এ বাড়িতেই আছে?
ছয়
লোকের তো তাই বিশ্বাস, ভিকি বলল। দু-চারজন বাদে। তারা বলে ভক্ত ব্যাটাই লেমিলকে খুন করে জিনিসটা নিয়ে পালিয়েছে।
অসম্ভব না। নাকে বালিশ চাপা দিয়ে দম বন্ধ করে মারলে ক্ষত থাকে না, বলল কিশোর। তা জিনিসটা কি? কোন ধারণা আছে?
মূল্যবান কোন পাথর-টাতর হবে।
পাওয়া গেলই না, না? চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।
না। লেমিল মারা যাওয়ার পর এই বাড়ির ভেতরে-বাইরে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে লোকে। পায়নি।…আরেক কাপ চা দেব?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। যাক, অনেক কিছু জানা গেল আপনার কাছে।
আমি চাই রহস্যটার একটা সমাধান হোক, যাতে রিসোর্টটা ঠিকমত চলে। মিস্টার উইলসনের কাছে অনেক দিন আছি। ভাল লোক, তার কোন ক্ষতি হোক চাই না। বিষণ্ণ শোনাল মহিলার কণ্ঠ, আর, প্লীজ, জুলিয়ানের বদনাম যদি একটু ঘোচাতে পারো। বিশ্বাস করো, ও খুব ভাল ছেলে। ওকে এখান থেকে বের করে দিলে আমার খুব কষ্ট লাগবে। বাপ নেই ছেলেটার, এতিম, সেজন্যেই তো পরের দয়া চাইতে এসেছে… গলা ধরে এল ভিকির। ছলছল করে উঠল চোখ।
তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর। আহাহা, এত অস্থির হওয়ার কি। আছে? সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা।
উঠল কিশোর। শূন্য, নীরব হলরুম দিয়ে ফিরে এল আবার নিজের ঘরে।
পরদিন ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হলো। হাতমুখ ধুয়ে জিনসের প্যান্ট আর গাঢ় লাল ঝলমলে সিল্কের শার্ট পড়ল, এই ওয়েস্টার্ন অঞ্চলের মানানসই পোশাক। বেরোল।
পেছনের বাগানে বসে চা খাচ্ছে মুসা, রবিন আর জিনা। টেবিলে পড়ে আছে শূন্য প্লেটগুলো, নাস্তা শেষ।
আরিব্বাপ! কিশোর পাশা দ্য গানম্যান, দেখেই বলে উঠল মুসা। ভুরু নাচাল।তা, মিয়া, কোমরে পিস্তল কই?
হাসল সবাই।
মুসার পায়ের কাছে শুয়ে ছিল কুকুরটা, হাসাহাসি শুনে উঠে বসল। কৌতূহলী চোখে তাকাল কিশোরের দিকে।
আরে, বাঘাটা না? কিশোর বলল। জনির সেই শিকারী কুকুর, টাইগার।
হ্যাঁ, জিনা বলল। ভিকিখালা এমন খাওয়ানো খাওয়ায়, চুরি তো দূরের কথা, অন্য কেউ সেধে দিলেও এখন আর কিছু খেতে চায় না। ভাল হয়ে গেছে।…আমাদের খুব খিদে পেয়েছিল, থাকতে পারলাম না, খেয়ে নিয়েছি। শুনলাম, কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকেছ-ভিকিখালা বলল-তাই আর ডাকলাম না।
ভাল করেছ, বসতে বসতে বলল কিশোর। কি ঘটেছিল, বলেছে? রাতের বেলা হলরুমের আবছা আলো-আঁধারিতে যা যা ঘটেছে এখন নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না সে-সব। রাতে চাঁদের আলোয় পরিবেশ ছিল এক রকম, এখন উজ্জ্বল সূর্যালোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হয়ে গেছে। কড়া রোদ, কমলা ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন, চোখ ধাঁধানো আলোয় বসে রাতের ব্যাপারটাকৈ স্বপ্ন মনে হচ্ছে এখন।
শুধু বলল, রবিন জানাল, রাতে নাকি হলরুমে কি দেখেছ তুমি। রান্নাঘরে বসে চা খেয়েছ, ভিকিখালার সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা করেছ।
ভূত দেখেছ নাকি? জিজ্ঞেস করল জিনা।
চারটে ডিমের ওমলেট আর বড় এক গেলাস কমলালেবুর রস নিয়ে হাজির হলো ভিকি, কিশোরের জন্যে। দিয়ে চলে গেল।
খেতে খেতে গতরাতের কথা সব জানাল কিশোর। শেষে বলল, প্রথমে ভেবেছিলাম চোর। তারপর দেখলাম ওটাকে। বিচিত্র আওয়াজ। হেঁড়ে গলায় ইনডিয়ানদের গান গাইল, কিছুই বুঝলাম না।
ইনডিয়ান গান? রবিনের চোখে বিস্ময়।
তা-ই তো মনে হলো।
তোমার সাহস আছে কিশোর, মুসা বলল। আমি হলে যেতাম। আর ভূত দেখার পর দাঁড়িয়ে থাকা তো অসম্ভব ছিল।
কি বুঝলে? জিজ্ঞেস করল জিনা।
ভিকির কাছে শোনা গল্পটা আবার শোনাল কিশোর।
মাথা নোয়াল জিনা। ক্যাচিনার অভিশাপের কথা আমিও শুনেছি। সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, ওই ভূত তাড়াতে হবে বাড়ি থেকে। নইলে উইলসন চাচার লালবাতি জ্বলবে। তিক্ত শোনাল জিনার কণ্ঠ, গতবছর বেচে না দিয়ে ভুলই করেছে। ডাক্তার জিংম্যান কিনতে চেয়েছিল।
তাই নাকি? চিবানো থামিয়ে জিনার দিকে তাকাল কিশোর। আগে বলোনি তো! সবাই যেখানে ভূতের ভয়ে কাবু, সেখানে কিনতে চায় কোন সাহসে?
বলার মত কিছু না। বাড়িটা চায় না, শুধু খেতখামার! অনেক গরু আছে তার, আরও বাড়াতে চায়। চেয়েছিল, তবে এখন চাচা বেচতে চাইলেও ডাক্তার কিনবে কিনা সন্দেহ। আর কিনলেও অনেক কম দাম দিতে চাইবে। তার মানে, রিসোর্ট চালাতে না পারলে চাচার অবস্থা কাহিল। টুইন লেকসের সব কিছু বেচে দিয়ে এসেছে, সেই টাকা আর জমানো যা ছিল সবই খরচ করেছে এই রিসোর্টের পেছনে। বেশির ভাগ টাকাই গেছে বাড়িটা সারাতে। ওটাই যদি কেউ কিনতে না চায়, শুধু জমিনের জন্যে আর কত দাম পাবে?
ভারি পরিবেশ হালকা করার জন্যে হাসল মুসা। তোমার চাচার কিচ্ছু হবে না, দেখো। আমরা তিন গোয়েন্দা এসে পড়েছি না? পালাতে দিশে পাবে না ক্যাচিনা ভূতের বাচ্চা।
শুধু রবিন হাসল।
নীরবে খেয়ে চলেছে কিশোর। ভূত-টুতে বিশ্বাস করে না সে। কিন্তু গতরাতে যা দেখেছে, সেটাকে চোখের ভুল বলেও উড়িয়ে দিতে পারছে না।
তো, আজ সকালটা কি করে কাটাতে চাও? জিজ্ঞেস করল জিনা। মেহমানরা আসবে বিকেলে। তারপর সুপারস্টিশনে রওনা হব আমরা। ভিকিখালা আর ডিউক আঙ্কেলও সঙ্গে যাবে বলেছে।
হুম্। ভালই জমবে।…আচ্ছা, শোনো, জুলিয়ান কোথায়? ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ও তো নেই। সেই ভোরেই বেরিয়ে গেছে। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই। ভেবেছিলাম, বিকেলে ওকেও সঙ্গে নেব।
শূন্য প্লেটটা ঠেলে দিয়ে গেলাস তুলে নিল কিশোর। জিনার দিকে তাকাল। কোথায় গেছে?
বলে যায়নি। ভিকিখালা বলল, সকালে উঠে পিন্টো ঘোড়াটা নিয়ে বেরিয়ে গেছে, মরুভূমিতেই বোধহয়। জন্তু-জানোয়ারের প্রতি ভীষণ আগ্রহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় ওসব দেখে দেখে। আগে এসে আমাকে বলত কি কি দেখেছে… থামল জিনা। ইদানীং আর বলে না, আগুন লাগানোর পর থেকে। এড়িয়ে চলে।
কোন্ কোন্ জায়গায় আগুন লেগেছে, দেখা যাবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
যাবে না কেন? ওই পাহাড়টা, হাত তুলে দেখাল জিনা। ওই যে, আস্তাবল থেকে মাইলখানেক পুবে, টিলাটক্কর দেখা যাচ্ছে না পাহাড়ের ওপরে? ওখানে। স্মোক সিগন্যাল প্র্যাকটিস করছিল।
আর বাকিগুলো?
প্রথমটার আধা মাইল দক্ষিণে দুটো পাহাড়ের ঢাল নিচে একসঙ্গে মিশেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে তারপর দেখতে পাবে। পোড়া স্যাগুয়ারো গাছ।
তারমানে দুটো জায়গায়ই হেঁটে যাওয়া যাবে? রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকাল জিনা। আমিই নিয়ে যেতাম, কিন্তু আজ পারছি না। মেহমানরা আসবে, খাবার লাগবে। ভিকিখালাকে সাহায্য করব। টনি জীপ নিয়ে গেছে ওদের দাওয়াত করতে। নইলে সে যেতে পারত।
আমরা একাই পারব, মুসা বলল।
কিভাবে যেতে হবে ভালমত জেনে নিয়ে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। আস্তাবলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সঙ্গে নিয়েছে কুকুরটাকে। কিছুদূর এগিয়েই দেখতে পেল, মরুভূমি মোটেই মরু নয়, তাতে প্রাণের ছড়াছড়ি। দিন কয়েক আগে বৃষ্টি হয়েছে, তরতর করে বেড়ে উঠেছে লম্বা ঘাসের গুচ্ছ, সবুজ হয়েছে। ঢেউ খেলানো পাহাড়ী ঢালে জন্মে রয়েছে নানা রকম গাছ, ফুল ফুটেছে। হলুদ, লাল, নীল, সাদা ফুলের ছড়াছড়ি, আর কি তার রঙ!
ওউফ, চোখ জুড়িয়ে যায়, চলতে চলতে বলল রবিন।: মরুভূমি যে এত সুন্দর, বইয়েই পড়েছি শুধু এতদিন। পড়ে বিশ্বাস হয়নি।
বিশাল এক খরগোশ দেখে থমকে দাঁড়াল টাইগার। তাড়া করবে কিনা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই দুই লাফে গিয়ে পিপের মত মোটা দুটো ব্যারেল ক্যাকটাসের আড়ালে লুকাল খরগোশটা।
ঘেউ ঘেউ করে উঠল টাইগার, তাড়া করতে চাইল। গৃলার বেল্ট টেনে ধরে ধমক দিল মুসা।
কুকুরের ডাকে চমকে গিয়ে ঝোঁপ থেকে বেরোল একটা পাখি। দৌড় দিল। ঘাসের গুচ্ছের পাশ কাটিয়ে ছুটে চলল তীব্র গতিতে।
রোড রানার, বলল রবিন।
দূরে গিয়ে থামল পাখিটা। কালো পালকে ঢাকা মাথা তুলে ফিরে তাকাল এদিকে। লম্বা কালো লেজে আঁকুনি তুলে আবার ছুটল। একটা আজব ক্যাকটাসের আড়ালে গিয়ে লুকাল। বানরের লেজের মত বাকা। উদ্ভিদটা, তাতে লাল ফুল ফুটেছে।
উড়তে পারে না ওই পাখি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আবার ছুটল রোড রানার।
পারে। তবে দৌড়াতেই পছন্দ করে। ছোটে কি জোরে দেখছ না?
মানুষের সাড়া পেয়ে সামনের একটা ঝোঁপ থেকে আতঙ্কিত চিৎকার করে উড়াল দিল এক জোড়া কোয়েল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার মাটিতে নামল। ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরোল ডজনখানেক বাচ্চা, মুরগীর বাচ্চার মত দেখতে। হলদে আর বাদামী পালকের ছোট ছোট বল যেন। চিক, চিক করছে। ঘাসের বীজ খুঁটে খেতে শুরু করল। গলা তুলে সতর্ক চোখে এদিকে চেয়ে রইল মা-বাবা, বিপদ বুঝলে হুশিয়ার করবে ছানাদের।
ছুটে গিয়ে ধরার জন্যে পাগল হয়ে উঠল টাইগার। কষে এক থাপ্পড় লাগাল মুসা। চুপ! ছিলি তো চোরের শাগরেদ। ভাল হবি কোত্থেকে? আমার সঙ্গে থাকলে বাপু তেড়িবেড়ি চলবে না। কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
শান্ত হলো টাইগার। পেছনের দুই পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে ফেলল লেজ।
পাখিগুলো যাতে ভয় না পায়, সেজন্যে ওগুলোর অনেক দূর দিয়ে ঘুরে এগোল ওরা।
পাহাড়ের ওপরে উঠে আগুন জ্বালানোর চিহ্ন চোখে পড়ল। বেশ কিছু শুকনো ডালপালা পড়ে আছে, আধপোড়া। কয়েকটা পোড়া ম্যাচের কাঠি পাওয়া গেল আশপাশে। ডালপালাগুলোর বেশির ভাগই বালি চাপা দেয়া।
আগুন নেভানোর চেষ্টা হয়েছিল, পোড়া ডালগুলো দেখাল কিশোর।
জুলিয়ান বোধহয় বালি ঢাকা দিয়েই ভেবেছে আগুন নিভেছে। সে চলে যাওয়ার পর আবার জ্বলে উঠেছে।
নেভানোর চেষ্টা তো অন্তত করেছে, মুসা বলল, তারমানে আগুন ছড়াক, এটা ইচ্ছে ছিল না।
জ্বালিয়ে ফেলে রেখে গেলেও কিছু হত না, রবিন বলল। আশপাশে তো কিছু নেই। ধরবে কিসে? বালি তো আর জ্বলে না যে আগুন ছড়াবে।
চলো, অন্য জায়গায় যাই, হাত তুলে দক্ষিণে দেখাল কিশোর।
পাহাড়ের শিরদাঁড়া ধরে চলল ওরা। খানিক দূর এগিয়ে নিচে দেখিয়ে মুসা বলল, ওই যে। পোড়া ক্যাকটাস।
ঢাল বেয়ে নিচে নামল ওরা। ওধার থেকে উঠে গেছে পাশের পাহাড়ের আরেকটা ঢাল। খড়খড়ে রুক্ষ মাটি, পাথরের ছড়াছড়ি। এখানে-ওখানে জন্মে আছে প্রিকলি-পার ক্যাকটাস, খালি কাটা, হুকের মত কাপড়ে গেঁথে গিয়ে টেনে ধরতে চায়।
দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী পথকে তো গিরিপথ বলে, মুসা বলল, দুই ঢালের মাঝখানকে কি বলে? গিরিঢাল?
কি জানি, আনমনে মাথা চুলকাল কিশোর, মুসার কথা ঠিক কানে গেছে বলে মনে হলো না। পোড়া, মস্ত স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস গাছটার দিকে এগোচ্ছে। তার মাথায় এখন ভাবনার তুফান।
বোধহয় শৈলশিরা, মুসার প্রশ্নের জবাবে বলল রবিন।
গাছের গোড়ায় এসে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখল কিশোর। বিড়বিড় করল, এখানে আগুন ধরিয়ে লাভটা কি? পাহাড়ের জন্যে কারও চোখে পড়বে না। সিগন্যাল দিলেই বা কি আর না দিলেই কি?
সেজন্যেই হয়তো এখানে ধরিয়েছে, অনুমান করল রবিন। দেখা যায়, এমন জায়গায় লাগিয়ে তো হেনস্তা কম হয়নি, তাই এখানে এসেছে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। রবিনের কথা সমর্থন করল কিনা বোঝা গেল না। গাছের গোড়ায় পোড়া ডালপাতা খুঁজছে। কুড়িয়ে এনে জড় করে আগুন ধরানোর কোন চিহ্ন নেই। পোড়া একটা কয়লাও কোথাও পড়ে নেই, একটা ম্যাচের কাঠিও না। কোনখানে মাটিও সামান্যতম পোড়া নেই, শুধু গাছের একেবারে গোড়ায় ছাড়া। সিগন্যাল দেয়ার জন্যে ডালপালা জ্বাললে, আর সেখান থেকে এসে গাছে আগুন ধরলে, তার চিহ্ন থাকবেই। কিন্তু নেই।
দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। কি বুঝছ?
কেউ জবাব দেয়ার আগেই বড় একটা পাথরের চাঙড়ের দিকে চেয়ে ঘড়ঘড় করে উঠল টাইগার। লম্বা লম্বা ঘাস আর শুকনো এক ধরনের ঝোঁপ জন্মে আছে পাথরটাকে ঘিরে।
কি দেখল? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
খরগোশ-টরগোশ বোধহয়, ধমক লাগাল মুসা, এই, চুপ!
আমার ধারণা, কিশোরের প্রশ্নের জবাবে বলল রবিন, সরাসরি গাছে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেন? মুসার জিজ্ঞাসা। একটা ক্যাকটাস গাছে আগুন লাগিয়ে কি এমন লাভ হলো কার?
কাঁধ ঝাঁকাল শুধু কিশোর, জবাব দিল না। নীরব। জোরে জোরে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে পোড়া স্যাগুয়ারোর কালো ধ্বংসাবশেষের দিকে।
ঘুরে দাঁড়াল হঠাৎ সে। চলো, আর কিছু দেখার নেই।
ভোঁতা, প্রচণ্ড শব্দ হলো, মাটির তলায় চাপা দেয়া বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটল যেন। ঘেউ করে লাফিয়ে এসে কিশোরের গায়ে পড়ল টাইগার।
চমকে ফিরে তাকাল কিশোর। এক লাফে সরে গেল।
দুলে উঠেছে পোড়া স্যাগুয়ারোর মস্ত কাঠামো। পড়তে শুরু করল।
সাত
ধুড়ম করে পড়ল গাছটা। মুহূর্ত আগে কিশোর যেখানে ছিল ঠিক সেখানে। গোড়ায় মস্ত এক খোড়ল।
আরি, কি হলো! কাঁপছে রবিনের কণ্ঠ। কিভাবে…
টাইগার ধাক্কা না দিলে গেছিলাম, কিশোরও কাঁপছে।
একেবারে ভূতের আড্ডা! ভয়ে ভয়ে তাকাল মুসা! চলো, ভাগি।
আর কিছু করার নেই এখানে। ফিরে চলল ওরা।
র্যাঞ্চে এসে টনি আর জিনাকে জানাল সব।
আমারই দোষ, উনি বলল। আগেই বলা উচিত ছিল। এ রকম ঘটতে পারে ভেবে সেদিন গিয়েছিলাম কেটে ফেলতে। উইলসন আঙ্কেলের খবর শুনে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম, পুরোটা আর কাটা হয়নি। ভেঙে পড়বেই তো।
তোমার দোষ নেই, টনিকে আশ্বস্ত করল কিশোর। সেজন্যে পড়েনি ওটা।
তাহলে…? থমকে গেল মুসা।
গাছ পড়ার আগে ধুপ করে যে শব্দটা হয়েছিল, নিশ্চয় শুনেছ। বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল গাছের গোড়ায়। পাথরের চাঙড়ের কাছে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল লোকটা। ওর গায়ের গন্ধ পেয়েই তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল টাইগার। সবার মুখের দিকেই তাকাল এক এক করে। বোমা ফাটানো হয়েছে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায়, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে।
জিনার চোখে শঙ্কা। সেটা গোপন করার জন্যে অন্যদিকে চেয়ে বলল, যা হবার হয়েছে। করতে তো আর কিছু পারেনি তোমার। জোর করে হাসল। যাও, পুলে গিয়ে খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে এসো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। রাতে জাগতে হবে।
মন্দ বলনি, সাঁতারের কথায় হাসি ফুটল মুসার মুখে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় পরে ঘর থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। মেহমানরা এসেছে, অপেক্ষা করছে। জিনার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় একটা মেয়ে, নাম শীলা। অন্য চারজন ছেলে, সতেরো থেকে বিশের মধ্যে বয়েস।
পরিচয়ের পালা শেষ হলো।
ঘোড়ায় জিন পরিয়ে তৈরি রেখেছে টনি। আস্তাবলে গিয়ে যার যার ঘোড়া বেছে নিল সবাই।
টাইগারেরও সঙ্গে যাওয়ার খুব ইচ্ছে, লেজ নাড়ছে, ঘেউ ঘেউ করছে। শেকলে বাঁধা, সামনে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও ছুঁয়ে দেখছে না। তাকে নিতে রাজি নয় ভিকি, তাই এই ব্যবস্থা করে রেখে গেছে।
রওনা হলো দলটা।
মুসার পাশে চলছে টনি। কিশোর চলে এল বিল হিগিনসের পাশে। হাসিখুশি তরুণ, মাথায় কালো চুল। অপরিচিত মানুষকে সহজে আপন করে নিতে জানে। চলতে চলতে কিশোরকে আশপাশে অনেক কিছু দেখাল সে, মরুভূমি আর পর্বত সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য জানাল।
লস্ট ডাচম্যান মাইনে গিয়েছ কখনও? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
গেছি, হাসল বিল। সাত-আট বছর বয়েসে, বাবার সঙ্গে। সোনাও পেয়েছি। না না, চমকে ওঠার কিছু নেই। খুব সামান্যই পেয়েছি। মাত্র দু-চার আউন্স।
ডাচম্যান মাইনে!
না, মাইনে পেয়েছি বলা যাবে না। সোনার ছোটখাটো দু-চারটা পকেট আর শিরা ওখানে আছে এখনও। শীতকালে বৃষ্টি হলে বন্যার পানিতে ধুয়ে চলে যায় মাটি। বেরিয়ে পড়ে একআধটা পকেট কিংবা শিরা। মাঝেসাঝে কিছু সোনা পাওয়া যায় তখন, খুবই সামান্য। এমন কিছু না।
স্বর্ণের আলোচনা শুনে পেছন থেকে এগিয়ে এল রবিন। তার পাশাপাশি এল আরেকটা ছেলে, নাম পিটার। কিছুটা লাজুক স্বভাবের। হেসে বলল, থাকো কিছুদিন এখানে, একদিন নিয়ে যাব খনি দেখাতে। চাই কি, ভাগ্য ভাল হলে সোনার তাল কিংবা নুড়ি পেয়েও যেতে পারো।
জিনাও এগিয়ে এল। সোনার লোভ না দেখিয়ে কিশোরকে রহস্যের লোভ দেখাও, হাসল সে। বলো না, লস্ট ডাচম্যান মাইনটা খুঁজে বের করে দিতে।
সে কি! ওটা এখনও হারানোই আছে? বিলের দিকে তাকাল। কিশোর। এই না বললে, এখানকার সবাই গেছে?
তা তো গেছেই, শীলাও হাসল। খনিটাতে যাওয়ার অন্তত পঁচিশটা ম্যাপ দিতে পারি তোমাকে, পঁচিশ রকমের, এবং সবগুলোই আসল। যেটা ধরেই যাও, খনি পাবে। তবে কেউই সঠিক বলতে পারে
আসল ডাচম্যান মাইন কোটা। এমনও হতে পারে, ওই পঁচিশটার কোনটাই মূল খনিটা নয়।
শীলা ঠিকই বলেছে, বলল আরেক তরুণ, কেন ফ্লেরেট।
হুঁ, রহস্যেরও খনি দেখছি এই এলাকা নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। হাসল, কোনটা ছেড়ে কোনটার সমাধান করি?
এমনিতেই খুব জটিল একটা রয়েছে হাতে..
ভূতের রহস্য? বিল জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
ও, তোমাদের বলা হয়নি, জিনা, বলল, কিশোর কাল রাতে ভূতটাকে দেখেছে।
রুক্ষ উঁচুনিচু পাহাড়ী পথে চলতে চলতে জমে উঠল ভূতের গল্প। রাস্তা ভাল না, কিন্তু ঘোড়াটার কারণে চলতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না কিশোরের। শান্ত একটা মাদী ঘোড়ায় চেপেছে সে। তবু, কয়েকটা পাহাড় ডিঙিয়ে আরেকটা পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে যখন একটা উপত্যকা দেখতে পেল-গাছপালায় ঘেরা, ফুলে ছাওয়া, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝর্না, হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল।
জায়গাটাকে উপত্যকা না বলে চওড়া একটা গিরিপথ বলাই ভাল। দুই পাশেই উঁচু পাহাড়। গিরিপথের এক মুখের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। র্যাঞ্চের জীপ। রান্না চড়ানো হয়ে গেছে। বাতাসে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে খাবারের সুবাস।
নিচে নেমে ঘোড়া থেকে নামল অশ্বারোহীরা, এগিয়ে গেল। আগুন জ্বেলে রান্না বসিয়েছে ভিকি, তাকে সাহায্য করছেন তার স্বামী স্কুলশিক্ষক ডিউক। বলিষ্ঠদেহী লোক, সুস্বাস্থ্যের কারণে একটু বেঁটে দেখায়, ইনডিয়ানদের মত কুচকুচে কালো চোখ।
আশপাশে কোথাও জুলিয়ানকে দেতে পেল না কিশোর। সে কোথায়, ভিকিখালাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এই সময় গাছের ফাঁকে দেখল সাদা-কালোর ঝিলিক। বন থেকে বেরোল পিন্টো ঘোড়াটা, তাতে বসে আছে জুলিয়ান।
ছেলেটাকে দেখে অস্বস্তি দূর হলো স্বামী-স্ত্রী দু-জনেরই।
এক জায়গায় বাধা হয়েছে সবগুলো ঘোড়া, জুলিয়ানও পিন্টোটা নিয়ে গেল ওখানে। কিশোর এগোল সেদিকে।
জুলিয়ানের সঙ্গে সহজ হতে সময় লাগল কিশোরের। খুবই লাজুক স্বভাবের ছেলে। দশটা প্রশ্ন করলে একটার জবাব দেয়।
কিন্তু তার ঘোড়াটার কথা তুলতেই মুখর হয়ে উঠল সে।
ও আমার, গর্বের সঙ্গে বলল জুলিয়ান, এক্কেবারে আমার। আর কারও না। উইলসন আঙ্কেলের কাছে একটা ঘোড়া চেয়েছিলাম। দিয়ে দিল। খুব সুন্দর।
চড়তেও পারো ভাল, বলল কিশোর। কে শিখিয়েছে? উইলসন আঙ্কেল?
হাতেখড়ি দিয়েছে। বাকিটা শিখিয়েছে ডিউক আঙ্কেল আর টনিভাইয়া। ওরা বলে, আমি নাকি দেখতে একেবারে ইনডিয়ানদের মত।
নানা রকম প্রশ্ন করে জুলিয়ানকে কথা বলিয়ে নিল কিশোর। তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছে। সহজ হয়ে এসেছে জুলিয়ান, প্রশ্ন করলেই এখন জবাব দেয়। মিথ্যে বলছে বলে মনে হলো না, আর যদি বলেই থাকে, তাহলে মানতে হবে মস্ত অভিনেতা সে।
জন্তু-জানোয়ারের কথা উঠলে সবচেয়ে বেশি খুশি হচ্ছে জুলিয়ান। হরিণ আর শুয়োর গোষ্ঠীর প্রাণী হ্যাঁভেলিনার কথা বলতে গিয়ে চকচক করে উঠল বড় বড় চোখ। পর্বতের ভেতরে, ঝর্নার মাথায় খাড়ির ধারে, মরুভূমিতে নাকি প্রায়ই দেখে ওসব জানোয়ার।
বড় হয়ে ওসব শিকার করব আমি, বলল জুলিয়ান। উইলসন আঙ্কেল বলে, আমার বয়েসেই নাকি তীর দিয়ে হরিণ মেরেছিল সে। তীর-ধনুক আমারও আছে, কিন্তু নিশানা ঠিক না। একদিকে মারলে আরেকদিকে চলে যায়।
আঙ্কেল খুব আদর করেন তোমাকে, না?
হ্যাঁ, অনেক।
সেজন্যেই তো বলি, চুলার কাছ থেকে বললেন শিক্ষক,
আঙ্কেলকে বেশি জ্বালিয়ো না। আরেকটা ব্যাপারে সাবধান করব, খবরদার, হ্যাঁভেলিনার ধারে-কাছেও যেয়ো না। লম্বা লম্বা দাঁত, যা ধার। পেট চিরে নাড়ি-ভুড়ি বের করে দেবে।
আরে, দূর, আঙ্কেল যে কি বলো। তুমি একটা আস্ত বোকা। আমি ঘোড়া থেকে নামব নাকি? পেটের নাগাল পাবে কোথায়?
জুলিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে কিশোরের, বকবক করে চলল।
খাবার তৈরি, ডাকল ভিকি। এই, তোমরা সবাই এসো।
খাবারের স্বাদ এত ভাল খুব কমই লেগেছে তিন গোয়েন্দার কাছে। মোটাতাজা কচি একটা আস্ত ভেড়ার কাবাব, ঠ্যাং ওপরে, শিকে গাঁথা অবস্থায় ঝুলছে আগুনের ওপর। মাংস কেটে প্লেটে নিয়ে তার ওপর ঢেলে দেয়া হয়েছে টমেটোর সস। সেই সঙ্গে আছে শিম, দু-ভাবে রান্না হয়েছে। আগুনের ওপর তন্দুরী রুটির মত সেঁকা, আর মেকসিকান পদ্ধতিতে চর্বি দিয়ে ভাজা। তাতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে পেঁয়াজ আর পনিরের কুচি। বাঁধাকপি আর আলুও আছে। মদের বালাই নেই, তার বদলে বরফ মেশানো পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি। সব শেষে দেয়া হবে ঘরে বানানো অ্যাভোকাডোর জেলি, তাজা কমলা এবং আঙুর।
কেমন লাগছে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।
এর নাম যদি ডায়েট কন্ট্রোল হয়, সারা জীবন করতে রাজি আছি আমি, চিবাতে চিবাতে বলল মুসা।
ডায়েট কন্ট্রোল কে বলল তোমাকে? ওপাশ থেকে হাসল ভিকি। এ তো পিকনিক।
তাহলে সারাজীবন পিকনিকই করে যাব।
মুসার কথায় না হেসে পারল না কেউ।
প্রচুর হই-হুঁল্লোড় আর হাসি-ঠাট্টার মাঝে শেষ হলো খাওয়া।
ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা।
টনি আর তার বন্ধুরা গেল শুকনো কাঠ-কুটো জোগাড় করার জন্যে।
পাহাড়ী অঞ্চল, তাড়াতাড়ি ডুবে গেল সূর্য। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অগ্নিকুণ্ড তৈরিই আছে, তাতে শুকনো লাকড়ি ফেলতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। চারপাশে গোল হয়ে বসল সবাই।
জীপ থেকে গিটার বের করে আনল টনি, বাজাতে শুরু করল। স্বপ্নিল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে শীলা। ব্যাপারটা তিন গোয়েন্দার নজর এড়াল না। কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপল মুসা।
বাজনার তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে সবাই। গান শুরু করল জিনা। তার সঙ্গে গলা মেলাল শীলা আর বিল। ডিউক আর ভিকিও বাদ রইল না। রবিন শুরু করতেই তার সঙ্গে যোগ দিল মুসা।
গানটান আসে না কিশোরের, গলা মোটেই ভাল না। শুয়ে পড়ল। সে, আকাশের দিকে চোখ। তারা ঝিলমিল করছে, নির্মেঘ রাতে অনেক বড় দেখাচ্ছে তারাগুলোকে। এত কাছে লাগছে, মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। এমন সুন্দর রাত খুব কমই আসে মানুষের জীবনে, ভাবল সে।
চাঁদ উঠলে রওনা হব আমরা, গানের ফাঁকে বলল টনি।
যে-পথে এসেছি সে-পথে? দু-হাত নাড়ল মুসা। তাহলে, বাবা, আমি নেই। অন্ধকারে খাদে পড়ে কোমর ভাঙতে পারব না।
না, অন্য পথে যাব, মুসার শঙ্কা দূর করল টনি। সহজ পথ।
গান-বাজনা চলছে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিচ্ছে ভিকি আর তার স্বামী। জীপে তুলছে।
চাঁদ উঁকি দিল পাহাড়ের মাথায়। উঠে বসল কিশোর। এতক্ষণে খেয়াল করল, জুলিয়ান নেই। তার ঘোড়াটাও নেই। কোন্ ফাঁকে চলে গেছে।
জীপে করে রওনা হয়ে গেল স্বামী-স্ত্রী।
ছেলেমেয়েরা ঘোড়ায় চেপে চলল। র্যাঞ্চে ফিরে চলেছে। দ্রুত ঠাণ্ডা হচ্ছে রাতের বাতাস।
জ্যাকেট এনে ভালই করেছি, জিনে বাঁধা জ্যাকেটটা খুলে নিতে নিতে বলল রবিন।
টনি তো বললই তখন, রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়বে, কিশোর বলল।
পাশাপাশি চলেছে তিন গোয়েন্দা, তাদের পাশে জিনা। বলল, রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ে মরুভূমিতে। এমন, কি গরমের দিনেও শীতকালের মত ঠাণ্ডা।দিনে আবার দোজখের আগুন জ্বলে।
আর বিশেষ কোন কথা হলো না। শুকনো একটা নদীর কূল ধরে রুক্ষ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে দলটা।
গভীর চিন্তায় নিমগ্ন কিশোর। ক্যাচিনা ভূতের কথা ভাবছে, জুলিয়ানের রহস্যময় আচরণের কথা ভাবছে, এরই ফাঁকে ফাঁকে মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হারানো সোনার খনির কথা, দ্য লস্ট ডাচম্যান মাইন। ঘোড়াটা যে ধীরে চলছে, খেয়াল করছে না। পেছনে পড়ল ঘোড়া, পথ থেকে সরে এল। পাহাড়ের ঢালে জন্মে থাকা রসাল সবুজ ঘাসের দিকে নজর।
হঠাৎ শোনা গেল বিচিত্র খড়খড় শব্দ। চমকে উঠে ঘুরে গেল ঘোড়া, আরেকটু হলেই পিঠ থেকে কিশোরকে ফেলে দিয়েছিল। লাগামের দুই মাথার একটা ছুটে গেল তার হাত থেকে, আরেকটা আঁকড়ে ধরে, দুই হাঁটু ঘোড়ার পেটে চেপে কুঁজো হয়ে রইল সে।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছে ঘোড়াটা, কোন্দিকে যাচ্ছে হুঁশ নেই। হাজার চেষ্টা করেও তাকে পথে আনতে পারল না কিশোর।
পাহাড়ে উঠে পড়েছে ঘোড়া, ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল আরেক পাশে। নামছে না বলে পড়ছে বলাই ঠিক। আলগা পাথরের ছড়াছড়ি, পা আটকাতে পারছে না, পিছলে যাচ্ছে দ্রুত। নিচে খাদ। অন্ধকার। কতখানি গভীর, বোঝা যায় না।
আতঙ্কিত হয়ে রাশ, ছেড়ে দিয়ে জিনের শিং আঁকড়ে ধরল কিশোর। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়লে এখন হাড়গোড় আর আস্ত থাকবে না। ভয়ে তাকাতে পারল না নিচের দিকে।
কিছুতেই পা আটকাতে পারছে না ঘোড়াটা। পিছলে পড়ছে, সেই সঙ্গে ঝুরঝুর করে পড়ছে আলগা পাথর আর বালি। পেছনে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন সাহায্যই করতে পারবে না ওরা। বাঁচামরা নির্ভর করছে এখন ঘোড়ার পায়ের ওপর, কোনমতে যদি পাথরে বা মাটিতে খুর আটকায়, তাহলেই শুধু বাঁচার আশা আছে।
আট
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল। হাত ছুটলে ঘোড়ার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যেত কিশোর।
থেমে গেল ঘোড়া।
জিনের শিং চেপে ধরে রেখে আস্তে মাথা তুলল কিশোর। নাহ্, থেমেছে। খাদে নেমে পড়েছে ওরা। গভীরতা একেবারেই কম খাদটার, এ যাত্রা প্রাণে বাঁচল তাই।
রাশ ধরল আবার কিশোর। ঘোড়াটার মতই ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। কাঁপছে ঘোড়াটাও।
কিশোর, কিশোর? খাদের কিনার থেকে জিনার ডাক শোনা গেল। তুমি ভাল আছ?
আছি! কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। সামনের একটা পা ঝাড়ছে ওটা। চেঁচিয়ে বলল সে, ঘোড়াটাকে দেখা দরকার। পায়ে আঘাত লেগেছে মনে হয়।
খাদের ঢালু পাড় বেয়ে নেমে এল সবাই। টর্চ জ্বালল রবিন। আরও দুটো টর্চ জ্বলে উঠল। ঘোড়াটার দিকে ছুটে এল টনি। পা পরীক্ষা করতে বসল।
কি হয়েছিল? জিনা জিজ্ঞেস করল।
র্যাটলম্নেক, জানাল কিশোর। চমকে ভয় পেয়ে ঘোড়াটা দিল দৌড়। থামাতে পারলাম না। টনির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? সাপে কেটেছে?
পায়ে হাত বোলাল টনি। দাগটাগ তো দেখছি না। হাঁটু গেড়ে পড়ে ছিল। আর এই যে, সামান্য চামড়া ছুলেছে। অন্য কোন জখম নেই।
কিন্তু ওটায় আর চড়া যাবে না, জিনা বলল। কারও সঙ্গে ডাবল রাইড করতে হবে।
অসুবিধে নেই, মুসা বলল। আমার সঙ্গেই যেতে পারবে ও।
বিল এগিয়ে এল। সাপটা ছিল কোথায়?
দেখিনি, মাথা নাড়ল কিশোর। খড়খড় শুনলাম।
মনে হলো উড়ে এসে পড়ল ঘোড়ার কাছে।
উড়ে! জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে বিচিত্র শব্দ করল বিল, মাথা নাড়ল, নাহ, মানতে পারছি না। মানুষ আর ঘোড়া দেখলে সাপ বরং সরে যায়। একেবারে পায়ের তলায় না পড়লে কামড়ায় না। ওড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ডানা নেই, লাফিয়ে এসে পড়তে পারে বড়জোর। ভুল দেখোনি তো? ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়েছে আসলে, তাই না?
না।
দেখি, কেউ একটা টর্চ দাও, হাত বাড়াল বিল। আর আমার ঘোড়াটা ধরো। কোথায় সাপ, দেখে আসি।
কোমরের বেল্টে ঝোলানো টর্চটা খুলে দিল মুসা।
সাবধান, বিল, মুখ ফিরিয়ে বলল টনি। দেখেশুনে যেয়ো। মারা পড়ো না।
জবাব দিল না বিল, হাঁটতে শুরু করেছে।
ঘোড়ার পা ভালমত দেখে উঠে দাঁড়াল টনি! না, তেমন খারাপ কিছু না। বেঁচে গেছে।
তবে ভয় পেয়েছে খুব, জিনা বলল, দেখছ না, এখনও কেমন করছে? চোখ থেকে ভয় যায়নি।
অপেক্ষা করছে সবাই। সাপের গল্প শুরু করল একজন, আরেকজন যোগ দিল তার সঙ্গে, দেখতে দেখতে জমে উঠল গল্প। র্যাটলস্নেকের সামনে পড়েনি, এমন একজনও নেই ওখানে। সবারই কোন না কোন অভিজ্ঞতা আছে। কোনটার চেয়ে কোনটা কম রোমাঞ্চকর নয়।
বিল ফিরে এল।
কি দেখলে? তিন-চারজনে একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
এই যে তোমার র্যাটলস্নেক, কিশোরের সামনে হাতের মুঠো খুলল বিল। সামান্য নড়াচড়ায়ই খড়খড় করে উঠল জিনিসটা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে পিছিয়ে গেল জখমী ঘোড়াটা, মাথা ঝাড়া দিয়ে টনির হাত থেকে লাগাম ছুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করল।
কি এটা? এগিয়ে এল মুসা। এক হাতে ধরে রেখেছে ঘোড়ার লাগাম।
রবিন আর বিল, দু-জনের হাতের টর্চের আলোই পড়ল জিনিসটার। ওপর।
র্যাটলস্নেকের লেজ, জবাব দিল বিল। বেশ বড় ছিল সাপটা। মারার পর কেটে নেয়া হয়েছে এটা। টুরিস্ট স্যুভনির। পথের ওপর পড়ে ছিল।
কিন্তু…? কথাটা শেষ না করেই ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরল জিনা, বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। ঘোড়ার ওপর উড়ে এসে পড়েছে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ছুঁড়ে দিয়েছে কেউ? আবছা অন্ধকার থেকে বলল টনি, চোখ দেখা গেল না তার।
কিশোর, জিনার কণ্ঠে অস্বস্তি, বুঝতে পেরেছ কি বিপদ থেকে বেঁচ্ছে? ভাগ্য ভাল, খাদটা গভীর নয়। আশপাশে গভীর খাদও আছে, ওগুলোতে পড়লে…
পড়িনি যখন, আর বলে কি লাভ? জিনাকে থামিয়ে দিল কিশোর। আমি পুরোপুরি ভাল আছি, ঘোড়াটার কেবল সামান্য ছুলেছে। এই তো, ব্যস। উপস্থিত সবাইকে সব কথা জানাতে চায় না সে, তাই আর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করল না। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করল, তাকে সরিয়ে দেয়ার আরেকটা চেষ্টা চালানো হলো। কে সেই লোক, যে চায় না রহস্যের সমাধান হোক?
জিনা, মুসা আর রবিনের মনেও একই প্রশ্ন।
সওয়ারী নিতে পারবে জখমী ঘোড়াটা, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে টনি চাপল ওটাতে। তার ঘোড়াটা দিল কিশোরকে। ধীরে ধীরে শুকনো নদীর ধার ধরে আবার চলল কাফেলা। তিন গোয়েন্দাকে সরিয়ে মাঝখানে রাখা হলো, যাতে আর কোনরকম বিপদ ঘটতে না পারে।
র্যাঞ্চে ফিরে গুডনাইট জানিয়ে চলে গেল মেহমানরা। জিনা আর টনি আস্তাবলে রাখতে গেল ঘোড়াগুলোকে।
হলরুমে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। নীরবে বসে রইল অনেকক্ষণ। নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটছে কিশোর। এখন তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলেও ঠিক মত জবাব পাওয়া যাবে না।
কিন্তু অবশেষে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল মুসা, ইচ্ছে করেই ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, তাই না, কিশোর?
উঁ!..হ্যাঁ। পাহাড়ের চূড়ায় ছিল লোকটা। আমি যখন পিছিয়ে পড়লাম, দল থেকে আলাদা হয়ে গেলাম, তখন. ছুঁড়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার।
ক্যাচিনা ভূতের কাজ নয় তো?
দূর! হাত নাড়ল রবিন, যেন থাবা মারল বাতাসে। এখনও ভূতটুতের ওপর থেকে বিশ্বাস গেল না তোমার…
থাকে তো অনেক সময়… মিনমিন করল মুসা।
মুচকি হাসল কিশোর। ভূত যদি হয়েই থাকে, এই ক্যাচিনাটা ভাল জাতের। কাল রাতে খালি একটু নাচ দেখিয়েছে, গান শুনিয়েছে। ঘাড় মটকাতে আসা তো দূরের কথা, ভয় পাওয়ানোরও চেষ্টা করেনি।
ঠিকই বলেছ, পেছনের দরজার কাছ থেকে বলে উঠল জিনা, ফিরে এসেছে। আমি আর টনিও তাই বলছিলাম।
তোমাদের কি ধারণা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভূতটা ভাল, টনি বলল, কিন্তু মানুষটা খারাপ, যে তোমাকে খুন করতে চায়। বাঁচতে চাইলে তোমার তদন্ত এবার বন্ধ করো।
বন্ধ করব কি, শুরুই তো করিনি এখনও।
হ্যাঁ, কিশোর, টনি ঠিকই বলেছে, জিনা বলল। আমার ভাল লাগছে না এসব। চিঠিটাকে গুরুত্ব দাওনি, দাওনি। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের চেষ্টার পর পরই থেমে যাওয়া উচিত ছিল। তারপর বিছেটা বেরোনোর পর আমাদেরই বাধা দেয়া উচিত ছিল তোমাকে। তারপর পড়ল পোড়া গাছ, আর আজ তো একটুর জন্যে বেঁচে এলে। অনেক হয়েছে, আর এগোতে দেব না। বেড়াতে এসেছ, বেড়াও, চুটিয়ে আনন্দ করো। রহস্য-টহস্য বাদ। ছুটি শেষ হলে একসঙ্গেই ফিরে যাব আমরা রকি। বীচে।
হ্যাঁ, জিনার কথার পিঠে বলল টনি, বাদ দাও ওসব তদন্ত ফদন্ত। রিসোর্টের যা হবার হবে। তুমি ভাল থাকো।
ভুল আমারই হয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছি, ঝুঁকি তো থাকবেই। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল আমার। তা না করে একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে গা ঢেলে দিয়ে বসে আছি। বিপদে পড়ব না তো কি হবে? ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে এই কাজই ছেড়ে দিতে হবে।
এই না হলে পুরুষ, তর্জনী নাচাল মুসা। মরব, সে-ও ভাল, কিন্তু গোয়েন্দাগিরি নেহি ছোড়েঙ্গা…
মুসার কথায় কান দিল না কিশোর, জিনা আর টনির দিকে চেয়ে বলল, তারমানে, বোঝা যাচ্ছে ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমি। নইলে এত ভয় কেন? আমাকে সরাতে চায় কেন?
ঠোঁট বাঁকিয়ে, ভুরু নাচিয়ে, হাত নেড়ে বিচিত্র ভঙ্গি করল টনি। তারপর আর কিছু না বলে চলে গেল।
ভিকির তৈরি গরম চকলেট ড্রিংক খেয়ে অস্বস্তি অনেকখানি দূর হয়ে গেল কিশোরের। নিজের ঘরে এসে কাপড়-চোপড় ছেড়ে শুয়ে উঠে বসল লাগল। শব্দওল আর সঙ্গে সঙ্গেই গতরাতের সেই পড়ল। কিন্তু ঘুম এল না। মনে নানা ভাবনা, খচখচ করছে কয়েকটা প্রশ্ন। এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি করল কিছুক্ষণ, শেষে ধ্যাত্তোরি বলে উঠে পড়ল। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানির তলায় ভিজল পুরো দশ মিনিট। গা মুছে নাইট ড্রেস পরে আবার এসে শুল বিছানায়। গায়ের ওপর কম্বল টেনে নিল।
কয়েক ঘণ্টা পর ভেঙে গেল ঘুম। কানে আসছে গতরাতের সেই অদ্ভুত কণ্ঠের দুর্বোধ্য গান। আজ আর সঙ্গে সঙ্গেই উঠল না, চুপচাপ শুয়ে গান শুনতে লাগল। শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করল। একটাও বুঝল না। উঠে বসল। খালি পায়েই নিঃশব্দে এগোল দরজার দিকে।
আগের দিনের জায়গায়ই ভূটাকে দেখা গেল। কিশোর অনুমান করল, ওটা মেঘ-ক্যাচিনা। কিংবা বলা যায় ধোয়া-ক্যাচিনা, রঙিন।
একই জায়গায় ভাসল কিছুক্ষণ ক্যাচিনাটা, তারপর ভেসে ভেসে এগোল দেয়ালের দিকে। আগের দিন যেখানে মিলিয়েছিল, ঠিক সেখানে পৌঁছেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আজ ভালমত খেয়াল রাখল কিশোর-ঠিক কোথায় মিলায় ওটা।
সুইচ টিপে আলো জ্বালল। এগোল পায়ে পায়ে। বেশ বড় একটা মেঘ-ক্যাচিনা-র কাছে মিলিয়েছে ভূতটা।
আরও কাছে থেকে ছবিটাকে দেখল সে। বোঝার চেষ্টা করল। কোথাও খুঁত, কিংবা চোখে লাগে এমন কিছু দেখতে পেল না। টর্চ আর ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে খুঁটিয়ে দেখলে কিছু পাওয়া যেতে পারে ভেবে, নিজের ঘরে ফিরে এল কিশোর।
হঠাৎ শোনা গেল জিনার উত্তেজিত চিত্তার, আগুন! আগুন! বাংলোয় আগুন লেগেছে!
নয়
পাজামা খোলার সময় নেই, তাড়াহুড়ো করে তার ওপরই প্যান্টি পরল কিশোর। টান দিয়ে আলনা থেকে একটা সোয়েটার নিয়ে তাতে মাথা গলাল। জুতো পরে দৌড়ে বেরোল ঘর থেকে। রবিন আর মুসাও হলে বেরিয়ে এসেছে।
কি-ক্কি হয়েছে? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা।
চলল, দেখি, বলেই পেছনের দরজার দিকে ছুটল কিশোর।
বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা।
থমকে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
বাড়ির সবচেয়ে কাছের বাংলোটায় আগুন লেগেছে। দাউদাউ করে জ্বলছে ছোট্ট বাড়িটা। বাগানের দুটো হোস পাইপ দিয়ে। একনাগাড়ে পানি ছিটিয়ে চলেছে টনি আর, ডিউক। কিন্তু কোন কাজই। হচ্ছে না।
দ্রুত এপাশ-ওপাশ তাকাল কিশোর। আগুনের গর্জন ছাপিয়ে · চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, দমকলকে ফোন করা হয়েছে?
করেছি, জিনা বলল। আস্তাবলের দিক থেকে ছুটে এসেছে। তার। পেছনে ভিকি। দু-জনের হাতে ঘোড়ার দানা রাখার চটের বস্তা। আসছে। ততক্ষণে আমরা যা পারি করি।
হাত লাগাল তিন গোয়েন্দা। বস্তাগুলো নিয়ে গিয়ে সুইমিং পুলের পানিতে চুবিয়ে আনল। আগুনের শিখার ওপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগল এক এক করে। আরও বস্তা আনতে ছুটল জিনা আর ভিকি।
মোটেও দমছে না আগুন। দ্রুত বাড়ছে, চোখের পলকে ছড়িয়ে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
বাংলোটা বাঁচানো সম্ভব নয় বুঝে আশপাশের বাড়িগুলোর দেয়াল, ছাত ভিজাতে শুরু করল টনি আর ডিউক। যাতে ওগুলোতেও আগুন ছড়াতে না পারে।
আগুন কি আর এত সহজে ঠেকানো যায়। বাংলোর পাশের শুকনো ঘাসে ধরল, লেগে গেল পাতাবাহারের বেড়ায়, ধরতে শুরু করল তার ওপাশের ঝোঁপঝাড়ে, বুনো ফুলের ডালপাতা আর ক্যাকটাসে। দ্রুত থামাতে না পারলে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে মরুভূমিতে।
ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন যেন। একটা শিখা কোনমতে নিভালে আরেক জায়গায় তিনটা জ্বলে ওঠে। পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে ঘন কালো ধোয়া-আস্তাবলের কাছে উড়ে গেল, ভেতরে ঢুকে বিষাক্ত করে তুলল বাতাস, শ্বাস নিতে না পেরে অস্থির হয়ে পা ঠুকে চেঁচামেচি জুড়ল ঘোড়াগুলো। দৌড় দিল জিনা। আস্তাবলের ঝাঁপ খুলে দিতে হবে, তাহলে কোরালে বেরিয়ে যেতে পারবে জানোয়ারগুলো।
ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে হাজির হলো দমকল বাহিনীর ঘোট একটা
গাড়ি, ফায়ার ইঞ্জিন।
কালিঝুলিতে একাকার হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা, দরদর করে ঘামছে। সরে এল দূরে। তাদের সাধ্যমত করেছে। এবার দমকল বাহিনীর দায়িত্ব।
ফায়ার ইঞ্জিনের সঙ্গে লড়াই করে টিকতে পারল না আগুন, নত হয়ে এল উদ্ধত শির, গর্জন কমছে।
উত্তেজনা প্রশমিত হতেই ক্লান্তি টের পেল তিন গোয়েন্দা। ধপ করে বসে পড়ল পুলের কাছে সাজিয়ে রাখা চেয়ারে।
ধরল কিভাবে, টনি? একজন ফায়ারম্যান জিজ্ঞেস করল। হেলমেট আর ইউনিফর্ম পরে থাকায় লোকটাকে এতক্ষণ চিনতে পারেনি ছেলেরা, বিল হিগিনস-তাদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিল যে।
মাথা নাড়ল টনি। জানি না। ঘুমিয়ে ছিলাম। জিনার চিৎকারে জেগেছি।
একসঙ্গে জিনার দিকে ঘুরে গেল কয়েক জোড়া চোখ।
কেউ প্রশ্ন করার আগেই জিনা বলল, নাকে ধোঁয়া ঢুকেছিল, কিংবা পোড়া গন্ধে ঘুম ছুটে গেছিল। চোখ মেলতেই জানালায় আলো দেখলাম। উঠে দেখি, আগুন। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সারা রিসোর্টেই আগুন লেগেছে।
ও এদিক-ওদিক তাকাল বিল। পুবের আকাশ মুক্তোর মত সাদা, মরুর ভোর আসছে। পোড়া জায়গা, লন আর ঝোঁপঝাড় এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেদিকে চেয়ে বলল, ভাগ্য ভাল, সময়মত টের পেয়েছ। শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে আছে সব কিছু, আর খানিকটা সময় পেলেই জ্বালিয়ে ছারখার করে দিত।
কফি আর স্যাণ্ডউইচে চলবে তোমাদের? দরজার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল ভিকি। তার পেছন থেকে বেরোল জুলিয়ান, দু হাতে দুই ট্রে।
আরে, খালা, কখন করেছ এসব? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।
দমকল আসতেই বুঝলাম; জবাব দিল ভিকি, আমার আর দরকার নেই এখানে। জুলিয়ানকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।
খুব আগ্রহের সঙ্গে প্লেট নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সকলেই।
দারুণ হয়েছে তো স্যাণ্ডউইচ, মুখভর্তি খাবার, দুই গাল ফুলে উঠেছে মুসার। কে বানিয়েছে?,
জুলিয়ান, জানাল ভিকি।
স্যাণ্ডউইচের তারিফ করল সবাই। লাজুক হাসি ফুটল জুলিয়ানের মুখে।
ভাজা মাংসের ওপর পনিরের হালকা আস্তরের পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচগুলো এই মুহূর্তে বেশি সুস্বাদু লাগার আরেকটা কারণ, প্রচণ্ড উত্তেজনা আর পরিশ্রমে সবাই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। লড়াই জেতার আনন্দ সবার মনে।
তবে জুলিয়ানের হাসি মুছে গেল খুব তাড়াতাড়ি, যখন একজন ফায়ারম্যান পোড়া বাংলোটা দেখিয়ে বলল, ওখানে আগুন ধরাটা দুর্ঘটনা নয়, টনি। বাংলোতে লোক থাকে না যে সিগারেটের আগুন থেকে ধরবে। নাকি গতরাতে তুমি ছিলে ও-ঘরে?
জোরে মাথা নাড়ল টনি। না না। ওটার কাজ তো কবেই শেষ, উইলসন আঙ্কেলের অ্যাক্সিডেন্টের আগেই। তারপর আর ওটার কাছে যাওয়ারও সময় পাইনি। অয়্যারিং বাকি ছিল, আঙ্কেল এলে করা হত, জানোই তো।
ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। জিজ্ঞেস করল, আগুনটা লাগানো হয়েছে ভাবছেন?
কেউ কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল জুলিয়ান, আবার যেন আমার দোষ দিয়ে বসবেন না! আমি লাগাইনি! উঠে দাঁড়িয়েছে। সে, হঠাৎ ঝাঁকুনিতে হাতের গেলাস থেকে ছলকে পড়ে গেল দুধ। আমি আগুন লাগাইনি!
কেউ কিছু বলল না।
গলা পরিষ্কার করে নিল ভিকি। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই গেলাস রেখে দৌড় দিল জুলিয়ান। কোরাল থেকে বের করে আনল তার, সাদা-কালো পিন্টো ঘোড়াটা। জিন-লাগাম ছাড়াই তাতে চড়ে বসল, ইনডিয়ানদের মত। খালি-পিঠে বসে গলা জড়িয়ে ধরে সোজা ছুটল মরুভূমির দিকে।
ওকে কিছু বলিনি আমি, ভিকির দিকে চেয়ে অপরাধী-কণ্ঠে বলল কিশোর। যাব ওর পিছে? ফিরিয়ে আনব?,
লাভ নেই, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ভিকি। ধরতে পারবে না।
ওকে দোষ দিয়েছ কেন ভাবল? কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করল রবিন।
সবাই দেয় তো, তাই, অস্বস্তি ফুটেছে ডিউকের চোখে। সিগন্যাল দেয়ার জন্যে সেই যে পাহাড়ে একবার আগুন জ্বালল, তাতেই হলো কাল। সবাই এখন খালি তার দোষ দেয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না এসব জুলিয়ানের কাজ… ধরে এল গলা। মাথা ঝাঁকিয়ে যেন আবেগ তাড়ালেন। স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস আর বেড়ায় আগুন দেয়া। এক কথা, আর বাংলোতে আগুন লাগানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।
না! হঠাৎ উঠে দাঁড়াল ভিকি। মুখে বেদনার ছাপ। আমিও বিশ্বাস করি না। এ কাজ জুলিয়ান করতেই পারে না। আগুন যখন লাগল, জুলিয়ান তখন বিছানায়। না, সে করেনি…
সবাই আমরা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি, পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে বলল বিল। এখনও ওখাতে ভীষণ গরম, পোড়া বাড়িটা দেখাল। কাছে যাওয়া যাবে না। বিকেলে এসে খুঁজে দেখব। কিভাবে আগুন লাগল, হয়তো বোঝা যাবে।
জুলিয়ান-প্রসঙ্গ তখনকার মত ওখানেই থেমে গেল।
কফি আর স্যাণ্ডউইচ শেষ করে, জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল দমকল বাহিনী।
পোড়া জঞ্জাল যতখানি সম্ভব সাফ করায়, মন দিল টনি, তাকে সাহায্য করলেন ডিউক। তিন গোয়েন্দা আর জিনাও চুপ করে বসে রইল না।
দিগন্তে দেখা দিল সূর্য। রোদ এসে পড়ল, সোনালি চাদর দিয়ে যেন ঢেকে দিল সব কিছু।
ঘরের দিকে রওনা হলো ক্লান্ত কিশোর। তার সঙ্গে রবিন আর, মুসা।
গোলমালটা কোথায়? চলতে চলতে আপনমনে বিড়বিড় করল কিশোর।
কিসের গোলমাল? জিজ্ঞেস করল মুসা।
জানো, খুব খারাপ লাগছে, বন্ধুর দিকে ফিরে বলল কিশোর। আমি ভাবছি ওর দুর্নামটা ঘোচাব, আর জুলিয়ান ভাবছে উল্টো। ও ভেবেছে বাংলোয় আগুন লাগানোর জন্য দোষ দিচ্ছি ওকে আমি।
তাই কি দিচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে জবাব দিল কিশোর, না। ওর দোষ একটাই, বাড়িতে না থাকা। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় সে-ই জানে। লোকের মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
আমারও দুঃখ হয় ছেলেটার জন্যে, গম্ভীর হয়ে বলল মুসা। বাপ নেই বেচারার, মা থেকেও নেই। ফুপুর কাছে এসে পড়ে আছে…পরের দয়ায় মানুষ হওয়ার যে কি যন্ত্রণা… হঠাৎ বদলে গেল কণ্ঠস্বর, ঝাঁঝাল গলায় বলল, কিন্তু ওকে দোষী বানিয়ে কার কি লাভ? শয়তানিগুলো করছে ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্যে।
কে যে করছে সেটাই যদি জানতাম, বহুদূর থেকে যেন শোনা। গেল কিশোরের কণ্ঠ। তারপর ফিরে এল বাস্তবে, ঠাণ্ডা হোক, তারপর যাব। পোড়া জায়গায় হয়তো কোন সূত্র মিলবে।
যদি সূত্র থাকে, রবিন যোগ করল।
হ্যাঁ, যদি থাকে।
ঘরে এসেই বাথরুমে ঢুকল তিনজনে। ভালমত সাবান মেখে সাফ করল শরীরের কালি, ময়লা আর ঘাম। নতুন কাপড় পরে বেরোল। ভিকি আর জিনার খোঁজে চলল রান্নাঘরে।
রান্নাঘরে নয়, লবিতে পাওয়া গেল জিনাকে।
টনি কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
শহরে গেছে, হাসপাতালে। চাচাকে জানাবে সব কথা।
জুলিয়ান ফিরেছে?
না।
গেল কই? অযথা মানুষের কথা শুনছে ছেলেটা।
হ্যাঁ, রাগে জ্বলে উঠল জিনার চোখ। শয়তানিটা করছে জানি কোন্ হারামজাদা ধরতে পারলে.. দাতে দাঁত চাপল সে।
দশ
অর্ধেক রাত ঘুম নষ্ট হয়েছে। তাই সকাল সকাল দুপুরের খাবার দিল ভিকি, যাতে খেয়েদেয়ে সবাই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে, রাতের ঘুমটা পুষিয়ে নিতে পারে।
বিকেলে যখন ঘুম থেকে উঠল তিন গোয়েন্দা, বাইরে তখনও কড়া রোদ। ভীষণ গরম। সুইমিং পুলে এসে নামল তিনজনেই।
মুসা সাঁতার কাটছে, রবিন পানিতে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। কিশোর দাঁড়িয়ে আছে কোমর পানিতে। সাঁতারের ইচ্ছে বিশেষ নেই, বার বার তাকাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। সাদা-কালো পিন্টো ঘোড়া আর ওটার সওয়ারীকে খুঁজছে তার চোখ।
মুসা আর রবিনের আগেই উঠে পড়ল পানি থেকে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, কাপড় পরে এগোল পোড়া বাংলোর দিকে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু কোন সূত্র পাওয়া গেল না। খানিক পরে বিল এল, সে-ও কিছু পেল না। নাহ্, কিছু নেই। আর কাঠ যা শুকনো, আগুন লাগলে থাকে নাকি কিছু?…কিন্তু…নাহ, শিওর হওয়া যাচ্ছে না।
ওর সঙ্গেই রয়েছে টনি। অ্যাক্সিডেন্ট কিনা জানতে চাইছ তো? মোটেই না। কোন সম্ভাবনাই নেই। উইলসন আঙ্কেলও তা-ই বলেছে। কেউ থাকে না ওখানে, সিগারেটের আগুন ফেলা হয়নি। আকাশ পরিষ্কার ছিল, বাজও পড়েনি। আর ইলেকট্রিকের তারই নেই যে ওখান থেকে আগুন লাগবে। ব্যাপার একটাই ঘটেছে, লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।
কেন লাগাল? মিস্টার উইলসনের সঙ্গে তার কি শত্রুতা?
হয়তো সে-লোক চায় না, কিশোর জবাব দিল, এখানে রিসোর্ট গড়ে উঠুক। এছাড়া আর তো কোন কারণ দেখি না।
ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরল টনি।
অন্য দিকে তাকাল কিশোর, পাহাড় আর মরুভূমির দিকে। দূরে দেখা গেল ঘোড়াটা। খুরৈর ঘায়ে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে ছুটে আসছে।
কাছে এলে বোঝা গেল, পিন্টো ঘোড়াটাই।
আসছি, বলে সোজা আস্তাবলের দিকে রওনা হলো কিশোর। ভেতরে ঢুকে জখমী ঘোড়াটার স্টলে এসে দাঁড়াল। হাত বুলিয়ে দিল। ওটার আহত পায়ে; বিড়বিড় করে বলল, এখনও ব্যথা করছে?
আস্তাবলে ঢুকল জুলিয়ান। ঘোড়া বাঁধল।
স্টলের ওপর দিয়ে মুখ বাড়াল কিশোর। কেমন বেড়ালে? ভাল?
একবার চেয়েই মুখ ফেরাল জুলিয়ান, মাথা ঝাঁকাল শুধু।
নতুন কোন ট্র্যাক চোখে পড়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
গাড়িতে, কিংবা ঘোড়ায় চড়ে এখান থেকে ছুটে পালাচ্ছে, এমন কারও চিহ্ন?
বড় বড় চোখ দুটো ফিরল এদিকে। কেন? কণ্ঠে সন্দেহ।
বাংলোতে আগুন আপনাআপনি লাগেনি, লাগানো হয়েছে। ভাবলাম, লোকটাকে দেখে থাকতে পারো তুমি।
চুপ করে ভাবল জুলিয়ান। পাহাড়ে গিয়েছিলাম আমি। ওদিকে, কেউ থাকে না।
কিন্তু ট্র্যাক তো চোখে পড়তে পারে? পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে ভাল লাগে না তোমার?
লাগে, ফিরে এল লাজুক হাসি। জোহান আঙ্কেল শিখিয়েছে, কিন্তু ভাল পারি না এখনও। সে পারে, সামান্য চিহ্নও তার চোখ এড়ায় না।
জোহান আঙ্কেল কে?
ওই ওদিকে থাকে। ডাক্তারের র্যাঞ্চের কাউবয়। তীর-ধনুকও খুব ভাল বানাতে পারে। আমাকে অনেকগুলো বানিয়ে দিয়েছে।
সুপারস্টিশনের অনেক গলিঘুপচির খোঁজ নিশ্চয় পেয়েছ তুমি, জোহান আঙ্কেলের দৌলতে?
হুঁ, মাথা কাত করল জুলিয়ান। সময় পেলেই আমাকে নিয়ে যায়।
আস্তাবল থেকে বেরোল দু-জনে।
কি কি দেখো?
অনেক কিছু। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যায় লোকে, পায়ে হেঁটে যায়। কেউ সোনা খুঁজতে, পুরানো খনিগুলো খোড়ে। পর্বতের গহীনে বনের কিনারে বাচ্চা নিয়ে বেরোয় কয়োটিরা। বাচ্চাকে শিকার শেখায়…
বাড়ির দিক থেকে ভিকির ডাক শুনে থেমে গেল জুলিয়ান। ফুপু ডাকছে, বলে দৌড় দিল সে।
তার পেছনে এগোল কিশোর। সে এখন নিশ্চিত, আগুন জুলিয়ান লাগায়নি। তবে সবার কাছে সেটা প্রমাণ করতে হবে। লোকে সন্দেহ করে, আড়চোখে তাকায়, নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগে ছেলেটার। লাগারই কথা।
সামনে এসে দাঁড়াল টনি। গম্ভীর। কি বলল?
টনির কণ্ঠস্বরে অবাক হলো কিশোর। কিসের কথা?
সারাদিন কোথায় কাটিয়েছে?
পর্বতে। কেন?
ডাক্তারের ওখান থেকে লোক এল এইমাত্র। ওদের দুটো ছাউনিতে আগুন লেগেছে। দুপুরের দিকে। ধোয়া দেখে আগুন নিভাতে গিয়ে দেখে বাঁচানোর আর কিছু নেই। পুড়ে ছাই। ওই জোহানটা হয়েছে যত নষ্টের মূল, ছেলেটাকে সে-ই প্রশ্রয় দেয়। নিজে এক শয়তান, ছেলেটাকেও শয়তান বানাচ্ছে।
কার কথা বলছ?
জুলিয়ান, আর কার।
ছাউনিতেও সে-ই আগুন লাগিয়েছে ভাবছ নাকি?
কিশোরের কথায় এমন কিছু রয়েছে, স্বর নরম করতে বাধ্য হলো টনি। ভাবতে তো খারাপই লাগছে। কিন্তু অন্য কেউ কেন ফাঁকা পড়ে থাকা ছাউনি পোড়াতে যাবে?
জুলিয়ানই বা কেন পোড়াবে?
থমকে গেল টনি। ভাবল। হয়তো ডাক্তারের ওপর রাগ। অ্যাপলুসা চুরির খবর ডাক্তার এসে দিয়েছে তো, সেজন্যে। কিংবা হয়তো ইনডিয়ান ইনডিয়ান খেলছে। খুব নির্জন এলাকা। ভেবেছে, কেউ দেখতে পাবে না।
দেখো, এ সবই অনুমান। প্রমাণ ছাড়া কাউকেই দোষী বলতে পারো না।
কিন্তু ডাক্তার জিংম্যান রেগে গেছে। মিস্টার উইলসনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাছাড়া এখানে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। গোয়াল আর কোরালের দরজা খুলে গরু-ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হয়েছে এতদিন, তেমন গায়ে মাখেনি ডাক্তার, কিন্তু আগুন লাগানো সহ্য করবে না। কেউই করবে না। আর বোধহয় জুলিয়ানকে রাখা যাবে না এখানে।
কিশোরের বলে ফেলতে ইচ্ছে হলো, তুমি রাখা না রাখার কে? বলল না। ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল, ও কোথায় যাবে?
মায়ের কাছে।
খুব রাগ হলো কিশোরের। বাচ্চা একটা ছেলের বিরুদ্ধে বড়রা এভাবে উঠে-পড়ে কেন লেগেছে? চ্যালেঞ্জ করে বসল, জুলিয়ান করছে না এসব, এবং সেটা আমি প্রমাণ করে ছাড়ব। বলে আর দাঁড়াল না।
রিসোর্টের ভেতরে, আর পাতাবাহারের বেড়ার বাইরে বাকি দিনটা সূত্র খুঁজে বেড়াল তিন গোয়েন্দা। কিছু পেল না।
পাব কি? মুসা বলল। যা ছিল আগুনে পুড়েছে। বাকি যদি বা কিছু ছিল, নষ্ট করেছে ওই দমকল। কাদা বানিয়ে দিয়েছে।
বাকিটা নষ্ট করেছি আমরা, আনমনে বলল কিশোর। গতকাল দল বেঁধে গিয়েছি, ঘোড়ার খুরের ছাপ তো আর একটা-দুটো নয়। তার ওপর রয়েছে জীপের চাকা। আজ যদি কেউ গিয়েও থাকে ওপথে, ছাপ আলাদা করে চেনার উপায় নেই।
বাড়ির কাছে চলে এল আবার ওরা।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কয়েক গুণ বড় হয়ে ছায়া পড়েছে বাড়িটার। সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিচিত্র একটা অনুভূতি হলো কিশোরের, মনে হলো, আড়াল থেকে তার ওপর চোখ রাখা হচ্ছে। বাতাস গরম, তবু গায়ে কাঁটা দিল।
এতই তন্ময় হয়ে ভাবছে কিশোর, ক্যাকটাস ঝাড়ের ভেতর থেকে একটা রোডরানার বেরোনোর শব্দেও চমকে উঠল। একদিকে ছুটে পালাল পাখিটা। কাছেই লম্বা ঘাসের ভেতর ডেকে উঠল কোয়েল। কাছেই আরেকটা পাখি চেঁচিয়ে তার জবাব দিল।
কি ব্যাপার? উত্তেজিত মনে হচ্ছে পাখিগুলোকে।
ক্যাকটাসের ভেতরে নড়ে উঠল একটা ছায়া, পলকের জন্যে।
মুসার শিকারী চোখ এড়াল না সেটা। দুই ধাক্কায় দুই পাশে দাঁড়ানো কিশোর আর রবিনকে ফেলে দিয়ে নিজেও পড়ল ডাইভ দিয়ে।
ধনুকের টংকার শোনা গেল। শিস কেটে ছুটে এল কি যেন। খট করে আওয়াজ হলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখল কিশোর, মুহূর্ত আগে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তার পেছনের গাছটায় বিঁধেছে তীরটা। থিরথির করে কাঁপছে তীরের পালক লাগানো পুচ্ছ।
এগারো
খবরদার, মাথা তুলবে না! ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। আস্তে আস্তে সরে যাও কোনার দিকে। ক্রল করে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে ওরা, ভয় করছে, এই বুঝি আরেকটা তীর এসে গাঁথল পিঠে।
আর কিছু ঘটল না। নিরাপদে সরে এল বাড়ির কোণে।
সাবধানে, মাথা তুলল কিশোর। স্থির চেয়ে রইল ক্যাকটাসের ঝাড়টার দিকে। কোনরকম নড়াচড়া নেই। ছোট একটা পাখি উড়ে এসে বসল একটা ডালের মায়ায়। ফুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিল চোখা, লম্বা ঠোঁট। মধু খেতে শুরু করল।
না, নেই কেউ ওখানে, পাখিটাকে দেখতে দেখতে বলল মুসা। চলে গেছে।
পায়ে পায়ে আবার গাছটার কাছে ফিরে এল ওরা। ডাল থেকে তীরটা খুলে নিল কিশোর।
পেছনের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল তিনজনে।
ভিকি রান্না করছে, একা, আর কেউ নেই ঘরে।
ফ্রিজ খুলে তিনটে লেমোনেড বের করে আনল মুসা। দুটো বোতল দু-জনের দিকে ঠেলে দিল। চেয়ার টেনে বসল তিনজনেই।
একবার মুখ ফিরিয়ে চেয়েই আবার রান্নায় মন দিল ভিকি। খুব ব্যস্ত।
এক চুমুকে অর্ধেকটা লেমোনেড শেষ করে ঠক করে বোতলটা টেবিলে নামিয়ে রাখল কিশোর।
মুসা, বড় বাঁচান বাঁচিয়েছ। আরেকটু হলেই গেছিলাম।
হাসল শুধু মুসা, কিছু বলল না।
কার শত্রু তুমি? কিশোরের দিকে চেয়ে ভুরু নাচাল রবিন।
সেটা জানতে পারলে তো রহস্যেরই সমাধান হয়ে যেত।
তন্দুর থেকে বিস্কুট বের করল ভিকি। হাত মুছে এগিয়ে এল টেবিলের কাছে। কি আলাপ করছ… টেবিলে রাখা তীরটা দেখে কুঁচকে গেল ভুরু। ওটা কোথায় পেলে?
কিশোরের মনে হলো, তীরটা ভিকির চেনা। পাল্টা প্রশ্ন করল, চেনেন নাকি?
হ্যাঁ, জবাব দিল ভিকি, জুলিয়ানের। ডাক্তারের র্যাঞ্চের কাউবয় বুড়ো জোহান বানিয়ে দিয়েছে। হাতে বানানো দেখছ না? পেছনের পালক লাগানো দেখেই বোঝা যায় অনেক কিছু। ইনডিয়ানদের কাছে। বানাতে শিখেছে জোহান।
হাতে বানানো যে সেটা তখনই বুঝেছি, কিশোর বলল।
পেলে কোথায়? আবার জিজ্ঞেস করল ভিকি। আবার কি ক্যাকটাস গাছে শুটিং প্র্যাকটিস করছিল নাকি?
কিশোরকে সই করে মেরেছে, রবিন বলল। ক্যাকটাস ঝাড়ের ভেতর থেকে। লোকটাকে দেখিনি। মুসা ধাক্কা দিয়ে না ফেললে তো গায়েই বিধত।
কিশোর! রক্ত সরে গেছে ভিকির মুখ থেকে। তু-তুমি নিশ্চয়। ভাবছ না… ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। তীরটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন ওটা বিষাক্ত সাপ।
না, জুলিয়ান নয়, আমি শিওর। কিন্তু ওর তীর অন্যের হাতে গেল কিভাবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিকি। প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কয়েকটা হারিয়েছে ঝোপে, আর ক্যাকটাসের ঝাড়ে। ডজনখানেক বানিয়ে দিয়েছিল জোহান। চারটা হারিয়েছে, আটটা থাকার কথা। কটা আছে গিয়ে দেখব?
দরকার নেই। জুলিয়ান তীর মারেনি আমাকে। মুসা আর রবিনের দিকে পর পর তাকাল কিশোর, আবার ভিকির দিকে ফিরল। আমার মনে হয়, এ কথাটা এখন কাউকে না জানানোই ভাল। চেপে যাব। জিনাকেও বলার দরকার নেই। শুনলেই রেগে হাউকাউ করে সবাইকে শোনাবে।
কিন্তু তোমার খুব বিপদ হতে পারে, কিশোর, প্রতিবাদ করল ভিকি।
তা হোক। তবু এ-রহস্যের সমাধান না করে আমি ছাড়ব না। টনি যেন এ কথা না শোনে। মিস্টার উইলসনকেও শোনানোর দরকার নেই। বাড়িতে আগুন লাগার কথা শুনেই নিশ্চয় মন খারাপ করে আছেন। দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে লাভ নেই। শেষে সবাই মিলে আমাকে তদন্তই করতে দেবে না।
তা ঠিক, শুনলে খুব চিন্তা করবেন, মাথা দোলাল ভিকি। হাসপাতাল থেকে চলে আসতে চাইবেন। উচিত হবে না। পুরোপুরি সুস্থ হননি এখনও। কিন্তু, কিশোর, তোমারও অহেতুক ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। জুলিয়ানকে বরং তার মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দেব। ধরে নেব, কপাল খারাপ ছেলেটার, থাকতে পারল না এখানে। কিংবা হয়তো আমিই এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে শহরে চলে যাব। বাপমরা এতিম ছেলে, ফেলব কোথায়?
মায়ের কাছেও পাঠাতে হবে না, আপনাকেও কোথাও যেতে হবে না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল গোয়েন্দাপ্রধান। এ-রহস্যের কিনারা আমি করবই করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
এক মুহূর্ত চুপ করে কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে রইল ভিকি। বুঝল, কিছুতেই এখন আর ওকে ঠেকানো যাবে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, যা ভাল বোঝো করো। কিন্তু খুব সাবধানে থাকবে। তোমার কিছু হলে, কোনদিন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
পরের দুটো দিন কিছুই ঘটল না।
অলসভাবে কাটল সময়।
অ্যাপাচি জাংশন দেখতে গেল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে গেল জিনা। নানারকমের দোকান আছে, ছোট ছোট জুয়েলারের দোকানই বেশি। নানারকম ইনডিয়ান অলঙ্কার রয়েছে প্রতিটি দোকানে। জিনার পছন্দে একটা করে চমৎকার বেল্ট কিনল ছেলেরা, রূপার বাকলসে একটা করে নীলকান্তমণি বসানো। যার যার বাড়ির লোকের জন্যে কিছু উপহার কিনল।
এক দোকানে একটা ক্যাচিনা পুতুল দেখে খুব পছন্দ হলো কিশোরের। বাহ, দারুণ তো! চাচীরও পছন্দ হবে। স্যুভনির হিসেবে খুব ভাল, না?
পুতুলটা বেশ চড়া দামে কিনে নিল সে। ওই দোকান থেকেই রাশেদচাচার জন্যে কিনল একটা সুন্দর ইনডিয়ান পাইপ।
জুলিয়ান, ভিকিখালা আর টনির জন্যেও একটা করে উপহার কিনল ওরা।
জিনা নিজের জন্যেও কিনল একটা রূপার চেন, লকেটের জায়গায় ছোট্ট একটা পাখি ঝুলছে। একটা কনডর। চোখ দুটো লাল পাথরের, ঝকঝক করে জ্বলছে।
চেনটা গলায় পরে বন্ধুদের দিকে ফিরল জিনা। কেমন লাগছে?
রাক্ষুসী, জবাব দিল মুসা।
কী? রেগে উঠল জিনা।
না না, ভুল করেছি, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা। মুচকি হেসে বলল, ওঝানী। ইনডিয়ান ওঝানী। চুলগুলোকে আরেকটু এলোমলো করো, মুখে রঙ লাগাও..
দেখো, ভাল হবে না বলছি। ভীষণ রেগে গেল জিনা। তুমি নিজে কি? তুমি তো একটা ভূত…
ঠিক বলেছ, দু-আঙুলে চুটকি বাজাল মুসা। বিকশিত হলো হাসি।
একটানে গলা থেকে চেনটা খুলে ফেলল জিনা। থাক! নেবই না!
না না, নাও, প্লীজ, হাতজোড় করে অনুরোধ করল মুসা। এমনি ঠাট্টা করছিলাম। এখানে এসে তোমার রাগ দেখিনি তো, কেমন যেন অন্য মানুষ অন্য মানুষ লাগছিল। তাই রাগিয়ে দিয়ে আসল রূপ…
হেসে ফেলল জিনা। আমি খুব বদমেজাজী, না? তাই তো এবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তোমাদের কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না।
কোন দরকার নেই, মিটিমিটি হাসছে রবিন। রাগ না থাকলে আসল জিনাকে হারাব আমরা। ভদ্র মিস জরজিনা পারকারকে চাই না, আমাদের জিনাকেই দরকার। তোমার যত খুশি দুর্ব্যবহার করো, মেজাজ দেখাও, কিছু মনে করব না।
তোমরা চেনো বলে…
যারা চেনে না তাদেরকেও বলে দেব, তোমার স্বভাবই ওরকম। বাইরে তুমি রুক্ষ হলেও ভেতরে তোমার অত্যন্ত কোমল সুন্দর একটা মন আছে। আসলে তুমি খুব ভাল মেয়ে।
হয়েছে হয়েছে, আর তেলাতে হবে না, কৃত্রিম মুখঝামটা দিল জিনা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত খুশি হয়েছে, রিঙের সঙ্গে ছোট্ট শেকলে ক্যাচিনা পুতুল ঝোলানো তিনটে চাবির রিঙ কিনে ওখানেই উপহার দিয়ে ফেলল তিনজনকে।
যাক, মাঝেসাঝে ঝগড়া বাধালে লাভই, বলল মুসা।
চেনটা আবার তুমি পরো, জিনা, প্লীজ।
কি ভেবে আবার চেনটা পরল জিনা।
সত্যি, চমৎকার মানিয়েছে, বলল ইনডিয়ান সেলসগার্ল, এতক্ষণ উপভোগ করছিল ছেলেমেয়েদের ঝগড়া। কাপড়-চোপড় ঠিকমত পরালে একেবারে ইনডিয়ান বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
চুল যে তামাটে?
তাতে কি? কালো করে নিলেই হবে।
তা রাগ অভিমান তো অনেক হলো, হাত তুলল কিশোর। বাড়ি টাড়ি কি যাব আমরা?
ইনডিয়ান মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোকান থেকে বেরোল ওরা।
শেষ বিকেলে র্যাঞ্চে ফিরল।
গত দু-দিন ধরে নতুন কিছু না ঘটায় কিছুটা হতাশই হয়েছে। কিশোর। জাংশন থেকে ফেরার পথে রহস্যগুলোর কথা খালি ভেবেছে। দু-রাত ধরে কাচিনা ভূতটারও দেখা নেই।
ব্যাপারগুলো এতই খচখচ করছে মনে, পেট ভরে খেতে পারল না রাতে। তাস খেলার প্রস্তাব দিল টনি, রাজি হলো না সে। মুসা আর রবিনকে নিয়ে খেলতে বসল টনি, জিনাও এসে যোগ দিল। কয়েক মিনিট খেলা দেখে উঠে পড়ল কিশোর। চলে এল বড় হলরুমটায়, যেখানে ক্যাচিনা পেইন্টিংগুলো রয়েছে। কি এক অদৃশ্য আকর্ষণ যেন তাকে টেনে নিয়ে এল, সেই মেঘ-ক্যাচিনাটার কাছে, যেটায় ভূত ঢুকে পড়েছে বলে মনে হয়েছিল সেদিন।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ। ব্যতিক্রমী কিছু চোখে পড়ল না। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।
আকাশের কোণে মেঘ, বৃষ্টির আগমন সঙ্কেতে যেন বাতাস উত্তেজিত।
কালো আকাশ চিরে দিল নীলাভ বিদ্যুৎ, সুপারস্টিশনের উঁচু চূড়া প্রায় ছুঁয়ে তীব্র গতিতে ছুটে হারিয়ে গেল ওপাশে।
থমথমে প্রকৃতিতে আলোড়ন তুলল ভেজা ঝড়ো বাতাস। দোল খেলে গেল জানালা-দরজার সাদা পর্দায়। বহুদূরে, পর্বতের দিক থেকে ভেসে এল বজ্রপাতের চাপা গুমগুম। এরই মাঝে শোনা গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ। আবছা আলোয় চকিতের জন্যে ঘোড়াটা চোখে পড়ল কিশোরের, ছুটে চলে যাচ্ছে-সাদা-কালো পিন্টো ঘোড়া।
মুহূর্ত দ্বিধা করেই দরজার দিকে দৌড় দিল কিশোর। বাইরে বেরিয়ে ছুটল আস্তাবলের দিকে। তুফান আসছে, এর মাঝে এই অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে জুলিয়ান? দেখতেই হবে। অন্য কাউকে কিছু বলে আসার সময় নেই।
অন্ধকারে, আস্তাবলের ভেতরে কিছু দেখা যায় না। দরজার ঠিক ভেতরের স্টলে যে ঘোড়াটা পেল, তাতেই চড়ে বসল। বের করে নিয়ে এল। আবছা অন্ধকারে যতখানি সম্ভব জোরে ছুটে অনুসরণ করে চলল সামনের ঘোড়াটাকে।
উপত্যকায় পৌঁছে শুকনো একটা চওড়া নালার মধ্য দিয়ে ছুটল ঘোড়া। গতি কমিয়ে সামনের ঘোড়াটা খুঁজল কিশোর, দেখল না। তারপর হঠাৎই আবার চোখে পড়ল সাদা-কালো ঝিলিক, ক্ষণিকের জন্যে। ওটাও ছুটছে নালা দিয়ে।
জুলিয়ান, শোনো! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। জুলিয়ান!
জবাবে শুধু ঘোড়ার খুরের শব্দ।
বাতাসের বেগ বাড়ছে, ধুলো উড়ছে। তার সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা আর কুটো। পড়ছে এসে চোখেমুখে, চোখ খুলে রাখা দায়। খুরের শব্দ শুনে শুনে অনেকটা অন্ধের মত ঘোড়া নিয়ে এগোচ্ছে কিশোর।
বজ্রপাতের গর্জন জোরাল হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। অনেক সামনে ঘোড়াটাকে ক্ষণে ক্ষণে চোখে পড়ছে সেই আলোয়। আরও কয়েকবার ডাকল কিশোর, কিন্তু সাড়া দিল না পিন্টোর সওয়ারী, ফিরেও তাকাল না।
নামল বৃষ্টি। বাজ পড়ল প্রচণ্ড শব্দে, দু-ভাগ হয়ে গেল যেন আকাশটা। মুষলধারে বৃষ্টি, ফোঁটা ফোঁটা নয়, যেন পানির চাদর। থেমে যাচ্ছে ঘোড়াটা বারবার, খোৎ-খোৎ করছে, মাথা ঝাড়ছে। এই
ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সামনে এগোতে রাজি নয় সে, ফিরে যেতে চায়। আস্তাবলের নিরাপদ শুকনো আশ্রয়ে।
ঘোড়াটাকে হাঁটতে বাধ্য করল কিশোর। রেকাবে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাল, পানির চাদর ফুড়ে অন্ধকারে কয়েক হাতও এগোল না নজর। পিন্টোটাকে দেখা গেল না। খুরের আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছে না এখন। ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। নালা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পর্বতের আরও ভেতরে।
থেমে থেমে যাচ্ছে ঘোড়াটা। চলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। তোড়ে নেমে আসছে পানি, শুকনো মাটি এখন পিচ্ছিল কাদা। আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। সামনের দৃশ্য দেখে কিশোরও চমকে গেল।
সামনে নালাটা মনে হলো শেষ। পিন্টো আর তার সওয়ারী অদৃশ্য। গেল কোথায়!
রাশ টেনে ঘোড়া থামিয়ে পরবর্তী বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষায় রইল কিশোর। ইস, বোকামি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োয় টর্চ আনতে মনে ছিল না।
বিদ্যুৎ চমকালে মনে হলো যেন দুপুরের আলো। স্পষ্ট চোখে পড়ল সামনের সব কিছু। সামনে নালার দুই পাড় এখানকার চেয়ে অনেক বেশি খাড়া। দুই পাশেই পাহাড়ের ঢাল, তা-ও যথেষ্ট খাড়া।
বৃষ্টি আরও বাড়ল। সামনে এগিয়ে আর লাভ হবে না, পিন্টোটাকে হারিয়েছে। হতাশ হয়ে ঘোড়াকে ওটার ইচ্ছেমত চলতে দিল সে।
গেল কোথায় পিন্টো? গভীর নালা থেকে হঠাৎ করে একেবারে উধাও তো হয়ে যেতে পারে না। ধারেকাছেই লুকিয়ে আছে কোথাও?
ছিল তো এখানেই, বিড়বিড় করে ঘোড়াটার সঙ্গে কথা বলল কিশোর। ঠিকই অনুসরণ করেছিস। তারপর?
কিশোরের কথার জবাবেই বুঝি আরেকবার ফোঁস করে উঠল ঘোড়া। হঠাৎ যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। বাঁকা হয়ে গেল পেছনদিকে। কাদামাটিতে নাল ঢুকিয়ে দিয়ে পতন রোধ করতে চাইছে। সামনে ঢাল, তারপরে তরাই।
অনেক কষ্টে পিছলে পড়া থেকে রেহাই পেল ঘোড়াটা। হাঁপ ছাড়তে যাবে এই সময় কিশোরের কানে এল একটা অদ্ভুত গমগমে আওয়াজ। বজ্রপাতের নয়। তুমুল বৃষ্টিতে ভরে গেছে নালা। পেছনে তাকিয়ে দেখল কিশোর, দুই পাড় উপচে ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে আসছে পানি, ভাসিয়ে আনছে ঝড়ে উপড়ানো গাছপালা ঝোঁপঝাড়।
বারো
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কিশোরের নির্দেশ ছাড়াই খাড়া পাড় বেয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করল ঘোড়াটা। মরিয়া হয়ে উঠল। পিছল মাটি, ভিজে আলগা হয়ে আছে ওপরের অংশ। নাল গাঁথতে চাইছে না তাতে, আর গাঁথলেও খসে যাচ্ছে আলগা মাটি। বাশ বেয়ে ওঠা সেই শামুকের অবস্থা হয়েছে যেন, দুই ফুট ওঠে তো দেড় ফুট নামে।
এসে গেছে পানি। শেষ চেষ্টা বল ঘোড়াটা। পেছনের দুই পা মাটিতে গেঁথে প্রায় লাফ দিয়ে পড়ল সামনে। সামনের দুই পা পাড়ের। ওপরের মাটিতে ঠেকলে আরেক ঝাঁকিতে শরীরটা তুলে আনল ওপরে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল কিশোর। আরেকটু হলে গিয়েছিল পিঠ থেকে পড়ে।
হুড়মুড় করে নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে পানি। তাতে পড়লে আর রক্ষা ছিল না। উড়ে গিয়ে পড়তে হত নিচে।
থরথর করে কাঁপছে ঘোড়া আর মানুষ, কে যে বেশি কাঁপছে বোঝা মুশকিল। ঘোড়ার গলায় গাল চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কিশোর।
নাক নামিয়ে নিজের দুই হাঁটু শুকল ঘোড়া, কেন কে জানে। ব্যথা করছে বোধহয়, কিংবা কিছু একটা হয়েছে। পাহাড়ের ঢাল আর নালার পাড়ের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
র্যাঞ্চটা কোন্দিকে কতদূরে আছে জানে না কিশোর, ঘোড়ার ওপরই এখন ভরসা। পথ চিনে যদি বাড়ি ফিরতে পারে। কিন্তু এই অন্ধকারে ঝড়ের মাঝে চিনবে তো?
চলছে তো চলছেই, পথের যেন আর শেষ নেই। কিশোরের মনে হলো, কয়েক যুগ পর যেন হঠাৎ করে থেমে গেল বর্ষণ। পিঠে ভারি ফোঁটার অনবরত আঘাত কমে আসতে মাথা তুলল সে। ভিজে সপসপ করছে কাপড়, গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস তীক্ষ্ণ সুচের মত মাংস ভেদ করে গিয়ে লাগছে যেন একেবারে হাড়ে। অবাক হয়ে দেখল, দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ, ইতিমধ্যেই পেছনে হয়ে। গেছে অনেকখানি। মখমলের মত কালো আকাশে উজ্জ্বল তারা ঝকমক, করছে। মেঘের নামগন্ধও নেই। এসব অঞ্চলের ঝড়বৃষ্টিই এমন, এই আর্সে এই যায়।
পাহাড়ের মোড় ঘুরতেই সামনে আলো দেখা গেল, গাড়ির হেডলাইট এদিকেই আসছে। কাছে এসে ব্রেক কষল। রিসোর্টের পুরানো একটা জীপ। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে আগে নামল টাইগার। ঘোড়র কাছে এসে ঘেউ ঘেউ আর নাচানাচি জুড়ে দিল। ছুঁতে চাইছে। কিশোরকে।
কিশোর! লাফিয়ে বেরোল মুসা। আল্লাহকে হাজার শোকর, পেলাম তোমাকে! আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় গিয়েছিলে? কি হয়েছিল?
একে একে নামল রবিন, জিনা, টনি।
কিশোরকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামাল টনি। ঘোড়ার পেছনে চাপড় দিয়ে বলল, বাড়ি যা। অনেক কষ্ট করেছিস!
চলতে শুরু করল ঘোড়াটা।
পিন্টোটাকে নিয়ে জুলিয়ান যে কোথায় গায়েব হলো, কিশোর বলল, কিছুই বুঝলাম না।
জুলিয়ান? জিনা অবাক। ঘরেই তো দেখে এলাম ওকে। বিকেল থেকেই আছে। ওর ঘোড়াটাও আস্তাবলে। খটখটে শুকনো। শুধু তুমি যেটাকে এনেছ সেটাকেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখলাম পিন্টোতে চড়ে যাচ্ছে, জোর প্রতিবাদ করল কিশোর। আমার সামনে সামনেই এগোল। তারপর নালার মাথা থেকে উধাও। নিচে তরাইয়েই পড়ে গেল কিনা কে জানে।
সত্যি দেখেছ? টনি জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই।
জুলিয়ানকে?
থমকে গেল কিশোর। ঢোক গিলল। চেহারা তো দেখিনি… অনিশ্চিত কণ্ঠস্বর। তাই তো, এ যে আরেকটা ফাঁদ, ভাবিনি তো! কিন্তু কি করে জানল সে আমি ওকে অনুসরণ করব?
হয়তো একটা চান্স নিয়েছে, রবিন বলল।
তোমাকে দেখিয়ে আস্তাবল থেকে বেরিয়েছে। পিন্টো দেখে যদি পিছু নাও, এই আশায়। এবং তার ফাঁদে পা দিয়েছ তুমি।
হ্যাঁ, তা ঠিক, খানিক আগের তুফানের মতই চালু হয়ে গেছে কিশোরের ব্রেন। আমি অনুসরণ করলে, সে আমাকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে অন্ধকারে পড়ে মরব। কেউ কিছু সন্দেহ করত না। সবাই ভারত, একটা দুর্ঘটনা।
বাঁচিয়েছে তোমাকে ফ্রান্সিস, ঘোড়াটার কথা বলল টনি। সবচেয়ে ভালটাকেই বেছেছিলে। কয়েকবার ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
ভেজা উঁচুনিচু পথ ধরে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে পুরানো জীপ। কিশোর একেবারে চুপ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। অন্যরাও চুপ করে রইল।
দূরে দেখা গেল র্যাঞ্চ হাউসের উজ্জ্বল আলো।
লস্ট ভ্যালির সামনে এসে গাড়ি রাখল উনি।
সবাই নামল।
গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে, মাখন মেশানো এক কাপ গরম চকলেট ড্রিংক খেয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর।
পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙল তার। বাইরে চমৎকার সকাল, ঝকঝকে রোদ। দেখে মনেই হয় না আগের রাতে ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেছে।
রহস্যের সমাধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে কিশোর। আর কত? কয়েকবার তার জীবনের ওপর হামলা হয়ে গেল। প্রায় প্রতিটি বারেই ভাগ্যগুণে বেঁচেছে। কোন সূত্র, কোন কূলকিনারা পাচ্ছে না সে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ধারেকাছেই রয়েছে শত্রু, তার ওপর চোখ রাখছে, আঘাতের পর আঘাত হানছে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। কাকে সন্দেহ করবে?
সেই নালাটার কাছে আবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে, যদিও এ-ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার। তবু
জিনা, কিশোর বলল, পিন্টো ঘোড়াটার খোঁজ নাও। দেখো, আর কোন্ র্যাঞ্চে আছে সাদা-কালো রঙের ওই ঘোড়া। আমি আবার নালাটার কাছে যাব।…তোমরা যাবে? দুই সহকারীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয় যাব, দু-জনের একই জবাব।
তবে, মুসা যোগ করল, র্যাটলস্নেক আর ঝড় থেকে দূরে থাকতে চাই।
আকাশ পরিষ্কার, বলল কিশোর। ঝড় আসবে না। আর, বেশি ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে না-ই বা গেলাম, তাহলেই সাপের কামড় খেতে হবে না।
না গেলেই কি, কেউ ছুঁড়ে তো দিতে পারে। যাকগে, চলো, যাই আগে, যা হয় হবে।
হ্যাঁ। চলো।
দিনের বেলা উজ্জ্বল সূর্যালোকে অন্যরকম লাগল প্রকৃতি, পরিবেশ গত রাতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাজা বাতাস। মরুভূমির বুনো প্রাণীরা সবাই কাজে ব্যস্ত, ঝড়ে সবারই কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে, মেরামত করে নিচ্ছে সে-সব।
নালায় পানি প্রবাহের চিহ্ন স্পষ্ট, কোথাও কোথাও এখনও নরম কাদা। পলি জমেছে, কিছু জায়গায়। খড়কুটো, আগাছা, জঞ্জাল জমে রয়েছে এখানে-সেখানে। পানিতে ভেসে এসেছে, কিন্তু শেষ দিকে স্রোত কম থাকায় আর সরতে পারেনি, আটকে গেছে।
মোড় ঘুরে নালার মাথার কাছে চলে এর ওরা। বাঁয়ে তাকাল কিশোর, ছোট ছোট হয়ে এল চোখ। হু, রহস্যময় ঘোড়সওয়ারের রহস্যজনক অন্তর্ধানের জবাবটা বোধহয় মিলল, আঙুল তুলে দেখাল। সে। নালার পাড় থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের গায়ে খুব সরু একটা গিরিপথ মত চলে গেছে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে…আর এত উত্তেজিত ছিলাম, কাল রাতে চোখে পড়েনি। তাই তো বলি, ব্যাটা গেল কই?,
যাবে নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
এতদূর যখন এলাম, যাওয়াই তো উচিত।
ঘোড়াটা শান্ত, কথা শোনে। সরু গিরিপথে ওটাকে ঢোকার নির্দেশ দিল কিশোর। পেছনে সারি দিয়ে চলল অন্য দুটো ঘোড়া।
ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে গিরিপথ। ঘোড়ার নালে লেগে ঝরে পড়ছে আলগা ছোট পাথর, মাটি। গড়িয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে নালায়।
যে কাল রাতে এখান দিয়ে গেছে, এই এলাকা তার নখদর্পণে, আশপাশের পাহাড় দেখছে কিশোর। ইচ্ছে করেই টেনে এনেছে আমাকে নালার মুখের কাছে। তারপর মারাত্মক বিপদে ঠেলে দিয়ে নির্বিঘ্নে সরে পড়েছে।
যাচ্ছি কোথায় আমরা? জিজ্ঞেস করল মুসা।
সামনে গিরিপথ শেষ। উল্টোদিকে পাহাড়ের আরেক ঢাল। গিরিপথের মুখ থেকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পায়েচলা আরেকটা পাহাড়ী পথ। পথের ধারে এক জায়গায় কয়েকটা চারাগাছের ছোট্ট ঝাড়। ঘন পাতা গায়ে গায়ে লেগে ছাতার মত হয়ে আছে।
সেগুলো দেখল কিশোর। আনমনে বলল, আমি যদি ঝড়ের সময় এ পথে যেতাম, বৃষ্টি নামলে অবশ্যই আশ্রয় নিতাম ওটার তলায়।
লোকটা আশ্রয় নিয়েছিল বলতে চাও? রবিন বলল।
মাথা নেড়ে বলল কিশোর, হ্যাঁ।
গাছের গোড়ায় এসে থামল ওরা। কড়া রোদেও পাতার নিচে বেশ ছায়া। গোড়ার মাটি ভেজা, কোথাও কাদা। রোদ পৌঁছতে পারেনি ওখানে। তাই শুকায়নি।
ঘোড়া থেকে নেমে রাশটা মুসার হাতে ধরিয়ে দিল কিশোর। একজোড়া পায়ের ছাপের দিকে চোখ।
ঠিকই আন্দাজ করেছ, মাটির দিকে চেয়ে আছে মুসাও।
ওদিকে দেখো, সামনে দেখাল কিশোর, পাথুরে। গেছে ওদিকেই, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাপ পাওয়া যাবে না। শক্ত মাটি, পড়বেই না ছাপ।
গাছগুলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখল সে। একটা ডালের দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল। মেসকিট ঝাড়ের কাঁটায় আটকে রয়েছে লাল এক টুকরো কাপড়।
এগিয়ে গিয়ে কাপড়টা খুলে নিল কিশোর, হাসল। যাক, এদ্দিন পরে সলিড কিছু পাওয়া গেল, কণ্ঠে খুশির আমেজ। লাল শার্ট পরেছিল লোকটা। ছিঁড়ে রয়ে গেছে, ঝড়ের মধ্যে বোধহয় খেয়ালই করেনি।
দারুণ! নিজের উরুতে চাপড় দিল মুসা। এটা প্রমাণ করবে অনেক কিছু।
এত খুশি হয়ো না, হাত নাড়ল কিশোর। যত সহজ ভাবছ তত না। ঝামেলা আছে। কার শার্ট ওটা খুঁজে বের করতে হবে আগে। ছেঁড়া শার্ট তো আর দেখিয়ে বেড়াবে না।
চুপসে গেল আবার মুসা। তাই তো, এটা ভাবিনি।
ওখানে আর কিছু পাওয়া গেল না।
চলো, বলল কিশোর, আর থেকে লাভ নেই।
রিসোর্টে ফিরে এল ওরা। কোরালে ছেড়ে দিল ঘোড়াগুলো।
জুলিয়ানের রহস্যটার সমাধান হলে বাঁচি, পেছনের বাগানের, দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল রবিন। আসল রহস্য তো বাকিই রয়েছে।
হ্যাঁ, ক্যাচিনা ভূত, মুসা বলল।
জুলিয়ানের রহস্যের সঙ্গে ভূত রহস্যের কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তাই বা কি করে বলি? দেখা যাক কি হয়? বলল কিশোর।
বাইরে কাউকে দেখা গেল না, কিছুটা অবাকই হলো ওরা।
রান্নাঘরে ঢুকল। কাজ করছে ভিকি আর জিনা। জিনা একবার মুখ তুলে চেয়েই আবার নামিয়ে নিল, ভিকি তাকালই না। দু-জনেরই মুখ থমথমে।
থমথম্ভেব ব্যাপার ত ডেকে লটা যে জ
অ্যাই যে, জিনা, ডেকে বলল মুসা, সাংঘাতিক একখান সূত্র পেয়েছে কিশোর। গতরাতের লোকটা যে জুলিয়ান নয়, প্রমাণ করা যাবে।
এদিকে তাকাল ভিকি। হাসি ফুটল না মুখে। গালে পানির দাগ, অনেক কেঁদেছে বোঝা যায়।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল কিশোর।
পেয়েছ, ভাল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, আবার ফুঁপিয়ে। উঠল ভিকি। ছুটে চলে গেল রান্নাঘর থেকে।
তেরো
কি হয়েছে? জিনাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
শেরিফ এসেছিল, জিনারও চোখ ছলছল করে উঠল। ঘণ্টাখানেক আগে, জুলিয়ানকে খুঁজতে। বলল, গতকাল নাকি কিছু অলঙ্কার চুরি গেছে। আর পিন্টো ঘোড়ায় চড়ে একটা ছেলেকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে ওই এলাকায়।
তাতেই কি প্রমাণ হয়ে গেল জুলিয়ান চুরি করেছে? শোনো, কাল রাতে আমিও একজনকে পিন্টো ঘোড়ায় চড়তে দেখেছি। আর সেটা যে জুলিয়ান নয়, তা-ও প্রমাণ করতে পারব।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল জিনা। কেউ বিশ্বাস করবে না তোমার কথা।
করবে না মানে? এমন একটা ভঙ্গি করল মুসা, যেন যে বিশ্বাস করবে না তাকে এখনি ধরে ধোলাই দেবে। প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।
সেটা অন্য কেস। জুলিয়ানকে বাঁচাতে পারবে না।
কেন? ভুরু নাচাল রবিন।
চোরাই একটা বেল্টের বাকলস পাওয়া গেছে আমাদের আস্তাবলে। জুলিয়ানের স্যাডল ব্যাগে।
শুধু বাকলস? আর কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, আর কিছু না। শেরিফ বলল, জুলিয়ানকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওকে বলতে বাধ্য করবে, চোরাই মাল কোথায় লুকিয়েছে।
বোকা নাকি সব এ দেশে? বিরক্তিতে নাক কুঁচকাল কিশোর। চিলে কান নিল বলল একজন, আর সবাই ছুটল চিলের পেছনে। শেরিফেরও তো মাথামোটা মনে হচ্ছে। কি কি অলঙ্কার চুরি গেছে?
অনেক। বেশি দামীগুলোর মধ্যে আছে দুটো হার, পাথর বসানো, একই রকম দেখতে। গোটা তিনটে ব্রেসলেট আর দুটো আঙটি।
চুরি হয়েছে কোত্থেকে?
এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, একটা ক্যারাভান থেকে। টুরিস্ট। ক্যারাভান নিয়ে বেড়াতে এসেছে।
কিন্তু বারো বছরের একটা ছেলে এত দামী জিনিস দিয়ে কি করবে? ওই জিনিস বিক্রি করতেও তো পারবে না। কেন করতে যাবে অহেতুক?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলে চুপ হয়ে গেল জিনা, বলল না।
শেরিফের কাছে বোধহয় আমাদের একবার যাওয়া দরকার, আবার বলল কিশোর। হয়তো বোঝাতে পারব গতরাতে কি ঘটছে…
টনি না ফিরলে যেতে পারছি না,. স্টেশন ওয়াগনটা নিয়ে গেছে, জিনা বলল। শেরিফ আসার আগেই গেছে শহরে।
জীপটা?
ওটা নিয়ে বাজারে গিয়েছিল ডিউক আঙ্কেল আর ভিকিখালা। শেরিফ এসে জুলিয়ানকে ধরে নিয়ে গেল। ফিরে এসে সব শুনে খালাকে নামিয়ে দিয়েই জীপ নিয়ে ছুটেছে আঙ্কেল। শেরিফের পিছু পিছু।
অফিসে ফোন করি তাহলে?
পাওয়া যাবে না, মাথা নাড়ল জিনা। অফিসে যাবে না। ক্যারাভানে যাবে শেরিফ। জুলিয়ানকে চিনতে পারে কিনা ওরা, দেখবে। বাকলসটাও দেখাবে।
ওরা চিনবে না জুলিয়ানকে, দরজার কাছ থেকে বলল ভিকি খালা। আগে কখনও দেখলে তো। সাফ বলে দেবে, জুলিয়ান চোর নয়।
নিশ্চয়ই বলবে, সান্ত্বনা দিল কিশোর, যদিও দ্বিধা আছে তার মনে। জুলিয়ান চোর হতেই পারে না।
আবার কাঁদতে শুরু করল ভিকি। ডিউকের সঙ্গে আমারও যাওয়া উচিত ছিল। কি ভুলটাই না করলাম। জোরে কেঁদে উঠল সে। বাচ্চা ছেলে, কি যে ভয় পাবে…ধমক দিলে, উল্টো-পাল্টা কি বলে বসেহায়। হায়, ছেলেটাকে বুঝি আর বাঁচাতে পারলাম না।
অযথা অস্থির হচ্ছেন, বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। দেখবেন, কিছুই হবে না ওর।
একটা চেয়ারে নেতিয়ে পড়ল ভিকি।
রবিন গিয়ে চায়ের পানি বসাল। ভিকির কাছ থেকে শেখা সুগন্ধী দেয়া চা বানিয়ে আনল। আগে ভিকিকে দিল এক কাপ।
হায় হায়, আমি কি করব রে! কপাল চাপড়াল ভিকি। ওর মায়ের কাছে আমি কি জবাব দেব?
কিছুই জবাব দিতে হবে না, জোর দিয়ে বলল কিশোর। ওকে ছাড়িয়ে নেবই আমরা। শেরিফ তো আসবে আবার। না এলে আমরাই যাব ওর কাছে। আশা করি, বোঝাতে পারব।
কান্না থামাল ভিকি। চা খেয়ে শান্ত হলো অনেকখানি। তারপর উঠে গিয়ে লাঞ্চের জোগাড় শুরু করল।
পিন্টো ঘোড়াটার খোঁজ নিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল কিশোর।
নিয়েছিলাম, জানাল জিনা। ধারেকাছে যে কটা র্যাঞ্চ আছে, সবারই আছে পিন্টো। কাল রাতে কেউ নাকি বেরোয়নি।
বেরোলেও কি আর স্বীকার করবে? হতাশার হাসি হাসল মুসা।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঘোড়া বেশি থাকায় কাজ জটিল হয়ে গেল আরও, আন্দাজে কাকে সন্দেহ করব?
কিছু ঢুকছে না আমার মাথায়! মাথা ঝাড়া দিল জিনা। কে বেচারাকে ফাসাতে চায়? কেন?
আজ হোক কাল হোক, জেনে যাবই সেটা, বলল কিশোর।
টেবিলে খাবার দিল ভিকি। টনি, ডিউক আর জুলিয়ানের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ওরা। কেউ এল না। শেষে খেতে বসে গেল। রান্না ভাল, খাবারও ভাল, কিন্তু রুচি মরে গেছে সবারই। এমনকি মুসাও বিশেষ কিছু মুখে তুলতে পারল না। ভিকি আরেক কাপ চা খেল, ব্যস।
খাওয়ার পর থালাবাসনগুলো ছেলেমেয়েরাই ধুয়ে রাখল।
আবার অপেক্ষার পালা। গড়িয়ে চলেছে মিনিটগুলো, সময় যেন। কাটতেই চায় না।
দুপুরের পর জীপের শব্দ শোনা গেল। ডিউক এসেছেন। বসার ঘরে ছুটে গেল সবাই।
জুলিয়ান কই? নিয়ে এলে না কেন? স্বামীকে ঢুকতে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল ভিকি।
বিষণ্ণ, থমথমে হয়ে আছে শিক্ষকের মুখ। শুধু কালো চোখদুটোয় বেদনা। শেরিফ নিয়ে আসবে। আমাকে চলে আসতে বলল, তোমাকে বোঝাতে।
সামান্য স্বস্তি যা ফিরে এসেছিল, দূর হয়ে গেল আবার ভিকির মুখ থেকে। ককিয়ে উঠল, বিশ্বাস করো, ডিউক, ও চুরি করেনি! করেনি!
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কি এসে যায়, বলো? ওরা ওকে চিনতে পেরেছে। ক্যারাভানের কাছে নাকি ঘুরঘুর করছিল, তার কিছুক্ষণ পরেই চুরি যায় গহনাগুলো।
ঘুরঘুর করেনি, প্রতিবাদ করল ভিকি। আমাকে তো বলেছে রানুষ কিছু মুখে থালাবাসনগুগেড়িয়ে চলেছে কালই, ওপথে পাহাড়ে গিয়েছিল। আর ঘুরঘুর করলেই কি প্রমাণ হয়ে গেল সে-ই চুরি করেছে? কেউ নিতে দেখেছে?
ওর স্যাডল ব্যাগে বাকলস পাওয়া গেছে।
ছিটকে সরে এল ভিকি। কড়া চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।
তুমিও বিশ্বাস করো এসব? জুলিয়ান গহনা চুরি করেছে?
দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্ত্রীর চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন শিক্ষক। করতে তো চাই না, ভিকি। কি বলব, বলো?
কেউ আর কিছু বলার আগেই বাইরে গাড়ির শব্দ হলো। জুলিয়ানকে নিয়ে ঘরে ঢুকল শেরিফ।
ছুটে এল ছেলেটা। ফুপুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তাকে থামানো দূরে থাক, তার সঙ্গে যোগ দিল আরও ভিকি।
কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল শেরিফ। জিনিসগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে বলল না, এত চেষ্টা করলাম। ওরা বলেছে, গহনাগুলো ফেরত পেলেই খুশি। চার্জ তুলে নেবে। কালই চলে যাচ্ছে ওরা। এর মাঝে বের করে দিলে বেঁচে যাবে জুলিয়ান।
কসম খোদার, ফুপু, কাঁদতে কাঁদতে বলল জুলিয়ান, আমি চুরি করিনি। কোথায় আছে জানি না।
কি করিসনি যে সে তো জানিই আমি, আরও জোরে ভাইপোকে জড়িয়ে ধরল ভিকি। চিবুক ধরে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে? খেয়েছিস কিছু?
মাথা নাড়ল জুলিয়ান।
ভাল মানুষকে চোর বলে ধরে নিয়ে যায়, আর খাওয়া দেবে ওরা, শেরিফের দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে জুলিয়ানকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল ভিকি।
এগিয়ে গেল কিশোর। নিজের পরিচয় দিল।
গোয়েন্দা, হাহ! বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়ল শেরিফের মুখে।
গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে। দিল। এই যে এটা দেখুন। তাহলেই বুঝবেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের লেখা সার্টিফিকেট দেখে নরম হয়ে গেল শেরিফ।
ডোন্ট মাইণ্ড। চোর-ছ্যাচড়দের নিয়ে থাকতে থাকতে বদমেজাজী হয়ে গেছি।
শেরিফকে সব খুলে বলল কিশোর। মাঝে মাঝে কথা ধরিয়ে দিল মুসা আর রবিন। রহস্যময় চিঠিটা দেখাল কিশোর।
হুম, গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল শেরিফ। তো, তুমি বলছ। ছেলেটাকে কেউ ফাঁদে ফেলেছে?
তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাল রাতে পিন্টো ঘোড়া নিয়ে এসেছিল যে লোকটা, সে-ই স্যাডল ব্যাগে বাকলস রেখে গেছে, আমি শিওর। এসেছিলই এজন্যে।
কিন্তু জুলিয়ানকে বিপদে ফেলে কার কি লাভ?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তাহলে তো রহস্যেরই সমাধান হয়ে যেত এতক্ষণে।
তা ঠিক। তোমার কথায় যুক্তি আছে, কিশোর পাশা, কিন্তু ছেলেটাকে তো ছাড়তে পারি না। সন্দেহের অভিযোগে আটক করতে হয়েছে। ওরা গহনা ফেরত না পেলে, চার্জ না তুললে কিছুই করতে পারছি না।
শেরিফকে অনুরোধ করে লাভ নেই, বুঝতে পারল কিশোর। ভাবনায় পড়ে গেল। হাতে সময় আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এর মাঝে রহস্যের সমাধান না করতে পারলে খুব অসুবিধে হবে জুলিয়ানের।
আপনার মিসেসকে একটু ডাকুন তো, প্লীজ, ডিউকের দিকে চেয়ে বলল শেরিফ। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করি।
উঠতে যাচ্ছিলেন শিক্ষক, হাত তুলে বাধা দিল মুসা। আপনি বসুন। আমিই যাই।
ভিকিকে ডেকে আনল মুসা।
তুমি গিয়ে রান্নাঘরে বসো, মুসাকে অনুরোধ করল শেরিফ। কেন, বুঝতে পারল মুসা। জুলিয়ানকে পাহারা দিতে বলছে।
আবার এসে রান্নাঘরে ঢুকল সে। আরে, জুলিয়ান কই? অর্ধেকটা স্যাণ্ডউইচ পড়ে আছে প্লেটে, দুধের গেলাসটায় তিন ভাগের এক ভাগ দুধ। শেষ করেনি।
ছুটে জানালার কাছে চলে এল মুসা। বাগানের শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে জুলিয়ান, আস্তাবলের দিকে ছুটছে।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মুসাও দৌড় দিল।
সে আস্তাবলের কাছে যাওয়ার আগেই ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে গেল জুলিয়ান।
ছুটে আস্তাবলে ঢুকল মুসা। সামনে যে ঘোড়াটা পেল সেটাতেই জিন পরিয়ে এক লাফে চড়ে বসল।
অনেক এগিয়ে গেছে পিন্টো। ওটাকে ধরা সহজ হবে না। যতটা জোরে সম্ভব ঘোড়া ছোটাল মুসা।
চলতে চলতে একটা প্রশ্ন জাগল মনে। কোথায় যাচ্ছে জুলিয়ান? দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল মুসা। জুলিয়ানকে ধরার চেষ্টা করবে না, পিছে পিছে গিয়ে দেখবে ছেলেটা কোথায় যায়।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অনুসরণ করে চলল মুসা। ইতিমধ্যে দু একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েছে জুলিয়ান। একই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মা ছোট ছোট পাহাড়ের সারি পেরিয়ে এল ওরা। রিসোর্টের সীমানার খুঁটি দেখা যাচ্ছে। আর কিছুদূর গেলেই শুরু হবে সুপারস্টিশন মাউন্টেইন।
পর্বতের ছায়ায় পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামল জুলিয়ান। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা গোল একটা উপত্যকায় টেনে নামাল ঘোড়াটাকে। প্রচুর সবুজ ঘাস আছে ওখানে। তারপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে।
জুলিয়ানের দেখাদেখি মুসাও তার ঘোড়া বাঁধল গোল উপত্যকায়। পিছু নিল।
চূড়ায় উঠে ফিরে তাকাল জুলিয়ান। ঠোঁটে আঙুল রেখে কোনরকম শব্দ না করতে ইশারা করল মুসাকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
মানুষের কণ্ঠ কানে এল মুসার। ওপাশে নিচে কারা যেন কথা বলছে। শাবল-কোদালের আওয়াজ। মাটি খুঁড়ছে মনে হয়।
চোদ্দ
এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল মুসা, তারপর বাকি কয়েক ফুট প্রায় ছুটে পেরোল। চূড়ায় এসে হুমড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল জুলিয়ানের পাশে।
নিচে একটা গিরিখাদ। বড় বড় পাথরের চাঙড় পড়ে রয়েছে। ঝোঁপঝাড় আর গাছপালা এত ঘন, ভাল করে না তাকালে খাদটা চোখে পড়ে না।
দু-জন লোক কথা বলছে আর কাজ করছে। একজন লম্বা, লালচে চুল। অন্যজন তার চেয়ে বেঁটে, কালো চুল। গিরিখাদের এক দিকের দেয়াল খুঁজছে ওরা। আরেক দিকে খানিকটা উঁচুতে খোলামত জায়গায় একটা কাঠের কেবিন।
ওদের একটা ঘোড়া দেখে চমকে গেল মুসা। সাদা-কালো পিন্টো, অবিকল জুলিয়ানের ঘোড়াটার মত দেখতে।
নীরবে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। আবার চোখ ফেরাল খাদের দিকে। কয়েক মিনিট দেখে জুলিয়ানকে ইশারা করল মুসা, সরে আসার জন্যে। এপাশে কয়েক ফুট নেমে এল, কথা বললে যেন লোকগুলো শুনতে না পায়।
কে ওরা? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা।
বোধহয় প্রসপেক্টরস।
রিসোর্ট এলাকার মধ্যে? জুলিয়ানও অবাক হলো।
চারপাশে তাকিয়ে দেখল মুসা। ল্যাণ্ডমার্ক দেখা যায়। প্রথম যেদিন টনি আর জিনার সঙ্গে বেরিয়েছিল, সেদিন ওই চিহ্ন চিনিয়েছে ওরা।
হ্যাঁ, রিসোর্ট এলাকা। ওই যে চূড়াটা, ওখান পর্যন্ত সীমানা।
সোনা খুঁজছে বোধহয় ব্যাটারা, ক্লান্ত হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল জুলিয়ানের ঠোঁটে। পেলে তো একটা কাজের কাজই করে ফেলবে।
আগে কখনও ওদেরকে দেখেছ এখানে?
নার্ভাস ভঙ্গিতে নড়ল জুলিয়ান, চোখ সরিয়ে নিল। ঘুরিয়ে জবাব দিল, দেখতে এসেছি কয়েকবার।
ওরা দেখেছে তোমাকে? কিছু গোপন করছে জুলিয়ান, বুঝতে পারল মুসা।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল জুলিয়ান। একবার। এখানে না। ওদিকে আরেকটা উপত্যকা আছে, চারপাশে পাহাড়, ওখানে। ঘোড়া নিয়েই নামলাম, দেখতে গেলাম কি করছে। রেগে গেল ওরা, লম্বুটা তো গুলিই করে বসল। সরে গেছি আগেই, তাই লাগেনি। তারপর বেশ কিছুদিন আর যাইনি ওদিকে।
গুলি করেছে? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়ান। আমি কিছু করিনি। খালি দেখতে গিয়েছিলাম, কসম।
আমি বিশ্বাস করছি তোমার কথা। ওদিকেও কি সোনাই খুঁজছিল?
আবার মাথা ঝাঁকাল জুলিয়ান। প্রসপেক্টররা পাহাড়ে যা করে, তা-ই করছিল। বহুবার লুকিয়ে দেখেছি।
চুপ করে কিছু ভাবল মুসা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল, আজ কোথায় যাচ্ছিলে? কাউকে কিছু না বলে চুরি করে যে পালিয়ে এলে?
পাতলা চোয়ালদুটো দৃঢ়বদ্ধ হলো। আবার সরিয়ে নিল চোখ। ঘুরতে যাচ্ছিলাম।
চুপ করে রইল মুসা। অপেক্ষা করছে।
পালিয়ে যাচ্ছিলাম, অবশেষে স্বীকার করল জুলিয়ান। আর। ফিরে যাব না রিসোর্টে।
সেটা কি ঠিক হবে? তোমার ফুপা-ফুপুর কথা ভাবলে না। ওরা তোমাকে কত ভালবাসে।
ফুপা আমাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ভাবছে, আমি চোর। শেরিফ বলেছে, আমি খুব খারাপ ছেলে। কসম খেয়ে বলেছি, আমি চুরি করিনি। কোত্থেকে ফিরিয়ে দেব? বড় বড় চোখ দুটোতে অশ্রু টলমল করে উঠল। হয়তো পিন্টোকেও কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে। এসব তো অন্যায়। ওকে কেন কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে, বলো? ও তো আমার, চুরি করে আনিনি।
ছেলেটার দুঃখ বুঝতে পারছে মুসা। কিন্তু পালিয়ে যে যেতে চাইছ, এতে তো সন্দেহ আরও বাড়বে ওদের। কদ্দিন ওদের চোখ এড়িয়ে বাঁচতে পারবে?
চুপ করে রইল জুলিয়ান। জবাব দিতে পারল না।
এই প্রসঙ্গ বাদ দিল মুসা। জানাল, আগের রাতে কি ঘটেছে, কি করে আরেকটা পিন্টো ঘোড়াকে অনুসরণ করে নালায় গিয়ে মরতে বসেছিল কিশোর।
গিরিখাদের পিন্টোটার কথা উল্লেখ করে জুলিয়ান বলল, বোধহয় ওটাই।
হাসল মুসা। আমারও তাই ধারণা। আচ্ছা, এখান থেকে কোথাও যায় না ওরা? সরে না?
সরে। কেন?
ওই কেবিনটায় ঢুকে দেখতে চাই। সব গোলমালের মূলে ওরা হলে, ওখানে কিছু সূত্র পাবই। আমি না বুঝলেও, কিশোরকে বললে বুঝবে, কেন তোমাকে ফাসাতে চাইছে ওরা।
এক কাজ করলেই পারি, দুষ্টু হাসি ফুটল জুলিয়ানের ভেজা চোখের তারায়। আমাকে তাড়া করুক ওরা। এই সুযোগে তুমি নেমে ঢুকে পড়ো কেবিনে।
মাথা নাড়ল মুসা। ভীষণ রিস্কি হয়ে যাবে.. কথা শেষ করতে পারল না সে, তার আগেই ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে জুলিয়ান।
বাধা দেয়ার সুযোগই পেল না মুসা। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে ছুটল জুলিয়ান। এদিকে ফিরে হেসে হাত নাড়ল।
এ দ্বিধা করছে মুসা। কেবিনে ঢুকতে তাকে বাধ্য করল জুলিয়ান। মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে সে, এখন আর পিছিয়ে আসা চলবে না মুসার।
আর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, আবার উঠে এল চূড়ায়। উপুড় হয়ে শুয়ে তাকিয়ে রইল নিচের দিকে।
গিরিপথের মত একটা জায়গা দিয়ে ঢুকতে হয় গিরিখাদে। পথের মুখে দেখা দিল জুলিয়ান। কেউ দেখল না তাকে। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে চেঁচিয়ে উঠল সে। কি বলল, স্পষ্ট বোঝা গেল না দূর থেকে। তবে চোর আর সোনা এই দুটো শব্দ কানে এল।
হাত থেকে বেলচা ফেলে কোরালের দিকে দৌড় দিল লোকদুটো। দেখতে দেখতে জিন পরিয়ে চেপে বসল ঘোড়ায়। জুলিয়ানকে তাড়া করল।
ওরা গিরিপথে অদৃশ্য হতেই উঠে পড়ল মুসা। দ্রুত গাছের আড়ালে আড়ালে নেমে চলে এল গিরিখাদের পাড়ে।
খাদের দেয়ালে অসংখ্য গর্ত, বোঝা গেল, লোকগুলোই খুঁড়েছে। ভালমত দেখার সময় নেই, একবার নজর বুলিয়েই কেবিনের কাছে চলে এল সে। নি।
দরজার কব্জায় তেল পড়েনি বহুদিন, ধাক্কা দিতেই কিচকিচ করে উঠল। ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে দিল মুসা। আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। একমাত্র জানালাটার কাছে রয়েছে একটা টেবিল আর দুটো টুল। দুটো চারপায়া, খাড়া করে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালের সঙ্গে। আনাড়ি হাতে তৈরি একটা শেলফে রান্নার সরঞ্জাম আর খাবার। বেশির ভাগই টিনজাত খাদ্য।
দরজার পাশে পড়ে আছে একটা ট্রাংক। ওটার দিকেই এগোল মুসা। ডালা তুলেই স্থির হয়ে গেল।
এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা, কাপড়ের ওপর পড়ে আছে। অনেকগুলো গহনা। > কোন সন্দেহ নেই, চোরাই মাল। এগুলোই চুরি করে আনা হয়েছে ক্যারাভান থেকে। দুটো একরকম হার দেখেই বোঝা গেল সেটা। ব্রেসলেট আছে তিনটে, দুটো আঙটি এবং আরও কিছু গহনা।
সাবধানে গহনাগুলো সরিয়ে রেখে কাপড়ের তলায় খুঁজতে শুরু করল মুসা। রঙচটা জিনসের একটা প্যান্ট টান দিতেই তলায় পাওয়া গেল লাল শার্ট, পিঠের কাছে খানিকটা জায়গা ছেঁড়া, কাপড়ই নেই। ওই শার্টের ভেতরেই পেঁচানো আরও দুটো জিনিস পাওয়া গেল, একটা চিনতে পারল, আরেকটা পারল না। তবে দুটোই যে রিমোট কমাণ্ডার, এটা বুঝতে অসুবিধে হলো না।
সরুটা বোমা ফাটানোর যন্ত্র; আর চ্যাপ্টা, অপেক্ষাকৃত বড়টা কোন যন্ত্রের কমাণ্ডার, চিনল না। তবে জটিল কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্রের হবে, সন্দেহ নেই।
তাহলে এই ব্যাপার।
বসে পড়ে ভাবতে শুরু করল মুসা। কি করবে এখন? জিনিসগুলো নিয়ে যাবে পোঁটলা বেঁধে? নাকি শুধু শার্ট আর গহনাগুলো নেবে? সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। ইস্, এখন কিশোর এখানে থাকলে ভাল হত। সঠিক কাজটা করতে পারত সে।
মুসার মনে হলো, জিনিসগুলো যেখানে রয়েছে সেখানে থাকলেই ভাল। নিজের চোখে এসে দেখে যাক শেরিফ। কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। জুলিয়ানকে ধরতে না পারলে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে দুই চোর। জিনিসগুলো এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। লোকজন নিয়ে ফিরে এসে তখন হয়তো আর কিছুই দেখাতে পারবে না মুসা। লজ্জায় পড়বে।
হঠাৎ, বাইরে শব্দ শোনা গেল। ঘোড়ার নালের শব্দ। দ্রুত এগিয়ে আসছে।
সেরেছে! লাফিয়ে উঠে জানালার কাছে ছুটে গেল মুসা। ধূলিধূসরিত জানালার নোংরা কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বাইরে তাকাল। সর্বনাশ! লোক দু-জন ফিরে আসছে। জুলিয়ান নেই সঙ্গে।
বিপদে পড়া গেল, রিকি, লম্বা লোকটা বলল। গেল কই বিছুটা?
আস্ত কয়েটির বাচ্চা, গাল দিল বেঁটে। কি করি এখন বল তো?
কোরালের দিকে চলেছে দু-জনে। ওর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, বলল বটে, কিন্তু জোর নেই গলায়। সকালে নাকি শেরিফ ওকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, চুরির দায়ে। একেই বলে কপাল, চুরি করলাম আমরা, আর ফসল কিনা… হা হা করে হাসল লোকটা।
কুৎসিত হাসিতে যোগ দিল না রিকি। আরও গম্ভীর হয়ে বলল, অত হেসো না, পেক। ওই তিনটে বিচ্ছুর কথা ভুলে যেয়ো না, রকি বীচ থেকে যেগুলোকে দাওয়াত করে আনা হয়েছে। হেলাফেলা কোরো না ওদের। বসের কাছে শুনলাম, ওরা ডেঞ্জারাস। একবার যার পেছনে লেগেছে, তার সর্বনাশ করে ছেড়েছে।
কি করতে বলো তাহলে? প্রশ্ন করল পেক। বিচ্ছুটা যে আবার এসেছিল, এখানে আমাদের খুঁড়তে দেখেছে, বসকে বলব? যাব র্যাঞ্চে?
মাথা নাড়ল রিকি। না, আজ রাতে তো আসবেই বস এখানে, বলল না? খোঁড়া কদ্দূর হয়েছে দেখতে। সঠিক জায়গাটা খুঁজে পাইনি। আমরা এখনও।
তবে কাছাকাছি পৌঁছেছি। নুড়িদুটো পেলাম, সেটাই প্রমাণ।
সেটা আমারও মনে হচ্ছে। কবে থেকেই তো বলছি এই গর্তে এসে খুঁজতে, তুমি আর বসই তো রাজি হচ্ছিলে না। পানিতে ধুয়ে মাটি সরে গেলে শিরা থেকে গড়িয়ে পড়বে সোনার নুড়ি, এটা তো সহজ কথা। আর গড়িয়ে একটা দিকেই পড়ে জিনিস, নিচের দিকে।
সে তো আমিও জানি। আমার প্রশ্ন হলো, খনিটা আছে কোথায়? ওটা খুঁজে না পেলে এত কষ্ট সব..দাঁড়াও, আরও খুঁড়ব। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখি কি পাওয়া যায়।
খিদে পেয়েছে আমার, বলল রিকি। চলো, আগে খেয়ে নিই।
কোরালে ঘোড়া রেখে কেবিনের দিকে রওনা হলো দু-জনে। কথা বলছে এখনও। কিন্তু সে-সবে কান নেই আর মুসার। আটকা পড়েছে। বেরোতে গেলেই এখন ওদের চোখে পড়বে। দরজা ছাড়া বেরোনোরও আর কোন পথ নেই। আর খাবার বের করার জন্যে এখন ঘরে ঢুকলেই হবে সর্বনাশ।
কিছুটা এগিয়ে মোড় নিল রিকি আর পেক। খাদের দিকে চলল। ব্যাপার কি? নতুন কিছু চোখে পড়ল নাকি? ওদিকে যাচ্ছে কেন?
খানিক পরেই বোঝা গেল, কেন গেছে। ওখানেই খাবার রেখেছে, খাদের নিচে পাথরের ওপর। যাক, একটা ভয় আপাতত গেল। খাবারের জন্যে আর ঘরে ঢুকতে আসবে না ওরা।
তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে আবার বেলচা তুলে নিল দু-জনে। খুঁড়তে শুরু করল।
জানালার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল সে। ঢোকার সময় তো ঢুকেছে, এখন বেরোয় কিভাবে? দরজা কিংবা জানালা যেদিক দিয়েই বেরোক, ওদের চোখ এড়াতে পারবে না। কিন্তু এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে? আর থাকাটাও যে নিরাপদ, তা-ও নয়। একসময় না একসময় কেবিনে ঢুকবেই ওরা, দেখে ফেলবে ওকে।
পনেরো
সারা ঘরে আরেকবার চোখ বোলাল মুসা। ট্রাংকের কাপড় আবার আগের মত করে ভরে গহনাগুলো রেখে দিল তার ওপর। ডালা নামিয়ে রাখল।
তারপর এসে একটা টুলে বসে ভাবতে লাগল, কিন্তু বেরোনোর কোন উপায় দেখল না।
তাহলে এ ঘরেই কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। ছোট্ট ঘর। লুকানোর জায়গা নেই। কয়েকটা কম্বল অবহেলায় স্কুপ হয়ে পড়ে আছে। এককোণে। আশা হলো তার। ওগুলোর নিচে লুকালে হয়তো চোখে পড়বে না কারও। লুকিয়ে থাকবে, তারপর লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়লে কোন এক সুযোগে বেরিয়ে যেতে পারবে।
লুকানোর জায়গার মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে জানালার কাছে ফিরে এল মুসা। দু-জনের কাজ দেখতে লাগল বসে বসে। আর কিছু করার নেই। অলস ভঙ্গিতে পাহাড়ের গা খুঁচিয়ে চলেছে ওরা। সোনা! হ্যাঁ, এখানকার সমস্ত গোলমালের মূলে ওই সোনার খনি।
ডাক্তার জিংম্যানের নামটা বার বার ঘুরেফিরে আসছে মনে। মিস্টার উইলসনের সম্পত্তি কেন কিনতে চেয়েছিল সে, এখন বোঝা যাচ্ছে।
এক ঘণ্টা কাটল, আরও এক ঘণ্টা। খোঁড়ায় বিরাম নেই রিকি আর পেকের। মাঝে মাঝে একটা পুরানো মেসকিটের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। গাছটার পাশেই ছোট একটা ঝর্না। তৃষ্ণার্ত চোখে ওটার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। গরমে, বদ্ধ এই নোংরা ঘরে বসে থেকে থেকে ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ।
সূর্য অস্ত যাওয়ার আগের ক্ষণে লম্বা লম্বা ছায়া পড়ল উপত্যকায়। কাজ থামাল লোকগুলো। শাবল-বেলচা ফেলে দিয়ে পা বাড়াল কেবিনের দিকে।
দুরুদুরু করতে লাগল মুসার বুক। তাড়াতাড়ি উঠে এগোল লুকিয়ে পড়ার জন্যে।
কম্বলের তলায় অন্ধকারে ঢুকে গেল।
ঘরে ঢুকল দুই প্রসপেক্টর। খাবারের টিন খুলতে খুলতে আলোচনা চালাল। বেশির ভাগই জুলিয়ানের কথা। ওরা অসতর্ক থেকেছে বলে বস যে ভীষণ বকবে, সেজন্যে অস্বস্তি বোধ করছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে মুসার, এই গরমে কম্বলের মধ্যে থাকাটা এক ভয়ানক অস্বস্তির ব্যাপার। আর যখন পারে না সে, অসহ্য হয়ে উঠেছে, তখন বেরোল লোকগুলো। সঙ্গে সঙ্গে একদিক ফাঁক করে নাকমুখ বের করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
বাইরে আগুন জ্বালানোর শব্দ। রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে। একটু পরেই শিকে গাঁথা ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ এসে কেবিনেও ঢুকল। জিভে পানি এসে গেল মুসার, মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর। দুপুরে প্রায় কিছুই খায়নি, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু করবেটা কি? বাইরে অবশ্য এখন অন্ধকার, কিন্তু তবু বেরোতে পারবে না, চোখে পড়ে যাবেই। দরজার কাছেই বসেছে ওরা।
কম্বলের তলায় অসহ্য লাগছে। ঘামছে। বেরিয়ে হাত-পা ঝাড়া দেয়ার লোভটা সামলাতে পারল না। আর বেরোতে গিয়েই বাধাল বিপত্তি। তার রাইডিং বুটে বেধে গেল কম্বলের ভেঁড়া একটা জায়গা, খেয়াল করল না সে। লাগল হ্যাঁচকা টান। হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল একটা চারপায়ার ওপর। দড়াম করে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে পড়ল চারপায়াটা।
সঙ্গে সঙ্গে হই-চই শোনা গেল বাইরে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। দরজা।
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।
লণ্ঠন হাতে ঢুকল একজন। দেখে ফেলল মুসাকে।
রিকি, হাসি হাসি গলায় পেঁচিয়ে ডাকল পেক, দেখে যাও এসে। একটা ছুঁচো।
মেরে ফেলল। মাড়িয়ে দাও পা দিয়ে…
আরে, ওই ছুচো না, মানুষ ছুঁচো। জলদি এসো।
পিকচুকল। বাহার। ঘরে ঢুকতম প্রতিবেশী এবং হুম। তো,
কঙ্কার জিংম্যান। উইহকারী না এটা তো চিঠিকে
কথা শেষ হলো না তার। ঘরে ঢুকল আরেকজন। ডাক্তার জিংম্যান! উইলসনের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বন্ধু।
পিচ্চি হোমসটার সহকারী না এটা? বলল ডাক্তার। হুম। তো, মিয়া, এখানে কি মনে করে? তোমার দোস্ত তো চিঠিকেও কেয়ার করল না, বিছেকেও ভয় পেল না। সাহস থাকা ভাল। তবে বেশি সাহস…
তিন বিচ্ছুর একটা নাকি এটা, বস? জিজ্ঞেস করল রিকি।
আবার জিজ্ঞেস করে, গাধা কোথাকার! চেনো না? তীর ছোঁড়ার সময় কি চোখ বুজে ছিলে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এটাই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। অন্য দুটোকে। নইলে সেদিন পালের গোদাটা যেত। না মরলেও আধমরা তো হতই।
হতে তো কত কিছুই পারত, কম সুযোগ মিস করেছ? এটা করলে ওটা করলে, সব ফুস আর ফাস! নালায় টেনে আনলে, এত নিরালা জায়গা, একলা পেলে, তা-ও কিছু করতে পারলে না, কর্কশ শোনাল জিংম্যানের কণ্ঠ।
সেটা কি আমার দোষ? পানি আসা পর্যন্ত থাকলই না, উঠে চলে গেল।
যাতে না যেতে পারে সেরকম ব্যবস্থা করতে পারতে।
এত অভিযোগ শুনতে ভাল লাগল না রিকির, সে-ও রেগে গেল। আমাকে একা বলো কেন? সুযোগ তো তুমিও পেয়েছ। ধাক্কা দিতে গিয়েছিলে গাড়িকে, পেরেছ? ঠিক নেমে চলে গেল পথের পাশে…
দূর, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ল পেক, শুরু করল ঝগড়া! অহেতুক তর্ক না করে এটাকে কি করব, তাই বলো।
ভুরু কুঁচকে ভাবল এক মুহূর্ত জিংম্যান। আপাতত হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। পরে ভেবেচিন্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটানো যাবে। ঢুকে যখন পড়েছে, বেরোতে আর দিই কি করে? মুসার হাত চেপে ধরল সে। সহকারীদের বলল, দড়ি আনো।
লম্বা শ্বাস টানল মুসা। অপেক্ষা করছে। আড়চোখে দেখল, দরজার কাছ থেকে সরে আসছে পেক। দড়ি আনতে ঘরের কোণে গেল রিকি। এই-ই সুযোগ। চোখের পলকে বুট তুলে গায়ের জোরে লাথি মারল ডাক্তারের বা পায়ের হাটুর ওপর।
আঁউ! করে উঠল ডাক্তার। ঢিলে হয়ে গেল আঙুল।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল মুসা। মাথা নিচু করে ছুটে গেল পেকের পেট সই করে। তার নিগ্রো-খুলির বদনাম আছে। রবিন তো বলে, তার মাথায় আছড়ে পাকা নারকেল ভাঙা যায়, এত শক্ত। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। তার মাথার গুতো যে একবার খেয়েছে, সহজে ভুলবে না।
সেই অভিজ্ঞতা পেকেরও হলো। তো খেয়ে বাপরে! বলে চেঁচিয়ে উঠে ধাক্কা খেল গিয়ে হাঁটু চেপে ধরে রাখা বসের গায়ে। তাকে নিয়ে পড়ল মেঝেতে। হাত থেকে পড়ে ভাঙল লণ্ঠন, আলো নিভে গেল।
দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা। লাফিয়ে এসে নামল চৌকাঠের বাইরে।
ক্যাম্পফায়ারের আলোতে নাচছে ঝোঁপঝাড় আর গাছের ছায়া। দেখার সময় নেই, মাথা নিচু করে ছুটছে মুসা। ছোট ঝর্নাটার ধার দিয়ে এসে ঢুকল, একটা ঘন ঝোপে। থামল। হাপরের মত ওঠানামা করছে। বুক। ফিরে তাকাল। সাময়িক মুক্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু এই পাহাড়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে কিনা সন্দেহ।
বেরিয়ে এসেছে তিন বদমাশ।
গিরিপথের মুখ আটকাও! আগুনে আরও লাকড়ি ফেলো! টর্চ আনো! ওকে পালাতে দেয়া যাবে না! চিৎকার করে একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলল জিংম্যান।
খুব সাবধানে ঝোঁপের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল মুসা। বৃষ্টিকে ধন্যবাদ, ডালপাতা ভিজিয়ে রেখেছে। শুকনো নয়, ফলে খড়খড় শব্দ হচ্ছে না। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। সামনে দেখল পাথুরে পাহাড়ের ঢাল। এগোল সেদিকে। বড় পাথরের চাঙড়ের আড়াল, নিদেনপক্ষে একটা গর্ত পেলেও লুকিয়ে পড়া যায়।
ভাগ্য ভাল বলতে হবে, দুটোই পেল একসঙ্গে। চ্যাপ্টা একটা পাথর কাত হয়ে আছে, একদিকে সামান্য উঁচু, তার নিচে পেয়ালা আকৃতির ছোট একটা গর্ত। কোনমতে জায়গা হবে শরীরটার। আর কোন বিকল্প নেই। ওর মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে দিল সে। মাথা রইল এক পাড়ে ঠেকে, অন্য পাড়ে পা। পেছনটা গর্তের তলায়। মাটি গরম, মরুর ঠাণ্ডা রাতে বেশ আরাম লাগল এই উষ্ণতায়। তাপমাত্রার কি দ্রুত ওঠানামা এসব অঞ্চলে, ভাবলে অবাক লাগে। এই তো, খানিক আগে গরমে কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে হাঁসফাঁস করছিল, আর এরই মধ্যে আবহাওয়া এতটাই শীতল হয়ে গেল, গরম এখন ভাল লাগছে।
ওকে গরুখোঁজা খুঁজছে তিনজন লোক। তাদের চেঁচামেচি আর নানারকম আওয়াজ স্পষ্ট কানে আসছে। তারপর হঠাৎ সব নীরব হয়ে গেল। বড় বেশি নীরব। কিছু একটা ঘটেছে।
আস্তে মাথা তুলল মুসা। কানে এল ঘোড়ার নালের খটাখট আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল কেউ।
কিশোর! লাফ দিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ল মুসা। ছুটল আবার ঝোঁপের ভেতর দিয়ে।
সবাই এসেছে। কিশোর, রবিন, জিনা, টনি, মিস্টার ডিউক, শেরিফ, সব্বাই। টাইগারও রয়েছে ওদের সঙ্গে। কুকুরটা আগে এগিয়ে এল। লেজ নাড়তে নাড়তে চেটে দিল মুসার হাত। তাতে মন ভরল না, লাফিয়ে উঠে তার বুকে দুই পা তুলে দিয়ে গাল-নাক চাটতে শুরু করল।
আরে, থাম, থাম, আলতো ধাক্কা দিয়ে টাইগারের মুখ সরিয়ে দিল মুসা।
টনি, মিস্টার ডিউক আর শেরিফ গিয়ে ঘিরে ধরল তিন অপরাধীকে। টনির হাতে রাইফেল, শেরিফের হাতে পিস্তল।
বাঁধুন ওদের, চেঁচিয়ে বলল মুসা। পালাতে দেবেন না। যত নষ্টের মূল এই তিন ব্যাটা।
জানি, বলল কিশোর। ঘণ্টাখানেক আগে রিসোর্টে পৌচেছে। জুলিয়ান। তোমার বিপদের কথা জানাল। শেরিফকে ফোন করলাম। তারপর ছুটে এলাম এখানে।
জুলিয়ান কই?
পাহাড়ের ওপাশে, হাত তুলে দেখাল রবিন। ঘোড়াগুলো পাহারা দিচ্ছে।
শেরিফ জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছিল, মুসা?
এটা রিসোর্টের এলাকা না? পাল্টা প্রশ্ন করল মুসা।
হ্যাঁ।
তাহলে অনেকগুলো অপরাধের অভিযোগে এদের গ্রেপ্তার করতে পারেন আপনি। অনধিকার চর্চা থেকে খুনের চেষ্টা, সবই করেছে ওরা এখানে। চুরি-চামারিও করেছে।
সমস্ত প্রমাণ স্বচক্ষে দেখল শেরিফ। আর কোন আশা নেই দেখে অপরাধ স্বীকার করল ডাক্তার জিংম্যান। জানাল, জুলিয়ানকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যেই ওরা নানারকম অন্যায় করে সেই দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। জুলিয়ানের ওপর মিস্টার উইলসনকে খেপিয়ে তোলার জন্যে বাংলোতেও আগুন দিয়েছে রিকি, অবশ্যই বসের নির্দেশে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ওটাই আসল লস্ট ডাচম্যান মাইন, তাই না?
হ্যাঁ, ওখানেই কোথাও আছে খনিটা, জবাব দিল টনি। ভালমত খুঁজলে বেরিয়ে পড়বে।
সোনা আছে?
থাকতে পারে। সে সম্ভাবনা আছে বলেই ঝুঁকি নিয়ে এত সব কুকর্ম করেছে ওরা, জিংম্যান আর তার দুই সহকারীকে দেখাল টনি।
এ-ব্যাপারে কিছু বলার আছে? জিংম্যানকে জিজ্ঞেস করল শেরিফ।
কি আর বলব, হতাশ কণ্ঠে বলল ডাক্তার। পাইনি কিছু। তবে। এখানেই আছে কোথাও। গত বছর দুটো নুড়ি পেয়েছিলাম, বেশ বড়। বুঝলাম, আছে কিছু এখানে। সেজন্যেই কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আরও আগেই যদি জানতাম, তাহলে কি আর উইলসন এত দূর থেকে এসে দখল করতে পারে? আমিই তো তার আগে কিনে নিতাম।
যদি সোনা না থাকে? শিওর তো না, বলল জিনা।
তাতে কি? জায়গাটার আসল দামই দিতে চেয়েছিলাম। ঠকা হত না আমার।
জুলিয়ান না কি যেন নাম, ছেলেটার পিছে লাগা হলো কেন? জিজ্ঞেস করল শেরিফ।
আমার এই দুই গর্দভ করেছে সর্বনাশটা। ওদেরকে কতবার বলেছি, হুশিয়ার হয়ে কাজ করতে, রিসোর্টের লোকজনের ওপর চোখ রাখতে, কানই দেয়নি। ওদেরকে এখানে খুঁড়তে দেখে ফেলেছিল ছেলেটা।
দেখলে কি হয়েছে? প্রশ্ন করল কিশোর।
গিয়ে বলে দিতে পারত আমরা এখানে সোনার খোঁজ করছি। সে যাতে কিছু বলে কাউকে বিশ্বাস করাতে না পারে, সে চেষ্টা করা হয়েছে।
এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, না? এক ঘুসিতে জিংম্যানের দাঁত কয়টা ফেলে দেয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলেন শিক্ষক।
রিসোর্ট এলাকায় বাইরের লোককে খুঁড়তে দেখেছে। কই, কখনও বলেনি তো জুলিয়ান? জিনা অবাক।
ও ভেবেছিল ওরা প্রসপেক্টর, জবাব দিল মুসা। পাহাড়ে অনেকেই সোনা আর মূল্যবান পাথরের জন্যে ওরকম খোঁড়াখুঁড়ি করে, বিশেষ করে এই অঞ্চলে। অনেককে দেখেছে জুলিয়ান। তাছাড়া, ও জানতই না যে এটা রিসোর্টের জায়গা। সাধারণ প্রসপেক্টর মনে করেছিল রিকি আর পেককেও। তবে বদমেজাজী প্রসপেক্টর, যারা মানুষ দেখলেই গুলি করে। সেজন্যে ওদের কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত।
হুঁ। অপরাধ করে কেউ পার পায় না, বিড়বিড় করল শেরিফ।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ? চলো, সবাই। মিস্টার ডিউক, চলুন?
হ্যাঁ, চলুন। ভিকি ওদিকে অস্থির হয়ে থাকবে। দেরি দেখলে নিজেই না বেরিয়ে পড়ে…
কিশোরের পাশাপাশি চলতে চলতে বলল রবিন, আরেকটা রহস্য কিন্তু বাকি রয়ে গেল। ক্যাচিনা ভূতের রহস্য।
অ্যাঁ! ফিরে তাকাল কিশোর। ও, ওটারও সমাধান করে ফেলেছি।
এই, রবিন বলল, আমার কথা শুনছ তো?
হ্যাঁ, তোমার কথার জবাবই তো দিলাম। র্যাঞ্চে চলো, দেখাব। আসামী নিয়ে চলে যেতে চাইল শেরিফ, কিশোর বাধা দিল, আর একটু, শেরিফ। বেশিক্ষণ আটকাব না। আরেকটা মজার জিনিস দেখে যান।
সবাইকে নিয়ে হলরুমে এল সে, ক্যাচিনা পেইন্টিংগুলো যে ঘরে রয়েছে। চমৎকার একটা শো দেখাবে যেন, এমন ভঙ্গিতে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিল। ভাল অভিনেতা সে, জমিয়ে ফেলল মুহূর্তে। আরাম করে চেয়ারে বসল সবাই। শো দেখবে।
ট্রাংকে যে দুটো কমাণ্ডার পাওয়া গেছে, তার একটা শেরিফের কাছ থেকে চেয়ে নিল কিশোর। যেটা মুসা চিনতে পারেনি।
এই যে, এবার ভূত দেখতে পাবেন, বলেই টিপে দিল কমাণ্ডারের একটা সুইচ, মেঘ-ক্যাচিনাটাকে লক্ষ্য করে।
কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না। তারপর শুরু হলো মৃদু গুঞ্জন। বাড়ল আওয়াজ। দুর্বোধ্য ইনডিয়ান গান আরম্ভ হলো। সড়সড় করে এক পাশে কয়েক ইঞ্চি সরে গেল ফ্রেমে বাঁধানো মেঘ-ক্যাচিনার ছবিটা। কালো একটা ফোকর বেরিয়ে পড়ল।
আলো নিভিয়ে দাও, চেঁচিয়ে বলল কিশোর। জলদি!
উঠে গেল মুসা আর রবিন। পটাপট নিভে গেল সমস্ত আলো। ঘর অন্ধকার।
দেখা দিল বেগুনী আলো। মেঘের মত ভেসে ভেসে এগিয়ে এল ঘরের মাঝখানে। ঘুরে ঘুরে রূপ বদলাচ্ছে।
খানিকক্ষণ নাচ দেখিয়ে ধীরে ধীরে আবার দেয়ালের দিকে রওনা হলো ভূত, ছবিটার কাছে গিয়ে মিলিয়ে গেল।
হয়েছে। আলো জ্বেলে দাও এবার, অনুরোধ করল কিশোর।
জ্বলে উঠল আলো। সবাই একসঙ্গে কথা বলে উঠল। নানারকম প্রশ্ন। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো ফোকরটা দেখা যাচ্ছে না আর, ছবিটা আগের জায়গায় সরে এসে ঢেকে দিয়েছে।
আস্তে, আস্তে, হাত তুলল কিশোর। মুচকি হাসল। এক এক করে জিজ্ঞেস করো, নইলে কারটার জবাব দেব? রবিন, মুসা, টনি, তোমরা এসো তো। সাহায্য করো আমাকে। সব প্রশ্নের জবাব পাবে এখনই।
স্ক্রু-ড্রাইভার, হাতুড়ি, ফাইল, প্লয়ার্স নিয়ে কাজে লাগল কিশোর। ছবিটাকে খুলে আনল দেয়াল থেকে। পেছনে দেয়ালে বেশ বড় একটা চৌকোনা খোপ। তাতে কয়েকটা যন্ত্র বসানো। একটা সকলেই চিনল। ছোট একটা টেপ রেকর্ডার, বিল্ট-ইন-মাইক্রোফোন। অন্যটা বেশ বড় আর ভারি।
জিংম্যানের দিকে ফিরল কিশোর, ডাক্তার সাহেব, এটা হলোগ্রাম। প্রোজেক্টর, তাই না?
আস্তে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার।
এগুলো এখানে বসিয়েছিলেন কেন? ভূতের গুজব ছড়িয়ে পড়লে টুরিস্ট আসবে না, রিসোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে, মিস্টার উইলসন সব কিছু বেচে দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হবেন। আর আপনি কিনে নেবেন সব, এই তো ইচ্ছেটা ছিল?
আবার মাথা ঝাঁকাল জিংম্যান।
আরে, এ তো দেখছি মহা-শয়তান লোক! চোখমুখ কালো করে ফেলেছে শেরিফ। কাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম এতদিন! যে হাসপাতালে ছিলে, সেখানেও শয়তানি করে এসেছ নাকি এরকম? এখন তো আমার মনে হচ্ছে, চাকরি তুমি ছেড়ে আসনি, তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভেবো না, খোঁজ-খবর আমি ঠিকই নের। রাগে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। তা, সাহেব, ওই হলোগ্রাম না কি গ্রাম, ওটাও কি হাসপাতাল থেকেই চুরি করেছ?
জবাব দিল না জিংম্যান। মুখ নিচু করে রইল।
আমার মনে হয় হাসপাতাল থেকেই এনেছে, আস্তে করে বলল কিশোর। ডাক্তার মানুষ তো। ডাক্তারদেরই জিনিস ওটা। খুব কাজে লাগে।
এবার উঠি, শেরিফ বলল!
মিস্টার ডিউক, টনি, তোমাদেরকেও একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে যেতে হবে, প্লীজ। তিনটে শয়তানকে একা আমি নিয়ে যেতে পারব না।
এক্ষুণি উঠি কি? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ভিকি। বসুন বসুন, খাবার তৈরিই রেখেছি। বেড়ে দিতে যতক্ষণ লাগে।
মুসাও উঠল। বাড়াবাড়ি সহ্য হবে না আমার, হাত নাড়ল সে, নিজেই নিতে পারব, সারাটা দিন উপোস। ওই দু-ব্যাটা যখন কাবাব বানাচ্ছিল না..আহ! সত্যি সত্যি তার জিভ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা পানি।