৯
তিনজন নামী প্রকাশক, বই-এর সংখ্যা ষাট ছাড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার নামী কাগজগুলোর শারদীয়ায় তাঁর লেখা না থাকলে পাঠকরা খুশি হয় না। সল্টলেকে ছিমছাম দোতলা বাড়ি, একফালি বাগান।
বয়স পঞ্চান্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক। তাঁর ক্লাস করতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও চলে আসে। পড়ানোর বাইরে লেখা নিয়েই অমিতের সময় দিব্যি যায়। বাবা গত হয়েছেন অনেকদিন হয়ে গেল। কুচবিহারের বাড়ি তালাবন্ধ থাকে। বৃদ্ধা মা অমিতের কাছে কলকাতায়।
মায়ের ইচ্ছে পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপারটা অদ্ভুত ধরনের।
তার তখন গোটা চারেক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতার কলেজের অধ্যাপক সে। পাত্র হিসেবে অবশ্যই চাহিদা তুঙ্গে। মায়ের বাপের বাড়ির সূত্রে সম্বন্ধটা এসেছিল। মেয়ে সুন্দরী এবং ইতিহাসে এম.এ করেছে। দু-পক্ষের দেখাদেখি হয়ে যাওয়ার পর সব যখন স্থির ঠিক তখন অমিত মেয়েটির ফোন পেল। বিয়ের আগে হবু স্বামী-স্ত্রীর দেখা করা এখন রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। অমিত সেরকম প্রস্তাব পাবে বলে ভেবেছিল।
কিন্তু মেয়েটি টেলিফোনেই বলল, ভণিতা না করেই বলছি। অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। সরাজীবন ধরে একটা গ্লানি বয়ে বেড়াতে আমি পারব না। শুনুন, আপনাকে অনুরোধ করছি, এই বিয়ে আপনি ভেঙে দিন।’
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অমিত। শুধু বলল, ‘হঠাৎ?’
‘তার জন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সাহসী হতে পারিনি। কিন্তু সময়টা যত এগিয়ে আসছে তত মনে হচ্ছে আমার পক্ষে তঞ্চকতা করা সম্ভব নয়। আপনি যদি রাজি না হন তাহলে আমার সামনে আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই।’ মেয়েটি বলেছিল।
‘কিন্তু কেন?’
‘আপনি না মানুষের মন নিয়ে গল্প লেখেন? হ্যাঁ, আর যাকে ভালোবাসি সে আপনার মতো সুপাত্র নয় তাই বাবার অপছন্দের। আর বেশি কিছু নিশ্চয়ই আপনাকে বলতে হবে না।’
‘আগেই যদি কথাগুলো বলতেন তাহলে ভালো হত। তবু আপনাকে ধন্যবাদ একেবারে না বলার চেয়ে দেরিতে হলেও বললেন। আপনি চিন্তা করবেন না। যা চাইছেন তাই হবে!’ অমিত বলেছিল।
হবু কনে চটপট ফোন রেখে দিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত মায়ের পাশে বসে সত্যি কথাটা তাঁকে বলেছিল অমিত। শুনে মায়ের চোখ যেন কপালে উঠেছিল। সেকি রে! কী হচ্ছে দিন দিন। তা মেয়েটা তো অনেক আগেই বাড়িতে এসব বলতে পারত।’
‘বাবার ভয়ে বলেনি।’
‘না না বাবা, এরকম মেয়েকে জোর করে এই বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত হবে না। শরীর থাকবে এখানে, মনে পড়ে থাকবে সেখানে। কোনও দরকার নেই।’ মা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন।
অথচ ঘটনাটি একেবারে বদলে গেল মুখে মুখে। গল্প তৈরি হচ্ছিল, তাতে যে যার ইচ্ছেমতো কল্পনা যোগ করছিল। শেষতক এই দাঁড়াল, গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলেন মেয়েটির বাবা। জেনেছিলেন, অমিত শারীরিক ত্রুটির কারণে কখনই পিতা হতে পারবে না। গল্প ছড়াল, প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে মেয়েটি নাকি ফোনে ভাবী পাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন যে, বাবা হওয়ার ক্ষমতা আপনার নেই, তারপরেও বিয়ের জন্যে মুখ থেকে লালা পড়ছিল কেন? এর জবাব দিতে পারেনি পাত্র।
সেই বিখ্যাত লাইনটি সত্যি হল। দিকে দিকে এই বার্তা রটে গেল ক্রমে—! আরও যেসব বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল তাঁরা দ্রুত নীরব হলেন। মা অনেক চেষ্টা করেও ছেলের জন্যে পাত্রী জোগাড় করতে পারলেন না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অমিত।
কখনো বিয়ে করবে না এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি অমিত। সে বোঝে, তার মায়ের বয়েস বাড়ছে। এখন বাড়িতে ফিরে সে মায়ের সঙ্গে অনেকটা সময়ে গল্প করে কাটায়। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর তো সে একেবারে একা হয়ে যাবে। এই বাড়িতে তাকে থাকতে হবে কাজের মহিলার ওপর ভরসা করে। সে বিয়ে করবে না এমন পণ কখনই করেনি; কিন্তু ওই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার বছর খানেক পরে এক ভদ্রলোক তাঁর অধ্যাপিকা মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব মাকে দিয়েছিলেন। ছবি দেখে মা খুব উৎসাহিত হন। কিন্তু মেয়ের বাবা মাকে স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলে সম্পর্কে সব খবর মোটামুটি আমরা জানি; উনি একজন বিখ্যাত লেখক। কিন্তু আমার মেয়ের বিয়ে যার সঙ্গে আমি দিতে চাই সে যেন ভালো স্বামী হয়। আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনার ছেলে বিয়ের পরে সুস্থ বিবাহিত জীবন যাপন করতে পারবে, সন্তানের পিতা হতে পারবে, এমন একটা সার্টিফিকেট যদি ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়ে আমাকে পাঠান তাহলে আমি নিশ্চিন্তে বিয়ের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’
চিঠিটা হাতে পাওয়ার পরে আর সেটা মাকে দেখায়নি অমিত। ভদ্রমহিলা যদি চাপে পড়ে ছেলেকে বলেন, ‘লোকের মুখ বন্ধ করতে ভালো ডাক্তারের দেখিয়ে সার্টিফিকেট এনে মেয়ের বাবাকে পাঠিয়ে দাও। সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।’ মায়ের মুখে ওইরকম কথা শোনার পরে সেটা এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। আর মায়ের আদেশ মান্য করতে হলে সারাজীবন মাথা নীচু করে থাকতে হবে।
পঞ্চাশে পা দেওয়ার পর মা আর ছেলের বিয়ের আশা ছেড়ে দিলেন। পাশের প্রতিবেশী এক সমবয়সি মহিলার সঙ্গে তার কিছুটা সখ্যতা হয়েছিল। রোজ বিকেলে দুজনে গল্প করতেন। এক ভোরে প্রায় নিঃশব্দে ওঁরা দুজনে বেলুড়ে গিয়ে দীক্ষা নিয়ে এলেন।
আচমকা যেন জীবন বদলে গেল মায়ের। সকাল-সন্ধে রোজ কয়েকঘণ্টা তাঁর আরাধ্য গুরুদেব-গুরুমাতা এবং স্বামীজির ছবির সামনে বসে ধ্যান শুরু করলেন।
একদিন অমিত তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘দীক্ষা নিয়ে তুমি কেমন আছ মা?’
মা হেসে বলেছিলেন, ‘খুব শান্তিতে আছি বাবা।’
ইদানীং বিভিন্ন সাহিত্যসভায়, জেলার বইমেলায় এত আমন্ত্রণ আসছিল যে হাঁপিয়ে উঠছিল অমিত। ইতিমধ্যে তার আরও তিনটে উপন্যাস অবলম্বনে ছবি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি, লেখার চাপ সামলে নিজের জন্যে আলাদা করে কোনও সময় বের করার কথা অমিত ভাবত না।
এই সময় একটি বিখ্যাত পাঠাগারের কর্তাব্যক্তিরা এসে জানালেন তাঁরা তাকে সম্বর্ধনা জানাতে চাইছেন। অমিত এইসব অনুষ্ঠানে যেতে খুব অস্বস্তি বোধ করে। সে এড়িয়ে যেতে চাইলেও উদ্যোক্তারা নাছোড়বান্দা হওয়ায় রাজি হতে হল। অনুষ্ঠানটি হবে পাঠাগারের সামনে মঞ্চ তৈরি করে। তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়ার পরে দুজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গান শোনাবেন।
নির্দিষ্ট দিনে উদ্যোক্তাদের দুজন গাড়ি নিয়ে এসে অমিতকে বেশ সমাদর করে নিয়ে গেল। যে অঞ্চলে গাড়ি যাচ্ছিল সেই অঞ্চলে বহুদিন বাদে এল অমিত। এর মধ্যে বাড়িঘরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, রাস্তাও বেশ চওড়া। যে গলির মুখে গাড়ি থেকে ওঁরা নামল তার গায়ের একটি বাড়িতেই বসার ব্যবস্থা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হলে ডেকে নিয়ে যাবে ওরা।
বনেদি বাড়ির বসার ঘর। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে নমস্কার করলেন, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি পাশের বাড়িতে থাকি।’
মাথা নাড়ল অমিত। এই কথা শুনে কী বলা যায় বুঝতে পারল না।
‘আমার এক জ্যেঠতুতো বোনকে আপনি বোধহয় চিনতেন।’
‘ও।’ সে কোনও প্রশ্ন করার আগেই পাশে দাঁড়ানো একজন বলল, ‘জানেন, আমি নর্থবেঙ্গলের ছেলে। আপনার লেখা পড়তে তাই খুব ভালো লাগে।’
‘নর্থ বেঙ্গলের কোথায়?’ অমিত জিজ্ঞাসা করল।
‘আলিপুরদুয়ার।’
অমিত প্রথম লোকটির দিকে তাকাল। জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার জ্যেঠতুতো বোনের নাম কী ভাই?’
‘মৃণাল। উনি একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু কী যে হল, তারপর থেকে আর করেননি।’
‘উনি তো আপনার দিদি বললেন, তাহলে আপনি আপনি করে কথা বলছেন কেন?’ হাসল অমিত।
‘উনি তো এখন প্রায় সন্ন্যাসিনীর জীবনযাপন করেন, কারও সঙ্গে কথা বলেন না, তাই ওঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই আমরা আপনি আপনি আপনি বলে থাকি!’ লোকটি বলল।
‘হ্যাঁ, উনি বোধহয় আমার গল্প নিয়ে প্রথম যে ছবিটা হয়েছিল তাতেই অভিনয় করেছিলেন।’ অমিত বলল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার তাহলে মনে আছে?’ লোকটি কথা শেষ করতেই উদ্যোক্তারা হই-হই করে এসে অমিতকে অনুষ্ঠানমঞ্চে নিয়ে গেল। অমিত দেখল বেশ ভিড় হয়েছে। কিন্তু দর্শকদের মধ্যে কোনও পরিচিত বয়স্কা মহিলার মুখ নেই। সে ওপরের দিকে তাকাল। উত্তর কলকাতার বাড়িগুলো যেমন হয়। ছাদে ছাদে মহিলাদের ভিড়। তারা ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখবেন। না, তাদের কাউকেই বয়স্কা বলে মনে হল না।
হঠাৎ অমিতের খেয়াল হল। মৃণাল এখন কীরকম দেখতে হয়েছে তা সে জানে না। অন্তত তিরিশ বছর চলে গিয়েছে এর মধ্যে। দশ বছরেই মানুষের চেহারা কত অদলবদল হয়, এ তো তিরিশ বছর। যদি এতগুলো বছর মৃণাল গৃহবন্দী হয়ে থাকে তাহলে সে কীরকম এখন দেখতে হয়েছে আন্দাজ করা কী সম্ভব! সভাপতি এসে সামনে দাঁড়াতেই অমিত উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাল।
অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গেল। একটি মেয়ে সুন্দর গলায় রবীন্দ্রনাথের গাই গাইল। তারপর ক্লাবের সম্পাদক একটি জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। প্রচুর হাততালি পড়ল। সম্পাদক দর্শকদের জানালেন, আজ যাকে আমরা সম্বর্ধনা জানাচ্ছি তিনি ছাত্রাবস্থায় আমাদের পাড়ায় প্রায়ই আসতেন। আজ আবার এলেন।’
তারপর সভাপতি খুব কম কথায় তাঁর বক্তব্য রাখলেন। এর পরে সংস্থার পক্ষ থেকে নানান উপহারসমগ্রী দিয়ে অমিতকে শুভেচ্ছা জানানো হল। তারপরে সম্পাদক অমিতকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন।
অমিত তার ভাষণ শুরু করল সংস্থা এবং সমবেত দর্শককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে। বলল, ‘উত্তর কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড়। আমার জন্মস্থান কুচবিহার। কিন্তু তারপরে এই উত্তর কলকাতাতেই আমার জীবনের অনেকটা সময়ে কেটেছে। আমার গল্প যা নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছিল এই অঞ্চলের পটভূমিতেই। অনেকেই হয়তো জানে না সেই সিনেমায় একটি অন্যতম চরিত্রে এই অঞ্চলের একজন তরুণী অভিনয় করে সুনাম পেয়েছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় সেই তরুণী আর কোনও ছবিতে অভিনয় করেননি। করলে বাংলা চলচ্চিত্র একজন সত্যিকারের প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর অভিনয় দেখা থেকে বঞ্চিত হত না।’ এর পরে অমিত অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বক্তৃতা শেষ হলে প্রচুর হাততালি পড়ল।
এরপর গানের আসর শুরু হবে বলে সম্পাদক অমিতকে সঙ্গে নিয়ে যে বাড়িতে প্রথমে এসে বসেছিল সেখানে চলে এলেন। অমিত কিছু খাবে না বললেও অন্তত এক কাপ কফি খেতে রাজি করালেন। ওদিকে গান শুরু হয়ে যাওয়ায় ঘরে চারপাঁচজন অমিতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। অমিত তাদের মধ্যে সেই প্রৌঢ়কে দেখতে পেয়ে বলল, ‘আমি যাঁর বাড়িতে যেতাম তিনি বোধহয় আপনার মাসিমা। তাই কি?’
‘হ্যাঁ। আমার বাবারা ছিলেন দুই ভাই। উনি বড়জনের স্ত্রী, মানে জ্যোঠিমার বোন। আমরাও তাঁকে মাসিমা বলেই ডাকতাম। বছর দুয়েক আগে উনি মারা গিয়েছেন। তাঁর আগে আমার জ্যেঠিমা-জ্যাঠামশাই চলে গিয়েছেন। শুধু জ্যাঠতুতো দিদি এখনও বাড়িতে আছেন।’ লোকটি বলল।
‘কেমন আছেন উনি?’ শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল অমিত।
‘শরীর ভালো নয়। সবসময় পুজোআর্চা নিয়ে থাকেন, নয়তো ধর্মের বই পড়েন। আপনার গল্পের ওপর যে ছবি হয়েছিল তাতে উনি অভিনয় করেছিলেন। আমরা টিভিতে দেখেছি। সেই চেহারার সঙ্গে এখন কোনও মিল নেই।’ লোকটি বলল।
‘ও। বাইরে কোথাও যান না?’
‘একদম না। যাওয়া দূরের কথা, খুব প্রয়োজন হলে আমাদের কয়েকজন ছাড়া কারও সঙ্গে দেখাও আর করেন না।’
‘কেন?’ নিজের অজান্তে প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল অমিতের।
মাথা নাড়ল লোকটি, ‘ঠিক জানি না। ছেলেবেলা থেকে এইরকম দেখে আসছি।’
চা খেতে খেতে অমিত ভাবল, লোকটিকে বলবে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু যে মহিলা জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন, বাড়িতে গেলে তিনি তো দেখা করতে নাও পারেন! শুধু শুধু তাঁকে বিব্রত করার কী দরকার।
অমিত বাড়ি ফিরে এল।
.
কিছুদিন থেকেই অস্বস্তি হচ্ছিল। ডাক্তার বললেন, ‘হাসপাতালে চলুন, মাত্র একদিনের ব্যাপার। আজ ভর্তি হলে পরশু বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন। তারপর দিন সাত-আট বিশ্রাম নিলে আর কোনও সমস্যা থাকবে না।
অমিত হেসে বলেছিল, ‘তাহলে যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে বাঁচতে হবে!’
ডাক্তার হেসে বললেন, ‘নড়ে যাওয়া দাঁত ফেলে দিয়ে আর্টিফিসিয়াল দাঁত লাগিয়ে মানুষ সারাজীবন তো দিব্যি খাওয়াদাওয়া করে থাকে, তাই না?’
সল্টলেকের একটি নার্সিংহোমে অমিতকে ভর্তি করা হল। খুব সহজভাবে তার বুকে যন্ত্র বসিয়ে দিলেন ডাক্তার।
তৃতীয় দিন বিকেলে সে বাড়িতে ফিরে যাবে। দুপুরের পর নার্স এসে জানাল তার একজন ভিজিটার আছে। নাম শুনে চিনতে না পেরেও অমিত লোকটিকে পাঠিয়ে দিতে বলল।
যে লোকটি তার ঘরে এল তাকে অমিত কল্পনাও করেনি। লোকটি হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘কাগজে আপনার খবরটা আজই পড়েছি। আমি তো রোজ এই নার্সিংহোমে আসছি, ভাবলাম যদি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা করব। এখন কেমন আছেন?’
‘এখন ভালো। আজই বাড়িতে ফিরে যাব। আপনি এখানে রোজ আসেন কেন? কোনও কাজের সূত্রে আসতে হয়?’ অমিত জিজ্ঞাসা করল।
‘না না। দিদি, মানে মৃণালদিদি এখানে ভর্তি আছেন। স্ট্রোক হয়েছে। বাঁ-দিকটায় কোনও সাড় নেই। তবু অদ্ভুত মনের জোর বলেই এখনও লড়াই করতে পারছেন। ক’দিন পারবেন ডাক্তারও বলতে পারছে না।’ লোকটি বলল।
বিষাদে আক্রান্ত হল অমিত। একটা বড় শ্বাস নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওঁর সেন্স চলে যায়নি তো?’
‘অধিকাংশ সময়েই সেন্স থাকে না। তাবে মাঝে মাঝে বোধহয় আসে। তখন ওঁর হাতের আঙুলগুলো মুঠো হয়, যেন কিছু ধরতে চেষ্টা করে।’ লোকটি বলল।
অমিত এক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল, ‘আমি কি ওঁকে দেখতে যেতে পারি?’
‘আপনি তো অসুস্থ। শুনলাম পেসমেকার বসানো হয়েছে। আপনি—?’
‘কোনও অসুবিধে হবে না।’
‘উনি তো কথা বলতে পারবেন না, আপনাকে চেনার ক্ষমতাও ওঁর নেই।’
‘আমি তো ওঁকে দেখতে যাব, দেখেই চলে আসব।’ উঠে দাঁড়াল অমিত।