হায় সজনি – ৮

কলকাতায় এখনও সেই ধরনের মেস বাড়ির কয়েকটি অবশিষ্ট আছে যাদের নিয়ে গতশতকের মাঝামাঝি প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। অনেক গল্প বা উপন্যাসের নায়ক কলকাতায় এসে যে ধরনের মেসে ষাট বছর আগে থাকত, সেইরকম এক মেসের সন্ধান অমিত পেয়ে গেল আমহার্স্ট স্ট্রিটে। খাওয়া থাকার জন্যে যা দিতে হবে তা স্কুলের মাইনের এক চতুর্থাংশ। একটি ঘরে দুটি তক্তাপোষ। অমিত যে ঘরে জায়গা পেল সেখানে অন্য যে ভদ্রলোক থাকেন তিনি দীর্ঘকাল ধরে আছেন। রোগা, পঞ্চাশের ওপর বয়স, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে শুয়ে থাকে দিনভর। সন্ধের পর বেরিয়ে যান, ফেরেন ভোর বেলায়। অমিত ওই ঘরে এলেও তিনি একবার শুধু তাকালেন, কথা বললেন না।

.

মাসখানেক স্কুলে পড়ানোর পরে অমিতের মনে হচ্ছিল সে যেন যন্ত্রের মতো জীবন যাপন করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়েই স্নান করতে চলে যেতে হয়। পৌনে ন’টায় খাওয়ার ঘরে গিয়ে বারোয়ারিভাবে রান্না করা ভাত ডাল আর মাছের ঝোল খেয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বাস ধরে চলে যায় শিয়ালদা স্টেশনে। সেখান থেকে সাউথের ট্রেন ধরে শহরতলীতে পৌঁছে যায় দশটা বাজার খানিকটা আগেই। এগারোটায় ক্লাস শুরু হয়। তার আগের সময়টুকু সে টির্চাস রুমে বসে সেদিনের ক্লাসগুলোয় যে বিষয় পড়াবে তা ঝালিয়ে নেয়। সারাদিন ধরে ছেলেদের পড়াতে তার মন্দ লাগছে না। চারটের সময় স্কুল ছুটি হওয়া মাত্র ট্রেন ধরে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে উল্টোদিকের একটা দোকানে ঢুকে জলযোগ সেরে নেয়। ওই দোকানের সিঙ্গারা এই তল্লাটে বিখ্যাত।

মেসে ফিরে ঘরে ঢুকে দ্যাখে তার রুমমেট তখনও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। সে যখন হাতমুখ ধুয়ে তার টেবিলে লিখতে বসে তখন ভদ্রলোক খাট থেকে নেমে ঘরের বাইরে যান। অমিত কয়েকবার ভেবেছিল, ভদ্রলোকের সঙ্গে যেচে আলাপ করবে। কিন্তু তিনি তাঁর মুখটা এমন গম্ভীর করে রাখেন যে ইচ্ছেটা ওঁর দিকে তাকালেই মন থেকে উধাও হয়ে যায়।

গল্প লিখতে বসে প্রথম দু’দিন অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল অমিত। কোনওটায় দুটো লাইন, কোনওটায় অর্ধেকটা, প্রতিবারই মনে হচ্ছিল কিছুই দাঁড়াচ্ছে না। তারপর একসময় মনে হল, হঠাৎই আচমকা তার কলম থেকে দুটো গল্প বেরিয়ে এসেছিল। ওই গল্প দুটোতেই তার সব সাহিত্য প্রতিভা শেষ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আর কিছু তার লেখার নেই।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় তার মনে এল স্যারের কথা। স্যার বলেছিলেন, নিজেকে নিয়ে লেখো। এই যে কুচবিহার থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে ভয়ে ভয়ে কলকাতায় এসেছিল, দুই তিনজনের সঙ্গে কথাবার্তা হত বটে কিন্তু বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে হয়নি, সেই ছেলে বাংলা সাহিত্য গোগ্রাসে গিলতে গিলতে এসে পড়ার সময় রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখে আচ্ছন্নের মতো এগিয়ে গিয়েছিল। কী কথা বলবে ভাবতে না পেরে শেক্সপীয়ারের লাইন বলতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল, সেই ছেলেটাকে নিয়ে লিখলে কেমন হয়!

একটা ঘোরের মধ্যে যেন চলে এল অমিত।

মাত্র চারদিন। স্কুল ফেরত মেসে এসে লেখা নিয়ে বসে চারদিনেই লেখাটা শেষ হল। ইচ্ছে করেই সে পত্রিকার অফিসে লেখা পৌঁছতে গেল না। ডাকে পাঠাল।

সেই লেখা ছাপা হল পরের মাসেই। সঙ্গে এল সম্পাদকের চিঠি। তিনি অনুরোধ করেছেন, অমিত যেন অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করে। লেখালেখি নিয়ে তিনি কথা বলতে চান। অমিতও ঠিক করল আগামী শনিবার সে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। সেদিন তার দুটোর মধ্যেই ছুটি হয়ে যায়।

.

কিন্তু পত্রিকার অফিসে যাওয়ার আগেই অমিতের মেসের ঠিকানায় চিঠিটা ডাকে এল। খামটা এসেছিল তার নামেই, কেয়ার অফ সম্পাদক। তাঁর দপ্তর থেকে রি-ডাইরেক্ট করে অমিতের মেসের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।

তক্তাপোষে শুয়ে খামটাকে দেখল অমিত। ওপাশের তক্তাপোষে তার রুমমেট পাশ ফিরে শুয়ে নাক ডাকছেন। খামের ওপর যে হাত ঠিকানা লিখেছে সেটা অবশ্যই একজন মহিলার। এর আগেই ওই দুটো গল্পের একটির জন্যে চিঠি পেয়েছিল, সেটা পোস্টকার্ডে এবং মহিলার নয়।

খামটার মুখ ছিঁড়ে সে ভাঁজ করা কাগজটা বের করল। সুন্দর হাতের লেখা দেখলেই ভালো লাগে।

আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব না জানা থাকায়, রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করি, থাক সে কথায়, লিখি বিনা সম্বোধনে। আপনার লেখা গল্পটি পড়ার পর আবার লেখকের নাম পড়লাম। না, ওই নামের কোনও লেখকের লেখা আগে পড়িনি।

ভালো লিখেছেন। বেশ ভালো। কিন্তু একটা অনুরোধ, কোনও ঘটনা ঘটেছিল কল্পনা করে লিখতেই পারেন, কিন্তু যা ঘটেছিল তার সঠিক চেহারা জেনে লিখলে চরিত্রগুলো কাচের বলে মনে হয় না। আর একটা কথা, আমার অনুমান ভুল হচ্ছে না, তাই জানাচ্ছি যাঁকে মেসোমশাই বলতেন তিনি দু’মাস আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। শুভেচ্ছা সহ, এই গল্পের পাঠিকা।

সোজা হয়ে বসল অমিত। নিজের নাম লেখেনি কিন্তু স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে মৃণাল—এই চিঠি তারই লেখা। কিন্তু তার গল্প পড়ে এই চিঠিতে মৃণাল যে ভাবে লিখতে বলছে সেটা নিয়ে সে ভাবছিল না, চোখের সামনে মৃণালের মেসোমশাই-এর মুখ ভেসে উঠল। মানুষটি চলে গেছেন পৃথিবী থেকে? খুব খারাপ হয়ে গেল মন। তার সঙ্গে মেসোমশাই-এর মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছিল কিন্তু তাঁকে তার অন্যধরনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল।

তক্তাপোষ থেকে নেমে আবার জামাপ্যান্ট পরে নিয়ে মেস থেকে বেরিয়ে পড়ল অমিত। চিঠিটা পড়ার পর তার মনে হচ্ছে মাসিমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করা দরকার।

আজ আর বাসে নয়, খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে বসল অমিত। এই প্রথমবার সে ওই বাড়িতে ট্যাক্সি করে যাচ্ছে। শিক্ষকতা করায় এটুকু বিলাসিতা সে করতেই পারে।

সেই পরিচিত মেয়েটি দরজা খুলল। অমিতকে দেখে সে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি খবরটা জানেন?’

নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল অমিত। তাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল। মিনিটখানেক পরে, মাসিমা ভেতর থেকে এসে দাঁড়ালেন, ‘কেমন আছ অমিত?’

অমিত উঠে দাঁড়াল। মুখ নীচু করে বলল, ‘আমি আজই জানতে পারলাম।’

‘ও!’ তারপর বললেন, ‘কাগজে শোক সংবাদ কলমে ছাপা হয়েছিল। মন দিয়ে না দেখলে ছবি দেখে চেনা যাবে না। সর্বনাশ তো একা আসে না। আমাকে তো সব দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে। যাক গে, তুমি কি কলকাতায় কোনও কাজে এসেছ না বেড়াতে?’

সত্যি কথাই বলল অমিত, ‘আমি এখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেয়েছি। চাকরিটি সাময়িক কিন্তু আমাকে সাহায্য করবে।’

‘কীরকম?’

‘আমি গবেষণা করব। সেই কারণে কলকাতায় থাকলে কিছু সুবিধে হবে। যদি দুই বছর চাকরিটা থাকে তাতে অনেক উপকৃত হব।’

‘মাত্র দুই বছর? এরকম কেন?’

‘যাঁর জায়গায় আমি পড়াচ্ছি তিনি ছুটি থেকে ওই সময় ফিরে আসতে পারেন বলেই শুনেছি।’ একটু থেমে অমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘ওঁর কী হয়েছিল?’

মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা, ‘কিছুই না। দুপুরে কখনই ঘুমান না। কিন্তু সেই রবিবারে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শুলেন। বিকেলে ডাকতে গিয়ে জানলাম চলে গেছেন। বোধহয় নিজেও বুঝতে পারেননি।’

এরপর কী কথা বলবে বুঝতে পারছিল না অমিত।

ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই ইউনিভার্সিটির সেই হোস্টেলে এখন থাকছ না?’

‘না। আমি আপাতত আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা বোর্ডিং-এ থাকি। আপনি এখন এই বাড়িতে একাই থাকেন?’ জিজ্ঞাসা করল অমিত।

‘ওমা! আমি কোথায় যাব! ওই মেয়েটা, যে তোমার জন্যে দরজা খুলল, ওকে তো আগেও তুমি দেখেছ, আমরা দুজনেই থাকি।’ ভদ্রমহিলার কথার মধ্যেই মেয়েটি একটা ট্রে-তে চায়ের কাপ আর প্লেটে বিস্কুট নিয়ে এল। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘নাও।’

এই অবস্থায় খাব না বলা যায় না আবার খেতেও ভালো লাগে না। অমিত বিস্কুটের প্লেট তুলে ধরে মেয়েটিকে বলল, ‘এটা নিয়ে যাও।’

মেয়েটি ভদ্রমহিলার দিকে তাকালে তিনি মাথা নেড়ে নিয়ে যেতে ইশারা করলেন।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি জোর করেছি বলে মৃণাল শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশুনা তো করেনি, রেজাল্ট ভালো হবে বলে মনে হয় না।’

মাথা নেড়ে সমর্থন করল অমিত। চায়ে চুমুক দিল।

‘এর মধ্যে আর এক সমস্যায় পড়েছি আমরা। কী যে করি বুঝতেই পারছি না। ভেবেছিলাম পাশ করে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে কী করবে তা ও নিজেই ঠিক করবে। কিন্তু যা ভাবি তা তো কখনও হয় না।’

‘কেন?’

‘হঠাৎ ওঁর মাথায় ঢুকেছে তিনি অভিনয় করবেন। স্কুলে ভালো আবৃত্তি করত, স্কুলের নাটকে অভিনয় করেছে, তাই সিনেমায় সুযোগ পেলে সে নাকি খুব ভালো অভিনয় করতে পারবে। বোঝ! এই ভূত আমি কী করে ওর মাথা থেকে নামাই, বলো!’

খুব অবাক হয়ে গেল অমিত। যে মেয়ে অভিভাবকদের পাহারায় কলেজে যাওয়া আসা করেছে সে হয়তো তার মধ্যেই নিজের মতো ফাঁক পেলেই বিদ্রোহী হওয়ার চেষ্টা করেছে। সহপাঠিনীর প্ররোচনায় পার্কে গিয়ে সিগারেটে সে টান দিতে শুরু করেছিল। অমিত যদি খবরটা মাসিমাকে পৌঁছে না দিত তাহলে সেটা কোথায় গিয়ে শেষ হত তা কেউ জানে না।

অমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘ওকে কেউ সিনেমায় অভিনয় করার কথা বলেছে?’

‘অমি জানি না। স্বামী মারা যাওয়ার পর তো আমার কাছে ও কিছুতেই মুখ খোলে না। যেন আমি ওর সবচেয়ে বড় শত্রু।’ বড় শ্বাস নিলেন মাসিমা, ‘অনেক বোঝাচ্ছি কিন্তু কে শোনে কার কথা?’

আরও কিছুক্ষণ মাসিমার সঙ্গে থাকার পর অমিত বেরিয়ে এল। তখন সন্ধের অন্ধকার ফিকে হয়ে কলকাতার পথে নেমে এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে মাসিমা বলেছেন, ‘সময় পেলে আবার এসো বাবা। তবে আসার আগে ফোন করে নিও।’

.

সম্পাদকের সঙ্গে শনিবার দুপুরে দেখা করল অমিত। প্রবীণ ভদ্রলোক বেশ অবাক হলেন অমিতকে দেখে। বসতে বলে আলাপ করার সময় যখন জানতে পারলেন অমিত শিক্ষকতা করছে তখন বলেই ফেললেন, ‘আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; প্রথমে এই খামটা রাখুন।’

অমিতের নাম লেখা একটা লম্বা খাম সামনে রাখলেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘আপনি নতুন লেখক। তবু আমাদের সাধ্যমতো সম্মানদক্ষিণা দিতে পেরে খুশি হয়েছি।’ ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ‘আর হ্যাঁ, আপনার গল্প পাঠকদের খুব ভালো লেগেছে। যেহেতু চিঠিগুলো আমাকে লেখা হয়েছে তাই আপনাকে ওগুলো পাঠাইনি। আপনি কোথায় আছেন? একটা মেসের ঠিকানা দেখলাম—!’

‘হ্যাঁ, মেসটা আমহার্স্ট স্ট্রিটে।’

‘আপনার মা-বাবা থাকেন কুচবিহার। কুচবিহার একটা স্বাধীন রাজ্য ছিল। প্রচুর কাহিনির পটভূমি ওই জেলা। কুচবিহার রাজপরিবারের সঙ্গে ভারতের বিখ্যাত রাজপরিবারদের কারও কারও সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছিল। আপনি চেষ্টা করলে তথ্য জোগাড় করে একটা বড় মাপের উপন্যাস লিখতে পারবেন। যদি লেখেন তাহলে আমি এই কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করব। সম্পাদক বললেন।

‘খুব বড় কাজ। আমার পক্ষে সামলানো কি সম্ভব হবে?’

‘জলে না নামলে কি সাঁতার কাটা যায়?’ ভদ্রলোকের কথার মধ্যেই ফোন বেজে উঠল, তিনি রিসিভার তুলে ওপাশের কথা শুনে বললেন, ‘ও, এসে গেছেন! কাউকে সঙ্গে দাও, আমার ঘর চিনিয়ে দেবে।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে সম্পাদক বললেন, ‘আপনি আমার ছেলের বয়সি, তুমি বললে নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না।’

‘না-না।’ সোজা হল অমিত।

‘এক ভদ্রলোক আসছেন আপনার সঙ্গে আলাপ করতে। উনি বেশ নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক। আমরা একসময় সহপাঠী ছিলাম।’ বলতে না বলতে দরজায় শব্দ হল। সম্পাদক চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে হেসে বললেন, ‘বাঃ, একদম ঠিক সময়ে। এসো, এসো, বসো।’

অমিত দেখল। মধ্যবয়সি মানুষটির ছবি সে আগেও দেখেছে। ভদ্রলোক তাকে নমস্কার করতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। সম্পাদক বললেন, ‘বসো সুকুমার। ইনি হলেন তরুণ লেখক যাঁর লেখা তুমি পড়েছ। অমিত, ইনি সুকুমার চ্যাটার্জি। তুমি বিখ্যাত চিত্রপরিচালক সুকুমার চ্যাটার্জির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ, ইনি সেই ভদ্রলোক।’

চেয়ারে বসে হাত নেড়ে থামতে বললেন সুকুমারবাবু, ‘আমি চেষ্টা করি ভালো ছবি তৈরি করতে। আমার ক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা করতে ফাঁকি দিই না। হ্যাঁ, অমি আপনার লেখা আগে কখনও পড়িনি। এই বড় কাগজে লেখার আগে নিশ্চয়ই ছোট কাগজে শুরু করেছিলেন?’

হেসে ফেলল অমিত, ‘না, লেখার কথা আগে আমি ভাবিনি। এই কাগজেই আমার একজন অধ্যাপকের উৎসাহে প্রথম লিখেছিলাম।’

‘বাঃ। চমৎকার ব্যাপার তো!’

সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সুকুমারের ছবি দেখেছ?’

‘কুচবিহারে যখন ছিলাম তখন দেখেছি। কিন্তু কলকাতায় আসার পর দুটো কারণে ছাত্রাবস্থায় ছবি দেখা হয়নি।’ হেসে বলল অমিত।

‘কী কারণ?’ সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলেন।

‘পড়াশুনার চাপ আর অর্থাভাব।’ হাসল অমিত।

‘অর্থাভাবের জন্যে একটাও সিনেমা দ্যাখোনি?’ সম্পাদক খুব অবাক।

‘হ্যাঁ। বাবা যা টাকা পাঠাতেন তা দিয়ে থাকা খাওয়া ইউনিভার্সিটির মাইনে, যাতায়াতের বাসভাড়া দেওয়ার পর যা থাকত তা তেল সাবান কিনতেই ফুরিয়ে যেত। সিনেমা থিয়েটারের টিকিটের কথা ভাবতেই পারতাম না।’ অমিত বলল।

‘যাক গে, সেই সব দিন পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছ। এখন আশাকরি পেছনদিকে তাকাতে হবে না। হ্যাঁ, সুকুমার তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। আমি ওকে বলেছিলাম তোমাকে দেখা করার কথা বলব কিনা। ও রাজি না হয়ে নিজেই তোমার কাছে আসতে চাইল নিশ্চয়ই তুমি খুব অবাক হচ্ছ। সুকুমার, তুমিই বলো।’ সম্পাদক হাসলেন।

সুকুমার চ্যাটার্জি বললেন, ‘অমিতবাবু, আমার বন্ধুর কাগজে আপনার লেখা বড় গল্পটি নিয়ে একটি ছবি বানাতে ইচ্ছে করছে। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছি, আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’

প্রথম কয়েকটি সেকেন্ড অমিত যেন কথা খুঁজে পেল না। তারপর বলল, ‘আমি জানি না এটা ছবি হবে কি না?’

সম্পাদক বললেন, ‘মৃণাল সেন বলেছিলেন, খবরের কাগজের একটা হেডলাইন থেকে ছবি হতে পারে।’

‘না না, আমার সেই ক্ষমতা নেই।’ সুকুমার বললেন, ‘কিন্তু আপনার গল্পটি পড়ে মনে হয়েছে ছবি তৈরি হলে দর্শকদের ভালো লাগবে।’ এখন বলুন, আপনার আপত্তি নেই তো?’

অমিত কী বলবে বুঝতে না পেরে সম্পাদকের দিকে তাকাল। সম্পাদক হেসে বললেন, ‘এ তো খুব আনন্দের কথা! তুমি তরুণ গল্পকার। লেখা শুরু না করতেই পাঠকের প্রশংসা পাচ্ছ। সুকুমারের মতো প্রতিষ্ঠিত চিত্রপরিচালক আগ্রহী হয়েছে ছবি তৈরি করতে। এটা কম কৃতিত্বের কথা নয়। আমার বন্ধু বলে নয়, সুকুমারের যা খ্যাতি তাতে একটা নতুন পালক যোগ হবে ও যদি এই ছবিটা করে।’

সুকুমার বললেন, ‘আপনার গল্প ছবি হলে আপত্তি নেই তো?’

অমিত এবার কথা বলতে বাধ্য হল, ‘তা নয়। আপনার মতো একজন বিখ্যাত পরিচালক আমার গল্প নিয়ে ছবি করার কথা ভাবছেন এটা কি কম কথা!’

‘জানি না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিচালক শিব গড়তে চান কিন্তু বাঁদর তৈরি হয়। আমার ছবি দেখেও আপনার মনে হতে পারে কেন অনুমতি দিলাম। তবে একটা কথা জোর দিয়ে বলছি, আমি খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কাজ করে যাই।’

সম্পাদক বললেন, ‘তাহলে তো হয়েই গেল। হ্যাঁ, এবার অর্থিক এবং অন্যান্য চুক্তির ব্যাপারটা বলো।’ বলে বেলের বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেয়ারা দরজা খুললে তিনি চায়ের অর্ডার দিলেন।

সুকুমার বললেন, ‘আমার প্রযোজক আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তিপত্রে সইসাবুদ করাবে। এখন বলুন, আপনি কত টাকা সম্মানদক্ষিণা নেবেন?’

মাথা নাড়ল অমিত, ‘বিশ্বাস করুন, এ ব্যাপারে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।’

‘আচ্ছা, একটা—’ বলেই সুকুমার সম্পাদকের দিকে তাকালেন, ‘তুমি না হয় টাকার অঙ্কটা ঠিক করে দাও।’

‘তুমি কত দিতে পারবে?’ সম্পাদক জিজ্ঞাসা করলেন।

‘একজন তরুণ লেখক হিসেবে প্রযোজককে আমি এক লক্ষ টাকা দিতে রাজি করিয়েছি। অমিতবাবু, এইরকম লেখা যদি আপনি কয়েক বছর ধরে লিখতেন তাহলে দুই-এর নিচে পেতেন না। এবার বলুন আপনি!’

অমিত নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ওইটুকু লেখার ওপর ভিত্তি করে সিনেমা তৈরি করবেন ভদ্রলোক আর তার জন্যে তাকে এক লক্ষ টাকা দেবে? এত টাকা?

সম্পাদক বললেন, ‘আমার মনে হয় এটা উত্তম প্রস্তাব অমিত।’

অমিত বড় শ্বাস নিয়ে বলল, ‘বেশ।’

সুকুমার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা মোটা খাম আর ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন, ‘এই কাজটা আমি কখনই করি না। কিন্তু আপনি নবীন লেখক বলে মনে হল করা উচিত। এই খামে অগ্রিম হিসেবে দশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এই কাগজে লেখা আছে, আপনাকে মোট এক লক্ষ টাকা দিতে হবে। তা থেকে শতকরা দশ টাকা হিসেবে দশ হাজার টাকা ইনকামট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স হিসেবে জমা দেওয়া হবে। বাকি নব্বুই হাজারের প্রথম দশ হাজার আজ আপনাকে দেওয়া হল। বাকি আশি হাজার প্রযোজক শুটিং শুরু করার আগেই চুক্তিপত্র তৈরি করে সইসাবুদ করার সময় চেকে আপনাকে দিয়ে দেবেন। বোঝাতে পেরেছি?’

মাথা নেড়ে অমিত জানাল, সে বুঝেছে। তারপর যেখানে যেখানে সই করার তা করে দিলে সুকুমার একটা করে কপি তাকে দিলেন। সম্পাদক ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে সুকুমারকে বললেন, ‘এর ভেতরে রেখে দাও।’

.

সুকুমার থাকে গড়িয়াহাটে। তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে চলুন। আমি তো আগেই নেমে যাব, তারপরে আমার গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

‘অনেক ধন্যবাদ কিন্তু আমি বাসেই চলে যেতে পারতাম।’ অমিত হেসে বলল।

‘পারতেন কিন্তু আপনার পকেটে এখন যে টাকার প্যাকেট রয়েছে সেটার জন্যে একটু সতর্ক হয়ে যাওয়া দরকার। কলকাতার পকেটমাররা আপনার চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী!’ সুকুমার বললেন।

পরিচালকমশাই নেমে গেলে গাড়ির পেছনের আসনে একা বসে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল অমিত। হঠাৎ খেয়াল হল, কলকাতার রাস্তায় এই প্রথমবার সে একা কোনও প্রাইভেট গাড়িতে চেপে যাচ্ছে। এই প্রথম তার পকেটে দশ হাজার টাকা রয়েছে। আচ্ছা, ভদ্রলোক এই টাকা সঙ্গে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে এসেছিলেন যে অমিত চুক্তিতে সই করবে। নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। যাঁরা বিখ্যাত লেখক, যাঁদের অনেক খ্যাতি, তাঁদের একটা গল্প সিনেমা করতে হলে কত টাকা দিতে হয় কে জানে। যাই হোক, লেখা শুরু করেই যে সে একটা গল্পের ছবি হবে বলে এক লাখ টাকা পাচ্ছে, এখনও ভাবতে পারছে না। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, ‘আমহার্স্ট্র স্ট্রিট কোন পথ দিয়ে ঢুকব বাবু?’

ঘোর কাটল। ড্রাইভারকে পথ বলে দিল সে।

মেসের ঘরে গিয়ে সে অভিনব দৃশ্যটা দেখল। তার রুমমেট নিজের তক্তাপোষের মাঝখানে পদ্মাসনে বসে আছেন চোখ বন্ধ করে। এর মানে, সে যখন ঘরে থাকে না তখন ভদ্রলোক এইসব করে থাকেন!

নিঃশব্দে নিজের তক্তাপোষের পাশে এসে পোশাক পরিবর্তন করতে করতে অমিত টাকাটার কথা ভাবল। কাল সকালের আগে ওটা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া যাবে না। এখন যদি টাকাগুলো স্যুটকেসে রাখে তাহলে তা তালাচাবি দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। টাকার প্যাকেটটা সে যে পাজামা এখন পরেছে তার পকেটে রেখে পাঞ্জাবি পরে নিল। বাইরে থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না তার পকেটে দশ হাজার টাকা আছে।

.

দু’দিন বাদেই খবরটা কাগজে বেরিয়ে গেল, ‘তরুণ লেখক অমিত মিত্রের গল্প ”পদ্মপাতায় জল” অবলম্বনে ছবি করছেন বিখ্যাত পরিচালক সুকুমার চ্যাটার্জি। আগামী মাসেই ছবির শ্যুটিং শুরু হবে।’

এই খবরের কল্যাণে স্কুলে বিখ্যাত হয়ে গেল সে। এর মধ্যেই অমিত ছাত্রদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এখন খবরটা তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিল।

মাথা থেকে সিনেমার ব্যাপারটাকে সরিয়ে গবেষণার কাজে স্কুল ছুটির পরে জাতীয় গ্রন্থাগারে যাতায়াত শুরু করেছিল অমিত। এক শনিবার গ্রন্থাগারে না গিয়ে মেসে ফিরে এসেছিল নতুন একটা লেখা তৈরি করার জন্যে। কাজের লোক ঘরে এসে জানাল, ‘একজন মহিলা আপনার খোঁজে আজ একবার এসেছিলেন, আবার এসেছেন। অফিসে কেউ নেই, ওখানেই বসাচ্ছি।’ বলেই চলে গেল লোকটা। ধরেই নিয়েছে, মহিলা যখন তখন অমিত নিশ্চয়ই দেখা করবে।

অবাক হয়ে গেল অমিত। তার কাছে কোনও পুরুষই আসে না, এই মহিলা এলেন কোত্থেকে! সেই স্কুলের ভিজিটার্স রুমে কখনও কোনও গার্জেন আসেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে। অবশ্য বাবা জ্যেঠারাই বেশি, মায়েরা বেশ কম। তাঁরা নিশ্চয়ই কলকাতার একেবারে উল্টোদিকে তার মেসে আসবে না দেখা করতে।

আবার পাজামা ছেড়ে প্যান্ট পরতে ইচ্ছে হল না। পাজামা এবং ঘরোয়া পাঞ্জাবি পরেই অমিত ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

অফিসঘরের দরজায় এসে অমিত দেখল অল্প বয়সি একটি যুবতী দেওয়ালে টাঙানো বিবেকানন্দের ছবি দেখছে। অমিত গলার শব্দ করে বলল, ‘বলুন!’

যুবতী ঘুরে দাঁড়ালে অমিত প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল। মাত্র একবার সে দেখেছে, তাও দু’তিন মিনিটের জন্যে। কিন্তু এই যুবতী মৃণাল ছাড়া অন্য কেউ নয়। কিন্তু মৃণাল জানবে কী করে সে এই মেসে এখন থাকে! তাহলে তারও ভুল হতে পারে।

‘মুখ দেখে বুঝতে পারছি আপনার চিনতে অসুবিধে হয়নি। ভালোই হল। নিজের পরিচয় নিজের গলায় বলতে হল না!’ গম্ভীর গলায় বলল যুবতী।

‘আপনি, আপনি বসুন।’ অমিত বলল।

‘আমি তো এখানে বসার জন্যে আসিনি।’

‘ও। মাসিমা কেমন আছেন?’

‘দেখুন, আমার মাসিমা আপনার মাসিমা কী করে হল ভগবান জানেন? হ্যাঁ, সবাই ভালো আছেন। আপনি তো আমার চরিত্র ভালো করার জন্যে ওঁর কাছে খবর পৌঁছে দেন। আশাকরি আমি এখানে এসেছি এই খবরটাও পৌঁছে দেবেন।’

‘না না। আমি ভেবে পাচ্ছি না আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি এই মেসে থাকি। এর ঠিকানা তো মাসিমাও জানেন না।’

‘তাই? আচ্ছা, বলুন তো, আপনি চালাক না ধূর্ত?’

‘এসব আপনি কেন বলছেন!’

‘কলকাতা শহরে একটা সূত্র পেলে ইচ্ছে হলে যে-কোনও মানুষের ঠিকানায় পৌঁছোনো যায় তা জানতেন না, এখন জানলেন। শুনুন, আপনার শ্রীমুখ দেখতে এখানে আসিনি।’

‘বলুন, কেন এসেছেন?’

‘কাগজে বেরিয়েছে আপনার গল্প ”পদ্মপাতায় জল” নিয়ে পরিচালক সুকুমার চ্যটার্জি সিনেমা তৈরি করতে যাচ্ছেন। সত্যি কথা তো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু—!’

‘আপনি পরিচালককে যদি বলেন ওঁর এই ছবিতে একটা ভালো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ দিতে। আমি অভিনয় করতে চাই।’

‘সেকি!’ চমকে উঠল অমিত।

‘মানে? কথাটার মনে আপনি বুঝতে পারেননি?’

‘তা পেরেছি। কিন্তু কোনও অনুশীলন ছাড়া, নিজেকে তৈরি না করে কি অভিনয় করা সম্ভব? একটু ভেবে দেখুন!’ অমিত বলল।

একটা হাত ওপরে তুলে মাথা নাড়ল মৃণাল, ‘আমাকে জ্ঞান দেবেন না, প্লিজ! শর্মিলা ঠাকুর ”অপুর সংসার” করার আগে অভিনয়ে অনুশীলন কি করেছিলেন? সবাইকে একই ফর্মুলায় ফেলা খুব খারাপ অভ্যেস!’

ঢোঁক গিলল অমিত। বললেন, ‘আপনি যে অভিনয় করতে চাইছেন তা আপনার মাসিমা, মা এবং বাবা জানেন? ওদের সম্মতি আছে?’

‘অদ্ভুত লোক তো আপনি! আমি একজন অ্যাডাল্ট।’ মাথা নাড়ল মৃণাল। ‘যেহেতু আপনার গল্প নিয়ে একজন নামকরা পরিচালক ছবি করছেন তাই—!’ বলতে বলতে থেমে গেল মৃণাল। অদ্ভুত চোখে অমিতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। তারপর বলল, ‘আপনি তো বেশিদিন আগে এম-এ পড়তেন না, তাই না? তখন কি আপনি লেখালেখি করতেন? অন্তত চর্চা করতেন? কোথাও কি আপনার লেখা ছাপা হয়েছিল ওই সময়?’

‘না।’ বলতে বাধ্য হল অমিত।

‘সেসময় আপনি রাস্তায় ঘুরে দেখতেন কোনও সুন্দরী মেয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েদের কাছে গিয়ে নাটক করে বলতেন, টু বি আর নট টুবি?’ হাসল মৃণাল।

আর ধৈর্য রাখতে পারল না অমিত। জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আমার কাছে এসেছেন সাহায্য চাইতে। অথচ আসার পর থেকে একের পর এক আক্রমণ করে চলেছেন! এটা কি উচিত হচ্ছে?’

‘উচিত?’ যেন অবাক হল মৃণাল, ‘আপনি যা করেছেন সেসব কি উচিত কাজ ছিল?’

‘আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আচ্ছা! আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার পেছনে আপনি গোয়েন্দাগিরি করতেন কেন? আমি পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে কী করছি তা আপনি মাসিমণিকে দেখিয়ে কী লাভ করেছেন? বলুন?’

‘উনি অনুরোধ করেছিলেন, তাই—।’

‘ভালো ছেলে মাসিমণির সেবা করতে লেগে পড়লেন। একটা গোবেচারা ভালোমানুষ ছেলের গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দেওয়ার পর চৈতন্য হল আপনার। সহ্য করতে না পেরে কলকাতা থেকে পালালেন। আমার সর্বনাশ করার জন্যে যা যা দরকার তা আপনি করেছেন। চমৎকার! যাক গে, এসব বলতে আমি এখানে অসিনি! কাগজে দেখলাম আপনি গল্প লিখতে শুরু করেছেন। একেবারে জীবন থেকে নেওয়া গল্প! তারপর দেখলাম আপনার গল্পের সিনেমা হচ্ছে। তাই বলছি অনেক উপকার করেছেন, এবার একটু অপকার করুন।’ হাসল মৃণাল।

‘অপকার?’

‘ওঠাতে না বলে নামাতে বলছি। সিনেমায় নামানো। সিনেমায় নামানো তো এখনও ভদ্র বাঙালি উপকার বলে না।’

‘দেখুন, আমি পরিচালক ছাড়া কাউকে চিনি না।’

‘আশ্চর্য! মিথ্যে কথা কেন বলছেন? একজন লেখককে এটা মানায় না! আপনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় না করেই পরিচালক খবরের কাগজকে বলে দিলেন?’

‘ওহো! একদিনই কথা হয়েছিল। উনি এসে কথা বলে চুক্তিপত্রে সই করে, অগ্রিম টাকা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।’

‘তার বেশি কী করবেন? আপনার যদি আমাকে সাহায্য করার ইচ্ছে না থাকে তাহলে সরাসরি সেটা বলতে পারছেন না কেন?’

‘আমি বললেই পরিচালক আপনাকে কাজ দিতে নাও পারেন।’

‘হতেই পারে। আমাকে তো একটার পর একটা ধাক্কা খেতে হচ্ছে, নাহয় আর একটা ধাক্কা খাব।’

‘বেশ। আপনি বসুন, আমি আমার ঘর থেকে লিখে নিয়ে আসছি চিঠিটা। বেশি দেরি হবে না।’

‘এখানে তো আপনি একাই থাকেন!’

‘হ্যাঁ। এটা মেসবাড়ি।’

‘বউ কোথায় থাকে? কুচবিহারে?’

চমকে তাকাল অমিত। তার বাড়ি যে কুচবিহার সেই খবর মৃণাল জানল কী করে! সে হেসে বলল, ‘তিনি কোথায় এখন আছেন তা জানি না, তবে কুচবিহারে এখনও পৌঁছতে পারেননি। বসুন, আমি আসছি।’

ঘরে গিয়ে একটা সাদা খাতার কাগজ ছিঁড়ে অমিত লিখল, ‘শ্রীযুক্ত সুকুমার চ্যাটার্জি, চলচ্চিত্র পরিচালক, শ্রদ্ধাভাজনেষু। পত্রবাহিকার পরিবার আমার পরিচিত। উনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে চাইছেন। আপনার ছবির কোনও চরিত্রে যদি ওকে আপনি উপযুক্ত মনে করেন তাহলে সুযোগ দিলে ভালো লাগবে। আশাকরি, আপনাকে বিব্রত করলাম না। বিনীত, অমিত্র মিত্র।’ তারপর চুক্তিপত্র বের করে তা থেকে সুকুমার বাবুর ঠিকানা নিয়ে নীচে লিখে দিল।

তার কাছে কোনও সাদা খাম নেই। বাধ্য হয়ে কাগজটি ভাঁজ করে সযত্নে অমিত ঘরে এসে দেখল মৃণাল তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অমিত বলল, ‘আমার কাছে কোনও খাম নেই। অনুগ্রহ করে একটা খামে এই চিঠি ভরে ওঁকে দিলে ভালো হয়। ঠিকানা নীচে লেখা আছে।’

‘অনেক ধন্যবাদ।’

‘ওহো, ওঁর ফোন নাম্বারটা—।’

‘আমি জানি।’ ঘড়ি দেখল মৃণাল, ‘আমি যে আপনার কাছে এই কারণে এসেছি তা মাসিমাকে কবে বলবেন?’

‘ওঁর সঙ্গে তো অনেকদিন যোগাযোগ নেই।’

‘তাতে কী? এখন তো খবরটা দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।’

‘উনি জিজ্ঞাসা না করলে আমি যেচে আপনার কথা বলব না।’ একটু থেমে অমিত বলল, ‘পরিচালক কী বললেন জানালে ভালো হত।’

‘উনি যদি সুযোগ দেন তাহলে ছবি দেখতে গিয়ে তো আমাকে দেখতেই পাবেন। আচ্ছা, এলাম।’ জোরে জোরে পা ফেলে বেরিয়ে গেল মৃণাল।

অমিতের মনে হল একবার, মৃণালকে অনুসরণ করলে হয়। ও একা এসেছিল, না সঙ্গে যে এসেছিল সে একটু দূরে অপেক্ষা করছে। তারপরেই ভাবনাটা বাতিল করল। জেনে কী হবে! এটা তো মৃণালের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি সঙ্গে এসেও থাকে তাহলে তার কী এসে যায়?

দিন সাতেক পরে মেসের ঠিকানায় সুকুমার চ্যাটার্জির চিঠি নিয়ে এল একজন প্রোডাকশনের কর্মী। সুকুমারবাবু লিখেছেন, ‘আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা সবসময় সম্ভব হচ্ছে না। যদি আপনি একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাহলে ভালো হয়। পত্রবাহকের হাতে আমি একটি স্বল্পমূল্যের ফোন পাঠালাম। আপাতত এটিকে গ্রহণ করতে পারেন।

দ্বিতীয়, আপনার চিঠি নিয়ে মৃণাল আমার কাছে এসেছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে ভালোই লেগেছে। আগামী সোমবার তার একটা স্ক্রিন টেস্ট নেব। দেখা যাক। শুভেচ্ছা সহ—!

লোকটি তার পকেট থেকে ছোটখাটো একটা মোবাইল ফোন আর চার্জার বের করে এগিয়ে দিল। অমিত বলল, ‘ওঁকে আমার ধন্যবাদ দেবেন।’

লোকটি চলে গেলে মোবাইলের ওপর লেখা নাম্বারটা কয়েকবার চোখ বোলাতেই মুখস্থ হয়ে গেল। অমিত দেখল মোবাইলে ফুল চার্জ দেওয়াই আছে। বোতাম টিপে সে দেখতে পেল সুকুমারবাবুর নাম এবং মোবাইল নাম্বার লেখা আছে। আর কোনও নাম নেই।

সে নাম্বারটায় চাপ দিতেই রিং-এর আওয়াজ কানে এল। তারপর সুকুমারবাবুর গলা শুনল, ‘হ্যালো!’

‘নমস্কার। আমি অমিত মিত্র বলছি। ফোনটা পেয়েছি। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব আমি জানি না। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এর দাম কত বললে খুব ভালো হয়!’ অমিত বলল।

হাসলেন সুকুমারবাবু, ‘ওটার দাম কত আমি জানি না। একজন ভক্ত ওটা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমি কী করে আপনার কাছ থেকে দাম নেব! এসব নিয়ে ভাববেন না। হ্যাঁ, সামনের সাতাশ তারিখ হল রবিবার। সেদিন দুপুর দুটোয় আমার বাড়িতে স্ক্রিপ্ট পড়া হবে। আমার ইচ্ছে আপনাকে শোনাতে। আসবেন?’

‘নিশ্চয়ই।’ উৎসাহের সঙ্গে বলল অমিত।

‘ঠিক আছে। আমার সহকারীরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। ছবির জন্যে যেটুকু গল্পের বদল করা দরকার তার বেশি কিছু করিনি। আচ্ছা ভাই, রাখলাম।’ সুকুমারবাবু কথা শেষ করলেন।

একটু ক্ষুণ্ণ হল অমিত। মৃণাল যে তার চিঠি নিয়ে সুকুমারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তিনি ওর টেস্ট নিচ্ছেন, এসব কথা তাকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেনি! অদ্ভুত মেয়ে। এমনভাবে সেদিন কথা বলছিল যেন শেষ কথা সে-ই বলছে। আচরণেও তাই বোঝাল। সেই বাসস্টপে দাঁড়ানো ভীরু মেয়েটির কী পরিবর্তন!

.

সকালে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করা। দিনগুলো যেন হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। একদিন সকালে সুকুমারবাবুর দেওয়া মোবাইল বেজে উঠতেই তড়িঘড়ি সেটাকে থামিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল অমিত। তার রুমমেট দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিল, শব্দটা কানে যেতে অত্যন্ত বিরক্তমুখে উঠে বসলেন।

ভিতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানান দিল অমিত। ওপাশ থেকে একজন কথা বলল, ‘নমস্কার। অমিতবাবু বলছেন?’

‘হ্যাঁ বলছি।’

‘আমি সুকুমারদার অ্যাসিস্টেন্ট। আগামী কাল দুপুর ঠিক দুটোর সময় সুকুমারদার বাড়িতে আমাদের আগামী ছবির চিত্রনাট্য পড়া হবে। সুকুমারদা জানাতে বললেন, আপনি কি নিজেই আসতে পারবেন না আমরা গাড়ি পাঠাব?’

‘উনি তো গড়িয়াহাটে থাকেন জানি, ঠিকানাটা যদি বলেন—?’

ছেলেটি সুকুমারবাবুর ঠিকানা বলল। অমিত মাথা নাড়ল, ‘কোনও অসুবিধে নেই। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব, গাড়ি পাঠাতে হবে না।’

ফোন বন্ধ করে ঘরে ফিরে অমিত দেখল তার রুমমেট আবার ওপাশের দেওয়ালের দিকে মুখ করে আগের মতো শুয়ে পড়েছেন। এরকম মানুষকে অদ্ভুত বললে কমা হয়। ওর মনে হল এই লোকটিকে নিয়ে সে একটি ছোট গল্প লিখবে।

শনিবারের রাত্রে তার মোবাইল ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে বসেছিল অমিত। এইসময় বাস একদমই ফাঁকা থাকে। নাম্বার অচেনা। নিশ্চয়ই সুকুমারবাবুর কোনও সহকারী। হয়তো আগামীকাল চিত্রনাট্য পড়া হবে না, সেকথাই জানাতে ফোন করছে।

সে হ্যালো বলতেই মহিলার গলা কানে এল, ‘আমি কি অমিতের সঙ্গে—!’

‘হ্যাঁ, আপনি?’ বলেই গলার স্বর চিনতে পারল অমিত। বেশ জোরেই বলে উঠল, ‘আরে! মাসিমা, আপনি?’

‘ও, চিনতে পেরেছ তাহলে! তুমি যে মোবাইল ফোন নিয়েছ তা আমাকে জানাবার দরকার আছে বলে মনে করোনি!’ মাসিমার গলায় অভিমান।

‘আমি মাত্র কয়েকদিন আগে পেয়েছি। একজন, এক চলচ্চিত্র পরিচালক এটি আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। কাউকে জানাবার সময় পাইনি। আপনি এর নাম্বার কার কাছে পেলেন?’

‘যে ভদ্রলোক তোমার গল্পের সিনেমা করছেন, তিনিই দিয়েছেন।’

‘সেকি!’ অবাক হয়ে গেল অমিত, ‘সুকুমারবাবু সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে! কিন্তু একথা তো মৃণাল সেদিন বলেনি।’

‘মৃণাল জানে না। শোন অমিত, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা বলা দরকার। এখন রাত প্রায় সাড়ে সাতটা। কোথায় দেখা করবে বলো?’

‘আপনি আজই দেখা করতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ। আজই।’

‘তাহলে আমি আধঘণ্টার মধ্যে আপনার ওখানে যাচ্ছি।’ অমিত বলল। কী হয়েছে সে বুঝতে পারছিল না।

.

দরজা খুললেন মাসিমা। বললেন, ‘এসো।’

ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল অমিত। মৃণালের মা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। সে হাতজোড় করে দুজনকেই নমস্কার করল। মৃণালের মায়ের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

মাসিমা বললেন, ‘সবাই বলছে তুমি প্রতিশোধ নিচ্ছ?’

‘প্রতিশোধ? কীসের প্রতিশোধ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘সেই যে তুমি মৃণালের পেছনে লেগেছিলে, ওর কলেজের বাইরে গায়ে পড়ে কথা বলতে গিয়েছিলে, পাত্তা পাওনি বলে ওর ক্ষতি করে যাচ্ছ একের পর এক। কেন এমন করছ বাবা? আমি তো ভালো মনে তোমাকে গ্রহণ করেছিলাম।’ মাসিমা কথা শেষ করতে মৃণালের মা বললেন, ‘দুধ দিয়ে কলসাপ পুষেছিলে!’

মাসিমা বললেন, ‘অমিত তুমি বসো।’

‘কী হয়েছে বলুন তো?’ অমিত চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করল।

‘একথা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, তোমার গল্প নিয়ে যে সিনেমা হচ্ছে, তাতে অভিনয় করার জন্যে তুমি মৃণালের নাম সুপারিশ করেছ?’ মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন। ‘সিনেমা লাইনে যে মেয়েরা ঢোকে তাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়। তুমি ভালো করেই জানো ওর সেসবের বালাই নেই। তবু করেছ। কেন?’ এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মৃণালের মা প্রশ্ন করলেন।

‘আমি কথাটা বুঝতে পারছি না।’ অমিত অবাক হয়ে বলল।

‘বুঝতে পারছ না? নিজের কীসে ভালো হবে তা জানলে কোনও মেয়ে বাজে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পার্কে বসে সিগারেট খেতে যায়? তুমি তা ভালো করেই জানো।

‘দেখুন, আমি মৃণালকে সিনেমায় নামতে উৎসাহ দিইনি। তাছাড়া ওকে আমি কলেজের সামনে মাত্র দু’মিনিটের জন্যে দেখেছিলাম। তারপর এই ক’দিন আগে সে আমার মেসে এসে উপস্থিত হল।’

‘তুমি ওকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে পরিচালককে চিঠি লিখে অনুরোধ করোনি? এটা নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা নয়।’ মাসিমা জানতে চাইলেন।

‘না, নয়। মৃণাল আমার মেসে এসে ওটা করতে বলেছিল।’

‘কেউ যদি বলে তাকে বিষ দিতে তাহলে তুমি তাকে বিষ দেবে?’

‘এসব আপনি কী বলছেন?’

‘ঠিকই বলছি। আমাদের ঘরের মেয়ে সিনেমায় অভিনয় করছে, ওর শ্বশুরবাড়িতে কী জবাব দেব?’ মাসিমা বললেন, ‘ওকে সুপারিশের চিঠি দেওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বললে না কেন?’

‘দেখুন, মৃণাল প্রাপ্তবয়স্ক। ও যেরকম করে কথা বলছিল তাতে বোঝাচ্ছিল সিনেমায় সে অভিনয় করবেই। তাছাড়া ওর স্ক্রিনটেস্ট হবে আর তারপর পরিচালক সিদ্ধান্ত নেবেন ও অভিনয় করবে কি না! এখনই ধরে নিচ্ছেন কেন ও অভিনয় করবে?’ অমিত বলল।

মৃণালের মা বললেন, ‘আমি কিছু জানি না। পরিচালককে বলতে হবে ওকে যেন সিনেমায় চান্স না দেন। এটা বন্ধ করতেই হবে।’

‘শুনলে?’ মাসিমা বললেন, ‘এই উপকারটুকু করো বাবা। ও যদি কোনও ভালো ছেলেকে পছন্দ করত তাহলে আমি দাঁড়িয়ে থেকে আবার ওর বিয়ে দিতাম। দ্যাখো অমিত, আমরা চাই ওর জীবনে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে কিন্তু যা হবে তা যেন সুস্থ স্বাভাবিকভাবে হয়।’

কয়েক সেকেন্ড ভাবল অমিত। সুকুমারবাবুকে বলতে হবে, যে মেয়েটিকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম তা দেওয়ার দরকার নেই।

মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন। ‘কী ভাবছ তুমি?’

‘পরিচালককে কীভাবে কথাটা বলা যায় তাই ভাবছি।’ উঠে দাঁড়াল অমিত। ‘আপনাদের এই ইচ্ছের কথা মৃণাল জানে?’ অমিত প্রশ্ন করল।

মৃণালের মা রেগে গেলেন, ‘এই যে শোন, আমি মৃণালের মা, ও ওর মাসিমা। আমরা ওর ভালো যা বুঝি তা ও নিজেই বোঝে না।’

‘বেশ। আমি আসছি।’ বলেই তার খেয়াল হল, ‘আচ্ছা, আপনারা আমার মোবাইল নাম্বার কোথায় পেলেন?’

‘সুকুমারবাবু দিয়েছেন?’ মাসিমা বলল।

‘সেকি! ওঁকে এসব কথা বলেছেন নাকি?’

‘তুমি আমাকে কী ভাবো? ঘরের কেচ্ছার কথা বাইরে বলে বেড়াব?’ মাসিমা বললেন, ‘ওঁকে বললাম আমরা তোমার লেখার ভক্ত তাই আলাপ করতে চাই। তখন উনি এই মোবাইল নাম্বারটা দিলেন।’

অমিত আর দাঁড়াল না।

কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছিল না কীভাবে মাসিমার কথা রাখা যায়! আজ মৃণালের মা তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছেন। কী করা যায়! হঠাৎ তার মনে হল, সে কেন এত ভাবছে? মৃণাল একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা। সে যা ভালো বোঝে তাই তাকে করতে দেওয়া উচিত। যদি সেই কাজের ফল খারাপ হয় তাহলে সেটা সে-ই ভোগ করবে। সিনেমায় না অভিনয় করতে নিশ্চয়ই ওর বাড়ি থেকে অনেক বোঝানো হয়েছে। সেসব কথা মৃণাল নিশ্চয়ই শুনতে চায়নি। তার পক্ষে মৃণালকে নিষেধ করা সম্ভব নয়। আর সে এখন সুকুমারবাবুকে কী করে বলবে পছন্দ হলেও মৃণালকে কাস্ট করবেন না।

অমিত স্থির করল, মৃণালের ব্যাপারে সে নাক গলাবে না।

.

রবিবার ঠিক দুটো বাজতে দশ মিনিটে অমিত সুকুমারবাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেল। অনেকেই এসে গিয়েছিলেন। সুকুমারবাবু তাঁদের সঙ্গে অমিতের আলাপ করিয়ে দিলেন। এঁরা কেউ বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান, কেউ এডিটার, প্রধান সহকারী পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক। ঠিক দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট আগে চলে এলেন বাংলা সিনেমার এক তরুণ নায়ক যাঁর এর মধ্যেই বেশ ভালো পরিচিতি হয়েছে।

পরিচালক সহকারীকে পড়তে বললেন। সহকারী চিত্রনাট্য পড়া শুরু করলেন। অমিতের মনে হল সে চোখের সামনে চরিত্রগুলোকে দেখতে পাচ্ছে।

টানা দেড়ঘণ্টা ধরে চিত্রনাট্যটি পড়া হল। মাঝের কিছু অংশ যা মূল গল্পে নেই তা চিত্রনাট্যে রয়েছে। মনে খুঁতখুঁতানি এসেছিল কিন্তু পরে অমিতের মনে হল গল্প যা লেখক লেখেন, কাগজে তাই ছাপা হয়, পাঠক পড়েন। সেই গল্প তো হুবহু সেলুলয়েডে ছাপা যায় না। নায়ক বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে চলে এল, একথা এক লাইনে লেখা যায়। কিন্তু স্টেশনে আসার পথে কোনও ঘটনা যদি পরিচালক সংযোজন করেন যা গল্পের বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করে তাহলে আপত্তি করার কী আছে!

চিত্রনাট্য পড়া শেষ হলে পরিচালক কথা বললেন, ‘আমরা এতক্ষণ চিত্রনাট্যটি শুনলাম। এখন আপনাদের অভিমত আমি জানতে চাই।’

প্রথমে কেউ কিছু বলছিলেন না। কিন্তু যেই একজন শুরু করলেন তখন সবাই মুখ খুললেন। সবাই স্বীকার করলেন, খুব জমজমাট চিত্রনাট্য হয়েছে। এটা না থাকলে বোধহয় আর একটু গতি বাড়ত। একজন বললেন, ‘ছবির শেষদিকে একটু যেন স্লো।’ এইসব কথা স্তিমিত হয়ে এলে সুকুমারবাবু বললেন, ‘এবার আমরা লেখকের কথা শুনতে আগ্রহী। বলুন অমিতবাবু।’

অমিত হাসল। বলল, ‘সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র একদম পৃথক দুটি মাধ্যম। এখানে গল্প থেকে চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। রুটি বা পরোটা তো আটা থেকেই তৈরি হয়। কিন্তু পরোটার মধ্যে শুকনো আটা যারা খোঁজেন তারা—।’ কথা শেষ না করে হাসল অমিত।

সঙ্গে সঙ্গে সুকুমারবাবু বললেন, ‘চমৎকার, চমৎকার বলেছেন!’ তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুনে কেমন লাগল?’

‘আমার তো কোনও অভিজ্ঞতা নেই, ছবি দেখে বলব কেমন লেগেছে।’ খুব সাধারণ গলায় কথাগুলো বলল অমিত।

‘সাধারণত, অনেক লেখকই চান তাঁর লেখা নিয়ে ছবি হোক। কিন্তু ছবি হওয়ার পরে তাঁদের বেশিরভাগেরই মনে হয় গল্পটা অনুসরণ করা হয়নি। তাঁরা ভুলে যান, দুটো মিডিয়া একদম আলাদা। আপনাকে ধন্যবাদ।’ বললেন সুকুমার। সবাই একমত হল। তারপর চা পানের পর্ব মিটে গেলে সবাই যে যার গন্তব্যে ফিরে গেলেন। অমিত যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু পরিচালক বললেন, ‘আপনার সঙ্গে এই ছবির প্রযোজকের আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি সূর্যশেখর দত্ত, ছবিটি প্রযোজনা করছেন।’

অমিত দেখল ভদ্রলোক করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ালেন। সেই পর্ব শেষ হলে সূর্যশেখর বললেন, ‘আপনার কাছে আরও লেখা আমরা আশা করছি। ও হ্যাঁ, এটা রাখুন।’

একটা খাম এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।

‘কী ব্যাপার?’ অবাক হল অমিত।

‘অগ্রিম আর ট্যাক্স বাদ দিয়ে বাকি টাকার চেক। এখানে একটা সই করে দিলে হবে।’ একটা কাগজ এবং কলম ভদ্রলোক দিলে অমিত সই করে দিল।

এখন ঘরে পরিচালক, প্রযোজক এবং সহকারী পরিচালক এবং অমিত ছাড়া কেউ নেই।

অনেকক্ষণ থেকেই মনে আসছিল, কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছিল না অমিত। যতই সে স্থির করে আসুক নাক গলাবে না তবু মৃণালের মাসিমার মুখটা মনে পড়ছিল। এতকাল ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই কথাও তো ফেলতে পারছে না।

‘কিছু বলবেন?’ সুকুমার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ। আমি একজন মহিলাকে চিঠি দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম—।’

হাত তুলে অমিতকে থামতে বললেন সুকুমার। তারপর বললেন, ‘সেই মহিলা এসেছিলেন। আমি এসব দায়িত্ব সাধারণত সহকারীদের ওপর দিয়ে দিই। কিন্তু আপনার চিঠির জন্যে ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল একটা সুযোগ দেওয়ার আগে পরীক্ষা করাই যেতে পারে। বলার ধরন বেশ ভালো।’ বলেই সুকুমার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েটি বলল আপনি ওর মাসিমার দিকের আত্মীয়। তাই?’

হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল অমিত। মাথা নাড়ল। যার দুটো অর্থই হয়।

‘খুব ভালো। মেয়েটির স্ক্রিনটেস্ট নেওয়া হলে আমাদের বেশ ভালো লেগেছে। ওকে ছবিতে কাজ দেব বলে স্থির করেছি। তবে প্রথম ছবিতেই নায়িকার ভূমিকায় ওকে টেস্ট না করে অর্পনার চরিত্রে ভেবেছি। কাজ করার ভালো সুযোগ আছে। আমি ওর সঙ্গে পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কোনও কথা বলিনি। আপনার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নেব ভেবেছি।’ সুকুমার বললেন।

মাথা নাড়ল অমিত, ‘আপনার ছবিতে কাজ করে ও যা পারিশ্রমিক পাবে তা আমার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা সঙ্গত হবে না। এই ব্যাপারটা আমি একদম বুঝি না। আর একটা কথা, আমি কিন্তু মেয়েটির অভিভাবক নই।’

‘ও। তাহলে—!’

‘এই ব্যাপারটা নিয়ে ওর সঙ্গেই কথা বললে ভালো হয়।’

.

সুকুমারবাবু অমিতের আপত্তি শুনতে চাইলেন না, তাঁর গাড়ি ওকে আমহার্স্ট্র স্ট্রিটে পৌঁছে দিল। ঘরে ঢুকে দেখল তার রুমমেট শীর্ষাসন করছেন। তার ব্যাঙ্ক সন্ধে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ে ব্যাঙ্ক তাকে যে চেক বই দিয়েছিল তার একটা পাতায় যা যা লেখার তা লিখে চেকটাকে আলপিন দিয়ে আটকে মেসের বাইরে পা বাড়াল সে। তার ব্যাঙ্ক বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। আশি হাজার টাকার চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিলে একটা ঝামেলা দূর হয়।

ফুটপাত দিয়ে সে যখন হাঁটছিল ঠিক তখন তার পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ওটা বের করে কানে চাপতেই মৃণালের গলা শুনতে পেল সে।’ অনেক ধন্যবাদ।’

‘কী জন্যে?’

‘ইচ্ছে করলেই মাসিমার হয়ে ওকালতি করতে পারতেন, সেটা করেননি। তাহলে আমি আপনার গল্পের একটা চরিত্র হচ্ছি। এবার মাসিমা আপনাকে খারাপ চোখে দেখবেন। কী করা যাবে! রাখছি।’ লাইন কেটে দিল মৃণাল।

.

শ্যুটিং যেদিন হবে তার আগের দিন সুকুমারবাবু ফোন করেছিলেন, ‘আগামী কাল এন টি ওয়ানের স্টুডিয়োতে কাজ শুরু করছি। আপনি এলে ভালো লাগবে।’

বিপাকে পড়ল অমিত। আগামীকাল স্কুলের সিনিয়ার ক্লাসগুলোর বাংলা বাৎসরিক পরীক্ষা। তাকে বিকেল চারটে পর্যন্ত স্কুলে থাকতেই হবে। কিন্তু তার গল্পের প্রথম ছবির শুরুর দিনটায় উপস্থিত থাকার ইচ্ছে এত প্রবল হয়ে উঠল যে, অমিত স্থির করল ঘণ্টা দেড়েকের ছুটি নিয়ে সে স্টুডিয়োতে যাবে, কিছুক্ষণ শ্যুটিং দেখেই স্কুলে ফিরে যাবে। সে যদি হেডমাস্টারকে ব্যাপারটা বলে তাহলে নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। ভদ্রলোক একেবারেই প্রাচীনপন্থী নন।

কিন্তু সে যখন তৈরি হয়ে মেস থেকে বের হচ্ছে তখন তার ফোন জানান দিয়ে উঠল, নাম দেখে অবাক হল। ফোন অন করে সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আজ আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। আপনার সৌজন্যে আমি আজ নতুন জীবনের দিকে এগোচ্ছি। আমার নমস্কার নেবেন।’ স্পষ্ট বাংলায় বলল মৃণাল। বলেই লাইন কেটে দিল, যেন সব কথা তার বলা হয়ে গেছে।

স্কুলে যেতে যেতে অমিত ভাবনার বদল করল। না, সে আজ শ্যুটিং দেখতে যাবে না। অবশ্য আজই মৃণালের কাজ আছে কি না তা জানা নেই। না থাকলেও সে উপস্থিত থাকতেই পারে। ওদের পারিবারিক সমস্যার মধ্যে সে আর জড়াতে চায় না। এমনিতেই হেডমাস্টারের অনুমতি নিয়ে শ্যুটিং দেখতে যাওয়ার জন্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছিল। না গেলে হেডমাস্টারের অনুমতি নিতে হবে না, পরীক্ষার সময় ছেলেদের পাশেই থাকা যাবে।

স্কুলে পৌঁছে অমিত সুকুমারবাবুকে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করল। যেহেতু আজ ছেলেদের বাৎসরিক পরীক্ষা তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে যেতে পারছে না। কিন্তু ছবির জন্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।

.

মাঝে-মাঝেই বিভিন্ন কাগজে সুকুমারবাবুর সিনেমার সংবাদ ছাপা হতে দেখেছে অমিত। কিন্তু পরিচিত নায়ক নায়িকার নামের সঙ্গে সে মৃণালের নাম দেখতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একটি বিখ্যাত দৈনিকের সিনেমার পাতায় এই ছবির নায়ক-নায়িকা এবং মহানায়িকার যে ছবি ছাপা হল তা দেখে অবাক হয়ে গেল সে। ছবির ক্যাপশনে মৃণালের বদলে লেখা হয়েছে, নবাগতা অমৃতা। অর্থাৎ মৃণাল সিনেমার অভিনেত্রী হতে গিয়ে নিজের নাম বদল করেছে। তা সে করতেই পারে কিন্তু এত নাম থাকতে অমৃতা কেন? ইচ্ছে করে অমিতকে বিব্রত করতে?

এসব ব্যাপার থেকে মন সরিয়ে অমিত তার গবেষণার কাজে মন দিল। খুব ভালো এগোচ্ছে কাজটা। অধ্যাপকও খুশি। অমিতের লেখা গল্প নিয়ে ছবি হচ্ছে জেনে ভদ্রলোক খুশি হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বলেছিলেন ‘লোক তোমার গল্পের চিত্ররূপ দেখবে এটুকু খুব আনন্দের। আবার যদি ছবি ভালো না হয় তাহলে কিন্তু দোষ দেবে তোমাকেই। বলবে, ওই গল্পটাই ভালো ছিল না। আর যদি ছবি সফল হয় তাহলে পরিচালকের নামই হবে। ব্যাপারটা খুব সাময়িক, এটা মনে রেখো।’

এইসব কথা শোনার পর মাথা থেকে শ্যুটিং দেখার আগ্রহ চলে গেল। এমনকী ওঁরা যখন আউটডোরে শ্যুট করতে কুচবিহারে গেলেন তখন আমন্ত্রিত হয়েও এড়িয়ে গেল সে। তার ফলে বাবার চিঠি এল। বাবা লিখলেন, ‘আমি সবাইকে বলেছিলাম তুমি যে গল্প লিখেছ সেটা সিনেমা হচ্ছে। তাই সেই সিনেমার লোকজন কুচবিহারের রাস্তায়, রাজবাড়ির সামনে যখন ছবি তুলছিল তখন সবাই তোমার খোঁজ করছিল। তুমি আসোনি তাই এই সিনেমার গল্প সত্যি তোমার রচনা কিনা তাতে সবাই সন্দেহ প্রকাশ করছিল। আমার মুখ রক্ষা করলেন এই সিনেমার একজন অভিনেত্রী যিনি শ্যুটিং করতে দলের সঙ্গে এসেছিলেন। অমৃতা বাড়িতে এসে আমার এবং তোমার মায়ের আশীর্বাদ প্রণাম করে নিয়ে গেছে। শুনলাম মেয়েটি এই প্রথম সিনেমায় নেমেছে তাই এখনও অহঙ্কারী হয়নি। যা হোক, সে আমার বাড়িতে আসায় কুচবিহারের মানুষ বিশ্বাস করেছে সিনেমার গল্প তোমার লেখা।

চিঠি পড়ে অবাক হল অমিত। মৃণাল শ্যুটিং করতে দলের সঙ্গে কুচবিহারে যেতেই পারে কিন্তু তার বাড়িতে যাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। এটা যেন ইচ্ছে করেই তাকে খোঁচা দেওয়া। বাবা লেখেনি, তাই জানা যাচ্ছে না, কুচবিহারের বাড়িতে গিয়ে মৃণাল তাকে নিয়ে কোনও গল্প তৈরি করে বলেছে কিনা। আর কিছু নয়, শুধু ওর কলেজের সামনে বাসস্টপে সে গায়ে পড়ে কথা বলতে গিয়েছিল কয়েকবছর আগে এই কথা যদি কুচবিহারের বাড়িতে জানিয়ে দিয়ে আসে তাহলে বাবা আর কখনই তার মুখ দেখবেন না। কিন্তু বাবা এই যে চিঠিটা লিখেছেন তা পড়ে মনে হচ্ছে মৃণাল তার সম্পর্কে বিরূপ কথা বলে আসেনি।

শ্যুটিং-এর পরে দল ফিরে এসেছিল কলকাতায়। মৃণাল আর তাকে ফোন করেনি। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল অমিত। কিছুদিন পরে সকালে ফোন এল সুকুমারবাবুর। বললেন, ‘কী ভাই, চিত্রনাট্য যে পছন্দ হয়নি তা নীরব থেকে বুঝিয়ে দিলেন!’

‘না, না, একথা কেন বলছেন?’ অস্বস্তিতে পড়ল অমিত।

‘তাহলে অন্তত একদিন শ্যুটিং দেখতে তো আসতে পারতেন। যাক, ছবি তো তৈরি হয়ে গেছে। সামনের মাসে মুক্তি পাবে। তবে তার আগে আমরা একটা ক্লোজডোর শো করাচ্ছি। এসে দেখে বলুন কী রকম লাগল।’ পরিচালক বললেন। শো কোথায় কখন হচ্ছে জেনে নিয়ে অমিত জানিয়ে দিল, সে যাবে।

কিন্তু শো-এর আগের দিন মনে হল, ওখানে তো মৃণাল থাকবে। সে যদি কুচবিহারে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারে তাহলে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে? সে তখন কী করে এড়িয়ে যাবে ওকে; সেটা করলে আর কারও না হোক সুকুমারবাবুর চোখে তো পড়বেই। শেষপর্যন্ত অমিত ঠিক করল সে মৃণালকে দেখেও না দেখার ভান করবে। মুখোমুখি হলে, এড়াতে না পারলে দেঁতো হাসি হাসবে। এইটুকু।

ধর্মতলার একটি বড় সিনেমা হলের ওপরে যে একটি প্রজেকশন রুম আছে তা জানা ছিল না অমিতের। পরিচালক মশাই তাকে দেখে এগিয়ে এসে হাত ধরে নিজের আসনের পাশের আসনে বসালেন। ইচ্ছে করেই অমিতকে স্বস্তি দিয়ে ছবি শুরু হল। সুকুমারবাবুর মুন্সিয়ানা স্বীকার করতেই হয়। মাঝে মাঝে যেখানে তিনি মৃদু গল্পের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন সেখানে সেটা জোর করে বানানো বলে মনে হচ্ছিল না। ছবি শেষ হলে সবাই যখন সোৎসাহে হাততালি দিচ্ছিল তখন সুকুমারবাবু অমিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন?’

ভদ্রলোক ডান হাত চেপে ধরে অমিত বলল, ‘খুব উপভোগ করলাম!’

‘আপনার গল্পের অমর্যাদা করিনি তো?’

‘আমার তো মনে হয়নি।’

‘ব্যস। এর চেয়ে বেশি আমি কিছু চাই না।’ খুশি হলেন সুকুমারবাবু। তারপর তিনি মঞ্চে উঠলেন। সীমিত দর্শক সত্ত্বেও উচ্ছ্বাসের যেন বন্যা বইল। হাত ওপরে তুলে সবাইকে শান্ত করে পরিচালক বললেন, ‘এই ছবি তৈরি করতে যাঁরা আমাকে সাহায্য করেছেন তাঁদের আমি মঞ্চে আহ্বান করছি। এই ছবি তৈরি করা সম্ভব হত না যদি এর কাহিনি শ্রীঅমিত মিত্র না লিখতেন। অমিতবাবু তরুণ লেখক, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’ হাত তুলে নমস্কার করলে দর্শকরা অমিতকে আবার অভিনন্দন জানালেন। এক এক করে নায়ক, নাকিয়া এবং বিভিন্ন কলাকুশলীদের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিলেন পরিচালক। অমিত অবাক হয়ে দেখল মঞ্চে মৃণাল উঠে আসেনি। শিল্পীদের সঙ্গেও তাকে দেখা যায়নি।

পরিচয় পর্ব শেষ হলে পরিচালক এগিয়ে এলেন অমিতের কাছে। ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন মৃণালের ঠিক কী হয়েছে?’

‘কেন? ও কি আজ আসেনি?’ জিজ্ঞাসা করল অমিত।

‘না। এলে সে নিশ্চয়ই মঞ্চে পরিচয়-পর্বে উঠে আসত। সে গতকাল ফোন করে জানিয়েছে শরীর খারাপ হওয়ায় আজ আসতে পারবে না। ব্যস্ততার জন্যে ওর খবর নেওয়া হয়নি। তাহলে আপনার কিছুই জানা নেই!’

মাথা নেড়ে না বলল অমিত।

জীবনের প্রথম ছবি, যে ছবিতে কাজ করার জন্যে মৃণাল মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এমনকী অসুস্থ হয়ে পড়ল যে আজ থাকতে পারল না! পরিচালক তো ভাবতেই পারেন, যে মহিলাকে অমিত সুপারিশ করেছিল তার কোনও খবরই সে রাখে না। ছবিতে মৃণাল যা অভিনয় করেছে তাতে মনেই হয়নি ও প্রথম ছবিতে কাজ করেছে। বোঝাই যাচ্ছিল, পরের ছবিতেই মৃণাল নায়িকার ভূমিকা পেয়ে যাবে।

মেসে ফিরে এসে অমিত মৃণালকে ফোন করল। ফোনের সুইচ বন্ধ করে রেখেছে মৃণাল! আধঘণ্টা পরেও ফোন করে দেখল কোনও পরিবর্তন হয়নি। তখন মনে হল, মৃণালের মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করবে কি না! কিন্তু সে ফোন করল না। খামোখা কু-কথা শোনার কোনও মানে হয় না।

ছবি মুক্তি পেল। নায়ক ও দুই নায়িকার ছবিতে শহর ছেয়ে গেল। ইদানীং বাংলা ছবিতে তেমন ভিড় হচ্ছিল না। কিন্তু এই ছবির জন্যে প্রথম সপ্তাহ থেকে সেই যে হাউসফুল বোর্ড ঝুলল তা সহজে নামবে বলে মনে হচ্ছিল না। একদিন সুকুমারবাবু ফোন করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো, মৃণাল ফোন ধরছে না, বাড়িতে লোক পাঠালে বলে দিচ্ছে অসুস্থ, দেখা করতে পারবে না। লুকিয়ে সিনেমা হলে সিনেমাটা যদি না দেখে থাকে তাহলে বলতে হবে আচমকা নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছে। কী ব্যাপার আপনি জানেন?’

‘না। আমি তো জানি না।’ অমিত বলল।

‘আশ্চর্য ব্যাপার। আচ্ছা, আপনি তো মৃণালকে সুপারিশ করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ওর সম্পর্কে কোনও তথ্যই আপনি জানেন না। ব্যাপার হচ্ছে, আমি পরের ছবি শুরু করতে চলেছি। প্রযোজক চাইছেন, আমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে মৃণালকে নায়িকার চরিত্রে কাস্ট করি। কিন্তু যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ না করা যায় তাহলে তো অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি না।’ ভদ্রলোকের গলায় বিরক্তি স্পষ্ট। আচমকা ফোন রেখে দিলেন।

অমিত ভেবে পাচ্ছিল না, তার কী করা উচিত। শেষ পর্যন্ত সে শনিবার বিকেলে মাসিমার বাড়িতে গেল। গিয়ে শুনল—সেই অল্প বয়সি কাজের মেয়েটিই জানাল, মাসিমা তাঁর দিদি এবং জামাইবাবুর সঙ্গে হরিদ্বার-কেদার-বদ্রীতে তীর্থ করতে গিয়েছেন। সঙ্গে আর কেউ গিয়েছে কিনা জানতে চাইলে মেয়েটি জানাল, সে জানে না।

এবার অমিত সোজা পৌঁছে গেল মৃণালের বাড়িতে। কাজের লোক জানিয়ে দিল বাড়ির কর্তা গিন্নিমা আর তার বোনকে নিয়ে তীর্থ করতে গিয়েছেন। ফেরার সময় কয়েকদিন দিল্লিতে থেকে আসবেন।

একটু ইতস্তত করে অমিত জানতে চাইল বাড়িতে মৃণাল আছে কি না। লোকটি মাথা নাড়ল। ‘সিনেমায় নামার পর থেকে দিদি আর এই বাড়িতে থাকেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হলে এই নাম্বারে টেলিফোন করবেন।’

একটু ফাঁকা জায়গায় এসে সেই নাম্বারে ফোন করল অমিত। সেটা বেজে বেজে থেমে গেলে হতাশ হল সে। আর একবার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করল। এবার ফোন যে ধরল তাকে অমিত পরিষ্কার বলল, ‘মৃণালকে বলুন, অমিত ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।’

একটু পরেই অমিত মৃণালের গলা পেল, ‘বলুন।’

‘আমি অমিত বলছি।’

‘তা তো আপনি কাজের লোককে একটু আগেই বলেছেন।’

‘সুকুমারবাবু আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি নাকি কিছুতেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।’

‘আমি তো তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিই নি, যে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেই আমি কথা বলব!’ মৃণাল বলল।

‘উনি তোমাকে ওঁর পরের ছবির নায়িকার চরিত্রে ভাবছেন।’

‘ভাবতেই পারেন।’

‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার! কে কী ভাবছে তা সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব আমাকে কেন নিতে হবে? সেরকম কথা কি আমি দিয়েছিলাম?’ বেশ ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বলল মৃণাল।

একটু মিইয়ে গেল অমিত, ‘তাহলে তুমি আর অভিনয় করতে চাইছ না?’

‘না। অন্তত এখন নয়।’

‘কিছু মনে কোরো না, জানতে পারি কি কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলে?’

‘যেদিন বুঝব আপনি আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত নেওয়ার যোগ্য মানুষ সেদিন নিশ্চয়ই কৈফিয়ত দেব।’ মৃণাল বলল।

‘আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, ফিল্মে সুযোগ পাওয়ার জন্যে তুমি একটা সময় মরিয়া হয়ে উঠেছিলে, সুযোগ পাওয়ার পর এরকম নির্লিপ্ত হয়ে গেলে কেন?’

‘আপনার কী মনে হয়?’ এবার আলতো হাসল মৃণাল।

‘আমি বুঝতে পারছি না, আমি তো কোনও কারণ দেখছি না—!’

‘তাহলে আর বুঝতে চেষ্টা করবেন না। হাসল মৃণাল, ‘এবার রাখি।’

‘কিছু মনে কোরো না, তোমার সামনে কিন্তু সুবর্ণ সুযোগ আছে।’

সাড়া পেল না অমিত। তিনবার হ্যালো বলে বুঝল মৃণাল লাইন কেটে দিয়েছে। কেন?

এই প্রশ্নটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। সাফল্যের প্রায় চুড়োর কাছে এসে কেউ কি চুপচাপ সরে যায়? এখনও পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন শহর ছাড়াও গৌহাটিতে মৃণালের ছবি রমরমিয়ে চলছে। অমিত কুচবিহারের তার বাড়িতে ফোন করেছিল। দুটো কথার পর মা উত্তেজিত হয়ে বললেন, পাশের বাড়ির মাসিমার সঙ্গে তিনি ছেলের গল্প নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। সেই সিনেমায় তাঁর বাড়িতে দেখা করতে আসা মৃণালের অভিনয় দেখে খুব ভালো লেগেছে। মনে হয়েছিল, নায়ক যদি নায়িকার বদলে ওকেই বিয়ে করত তাহলে তার বেশি ভালো লাগত। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনি মিষ্টি ওর কথা বলার ভঙ্গী।

কথাগুলো শুনে অমিতের মনে হল, মায়ের কথাগুলো চুপচাপ মেনে নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে বিতর্ক না করাই ভালো।

.

পৃথিবীটা চুপচাপ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কলকাতায় হোর্ডিং, রাস্তার দু’পাশের দেওয়াল থেকে তার গল্পের ছবির অস্তিত্ব মুছে গেল। বাংলা চলচ্চিত্রে একজন সম্ভাবনাময় নায়িকা আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেলেন, একথা নিয়ে বেশিদিন চর্চা হল না।

অধ্যাপকের অনুপ্রেরণায় গবেষণা শেষ করল অমিত। সেটা জমা দেওয়ার পরেই স্কুল থেকে তাকে জানানো হল, যে শিক্ষক ছুটিতে গিয়েছিলেন তিনি ফিরে আসছেন। তবে তিন মাস পরে আর একজন শিক্ষকের ছুটির সময়ে সে আবার কাজে যোগ দিতে পারে।

এইসময় একটি অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে গেল অমিত। অধ্যাপকের সাহায্যে জলপাইগুড়ির ডি সি কলেজে লিভ ভ্যাকেন্সিতে এক বছরের জন্যে লেকচারারের চাকরি পেয়ে গেল অমিত। জলপাইগুড়ি থেকে কুচবিহার বাসে চেপে কয়েকঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। জলপাইগুড়িতে পৌঁছে সে হোটেলে উঠল ইন্টারভিউ-এর আগের দিন। বিকেলে রিকশায় বসে সমস্ত শহর ঘুরে দেখল সে। তিস্তা নদীর গায়ে বাঁধের দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ল দেবেশ রায়ের লেখা ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসটির কথা। শহরটাকে ভালো লেগে গেল তার।

ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়ে মনে মনে সুকুমারবাবুকে ধন্যবাদ দিল সে। তাঁর লেখা গল্প নির্বাচকরা পড়েননি এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল কিন্তু ওঁরা সুকুমারবাবুর তৈরি সিনেমা দেখেছেন এবং সেই সিনেমা তার গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই খবরও জানেন। শুধু একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি এমন একটি গভীর বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তারপরেও সিনেমার জন্যে গল্প লিখেছেন কী করে তা যদি আমাদের বলেন—!’

মাথা নেড়েছিল অমিত, ‘আমি সিনেমার জন্যে গল্প লিখিনি।’

‘সেকি! আপনার লেখা গল্পের ওপর তো সিনেমা হয়েছে!’

‘হ্যাঁ, তা হয়েছে। আমি যখন গল্পটি লিখেছিলাম তখন তো সিনেমার কথা মাথায় ছিল না। সিনেমাজগতের কাউকেই আমি চিনতাম না। ওই গল্প প্রকাশিত হলে পরিচালক তা পড়ে মনে করেন, সিনেমায় আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবেন। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। কথা বলে গল্পের চিত্রসত্ত্ব কিনে সিনেমাটি তৈরি করেন। গল্প লেখার সময় আমি কল্পনা করিনি ওটা নিয়ে কেউ সিনেমা তৈরি করবেন।’ অমিত বলল।

ভদ্রলোক একটু হতাশ হলেও অমিত চাকরিটা পেয়ে গেল।

অধ্যাপকদের মেসে জায়গা ছিল। হেঁটেই কলেজে যাওয়া আসা করা যায়। শনিবার দুপুর দুটোয় ছুটি হলে কুচবিহারের বাসে চেপে সে সোজা বাড়িতে চলে যায়। দুটো রাত বাড়িতে থেকে সোমবার সকালেই জলপাইগুড়িতে ফিরে এসে আবার ক্লাস করে। এই জীবন যাপন করতে মন্দ লাগে না তার।

মা চাপ দিচ্ছিলেন, এবার তাকে বিয়ে করতে। নানান সূত্রে তাঁর কাছে সুপাত্রীদের খবর আসছিল। কিন্তু বাবা রাজি নন। এখন অমিত একটার পর একটা টেম্পোরারি চাকরি করছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর বউকে খাওয়াবে কী? গল্প লিখে যা পায় তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না। আর তার ওই একটাই গল্প সিনেমা হয়েছে। লিখলেই যে সিনেমা হয় না তা তো স্পষ্ট। তাই যতদিন না ছেলে পাকা চাকরি পাচ্ছে তদ্দিন বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না।

বাবার এই সিদ্ধান্তে খুশি হল অমিত। দীর্ঘদিন হয়ে গেল, কিন্তু কিছুতেই ফোনে শেষবার যে কথা মৃণালের সঙ্গে হয়েছিল তা সে ভুলতে পারছে না। যতদিন গেছে ততদিন তার মনে হয়েছে, মৃণাল যা বলতে চেয়েছিল তার আসল মানেটা বুঝতেই পারেনি সেদিন। কিছু সময় ব্যবধানে রেখে সে ওই নাম্বারে ফোন করেছিল, কিন্তু মৃণাল আর ফোন ধরেনি।

যেদিন তার থিসিস স্বীকৃতি পেল সেদিন সে পুজোর উপন্যাসের শেষ পর্ব লিখতে ব্যস্ত ছিল। খবর পেয়েই সে অধ্যাপককে ফোন করে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমিই তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, তুমি সামনের রবিবারের মধ্যেই কলকাতায় চলে এসো। আর হ্যাঁ, আসার আগে কলেজকে জানিয়ে এসো তোমার পক্ষে আর জলপাইগুড়িতে থাকা সম্ভব নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *