হায় সজনি – ৭

ঠিক দশটায় শহরতলীর স্কুলে পৌঁছে নিজের উপস্থিতির কথা অফিসে জানিয়ে দিল অমিত। যে ঘরে তাকে বসতে বলা হল সেখানে আরও দুজন প্রার্থী বসে আছেন। অমিত বুঝতে পারল এরাও চাকরি প্রার্থী। গম্ভীর মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, বেশ টেনশনে আছেন দুজনে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অমিত একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কলকাতার বাইরে থেকে এসেছি, আপনারা কি কলকাতায় থাকেন?’

দুজনে একসঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, মুখ খুলল না।

‘আমার কোনও ব্যাকিং নেই। শুনেছি কলকাতায় ব্যাকিং ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না। আপনাদের কেউ কি ব্যাক করছেন?’

দুজনে অমিতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আগের মতো গম্ভীর হয়ে বসে রইল।

এই সময় একজন বেয়ারা গোছের লোক এসে ইন্টারভিউ লেটার চেয়ে নিয়ে গেল তিনজনের কাছ থেকে। মিনিট দশেক পরে লোকটি ফিরে এসে গলা তুলে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ কর। আপনি আসুন।’

ওপাশের ভদ্রলোক তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পরপর তিনবার দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকাতে ঠেকাতে বিড়বিড় করল। তারপর পাশে রাখা ফাইল তুলে দ্রুত লোকটির পেছনে হাঁটতে থাকল।

ওরা চোখের বাইরে চলে গেলে দ্বিতীয় লোকটি অমিতের দিকে তাকাল, ‘আমার চেয়ে পার্সেন্টেজ অনেক কম। কিন্তু শুনলাম চেয়ারম্যানের নাকি দূর সম্পর্কের রিলেটিভ। সবই কপাল।’

অমিত বলল, ‘তাহলে আর এখানে বসে আছেন কেন?’

‘চলে যাওয়া আর বসে থাকা যখন সমান তখন বসেই থাকি।’ বলেই লোকটা আবার আগের মতো বন্ধু হয়ে গেল।

পাঁচ মিনিট পরে বেয়ারা ঘরে এসে বলল, ‘বিক্রমজিৎ দত্ত!’

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই পূর্বদিক কোনটা?’

বেয়ারা একটা দেওয়াল দেখিয়ে দিতেই লোকটা সেদিকে ঘুরে হাত জোড় করে কী একটা বিড়বিড় করে বলে বারংবার কপালে হাত ছুঁইয়ে নিজের ব্যাগ তুলে নিয়ে বেয়ারার সঙ্গে এগিয়ে গেল।

অমিতের ডাক পড়ল দশ মিনিট পরে। তাকে হাঁটতে দেখে বেয়ারা হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি প্রণাম করবেন না?’

‘চাকরি পেলে করব।’ হেসে বলল অমিত।

পাঁচজন প্রবীণ বসে আছেন টেবিলের ওপাশে। অমিত তাঁদের নমস্কার করতে মাঝের ভদ্রলোক বললেন, ‘বসুন।’

অমিত বসামাত্র একজন বললেন, ‘অমিতবাবু, আপনি তো বর্ধমানের একটা কলেজে অধ্যাপনা করেন। সেটা না করে স্কুলের টেম্পোরারি শিক্ষকতার চাকরি করতে চাইছেন কেন?’

অমিত বলল, ‘স্কুলের ছাত্রদের পড়ানোর সময়ের বাইরে যে সময়টা আমি পাব তা কলকাতায় থাকলে গবেষণার কাজ করতে পারব! তাই!’

পঞ্চমজন বললেন, ‘অর্থাৎ আপনি স্কুলের শিক্ষকতা করতে চাইছেন নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে। ছাত্রদের সামনে একজন আদর্শ শিক্ষকের ছবি আপনি রাখতে চাইছেন না।’

‘কথাটা ঠিক নয় স্যার। আমাকে সুযোগ দিলে শিক্ষক হিসেবে প্রতিটি ক্লাসে নিজেকে উজাড় করে দিতে আমি প্রস্তুত। সেই কাজে আমার কোনও গাফিলতি বিন্দুমাত্র থাকবে না।’ অমিত বলল।

‘এর অর্থ আপনি নিজেকে চব্বিশ ঘণ্টাই শিক্ষক বলে ভাববেন না।’

‘স্যার, সেটা কি সম্ভব? যখন কোনও শিক্ষক তার মাইনের চেক হাতে নেন তখন তিনি সেই চেক ক্যাশ করার কথাই ভাবেন, শিক্ষকতা করার চিন্তা তো মাথায় আসতে পারে না।’ নম্র গলায় বলল অমিত।

‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই চাকরি স্থায়ী নয়, অস্থায়ী বলাও ঠিক হবে না। একজন ছুটিতে গিয়েছেন কয়েক মাসের জন্যে। এসব জানার পরে আপনি কলেজের চাকরি ছেড়ে আসার পেছনে যে তথ্য দিলেন তা কি বিশ্বাসযোগ্য?’ মাঝখানে যিনি বসেছিলেন তিনি গম্ভীর প্রশ্ন করলেন।

‘যা সত্যি আমি তাই বলেছি।’

পাঁচজনের একজন যিনি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, এবার মুখ খুললেন, ‘সাহিত্য পত্রিকায় লেখার আগে আপনি কোথায় লিখেছেন? কোনও লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে কি আপনি যুক্ত?’

‘আজ্ঞে না। আমার প্রথম লেখা সাহিত্য পত্রিকাতেই প্রকাশিত ওই গল্পটি।’ বিনীত গলায় বলল অমিত।

‘আপনি এখন বর্ধমানে আছেন?’ মধ্যবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ। বর্ধমান শহর থেকে দেড়ঘণ্টা দূরে।’

‘ঠিক আছে, আপনি এখন আসতে পারেন।

বাইরে বেরিয়ে এল অমিত। তারপর বাস ধরে চলে এল কলেজ স্ট্রিট। সোজা কফি হাউসে ঢুকে একটা খালি টেবিলে একা বসে রইল বিকেল পর্যন্ত। চাকরিটা যে হবে না তা টেবিলের ওপাশে যাঁরা বসেছিলেন তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে সে বুঝতে পেরেছিল। নিজেকে বোঝাল সে। যাঁরা কলকাতা থেকে অনেক দূরে থেকেও রিসার্চ করেন তাঁরা নিশ্চয়ই প্রচুর অসুবিধে সত্ত্বেও কাজটা করে থাকেন। তাহলে সেই অসুবিধের সঙ্গে লড়াই করে সে কেন পারবে না। হেস্টেলে ফিরে গিয়ে আচমকা মাথায় আসা একজন লড়াকু মানুষের লড়াই নিয়ে গল্প লিখল অমিত।

তিনদিন পরে অমিতকে অবাক করে স্কুল থেকে চিঠি এল। আপাতত ছয়মাসের জন্যে স্কুল তাকে বাংলার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করছে। আগামী সোমবারের মধ্যে তাকে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। তখনই তাকে যাবতীয় তথ্য দেওয়া হবে।

.

নতুন চাকরিতে এসে সহকর্মী হিসেবে যাদের অমিত পেল তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবয়সি। অমিত বুঝতে পারল সে একজন গল্প লেখক এই খবর সহকর্মীরা জানেন, এবং সেই কারণে তার সঙ্গে বেশ সমীহ করেই কথা বলছেন।

কলেজের ছাত্রদের পড়ানোর আর স্কুলের ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের ক্লাস নেওয়া এক ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝার জন্যে অমিত অধ্যাপকের বাড়িতে গেল। তাঁকে প্রণাম করতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘কি খুশি তো?’

‘আপনি কলকাতায় না থাকায় আমি বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। ইন্টারভিউতে ওঁরা যে ভাবে প্রশ্ন করছিলেন তাতে মনে হয়েছিল আমাকে নাকচ করা হবে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, আপনার সাহায্য ছাড়া চাকরিটা পেতাম না।’ অমিত বলল।

‘ওসব কথা ছেড়ে দাও। ক্লাস আরম্ভ করেছ?’ প্রফেসর প্রশ্ন করলেন।

‘না। আগামীকাল শুরু হবে।’ অমিত বলল, ‘এই কয়েকমাস আমি কলেজের ছেলেদের আমার মতো করে পড়িয়েছি। স্কুলের ছাত্রদের ম্যাচিউরিটি কিছুটা কম, ওদের যখন পড়াব, তখন কি সরল কথায় বোঝাব?’

‘শোন, স্কুলের যেসব ছেলেকে পড়াবে তাদের সম্পর্কে আগাম কোনও ধারণা নিয়ে ক্লাসে যেও না। হয়তো দেখবে যে ছেলেটি ক্লাস টেনে পড়ে সে ইলেভেনে পড়া অনেক ছাত্রের চেয়ে বেশি ভাবতে পারে; তাই ক্লাসে গিয়ে প্রথম দশ মিনিট ওদের সঙ্গে আলাপ করার ছলে অ্যাসেস করে নেবে, ওদের বোধবুদ্ধি কি স্তরের সেই অ্যাসেনমেন্ট ঠিক হলে পড়াতে অসুবিধে হবে না তোমার।’ অধ্যাপক বললেন।

অধ্যাপকের স্ত্রী এসে এক প্লেট মিষ্টি দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তোমার স্যারের কাছে চাকরির খবর শুনেছি। কিন্তু এই মিষ্টি চাকরির জন্যে নয়।’

অমিত অবাক চোখে তাকাল। ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, ‘গল্পটি পড়ে এত ভালো লেগেছে তাই মিষ্টি খাওয়াচ্ছি। এরকম লেখা আরও লেখো।’

প্রফেসারকে অমিত জানাল, পত্রিকা থেকে তার কাছে একটি বড় লেখা চেয়েছে। সে যেহেতু সবে লেখা শুরু করেছে তাই ভেবে পাচ্ছে না কী নিয়ে লিখবে।

প্রফেসরের স্ত্রী ওপাশের চেয়ারে বসে ওদের কথা শুনছিলেন। এবার তিনি বললেন, ‘ওমা, এ আর কি কঠিন ব্যাপার! তুমি নিজেকে নিয়ে লেখো, নিজেকে নিয়ে, কিন্তু আত্মজীবনী নয়।’

প্রফেসর বললেন, ‘বাঃ, ভালো বলেছ তো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *