হায় সজনি – ৬

কলেজের চাকরিতে যোগ দেওয়ার খবর ফোন করে বাবাকে জানাল অমিত। বাবা এখন অফিসে। শুনে বললেন, ‘খবরটা চিঠি লিখে মাকে জানিও।’

কলকাতা ফিরে এল সে বিকেল বিকেল। শিয়ালদা স্টেশনে পা দিয়েই তার মনে হল এই শহরের মানুষের কাছে সে বাইরের লোক। এখানে থাকার কোনও প্রয়োজন তার নেই, কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করে নেই। সে ঠিক করল, রবিবার দুপুরেই সে হোস্টেল ছেড়ে স্টেশন গিয়ে বর্ধমানের ট্রেন ধরবে।

শনিবার দুপুরে হোস্টেল ভর্তি থাকে। যে বন্ধুর নামে সে রুম শেয়ার করছে তার কাছে একজন গেস্ট আসায় সে বাইরে বেরিয়ে এল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তার মনে হল অ্যাদ্দিন নিশ্চয়ই মৃণালকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন ওর আত্মীয়রা। মৃণাল কি এখন বিধাবাদের মতো জীবন যাপন করছে। পোশাকও সেইরকম? এখন কি আর আগের মতো মেয়েরা বৈধব্য পালন করে?

অমিতের খুব ইচ্ছে করছিল মৃণালের সঙ্গে দেখা করতে! মাসিমণির কথা শুনে এই অধ্যাপক ছেলেটির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার পরে সে স্থির করেছিল বানিয়ে বানিয়ে এমন মিথ্যে বলে যাতে বিয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু বলার সময় তার কী যে হল, সত্যি কথা না বলে পারল না।

কিন্তু মৃণালের বাড়িতে গেলেই যে ওর দেখা পাবেই তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। মাসিমণিকেও বলা যাবে না সে মৃণালের সঙ্গে দেখা করতে চায়। কেন চায় তা সে বোঝাতে পারবে না। কী করবে বুঝতে পারছিল না অমিত।

তবু বাস ধরে সে সোজা চলে গেল মৃণালের মাসিমার বাড়িতে। দরজা খুলল সেই কাজের মেয়েটি। তাকে দেখে মাথা নেড়ে বলল, ‘মা তো বাড়িতে নেই। উনি ওঁর দিদির বাড়িতে গিয়েছেন। আপনার কাছে কি ওঁর কোনও ফোন নম্বর আছে? না থাকলে দিতে পারি, কথা বলে নিতে পারেন আপনি।’

মাথা নাড়ল অমিত। ‘ওঁর নম্বর আমার কাছে আছে। আচ্ছা, মৃণালকে নিয়ে ওঁরা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন, তুমি কিছু জানো?’

‘হ্যাঁ, ফিরে এসেছেন।’

‘মৃণাল কি শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছে না বাবা-মায়ের কাছে আছে?’

‘দিদি বাপের বাড়িতেই আছে।’

‘ঠিক আছে।’ বলে রাস্তায় বেরিয়ে এল অমিত।

শেষপর্যন্ত ফোন করবে বলে ঠিক করল সে। শোকের বাড়িতে গেলে কথা খুঁজে পাওয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। খানিকটা হাঁটার পর একটা দোকানের গায়ে এসটিডি-লোক্যাল কলের বোর্ড ঝুলতে দেখে সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। তার মধ্যে একটা কাগজে মাসিমণির মোবাইল নাম্বার লেখা ছিল। সেই নাম্বার ডায়াল করল অমিত।

কয়েকবার রিং হতেই ভদ্রমহিলা কথা বললেন, ‘হ্যালো।’

‘আমি অমিত বলছি। আপনার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম আপনি এই বাড়িতে এসেছেন।’ অমিত খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বলল।

‘ও, তুমি কলকাতা থেকে তো চাকরি করতে চলে যাচ্ছ, তাই না?’

একটু অবাক হল অমিত, ভদ্রমহিলা এরমধ্যেই কথাগুলো ভুলে গেলেন! সে বলল, ‘হ্যাঁ।’

ঠিক আছে। যাও, ভালো থেকো বাবা, জীবনে সফল হও। রাখছি।’ ফোন রেখে দিলেন ভদ্রমহিলা। অমিত খুব অবাক হল। এইরকম নির্লিপ্ত গলায় উনি কখনও কথা বলেননি।

.

ছাত্র পড়ানোর চাকরিতে মজে গেলে খানিকটা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন অনেক তরুণ শিক্ষক। অমিতের অবস্থা তাই হল। বিভাগীয় প্রধান তাকে বলেছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্য পড়াতে। বাংলা বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষকই বয়স্ক, পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে বয়স। তাঁরা চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী থেকে বঙ্কিমচন্দ্র পড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্য শুরু হয় কুমুদরঞ্জন মল্লিক এবং তৎকালীন লেখকদের ছুঁয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ে শরৎচন্দ্রের নির্বাচিত কিছু রচনায়। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস প্রবন্ধ ছোটগল্প অনার্স ক্লাসে পড়ানো হয়। পাশ ক্লাসে তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা নির্বাচন করা হয়েছে।

তা যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে বেশিরভাগ দিনই সিলেবাসের বাইরে চলে যায় অমিত। তার বাচনভঙ্গী, ব্যবহার ছাত্রদের মুগ্ধ করেছে। একজন প্রবীণ অধ্যাপক প্রফেসরদের বসার ঘরে তার পাশে বসে বলেছিলেন, ‘বুঝলে ভাই, এটা হল ম্যারাথন রেসের মতন। আগেই যদি জোরে দৌড়াও তাহলে কয়েক বছরের মধ্যেই হাঁপিয়ে পড়বে। তখন ক্লাস করবে চাকরি বাঁচাতে, ছাত্ররা তোমার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু পাবে না।’

‘তাহলে কী করা উচিত?’

‘যা জানো তার সবটাই বিলোতে যেও না। ধীরে ধীরে এগোও। মনে রেখো তোমাকে ষাট বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে হবে। প্রতিবছর নতুন ছাত্রদের মুখোমুখি হবে। ওদের যখন শেখাবে যদি দ্যাখো তুমি নিজেও কিছু শিখছ, পুরোনো ধারণাগুলো বদল হচ্ছে তখন তুমিই লাভবান হবে।’ খুব আন্তরিক গলায় বলেছিলেন ভদ্রলোক।

টিভিতে ম্যারাথন দৌড় দেখেছিল সে; তিরিশ পঁচিশজন প্রতিদ্বন্দ্বী শুরুতে প্রায় একসঙ্গে দৌড় শুরু করল। ছাব্বিশ মাইল দৌড়তে হবে তাদের। সেই দৌড়ের সময় অনেকেই থেমে যায়, অনেকেই পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু দূরত্ব যত কমে আসে তত পরিবর্তনটা চোখে পড়ে? শরীরে সঞ্চয় করা শক্তি তখন উজাড় করে দেন প্রতিযোগীরা। বোঝাই যায় না তাঁরা ছাব্বিশ মাইল দৌড়ে এসেছেন। অমিতের মনে হল শিক্ষকতা ওই ধরনের এক দৌড়। সেই দৌড়ে সে সবে যোগ দিয়েছে।

আর এই সময়ে সে যেন কলকাতাকে ভুলে গেল। ছাত্রদের মনে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে বদ্ধপরিকর হল সে। তিন বছর পরে সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অধ্যাপকের চিঠি পেল। মাত্র দুটো কথা লেখা ছিল তাতে, ‘দেখা করো?’

দু’দিনের ছুটি পেয়ে শিয়ালদায় ট্রেন থেকে নেমে একটু ফাঁপড়ে পড়ল সে, কোথায় উঠবে? হোস্টেলে যেতে হলে সেই বন্ধুর খোঁজ নিতে হবে যা এখন পছন্দ হল না। মির্জাপুর স্ট্রিটের একটি সাধারণ হোটেলের উঠে বেশ স্বস্তি পেল অমিত। বহুদিন হোটেলে বা পেয়িং গেস্ট থাকার অভ্যেস কাজে লাগল। তক্তাপোষের ওপর পাতা পাতলা তোষকের বিছানায় টানটান হয়ে সে জানলার বাইরের আকাশ দেখল। কলকাতা আর বর্ধমানের আকাশের মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই। ভেসে আসা শব্দের পার্থক্য আছে। দিনের বেলায় কলকাতা শান্ত হতে জানে না।

তিনটে নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস ধরে সে ভবানীপুরে চলে এল। অধ্যাপকই দরজা খুললেন, ও তুমি, এসো। বসো। কবে এলে?’

‘আজই। আপনি কেমন আছেন?’ চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করল অমিত।

‘আছি।’ উল্টোদিকের চেয়ারে বসে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে, তোমরা শরীরের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। একটা কথা অল্প বয়স থেকে শুনে আসছি, যারা বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে বা পড়ায় তারা শরীরচর্চা করে না। তোমার ক্ষেত্রেও কি কথাটা প্রযোজ্য?’

অমিত হাসল, মুখ নামাল, কিছু বলল না।

‘মফস্বল শহরে বাংলা পড়াতে কেমন লাগছে?’

‘প্রথম প্রথম অসুবিধে হচ্ছিল, এখন মানিয়ে নিয়েছি।’

‘শোনো, তোমার কি গবেষণা করার বাসনা রয়েছে?’

ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন মনে আসছে এবং যাচ্ছে। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

‘বাঃ বিষয়? অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন।

‘রবীন্দ্রনাথের না বলা বাণী।’

চোখ বড় হয়ে গেল অধ্যাপকের। তারপর বললেন, ‘এমন বিষয় তোমার মনে এল কী করে? আমি খুব অবাক হচ্ছি অমিত।’

‘রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই লিখে গিয়েছেন—!’

‘হু! এরজন্যে তো কঠিন পরিশ্রম করতে হবে তোমাকে? অনেক বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বর্ধমান শহর থেকে অত দূরের ছোট শহরে বসে সেই সাহায্য কী করে পাবে! আচ্ছা, এটি ছাড়া অন্য বিষয় ভেবেছ?’

‘না। তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা করতে যাওয়া ছাড়া আমাদের তো অন্য পথ নেই।’

হাসলেন অধ্যাপক। তারপর বললেন, ‘দ্যাখো, ভেবে দ্যাখো। তবে এই গবেষণা তো কল্পনার ডানায় ভেসে করা সম্ভব নয়। তথ্য সংগ্রহ করতে তোমাকে হয় কলকাতা নয় শান্তিনিকেতনে এসে থাকতে হবে। আসতে চাও?’

‘ছাত্র পড়ানো ছাড়া অন্য কোনও জীবিকার কথা তো আমার জানা নেই।’

‘বছর তিনেক স্কুলে পড়াও। শান্তিনিকেতনের পনেরো মিনিটের মধ্যে একটি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পার্ট টাইম বাংলার টিচার প্রয়োজন। পার্ট টাইম কিন্তু ওই চাকরি বছর দুই বা তার বেশি থাকতে পারে। এখনই তোমাকে কিছু বলতে হবে না। ফিরে গিয়ে ভাবনা চিন্তা করে আমাকে জানিও। তুমি কী খাবে? চা না কফি?’

অধ্যাপক জিজ্ঞাসা করা মাত্র উঠে দাঁড়াল অমিত। তারপর কাঁধের ঝোলা থেকে ভাঁজ করা কয়েকটা ফুলস্কেপ কাগজ বের করে সামনের টেবিলের ওপর রেখে বলল, ‘বাংলা পড়েছি বলে কুঁজোর চিৎ হয়ে শোওয়ার রোগটা ধরেছে। যদি দয়া করে চোখ বোলান স্যার। এটি আমার আট নম্বর গল্প। আগেরগুলো ভয়ে ভয়ে কাউকে দিইনি।’

.

আশুতোষ কলেজের কাছাকাছি একটি পাবলিক টেলিফোন বুথ দেখে ইচ্ছেটা প্রবল হল। পকেট থেকে পয়সা বের করে সে মাসিমণির ফোনের নাম্বার ডায়াল করল। এই নাম্বারে শেষবার ফোন করেছিল কলকাতা ছাড়ার আগে।

পুরুষকণ্ঠে হ্যালো কানে আসতেই অমিত অনুমান করল, ফোন ধরেছেন মেসোমশাই। সে বলল, ‘আমি অমিত বলছি মেসোমশাই!’

‘অমিত!’ ভদ্রলোক বুঝতে একটু সময় নিলেন, ‘ওহো, তুমি অনেক দিন পরে ফোন করলে! ব্যাপার কী?’

‘আমি বর্ধমান জেলার একটা কলেজে এখন পড়াচ্ছি। অনেককাল বাদে আজ কলকাতায় এলাম। আপনারা সবাই কেমন আছেন?’ অমিত জিজ্ঞাসা করল।

‘আমরা? ওহো, তুমি তো জানো মৃণালের কথা। তাই তো?’

‘হ্যাঁ জানি।’

‘তারপর আর কীরকম থাকতে পারি অনুমান করতেই পারো।’

‘মাসিমা বাড়িতে আছেন?’

‘হ্যাঁ। পাশের ঘরে মৃণালের সঙ্গে গল্প করছে। দাঁড়াও।’

মিনিট খানেকের মধ্যে মাসিমার গলা শুনতে পেল অমিত, ‘কী খবর? এতদিন পরে মাসিমাকে মনে পড়ল। এখন কোথায়?’

‘আজই কলকাতায় এসেছি।’

‘কেমন আছ তুমি?’

‘আছি। মফস্বল শহরের কলেজে ছাত্র পড়াই। চলে যাচ্ছে দিন।’

‘শুধু ছাত্র? কলেজে ছাত্রীরা পড়ে না?’

‘না। ওটা ছেলেদের কলেজ।’

‘সেকি! এখনও শুধুমাত্র মেয়েদের স্কুল-কলেজ আছে বলে জানি, কেবল মাত্র ছেলেদের জন্যে কলেজ এখনও এদেশে আছে? যাক গে, ক’দিন আছ?’

‘কালই চলে যাব।’

‘তাহলে কি তোমার দেখা এবার পাচ্ছি না?’

‘দেখি, আমার খুব ইচ্ছে আছে দেখা করে যাওয়ার।’

‘দ্যখো, এলে তো বেশ ভালো লাগবে।’ ফোন রেখে দিলেন। আজ যেন মাসিমা তার সঙ্গে অন্যরকম গলায় কথা বললেন, আগের সেই উত্তাপের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর আজকের কথায়। সে ওঁর সঙ্গে সমুদ্রে যেতে পারেনি বলে কি অসন্তুষ্ট হয়েছেন? তা কেন হবেন? সেদিন তার যে সমস্যা ছিল তা তো তিনি বুঝেছিলেন।

তাছাড়া আজ ভদ্রমহিলার কথা বলার ভঙ্গীতে শোকে ভেঙে পড়ার কোনও ইঙ্গিত সে পায়নি; হয়তো চলে যাওয়া সময় সেই শোকটাকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু মাসিমা একবারও মৃণালের কথা বললেন না। অথচ তিনি এতক্ষণ পাশের ঘরে মৃণালের সঙ্গে গল্প করছিলেন, মেসোমশাই তো তাই বললেন। অমিত ঠিক করল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে আজ মাসিমার বাড়িতে যাবে না।

.

অধ্যাপকের উপদেশ মতো আবেদনপত্রের সঙ্গে নিজের বায়োডাটা পাঠিয়েছিল অমিত। তার মাসখানেক পরে সে ইন্টারভিউ-এর চিঠি পেয়ে গেল।

কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে স্কুলের শিক্ষকতার আবেদন করার সময়ে মনে কিন্তু কিন্তু ভাব এসেছিল। কিন্তু সেটা দূর হয়ে গেল এক ছাত্রের কথায়। ছাত্রটি এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি পত্রিকাটি পেয়েছেন স্যার?’

‘কোন পত্রিকা?

‘সাহিত্য!’

‘না। কী আছে তাতে?’

ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে পত্রিকাটি বের করল। ছেলেটি বলল, ‘বাবা আজ বর্ধমান থেকে কিনে এনেছেন?’

বেশ অবাক হয়ে পত্রিকাটি হতে নিল অমিত। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলার বিখ্যাত পাক্ষিক পত্রিকাটি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিয়মিত পড়ত। বেশ অবাক হয়ে প্রথম দুটি পাতার পর সূচিপত্রের ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। তার গল্পটি যা সে অধ্যাপককে পড়তে দিয়ে এসেছিল তা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

দ্রুত সূচিপত্রে পাতার নম্বর দেখে নিজের গল্পের ইলাস্ট্রেশন দেখল সে। তার নাম বেশ কায়দা করে লিখেছেন শিল্পী। অমিতের আঙুল কাঁপছিল। খুশিতে চোখ বুজে এল তার। অধ্যাপকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে আসছিল মন। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি বলল, ‘এই গল্প আপনি লিখেছেন, তাই না স্যার?’

নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল অমিত। তারপর বলল, ‘এই পত্রিকা আজ আমি রেখে দিতে পারি? কাল ফেরত নিয়ে যেও।’

‘না না, ফেরত দিতে হবে না। গল্প যদি আপনার লেখা হয় তাহলে বাবা বলেছেন আর একটা কপি বর্ধমান থেকে আনিয়ে নেবেন।’

‘বাঃ, খুব ভালো হল। ওঁকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ দিও।’ খুশি হয়ে বলল অমিত।

ছেলেটি চলে গেলে নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখল অমিত। তারপর গল্পটি পড়তে লাগল। লাইনগুলো কীরকম অচেনা মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে চোখ ছোট করছিল। কোন কোন শব্দ না লিখলেই ভালো হত। কোনও কোনও লাইন একটু অতিরিক্ত লেখা হয়ে গিয়েছে।

গল্পটি পড়া শেষ হলে চুপচাপ বসে থাকল অমিত। এই পত্রিকা কি মৃণালের হাতে পৌঁছাবে? পৌঁছলেও মৃণাল কি গল্পটি পড়বে? যদি পড়ে তাহলে কি সে বুঝতে পারবে গল্পের নায়িকার ছায়ায় মাখামাখি হয়ে রয়েছে সে। বিখ্যাত সেই লাইনটা মনে এল, তুমি তো জানিলে না, না জানিলে—!

তখনই অধ্যাপককে চিঠি লিখে তার কৃতজ্ঞতা জানাল সে। যার উত্তরে অধ্যাপক লিখলেন, তীর ছেড়ে যাত্রা করার সময় লগি দিয়ে জোরে জোরে ঠেলা দিতে হয়। নৌকো চলতে শুরু করার পর সেই লগির তেমন কোনও ভূমিকা থাকে না। নৌকো কেমন চলবে তা মাঝির ওপর নির্ভর করে।’

.

বড় কাগজে একবার লেখা ছাপা হলে সামনের বেশ কয়েকটি বন্ধ দরজা একটু একটু করে খুলে যায়। অমিত বর্ধমানের একটি ছোট শহর থেকে গল্প পাঠানোর সময় ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটির উল্লেখ করেছিল। নিজের প্রসঙ্গে সে কেন বলবে, তার গল্পই তো কথা বলবে, এই ভাবনায় আটকে থাকতে পারেনি সে। ফলে তার দ্বিতীয় গল্পটিও একটি সিনেমার সঙ্গে গল্প উপন্যাস মেশানো কাগজে শুধু ছাপাই হল না, তারা একটি ছোট উপন্যাস পাঠাতে বলল। নিজের লেখার জন্যে চারশো টাকা সম্মানমূল্য পাবে তা কোনওদিন কল্পনা করেনি সে।

কলকাতার স্কুলে চাকরির ইন্টারভিউ-এর চিঠি আসার পর তার মনে হল এই চাকরিটা তার হয়ে যাবেই। সে শুধু ভালো নম্বর পেয়ে এম.এ পাশ করেনি, তরুণ গল্পকার হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ইন্টারভিউ-এর চিঠি পেয়ে সে আবার সেই আগের হোটেলে উঠল। বিকেলে দেখা করতে গেল অধ্যাপকের সঙ্গে। ভেবেছিল, এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে যাবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হল, মিষ্টির বদলে স্যারকে বই দেওয়াই শোভন হবে। কাল সোমবার, কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনে স্যারকে দিয়ে আসবে। কিন্তু স্যারের বাড়িতে গিয়ে খুব হতাশ হল সে। জরুরি প্রয়োজনে স্যার কলকাতার বাইরে গিয়েছেন। ফিরবেন সামনের শুক্রবার। অর্থাৎ স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনও সুযোগ এবার নেই। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আত্মবিশ্বাস যেন দুলতে শুরু করল। স্যার কলকাতায় নেই অথচ কাল তার ইন্টারভিউ। এর ব্যবস্থা স্যারই করে দিয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতি কি অন্যরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। হয়তো স্যার জানতে পেরেছেন, এই চাকরির জন্যে অন্য প্রার্থী ঠিক হয়ে গেছে, তাই তিনি অমিতের মুখোমুখি হতে চান না।

নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে সে হোটেলে ফিরে এসেছিল। রাতের খাওয়ার পরেও ঘুম আসছিল না। আর তখনই তার মনে পড়ল, কলকাতায় এসে নিজের চাকরির চিন্তায় এতটাই আটকে ছিল যে মৃণালের কথা মনে আসেনি! মৃণাল কি আবার কলেজে যাচ্ছে? তাহলে তো ওর এবার বি.এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা। কেমন আছে সে? মাসিমা কেমন আছেন?

ঘড়ি দেখল অমিত। রাত দশটা। এইসময় কারও বাড়িতে ফোন করা অনুচিত। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফোন করলে মানুষ বিরক্ত হবেই। তবু, কিন্তু কিন্তু করে সে হোটেলে ম্যানেজারের ঘরে চলে এসে বলল, ‘ফোন করতে চাই।’

হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটা দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। রিসিভার তুলে একটু আগে দেখে আসা নাম্বার ডায়াল করল অমিত। রিং হচ্ছে। কে তুলবে ওদিকের রিসিভার? এক দুই করে দশবার রিং হওয়ার পরেও যখন কেউ ওদিকের রিসিভার তুলল না তখন লাইন কেটে দিয়ে সে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেউ রেসপন্স করেনি।’ ভদ্রলোক হেসে মাথা নাড়লেন, যার অর্থ, পয়সা লাগবে না।

ঘরে ফিরে এসে শোওয়ার পরেও ঘুম আসছিল না। মাসিমা বা মেসোমশাই কি বাড়িতে নেই? তাই হবে। মৃণালের যদি নিজস্ব ফোন থাকত তাহলে সে সাহস করে জিজ্ঞাসা করত, ‘কেমন আছ?’ বুক থেকে চাপ যেন ঈষৎ কমল। মনে মনে কত কথাই না বলা যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *