৫
হোস্টেলের নিয়ম অনুযায়ী এম.এ-এর রেজাল্ট বের হওয়ার সাতদিনের মধ্যে হোস্টেল ছেড়ে দিতে হয়। এই সমস্যায় যাতে পড়তে না হয় তাই অনেক ছাত্র শেষ বছরে এসে আইনক্লাসে ভর্তি হয়ে যায়। ফলে ক্লাস করুক বা না করুক আরও দু’বছর হোস্টেলের সিট হাতছাড়া হয়ে যায় না। অমিত সেটা করেনি অথবা করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হল আইনক্লাসে ভর্তি হতে হলে যত টাকা দরকার হয় তা অমিতের ছিল না। তাছাড়া সে যখন ল’ পড়বে না, ওকালতি করার বিন্দুমাত্র বাসনা তার ছিল না, তাই রেজাল্ট বের হলেই তাকে হোস্টেল ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে। কিন্তু তার রুমমেট ল’ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেছে। তার গেস্ট হিসেবে সে অন্তত মাসখানেক হোস্টেলে থাকতে পারে। তারপরেই কলকাতায় থাকার জন্যে একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাপারটা যে কী করে সম্ভব হবে তা তার মাথায় ঢুকছে না।
মাত্র দশ নম্বরের জন্যে এম.এ-তে প্রথম শ্রেণি না পেলেও চাকরির ইন্টারভিউটা ভালোই হল। চাকরিতে প্রথম মাসে যে মাইনে পাবে তাতে একজন মানুষের আরামসে চলে যাবে এবং তা কলেজের অধ্যাপনার মাইনের চেয়ে খুব কম নয়। যদিও পরের দিকে অধ্যাপকদের মাইনে অনেক বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু পড়ে পাওয়া চৌদ্দোআনা কথাটা মেনে চাকরিতে ঢুকে পড়ল অমিত। প্রথম মাসের মাইনের টাকার এক তৃতীয়াংশ বাবাকে দিতে হবে বলে ব্যাঙ্কে জমা রেখে সে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা মেসবাড়িতে চলে এল। খবরটা পেয়ে বাবা খুব দুঃখ পেলেন। মা চিঠিতে জানালেন, ‘চেষ্টা করো যদি তুমি অধ্যাপনার চাকরি পেতে পারো। তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল তোমাকে অধ্যাপক হিসেবে দেখতে পাওয়া।’
এই চিঠির পর অমিতের ধ্যানজ্ঞান হল কলেজের চাকরিতে লেকচারার পদের জন্যে আবেদন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক পরামর্শ দিলেন, যদি মফসসলে গিয়ে কলেজের চাকরিতে তার আপত্তি না থাকে তাহলে তিনি চেষ্টা করতে পারেন। কলকাতা ছেড়ে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে অমিতের মোটেই ছিল না, কিন্তু এখন তার মনে হল সুযোগ পেলে যাওয়াই উচিত।
বর্ধমানের একটি কলেজে তার লেকচারারের চাকরি হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সুপারিশে। চাকরি পেয়েই বাবাকে চিঠি লিখে জানালে তিনি একটি ছোট চিঠি লিখলেন, ‘খবরটি বোধহয় আমার আয়ু বাড়িয়ে দিল। ভালো অধ্যাপক হও, ভালো মানুষ হও।’
যেদিন কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে তার আগের দিন সকালে তার মনে সেই বেদনাটা ফিরে এল যা মৃণালের বিয়ের দিন তাকে পীড়িত করেছিল। সেসব এখন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, অমিতের মনে হল, কিন্তু কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে মৃণালের মাসিমণির সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে হল তার। ফোন করতে পারত কিন্তু সেটা না করে সেই বিকেলে সোজা ভদ্রমহিলার বাড়িতে চলে গেল সে। কাজের মেয়েটি তাকে দেখে চিৎকার করতে করতে ভেতরে দৌড়ে গেল। একটু বাদে মাসিমণি ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়ালে অমিত তাঁকে দু’হাত বুকের ওপর এক করে নমস্কার জানাল।
‘বাব্বা।’ মাসিমণি চোখ বড় করলেন, ‘অ্যাদ্দিনে মনে পড়ল মাসিমাকে।’
‘কুচবিহারে ছিলাম এতদিন। তারপর রেজাল্ট বের হল।’
‘তাই?’ ভদ্রমহিলা হাসলেন, ‘কেমন রেজাল্ট হল?’
‘একটুর জন্যে ফার্স্টক্লাস হয়নি।’ মুখ নামাল অমিত।
‘ইসস!’ মাসিমণি মাথা নাড়লেন, ‘হলে ভালো হত, এই বা কম কী? এসো। বসো। আগে মিষ্টি মুখ করো।’
চেয়ারে বসে অমিত বলল, ‘না না। মিষ্টি খাব না। আপনারা সবাই ভালো আছেন তো?’
‘হ্যাঁ বাবা।’ মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা, ‘তুমি তো আসতে পারলে না বিয়েতে। সবাই খুব আনন্দ করেছে। নয়শো লোক নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। খুব আনন্দ করেছে সবাই শুধু একজন ছাড়া।’
‘মানে? কে তিনি?’
‘আর বোলো না, বিয়ের কনের কথা বলছি। আমাদের যেন কারও বিয়ে হয়নি। আমরা কেউ বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে আসিনি—’
‘কেন? কী হয়েছিল?’
‘আষাঢ় মাসের আকাশ করে বসেছিল মুখটাকে। বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে সবারই কষ্ট হয়, আমারও হয়েছিল, তাই বলে ওরকম গোমড়া মুখে বসে থাকতে হবে?’ মাসিমণি বললেন।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? ওখানে গিয়ে কী করছে জানি না, দ্বিরাগমনে বাপের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি, জানো? এটাকে বাড়াবাড়ি বলব না তো কী? সেই তো এখন বরের সঙ্গে উড়িষ্যার সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেলি, তার বেলা? হাসলেন মহিলা।
বড় শ্বাস ফেলল অমিত। জিজ্ঞাসা করল, ‘মেসোমশাই বাড়িতে নেই?’
‘আর বোলো না। শুধু ট্যুর আর ট্যুর! অফিসের কাজে দিল্লি গিয়েছে।’ এইসময় টেলিফোনের রিং হচ্ছে বোঝা গেল। মাসিমণি ‘একটু বসো বাবা’ বলে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরেই তাঁর তীব্র চিৎকার কানে আসায় উঠে দাঁড়াল অমিত।
দ্রুত পাশের ঘরে গিয়ে সে দেখতে পেল ভদ্রমহিলা হাউহাউ করে কাঁদছেন। তাঁর হাতে তখনও টেলিফোনের রিসিভার ধরা রয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বসে পড়লেন চেয়ারে।
অমিত কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’
কাঁদতে কাঁদতে মাসিমণি বললেন, ‘কপাল পুড়ে গেল মেয়েটার। জামাই নেই! সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছে—’
‘সেকি!’ চমকে উঠল অমিত।
‘এখন কী হবে, এখন কী হবে!’ ভদ্রমহিলা পাগলের মতো মাথা নাড়তে লাগলেন। আর এক নাগাড়ে কেঁদে চললেন। কী বলবে বুঝতে পারছিল না অমিত। এখন তার কী করা উচিত! ভদ্রমহিলা কান্না জড়ানো গলায় বলে চলেছেন, ‘আমার জন্যে মেয়েটা বিয়ে হতে না হতেই বিধবা হয়ে গেল! আমিই দায়ী, ও ভগবান।’
অমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে কে ফোন করেছিলেন?’
‘জামাইবাবু। ওরা গোপালপুরে রওনা হয়ে গিয়েছে।’
‘কী হয়েছিল কিছু শুনলেন?’
‘সাঁতার কাটতে গিয়ে স্রোতের টানে জামাই ভেসে গিয়েছে।’ কথার মধ্যেই ফোন বেজে উঠল। কান্না গিলতে গিলতে মাসিমা ফোন তুললেন। ‘হ্যালো! দিদি একি হল রে!’ কিছুক্ষণ কান্না চলল। তারপর বললেন, ‘তুই, তুই জামাইবাবুর সঙ্গে গেলি না কেন? মেয়েটা ওখানে একা এই অবস্থায় কী করছে ভগবান জানেন। হ্যাঁ, ক’টায় ট্রেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আমিও যাব।’ ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। তারপর অমিতের দিকে তাকিয়ে যেন তার সম্বিত ফিরল, অমিত, তুমি কি কখনও গোপালপুর অন সি-তে গিয়েছ?’
‘না মাসিমা। কেন?’
‘দিদির বুকে ব্যথা হচ্ছে খবরটা শোনার পর, তাই জামাইবাবু ওকে গাড়িতে নিয়ে যাননি। কিন্তু মেয়েটা একা আছে বলে আমাদের কারও যাওয়া উচিত। তুমি আমাদের একটা উপকার করবে।’
‘নিশ্চয়ই, বলুন কী করতে হবে!’
‘আমি টাকা দিচ্ছি। শুনলাম রাত ন’টার ট্রেন। যেমন করেই হোক ট্রেনের টিকিট কিনে আনবে?’
‘নিশ্চয়ই।’
ভদ্রমহিলা উঠে আলমারি খুলে টাকা বের করে ফিরে এসে কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘তোমায় একটা কথা বলব?’
‘বলুন।’
‘তোমার তো রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, এখন পড়াশুনার চাপ নেই, তুমি আমার সঙ্গে যাবে? আমি কখনও একা ট্রেনে কোথাও যাইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই।’ ভদ্রমহিলা আবেদন করলেন।
সঙ্গে যাব বলতে যাচ্ছিল অমিত। এখানে এসে আকস্মিকভাবে মেয়েটার বিধবা হওয়ার খবর পেয়ে সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। মাসিমার সঙ্গে গেলে নিশ্চয়ই একটা বড় উপকার করা হবে। কিন্তু হ্যাঁ বলতে যাওয়ার সময় তার মনে পড়ে গেল কাল সকালে তাকে বর্ধমান যেতে হবে। কাল সকাল দশটায় চাকরিতে জয়েন করার নির্দেশ এসেছে। সে যদি গোপালপুরে মাসিমার সঙ্গে যায় তাহলে ফিরে এসে চাকরিটা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। না পেলে কী জবাব দেবে সে বাবাকে? নিজের ভবিষ্যৎ আবার অস্পষ্ট হয়ে যাবে! কিন্তু কিন্তু করে সে কথাটা বলল মাসিমাকে। তিনি বড় চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘এই হল প্রকৃতির নিয়ম। এক পাড় ভাঙে তো অন্য পাড় গড়ে। ঠিক আছে, আমি এক কাজ করি। দু’সেকেন্ড ভাবলেন মহিলা, ‘আমি বরং দিদির বাড়িতে যাই। দিদি এখন একা আছে, খুব ভেঙে পড়েছে, আমার ওর সঙ্গেই থাকা উচিত। হুটহাট করে একা বেরিয়ে পড়ে যদি বিপদে পড়ি তাহলে এই অবস্থায় সবাই দুর্ভোগে পড়বে।’ চোখের জল মুছলেন মাসিমণি, ‘যাও বাবা, সাবধানে যাও।’ আঁচলে মুখ চাপা দিলেন তিনি। কথা খুঁজে না পেয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল অমিত।
বাড়ির বাইরে এসে তার মন খুব খারাপ লাগছিল। মৃণালের বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ওর বর মারা গেল। সাঁতার যারা জানে তারাও সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চায় না। নতুন বউ-এর সামনে কৃতিত্ব না দেখালেই কি চলছিল না লোকটার? অমিতের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এক ছুটে সমুদ্রের ধারে চলে গিয়ে মৃণালকে বলে, ‘ভেঙে পড়ো না, শক্ত হও। জীবন তো এখানেই শেষ নয়, জীবন অগাধ।’
কিন্তু এই ইচ্ছে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তাকে কাল সকালে চাকরির জন্যে কলেজে পৌঁছতেই হবে? না গেলে বাবাকে কী কৈফিয়ত দেবে সে? একদিন সে বাসস্টপে যে মেয়েটির সঙ্গে মাত্র একবার কথা বলার চেষ্টা করেছিল কোনও একদিন তার স্বামী সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে শুনে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রে চলে গিয়েছিল। শুনে বাবা কী বলবে? হয়তো সারাজীবনে আর মুখ দেখবে না। কিন্তু তাকে দেখলে কি মৃণাল কান্না মুছে তাকাত?
কিন্তু এমন হতেই পারে, সে পৌঁছনোর আগেই মৃণালের আত্মীয়স্বজন পৌঁছে গেছে এবং তাদের ভিড় সরিয়ে সে মৃণালের কাছে পৌঁছতে পারবে না। সেক্ষেত্রে এই যাওয়াই বিফলে যাবে। তবু মেয়েটার জন্যে অমিতের খুব মন খারাপ লাগছিল। বাঙালি মেয়ে বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই যদি বিধবা হয়ে যায় তাহলে তার ভাগ্য কি সুখের হয়?
.
বর্ধমান থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের কলেজে পৌঁছে প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করতেই তিনি বললেন, ‘আসুন ভাই। বসুন। এর আগে কখনও ছাত্র পড়িয়েছেন? স্কুলে বা প্রাইভেটে?’
মাথা নেড়ে সত্যি কথা বলল অমিত, ‘না।’
হেসে ফেললেন ভদ্রলোক, ‘একরম প্রশ্ন শুনলে জয়েন করতে এসে ক্যান্ডিডেট অনেক বড় বড় কথা বলে। আপনি সেই পথে হাঁটেননি শুনে খুশি হলাম। আপনি কি বর্ধমান শহর থেকে রোজ যাতায়াত করবেন?’
‘এখানে থাকার ব্যবস্থা না থাকলে তাই করব।’ অমিত বলল।
‘ব্যবস্থা আছে। স্কুলের কাছেই এক ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখেন। আগের মাস্টারমশাইও ওখানে থাকতেন। খুব রিজনেবল চার্জ করেন।’
‘তাহলে তো খুব ভালো, হয়ে গেল! আমাকে কবে জয়েন করতে হবে?’
‘আগামী সোমবারে অসুবিধে হবে?’
‘একদম নয়।’
প্রিন্সিপ্যালের কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করে কথা বলে কলেজে ফিরে চাকরির যাবতীয় কাগজপত্রে সই করল সে।