৪
হোস্টেলে ফেরার সময় বাসে বসে চোখ বন্ধ করল। যা বলবে বলে ভেবে গিয়েছিল তা না বলে যা সত্যি তাই বলে এল সে? কিছুতেই সাজিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারল না মৃণালের মেসোমশাই-মাসিমণিকে।
অমিত চোখ খুলল। আচ্ছা, যদি সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারত তাহলে কী হত? সে যদি বলত যার সঙ্গে সম্বন্ধ হচ্ছে সেই ছেলের একজন প্রেমিকা আছে। বহুদিনের প্রেম। সেই প্রেমিকাও কলেজে পড়ায়। বেজাতের মেয়ে বলে পাত্রের মা-বাবা সেই মেয়েকে বাড়ির বউ করবে না। তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো মনের জোর ছেলের নেই। চাপে পড়ে যদি সে বিয়ে করে তাহলেও তার পক্ষে প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এইসব কথা বলার সময় কিছু কিছু লোকের নাম তাকে করতে হত যাদের কোনও অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু বলার সময় কিছুতেই কথাগুলো মুখ দিয়ে বের হল না।
এইসব ভাবতে ভাবতে তার মনে আর একটা কথা ধীরে ধীরে জোরালো হল। যদি সে বলতে পারত এই মিথ্যেটা তাহলে বিয়ে ভেঙে গেলেও যেতে পারত। তারপর আবার কোনও সম্বন্ধ এলে মাসিমণি তাকে খোঁজখবর নিতে অনুরোধ করলে সে একটা না একটা কারণ দেখিয়ে সেই ছেলে বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কথা সাজাত। তাতেও হয়তো বিয়ে ভাঙত। তারপর কী হত?
আচ্ছা, যদি উল্টোটা হত। যদি মাসিমণি তাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘এত চেষ্টা করেও মেয়ের জন্যে ভালো ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না, তুমি তো আজ বাদে কাল এম.এ পাশ করবে। তোমার বাবার ফোন নাম্বার দাও, আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলব।’
কথাগুলো মাথায় আসামাত্র সে সোজা হয়ে বসল। এরকম যদি হয় তাহলে কেমন হবে? ভাবাই যায় না। কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে রইল সে। বাস থেকে হোস্টেলে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল সে। তারপরেই বাবার মুখ মনে এল। বাবা যদি মেসোমশাই-মাসিমণিকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা অমিতের সঙ্গে আপনাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু ভেবেছেন কি, ওকে খাওয়াবে কে? অমিতের তো আমার পয়সায় চলছে। যদি পাস করে তাহলে কবে কীরকম চাকরি পাবে তা ঈশ্বর জানেন। আপনারা কি ভেবেছেন আমি চিরকাল ওদের দুজনের ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেব?
বাবা এরকম প্রশ্ন করতেই পারেন। করলে মাসিমণি তার কাছে এর জবাব চাইলে সে কী বলবে? এখন যা অবস্থা তাতে কোনও পাগলও বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারে না। সপ্তাহে দুই-তিনঘণ্টা পার্কে বাসে প্রেম করা যায় তার বেশি এক পা-ও নয়।
অমিত চোখের সামনে হাতের আঙুলগুলো মেলে ধরল। যদি এরা না থাকত তাহলে সে কোনও কিছু ধরতে পারত। ওই যে পাণিগ্রহণ না কি যেন বলে, তা কি গ্রহণ করতে পারত? অসম্ভব। তার তো এখন ওই আঙুলছাড়া হাতের অবস্থা। মনে মনে তলোয়ার ঘুরিয়ে জীবনযুদ্ধে নামার স্বপ্ন দেখে কী লাভ—এইসব ভাবতে ভাবতে মিইয়ে গেল অমিত। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে তো কোনও লাভ নেই!
.
পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই কুচবিহার থেকে বাবার চিঠি এল, ‘তোমার পরীক্ষা শেষ হলে রেজাল্ট বের না হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় থাকার আবশ্যকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। এম.এ পাশ করার পর তোমার কী করার ইচ্ছা তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে? আজ তোমাকে এই মাসের টাকার সঙ্গে কুচবিহারে আসার ট্রেনের ভাড়া পাঠালাম। পাওয়ামাত্র টিকিট কেটে নিও। আশীর্বাদক, তোমার বাবা।’
যাঃ। অমিত ভেবেছিল পরীক্ষার পরে সে দীঘায় বেড়াতে যাবে। দীঘাতে তার সহপাঠী রবীন্দ্রনাথের বাড়ি আছে। অবশ্য সেখানে ওর বাবা-মা থাকেন না। তাঁরা থাকেন তমলুকে। রবীন্দ্রনাথ বার বার করে বলেছে। দীঘার বাড়িতে যে কাজের লোক আছে সে রান্না করে দেবে। বারান্দায় বসেই সমুদ্রের ঢেউ দেখা যাবে। এখনও কোনও দিন স্বচক্ষে সমুদ্র দ্যাখেনি অমিত। তাই খুব ভালো লেগেছিল প্রস্তাবটা। কিন্তু বাবার এই চিঠির পরে সমুদ্র দ্যাখার ইচ্ছে বাতিল করতে হল।
যেদিন পরীক্ষা শেষ হল সেই বিকেলে বেয়ারা এসে জানাল, একজন দিদিমণি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
বাইরে বেরিয়ে অবাক হল অমিত। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মাসিমণি। মুখে মিষ্টি হাসি। জিজ্ঞসা করলেন, ‘পরীক্ষা কেমন হল?’
‘ভালোই। আপনারা কেমন আছেন?’
‘খুব চাপে আছি বাবা। আগে এটা ধর!’ হাত বাড়িয়ে একটা খাম এগিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। ‘তোমার সুপারিশে মৃণালের বিয়ে স্থির হয়েছে। সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। ছেলের মায়ের ওকে দেখে এত পছন্দ হয়ে গেল যে একটুও দেরি করতে চাইলেন না। তোমার হোস্টেলের কাছাকাছি বিয়ে বাড়ি নেওয়া হয়েছে। তোমাকে তো আসতেই হবে।’ মাসিমণি বললেন।
তারিখটা দেখল অমিত। ওই সময় তার কুচবিহারে থাকার কথা। বিয়ে উপলক্ষে কলকাতায় আসতে হলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। এই একমাস হোস্টেলের মিল অফ করে গেলে অনেক পয়সা বাঁচবে। ভদ্রমহিলাকে একথা সে বলবে কী করে!
সে মাথা নাড়ল, ‘চেষ্টা করব। খুব চেষ্টা করব।’
‘মানে? একি বলছ তুমি?’ মাসিমণি খুব অবাক হলেন।
‘আসলে আমার তো পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। আগামীকাল আমি কুচবিহারে বাবা-মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি। রেজাল্ট বের হওয়ার আগে ফিরে আসার কথা। বিয়েটা তো তার মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে। তাই—।’ বলতে বলতে থেমে গেল অমিত। মুখের ওপর না বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল।
‘সেকি! তুমি বিয়েতে থাকবে না তা হয় নাকি? তোমার জন্যেই তো এমন পাত্র মৃণালের জন্যে পেয়েছি।’ বিমর্ষ মুখে বললেন মাসিমণি।
‘আমি চেষ্টা করব, খুব চেষ্টা করব।’
অনেক অনুরোধ করে ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর অমিতের মনে হল, শাপে বর হয়েছে। বাবার চিঠিটা পেয়ে তার মন খারাপ হয়েছিল দীঘায় যেতে না পারার জন্যে। এখন মনে হচ্ছে কলকাতায় থাকলে মৃণালের বিয়েতে না যাওয়ার কী কারণ দেখাত? কিন্তু এটাও সত্যিই যেতে তার ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু পরের দিন সকালে যে তার জন্যে এত বড় চমক অপেক্ষা করছিল তা অমিতের কল্পনাতেই আসেনি। সকালের চা খাওয়ার পর জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল অমিত। তার ট্রেন দুপুরে। হোস্টেলের কাজের লোক এসে জানিয়ে গেল তার ফোন এসেছে।
সে যে কুচবিহারে যাচ্ছে তা কয়েকজন সহপাঠী জানে। তাদের কেউ হয়তো ফোন করেছে ভেবে অমিত দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে এসে টেবিলের ওপর শোওয়ানো রিসিভার তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আপনি কি অমিত?’ একটি মেয়েলি গলা ভেসে এল।
‘হ্যাঁ, আমি অমিত।
‘ও। নিজেকে আপনি কী ভাবেন? খুব বড় মনের মানুষ? দাতা কর্ণ?’ ভদ্রমহিলার গলায় বিদ্রুপ স্পষ্ট।
চোখ বড় হয়ে গেল অমিতের। বলল, ‘আপনি কে বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘বুঝতে গেলে যে মগজ মাথায় থাকা দরকার তা আপনার নেই। আপনাকে এই ফোন করছি একটা প্রশ্ন করতে। জবাব দিন। আমার সর্বনাশ না করা পর্যন্ত আপনার ঘুম হচ্ছিল না কেন?’
‘আপনি কে আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। আপনার সর্বনাশ কেন করব? আমার কতটুকু ক্ষমতা? আপনি ভুল করছেন—!’
‘সেকি! আমার মাসিমা আপনাকে আমার জন্যে পাত্র খোঁজার কথা বললে আপনি সেই দায়িত্ব নেননি? সত্যি কথা বলুন!’
‘ও।’ হকচকিয়ে গেল অমিত, ‘আপনি!’
‘টু বি আর নট টু বি—এই ন্যাকামি আপনি করেননি?’
‘মানে—।’ কথা খুঁজে পেল না অমিত।
‘আমি পার্কে গিয়ে কী করছি, কাদের সঙ্গে বসে সিগারেট খাচ্ছি তাতে আপনার কী? কী লাভ হল আপনার?’
আমি কোনও কিছুর জন্যে ওঁকে বলিনি।’
‘তাহলে আমাকে ফলো করে পার্কে গিয়েছিলেন কেন?’
কী জবাব দেবে ভেবে পেল না অমিত।
‘চুপ করে থাকলে চলবে না। জবাব দিন।’
‘বিশ্বাস করুন, আমি আপনার ক্ষতি হোক এমন কিছু কখনই করতে চাইনি।’ পরিষ্কার গলায় বলার চেষ্টা করল অমিত।
‘একশোবার করেছেন। আপনি একজন মানুষ যার কোনও মেরুদণ্ড নেই। শুনলাম বিয়েতে আসবেন না বলে কলকাতা থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। কেন? আসুন, বিয়ের নেমন্তন্ন পেট ভরে খেয়ে যান।’ কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিল মৃণাল।
পাথরের মতো কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল অমিত। আজ মৃণাল যেসব কথা বলল তার পেছনে যে কারণটা সে আন্দাজ করছে তা এতকাল বুঝতে পারেনি কেন? বড় ঢোঁক গিললো অমিত।
.
কুচবিহারের বাড়িতে এসে প্রথমদিকে মা বাবা ভাই-এর সঙ্গে এবং ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গ পেয়ে সে ভালোই ছিল। কিন্তু মৃণালের বিয়ের তারিখটা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। যেদিন কলকাতায় মৃণালের বিয়ে সেদিন শরীরে উত্তাপ এল। জ্বর হয়েছে বলে বিছানায় শুয়ে রইল অমিত। কিন্তু দুপুরবেলায় তার মনে হল হলিউড বা বলিউডের বিখ্যাত সুন্দরী তারকাদের দেখলে মন মোহিত হয়। খুব কম তরুণ তাঁদের কাছে পৌঁছনোর জন্যে পাগল হয়। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ একটু বয়স হলে সেই উন্মাদনা কাটিয়ে ওঠে। ব্যাপারটা নিয়ে ওইরকম ভাবা যে হাস্যকর তা বুঝতে আর অসুবিধে হয় না।
মৃণালের পরিবার, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান তাদের থেকে এতটাই ওপরে যে তুলনা করাই চলে না। আজ মৃণালের বিয়ে হয়ে যাবে। আজ তার এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নেই। এম.এ পাশ করে যখন সে কাজকর্ম করবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন হয়তো মৃণালের বিবাহিত জীবনে সন্তান এসে যাবে। সে কখনই মৃণালের সঙ্গে এক প্লাটফর্মে আসবে না। তাই মৃণালের নতুন জীবনে যাওয়ার দিনে মন খারাপ করে কী লাভ? রাত যখন বাড়ল তখন কিনু গোয়ালার গলির লাইনগুলো মনে এল অমিতের, ‘মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ।’
রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই চাকরির ইন্টারভিউ লেটারটা কুচবিহারের বাড়িতে চলে এল। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি, ইন্সপেক্টারের পদ। চিঠিটা দেখে বাবা বললেন, ‘মাইনেটা খারাপ নয়। কিন্তু তোমাকে প্রশ্ন করব, এম.এ পড়লে কেন?’
‘মানে?’ হকচকিয়ে গেল অমিত।
‘এই চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অন্তত বি.এ পাশ। তাহলে আরও দু’বছর পড়াশোনা করে এম.এ দেওয়ার কী দরকার ছিল? উত্তর দাও।’
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজে পেল না অমিত।
‘উত্তর তোমার জানা নেই। ঠিক আছে, কলকাতায় যাও, ইন্টারভিউ দাও, কিন্তু যদি চাকরিটা পাও তাহলে তোমাকে ঋণশোধ করতে হবে।’
‘ঋণশোধ? মানে?’ হকচকিয়ে গেল অমিত।’
‘এই সরকারি চাকরিটার জন্যে দু’বছর এম.এ পড়ার দরকার ছিল না। তার মানে আমি দু’বছর ধরে তোমার পেছনে অর্থের অপব্যায় করেছি। তোমার একটি ভাই আছে। তার পড়াশুনা চলছে। আমি তাকে বঞ্চিত করতে পারি না। তাই এম.এ পড়ার জন্যে যে টাকা খরচ হয়েছে তা চাকরি পেয়ে আমাকে ফেরত দেবে। সেইজন্যে আমি তোমাকে চারবছর সময় দিচ্ছি। তুমি দ্যাখো, কলকাতায় গিয়ে ইন্টারভিউ ভালো দিয়ে চাকরিটা পাও কিনা।’ গম্ভীর মুখে বাবা কথাগুলো বললেন।
‘যদি এই চাকরি না পাই—!’
তোমার দুর্ভাগ্য। তবে যদি এম.এ পাশ করার পর এমন কোনও চাকরি পাও যার জন্যে এম.এ ডিগ্রির যোগ্যতা দরকার হয়, তাহলে তোমার কাছ থেকে আমি কোনও টাকা ফেরত নেব না।’ বাবা সামনে থেকে সরে গেলেন।
কী করবে বুঝতে পারছিল না অমিত। যা হয় হবে ভেবে কলকাতায় ফিরে এল সে।