৩
হোস্টেলে ফিরতেই অবাক হয়ে গেল অমিত। গেটের সামনে যে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেটা যে মাসিমণিদের তা বুঝে এগিয়ে গেল সে। গাড়ির দরজা খুলে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি না এসে পারলাম না। সামনের রবিবার উকিলবাবু মেয়ে দেখতে আসতে চাইছেন।’
‘সেকি?’
‘হ্যাঁ! আজকের মধ্যেই খোঁজ খবর নাও বাবা।
‘আমি এখন ওদের বাড়ি দেখে এলাম।’
ভদ্রমহিলার মুখে হাসি ফুটল, ‘তাই! খুব বড় বাড়ি বুঝি!’
‘চারতলা বাড়ি। পাঁচিল ঘেরা।’ অমিত বলল।
‘বাঃ। ছেলেটি সম্পর্কে কিছু কি আজ জানতে পারলে?’
‘হ্যাঁ।’ আজ যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অকপটে বলল অমিত।
শুনতে শুনতে চোখ বড়, মুখ হাঁ হল, গালে হাত দিলেন মাসিমণি, তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘সেকি গো?’
‘আমার তো ওকে বড়লোকের বকে যাওয়া ছেলে বলে মনে হয়েছে।’
‘তাহলে তো এই বিয়ে আটকাতেই হবে। জেনেশুনে তো মেয়েটাকে ভাসিয়ে দিতে পারি না।’ তারপরেই চিন্তায় পড়লেন, ‘কিন্তু কথাটা তো দিদি-জামাইবাবুকে জানাতে হবে, কী করে জানাব?’
অমিতের মনে হল মাসিমণি ঠিকই বলেছেন। ওঁরা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন তিনি জানলেন কী করে? কী উত্তর দেবেন মাসিমণি। আচমকা তার মাথায় মতলবটা এল। সে বলল, ‘আপনার দিদির ফোন নাম্বার যদি দেন তাহলে নিজের পরিচয় না দিয়ে ওঁকে সব কথা জানিয়ে দিতে পারি।’
‘পারবে? তুমি পারবে?’ মুখে হাসি ফুটল ভদ্রমহিলার।
‘এরকম কখনও করিনি। তবে কারও ভালো হবে বলে চেষ্টা করতে পারি।’ নীচু স্বরে কথাগুলো বলল অমিত।
‘দাঁড়াও। দিদির টেলিফোন নাম্বারটা তোমাকে লিখে দিচ্ছি।’ ভদ্রমহিলা একটা কাগজে নাম্বার লিখে দিলে অমিত বলল, ‘আপনি একটু বসুন, আমি হোস্টেলের অফিসঘর থেকে ফোন করে আসি।’
দ্রুত অফিসঘরে চলে এসে খুশি হল অমিত। এখন ঘরে কেউ নেই। সে রিসিভার তুলে ডায়াল করল। কিছুক্ষণ পরে মহিলা কণ্ঠ কানে এল। অমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, মৃণালের বাবাকে ফোনটা দেবেন?’
‘উনি কাজে গিয়েছেন। আপনি কে বলছেন?’
‘আপনি আমাকে চিনবেন না। তাহলে মৃণালের মাকেই দিন।’
‘আমি মৃণালের মা। আপনি কে বলুন তো?’
‘পরিচয় দিলে চিনতে পারবেন না। শুধু বলব, যার সঙ্গে আপনারা মেয়ের বিয়ে দিতে যাচ্ছেন সেই উকিলবাবুর ছেলের চরিত্র কীরকম তা খোঁজ নিয়ে দেখুন। রোজ মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে, মানুষের সঙ্গে কোনও কারণ ছাড়াই খারাপ ব্যবহার করে। নিজের মেয়ের সর্বনাশ করবেন না। আমার কথা বিশ্বাস না-হলে ওর পাড়ায় গিয়ে খোঁজ করলেই সত্যিটা জানতে পারবেন। আচ্ছা নমস্কার।’ ভদ্রমহিলাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ফোন করার খাতায় নিজের নাম লিখে বাইরে বেরিয়ে এল অমিত।
ভদ্রমহিলা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। একটা হাত গাড়ির দরজায়। মুখে উদ্বেগের ছাপ। তিনি কথা-বলার আগেই টেলিফোনের কথাগুলো অমিত তাঁকে সবিস্তারে বলল, ভদ্রমহিলা বললেন, ‘সত্যি এসব বলেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওঃ, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বাবা। তোমার কি মনে হয় দিদি তোমার কথা বিশ্বাস করবে? দিদি করলও জামাইবাবু কি শুনবে?’
‘আমি তো ওঁদের চিনি না, কী করে বলব বলুন।’
‘আচ্ছা, এই যে ফোন করলে, তার দাম হোস্টেল নেবে?’
‘তা তো নেবেই।’
সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুঠোয় ধরা পার্সের চেন খুলে তা থেকে দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে ধরলেন ভদ্রমহিলা, ‘তুমি টাকাটা রাখো।’
‘না না, একি করছেন আপনি।’
‘দ্যাখো, তুমি চাকরি করো না। মফসসল থেকে কলকাতায় এসেছ পড়াশুনা করতে। এখন তুমি বাড়তি খরচের টাকা কোথায় পাবে?’
‘ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ।’
ভদ্রমহিলা টাকাটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘আমি এখনই দিদির বাড়িতে যাচ্ছি। ওখানে কী হচ্ছে তা তোমাকে জানাব।’ গাড়িতে উঠলেন তিনি।
.
এখন প্রায় সন্ধ্যা। জামাইবাবুর বাড়ি প্রায় পুরোনো দিনের জমিদার বাড়ির মতন। দোতলায় উঠে তিনি দেখলেন দিদি বারান্দায় বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে। উল্টোদিকে জামাইবাবু।
তাকে দেখে দিদি সোজা হল, ‘কিরে।’
‘আর বলিস না দিদি। জিলিপি খাওয়ার শখ হয়েছিল তাই ড্রাইভারকে বলেছিলাম মিষ্টির দোকানে যেতে। অন্তত তোদের বাড়ি অবধি দশটা দোকানে ঢুঁ মেরে এসে ড্রাইভার বলল কেউ নাকি বিকেলে জিলিপি বিক্রি করে না। ওটা সকালে বানায়, সকালেই শেষ। এতদূরে এসেছি যখন তখন ভাবলাম তোর বাড়ি থেকে চা খেয়ে যাই। মেয়ে কোথায়? ডাক তাকে! চেয়ার টেনে বসলেন মহিলা।
দিদি ঢোঁক গিলে জামাইবাবুর দিকে তাকালেন। তাই দেখে জামাইবাবু কাঁধ নাচালেন। সেটা লক্ষ করে বোন বলল, ‘কিছু হয়েছে নাকি? তোমরা কীরকম গম্ভীর মুখ করে বসে আছ!’
জামাইবাবু বললেন, ‘তোমার দিদির বাস্তববুদ্ধি কবে হবে জানি না। কাক কান নিয়ে গেছে শুনে কাকের পেছনে দৌড়াচ্ছে।’
বোন হাসল, ‘ও মা। কী হয়েছে?’
‘একদম বাজে কথা বলবে না। একটা অচেনা লোক গায়ে পড়ে এমন খবর দেবে কেন?’ দিদি ফুঁসে উঠল।
লোকটা কে? তাকে চেনো? সে কি তার নাম বলেছে? এটা আজ নয়, চিরকাল হয়ে এসেছে। কিছু লোকের অভ্যেস হল ভালো কাজ যাতে না হয় তাই লাগানি ভাঙানি দেওয়া।’
‘তাতে তার কী লাভ! বললেই হল।’ দিদি বলল।
বোন মাথা নাড়ল, ‘ব্যাপারটা কী তা বলবে তো?’
দিদি বলল, ‘একজন ফোন করে তোর জামাইবাবুকে প্রথমে চাইল। ও নেই শুনে আমাকে বলল, যে ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে সে নাকি রোজ মদ খায়। অত্যন্ত খারাপ ছেলে।’
‘মদ খেলেই খারাপ হয়? আমিও তো পার্টিতে গেলে এক আধ পেগ ড্রিঙ্ক করি। তারমানে আমি খারাপ?’ জামাইবাবু বললেন।
‘তোমার বয়সে বছরে দুদিন যা কর তা তোমার হাঁটুর বয়সি ছেলে যদি রোজ করে তাহলে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে কী হবে তা কল্পনা করতে পারো?’ দিদি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
বোন জিজ্ঞাসা করল, ‘যার সঙ্গে মৃণালের সম্বন্ধ এসেছে সে কি খুব মদ খায়? কী করে ও। পড়াশুনা করে তো?’
‘তাতেই এই, বোঝ। ওর সঙ্গে বিয়ে হলে মাস দুয়েক পরে মেয়ে নেশা করে বাড়িতে ফিরবে, এই তোমাকে বললাম।’ দিদি কথাগুলো বেশ জোরের সঙ্গে বলল।
‘আমি বুঝতে পারছি না, তোমরা একটা উড়ো ফোনের কথা বিশ্বাস করছ কী করে। লোকটা যদি নিজের পরিচয় দিয়ে ওই কথাগুলো বলত তাহলে বোঝা যেত।’ জামাইবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, ওই পাড়ায় আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক থাকেন। ভেবেছিলাম বিয়ের ব্যাপার নিয়ে পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করলে তারা হয়তো ওই ছেলের বাবাকে খবরটা দিয়ে দেবে। তোমরা যা করছ তাতে আর না করে কোনও উপায় থাকছে না।’ জামাইবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দেওয়ালের পাশে টেবিলের ওপর রাখা ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। মিনিট তিনেক কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে চেয়ার ফিরে এলেন?
দিদি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’
‘নাঃ, ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। ভদ্রলোক বলছেন, ছেলেটা হয়তো একটু রগচটা, কিন্তু মাঝে মাঝে ড্রিঙ্ক করলেও করতে পারে, তবে রোজ করে বলে মনে হয় না।’ মুখ গম্ভীর জামাইবাবুর।
শোনামাত্র দিদি চেঁচিয়ে উঠল, ‘তার মানে ফোনে লোকটা যা বলল তা মিথ্যে নয়। ছিঃ! কলেজে পড়া একটা ছেলে বাপের পয়সায় মদ খাচ্ছে আর বাপ তাকে কিছু বলছে না, প্রশ্রয় দিচ্ছে, এই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেবে তুমি?’
‘আমি তো বললাম, আর একটু খোঁজ করে দেখতে হবে।’ জামাইবাবু বললেন।
দিদি বোনের দিকে তাকালেন, ‘দ্যাখ তোর জামাইবাবুর কাণ্ড। এসব শোনার পরেও উনি বলছেন ভাবতে হবে, খোঁজ নিতে হবে। তারচেয়ে মেয়েকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দাও না। তোমার ঘাড় থেকে বোঝা নেমে যাবে।’
এবার শ্যালিকা কথা বলল, ‘জামাইবাবু, ভাগ্যিস ফোন এসেছিল, নইলে তো আমরা জানতেই পারতাম না। তাই না। দিদি ঠিকই বলছে, আর ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। আপনি ওদের রবিবারে আসতে নিষেধ করে দিন।’
‘নিষেধ করতে হলে বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখাতে হয় যে—?’
‘আশ্চর্য! তোর জামাইবাবুর কথা শুনলি?’ দিদি মাথা নাড়ল।
শ্যালিকা বলল, ‘যা হোক কিছু বলে দাও না। জ্যোতিষী বলেছে দেড় বছরের মধ্যে বিয়ে দিলে ঘোর অমঙ্গল হবে। যে সে জ্যোতিষী নয়, একবারে বেনারসের জ্যোতিষী। নাম জিজ্ঞাসা করলে যা হোক নাম বলে শেষে একটা আনন্দ বসিয়ে দিলেই বিশ্বাস করবে।’
দিদি বলল, ‘খুব ভালো, বলো, তুমি এখনই বলো।’
‘এখন তো ফোন ধরেন না, মানে ফোন করলে বিরক্ত হন। বলেন, সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে ফোন করতে।’ জামাইবাবু বললেন।
‘না জামাইবাবু,’ শ্যালিকা বলল, ‘এটা অত্যন্ত অসভ্যতা। আপনি ভদ্রলোকের হবু বেয়াই। আপনার সঙ্গে কর্মচারীর মতো ব্যবহার করছেন। দিনে ওই এক ঘণ্টার বেশি তিনি আপনার সঙ্গেও কথা বলবেন না? চমৎকার!’
জামাইবাবু আবার উঠলেন, ফোন করে উকিলবাবুকে শেখানো কথাগুলো স্পষ্ট গলায় বলে রিসিভার রেখে দিলেন।
শ্যালিকা বলল, ‘খুব ভালো কাজ করলেন জামাইবাবু।’
জামাইবাবু বললেন, ‘শোনো, যে ছেলেটি কলেজে পড়াচ্ছে, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে, অবশ্য বনেদি বড়লোক নয়, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করলে আশা করি তোমাদের আপত্তি হবে না—!’
দিদি বলল, ‘আগে খোঁজ খবর নাও। সব ছেলে তো মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কী আছে তা জানব কী করে?’
জামাইবাবু বললেন, ‘লাক! লাকে যা আছে তাই হবে। তোমাদের বাবা-মায়ের লাক ভালো ছিল বলে দুটো ভালো জামাই পেয়েছিলেন। বলছ যখন, তখন নিশ্চয়ই খোঁজ নেব।’
শ্যালিকা উঠে দাঁড়াল, ‘মেয়ে কোথায়?’
‘রবিবারে পাত্রপক্ষ আসবে শুনে রাগ করে শুয়ে আছে।’ দিদি বলল। ‘তুই যা তো, গিয়ে খবরটা দে ওকে।’
মৃণালের মাসিমণি হাসিমুখে ভেতরে চলে যায়।
.
পরের দিন সকালে মাসিমণি অমিতকে ফোন করে বললেন, ‘তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বাবা, মৃণালের ওই সম্বন্ধ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তুমি যদি ওখানে গিয়ে খবরটা না নিয়ে আসতে তাহলে সারাজীবন কেঁদে মরত মেয়েটা।’
‘খুব ভালো খবর এটা। তবে—!’ বলতে গিয়ে থেমে গেল অমিত।
‘থেমে গেলে কেন, কী বলছিলে বলো বাবা!’
‘মৃণাল ওই পার্কে আর যাচ্ছে না তো!’
‘না না। আমি রোজ ওকে কলেজে পৌঁছে দিচ্ছি আবার ছুটির সময় নিয়ে আসছি আমার বাড়িতে। দিদি এসে ওকে নিয়ে যায়। পার্কে যাবে কী করে?’
‘তাহলে তো ভালোই।’
‘তোমার ওপর খুব কাজের বোঝা চাপাচ্ছি আমি। কিছু মনে করছ না তো?’
‘না না। বলুন, কী করতে হবে?’
‘আগে বলো, তোমার পরীক্ষা কবে?’
‘এখনও বারো সপ্তাহ বাকি আছে।’
‘তাহলে থাক।’
‘না না, কী করতে হবে বলুন না। আমার কোনও অসুবিধে নেই।’
কিন্তু কিন্তু করেও শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ছেলেটির কথা অমিতকে বললেন মাসিমণি, ‘দ্যাখো, পড়াশুনা নষ্ট করে খোঁজখবর নিতে বলছি না। যদি তুমি সময় পাও তাহলেই—, বুঝতেই পারছ!’
‘আপনি ঠিক কী খবর চাইছেন তা যদি বলেন—।’ অমিত বলল।
‘ছেলেটি কেমন? কীরকম বয়স। ওর সম্বন্ধে পড়ার লোকজন কী বলে এটুকু জানলেই হবে। বাকিটা মৃণালের কপালে যা আছে তাই হবে।’
মাসিমণি ফোনেই ছেলেটির সম্পর্কে যা যা তথ্য বললেন তা অমিত একটা কাগজে লিখে নিল।
ভাবী পাত্রের নাম তারাশংকর রায়। গড়িয়ার একটি কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক। বাড়ি হাজরা রোডে। অমিতের মনে পড়ল ওর ক্লাসের সহপাঠী স্বপন হাজরা রোডে থাকে। সে খুব সরলভাবে স্বপনকে বলল, ‘তুমি হাজরা রোডের যেখানে থাকো সেখান থেকে কমলালয় বলে দোকানটা কতদূরে?’
‘কাছেই। কেন বলো তো?’
‘ওখানে, মানে ওই দোকানের পাশে একজন ভদ্রলোক থাকেন যিনি ইংরেজিতে অধ্যাপনা করেন। নাম বললে চিনতে পারবে?’
‘কী নাম?’
স্বপনকে নামটা বলল। স্বপন চিনতে পারল না, কিন্তু জানালো খোঁজ নিয়ে এসে জানাবে। ওখানে একটা মুদির দোকান আছে। তারা সবাইকে চেনে।
দুদিন বাদে স্বপন যে তথ্য জানাল তার সঙ্গে মাসিমণির দেওয়া তথ্যের পার্থক্য নেই। তখন স্বপনকে খোঁজ নেওয়ার কারণটা বলল অমিত। স্বপন যা বলল তাতে অমিত বুঝতে পারল বাঙালি মা-মাসিরা যেমন ধরনের পাত্রকে জামাই হিসেবে পেতে চান তারাশংকর রায় তার আদর্শ উদাহরণ।
খবরটা নিশ্চয়ই ভালো। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার এইরকম পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তার জীবন নিশ্চিন্ত করতে চান। কিন্তু হঠাৎ অমিতের মন উদাস হয়ে গেল।
স্রেফ মজা করার জন্যে কলেজের বাসস্টপে সে মৃণালের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিল। তারপর যে যে ঘটনা ঘটেছিল তাতে মন থেকে মজা করার ইচ্ছাটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেসময় যেন মনে হয়েছিল, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। তারপর থেকে তার সঙ্গে মৃণালের দেখা হয়নি এবং দেখা করার জন্যে মনে আগ্রহ তৈরি হয়নি। কিন্তু ওই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পার্কে বসে সিগারেট খাওয়া, বড় উকিলের কুপুত্রের সঙ্গে প্রায় পাকা হতে চলা বিয়ের সম্পর্ক তার উদ্যোগে বানচাল হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার মনে একটা নরম অনুভূতি তিরতিরিয়ে কাঁপছে।
তাই এই সুপাত্রের কথা যদি মাসিমণিকে জানিয়ে দেয় তাহলে পাত্রীপক্ষ হিসেবে নিশ্চয়ই ওঁরা খুশি হবেন। হয়তো মৃণালের বিয়েও এই অধ্যাপক ছেলের সঙ্গে হয়ে যাবে। দুজনের বয়সের পার্থক্য কত? মৃণালের বয়স আঠারোর বেশি নয়। অধ্যাপকের কত হবে? অন্তত বাইশ-তেইশের আগে তো এম.এ পাশ করা সম্ভব নয়। তারপরে চাকরির চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত কলেজের চাকরি পেতে পেতে তো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়। যদি পাঁচ বছর অপেক্ষার পরে চাকরি পেয়ে থাকে এবং সেই চাকরির বয়স যদি দু’বছর হয়ে থাকে তাহলে ওই তারাশংকর রায়ের বয়স কিছুতেই তিরিশের নীচে হবে না। তাহলে দুজনের বয়সের পার্থক্য অবশ্যই বারো বছর। এই কথাটা কি সে মাসিমণির কানে ঢুকিয়ে দেবে?
সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। বেল বাজার পরে দরজা খুললেন মেসোমশাই। বললেন, ‘আরে তুমি যে! এসো এসো।’
ঘরে ঢোকার পর চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে নিজে একটায় বসে বললেন, ‘তারপর! কী খবর বলো? কেমন আছ?’
‘আছি।’ হাসল অমিত।
‘শুনলাম তুমি মৃণালকে এবার রক্ষা করেছ। গুড। গুড।’
এইসময় ভেতর থেকে মাসিমণি বেরিয়ে এলেন, ‘ওমা! তুমি কখন এলে। বসো বসো।’ ভদ্রমহিলা অন্য চেয়ারে বসে বললেন, ‘কোনো খবর পেয়েছ বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল অমিত।
মেসোমশাই বললেন, ‘আমি শুধু খবর পেয়েছি ছাত্রদের কাছে ও অধ্যাপক হিসেবে বেশ পপুলার।’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল অমিত। ‘ওঁর বিরুদ্ধে কোনও কথা শুনিনি।’
মেসোমশাই বললেন। ‘বাঃ, তাহলে তো হয়েই গেল। তুমি তোমার দিদিকে ফোন করে দাও। ছেলে-মেয়ে যদি দুজন দুজনকে যদি পছন্দ করে তাহলে তো কাজটা হয়েই যেতে পারে।’
মাসিমণি উঠে দাঁড়ালেন, ‘দাঁড়াও, আগে তোমাকে মিষ্টি খাওয়াই।’