হায় সজনি – ২

হোস্টেল থেকে মাইল খানেক রাস্তা হেঁটেই এল অমিত। বাবা যা প্রতি মাসে পাঠান তাতে সব খরচ মেটাবার পর হাতখরচ হিসেবে সামান্যই থাকে। কিছুদিন তার মনে হয়েছে পার্ট টাইম কোনও কাজ করবে। কিন্তু তার জন্যে যে সময় দিতে হবে তাতে পড়াশুনার ক্ষতিই হবে। বাবা যা পাঠান তাতে বাজে খরচ না করে চললে তেমন অসুবিধে হয় না।

একবার বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটি দরজা খুলে বলল, ‘আসুন, বসুন।’ অমিত চেয়ারে বসলে সে দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যাওয়ামাত্র ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে একটা বড় খাম। চেয়ারে বসে তিনি বললেন, ‘তোমার কথাই আমি ভাবছিলাম। তুমি ভালো আছ তো?’

‘হ্যাঁ। মেসোমশাই নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন!’

‘হ্যাঁ। তোমাকে যে আসতে বলেছি তা উনি জানেন। কিন্তু ওঁর অফিসে খুব জরুরি একটা মিটিং আছে আজকে। বলেছে আগে শেষ হলে চলে আসবে। আচ্ছা, তোমাকে কয়েকটা ছবি দেখাব। প্রথমে একে দ্যাখো।’ একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফটোগ্রাফ খাম থেকে বের করে অমিতের হাতে দিলেন ভদ্রমহিলা।

বছর আটাশ উনত্রিশের এক যুবকের ছবি। দেখেই বোঝা যায় মানুষটি যাকে বলে গুডবয়, তাই। মেয়েদের মতো মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি কাটা। গলায় মোটা সোনার হার রয়েছে। খুব ফর্সা গায়ের রঙ।

‘ভদ্রলোক কে?’ জিজ্ঞাসা করল অমিত।

‘জামাইবাবুর এক পরিচিত মানুষের ছেলে। কলকাতায় পাঁচ পাঁচখানা বাড়ি আছে। কোনও নেশা ভাঙ করে না। মায়ের খুব বাধ্য ছেলে। আমাদের মৃণালের সঙ্গে কেমন মানাবে বলে তোমার মনে হয়?’ মাসিমণি জিজ্ঞাসা করলেন।

অস্বস্তিতে পড়ল অমিত। কী বলবে সে? ভদ্রমহিলা এই ব্যাপারে তার মতামত নেওয়ার জন্যে তাকে ডেকেছেন? সে বলল, ‘ভালোই। কতদূর পড়েছেন ইনি?’

‘ওইটাই মুশকিল।’

‘কেন?’

‘বলছে ছেলেটি এস এফ ব্যাকড।’

‘মানে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করেনি? অবাক হল অমিত।

‘তাই তো দাঁড়ায়। কিন্তু দিদি বলছে বি.এ এম.এ পাশ করলেই বা কী এমন হত? ওর যা সম্পত্তি আছে তাতে পাঁচ পুরুষ খরচ করে শেষ করতে পারবে না। ছেলে নেশা করে না, বদ কোনও বন্ধু নেই। মা যা বলে তাই মান্য করে। আর কী চাই?’ মাসিমণি বললেন, ‘আচ্ছা অমিত, পাত্র হিসেবে তুমি একে দশে কত নম্বর দেবে?’

‘দেখুন, আমি তো এসব—!’

‘সঙ্কোচ কোরো না, আমি ছাড়া কেউ জানবে না। আচ্ছা, এই কাগজে লিখে তোমার কাছেই রেখে দাও।’ ভদ্রমহিলা একটা কাগজ এগিয়ে দিলে তাতে শূন্য লিখে নিজের পকেটে রেখে দিল অমিত।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এবার দ্বিতীয় ছবিটা দ্যাখো। এই ছেলের বাবা খুব নামকরা উকিল। ছেলে ল’ পড়ছে। পাশ করে বাবার মক্কেলদের পেয়ে যাবে। বুঝতেই পাচ্ছ বিস্তর টাকা। শুনলাম, গাড়ি চালিয়ে ল’ পড়তে যায়। এটাই আমার খারাপ লাগছে। এই বয়সেই এত বৈভবের মধ্যে থাকা ভালো নয়। এরা শোভাবাজারে থাকে। তুমি একটু খোঁজ নিতে পারবে?’

‘আমি?’

‘আর কাকে পাব বাবা। মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। তবু ওকে ভালোবাসি বলেই আমি চাই খারাপ ছেলের সঙ্গে যেন বিয়ে না হয়। এই কাগজে ছেলে, তার বাবা আর বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে।’ কাগজ এগিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। এসব করার ইচ্ছে ছিল না অমিতের, তবু না বলতে পারল না।

.

শোভাবাজারের যে রাস্তায় উকিল পরিবার থাকেন সেখানে গিয়ে বাড়ি দেখে চোখ বড় হয়ে গেল অমিতের। বিশাল চারতলা বাড়ির চারপাশে পাঁচিল দেখেই বোঝা যায় প্রচুর ধনী পরিবার। কিন্তু এই পরিবার, বিশেষ করে যে ছেলে ল’ পড়ে তার সম্পর্কে খবর পাবে কী করে?

অমিত রাস্তার দিকে তাকাল। বেশি লোকজন চলাচল করছে না। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একজন কাজের লোক ছুটে এসে গেট খুলে দিল। তার একটু পরে সাদা রঙের একটা গাড়ি ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বেশ জোরে গতি বাড়াতেই একটা হাতে টানা রিকশা তার সামনে পড়ে গেল। প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল গাড়ির ড্রাইভার। রিকশাওয়ালা ‘মর গিয়া’, ‘মর গিয়া’ বলে চিৎকার করতে লাগল মাটিতে বসে পড়ে। গাড়ি যে চালাচ্ছিল সে দরজা খুলে নেমে এসে সবেগে রিকশাওয়ালাকে একটা চড় মেরে বাপ-মা তুলে গালাগাল করতে লাগল। তারপর লাথি মেরে রিকশাটাকে সরাতে চাইল। ওপাশ দিয়ে একজন বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘একি করছ তুমি? দোষ তোমার অথচ ওকে মারধোর করছ? ছি ছি ছি!’

ড্রইভার বেশ কেতাদুরস্ত পোশাক পরা যুবক! আঙুল নেড়ে বলল, ‘যান যান, নিজের কাজে যান। জ্ঞান দিতে আসবেন না। এই রিকশাওয়ালা, হাঠাও রিকশা। জলদি কর!’

বৃদ্ধ বললেন, ‘একি! দোষ করলে তুমি অথচ—।’

তাকে থামিয়ে ছেলেটি বলল, ‘আপনি কেটে পড়ুন। এই পাড়ায় থাকেন বলে মনে হয় না।’ বলে নিজেই রিকশাটাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেশ জোরে বেরিয়ে গেল।

বৃদ্ধ মুখ চুন করে চলে গেলেন। আশেপাশের লোক উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখে চুপচাপ চলে যাচ্ছিল। তাদের একজনকে অমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেটা কে দাদা?’

‘উকিলবাবুর ছেলে। হবু উকিল। দিনের বেলা বলে মারপিট করল না, রাত হলে রিকশাওয়ালা মার খেত।’ লোকটা বলল।

‘কেন?’

‘রাতে তো খালি পেটে বাড়ি ফেরে না।’ লোকটা চলে গেল।

এই ছেলের সঙ্গে মৃণালের বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। একজন পড়ুয়া ছাত্রের এমন মেজাজ থাকলে ওদের দাম্পত্য জীবনে মৃণালের কী অবস্থা হবে? দ্বিতীয়ত এই ছেলে যদি এই বয়সেই পান করে বাড়িতে ফেরে তাহলে স্ত্রীর সঙ্গে যে বন্ধুর মতো সম্পর্ক থাকবে না তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *