হায় সজনি – ১

এককালে পাড়ার লোকেরা বলত, ডানাকাটা পরি। সেইসব পরিদের ছবি দেখত সে রূপকথার বইতে। মেঘরঙা হাঁটু ছোঁয়া চুলের ঢেউ, মোমের মতো গায়ের রঙ, টানা টানা চোখ, টিকালো নাক। সেই ছোট্টবেলা থেকে সে শুনে এসেছে, মা তো প্রায়ই বলত, যে-কোনও পরির চেয়ে আমার মেয়ে সুন্দরী। এর বিয়ে দেব আমি রাজপুত্রের সঙ্গে।

বিধবা বড়পিসি গালে হাত দিয়ে বলত, ‘সর্বনাশ!’

‘ওমা! কার সর্বনাশ হল?’

‘নিজের। ও কথা বলা মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। আজকের দিনে এদেশে তো রাজপুত্র পাওয়া যায় না। শুনেছি সাহেবদের দেশে এখনও তারা আছে। তাদের খোঁজ পাবে কী করে? আর দরকার হলে ও নিজেই তাদের খুঁজে নেবে।’ বড়পিসি বলেছিল।

কথাগুলো পছন্দ হয়নি মায়ের। বলেছিল, ‘আপনার ভাইকে তো চেনেন, ওসব করতে চাইলে মেরে পা ভেঙে দেবে মেয়ের!’

মেয়েদের স্কুল শেষ করে মেয়েদের কলেজ। পুরনো প্রৌঢ় ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে মেয়েকে কলেজের দরজায় নামিয়ে দিয়ে আসে। ছুটির কিছু আগে আনার জন্যে পৌঁছে যায়। মাঝে মাঝে সেই গাড়িতে বসে থাকে মেয়ের মা।

পড়াশুনায় বেশ ভালো মেয়ে। মেয়ের নাম অনেক বাছাই করার পর তার ঠাকুর্দা রেখে গিয়েছিলেন মৃণালিনী। স্কুলের শেষ দিকেই প্রতিবাদ শুরু করেছিল মেয়ে। বান্ধবীরা যেদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুই কোন শতাব্দীর মেয়ে রে?’

গালে রক্ত জমেছিল মেয়ের। এক সহপাঠিনী হেসে বলেছিল, ‘তোকে বোধহয় অনুমান করে সেই কতবছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন স্ত্রীর পত্র।’

আর একজন বলেছিল, ‘তাহলে তো ও বিশাল সম্মান পেয়েছে। স্ত্রীর পত্রের মৃণাল অত্যাচারী পুরুষদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। আমাদের এই মৃণালের অবশ্য কোনও ছেলে বন্ধু নেই, প্রতিবাদও করতে হয় না।’

কিন্তু প্রতিবাদ কি শুধু স্বামী বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে, বালিকা বয়সে নিজের পরিবারের যেসব ব্যাপার নজরে পড়লেও তা মাথায় কোনও প্রতিক্রিয়া ঢুকত না, তা স্কুলের শেষ দিকে অস্বস্তির কারণ হতে লাগল। আমরা ব্রাহ্মণ, তাই অন্যজাত তো বটেই, কায়স্থদের পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ করার কথা বাবা-ঠাকুর্দা-মা-পিসি ভাবতেই পারে না। বড়পিসিমাকে মৃণাল জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আচ্ছা, তোমরা কি কায়স্থদের মানুষ বলে মনে করো না?’

বড়পিসিমা চোখ কপালে তুলেছিল, ‘ওমা! একথা কখন বললাম?’

‘তাহলে তোমাদের বাড়ির ছেলেমেয়ের বিয়ে কায়স্থদের সঙ্গে দাও না কেন?’

‘বিয়ে হয় সমানে-সমানে। তাহলে সেই বিয়ে সুখের হয়।’

‘তোমারও তো সমান ঘরে বিয়ে হয়েছিল তাহলে—’ কথা শেষ করেনি মৃণাল।

বড়পিসির মুখে মেঘ জমেছিল। বলেছিল, ‘মাঝ নদীতে নৌকো ডুবে গেলে বাঁচবে কী করে!’ বলে সামনে থেকে চলে গিয়েছিল।

তারপর থেকেই বাড়িতে যেন একটা রাখঢাক ব্যাপার শুরু হল। সে ঘরে ঢুকলেই যারা ঘরে বসে কথা বলছে তারা হয় চুপ করে যেত, নয় অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করত। সেই চেষ্টাটা মৃণাল স্পষ্ট বুঝতে পারত।

সেদিন কলেজের একটা পিরিয়ড শেষ হতেই খবর এল গভর্নিং বোর্ডের একজন সদস্য মারা গিয়েছেন বলে কলেজ ছুটি হয়ে যাচ্ছে। অনেক মেয়ে খুশিতে চেঁচামেচি করে কলেজ থেকে বাড়ি চলে গেল। কিছু মেয়ে কলেজের অফিসরুমের সামনে লাগানো পাবলিক টেলিফোন থেকে বাড়িতে ফোন করার জন্যে লাইনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করল মৃণাল। তাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে বাড়িতে গাড়ি রেখে ড্রাইভার ভাত খেতে বাড়ি চলে যায়। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফিরে এসে ছুটির সময়ে গাড়ি কলেজে নিয়ে আসে। তাই এখন ফোন করলে ড্রাইভার না থাকায় গাড়ি পাওয়া যাবে না।

অথচ তাদের বাড়ি কলেজ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে খুব বেশি হলে পঁচিশ মিনিট লাগে। তাও রাস্তায় বাসট্রাম গাড়ির ভিড় থাকে বলেই দেরি হয়। তার ক্লাশের কিছু মেয়ে তো ওই দূরত্ব হেঁটেই চলে যায়। একা এতটা পথ কোনওদিন হাঁটেনি মৃণাল। কিন্তু যাওয়া আসার সময় গাড়িতে বসে প্রচুর বাস দেখেছে সে। বিশেষ করে দোতলা দু-নম্বর বাস। দোতলা বাসে কোনওদিন চড়েনি সে। তাদের বাড়ির মেয়েরা বাসে চাপবে এটা কেউ ভাবতেই পারে না। একবার মা বাবা এবং মাসিমণির সঙ্গে ওদের বাড়ির কাছাকাছি ট্রামডিপো থেকে ট্রামে চড়ে ধর্মতলা ঘুরে এসেছিল সে। সেটা ছিল ছুটির দিনের বিকেল। মা, মাসিমণি খুব সেজেছিল। সেই একবারই। কী যে মজা হয়েছিল সেদিন।

মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল মৃণাল। ড্রাইভার আসবে ঠিক চার ঘণ্টা পরে। ততক্ষণে কলেজ নিশ্চয়ই ফাঁকা হয়ে যাবে। লাইব্রেরি যদি খোলা থাকে তাহলে সেখানে গিয়ে হয়তো বসে থাকা যায়। কিন্তু সেখানে আর কেউ যদি না থাকে? তার চেয়ে কলেজের গেট থেকে তিন পা হাঁটলেই তো বাসস্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই তো লাল রঙের দুই নম্বর বাস সে পেয়ে যাবে যা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায়। তার ব্যাগে একটা দশ টাকার নোট আছে।

নোটটা একবছর আগে মাসিমণি তাকে দিয়ে বলেছিল, ‘ব্যাগে রেখে দিস। দেখবি, ঠিক কাজে লেগে যাবে।’ গত এক বছরে দরকার পড়েনি বলে টাকাটার কথা মৃণালের খেয়াল ছিল না। আজ তড়িঘড়ি ব্যাগটা খুলে দেখল টাকা দু’ভাজ করে ব্যাগের পকেটে সে যেমন রেখেছিল তেমনই রয়ে গেছে। দশ টাকার অনেক কমে যে বাসের টিকিট পাওয়া যাবে তা সহপাঠিনীদের কাছে জেনেছিল সে।

কেউ চোখ রাঙালো না, মৃণাল ব্যাগ নিয়ে কলেজের গেট পেরিয়ে বাস স্টপের দিকে পা বাড়ালো। ইতিমধ্যে সে কিছুটা দেরি করে ফেলায় বাস স্টপের দুজন সিনিয়ার ছাত্রী ছাড়া কেউ নেই। একটা একতলা বাস এসে দাঁড়াতেই তারা উঠে গেল সেই বাসে।

বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছিল। আশেপাশে কেউ নেই। বাসও আসছে না। মৃণালের মনে হল তার কলেজে ফিরে যাওয়া উচিত। তার এইভাবে বের হওয়া বাড়ির কেউ পছন্দ তো করবেই না, খুব বকাবকি করবে। দূরে একটা বাস দেখা দিল। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ওই বাস যদি তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায় তাহলে উঠে পড়বে আর সমস্যা থাকবে না। বাস থেকে নেমে সে সোজা বাড়িতে ঢুকে যাবে।

বাসটা যখন কাছাকাছি চলে এসেছে ঠিক তখনই একটা গলা কানে এল, ‘টু বি অর নট টু বি?’

প্রশ্নটা যে তাকেই করা হয়েছে তা বুঝতে পারল না মৃণাল। সে দু’পা এগিয়ে যেতেই বাসের নম্বর দেখতে পেল। বাসের সামনে যে বোর্ড ঝুলছে তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে টুবি অর্থাৎ এই বাস মৃণালদের বাড়ির দিকে যাবে না! সে দুই পা পিছিয়ে গেল। তাহলে এবার তার কলেজে যাওয়াই উচিত।

মৃণাল ঘুরে দাঁড়াতেই ছেলেটিকে দেখতে পেল। সাধারণ শার্টপ্যান্ট পরা একুশ-বাইশ বছরের তরুণ। গালে হালকা দাড়ি যার রঙ এখনও কালো হয়নি। তাহলে এই ছেলেটি একটু আগে ওই কথাগুলো বলেছিল?

ছেলেটি এগিয়ে এল এক পা, ‘তাহলে নট টুবি। কোনও কোয়েশ্চেন নেই। আপনার বাস শুধু নাম্বার টু। তাই তো?’

চোখ বন্ধ করল মৃণাল। ছেলেটার পাশ কাটিয়ে দৌড়ে কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে? ছেলেটা হাসল, ‘আমার নাম অমিত। না, আমিত রায় নয়, অমিত মিত্র। এম.এ পড়ি। ওই মোড়ের মাথায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস আছে, সেখানেই থাকি। ইয়ে, মানে আপনি বলব না তুমি? যাক গে, নাম জানতে পারি?’

এইসময় দু’নম্বর বাস সামনে এসে দাঁড়াতেই মৃণাল দ্রুত তার পাদানিতে উঠে পড়ল। তার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল দোতলা বাসের ওপর তলায় উঠে জানলার ধারে বসার। কিন্তু আজ নার্ভাস চোখে দেখল বাসের নিচ তলায় তিনজন মহিলা যাত্রী বসে আছেন। ওঁদের পাশে বসলে নিরাপদে যেতে পারবে ভেবে সে একতলার আসনে গিয়ে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাতে তার ভয় করছিল।

গায়ে পড়ে যে ছেলে কথা বলে তাকে বিশ্বাস করা মুশকিল। মৃণাল জানলার বাইরে তাকালো। তার খুব ভয় হচ্ছিল, ছেলেটা ওপাশের খালি আসনে এসে না বসে। মোড়ের মাথায় দুজন মহিলা নেমে গেলে সে তৃতীয় মহিলার দিকে তাকাল। চশমা পরা মধ্যবয়সি মহিলাকে দেখে মনে হল উনি খুব রাগী।

হঠাৎ তার মনে হল নিজেদের বাড়ির সামনে বাস থেকে নেমে যাওয়া ঠিক হবে না। ছেলেটি নিশ্চয়ই এই বাসে আছে। তাকে নামতে দেখলে ও অনুসরণ করবে। বাড়িটা বুঝে নিয়ে পরে সে বিরক্ত করতে আসবে না নিশ্চয়তা কি? আর সেটা যদি বাবা-মা জানতে পারে তাহলে আর দেখতে হবে না; নির্ঘাত তাকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে এনে বর খুঁজতে বের হবে। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চেয়েছিল। দুটো কারণে বিয়ে হয়নি, মাসিমণি প্রচণ্ড আপত্তি করেছিল আর তার বয়সের পাত্রীর জন্যে অল্পবয়সি বর পাওয়া যায়নি; বাবা বলেছিল, ‘অনার্স গ্রাজুয়েট হলে তিনবছর বয়স বাড়বে আর পাত্রও ভাল পাওয়া যাবে।’ কিন্তু একটা ছেলে তাকে ফলো করেছে, এটা তার অপরাধ না, ওঁরা বুঝতেই চাইবে না। মৃণাল ঠিক করল, নিজের বাড়ির সামনের স্টপে সে বাস থেকে নামবে না।’

চোখ বন্ধ করল সে। বাস বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চলে আসার পরে সে চোখ খুলল। আর তখনই তার মনে পড়ল মাসিমণির কথা। তাদের বাড়ির থেকে মিনিট আটেক দূরে মাসিমণির বাড়ি। মাসিমণি বেশি আসে তাদের বাড়িতে। বাবা মেসোকে পছন্দ করে না বলে বিশেষ উপলক্ষ না থাকলে তারা যায় না। মৃণাল সোজা হল। মাসিমণির বাড়িতেই যাবে সে? তাতে যদি ছেলেটা ভেবে নেয় ওটাই তার বাড়ি, তাই ভাবুক।

মাসিমণির বাড়ির স্টপে সে বাস থেকে নেমে একবার পেছনে তাকিয়ে নিল। না, ছেলেটাকে দেখতে পেল না। বাস চলে গেলে শূন্য স্টপেজে সে একা। স্বস্তির শ্বাস ফেলল মৃণাল। না, হয় ছেলেটা তাকে অনুসরণ করেনি, নয়তো বাসেই বসে আছে, সে যে নেমে পড়েছে তা বুঝতে পারেনি। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে সে গলিতে ঢুকেই মাসিমণির বাড়ির দরজার বেলে চাপ দিল।

কাজের মেয়ে চম্পা দরজা খুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওম্মা, তুমি?’

তার চিৎকারে মাসিমণি দ্রুত চলে এসে কপালে ভ্রু তুললেন, ‘একি! তুই একা এলি? সঙ্গে কেউ আসেনি!’

মাথা নেড়ে না বলে বাইরের ঘরের চেয়ারে বসে পড়ল মৃণাল। তারপর কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক গ্লাস জল দাও।’

মেয়েটি ভেতরে দৌড়ে গেলে মাসিমণি কাছে এসে অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে রে? মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস নাকি?’

মাথা নেড়ে না বলল মৃণাল।

‘তুই আজ কলেজে যাসনি?’

‘গিয়েছিলাম।’ মেয়েটির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে জল খেল সে অনেকটা। তারপর বলল, ‘ওঃ।’

‘কী হয়েছে? নিশ্চয়ই কোনও ঝামেলা বাঁধিয়েছিস?’

‘আমি ঝামেলা বাঁধাই?’

‘নইলে তুই একা আমাদের বাড়িতে এলি কী করে? আজ পর্যন্ত কোনও দিন তুই একা এই বাড়িতে কখনও এসেছিস না তো মা-বাবা আসতে দিয়েছে? কী হয়েছে খুলে বল।’ বলতে বলতে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন মাসিমণি। তাঁর হাত দু’হাতে ধরল মৃণাল। তারপর ঠিক যা যা ঘটেছিল তাই খুলে বলল।

সব শুনে মাসিমণির চোখ কপালে উঠল, ‘কী সর্বনাশ! তুই এ কী করেছিস? কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিস তা জানিস? তোর মা-বাবা জানলে আমার শ্রাদ্ধ করবে। ওদের একদম ইচ্ছে ছিল না তোকে কলেজে পড়ানোর। আমার জোরাজুরিতে রাজি হয়েছিল। এখন এসব শুনলে আমাকে আস্ত রাখবে?’

মুখে ভয় জমেছিল মৃণালের। বলল, মাসিমণি, তুমি ওদের বোলো না।’

মাসিমণি একটু ভাবলেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে বড় টেবিলে রাখা টেলিফোনের রিসিভার তুলে তাদের বাড়ির নম্বর ডায়াল করলেন। করেই জিজ্ঞাসা করলেন মৃণালকে, ‘আর কখনও এমন কাজ করবি না তো?’

নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলে মৃণাল।

ওপাশ থেকে মৃণালের মায়ের গলা ভেসে আসতেই মাসিমণি বললেন, ‘আমি বলছি গো, কী করছ?’

‘এই তো, খাবার দিতে বসলাম। আজ হঠাৎ এই সময়ে? সূর্য উঠেছে তো?’ গলায় হাসি মিশিয়ে প্রশ্ন করল মৃণালের মা।

‘উঠেছে উঠেছে। যে যার নিয়মের কাজ ঠিকঠাক করেছে। শুধু একটাই বেঠিক কাজ হয়েছে। আজ তোমার জামাই-এর সঙ্গে দোকানে গিয়েছিলাম। উনি আফিসে নেমে গেলে আমি কলেজ স্ট্রিট-কর্নওয়ালিস স্ট্রিট হয়ে বাড়ি ফিরছিলাম।’

‘একা একা?’

‘ওমা! দোকা কোথায় পাব? তাছাড়া বুড়ো ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে, আমি পেছনে একা বসে আছি, ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। তা যেই হেদোর সামনে গাড়ি এল, দেখলাম দলে দলে মেয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। ড্রাইভারকে বললাম, কী হয়েছে তার খোঁজ নিতে। সে ফিরে এসে বলল হঠাৎ কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। তখন ভাবলাম খুকির ড্রাইভার কি ছুটির খবর জানে?’

‘সে কি রে?’ মৃণালের মা চিৎকার করে বলল, ‘সে তো গাড়ির চাবি নিয়ে গিয়েছে, আবার বিকেলে আসবে। এখন কী হবে?’

‘কী আর হবে? আমি তোমার মেয়েকে কলেজ থেকে বের করে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। ও অবশ্য কিছুতেই আসতে চাইছিল না। বলছিল, মা-বাবা খুব রাগ করবে। আমি বলেছি, করে করুক। তাই বলে খালি হয়ে যাওয়া কলেজে তুই বিকেল অবধি কার ভরসায় বসে থাকবি। কিগো, ঠিক করিনি নিয়ে এসে?’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক, কিন্তু তোর জামাইবাবু শুনলে খুব রাগ করবে। আচমকা যদি ছুটি হয়ে যায় তাহলে প্রিন্সিপালের উচিত মেয়েদের দায়িত্ব নেওয়া। তোর বদলে অন্য কেউ যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে নিয়ে যেত?’ দিদির গলায় আতঙ্ক।

‘কী যে বলো! ও কি বাচ্চা মেয়ে যে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কেউ নিয়ে যাবে। আমার সঙ্গেই আসতে চাইছিল না যদি তোমরা রাগ করো।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই ওকে এখনই গাড়ি দিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দে। ওর বাবা বিকেলে ফিরবে। আমি তাকে জানাতে চাই না।’

‘আঃ। এত ভয় পাচ্ছ কেন? ও তো জলে পড়ে নেই। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক সময়ে ওকে তোমার কাছে দিয়ে আসব। এখন রাখছি।’

রিসিভার রেখে মাসিমণি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাত খেয়ে বেরিয়েছিস না খাবি?’

মাথা নাড়ল মৃণাল, সে খাবে না।

এবার গলার স্বর বদলে গেল মাসিমণির, ‘ছেলেটা কে?’

‘আমি চিনি না।’

‘তুই চিনিস না অথচ তোকে ওসব বলল?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর কী বলল?’

‘বলল ওর নাম অমিত মিত্র, কিছু দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকে। এম.এ পড়ে। এইটুকু।’

‘অমিত মিত্র? কায়স্থ! তোর সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলল?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে বোঝাই যাচ্ছে কীরকম ছেলে। এম.এ পড়ুক বা যাই পড়ুক, চরিত্র বলে কিছু নেই। তোর বাবা মা জানলে আমি কী জবাব দেব? তারা তো তোকে কলেজে পড়াতেই চায়নি। আমি জোর করেছিলাম বলে—।’ একটু ভাবলেন মাসিমণি; ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকে বলেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘মিথ্যেও বলতে পারে। ভদ্রঘরের সুন্দরী মেয়েদের মিথ্যে কথা বলে ভুলিয়ে সর্বনাশ করে যারা, তারা কি সত্যি কথা বলবে? যাক গে, এসব কথা যেন কেউ জানতে না পারে। এখন যাও, ভিতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ো। যাওয়ার আগে তোমাকে ডেকে নেব। যাও।’ মাসিমণি বললে মৃণাল উঠে ঘরে চলে গেল। বাবা-মায়ের কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে না যার জন্যে তার কথা না শুনে উপায় নেই।

মৃণাল উঠে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভাবলেন মাসিমণি। তারপর উঠে গিয়ে টেলিফোনের নম্বরগুলো টিপলেন। স্বামীর গলা কানে যেতেই যা যা ঘটেছে তা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন মাসিমণি। সমস্তটা বলার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বুঝতেই পারছি, এই ছেলেটা অত্যন্ত বদ। ওকে তুমি শাস্তি দিতে পারবে? এমন শাস্তি যাতে আবার কোনও মেয়ের দিকে মুখ তুলে না তাকায়।’

‘অল্প বয়সের চাপল্য। ওরকম হতেই থাকে। বুদবুদের মতো। এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। তোমার ভাগ্নীকে এবার সাবালিকা হতে দাও।’ ফোন রেখে দিলেন মেসোমশাই।

কিন্তু মন মানছিল না। দিদি-জামাইবাবু যদি জানতে পারে তাহলে তারা তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। মেয়েকে কলেজে না পাঠালে বাইরের ছেলেরা ওর নাগাল পেত না। আর এই ছেলে যে চরিত্রহীন তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

মাসিমণি মনস্থির করলেন। আজ যেটুকু এগিয়েছে, কে বলতে পারে কাল তার চেয়ে আরও বেশি এগোবে না। এই বয়সের মেয়েরা ভালো কথা শুনলে অল্পেই গলে জল হয়ে যায়। তাই যা করার তা আজই করতে হবে। এই মেয়েকে তো রোজ রোজ এই বাড়িতে পাওয়া যাবে না।

বাইরে যাওয়ার পোশাক পরে তিনি ওপাশের ঘরে শুয়ে থাকা মৃণালের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি একটু আসছি। তুই শুয়ে থাক।’

‘কোথায় যাচ্ছ গো?’ পাশ ফিরল মৃণাল।

‘পাড়াতেই, একজনের বাড়িতে।’ হাসলেন মাসিমণি, ‘তুই বিশ্রাম নে।’

বাইরে বেরিয়ে এসে মাসিমণি ইশারায় ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি বের করতে বললেন। তারপর গাড়ি চললে নির্দেশ দিলেন কোথায় যেতে হবে। যাতায়াতের পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলটা কয়েকবার তিনি দেখেছিলেন। আজ গেটের সামনে গাড়ি রেখে দারোয়ানকে বললেন, ‘এখানে কি অমিত মিত্র নামের কোনও ছাত্র থাকে?’

দারোয়ান হাত তুলে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে গেল। দু’মিনিটের মধ্যে সে বেরিয়ে এল এক মধ্যবয়সিকে নিয়ে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাকে চাইছেন?’

‘অমিত মিত্র। এম.এ পড়ে।’ মাসিমণি বললেন।

‘ও হ্যাঁ। সে এই হোস্টেলেই থাকে। তাকে দরকার?’

‘হ্যাঁ। একটু ডেকে দিলে ভালো হয়।’

‘আপনার নামটা—!’

‘মাসিমা বলুন, তাতেই হবে।’

ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন। মিনিট তিনেক পরে একটি তরুণকে বাইরে বেরুতে দেখলেন তিনি। সে কাছে এসে বলল, ‘আপনি কি আমাকে খুঁজছেন?’

‘তোমার নাম অমিত?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল ছেলেটি।

‘এম.এ পড়।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা খুলে কড়া গলায় মাসিমণি বললেন, ‘কোনও কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসো।’

‘গাড়িতে?’ হকচকিয়ে গেল ছেলেটি।

‘কানে কম শোন নাকি। ওঠো বলছি!’ ধমকে এত জোর ছিল যে ছেলেটি, যার নাম অমিত মিত্র, সুড়সুড় করে গাড়িতে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে মাসিমণি ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন। ‘গাড়ি বাড়িতে নিয়ে যাও।’

অমিত জানলা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আরে! এ কী করছেন? কে আপনি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’

প্রায় সমান উঁচু গলায় ধমক দিলেন মাসিমণি, ‘চুপ! একদম চুপ করে বসে থাকো।’

বলার ভঙ্গীতে এমন তেজ ছিল যে অমিত একটু নেতিয়ে গেল। অসহায় লাগছিল তাকে।

বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে মাসিমণি ধমক দিয়ে বললেন, ‘নেমে এসো।’ তারপর পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির দরজার পাশে বেলের বোতাম টিপলেন।

কাজের মেয়ে চম্পা দরজা খুলে একপাশে সরে দাড়াল। মাসিমণি গম্ভীর গলায় অমিতকে বললেন, ‘ভেতরে এসো। ওই চেয়ারে চুপ করে বসো।’ তারপর চম্পাকে বললেন, ‘দরজা বন্ধ কর।’ অমিত চেয়ারে বসলে মাসিমণি গম্ভীর মুখে ভেতরের ঘরে গেলেন। যে ঘরে মৃণাল শুয়েছিল সেই ঘরে ঢুকে তিনি অবাক হলেন। ঘরে কেউ নেই। চিৎকার করে চম্পাকে ডাকলেন। সে দৌড়ে এলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মৃণাল কোথায় রে?’

‘দিদিমণি তো একটু আগে বাড়ি চলে গেল।’ চম্পা বলল।

‘এ্যাঁ? চলে গেল!’ আঁতকে উঠলেন মাসিমণি।

‘বলল, বাড়িতে যাবে। আমি বলেছিলাম আপনি ফিরে এলে গাড়িতে যেতে কিন্তু শোনেনি। মনে হচ্ছিল যেন ভয় পেয়েছে।’ চম্পা বলল।

‘ভয়? কীসের ভয়?’

‘তাতো জানি না।’

খাটের ওপর ধপাস করে বসে পড়লেন মাসিমণি। চলে গেল কেন মৃণাল? সে কি বুঝতে পেরেছিল কিছু? কী করে বুঝবে মাসিমণি এই ছেলেটাকে ধরে আনতে গিয়েছেন? একবারও তো সেকথা তিনি বলে যাননি। এখন যদি মেয়ে বাড়িতে না ফিরে অন্য জায়গায় চলে যায়? কী কৈফিয়ত দেবেন তিনি? দিদি জামাইবাবু তো বটেই নিজেকে কী বলবেন? দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে মা কালীকে ডাকতে লাগলেন। তারপর এই ঘরে টেলিফোনের যে এক্সটেনশন লাইন আছে সেখানে গিয়ে ভয়ে ভয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরেই দিদির গলা কানে এল, ‘তোর দেখছি খুব পা ভারী হয়েছে। বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিস কিন্তু মুখ দেখাচ্ছিস না!’

‘এমা! এসব কী বলছ?’ অবাক হলেন মাসিমণি।

‘নেকু! যেন কিছুই বুঝতে পারছিস না! তুই মৃণালকে কলেজ থেকে তুলে এই রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাসনি?’

‘তাই বলো—ওই ভরদুপুরে বাড়িতে গেলে তুমি মুখে কিছু বলতে না, মনে মনে ভাবতে জ্বালাতে এল।’

‘খুব কথা শিখেছিস! এখন ভরদুপুর? তুই তো একটু আগে মেয়েকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলি।’ তারপর একটু থেমে দিদি বললেন, ‘খুব ভালো করেছিস ফোন করে। তুই যে মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছিস তা বলার দরকার নেই।’

‘তাহলে?’

‘এই বিষয়ে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই। সে শুনলে আমার মাথার পোকা বের করে ছাড়বে।’

‘তাহলে মেয়ে বাড়ি ফিরল কী করে?’

‘কলেজ যে আগেভাগে ছুটি হয়েছিল তা ওর জানার কথা নয়।’

‘ঠিক আছে।’

ফোন রেখে মাসিমণি বাইরের ঘরে এসে দেখলেন ছেলেটা প্রায় শামুকের মতো গুটিয়ে আছে।

একটু দূরের চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী যেন নাম?’

‘আজ্ঞে, অমিত, অমিত মিত্র।’

‘হোস্টেলে থাকো, বাড়ি কোথায়?’

‘কুচবিহারে।’

‘বাবা বোধহয় প্রচুর টাকা পাঠান?’

‘না, মানে, কেন?’

‘কলকাতায় পড়তে আসার নাম করে বদমায়েসি করে বেড়াচ্ছ! নিশ্চয়ই বিড়ি সিগারেট খাচ্ছ। হোস্টেলের ছেলেরা শুনেছি মদ খায়, তুমি গেলো নাকি?’

‘না না না।’ প্রবল মাথা নাড়ল অমিত।

‘কী করে বুঝব তুমি সত্যি বলছ। যে ছেলে বাবার পয়সায় কলকাতায় পড়তে এসে বাসস্টপে দাঁড়ানো অচেনা মেয়ের সঙ্গে গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চায় সে যা খুশি তাই করতে পারে।’ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন মাসিমণি।

বিশ্বাস করুন, আমি খারাপ কাজ কী করেছি তাই বুঝতে পারছি না।’ কাতর গলায় বলল অমিত, ‘একটু যদি আমাকে বলেন।’

‘তুমি মেয়েদের কলেজের সামনে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মেয়েকে গায়ে পড়ে কথা বলানোর চেষ্টা করোনি? বলো না, বলো।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ও। কেন? কী জন্যে নাটক করে কথা বলেছ?’

‘কিছু ভাবিনি। হঠাৎ কথা বলতে ইচ্ছে হল, তাই!’

‘বা বাঃ। চমৎকার। হঠাৎ খুন করার ইচ্ছে হল, তাই খুন করলাম।’

‘দুটো কি এক হল?’

‘এ্যাঁ? তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ?’ মাসিমণি রেগে গেলেন, ‘সে ভালো মেয়ে তাই কথা বলেনি। কথা বললে তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যেতে চা খাবে বলে। প্রথমদিন নিজেই দাম দিতে, তারপর থেকে ওর ঘাড় ভেঙে খাবার খেতে। এরকম গল্প আমি শুনেছি। আমি তোমার হেস্টেলে গিয়ে কমপ্লেন করব।’

‘প্লিজ। সুপার খুব কড়া মানুষ। আমাকে হোস্টেলে রাখবেন না।’

‘তাই তো উচিত। বেশ, তাহলে ইউনিভার্সিটির অফিসে জানাব। তুমি তো এম.এ-তে নাম লিখিয়েছ। কোন সাবজেক্ট?’

‘আজ্ঞে বাংলা।’

‘কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই এসব করে বেড়াচ্ছ। সায়েন্স ইকনমিক্স নিয়ে পড়লে এসব করার সময় পেতে না।’

‘ম্যাডাম, আর কখনও এই ভুল করব না।’

ম্যাডাম শব্দটি শুনতে ভারি ভালো লাগল মাসিমণির। তবু তিনি মাথা নাড়লেন, ‘তাহলে তোমার বাবার ঠিকানা দাও। তাঁকে সব জানাব।’

‘বাবা!’ হাঁ হয়ে গেল অমিত।

‘মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল মনে হচ্ছে?’

‘আমার বাবা খুব রাগী। জানলে টাকা পাঠানো বন্ধ করবেন।’

‘তাই তো করা উচিত। কী নাম তোমার বাবার।’

‘ম্যাডাম। আমাকে ক্ষমা করুন। প্লিজ!’

আবার ম্যাডাম শব্দটি শুনতে খুব ভালো লাগল। আর এইসময় বেলের আওয়াজ হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চম্পা ভেতর থেকে ছুটে এসে দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। প্রবীণ এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পরনে স্যুট, টাই, হাতে ছড়ি। দেখে মনে হয় গত শতাব্দী থেকে চলে এসেছেন।

অমিতকে দেখে ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘হু ইজ হি?’

মাসিমণি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘এর নাম অমিত। এম.এ পড়ে।’

‘অমিত! আই সি।’ ভদ্রলোক সোজা হওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘হু ইজ হি?’

‘এই সেই ছেলে যে আজ মৃণালকে টিজ করেছিল।’ মাসিমণি উঠে দাঁড়ালেন।

‘মাই গড! একে কোথায় পেলে?’

‘ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকে।’

‘ও। তুমি গিয়ে ডাকলে আর সুড়সুড় করে চলে এল! তাজ্জব ব্যাপার!’ বলতে বলতে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন ভদ্রলোক।

মাসিমণি অমিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওঁকে তুমি চেনো?’

মাথা নেড়ে না বলল অমিত।

‘দুপুরে লাঞ্চ পার্টি ছিল, তাই বোধহয়—! ঠিক আছে তুমি এখন যেতে পারো? কিন্তু আমি তোমাকে যা যা বলেছি তা যদি মনে না রাখো তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’

অমিত উঠে দাঁড়াল। এই সময় ভদ্রলোক ফিরে এলেন। তখন তার শরীরে কোট এবং টাই নেই। জামার ওপরের দুটো বোতাম খোলা। ঘরে ঢুকে উল্টো দিকের চেয়ারে বসে বললেন, ‘তাহলে তুমিই অমিত। মেয়েদের টিজ করে বেড়াও।’

‘না স্যার, আমি কখনও কোনও মেয়েকে টিজ করিনি।’ অমিত বলল।

‘তোমার বিরুদ্ধে সেটাই অভিযোগ।’ আঙুল নেড়ে বসতে বললেন তিনি, বাধ্য হল অমিত। বসে মাসিমাণির দিকে তাকাল।

মেসোমশাই মাসিমণিকে বললেন, ‘তুমি গিয়ে ডাকলে আর ও সঙ্গে সঙ্গে চলে এল? বাঃ! হোস্টেলে থাকো। বাড়ি কোথায়?’

‘আজ্ঞে কুচবিহারে।’

‘যাকে আজ টিজ করেছ তাকে কতদিন ধরে ফলো করেছ?’

‘না না, আমি টিজ করিনি, এর আগেও কখনও দেখিনি।’

‘আজই প্রথম দেখেই কথা বলতে ইচ্ছে করল?’

‘বাঃ!’ স্ত্রীর দিকে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘প্রিন্সেস কোথায়? ডাকো তাকে?’

অস্বস্তিতে পড়লেন কিন্তু বলতে হল মাসিমণিকে, ‘ও বাড়িতে ফিরে গেছে।’

‘সেকি? কোর্টে মামলা উঠল আর অভিযোগকারিণী উধাও। তাহলে কি ওর মামলা ধোপে টিকবে?’

‘বোধহয় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।’

‘শোনো, কি যেন নাম বললে—!’

‘অমিত।’

‘হ্যাঁ, অমিত, আমার পকেটে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার আছে।’ তাতে আমরা এতক্ষণ যা যা বললাম সব রেকর্ডেড হয়ে গিয়েছে। আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করছি। তুমি আগামী চার বছরের মধ্যে মৃণালের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করবে না। চার বছর পরে তোমরা যথেষ্ট স্বাবলম্বী হবে, তখন যা করবে তা নিজের দায়িত্বে করবে। অবশ্য যদি তখন সেরকম পরিস্থিতি হয়। কিন্তু তার আগে যদি খবর পাই খুব বিপদে পড়বে। আমার হাত বেশ লম্বাই।’ খুব ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বললেন মৃণালের মেসোমশাই।

দরজার বাইরে কয়েক পা সঙ্গে এলেন মাসিমণি। বললেন, ‘ওঁর কথায় কিছু মনে করো না বাবা। মেয়েটাকে খুব ভালোবাসেন তো, তাই রেগে গিয়েছেন। রাগ যেমন চট করে চড়া হয় আবার তেমনি অল্পতেই জল হয়ে যায়।’

‘আমি আসছি।’ অমিত বলল।

‘না না, দাঁড়াও। আমি ড্রাইভারকে বলছি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে।’

‘না না, তার দরকার নেই। এখান থেকে বাসে উঠলে বেশি সময় লাগবে না। এই সময় তো বাসে ভিড় থাকে না।’ অমিত মাথা নাড়ল।

‘ও হো, তোমার কাছে কাগজ কলম আছে?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘তোমার হোস্টেলের টেলিফোন নম্বরটা লিখে দাও। আলাপ যখন হয়েই গেল তখন নিয়েই রাখি।’ হাসলেন মাসিমণি।

পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তাতে নম্বর লিখে সামনে ধরলে মাসিমণি সেটা নিয়ে পড়লেন, ‘এমনি রেখে দিলাম। যদি কখনও খুব প্রয়োজন পড়ে!’

‘নিশ্চয়ই আপনার প্রয়োজন হলে বলবেন। যাই?’

‘হ্যাঁ, ও, আর একটা কথা। তুমি তো ওই পথে যাতায়াত করো, যদি হঠাৎ চোখে পড়ে ও এমন কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যা ভালো নয়, তাহলে আমাকে জানিও। আমার বাড়ির নম্বর লিখে নাও।’ নম্বর বললেন মহিলা।

সেটা লিখে নিয়ে অমিত বলল, ‘এবার চলি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলি বলতে নেই, আসি বলো। সাবধানে যাও, দুর্গা, দুর্গা!’

.

হোস্টেলের ছেলেরা জটলা করে অমিতের উধাও হওয়া নিয়ে কথা বলছিল। এক মধ্যবয়সিনী গাড়ি নিয়ে এসে ধমকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছে, দারোয়ান এমন কথাই বলেছে। নেতা স্থানীয় ছাত্ররা স্থির করল, এখনই থানায় গিয়ে জানানো উচিত। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় অমিত হোস্টেলের দরজায় পৌঁছে গেল।

তাকে দেখতে পেয়ে হই-হই করে ছেলেরা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘কে ওই মহিলা? কেন তাকে ইলোপ করেছিলেন? মুক্তি পাওয়ার জন্য মহিলাকে কত টাকা দিতে হয়েছে? আমিত কি থানায় গিয়েছিল।’

অমিত মাথা নেড়ে যাচ্ছিল। বন্ধুরা থামলে বলল, ‘ওই ভদ্রমহিলা আমার এক সহপাঠিনীর মাসিমা। খুব রাগী। কেউ ওঁর কাছে আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেছিল বলে যাচাই করতে এসেছিলেন। এমন কোনও ব্যাপার নয়।’

বন্ধুদের উত্তেজনায় জল ঢেলে নিজের ঘরে চলে এসেছিল অমিত। ওর রুমমেট সুজয় এসে বলল, ‘কেসটা কী বল তো?’

ঘরে আর কেউ নেই দেখে সুজয়কে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল অমিত।

সুজয় বলল, ‘বাপস। কী ডেঞ্জারাস মহিলা। ছেলেদেরও হার মানাবে। শোন অমিত, ভুলেও ওই মেয়ের ছায়া মাড়াস না। মাসি যদি এইরকম হয় তাহলে মা-বাবা কীরকম হবে তা আন্দাজও করা যাচ্ছে না। কলকাতায় প্রচুর নরম মনের বাবা-মা আছে, ভাগ্যে থাকলে তাদের কাউকে পেয়ে যাবি।’

.

হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বাসে উঠলে ওই মেয়েদের কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে কুড়ি মিনিটও লাগে না। বাসে উঠে বসতে পারলে তো কথাই নেই, দাঁড়িয়ে থাকলেও কলেজ পার হওয়ার সময় দুই চোখ বন্ধ করে রাখে তখন। বলা যায় না, ওই মেয়ের সঙ্গে যদি চোখাচুখি হয়ে যায়। সে বাসের ভেতরে থাকলে অবশ্য তাকে চিনতে পারা সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়েটা তো তাকে ভালো করে দ্যাখেওনি।

বাবার ইচ্ছে ছিল না, মায়ের জোরাজুরিতে সে কলকাতায় পড়তে আসতে পেরেছে হায়ার সেকেন্ডারির পর। প্রেসিডেন্সি কলেজে সুযোগ পেয়েছে। বাবার ইচ্ছে ছিল সে ইকনমিক্স নিয়ে পড়ুক। আবেদন করা সত্ত্বেও সে সুযোয় পায়নি। তাই বাংলা নিয়ে পড়ে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিল। সেটা জানার পর বাবা একটু শান্ত হয়েছে। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় সে কোনও মেয়েকে বিরক্ত করেছে জানলে টাকা পাঠানো বন্ধ করে বলবে, ‘আর পড়তে হবে না, ফিরে এসো।’

অমিত ভাবছিল, সেদিন মেয়েটিকে দেখে তার যে আচমকা কী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটা ঠিক, ওর সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল তার বেশি কিছু নয়। এরকম ভুল সে কখনও করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। ওই মেসোমশাই মাসিমণি যদি তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতেন তাহলে আর দেখতে হত না! তার ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকত না। তবে এখন তার মনে কতগুলো প্রশ্ন এল। মেয়েটা তার বিরুদ্ধে মাসিমণির কাছে নালিশ করেছিল। কিন্তু তিনি যখন তাকে বাড়িতে আনতে গেলেন তখন মুখোমুখি না হয়ে বাড়ি চলে গেল কেন? তার সামনে দাঁড়িয়ে মাসিমণির কাছে নালিশ করাই তো স্বাভাবিক ছিল। মেয়েটা পাগল নাকি!

দ্বিতীয়, ওর মেসো কি প্রকৃতিস্থ ছিলেন। যেরকম ভয়ঙ্কর রেগে প্রথম দিকে ছিলেন, মাঝপথ থেকেই কেমন নরম হয়ে গেলেন। কেন? মাসিমণিও খুব দ্রুত বদলে গিয়েছিল। শেষদিকে খুব ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছিল।

এইরকম পরিবারের কাছাকাছি যাওয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। মাস চারেক পরে স্মৃতি যখন ঈষৎ ঝাপসা তখন হোস্টেলের কাজের লোক ঘরে এসে বলল, ‘আপনার ফোন এসেছে।’

খুব প্রয়োজন ছাড়া বাবা কুচবিহার থেকে ফোন করে না। বাবার ফোন মানে একটা না একটা উপদেশ অথবা আদেশ। দ্রুত অফিসঘরে গিয়ে রিসিভার তুলে অমিত বলল, ‘হ্যালো।’

‘আমি কি অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলছি?’ একজন মহিলা স্পষ্ট উচ্চারণে প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ। আমি অমিত।’

‘তুমি আমার নাম বললে তো চিনতে পারবে না বাবা। এক দুপুরে তুমি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে। মনে আছে?’

সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ড কনকনিয়ে উঠল। চট করে সেই দুপুরটার কথা মনে এসে গেল। অমিত বলল, ‘ওহো, হ্যাঁ, কেমন আছেন মাসিমণি?’

‘ভালো না বাবা, একদম ভালো না। খুব বিপদের মধ্যে আছি। কী করব বুঝতেই পারছি না। এখনকার ছেলেমেয়েদের আমি বুঝি না। তুমি যদি কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে একবার আসো তাহলে খুব উপকার হয়।’

অমিতের গলা শুকিয়ে গেল, ‘কে-কেনো, কী হয়েছে?’

‘আমি বুঝতে পারছি না। যদি সর্বনাশ হয় তাহলে তার সব দায় আমার ওপর পড়বে। কারও সঙ্গে যে আলোচনা করব এমন কেউ পাশে নেই। তোমার মেসোমশাই অফিসের কাজে এখন ইউরোপে গিয়েছেন। তাঁকে ফোন করে এসব কথা বলা ঠিক না। তাই তোমার কথা মনে পড়ল। আজ একবার আসবে?’ কাতর গলায় বললেন ভদ্রমহিলা।

কথাগুলো বলার সময় এমন একটা করুণ আবহ তৈরি হল যে অমিতের গলা থেকে যে সব শব্দ বেরিয়ে এল তার জন্যে সে নিজেই প্রস্তুত ছিল না। অমিত বলল, ‘আমি যদি বিকেল পাঁচটার সময় যাই তাহলে কি অসুবিধে হবে?’

‘না, কোনও অসুবিধে হবে না। এসো, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।’ যেন স্বস্তির শ্বাস ফেললেন মৃণালের মাসিমণি।

.

খুব নার্ভাস হয়ে হোস্টেল থেকে বেরিয়েছিল অমিত। ফোনটা আসার পরে সে রুমমেট সুজয়কে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী করা যায়? সুজয় মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘আমার তো মনে হয় ঘুরে আসা উচিত। ভদ্রমহিলা খুব অসহায় না হলে তোকে ফোন করতেন না।’

‘তুই যাবি আমার সঙ্গে?’

‘পাগল! আমাকে দেখে হয়তো খুব বিরক্ত হবেন। কথাই বলবেন না।’

.

ঠিক পাঁচটায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে যেতে যেতে অমিত ভাবল, দুদিনের যাওয়ার মধ্যে কত পার্থক্য। সেদিন সে প্রায় চুরির দায়ে ধরা পড়েছিল।

বেল বাজাতেই মাসিমণি নিজেই দরজা খুললেন। ‘এসো, এসো। বসো বাবা। তোমাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম বলে কিছু মনে করো না।’

‘না না, এভাবে বলবেন না।’

ভদ্রমহিলা দরজা বন্ধ করে সামনের সোফায় এসে বসলেন, ‘ওইরকম শান্ত লাজুক, ভীরু স্বভাবের মেয়েটার এ কী হল বলত। তুমি জানো, ও আমার কাছে মিথ্যে কথা বলছে! এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’

‘এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?’ অমিত নীচু স্বরে বলল।

‘আমি কাকে বলব বাবা? দিদি-জামাইবাবুকে তো বলতে পারছি না। আমার স্বামীও বাইরে। দিদি-জামাইবাবু জানলে কোনওদিন আমার মুখ দেখবে না। ওই মেয়েকে ওঁরা কলেজে পড়াতে চাননি। হায়ার সেকেন্ডারির পরেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমিই জোর করেছিলাম। অন্তত গ্রাজুয়েশনটা করুক। আমার কথায় ওঁরা রাজি হয়েছিল। কিন্তু বলেছিল ও যেন ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা না করে।’

অমিত বলল, ‘ও তো মেয়েদের কলেজেই পড়ছে।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আজকাল ও প্রায়ই মিথ্যে কথা বলছে। কলেজ থেকে বেরিয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে বলছে সে আমার বাড়িতে আসবে। এখানে এসে গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে না ঢুকে কোথাও যায়। যখন আমার কাছে আসে তখন ওর হাঁটু পর্যন্ত ধুলো। তার মানে ও অনেক হাঁটাহাটি করে। যে মেয়ে কোনওদিন গাড়ি ছাড়া রাস্তায় যায়নি সে কোথায় যাচ্ছে।’

‘ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন?’

‘করেছি। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে মিথ্যে বলছে। মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস কোনওদিন ছিল না ওর। অত্যন্ত শান্ত, বলতে পারো একটু ভীরু প্রকৃতির মেয়ে ছিল। কিন্তু আমার মন বলছে ও কোনও অন্যায় কাজ করছে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলেন মহিলা।

‘আপনি অনুমান করে কষ্ট পাচ্ছেন। ওকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই সত্যি কথাটাই আপনাকে বলবে।’ অমিত বুঝতে পারছিল না আর কী বলা উচিত।

‘দ্যাখো, আমি ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জানি। আমি চেয়েছিলাম, আমরা যে পড়াশুনা করার সুযোগ পাইনি তা ও পাক। কিন্তু এরকম হবে ভাবতে পারিনি।’

‘কিন্তু ও কোথায় যাচ্ছে বলে আপনি সন্দেহ করছেন?’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে ও খুব অসৎ ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশছে। তোমায় বলব কি বাবা, একদিন এই বাড়িতে দুপুরবেলায় এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। পাক্কা পনেরো মিনিট পরে যখন বের হল তখন ওর নাকের নীচের ঠোঁট পর্যন্ত লালচে হয়ে গেছে। অথচ যখন বাথরুমে সে ঢুকেছিল তখন মুখ স্বাভাবিক ছিল। জিজ্ঞাসা করতে বলল মুখ কুটকুট করছিল বলে সাবান লাগিয়েছে। আমার কিন্তু অন্য সন্দেহ।’ চোখ বড় করলেন মহিলা।

‘কী?’

‘ও সেদিন নির্ঘাত সিগারেট খেয়েছিল।’

‘সেকি!’

‘তাই তো তোমাকে লজ্জার মাথা খেয়ে ডাকলাম।’

‘না না, ওভাবে বলছেন কেন!’

‘তুমি আমার উপকার করে দাও বাবা!’

‘বলুন, কী করতে হবে?’

‘তুমি মেয়ের ওপর একদিন একটু নজর রাখতে পরাবে? মানে, ও আমার বাড়িতে আসার নাম করে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, এইসব খবর এনে আমাকে দেবে বাবা।’ মাসিমণি কাতর গলায় বললেন।

‘আমার মনে হয় সরাসরি ওকেই জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে।’

‘বলবে না। একটা কথাও ওর পেট থেকে বের করতে পারব না। এতদিন যা ছিল এখন তার উল্টোটা হয়ে গিয়েছে।’

‘কিন্তু আমি কোথায় গিয়ে খোঁজ নেব তাই তো জানি না।’

‘তুমি এককাজ করো। আমার বাড়ির কাছাকাছি বেলা তিনটে নাগাদ এসে অপেক্ষা করবে। মেয়ে যখন বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে কোথাও যাবে তখন তাকে অনুসরণ করবে। দেখবে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে। গলা নামিয়ে কথাগুলো বলেন মাসিমণি, ‘ও যেন টের না পায়।’

‘কিন্তু—!’

‘আপত্তি কোরো না বাবা, আমার এই উপকারটুকু করো!’

ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আপত্তি করতে পারল না অমিত।

.

পরদিন ঠিক দুপুর বেলায় ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাস ধরে অমিত চলে এল। মাসিমণির বাড়ির কাছাকাছি বাসস্টপে লোকজন নেই। রাস্তাও ফাঁকা। ঠিক সাড়ে তিনটের সময় সাদা গাড়িটাকে আসতে দেখল সে। গাড়িটা যখন বাড়ির একটু আগে, গাড়ি থেকে দরজা খুলে নেমে চারপাশে চট করে তাকিয়ে নিল মৃণাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে নীচু গলায় কিছু বলে ফুটপাত ধরে পেছন দিকে হাঁটতে লাগল দ্রুত পায়ে।

অর্থাৎ মেয়েটা, যার নাম মৃণাল, সে তার মাসির বাড়িতে এখন যাচ্ছে না। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ও। অমিত উল্টো ফুটপাত ধরে অনুসরণ করল। খানিকটা যাওয়ার পর মৃণাল বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। অনেকটা দূরত্ব রাখা ঠিক নয়। যে-কোনও বাড়িতে যদি মৃণাল ঢুকে যায় তাহলে বুঝতেই পারবে না। কিন্তু দূরত্ব কমাতেও সাহস পাচ্ছিল না। কলেজের সামনে বাসস্টপে সে কথা বলতে চেয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। তাছাড়া, সেদিনে মৃণাল তার মুখের দিকে একবারও তাকায়নি। তাই এখন তাকে দেখে চিনতে পারার কথা নয়।

আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই একটা পার্ক শুরু হল ডান দিকে। সেই পার্কের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল মৃণাল। তখনই অমিতের খেয়াল হল, গাড়ি থেকে এদিকে আসার সময় মৃণাল তার খাতাবই সঙ্গে আনেনি। ওগুলো গাড়িতেই রেখে এসেছে।

পার্কের ধার দিয়ে একই গতিতে হেঁটে মৃণাল যেখানে পৌঁছাল সেখানে একটা শেডের নীচে বেঞ্চিতে বসে আছে তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটি মৃণালকে দেখে উঠে হাসতে হাসতে হাত মেলাল। মৃণাল ওদের সঙ্গে বসল।

খানিকটা দূরে একটা বড় থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ্য করতে লাগল অমিত। ছেলে তিনটের দুটো ওদেরই বয়সি, একটা বছর তিনেকের বড়। ওদের কথা শুনে খুব হাসছে মৃণাল। এবার বড় ছেলেটা পকেট থেকে প্যাকেট বের করে তা থেকে সিগারেট নিয়ে লাইটার জ্বেলে আগুন ধরালো। ধরিয়ে বেশ জোরে ধোঁয়া টেনে বাইরে ছাড়ল। বাকি ছেলে দুটো আর মেয়েটি উদগ্রীব হয়ে সিগারেট খাওয়া দেখছে। কিন্তু মৃণাল বসে আছে মাথা নীচু করে।

এবার বড় ছেলেটা জ্বলন্ত সিগারেট এগিয়ে ধরতে একজন ছেলে তা নিয়ে খুব সন্তর্পণে ধোঁয়া টেনে কাশতে শুরু করল। এবার তৃতীয় ছেলেটি সেই সিগারেট নিয়ে সামান্য টান দিয়ে মেয়েটির হাতে সিগারেট ধরিয়ে দিল। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে সেই সিগারেটে একবার টান দিয়েই ক্ষান্ত হল না। দ্বিতীয়বার ধোঁয়া টানল। অমিত লক্ষ্য করল মেয়েটা সিগারেটে টান দিয়েও একবারও কাশল না।

এবার মেয়েটা সিগারেটটা এগিয়ে ধরল মৃণালের সামনে। মৃণাল দ্রুত মাথা নেড়ে না বলল। তখন বড় ছেলেটা আর একটা প্যাকেট পকেট থেকে বের করে এগিয়ে দিল। মেয়েটি সেটা থেকে সিগারেট বের করে লাইটার চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে মৃণালকে দিলে সে অতি সন্তর্পণে সেটা নিয়ে চারপাশে তাকাল। তারপর আলতো করে সিগারেটে টান দিতেই এমনভাবে কাশতে লাগল যে উঠে দাঁড়াল। পাশের মেয়েটি ওর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে অন্য হাতে মৃণালের পিঠে আলতো করে আদুরে-আঘাত করতে লাগল। দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও অমিতও বুঝতে পারল মৃণাল বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। বাঁ-হাতের মুঠোয় ধরা রুমালে চোখের জল মুছে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল।

সঙ্গের মেয়েটিও কিছু প্রশ্ন করলে মৃণাল মাথা নেড়ে না বলে শেষ পর্যন্ত হাসল। সঙ্গিনী আবার সিগারেটটা মৃণালকে দিল। এবার সে কাশল না। সঙ্গে সঙ্গে তিনটি ছেলে খুশির আওয়াজ তুলে হাততালি দিল। সবাই হাত বাড়িয়ে মৃণালের হাত স্পর্শ করল। এবার বড় ছেলেটি তার অন্য হাতে ধরা সিগারেট দেখিয়ে কিছু বললে মৃণাল চোখ বড় করে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে না বলল।

ওরা কী বলছে তা এতদূর থেকে শোনা সম্ভব না। যেখানে ওরা বসে আছে তার কাছাকাছি কোনও আড়াল নেই যে সেখানে গিয়ে কথা শোনা যাবে। এখন যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে তার আড়াল ছেড়ে এগোলেই ওরা তাকে দেখতে পেয়ে যাবে। তাই ওদের কথা শোনার কোনও উপায় নেই। একটু পরে সে দেখল মৃণাল উঠে দাঁড়িয়েছে। বাকিরা তাকে যেন অনুরোধ করছে কিন্তু হাতের কব্জির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল মৃণাল। অমিত অনুমান করল মৃণাল এখন ফিরতে চাইছে। ফিরতে হলে এই পথ দিয়েই তাকে আসতে হবে। অমিত দ্রুত পেছন দিকে হাঁটতে লাগল। পার্ক থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকে না গিয়ে সে ডানদিকের একটা দুধের বুথের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। মৃণাল দ্রুত পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারের নলকূপের সামনে দাঁড়াল। তারপর হাতলে চাপ দিলে বেরিয়ে আসা জল হাতে নিয়ে কয়েকবার কুলকুচি করে রুমালে মুখ মুছল। তারপর হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

গলি থেকে বেরিয়ে সে মাসিমণির বাড়িতে না গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। পেছন পেছন খানিকটা দূরত্ব রেখে আসছিল অমিত। মেয়েটি যে আবার গাড়িতে উঠে বসবে তা সে ভাবেনি। ভেবেছিল এবার নিশ্চয়ই মৃণাল মাসিমণির বাড়িতে যাবে। কিন্তু ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে যখন ফিরে গেলে তখন বুঝল মৃণাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

দৃষ্টির বাইরে গাড়ি চলে গেলে অমিত ফাঁপড়ে পড়ল। মৃণালের এই গোপন অভিযানের কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? তা করুক না করুক তার উচিত মাসিমণিকে ব্যাপারটা জানানো। ওই বড় ছেলেটা যে সিগারেট খাচ্ছিল সেটা নিশ্চয়ই সাধারণ সিগারেট নয়। তাদের হোস্টেলের কোনও কোনও ছেলে গাঁজা পোরা সিগারেট খায়। ওটা বোধহয় সেই ধরনের সিগারেট। আজ মৃণাল ওই সিগারেট খায়নি বটে কিন্তু কাল যে খাবে না তার ঠিক কি? সে হেঁটে এসে মাসিমণির দরজার বেলে চাপ দিল।

দ্বিতীয়বার কাজের মেয়েটি দরজা খুলে বলল, ‘ও, আপনি!’

তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘মা, নতুন দাদা এসেছেন। আপনি আসুন।’

অমিতকে বাইরের ঘরে বসিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল। মাসিমণি এলেন একটু পরে। অমিত অনুমান করল কাজের মেয়ের ডাকে ভদ্রমহিলার ঘুম ভেঙেছে।

অমিত উঠে দাঁড়াল, ‘এই অসময়ে আসার জন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন।’

‘না না, বসো বসো। এখন তো প্রায় বিকেলই হয়ে এল। বলো, কী ব্যাপার?’

দুজনে মুখোমুখি বসার পর আজ যা যা দেখেছে তা বিশদে বর্ণনা করল অমিত। শুনতে শুনতে প্রথমে চোখ বড় হয়ে গেল ভদ্রমহিলার। তারপর তিনি দু-হাতে মুখে ঢাকলেন। ‘ছি ছি ছি! আমাদের বাড়ির মেয়ে পার্কে বসে সিগারেট খাচ্ছে। আমার সন্দেহটা তাহলে সত্যি। ছিঃ! এর জন্যে আমিই দায়ী।’

‘একথা কেন বলছেন।’ জিজ্ঞাসা করল অমিত।

‘জামাইবাবুর খুব আপত্তি ছিল, দিদিও প্রথমে রাজি হয়নি। আমিই জোর করে মৃণালকে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলাম। ওর হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেশ ভালো ছিল। ইচ্ছে করলে প্রেসিডেন্সিতেও ভর্তি হতে পারত। কিন্তু কো-এডুকেশন কলেজে ওকে পড়াতে ওরা কিছুতেই রাজি হয়নি বলে বেথুনে ভর্তি করেছিলাম। এখন এইসব কথা জানলে দিদি আমার রক্ষা রাখবে? জামাইবাবু জীবনে আমার মুখ দেখবে না। হায় হায়, এখন আমি কী করি!’ দু-হাতে মুখ ঢাকলেন ভদ্রমহিলা।

একটু অপেক্ষা করে অমিত বলল, ‘আপনি যদি ওকে একটু বুঝিয়ে বলেন—।’

‘যে মেয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে সে সত্যিটা স্বীকার করবে ভেবেছ? না, কক্ষনো না। তার চেয়ে…’ একটু ভাবলেন মাসিমণি, ও কি রোজ এখানে আসে?’

‘তা তো আমি জানি না।’ বলল অমিত।

‘সে তোমাকে তো দেখতে পায়নি, না?’

‘না বোধহয়।’

‘তাহলে বাবা কষ্ট করে ক’দিন তুমি এসে লক্ষ্য রেখো। যদি দ্যাখো সে গাড়ি থেকে নেমে পার্কের দিকে যাচ্ছে তাহলে আমাকে খবরটা দিও।’ সোজা হয়ে বসলেন ভদ্রমহিলা। তার মুখ থমথমে।

‘আপনি কী করবেন?’

‘কী করব মানে? সোজা পার্কে গিয়ে ওর ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসব বাড়িতে। যাদের সঙ্গে বসে সিগারেট খায় তাদের চোদ্দোপুরুষের নাম ভুলিয়ে তবে ছাড়ব।’ ভদ্রমহিলা খুব উত্তেজিত।

অমিত বলল, ‘আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি যা বললেন তা যদি করেন তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে।’

‘তার মানে?’ বড় চোখে তাকালেন মাসিমণি।

‘ওরা চেঁচামেচি করতে পারে। তাই শুনে ভিড় জমে যেতে পারে। যা ঘটেছে তা জানার পরে লোকে হাসাহাসি করতে পারে। ঠিক কিনা?’

একটু ভাবলেন ভদ্রমহিলা, ‘তা ঠিক। উঃ, কী বিপদে পড়েছি! তুমি বাবা একটা রাস্তা বলতে পারবে?’

‘আমি কী বলব বলুন—’ অস্বস্তিতে পড়ল অমিত।

মাসিমণি মাথা নাড়ালেন, ‘না, আর আমি দায়িত্ব নিতে পারব না। ওর পড়াশুনো বন্ধ হলে বাড়ি থেকে বেরুতে পারবে না। জামাইবাবু তো বিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাই এখন দিয়ে দিক।’ মাথা নাড়লেন মহিলা, ‘আমাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে সিগারেট খাচ্ছে! ভাবাই যায় না। আর তিনটে ছেলে আর ওই—মেয়েটা, ওরা কারা? ওদের দেখে কি তোমার মনে হল ওরা পড়াশোনা করে?’

‘বোধহয়। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ অমিত বলল।

‘আমার তো মনে হয় না? তুমি বললে যে সিগারেটটা বড় ছেলেটা খাচ্ছিল তা মৃণাল খেতে চায়নি বলে তাকে অন্য সিগারেট খেতে দিয়েছে?’

‘তাই তো দেখলাম।’

‘বড় ছেলেটা যে সিগারেট খাচ্ছিল সেটা কি অন্যরকম ছিল?’

‘বোধহয় খুব কড়া সিগারেট।’ অমিত বলল।

‘ঠিক আছে। তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বাবা। এই খবর না দিলে মেয়েটা বোধহয় নষ্ট হয়ে যেত। আমাকে এখনই দিদির বাড়িতে যেতে হবে।’

‘ওর সঙ্গে কথা বলতে যাবেন?’ অমিত জিজ্ঞাসা করল।

‘না। ওর সঙ্গে কোনও কথা নয়। ওর বাবা মাকে বলে আসব মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজতে। আর কলেজে পাঠাবার দরকার নেই।’ মাসিমণির মুখ গম্ভীর।

‘ওরা নিশ্চয়ই কারণ জানতে চাইবেন।’

‘একটা কিছু বলে দেব। যেমন, বাজে ছেলেরা পেছনে লেগেছে। কখন কী হয়ে যাবে বলা যাচ্ছে না। বিয়ের পিঁড়িতে তো বসতেই হবে, তাহলে আর দেরি করে লাভ কী! আমার কথা শুনলে ওরা খুব খুশি হবে। এটাই তো ওরা চেয়েছিল।’ বড় শ্বাস ফেললেন মাসিমণি, তারপর উঠে দাঁড়ালেন।

অমিতও উঠল। বলল, ‘একটা অনুরোধ করব?’

অমিতের মুখের দিকে তাকালেন মাসিমণি।

‘আপনি বলেছিলেন মৃণাল হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল। আপনিই ওকে আরও পড়াতে চেয়েছিলেন। এই ঘটনাটা যদি আর না ঘটে তাহলে ওর পড়াশুনা বন্ধ কেন করবেন?’ অমিত বলল।

‘কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আপনি যে সব কথা জেনে গেছেন, তা ওকে বলুন। ওই সংস্পর্শে থাকলে ওর ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে তা ওকে বোঝান। ওর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিন, পড়াশুনা করতে হবে।’ খুব জোর গলায় বলল অমিত।

‘ধরো, আমাকে চাপে পড়ে কথা দিল। কিন্তু সে যে কথা রাখছে তা আমি জানব কী করে? আমার পক্ষে তো রোজ কলেজের সামনে গিয়ে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়।’ মাসিমণি মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, ‘তুমি যদি কোনও পাহারাদার ব্যবস্থা করে দাও তো আমি ভরসা করতে পারি। বৃদ্ধ হলেই ভালো হয়। তেমন কেউ জানা আছে?’

‘না। তা নেই।’ মাথা নাড়ল অমিত।

‘তাহলে! ওরকম নির্ভরযোগ্য লোক আমি কোথায় পাব! ঠিক আছে, এখন কয়েকদিন ওর কলেজ ছুটির আগে আমি সেখানে যাব। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর ফিরে আসব।’ মাসিমণি বললেন।

অমিত বলল, ‘হঠাৎ এরকম কেন করছেন সেকথা তো ওঁরা জানতে চাইবেন!’

‘জিজ্ঞাসা করলে বলব, বাজে ছেলেরা কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, পুলিশও কিছু করে না, তাই আমাকেই যেতে হচ্ছে। তখন যদি জামাইবাবু বলে, ওকে আর পড়তে হবে না তাহলে আমি আর আপত্তি করব না।’ মাসিমণি বললেন।

নমস্কার করে হোস্টেলে ফিরে গিয়েছিল অমিত। পরের দিন সে কৌতূহল সমালাতে না পেরে মৃণালের কলেজের গেট থেকে খানিকটা দূরে একটা থামের আড়ালে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। কলেজ ছুটি হতেই ছাত্রীরা একে একে নিজের নিজের বাড়ি থেকে আসা গাড়িতে উঠে পড়ছিল। এই সময় সে মৃণালকে দেখতে পেল। হনহনিয়ে আসছিল সে কলেজের ভেতর থেকে। গাড়ির সামনে এসে সে থমকে গেল।

মাসিমণি পেছনের দরজা খুলে দেওয়ায় বোঝা গেল, সে অনিচ্ছা সত্ত্বে গাড়িতে উঠতে বাধ্য হল। গাড়ি বেরিয়ে গেলে অমিতের মুখে হাসি ফুটল। আর তখনই তার মনে হল, এসব সে কেন করছে? এখানে এসে মেয়ে আর তার মাসির ব্যাপারটা দেখার কোনও দরকার ছিল না। নিজের ওপর বিরক্ত হল সে।

.

মাস দুয়েক পরে হোস্টেলের অফিসে ডাক পড়ল অমিতের। সে সেখানে যেতেই একজন কর্মচারী বললেন, ‘আপনার মাসিমা ফোন করেছিলেন। এই নম্বরে তাঁকে ফোন করতে বলেছেন। চট করে চিনতে অসুবিধা হল। মাসিমা বলে কাউকে সে এই শহরে এখনও ডাকেনি। কর্মচারীর দেওয়া নম্বর ডায়াল করল অমিত। রিং হচ্ছে কানে এল। তারপরেই মাসিমণির গলা শুনতে পেল, ‘হ্যালো।’

‘আমি অমিত।’

‘ও অমিত। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। আগে বলো তো, এই ফোন করার জন্যে তোমাকে কি ওদের টাকা দিতে হবে?’

‘কেন বলুন তো? হোস্টেলে তো বিনা পয়সার ফোন নেই।’

‘তাহলে রেখে দাও রিসিভার। আমি তোমাকে ফোন করছি।’ কথা বলেই লাইন কেটে দিলেন ভদ্রমহিলা। পরক্ষণেই রিং শুরু হল। রিসিভার তুলতেই মাসিমণির গলা কানে এল, ‘তোমাকে বোধহয় বিরক্ত করছি বাবা, কিছু মনে কোরো না। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। তোমার পরামর্শ চাই।’

‘আমি? কী ব্যাপার?’ অবাক হল অমিত।

‘তুমি কি আজ একবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবে?’

‘আজ? কখন?’

‘তোমার যখন খুশি এসো।’

‘ঠিক আছে। আমি বিকেল বিকেল যাব।’

‘এসো বাবা। তোমার সাহায্য খুব দরকার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *