হায়েনা

হায়েনা

‘লাশটা কি পুড়িয়ে ফেলবে?’

‘নাহ, মজদুররা গন্ধ পেয়ে যাবে। আমার আর্দালি— খানসামা, ওরাও সন্দেহ করতে পারে! এখন আর কুকুর ছাগলের মতো নেটিভদের মারা যায় না। আইন কড়া হচ্ছে।’

‘তবে? ওপরের যমদূতটাকে সরাব কী করে!’

‘তুমি ক’টা ছুরি এনেছ ক্যাম্পে? শাবল জাতীয় কিছু আছে?’

এই হত্যাকাহিনীর সময়কাল এখনকার নয়। এই সত্যঘটনাশ্রয়ী কাহিনীর মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের আর্মি। প্রায় দেড়শো বছর ধরে যে অগণিত ইংরেজ তরুণরা জাহাজে চেপে এসে নামতো প্রাচ্যের এই দেশের বুকে, যাদের গরিষ্ঠভাগই ছিল গর্বোদ্ধত, গোঁড়া ক্যাথলিক, তাঁরাই এই কাহিনীর মূল চরিত্র।

শরীরে শিহরণ জাগানো এই ঘটনাকে আমি এক অলস বিকেলে খুঁজে পেয়েছিলাম সিমলা স্টেট লাইব্রেরির archives section-এ।

সে আরেক কাণ্ড। বছর কয়েক আগের কথা। তখন আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি। ব্যাঙ্কের এক ট্রেনিং এ মাস দুয়েকের জন্য সিমলা যেতে হয়েছিল। তখনই অবসরসময়ে সিমলা মল রোডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড স্টেট লাইব্রেরিতে যেতাম।

আর সেইসময়েই হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় আবিষ্কার করেছিলাম এই রোমহর্ষক খবর। এই সত্যঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ লেখিকা অ্যালিস পেরিনও লেখেন তাঁর এক বিখ্যাত গল্প। সেই গল্পের নাম বলব একেবারে শেষে।

দেড় ইঞ্চির সেই অতিসংক্ষিপ্ত সংবাদ থেকে আমিও সৃষ্টি করতে চলেছি এই দীর্ঘ কাহিনীর। যেখানে মূল চরিত্র ও একেবারে মূল ঘটনা ছাড়া বাকি সব আমার কল্পনাপ্রসূত। সংবাদটিতে ‘অজ্ঞাতনামা’ শব্দটির প্রয়োগ থাকায় সেখানেও নিতে হয়েছে কল্পনার আশ্রয়।

তাই এটি ‘সত্যঘটনাশ্রয়ী উপন্যাস’, ‘নন-ফিকশন’ নয়।

বলছিলাম পরাধীন ভারতবর্ষের আর্মির ব্রিটিশ সৈন্যদের কথা। কালো ‘নেটিভ’দের তারা মানুষ হিসেবে গণ্য করত না। তারা আক্ষরিক অর্থেই ‘dogs and natives’দের সমগোত্রীয় মনে করত। ব্রিটিশ আর্মি রেজিমেন্ট যে শহরগুলোয় ছিল, সেখানে কান পাতলে আজও শোনা যায় তাদের নিষ্ঠুরতার বহু গল্প।

এমন অনেক ব্রিটিশ আর্মি অফিসার ছিলেন, যাদের ‘হিরো’র তকমা দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন অসম্ভব অত্যাচারী, কিছুক্ষেত্রে বিকৃত।

আর এই তালিকায় শীর্ষে থাকবে জন নিকলসনের নাম।

জন নিকলসন ( ১৮২২-১৮৫৭) ছিলেন ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন আর্মি অফিসার। আদতে আয়ারল্যান্ডের মানুষ নিকলসনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা বিদ্রোহ যেমন ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ, ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ ইত্যাদিকে বীরত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার নানা পুরস্কারে ভূষিত করলেও ভারতীয়দের কাছে তিনি ছিলেন নেহাতই একজন চরম অত্যাচারী সাইকোপ্যাথ। নিকলসন দেশীয় ভারতীয়দের আদৌ মানুষ বলে গণ্য করতেন না। একদিকে ১৮৫৭ সালে বেঞ্জামিন ডিসরায়েলি সগর্বে বলছেন, ‘‘Let’s not forget the intrepid Nicholson!’’ ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং অকুণ্ঠ সমর্থন করছেন তাঁকে, অন্যদিকে নিকলসনের অধীনে থাকা দেশীয় সেনারা ভয়ে কাঁপছেন।

প্রায় ছ-ফুট দু-ইঞ্চি উচ্চতা, চওড়া কাঁধ ও পুরুষ্টু গোঁফদাড়ির আইরিশ নিকলসন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে গেলে অসম্ভব ঘৃণা করতেন ভারতীয় সেনাদের। শুধু সেনা নয়, সমস্ত ভারতীয়রাই ছিল তাঁর কাছে বিবমিষার বস্তু।

একবার তিনি এক মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, মসজিদের ইমাম ধর্মচর্চায় এমনই মগ্ন, তাঁকে দেখে একটা ‘সালাম’ পর্যন্ত ঠুকলেন না। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে উপস্থিত সকলের সামনে হিড়হিড় করে টেনে আনলেন মসজিদ প্রধান সেই ইমামকে। তারপর প্রকাশ্যে তাঁর চুলদাড়ি কাটতে বললেন নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের। বাদ গেল না নিজের জুতো চাটতে বলাও।

এখানেই শেষ নয়। খাবারে ক্ষতিকারক কিছু পাওয়ায় কোনোরকম বিচার ছাড়াই নিজের রেজিমেন্টের গোটা রাঁধুনির দলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন তিনি।

ভাবা যায়? কোনো তদন্ত হলনা, দোষ গুণ পরীক্ষা হল না, একদল দেশীয় মানুষের ফাঁসি হয়ে গেল!

এই ছিলেন জন নিকলসন। যিনি শেষমেস ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে প্রাণ হারান। ইউরোপের বহু স্থানে তাঁর রণোদ্ধত বীরোচিত মূর্তি আজও রয়েছে রাস্তার মোড়ে।

আমাদের আজকের কাহিনীর নায়ক বা খলনায়ক যাই বলা হোক না কেন, জন নিকলসন নন। নিকলসনের মতো এমন বেশ কিছু ব্রিটিশ আর্মি অফিসারের অত্যাচার ইতিহাসে লেখা রয়েছে। দেশীয়দের প্রতি ঘৃণা, সন্দেহ, চরম বিতৃষ্ণা ছিল যাদের মজ্জাগত।

তেমনই একজন হলেন হেক্টর সাহেব। ম্যাথিউ হেক্টর। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আর্মির পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একজন অফিসার। যুদ্ধক্ষেত্রে দক্ষ বীর, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ততটাই বদমেজাজী, উগ্র, রগচটা।

সময়টা কুড়ির দশক। মহাত্মা গান্ধী বছরকয়েক হল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন দেশে, কংগ্রেস ক্রমশই গান্ধীর দেখানো পথে এক অন্যরকমের আন্দোলনের দিশা পাচ্ছে। নরমপন্থী বা চরমপন্থী কোনোটাই নয়, অসহযোগিতা করেও যে শাসককে ভয় দেখানো যায়, তা মানুষ বুঝতে শুরু করেছে।

অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে, ভারতীয়রা হেলায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুল ছাড়িয়ে ভরতি করা হচ্ছে স্বদেশি স্কুলে।

এইরকম সময়েই হেক্টর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একেবারে সীমান্তে ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি অবিবাহিত, বছর বত্রিশের ঝকঝকে সুদর্শন ব্রিটিশ তরুণ। এরমধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একাধিকবার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া আর্মির বিভিন্ন খেলায় বা স্পোর্টস ইভেন্টে তিনি প্রায় অপ্রতিরোধ্য।

সামরিক শহর, প্রধানত আর্মির কর্মীরাই থাকে। প্রকাণ্ড একেকটি জায়গা জুড়ে একেকজন আর্মি অফিসারের বাংলো। সামনে পেছনে সুদৃশ্য বাগান। দূরে পাহাড়ের সবুজ ঢাল বেয়ে নেমে গেছে নিশ্বাস বন্ধ করা সুন্দর প্রকৃতি। বাংলোগুলোর পেছনে অফিসারের দেশীয় ভৃত্যদের আউটহাউজ। বিদেশি প্রভু এবং তার স্ত্রীপরিবারের সেবায় তারা সদাতৎপর। জিমখানা থেকে ক্লাব, টেনিস কোর্ট থেকে গলফ, শহরে আর্মি অফিসারদের বিনোদনের জন্য মজুত রয়েছে সবরকমের বিনোদন। এছাড়াও শহরের উপকণ্ঠ থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে গভীর অরণ্য। গাড়োয়াল হিমালয়ের পাদদেশের সেই অরণ্যে পাহাড়ি চিতা থেকে শুরু করে হিমালয়ান টার বা কালো ভালুক সবই আছে। অফিসাররা প্রায়ই সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সেখানে শিকারে যান।

আমাদের কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র হেক্টরের মতো তরুণ দক্ষ আর্মি অফিসারের ক্লাব, জিমখানা থেকে শুরু করে নিত্যদিন লেগে থাকা পার্টি সব জায়গাতেই মধ্যমণি হয়ে থাকার কথা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে সবাই এড়িয়ে চলে। তার কারণ হেক্টরের অতি উগ্র বদমেজাজ সর্বজনবিদিত।

হেক্টর যে শুধুমাত্র বদরাগী তাই নয়, তিনি অত্যন্ত হিংসাপরায়ণও। প্রতিবছর আর্মির টুর্নামেন্টের সমস্ত ইভেন্টের সোনার মেডেলটি তিনি পকেটস্থ করেন, দৈবাৎ কোনোটা মিস হয়ে গেলে প্রতিপক্ষকে মারধর করতেও পিছপা হননা। গোটা শহরে তাঁর কোনো বন্ধু নেই, বন্ধুত্ব করার ইচ্ছাও হেক্টরের নেই।

এহেন হেক্টর যখন একদিন কাজের ফাঁকে নিজে যেচে এসে ডেনিসকে ‘হ্যালো’ বললেন, নির্বিরোধী সদালাপী সদ্যযুবা আর্মি অফিসার ডেনিস বেশ অবাকই হয়ে গেলেন।

‘হ্যালো ডেনিস!’ একটা চুরুট ঠোঁটের কোণে ঝুঁকিয়ে হেক্টর বললেন, ‘এই উইকএন্ডে কী করছ?’

‘সে’রকম কিছু নয়!’ ডেনিস ইতস্তত করে উত্তর দিলেন। ক্যান্টিনের বাকিরা তাঁর দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। অন্যদিন হেক্টর ক্যান্টিনে এসে কোণের জানলার সামনে চুপচাপ বসে লাঞ্চ সারেন, ক্যান্টিনবয় রুটিন মাফিক খাবার দেয়। যতক্ষণ হেক্টর বসে থাকেন, ভয়ে ক্যান্টিনবয়ের বুক ঢিবঢিব করে। এই বুঝি কোনো ভুল হয়ে গেল!

একবার ভুল করে হেক্টরের অপছন্দের বাঁধাকপি দিয়ে একটা ডিশ বানিয়ে দেওয়ার জন্য সাহেব তাকে প্লেট ছুঁড়ে মেরেছিলেন। অভিযোগ করেও কোনো লাভ নেই। একে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নেটিভের ওপর অত্যাচার দেখেও দেখতে পান না, তার ওপর হেক্টরের মতো ভাইসরয় মেডেল পাওয়া অফিসারের বিরুদ্ধে নালিশ করতে গেলে পত্রপাঠ তাকে এখান থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে।

‘উইকএন্ডে ফ্রি আছ তাহলে? ভেরি গুড! আমি এই ফ্রাইডে উত্তরের পাহাড়ে হান্টিং এ যাচ্ছি। হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন মি?’ হেক্টর চুরুট থেকে লম্বা একটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন।

ডেনিস বিস্মিতচোখে তাকালেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। কলোনেল হেক্টর নিজে এসে তাঁকে শিকারে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন? হঠাৎ তাঁর প্রতি এই বদান্যতার কারণ কী?

‘কী হল? আরে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি কি হিমালয়ান লেপার্ড নাকি? হা হা!’ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়লেন হেক্টর, ‘শুনছিলাম তোমার বন্দুকের টিপ নাকি দারুণ, আগের মাসে কুমায়ুন রেঞ্জের পিথোরাগড়ে গিয়ে অনেকগুলো হাঁস পরপর শুট করেছিলে?’

‘হ্যাঁ, তা করেছিলাম।’ ডেনিস দ্রুত স্বাভাবিক হলেন, ‘কিন্তু সে তো বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে। আপনি তো আমার থেকে সিনিয়র … মানে … আপনার সঙ্গে …!’

‘সো হোয়াট!’ এগিয়ে এসে ডেনিসের কাঁধ চাপড়ে দিলেন হেক্টর, ‘ডিউটির সময়টুকু ছাড়া উই অল আর ফ্রেন্ডস হিয়ার! আমি কাছেই থাকি, বিশপ লেনন রোডের পেছনে আমার বাংলো।’

‘হ্যাঁ। ওদিকটায় সিনিয়র অফিসাররা থাকেন। চিনি।’ ছোট্ট করে জবাব দিলেন ডেনিস।

‘ইয়েস! ফ্রাইডে ভোর পাঁচটার সময় রেডি হয়ে চলে এসো। আমরা ট্রেক করে হিলসে যাব। ফিরতে ফিরতে সানডে। আমার আর্দালি, খানসামা, বাবুর্চি সবাই যাবে। শুনেছি ওদিককার বনমুরগির দারুণ টেস্ট। সঙ্গে ভালো স্কচও থাকবে। হা হা! সি ইউ অন ফ্রাইডে!’

ডেনিসের উত্তরের কোনো অপেক্ষা না করেই হেক্টর স্বভাবজাত বেপরোয়া ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন ক্যান্টিন থেকে।

আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চিলের মতো ওঁত পেতে থাকা ডেনিসের সহকর্মীরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হেক্টরের কণ্ঠস্বর বাজখাঁই প্রকৃতির, গোটা ডাইনিং হল সব কথা শুনেছে।

‘হোলি জেসাস, ডেনিস! হোয়াট দ্য হেল হ্যাভ ইউ ডান?’

‘আর ইউ ক্রেজি? ওই beard splitter ডেভিলটার সঙ্গে তুমি কিনা হান্টিং এ যাবে? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’

‘শয়তানটা নির্ঘাত তোমাকেই শিকার করার প্ল্যান করছে!’

একেকজন একেকরকমভাবে বোঝাতে থাকে ডেনিসকে। সবারই এক বক্তব্য, বদমাশ হেক্টরের নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। যে নেটিভ তো দূর, খাঁটি ইউরোপিয়ানদের সঙ্গেও কুকুর বিড়ালের মতো ব্যবহার করে, সে হঠাৎ ডেনিসকে শিকারের যাওয়ার প্রস্তাব দেবে কেন?

ডেনিস বিব্রতমুখে বলেন, ‘সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু ভদ্রভাবে কেউ ইনভাইট করলে তো না বলা যায় না। এর আগেও আমাকে আর্মি ক্লাবের ওয়েটার মাইকেল বলেছিল, হেক্টর নাকি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। হয়ত ওঁর একাকীত্ব আর ভালো লাগছেনা। তাই আমাকে সঙ্গী করতে চাইছেন।’

‘মানে?’ বিস্ময়ে সবার চোখ গোলগোল হয়ে ওঠে, ‘তুমি সামান্য উঁচুগলায় কথা পছন্দ করো না, আর যে লোকটা কথায় কথায় গালাগালির ফোয়ারা ছোটায়, চাকরবাকরদের নিজের জুতো পর্যন্ত চাটিয়ে শাস্তি দেয়, তুমি তার সঙ্গে যাবে?’

‘কিছু করার নেই। আমি ওঁকে প্রমিস করেছি।’

বাড়ি এসে ডেনিস বেশ মনমরা হয়ে রইলেন। তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। বছরদেড়েক হল সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন ইন্ডিয়ায়। ট্রেনিং শেষে তাঁর পোস্টিং হয়েছে হিমালয়ের পায়ের কাছের এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে তিনি এখনো বলার মতো কিছু করে দেখাতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু ভালো ব্যবহারের জন্য এখানে সবাই তাঁকে ভালোবাসে।

বদমেজাজি হেক্টরের সঙ্গে হান্টিং এ গিয়ে কোনো উটকো বিপত্তি হবেনা তো?

তখনও ডেনিস কল্পনাও করতে পারেননি, কি ভয়ংকর দুর্যোগ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে!

শুক্রবার ভোর হতে না হতেই নিজের শিকারের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে পাহাড়ের চড়াইউতরাই বেয়ে ডেনিস গিয়ে উপস্থিত হলেন হেক্টরের বাংলোয়। হেক্টর প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ডেনিস পৌঁছনোমাত্র দুজনে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়লেন। হেক্টরের ভৃত্যরা আগের দিন রাতেই ক্যাম্প খাটিয়ে ব্যবস্থাপনা করার জন্য সেখানে চলে গিয়েছে।

ঔপনিবেশিক জমানায় ব্রিটিশ শিকারিরা মূলত হিমালয়ের বিভিন্ন রেঞ্জেই হান্টিং করতে যেতেন। তাঁদের সঙ্গে যেত দেশীয় শিকারিদের ছোটবড় দল। সাহেবরা বন্দুক উঁচিয়ে মাচায় বসে থাকবেন, দেশীয় শিকারিরা বাঘ বা অন্য কোনো বন্য জন্তুকে তাড়িয়ে সেখানে নিয়ে আসবে, সাহেব তখন উঁচু থেকে সেটাকে গুলি করে মারবেন। Joseph Sramek এই প্রসঙ্গে বেশ মজার একটি কথা বলেছিলেন। যদিওবা অধিকাংশ ব্রিটিশ অফিসার ভারতীয়দের পৌরুষ বা সাহসিকতার দিক দিয়ে ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না, কিন্তু শিকারে যাওয়ার সময় তাঁরা অন্ধভাবে দেশীয় শিকারিদের ওপরেই বিশ্বাস করতেন।

পাহাড়ি পায়ে চলা পথ দিয়ে হেক্টর আর ডেনিসের ঘোড়াদুটো এগিয়ে চলেছিল। হেক্টরের সম্পর্কে যত দুর্নামই শোনা যাক না কেন, এখনো পর্যন্ত তিনি বেশ স্বাভাবিক খোলামেলাভাবেই কথা বলছেন ডেনিসের সঙ্গে। ডেনিসও তাই ক্রমশ আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠছেন। হয়তো হেক্টর একটু চট করে রেগে যান, কিন্তু কত অতিরঞ্জিতভাবে যে কথা ছড়ায়! আর এইটুকু শহর, সকলেই আর্মির লোক। একটা কথা রটতে শুরু করলে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

হেক্টর চলতে চলতে বলছিলেন, ‘আমরা এখন সোজা ত্রিশ মাইল যাব, ইয়ং ম্যান! সেখানে জঙ্গলের মধ্যে বড় বড় কয়েকটা ঝিল আছে। আমি আগেও গিয়েছি। প্রচুর হাঁস আর পাখি আসে।’

‘পাহাড়ের ওপর?’ ডেনিস জিজ্ঞেস করলেন।

হেক্টর বললেন, ‘একেবারে ওপরে নয়, তবে বেশ খানিকটা উঁচুতে। আমি আগের মাসে গিয়ে জায়গাটা মার্ক করে এসেছি। আমার লোকেরা কাল রাতে ওখান থেকে একটু নীচে একটা সমতলে ক্যাম্প খাটিয়েছে। আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ব।’

বেলা যত বাড়ছিল, তত ঠান্ডা যেন জাঁকিয়ে ধরছিল ডেনিসকে। আসলে এতদিন এই শহরে থেকেও বুঝতে পারেননি যে উত্তরের এই জঙ্গল এতটা গভীর। প্রকাণ্ড দৈত্যের মতো উঁচু বন্য গাছগুলো যেন প্রতিজ্ঞা করেছে সূর্যের আলো একফোঁটাও ভেতরে ঢুকতে দেবে না।

একটা সোঁদা মাটিমেশানো বুনো গন্ধ এসে ঝাপটা মারছে নাকে।

কিছুক্ষণ একভাবে চলার পর হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে হেক্টর বললেন, ‘তুমি হয়তো ভাবছ, হঠাৎ কেন তোমাকে আমি ইনভাইট করলাম, তাই তো?’

ডেনিস চুপ করে রইলেন।

হেক্টর বললেন, ‘অনেকের মুখেই শুনছিলাম তোমার ট্রিগারের টিপ খুব ভালো। তোমার পিথোরাগড়ের পারফরম্যান্স ক্লাবে আসা সুন্দরী মেয়েদের পর্যন্ত মুখে মুখে ঘুরছে। তাই ভাবলাম একটু কম্পিটিশনে নেমে দেখি, কার লক্ষ্য বেশি ভালো।’

ডেনিস বুঝতে পারলেন, তাঁর বন্ধুরা তাঁকে খুব ভুল কিছু বলেননি। হেক্টর অত্যন্ত পরশ্রীকাতর, তিনি কারুর জেতা বা ভালো দেখতে পারেননা। এতদিন হান্টিং এ হেক্টরের খ্যাতি ছিল শহরজোড়া, কিন্তু ডেনিস এসে সেই মর্যাদা কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছে। চারপাশে ডেনিসের সুখ্যাতি হেক্টর সহ্য করতে পারছেন না।

অদ্ভুত হেক্টরের প্রকৃতি! এত হিংসা নিয়ে মানুষ বাঁচে কী করে! কেউ কিছুতে ভালো হলেই তাকে হারাতে হবে, এ একধরনের অসুস্থতা।

ডেনিস ঠিক করলেন, তিনি ইচ্ছে করে লক্ষ্যভেদ করবেন না। মূর্খের সঙ্গে সংগ্রামে গিয়ে কোনো লাভ নেই। হেক্টর এখানে ডেনিসকে নিয়ে যাচ্ছেন নিজে শিকারে ডেনিসকে হারাবেন বলে, তাতে যদি তাঁর তৃপ্তি হয়, তাই হোক।

কিন্তু অদৃষ্ট অন্য কিছু স্থির করে রেখেছিল ওঁদের দুজনের জন্য। ঝিলের নীচে খাটানো তাঁবুতে পৌঁছে দুজনে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নিলেন, হেক্টরের ভৃত্যরা ঘোড়াদুটোকে নিয়ে চলে গেল দানাপানি খাওয়াতে। হেক্টর আর ডেনিস বেরিয়ে পড়লেন ওপরের ঝিলের দিকে। সূর্য তখন মাথার একেবারে ওপরে।

আজ আবহাওয়া বেশ সুন্দর। ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে উজ্জ্বল রোদ পাহাড়ি গাছ, রাস্তাঘাটের গায়ে তার ওম মাখিয়ে দিচ্ছে নিশ্চুপে।

হেক্টর আর ডেনিস কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে হাঁটছিলেন। পেছনে বেশ খানিকটা তফাতে আসছিল হেক্টরের কয়েকজন ভৃত্য। তাদের কারুর হাতে কার্তুজের বাক্স, কারুর হাতে খাবারদাবার।

‘দেশি শিকারি কেউ নেই?’ ডেনিস প্রশ্ন করলেন।

হেক্টর তাঁর খয়েরি ভ্রূ দুটো বেশ কিছুটা ওপরে তুলে ঠোঁট বেঁকিয়ে একটা অদ্ভুত শ্লেষাত্মক ভঙ্গি করলেন, ‘সেকি! তুমি হলে গিয়ে এখানকার বেস্ট হান্টার, দেশি শিকারিদের ছাড়া তুমি হান্টিং করতে পারো না?’

‘না তা নয় …।’ ডেনিস বললেন, ‘আসলে এদিকটায় আমি সেভাবে আসিনি কখনো…!’

‘ডোন্ট ওয়ারি ইয়ং ম্যান! আমি এই জায়গাটা হাতের তালুর মতো চিনি। ঝিলের কাছে নিয়ে যাই, তারপর তুমি শুধু ট্রিগার টিপবে ব্যাস! দেখি আজ ক’টা পাখি মি. ডেনিসের দৌলতে পাই! হা হা!’ হেক্টরের অট্টহাস্যে চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে।

ডেনিস মুখ শক্ত করে সামনে তাকান। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেক্টর তাঁকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছন পাহাড়ের একেবারে ওপরের সেই ঝিলে।

নাহ, সত্যিই অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য! মুগ্ধ হয়ে যান ডেনিস। মনে মনে হেক্টরকে ধন্যবাদ না দিয়েও পারেননা। হাজার হোক, তাঁর জন্য এমন সুন্দর একটি স্থানে আসতে পেরেছেন ডেনিস।

চারপাশে পাহাড়, মাঝে একটি মাঝারি মাপের ঝিল। কিন্তু সেই ঝিলটিকে যেন মনে হয়না পৃথিবীর কোনো অংশ। তার কাচের মতো স্বচ্ছ জলের ওপর সূর্যালোকের ঝিকমিক যেন স্বর্গকে মনে করায়। ঝিলের ওই প্রান্তে বসে আছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। তারা পরিশ্রান্ত, কয়েক হাজার মাইল উড়ে এসেছে এই অনন্যসুন্দর হ্রদে, আকণ্ঠ জলপানে ব্যস্ত তারা।

আহ! কী রূপের বাহার একেকজনের। সৃষ্টিকর্তা যেন প্রকৃতির সব রং অকৃপণভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন তাদের।

‘কী দেখছ?’ হেক্টর বলে উঠলেন, ‘তাড়াতাড়ি শুরু করো। এখানকার আবহাওয়া খুব খামখেয়ালি। এই দেখছ ঝকঝকে রোদ, তো পরক্ষণেই গাঢ় কুয়াশায় চারদিক ঢেকে যাবে। তখন আর কিচ্ছু করা যাবেনা, পুরো দিনটাই নষ্ট হবে।’

ডেনিস কিছু বলার আগেই হেক্টর কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে উলটোদিকের একটা লাল-নীল-হলুদ রঙে মেশানো বড় পাখিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেন। চারপাশের কিচিরমিচির, জলের শব্দ চিরে ছুটে গেল কর্কশ বন্দুকের গুলি।

ডেনিস দক্ষ শিকারি। বাঘ, হরিণ, পাহাড়ি চিতা থেকে শুরু করে বুনো মোষ, সবকিছু শিকার করার কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর পকেটে। বাঘ মারার পর তার নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কারের সময় ভৃত্যদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন অক্লেশে, নির্বিকারে।

তবু এত সুন্দর পাখিটার দিকে তাক করে গুলি ছুটে যেতে তাঁর বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠল। তিনি বলতে গেলেন, ‘এমনি পাতিহাঁসও তো বেশ কিছু রয়েছে দেখছি!’

কিন্তু বলতে পারলেন না। কারণ হেক্টর বিকট একটা চিৎকার করে নিজের পা দিয়ে শূন্যে প্রবল আক্রোশে লাথি ছুঁড়লেন। ডেনিস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখলেন, পাখিটা উড়ে গিয়ে বসেছে কাছেরই একটা গাছের মগডালে। কার্যত হেক্টরের অব্যর্থ নিশানাকে সে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সুন্দর গ্রীবা উঁচিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এ’দিকে।

‘ড্যাম ইট!’ হেক্টর বললেন, ‘একটুর জন্য ফসকে গেল।’

কথাটা বলতে বলতে বন্দুকে কার্তুজ ভরে তিনি আবার নিশানা স্থির করলেন। এবার আরেকটি পরিযায়ী পাখি।

অবাক কাণ্ড! এবারেও লক্ষ্যভেদ হলনা। এই পাখিটাও উল্কার গতিতে উড়ে গিয়েছে ঠিক।

সেই শুরু হল। যত বেলা বাড়তে লাগল, প্রতিটা পাখি যেন হেক্টরকে নিয়ে উপহাস করতে লাগল। কুড়ি, পঁচিশ, ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ, গুলির পর গুলি খরচ হতে লাগল, কিন্তু একটা পাখিকেও মারা গেলনা।

একটা করে লক্ষ্য হাতছাড়া হচ্ছে, হেক্টর তত উন্মত্ত হয়ে উঠছেন। সামনের দিকের সেই ঝিল কখন পেরিয়ে এসেছেন। ছুটতে ছুটতে ক্রমশ ঢুকে পড়ছেন গভীর অরণ্যে।

ডেনিসকেও হাত গুটিয়ে রাখতে দেননি, জোর করে ছুঁড়িয়েছেন গুলি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডেনিস তিনটে পাতিহাঁস মেরেছেন। আর হেক্টরের চোয়ালের পেশিগুলো ততই কঠিন হয়ে উঠেছে। নিজের ঝুলি যেখানে শূন্য, সেখানে ডেনিসের শিকার হেক্টর কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

রাগে, উদ্বেগে, উত্তেজনায় হেক্টরের মুখ লাল হয়ে উঠছিল। হাঁপাচ্ছিলেন, তবু থামছিলেন না। পেছনে কার্তুজের বাক্সকাঁধে ভৃত্যদের দল কখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাহাড়ের এই দুর্গম অরণ্যের একেবারে ভেতরে হেক্টর আর ডেনিস হেঁটে চলেছেন নিরন্তর।

ঘড়িতে যখন দুপুর দেড়টা, তখন ডেনিস আর থাকতে না পেরে বলে ফেললেন, ‘এবার ফিরে চলুন হেক্টর! সবারই ব্যাড ডে আসে। আজ হয়ত তেমনই একটা দিন। লাঞ্চের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাল সকালে আবার হবে’খন। আছি তো এখনো দুদিন!’

হেক্টর যেন শুনতেই পেলেননা। নিজে একটাও শিকার করতে না পারা, তার ওপরে ডেনিসের পাখি শিকার তাঁকে উন্মত্ত করে তুলছিল। ডেনিসের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে দূরের একটা পাখিকে লক্ষ্য করে আবারও গুলি ছুঁড়লেন তিনি।

পাখিটা যেখানে বসেছিল, সেখান থেকে গুলির আওয়াজে এক সেকেন্ড উড়ে গেলে কোনো অবস্থানে যেতে পারে, সেই আন্দাজ করেই হেক্টর গুলি ছুঁড়েছিলেন। একটা কিছু ঝুপ করে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেতেই জঙ্গলের শুকনো ঘাসপাতা পেরিয়ে হেক্টর পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন।

ডেনিসও দ্রুতপায়ে অনুসরণ করলেন হেক্টরকে।

শীতকাল, বেলা এমনিতেই ছোট, ক্রমশ পড়ে আসছে। রোদের তেজ কমছে দ্রুত।

হেক্টর আর ডেনিস সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলেন।

পাখিটাকে কোলে জড়িয়ে পরম মমতায় আগলে রেখেছে একটা লোক। এই ঠান্ডাতেও লোকটার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নীম্নাঙ্গে শুরুমাত্র একটা কৌপীন জড়ানো। গোটা গায়ে ধূসর কিছু মাখানো। সম্ভবত ছাই।

লোকটার বুকের কাছে শক্ত হয়ে বসে রয়েছে পাখিটা। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে সে একবার তাকাচ্ছে মৃত্যুদূতদের দিকে, পরক্ষণে আবার নিজের ঠোঁট দিয়ে আঁকড়ে ধরছে জীবনদাতাকে।

লোকটা একজন ভারতীয় যোগী। হেক্টর অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ঠোঁট উলটোলেন। এই নিগারদের দেশে এইসব ছাইভস্মমাখা যোগীদের অভাব নেই। এরা আজব মানুষ, আদৌ মানুষ কিনা কে জানে! কনকনে শীতে অর্ধউলঙ্গ হয়ে পাহাড়ের ওপরে বসে থাকে আর বিড়বিড় করে। এর আগেও শিকার করতে এসে এদের দেখা পেয়েছেন তিনি। ডিসগাস্টিং!

কিছুটা চিবিয়ে চিবিয়ে হেক্টর ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে বললেন, ‘ডার্টি নিগার! তুমি ওকে ধরলে কেন? আমাদের একটা গুলি নষ্ট হল!’

ডেনিস লক্ষ্য করলেন, লোকটার মুখটা লম্বাটে আর সরু। দীর্ঘদিনের চোখের মণি দুটো সামান্য কেঁপে স্থির হয়ে গেল। কিন্তু সে হেক্টরের থেকে দৃষ্টি সরাল না।

ডেনিস ফিসফিস করে বলতে গেলেন, ‘চলো, আমরা ওইদিকটায় যাই।’

কিন্তু কোনো লাভ হল না।

‘কী দেখছ ওরকম করে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন হেক্টর, জোরে থুতু দিলেন লোকটাকে লক্ষ্য করে। তারপর বললেন, ‘হঠো সামনে থেকে!’ রাগের বশে মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাথরের নুড়ি তুলে হেক্টর ছুঁড়ে মারলেন সামনের দিকে।

লোকটা সামান্য মাথাটা সরিয়ে নুড়ির আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচালো। তারপর হেক্টরের দিকে একভাবে চোখ রেখেই পাখিটাকে উড়িয়ে দিল আকাশে।

‘ইউ ব্লাডি …!’ হেক্টর পাখিটার উড়ে যাওয়ায় তীব্র আক্রোশে আরো একটা নুড়ি তুলে সজোরে ছুঁড়তে গেলেন, কিন্তু তার আগেই লোকটা পেছনের লম্বা লম্বা এক মানুষ সমান বুনো ঘাসের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হেক্টর ডেনিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মুখখানা দেখেছ? লোকটা নির্ঘাত আগের জন্মে পাড়িয়া কুত্তা ছিল! না না কুত্তা নয়, বুনো শিয়াল ছিল নিশ্চয়ই!’

ডেনিস বললেন, ‘এবার ফেরত চলো। বেলা ছোট হয়ে আসছে। এতটা ভেতরে এসেছি, তোমার সাকরেদদেরও কোনো পাত্তা নেই। রাস্তা হারালে মুশকিলে পড়ব!’

হেক্টর এবারেও ডেনিসের কথায় কর্ণপাত করলেন না, বন্দুক তাক করে ফের এগিয়ে গেলেন দূরের অন্য একটা পাখির দিকে।

* * *

ডেনিসের এবার বিরক্ত লাগছিল। একে সেই ভোরবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, তার ওপর নিরন্তর এই ব্যর্থ শিকার তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাল।

তিনি বিরক্তমুখে পেছন ফিরলেন। বললেন, ‘আমি টেন্টে যাচ্ছি হেক্টর! তুমি হয়ে গেলে এসো।’

হেক্টর কোনো উত্তর দিলেন না। কাছেই রয়েছেন, অথচ গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে তাঁকে দেখাও যাচ্ছেনা।

ঠিক এইসময়েই ডেনিস একটা গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ভারী কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ।

পেছন ফিরে ছুটে এসে দেখলেন হেক্টর বন্দুক উঁচিয়ে উল্লসিত চোখে বলছেন, ‘ইয়েস! এটা শিওর হিট করেছে! অ্যান্ড দিজ ইজ অ্যা জায়ান্ট বার্ড, ডেনিস! আওয়াজ শুনেছ? মাই নেম ইজ ম্যাথিউ হেক্টর। ছুটকো পাতিহাঁস মেরে আমি হাত গন্ধ করি না। চলো শীগগির!’

ডেনিস হেক্টরের পিছু পিছু ছুটছিলেন।

এই দিকটায় একধরনের বুনো ঘাস প্রায় একমানুষ সমান। একটু অসাবধান হলেই পায়ে জড়িয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঘাসগুলোকে আড়াল করে চলতে হচ্ছিল।

ছুটতে ছুটতে দুজনে যখন অকুস্থলে পৌঁছলেন, দুপুর তখন তিনটে।

পৌঁছনোমাত্র দুজনে আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন।

ডেনিস চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘একি!’

হেক্টর হতভম্ব চোখে তাকিয়ে ছিলেন।

তাঁর এবারের গুলি সত্যিই নষ্ট হয়নি। তা একটি জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়েছে ঠিকই, তবে তা পাখির দেহে নয়। পাখি, পশু কিচ্ছু নয়। একটু আগে যে দেশীয় যোগীটি ওঁদের গুলি থেকে একটা পাখিকে বাঁচিয়েছিল, সেই যোগী লোকটির বুকেই বন্দুক থেকে বেরিয়ে সটান এসে ঢুকেছে হেক্টরের গুলি। বুকের সেই জায়গাটা একটা কালো গর্ত তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত।

অদ্ভুত! কুচকুচে কালো নেটিভ হলেও রক্তের রং আমাদের মতোই একেবারে টকটকে লাল, সম্ভবত ভাবছিলেন হেক্টর।

ডেনিস উদ্ভ্রান্তের মতো উবু হয়ে বসে পড়লেন, পাগলের মতো পরীক্ষা করতে চাইলেন লোকটার নাড়ি, হৃদস্পন্দন। কিন্তু ততক্ষণে আর কিছু করার নেই। লোকটার প্রাণবায়ু দেহ থেকে বেরিয়ে গেছে। চোখদুটো খোলা, ফ্যাকাশেভাবে তাকিয়ে রয়েছে ওপরের আকাশের দিকে। প্রকান্ড উঁচু একটা গাছের ডালপালা ঝুঁকে রয়েছে তার ওপর। বুনো পাতার সেই সবুজ রঙ প্রতিফলিত হচ্ছে মরা চোখদুটোর মণিতে।

মনে হচ্ছে লোকটার চোখের মধ্যেই রয়েছে আস্ত একটা জঙ্গল। একবারের বেশি তাকালেই গা-টা কেমন শিরশির করে ওঠে।

‘কী হবে এবার?’ সাদা চোখে তাকালেন ডেনিস।

হেক্টর বিড়বিড় করলেন, ‘ইদানীং এমন কড়াকড়ি হয়েছে, আগের মতো ইচ্ছে হলেই নেটিভগুলোকে মারা যায়না। আমার সার্ভেন্টরা খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এলে মুশকিলে পড়ে যাব!’

ডেনিস কোনো কথা বলছিলেন না। আমোদপ্রমোদে এসে যে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হতে হবে, তা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। হেক্টর বদরাগী, হেক্টর রগচটা, সবই তাঁর জানা ছিল, কিন্তু যাকে কয়েক মুহূর্ত আগে চরম দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়েছেন, তারই যে প্রাণটা এভাবে নিয়ে নেবেন, ডেনিস তা কল্পনাও করতে পারেননি।

তীব্র আফসোসে নিজের গালেই নিজে থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করছে ডেনিসের। কী কুক্ষণে কারুর কথা না শুনে বেশি ওস্তাদি দেখিয়ে তিনি হেক্টরের সঙ্গ নিলেন! সকাল থেকে আজ কোনোকিছুই সায় দিচ্ছিল না। শেষে এই ভয়ংকর পরিণতি।

বেলা পড়ে আসছে দ্রুত। পাহাড়ি জায়গায় সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। তাপমাত্রাও নেমে আসছে। এখনো তাঁবুতে ফিরতে না পারলে মুশকিল হয়ে যাবে।

‘এক কাজ করা যাক!’ হাজার বছরের ঘুম ভেঙে যেন জেগে উঠলেন হেক্টর, ‘এখন ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা। তাড়াতাড়ি হেঁটে টেন্টে চলে যাই আমরা। আমার খিদমগারের কাছে ভালো ছুরি আর শাবল আছে। মাঝেমধ্যে লাগে জঙ্গলে। দুজনে নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এসে এই নেংটি পরা নোংরা নেটিভটাকে কবর দিয়ে দিই!’

ডেনিস বিস্ময় চাপতে পারলেন না। একজন নিরপরাধ মানুষকে মেরে ফেলেও হেক্টরের কোনো অনুতাপ নেই, এমনকি সহমর্মিতার লেশমাত্র নেই। অবলীলায় তিনি বলতে পারছেন ‘নেংটি পরা নোংরা নেটিভ’!

‘আরে কী ভাবছ!’ খানিকটা অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন হেক্টর, ‘অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। শিগগীর চলো।’

‘এখনই গিয়ে এখনই ফিরব? অন্ধকারের মধ্যে এসে আমরা শুধু দুজনে মিলে একটা লাশকে …!’ ডেনিস কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ ততক্ষণে শুকনো ঘাসপাতার মধ্য দিয়ে বন্দুক কাঁধে হেক্টর হাঁটা লাগিয়েছেন পেছন দিকে।

তারপরের একটা ঘণ্টা কাটল প্রচণ্ড মানসিক চাপে। প্রায়ান্ধকার অজানা পথ ধরে নীচের তাঁবুতে ফিরে যাওয়া, তারপর সেখানে হেক্টরের গুচ্ছের খানসামা, আর্দালি, খিদমদগারের অলক্ষ্যে কিছুই হয়নি এমন ভাব করে ছুরি আর শাবল নিয়ে বেরিয়ে আসা, সবকিছুর মধ্যেই স্নায়ুর ওপর প্রবল চাপ পড়ে বইকি!

হেক্টরের খাস ভৃত্য রোশনলাল তো বলেই ফেলল, ‘কিছু দিক্কত হয়েছে সাহিব? আপনারা কেন তকলিফ করবেন, আমি যাচ্ছি সঙ্গে!’

‘না। তোমাদের যেতে হবে না।’ রুক্ষগলায় বলেছেন হেক্টর, ‘গুলি খেয়ে একটা পাখি গর্তে পড়ে গেছে। সেটাকে তুলতে যাচ্ছি। তোমরা এখানেই থাকো। রাতের খানা আচ্ছাসে পাকাও!’

হেক্টর আর ডেনিস আবার যখন অকুস্থলে ফিরে এলেন, তখন রীতিমতো অন্ধকার। হেক্টরের জোরালো টর্চের আলোয় কোনোমতে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে উঠলেন তাঁরা।

ডেনিস সেই কালান্তক ঘটনার পর থেকে কথাবার্তা বিশেষ বলছিলেন না। হেক্টরের প্রতি অসম্ভব রাগে, পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় তাঁর মেজাজটা একেবারে তেতো হয়ে গিয়েছিল।

রাতের জঙ্গলের রূপ একেবারে অন্যরকম। আকাশছোঁয়া উঁচু উঁচু গাছগুলো যেন মনে হয় অন্ধকারে আকাশের বুক চিরে উঠে গেছে।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে যতটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, আজ আকাশে একটাও তারা নেই।

বৃষ্টি হবে কি?

বৃষ্টির জলে কি ওই লোকটার বুক থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে?

ডেনিস নিজের মনে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন।

লাশটা যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে ওঠার আগে বেশ কিছুটা খাড়াই। একহাতে শাবল অন্যহাতে ছুরি নিয়ে হেক্টর ডেনিসের আগে আগে উঠেই কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেলেন।

মুখ দিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদ বেরিয়ে এল, ‘হোলি জেসাস!’

‘কী হয়েছে?’ ডেনিস পিছুপিছু উঠে এসে হেক্টরের টর্চের আলোয় সামনের দৃশ্যটা দেখে কেঁপে উঠলেন।

* * *

ডেনিস দেখলেন, সেই লোকটার লাশটা একইরকমভাবে পড়ে রয়েছে মাটিতে। একইরকমভাবে তার চোখদুটো নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে ওপরের দিকে। কিন্তু চোখের নীচ থেকে গোটা শরীরটা আর কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা।

কেন?

কারণ গোটা শরীরটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা চতুষ্পদ প্রাণী। প্রাণীটা কী প্রজাতির সেটা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না, তবে সেটা যে আকারে আয়তনে প্রকাণ্ড আস্ত একটা প্রমাণ আকারের মানুষের মতোই বড়, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

হাউন্ড জাতীয় কোনো হিংস্র কুকুর কি?

ডেনিস ফ্যাকাসে মুখে হেক্টরের দিকে তাকালেন। হেক্টর বিড়বিড় করে বললেন, ‘যমদূতের মতো জন্তুটা কী, বুঝতে পারছ?’

‘না।’ ডেনিস বললেন, ‘শিয়াল? না কোনো বুনো কুকুর?’

‘কোনোটাই নয়।’ হেক্টরের জোরালো টর্চের আলোয় গোটা জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠলেও জন্তুটার যেন কোনো হেলদোল নেই। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে লোকটার ওপর। জন্তুটার লেজটা খুব একটা বড় নয়, সেটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠছে জোরে জোবে।

 লোকটার লাশটাও সেই কম্পনে নড়ছে।

সদ্যবিবাহিতা যুবতী স্ত্রীর সামনে যুদ্ধে মৃত স্বামীর মৃতদেহ আনা হলে, সে যেভাবে শোকে পাথর হয়ে পড়ে থাকে লাশের ওপরেই, জন্তুটাও যেন সেভাবেই পড়ে রয়েছে!

‘হায়েনা। আফ্রিকায় দেখেছিলাম। ইন্ডিয়ার এই ফরেস্টে আছে জানতাম না!’

ডেনিস ফিসফিস করে বললেন, ‘হায়েনা তো আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু সেগুলো উচ্চতায় বড়জোর তিন সাড়ে তিন ফুট। এত বড় কি হায়েনা হয়?’

হেক্টর বললেন, ‘তুমি উঠে আসার আগে আমি প্রথম বার যখন টর্চের আলো ফেলেছিলাম, জন্তুটা মুখ ফিরিয়ে দেখেছিল। অমন কুতকুতে শয়তান বুড়োর মতো মুখ হায়েনা ছাড়া কারুর নয়। ওইরকম একটা প্যা*ংলা লোক এমন ভয়ংকর হায়েনা পুষত, ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছি।’

‘কিন্তু জন্তুটা ওইভাবে পড়ে থাকলে আমরা লাশটাকে মাটিতে পুঁতব কি করে?’ ডেনিস বললেন।

হেক্টর উত্তর দিলেন না। কাঁধের বন্দুকটা টেনে কাছে এনে নিশানা স্থির করতে যাবেন, ডেনিস এবার শক্তভাবে হাত চেপে ধরলেন, ‘না। তুমি আর শুধু শুধু কাউকে মারবে না হেক্টর!’

হেক্টর বিরক্ত ক্রুদ্ধ চোখে তাকালেন, ‘আরে! এটাকে না মারলে কাজটা সারব কী করে? রাত হয়ে আসছে। হায়েনারা সাধারণত জোট বেঁধে থাকে, এটাকে ঝটপট না সরালে গোটা পাল চলে এলে আমরাই এদের ডিনার হয়ে যাব! তার চেয়ে আপদ বিদায় করাই ভালো।’

ডেনিসের শত অনুরোধও হেক্টর শুনলেন না, বন্দুকের পরপর দুটো গুলি বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল লাশের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা হায়েনাটার মাথা লক্ষ্য করে।

অদ্ভুত ব্যাপার! যে জন্তুটার লেজ এতক্ষণ নড়ছিল, গুলি খেয়েও সে একটুও কেঁপে উঠলনা। একইরকমভাবে পড়ে রইল লাশের ওপর।

হেক্টর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন, তারপর এগিয়ে গিয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঠেললেন জন্তুটা। দু’বারের ধাক্কায় নিষ্প্রাণ হায়েনাটা গড়িয়ে পড়ে গেল পাশে।

ডেনিস দেখতে পেলেন, লোকটার বুকের রক্ত এখন কালচে হয়ে শুকিয়ে গেছে। কিন্তু হায়েনাটার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত তার মুখটাকে ভরতি করে দিয়েছে। লোকটার মুখটা এখন দেখাচ্ছে গল্পের বইতে পড়া ব্রাম স্টোকারের রক্তচোষা ড্রাকুলার মতো।

ডেনিসের গা-টা গুলিয়ে উঠল এই বীভৎস দৃশ্য দেখে।

তারপরের এক ঘণ্টা গেল শাবল দিয়ে একটা লম্বা চওড়া গর্ত খুঁড়তে। প্রথমে ছুরি অনেকটা গভীরে পুঁতে দেওয়া, তারপর শাবল দিয়ে সেই জায়গার মাটি উপড়ে তোলা, এইভাবে টানা কাজ করে গেলেন হেক্টর আর ডেনিস। অবশেষে যখন প্রমাণ আকারের একখানা গর্ত হল, হেক্টর লাফিয়ে ভেতরে নেমে দেখে টেখে বললেন, ‘নাহ! হিন্দু ফকির হলে কি হবে, আমরা তাকে এক্কেবারে আমাদের আদলে কবর দিচ্ছি। বেচারা এত পুণ্যের কথা কোনোদিন কল্পনা করতে পেরেছিল? হাঃ হাঃ!’

ডেনিস কোনো উত্তর দিলেন না।

ঘড়িতে রাত সাড়ে সাতটা। গাঢ় অন্ধকার নেমে গিয়েছে। একে পাহাড়ি জঙ্গল, তার ওপর রাত। আজ মনে হয় অমাবস্যা, আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্ন নেই। মেঘ জমে আছে থোকা থোকা, তাই নেই তারাদের মিটমিটও।

ডেনিসের মনে হল, মৃত হায়েনার সঙ্গীরা আশেপাশেই কোথাও ওঁত পেতে বসে নেই তো? চুপিসাড়ে তারা দেখেনি তো আপনজনের মৃত্যু? হয়ত অপেক্ষা করছে উপযুক্ত মুহূর্তের, সুযোগ আসামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে ওঁদের ওপর!

হায়েনা দেখতে কুকুরের মতো হলেও বিড়ালের মতো হিংস্র প্রজাতির। মাংসাশী এই প্রাণীরা থাকে আশিটা বা তারও বেশি হায়েনা মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে। সিংহকে মারাও এদের পক্ষে বিচিত্র নয়।

আর সেখানে এই হায়েনাটা তো সাধারণ হায়েনার প্রায় দ্বিগুণ!

এত বড় হায়েনা হয়?

হেক্টর ঝুঁকে পড়ে দু-হাত দিয়ে লোকটার লাশটাকে গর্তে ফেলে দিলেন। লাশটা পড়ার সময় একদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ধপ করে একটা শব্দ হল।

লোকটার ওপরেই হায়েনাটার লাশটা বন্দুকের বাঁট দিয়ে ঠেলে ঠেলে ফেলে দিলেন। তারপর চারপাশের চুড়ো করে রাখা মাটি শাবল দিয়ে ফেলতে লাগলেন গর্তটাকে।

‘চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কেন, ডেনিস? একটু হাত লাগাও!’

হেক্টরের তিরস্কারে সম্বিৎ ফিরে পান ডেনিস। দুজনে মিলে দ্রুত গর্তটা বোজাতে থাকেন। গোটা জঙ্গল ভরে যেতে থাকে ঝিঁঝিঁ জাতীয় পোকার ক্রমবর্ধমান গুঞ্জনে।

একটা নির্দোষ মানুষ ও আরেকটা নির্দোষ প্রাণীর মৃতদেহ ক্রমশ মিশে যেতে থাকে মাটির সঙ্গে।

* * *

সেই কালান্তক ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় একমাস। পরেরদিন সকালেই শহরে ফিরে এসেছিলেন ডেনিস আর হেক্টর।

ওই ঘটনার পর হেক্টর যতই নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করুন, ডেনিস দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়েছিলেন, তিনি আপাতত কিছুতেই শিকার করবেন না। সেই ইচ্ছা বা মানসিকতা কোনোটাই তাঁর নেই।

হেক্টর যতই তাচ্ছিল্য করুন, ডেনিসের ইচ্ছাকে অমান্য করতে পারেননি। শিকার অভিযান শেষ হয়েছিল একেবারে আধখেঁচড়াভাবে, এবং প্রায় শূন্য হাতে।

ফিরে এসে ডেনিস অফিস জয়েন করলেন এবং কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি এখনো অবিবাহিত, অফিস শেষে বাকি সন্ধেটা কেটে যায় ক্লাবে। তারপর ডিনার সেরে কিছুক্ষণ নিজের ছোট্ট বাংলোর খোলা বারান্দায় বসে দূরের পাহাড় দেখেন আর দুটো চুরুট শেষ করেন।

 সেইসময়ে তার চিন্তার জালে মাঝে মাঝেই এসে পড়ে সেই দেশীয় যোগীটা। তখন তিনি জোর করে মনকে অন্যদিকে ঘোরান। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁলে শুয়ে পড়েন।

খবরটা প্রথম দিল স্টোর অ্যান্ড পারচেজ ডিপার্টমেন্টের স্যামুয়েল।

‘শুনেছ তোমার বন্ধুর কী হয়েছে?’

‘আমার বন্ধু?’ ডেনিস বুঝতে পারলেন না, ‘কার কথা বলছ?’

‘কার আবার, যার সঙ্গে আনন্দে ডগমগ হয়ে হান্টিং এ গিয়েছিলে। বদরাগী ম্যাথিউ হেক্টর!’

ডেনিস বললেন, ‘আসার পর থেকে তো তাঁর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। কেন, কী হয়েছে তাঁর?’

”অনেক কিছু।” স্যামুয়েল ধীরেসুস্থে একটা চুরুট ধরাল। লম্বা লম্বা দুটো ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘হেক্টরের বাংলোর সবচেয়ে কাছে হল রবার্টের বাংলো। তা রবার্ট বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকে। একবার রবার্টের ছেলে খেলতে খেলতে হেক্টরের জানলায় বল ছুঁড়েছিল বলে রবার্টকে তখন যাচ্ছেতাই বলেছিল হেক্টর। সেই থেকে ওরা ওদিকে খুব একটা ঘেঁষে না। হঠাৎ গত সপ্তাহে এক কাণ্ড!’

‘কী কাণ্ড?’

‘তখন রাত দুটো কি আড়াইটে। হঠাৎ রবার্টের বাড়ির দরজায় ঠকঠক। কী ব্যাপার? রবার্ট খুলে দেখে, হেক্টর। তার মুখ নাকি শুকিয়ে এতটুকু। রবার্টকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল, তার নাকি একা থাকতে খুব ভয় লাগছে। যদি কিছু অসুবিধা না থাকে, সেই রাতটুকু কি হেক্টর রবার্টের বাংলোর গেস্টরুমে থাকতে পারে?’

ডেনিস এবার হেসে ফেললেন। বললেন, ‘মশকরা করারও একটা লিমিট আছে স্যামুয়েল! কল্পনার ঘোড়া এমন জোরে ছুটিও না যাতে ইয়ার্কিটা লোকে বুঝতে পেরে যায়। হেক্টরের মতো দাপুটে লোক, অত ভালো শিকারী, অতগুলো মেডেল পাওয়া আর্মি অফিসার, সে কিনা একা থাকতে ভয় পাচ্ছে? আজকাল ক’পেগ করে মারছ শুনি?’

স্যামুয়েল কিন্তু হাসল না। বেশ বিরক্তমুখে বলল, ‘ধুর! মশকরা করতে হলে দুনিয়ায় এত ভালো ভালো ব্যাপার ঘটছে সে’সব নিয়েই করব, ওই বুনো শুয়োরটাকে নিয়ে কেন করব? বিশ্বাস না হলে তুমি রবার্টকে জিজ্ঞাসা করো। আরও অনেকেই জানে ব্যাপারটা। রাতের বেলা ওর বাংলো থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। এমনকি হেক্টরের ডিপার্টমেন্টেরও কেউ কেউ বলেছে, হেক্টর সবসময় কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। আগের সেই তিরিক্ষি মেজাজ তো নেই-ই, উলটে ভয় ভয় মুখ করে ঘোরে। ঠিকমতো অফিসও আসেনা। আগের উইকে পানিশমেন্ট পেয়েছিল।’

স্যামুয়েল চলে গেলে ডেনিস কিছুক্ষণ বসে রইলেন। একই শহর হলেও এখানে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির অনেকগুলো অফিস ব্লক। হেক্টর কাজ করেন অন্যদিকে একটা ব্লকে। তাই কর্মক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে ডেনিসের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

কিন্তু ডেনিসের বাংলো থেকে হেক্টরের বাংলো খুব একটা দূর নয়। আজ বিকেলে কি একবার ডেনিস যাবেন? হাজার হোক, একমাস আগে যে ভয়াল ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন দুজনে মিলে হয়েছিলেন, সেই সুবাদেও কি একবার কুশল বিনিময় করা উচিত নয়?

বিকেলে ডিউটির পর ডেনিস নিজের ঘোড়ায় রওনা দিলেন হেক্টরের বাংলোর দিকে। সেনাবাহিনীতে হেক্টরের পদমর্যাদা ডেনিসের চেয়ে বেশ খানিকটা ওপরে। বিশপ লেনন রোডে এই তল্লাটে যে ক-টা বাংলো রয়েছে, প্রত্যেকটাই হেক্টরদের মতো সিনিয়র আর্মি অফিসারদের বাসস্থান।

এই বাংলোগুলো আকারে ও আয়তনে ডেনিসের বাংলোর প্রায় দ্বিগুণ। সামনে পেছনে অনেক প্রশস্ত উদ্যান। খানসামা ও বাবুর্চির সংখ্যাও বেশি। সব ঠিকমতো চললে বছরদশেকের মধ্যে ডেনিস এই বাংলোগুলোয় থাকতে পারবেন। ততদিনে দেশে গিয়ে বিয়েটা সেরে আসতে হবে। তারপর সংসারধর্ম।

আনমনে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে ডেনিস হেক্টরের বাংলোর সামনে এসে একটু থমকে গেলেন। বাংলোর গেটের ওপাশের যে সুন্দর বাগান আগের মাসে ডেনিস দেখে গিয়েছিলেন, সেখানে যেন তুমুল অপরিচ্ছন্নতার অভাব। যে কেয়ারি করা ফুলগাছগুলো আগেরবার ডেনিসকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সেগুলো শুকিয়ে নুয়ে পড়েছে। বাগানের ঘাসগুলোও বেড়েছে অগোছালোভাবে।

গেট খুলে ভেতরের লন দিয়ে হেঁটে গিয়ে ডেনিস ডাকলেন, ‘হেক্টর! হেক্টর!’

কোনো সাড়া নেই।

হেক্টরের যে একগাদা চাকরবাকর ছিল, তারাই বা গেল কোথায়?

ডেনিস একটু ইতস্তত করলেন, তারপর এগিয়ে এলেন ভেতরের দিকে। বাংলোর ওপরের চিমনি থেকে শুরু করে বাইরের বাগানের স্থাপত্য, সবেতেই যেন মালিন্যের ছাপ!

অথচ বদমেজাজের সঙ্গে হেক্টরের পরিচ্ছন্নতার বাতিকও সুবিদিত।

ডেনিস আবারও চড়াগলায় ডাকলেন, ‘হেক্টর! ডেনিস হিয়ার!’

প্রায় মিনিটদুয়েক পর মূল দরজায় একটা খরখর করে শব্দ হল। দরজার পাল্লা খুলে যে উঁকি মারল, তাকে দেখে চমকে গেলেন ডেনিস।

মোটা পশমের স্লিপিং গাউনের ভিতর যে খয়াটে শরীরের কাঠামোটা উঁকি মারছে, সেটা কি হেক্টরের?

কিন্তু হেক্টরের অমন পেটাই চেহারাটা এমন ভয়ংকর হয়ে গেল কী করে? এই কয়েকদিনেই যেন অসম্ভব রোগা হয়ে গিয়েছেন হেক্টর। মুখের চোয়ালদুটো থেকে যেন কে মাংস কেটে বের করে নিয়েছে, সেখানে বিশ্রীভাবে উঁচু হয়ে রয়েছে হাড়। চোখ কোটরাগত, তার মধ্যে মণিদুটো কেমন অস্থিরভাবে চলাফেরা করছে।

‘ওহ, ডেনিস! কাম! কাম ইন!’

ডেনিস ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতে একরকম যেন তাঁকে জোর করে ঠেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন হেক্টর। বললেন, ‘ভেতরে চলো।’

বাংলোর ভেতরে ঢোকামাত্র কেমন এক বোঁটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ডেনিসের। গোটা বাংলোটা প্রায় অন্ধকার। একটা গ্যাসবাতিও জ্বালানো নেই। দূরের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে আসছে জানলা দিয়ে। সেই নরম জ্যোৎস্নায় চারপাশ কেমন অতিপ্রাকৃত দেখাচ্ছে।

হেক্টরের প্রকাণ্ড ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলেন ডেনিস। এখানেও সেই বিকট পচা গন্ধ। ঘরটাও অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। এদিক ওদিক তাকাতেই এই প্রায়ান্ধকারেও গন্ধের উৎস দেখতে পেলেন ডেনিস। মাংসের হাড়, পচে যাওয়া খাবার স্তূপাকৃতি করে ফেলে রাখা আছে এখানে ওখানে। সেগুলো দেখেই তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে।

ডেনিসের গা পাক দিলেও তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার? আপনার এরকম চেহারা কীভাবে হল? শরীর টরির খারাপ, নাকি? চাকরবাকররাই বা কোথায়? সার্ভেন্টস কোয়ার্টার দেখলাম অন্ধকার!’

হেক্টর ফিসফিস করে বললেন, ‘সব ব্যাটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘কেন?’

হেক্টর হঠাৎ চুপ করে গেলেন। পাশের যে প্রকাণ্ড জানলার কাচ ভেদ করে চাঁদের আলো এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনকে, সেদিকে কান খাড়া করে বললেন, ‘ওই যে! ওই যে! আবার এসেছে! শুনতে পাচ্ছ?’

ডেনিস কৌতূহলী চোখে তাকালেন। জানলার বাইরে থেকে শুরু হয়ে গেছে জঙ্গল। খুব ঘন না হলেও উঁচু পাইন, হেমলক, দেবদারু গাছে ভরে আছে জায়গাটা। হেক্টরের বাংলোটাই এদিকের শেষ বসতবাড়ি। গাছগুলোর পাতা যে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে, তা নরম জ্যোৎস্নায় বোঝা যাচ্ছে।

কিন্তু ডেনিস কোনো আওয়াজই শুনতে পাচ্ছিলেন না। রাতের হিমালয় বড় শান্ত, বড় নিস্তব্ধ!

‘কীসের আওয়াজ? আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছিনা?’

হেক্টর অস্থিরভাবে বললেন, ‘আরে! ভালো করে শোনো। একটা বিটকেল হাসি! দ্যাখো, একটানা হেসেই চলেছে!’

‘হাসি? কার হাসি? ওই জঙ্গলে রাতের বেলা কে হাসবে হেক্টর?’

‘মানুষ নয়। হায়েনা।’ হেক্টরের মুখে কালো ছায়া পড়ল। ঈষৎ কাঁপা স্বরে বললেন, ‘আফ্রিকায় শুনেছিলাম হায়েনার হাসি। শুকনো পাউরুটির মতো চিমসে হয়ে যাওয়া বুড়ো বিকট জোরে হাসলে যেমন শুনতে লাগে, হায়েনার হাসিও তেমন। তীক্ষ্ন আর একটানা। শুনতে পাচ্ছ না?’

হায়েনার হাসি? ডেনিস থমকে গেলেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ছোট থেকে শুনে আসছেন, হায়েনার হাসি সাংঘাতিক, শুনলে শরীরের রক্ত জল হয়ে যায়। কিন্তু সেটা কি সত্যি? নাকি গল্পকথা?

আর যদি সত্যি হয়ে থাকে, তেমন কোনো শব্দ তো কোত্থাও নেই!

ডেনিসকে চুপ করে থাকতে দেখে হেক্টর চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী হল! তুমিও আমার সারভেন্টদের মতো কিছুই শুনতে পাচ্ছ না? নাকি শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করে আমার সঙ্গে চালাকি করছ! এমন আকাশ ফাটানো হাসি তোমার কানে যাচ্ছে না?’

ডেনিস বিব্রতমুখে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন হেক্টর, আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। আর আপনার বাংলোর পাশে হায়েনা আসবেই বা কোত্থেকে! এদিকে তো হায়েনা আছে বলে শুনিনি।’

হেক্টরের মুখটা হঠাৎ পার্চমেন্ট কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। বললেন, ‘শোননি। কিন্তু দেখেছ। মনে নেই, সেই … সেই লোকটার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা সেই প্রকাণ্ড … ওফ! কী রক্তজল করা চাউনি তার!’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তাকে তো আপনি নিজের হাতে গুলি করেছিলেন হেক্টর!’

‘না!’ হেক্টর এবার প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘গুলি করলেও সে মরেনি ডেনিস! দিবারাত্র সে আমার বাংলোর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তার হাসিতে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনা! তুমি … তুমি জানো, যখন তখন ওই যমদূতের মতো শয়তানটা আমার বাগানে ঢুকে পড়ে! তছনছ করে সব কিছু! রাত দুটো-তিনটের সময় ছাদের ওপর দাপাদাপি করে! ওফ! আমি কতবার গুলি করেছি ডেনিস! কিচ্ছু হয়নি। জন্তুটা ঠিক ফসকে গেছে!’

ডেনিস অবাক চোখে হেক্টরের এই রূপ দেখছিলেন। উত্তেজনায় ভয়ে হেক্টরের মুখ লাল হয়ে গেছে। হাতের শিরা ওঠা শুকনো আঙুলগুলো কাঁপছে তিরতির করে।

এরই মধ্যে বাইরে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। সঙ্গে বৃষ্টি। বৃষ্টির তোড়ে উঁচু উঁচু গাছগুলোও বেঁকে যাচ্ছে।

কী আশ্চর্য! এতক্ষণ তো আকাশে তেমন মেঘ ছিল না!

ডেনিস বললেন, ‘কিন্তু না মরলেও হায়েনাটা বেরোবে কি করে হেক্টর? তাকে তো আমরা ওই লোকটার সঙ্গেই মাটির তলায় চাপা দিয়ে এসেছি। গুলিতে না মরলেও দম আটকে সে তো মরে গেছেই।’

‘না!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন হেক্টর, ‘বিশ্বাস করো ডেনিস, শয়তানটা মরেনি। ওই বিশাল আকারের হায়েনাটা প্রতিদিন আমার বাংলোর আশেপাশে ঘোরে। আমার প্রতিটা জানলায় নখ দিয়ে আঁচড়ায়, বিকট জোরে হাসে। আমি … আমাকে বাঁচাও ডেনিস!’

কে বলবে হেক্টর শহরের সবচেয়ে বদরাগী দুর্বিনীত মানুষ। মানুষটার প্রতিটা অভিব্যক্তি থেকে ঝরে পড়ছে অনুনয়, আকুতি, ভয়।

ডেনিস বললেন, ‘আপনি কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন, এটা সেই হায়েনাটাই?’

‘অত বড় এক মানুষ উচ্চতার হায়েনা এই তল্লাট কেন গোটা দুনিয়ায় আর দুটো আছে কিনা সন্দেহ!’ হেক্টর কাতর গলায় বললেন, ‘ইন্ডিয়ার এই সব হিন্দু যোগীরা অনেক রকম ম্যাজিক জানে, জানো! পাটিয়ালা রেজিমেন্টে থাকার সময় আমার এক সহকর্মী বলেছিল, সেখানে এক যোগী নাকি শূন্যে ভেসে থাকতে পারত। সেদিন জঙ্গলে ওই যে লোকটা … ওই হাফ নেকেড যোগীটাই কিছু করছে না তো ডেনিস?’

ডেনিস যখন নিজের বাংলোয় ফিরে এলেন, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। তাঁর কিছু ভালো লাগছিল না। ভারাক্রান্ত মনে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে বাইরের বারান্দায় বসলেন। আজ ঠান্ডাটা একটু কম। অথচ একটু আগেই হেক্টরের বাংলোয় থাকার সময় কেমন অপ্রত্যাশিতভাবে ঝমঝমিয়ে ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেল।

হেক্টর যা বলছেন, তা কি সত্যি? কিন্তু সত্যি হওয়া যে কিছুতেই সম্ভব নয়! আজও সেই জঙ্গলে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে সেই জায়গাটা, যার মধ্যে শুয়ে রয়েছে সেই লোকটা আর হায়েনাটা!

তবে?

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায়, এটা অন্য একটা হায়েনা, সে তবে হেক্টরের বাংলোর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কেন!

নাকি পুরোটাই হেক্টরের মতিভ্রম! নিজের হাতে তিনি মেরেছিলেন ওই নিরীহ লোকটাকে, শেষ করছিলেন ওই নির্দোষ জন্তুটাকে, সেই অপরাধবোধ তাঁর ব্যবহারে প্রকাশ না পেলেও অবচেতন মনের কোথাও ধাক্কা দিচ্ছে সজোরে, যা সৃষ্টি করছে এই হ্যালুসিনেশনের।

ডেনিস বেশিক্ষণ একমনে ভাবার সময় পেলেন না। বারান্দা থেকেই দেখতে পেলেন, তাঁর বাংলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একখানা ঘোড়ার গাড়ি।

কে এল? ঘড়িতে রাত দশটা। এত রাতে এই পাহাড়ি শহরে প্রচণ্ড দরকার না পড়লে কেউ বাইরে বেরোয়না।

ভাবতে ভাবতেই ডেনিসের ভৃত্য শিউচরণ রবার্ট আর স্যামুয়েলকে নিয়ে ঢুকল।

স্যামুয়েল বললেন, ‘ডেনিস! রবার্ট খুব বিপদে পড়েছে। আমি বললাম হেক্টরের বাড়ি তুমি আজ গিয়েছিলে। তাই ও তোমার সঙ্গে দেখা করতে এল।’

‘কী ব্যাপার?’ ডেনিস কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। রবার্টের সঙ্গে মুখচেনা থাকলেও তেমন আলাপচারিতা তাঁর নেই।

রবার্ট বললেন, ‘আপনি ওর বাংলো থেকে কখন বেরিয়েছিলেন?’

ডেনিস বললেন, ‘এই ধরুন সাতটা নাগাদ। কেন?’

রবার্ট বললেন, ‘আটটা নাগাদ হেক্টরের খানসামা রোশনলাল এসে আমায় খবর দিল, হেক্টর বাড়ির দরজা খুলছে না।’

‘দাঁড়ান দাঁড়ান।’ বাধা দিলেন ডেনিস, ‘হেক্টর তো বললেন ওর কোনো চাকরবাকর আর নেই। আমি নিজেও কাউকে দেখতে পাইনি। রোশনলাল এল কোত্থেকে?’

‘আপনাকে হেক্টর পুরো ব্যাপারটা খুলে বলেনি। সব চাকরবাকর চলে গেলেও রোশনলাল প্রভুভক্ত, সবচেয়ে পুরোনো। হেক্টরের অনেক গঞ্জনা সে বহুবছর ধরে সহ্য করেছে। এবারেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সে যায়নি। সে এই ক-দিন আমার এক চাকরের সঙ্গে আমার বাংলোর সারভেন্টস কোয়ার্টারে থাকত। যত যাই হয়ে যাক, রোজ রাতে সে একবার করে হেক্টরের বাংলোয় যেত। হেক্টর দরজা খুলে তাকে গালমন্দ করত, তবু সে প্রভুকে স্বশরীরে দেখে ফিরে আসত। কিন্তু আজ এসে বলল, অনেক ডাকাডাকিতেও হেক্টর দরজা খোলেনি।’

‘তারপর?’

রবার্ট শুকনো গলায় বললেন, ‘শুনে আমি আমার দুজন খানসামাকে নিয়ে সেখানে গেলাম। গিয়ে সেই একই ব্যাপার। দরজা খুলছে না। রোশনলাল বাংলোর চারদিকে ঘুরে ঘুরে জানলা দিয়ে ভিতরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠে আমাদের ডাকল। আমরা গিয়ে দেখি, বাংলোর বাঁ-দিকের একটা জানলার কাচ পুরো ভাঙা। যেন বড় কোনো জিনিস জোরে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে কাঁচটাকে।’

‘তারপর?’ ডেনিসের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ওই জানলাটার পাশেই যে কয়েকঘন্টা আগে তিনি আর হেক্টর বসে কথা বলছিলেন, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

‘কাচটা এমনভাবে ভেঙেছে যে, একটা মানুষ অনায়াসে সেখান দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে। আমরা কোনোমতে সেখান দিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি গোটা ঘরটা তছনছ করেছে কেউ, টেবিলল্যাম্প ভেঙে গড়াগড়ি যাচ্ছে। দেওয়ালের ছবি ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। আর ঘরের একেবারে মধ্যিখানে হেক্টর পড়ে আছে।’

ডেনিসের বুকের ভেতর যেন কেউ হাতুড়ি পিটছিল। কোনোমতে তিনি বলতে পারলেন, ‘হেক্টর ইজ নো মোর?’

ওই দেশীয় যোগীটা হায়েনাটার কে ছিল? হায়েনাটা কি ওর পোষা ছিল? তাই নিজের মৃত্যুর পরেও প্রভুহত্যার প্রতিশোধ নিয়ে গেল এইভাবে?

ডেনিসের মাথা ঘুরছিল। চেতনা লুপ্ত হয়ে পড়ে যেতে যাবেন, এমন সময় রবার্ট বললেন, ‘না। ওকে আমরা আমার বাংলোয় নিয়ে এসেছি। গায়ে ধুম জ্বর। চোখ চেরিফলের মতো লাল। অনেক ওষুধ দেওয়া হয়েছে। টেম্পারেচার কমছেনা। খালি বিড়বিড় করে কত কী যে বকছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকবার তোমার নাম শুনতে পেয়েছি আমরা। তাই স্যামুয়েলকে নিয়ে এলাম। যদি তুমি একবার চলো …।’

ডেনিস পৌঁছনোর পর হেক্টর বেঁচে ছিলেন মাত্র পাঁচমিনিট। যেন ডেনিসের জন্যই অপেক্ষা করছিল তাঁর ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণবায়ু।

ডেনিসকে দেখতে পেয়ে তিনি ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর খুব আস্তে, প্রায় শুনতে না পাওয়ার মতো করে বললেন, ‘দ্য হায়েনা কেম অ্যাট লাস্ট, ডেনিস!’

‘আ-আপনি শিওর?’ ডেনিসের গলা কাঁপছিল। কিছুটা আতঙ্কে, কিছুটা ভয়ে।

‘মোর দ্যান এনিথিং ডিয়ার!’ হেক্টর আলতো হেসে বললেন, ‘শি হ্যাজ টেকন দ্য রিভেঞ্জ! গুড বাই!’

‘কীসের গুড বাই?’ ডেনিস ছটফটিয়ে উঠলেন।

দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রবার্ট, স্যামুয়েল এবং কয়েকজন ভৃত্য। তাদের দিকে একঝলক তাকিয়ে ডেনিস আবার চোখ ফেরালেন এদিকে। হেক্টর এখন স্পষ্ট তাকিয়ে রয়েছেন। মনে হচ্ছে জ্বরটাও এখন সেরে গিয়েছে। কাঁপুনিটাও নেই।

‘আপনি বেঁচে যাবেন হেক্টর!’ ডেনিস হেক্টরের মাথায় হাত রাখলেন, ‘আমরা আবার হান্টিং এ যাব!’

‘না। তার আর সময় হবেনা বন্ধু।’ হেক্টর বললেন।

তারপরেই তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল।

সাধারণত সজ্ঞানে মৃত্যুর আগে চোখের পাতা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু উলটোপথে হেঁটে হেক্টরের চোখের পাতা গুলো আরো বেশি খুলে গেল। সে দুটো তাকিয়ে রইল ছাদের দিকে।

ঠিক সেই অর্ধনগ্ন যোগীর মতো!

এরপর ডেনিস কী করেছিলেন জানা যায়নি। জানা যায়নি সত্যিই সেই তল্লাটে আদৌ আর কোনো হায়েনা ছিল কিনা। তবে হিমালয়ের পায়ের কাছের সেই আর্মি ক্যান্টনমেন্টে গেলে আজও অতিবৃদ্ধরা বিড়বিড় করেন এই ঘটনা।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত আটটি বাক্যের অতি ক্ষুদ্র সেই সংবাদ থেকে নিজের কল্পনায় ভর করে অ্যালিস পেরিন লিখেছিলেন Caulfield’s Crime.

সেখানে যদিও জন্তুটি ছিল শিয়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *