হামা-ভূত
বাংলাদেশে কত ধরনের ভূত আছে জানেন?
আমি বললাম, জানি না।
মিসির আলি বললেন, আটত্রিশ ধরনের ভূত আছে—ব্রহ্মদৈত্য, পেতনি, শাকচুন্নি, কন্ধকাটা, মামদো, পান ভূত, কুয়া ভূত, কুনি ভূত, বুনি ভূত।
কুনি ভূতটা কী রকম?
মিসির আলি বললেন, ঘরের কোনায় থাকে বলে এদের বলে কুনি ভূত। আরেক ধরনের ভূত আছে এরা কোনো শরীর ধারণ করতে পারে না। শুধুই শব্দ করে। নিশি রাতে মানুষের নাম ধরে ডাকে। আরেক ধরনের ভূত আছে নাম ‘ভুলাইয়া’। এরা পথিককে পথ ভুলিয়া নিয়ে যায়। শেষ সময় বিলের পানিতে ডুবিয়ে মারে।
আমি বললাম, ভূত নিয়ে আপনার স্টকে কোনো গল্প আছে?
মিসির আলির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল গল্প আছে। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন।
হামা-ভূতের নাম শুনেছেন?
না তো।
হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে বলেই এই ভূতের নাম হামা-ভূত। আট-ন’ বছর বয়সী বালকের মতো শরীর। চিতা বাঘের মতো গাছে উঠতে পারে। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। শোঁ শোঁ শব্দ করে। আপনি কখনো হামা ভূত দেখেছেন?
আমি বললাম, সাধারণ কোনো ভূতই এখনো দেখি নি। হামা-ভূত দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি দেখেছেন?
মিসির আলি বললেন, শুধু যে দেখেছি তা না। হামা-ভূতকে পাউরুটি খাইয়েছি। ভূত পাউরুটি খায়?
অন্য ভূত খায় কি না জানি না, হামা–ভূত খায় এবং বেশ আগ্রহ করেই খায়। গল্প শুনতে চান?
অবশ্যই চাই।
হামা-ভূতের গল্প হল প্রস্তাবনা। তবলার টুকটাক। মূল গল্প অসাধারণ, আমার Unsolved ক্যাটাগরির। হামা-ভূত না দেখলে মূল গল্পের সন্ধান পেতাম না। যাই হোক শুরু করি—
পত্রিকায় পড়লাম নেত্রকোনার সান্ধিকোনা অঞ্চলে হামা-ভূতের উপদ্রব হয়েছে। যারা এই ভূত দেখেছে তারা সবাই অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে আছে। অঞ্চলের লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে কেউ বের হয় না। হামা-ভূতের বিশেষত্ব হচ্ছে— সে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে গাছে ওঠে। যেসব বাড়িতে নবজাতক শিশু আছে সেই সব বাড়ির চারপাশে বেশি ঘোরাঘুরি করে।
আমার তখন বয়স কম, আদিভৌতিক বিষয়ে খুব আগ্রহ। হামা-ভূত দেখার জন্য ঢাকা থেকে রওনা হলাম। বাংলাদেশের গ্রামে অজানা জন্তুর আক্রমণের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। ভূতের আক্রমণের খবর তেমনভাবে আসে না।
সান্ধিকোনা গ্রামে সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছলাম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্ভেজাল গ্রাম। একটা স্কুল আছে, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ানো হয়। স্কুলের দু’জন শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে একজন চলে গেছেন। যিনি টিকে আছেন তার নাম প্রকাশ ভট্টাচার্য।
আমি হামা–ভূত দেখতে এসেছি এই খবর রটে গেল। দলে দলে লোকজন আমাকে দেখতে এল। যেন আমি ফিল্মের কোনো বড় তারকা, পথ ভুলে এখানে চলে এসেছি।
প্রত্যন্ত গ্রামের প্রধান সমস্যা একই ধরনের প্রশ্নের জবাব বারবার দিতে হয়।
আপনার নাম?
দেশের বাড়ি? সার্ভিস করেন?
বেতন কত পান?
শাদি করেছেন?
নতুন যেই আসছে সে-ই এসব প্রশ্ন করছে। রাত কোথায় কাটাব এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা নিচু গলায় চলতে লাগল। সাধারণত গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাড়িতে বিদেশি মেহমান রাখা হয়। সম্ভবত এই গ্রামে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নাই। আক্কাস আলি নামের একজনের কথা কয়েকবার শোনা গেল। তবে তাঁর বাড়িতে আজ অসুবিধা। শ্বশুরবাড়ির অনেক মেহমান হঠাৎ করে চলে এসেছে। সুরুজ মিয়ার নাম উচ্চারিত হল। তাঁর বাড়িতেও সমস্যা। তাঁর ছোটমেয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে।
আমি বললাম, আমার রাতে থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সঙ্গে করে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছি। গাছতলায় থাকব।
গাছতলায় থাকবেন! কী কন? গ্রামের ইজ্জত আছে না। আপনি বিদেশি মেহমান।
আমি বললাম, ভাই ভূত দেখতে এসেছি। রাতে যদি কোনো বাড়িতে ঘুমিয়েই থাকি ভূতটা দেখব কীভাবে? সারা রাত আমি জেগেই থাকব, হাঁটাহাঁটি করব।
গ্রামের এক মুরুব্বি বললেন, সাথে কি তিন-চাইরজন জোয়ান পুলাপান দিব? অলঙ্গা নিয়া আপনার সাথে থাকব।
অলঙ্গা জিনিসটা কী?
বর্ণা। তালগাছ দিয়া বানায়।
আমি বললাম, একগাদা লোক সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে তো ভূত দেখা দিবে না। বর্শা দিয়ে ভূত গাঁথা যাবে না। আমাকে একাই ঘুরতে হবে। আর আমার রাতের খাবার নিয়েও চিন্তা করবেন না। আমি রাতের খাবার, পানি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
মুরুব্বি বললেন, এইটা কেমন কথা! চাইরটা ডাল-ভাত আমাদের সাথে খাবেন না?
আমি বললাম, আবার যদি কোনোদিন আসি তখন খাব।
আমার কাছে মনে হল মুরুব্বি এবং মুরুব্বির সঙ্গে অন্যরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
প্রশান্ত ভট্টাচার্য বললেন, কোনো কারণে ভয় পেলে আমার বাড়িতে উঠবেন। ঐ যে টিনের বাড়ি। আমি বলতে গেলে সারা রাত জাগনাই থাকি। রাতে ঘুম হয় না।
ভূতের ভয়ে ঘুম হয় না?
তা না। এমনিতেই ঘুম হয় না। ভগবানের নাম জপে রাত পার করি। অনেক আগে থেকেই করি।
গ্রামের লোকজন হামা-ভূতকে যথেষ্টই ভয় পেয়েছে বুঝা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়ল। গল্প-উপন্যাসে শ্মশানপুরীর উল্লেখ থাকে। সান্ধিকোনা শ্মশানপুরী হয়ে গেল। আমি একা একা ঘুরছি। চমৎকার লাগছে।
ভাদ্র মাস। এই সময়ে যতটা গরম হবার কথা ছিল তত গরম না। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। মেঘমুক্ত আকাশে শুক্লাপক্ষের চাঁদ উঠেছে। মোটামুটি পরিষ্কারভাবেই চারপাশ দেখা যাচ্ছে।
গ্রামের একটাই পুকুর। ভাঙা পাকা ঘাট। পুকুরের চারপাশ গাছপালায় ঢাকা। একদিকে কালীমন্দির আছে। এই অঞ্চলে গ্রামের পটভূমিতে সিনেমা বানালে পুকুরঘাট অবশ্যই ব্যবহার করা হত।
বিশাল অশ্বথ গাছ দেখলাম। অশ্বথ গাছের নিচে জমাট অন্ধকার। কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়ালাম। গ্রামদেশে ভাদ্র মাসে বেশ কিছু মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গর্তের ভেতর থেকে সাপ বের হয়ে আসে। ভাদ্র-আশ্বিন দু’মাস বেশিরভাগ প্রাণীর মেটিং সিজন। সাপেরও তাই। এই সময়ে সাপ মানুষকে আশপাশে দেখতে পছন্দ করে না।
আমার পায়ে রাবারের গাম বুট। সাপের ভয় এই কারণে পাচ্ছি না। জনমানবশূন্য গ্রাম দেখতে ভালো লাগছে।
অশ্বত্থ গাছের ডালে প্রচুর হরিয়াল বাসা বেঁধেছে। তাদের ডানার ঝটপট শব্দ শুনতে শুনতেই আমি হামা-ভূত দেখলাম। দেখতে মানুষের মতো। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে আসতে আসতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
উত্তেজিত স্নায়ু ঠাণ্ডা করাবার জন্য আমি সিগারেট ধরালাম। অদৃশ্য হামা ভূত আবার দৃশ্যমান হল এবং আমার দিকে মুখ করে বসল। কাঁধের ঝোলা থেকে এক পিস পাউরুটি বের করে দিলাম। সে পাউরুটিটা আগ্রহ করে খেল।
আমি রওনা হলাম প্রশান্ত বাবুর বাড়ির দিকে। হামা-ভূত আমার পেছনে পেছনে আসতে লাগল। শোঁ শোঁ শব্দ করেই সে আসছে।
.
প্রশান্ত বাবু জেগেই ছিলেন। দরজায় ধাক্কা দিতেই তিনি হারিকেন হাতে দরজা খুললেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ভূত দেখেছেন?
আমি বললাম, শুধু যে দেখেছি তা না। সঙ্গে করে নিয়েও এসেছি। ঐ যে দেখুন।
হে ভগবান। এটা তো একটা কুকুর।
আমি বললাম, এমন এক কুকুর যার অদৃশ্য হবার ক্ষমতা আছে। এ অদৃশ্য হতে পারে।
কী বলেন আপনি?
আমি ঝোলা থেকে পাউরুটি বের করে ছুড়ে দিলাম। কুকুর পাউরুটি নিতে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভয়ে আতঙ্কে প্রশান্ত বাবুর হাত থেকে হারিকেন পড়ে গেল। তিনি নিজেও পড়ে যেতেন, আমি তাকে ধরে বললাম, চলুন ঘরে বসি। ঘটনা ব্যাখ্যা করি।
ঘটনা সাধারণ। কুকুরটা ধবধবে সাদা রঙের। কেউ একজন তার গায়ে ভাতের মাড় বা গরম পানি ফেলেছে। তার একদিক ঝলসে লোম পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কুকুরের নাকটা কালো, নাকের কিছু উপর থেকে সাদা রঙ। তার মুখের দিকে তাকালে লম্বা ভাবটা বুঝা যায় না। খানিকটা মানুষের মতো মনে হয়। কুকুরের ল্যাজটাও একটা সমস্যা করেছে। তার ল্যাজ নেই। ল্যাজ কাটা কুকুর
দিনের বেলাতেও এই কুকুর নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়ায়, কেউ তাকে গুরুত্ব নিয়ে দেখে না। রাতের অল্প আলোয় সে হয়ে ওঠে রহস্যময়। সে যখন ঘুরে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ তার গায়ে সাদা অংশের জায়গায় কালো অংশ চলে আসে। ভীত দর্শকের কাছে কুকুর হয়ে যায় অদৃশ্য।
ম্যাজিশিয়ানরা কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে কালো বস্তু রেখে বস্তুটাকে অদৃশ্য করার খেলা দেখান। একে বল ব্ল্যাক আর্ট। আপনাদের এই কুকুর নিজের অজান্তেই ব্ল্যাক আর্টের খেলা দেখাচ্ছে।
প্রশান্ত বাবু মুগ্ধ গলায় বললেন, আপনার কথা শুনে মন জুড়ায়েছে। জটিল একটা বিষয়কে পানির মতো করে দিলেন। ভগবান আপনার মাথায় অনেক বুদ্ধি দিয়েছেন।
আমি বললাম, মাথাটাই কিন্তু আমাদের বড় সমস্যা। আপনাকে বুঝিয়ে বলি। মানুষের মস্তিষ্কের দু’টা প্রধান ভাগ। ডান ভাগ এবং বাম ভাগ। Right lobe, left lobe. আমরা যখন শরৎকালের সাদা মেঘ ভর্তি আকাশের দিকে তাকাই তখন মস্তিষ্কের বাম ভাগ আমাদের আকাশের মেঘটাই শুধু দেখায়। অন্য কিছু দেখায় না। কিন্তু মস্তিষ্কের ডান ভাগ সেই মেঘকে নানান ডিজাইন করে দেখায়। কেউ দেখে হাতি, কেউ পাখি, কেউ মন্দিরের চূড়া। কল্পনার ব্যাপারটা মস্তিষ্কের ডান ভাগের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের মাথায় যদি ডান মস্তিষ্ক না থাকত তা হলে আমরা কিন্তু হামা- ভূত দেখতাম না। মস্তিষ্কের ডান অংশ আমাদের হামা–ভূত দেখতে সাহায্য করেছে।
প্রশান্ত বাবু বললেন, আপনার রাতের খাওয়া নিশ্চয়ই হয় নাই?
আমি বললাম, এখন খেয়ে নেব। সঙ্গে খাবার আছে। শুকনা খাবার।
প্রশান্ত বাবু বললেন, আমি রান্না বসাচ্ছি। আপনি আমার এখানে খাবেন। খিচুড়ি করব। ঘি দিয়ে খাবেন। আমি রাতে খাই না। আপনার জন্যই রান্না করব। আপনি দয়া করে না বলবেন না। আমি ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা ভালো রাঁধুনি হয়।
প্রশান্ত বাবু উঠানে রান্না বসালেন। আমি তাঁর পাশে মোড়া পেতে বসলাম। ভদ্রলোক বেশ গোছানো। নিমিষেই চুলা ধরিয়ে ফেললেন। চাল-ডাল হাঁড়িতে চড়িয়ে দিলেন। আমি বললাম, আপনি একা থাকেন?
প্রশান্ত বাবু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
চিরকুমার?
না। বিবাহ করেছিলাম। স্ত্রী-পুত্র স্বর্গবাসী হয়েছে। আচ্ছা জনাব, আপনি তো অনেক কিছু জানেন–মৃত মানুষ কি ফিরে আসতে পারে?
আমি বললাম, প্রশ্নটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি না।
তিনি বললেন, ধরুন কেউ একজন মারা গেল, তার কবর হল বা দাহ হল। বৎসর খানিক পরে সে আবার উপস্থিত। এরকম কি হতে পারে?
আমি বললাম, গল্প-উপন্যাসে হতে পারে। বাস্তবে হয় না। কবর থেকে উঠে আসা মানুষদের বলে জম্বি। তারা মানুষ না। বোধশক্তিহীন মানুষ। তবে সবই গল্পগাথা। বাস্তবে কেউ কখনো জম্বি দেখে নি। সিনেমায় দেখেছে। জম্বিদের নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে। আমি একটা ছবি দেখেছিলাম সেখানে জম্বিরা পুরো একটা গ্রাম দখল করে নেয়। Return of the Dead.
প্রশান্ত বাবু বললেন, পরকাল থেকে মানুষ ফিরে আসার কোনো ঘটনা নাই?
আমি বললাম, ইংল্যান্ডের চার্চগুলো অঞ্চলের মানুষদের জন্ম-মৃত্যুর হিসেব রাখে। তাদের এক ক্যাথলিক চার্চে চারশ বছর আগে মৃত মানুষের এক বছর পরে সংসারে ফিরে আসার ঘটনা উল্লেখ আছে। বিষয়টা নিয়ে তখন বেশ হইচই হয়। তাকে পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেয়া হবে না বলে চার্চ ঘোষণা দেয়। ইংরেজ রাজপরিবারকে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়।
তাকে কি পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়েছিল?
না। সে তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যায় এই বিষয়ে কোনো তথ্য নাই। আপনার কাছে কি এই ধরনের কোনো গল্প আছে? পরকাল থেকে কেউ ফিরে এসেছে?
প্রশান্ত বাবু বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, না।
আমি বললাম, প্রশান্ত বাবু! মানুষ যখন সত্যি কথা বলে তখন চোখের দিকে তাকিয়ে বলে। মিথ্যা যখন বলে চোখ নামিয়ে নেয়। পরকাল থেকে মানুষ ফিরে আসার ব্যাপারটা নিয়ে আপনার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে আপনি এ ধরনের কোনো গল্প জানেন। আমাকে গল্পটা বলুন আমি চেষ্টা করব লৌকিক ব্যাখ্যা দিতে। অতীন্দ্রিয় ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে আমার ভালো লাগে।
আপনি খাওয়াদাওয়া করুন। তারপর বলি। তবে আপনার কাছে আমি ব্যাখ্যা চাই না। ব্যাখ্যা ভগবানের কাছে চাই। আর কারো কাছে না।
আমি খেতে বসলাম। অতি উপাদেয় খিচুড়ি। হালকা পাঁচফোড়নের বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘিয়ের গন্ধ। খিচুড়ি রান্নায় অস্কার পুরস্কার থাকলে প্রশান্ত বাবু দু’টা অস্কার পেতেন।
আমি বললাম, গল্প শুরু করুন।
প্রশান্ত বাবু অস্বস্তি এবং দ্বিধার সঙ্গে থেমে থেমে কথা বলা শুরু করলেন। ভাবটা এরকম যে তিনি একটা খুন করেছেন। এখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছেন।
.
আমার বড় ভাইয়ের নাম বিকাশ ভট্টাচার্য। তাঁর স্ত্রী এক মাসের শিশুপুত্র রেখে একদিনের জ্বরে স্বর্গবাসী হন। আমার বড় ভাই পরম আদরে এবং যত্নে শিশুপুত্র লালন করতে থাকেন। আমরা কথায় বলি নয়নের মণি। আমার ভাইয়ের কাছে সত্যিকার অর্থেই তার পুত্র ছিল নয়নের মণি। সন্তান চোখের আড়াল হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর হাঁপানির টান উঠে যেত।
ছেলের যখন নয় বৎসর বয়স তখন সে পানিতে ডুবে মারা যায়। ছেলেটার শখ ছিল বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পুকুর ঘাটে চলে যাওয়া। পানিতে ঢিল মেরে খেলা করা। দুপুরবেলা ভাই যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন সে পুকুরঘাটে খেলতে গিয়ে পা পিছলে মারা যায়।
সোমবার সন্ধ্যায় তাকে সাজনাতলা শ্মশানঘাটে দাহ করা হয়। আমার বড় ভাই উন্মাদের মতো হয়ে যান। চিৎকার করতে থাকেন–মানি না, মানি না। আমি ভগবান মানি না। ভগবানের মুখে আমি থুতু দেই। মানি না। আমি ভগবান মানি না।
তখন বৈশাখ মাস। ঝড়বৃষ্টির সময়। তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। দাহ হয়ে গেছে। লোকজন চলে গেছে। আমার বড় ভাইকে ঘরে আনার অনেক চেষ্টা করা হল। তিনি এলেন না। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বসে রইলেন এবং কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করতে লাগলেন, মানি না, মানি না—আমি ভগবান মানি না।
রাত তিনটায় তিনি শূন্য বাড়িতে ফিরলেন। শোবার ঘরে ঢুকে দেখেন — ঘরে হারিকেন জ্বলছে। খাটের উপর তার ছেলে বসে আছে। পা দুলাচ্ছে। আমার ভাই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরল। তখনো ছেলে খাটে বসা। ভাই বললেন, বাবা তুমি কে?
সে বলল, আমি কমল। আমি এসেছি।
কোত্থেকে এসেছ বাবা?
পানির ভিতর থেকে।
তুমি কি চলে যাবে?
না।
আমার ভাই বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু তিনি একটি ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। চারদিকে প্রচার করলেন—পুত্রশোক ভুলার জন্য তিনি একটি কন্যা দত্তক নিয়েছেন। তিনি কমলকে মেয়েদের পোশাক পরালেন। তার নাম দিলেন কমলা।
গ্রামের লোক সহজেই বিশ্বাস করল। দু’একজন শুধু বলল, পালক মেয়েটার সঙ্গে মৃত ছেলেটার চেহারার মিল আছে।
আমি বললাম, ছেলেটা কি এখনো আছে?
হুঁ আছে।
কোথায়?
ভাইজান তাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। গৌহাটিতে থাকেন।
ছেলেটার কি মানুষের মতো বুদ্ধি আছে?
প্রশান্ত বাবু বললেন, না। দশ বছর আগে সে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। সে কোনো খাদ্য খায় না। দিনে-রাতে কখনো ঘুমায় না। রাতে পুকুরঘাটে বসে থাকতে খুব পছন্দ করে। হামা-ভূতের ভয়ে অনেক দিন পুকুরঘাটে যাওয়া হয় না।
আমি বললাম, আপনার বড় ভাইয়ের ছেলে তার বাবার সঙ্গে গৌহাটিতে থাকে। সেখানে হামা–ভূত গেল কীভাবে?
প্রশান্ত বাবু চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, বারান্দায় দু’টা মেয়েদের জামা শুকোতে দেয়া আছে। আপনি একা থাকেন। মেয়েদের জামা কেন? ছেলেটা কি আপনার?
প্রশান্ত বাবু বিড়বিড় করে বললেন, জে আজ্ঞে, আমারই সন্তান।
কত বছর আগের ঘটনা। অর্থাৎ কত বছর আগে ছেলে ফিরে এসেছে?
একুশ বছর।
ছেলে আগের মতোই আছে। বয়স বাড়ে নি?
প্রশান্ত বাবু জবাব দিলেন না।
আমি বললাম, ছেলেটাকে ডাকুন। কথা বলি।
না। আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে সে ভয় পায়।
আমি বললাম, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। তার জন্যও জরুরি। আপনার জন্যও জরুরি।
প্রশান্ত বাবু বললেন, না। আপনার সঙ্গে গল্পটা করে আমি বিরাট ভুল করেছি। ভুল আর বাড়াব না।
আমি প্রশান্ত বাবুকে অগ্রাহ্য করে উঁচু গলায় ডাকলাম, কমল! কমল।
নয়-দশ বছর বয়সী মেয়েদের পোশাক পরা এক বালক দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল। আমাকে এক পলক দেখে বাবার দিকে আসতে শুরু করল। প্রশান্ত বাবু কঠিন গলায় বললেন, ঘরে যাও। ঘরে যাও বললাম।
ছেলেটি ঘরের দিকে যাচ্ছে। এক পা টেনে টেনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, তার পায়ে কী সমস্যা?
প্রশান্ত বাবু কঠিন গলায় বললেন, তার পায়ে কী সমস্যা সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নাই।
.
হামা ভূত রহস্য ভেদ করার জন্য আমি গ্রামে এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিংয়ের মর্যাদা পেলাম। আমাকে রেলস্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য দু’জন রওনা হল। একজন মাথায় ছাতা ধরে রইল।
তাদের কাছে শুনলাম ছেলেটা পানিতে ডুবে মারা যাবার পর প্রশান্ত বাবুর খানিকটা মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে। তিনি তার ছেলের চেহারার সঙ্গে মিল আছে এরকম একটা মেয়ে কোথেকে ধরে নিয়ে এসে পালক নিয়েছেন। দিন-রাত মেয়েটার সঙ্গে থাকেন, কারো সঙ্গে মেশেন না। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু মেয়েটা গিট্টু লেগে আছে, বড় হচ্ছে না। তা ছাড়া ঠ্যাং খোঁড়া, সম্বন্ধও আসে না।
প্রশান্ত বাবু লোক কেমন?
নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। ভালো লোক। সমস্যা একটাই। মেয়ে ছাড়া কাউকে চিনে না।
.
যুগান্তর ১৩ মে, ২০০৯-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্ট
জলপরীদের দেশ থেকে দশ বছর পর ফিরে এলো মাসুদ
এমরান ফারুক মাসুম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে
পানিতে ডুবে যাওয়ার ১০ বছর পর অলৌকিকভাবে জলজ্যান্ত মায়ের কোলে ফিরে এসেছে মাসুদ (১৪) নামের এক শিশু। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনাটি ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের কাচারিবাড়িতে। এলাকাজুড়ে জোর গুজব, মাসুদ এতদিন ছিল জলপরীদের দেশে। সেখানে সে জীবনযাপন করেছে অলৌকিকভাবে। জলপরীরাই তাকে লালনপালন করেছে এতদিন। ছেলেটিকে নিয়ে নানাজনের মুখে নানা কথা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র এলাকায়। জানা গেছে, সদর উপজেলার রামজীবনপুর গ্রামের কাচারিবাড়ির মৃত মাহতাবউদ্দিনের ছেলে মাসুদ (৫) ১৯৯৯ সালে তার ভাই-বোনদের সঙ্গে মহানন্দার রামজীবনপুর ঘাটে গোসল করতে গিয়ে ডুবে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মাসুদের কোনো সন্ধান না পেয়ে মা শেফালী বেগম বুকে পাথর বেঁধে দিন কাটান। অবশেষে ১০ বছর পর গত ৮ মে শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অলৌকিকভাবে মহানন্দা নদীর কল্যাণপুর ঘাটের কাছে মাঝনদীতে সে ভেসে ওঠে।
কল্যাণপুর মহল্লার ইলিয়াস আহমেদের স্ত্রী রানী বেগম জানান, তিনি গত ৮ মে শুক্রবার দুপুরে নদীর ঘাটে গোসল করতে যান। গোসল করার সময় মাঝনদীতে ছেলেটিকে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে দেখতে পেয়ে সেখানে কয়েকজনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন। নদী থেকে তোলার সময় একটি ৫ বছরের শিশুর মতোই সে আচরণ করছিল।
শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে আসার পর রানী বেগম স্থানীয় লোকজনকে ঘটনাটি জানান। শিশুটি কোনো কথা বলতে না পারার বিষয়টি বিভিন্নভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে শিশুটিকে দেখতে আসেন রামজীবনপুর গ্রামের কাচারিবাড়ির শেফালী বেগম। শেফালী বেগম সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই উদ্ধারকৃত শিশুটি শেফালীকে জড়িয়ে ধরে। এ সময় শেফালী বেগম তাকে তার ছেলে বলে শনাক্ত করেন। ছেলেটির কোমরে একটি পোড়া দাগ দেখেই তাকে শেফালী বেগমের ছেলে বলে স্থানীয় লোকজন শনাক্ত করেন।
উদ্ধারের পর থেকেই মাসুদ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত রানী বেগমের হেফাজতেই ছিল। অবশেষে মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় তাকে নিয়ে আসা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক আতাউর রহমানের উদ্যোগে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহসানুল হক ছেলেটিকে বালিয়াডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের উপস্থিতিতে তার মা শেফালী বেগমের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মাসুদকে একনজর দেখার জন্য হাজার হাজার লোক ভিড় জমায়।
১৯৯৯ সালে শিশু মাসুদ মহানন্দা নদীতে ডুবে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৫ বছর। শুক্রবার মাসুদকে উদ্ধার করার পর থেকে তার শারীরিক গঠনও অলৌকিভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই ৫ দিনেই সে এখন বেড়ে ১৪ বছরের এক বালক। বালক মাসুদের আচার-আচরণ অস্বাভাবিক। সে কোনো কথা বলতে পারছে না। কোনো খাবারও খেতে পারছে না। মাঝে মাঝে তার গলা থেকে পানির জীবজন্তুর মতো অস্ফুট শব্দ বের হচ্ছে।