হাবুল দারোগার গল্প – অত্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
জামালউদ্দীনকে চেনো? মাস্টার টেলার্স! হাবুল দারোগা প্রশ্ন করলেন।
বললাম, চিনি বৈকি। বছর দুই আগে ওদের দোকান থেকে গরম কোট তৈরি করিয়েছি। হাবুল দারোগা বললেন, লোকে চোর ধরে, জামালউদ্দিন একবার পুলিশ ধরেছিল। অবশ্য ঠিক জামাল নয়, তার দোকানের বুড়ো কারিগর মীর্জা।
কি রকম? —বলে আমি পেন আর প্যাড নিয়ে বসলুম।
দাঁড়াও হে, আগে বলতে দাও, তারপর লিখো। এডিটরদের এই এক দোষ, রান্নার আগেই পাত পেড়ে বসে থাকে। এমন গল্প-পেটুক জাত আর নেই।
হেসে বললাম, কি করব বলুন, আপনারা হচ্ছেন পাকা হালুইকর। আপনাদের ভিয়েনে নিত্যি এমন মুখরোচক গল্প-মেঠাই পাক হচ্ছে যে লোভ সামলাননাই দায়!
হাবুল দারোগাও হাসলেন। বললেন, গল্প-মেঠাই খাবে তো পাক কড়া হতে দাও, রসে জাল দিতে দাও।
পেন আর প্যাড় সরিয়ে রেখে বললাম, বেশ, আগে বলুন।
হাবুল দারোগা শুরু করলেন। ঘটনাটা ছোট্ট, কিন্তু মজার।
পার্ক স্ট্রীট থেকে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে ঢুকেই দোকান—জামাল ব্রাদার্স। কলকাতার সবচেয়ে পুরোন টেলার্সদের একটি। কাটার হিসেবে জামালের ঠাকুর্দা নিজামের সুনাম ছিল। প্রথম বয়সে র্যাঙ্কিনে কাজ করত, পরে এই দোকানটি খোলে। জামালের বাবা কামালউদ্দিন মিলিটারী আর পুলিশের কন্ট্রাক্ট ধরে ব্যবসাকে ফাঁপিয়ে তোলে, দোকানের হাল ফিরিয়ে দেয়! বাপের পর জামাল যখন ব্যবসার মালিক হয়ে বসল, দোকান তখন রমরম করে চলছে। এখন তার বয়েস হয়েছে, কিন্তু ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন তার জোয়ান বয়েস।
তখন দোকান বন্ধ হত ন’টায়। ক্যাশ মিলিয়ে জামালের বাড়ি যেতে দশটা বেজে যেত। দোকানের দরজার একটা পাল্লা বন্ধ করে দেওয়া হত ন’টার পর। সেদিন সন্ধ্যে থেকেই আবহাওয়াটা ঘোলাটে। আশ্বিনের মাঝামাঝি হলেও বর্ষা ছাড়েনি। ঝিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে, আর ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে। তাড়াতাড়ি ক্যাশ মিলিয়ে জামাল পালাবে ভাবছিল। বাড়িতে নয়, রেনবো কাফের আড্ডায়। জামাল আজকালকার ছেলে, সৌখিন মেজাজের মানুষ। বাপ-দাদার মত ফিতে-কাঁচি নিয়ে জীবন কাটায় না, জীবনের স্বাদ নিতে জানে।
ক্যাশ মিলিয়ে লকারে চাবি দিতে দিতে জামালের মনে পড়ল রেনবো কাফের আড্ডায় এতক্ষণ হাসান, সুবীর, মণি, মোহন সিং জমায়েত হয়েছে, আর তাদের সঙ্গে অপেক্ষা করছে সুপর্না—বাংলা ফিল্মের উঠতি নায়িকা। আজকের আবহাওয়াটা সত্যিই ‘হুইস্কি ওয়েদার।’
চঞ্চল হয়ে উঠল জামাল। কারিগররা একে একে চলে গেছে, শুধু বুড়ো মীর্জা চোখে চশমা লাগিয়ে বসে বসে তখনও একটা প্রিন্সকোটে বোতাম টাঁকছিল। বিরক্ত হয়ে জামাল তাড়া দিলে, তোমার হল মীর্জা?
দ্রুত হাত চালিয়ে মীজা বললে, এই যে—হল বলে। আপনে দরোজা বন্ধ করতে বলেন ছোট মালিক।
দোকানের পেছন দিকে আর একটা ছোট দরজা আছে, যেটা দিয়ে একটু ঘুরে ফ্রী স্কুল স্ট্রিটে এসে পড়া যায়, অতএব জামাল হাঁকলে, আবদুল, দরওয়াজা বন্দ করো, আওর টিক্সি বোলাও!
আবদুল ছুটে গেল দরজার আর একটা পাল্লা বন্ধ করতে, কিন্তু বন্ধ করা হল না। তার আগেই ঘ্যাঁস করে একখানা পুলিশের জীপ এসে থামল দোকানের ঠিক সামনেই। একজন উচ্চপদস্থ অফিসার তড়াক করে নেমে সোজা দোকানের ভেতর ঢুকে গেল।
আবদুল হতভম্ব, কিন্তু পুলিশ দেখে জামাল হকচকিয়ে গেল না, বরং মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললে, দুঃ শা—! আসবার আর সময় পেল না!
অফিসারটিকে অনায়াসেই সুপুরুষ বলা চলে। রঙটা খুব উজ্জ্বল না হলেও অত্যন্ত সুগঠিত লম্বা চেহারা। চোখা মুখে সরু গোঁফ, চোখে রিমলেশ চশমা, স্টার-লাগানো তার সাদা পোশাক একই সঙ্গে ভয় আর সম্রম জাগায়।
মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে অত্যন্ত অমায়িক হাসি এনে জামাল বললে, ইয়েস!
ধীর গম্ভীর আওয়াজে অফিসার বললে, আপনি মিস্টার জামালউদ্দিন তো? আমি হেড কোয়ার্টার্স থেকে আসছি।
একটু অবাক হল জামাল। লালবাজার থেকে! পোশাকের নতুন অর্ডার আছে নাকি?
তেমনি ধীর গম্ভীর আওয়াজ হল, আমি দুঃখিত, আপনাদের বিরুদ্ধে একটা চার্জ আছে।
এবার কিন্তু রীতিমত হকচকিয়ে গেল জামাল। কয়েক সেকেণ্ড হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, চার্জ? কিসের?
নীরস গলায় এবং বিরস মুখে অফিসার বললে, বেশ কিছুদিন ধরে প্রচুর বিদেশী গরম কাপড় আপনি স্মাগল করে আনিয়েছেন।
জামালউদ্দিনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল : মিথ্যে কথা, বিলকুল মিথ্যে কথা! আমি স্মাগল করে আনতে যাব কেন? আমার পারমিট রয়েছে।
আর পারমিটের চেয়েও বেশি কাপড় আপনার স্টকে আছে, তাই না?
রিমলেশ চশমার পেছনে অফিসারের একটা চোখ ছোট দেখাল।
জামাল চড়া গলায় বললে, কী যা-তা বলছেন, আমার ‘কোটা’ দেখিয়ে দিচ্ছি, আপনি স্টক মিলিয়ে দেখুন।
অফিসারের ডান দিকের সরু গোঁফ একটু ওপরে উঠে গেল—সেটা বোধ করি পুলিশী হাসি। অফিসার বললে, আপনার আসল স্টক যে পার্ক স্ট্রীটে নয়, স্টার রোডে—আমরা জেনে ফেলেছি মিস্টার জামালউদ্দিন। সুতরাং এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ কি!
রাগে অপমানে আর বিস্ময়ে জামালউদ্দিন কয়েক সেকেণ্ড হতবাক হয়ে গেল। এমন কি, মীর্জা বুড়োও চশমার ফাঁকে চোখ পিটপিট করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অফিসারের দিকে। তারপর হঠাৎ জামাল বলে উঠল, এ আজব খবরটি পেলেন কোত্থেকে?
পকেট থেকে একখানা পোস্টকার্ড সাইজ ফটোগ্রাফ বার করলেন অফিসার। জামালের সামনে সেখানা ধরে বললে, মোহন সিং পাঞ্জাবীকে আপনি চেনেন? দেখুন তো ভাল করে?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল জামাল। রেনবো কাফেতে মোহন সিংয়ের পাশে সে বসে আছে! সামনে দুটো হুইস্কির গ্লাস।
রসকসহীন গলায় অফিসার বলে যেতে লাগল, ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং ব্যাপারে পুলিশ মোহন সিং পাঞ্জাবীকে খুঁজছে, কাল শেষ রাতে সে ধরা পড়েছে। আর স্বীকারও করেছে যে, প্রচুর বিদেশী গরম কাপড় আপনার স্টার রোডের গোডাউনে তুলে দিয়েছে। সো ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট, মিস্টার জামালউদ্দিন!
জামালের টকটকে লাল মুখে সমস্ত রক্ত ভয়ের ব্লটিং পেপার যেন শুষে নিতে লাগল! নার্ভাস গলায় সে বললে, বিশ্বাস করুন অফিসার—খোদার দোহাই—মোহন সিং যে একজন স্মাগলার আমি তা জানতুম না! তার সঙ্গে একটু-আধটু হুইস্কি খাওয়া ছাড়া আর কোন সম্পর্ক আমার নেই! এই দোকান ছাড়া আর কোথাও আমার স্টক নেই।
অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় অফিসার বললে, বেশ তো, আপনার ডিফেন্স কাউন্সেলকে এই কথা বলতে বলবেন।
আঁতকে উঠল জামাল। বললে, ডিফেন্স কাউন্সেল! মানে আদালত—মামলা—আমি স্মাগলিং কেসের আসামী! প্লিজ অফিসার, আমাকে বাঁচান!
তেমনি ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এল, আপনি ছাড়াও তো পেয়ে যেতে পারেন।
নিতান্ত অসহায় মুখে জামাল বললে, কিন্তু তার আগে জামাল ব্রাদার্সের সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে—তিন পুরুষের এই দোকান উঠে যাবে।
কান্ট হেল্প মিস্টার! আমাকে আমার ডিউটি করতেই হবে।—সংক্ষেপে জবাব দিল অফিসার।
বোবা হয়ে গেল জামালউদ্দিন। আর চশমার ফাঁকে চোখ রেখে পিট পিট করে তাকিয়ে রইল বুড়ো মীর্জা।
কি জানি কেন হঠাৎ সুর পাল্টে গেল অফিসারের। একটা চোখ ছোট করে বলতে লাগল, আমি দুঃখিত জামাল সাহেব, আপনি শহরের একজন সম্ভ্রান্ত দোকানদার। একটা নোংরা মামলায় জড়িয়ে পড়ে আপনার সুনাম নষ্ট হবে, এটা দুঃখের বিষয় বৈকি। কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানেন যে আইন যেমন আছে তেমনি আইনের ফাঁকও আছে।
জামাল তাকাল অফিসারের দিকে। রিমলেশ চশমার ভেতর দিয়ে ছোট চোখে কি যেন ইঙ্গিত! সাহস করে বললে, আইনের ফাঁক আছে?
আছে বৈকি। ফাঁক বলুন, বা ফাঁকিই বলুন। সবই এর খেলা।
দু-আঙুলে অফিসার একটা অদৃশ্য টাকা বাজালে।
সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়তে পড়তে জামাল যেন একটা কার্নিশ ধরে ফেললে। সাগ্রহে বললে, আমি রাজী অফিসার। বলুন কত লাগবে?
কিছু না বলে অফিসার একবার মীর্জার দিকে তাকালে।
জামাল বুঝল। বললে, আসুন। বলে অফিসারকে নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকে গেল।
বুড়ো মীর্জা চোখ পিটপিট করে তাদের দেখল, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল টেলিফোনের কাছে।
নগদ সাড়ে চার হাজার টাকা পকেটে পুরে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের অফিসার যখন ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে এল, তখন রিমলেশ চশমার ফাঁকে দুটো চোখই হাসি হাসি দেখাচ্ছে। জামালের দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। কিন্তু চৌকাঠ পার হবার আগেই আরেকখানা পুলিশ-জীপ সাঁ করে এসে থামল দোকানের সামনে। সঙ্গে সার্জেন্ট আর কনস্টেবল নিয়ে যে অফিসারটি ঢুকে এল, সেও হেড কোয়ার্টার্সের। তাকে দেখে ভয়ে আর আতঙ্কে রিমলেশ চশমার ফাঁকে চোখ দুটো গোল গোল হয়ে উঠল।
দ্বিতীয় অফিসারটি সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলে, আপনার আইডেনটিটি কার্ড?
রিমলেশ চশমা আমতা আমতা করে কি যে বললে শোনা গেল না।
দ্বিতীয় অফিসার এবার কড়া গলায় বললে, কদ্দিন থেকে জাল পুলিশ সাজা হচ্ছে? জীপে সি পি লিখতেও ভুল হয়নি দেখছি! বাঃ! বাঃ!
জাল অফিসারের গলা দিয়ে একটা ঘরঘর আওয়াজ বেরোল শুধু।
দ্বিতীয় অফিসার জামালকে বললে, এই নিয়ে পাঁচটা কেস হল, আর এটাই শেষ। আসামীর সঙ্গে আপনাকেও একবার হেড কোয়ার্টার্সে আসতে হবে জামাল সাহেব।
অফিসারের ইঙ্গিতে সার্জেন্ট আসামীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলে। তারপর একই সঙ্গে দুটো জীপ চলে যাওয়ার শব্দ মিলিয়ে গেল।
প্রিন্স-কোর্টের শেষ বোতামটা টাঁকতে টাঁকতে বুড়ো মীর্জা ফিক করে হাসলে একবার।
জিজ্ঞেস করলুম, লোকটা যে জাল পুলিশ, মীর্জা কি করে সন্দেহ করল?
হাবুল দারোগা বললেন, তার পোশাক দেখে।
পোশাক তো নিখুঁত ছিল!
কিন্তু শাদা রঙের কাপড়টা ছিল অন্য কোয়ালিটির। আগেই তো বলেছি, জামাল ব্রাদার্স পুলিশের অর্ডার সাপ্লাই করে। আর জামালের ঠাকুর্দার আমল থেকে পুলিশের পোশাক সেলাই করে আসছে ওই বুড়ো মীর্জা। সুতরাং খাঁটি পুলিশের পোশাক সে চিনবে না তো চিনবে কে?