হাবাগোবা
পৃথিবীতে কিছু লোক চিরকালের হাবাগোবা; কিছু লোক একেবারে তুখোড় করিতকর্মা। হাবাগোবাদের জীবনে কিছুই হয় না। তারা রগড়ে রগড়ে পাশটাশ করে। কোনও রকমে সরকারি দপ্তরে অথবা পোস্টাপিসে একটা কেরানিগিরি জুটিয়ে নেয়। শান্ত ভালো মানুষের মতো চেহারা। যেকোনও জিনিস বুঝতে একটু দেরি করে; কিন্তু একবার বুঝে গেলে জীবনে আর ভুল করে না। হাবাগোবা মানুষরা দুধ, ছানা, মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি পছন্দ করে। খুব বিশ্বাসী হয়। যেকোনও কথা, কাজ, প্রতিশ্রুতি ভীষণ বিশ্বাস করে। সহজে কারোকে সন্দেহ করে না। বাঁকা কথা, রঙ্গব্যঙ্গ তেমন বুঝতে পারে না। সেনস অফ হিউমার নেই বললেই চলে। এরা সহসা রাগে না। কখনও রেগে গেলে খুব-একটা হম্বিতম্বি করে না, আপন মনে গজগজ করে। বলে, খাব না। চা খাব না, ভাত খাব না। রাগের সময় চোখে জল এসে যায়। নির্জনে সরে গিয়ে, গাছপালা, পাখি, বেড়াল, কুকুরের সঙ্গে আপন মনে কথা বলতে থাকে—কথার ধরন, ‘আয় রে! তোরও কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। পুষি, তোর মা আছে? জানিস পুষি, তুই আর আমি পুরীতে বেড়াতে যাব। তোকে না একদিন মালপো খাওয়াবো।’ বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘এটা কি পাখি? গাছে সবুজ পাতা এসেছে। আ:, আকাশটা কি নীল। বর্ষা এল বলে।’ রাগের মাত্রা যত বাড়ে, কথা বলাও তত বেড়ে যায়। রেগে গেলে সময়-সময় আপাদমস্তক চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ে। হাবাগোবা লোকদের ঘুম একটু বেশি হয়। শোওয়ামাত্রই নাক ডাকতে থাকে। একটু ঘুম দিতে পারলেই এদের রাগ জল।
হাবাগোবা লোকেরা সংসার ভালোবাসে। পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। আর স্ত্রীর খুব নেওটা। বিয়ের ব্যাপারে এদের খুব উদার মনোভাব। তেমন রূপসী, বিদুষী স্ত্রী না হলেও চলে। বিয়ের পর ওরা বউবগলে সর্বত্র বেড়াতে যায়। পথে যেতে-যেতে বারে বারে প্রশ্ন করে, ‘হ্যাঁ গা, পান খাবে’? হ্যাঁ গা ঠান্ডা জল খাবে? এদের শরীরে স্বচ্ছন্দে স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া যায় ‘অন হার ম্যাজেসটিজ সারভিস।’ এরা যেকোনও প্রসঙ্গেই স্ত্রীর প্রসঙ্গ এনে ফেলবে। কথায় বার্তায় তেমন পালিশ না থাকায়, ওয়াইফ বা মিসেস না বলে দুম করে বলে বসবে, ‘আমার বউ বলে, বৈশাখেই পুজোর বাজার করবে।’ অথবা ‘আমার বউ বলছিল, ‘চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খেলে অম্বল হয়।’ হাবাগোবা লোকেরা মা আর বউ দুজনেই সমান ভালোবাসে। মাকে নিয়ে তীর্থে যায়, বউকে নিয়ে সিনেমায়। হাবাগোবারা সংসারে অনেক কাজ করে। কাজ করতে ভালোবাসে তারা। মান-অপমান বোধটা খুবই কম। টিন বাজাতে-বাজাতে কেরোসিন তেল আনতে ছুটল। যে বাজারে চাল সস্তা, সেই বাজারে গেল চাল কিনতে। বউকে সাহায্য করার জন্যে নিজেই বসে গেল চিংড়ির খোলা ছাড়াতে। এরা মায়ের জন্যে আনতে ছোটে বাতের দৈব তেল। আবার বউয়ের জন্যে কলেজ স্ট্রিটের বাজারে ছোটে অনন্ত মূলের শিকড় কিনতে। হাবাগোবাদের দেখা যায়, নিজের এক মাসের শিশুপুত্রটিকে কোলে ফেলে দোলাচ্ছে আর ‘আয় আয়’ করে কান্না ভোলাবার চেষ্টা করছে। কোনও লজ্জা নেই। বউকে একটু রিলিফ দেওয়ার চেষ্টা। ছেলে হিসি করে দিলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, প্রতিবেশীরা শুনতে পায়, ‘যা: ব্যাটা, হিসসি করে দিয়েছে রে।’
হাবাগোবাদের একটা ব্যাঙ্কের পাশ বই থাকে। রাজস্থানের বৃষ্টির মতো শূন্য দশমিক কয়েক মিলিমিটার সঞ্চয় হয়তো বাড়ল, তারপর একদিন বই খুলে হাবাগোবার হাহা হাসি—’যা: শালা দশটা টাকা পড়ে আছে। নে, আম খা, লিচু খা।’ হাবাগোবারা সাধারণত বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, কোনও কিছুই মিস করে না। চোখ উলটে বলে না, সোসাল নুইসেনস। সপরিবারে বললে বোকার মতো সপরিবারেই যায়। আর হাবাগোবাদের ছেলেমেয়েরা তেমন সহবত শেখে না বলে সারা কাজের বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ায়, টেবিলে জলের গেলাস উলটে দেয়। কাজের বাড়ির কর্মকর্তারা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এ বাঁদরগুলো কোথা থেকে এল।’ হাবাগোবার খেয়াল থাকে না, কারণ সে জানে, ছোটরা ছোটদের মতোই চলবে। সে কেবল অন্যের সঙ্গে গল্প করতে-করতে আদুরে গলায় ছেলেকে বলবে ‘বাবু, তুমি দুষ্টুমি কোরো না, বাবু।’ হাবাগোবাদের বাড়ি হয় না। তারা বাড়ি করার গল্প শোনে। আলিপুর রোডে কাজে গিয়ে, বিড়লা বাড়ির দারোয়ানকে বোকার মতো জিগ্যেস করে বসে, ‘এখানে জায়গা জমির দাম কী যাচ্ছে।’ দারোয়ান ভয়ে ছুটে পালায়। ভাবে এরপর হয়তো কামড়েই দেবে। সিঁথির মোড়ে পান কিনতে-কিনতে পানওয়ালাকে জিগ্যেস করে, ‘এখানে জমির কী দাম যাচ্ছে।’ যেন কোটিপতি বেগুন কেনার মতো, জমি কিনতে বেরিয়েছে। পানওয়ালা, পানের বোঁটায় চুন দিতে-দিতে বেশ গর্বের গলায় বলে—’ঢাই লাখ।’ পানওয়ালারও কিছু নয়, হাবাগোবারাও কিছু নয়, তবু পানওয়ালার সুরে গর্ব; যেন তার জমি; আর হাবাগোবার মনে কী আনন্দ। জিভে চুন ঠেকাতে-ঠেকাতে উজ্জ্বল চোখে উঠতি জনপদের দিকে তাকিয়ে বলে—’আড়াই লাখ? এক কাঠা জমির দাম আড়াই লাখ! দু-কাঠা পাঁচ লাখ! বা:বা: ! তাহলে এই নতুন সাততলা বাড়িটার দাম কত হল?’
হাবাগোবারা অন্যের জমি কেনার, বাড়ি করার গল্প শোনে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে ইটের দাম, সিমেন্টের দাম, লোহার দাম। গৃহপ্রবেশে নিমন্ত্রিত হয়ে সস্ত্রীক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যায়। অন্য নিমন্ত্রিতরা যখন ঈর্ষায় জ্বলতে থাকে, তখন হাবাগোবার মনে থইথই বিস্ময়। সে আর নিজেকে চেপে রাখতে পারে না। একঘর লোকের মধ্যে বউকে ডেকে বলে, ‘দ্যাখো-দ্যাখো, মেঝে দ্যাখো, একে বলে মোজাইক। জানলার কাচ দ্যাখো, একে বলে ক্যালোরেকস, দেওয়ালের রং দ্যাখো, একে বলে প্ল্যাস্টিক ইমালসান।
হাবাগোবারা পৃথিবীতে আসে দেখতে আর শুনতে। হাবাগোবাদের ব্যাঙ্ক-ব্যালেনস থাকে না। তাদের ফোন, ফ্রিজ, টিভি থাকে না। যা রোজগার করে, তাইতে ভাত ডাল তরকারিটা হয়ে যায়। ছেলেকে পাড়ার বাংলা মিডিয়ামে পড়ায়। ইনকাম ট্যাকস, ওয়েলথ ট্যাকস, কোনও ট্যাকসেরই ঝামেলা নেই। হাবাগোবার সংসারে সদা শান্তি। কারণ তারা আসে খেলতে নয় খেলা দেখতে। যে অন্যকে খেলায় না, জগৎও তাকে নিয়ে খেলে না। যে সহজে নাচে না, তার জীবনে অনেক শান্তি।
ট্রেন চলেছে ব্রিজের ওপর দিয়ে গুমগুম করে। জানলায় চারটি মুখ, হাবাগোবা, তার মা, বউ আর ছেলে। বাতাসে ভেসে যাচ্ছে হাবাগোবার সহর্ষ কণ্ঠস্বর, ‘দ্যাখো দ্যাখো, মা দ্যাখো, ওগো তুমি দ্যাখো, খোকা দ্যাখ, এই সেই গোদাবরী নদী।’ সহযাত্রী বিরক্ত হলে কী হবে। হাবাগোবারা এইভাবে দেখাতে-দেখাতে, দেখতে-দেখতে, একটি ঐকতানের মতো ভেসে চলে যাবে। আঙুল থেকে আলুর দমের ঝোল চেটে নিতে-নিতে লুচি ভরাট মুখে বলবে, ‘হ্যাঁ গা’ মা’কে আর একটু দাও, আর একটু দাও।’ নীল পাহাড়ের কোল ছুঁয়ে চলেছে জীবন-একপ্রেস। মা, বউ, নাতি, নাতনি, হাবাগোবা ঘুমে কাদা। সুখনিদ্রা। বুদ্ধির অসুখটা নেই বলেই জীবনে এত সুখ।