হানাবাড়ি
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে বরিশাল শহর ছিল নিতান্তই একটি মফস্বল। শহরটিকে পাড়া গাঁয়ের একটু উঁচু সংস্করণ বলা যায়। শহরের শেষ মাথায় ছিল কেদার চাটুজ্যের পোডড়া ভিটে। এ গল্পের যখন শুরু তারও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে চাটুজ্যে মারা গেছেন। তারপর থেকে ওই পোডড়া ভিটেতে কেউ বাস করার সাহস পায়নি। তখন অবশ্য এত ঘনবসতি ছিল না। শহরগুলোয় কাজেই বাড়ি ফাঁকা পেলেই সেখানে বসত গড়ার ফন্দিও কেউ করত না। আর কেদার চাটুজ্যের পোডড়া ভিটের ধারেকাছেও কেউ যেত না ভয়ে। কারণ লোকে বলত ওই বাড়িটি নাকি একটা হানাবাড়ি।
চাটুজ্যে বংশের সকলের ছিল অগাধ টাকা পয়সা। এখন নাকি চাটুজ্যের শেষ বংশধর কেদার চাটুজ্যে মরে যক্ষ হয়ে নাকি ওই সব টাকাকড়ি আগলাচ্ছে। ধনরত্রের লোভে কেউ ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেষলেই যক্ষ রেগে গিয়ে তার গলা টিপে মেরে ফেলে!
এই কথাটা এই অঞ্চলের সব লোকই বিশ্বাস করে। তাই রাতে তো দূরের কথা, দিনের বেলাতেও কেউ ওই বাড়ির কাছে ঘেঁষে না।
তাছাড়া বাড়িটার চারদিকের আবহাওয়াও কেমন যেন রহস্যময়।
বহু পুরোনো বাড়িটা। ইটগুলো সব দাঁত বের করে আছে। চুন সুরকি সবই বহুদিন হলো খসে পড়েছে। বাড়ির পেছনের দিকের অর্ধেকটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
তাছাড়া চারদিকে অদ্ভুত এক নির্জনতা। অন্ধকার যেন ডানা মেলে বাড়িটাকে গ্রাস করে বসে আছে।
শহরের একেবারে প্রান্তে–তাই চারদিকই বনজঙ্গলে ভর্তি। সামনেই একটা প্রকাণ্ড বটগাছ ঝুরি নামিয়ে চারদিকে ছায়া করে রেখেছে। এছাড়াও আসশেওড়া, আমলকী, শিয়ালকাঁটা আর কাঁটানটে গাছের ঝোঁপের বাড়িটা বোঝাই। পেছন দিকেও দুতিনটে নারিকেল গাছ আর একটা বিশাল আম গাছ।
সন্ধ্যার পরই চারদিকে অদ্ভুত নৈশব্দ থম থম করে। এমন কী একটা আলো পর্যন্ত জ্বলে না কোথাও।
রাতের বেলা মাঝে মাঝেই শোনা যায় অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ।
পথ চলতি লোক কেউ এ শব্দ শুনলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যায়।
লোকে বলে, যক্ষেরা নাকি শব্দ করে করে মোহর গুনতে থাকে, তাই এই শব্দ। যদি কেউ ভুলেও এ সময় ওই পথে পা বাড়ায় তবে তার আর রক্ষা নেই।
এই সব কারণেই গত বিশ বছরের মধ্যে কেউ কখনও ওই চাটুজ্যে বাড়িতে পা দেয়নি। দরকার কী বাপু বিনা কারণে নিজের জীবনটা খুইয়ে!
দিন পনেরো কুড়ি হলো শহরে দুজন নতুন গুণ্ডা বদমাইশ লোক এসেছে। কখন আবার কী আপদ বিপদ ঘটে ঠিক নেই। শহরের লোক তাই ভয়ে সন্ত্রস্ত।
বলরাম মুখুজ্যে গরীর ব্রাহ্মণ।
শহরের এককোণে তার একটা ছোট্ট মুদি দোকান আছে। তাতে যা সামান্য কিছু আয় হয়, তাতেই চলে তার সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা।
সেদিন অমাবস্যার রাত।
দোকানের কাজকর্ম শেষ করে একহাতে একটা ছোট্ট টিমটিমে লণ্ঠন আর অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে ঠুকঠুক করতে করতে তিনি চলেছিলেন নিজের বাড়ির দিকে। রাত নটা বেজে গেছে।
পথ নির্জন। কেদার চাটুজ্যের পোডড়া ভিটের পাশ দিয়েই এই পথটা।
হঠাৎ বলরাম মুখুজ্যে দেখলেন শহরে নতুন আসা সেই দুজন গুণ্ডা বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছে বিড় বিড় করে কী যেন বলতে বলতে।
বলরাম মুখুজ্যে একটা গাছের আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন ওদের কথাবার্তা।
হানাবাড়ির কথাই ওরা বলাবলি করছিল।
একজন বলল, চল এক্ষুণি যাই। ওই কোণের ঘরটায় কাল রাতে গিয়েছিলাম। শাবল দিয়ে একটা চাঙড় তুলতেই একটা কাঠের সুড়ঙ্গপথ দেখতে পেলাম। সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে নামতে একটা মস্তবড় অন্ধকার চোরকুঠুরী। তার মধ্যে তিন ঘড়া মোহর বসানো আছে।
অন্য গুন্ডাটি বলল, তা হলে ওই যক্ষ টক্ষ সব বাজে কথা?
আগের গুন্ডাটা হেসে বলল, দূর, ওসব কিছু না। যত সব ইঁদুর চামচিকা, ছুঁচো ওই মোহর গুনছে।
অন্য গুন্ডাটা হো হো করে হেসে উঠে বলল, চল তবে। বলরাম মুখুজ্যে সমস্ত কথা শুনলেন।
কেমন একটা কৌতূহল হলো তাঁর। লোভও যে কিছুটা না হলে এমন নয়।
তিনি ভাবলেন গুন্ডাগুলো চলে গেলে যদি গোটাকয়েক মোহরও তিনি খুঁজে আনতে পারেন, তবে তাঁর মতো একজন গরীবের একটা হিল্লে হয়ে যায়।
লণ্ঠনের শিখাটাকে কমিয়ে দিয়ে তিনি গুণ্ডা দুজনকে অনুসরণ করে প্রবেশ করলেন চাটুজ্যের পোড়াবাড়িতে।
বাতাস বয়ে চলেছে গাছের পাতার মধ্য দিয়ে শিরশিরিয়ে।
বিশ্রী একটা শব্দ করে একসঙ্গে ডেকে উঠল কতগুলো পেঁচা। তাদের সে ডাক কর্কশ কান্নার মতো।
বটগাছটার ওপর থেকে কতগুলো বাদুড় ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে গেল।
গুন্ডা দুটো বাড়ির সদর দরজা ও ভাঙা চত্বরটা পেরিয়ে একটা বিরাট ভগ্নস্তূপের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
বলরাম মুখুজ্যে ইতস্তত করতে লাগলেন। দরকার কি মিছামিছি ওদের পেছন পেছন গিয়ে। শেষ পর্যন্ত হয় তো প্রাণটাই যাবে!
কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা।
তারপরেই আবার তাঁর মনে লোভ জেগে উঠল। বিপদ দেখে ভয় পেলে জীবনে টাকা আয় করা যায় না!
মুখুজ্যে একবার ভালো করে চারদিকে চেয়ে দেখলেন।
চারদিকেই ঘোর অন্ধকার! আলোর চিহ্ন নেই কোথাও।
গভীর রাতের বুকের উপর প্রেতপুরীর মতো বিরাট ভাঙাবাড়িটা দাঁড়িয়ে।
বাঁ দিকের সরু পথটা ধরে তিনি ভগ্নস্তূপের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লেন। সারি সারি ভাঙা ঘর। চারিধারে ধ্বংসস্তূপ।
মাঝে মাঝে ভাঙা দালান। তার ফাটলের গা বেয়ে বট, অশ্বত্থ আর নিমগাছেরা জড়াজড়ি করে উঠেছে।
হঠাৎ যেন সৎ করে একটা বিরাট ছায়া তার সামনে দিয়ে ওড়ে চলে গেল।
এ কী ব্যাপার! বলরাম মুখুজ্যে অবাক।
সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে কতগুলো চামচিকা জেগে উঠে চিৎকার করতে লাগল। হঠাৎ তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতেই জেগে উঠেছে
তারা।
বলরাম মুখুজ্যের গতি যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
একটা অদ্ভুত আতঙ্ক ভরা চিৎকার এসে তার কানে বাজল। মনে হলো। কেউ যেন কাউকে আক্রমণ করেছে। প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাই সে চিৎকার করছে।
শব্দটা হঠাৎ যেন থেমে গেল।
তারপরেই বিকট একটা অট্টহাসি–হাঃ! হাঃ! হাঃ! অদ্ভুত সে হাসি। সে হাসি যেন আর থামবে না! ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হলো–দুম!
কেউ যেন কোনো জিনিস দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
মুখুজ্যে মশাই ভাবলেন নিশ্চয়ই গুন্ডা দুটো নিজেদের মধ্যে মারামারি আরম্ভ করেছে গুপ্তধনের বখরা নিয়ে।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
মুখুজ্যে মশাই এগিয়ে লণ্ঠনের উঁকি মেরে দেখলেন। কিন্তু কিছুই ভালো করে চোখে পড়ল না।
আর একটু এগিয়ে লণ্ঠনের শিখাটা বাড়িয়ে দিতেই চোখ পড়ল, দুটি গুণ্ডাই কোনের ঘরের ঠিক সামনের বারান্দার মেঝের উপর পাশাপাশি শুয়ে আছে। রক্তে চারদিক যেন ভেসে যাচ্ছে।
ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেন, দুজনের কারও দেহেই প্রাণের চিহ্ন নেই।
হঠাৎ তাঁর কানে এলো ঝনঝন খনখন শব্দ।
ঘরের মেঝেতে পরপর তিনটি ঘড়া বসানো। তিনটিই মোহর পূর্ণ। কতগুলো ইঁদুর আর ছুঁচো লাফিয়ে তার উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ উঠল ঝনঝন–
বলরাম মুখুজ্যের মনে খুব আনন্দ হলো। যাক, গুন্ডা দুটো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরেছে। এবার মোহর তিনিই পাবেন।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে দপ্ করে জ্বলে উঠল একটা আলো।
অদ্ভুত একটা ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
মুখুজ্যে মশাই সেই বিকট ছায়ামূর্তি দিকে তাকিয়ে কোনো কথাই বলতে পারলেন না।
ঠিক যেন পাথরে কোঁদা বিরাট দেহ একজন ব্রাহ্মণ। খালি গা। গলায় ধবধবে সাদা পৈতা। কাঁধে একটা চাদর।
সাদা দাঁত বের করে হি হি করে অদ্ভুত হাসি হেসে তিনি বললেন, আমিই কেদার চাটুজ্যে। গত ৫০ বছর ধরে যক্ষ হয়ে এই গুপ্তধন আগলাচ্ছি। গুণ্ডা ব্যাটারা এই ধন নিতে এসেছিল। কিন্তু বদমাইশদের এই ধনের উপর হাত দেবার অধিকার নেই। আপনি গরিব ব্রাহ্মণ। তাই আপনাকে এই ধন দান করলে আমার আত্মার মুক্তি হবে। আপনি আমার পুর্বপুরুষ সঞ্চিত অর্থ তিন ঘড়া মোহর নিয়ে যান। আর দয়া করে গয়ায় আমাদের নামে পিণ্ড দিয়ে দেবেন।
এর পরের খবর আমরা যা জানি, গরিব মুখুজ্যে মশাই হঠাৎ রাতারাতি বড়োলোক হয়ে ওঠেন এবং সর্বদা ধর্মে মতি রাখতেন। গরিব-দুঃখীকে প্রচুর দান করতেন।
একমাস পরে তিনি যক্ষের অনুরোধ মতো গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করে এসেছিলেন।
এরপর হানাবাড়িতে আর কখনও ভূতের উৎপাতের কথা শোনা যায়নি। গভীর রাতেও সে পথে চলতে আর কেউ ভয় পেত না।