হানাবাড়ি – প্রেমেন্দ্র মিত্র
এক
নির্জন পরিত্যক্ত যশোর রোড কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদের আলোয় যেন বিশাল সুষুপ্ত এক অজগরের মতো পড়ে আছে।
যখনকার কথা বলছি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আলোড়নে কলকাতায় তখন মানুষের মাথা গোঁজবার ঠাঁই দুষ্প্রাপ্য হয়েছে বটে, কিন্তু দেশ তখনও অবিভক্ত, এবং দ্বিখণ্ডিত দেশের যারা প্রধান বলি সেই হতভাগ্যের দলকে শহরের উপান্ত থেকে সারা দেশে সামান্য একটু আশ্রয়ের আশায় তখনও হন্যে হয়ে ফিরতে হয়নি।
দমদম বিমানঘাঁটি ছাড়িয়ে যশোর রোডের এই দিকের নির্জনতা তাই তখনও অটুট।
এই নির্জন স্তব্ধতা কিন্তু দিনের বেলাতেই শুধু বুঝি উপভোগ্য—রাত্রে নয়।
সেই স্তব্ধতা যদি দ্রুত ধাবমান কারুর পায়ের শব্দে হঠাৎ ভেঙে যায় তাহলে বুঝি আরো অস্বস্তি বোধ করার কথা।
সে—রাত্রে ওই নির্জন রাস্তার বিনিদ্র প্রহরী কেউ থাকলে সহসা ওই রকম একটি পদশব্দই শুনতে পেত। কেউ যেন সভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কোথায় ছুটে পালাচ্ছে!
সে পদশব্দ অনুসরণ করলে শোনা যেত শ’তিনেক গজ দূরে একটি বেশ পরিচ্ছন্ন বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির কাছে এসে তা থেমে গেছে।
রাস্তার ধারের এ বাড়িটি একরকম নিঃসঙ্গ বলা যায়। এখান থেকে আরো প্রায় মাইলখানেক দূরে এ অঞ্চলের প্রথম বসতিগুলি ছাড়াছাড়া ভাবে শুরু হয়েছে।
মরা চাঁদের আলোয় বাড়িটি ভালো করে দেখতে না পাবারই কথা। তবে এত রাত্রেও বাড়িটির ভেতর আলো জ্বলতে দেখা যায়। এবং সেই সঙ্গে শোনা যায় সুমিষ্ট বেহালার সুর তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে যে লোকটি দৌড়ে এসেছিল সে সজোরে এবার বাড়িটির বাইরের দরজায় ধাক্কা দিলে।
কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর ভেতরের বেহালার আওয়াজ থেমে গেল। তার খানিক বাদে সবিস্ময়ে বাইরের দরজা যে এসে খুললে সে কিছু বলবার আগেই, রাস্তা দিয়ে যে ছুটে এসেছিল সে উত্তেজিত কণ্ঠে বললে—’মাপ করবেন! ভয়ানক বিপদে পড়ে এত রাত্রে আপনাকে কষ্ট দিলাম। না দিয়ে আমার উপায় ছিল না।’
কোনোরকমে ঝড়ের মতো এ কথাগুলি বলে ফেলে লোকটি আবার হাঁফাতে হাঁফাতে অনুনয় করলে—’আমায় একটু জল দিতে পারেন?’
দরজা যে এসে খুলেছিল সে প্রথমটা একটু বুঝি বিমূঢ়ই হয়ে গেছল। তারপর ঈষৎ হেসে সে বিমূঢ়তা গোপন করে বললে—’নিশ্চয় পারি। আসুন, ভেতরে আসুন।’
‘ভেতরে যাব?’—নবাগত বেশ একটু সঙ্কোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে আবার।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আসবেন বই কি!’—বাইরের দরজা বন্ধ করে নবাগতকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বাড়ির মালিক আশ্বাস দিয়ে বললে—’আপনার সঙ্কোচের কোনো কারণ নেই। এখানে আমি একলাই থাকি।’ বারান্দা পার হয়ে বেশ প্রশস্ত একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে নবাগতকে সামনের একটি সোফা দেখিয়ে দিয়ে সে বললে—’বসুন।’
নবাগত ও বাড়ির মালিক, দুজনকেই ঘরের উজ্জ্বল আলোয় এবার ভালো করে দেখা গেল। দুজনকেই বয়সে যুবক বলা যায় এবং দীর্ঘ সুগঠিত চেহারার দিক দিয়েও দুজনের মিল আছে। কিন্তু সাদৃশ্য আবার ওইখানেই শেষ। লম্বা চুল ও দাড়ি—গোঁফ নিয়ে বাড়ির মালিককে বেশ একটু সৌম্য সাধকের মতো দেখায়, নবাগতর চেহারা সে তুলনায় কঠিন ও রুক্ষ।
বসতে অনুরুদ্ধ হলেও ঘরের সাজসজ্জা আসবাব ঐশ্বর্য দেখে অবাক হয়েই নবাগত বোধহয় প্রথমটা বসতে পারেনি। ঘরটি সত্যিই দেখবার মতো এবং সে ঘরের চেহারা দেখলেই মালিকের পরিচয় সম্বন্ধে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার থাকে না। তিনি যে একজন শিল্পী, ঘরের সব কিছুই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ঘরটি আকারে বেশ বড় এবং তার সব কটি দেওয়াল অসংখ্য ছবিতে একরকম ঢাকা পড়েছে বলা যায়। ঘরের মাঝখানেই একটি বড় স্ট্যান্ডের ওপর অর্ধসমাপ্ত একটি ছবি বসানো। তারই পাশে একটি টেবিলের ওপর খোলা সুদৃশ্য একটি বাক্সের ধারে একটি বেহালা ও ছড়ি পড়ে আছে। বাইরে থেকে এই বেহালার সুমিষ্ট বাজনাই শোনা গেছল বোঝা গেল। তাড়াতাড়িতে সেটি তুলে রেখে যাবার সময়ও পাওয়া যায়নি।
বাড়ির মালিক ঘরের এক কোণের একটি সুদৃশ্য কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল এনে তার হাতে দিতে নবাগতের যেন চমক ভাঙল। এক নিশ্বাসে জলটুকু খেয়ে নিয়ে একটু অপ্রস্তুত ভাবেই সোফার একধারে বসে সে বললে—’আমার ব্যবহারে আপনি বিরক্ত না হ’ন, অবাক নিশ্চয় হয়েছেন। এত রাত্রে অচেনা একজনের বাড়ির দরজায় এসে ধাক্কা দেওয়া ঠিক স্বাভাবিক ব্যাপার তো নয়! বাইরে থেকে আপনার জানলার আলো না দেখলে আর বেহালার শব্দ না শুনলে হয়তো আমি সাহসও করতাম না।’
বাড়ির মালিক এবার একটু হাসল। তারপর সোফার অপর প্রান্তে বসে বললে—’আপনি মিছামিছি অত কুণ্ঠিত হবেন না। এভাবে পরের দরজায় ধাক্কা দেবার পেছনে একটা কোনো কারণ যে আছে তা বেশ বুঝতে পারছি। এখন ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো—অবশ্য যদি সুস্থ হয়ে থাকেন।’
‘হ্যাঁ, সুস্থ অনেকটা হয়েছি।’ বলে একটু যেন ইতস্তত করে নবাগত বললে—’এখান থেকে মাইলখানেক দূরে একটা প্রকাণ্ড পোড়ো বাড়ি আছে জানেন বোধহয়?’
‘এ অঞ্চলেই থাকি, আর ও—বাড়ির কথা জানি না!’—বাড়ির মালিকের স্বরে একটু কৌতুকের—ই আভাস পাওয়া গেল। তারপর সত্যিই কৌতূহলী হয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে—’আপনি ওই বাড়িতেই গিয়ে ঢুকেছিলেন নাকি!’
‘হ্যাঁ, জরুরি একটা কাজে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ওই বাড়িটার সামনেই গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে। কিছুতেই সেটা ঠিক করতে না পেরে ভাবলাম রাতটা ওই বাড়িতেই কোনোরকমে কাটিয়ে দেব। বাড়িটার চেহারা অবশ্য সুবিধের নয়। আবছা চাঁদের আলোতেও মনে হল বহুকাল ও বাড়িতে কেউ বাস করেনি। তবু রাতটুকু থাকবার মতো একটা ঘর ওখানে পেতে পারি এই আশায় বাড়িটার ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম।’
এ পর্যন্ত বলে নবাগত একটু যেন দ্বিধাভরেই বাড়ির মালিকের দিকে তাকাল।
বাড়ির মালিক উৎসাহ দিয়ে বললে—’বলুন, থামলেন কেন!’
‘না, বলছি, তবে এখন যা বলতে যাচ্ছি তা কতদূর আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন জানি না।’ বলে একটু চুপ করে থেকে নবাগত যে কাহিনি বললে তা সত্যই অদ্ভুত।
বাড়িটি যেমন বিশাল তেমনি পুরোনো। একদিকের অংশ একটু মজবুত আছে মনে হওয়ায় সে সেদিকের সিঁড়ি দিয়ে কোনোরকমে দেশলাই—এর কাঠি জ্বেলে জ্বেলে পথ দেখে ওপরে গিয়ে ওঠে। বাড়িটিতে বহুকাল কোনো মানুষের পদার্পণ যে হয়নি, তার আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুর ও অসংখ্য চামচিকের সশব্দ প্রতিবাদ ও চঞ্চলতাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এতকাল ধরে ও বাড়িতে তারাই অবাধে রাজত্ব করে এসেছে। ওরই মধ্যে অপেক্ষাকৃত ব্যবহারযোগ্য একটি ঘর খুঁজে নিয়ে সে সেখানে বিশ্রামের উদ্যোগ করছে এমন সময়ে পেছনের দিকের একটি বারান্দায় অস্বাভাবিক একটা শব্দ শুনে সে চমকে ওঠে। শব্দটা যেন হিংস্র কোনো প্রাণীর চাপা গর্জনের মতো। কিন্তু এ বাড়ি যতই নির্জন হোক ওরকম কোনো প্রাণী এখানে কি করে থাকতে পারে! তা ছাড়া হিংস্র প্রাণী বলতে যা বোঝায়, বাঘ—ভালুকের মতো সে রকম কোনো জানোয়ারের গর্জনও সেটা নয়। তাহলে কি অশরীরী কোনো কিছু!
কিছুক্ষণ বাদে আর কৌতূহল চাপতে না পেরে সে সন্তর্পণে সেই বারান্দার দিকটা অনুসন্ধান করতে যায়। বাড়ির সেই দিকটা ভেঙে প্রায় ধসে পড়েছে। চারিদিকে গাছপালা ও লতাপাতার জঙ্গল। তার ওপরে আবার একেবারে গাঢ় অন্ধকার। প্রথমটা তাই সে কিছুই দেখতে পায়নি। আশ্চর্যের বিষয় শব্দটাও তখন থেমে গেছে। সে দিকে কিছু না পেয়ে সে আবার আগের ঘরটির দিকে ফিরছে এমন সময়ে আতঙ্কে চমকে উঠে তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। ঠিক তার ঘাড়ের ওপর কার নিশ্বাস পড়ছে! তার শরীরের সমস্ত শিরা—উপশিরার ভেতর দিয়ে একটা বিদ্যুতের শিহরন যেন খেলে যায়। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে প্রথমটা সাহস করে ফিরে দেখতেও পারে না।
হঠাৎ পেছনে কিসের একটা প্রচণ্ড শব্দ হতেই এক ঝটকায় ফিরে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে দেখেই সে ভয়ে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে ওপরের বারান্দা থেকে ভাঙা রেলিং টপকে নীচে লাফিয়ে পড়ে। সেই এক মুহূর্তে সে যা দেখেছে স্বাভাবিক অবস্থায় সেরকম ভয়াবহ মূর্তি কল্পনা করাও বুঝি কঠিন। দৈত্যের মতো বিশাল লোমশ একটা দেহ ও তার ওপরে হিংস্র দংষ্ট্রা—বিকশিত ভয়ঙ্কর মুখে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দুটি পৈশাচিক চোখ। শিকার ধরবার উল্লাসে সেই বিকট প্রাণীটা সশব্দে দুই লোমশ হাতে বুক বাজিয়ে আস্ফালন করছে। এইটুকু দেখেই সে নীচে লাফ দিয়ে পড়ে।
নীচে পোড়ো বাড়ির ভাঙা ইটকাঠের স্তূপে পড়ে গিয়ে প্রথমটা তার উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই থাকে না। সেই বিকট বিভীষিকা সিঁড়ি দিয়ে হিংস্র লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে ক্রমশই ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে দেখেও আচ্ছন্নের মতো আত্মরক্ষার চেষ্টা করবার কথাও সে যেন ভুলে যায়। শেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড শক্তিতে নিজের চেতনা ফিরিয়ে এনে সে কোনোরকমে সেই বিভীষিকার কবল থেকে বাইরে ছুটে পালিয়ে আসে।
এক নিশ্বাসে এ কাহিনি বলে যাবার পর একটু থেমে নবাগত আবার বলে—’সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেও কোথায় যাব কিছুই ভেবে পাইনি। ও বাড়ির ধারেকাছে আশ্রয় নেবার মতো একটা জায়গা নেই। তারপর বহুদূরে আপনার বাড়ির এই আলো দেখতে পেলাম। ছুটতে ছুটতে এসে আপনার বেহালার শব্দ শুনে ভরসা পেয়ে তখন দরজায় ধাক্কা দিলাম। আপনার এখানে আশ্রয় না পেলে আজ রাত্রে এই অচেনা জায়গায় কি যে করতাম জানি না। আপনার অবশ্য খুবই অসুবিধা করলাম।’
‘না, অসুবিধা কিসের!’ প্রসন্ন হাসিতে আশ্বাস দিয়ে বাড়ির মালিক বলে—’কি বলে—আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানি না!’
হঠাৎ এ প্রশ্নের জন্যে নবাগত যেন প্রস্তুত ছিল না। একটু বুঝি চমকে উঠেই বলে—’আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরী।’
‘আমার নাম শ্রীমন্ত সরকার। পেশা বা খেয়াল যাই বলুন এই!’—ঘরের ছবি ও মূর্তিগুলির দিকে হাত নেড়ে দেখিয়ে শ্রীমন্ত বলে—’আপনার কাছে যা শুনলাম তাতে কিন্তু খুব অবাক হচ্ছি। এ অঞ্চলের অশিক্ষিত সাধারণ লোক ওটাকে ভূতুড়ে বাড়ি বলে, জানি, কিন্তু সত্যিই ওখানে ভয় পাবার মতো কিছু থাকতে পারে কখনও বিশ্বাস করিনি।’
একটু থেমে শ্রীমন্ত আবার জিজ্ঞাসা করে—’আচ্ছা ব্যাপারটা আপনার চোখের ভুল নয় তো!’
‘না মশাই, চোখের ভুল নয়!’—জয়ন্তর গলার স্বরে একটু অধৈর্য—ই প্রকাশ পায়।—’গায়ের ওপর তার নিশ্বাস টের পাওয়া যায় এত কাছ থেকে আমি তাকে দেখেছি। নইলে কি মনে করেন, আপনার এখানে ঢোকবার জন্যে মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলছি!’
কথা বলবার ধরনে হেসে ফেলে শ্রীমন্ত সরকার বলে—’আপনি এখনও উত্তেজিত হয়ে আছেন দেখছি! আমার কথাটা ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি কি, যে, ওরকম নির্জন পোড়ো বাড়িতে অন্ধকারে অনেক সময় মানুষের দৃষ্টি—বিভ্রম তো হয়।’
‘হয়ত হয়, আমার তা হয়নি।’—বোঝা গেল জয়ন্ত এখানো বেশ ক্ষুণ্ণ।
শ্রীমন্ত এবার গম্ভীর হয়ে বলে—’তাহলে তো বেশ গুরুতর ব্যাপারই বলতে হবে। এখানকার পুলিশকে একবার তাহলে জানাতে হয়।’
পুলিশের কথায় জয়ন্ত কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে—’না, না, পুলিশকে জানিয়ে কোনো লাভ নেই।’
শ্রীমন্ত একটু অবাক হয়েই জয়ন্তর মুখের দিকে তাকায়। তারপর হেসে বলে—’লাভ না থাক, লোকসান তো কিছু নেই। এখানকার থানার অফিসার মিঃ সোম আমার চেনা। আজ রাতটা আপনি এখানেই বিশ্রাম করুন। কাল সকালেই আপনাকে আমি তাঁর কাছে নিয়ে যাব।’
কথাটা জয়ন্তর খুব মনঃপুত তবু হয় না। মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলে—’পুলিশকে জানাবার কিন্তু কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
‘বিনা প্রয়োজনেই না হয় গেলেন।’—জয়ন্তর আপত্তিটা হেসে খণ্ডন করে শ্রীমন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলে—’আসুন, আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিই গে!’
‘না, না, আমার জন্যে ব্যস্ত হবার দরকার নেই।’—জয়ন্তর সঙ্কোচটা আন্তরিক। পাশের লম্বা সোফাটা দেখিয়ে সে বলে—’আমি রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব।’
‘অত কুণ্ঠিত হচ্ছেন কেন? আমি তো আগেই বলেছি এখানে আমি একলাই থাকি!’ বলে শ্রীমন্ত তার চাকরের নাম ধরে দু’বার ডাক দেয়।
কোনো সাড়া না পেয়ে তারপর হেসে বলে—’দুলাল বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তার অপরাধই বা কি! রাত তো কম হয়নি। আসুন আপনি!’
জয়ন্তকে অগত্যা শ্রীমন্ত সরকারের সঙ্গে যেতেই হয়। ইচ্ছে করেই সে একটু পিছিয়ে থাকে কি না কে জানে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে, ফিরে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে সব কিছুর ওপর তার চোখ বুলিয়ে নেবার ধরনটা দেখলে শ্রীমন্ত কিন্তু একটু অবাকই বোধহয় হত।
দুই
বয়সে যুবক হলেও থানার অফিসার মিঃ সোম এ—অঞ্চলে অল্পদিনের মধ্যেই সৎ ও সুযোগ্য দারোগা হিসাবে যতখানি সম্ভব সুনাম অর্জন করেছেন।
শ্রীমন্ত সরকার সকাল বেলাতেই জয়ন্তকে নিয়ে থানায় এসে হাজির হয়েছিল। জয়ন্তর কাছে সমস্ত ব্যাপারটা শুনে মিঃ সোম একটু হাসলেন।
সে হাসিতে একটু বিরক্ত হয়েই জয়ন্ত তাঁর দিকে ভ্রূকুটি করে তাকাতে তিনি বললেন—’আপনিও তাহলে ও—বাড়িতে ওই রকম ভয় পেয়েছেন? আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্যটা কি? আমার ভয় পাওয়া?’ জয়ন্তর স্বর বেশ রুক্ষ।
সকৌতুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মিঃ সোম বললেন—’না ভয় পাওয়া নয়। ভয় ও—বাড়িতে অনেকেই পেয়েছে। এ—অঞ্চলে হানাবাড়ি বলে, ওর ধারেকাছে কেউ ঘেঁষে না, অন্তত রাত্রে তো নয়ই। আশ্চর্য, আজই আপনার থানায় একথা জানাতে আসা!’
‘কেন বলুন ত?’—জয়ন্ত সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে। মিঃ সোম কিছু বলবার আগেই শ্রীমন্ত হেসে বললে—’উনি তো আসতেই চাইছিলেন না। আমিই জোর করে ওঁকে ধরে নিয়ে এলাম!’
‘তাই নাকি!’—মিঃ সোমের কণ্ঠস্বরে একটু বিস্ময় যেন প্রকাশ পেল।
শ্রীমন্ত হেসে বললে—’হ্যাঁ, থানায় আসতে ওঁর বেশ আপত্তি ছিল। তবে আমার নিজের এখনও কি ধারণা জানেন—ব্যাপারটা ওঁর চোখের ভুল ছাড়া আর কিছু নয়!’
‘চোখের ভুল—!’ জয়ন্ত বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। ‘যে বিকট প্রাণীকে আমি সুস্পষ্ট দেখলাম, তা আমার চোখের ভুল বলতে চান! তার চেয়ে বলুন না, আমি মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলছি।’
জয়ন্ত হঠাৎ এতখানি ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে উঠবে শ্রীমন্ত ভাবতে পারেনি বোধ হয়। সে অপ্রস্তুত হয়ে কি বলতে যাচ্ছিল। মিঃ সোম গম্ভীর ভাবে তাকে বাধা দিয়ে বললেন—’মিথ্যে কি সত্যি জানি না জয়ন্তবাবু, তবে এ—বাড়ির পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে আপনার গল্প আশ্চর্য রকম মিলে যাচ্ছে এইটুকু বলতে পারি।’
এবার শ্রীমন্তই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে—’পুরোনো ইতিহাস! এ—বাড়ির একটা ইতিহাস আছে নাকি?’
জয়ন্তও সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিলে—’ইতিহাসটা কি জানতে পারি?’—তার কণ্ঠস্বর এখনও রুক্ষ।
মিঃ সোম দু’জনের দিকেই চেয়ে হেসে বললেন—’তা পারেন। একটু বসুন আমি ফাইলটাই নিয়ে আসছি।’
মিঃ সোম আলমারি খুঁজে ফাইলটা নিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসতে যাচ্ছেন, এমন সময় বাইরের দরজার কাছে কার সম্ভাষণ শোনা গেল—‘Good Morning ইন্সপেক্টার সাব!’
মিঃ সোম বিরক্তভাবে সে দিকে তাকালেন। দেখা গেল, ছেঁড়া ঝুলি কাঁধে, অজস্র তালি দেওয়া বেঢপ কোটপ্যান্ট—পরা, একমুখ দাড়ি—গোঁফ সমেত এক বাউন্ডুলে ভিখিরি গোছের অদ্ভুত চেহারার লোক এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে তার একজন কনেস্টবল।
মিঃ সোম তার দিকে তাকাতে সে আর দু—পা এগিয়ে এসে বেশ একটু গম্ভীর চালে বললে—‘May I have a word with you?’
যেমন তার চেহারা—পোশাকের ছিরি তেমনি বেয়াড়া তার কণ্ঠস্বর। শুনলেই মেজাজ বিগড়ে যায়।
মিঃ সোম যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সঙ্গের কনেস্টবলকে ধমক দিয়ে উঠলেন—’একে আবার আসতে দিলে কেন?’
কনেস্টবল সে ধমকে কেঁপে উঠে কাতর ভাবে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করলে,—’আজ্ঞে একেবারে নাছোড়বান্দা স্যার, কিছুতেই মানা শুনলে না। বলে, নালিশ আছে।’
‘Yes, yes, I have a complaint to make—’ ফিরিঙ্গি ভিখিরি সঙ্গে সঙ্গে ভারিক্কি চালে সায় দিলে। ভাবটা যেন কনেস্টবলকে সে—ই অভয় দিচ্ছে।
ভ্রূকুটিভরে তার দিকে একবার তাকিয়ে মিঃ সোম বললেন—’আচ্ছা আচ্ছা! I am busy now, you will have to wait !’
‘All right. All right—!’ পরম সহিষ্ণুতার সঙ্গে মিঃ সোমকেই যেন ক্ষমা করে ভিখিরি সাহেব ঘরের এক কোণে ছোট দারোগা যে টেবিলে কাজ করছিলেন তার পেছনের একটি টুলে গিয়ে বসল।
মিঃ সোমও সাময়িক বিরক্তিটা দমন করে ফাইল খুলে বসে হানাবাড়ির ইতিহাস যা জানালেন তা সংক্ষেপে এই :—বহুদিন আগে শশীশেখরবাবু বলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওই বাড়িটি কেনেন। অতবড় বাড়িতে তিনি একরকম একলাই থাকতেন। এ—অঞ্চলের লোকের সঙ্গে মেলামেশা দূরে থাক কারুর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে চাইতেন না বলে তাঁর সম্বন্ধে অনেক রকম দুর্নাম ছিল বটে কিন্তু তাঁর সত্যিকার পরিচয় কেউই কিছু জানত না। হঠাৎ একদিন ওই নির্জন বাড়িতে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁকে যে কেউ খুন করেছে এটা বুঝলেও পুলিশ সে খুনের কোনো কিনারা করতে পারে না। শশীশেখরের কোনো আত্মীয়স্বজন বা ওয়ারিশানের খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত সরকারি খাজনা ও দেনার দায়ে ও—বাড়ি তাই নিলামে ওঠে। নিলামে ও—বাড়ি যিনি কেনেন তিনিও বেশিদিন ও বাড়ি ভোগ করতে পারেননি। পর পর কয়েকটা পারিবারিক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে ভয় পেয়ে বাড়িটা অভিশপ্ত বলেই তাঁর ধারণা হয়। তিনি ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে ওখানে আর কেউ ঢোকেনি। বহুকাল পরিত্যক্ত হয়ে থেকে এখন ওটা সাধারণের কাছে হানাবাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিঃ সোমের বিবরণ শেষ হবার পর জয়ন্ত একটু বিদ্রূপের স্বরেই জিজ্ঞাসা করলে—’খুনের কিনারা তো পুলিশ করতে পারেনি বুঝলাম, শশীশেখর সামন্ত কে ছিলেন সেটুকু কি তারা জানতে পেরেছে?’
‘শশীশেখর সামন্ত কে ছিলেন?’—স্থির দৃষ্টিতে জয়ন্তর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে মিঃ সোম ধীরে ধীরে কথাটা পুনরাবৃত্তি করে বললেন—’শশীশেখর সামন্ত কে ছিলেন আমরা এখন জানি কিনা জিজ্ঞাসা করছেন?’
জয়ন্ত এ কথায় কেমন যেন একটু বিচলিত হয়ে উঠল।
‘হ্যাঁ—মানে, শশীশেখরবাবুর কোনো পরিচয় তারপর পাওয়া গেছে কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।’
‘হ্যাঁ, পরিচয় পাওয়া গেছে!’ মিঃ সোম গম্ভীর স্বরে বললেন—সেই জন্যেই তখন বলেছিলাম—আশ্চর্য! আজই আপনার থানায় এ সব কথা জানাতে আসা! শশীশেখরবাবুর পরিচয় ও তাঁর মৃত্যুর রহস্যের সূত্র যার কাছে পাওয়া গেছে, ঘটনাচক্রে সেই লোকই আজ এখানে উপস্থিত।’
‘কিন্তু এতক্ষণ আপনি যে ইতিহাস বললেন’, শ্রীমন্ত এবার একটু বিমূঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করলে—’তার সঙ্গে জয়ন্তবাবুর ভয় পাওয়ার ব্যাপারের কোথায় কি মিল তা তো বুঝতে পারলাম না!’
‘পারবেন, এখুনি পারবেন!’ বলে, মিঃ সোম তাঁর সহকারীকে ডেকে বললেন—’সুনীলবাবু, আমাদের নতুন মক্কেলটিকে একবার এখানে নিয়ে আসুন তো!’
‘যে আজ্ঞে’, বলে সুনীলবাবু চলে যাবার পর দেখা গেল তাঁর টেবিলের পেছনে ভিখিরি সাহেব এখনো তেমনি পরম ধৈর্যের প্রতিমূর্তির মতো নিভোনো আধপোড়া একটি সিগরেট হাতে চোখ দু’টি অর্ধনিমীলিত করে বসে আছে। এতক্ষণের এসব কোনো কথা তার কানে গেছে বলে মনে হয় না।
মিঃ সোম সেদিকে একবার ভ্রূকুটিভরে চেয়ে আবার জয়ন্ত ও শ্রীমন্তর দিকে ফিরে বললেন—’শশীশেখরের কি পরিচয় পেয়েছি আগে বলে নিই শুনুন। শশীশেখর ছিলেন একেবারে সেরা চোরাই মালের কারবারি। হীরে—জহরত মণিমুক্তোর নীচে তিনি নামতেন না। তাঁর দলের লোকেরা যেখান থেকে যা কিছু লুট করে আনত, সব তাঁর কাছে এই নির্জন বাড়িতে গচ্ছিত থাকত। পরে গোপনে সে সব বিক্রির ব্যবস্থা করে তিনি যার যা প্রাপ্য ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিতেন।’
ইতিমধ্যে ছোট দারোগা শুকনো রোগা চেহারার এক প্রৌঢ়কে সেখানে এনে হাজির করেছে। মিঃ সোম তাকে দেখিয়ে বললেন—’এই ইনিই হলেন শশীশেখরবাবুর মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী। বাজার সরকার বলুন, মুহুরি বলুন, ইনি ছিলেন শশীশেখরের একমাত্র কর্মচারী ও সঙ্গী।’ লোকটিকে উদ্দেশ্য করে মিঃ সোম এবার বললেন—’বলুন বেহারীবাবু, শশীশেখরের মৃত্যু সম্বন্ধে যা আপনি জানেন বলুন।’
বেহারীবাবু এতক্ষণ নির্জীবভাবে যেন আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। মিঃ সোমের কথায় নির্বোধের মতো দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন—’আজ্ঞে আমার যা বলবার তা তো আগেই বলেছি।’
‘আগে যা বলেছেন, তাই আবার বলুন।’
মিঃ সোমের ধমক খেয়ে বেহারীবাবুর যেন একটু সাড় ফিরে এল। তাড়াতাড়ি বললেন—’আজ্ঞে বলছি।’ তারপর দু’বার ঢোক গিলে শুরু করলেন—’বড় অদ্ভুত লোক ছিলেন আমার এই মনিব। দিনের বেলা তাঁর কাজ—কর্ম করতাম, কিন্তু রাত হলে আর ওখানে থাকতে দিতেন না।’
বেহারীবাবু এইটুকু বলেই থামাতে, মিঃ সোম যেন তাঁকে সাহায্য করবার জন্যেই বললেন—’তাইতে আপনার মনে খুব কৌতূহল হয়।—কেমন? একদিন তাই রাত্রে ও—বাড়িতে ফিরে আসেন। ফিরে এসে কি দেখেন বলুন!’
বেহারীবাবু ধীরে ধীরে এবার বলতে থাকেন—’আজ্ঞে ফিরে এসে প্রথমে কোথাও কাউকে দেখতে পাই না। তারপর মনে হয় একটা ঘরের ভেতর থেকে যেন কাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। দরজায় চাবি লাগাবার ফুটোয় তারপর চোখ লাগিয়ে দেখি আমার মনিবের সঙ্গে আর দু’জন অচেনা লোক ঘরের ভেতর বসে আছে। ঘরের ভেতরটায় তেমন আলো ছিল না। তার ওপর দরজার দিকে পেছন ফিরে বসার দরুন অচেনা দু’জনের মুখ অবশ্য দেখতে পাইনি কিন্তু আমার মনিবের সঙ্গে তাদের যে ঝগড়া হচ্ছিল তা সবই শুনতে পাচ্ছিলাম। ঝগড়া হচ্ছিল ভাগ—বাঁটোয়ারা নিয়ে। আমার মনিব রেগে বলছিলেন—’আর এক কানাকড়িও তোমরা কেউ পাবে না জেনে রেখো। তোমাদের যা ন্যায্য বখরা দেবার আমি দিয়েছি।’ তাঁর কথায় একজন বলে উঠল—’ন্যায্য বখরা দিয়েছেন! দশ বছর ধরে আমরা যা জোগাড় করে এনেছি, কোথায় তার হিসেব? রতনচাঁদের দোকানের সমস্ত হিরে—জহরত, শুশুনিয়া রাজবাড়ির সমস্ত মণিমুক্তো জড়োয়া—এ রকম কত নাম করব—সে সব মাল গেল কোথায়— সব কিছুর ন্যায্য ভাগ আমাদের চাই।’ অন্য অচেনা লোকটিও এ কথায় যোগ দিয়ে বললে—’ন্যায্য নয় বল সমান ভাগ। এখানে বসে আপনি তো শুধু ফন্দিই এঁটেছেন, আর ফাঁসির দড়ি মাথার ওপর ঝুলিয়ে আসল কাজ করেছি আমরা—’। এ কথায় শশীবাবু চটে উঠে বললেন—’হাত চিরকালই কাজ করে কিন্তু তাকে চালায় মাথা। হাতের জায়গা তাই মাথার নীচে।’ ঝগড়াটা এর পর আরো তুমুল হয়ে উঠল। অচেনাদের একজন শশীবাবুর কাছে কোথায় সব জিনিস লুকোনো আছে জানতে চেয়ে বললে—’আপনি হঠাৎ মারা যেতে পারেন। তখন কি হবে? এসব জিনিস কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন তা অন্তত আমাদের জানিয়ে দিতে হবে।’ শশীবাবু তাতে মুখ বেঁকিয়ে বললেন—’জানিয়ে দিলে আমার মারা যাওয়াটা সত্যি হঠাৎ হয়ে যেতে পারে—না? অত আহাম্মক আমায় ভেবো না। কিছুই আমি জানাব না আর যেখানে আমি এসব লুকিয়ে রেখেছি আমি না বলে গেলে সারা জীবন খুঁজেও তা তোমরা পাবে না। দরকার বুঝলে সে জায়গা বারুদে উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করবার ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি জেনো।’ আমার মনিবের এই কথার পর আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে আমার সাহস হয় না। আমি ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে তারপর চলে যাই।’
বেহারীবাবু এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে ক্লান্তভাবে চুপ করলেন। কিন্তু তখনও তাঁর নিষ্কৃতি নেই। মিঃ সোম তাঁকে যেন খেই ধরিয়ে দেবার জন্যে বললেন—’তারপর শশীশেখরবাবুর গোপন সম্পত্তি সম্বন্ধে আপনারও মনে লোভ জাগে—না বেহারীবাবু? কোথায় সেগুলো লুকোনো থাকে জানবার জন্যে আপনি একদিন ওত পেতে থাকেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ!’ বেহারীবাবুকে আবার বলে যেতে হল—’বাড়ির পেছনের মহলের একটা জায়গায় আমি লুকিয়েছিলাম, এমন সময় সিঁড়িতে শশীবাবুর পায়ের শব্দ শুনলাম। যেখানে লুকিয়েছিলাম সেই ভাঙা দেওয়ালের আড়াল থেকে দেখি শশীবাবু একটা নক্সা—কাটা মাঝারি গোছের কাঠের বাক্স হাতে নিয়ে নেমে আসছেন। সে বাক্সে সাধারণ সোনাদানার চেয়ে দামি হিরে—মুক্তো গোছের যে কিছু ছিল তা আমি বুঝেছিলাম। আমার মতলব ছিল ও বাক্সের জিনিস কোথায় তিনি লুকিয়ে রাখতে যান, আড়াল থেকে তাই দেখা। কিন্তু সিঁড়ির নীচে তিনি নেমে আসা মাত্র এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল যা ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সিঁড়ির একধারে বড় বড় খিলেন দেওয়া একটা ঘুলঘুলি বাড়ির ভাঙা মহলের দিকে চলে গেছে। হঠাৎ সেই ঘুলঘুলির অন্ধকার থেকে একটা বিকট দানবের মতো মূর্তি যেন ভোজবাজির মতো বেরিয়ে এল। সে ভূত না প্রেত, দৈত্যি না দানো আমি জানি না, কিন্তু অমন একটা ভয়ঙ্কর চেহারা অতি বড় দুঃস্বপ্নেও কখনও দেখিনি। ভালুকের মতো লোমে ঢাকা যেমন পাহাড়ের মতো বিশাল তার দেহ, তেমনি মুলোর মতো দাঁত—বার—করা প্রকাণ্ড বিশ্রী মুখে সাক্ষাৎ শয়তানের মতো তার দুই জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি। তাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে তো তখন শশীবাবুর গলা দিয়ে আওয়াজই বেরুচ্ছে না। পেছু হেঁটে পালাতে গিয়ে তিনি সেখানেই পড়ে গেলেন। দানোটাকে সেইদিকে এগিয়ে আসতে দেখে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় আমি সেখান থেকে ছুটে পালালাম।
পরের দিনই পুলিশ ও—বাড়িতে শশীবাবুর লাশ পায়। সে কথা জানবার পর আমি এ—মুল্লুক ছেড়েই চলে গেছলাম।’
‘তবু শেষ পর্যন্ত পুলিশ ওঁকে সন্ধান করে বার করেছে।’ বলে, মিঃ সোম শ্রীমন্তর দিকে ফিরলেন। ‘জয়ন্তবাবুর গল্পের সঙ্গে এ—বাড়ির পুরোনো ইতিহাসের কোথাও মিল এখন আশা করি বুঝতে পারছেন!’
শ্রীমন্ত হেসে বললে—’তা পারছি। কিন্তু এতে জয়ন্তবাবুর গল্পই তো সত্য বলে প্রমাণ হচ্ছে।’
‘হয়ত হচ্ছে।’ মিঃ সোম হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন—’কিন্তু এই ভয় পাওয়ার ব্যাপারে আমরা কি করিতে পারি বলুন। বড় জোর বলতে পারি ও রকম হানাবাড়ির ত্রিসীমানায় আর যাবেন না…’
‘Excuse me, sir!’—মিঃ সোমের কথার ওপরেই ভিখিরি সাহেবের গলা হঠাৎ শোনা গেল। টুল থেকে উঠে এসে মিঃ সোমের টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ একটু ক্ষুব্ধ স্বরেই সে জিজ্ঞাসা করলে—’আভি মেরা নালিশ শুনেঙ্গে?’
‘হ্যাঁ, কি তোমার নালিশ?’—মিঃ সোম স্পষ্টই বিরক্ত।
ভিখিরি সাহেব গলাটাকে যতদূর সম্ভব করুণ করে এবার তার অভিযোগ জানালে—’আপকা সিপাহি লোগ হামকো বড়া দিক করতা। I am a poor beggar—ভিখ মাঙকে খাতা। Why they always push me about? যাঁহা ঠারতা সব জাগাসে ভাগা দেতা!’
‘ভাগা দেতা?’—মিঃ সোম আপাদমস্তক তাকে ভালো করে লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন।
ভিখিরি সাহেব সোৎসাহে ঘাড় নাড়লে।
প্রতিকারের আশায় ভিখিরি সাহেবের মুখ বুঝি একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এক দাবড়ানিতে তাকে একেবারে বসিয়ে দিয়ে মিঃ সোম আবার বললেন—‘They will put you in a lock-up now!—এখন থেকে কোনো বেচাল দেখলে, হাজতে পুরে রাখবে, বুঝেছ?’
ভিখিরি সাহেবের চোখ দু’টো মনে হল যেন জ্বলছে। একটুখানি চুপ করে থেকে ঝোলাটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে যেতে যেতে সে খেঁকিয়ে বলে গেল—‘Yes, Yes, I understand. There is no justice for a poor man in this world. গরিবকো বিচার কঁহি নেহি মিলতা।’
এ রকম ঔদ্ধত্যে মিঃ সোম অভ্যস্ত ন’ন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই খানিকটা বোধহয় তিনি চুপ করে রইলেন। তারপর মেজাজটা যেন অতিকষ্টে সামলে শ্রীমন্ত ও জয়ন্তর দিকে ফিরে আগের কথার জের টেনে বললেন—’হ্যাঁ, যা বলছিলাম।—দেখুন, চোর ডাকাত ধরাই আমাদের কাজ! এসব আজগুবি ভূতুড়ে জানোয়ার ঠিক আমাদের এলাকার মধ্যে পড়ে না।’
‘আপনারা যে কিছু করতে পারবেন না তা জানতাম।’—জয়ন্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে মিঃ সোমের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর তাচ্ছিল্যভরে হাত দু’টো একটু নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলে বললে—’আচ্ছা চলি। আসবেন শ্রীমন্তবাবু?’
‘হ্যাঁ, যাব বই কি!’—শ্রীমন্ত একটু হেসে উঠে দাঁড়াল। তারপর মিঃ সোমকে নমস্কার জানিয়ে সেও জয়ন্তর সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
বেহারীবাবু তখনও একভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দিকে ফিরে মিঃ সোম অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে হঠাৎ যে প্রশ্ন করলেন তাতে একটু অবাক হবারই কথা। ‘এখানে যাঁরা বসেছিলেন তাঁদের দু’জনকেই তো দেখলেন বেহারীবাবু’—মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন—’এদের কাউকে আগে ও বাড়িতে দেখেছেন বলে মনে হয়?’
বেহারীবাবু খানিক চুপ করে থেকে বোধ হয় ভাববার চেষ্টা করলেন, তারপর ক্লান্ত ভাবে বললেন—’আজ্ঞে, ঠিক মনে করতে পারছি না।’
‘পারছেন না? তবু ভালো করে চেষ্টা করে দেখুন গিয়ে—যান।’—বলে, মিঃ সোম বেহারীবাবুকে বিদায় করে দিলেন।
ছোট দারোগা সুনীল মিঃ সোমকে একলা পাওয়ার জন্যে বোধহয় অপেক্ষা করছিল। বেহারীবাবু চলে যেতেই মিঃ সোমের কাছে এসে তাঁর কানের কাছে মুখ নামিয়ে সে চাপা গলায় বললে—’একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করেছেন স্যার?’
মিঃ সোম মুখ না ফিরিয়েই গম্ভীর ভাবে বললেন—’হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি বলেই তো ভাবছি।’
কে জানে লক্ষ করবার মতো কি মজার ব্যাপার এর মধ্যে ঘটেছে!
জয়ন্ত ওদিকে শ্রীমন্তর সঙ্গে যেতে যেতে পথের মাঝে হঠাৎ দেখা গেল থেমে পড়েছে। একটু অবাক হলেও শ্রীমন্তকেও অগত্যা থামতে হল।
‘আপনি বাড়ি যান শ্রীমন্তবাবু। একটা কথা আমি জেনে আসি!’ বলে—শ্রীমন্তকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার অবসর না দিয়েই জয়ন্ত হন হন করে থানার দিকেই আবার ফিরে গেল।
‘কি আবার ফিরে এলেন যে!’—মিঃ সোমও জয়ন্তকে ফিরে আসতে দেখে বেশ অবাক।
‘হ্যাঁ, একটা কথা আপনাদের জিজ্ঞাসা করতে এলাম।’ এক মুহূর্তের জন্যে একটু বুঝি দ্বিধা করে জয়ন্ত প্রশ্নটা করেই ফেলল—’শ্রীমন্ত সরকার সম্বন্ধে আপনারা কতদূর কি জানেন?’
প্রশ্নটা সত্যই অপ্রত্যাশিত। মিঃ সোম প্রথম বিস্ময়টা সামলে একটু বিদ্রূপের সঙ্গেই হেসে বললেন—’যা জানি তা আপনাকে বলব ভাবলেন কি করে!’
পরমুহূর্তেই তাঁর গলার স্বর বেশ কঠিন হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করলেন—’আপনি ভয় পেয়ে কাল ওঁর আশ্রয়েই গিয়ে উঠেছিলেন—না?’
‘হ্যাঁ, উঠেছিলাম!’—জয়ন্ত বিশেষ লজ্জিত বলে মনে হল না। ‘তবু ওঁর সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজ নেওয়া দরকার বলে মনে করি।’
‘আমাদের কর্তব্য আমাদের শিখিয়ে দিতে এসেছেন বলে ধন্যবাদ!’—মিঃ সোমের কণ্ঠস্বর বেশ রূঢ়ই বলা যায়—’এখন আপনার খোঁজ একটু নিতে পারি কি? আপনি কে এবং কাল হঠাৎ ওই পোড়ো বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন কেন?’
শেষ কথাগুলো মিঃ সোম যে রকম ধীরে ধীরে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বললেন, তাতে মুহূর্তের জন্যে জয়ন্তকে একটু বিচলিত মনে হল কি!
কিন্তু উত্তর সে তারপর বেশ সহজ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই দিলে—’আমি একজন সাধারণ লোক, আর এমনি রাত্রে ওই রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওখানে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলাম!’
‘কিন্তু প্রথমে থানায় এ ব্যাপারটা জানাতে আসতে চাননি কেন?’—মিঃ সোম তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে জয়ন্তর দিকে তাকালেন।
জয়ন্ত তাতে অস্বস্তি বোধ করল কিনা বলা যায় না কিন্তু উত্তরটা যেন তার তৈরিই ছিল মনে হল।—’এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো সাহায্য পাবার আশা যে নেই তা জানতাম বলে।’
‘ওঃ!’—মিঃ সোমকেই এবার যেন হার স্বীকার করতে হল।
জয়ন্ত আবার বললে—’একটা সাহায্য অবশ্য এখনও করতে পারেন!’
‘বলুন।’
‘এ—বাড়ির শেষ মালিক তো ছেড়ে চলে গেছেন। বাড়িটা এখন কার জিম্মায় আছে বলতে পারেন?’
খানিক নীরবে কি যেন ভেবে নিয়ে মিঃ সোম বললেন—’একটু অপেক্ষা করুন, আমাদের ফাইল দেখে বলছি।’
তিন
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিটে প্রকাণ্ড এক অফিস বাড়ি। পাঁচতলা বাড়িটার নীচের প্রধান দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন কোম্পানির নামের ফলকগুলো পড়ে শেষ করতেই বোধহয় একবেলা কেটে যায়। একটা নয় অসংখ্য কোম্পানি মৌচাকের মতো এই বিরাট বাড়িটার অসংখ্য খোপ জুড়ে বসে আছে।
‘বাগ অ্যান্ড নাগ কোম্পানি—হাউজ এজেন্টস’। তারই মধ্যে একটি। তেতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাঁ ধারে তাদের অফিস ঘর। বাড়ি—ঘর জমি—জায়গা কেনা—বেচা ও ভাড়া—ইজারা দেওয়ার বন্দোবস্ত করাই তাদের ব্যবসা। কোম্পানির কাজ কারবার ভালোই কিন্তু বাগ ও নাগ দুই অংশীদার দু’টির অদ্ভুত চরিত্র। শ্যামলাল বাগ যেমন মোটাসোটা গোলগাল পিপে গোছের, নবদ্বীপচন্দ্র নাগ তেমনি রোগা শুকনো ঢেঙা তালগাছ। এক ব্যবসার ব্যাপারে ছাড়া দু’জনের মধ্যে কোনো বিষয়ে বনিবনাও নেই। খিটিমিটি লেগেই আছে।
সকাল সাড়ে দশটায় সেদিন বাগ—নাগের অফিসে লেডি টাইপিস্ট মিস গুপ্তা একলা বসে অফিসের কাজ করছেন, এমন সময় শ্যামলাল বাগকে প্রথম ঘরে এসে ঢুকতে দেখা যায়।
ঘরের দু’ধারে বাগ ও নাগের দু’টি আলাদা টেবিল পাতা। নাগের টেবিলের দিকে একবার চেয়ে বাগ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করে—’নাগ এখনো আসেনি মিস গুপ্তা?’
‘আজ্ঞে না।’
‘হুঁ’—চাপা গর্জনের মতো একটা আওয়াজ করে বাগ টেবিলের ওপরকার ঘড়িটা তুলে নিয়ে কাঁটাটা মিনিট দশেক এগিয়ে দেয় তারপর লাঠিটা টেবিলের ধারে রাখতে গিয়েই বাইরে পায়ের আওয়াজ পেয়ে দরজার এক পাশে গিয়ে লুকিয়ে দাঁড়ায়।
এবার ঘরে এসে ঢোকে বাগ অ্যান্ড নাগ কোম্পানির অন্যতম অংশীদার শ্রীনবদ্বীপচন্দ্র নাগ।
ঘরে ঢুকে তারও প্রথম দৃষ্টি অংশীদারের টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপর ঘড়িটা দেখেই সে চমকে ওঠে। এগারোটা বাজতে আর দেরি নেই। ঘড়িটা তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে কাঁটা পেছনে ঘুরিয়ে দিতে দিতে নাগ জিজ্ঞাসা করে—’বাগ এখনও আসেনি?’
মিস গুপ্তা সম্ভবত দুই মনিবকেই ভালো করে চেনেন। টাইপ—রাইটার থেকে মুখ না তুলেই বলেন—’আজ্ঞে হ্যাঁ, এসেছেন তো!’
‘এসেছেন!’—নাগের মুখটা একটু বুঝি কেমন দেখায়। তাড়াতাড়ি ঘড়িটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে যাবে, এমন সময় পেছনে বাগের বাজখাঁই আওয়াজ পাওয়া যায়।
‘বলি ওটা কি হচ্ছে, নাগ?’
নাগ চমকে ফিরে তাকাতেই বাগ এগিয়ে এসে আবার বলে—’দেরি করে এসে আবার ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে রাখা হচ্ছে।’
কোনো জবাব খুঁজে না পেয়েই বোধহয় নাগ প্রথমটা ভেঁচে ওঠে—’কাঁটা ঘুরিয়ে রাখা হচ্ছে! কাঁটা ঘুরিয়ে রেখেছে কে? আমি ঠিক সাড়ে দশটায় এসেছি।’
‘সাড়ে দশটায় এসেছ!’ কোন দিন সাড়ে দশটায় তুমি আসো শুনি! You are always late।’
‘Never।’—বাগের সঙ্গে সমান তালে জবাব দিয়ে নাগ ঘড়িটা তার টেবিলে রাখতে যায়।
‘ঘড়িটা ওখানে রাখছ যে বড়?’—শ্যামলাল বাগ একেবারে ছোঁ মেরে ঘড়িটা কেড়ে নিজের টেবিলে রেখে বলে—’ঘড়ি থাকবে এইখানে।’
নাগ প্রথমটা যেন নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বাগের গতিবিধি লক্ষ করে। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে বাগের টেবিল থেকে ঘড়িটা তোলবার জন্যে এগিয়ে যায়।
বাগ কিন্তু তার আগেই ঘড়ি সরিয়ে নিয়েছে। নাগ হাত বাড়াতেই গম্ভীর ভাবে সে বলে—’ভালো হবে না বলছি, নাগ, ভালো হবে না। ঘড়ি এই টেবিলে থাকবে।’
‘এ টেবিলে থাকবে কেন?’—নাগের একেবারে রণং দেহি ভাব।
বাগ তাকে ভেংচে বলে—’কেন?’ তারপর অকাট্য যুক্তির সঙ্গে অধিকার—অনধিকারের প্রশ্নের সহজ মীমাংসা করে দেয়—’কোম্পানির নামটা কি খেয়াল আছে! বাগ অ্যান্ড নাগ! আগে বাগ তারপরে নাগ। আমি হলুম সেই বাগ।—সিনিয়র পার্টনার।’
যুক্তির সামনে একটু কাবু হয়ে নাগ এবার অনুপ্রাস ও বিদ্রূপের সাহায্য নেয়—’সিনিয়র পার্টনার না স্লিপিং পার্টনার। এই নাগ না থাকলে কোম্পানি চলত?’
‘তোমার মতো ভাঙা চাকা না থাকলে আরো গড় গড় করে চলত।’—বাগের জবাব যেন মুখস্থ।
‘আমি গাড়ির ভাঙা চাকা!’—এবার নাগ একেবারে হতভম্ব।
সজোরে মাথা নেড়ে বাগ বলে—’হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা!’—নাগের ফিরে আসার ভঙ্গি দেখে মনে হয় নিরুপায় হয়ে সে যেন হার স্বীকার করে নিয়েছে।
বিপক্ষকে পরাস্ত করে বাগ তখন বিজয়দর্পে তার টেবিলে বসতে যাচ্ছে। কিন্তু বসা আর তার হয় না। হঠাৎ নাগ ঝড়ের বেগে ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর আচমকা তার জবাবের ব্রহ্মাস্ত্রটি ছাড়ে—’তুমি, তুমি তাহলে গাড়ির খোঁড়া বলদ!’
এই অপ্রত্যাশিত আঘাতে বাগ একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। খানিক নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে সে শুধু সংক্ষেপে বলে—’ব্যস।’
‘কি?’ বিমূঢ়ভাবে নাগকেই প্রশ্ন করতে হয়।
‘ব্যস। মানে Partnership dissolved’—শ্যামলাল ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়—’আজ থেকে বাগ আর নাগ আলাদা কোম্পানি!’
ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে নাগের একটু সময় লাগে, কিন্তু বোঝবার পর সেও বেপরোয়া ভাবে জানিয়ে দেয়—’ভালো কথা! খুব ভালো কথা! আমি কি পরোয়া করি নাকি! আজ থেকে তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই!’
দুই অংশীদার যেভাবে দু’দিকের টেবিলে গিয়ে বসে তাতে মনে হয় জীবনে কেউ কারুর মুখদর্শনও করবে না।
মিনিট পাঁচেক বাদেই কিন্তু সব উল্টে যায়।
দরজার কাছে একজনের গলা শোনা যায়—’ভেতরে আসতে পারি?’
‘আসুন! আসুন!’ বলে বাগ ও নাগ দু’দিক থেকে যেরকম ব্যগ্রভাবে উঠে গিয়ে আগন্তুককে সাদর সম্ভাষণ জানায় তাতে কে বলবে খানিক আগেই তাদের চরম ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
সম্বর্ধনার আতিশয্যে আগন্তুক বুঝি প্রথমটা একটু হকচকিয়ে যায়।
আগন্তুক অবশ্য জয়ন্ত চৌধুরী। থানার অফিসার মিঃ সোমের কাছে ঠিকানা জোগাড় করে সে এইমাত্র বাগ অ্যান্ড নাগ কোম্পানির অফিস খুঁজে বার করে ওপরে উঠে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে তার তেতলায় উঠে আসবার সময় উপস্থিত থাকলে একটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার কিন্তু চোখে পড়ত। বাগ অ্যান্ড নাগ কোম্পানির অফিসের দরজার বাইরে একটি লোক কিছুক্ষণ আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিল। জয়ন্ত চৌধুরীকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখেই সে যেভাবে তাড়াতাড়ি সরে যায় তা সত্যিই একটু সন্দেহজনক।
জয়ন্ত অবশ্য সে ব্যাপারের কিছুই সম্ভবত লক্ষ করেনি। আপাতত দুই অংশীদারের আপ্যায়নের ঘটায় একটু সংশয়ের সঙ্গেই সে জিজ্ঞাসা করে—’মাপ করবেন, এটা বাগ অ্যান্ড নাগ কোম্পানির অফিস তো?—House Agents?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’—বাগ অ্যান্ড নাগ দু’জনেই সমস্বরে আশ্বাস দিয়ে, অনুরোধ জানায়—’কই আপনি বসলেন না তো! বসুন!’
‘বসব তো!’—দ্বিধাভরে জয়ন্ত একবার এদিক আর একবার ওদিকে তাকিয়ে বলে—’কিন্তু কোন দিকে বসব বলুন তো?’
‘এদিকে বাগ ওদিকে নাগ। বসুন না যেদিকে খুশি! কি বল নাগ?’—বাগের গলায় যেন মধু ঝরে পড়ে।
‘তা আর বলতে!’
দু’জনে যেন হরিহরাত্মা এমনি গদগদ ভাবে নাগ আবার ব্যাখ্যা করে দেয়—’ও বাগও যা নাগও তাই।’
‘হ্যাঁ, একজন ঘাড় ভাঙে আর একজন ছোবলায়, এই যা তফাত।’—জয়ন্ত পরিহাস না করে পারে না। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে—’আপনাদের স্বধর্ম ত্যাগ করতে বলছি না, শুধু একটা খবর অনুগ্রহ করে আমায় দিলে বাধিত হব।’
জয়ন্তর কথা মুখ দিয়ে বেরুতে না বেরুতেই এমন কাণ্ড ঘটবে কে জানত! হঠাৎ দুই অংশীদারে যেন কবির লড়াই লেগে যায়।
বাগ জিজ্ঞাসা করে—’বলুন, কি খবর চান?’
জবাবটা আর জয়ন্তকে কষ্ট করে দিতে হয় না। তার আগেই নাগ বলে ওঠে—’শহর না মফস্বল?’
‘পাকা না কাঁচা?’
‘কেনা না বিক্রি?’
‘ভাড়াটে সমেত না খালি?’
প্রশ্নের তুবড়িবাজিতে জয়ন্ত একেবারে দিশাহারা।
‘দোহাই! দোহাই আপনাদের। আমার কথাটা আগে দয়া করে শুনুন!’ বলে দু’জনকে থামিয়ে সে নিজের বক্তব্যটা জানাবার চেষ্টা করে—’যশোর রোডের ওপর কলকাতা থেকে মাইল বারো দূরে একটা বাড়ি আছে জানেন?—বাড়িটা পুরোনো কিন্তু খুব বড়।’
‘ওঃ, গোয়ালভাঙার বাড়িটার কথা বলছেন?’—বাগের মুখে অবজ্ঞা মিশ্রিত করুণা ফুটে ওঠে।
তারপরই আবার দু’জনের নামতা পড়া শুরু হয়ে যায়।
‘তেমহলা লোহার ফটক!’
‘আমবাগান, পুকুর, বাঁধাঘাট!’
‘মোট দু’বিঘে সাত ছটাক!’
জয়ন্ত হাত তুলে তাড়াতাড়ি দু’জনকে থামিয়ে বলে—’ঠিকই বুঝেছেন। এখন, সে বাড়িটা কার এবং বিক্রি কিংবা ভাড়া আছে কি না বলতে পারেন?’
‘আরে ছ্যা ছ্যা!’—বাগ জয়ন্তকে একেবারে আহাম্মক বানিয়ে দেয়—’আপনি সেই বাড়ি চান?’
নাগ সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস দেয়—’ঢের ভালো বাড়ি আপনাকে দিচ্ছি।’
‘কোলকাতার ওপর দোতলা—’
‘দক্ষিণ খোলা!’
‘থাক থাক হয়েছে!’—নামতার ভয়ে জয়ন্ত বাধা দিয়ে বলে—’আমি ওই বাড়িটাই চাই।’
‘ওই বাড়িটাই চান?’—বাগের গলার স্বর করুণ হয়ে ওঠে—’শুনছ নাগ, উনি ওই বাড়িটাই চান!’
ব্যথার ব্যথীর মতো নাগ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—’কিন্তু ও—বাড়ি তো আর হয় না।’
‘কেন?’—জয়ন্ত বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করে।
‘এই কালই একজনেরা নিয়ে নিয়েছেন কিনা!’—বাগ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানায়।
‘কালই নিয়েছেন!’—খবরটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। জয়ন্ত খানিক গুম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে হাত তুলে একটা শুকনো নমস্কার জানিয়ে দ্রুতপদে বেরিয়ে যায়।
চার
এতদিনে পোড়ো বাড়িতে সত্যিই নতুন বাসিন্দার সমাগম যে হয়েছে, বাড়ির ভেতরের ও বাইরের উঠোনে গাদাকরা মালপত্রের বহর দেখেই তা বোঝা গেল।
আধাবয়সি একজন ভদ্রলোক নীচে থেকে মালপত্র কুলিদের দিয়ে ওপরে পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। হঠাৎ কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠস্বরে তাঁকে ফিরে তাকাতে হল।
‘হ্যাঁগা মামাবাবু! এ কী রকম বাড়ি নিয়েছ গো!’
কণ্ঠস্বরটি যার, বেশভূষা ও চেহারা দেখার পর পরিচারিকা বলে তাকে চিনিয়ে দেবার দরকার হয় না, এবং সেই সঙ্গে তার কথার ধরনে এটুকুও বোঝা যায় যে, মনিবই হোক আর যেই হোক, কাউকে সমীহ করার কোনো বালাই তার নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতেই ঝি তার বক্তব্যটুকু শেষ করলে—’যাই বলো বাপু, আমার ভালো লাগছে না। এ—বাড়িতে কোনোকালে যেন জনমনিষ্যি ছিল না। যেখানে যাই গা ছম ছম করে।’
মাল যারা তুলছিল তাদের মধ্যে একজন কুলি এবার উৎসাহ পেয়ে জানালে—’হাঁ বাবু। এ বড়ো খারাপ মোকান আছে। কোতো দিন হোয়ে গেল কোই এখানে আসে না। হামাদের তো লাখ রূপেয়া দিলে ভি সনঝার পর এ—বাড়িতে থাকবে না।’
‘ওই শোন!’—ঝি এই সমর্থনটুকুর জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল।
মামাবাবু বলে যাঁকে ডাকা হয়েছিল, তিনি এবার ধমক দিয়ে উঠলেন—’হ্যাঁ শুনেছি। পুরোনো বাড়ি, অনেক কাল কেউ ছিল না। তাতেই বাড়িটা একেবারে ভূতুড়ে হয়ে গেছে—না?’ এতখানি বলে নিজেকেই যেন তিনি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন—’আজকালকার বাজারে এর চেয়ে ভালো বাড়ি পেতাম কোথায়? বিদেশ থেকে এসে মেয়ে দুটোকে নিয়ে তো আর রাস্তায় দাঁড়াতে পারি না?’
মেয়ে দুটোর কথায় মামাবাবুর বোধহয় খেয়াল হল যে ধারে কাছে কেউ তারা নেই। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—’ললিতা—নমিতা, এরা দু’জনে গেল কোথায়?’
ধমক খেয়ে ঝির মেজাজ খারাপ হয়েছিল। বেশ একটু ঝঙ্কার দিয়েই বললে—’কি জানি বাপু! ওপরেই তো ঘোরাঘুরি করছে দেখে এলাম।’
কুলিরা এতক্ষণ হাত গুটিয়ে এদের কথাবার্তাই শুনছিল। মামাবাবু তাদের বকুনি দিয়ে উঠলেন—’তোমরা আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সন্ধের পর তো আবার থাকবে না। মালগুলো অন্তত তুলে দাও তার আগে।’
কুলিরা ব্যস্ত হয়ে কাজে লাগল।
‘তুমি এইখানেই থাকো ভূতোর মা। দেখি আবার মেয়ে দুটো কোথায় গেল।’ বলে মামাবাবু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেলেন।
ললিতা ও নমিতা দু’জনের কেউই তখন ওপরে নেই। বাড়ির সামনের মহলটিই মজবুত আছে খানিকটা। সেদিকে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে তারা তখন পেছনের মহলের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছে।
নীচে নামবার আগ্রহটা ললিতার। দিদির পাল্লায় পড়ে নেহাত বাধ্য হয়েই নমিতাকে সঙ্গে থাকতে হয়েছে।
দুটি বোন বয়সে প্রায় পিঠোপিঠি। কিন্তু চেহারায়—চরিত্রে অনেক তফাৎ। ললিতা এই বয়সেই স্থির ধীর গম্ভীর। তার বুদ্ধি তীক্ষ্ন, সাহসও কম নয়। আর নমিতা এখনো নেহাত ছেলেমানুষ। যেমন চঞ্চল তেমনি ভীরু অসহায়। বাপ—মা—মরা মেয়ে দুটিকে মামাবাবু ছেলেবেলা থেকে পরম স্নেহে মানুষ করেছেন, কিন্তু তিনি পুরুষ মানুষ। সংসারের বাইরের দিকটাই সামলেছেন। বয়সে সামান্য বড় হওয়ার দরুন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেই ললিতাকে অনেক কিছুর দায়িত্ব নিতে হয়েছে। নমিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা তাই একাধারে বন্ধুর ও অভিভাবকের।
দিদির পিছু পিছু সভয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে সিঁড়ির অর্ধেকটা পর্যন্ত নেমেই নমিতার আর সাহসে কুলোয় না। ললিতার আঁচল ধরে টান দিয়ে সে কম্পিত কণ্ঠে বলে—’না দিদি আর গিয়ে কাজ নেই। আমার ভয় করছে।’
ভয় করা অন্যায় নয়। বাড়ির এই পেছনের মহলটা ভগ্নস্তূপ বললেই হয়। ঘরদোর যেখানে যা ছিল তার অধিকাংশই ভেঙে ধ্বসে পড়েছে। কোথাও ভাঙা ইটকাঠের ঢিবি, কোথাও গুহার মতো খিলান দেওয়া অন্ধকার ঘুলঘুলি। এই ধ্বংসাবশেষ ভেদ করে জায়গায় জায়গায় বিরাট সব গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দালান কোঠা এখনো যেখানে যেটুকু দাঁড়িয়ে আছে তাও বুনো লতা—পাতার জঙ্গলে প্রায় ঢাকা। দিনের বেলাতেই এদিকটা কেমন অন্ধকার রহস্যময় মনে হয়। ললিতার কাছে কিন্তু সেইটেই বড় আকর্ষণ।
নমিতাকে সাহস দিয়ে সে তাই বলে—’আহা আয় না। দিনের বেলা, চারিদিকে লোকজন ঘুরছে। এখন আবার ভয় কি?’
সমস্ত জায়গাটার আবহাওয়াই কিন্তু এমন যে, নমিতাকে ভরসা দিলেও একেবারে স্বচ্ছন্দে ললিতা নেমে যেতে পারে না। কতকটা ভাঙাচোরা সিঁড়ির ধাপের দরুন আর কতকটা অজানা কিসের একটা প্রভাবে তাকে বেশ সাবধানে সন্তর্পণেই নামতে হয়। নমিতার অবশ্য দিদির সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না।
নীচে নেমে এসে ললিতা ভালো করে চারিদিকটা একবার দেখে নেয়। এককালে এ মহলটা যে বিরাট ছিল এখনকার ধসে পড়া চেহারা থেকেও তার পরিচয় মেলে। ভাঙা মহল ছাড়িয়ে দক্ষিণে প্রকাণ্ড একটা দেওয়াল ঘেরা বাগান। ভাঙাচোরা হলেও এখনো সে দেওয়াল বেশির ভাগ খাড়া আছে। বাগানের মাঝামাঝি কপিকলের থাম সমেত একটি বিরাট ইঁদারা আগেকার দিনের এ বাড়ির সুব্যবস্থার সাক্ষ্য দিচ্ছে। দক্ষিণ—পূবে কোণে চাইলে পাকা ছাউনি দেওয়া একটা চত্বর ও তা থেকেও বহুদূরে বিরাট নাট—মন্দিরের আর একটা ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে।
যেখানটায় তারা নেমেছিল সেখানে চারিধারে শুধু ভাঙা ইট—কাঠের স্তূপ আর এদিকে—ওদিকে পাহাড়ের গুহার মতো আগেকার সব ধসে পড়া প্রকোষ্ঠের দরজা—জানলাহীন গহ্বর।
দু’চার পা সেখানে অগ্রসর হবার পরই নমিতা হঠাৎ শিউরে উঠে সভয়ে ‘দিদি’ বলে চিৎকার করে ললিতাকে জড়িয়ে ধরে।
চিৎকার না করলেও ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে ললিতাও তখন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
সিঁড়ির ঠিক বিপরীত দিকে একটি ভাঙা খিলানের পেছনের গহ্বরে কি যেন একটা নড়ছে মনে হয়।
ভয়ে দু’জনেই একেবারে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে থাকলেও এখান থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাবার উপায় নেই। রুদ্ধ নিশ্বাসে একদৃষ্টে সেই গহ্বরের দিকে তাই তারা তাকিয়ে থাকে।
গহ্বর থেকে ধীরে ধীরে এবার যে বেরিয়ে আসে ঠিক ভয়াবহ না হলেও তার চেহারা পোশাক দেখে অকস্মাৎ তার এই আবির্ভাবে অবাক হবারই কথা।
লোকটি আর কেউ নয়, থানায় পুলিশের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে নালিশ জানাতে গিয়েছিল, সেই ভিখারি সাহেব। এখনও তার সেই বিচিত্র তালিমারা পোশাক ও কাঁধে সেই সনাতন ঝুলিটি।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সে প্রথম খানিক মিটমিট করে ললিতা—নমিতার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দিদির হাত ধরে টেনে নমিতা ভীত কণ্ঠে বলে—’চলে এসো দিদি!’ ললিতা তা সত্ত্বেও নড়ে না।
দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ভিখিরি সাহেবের মুখে এবার অদ্ভুত একটি হাসি দেখা দেয়।
দুই বোনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে গলাটিকে সাধ্যমত মোলায়েম করার চেষ্টা করে সে বলে—‘Don’t be afraid little ladies ! Dont’ be afraid of me !’
লোকটা কাছে এসে দাঁড়াবার পর ললিতা তীক্ষ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করে—কৌন হ্যায় তুম?’
‘ম্যায় কৌন হ্যায়!’—ভিখিরি সাহেব এমন মজার প্রশ্ন কখনও যেন শোনেনি এমনি ভাবে হেসে ওঠে। তারপর তার পরিচয় না—জানাটা ললিতা, নমিতারই অপরাধ, এই ভাবে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে—‘Don’t you know?’
ললিতা ভ্রুকুটির সঙ্গে মাথা নাড়ে।
একটা অতি গোপনীয় খবর যেন দিতে যাচ্ছে, এই ভাবে সাবধানে চারিদিকে এবার তাকিয়ে নিয়ে মুখটা ললিতার কাছে নামিয়ে এনে ভিখিরি সাহেব চাপা গলায় বলে— ‘I am an ex-Major General of the army !’
এত বড় সংবাদটা দিয়ে একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে ভিখিরি সাহেব প্রসন্ন মুখে আবার জিজ্ঞাসা করে—‘You are sisters—aren’t you?’
লোকটা পাগল না বদমায়েশ? নমিতা দিদিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
ভিখিরি সাহেব এবার তাকেই উদ্দেশ করে বলে—‘Don’t be afraid of me, little lady. I am a poor beggar now.’
‘ও ভিখিরি!’—ললিতা বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করে—’তা এখানে এসে ঢুকেছ কেন?’
‘Just for a night’s shelter ! খালি রাতমে শোনে—কে লিয়ে!’—ভিখিরি সাহেবের কণ্ঠ একেবারে করুণ হয়ে ওঠে। ‘You must have pity on a poor beggar,—no home, no friends, nobody to take care of me! দুনিয়ামে মেরা কোই নেহি হ্যায়।’
দুই বোনের মুখে বুঝি আপনা থেকেই একটু সহানুভূতির আভাস দেখা যায়। চট করে সেটুকু লক্ষ করে নিয়ে ভিখিরি সাহেব সুর পাল্টে বলে—‘Shall I tell your fortunes, little ladies?’
ভয় খানিকটা কেটে গিয়ে নমিতার এতক্ষণে একটু যেন উৎসাহ দেখা যায়—’কি বলছে দিদি! হাত দেখতে পারে?’
‘তাই তো বলছে।’—ললিতার গলার স্বরে সন্দেহই প্রকাশ পায়।
ভিখিরি সাহেব কিন্তু নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে—’হাঁ, হাঁ খুব ভালো হাত দেখতে পারে। Come here, come here!’
খানিকটা মোহাচ্ছন্নের মতই ললিতা ও নমিতা ভিখিরি সাহেবের ডাকে কিছু দূরের একটা ভাঙা চাতালের ওপর গিয়ে বসে।
ভিখিরি সাহেব প্রথম নমিতার হাতটাই দেখতে চায়। কিন্তু সম্পূর্ণ ভয় তার এখনো কাটেনি।
‘না না আমার হাত দেখতে হবে না। দিদির আগে দেখো।’ বলে সে তাড়াতাড়ি সরে বসে।
‘এখনো ডর আছে! Still afraid of me!’ বলে হেসে ভিখিরি সাহেব ললিতার হাতটাই এবার বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করে।
ভিখিরি সাহেবের ভাবভঙ্গি একেবারে পাকা জ্যোতিষীর মতো। খানিক হাতের রেখাগুলো লক্ষ করে সে বলে ওঠে—‘Ah! I see. You are a brave little lady! খুব সাহস আছে!’
পরমুহূর্তেই তার চোখ মুখের চেহারা বদলে যায়। গম্ভীর ভাবে বলে—‘But what’s this? হাঁ, একটা বিপদ আছে দেখছি!—a tall dark young man. Beware of him!’
ভিখিরি সাহেবের বলার ভঙ্গিতে, ললিতার না হোক নমিতার চোখ দুটো ভয়ে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ‘কার কথা বলছে দিদি?’—সভয়ে সে জিজ্ঞাসা করে।
‘কার কথা বলছে তা কি করে জানব!’—ললিতা একটু বিরক্ত ভাবেই জবাব দেয়।
ভিখিরি সাহেব তৎক্ষণাৎ আশ্বাস দিয়ে বলে—’জানবে, জানবে, জলদি জানতে পারবে। A handsome young man. লেকিন আদমি আচ্ছা নেহি। ওর কাছে হুঁশিয়ার থাকবে।’
‘লোকটা কে তাই জানলাম না, হুঁশিয়ার থাকবে!’ ললিতা এবার ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে—’তুমি তো ভারী হাত দেখতে জান দেখছি! সত্যি কিছু জান তো বলো!’
ভিখিরি সাহেব এ ভর্ৎসনা গ্রাহ্যই করে না। অবিচলিত ভাবে বলে—’বলছে বলছে, সব বলবে।’ তারপর চারিদিকে একবার যেন সভয়ে চোখ বুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে—’এ বাড়িতে আসা তোমাদের ঠিক হয়নি। It’s a dangerous house। বহুৎ খারাপ বাড়ি আছে।’
ললিতা—নমিতা এক মনে ভিখিরি সাহেবের কথা শুনছিল। হঠাৎ ভিখিরি সাহেবের চোখের দৃষ্টি দেখে তারা বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করে। সে দৃষ্টি যেন দূরে কোথায় পার্থিব জগৎ ছাড়িয়ে চলে গেছে। সেই ভাবেই খানিক সামনে চেয়ে থেকে ভিখিরি সাহেব যেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বলে—‘I see a murder—no—no—two murders possibly.’
‘কি বলছে দিদি! এখানে খুন হবে?’—নমিতার মুখ একেবারে ভয়ে চুন।
নিজেও বেশ একটু ভয় পেলেও ললিতা তাকে সাহস দেবার জন্যে রাগ দেখিয়ে বলে—’ওসব যাতা কথা শুনিস কেন?’ তারপর হাতটা সবেগে টেনে নিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে—’থাক তোমার আর হাত দেখতে হবে না! আমার হাতে শুধু এই সব কথাই লেখা আছে বুঝি!’
‘নেহি, নেহি, লিখা নেই, But I can see the future from your hands—এ বাড়িতে কি হবে সব আমি দেখতে পাচ্ছি…’
ভিখিরি সাহেবের কথা আর শেষ হয় না। দূর থেকে মামাবাবুর গলা শোনা যায়—’আরে তোরা এখানে! আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
কাছে এসে দুই বোনের সঙ্গে ভিখিরি সাহেবকে দেখে মামাবাবু অবাক হয়ে যান। ভ্রূকুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করেন—’আরে, এটা আবার কে?’
‘ও একটা সাহেব ভিখিরি, মামাবাবু।’ নমিতাই উৎসাহের সঙ্গে তাদের নতুন আবিষ্কারের পরিচয় দেয়—’ও হাত দেখতে পারে।’
সাহেব ভিখিরি একগাল হেসে সগর্বে মাথা নেড়ে নমিতাকে সমর্থন করে—‘Yes sir, I am a poor beggar, but I can foretell the future…’
আরো কিছু হয়তো সে বলত, কিন্তু হঠাৎ মামাবাবুর ধমকে তাকে মুষড়ে পড়তে হয়।
‘You can foretell the future! বদমায়েসির আর জায়গা পাওনি।’ বলে তাকে থামিয়ে দিয়ে মামাবাবু আবার ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করেন—’এ—বাড়িতে ঢুকেছ কেন?’
‘বাড়ি!’—ভিখিরি সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়ে—’বাড়ি কাঁহা? এ তো জঙ্গল আছে। Only the ruins of a house।’ মুখখানা আবার করুণ করে সে বলতে যায়—’খালি রাতমে শোনেকে লিয়ে—’
‘না না ওসব হবে না।’—মামাবাবু ধমক দিয়ে ওঠেন। ‘ফের যদি এ বাড়িতে ঢোকো তো মজা টের পাবে। যাও—’
‘All right! যাতা হ্যায়!’ ভিখিরি সাহেব হতাশ ভাবে ঝোলা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সমস্ত বিশ্বসংসারকে শুনিয়ে যেন মন্তব্য করে—’গরিব কো কোই নেই দেখতা।’
ক্লান্তির ভারে পা যেন চলে না, এমনি ভাবে খানিকদূর নিজস্ব ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়েই কিন্তু সে ফিরে দাঁড়ায়। তারপর হঠাৎ তর্জনী তুলে গম্ভীর স্বরে বলে—‘But remember, I can see the future !’
‘যাও বলছি।’—মামাবাবুর আর এক ধমকে তার সব বাহাদুরী মাটি হয়ে যায়। চমকে উঠে ফণা ছেড়ে একেবারে কেঁচো হয়ে সে সুড়সুড় করে সরে পড়ে।
পাঁচ
সেই দিন রাত্রেই জয়ন্তকে শিল্পী শ্রীমন্ত সরকারের ঘরে আবার দেখা গেল।
উজ্জ্বল বাতির আলোয় ‘ইজল’—এর ওপর রাখা একটি ছবিতে শ্রীমন্ত তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঙ লাগাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে সেদিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে জয়ন্ত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে বেশ একটু চিন্তিত ও উত্তেজিত ভাবে।
তার দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনার কারণটা শ্রীমন্তর কথাতেই খানিকটা বোঝা গেল।
রং লাগাতে লাগাতে একটু থেমে শ্রীমন্ত বললে—’ওই ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতেও তাহলে লোক এসেছে বলছেন। খুব সাহসী লোক বলতে হবে!’
‘সাহসীর বদলে নিরুপায়ও তো হতে পারে!’ জয়ন্ত পায়চারী করতে করতে থামল। ‘আজকাল বাড়ি পাওয়া তো সোজা নয়! বাধ্য হয়েই হয়তো অমন বাড়ি নিয়েছে।’
একটু চুপ করে থেকে শ্রীমন্তর কাছে এগিয়ে এসে জয়ন্ত আবার বললে—’তবু আমার একটা কর্তব্য আছে বলে মনে করি। সেই জন্যেই আপনার আতিথ্য আবার নিতে হল।’
শ্রীমন্ত একটু হেসে বললে—’আতিথ্য নিয়েছেন বেশ করেছেন। কিন্তু কর্তব্য আর আপনার কি আছে? পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। এখন পুলিশ, আর যারা বাড়ি নিয়েছে দায় তাদের।’
‘না দায় আমারও আছে।’ জয়ন্ত প্রতিবাদ জানালে—’নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখবার পর নিশ্চিন্ত মনে চলে যেতে আমি পারব না, তাই আজ রাত্রে লুকিয়ে বাড়িটা পাহারা দেব ঠিক করেছি।’
‘সারারাত ওই বাড়ি পাহারা দেবেন!’ শ্রীমন্ত তুলি নামিয়ে সত্যিই অবাক হয়ে জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলে—’তাতে লাভ?’
‘দেখা যাক না লাভ—লোকসান কি হয়। যাবেন আমার সঙ্গে?’—জয়ন্তর শেষ কথাটা যেন শ্রীমন্তর সাহসের প্রতি কটাক্ষ।
সকৌতুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত বললে—’না গেলে তো কাপুরুষ ভাববেন! সুতরাং যেতেই হবে। তাছাড়া আপনাকে পাহারা দেবার জন্যেও তো সঙ্গে থাকা দরকার!’
জয়ন্ত চমকে মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু শ্রীমন্ত তখন নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে মাত করে দিচ্ছে।
পোড়ো বাড়ির নতুন বাসিন্দাদের কোনমতে ঘরদোর গুছোনো তখন একরকম সারা হয়েছে। শুতে যাবার আগে মামাবাবু ললিতা ও নমিতার ঘরে একবার তদারক করতে আসেন।
বাড়ির মধ্যে এই ঘরটির গোছগাছই একরকম পুরোপুরি হয়েছে বলা যায়। চারিদিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে মামাবাবু বলেন—’বাঃ তোরা তো এরই মধ্যেই দিব্যি গুছিয়ে ফেলেছিস দেখছি।’
এ প্রশংসাতেও ললিতাকে খুব খুশি মনে হয় না, বলে—’তা গুছিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ভাবছি মিছিমিছিই এত কষ্ট করা হল। দু’দিন বাদেই তো আবার চলে যেতে হবে।’
ললিতার কথায় বোঝা গেল ইতিপূর্বে এরকম বাড়িতে ওঠার দুঃখে সান্ত্বনা দেবার জন্যে মামাবাবু ওইরকম কোনো আশ্বাস বোধ হয় দিয়ে থাকবেন। এখন কিন্তু মিথ্যে স্তোক আর তিনি দিতে পারেন না, বিষণ্ণ ভাবে বলেন—’সত্যিই কি দু’দিন বাদে যাওয়া হবে মা,— আজকাল বাড়ি পাওয়া কি অত সোজা!’
‘ও বাবা! এ—বাড়িতে এখনো অনেকদিন থাকতে হবে নাকি?’—নমিতা মামাবাবুর কথায় একেবারে আঁতকে ওঠে। তারপর কাতর ভাবে জানায়—’না মামাবাবু, সে আমি পারব না।’
সস্নেহে মামাবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন—’না রে পাগলি না। অনেকদিন থাকতে হবে না। বাড়ি একটা পেলেই এখান থেকে চলে যাব। আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে, সারাদিন ধকলও কম যায়নি। এবার ভালো করে দরজা—টরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। আমি যাচ্ছি।’
মামাবাবু নিজের ঘরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই কিন্তু আবার নমিতার কাঁদ কাঁদ স্বর শোনা যায়—’মামাবাবু—!’
ফিরে দাঁড়িয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে মামাবাবু যথাসাধ্য ভরসা দিয়ে যান—’কিছু ভয় নেই রে পাগলি। আমি ওই ওদিকের ঘরেই আছি। ডাকলেই সাড়া দেব।’
নমিতা একথায় খুব বেশি সাহস বোধহয় পায় না। মামাবাবু চলে যাবার পর সভয়ে চারিদিকে একবার তাকিয়ে দিদিকে কাতর ভাবে মিনতি জানায়— ‘দরজা—জানলাগুলো এবার বন্ধ করে দাও না দিদি।’
মনে ভয় থাকলেও ছোট বোনের কাছে ধরা দিতে ললিতা রাজি নয়। হেসে বলে—’দিচ্ছিরে দিচ্ছি, অত ভয় কিসের!’
পরমুহূর্তেই দরজার কাছে কিসের একটা শব্দে চমকে উঠে তাকেও চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হয়—’কে?’
‘আমি গো আমি!’—ভয় পাবার মতো কেউ নয়, দেখা যায় ভূতোর মা—ই মাদুর—বালিশ বগলে করে, হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকছে।
তার আসার ধরনে হেসে ফেলে ললিতা বলে—’তুমি যে বিছানাপত্র সব নিয়ে এসে হাজির করলে দেখছি।’
মাদুর ও বালিশটা মেঝের উপর নামিয়ে ভূতোর মা একটু নিশ্চিন্ত হয়ে এবার নিজস্ব গলা বার করে—’তা করবনি তো কি করব! আত্তির বেলা এ বাড়িতে আমি একলা শুতে পারবনি। তা আমায় মেরেই ফেল আর কেটেই ফেল!’
অত্যন্ত গম্ভীর হবার ভান করে ললিতা বলে—’কেটে না ফেলে যদি শুধু মেরে ফেলি!’
রসিকতাটা বুঝতে ভূতোর মার একটু সময় লাগে কিন্তু বোঝবার পর সে রীতিমতো চটে যায়।
‘কি হাসি—তামাশা কর বাপু, ভালো লাগে না!’ তার গলার ঝঙ্কার কিন্তু শেষ পর্দায় পৌঁছোবার আগেই হঠাৎ সমস্ত দরজা জানলা কাঁপিয়ে একটা উদ্দাম হাওয়া বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যায়।
ভূতোর মা সভয়ে বলে—’ওই, ওই দেখ!’
আচমকা এই দমকা হাওয়ায় ললিতাও নিজের অজান্তে একটু শিউরে ওঠেনি এমন নয়। নমিতা তো তখন একেবারে তার গায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
সকলকে সাহস দেবার জন্যেই তাচ্ছিল্যের স্বরে ললিতা বলে—’দেখব আবার কি! ও তো হাওয়া!’
‘হ্যাঁ হাওয়া! তুমি তো সব জান!’—ভূতোর মার বলার ভঙ্গিতেই দমকা হাওয়াটা নমিতার কাছে অন্তত একেবারে তার সত্যকার চেহারায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাতর ভাবে সে মিনতি করে—’এই বার দরজা জানলাগুলো বন্ধ করে দাও দিদি, আমার বড় ভয় করছে!’
নমিতার অনুরোধ রাখতে ললিতার এখন আর খুব আলস্য দেখা যায় না।
ছয়
দরজা—জানলা বন্ধ করে শোবার পরও অনেক রাত পর্যন্ত ললিতার চোখে ঘুম আসে না।
দুই বোনে তারা মশারি ফেলে একটি খাটের উপর শুয়েছে। মেঝেতে তাদেরই কাছে বিছানা পেতে শুয়েছে ভূতোর মা।
নমিতা প্রথমটা ভয়ে একটু অস্থির হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিদির গা ঘেঁষে সে বেশ গভীর ভাবেই ঘুমোচ্ছে। মেঝে থেকে ভূতোর মার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ললিতাই একলা জেগে।
রাত্রে পুরোনো ভাঙা বাড়ির নানাদিকে নানারকম শব্দ। কল্পনাকে প্রশ্রয় দিলে তার প্রত্যেকটি থেকেই অনেকরকম ভয়াবহ ব্যাপার গড়ে তোলা যায়। ললিতার মন কিন্তু অত দুর্বল নয়।
এ—বাড়ির ব্যাপার মন থেকে ঠেলে রেখে অনেকক্ষণ ধরে সে অন্য কথাই ভাবে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানতে পারে না। হঠাৎ নমিতার ঠেলায় তার তন্দ্রা এক নিমেষে ভেঙে যায়।
সবলে তাকে ঠেলা দিতে দিতে নমিতা চাপা কম্পিত গলায় ডাকছে—’দিদি! দিদি!’
অসময়ে ঘুম ভাঙানোতে ললিতা একটু বিরক্ত হয়েই বলে—’কি, হয়েছে কি?’
‘একবারটি ওঠো। কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে!’ নমিতার গলা দিয়ে স্বরই বার হতে চাচ্ছে না।
ললিতাকে এবার উঠতেই হয়। প্রকাণ্ড ঘর, তাদের বিছানা থেকে বেশ দূরের একটা জানলা, পাল্লা ভাঙা থাকার দরুন বন্ধ করা যায়নি। জানলায় অবশ্য লোহার মোটা শিক দেওয়া। রাতের আকাশের অস্পষ্ট আলো তার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু ওটা কি হঠাৎ জানলাটা আড়াল করে দাঁড়ায়!
মশারির প্রান্তটা তুলে ধরে সেই দিকে চেয়ে দুই বোনের সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে যায়।
বিশাল ভয়ঙ্কর একটা কালো মূর্তি জানলার গরাদগুলো যেন মোমের তৈরি এমনি ভাবে বেঁকিয়ে দিচ্ছে!
মামাবাবু ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেন। ও কার কাতর আর্ত চিৎকার! ললিতা—নমিতার না?
টেবিলের ওপর কেরাসিন ল্যাম্পের আলোটা একটু কমানো ছিল। তাড়াতাড়ি সেটা বাড়িয়ে দিয়ে হাতে তুলে নিয়ে তিনি দ্রুত পদে মাঝের দালানে বেরিয়ে আসেন।
পরের মুহূর্তেই—’মামাবাবু’ বলে চীৎকার করে নমিতাই প্রথম পাশের ‘করিডর’ দিয়ে ছুটে এসে সভয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। তার ঠিক পিছু পিছু আসে ললিতা ও ভূতোর মা।
মামাবাবু বিস্ময় বিমূঢ় ভাবে জিজ্ঞাসা করেন—’কি, হয়েছে কি?’
‘কি একটা ভয়ঙ্কর জানোয়ার এইমাত্র আমাদের ঘরে ঢুকেছে।’—নমিতাই এক নিশ্বাসে ঝড়ের মতো বলে যায়!
‘ভয়ঙ্কর জানোয়ার!’—মামাবাবু ব্যাপারটা বুঝতেই পারেন না। ‘হ্যাঁ মামাবাবু!’ এবার ললিতাই অনেকটা ধীরভাবে বুঝিয়ে দেয়—’অন্ধকারে ভালো দেখতে পাইনি। কিন্তু মনে হল বিরাট দৈত্যের মতো চেহারা। লোহার গরাদগুলো ঠিক কঞ্চির মতো বেঁকিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল।’
‘তারপর?’—মামাবাবুর বিমূঢ়তা আরো বেড়ে গেছে।
‘তারপর আর কি কিছু দেখেছি! ছুটে পালিয়ে এসেছি!’—নমিতা এখনও কাঁপছে।
‘আমি একবার ফিরে দেখেছি মামাবাবু।’ ললিতা বলে—’মনে হল ঘর থেকে পেছনের বারান্দায় বেরিয়ে নীচে নেমে গেল।’
এবার মামাবাবু উপস্থিত বুদ্ধি যেন খুঁজে পান। ব্যস্ত হয়ে বলেন—’তাইতো! বন্দুকটা নিয়ে তাহলে তো একবার দেখতে হয়!’
মামাবাবু তাঁর ঘরের দিকে ফেরার আগেই ভূতোর মার কাংস্যকণ্ঠ বেজে ওঠে—’বন্দুক নিয়ে কি করবে গা! ওকি রক্তমাংসের দত্যি যে বন্দুক ছুড়বে! ও দানো ভূত!’
পরমুহূর্তেই তার বিলাপ শুরু হয়ে যায়—’কেন মরতে আমি এখানে কাজ নিয়েছিলাম গো! শেষে আমার কপালে কি অপঘাতে মৃত্যু লেখা ছিল গো…’
‘থামো দেখি!’
ভূতোর মার বিলাপ হয়তো আরো বেশ কিছুক্ষণ চলত। কিন্তু ললিতা ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে—’না, মামাবাবু। ওখানে তোমার একলা যাওয়াএখন ঠিক হবে না, তার চেয়ে আশপাশ থেকে কিছু লোকজন ডাকতে পারলে ভালো হত।’
‘আশপাশে লোকজন কোথায় যে ডাকব!’ মামাবাবু হতাশ ভাবে বলেন, তারপর ক্ষীণ একটু আশার আলো যেন দেখতে পেয়ে আবার বলতে যান—’তবে—’
তাঁর কথা শেষ করবার আগেই নমিতা বলে ওঠে—’হ্যাঁ মামাবাবু! অনেক দূরে একটা বাড়ি আছে, ছাদ থেকে দেখেছি!’
মামাবাবু বোধহয় সেই কথাই ভাবছিলেন। কিন্তু মনের খটকাটুকুও তিনি প্রকাশ না করে পারেন না—’কিন্তু এত রাত্রে অতদূরে পরের বাড়ি গিয়ে—’
হঠাৎ কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন—’নীচের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কে?’
সত্যি নীচের তলার বাইরের দরজায় সজোরে ধাক্কার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ব্যস্ত হয়ে সবাই এবার নীচে নেমে যান।
সাত
মামাবাবুই প্রথম সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তীক্ষ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করেন—’কে?’
দরজার ওধার থেকে কার কণ্ঠস্বর শোনা যায়—’দরজা খুলুন, বলছি।’
মামাবাবু একটু দ্বিধাভরেই দরজা খোলেন, কিন্তু দরজা খোলার পর প্রথম যে ভেতরে ঢোকে তাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান।
‘একি তুমি!’—আপনা থেকেই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে যায়।
যাকে দেখে তাঁর এই বিস্ময়, সে জয়ন্ত ছাড়া আর কেউ নয়। শ্রীমন্ত সরকারকে সঙ্গে নিয়ে সে—ই এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল।
মামাবাবুর পিছু পিছু ললিতা, নমিতা ও ভূতোর মাও নীচে নেমে এসে কিছু দূরে তখন দাঁড়িয়েছে। সকলের দিকে চকিতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে জয়ন্ত বলে—’হ্যাঁ, আমিও আপনাদের এখানে দেখব, আশা করিনি। কিন্তু এখন সে কথা থাক। আমরা বাইরেই ছিলাম। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একটা চিৎকার শুনে খোঁজ করতে এলাম। কি, হয়েছে কি?’
‘যা হয়েছে তা বিশ্বাস করবার মতো নয়। ললিতা—নমিতা যে ঘরে শুয়েছিল, হঠাৎ তার একটা জানলার গরাদ ভেঙে—’
মামাবাবুর কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে জয়ন্ত বলে—’থাক বুঝেছি, আর বলতে হবে না। এই ভয় করেই আমরা বাইরে পাহারায় ছিলাম। আচ্ছা আমি থানায় যাচ্ছি। শ্রীমন্তবাবু ততক্ষণ এখানে থাকুন।’
শ্রীমন্ত যে এঁদের অপরিচিত, যেতে গিয়ে বোধ হয় তার খেয়াল হয়। ফিরে দাঁড়িয়ে শ্রীমন্তকে দেখিয়ে বলে—’এঁর পরিচয় বোধহয় পরে দিলেও চলবে। এঁর নাম শ্রীমন্তবাবু— আর্টিস্ট মানুষ, কাছেই থাকেন—আপাতত এইটুকুই বোধহয় যথেষ্ট।’
ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে জয়ন্ত বেরিয়ে যাবার পর কয়েক মুহূর্ত উপস্থিত কেউই কোনো বলবার কথা খুঁজে পায় না। শ্রীমন্তই তারপর সঙ্কুচিতভাবে শুরু করে—’দেখুন, জয়ন্তবাবু তো ঝড়ের মতো শুধু নিজের কথা বলেই চলে গেলেন। আমার নিজের কৈফিয়ৎটা বোধহয় এখন দেওয়া দরকার।’
মামাবাবু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলেন—’না, না, কৈফিয়ত কি দেবেন। এই বিপদের সময়ে আপনারা না এসে পড়লে এদের নিয়ে কি যে আমি করতাম জানি না।’
শ্রীমন্তকে সঙ্গে করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মামাবাবু এবার সকলের পরিচয় করিয়ে দেন—’এই দুটি আমার ভাগনি—ললিতা আর নমিতা।’
লৌকিকতার নমস্কার সারা হবার পর মামাবাবু একটু কৌতূহলী হয়েই আবার জিজ্ঞাসা করেন—’জয়ন্ত তাহলে আপনার বন্ধু।’
‘বন্ধু!’—শ্রীমন্ত প্রথমটা একটু বোধহয় মুশকিলেই পড়ে। তারপর একটু হেসে বলে—’হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। তবে কাল সবে আমাদের পরিচয় হয়েছে।’
‘সবে কাল পরিচয় হয়েছে!’—মামাবাবু সত্যিই বিস্মিত হন।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ!’—শ্রীমন্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়—’আমি এখান থেকে কিছু দূরে থাকি। কাল হঠাৎ এমনি মাঝরাত্রে উনি আমার দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেন। উনিও আপনাদের মতোই এ বাড়িতে কাল ভয় পেয়েছিলেন।’
‘তাই নাকি! আশ্চর্য তো! জয়ন্ত হঠাৎ এ—বাড়িতে এসেছিল কি করতে? তাকে এখানে দেখব আমি তো ভাবতেই পারিনি!’—মামাবাবুর বিস্ময় বিমূঢ়তা তাঁর গলার স্বরে বেশ স্পষ্টই প্রকাশ পায়।
জয়ন্তকে ওদিকে থানায় গিয়ে মিঃ সোমকে জাগিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা বোঝাতে গোড়ায় বেশ একটু বেগ পেতে হয়। থানার সংলগ্ন কোয়ার্টারেই মিঃ সোম থাকেন। ইতিপূর্বে, ভুতুড়ে ব্যাপার সম্বন্ধে পুলিশের কোনো দায়িত্ব নেই, জানালেও, ঘটনাটা শোনবার পর মিঃ সোমের খুব বেশি উদাসীনতা কিন্তু দেখা যায় না। সাজ—পোশাক বদলে তৈরি হয়ে এসে একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে বেরুবার সময় শুধু তিনি বলেন—’চলুন জয়ন্তবাবু, আমি তৈরি—। আশা করি এত রাত্রে মিছিমিছি ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দিচ্ছেন না।’
‘মিথ্যে কি সত্যি, এখুনি তো জানতে পারবেন।’ বলে জয়ন্ত এগিয়ে যায়।
সিঁড়ির নীচের হলঘরে জয়ন্তর ফেরার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে শ্রীমন্তরই প্রথম ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
পরিচয় হয়ে গেলেও এ পরিবারের কাছে সে একেবারে নতুন লোক। এই বিপদের মাঝখানে সাধারণ মামুলি আলাপও বেশিক্ষণ চালানো যায় না। কিছুক্ষণ থেকে একটা অস্বস্তিকর স্তব্ধতায় সকলেই তাই কেমন আড়ষ্ট বোধ করছিল।
শ্রীমন্তই প্রথম সে স্তব্ধতা ভেঙে বলে—’জয়ন্তবাবুর ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না তো!’ তারপর ললিতার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করে—’আচ্ছা সেই অদ্ভুত জানোয়ারটা বাড়ির পেছনের মহলের দিকে নেমে গেছে, বলছিলেন না?’
‘আমি তো সেই রকমই দেখেছি!’—ললিতা জানায়।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীমন্ত বলে—’আমি তাহলে একবার ওদিকটা দেখেই আসি।’
শ্রীমন্তর কথায় সবাই একেবারে স্তম্ভিত। মামাবাবু তো সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান—’কী, বলছেন কি শ্রীমন্তবাবু! না, না আপনার একলা ওদিকে যাওয়া কিছুতেই উচিত নয়।’
‘কিছু ভাবনা নেই আপনাদের!’—শ্রীমন্ত হেসে আশ্বাস দেয়—’আমি খুব সাবধানেই যাব।’ তারপর একটু সঙ্কোচের সঙ্গে নিজের কৈফিয়তটা জানায়—’সত্যি কথাটা কি জানেন, গোড়া থেকে ব্যাপারটা আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। নিজের চোখে তাই সন্দেহটা ভঞ্জন করতে চাই।’
কাউকে আর কিছু বলবার অবসর না দিয়ে শ্রীমন্ত দ্রুতপদে পেছনের মহলের দিকে চলে যায়।
কি করা উচিত বুঝতে না পেরে মামাবাবু তখন বিমূঢ়। ললিতা তার ওপর আবার ঘা দিয়ে বলে—’ওঁকে কিন্তু একলা যেতে দেওয়া উচিত হল না মামাবাবু!’
মামাবাবু অসহায়ভাবে বলেন—’বারণ তো করলাম, না শুনলে হাত ধরে তো টেনে রাখতে পারি না।’
‘ও কি টেনে রাখা যায়!’—এতক্ষণে ভূতোর মার সাড়া পাওয়া যায়। ‘ও নিয়তিতে টেনেছে—বেঘোরে পেরাণটা যাবে বলে নিয়তিতে টেনেছে!’
এরপর মামাবাবু কী করতেন বলা যায় না; কিন্তু হঠাৎ বাইরে কাদের পদশব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে জয়ন্তর গলা—’এই যে এদিকে আসুন।’
মিঃ সোম ও একজন কনেস্টবলকে সঙ্গে নিয়ে জয়ন্ত ভেতরে এসে ঢোকে।
মামাবাবুদের কাছে এসে জয়ন্ত সংক্ষেপে প্রথম পরিচয়টা সেরে নেয়—উপস্থিত সকলকে দেখিয়ে বলে—’এই এঁরাই এখন এ—বাড়ি নিয়েছেন। ঘটনাটা এঁদের কাছেই শুনুন!’
হঠাৎ তার খেয়াল হয় যে এঁদের ভরসা দেবার জন্য যাকে রেখে গিয়েছিল সেই শ্রীমন্তই সেখানে নেই। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞাসা করে—’শ্রীমন্তবাবু গেলেন কোথায়?’
কথাটা ললিতার দিকে চেয়েই বলা হয়েছিল, কিন্তু তাকে মুখ ফিরিয়ে চুপ করে থাকতে দেখে নমিতাই জবাবটা দেয়—’তিনি কারুর কথা না শুনে একলাই ওদিকটা দেখতে গেলেন।’
‘একলা গেলেন!’—জয়ন্ত বিস্মিত না বিরক্ত ঠিক বোঝা যায় না।
পরমুহূর্তে সকলেই চমকে উঠে সভয়ে পেছনের মহলের দিকে কান পাতেন।
সেখান থেকে একটা চাপা আর্তনাদ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
মিঃ সোমই প্রথম বলে ওঠেন—’এ তো শ্রীমন্তবাবুর গলা!’
তৎক্ষণাৎ তিনি পেছনের মহলের দিকে ছুটে যান।—তাঁর পিছু পিছু আর সকলে।
শুধু জয়ন্ত তাদের অনুসরণ করে না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে বাইরের দরজা দিয়েই দ্রুতপদে বেরিয়ে যায়।
আট
সামনের মহল থেকে পেছনের মহল একেবারে এক নিমেষে যাওয়া যায় না। নীচের তলা দিয়ে যেতে হলে দুই মহলের মাঝখানে একটা সেকেলে সুড়ঙ্গের মতো বেশ লম্বা গলিপথ পার হতে হয়। গলিপথটির এখন নিতান্ত ভগ্ন দশা, তবে ব্যবহারের একেবারে অযোগ্য নয়।
মিঃ সোম সবার আগে সেই পথ দিয়ে পেছনের মহলে এসে পৌঁছেন।
প্রথম যে আর্ত চিৎকার শুনেছিলেন তা এখন থেমে গেছে, তার বদলে একটা অস্পষ্ট গোঙানি কোথা থেকে উঠছে। অন্ধকার হলেও সে গোঙানির শব্দ অনুসরণ করে ব্যাপারটা কোথায় কি ঘটছে দেখতে পেতে খুব দেরি লাগে না। কিন্তু যে দৃশ্য সেখানে তাঁর চোখে পড়ে, তাতে ঝানু সাহসী পুলিশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও মনের স্থৈর্য বজায় রাখা তাঁর পক্ষে একটু কঠিনই হয়।
দূরে পোড়ো বাড়ির জঙ্গলের মাঝে বিরাট দৈত্যের মতো একটা মূর্তি, শ্রীমন্তবাবুকেই নিশ্চয়, বেড়ালের কাছে যেন ইঁদুর ছানা, ঠিক এমনি ভাবে, দু—হাতে গলা টিপে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে।
অন্ধকারে দুটি চেহারাই অস্পষ্ট ও একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো। সোজা সেই দৈত্যাকার বিভীষিকাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়তে তাই সোম সাহস পান না। রিভলভারটা বার করে তাদের মাথার ওপরে শূন্যে পর পর কয়েকবার তিনি আওয়াজ করেন।
গুলির শব্দে কিছু ফল অন্তত পাওয়া যায়। দৈত্যকার মূর্তিটা চমকে ফিরে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ তার শিকার ফেলে দিয়ে পেছনের গাছপালার দিকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়।
সোম তৎক্ষণাৎ শ্রীমন্ত যেখানে পড়ে আছে সেখানে ছুটে গিয়ে মূর্তিটাকে লক্ষ করবার চেষ্টা করে গুলি ছোড়েন। কিন্তু তাতে ফল বিশেষ কিছু বোধহয় হয় না। অন্ধকারে সোম লক্ষ স্থির করবার আগেই প্রকাণ্ড একটা গাছের ঝুরি ধরে ঝুলে সোমের মাথার ওপর দিয়েই দোল খেয়ে প্রাণীটা পেছনের মহলের দোতলার ভাঙা বারান্দায় গিয়ে উঠে উধাও হয়ে যায়।
কনেস্টবল সমেত মামাবাবু ও অন্যান্য সকলে তখন সেখানে এসে পড়েছেন। এক নিশ্বাসে শ্রীমন্তকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার ও বেঁচে থাকলে ডাক্তার দেখাবার নির্দেশ দিয়ে সোম প্রাণীটাকে অনুসরণ করবার জন্যে ছুটে ওপরে উঠে যান।
কিন্তু বনমানুষের মতো শূন্যপথে যে অনায়াসে ঝুলে পার হয় তার নাগাল পাওয়া সহজ নয়। অনেক দূর পর্যন্ত বৃথাই তার অনুসরণ করবার চেষ্টা করে সোম শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন।
সিঁড়ির নীচের হলঘরে শ্রীমন্তকে ঘিরে সবাই তখন শুশ্রূষায় ব্যস্ত। মিঃ সোম যতখানি আশঙ্কা করেছিলেন তার চেয়ে তার অবস্থা যথেষ্ট ভালো দেখে আশ্বস্ত হন। শ্রীমন্তর ভাগ্য অবশ্য অত্যন্ত ভালো যে মিঃ সোম ঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে সেই বিভীষিকাকে তাড়াতে পেরেছিলেন। সকলেই স্বীকার করেন যে আর একটু দেরি হলে কি যে হতে পারত কিছুই বলা যায় না। আপাতত দেখা যায় যে গলা টেপা ও শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের দরুন কিছুটা দুর্বলতা ও আচ্ছন্ন ভাব থাকলেও তেমন মারাত্মক কোনো ক্ষতি তার হয়নি।
তবু মিঃ সোম ভালো করে শ্রীমন্তকে একবার পরীক্ষা করে দেখেন। পরীক্ষা শেষ করে নিশ্চিন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই জয়ন্ত তাঁর দিকে চেয়ে হেসে বলে—’পিস্তল নিয়ে ধাওয়া করেও কিছু করতে পারলেন না তাহলে!’
জয়ন্তর কথায় প্রচ্ছন্ন একটু বিদ্রূপ হয়তো ছিল, কিন্তু সোম সেটা গ্রাহ্য না করে সহজ ভাবেই বলেন—’না তা পারলাম না!’ তারপর মামাবাবুর দিকে ফিরে জানান—’যে ঘরে জানোয়ারটা প্রথম ঢোকে সেইটে এখন একবার দেখতে চাই।’
‘হ্যাঁ, সেটা আপনার দেখা দরকার। আসুন।’ বলে মামাবাবু ললিতাকেও সঙ্গে যেতে ডাকেন।
ললিতাদের ঘরে গরাদ—ভাঙা জানলার কাছে যখন তাঁরা উপস্থিত হন তখন দেখা যায় জয়ন্তও তাঁদের সঙ্গে এসেছে।
বেঁকানো গরাদগুলো দেখিয়ে মামাবাবু বলেন—’কী সাংঘাতিক ব্যাপার দেখেছেন! এরকম শক্ত লোহার গরাদগুলো অনায়াসে বেঁকিয়ে দিয়েছে!’
‘এক গরিলা ছাড়া এরকম জোর আর কোনো প্রাণীর আছে বলে জানি না!’—জয়ন্তই মন্তব্য করে—তারপর সোমকেই উদ্দেশ করে বলে—’আমার সেদিনকার গল্প বানিয়ে বলেছিলাম কিনা, এখন আশা করি বুঝতে পারছেন।’
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোম গরাদগুলোই খানিক পরীক্ষা করে বলেন—’হুঁ, গরাদের গায়ে এখনো সব লোম লেগে আছে দেখছি।’
পকেট থেকে একটা খাম বার করে কিছু লোম তার ভেতর ভরে নিয়ে সোম আবার বলেন—’এ জানলার পেছনে যে বারান্দা তার ওধারেই তো বাড়ির পোড়ো দিকটা। সেখানে কি আছে না আছে ভালো করে দিনের বেলা দেখেছেন?’
‘এই তো সবে এসেছি’—মামাবাবু ক্ষুণ্ণস্বরে জানান—’ভালো করে দেখবার সময় কোথায় পেলাম বলুন।’
‘তুমি ভুলে যাচ্ছ মামাবাবু’, ললিতা মামাবাবুর কথার ওপরেই প্রতিবাদ করে বলে—’আমার ছোটবোনের সঙ্গে দুপুরে একবার ওদিকে গেছলাম। ভিখিরি গোছের একটা অদ্ভুত লোক তখন ওখানে দেখেছি।’
‘ভিখিরি গোছের অদ্ভুত লোক!’— সোমকে অত্যন্ত বিস্মিত দেখায়।
‘হ্যাঁ, ছেঁড়া কোট প্যান্ট পরা।’ ললিতা বিস্তারিত বিবরণ দেয়—’আবার ইংরিজিতে কথা বলে। মামাবাবু অবশ্য তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।’
অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে ‘হুঁ’ বলে সোম বেশ গম্ভীর হয়ে যান।
‘কিন্তু এখন আমরা কি করব বলুন তো!’ —মামাবাবু এবার তাঁর দুঃখের কথা পাড়েন। ‘এরকম বাড়িতে একদণ্ড থাকতে তো সাহস হয় না। অথচ যাবই বা কোথায়!’
‘যাবার জায়গা যতদিন না পান ততদিন এখানেই থাকতে হবে। তবে আপনাদের বিশেষ কিছু ভয় নেই।’ মিঃ সোম আশ্বাস দিয়ে বলেন—’এখন থেকে আমার লোকজন সারাক্ষণ এ—বাড়ি নজরে রাখবে। আর ভূত—প্রেত নয়, জ্যান্ত জানোয়ার বলে যখন জানা গেছে, তখন একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবেই বলে মনে হচ্ছে।’
জয়ন্ত এতক্ষণ বেশিরভাগ নীরব শ্রোতা হয়েই ছিল। এইবার মামাবাবুর দিকে ফিরে সে বলে—’আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি নীচের একটা ঘরে এখন কয়েকদিন এসে থাকতে পারি।’
‘আপত্তি কিসের? তাতে তো আমাদের সুবিধে!’—বেশ উৎফুল্ল হয়েই কথাগুলো বলে মামাবাবু শেষে আবার একটু সন্দেহ প্রকাশ করেন—’তবে তুমি যা খেয়ালি ছেলে, ক’দিন ধৈর্য ধরে এখানে থাকবে তাই ভাবছি।’
এঁদের কথার মাঝখানে সোম সবিস্ময়ে এবার বলতে বাধ্য হন—’জয়ন্তবাবুকে আপনারা তাহলে চেনেন!’
‘চিনি মানে!’ মামাবাবু সোৎসাহে বলে যান—’বর্মায় যে জায়গায় আমরা থাকতাম, সেখানে ও তো আমাদের ঘরের ছেলের মতো ছিল। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে কোথায় যে একদিন উধাও হয়ে গেল, পাত্তাই পাওয়া গেল না। তারপর আমাদেরও অবশ্য এই যুদ্ধের গোলমালে বর্মা থেকে চলে আসতে হয়েছে।’
‘হুঁ!’ কী যেন একটা ভেবে নিয়ে সোম বলেন—’আপনারা তাহলে আগে এদেশে থাকতেন না?’
‘থাকতাম না বলেই তো এই বিপদ!’ মামাবাবু দুঃখের সঙ্গে জানান—’দেশের সঙ্গে বহুকাল সম্পর্ক নেই বলে, কিছুই এখানকার জানি না। না হলে এরকম একটা সর্বনেশে ভুতুড়ে বাড়ি, না বুঝেশুঝে নিয়ে বসি। বাড়ি পাওয়া যা সমস্যা তাতে এখন কী উপায় হবে তাই ভাবছি।’
মামাবাবুকে সান্ত্বনা দেবার মতো কিছু একটা সোম বোধহয় বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা আর তাঁর হয়ে ওঠে না। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে তিনি বলেন—’এই যে শ্রীমন্তবাবু! আপনি একটু সুস্থ হয়েছেন তাহলে?’
শ্রীমন্তই সত্যি ওপরে উঠে এসেছে। এইমাত্র যে বিপদ সে কাটিয়ে উঠেছে, ছেঁড়া খোঁড়া দাগ লাগা জামাকাপড় ও নানা জায়গায় ক্ষত বিক্ষত চেহারায় তার চিহ্ন এখনও সুস্পষ্ট, কিন্তু মনের জোর যে তার কম নয় তার কথার ধরনেই তা বোঝা যায়।
সোমের কথার জবাবে একটু হেসে সে বলে—’হ্যাঁ শারীরিক খানিকটা সুস্থ হয়েছি, কিন্তু মাথাটা মশাই একেবারে গুলিয়ে গেছে। এরকম একটি আজগুবি ব্যাপার যে সম্ভব, আগে ভাবতেই পারিনি। জয়ন্তবাবুর কথা তখন অবিশ্বাস করেছিলাম বলেই বোধহয় এই শিক্ষাটা পেতে হল।’
‘শিক্ষা আপনি নিজের দোষেই পেয়েছেন!’—জয়ন্তর গলার স্বরে একটু রূঢ়তাই যেন প্রকাশ পায়—’কী দরকার ছিল আপনার বাহাদুরি দেখাতে ওখানে যাবার?’
‘বাহাদুরি!’—বোঝা যায় শ্রীমন্ত সত্যিই একটু আহত হয়েছে।
তার হয়ে ললিতাই হঠাৎ জবাব দেয়—’আপনি কিছু মনে করবেন না শ্রীমন্তবাবু। সাহস আর বাহাদুরির তফাতটা অনেকের ঠিক জানা নেই।’
কথাটা জয়ন্তর দিকে অবজ্ঞাভরে যেন ছুড়ে দিয়ে ললিতা সেখান থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে চলে যায়।
ঘরের আবহাওয়াটা এক মুহূর্তে কেমন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। আলাপটার এরকম একটা মোড় নেবার জন্যে কেউ যেন প্রস্তুত ছিল না।
জয়ন্তই প্রথম ব্যাপারটা হালকা করে দেবার চেষ্টা করে। হেসে বলে—’শুনলেন মামাবাবু আপনাদের এখানে অভ্যর্থনাটা কিরকম হবে এখনই তার নমুনা পাচ্ছি। তবু আমায় থাকতেই হবে।’
‘হাঁ, হাঁ, থাকবে বই কি!’ মামাবাবু অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠে খুশি হয়ে বলেন—’আমার ললিত মাকে তো জান। কখন যে কি মেজাজে থাকে হদিস পাওয়া যায় না। আর তোমাদের এ ঝগড়া তো নতুন নয়।’
সকলের সঙ্গে নীচে নামতে নামতে মামাবাবু জয়ন্তর পিঠটা সস্নেহে দু’বার চাপড়ে দেন।
নয়
একটা দিন তারপর কেটে গেছে। বিশেষ কিছু ইতিমধ্যে ঘটেনি। শুধু জয়ন্ত এ বাড়ির নীচের একটি ঘরে তার জিনিসপত্র নিয়ে এসে উঠেছে।
দ্বিতীয় দিন সকাল বেলা ললিতা ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছে এমন সময় সামনে সিঁড়ির তলায় জয়ন্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে থামতে হ’ল একটু।
নীচের হলের বাঁ দিকের প্রথম ঘরটা জয়ন্তর। সেখান থেকে ললিতাকে নামতে দেখেই সে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়েছে।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালেও ললিত তারপর জয়ন্তকে অগ্রাহ্য করেই নীচে নেমে গেল।
জয়ন্তকে পাশ কাটিয়েই সে চলে যাচ্ছিল কিন্তু এ উপেক্ষা সত্ত্বেও জয়ন্ত পেছন থেকে ডেকে বললে—’কি ললিতা! মনে হচ্ছে আমাকে যেন তুমি চেন—ই না!’
তার মুখে গোড়া থেকেই একটি কৌতুকের হাসি লেগে আছে।
পিছন ফিরে না তাকালেও জয়ন্তর গলার স্বরের এ কৌতুক ললিতার বোধহয় অগোচর রইল না। কঠিন স্বরে সে জবাব দিলে—’কথাটা খুব মিথ্যে হয়তো নয়।’
জয়ন্ত একটু এগিয়ে গিয়ে আবার হেসে বললে—’এই ক’দিনেই এত অচেনা হয়ে গেলাম!’—বিদ্রূপ নয়, এখনো তার গলায় সহজ পরিহাসের সুর!
ললিতা এবার ফিরে দাঁড়াল। তারপর অত্যন্ত তিক্তভাবে হেসে বললে—’ক’দিন হয়ে যাওনি। কোনো কালেই হয়তো তোমায় ঠিক চিনতাম না।’
কৌতুকের হাসি জয়ন্তর মুখ থেকে এবার মুছে গেল। খানিক চুপ করে থেকে সে বলল—’আমায় তুমি ভুল বুঝেছ জানি। সে ভুল ভাঙবার সুযোগ আমি কিন্তু এখনো পাইনি।’ তার গলার স্বর বেশ ক্ষুণ্ণ।
কিন্তু ললিতার কাছে মনে হ’ল সে ক্ষোভের কোনো দাম নেই।
‘কোনো সুযোগেরই তোমার দরকার নেই। এসব কথা আমি আলোচনা করতেই চাই না।’ বলে ললিতা পেছনের মহলের দিকে দ্রুতপদে চলে গেল।
কিন্তু দেখা গেল, জয়ন্ত অমন এক কথায় এ আলোচনা শেষ করতে প্রস্তুত নয়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে ললিতাকে অনুসরণ করে পেছনের মহলে গিয়ে আবার ডাক দিলে—’শোন ললিতা, দাঁড়াও।’
অনুরোধ নয় আদেশের স্বর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ললিতাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হ’ল।
জয়ন্ত কাছে এসে উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞাসা করল—’একটুখানি ধৈর্য ধরে আমার কথাগুলোও কি তুমি শুনতে পার না। আমার যা বলবার আছে সব শুনে তারপর আমার বিচার কোরো।’
‘তোমার বিচার আমি করতেই বা যাব কেন?’ অবজ্ঞাভরে ললিতা উত্তর দিল। ‘সেরকম কোনো উৎসাহ আমার নেই। তুমি যাই হও আর যা খুশি করো, আমার তাতে কিছু আসে যায় না।’
‘কিছু আসে যায় না।’
‘না’—ললিতার দ্বিধাহীন সুস্পষ্ট জবাব।
‘ওঃ, এক বছর আগে কিন্তু একথাটা বোধহয় বলতে পারতে না।’—এবার জয়ন্তর কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপের আভাস।
কিন্তু ললিতা আগের মতোই কঠিন স্বরে বললে—’হয়তো পারতাম না। কিন্তু এক বছরে মানুষ অনেক কিছু শেখে, মানুষের অনেক কিছু বদলে যায়।’
‘হ্যাঁ, সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি!’ জয়ন্তর স্বর অত্যন্ত তিক্ত। ‘আচ্ছা আর তোমায় বিরক্ত করব না। আপাতত তোমাদের বাড়িতে যে আছি, তাতেও যদি তোমার আপত্তি থাকে তো বল আমি আজই চলে যাচ্ছি।’
‘তাতে তোমার খুব অসুবিধে হবে না কি?’—ললিতা বেশ একটু আঘাত দিয়েই বললে—’আমার জন্যে তুমি এখানে আসনি এবং আমি বলা মাত্র চলে যেতেও বোধহয় পারবে না।’
‘একথার মানে?’—জয়ন্ত উষ্ণ হয়ে উঠল। ‘এ—বাড়ির রহস্য সম্বন্ধে আমার কৌতূহল আছে সত্যি, কিন্তু সেই রহস্যের সন্ধান, আর তোমাদের একটু পাহারা দেওয়া, এ ছাড়া আমার এ বাড়িতে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করো?’
‘কি মনে করি, তা নাই শুনলে।’—ললিতা অবিচলিত ভাবে জবাব দিলে। ‘তবে তোমার ভাবনার কোনো কারণ নেই। তুমি এ—বাড়িতে মামাবাবুর অতিথি, সুতরাং আমার আপত্তি থাকলেও তোমার তা গ্রাহ্য করবার কোনো দরকার নেই। তোমার কাজ তুমি নির্বিঘ্নে করে যেতে পারো।’
‘তোমার উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ!’ একমুহূর্ত আর সেখানে না দাঁড়িয়ে জয়ন্ত আরক্তমুখে হন হন করে ভেতরের দিকে চলে গেল।
মুখ দেখে ললিতার মনের কথা বোঝা কঠিন। খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার পেছনের বাগানটার দিকে ফিরল। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে আবার তাকে থমকে দাঁড়াতে হল। পুরোনো ইঁদারাটার পেছনে কার যেন কাশির শব্দ।
কাশির শব্দে ললিতা চমকে গেছিল, কিন্তু ইঁদারার পেছন থেকে অত্যন্ত সঙ্কুচিত ভাবে যে লোকটি এবার উঠে এল তাকে দেখে সে আরো অবাক।
লোকটি আর কেউ নয় শ্রীমন্ত। কাছে এসে অত্যন্ত লজ্জিতভাবে সে বললে—’মাপ করবেন। বড়ই মশকিলে পড়েছিলাম। দিনের বেলায় জায়গাটা ভালো করে পরীক্ষা করবার জন্যে সবে এসে এখানে বসেছি, এমন সময় আপনাদের কথা শুনতে পেলাম। তখন না পারি, হঠাৎ উঠে পড়তে না পারি বসে থাকতে। লুকিয়ে বসে এসব কথা শোনা অন্যায়, অথচ পাছে আপনারা অপ্রস্তুত হন বলে উঠতেও পারছিলাম না।’
একটু থেমে শ্রীমন্ত আবার অনুরোধ জানালে—’নেহাৎ অনিচ্ছায় বাধ্য হয়ে যে অপরাধ করেছি তার জন্যে মাপ করবেন।’
‘না, না, মাপ করবার কি আছে।’ ললিতাই এখন অপ্রস্তুত। ‘আর গোপন করার মতো কথাও ও সব নয়।’
প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্যে ললিতা একটু হেসে আবার জিজ্ঞাসা করলে—’জায়গাটা পরীক্ষা করে কিছু পেলেন?’
‘না, দিনের বেলা তো বিশ্বাসই হয় না, এখানে এমন একটা ব্যাপার ঘটতে পারে।’ হঠাৎ কি একটা মনে পড়ায় ইঁদারার ধার থেকে একটা ঝোলা কুড়িয়ে নিয়ে এসে শ্রীমন্ত আবার বললে—’এই ঝোলাটা কিন্তু এখানে কোথা থেকে এল বুঝতে পারছি না।’
ঝোলাটা দেখেই ললিতা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। শ্রীমন্তর কাছ থেকে সেটা হাতে নিতেই তার মনে পড়ে গেল। ‘আরে এটা তো সেই—’
‘Yes! sweet Lady!’
কথার মাঝখানেই চমকে দু’জনকে ফিরে তাকাতে হল। সেই ভিখিরি সাহেবটা ইদারার ভেতর থেকে উঠে পাড়ের ওপর একটা পা ঝুলিয়ে তাদের দিকে সকৌতুক দৃষ্টিতে হাসিমুখে চেয়ে আছে।
তাদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ইঁদারা থেকে নেমে এসে ললিতার হাত থেকে ঝোলাটা তুলে নিয়ে কুর্নিশ করবার ভঙ্গিতে সে বললে— ‘You are quite right! It belongs to me. এঠো মেরা হ্যায়!’
শ্রীমন্ত অবাক হয়ে ললিতাকে জিজ্ঞাসা করলে—একে চেনেন নাকি!’
ললিতা হেসে কি বলতে যাচ্ছিল, তার আগে শ্রীমন্তই আবার বলে উঠল—’দাঁড়ান, দাঁড়ান, সেদিন একে যেন থানায় দেখেছি, মনে হচ্ছে।’
ভিখিরি সাহেব এক গাল হেসে জানালে—‘May be!’ সব জাগামে ভিখ, মাঙকে খাতা!’
হঠাৎ ভিখিরির মতো ভঙ্গিতে শ্রীমন্তর সামনে ডান হাতটি সে কাতর ভাবে বাড়িয়ে দিলে—‘Give me something!’
‘Give you something!’ সকৌতুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে—’এ কুয়োর ভেতর ঢুকে কি করছিলে? ভিখ মাঙছিলে?’
‘No, No, No!’—ভিখিরি সাহেবের মুখ একেবারে করুণ হয়ে উঠল— ‘I just fell down the well, Sir—ইন্দারামে গির পড়া!’
‘গির পড়া!’ শ্রীমন্ত ও ললিতা দু’জনেই হেসে উঠল।
শ্রীমন্ত আবার বললে—’গির পড়েও তো কিছু হয়নি দেখছি। মাথাটা বেশ আস্তই আছে।’
এটাই যেন তার একটা বাহাদুরি এমনি ভাবে নিজের মাথায় দুটো টোকা দিয়ে ভিখিরি সাহেব বুঝিয়ে দিলে—‘Got a very strong head Sir— শির বহুৎ মজবুত হ্যায়।’
কথাটা শেষ করবার আগেই পাশের দিকে চোখ পড়ায় ভিখিরি সাহেবের মুখটা হঠাৎ ভয়ে যেন শুকিয়ে গেল।
ভয় পাওয়ার কারণও ছিল। দেখা গেল পেছনের মহলের আর একদিক থেকে মামাবাবুর সঙ্গে ইনস্পেক্টর মিঃ সোম সেইদিকেই আসছেন।
‘এই, ঠারো!’
তাড়াতাড়ি সরে পড়তে গিয়েও ভিখিরি সাহেব সুবিধে করতে পারলে না। শ্রীমন্তই হাতটা বাড়িয়ে তাকে আটকে দিলে।
কাছে এসে মামাবাবুর দিকে ফিরে সোম জিজ্ঞাসা করলেন—’এই লোকটার কথাই বলছিলেন না?’
‘হ্যাঁ, সেদিন মানা করে দিয়েছিলাম, তবু আবার এসেছে দেখছি।’
এদের কথাবার্তার সুযোগে ভিখিরি সাহেব আর একবার পালাবার চেষ্টায় ছিল কিন্তু শ্রীমন্তই আবার তাকে ধরে ফেলে হেসে বললে—’এই, ভাগতা কাঁহা?’
‘নেহি, ভাগতা নেহি।’—ভিখিরি সাহেব কাঁদুনে সুর তুলে ছাড়া পাবার জন্যে আকুল হয়ে উঠল। ‘হাম চলা যাতা! আভি চলা যাতা। আউর হিঁয়া কভি নেহি আয়েগা।’
‘নেহি আয়েগা!’—সোম ধমক দিয়ে উঠলেন—’যাতে না আসতে পারো সেই ব্যবস্থাই করছি। চল আজ তোমায় হাজতে দেবই।’
সোম তার ঘাড়টা ধরতেই ভিখিরি সাহেব একেবারে যেন ককিয়ে উঠল— Oh, please, please ইন্সপেক্টর সাব। I am a poor beggar!’
‘থাকগে, আজকের মতো ছেড়ে দিন মিঃ সোম।’—শ্রীমন্তর মনটাই এ কাঁদুনিতে গলেছে দেখা গেল। ‘লোকটা harmless tramp বলে মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ tramp, কিন্তু harmless কিনা আমার সন্দেহ আছে।’ ভিখিরি সাহেবকে একটা ঠেলা দিয়ে সোম বললেন—’যাক আপনার কথায় আজকের মতো ছেড়ে দিলাম।’
বলা বাহুল্য, ভিখিরি সাহেব তৎক্ষণাৎ সে তল্লাট ছেড়ে উধাও।
‘লোকটার চালচলন কিন্তু সত্যি কিরকম সন্দেহজনক!’ ললিতাই প্রথম মন্তব্য করলে। ‘জানেন, খানিক আগে ওই কুয়োটার ভেতর থেকে উঠে এল!’
‘কুয়োটার ভেতর থেকে!’ সোম অবাক হয়ে আরো কি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই শ্রীমন্ত হেসে বললে—’হ্যাঁ কুয়োটার ভেতর থেকে উঠে এসেছে সত্যি। তবে চালচলন সন্দেহজনক বলেই আড়াল থেকে নজর রাখবার জন্যে ছেড়ে রাখা দরকার। কেমন তাই নয় কি মিঃ সোম?’
‘তা খুব ভুল বলেননি!’ মিঃ সোম এবার না হেসে পারলেন না।
‘আচ্ছা আমি তাহলে চলি।’ বলে শ্রীমন্ত বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর মামাবাবু নিজের দুঃখের কথা আবার পাড়লেন—’দেখুন মিঃ সোম, আপনার ভরসা পেয়েও আমি কিন্তু খুব নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।’
‘নিশ্চিন্ত যাতে হতে পারেন সেই চেষ্টাই তো করছি।’—’মিঃ সোম আশ্বাস দিয়ে বললেন—’শুনুন যে কথা আজ আপনাকে বলতে এসেছি। আমার লোকজন তো এখানে পাহারায় আছেই, তাছাড়াও রাত্রে যদি কখনো কোনো বিপদ বোঝেন, আপনাদের চিলকুঠুরির জানলায় একটা আলো জ্বালিয়ে দেবেন। বুঝেছেন?’
মামাবাবু অবাক হয়ে তাকাতেই মিঃ সোম আবার হেসে বললেন—’আশা করি অবশ্য আলো জ্বালবার দরকার কখনও হবে না।’
দশ
বাগ—নাগের অফিসে দুই অংশীদারে ঠোকাঠুকি লেগেই আছে।
সেদিন সকালেও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
এমনিতেই নাগ একবার হাঁচলে, বাগ দুবার অন্তত কেশে তার প্রাধান্য জাহির করে এবং নাগ আবার তার ওপর টেক্কা দেবার জন্য ফিকির খোঁজে।
সেদিন রেষারেষিটা শুরু চিঠি লেখানো নিয়ে।
মিস গুপ্তা নিজের মনে কাজ করে যাচ্ছেন। নাগ—বাগ দু’জনে মুখোমুখি দুই টেবিলে বসে খাতাপত্র দেখার মাঝে এক একবার পরস্পরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি হানছে।
এরই মধ্যে বাগ হঠাৎ উঠে পড়ে মিস গুপ্তার টেবিলের কাছে গিয়ে ডাক দিলে—’মিস গুপ্তা!’
আর তারপর রক্ষে আছে! নাগও তৎক্ষণাৎ টেবিল থেকে উঠে এসে মিস গুপ্তার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে হাঁকলে—’মিস গুপ্তা!’
মিস গুপ্তা কার দিকে ফিরবেন!
তবু একবার এদিকে একবার ওদিকে মুখ ফিরিয়ে দুই মনিবের মর্যাদা রাখলেন।
নাগের দিকে এবার বিষদৃষ্টি হেনে বাগ হুকুম করলে—’একটা চিঠির ডিক্টেশন নিন তো :—
To,
Messrs Roy & Roy,
Solicitors’.
বাগকে আর এগুতে হল না। নাগ মিস গুপ্তার টেবিলে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে—’আমার চিঠিটা নিন তো:
To,
Baker & Sons Limited.’
এ বেয়াদবির উত্তরে বাগ জলদ—গম্ভীরস্বরে জানালে—’আগে আমার চিঠি ধরুন :—
Dear Sirs,
We thank you heartily for the satisfactory way…’
নাগও তখন শুরু করে দিয়েছে :—
‘Dear Sirs,
We regret very much to inform you that your…’
‘মিস গুপ্তা!’—বাগ হুঙ্কার দিয়ে উঠল—’আপনাকে যদি কেউ বিরক্ত করে, তাহলে তাকে বলে দিন যে, এটা কাজ করবার অফিস, ছেলেখেলার জায়গা নয়—’
নাগও ছেড়ে কথা বলবার পাত্র নয়। তাচ্ছিল্য ভরে জানিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ—’মিস গুপ্তা! বাজে কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করে যান। পড়ুুন কি লিখেছেন—
মিস গুপ্তা অগত্যা যা লিখেছেন, পড়লেন—
‘To
Messrs, Roy & Baker Limited.
Dear Sirs,
We regret to thank you heartily for…’
চিঠি শুনে বাগ—নাগ দু’জনেরই চোখ কপালে উঠেছে তখন। বাগের সমস্ত রাগ এবার পড়ল নাগের ওপর। এতক্ষণ মধ্যস্থ মারফত কথা চলছিল, এবার একেবারে সরাসরি আক্রমণ।
‘দেখো নাগ তোমায় আমি শেষ কথা বলে দিচ্ছি…’
নাগও তখন কোমার বেঁধে তৈরি—’তুমি শেষ কথা বলবে কি, আমি গোড়ার কথা বলছি…’
লড়াইটা কতদূর পর্যন্ত গড়াত বলা যায় না, কিন্তু একমুহূর্তে যেন ভোজবাজিতে দু’জনের মুখের চেহারা একেবারে বদলে গেল।
ওধারের দরজা দিয়ে কে একজন নতুন মক্কেল ঢুকছেন। তাই এই আশ্চর্য রূপান্তর।
‘আসুন, আসুন, বসুন।’—দু’জনে একেবারে আপ্যায়নে গদগদ হয়ে উঠল।
আগন্তুক ভদ্রলোকটি ধীরে ধীরে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে চারিদিকে চাইতে চাইতে চেয়ারে এসে বসলেন। সাদর সম্ভাষণে কোনো ত্রুটি না হলেও বাগ—নাগের মুখের গদগদ ভাবের ওপর একটা কিসের ছায়া তখন পড়েছে।
অনেক মক্কেল, ব্যবসা করা অবধি তারা চরিয়েছে, কিন্তু এরকম একটা লোক তাদের মতো ঝানু কারবারির চোখেও কখনও পড়েছে কিনা সন্দেহ।
ভদ্রলোকের চেহারা যে কুৎসিত ভয়াবহ কিছু, তা নয়। কিন্তু চেহারা চালচলন ভঙ্গি সব কিছু মিলে কেমন একটা অস্বস্তি জাগায়। কি একটা থমথমে আবহাওয়া তিনি যেন সঙ্গে করে নিয়ে ফিরছেন।
ধীরে ধীরে একবার বাগ ও একবার নাগকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে যেন ওজন করে নিয়ে ভদ্রলোক গম্ভীর ভাবে ধীরে ধীরে বললেন—’খবরের কাগজে আপনাদের বিজ্ঞাপন দেখে এলাম। একটা বাড়ির খোঁজ আমায় দিতে পারেন?’
ভেতরে যত অস্বস্তিই হোক ব্যবসাদারীতে বাগ নাগের কোনো ত্রুটি নেই।
তৎক্ষণাৎ তাদের তরজা শুরু হয়ে গেল।
‘একটা বাড়ির খোঁজ!’—বাগ যেন দুঃখিত। ‘একটা কি বলছেন, দশ বিশ পঞ্চাশ, একশোটা বাড়ির খোঁজ নিন না!’
‘আর বাড়ি শুধু!’ নাগ তার পালা সুরু করলে—’পুকুর বাগান, ক্ষেত খামার, জলা জঙ্গল কিসের খোঁজ না দিতে পারি!’
‘ওসব দরকার হবে না।’—ভদ্রলোক একটি কথায় তাদের থামিয়ে দিলেন। ‘আমি শুধু একটি বিশেষ বাড়ির খোঁজ করতে এসেছি।’
পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে বাগের হাতে দিয়ে তিনি বললেন—’এই হল তার বিবরণ আর ঠিকানা।’
ঠিকানাটা পড়ে বাগ—নাগের চোখ কপালে উঠল।
‘আপনি এই বাড়িটার খোঁজ করছেন!’—করুণ স্বরে বাগ জিজ্ঞাসা করলে।
‘হ্যাঁ, বাড়িটা বিক্রি আছে কিনা আর কার কাছে কী দামে পাওয়া যেতে পারে জানতে পারলে সুখী হব।’
‘পারবেন। পারবেন। সব জানতে পারবেন।’ মক্কেল হাতছাড়া করতে নাগ রাজি নয়—’শুধু একটা দিন আমাদের সময় দিতে হবে। সব খবর আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি তারপর।’
‘বেশ একদিন বাদেই আসব।’ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কারটুকু পর্যন্ত না করে বেরিয়ে গেলেন।
বাগ—নাগ তারপরও খানিক থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ঘরের থমথমে আবহাওয়াটা যেন এখনো কাটেনি। নিজেদের একটু সামলে নেবার পরই আবার তাদের নিজস্ব রূপ দেখা গেল।
মিস গুপ্তার টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে বাগ গম্ভীরভাবে আদেশ করলে—’শুনুন, মিস গুপ্তা! মিঃ নাগকে জানিয়ে দিন যে কাল সকালে এই বাড়ি দেখতে যাওয়ার জন্যে তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন।’
মিস গুপ্তা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।
কিন্তু শেষ কথা নাগের বলা চাই। বাগের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টি হেনে মুখ ফিরিয়ে সেও জানিয়ে দিলে—’মিস গুপ্তা, আপনি মিঃ বাগকেও বলে দিন যে একথা আমায় না জানালেও চলত। আমি অপ্রস্তুত নই।’
মিস গুপ্তা ক্লান্তভাবে বললেন—’যে আজ্ঞে।’
এগারো
বাগ এবং নাগ তারপর দিন যশোর রোডের সেই পোড়ো বাড়িতে সকাল বেলা ঠিক গিয়ে হাজির।
মামাবাবুর অভ্যর্থনাটা কিন্তু খুব সাদর বলে মনে হয় না।
‘আসুন! আসুন!’ বলে তিনি ভেতরে দু’জনকে ডেকে নিয়ে আসেন, কিন্তু সেই সঙ্গে যে কথাগুলি বলেন, তা বিশেষ মধুর নয়।
‘আপনারা নিজে থেকে খোঁজ নিতে আসবেন, এতো ভাবতেই পারিনি মশাই। যে বাড়ি গছিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে এখনো টিঁকে আছি কিনা দেখতে এসেছেন বোধহয়!’
বাগ খোঁচাটা গায়েই মাখে না। ব্যাপারটা যেন মধুর পরিহাস এমনি ভাবে বলে—’সে কি কথা! টিকে থাকবেন না কি!’
‘এ ত চমৎকার বাড়ি!’—নাগ তৎক্ষণাৎ ফোড়ন দেয়।
‘হ্যাঁ, চমৎকার!’ মামাবাবু ধমকে ওঠেন।
নমিতা সেইখান দিয়েই তখন যাচ্ছিল। হঠাৎ তাকে ডেকে মামাবাবু এমন একটা কথা বলে বসেন যে, বাগ—নাগ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
‘যা তো মা নমিতা, বাড়ির ওই মহলটা এঁদের একবার দেখিয়ে নিয়ে আয় তো—সেদিন রাত্রে শ্রীমন্তবাবু যেখানে মরতে বসেছিলেন।’
‘মরতে বসেছিলেন!’—বাগ এবং নাগ পরস্পরের দিকে কাতর ভাবে একবার তাকায়।
‘না, না, দেখবার আর কি আছে!’—বাগ তাচ্ছিল্যের ভান করে কথাটা কাটাবার চেষ্টা করে।
‘হ্যাঁ, আমাদের আর দেখবার দরকার হয় না।’—নাগ যেন এসব ব্যাপারে উদাসীন।
‘আর দেখবার সময় তো যথেষ্ট আছে!’ বাগ বাইরের দরজার দিকেই পা বাড়ায়। কিন্তু মামাবাবুর ধমকে তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়।
‘যাচ্ছেন কোথায়! যান এখুনি একবার দেখে আসুন!’
মামাবাবুর গলার স্বরটা এমন, যে অমান্য করতে সাহসে কুলোয় না।
বাগ করুণ ভাবে জিজ্ঞাসা করে—’এখুনি যেতে হবে, বলছেন?’
‘হ্যাঁ, তাই বলছি।’—মামাবাবু একেবারে অটল।
‘বেশ যাচ্ছি। এসো হে নাগ।’—এখন নাগকেই এগিয়ে দেবার উৎসাহটা বাগের খুব বেশি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ চলো না।’—নাগ এ সম্মানে কিন্তু রাজি নয়।
কে আগে যাবে তাই নিয়ে দুচারবার গড়িমসি করে শেষ পর্যন্ত নমিতার সঙ্গে যাওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকে না।
পেছনের মহলে ঢোকবার পর চারিদিকে একবার তাকিয়ে দু’জনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
নমিতা বলে—’কই চলুন। এই তো সেই জায়গা।’
এ যে কি জায়গা তা আর তাদের তখন বুঝতে বাকি নেই।
‘যাও না নাগ—গিয়ে দেখে এসা না!’—এসব ছোট কাজ যেন তার উপযুক্ত নয়, বাগ এবার এইরকম একটা ভাব দেখায়।
কিন্তু নাগ তাতে ভোলবার পাত্র নয়।
‘আমি দেখে আসব! কেন? তুমি যাও না! তুমি না Senior partner. সব কিছুতে তুমি আগে! যাও এবার Senior partner!’
এ খোঁচা সহ্য করতে বাগ প্রস্তুত নয়। গম্ভীর হয়ে বলে—‘Senior partner তো নিশ্চয়ই! Senior হিসেবে আমি তোমায় Order করছি। যাও দেখে এস।’
জবাবটার জন্যে দু’সেকেন্ড নাগকে ভাবতে হয়। তারপর সে সগর্বে বলে—’তোমার অর্ডার আমি Cancel করলাম।’
‘Cancel করে দিলে!’—বাগ একটু বিপদেই পড়ে। তারপর হঠাৎ রাস্তা খুঁজে পেয়ে সদম্ভে জানায়—’আমি অর্ডার আবার Re-issue করলাম।—এইবার!’
‘কি করলে?’—নাগ ঠিক থই পায় না।
‘Re-issue করলাম।’—বাগ অবজ্ঞা মিশ্রিত করুণার সঙ্গে নাগকে বুঝিয়ে দেয়—’ও তুমি তো আবার ইংরিজি জান না। Re-issue করলাম মানে আমার হুকুম আবার চালু করলাম!’
এদের কাণ্ড—কারখানা দেখে নমিতার পক্ষে হাসি চেপে রাখাই কঠিন। তবু সে বিরক্তির ভান করে বলে—’আপনারা ঝগড়া করবেন, না জায়গাটা দেখবেন?’
‘না, না, দেখতে হবে বই কি!’—লজ্জা পেয়ে বাগ এবার সাহস দেখায়—’আমি কি ওই নাগের মতো ভয় কাতুরে নাকি?’
বীর বিক্রমে বাগ কয়েক পা এগিয়ে যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
‘Good Morning!’
হঠাৎ কোথা থেকে যেন অশরীরী সম্ভাষণ শুনে বাগ একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠিক তার পেছনেই বিস্ময়ে মুখব্যাদন করে নাগ।
‘Good morning বললে কে?’—বাগ সভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
নাগ শুষ্ক মুখে স্বীকার করে—’আমি বলিনি।’
‘তুমি বলনি তা জানি। তুমি কি ইংরিজি জান! কিন্তু বললে কে?’—বাগ সতর্ক ভাবে চারিদিকে তাকাতে গিয়ে আবার চমকে ওঠে।
কিছুদূরের একটা খিলানের পেছন থেকে কিরকম একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এক মুহূর্তে হুলস্থূল বেধে যায়।
‘ও বাবা, আমি পালাই।’ বলে নমিতা বাড়ির ভেতরে ছুট দেয়। তার পেছু নিতে গিয়ে, বোধহয় বেশি নিরাপদ বুঝে নাগ এসে দু’হাত দিয়ে বাগের বিপুল দেহটি জড়িয়ে ধরে।
‘এ সব কি!’
বাগ নিজেই তখন ভয়ে দিশেহারা। রেগে উঠে নাগের হাত দুটো সবলে ছাড়িয়ে দেয়।
খিলানের পেছন থেকে, সমস্ত গণ্ডগোলের যে মূল, তাকে এবার বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। বলা বাহুল্য সে ভিখিরি সাহেব স্বয়ং।
খানিক আগে ‘Good Morning’ বলে সম্ভাষণ করে সে একটু আরাম করে, আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলেছিল বলেই এত লন্ডভন্ড ব্যাপার।
ঝোলাটি কাঁধে নিয়ে গুহার মত খিলানের তলা থেকে বেরিয়ে এসে ভাঙা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আঙুল নেড়ে বাগ—নাগকে কাছে যেতে ইশারা করে।
বাগ—নাগের অবস্থা তখন কাহিল।
নাগকে ঠেলা দিয়ে বাগ বলে—’যাও না, তোমায় ডাকছে।’
‘আমায় ডাকবে কেন, তোমাকে ডাকছে!’—বাগকে সম্মানটা দিতে নাগের আর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
‘Come here, both of you !’—ভিখিরি সাহেব গোলোযোগ মিটিয়ে দেয়।
কিন্তু সাহস পাওয়ার বদলে তাতে বুঝি হিতে বিপরীত হয়।
‘ইংরিজি বলে যে!’—বাগ সভয়ে নাগের কাছেই বিস্ময়টা প্রকাশ করে।
‘বোধহয় সাহেব ভূত!’—নাগ সিদ্ধান্তটা জানায়।
‘No, No, I am no ghost !’—ভিখিরি সাহেব নিজেই এবার তাদের কাছে এগিয়ে আসে।
ভয়ে ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বাগ এবার নাগকেই অনুরোধ করে—’বলে দাও না, আমাদের এখন আলাপ করবার সময় নেই।’
‘আমি কি বলব। আমি কি ইংরিজি জানি। তুমি তো Senior partner, এবার তুমি বলো।’
একথায় বাগের বুঝি আত্মসম্মানে ঘা লাগে। সাহস করে দাঁড়িয়ে পড়ে মরি কি বাঁচি করে সে বলে ফেলে—’এই—মানে, Who are you?’
‘Don’t you know me !’—ভিখিরি সাহেব যেন অবাক।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাগ—নাগের তখন আর নড়বার ক্ষমতা নেই। তাদের একেবারে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ভিখিরি সাহেব প্রায় চুপি চুপি বলে—‘I am a retired Major general!’
তারপর হঠাৎ ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ভিক্ষে করে—‘Give me something !’
নাগ হতভম্ব হয়ে বাগকে জিজ্ঞাসা করে—’কি, চায় কি?’
‘পয়সা চায় বোধহয়।’
‘নেহি, নেহি, পয়সা নেহি।’ ভিখিরি সাহেব রীতিমতো চটে যায়। ‘Give me a rupee!’
‘হল আপনাদের বাড়ি দেখা!’ দূর থেকে মামাবাবুর গলা শুনেই ভিখিরি সাহেব তাড়াতাড়ি হাত গুটিয়ে নেয়।
মামাবাবু কাছে এসে তাকে সেখানে দেখে একেবারে জ্বলে ওঠেন—’এই—ফের তুমি এখানে এসেছ!’
ভিখিরি সাহেবের চেহারা তখন একেবারে বদলে গেছে। কাতরভাবে সে জানায়—’একঠো রূপয়া মাঙতা।’
‘না, না, রূপয়া—টুপয়া এখানে হবে না!’ মামাবাবু ধমকে ওঠেন। ‘দারোগা সাহেব না তোমাকে বারণ করে দিয়েছিলেন এখানে আসতে। যাও। আভি যাও। খবর দেব, দারোগা সাহেবকে!’
দারোগার নামে ভিখিরি সাহেব হঠাৎ যেন খাপ্পা হয়ে ওঠে—’ওঃ, বড়া দারোগা সাব আয়া!’
সকলের দিকে উদ্ধত দৃষ্টি হেনে সে চলে যাবার পর মামাবাবু বাগ—নাগের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করেন—’কি বাড়ি আমায় গছিয়েছেন দেখতে পাচ্ছেন!’
বাগ—নাগ তৎক্ষণাৎ আবার স্বমূর্তি ধারণ করে।
‘পাচ্ছি না আবার! চমৎকার বাড়ি।’—বাগ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
‘কী আলো!’ নাগ শুরু করে।
‘কী হাওয়া!’ বাগ বাড়িয়ে যায়।
‘কী অঢেল জায়গা!’ নাগ একেবারে গদগদ।
‘কী বড় বড় ঘর!’ বাগ মুগ্ধ।
‘রাখুন মশাই।’ মামাবাবু তাদের নামতা থামিয়ে উষ্ণস্বরে বলেন—’এত ভালো যদি বাড়ি হয় তো খদ্দেরের ভাবনা কি আপনাদের!’
‘না, ভাবনা আবার কিসের? কি বল নাগ?’
‘হ্যাঁ, এ বাড়ি বিক্রির আবার ভাবনা।’ নাগের কথায় মনে হয় রাস্তায় এরই মধ্যে এ—বাড়ির খদ্দেররা যেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।
আধ ঘন্টাটাক বাদে সিঁড়ির নীচের হলের একটি টেবিলের দু’ধারে দুটি চেয়ারে, বাগ ও নাগকে অত্যন্ত মন—মরা ভাবে বসে থাকতে দেখা যায়।
অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করে নাগ শেষ পর্যন্ত বাগকেই প্রশ্নটা না করে পারে না—’আচ্ছা আমাদের বসতে বলে গেল কেন, বল তো?’
‘কেন বুঝতে পারলে না!’—বাগ অবজ্ঞাভরে তার দিকে তাকায়।
নাগ কিন্তু সেটা গ্রাহ্য না করে উৎসাহিত হয়ে ওঠে—’বোধ হয় না খাইয়েদাইয়ে ছাড়বে না,—না?’
‘হ্যাঁ, খাওয়ার ব্যবস্থাই হচ্ছে! বাড়ি পেয়ে যা খুশি হয়েছে একেবারে উত্তমমধ্যম না খাইয়ে ছাড়বে না।’
‘উত্তমমধ্যম খাওয়াবে!’—নাগ রীতিমতো উল্লসিত হয়ে ওঠে। তারপর লোভ যে তার বেশি নেই তার প্রমাণ দিয়ে বলে—’আমার মধ্যম হলেই চলবে!’
‘মধ্যম হলেই চলবে!’ বাগ এবার খিঁচিয়ে ওঠে—’আহম্মক কোথাকার! উত্তমমধ্যম মানে জানো? উত্তমমধ্যম মানে—প্রহার—যাকে বলে মার!’
‘অ্যাঁ!’—নাগ একেবারে আঁতকে ওঠে—’মারধোর দেবে নাকি? আমি তাহলে নেই।’
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সে বাইরের দরজার দিকে পা বাড়ায়। বাগও তাকে অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত মনে করে। কিন্তু পলায়নের সুযোগ তাদের মেলে না।
‘ওকি চলে যাচ্ছেন যে!’
সিঁড়ির ওপর থেকে হাঁক দিয়ে মামাবাবু নীচে নেমে আসেন।
‘না, না, যাব কেন?’—বাগ কথাটা উড়িয়েই দেয়।
নাগ তাকে সমর্থন করে জানায়—’এই একটু পা দুটো ছাড়িয়ে নিচ্ছি।’
ভূতোর মা এসে তাদের এ বিপদ থেকে মুক্তি দেয়।
‘কে একজন বাবু বাইরে ডাকছে গো মামাবাবু—বলছে বাড়ি দেখতে এসেছে।’—খবরটা দিয়ে সে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
মামাবাবুকে আর খোঁজ নিতে বাইরে যেতে হয় না। বাড়ি দেখতে যিনি এসেছেন তিনি দরজাতেই এসে দাঁড়ান।
মামাবাবুর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও বাগ—নাগ তাঁকে দেখেই চিনতে পারে। ইনিই সেদিন তাদের অফিসে এ—বাড়ির খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন।
‘আসুন! আসুন!’ বলে অভ্যর্থনা করে বাগ—নাগ তাঁকে ভেতরে নিয়ে আসে।
‘আপনাদের অফিসে গেছলাম!’—ভদ্রলোক কৈফিয়ত স্বরূপ জানান—’শুনলাম আপনারা এখানেই এসেছেন। তাই বাড়িটা একবার নিজেই দেখতে এলাম।’
‘বেশ করেছেন। নিজের চোখে না দেখলে কি আর দেখা!’ বাগ তাঁকে সমর্থন করে। তারপর মামাবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে—’এই ইনিই বাড়িটা কেনবার জন্যে একবার দেখতে চান।’
মামাবাবু কিছু বলবার আগেই ভদ্রলোক নিজে থেকে বলেন—’তার আগে অবশ্য বাড়িটা আপনি বেচতে রাজি আছেন কিনা জানা দরকার।’
‘রাজি কি আর সহজে হতে চান!’—বাগ মামাবাবুকে কথা বলবারই অবসর দেয় না।
‘এ—বাড়ি পেলে কি কেউ ছাড়ে!’ নাগ বাড়ির দর বাড়ায়।
‘অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি।’—অসাধ্যসাধন যেন করেছে বাগের ভাবটা এমনি।
ভদ্রলোক অবিচলিত ভাবে বলেন—’তাহলে বাড়িটা আমি একটু ঘুরে দেখতে পারি বোধহয়।’
‘পারেন বই কি!’ মামাবাবু এতক্ষণে কথা বলবার সুযোগ পান। বাগ—নাগকে উদ্দেশ করে বলেন—’আপনারাই তাহলে যা দেখাবার দেখিয়ে দিন।’
‘আমরা!’—বাগ—নাগের খুব উৎসাহ আর দেখা যায় না, কিন্তু মামাবাবুর কথার ওপর কথা কইতেও সাহস হয় না।
বাড়ির পোড়ো দিকটায় ধসে পড়া একটা ঘরের ভাঙা খিলানের নীচে গুহার মতো একটা আধা অন্ধকার জায়গা।
মামাবাবু ও ইনস্পেক্টরের বারণ সত্ত্বেও দেখা যায় ভিখিরি সাহেব তার সেই আস্তানাটি ছাড়েনি।
ঝোলাটি একধারে সরিয়ে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে অর্ধশায়িত অবস্থায় আপাতত সে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে একটি আধপোড়া সিগারেটের ধূম পানে মত্ত।
হঠাৎ কী একটা শব্দে সে কান খাড়া করে উঠে বসে। তারপর তাড়াতাড়ি সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে হাত নেড়ে ধোঁয়াটা উড়িয়ে দিয়ে সতর্কভাবে খিলানের পাশ দিয়ে বাইরে তাকায়।
শুনতে ভুল তার হয়নি।
যিনি বাড়ি কিনতে চেয়েছেন, সেই ভদ্রলোককেই পেছনের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে আসতে দেখা যায়।
নীচে নেমে এসে এদিক—ওদিক সতর্কভাবে তাকিয়ে তিনি এবার যা করেন তা কিন্তু বেশ একটু অস্বাভাবিক।
পকেট থেকে একটা গোটানো ফিতে বার করে তিনি হঠাৎ সিঁড়ির নীচের একটি জায়গা মাপতে শুরু করেন।
খানিকটা মাপবার পরই কিন্তু তাড়াতাড়ি তাঁকে ফিতে গুটিয়ে নিতে দেখা যায়। ভেতর দিক থেকে আবার কাদের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
পায়ের শব্দ অবশ্য বাগ, নাগ ও মামাবাবুর। তাঁরা কাছে এসে পৌঁছোবার আগেই ভদ্রলোক ফিতেটা গুটিয়ে পকেটে ভরে ফেলেন।
মামাবাবু কাছে এসে একটু বিস্মিত ভাবেই জিজ্ঞাসা করেন—’আপনি এদিকে এসেছেন! আর আমরা খুঁজে না পেয়ে ভাবছি হঠাৎ গেলেন কোথায়!’
মামাবাবুর কথায় বোঝা যায় ভদ্রলোক কোন সময়ে এদিকে চলে এসেছেন কেউ জানতে পারেনি।
ভদ্রলোক কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্যভাবে বুঝিয়ে দেন। বরং উল্টো অভিযোগ করে বলেন—’আপনারা তো শুধু ভালো দিকটাই দেখাচ্ছিলেন, তাই ভাবলাম এদিকটাও একবার দেখা দরকার—!’
‘দেখবেন বই কি!’—বাগ তাঁকে সোৎসাহে সমর্থন করে—’বাড়ি কিনতে হলে সব দিকই দেখা দরকার।’
মামাবাবু জিজ্ঞাসা করেন—’পছন্দ হল বাড়ি?’
ভদ্রলোককে আর মুখ খুলতে হয় না। বাগ—নাগের নামতা শুরু হয়ে যায়— ‘হবে না পছন্দ!’
‘কী মজবুত সেকেলে ভিৎ!’
‘কী তখনকার খাঁটি মশলা!’
‘একটু মেরামত করলে—’
‘একেবারে রাজপ্রাসাদ!’
‘অথচ একেবারে জলের দর! জলের দর!’
দম নেবার জন্যেই বাগ—নাগকে বোধহয় থামতে হয়। ভদ্রলোক এইবার বলেন—’বাড়িটার কি একটু বদনাম আছে শুনেছি!’
‘বদনাম!’—বাগ একেবারে আকাশ থেকে পড়ে—’বাড়ির আবার নামই বা কি, আর বদনামই বা কি?’
নাগও তার সঙ্গে যোগ দেয়—’বাড়ি কি চুরিচামারি করে, না ঘুষ খায়!’
‘তবু আমার আর একটু খোঁজখবর নিতে হবে।’—ভদ্রলোক জানান।
‘বেশ তো নিন না, খোঁজ খবর।’—ভেতরে ফিরে যেতে যেতে মামাবাবু বলেন—’পছন্দ না হলে বাড়ি আপনি নেবেন কেন?’
ভিখিরি সাহেব লুকিয়ে লুকিয়ে এতক্ষণ সব কিছু দেখেছে ও শুনেছে। সকলে চলে যাবার পর খিলেনের তলা থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে এসে, সে ভেতরে যাবার গলিপথটার দিকে তাকিয়ে কী যেন মনে মনে জল্পনা করে।
হঠাৎ কাঁধের ওপর একটা চাপড় পড়ায় সে চমকে ফিরে তাকিয়ে একেবারে যেন বেসামাল হয়ে পড়ে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে সকৌতুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত হাসছে।
‘কি, দেখছ কি, লুকিয়ে লুকিয়ে?’—শ্রীমন্ত হেসে জিজ্ঞাসা করে।
‘কুছ নেহি কুছ নেহি! Just standing here!’ নির্বোধের মতো হেসে ভিখিরি সাহেব তার ধরা পড়ার অস্বস্তিটা চাপা দেবার চেষ্টা করে।
‘Just standing’. শ্রীমন্তও হাসতে হাসতে ভয় দেখিয়ে বলে—’ডাকব দারোগা সাহেবকে!’
দারোগার নামেই ভিখিরি সাহেবের মুখখানা একেবারে শুকিয়ে যায়।
‘No, No, No. Please don’t. I am a poor beggar !’—করুণ ভাবে মিনতি করে ভিখিরি সাহেব ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়—Give me something. কালসে কুছ খানে কো নেহি মিলা।’
শ্রীমন্তর মায়া হয় কিনা বলা যায় না, কিন্তু পকেট থেকে কিছু পয়সা বার করে তার হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে—’তুমি কিন্তু একটি আসল শয়তান!’
শ্রীমন্ত চলে যাবার পর ভিখিরি সাহেব ডান হাতের পয়সাগুলো একটু নাড়াচাড়া করে। তারপর শ্রীমন্তর যাবার পথের দিকে যে ভাবে সে তাকায় তাকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি অন্তত বলা চলে না।
ওদিকে বাগ—নাগের সঙ্গে নবাগত ভদ্রলোক তখন মামাবাবুর কাছে বিদায় নিচ্ছেন।
‘আচ্ছা, আমরা তাহলে চলি।’ বাগই সকলের হয়ে বলে—’যা ঠিক হয় আপনাকে পরে জানাব। নমস্কার।’
বাইরের দরজার দিকে যেতে যেতে বাগ—নাগকে কিন্তু থমকে ফিরে তাকাতে হয়। ভদ্রলোক তাদের পিছনেই আসছিলেন। দেখা যায় তিনি হঠাৎ একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে কি যন্ত্রণায় একেবারে নুয়ে পড়েছেন।
সকলে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁকে ধরে চেয়ারটায় বসিয়ে দেয়।
মামাবাবু উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করেন—’কী হল কী!’
ভদ্রলোক একটু সামলে নিয়ে কুণ্ঠিতভাবে থেমে থেমে বলেন—’না, এমন কিছু নয়। আপনাদের বোধহয় আর একটু বিরক্ত করতে হল। মাঝে মাঝে এরকম আমার হয়। তখন আর উঠতে পারি না।’
যন্ত্রণাটা আবার বোধহয় শুরু হওয়ায় ভদ্রলোক ধুঁকতে থাকেন।
‘একটু শোবার ব্যবস্থা করলে ভালো হত না?’—মামাবাবু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
‘তা হত!’—ভদ্রলোকের সঙ্কোচের কিন্তু আর সীমা নেই—’কিন্তু আপনাদের ওপর বড় অত্যাচার হয়ে যাচ্ছে।’
‘না, না, অত্যাচার কিসের!’—মামাবাবু প্রবল ভাবে প্রতিবাদ করেন।
ললিতা ওপর থেকে এই ব্যাপার দেখে তখন নেমে এসেছে। মামাবাবু তাকে জয়ন্তর ঘরে ভদ্রলোকের জন্য একটা বিছানার ব্যবস্থা করতে বলেন।
ভদ্রলোক কিন্তু তখনও কুণ্ঠিত। আপত্তি জানিয়ে বলেন—’কেন মিছিমিছি এত হাঙ্গামা করছেন। আমার কিন্তু বড় সঙ্কোচ হচ্ছে।’
‘সঙ্কোচের কিছু নেই।’ মামাবাবু আশ্বাস দেন—’যতক্ষণ না সুস্থ হন আপনি অনায়াসে এখানে থাকতে পারেন।’
ভদ্রলোককে ধরাধরি করে জয়ন্তর ঘরের একটি বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসবার পর বাগ—নাগ এবার বেশ একটু হতভম্ব ভাবেই বিদায় নেয়।
বাড়ি বেচার উৎসাহ তাদের বিশেষ আর নেই।
বারো
এ—বাড়িতে প্রথম রাত্রে ভয় পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন দুপুর বেলা ললিতা পেছনের মহলের পোড়ো দিকটা একবার করে ঘুরে যায়। এখানকার একটি জায়গা আবার তার খুব পছন্দ। সেখানে একটা বড় ঝাঁকড়া গাছের তলায় খানিকক্ষণ তার বসা চাই—ই।
আজও সে সেখানে এসে বসেছিল। আর আজ সে জোর করে নমিতাকে সঙ্গে করে এনেছে।
নমিতা খুব স্বচ্ছন্দে সেখানে বসতে কিন্তু পারেনি। খানিক উসখুস করে এদিক—ওদিক চেয়ে সে বললে—’এ জায়গাটা কি যে তোমার ভালো লাগে বাপু বুঝি না! ঘরে বুঝি বসবার জায়গা নেই!’
ললিতা একটু হেসে বললে—’কেন ঘরের চেয়ে এ জায়গাটা ভালো না? কেমন নিরিবিলি।’
‘অত নিরিবিলিতে আমার দরকার নেই!’—নমিতা সোজাসুজি স্বীকার করে ফেললে—’দিনের বেলাতেও এখানে আমার কেমন ভয় ভয় করে।’
একটু থেমে কি ভেবে নিয়ে সে আবার বললে—’আচ্ছা তুমি রোজ রোজ কেন এখানে আসো, বলব?’
‘কেন বল তো!’—ললিতার চোখে কৌতুকের হাসি।
‘তোমার একটু গোয়েন্দা হবার শখ হয়েছে।’ নমিতা তার ধারণাটা গম্ভীর ভাবে জানিয়ে দিলে—’তুমি ভাবছ, এ বাড়ির রহস্যটা তুমিই সবার আগে ধরে ফেলবে!’
‘দূর বোকা মেয়ে!’ ললিতা হেসে উঠল—’মেয়েছেলে কখনো গোয়েন্দা হয়!’
‘কেন হবে না!’—নমিতা অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ—’বুদ্ধি থাকলেই হয়। আর খুব ডিটেকটিভ বই পড়তে হয়।’
গোয়েন্দা হবার উপায়টা অনায়াসে বাতলে দিয়ে নমিতা এবার দিদিকে পরীক্ষা করবার চেষ্টা করলে—’ডিটেকটিভ গল্পের বদমায়েশদের চেহারা কিরকম হয় বল তো?’
‘কী করে জানব!’—ললিতা আবার হাসল—’বদমায়েসদের চেহারা কি একরকম হয়!’
‘হয়, হয়, তুমি জান না।’—দিদির অজ্ঞতায় নমিতা একটু অসন্তুষ্ট—’ডিটেকটিভ গল্পের সব বদমায়েশদের দাড়ি থাকে। এক মুখ দাড়ি—গোঁফ।’
ললিতা এবার অবাক হবার ভান করে বললে—’তাই নাকি!’
তারপর নিজেও যেন গভীর গবেষণায় মেতে উঠল।—’আচ্ছা আমাদের এখানে যারা আসে তাদের কার কার দাড়ি আছে ভেবে দেখ দিকি!’
দিদির কাছে উৎসাহ পেলে নমিতাকে আর পায় কে।
‘তাই তো ভাবছি।’ বলে সে তখনই হিসেব করতে বসল—’শ্রীমন্তবাবুর দাড়ি আছে, আর ওই সাহেব ভিখিরিটার—আর ওই নতুন যে লোকটি বাড়ি কিনতে এসেছে তার।’
‘ওদের মধ্যেই একজন তাহলে নিশ্চয় বদমাশ!’ ললিতা গম্ভীর ভাবে মত প্রকাশ করে তাকে তারিফ করলে—’তুই তো ডিটেকটিভ হয়েই গেছিস।’
এ প্রশংসায় গর্ববোধ করবারই কথা। কিন্তু দিদির ঠোঁটের কোণের হাসিটা হঠাৎ নমিতার চোখে পড়ে যাওয়ায় ব্যাপারটা সে ধরে ফেললে।
‘যাঃ ঠাট্টা হচ্ছে!’—বলে দিদিকে ঠেলা দেবার পর দু’জনেই খানিক হেসে লুটোপুটি।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে নমিতা বললে—’চুপ করো, চুপ করো! কে যেন ডাকল—না?’
ললিতা অবাক—’কই কে আবার ডাকল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডেকেছে, তুমি শুনতে পাওনি।’—নমিতা তীক্ষ্নদৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল।
ললিতা এবার হেসে বললে—’তাহলে তোকেই বোধহয় ডাকছে।’
‘আমায় ডাকবে কেন? তোমাকেই ডাকছে।’ নমিতাও দিদিকে ঠাট্টা করতে ছাড়লে না।
‘আমায় অমন চুপি চুপি ডাকবার কেউ নেই।’—ললিতা গম্ভীর হবার ভান করে জানালে।
‘কেউ নেই? ঠিক করে বলো তো?’—নমিতা এবার দিদিকে জ্বালাতন করবার সুবিধে পেয়েছে।
দিদি ধরবার চেষ্টা করতেই সে একটু নাগালের বাইরে পালিয়ে গিয়ে হাসতে লাগল। তারপর দূরে কি একটা লক্ষ করে কাছে এসে বললে—’কে ডাকছিলেন বুঝেছ দিদি!’
ললিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে—’কে?’
‘ওই শ্রীমন্তবাবু বোধহয়!’
সত্যিই শ্রীমন্ত পোড়ো বাড়ির আর একদিকে এসে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। বোঝা গেল ললিতা নমিতাকে সে এখনো দেখতে পায়নি।
ললিতা ভ্রূকুটি করে বললে—’আহা শ্রীমন্তবাবু আমায় ডাকতে যাবেন কেন?’
‘কেন ডাকতে নেই!’—নমিতার মুখে দুষ্টুমির হাসি। হঠাৎ সে আবার বলে উঠল—’ডাকব শ্রীমন্তবাবুকে?’
‘না, না, কী পাগলামি হচ্ছে!’—ছোট বোনের ছেলেমানুষি থামাতে পারলে ললিতা বাঁচে।
‘আহা ডাকি না!’ দিদির অনুমতির অপেক্ষা না করেই নমিতা ডেকে বসল—’শ্রীমন্তবাবু, শ্রীমন্তবাবু!’
সে ডাকে শ্রীমন্ত দূর থেকে এবার দুই বোনকে দেখতে পেল। তারপর কাছে এসে হেসে নমিতাকেই উদ্দেশ করে বললে—’কি নমিতা, আজকাল তোমারও সাহস বেড়েছে দেখছি। আগে তো এ দিকেই আসতে না।’
‘এখানো কি আসতে চাই! এই দিদিটার জন্যে আসতে হয়!’ নমিতা দিদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানালে। তারপর দিদির চোখের নীরব শাসন যেন দেখতেই পায়নি এমনি ভাবে জিজ্ঞাসা করলে—’আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব শ্রীমন্তবাবু!’
না, এই পাগল মেয়েটার কোনো কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেই। এখুনি হয়তো শ্রীমন্তবাবু ডাকছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করে বসবে। দারুণ মুসকিলে পড়ে চাপা গলায় ললিতাকে তাই ধমক দিতে হল—’নমিতা।’
কিন্তু সে ধমক গ্রাহ্য করে কে! নমিতা উঠে পড়ে শ্রীমন্তর কাছে গিয়ে তখন দাঁড়িয়েছে।
ললিতা একেবারে তটস্থ। কিন্তু যে প্রশ্ন নমিতা এবার করে বসল, তাতে ললিতার পক্ষেও হাসি চাপা কঠিন।
‘আচ্ছা আপনি—আপনি—’ দিদিকে খানিক দারুণ অস্বস্তির মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে—’আপনি দাড়ি রাখেন কেন?’
এমন প্রশ্ন শ্রীমন্তরও বুঝি কল্পনার অতীত।
‘তাই তো এ তো বড় কঠিন প্রশ্ন!’—শ্রীমন্তকে রীতিমতো ভাবিত মনে হল। অনেক কষ্টে সে যেন উত্তর খুঁজে পেয়ে বললে—বোধহয় কামাবার সময় পাই না বলে। তা তোমার যদি আপত্তি থাকে, না হয় কামিয়েই ফেলব।’
‘না, না, দাড়িতে আপনাকে বেশ ভালো দেখায়!’—নমিতা দাড়ির স্বপক্ষে রায় দিয়ে ফেললে।
শ্রীমন্ত যেন একেবারে উৎফুল্ল।
‘তাই নাকি! শুনে কি সাহসই যে পেলাম। হয়ত একদিন দাড়ির চ্যাম্পিয়নই হয়ে যাবে।’
তিনজনেই এবার হেসে উঠল।
তেরো
সেই দিন বিকেলের দিকেই মিঃ সোম বাইরের মাঠ দিয়ে পেছনের মহলে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ অবাক হয়ে তিনি থমকে দাঁড়ান।
পোড়ো বাড়ির একটা ভাঙা চাতালের কাছে জয়ন্ত গভীর ভাবে কী যেন একটা ভাবতে ভাবতে পায়চারি করছে। তার চলাফেরা ও গভীর তন্ময়তার ধরনে, ভাবনাটা মতলব আঁটা বলে সন্দেহ করাও খুব অস্বাভাবিক বোধহয় নয়।
খানিক নীরবে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করে মিঃ সোম কাছে এসে জয়ন্তকে চমকে দেন।
‘কি ভাবছিলেন, জয়ন্তবাবু? কি একটা ব্যাপার যেন বুঝে উঠতে পারছেন না, মনে হচ্ছে!’
জয়ন্ত পায়চারি থামিয়ে চমকেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এবার গম্ভীর ভাবে বলে—’না বুঝতে পেরেছি বলেই ভাবছি!’
‘বুঝতে পেরেছেন! সেটা কি জানতে পারি?’—মিঃ সোম একটু বিদ্রূপের স্বরেই জিজ্ঞাসা করেন।
‘পারেন।’—জয়ন্ত বিদ্রূপটা অগ্রাহ্য করে বলে—’সত্যি কথা বলতে কি আপনারই আগে জানা দরকার।’
একটু থেমে জয়ন্ত গলা নামিয়ে আবার বলে—’শুনুন মিঃ সোম, আজ রাত্রেই এখানে একটা গুরুতর কিছু ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।’
‘আজ রাত্রেই ঘটবে আপনি আগে থাকতে নিশ্চিত করে জানলেন কি করে!’—মিঃ সোমের কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপের চেয়ে বিস্ময়টাই এবার বেশি।
‘কী করে জানলাম তা না—ই এখন জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কথাটা শুনে আগে থাকতে সাবধান হওয়াটা তো দোষের নয়!’
‘না, তা দোষের নয়!’—মিঃ সোম স্বীকার করেন। ‘কিন্তু সাবধান হওয়া মানে তো আপনাদেরই ওপর নজর রাখা!’—সোম একটু হাসেন।
‘হ্যাঁ, আমাদের ওপর!’—ভেতরে যাই হোক, বাইরে অবিচলিত থেকে জয়ন্ত জবাব দেয়—’কিন্তু আশা করি, শুধু আমার ওপর নয়—!’
‘আপনার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছি।’ সোম খোঁচা দিয়ে বলেন—’শ্রীমন্তবাবুর ওপর নজর রাখতে বলছেন তো!’
‘না, ঠিক তা বলিনি।’ জয়ন্ত কঠিন স্বরে জানায়। ‘তবু শ্রীমন্তবাবুর ওপরও নজর রাখবেন না কেন? অন্তত আজ রাত্রে রাখা দরকার।’
উদ্ধতভাবে শেষ কথাগুলো বলে জযন্ত আর সেখানে দাঁড়ায় না।
মিঃ সোমকে কিন্তু অনেকক্ষণ সেখানে গভীর ভাবে কি যেন ভাবতে দেখা যায়।
রাত তখনও খুব বেশি হয়নি। ভূতোর মার কাংস্যকণ্ঠে হঠাৎ বাড়ি সরগরম হয়ে ওঠে।
হাতে এক কাপ চা নিয়ে সে জয়ন্তর ঘরে গিয়েছিল। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়েই তার গজরানি শুরু হয়ে যায়।
‘যেমন ভূতুড়ে বাড়ি, মানুষজনও কি এখানে তেমনি আসে গা!’
মামাবাবু ব্যস্ত হয়ে ওপর থেকে নেমে এসে বিরক্ত হয়ে বলেন—’চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছ কেন? কী, হয়েছে কী!’
‘হবে আবার কি! আমায় মিছিমিছি হয়রানি!’ ভূতোর মার গজরানি থামে না—’ওই যে তোমাদের নতুন কে ভদ্দর নোক এসেছে গো বাড়ি কিনতে—এই আত্তিরে তাঁর হুকুম হল এক কাপ চা চাই। চা নিয়ে এসে দেখি—ঘরেই নেই।’
‘ঘরেই নেই!’ মামাবাবু সত্যি অবাক হয়ে যান। ‘ভদ্দরলোক যে অসুখ বলে আজ এখান থেকে যেতে পারলেন না! তাঁর তো ঘরে শুয়ে থাকবার কথা।’
‘তবে আর বলছি কি!’ ভূতোর মা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে।
‘জয়ন্ত কোথায়! সে ঘরে নেই?’—মামাবাবু জিজ্ঞাসা করেন।
‘তিনি আবার ঘরে থাকে কখন!’ ভূতোর মা খেঁকিয়ে ওঠে। ‘সেই সন্ধের সময় বেরিয়ে গেছে।’
মামাবাবু অত্যন্ত চিন্তিত ভাবে বলেন—’তাই তো! ভদ্রলোক গেলেন কোথায় এমন সময়ে!’
‘মামাবাবু!’—হঠাৎ ওপর থেকে ললিতার ডাক শোনা যায়।
দ্রুতপদে তার নামার ধরন দেখেই একটা গুরুতর কিছু ঘটেছে বলে মামাবাবু আশঙ্কা করেন।
মামাবাবুর আশঙ্কা যে অমূলক নয় ললিতার কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কাছে এসে উত্তেজিত ভাবে এক নিশ্বাসে সে বলে যায়—’ওদিকের বারান্দা দিয়ে আসছিলাম, পেছনের দিকের বাগানে কাদের যেন কথা শুনলাম। কে একজন তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। নমিতাও শুনেছে!’
মামাবাবু যেন দিশেহারা হয়ে পড়েন।
‘এ তো বড় মুসকিলে পড়া গেল দেখছি! চল দেখি।’ বলে ললিতাকে নিয়ে তিনি ওপরে গেলেন।
কিন্তু যে বারান্দা থেকে ললিতারা পেছনের বাগানের কথাবার্তা ও চিৎকার শুনেছিল সেখান থেকে এমন কিছুই শোনা বা দেখা যায় না। নিস্তব্ধ অন্ধকারে সমস্ত জায়গাটা শুধু থমথম করছে।
মিঃ সোমের নির্দেশের কথাটা এবার মামাবাবুর মনে পড়ে যায়। ওপরের চিলকুঠুরিতে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করতে তিনি ললিতাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ফিরে আসেন!
জয়ন্তর ইঙ্গিতের কোনো মূল্য তাঁর কাছে থাক বা না থাক মিঃ সোম তখন শ্রীমন্তর বাড়ির দিকেই আসছিলেন।
বাড়িতে ঢোকবার আগেই ভেতর থেকে সুমিষ্ট বেহালার আওয়াজ তিনি শুনতে পান। শ্রীমন্ত শুধু ছবি আঁকে না, বেহালার হাতও যে তার আশ্চর্য রকম মধুর, এ বাজনা শুনে তা স্বীকার করতেই হয়।
শ্রীমন্তর বাড়ির দরজা পর্যন্ত এসেও ভেতরে ঢোকা সোমের আর হয় না। দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ান।
দূরে মামাবাবুদের বাড়ির চিলকুঠুরি থেকে উজ্জ্বল একটা আলো দেখা যাচ্ছে।
এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোম সেদিকে ছুটতে শুরু করেন।
সোম যখন গিয়ে পৌঁছান, মামাবাবু তখন নীচের হলে উদ্বিগ্ন ভাবে একটি বাতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
সোমকে দেখে ব্যস্তভাবে তিনি এগিয়ে আসেন।
‘আপনার চিলকুঠুরির আলো দেখে এলাম। কী হয়েছে কী?’—সোম উৎসুক ভাবে জিজ্ঞাসা করেন।
‘ব্যাপার এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মামাবাবুর দিশাহারা ভাব এখনো কাটেনি। বিমূঢ়ভাবে তিনি বলে যান—’এক ভদ্রলোক বাড়ি কিনতে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে আজ রাতটা এখানে ছিলেন। তাঁকে ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে বাড়ির পেছনের মহলে আমার ভাগনীরা কাদের যেন কথাবার্তা আর একটা চিৎকার শুনেছে!’
মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে সোম বলেন—’জয়ন্তবাবুর কথাই তাহলে ঠিক হল মনে হচ্ছে। আচ্ছা আসুন।’
সোম পেছনের মহলের দিকে এগিয়ে যান। লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে মামাবাবু তাঁর অনুসরণ করেন।
পেছনের ধ্বসে যাওয়া মহল তো ছোটখাটো জায়গা নয়। তার ওপর একেবারে গাঢ় অন্ধকার। সামান্য লণ্ঠনের আলোয় তার কতটুকু দেখা যায়।
খানিক এপাশে—ওপাশে একটু ঘুরে সোম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করেন—’শব্দটা এই দিক থেকেই শোনা গেছল বলছেন!’
‘হ্যাঁ, ললিতা—নমিতা তো তাই বললে।’ নেহাত অকারণে যে ইনস্পেক্টরকে কষ্ট দিচ্ছেন না তা বোঝাবার জন্যেই মামাবাবু বলেন। ‘সেই জন্যই তো আপনার কথা মতো চিলকুঠুরিতে আলো জ্বাললাম!’
‘বাড়ি কিনতে যিনি এসেছিলেন তাঁকে কতক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না?’—সোম প্রশ্ন করেন।
‘ঠিক বলতে পারছি না। তবে বেশ খানিকক্ষণ হবে। অসুস্থ হয়ে তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে কাউকে কিছু না বলে কখন যে বেরিয়ে গেছেন কেউ জানে না।’
মামাবাবুর কথায় সোম খানিকটা কী যেন ভাবেন, তারপর পকেট থেকে টর্চটা বার করে জ্বেলে দূরের বাগানটার ওপর ফেলেন।
অন্ধকারে টর্চের জোরালো আলোটা এধারে—ওধারে ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ দু’জনেই চমকে ওঠেন। যে ভাঙা চাতালের কাছে বিকালে জয়ন্তর সঙ্গে মিঃ সোমের কথা হয়েছিল সেখানে কে যেন একজন বসে আছে।
দু’জনে তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে যান। কয়েক পা যেতেই লোকটিকে চেনা যায়। বাড়ি কিনতে যিনি এসেছিলেন সেই ভদ্রলোকই একটা ভাঙা থামে হেলান দিয়ে বসে আছেন।
মামাবাবু কাছে গিয়ে একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলেন—’কি মশাই! আপনি এখানে এসে—’
তাঁর মুখের কথা মুখেই থেকে যায়।
সোম ভদ্রলোকের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার পিঠটা একটু ছুঁয়েছিলেন মাত্র। ভদ্রলোকের দেহটা তাইতেই একটা ভারী পাথরের মতো সামনের মেঝের ওপর সশব্দে পড়ে যায়!
‘ব্যাপার কী!’—মামাবাবু সভয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন।
‘কী আর!’ টর্চের আলো দেহটার ওপর ধরে সোম গম্ভীর স্বরে বলেন—‘He is already dead! পিঠে কে ছুরি মেরেছে!’
পিঠের ওপর ছুরিটা এখনও গেঁথে রয়েছে। রক্ত যা গড়িয়ে পড়েছে তা এখনও ভালো করে জমাট বাঁধেনি। সোম বেশ একটু কষ্ট করে ছুরিটা পিঠ থেকে টেনে বার করে আবার বলেন—’যে ছুরি মেরেছে সে নিজেও একটু জখম হয়েছে, মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, এই তো রক্তের দাগ;’—মামাবাবু লণ্ঠনটা নামিয়ে রক্তের দাগটা বাইরের দিকে যে চলে গেছে তা দেখিয়ে বলেন—’এই দিক দিয়েই লোকটা পালিয়েছে!’
হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে যান।
‘একি জযন্ত, তুমি!’
বাইরের দিক থেকে জয়ন্তই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘হ্যাঁ, আমি একটু বেরিয়েছিলাম! দূর থেকে চিলকোঠার জানলায় আলো দেখে ফিরে এলাম।’—বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে এসে জয়ন্ত হঠাৎ নীচের দিকে চেয়ে চমকে ওঠে।
‘একি!’ স্তম্ভিত ভাবে খানিক সে দিকে চেয়ে থেকে সে গম্ভীর ভাবে খানিকটা যেন নিজের মনেই বলে—’আমি অবশ্য এই রকম একটা ভয়ই করছিলাম।’
পর মুহূর্তে সে—ই মুখ ফিরিয়ে বলে ওঠে—’আরে শ্রীমন্তবাবু যে!’
শ্রীমন্ত কাছে এসে দাঁড়াবার পর জয়ন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে—’আপনি হঠাৎ এখানে এসে হাজির হলেন কী করে!’
‘আমি!’ শ্রীমন্ত বিস্মিত ভাবে বলে—বাঃ, আপনিই তো আমায় ডেকে এলেন!’
‘আমি ডেকে এলাম! আমি আপনার বাড়ির ত্রিসীমানায় ছিলাম না!’—জয়ন্ত তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
‘তাহলে তো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার!’—শ্রীমন্ত বিমূঢ় ভাবে বিবরণটা দেয়—’বাইরে থেকে আমার দরজায় কে ধাক্কা দিলে। কে—জিজ্ঞাসা করাতে বললে—মিঃ সোম এখুনি একবার আমায় এখানে ডাকছেন। গলাটা তো আপনার বলে—ই আমার মনে হল। দরজা খুলে অবশ্য কাউকে দেখতে পাইনি।’
শ্রীমন্তর কথা শেষ হতে জয়ন্ত তার হাতের দিকে চেয়ে বলে—’আপনার হাতটা কেটে গেছে দেখছি।’
শ্রীমন্তর ডান হাতের একটা আঙুলে সত্যিই পটি জড়ানো। সেটা নিজেই তুলে ধরে সে বলে—’হ্যাঁ, এইমাত্র দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে গিয়ে চিপসে গেল।’
‘একটু আগে তাহলে আপনি বাড়িতেই ছিলেন?’—জয়ন্ত ঈষৎ অবিশ্বাসের সুরেই প্রশ্ন করে।
সুরটা ধরতে পারলেও শ্রীমন্ত হেসে বলে—’আপনার কী মনে হয়!’
‘এসব প্রশ্নগুলো আমাকেই করতে দিন জয়ন্তবাবু!’ সোম এতক্ষণ খুনের ছুরিটা পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে সাবধানে তাতে জড়িয়ে রাখছিলেন। সেটা পকেটে রেখে তিনি একটু বিরক্ত ভাবেই বলেন—’উনি কোথায় ছিলেন, তা আমি জানি, কিন্তু আপনি ঠিক কোথায় ছিলেন বলুন তো?’
‘আমি!’—জয়ন্তকে সামান্য একটু বিব্রত মনে হয়। তারপর সে সহজ ভাবে বলে—’বললাম তো একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম।’
‘এই এত রাত্রে!’—সোম বিস্ময় প্রকাশ করেন—’আপনার শখ তো মন্দ নয়।’
এ প্রসঙ্গ আপাতত স্থগিত রেখে সোম আবার বলেন—’আচ্ছা এখন এই লাশটা একটু ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। আমায় একটু সাহায্য করুন দেখি।’
জয়ন্ত ও শ্রীমন্ত দু’জনেই সোমকে সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে আসে।
লাশটা তোলবার সুবিধের জন্যে ডান হাতের আস্তিনটা একটু গোটাতে গিয়েও জয়ন্ত আবার সেটা টেনে নামিয়ে দেয়। সেইটুকুর মধ্যে তার কব্জির ওপরকার ব্যান্ডেজটা কারুর চোখে পড়ে কিনা বলা যায় না।
চৌদ্দো
বাড়ি কিনতে এসে যিনি খুন হয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর দু’দিন পরে সিঁড়ির নীচের হল ঘরে সেদিন সকাল বেলা শ্রীমন্ত, জয়ন্ত, মামাবাবু ও সোম চারজনকেই উপস্থিত দেখা গেল।
মিঃ সোমই সকলকে এখানে আজ ডাকিয়ে এনেছেন। টেবিলের চারিধারে সবাই বসবার পর মিঃ সোম শুরু করেন—’কেন আপনাদের সকলকে আজ একসঙ্গে ডেকেছি তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। এ বাড়ির রহস্য একটা ছিল, কিন্তু এই ক’দিনের মধ্যেই সত্যিকার একটা খুন হবার পর ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যে তাই একটা আলোচনা আমাদের হওয়া দরকার।’
‘নিজেদের মধ্যে বলে আমাদের অযথা সম্মান দিচ্ছেন।’ জয়ন্ত উদ্ধত ভাবে প্রতিবাদ করে—’আসল কথা এ ব্যাপারে যারা জড়িত বলে সন্দেহ করেন তাদের একটু বাজিয়ে দেখতে চান—এই তো?’
‘তাই যদি মনে করেন, তাহলে আপনাকেই একটা কথা প্রথম জিজ্ঞাসা করি।’ সোমের মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। জয়ন্তর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি প্রশ্ন করেন—’আপনার হাতটা সেদিন কেটেছিল কী করে?’
‘আমার হাত!’—জয়ন্ত প্রথমটা এ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে বেশ একটু বিচলিত হয়েছে মনে হয়। তারপর কঠিন স্বরে বলে—’না, হাত আমার কাটেনি। একটু ছড়ে গিয়েছিল।’
সকলে তবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে দেখে সে বুঝিয়ে দিয়ে বলে—’আগেই তো বলেছি, সেদিন একটা কিছু ঘটতে পারে সন্দেহ করে বাইরে পাহারায় ছিলাম। আপনাদের সঙ্গে দেখা হবার কিছু আগে একটা লোককে ও—বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখি। তাকে ধরবার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে হাতটা ছড়ে যায়।’
‘তাকে ধরতে তাহলে পারেননি!’—সোমের মুখে যেন ঈষৎ হাসির আভাস।
‘ধরব কী করে!’ জয়ন্ত রেগে ওঠে—’বললাম তো পড়ে গিয়েছিলাম।’
প্রসঙ্গটা অপাতত চাপা দিয়ে সোম বলেন—’যাই হোক, আমার আসল কথা যা ভেবেছেন ঠিক তা নয়। এ—বাড়ির রহস্য ভেদ করবার জন্যে, আপনাদের সকলের সাহায্য আমার দরকার। তাই দুটো কথা আপনাদের জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তার প্রথম হল এই যে— যে লোকটি এখানে সেদিন খুন হয়েছে সে এ—বাড়ির প্রথম মালিক শশীশেখরেরই একজন সাকরেদ ছিল বলে জানা গেছে।’
‘তাহলে বাড়ি কিনতে আসাটা তার ভান!’—মামাবাবু অবাক হয়ে যান।
‘হ্যাঁ, আসলে এ—বাড়ির গুপ্তধনের সন্ধানেই সে এসেছিল মনে হচ্ছে।’ শ্রীমন্ত তার সন্দেহটা প্রকাশ করায় মিঃ সোম তার কথায় সায় দিয়ে বলেন—’এবং সেই জন্যেই অসুখের ছল করে রাতটা সে এখানে ছিল।’
‘বুঝলাম, এখন দ্বিতীয় কথাটা কী!’—অধৈর্যের সঙ্গে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করে।
‘দ্বিতীয় কথাটা এই যে, এ—বাড়ির বিভীষিকা সেই অদ্ভুত জানোয়ারের লোম আমি পরীক্ষা করে আনিয়েছি। তা গরিলা বা সেরকম কোনো প্রাণীর লোম নয়।’
‘এ সংবাদটা সত্যিই বিস্ময়কর।’ মামাবাবু খানিকটা আশ্বস্তও বোধহয় হন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন—’আমরা এখন কী সাহায্য আপনাকে করতে পারি বলুন।’
‘সাহায্য আর কিছু নয়। এখন থেকে আর একটু বেশি সজাগ থাকা।’ সোম মামাবাবুকে উদ্দেশ করে এবার একটু লজ্জিত ভাবে বলেন—’তবে আপনার কাছে আমার একটু ক্ষমা চাইবার আছে, আপনাকে নির্ভয় হবার যে আশ্বাস দিয়েছিলাম, তা আমি রাখতে পারিনি। তাই বলছি সুবিধে থাকলে এ বাড়ি এখন আপনাদের ছেড়ে দেওয়াই ভালো।’
‘না, মিঃ সোম!’—মামাবাবুর মত একেবারে বদলে গেছে দেখা যায়—’আমারও এখন জেদ চেপে গেছে। এ রহস্যের শেষ না দেখে এ—বাড়ি ছাড়ব না।’
নিজের সঙ্কল্পের দৃঢ়তাটা বোঝাবার জন্যেই মামাবাবু টেবিলের ওপর সজোরে একটা চাপড় মেরে উঠে দাঁড়ান।
প্রথম রাত্রের সেই ‘দানো ভূত’ দেখা, আর তারপর সত্যিকার একটা খুনের কথা শোনার পর, ভূতোর মা কি অবস্থায় এ—বাড়িতে যে কাজ করছে তা বোঝাবার বোধহয় প্রয়োজন নেই। মুখে যাই বলুক, অন্তরে ললিতা—নমিতার ওপর সত্যিকার একটা মায়া পড়েছে বলেই শুধু সে ছেড়ে যেতে পারে না।
সারাক্ষণ কিন্তু ভয়ে ভয়েই সে কাটায়, আর এমনি তার কপাল যে, যত বিতিকিচ্ছি ব্যাপার কি সবার আগে তারই চোখে পড়ে!
সেদিন দুপুরবেলা রান্নাঘরের কাজটাজ সেরে ওপরে যেতে গিয়ে তাকে একেবারে থ’ হয়ে দাঁড়াতে হয়।
সেই হতভাগা ভিখিরি সাহেবটা এদিক—ওদিক চেয়ে ঠিক চোরের মতো দোতলা থেকে নামছে!
ভূতোর মা পারতপক্ষে এখনো পেছনের মহলের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। তবু রাস্তায়—ঘাটে এই অদ্ভুত লোকটা তার চোখে পড়েছে। পেছনের পোড়ো বাড়ির জঙ্গলে যে তার আস্তানা ললিতা—নমিতার কাছে সে কথাও শুনেছে।
দিন দুপুর বেলা সেই বিদঘুটে লোকটাকে একেবারে ভেতরের মহল থেকে নামতে দেখে ভূতোর মা প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেলেও পরের মুহূর্তে একেবারে ঝঙ্কার দিয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে তোলে।
‘ও মা এ কী কাণ্ড গো! এ হতভাগা একেবারে বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল যে। একি আস্পর্ধা গো!’
ভূতোর মার গলা শুনেই ভিখিরি সাহেব সভয়ে চমকে ফিরে দাঁড়ায়। তারপর তাড়াতাড়ি নেমে এসে মধুর হাসিতে ভূতোর মাকে একেবারে জল করে দেবার চেষ্টা করে—’আরে কাহে চিল্লাতা! আমি তো চলে যাচ্ছে!’
ভূতোর মার কাছ থেকে গোঁত্তা মেরে চলে যেতে গিয়ে কিন্তু হঠাৎ সে বাধা পায়।
‘কোথায় চলে যাচ্ছ!’—শ্রীমন্তই পেছন থেকে এসে তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। কঠিন স্বরে সে জিজ্ঞাসা করে—’বাড়ির ভেতর ঢুকেছিলে কেন?’
‘নেহি নেহি!’—কাতর ভাবে ভিখিরি সাহেব সাফাই গাইবার চেষ্টা করে—‘I was just passing!’
শ্রীমন্ত এতক্ষণ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্য করছিল। আগের প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করে—’হাতটা কাটল কি করে?’
ভিখিরি সাহেবের হাতের দুটো আঙুল সত্যি পটি বাঁধা। এ প্রশ্নে সে কিন্তু অম্লান বদনে বলে—’এই সি কট গয়া।—Only a scratch! চাক্কুসে কট গয়া।’
নীচের গোলমাল মামাবাবুরও তখন কানে গেছে। ওপর থেকে নামতে নামতে তিনি জিজ্ঞাসা করেন—’কী, ব্যাপার কী!’
শ্রীমন্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়—’ব্যাপার গুরুতর! ইনি পেছনের মহল ছেড়ে একেবারে আপনাদের ওপরে গিয়ে হানা দিয়েছিলেন।’ তারপর ভিখিরি সাহেবের দিকে ফিরে কড়া গলায় বলে—’চল আমিই আজ তোমায় থানায় নিয়ে যাব।’
ভিখিরি সাহেবের হাতটা ধরতেই সে হতভাগা অমন যন্ত্রণায় যে ককিয়ে উঠবে শ্রীমন্ত মোটেই তার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। নিজের অজান্তেই সে চমকে উঠে হাতটা ছেড়ে দেয়।
ভিখিরি সাহেব শ্রীমন্তকে ভেংচে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে এক দৌড়ে উধাও।
‘পালিয়ে গেল! ধরে রাখতে পারলেন না!’—মামাবাবুর আফসোসটা বেশি।
শ্রীমন্ত হেসে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—’যাক, কতদিন আর পালিয়ে থাকবে!’ তারপর নিজের আসার উদ্দেশ্যটা জানায়—’শুনুন, আজ আপনাদের সকলকে আমাদের বাড়িতে একটু যেতে হবে। পরিচয় হওয়া অবধি একদিনও তো যাননি। জয়ন্তবাবুর দেখা পেলাম না, তাঁকেও একটু বলে দেবেন। কেমন আসবেন তো সবাই?’
‘হ্যাঁ, যাব বই কি! আপনি নিমন্ত্রণ করছেন, আর যাব না!’ মামাবাবু সানন্দে সম্মতি জানান।
ছবির সমঝদার সত্যিই কেউ নয়, তবু ললিতা ও জয়ন্তকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সমস্ত ছবি দেখে মামাবাবু খুশিই হলেন।
‘বাঃ—চমৎকার!’ ছবির তারিফ করে তিনি বললেন—’কিন্তু এই বনগাঁয়ে আপনার এই রঙের হাটের কদর কে বুঝবে তাই ভাবছি।’
কারুর প্রশংসার আশায় নয়, শুধু নির্জনে নিজের কাজের সুবিধের জন্যেই এখানে যে সে আছে, শ্রীমন্ত লজ্জিত ভাবে সেই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা করছিল। তারই মধ্যে জয়ন্ত বাধা দিয়ে ফোড়ন কাটলে—’বনগাঁয়ে উনি বোধহয় শেয়াল রাজা হতে চান।’
শ্রীমন্ত একটু হেসে পাল্টা জবাব দিলে—’সিংহ হওয়া যাদের ভাগ্যে নেই তাদের শিয়াল রাজা হয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত না কি?’
জয়ন্ত কিছু বলবার আগেই ললিতার সমর্থনসূচক মন্তব্য শোনা গেল—’হ্যাঁ, অন্যের চামড়া ধার করে সিংহ সাজার চেয়ে শিয়াল রাজা হওয়া বোধহয় ভালো।’
কথার পিঠে একথা ঠিক আসে না। এ যেন নেহাত গায়ে পড়ে গাল দেওয়া তা বুঝলেও জয়ন্ত উত্তর দেবার সুযোগ পেল না। ললিতা খোঁচাটা দিয়েই তখন দূরে সরে গেছে।
‘মাপ করবেন একটু।’ বলে মামাবাবু ও জয়ন্তর কাছে ক্ষমা চেয়ে শ্রীমন্তও সেদিকে গেল।
ললিতা তখন ছোট বোনের কাছে গিয়ে বসেছে। নমিতা অনেকক্ষণ থেকেই সেখানে একলা একটি সোফায় উদাসীন ভাবে বসে ছিল। সকলের সঙ্গে সেও খানিক ঘুরে ঘুরে ছবি দেখবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিশেষ কিছুই না বুঝে শেষ পর্যন্ত দল ছেড়ে চলে এসেছে।
‘কী নমিতা, তুমি যে একলা চুপ করে বসে আছ!’ শ্রীমন্ত নমিতাকেই হেসে জিজ্ঞাসা করলে—’তোমার ভালো লাগছে না বুঝি?’
‘না বাবা, একসঙ্গে এত ছবি দেখলে আমার মাথা গুলিয়ে যায়।’ নমিতা স্পষ্টই স্বীকার করে ফেললে।
শ্রীমন্ত ঠাট্টা করে বললে—’শাড়ির দোকানে একসঙ্গে অনেক শাড়ি দেখলে যেমন হয়—না? আচ্ছা তোমার যা ভালো লাগবে এমন জিনিস দেখাচ্ছি চল।’
‘আসুন না ললিতা দেবী।’—শ্রীমন্ত ললিতাকেও অনুরোধ করলে।
‘না, ওকেই নিয়ে যান। আমি এখানেই একটু বসছি।’—ললিতার বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না।
‘আহা চল না দিদি’—নমিতাই এবার নাছোড়বান্দা। ওরই ভেতর আবার কথার চিমটি কেটে সে বললে—’আমার ছুতো করে তোমাকেই দেখাতে চাইছেন তা বোঝ না!’
দিদির ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে হাসতে হাসতে নমিতা তাকে টেনে নিয়ে চলল।
ছবির ঘরটি পার হয়ে একটা লম্বা করিডর দিয়ে যে ঘরটিতে তারা গিয়ে পৌঁছল সেটিকে একটি বিরাট হলই বলা উচিত।
হলের চারিদিকে নানান দেশের নানান রকম পাথর, ব্রঞ্জ ও কাঠের মূর্তি নানান ভঙ্গিতে সাজানো।
‘দেখ দিকি ছবির চেয়ে এসব ভালো লাগে কিনা!’—শ্রীমন্ত হেসে নমিতাকে জিজ্ঞাসা করলে।
জিজ্ঞাসা করবার অবশ্য দরকার ছিল না। রংচং—এর হিজিবিজির চেয়ে এসব মূর্তি নমিতার অনেক বেশি মনোমতো।
ঘুরে ঘুরে এদিক—ওদিক খুশি হয়েই তখন সে দেখছে।
হঠাৎ একটি মূর্তি দেখতে দেখতে মুখ ফেরাতে গিয়ে সে যেন আঁতকে চিৎকার করে উঠল—’কে! ও কে!’
শ্রীমন্ত চমকে তার কাছে ছুটে এল।
‘কোথায় কে?’—সবিস্ময়ে সে প্রশ্ন করলে।
‘সত্যি ওই স্ক্রিনের পেছনে কে যেন সরে গেল মনে হল।’—জবাবটা ললিতাই দিলে উত্তেজিত ভাবে। নমিতার সঙ্গে সেও ব্যাপারটা দেখেছে।
‘আমি স্পষ্ট দেখেছি। কী ভয়ানক চেহারা!’—নমিতা দিদিকে ভীত কণ্ঠে সমর্থন করলে।
‘কী, হয়েছে কী? কার ভয়ানক চেহারা?’—মামাবাবু ও জয়ন্ত পর পর প্রশ্ন করলেন। এদের পেছনে তাঁরাও এইদিকে আসতে গিয়ে নমিতার চিৎকারটা শুনেছেন।
‘বুঝতে পারছি না।’ বলে শ্রীমন্ত দূরের দেয়ালের ধারে স্ক্রিনটার দিকে দ্রুত পদে ছুটে গেল।
স্ক্রিনের এধার থেকে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
শ্রীমন্ত কড়া গলায় হাঁক দিলে—’কে? কে এখানে? বেরিয়ে এস। বেরিয়ে এস বলছি।’
কারুর কোনো সাড়াশব্দ কিন্তু পাওয়া গেল না।
এবার শ্রীমন্ত স্ক্রিনের পেছনে দেখতে যাওয়ার উপক্রম করতেই কিন্তু ফল ফলল।
যে লোকটি স্ক্রিনের পেছন থেকে এবার ক্রুদ্ধ মুখে বেরিয়ে এল তার চেহারা দেখে নমিতার ভয় পাওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। যেমন দীর্ঘ বিশাল তার দেহ, তেমনি অসংখ্য গভীর রেখায় বিকৃত বীভৎস তার মুখের চেহারা।
এই লোকটিকেই এর আগে বাগ—নাগের অফিসের সামনে একবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছল।
‘তুমি!’—লোকটিকে দেখে শ্রীমন্ত বিস্মিত শুধু নয়, রাগে একেবারে জ্বলে উঠল।—’কি করছিলে তুমি এখানে! তোমায় না এখানে আসতে আমি বারণ করে দিয়েছি!’
লোকটা তবুও চুপ। শুধু তার হিংস্র চোখগুলোর ভেতর দিয়ে যেন চাপা আগুন বেরুচ্ছে মনে হল।
মামাবাবু ও অন্যান্য সকলেও তখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘আপনার চেনা নাকি?’ মামাবাবুই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ, আগে এ—বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে রেখেছিলাম।’ শ্রীমন্ত বললে—’তারপর বেচালের জন্যে তাড়িয়ে দিই।’
লোকটার দিকে ফিরে আবার ক্রুদ্ধ স্বরে সে প্রশ্ন করলে—’বল কি করছিলে এখানে?’
‘আপনার সঙ্গে দরকার ছিল।’—কথা নয় মনে হল যেন বাঘের গলার চাপা গর্জন!
শ্রীমন্ত কিন্তু সে গর্জন ও ধমককে দাবিয়ে দিয়ে বললে—’তাই তোমার এত বড় আস্পর্ধা যে একেবারে বাড়ির ভেতর ঢুকে বসেছিলে! কী দরকার তোমার আমার সঙ্গে?’
লোকটা চাপা রাগে ফুললেও কোনো জবাব দিলে না।
‘মাইনে?’—শ্রীমন্ত নিজেই তার বক্তব্য অনুমান করে জ্বলে উঠে বললে—’সে সব আমি চুকিয়ে দিয়েছি।’
‘না, এখনো বাকি আছে।’—এবার লোকটা উদ্ধত ভাবেই জানালে।
‘না, কিছু বাকি নেই।’—শ্রীমন্ত আগুন হয়ে উঠল একেবারে। তারপর কঠিন স্বরে আদেশ করলে—’এখন যাও এখান থেকে। কোনোদিন এখানে যেন আর তোমায় না দেখি। যাও—’
এ আদেশ অমান্য করতে লোকটা বোধহয় আর সাহস করল না, তবু যাবার সময় সে জানিয়ে গেল—’মাইনে কিন্তু আমার চাই।’
লোকটা চলে যেতে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। জয়ন্ত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে হেসে বললে—’এই লোককে আপনি পাহারায় রেখেছিলেন মশাই! ও তো কোনোদিন আপনাকেই কেটে রেখে যেত!’
শ্রীমন্ত এবার হেসে বললে—’সেই ভয়েই তো ছাড়িয়ে দিয়েছি!’
‘নাঃ, এই অঞ্চলটাই সুবিধের নয়।’ মামাবাবুর শেষ মন্তব্য শোনা গেল—’সব জায়গাতেই একটা কিছু গন্ডগোল লেগেই আছে!’
মামাবাবুর মন্তব্য যে নেহাত ভুল নয়, সেদিন দুপুরেই তার আর একটি প্রমাণ পাওয়া গেল।
ললিতা কী একটা কাজে মামাবাবুর ঘরে এসে দেখে মামাবাবু অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটি পেরেক ঠুকছেন।
‘কি করছেন মামাবাবু’—ললিতা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করে। মামাবাবুর নানারকম খেয়াল তার অজানা নয়।
‘এই দেখ না মা!’—মামাবাবু হাতুড়ি নামিয়ে ললিতাকে বোঝাতে লেগে যান—’ভাড়াটে লোক দিয়ে কখনো ঘর সাজানো হয়। এই দেয়ালটা একেবারে খালিই রেখে দিয়েছে। ঘরটা কীরকম বেমানান দেখাচ্ছে বল দেখি।’
ললিতাকে গম্ভীর হয়ে সায় দিতেই হয়। সমর্থন পেয়ে মামাবাবু উৎসাহিত হয়ে বলেন—’তাই এখানে একটা ছবি টাঙাব ভাবছি।’
মামাবাবু আবার দেয়ালে পেরেক ঠোকায় মন দেন।
হঠাৎ এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে যায়, যা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
একটা সুবিধে মতো জায়গা বুঝে জোরে ক’বার হাতুড়ির ঘা দিতেই হঠাৎ দেয়ালের খানিকটা চিড় খেয়ে উল্টে গিয়ে একটা ফোকর বেরিয়ে পড়ে।
‘এ কি ব্যাপার!’—মামাবাবু চমকে এক পা পিছিয়ে দাঁড়ান।
ললিতা কাছে এসে ভালো করে লক্ষ করে বলে—’ভেতরে কি যেন একটা রয়েছে মনে হচ্ছে।’
মামাবাবুও এবার দেখতে পেয়ে হাত বাড়িয়ে সেটা বার করে আনেন।
চমৎকার নক্সাকাটা একটা কাঠের বাক্স।
টেবিলের কাছে বাক্সটা নিয়ে এসে খোলবার পর দেখা যায় একটা ভাঁজ করা বড় কাগজ তার মধ্যে রাখা।
মামাবাবু কাগজটার ভাঁজ খুলে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও কিছু বুঝতে না পেরে ললিতার হাতে দিয়ে বলেন—’কীসের কাগজ বল তো? লেখাটেখা তো কিছু নেই।’
ললিতা কিন্তু খানিক ভালো করে দেখে বলে—’কিসের যেন একটা নকশা বলে মনে হচ্ছে।’
নমিতাও ইতিমধ্যে ব্যাপারটা কী দেখবার জন্যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
মামাবাবু তাকেই বলেন—’ডাক তো নমিতা, জয়ন্তকে একবার নীচে থেকে ডেকে আন তো!’
‘জয়ন্তদা তো সকালেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে!’—নমিতা জানায়।
‘বেরিয়ে গেছে! আচ্ছা থানায়’—বলে কী বুঝে থেমে মামাবাবু আবার বলেন—’না, না, শ্রীমন্তকে একবার তাহলে খবর পাঠা দেখি!’
খবর পেয়ে শ্রীমন্ত যখন এসে পৌঁছায় তখন নীচে কেউ নেই। একটু দ্বিধাভরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই ললিতার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়।
শ্রীমন্ত নমস্কার করে একটু কুণ্ঠিত ভাবে বলে—’আপনার মামাবাবু আমায় ডাকছেন শুনে এলাম। অনুমতি না নিয়েই কিন্তু ওপরে উঠে এসেছি, কিছু মনে করবেন না।’
‘মনে যথেষ্ট করলাম!’ ললিতা একটু পরিহাস করে—’অনুমতি নিয়েই আপনার আসা উচিত ছিল। যাই হোক আপনি বসুন, আমি মামাবাবুকে ডেকে আনছি।’
সামনের একটি টেবিলের ধারে কয়েকটি চেয়ার পাতা। শ্রীমন্ত তার একটিতে গিয়ে বসে।
বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। তবে মামাবাবু নয় নমিতাই এসে প্রথম দেখা দেয়।
বেশ হাসিমুখে এগিয়ে এলেও শ্রীমন্তর কাছে এসেই দেখা যায় তার মুখ বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
শ্রীমন্ত এই অপ্রত্যাশিত গাম্ভীর্যের কারণটা ঠিক অনুমান করতে না পেরে সকৌতুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই নমিতা গম্ভীর ভাবে জানিয়ে দেয়—’আপনার সঙ্গে কথা কইব না জানেন তো!’
‘কথা যে কইবে না তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ শ্রীমন্তও গম্ভীর হবার ভান করে। ‘শুধু কি অপরাধে আমার এত বড় শাস্তি সেইটে ভেবে কূল পাচ্ছি না। চুপি চুপি বলে ফেল তো!’
‘চুপি চুপি বলব কেন!’—নমিতা দস্তুরমতো অপমান বোধ করে জানায়—’জোরেই বলব।’
তারপর ক্ষোভের আসল কারণটা সে ব্যক্ত করে,—’আপনি না আমার একটা মূর্তি তৈরি করে দেবেন বলেছিলেন! কই দিয়েছেন?’
‘ওঃ এই কথা!’ শ্রীমন্ত যেন আশ্বস্ত হয়।
কোনো দুর্বল মুহূর্তে এরকম একটা প্রতিশ্রুতি সে অবশ্য দিয়ে ফেলেছিল। এখন ত্রুটিটা সারবার চেষ্টা করে।
‘কিন্তু ব্যাপার কি জান, তোমার মূর্তি তো যে—সে পাথরের তৈরি করলে চলবে না, একেবারে স্ফটিক পাথর চাই। সেই পাথরটাই পাওয়া যাচ্ছে না।’
শ্রীমন্তর কথার ধরনে নমিতার প্রথম বুঝি একটু বিশ্বাসই হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠাট্টাটা সে ধরতে পেরে চটে যায়।
‘যত বাজে কথা!’ সে রেগে বলে—’তৈরি করবার ইচ্ছে নেই তাই বলুন। দিদি নেহাত রাজি নয় তাই, নইলে তার বেলা এতদিনে ঠিক সব জোগাড় হয়ে যেত।’ তার মুখে আবার একটু দুষ্টুমির হাসি দেখা দেয়।
‘আরে তোমার দিদির জন্যে তো পাথর লাগে না!’—শ্রীমন্ত প্রতিবাদ করে—’শুধু মাটি! মাটি!’
‘হ্যাঁ, মাটি! যান আর ঠাট্টা করতে হবে না।’ বলে দূর থেকে মামাবাবু ও দিদিকে আসতে দেখে সে হেসে ছুটে পালায়।
‘আজ বড় অদ্ভুত একটা ব্যাপার হয়েছে!’—ললিতার সঙ্গে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই মামাবাবু শুরু করেন। শ্রীমন্তর কাছে একটা চেয়ারে বসে পকেট থেকে সেই কাগজটা বার করে তিনি বলেন—’আমার ঘরের দেয়ালে একটা পেরেক ঠুকতে গিয়ে হঠাৎ একটা লুকোনো কুলুঙ্গি বেরিয়ে পড়ে। তার ভেতর একটা কাঠের বাক্সে এই কাগজটা পাই।’
কাগজটা শ্রীমন্তর হাতে দিয়ে মামাবাবু আবার বলেন—’কাগজটা কিসের কিছু বুঝতে পারছি না। তাই আপনাকে একবার দেখাবার জন্যে ডাকলাম।’
শ্রীমন্ত কাগজটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বোঝবার চেষ্টা করে। তারপর হতাশ ভাবে বলে—’এ তো কী সব হিজিবিজি আঁকা দেখছি।’
‘হ্যাঁ, হিজিবিজি, কিন্তু কোনোরকম একটা নকশা বলে মনে হচ্ছে—হয়ত কোনো গুপ্ত জায়গার!’—ললিতাই এবার বলে।
‘গুপ্ত জায়গার নকশা!’ শ্রীমন্ত আর একবার কাগজটা পরীক্ষা করে। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বলে—’আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।’
একটু হেসে সে আবার বলে—’এই ভূতুড়ে বাড়িতে থেকে থেকে আপনাদের কল্পনা একটু বেশি রঙিন হয়ে গেছে বোধহয়।’
‘তা হতে পারে।’—ললিতা স্বীকার করে। ‘কিন্তু কাগজটা খুব দামি না হলে অত যত্ন করে লুকোন থাকবে কেন?’
‘সেটা একটা ভাববার কথা বটে!’—শ্রীমন্তকে এ যুক্তির সারবত্তা স্বীকার করতেই হয়।
‘এই যে জয়ন্ত!’
হঠাৎ মামাবাবু জয়ন্তকে দেখতে পান। সে যে কখন নিঃশব্দে দূরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষই করেনি। মামাবাবু তাকে দেখে যেন অকূলে কূল পেয়ে বলেন—’তুমি একবার দেখ তো কাগজটা।’
কিন্তু জয়ন্তর জবাবে শুধু তিনি নন, সবাই অবাক হয়ে যায়।
‘থাক, আমার দেখবার দরকার হবে না। যাকে দেখাবার জন্যে ডেকেছেন তিনি দেখলেই হবে।’—বেশ রাগের সঙ্গে কথাগুলো বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মামাবাবু খানিক চুপ করে থেকে বিমূঢ় ভাবে ললিতাকেই জিজ্ঞাসা করেন—’জয়ন্তর হঠাৎ এত রাগ হল কেন?’
ললিতা চুপ করে থাকে। তার বদলে শ্রীমন্তই হেসে বলে—’জয়ন্তবাবুর ও সব ছেলেমানুষি একটু আছে। আমি তো ওঁর মেজাজের জন্যে আজকাল বেশ ভয়ে ভয়ে থাকি।’
মামাবাবু জয়ন্তর ব্যবহারে বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছেন বোঝা যায়। ও বিষয়ে কোনো কথা আর না বাড়িয়ে শ্রীমন্তকে তিনি অনুরোধ করেন—’কাগজটা আপনিই তাহলে রাখুন। দেখুন এ থেকে রহস্য কিছু উদ্ধার করা যায় কি না।’
শ্রীমন্তর খুব উৎসাহ দেখা যায় না। কুণ্ঠিত ভাবে হেসে সে বলে—’দিচ্ছেন দিন, কিন্তু রহস্য যদি কিছু থাকেও তা উদ্ধার করা আমার বুদ্ধিতে কুলোবে বলে মনে হচ্ছে না।’
ললিতা ও মামাবাবুর প্রসন্ন দৃষ্টি থেকে কিন্তু বোঝা যায় যে তাদের ধারণা ঠিক তার বিপরীত।
শ্রীমন্ত কাগজটা পকেটে নিয়ে সোজা তার নিজের বাড়িতেই যায়। অন্যমনস্ক না হলে বাড়িতে ঢোকবার পথে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হয়তো তার চোখে পড়ত।
মামাবাবুদের বাড়ি থেকে বার হবার পর থেকেই একটি লোক দূর থেকে তার পেছু নিয়েছে।
শ্রীমন্ত বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করবার পর সে লোকটি সন্তর্পণে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর এদিক—ওদিক চেয়ে সে একদিকের একটি জানলার কাছে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। সেখান থেকে জানলার ফাঁক দিয়ে তার উঁকি মারবার চেষ্টাটা আর যাই হোক খুব স্বাভাবিক নয়।
বলা বাহুল্য লোকটি ভিখিরি সাহেব।
জয়ন্ত সেই যে দুপুর বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তারপর থেকে আর ফেরেনি। রাত্রে সে কথা জানবার পর মামাবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে ওঠেন।
নামিতাকে নীচে তার খোঁজে পাঠিয়েছিলেন, সে জয়ন্তকে না পেয়ে ফিরে এসে খবর দেবার পর মামাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন—’জয়ন্ত এত রাত পর্যন্ত বাড়িই ফেরেনি!’
‘বোধহয় রাগ হয়েছে।’—নমিতা না ফেরার কারণটা সম্বন্ধে তার অনুমান জানায়।
‘রাগ করা তো তার অন্যায় বাপু!’—মামাবাবু অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ স্বরে বলেন—’ও নকশার কাগজ তো তাকেই আগে দেখাবার জন্যে ডেকেছিলাম। তখন ও বাড়ি ছিল না, তা আমি কী করব!’
‘তোমার ও নিয়ে ভাবারই দরকার নেই। সব কিছু তাঁকেই আগে দেখাতে হবে এমন কি কথা আছে।’ ললিতা জয়ন্তর বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়।
কিন্তু মামাবাবু এবার জয়ন্তর দোষটাই স্খালন করবার চেষ্টায় বলেন—’হাজার হলেও ছেলেমানুষ তো!’
তারপর যে সব কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন সেগুলো তোলবার জন্যে আলমারির দিকে যেতে যেতে বলে যান—’আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে, তোরা এখন শুতে যা!’
ললিতা নমিতা মামাবাবুর কথামতো ঘর থেকে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মামাবাবুর ব্যবহারে বিস্মিত হয়ে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে।
কাঠের আলমারিতে কাগজপত্রগুলো রাখতে গিয়ে মামাবাবু জানলা থেকে কী একটা যেন চোখে পড়ায় একাগ্র দৃষ্টিতে লক্ষ করছেন।
এ জানলাটা থেকে বাইরের পোড়ো বাড়ি ও বাগানের একটা অংশ দেখা যায়। কিন্তু সেখানে কী এমন জিনিস মামাবাবুর অতখানি আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারে!
জানলা থেকে ফিরে মামাবাবুকে একেবারে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখে তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে যায়।
‘কী হয়েছে মামাবাবু! কোথায় যাচ্ছেন?’—ললিতা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে।
‘এখুনি আসছি।’—অন্যমনস্ক ভাবে বেরিয়ে যেতে যেতে মামাবাবু এর চেয়ে বেশি কিছু বলা প্রয়োজন মনে করেন না।
ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে মামাবাবু প্রথম পেছনের মহলের বারান্দায় এসে দাঁড়ান। সেখান থেকে অন্ধকারে সামনের বাগান ও পোড়ো বাড়ির কিছুই প্রায় দেখা যায় না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করবার পর আবার তাঁকে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে দেখা যায়।
নীচে নেমে বাগানের ভেতর কিছুদূর গিয়েই আবার তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। সামনে নয়, এবার পেছন দিকে ফিরে তিনি কান পাতেন। তাঁর পেছনে কার পায়ের শব্দ যেন পাওয়া যাচ্ছে।
পায়ের শব্দ আরো কাছে এগিয়ে আসবার পর অন্ধকারেও মানুষটাকে খানিকটা চেনা যায়, ও বোঝা যায় যে মিঃ সোম তাঁদের মিথ্যে আশ্বাস দেননি। লোকটা একজন কনেস্টবল। রাত্রে বাড়ির চারিধারে পাহারা দিয়ে ঘোরাই তার কাজ।
কাছে এসে মামাবাবুকে অন্ধকারে অমন জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে—’কি হয়েছে স্যার?’
‘চুপ!’—মামাবাবু তাকে চাপা গলায় শব্দ করতে নিষেধ করে বলেন—’এইখানে থাকো। আমি ডাকলেই আসবে।’
মামাবাবু সামনের দিকে এবার এগিয়ে যান।
ব্যাপারটা ঠিক না বুঝলেও মামাবাবুর আদেশ মতো কনেস্টবল সেইখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।
বাগানের শুকনো লতা—পাতা মাড়িয়ে মামাবাবুর চলে যাবার পদশব্দ অনেক দূর পর্যন্ত কান খাড়া করে সে শুনতে পায়।
তার কিছুক্ষণ বাদেই অন্ধকারে মামাবাবুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—’তুমি!’
বোঝা যায় মামাবাবু পরিচিত কোনো লোকেরই দেখা পেয়েছেন।
পরিচিত লোকটির কথা কিন্তু শোনা যায় না। তার বদলে মামাবাবুর কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়—’আমি প্রথমটা কিন্তু ভাবতেই পারিনি। তবু হাঁটাটা কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল…’
হঠাৎ কনেস্টবল চমকে শিউরে ওঠে।
মামাবাবুর কথার ওপরই দু’বার কিসের একটা আঘাতের শব্দ আর সেই সঙ্গে মামাবাবুর অস্ফুট আর্তনাদ।
কনেস্টবল তৎক্ষণাৎ সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুটে যায়।
অন্ধকারে দিক নির্ণয় করা খুব সহজ নয়। তবু খানিক এদিক—ওদিক একটু ছোটাছুটির পর অন্ধকারে আর একটি ডাক তার কানে এসে পৌঁছায়।
‘এই, কে আছে এখানে! কে আছে?’
ডাকটা যেদিক থেকে এসেছে সেই দিকে এবার ছুটে গিয়ে সে একেবারে অবাক হয়ে যায়।
পুরোনো মহলের বাগান ছাড়িয়ে ভাঙা নাটমন্দিরের ধ্বংসস্তূপের একধারে মামাবাবু মাটির ওপর পড়ে আছেন, আর তাঁর পাশে বসে জয়ন্ত তাঁর মাথাটা এক হাতে তুলে ধরে আছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে ভীত উত্তেজিত কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করে—’কি হয়েছে জয়ন্তবাবু? এঁকে মারলে কে?’
‘জানি না। সে গবেষণা পরে করলেও চলবে।’ গম্ভীর স্বরে কনেস্টবলের কৌতূহলকে শাসন করে জয়ন্ত বলে—’এখন এঁকে ধর দেখি। ভেতরে নিয়ে যেতে হবে।’
দু’জনে ধরাধরি করে মামাবাবুর রক্তাক্ত অচৈতন্য দেহ ভেতরে নিয়ে যায়।
পনেরো
খবর পেয়ে মিঃ সোম পরের দিন সকাল বেলাই শ্রীমন্তর সঙ্গে মামাবাবুকে দেখতে এলেন।
স্থানীয় ডাক্তারকে অবশ্য রাত্রেই ডাকা হয়েছিল। শহরের বড় ডাক্তারও সকাল বেলা এসে দেখে যা ব্যবস্থা সম্ভব করে গেছলেন।
কোনো ব্যবস্থায় কিছু যে হবে মামাবাবুকে দেখে সে আশা কিন্তু করা গেল না। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা রয়েছে বটে, তবু তখনো পর্যন্ত জ্ঞান তাঁর হয়নি।
জয়ন্তই মিঃ সোম ও শ্রীমন্তকে সমস্ত ব্যাপারটার বিবরণ দিচ্ছিল।
বিছানায় মামাবাবুর পাশে ললিতা ও নমিতা আচ্ছন্নের মতো মাথা নীচু করে বসেছিল। সমস্ত রাত কেঁদে কেঁদে তাদের দু’জনেরই চোখ—মুখ ফুলে গেছে।
সমস্ত বিবরণ শুনে শ্রীমন্ত উদ্বিগ্ন ভাবে জিজ্ঞাসা করলে—’ডাক্তার তাহলে জ্ঞান হবার আশা খুব কম বলে গেছেন?’
‘হ্যাঁ! তবে জ্ঞান যদি হয় তাহলে এ যাত্রা বেঁচেই যাবেন।’—জয়ন্তর কাছে অন্ধকারের মধ্যে একটুখানি আশার আলোর আভাস পাওয়া গেল। কথাটা সে আরো ভালো করে বুঝিয়ে দিলে—’কারণ এমনিতে জখম খুব বেশি হননি। মস্তিষ্কটা শুধু অসাড় হয়ে গেছে।’
‘ওঁর জ্ঞান হওয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে কিন্তু।’ শ্রীমন্ত আশান্বিত হয়ে উঠেছে দেখা গেল। ‘সমস্ত রহস্যের সূত্রই হয়ত ওঁর কাছে পাওয়া যাবে।’
একটু থেমে সে আবার জিজ্ঞাসা করলে—’আচ্ছা জ্ঞান যদি হয় তো, কতদিনে হতে পারে, ডাক্তার কিছু বলেছেন?’
‘না, তার কোনো ঠিক নেই।’ জয়ন্ত আবার হতাশ করে দিলে—’আর জ্ঞান যদি হয়ও তবু তারপর ওঁকে অত্যন্ত সাবধানে ঘুম পাড়িয়ে রাখা দরকার। মাথার সে অবস্থায় কোনো রকম উত্তেজনায় দারুণ ক্ষতি হতে পারে।’
কথা বলতে বলতে জয়ন্তর সঙ্গে শ্রীমন্ত ও মিঃ সোম মামাবাবুর বিছানা থেকে খানিকটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মিঃ সোমই এবার হঠাৎ প্রশ্ন করলেন—’আচ্ছা জয়ন্তবাবু, আপনি ওঁর চিৎকার শুনে ওখানে ছুটে যান—না?’
জয়ন্তর মুখটা হঠাৎ এ প্রশ্নে কঠিন হয়ে উঠল। ভুরু কুঁচকে মিঃ সোমের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সে সংক্ষেপে শুধু বললে—’হ্যাঁ।’
সে ভ্রূকুটি যেন দেখতেই পাননি এমন ভাবে সোম আবার জিজ্ঞাসা করলেন—’কাউকে পালাতে কিন্তু দেখতে পাননি?’
‘না।’ জয়ন্ত এবার তৎক্ষণাৎ জবাব দিলে—’যেরকম অন্ধকার, হয়তো কাছেই কোথাও সে লুকিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মামাবাবুকে ওই অবস্থায় ফেলে তখন খোঁজবার সময় পাইনি।’
‘চিৎকারটা যখন শোনেন, তখন আপনি কাছেই ছিলেন মনে হচ্ছে।’—সোম প্রসঙ্গটা এখনো শেষ করতে দিলেন না।
‘হ্যাঁ।’ জয়ন্ত উত্যক্ত ভাবটা বিশেষ চাপবার চেষ্টা না করেই বললে—’আপনি হয়তো জানেন না, প্রতি রাত্রেই আমি এ—বাড়ির চারিধারে টহল দিয়ে বেড়াই।’
‘ও!’—জয়ন্তর কথার ওপর এইটুকু মাত্র বিস্ময়সূচক ধ্বনি করে সোম শ্রীমন্তর দিকে ফিরে বললেন—’আসুন শ্রীমন্তবাবু, আপনি তো বাড়িতেই ফিরবেন?’
‘হ্যাঁ, চলুন একসঙ্গেই যাওয়া যাক।’ বলে শ্রীমন্ত সোমের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
শ্রীমন্তর সঙ্গে মামাবাবুর দুর্ঘটনার বিষয়েই আলোচনা করতে করতে সোম কখন তার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছলেন বোধহয় টের পাননি।
আলোচনাটা আরো খানিক চালাবার জন্যে শ্রীমন্ত তাঁকে বাড়ির ভেতরে গিয়ে একটু বসবার অনুরোধ করতে তিনি আর না বলতে পারলেন না।
বাইরের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে কিন্তু শ্রীমন্তর সঙ্গে তিনিও বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
শ্রীমন্তর বাংলা বাড়িটির সামনে ছোট্ট একটি দেয়াল ঘেরা বাগান। কাঠের গেট দিয়ে সে বাগানে ঢুকে কয়েকটা বাহারে ধাপ দিয়ে উঠে বাড়ির বাইরের দরজায় পৌঁছানো যায়।
সেই বাগানের ভেতর বাইরের দরজার কাছে দু’টি লোক কি যেন গোপন পরামর্শ করছে দেখা গেল।
তাদের একটি ভিখিরি সাহেব এবং অপরটি, নমিতা যাকে দেখে আঁতকে উঠেছিল, শ্রীমন্তর সেই বরখাস্ত করা লোক।
সোম ও শ্রীমন্তকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই ভিখিরি সাহেব একেবারে যেন ভয়ে কেঁচো হয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়ল। কিন্তু অপর লোকটি নড়ল না।
‘কি করছিলে তোমরা এখানে?’ শ্রীমন্ত তার কাছে গিয়ে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলে। রাগে সে তখন জ্বলছে।
‘কি আবার করব। আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি!’ লোকটার ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা আজ যেন একটু বেশি মনে হল।
‘আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ!’ শ্রীমন্ত অতি কষ্টে রাগ সামলে তীক্ষ্ন স্বরে বললে—’তা ওই লোকটি সঙ্গে ছিল কেন? নতুন বন্ধু বুঝি!’
‘বন্ধু আবার কে! বন্ধু—টন্ধু আমার নেই!’ লোকটা আগের মতোই উদ্ধত ভাবে জানালে—’আমার কাছে ভিক্ষে চাইছিল। আমি বললাম—হবে না।’
‘বটে! তোমার কাছে ও ভিক্ষে চাইছিল! ভালো, ভালো!’ শ্রীমন্তকেও এবার হাসতে হল। তারপর কঠিন স্বরে সে জিজ্ঞাসা করলে—’তা আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
‘আমার সেই মাইনে।’—লোকটার স্পর্ধা সত্যিই অসহ্য।
‘আবার সেই বাজে ওজর!’ শ্রীমন্ত গর্জন করে উঠল—’তোমার সমস্ত মাইনে আমি হিসেব করে চুকিয়ে দিয়েছি।’
‘আজ্ঞে না, সে হিসেবে ভুল আছে।’—লোকটা অবিচলিত।
‘ভুল আছে!’ রাগে শ্রীমন্ত খানিকক্ষণ বুঝি কথাই বলতে পারলে না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে তারপর সে যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললে—’বেশ, আজ ও বেলায় এস। সব হিসেব আমি তোমার সামনেই দেখব। পাওনা যদি কিছু তোমার থাকে তো পাবে। কিন্তু তারপর এ—বাড়ির ধারেকাছে আর যেন তোমায় না দেখি।’
‘পাওনা চুকিয়ে দিলে আর আমার আসবার কি দরকার!’ শেষ কথাগুলোও অভদ্র ভাবে বলে লোকটা চলে গেল।
মিঃ সোম এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে লোকটাকে লক্ষ করছিলেন। এবার কাছে এসে বললেন—’ও রকম লোক ছাড়িয়ে দিয়ে ভালোই করেছেন মশাই। চেহারা, ধরন—ধারণ যা দেখলাম তাতে শুধু বাকি মাইনের জন্যে এখানে ঘোরাঘুরি করছে বলে মনে হয় না।’
কথা বলতে বলতে হঠাৎ শ্রীমন্তর দিকে চোখ পড়ায় সোম বুঝতে পারলেন শ্রীমন্ত তাঁর কোনো কথাই বোধহয় শোনেনি। অত্যন্ত তন্ময় হয়ে কি একটা যেন সে ভাবছে।
‘কি ভাবছেন বলুন তো!’—সোম সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘যা ভাবছি তা যদি ঠিক হয়—’ শ্রীমন্ত অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে সোমের দিকে তাকিয়ে বললে—’তাহলে হানাবাড়ির একটা রহস্য আজ রাত্রেই বোধহয় ভেদ করতে পারব। আপনাদের কিন্তু আমার সঙ্গে পাহারায় থাকতে হবে।’
‘আজ রাত্রেই?’ সোম অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ, আজ রাত্রেই।’—শ্রীমন্ত দৃঢ় স্বরে জানালে—’আমার বিশ্বাস হানাবাড়ির সেই বিভীষিকাকে আজ রাত্রেই আবার দেখা যাবে।’
সেদিন গভীর রাত্রে পোড়ো বাড়ির ভাঙা বারান্দার এক কোণে অন্ধকারে একটি থামের আড়ালে তিনটি মানুষকে নিঃশব্দে পাহারায় থাকতে দেখা যায়। তারা মিঃ সোম, শ্রীমন্ত ও জয়ন্ত। মিঃ সোমই জয়ন্তকে খবর দিয়ে এই পাহারায় থাকবার জন্যে ডাকিয়ে আনিয়েছেন। এই অস্বস্তিকর জায়গায় বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে সকলেরই প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার জোগাড় হয়। শ্রীমন্তর ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে সকলেই যখন একরকম হতাশ হয়ে উঠেছে এমন সময় সকলেরই কান হঠাৎ খাড়া হয়ে ওঠে।
অন্ধকারে দূরের বাগানের শুকনো লতা—পাতার ভেতর কিসের সুস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
তার অনুমান যে সত্যি এতক্ষণে তা বুঝি প্রমাণ হতে চলেছে। শ্রীমন্তই সবচেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে চুপি চুপি বলে—’মনে হচ্ছে এখুনি দেখতে পাওয়া যাবে।’
দেখতে পাওয়ার কথাটা অবশ্য একটু বাড়িয়ে বলা। বাগানের বেশির ভাগ জায়গাতেই একেবারে জমাট অন্ধকার। শুধু একটি জায়গায় গাছপালা হাল্কা হওয়ায় দূরের আকাশের পশ্চাৎপটে সামান্য কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তিনজনে রুদ্ধ নিশ্বাসে সেদিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করেন। লতা—পাতার শব্দটা ক্রমশ সেই দিকেই এগিয়ে আসছে।
শ্রীমন্ত তার পিস্তলটা সেই দিকে উঁচিয়ে ধরে।
একটা কালো ছায়ামূর্তির আভাস এবার সেই অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গার একেবারে কিনারায় এসে পড়েছে।
রাতের আকাশের পশ্চাৎপটে মূর্তিটা আরো স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে।
শ্রীমন্ত পিস্তলটার লক্ষ্য স্থির করে—
জয়ন্ত ও সোম দু’জনেই হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দেয়।
‘দাঁড়ান শ্রীমন্তবাবু।’
‘এখন গুলি করবেন না।’
কিন্তু শ্রীমন্তর গুলি তখনই পর পর দু’বার সমস্ত জায়গা কাঁপিয়ে ছুটে গেছে।
প্রথম আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকিয়ে সেই কালো ছায়ামূর্তিটা বিদ্যুদ্বেগে একটা ডিগবাজি খেয়ে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।
ওপর থেকে তিনজন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে সেই দিকে ছুটে যায়।
কিন্তু এ কী আশ্চর্য ব্যাপার?
সে মূর্তির কোথাও কোনো চিহ্ন নেই।
সে কি এরই মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি!
হাওয়ায় যে মিলিয়ে যায়নি, টর্চ জ্বেলে খানিকটা খোঁজবার পরই তা বোঝা যায়।
টর্চের আলোয় যা দেখা গিয়েছিল মিঃ সোম সেটি হাতে তুলে নিয়ে অবাক হয়ে বলেন—’আশ্চর্য এতো শুধু খোলসটা পড়ে আছে!’
‘খোলস ছেড়ে পালিয়েছে তাহলে!’
জয়ন্তের এই নির্লিপ্ত ধরনের মন্তব্যে শ্রীমন্ত একটু বিরক্ত হয়েই বলে—’না, যে গুলি সে খেয়েছে, তাতে প্রাণে বাঁচলেও পালান তার পক্ষে সম্ভব নয়!’
‘আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই।’ জয়ন্ত উপহাসের সুরে বলে—’স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে পালিয়েছে, তবু বলছেন পালানো সম্ভব নয়।’
‘আমি বলছি কেউ সাহায্য না করলে এইটুকুর মধ্যে খোলস ছেড়ে তার পালানো সম্ভব নয়।’—শ্রীমন্ত এবার উত্তেজিত ভাবে জানায়।
মিঃ সোম এবার দু’জনের তর্কে বাধা দিয়ে বলেন—’সেই রকমই মনে হচ্ছে। আচ্ছা, তবু একটু খুঁজে দেখি আসুন।’
তিনজনে পোড়ো বাড়ির সমস্ত দিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিন্তু কিছু পান না।
খোঁজাখুঁজির উৎসাহটা অবশ্য সোম ও শ্রীমন্তরই বেশি। জয়ন্ত তাঁদের সঙ্গে ঘুরলেও কেমন উদাসীন হয়েই থাকে।
শেষ পর্যন্ত কোনো সন্ধান যখন পাওয়া যায় না, তখন সে—ই ঈষৎ বিদ্রূপের সঙ্গে বলে—’ঘোরাঘুরিই সার হল তাহলে!’
‘তাই ত দেখছি।’ সোম চিন্তিতো ভাবে বলেন—’অথচ এরই মধ্যে কোথায় সে যেতে পারে তাও বুঝতে পারছি না।’
জয়ন্ত এবার মন্তব্য করে—’খোলসটা যারই হোক, গুলি খেয়ে তেমন জখম হয়েছে বলে তাহলে মনে হচ্ছে না!’
‘কেন বলুন তো?’—শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করে।
‘কেন বুঝতে পারলেন না?’—জয়ন্ত বুঝিয়ে দেয়—’সে রকম জখম হলে কারুর সাহায্য নিয়েও এত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে সে পারত না।’
শ্রীমন্তই এবার বিস্মিত ভাবে বলে—’পালিয়ে যাওয়ায় আপনি যেন খুশিই হয়েছেন মনে হচ্ছে।’
‘খুশি না হই, দুঃখিত হবারই বা কি আছে!’—জয়ন্ত তাচ্ছিল্যের সুরে বলে—’সব রহস্যের এত সহজে মীমাংসা হয়ে যাওয়া কি ভালো? আপনাদের সেই নকশার রহস্যটাই ধরুন না। তার মীমাংসা কিছু হয়েছে?’
‘নকশা!’—সোম ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন না।
‘ও, আপনি জানেন না বুঝি!’—জয়ন্ত বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দেয়—’জখম হবার আগে, একটা চোরা কুলুঙ্গি থেকে মামাবাবু একটা পুরোনো কাগজ পেয়েছিলেন, তাতে কিসের নকশা আঁকা। মামাবাবু সেটা ওঁকেই দিয়েছিলেন।’
শ্রীমন্তর দিকে ফিরে সে আবার জিজ্ঞাসা করে—’কী, সে নকশার মানে কিছু খুঁজে পেলেন?’
‘না, এখনো পাইনি!’ শ্রীমন্ত এবার একটু পাল্টা ঘা না দিয়ে পারে না—’কিন্তু সে নকশা সম্বন্ধে আপনার কোনো কৌতূহল ছিল না বলেই তো জানতাম।’
‘কৌতূহল এখনো আছে ভাবছেন কেন?’ জয়ন্ত বেশ রূঢ়ভাবেই জবাবটা দিয়ে সবার আগে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
ষোল
গোপন নকশা সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল নেই বলে বড় গলায় জানালেও পরের দিন দুপুর বেলায় জয়ন্তর গতিবিধি দেখলে যে কেউ বেশ বিস্মিত হত।
শ্রীমন্তর চাকর দুলাল দুপুর বেলা মনিবের অনুপস্থিতিতে একটু দিবানিদ্রা দেবার আয়োজন করছে এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।
দুলাল উঠে গিয়ে দরজা খোলার পর জয়ন্ত একেবারে ভেতরেই ঢুকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে—’কী হে দুলাল! শ্রীমন্তবাবু বাড়ি নেই নাকি!’
‘আজ্ঞে না, তিনি খানিক আগে বেরিয়ে গেলেন।’
এ কথা শুনেও জয়ন্তর কিন্তু চলে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ভেতরে এসে একটি সোফায় বসে পড়ে সে বললে—’আচ্ছা, আমি একটু বসছি।’
তারপর পকেট থেকে কিছু পয়সা বার করে দুলালের হাতে দিয়ে বললে—’তুমি—তুমি আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এস দেখি।’
দুলাল বড় মুশকিলে পড়ল। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া তার উচিত নয়, অথচ মনিবের বিশেষ বন্ধু বলে যাঁকে জানে তাঁকে অসন্তুষ্ট করতেও তার সাহস হয় না।
একটু আমতা আমতা করে সে বললে—’আজ্ঞে একটু দেরি হবে কিন্তু। দোকান সেই থানার কাছে কিনা।’
‘বেশ তো, হোক না দেরি। আমি ততক্ষণ আছি!’ জয়ন্ত সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসল।
দুলালকে অগত্যা সিগারেট আনতে যেতেই হল।
বাইরের দরজাটা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তর ভাব—গতিক একেবারে কিন্তু বদলে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে ঘরের টেবিল ও দেরাজের সমস্ত ড্রয়ারগুলো যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি খুলে পরীক্ষা করতে শুরু করলে।
একটির পর একটি ড্রয়ার খুলতে খুলতে একেবারে তলার একটি ড্রয়ারের একটি ফাইলে সে যা খুঁজছিল তা বোধহয় পেলে। বলা বাহুল্য সেটি একটি নকশা। তেমন দামি মনে করলে এরকম জায়গাতেও শ্রীমন্ত সেটি বোধহয় রাখত না।
পকেট থেকে একটি কাগজ বার করে টেবিলে বসে নকশাটির নকল করে ফেলতে তার বেশিক্ষণ লাগল না। কিন্তু নকল করা যখন শেষ হয়েছে তখনই বাইরের দরজায় কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
তাড়াতাড়ি আসল নকশার কাগজটি ফাইলে ভরে দেরাজ বন্ধ করে জয়ন্ত উঠে দাঁড়াবার পরই দেখা গেল শ্রীমন্ত ঘরে এসে ঢুকেছে।
জয়ন্তকে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখে যদি কোনো সন্দেহ তার মনে জেগেও থাকে, শ্রীমন্তর মুখে কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। সহজ ভাবেই হেসে সে বললে—’এই যে জয়ন্তবাবু! কতক্ষণ এসেছেন! আজকাল ততো আর এখানে আসেন—ই না!’
শেষের কথাগুলোতে খোঁচা কিছু ছিল কিনা বলা যায় না, কিন্তু জয়ন্ত হেসে পাল্টা জবাব দিলে—’এলেও আপনার দেখা তো সব সময়ে পাওয়া যায় না। আপনিই বা বাড়িতে কতক্ষণ থাকেন!’
‘তা ঠিক!’ শ্রীমন্ত স্বীকার করলে—’আজকেও হঠাৎ রাস্তা থেকে ফিরে না এলে আর দেখা হত না।’
হঠাৎ এদিক ওদিক চেয়ে শ্রীমন্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে—’আচ্ছা দুলাল গেল কোথায়?’
‘তাকে এক প্যাকেট সিগারেট আনতে পাঠিয়েছি।’—জয়ন্তের মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
‘ও!’—শ্রীমন্ত যেন আশ্বস্ত হল, কিন্তু পরমুহূর্তেই অবাক হয়ে বললে—’কিন্তু আপনাকে সিগারেট খেতে তো বড় একটা দেখি না!’
‘না, মাঝে মাঝে খেয়াল হলে খাই।’—জয়ন্ত অবিচলিত।
‘আপনি বেশ একটু খেয়ালি মানুষ দেখছি।’—শ্রীমন্ত হেসে উঠল।
‘তা বলতে পারেন। আচ্ছা আমি এখন চলি।’—জয়ন্ত হঠাৎ যাবার জন্যে পা বাড়ালে।
‘সে কি!’—শ্রীমন্ত সবিস্ময়ে বলে উঠল—’এই তো এলেন! এরই মধ্যে যাবেন কি?’
জয়ন্ত দাঁড়িয়ে পড়ে বললে—’এও একটা খেয়াল মনে করুন।’
জয়ন্ত আবার যেতে উদ্যত হতেই শ্রীমন্ত বাধা দিয়ে বললে—’কিন্তু দুলাল যে আপনার সিগারেট আনতে গেছে!’
‘সে আমি রাস্তা থেকেই তার কাছে নিয়ে নেবখন।’ জায়গাটা যেন তার অসহ্য—জয়ন্ত এমনি ভাবে বেরিয়ে চলে গেল।
জয়ন্ত চলে যাবার পর শ্রীমন্ত কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর ভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুতপদে দেরাজের কাছে গিয়ে নীচের ড্রয়ারটা খুলে নকশার কাগজটা যে ফাইলে ছিল সেটা বার করে দেখলে।
না, নকশাটা ঠিক যথাস্থানেই আছে।
নকশাটি বার করে দেখতে দেখতে শ্রীমন্তর মুখে যে হাসি ফুটে উঠল তা দেখলে জয়ন্ত নিজেকে খুব বুদ্ধিমান বোধহয় ভাবতে পারত না।
জয়ন্ত যে কেন অকস্মাৎ তার অনুপস্থিতির সুযোগে তার বাড়িতে এসেছিল শ্রীমন্তর তা বুঝতে বাকি যে ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। এতদিন ছোটখাটো নানা ব্যাপার উপেক্ষা করলেও এ কথাটা থানায় মিঃ সোমকে জানানো উচিত বলেই তার মনে হল।
সেই উদ্দেশ্যে খানিক বাদেই থানায় গিয়ে কিন্তু সে অবাক হয়ে গেল।
জয়ন্ত সোমের টেবিল থেকেই উঠে আসছে।
শ্রীমন্তকে দেখে অপ্রস্তুত হওয়ার দরুনই বোধহয় উল্টো বাহাদুরি দেখিয়ে সে—ই নিজে থেকে প্রথম সম্ভাষণ করলে—’এই যে শ্রীমন্তবাবু, এখানেও আপনি! আমাকে অনুসরণ করছেন নাকি!’
‘করলে, আপনার ভয়ের কিছু আছে?’—শ্রীমন্তর গলাটা যত না হোক জয়ন্তর প্রতি দৃষ্টিটা বেশ তীক্ষ্ন।
‘ভয় না হোক, অস্বস্তি একটু হয় বই কি!’—নেহাত তাচ্ছিল্যের স্বরে কথাগুলো বলে জয়ন্ত বেরিয়ে গেল।
শ্রীমন্ত মিঃ সোমের দিকে ফিরে এবার জিজ্ঞাসা করলে—’জয়ন্তবাবু আজ আবার কী মনে করে এসেছিলেন?’
‘As usual!’ সোম হাসলেন—’আপনার বিরুদ্ধে আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলবার চেষ্টায়।’
‘হুঁ,’ শ্রীমন্ত গম্ভীর হয়েই বললে—’আজ আমিও কিন্তু জয়ন্তবাবুর বিরুদ্ধে একটু অভিযোগ করতে এসেছি। ওঁর ভাবগতিক ক্রমশই কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। আজ উনি সেই নকশাটি চুরি করে নকল করবার জন্যে ফন্দি করে আমার বাড়িতে ঢুকেছিলেন।’
‘সেই চোরা কুলুঙ্গিতে পাওয়া নক্সা?’—সোম সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
শ্রীমন্ত মাথা নেড়ে সায় দেওয়ায় সোম অবাক হয়ে আবার বললেন—’জয়ন্তবাবু চুরি করে সেটা নকল করতে গেছলেন! আশ্চর্য তো। নকশাটার কোনো মানেই তো বার করা যায় না বলছিলেন।’
‘না, তা যায়নি এখনো!’—শ্রীমন্ত স্বীকার করলে।
‘তবু সেটা বেশ দামি জিনিস মনে হচ্ছে।’—সোম চিন্তিত হলেন।
‘হ্যাঁ, আগে জানলে আর একটু সাবধানেই লুকিয়ে রাখতাম’—শ্রীমন্ত আফসোস জানালে।
‘যাই হোক!’ সোম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—’যে খবরটা দিলেন, তা থেকেও একটা সূত্র বোধহয় আমরা পেতে পারি।’
‘আমারও তাই মনে হয়!’ বলে শ্রীমন্ত যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল।
‘আপনাকে উপদেশ দেওয়ার দরকার নেই, তবু বলছি এখন থেকে চোখ—কান আর একটু সজাগ রাখবেন।’—বিশেষ একটু ইঙ্গিতের সঙ্গে সোম এই শেষ কথাটি শুধু জানিয়ে দিলেন।
সোম যে মিথ্যে ইঙ্গিত করেননি পরের দিন দুপুর বেলায় তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
বাড়ির পেছনের মহল এখন একেবারে নির্জন। মামাবাবুর এখনও জ্ঞান হয়নি। ললিতা ও নমিতা ভেতরের মহলে তাঁরই পরিচর্যায় ব্যস্ত, আর দারোগার ভয়েই বোধহয় ভিখিরি সাহেবকেও আজকাল আর এদিকে দেখাই যায় না।
সেই নির্জন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দুপুর বেলা ঘুরতে ঘুরতে একবার ঢুকে শ্রীমন্ত অবাক হয়ে গেল।
পোড়ো বাড়ির বাগানের মাঝখানে যে পুরোনো ইঁদারাটি আছে, প্রকাণ্ড একটি দড়ি তার ভেতর নামিয়ে জয়ন্ত কি যেন করছে।
দড়িটি ধীরে ধীরে গুটিয়ে তোলবার পর দেখা গেল তাতে কুয়ো থেকে ডোবা বালতি ঘড়া ইত্যাদি তোলবার একটি কাঁটা বাঁধা।
কাঁটা দিয়ে ইঁদারা থেকে কি তোলবার চেষ্টা করছিল জয়ন্ত?
শ্রীমন্ত কাছে গিয়ে সেই প্রশ্নই করলে—’ব্যাপার কি জয়ন্তবাবু! কি, করছেন কী এটা?’
পেছন দিক থেকে আসার জন্যই বোধহয় জয়ন্ত এতক্ষণ শ্রীমন্তকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেয়ে দড়ি থেকে কাঁটাটা খুলতে খুলতে বেশ একটু কর্কশ স্বরেই বললে—’কী করছি, বুঝতে পারছেন না?’
‘না,’ শ্রীমন্ত যতদূর সম্ভব পরিহাসের মতো করে কথাটাকে বলবার চেষ্টা করলে—’তবে ক’দিন থেকেই আপনার গতিবিধি আমার কেমন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে!’
‘তাই নাকি!’ তীক্ষ্ন স্বরে কথাটা বলেই জয়ন্ত যা করে বসল শ্রীমন্ত তা বোধহয় কল্পনাও করতে পারেনি। দড়ি থেকে কাঁটাটা খোলা তার হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ প্যান্টের পকেট থেকে একটা পিস্তল বার করে সে তীব্র বিদ্রূপের সঙ্গে বললে—’তাহলে, সন্দেহ যখন একবার হয়েছে, তখন একেবারে সেটা মিটিয়েই দেওয়া যাক।’
শ্রীমন্ত চমকে উঠে বুঝি আপনা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিল। জয়ন্ত পিস্তলটা তার একেবারে বুকের উপর লক্ষ্য করে ধমকে উঠল—’দাঁড়ান!’
‘আরে মশাই, করছেন কি!’ শ্রীমন্ত বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা হয়তো তামাশা হতে পারে এই ভরসায় বললে—’এ রকম ঠাট্টা ভালো নয়! পিস্তলে সত্যি গুলি টুলি আছে নাকি?’
‘এখনো ব্যাপারটা ঠাট্টা বলে আপনার মনে হচ্ছে!’ উগ্র স্বরে জয়ন্ত হুকুম করলে—’দাঁড়ান, ফিরে দাঁড়ান।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে শ্রীমন্ত বললে—’আপনার তো সত্যি মাথা খারাপ হয়ে গেছে দেখছি! কি করতে চান আমাকে?’
পিস্তলটা ইঁদারার পাড়ের উপর রেখে, দড়িটা হাতে গুছিয়ে নিয়ে জয়ন্ত পেছন থেকে বললে—’কিছু নয়। এইখানে একটু বেঁধে রাখতে চাই। হাত দুটো পেছনে দিন।’
অসহায় ভাবে হাত দুটো পেছনে দিয়ে শ্রীমন্ত হতাশভাবে বললে—’এ তো ভালো জ্বালায় পড়লাম! আমার সত্যি বেঁধে রাখবেন! কি করেছি আমি?’
‘কি করেছেন?’—বেশ জম্পেশ করে দড়ি দিয়ে হাত দুটো পেছন থেকে বাঁধতে বাঁধতে জয়ন্ত বললে—’আমায় সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। আর সন্দেহ যখন একবার করেছেন, তখন আপনাকে ছেড়ে রাখতে পারি না।’
‘কিন্তু বেঁধে তো রেখে যাচ্ছেন—তারপর—?’ এই বিপদের মধ্যেও শ্রীমন্তর গলার স্বরে এবার একটু কৌতুকের আভাষে।
‘তারপর কি, তা যদি এখনো বুঝতে না পেরে থাকেন’, জয়ন্ত আগের মতোই কঠিন স্বরে বললে—’তাহলে একটু ধৈর্য ধরে থাকুন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।’
বাইরে কৌতুকের ভান করলেও শ্রীমন্ত একাগ্রভাবে একটুখানি সুযোগের অপেক্ষাই করছিল। পেছনে দড়ি বাঁধতে বাঁধতে জয়ন্তর হাতের টান একটু আলগা বলে বোধ করতেই সে নিজের হাত দুটো টেনে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ফিরে দাঁড়াল।
কিন্তু আর কিছু করবার সুযোগ সে পেল না! জয়ন্ত তার চেয়েও ক্ষিপ্রবেগে পিস্তলটা তখন ইঁদারার পাড় থেকে তুলে নিয়ে তার দিকে উঁচিয়ে ধরেছে।
‘উহুঁ—কোনো চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না। এ পিস্তলটা যদি আপনার ঠাট্টা বলে ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে ঠাট্টার নমুনাটা একটু দেখে রাখুন।’—জয়ন্ত শ্রীমন্তর দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে ডান হাতটা আকাশের দিকে তুলে দু’বার পিস্তলের আওয়াজ করলে।
মামাবাবুর বিছানার পাশে বসে ললিতা ও নমিতা সে আওয়াজে চমকে উঠল। কিছুক্ষণ আগেই মামাবাবুর সামান্য একটু জ্ঞান হয়েছিল, তিনি জড়িত কণ্ঠে কি যেন বলতে চাইছিলেন। ডাক্তারের নির্দেশ মতো কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে ললিতা তৎক্ষণাৎ ওষুধ খাইয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
আওয়াজটা শুনেই ললিতা উঠে দাঁড়িয়েছিল। তাকে তারপর ঘর থেকে বেরুতে দেখে নমিতা সভয়ে বলে উঠল—’ও কি দিদি, যাচ্ছ কোথায়! আমার ভয় করছে।’
‘ছেলেমানুষি করিসনি! দিনের বেলা আবার ভয় কিসের। আওয়াজটা কিসের দেখতে হবে না!’ বলে ললিতা বেরিয়ে গেল।
নমিতাকে কিছু না বললেও আওয়াজটা সম্ভবত বন্দুকের ও পেছনের মহল থেকেই হয়েছে বুঝে ললিতা যখন সে দিকে যাচ্ছে, শ্রীমন্তকে বাগ মানিয়ে পিছমোড়া করে তার হাত—বাঁধা শেষ করে জয়ন্ত তখন ইঁদারার থামটার সঙ্গে তাকে ভালো করে বাঁধছে।
বাঁধা শেষ হবার পর বাঁধনটা যথেষ্ট মজবুত কিনা জয়ন্তকে পরীক্ষা করতে দেখে শ্রীমন্তর মুখে এবার হাসি দেখা গেল।
‘বাঁধা আপনার হল?’ হেসে জিজ্ঞাসা করে সে বললে—’দেখুন, আমি আর্টিস্ট মানুষ, ম্যাজিশিয়ন নই। আপনার এ বাঁধন কোনো মন্ত্রবলে খুলতে পারব না!’
শ্রীমন্তর কাঁধ থেকেই তার চাদরটা তুলে নিয়ে বাগিয়ে ধরে জয়ন্ত বললে—’তবু সাবধানের মার নেই।’
‘ওঃ, মুখটাও বেঁধে ফেলতে চান?’ শ্রীমন্তর মুখে এখনো কৌতুকের হাসি। ‘বেশ বাঁধুন। তবে তার আগে একটা কথা বলে নিই। সত্যিই আপনাকে আমি চিনতে ভুল করেছিলাম। তা না হলে…’
পাকান চাদরটা চাপা দিয়ে কথা বন্ধ করে তার মুখটা থামের সঙ্গে বাঁধতে বাঁধতে জয়ন্তই শ্রীমন্তর কথা শেষ করে দিলে—’তা না হলে আজ এ দুর্দশা আপনার হত না।’
বাঁধা শেষ করে সবটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে আবার নিষ্ঠুর বিদ্রূপের সঙ্গে বললে—’আচ্ছা এখন আপনি পরমানন্দে ইষ্ট নাম জপ করতে পারেন। আপনার চাবিগুলো আমি শুধু একটু ধার নিচ্ছি।’
শ্রীমন্তর পকেট হাতড়ে একটা চাবির তোড়া বার করে নিয়ে জয়ন্ত যে ভাবে হেসে চলে গেল সেই অবজ্ঞার হাসিটুকুই বুঝি অসহ্য।
জয়ন্ত দৃষ্টির বাইরে যেতে না যেতে পোড়ো বাড়ির কোন গোপন জায়গা থেকে ভিখিরি সাহেব বেরিয়ে এল। সে যে এতক্ষণের সমস্ত ব্যাপার নীরবে গোপনে লক্ষ করেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
নিজস্ব ভঙ্গিতে শ্রীমন্তর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েও তার বাঁধন খোলবার কোনো চেষ্টা সে কিন্তু করলে না।
তার বদলে সে কী অদ্ভুত তার হাসি! শ্রীমন্ত জব্দ হওয়ায় সে যেন খুশিই হয়েছে।
এই হাসি অবশ্য বেশিক্ষণ তার চলল না। হঠাৎ দূরে পায়ের শব্দ পেয়েই সে চট করে সেখান থেকে সরে গেল।
এবারের পায়ের শব্দ ললিতার। কাছে এসে শ্রীমন্তকে ওই অবস্থায় দেখে সে তো অবাক।
‘এ কি! আপনাকে বাঁধলে কে?’
জবাব দেবে কে? শ্রীমন্তর মুখই বাঁধা। ললিতা এবার বাঁধনগুলো খোলবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু অত শক্ত বাঁধন খোলা কি তার সাধ্য!
‘Excuse me!’
ললিতা চমকে ফিরে তাকাল। সেই ভিখিরি সাহেব অমায়িক ভাবে হেসে তাদের কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।
ললিতার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল তার ওপর—’তুমি, তুমিই এঁকে বেঁধেছ? পাজি! বদমাশ!’
‘Oh, No, No, No!’—ভিখিরি সাহেবের গলায় যেন মধু—‘I am a poor beggar. I never do that.’
হঠাৎ ললিতাকে সাহায্য করবার জন্যে সে ব্যাকুল হয়ে উঠল—‘Want a knife? I have a knife.’
ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে মস্ত এক ছোরা বার করে ললিতার সামনে ধরে সে বললে— ‘Here’s a nice little knife !’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোরাটা ললিতাকে নিতে হল। বাঁধন কেটে শ্রীমন্তকে মুক্ত করতে এবার বেশিক্ষণ লাগল না।
‘কী ব্যাপার বলুন তো! আপনাকে এমন করে বাঁধল কে?’—ললিতা প্রশ্নটা নতুন করে করলে।
‘কে বাঁধল?’—শ্রীমন্ত অত্যন্ত দুঃখের হাসি হাসল। ‘নামটা করলে বিশ্বাসই করতে পারবেন না। আমারই এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘I know, I know’—বলে বাহাদুরি নিতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে তাকিয়েই ভিখিরি সাহেব একেবারে অন্য সুর বার করে ফেললে—‘Good evening Inspector’.
সত্যিই মিঃ সোম যে কখন তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, কেউ টেরই পায়নি।
দারোগাকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েই ভিখিরি সাহেব সরে পড়বার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু সোম হাত বাড়িয়ে তার কাঁধের জামাটা ধরে ফেললে।
‘কাঁহা যাতে হো! What do you know?’
বেড়ালের থাবায় যেন ইঁদুর এমনি ভাবে ভিখিরি সাহেব নাকে কেঁদে উঠল—‘No, No, I know nothing. I am a poor beggar. ভিখ মাঙকে খাতা।’
‘ভিখ মাঙকে খাতা!’—সোম কড়া ধমক দিয়ে উঠলেন—’তোমার শয়তানি আমি একদিন সিধে করে দেব।’
সামনে গুরুতর ব্যাপার থাকার দরুনই বোধহয় ভিখিরি সাহেব এ যাত্রায় রেহাই পেয়ে গেল। সজোরে ধাক্কা দিয়ে উপদ্রবটাকে সরিয়ে দিয়ে সোম আসল ব্যাপারে মনোযোগ দিলেন।
‘কী, হয়েছে কী, বলুন তো? এ দড়ি কিসের?’
‘এই দড়ি দিয়ে কে ওঁকে বেঁধেছিল।’ ললিতা উত্তেজিত ভাবে জানালে।—’একটা বন্দুকের আওয়াজ শুনে, খোঁজ করতে এসে দেখি এই অবস্থা।’
‘বন্দুক নয়, পিস্তলের আওয়াজ।’—সোম সংশোধন করে বললেন—’আমিও তাই শুনেই আসছি। কিন্তু শ্রীমন্তবাবুকে বাঁধলে কে?’
শ্রীমন্ত নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দিলে—’শুনলে অবাক হবেন। বেঁধেছেন জয়ন্তবাবু। তাঁর মাথাটা হঠাৎ খারাপই হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।’
হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে সে আবার বলে উঠল—’ওই যা, ভুলেই গেছলাম। আমার ঘরের চাবিটাবি জয়ন্তবাবু নিয়ে গেছেন।’
‘চাবি নিয়ে গেছেন!’ সোম রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন—’শিগগির আসুন, যেতে যেতে সব কথা শুনব।’
সোম ও শ্রীমন্ত দ্রুতপদে বেরিয়ে যাবার পর দেখা গেল ললিতাও তাদের পেছনে আছে।
সোমই প্রথম শ্রীমন্তর বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন। তাঁর পিছু পিছু শ্রীমন্ত ও ললিতা।
জয়ন্তকে বেশি খোঁজাখুঁজি অবশ্য তাদের করতে হল না।
চাবির রিংটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে যেন তাদেরই অপেক্ষা করছিল।
কেউ কিছু বলবার আগে সে—ই শ্রীমন্তকে উদ্দেশ করে বললে—’ও, আপনি ছাড়া পেয়েছেন তাহলে!’ তারপর সোম ও ললিতার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে চেয়ে আবার টিপ্পনি কাটলে—’আপনার বন্ধু ভাগ্য ভালো দেখছি।’
‘বন্ধু তো আপনাকেও মনে করতাম।’ শ্রীমন্ত ক্ষুণ্ণ স্বরে জানালে।
‘আশা করি সে ভুল আপনার ভেঙেছে!’
‘মিছে কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই জয়ন্তবাবু!’—সোম কঠিন স্বরে জানালেন—‘You are under arrest!’
‘Under arrest!’—জয়ন্তকে একটু বিচলিত মনে হল কি? কিন্তু সে শুধু এক মুহূর্তের জন্যে। তারপরই সে ব্যঙ্গের সুরে বললে—’তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন জানতে পারি?’
‘এখনো কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’—সোম পাল্টা বিদ্রূপ করলেন—’শ্রীমন্তবাবুকে বেঁধে রেখে চাবি চুরি করে তাঁর ঘরে ঢোকাই কি যথেষ্ট কারণ নয়!’
‘এই অভিযোগেই তাহলে আমায় গ্রেপ্তার করছেন?’
‘না শুধু এই অভিযোগ নয়। অন্য অভিযোগ আছে!’—সোমকে এত কঠিন হতে আগে কখনও দেখা যায়নি।
জয়ন্ত তবু তার বেপরোয়া ভাব বজায় রেখেই জিজ্ঞাসা করলে—’যেমন?’
‘যেমন—নরহত্যা।’—ধীরে ধীরে সোম কথাগুলো উচ্চারণ করলেন।
হঠাৎ যেন ঘরে একটা বাজ পড়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘নরহত্যা!’ জয়ন্তর গলা এইবার বুঝি কাঁপল একটু—’আমার বিরুদ্ধে নরহত্যার অভিযোগও আছে তাহলে!’
‘হ্যাঁ।’—নির্মমভাবে সোম বলে গেলেন—’বাড়ি কিনতে এসে যে লোকটি এখানে মারা যান তাঁকে আপনিই হত্যা করেছেন।’
সোমের কথার ওপরেই হঠাৎ ললিতার কাতর স্বর শোনা গেল—’না, না, এ আমি বিশ্বাস করি না।’
একপাশে দাঁড়িয়ে সে এতক্ষণ নীরব শ্রোতা মাত্র হয়েছিল। কিন্তু নিজেকে এবার আর সম্বরণ করতে পারল না।
জয়ন্ত যেন ললিতার এই উচ্ছ্বাসে নিজের সাফাই গাইবার একটা সুযোগ পেয়ে গেল।
‘বিশ্বাস করো না ললিতা, এ সমস্তই মিথ্যে!’ জোর গলায় ললিতাকে আশ্বাস দিয়ে সে সোমের দিকে ফিরে উদ্ধত ভাবে জিজ্ঞাসা করলে—’কী প্রমাণ তার আপনারা পেয়েছেন? তাকে হত্যা করে আমার লাভ কী?’
‘লাভ পথের কাঁটা সরানো।’—সোম শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন—’আপনি কে, তা আমরা জানি জয়ন্তবাবু! শশীশেখরবাবুর পদবি যে সামন্ত ছিল, কেউ বলে দেবার আগেই আপনি যখন থানায় প্রথম বলে ফেলেন, তখনই আমার সন্দেহ হয়! তারপর সন্ধান নিয়ে সব কিছুই আমরা জেনেছি। বলুন, আপনিই শশীশেখরবাবুর সবচেয়ে নিকট আত্মীয় কি না! বলুন, তারই লুকনো সম্পত্তির লোভে আপনি প্রথম ও বাড়িতে গিয়েছিলেন কি না!’
এই প্রবল জেরার সামনে জয়ন্ত এসব কথা আর অস্বীকার করতে পারলে না। একেবারে অন্য সুর ধরে সে বললে—’যদি গিয়ে থাকি, তাতে দোষ কি। শশীশেখরবাবুর আত্মীয় হওয়াটাই একটা অপরাধ বোধহয় নয়। শশীশেখরবাবু আমার দূরসম্পর্কে কাকা হতেন, তাঁর চিঠি পেয়েই বর্মা থেকে এখানে আমি খোঁজ করতে আসি। কিন্তু ঠিকানা ভুল থাকার দরুণ তাঁর চিঠি অনেক দেরিতে আমার হাতে পড়েছিল। আমি যখন এখানে এসে পৌঁছাই তার অনেক আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।’
‘বর্মা থেকে চলে আসবার সময় এসব কিছুই তো তুমি জানাওনি!’—ললিতার ব্যথিত, বিস্মিত কণ্ঠ আবার শোনা গেল।
‘উপায় ছিল না বলে জানাইনি।’—জয়ন্ত ললিতার মারফত যেন সকলকে বোঝাতে চাইলে—’কাকাবাবু তাঁর চিঠিতে কাউকে কিছু জানাতে বিশেষ ভাবে বারণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবন যে বিপন্ন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর যা কিছু ছিল আমায় বুঝিয়ে দেবার জন্যে লুকিয়ে আমায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।’
‘কিন্তু এখানে এসে সব জানবার পরও নিজের পরিচয় গোপন করেছিলেন কেন?’—শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে।
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না।
সোমই তার বদলে তিক্ত স্বরে বললেন—’তা না করলে ওঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির সুবিধে হত না যে! প্রথম রাত্রে ভয় পাওয়ার যে গল্প বলে উনি আপনাকে অভিভূত করে দেন, সেটাও আপনার এখানে আশ্রয় নেবার একটা ফিকির কি না কে জানে! অথচ আপনার কাছে আশ্রয় নিয়ে উনি প্রথম থেকে আপনার বিরুদ্ধেই আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলবার চেষ্টা করে এসেছেন।’
‘তাতে ওঁর লাভটা কী, তা তো বুঝতে পারছি না।’—শ্রীমন্ত বেশ বিস্মিত।
‘লাভ প্রথমত সন্দেহটা ভুল পথে চালিয়ে আত্মগোপন করার সুবিধে, আর দ্বিতীয়ত, আপনার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটানো।’
‘আমার বিরুদ্ধে আক্রোশ!—সোমের কথায় শ্রীমন্ত একেবারে অবাক—’আমার বিরুদ্ধে ওঁর আক্রোশ হবে কেন?’
‘মাপ করবেন। বাধ্য হয়েই তাহলে সত্য কথাটা আমায় বলতে হচ্ছে।’—সোম একটু ইতস্তত করে ললিতাকে দেখিয়ে বললেন—’আক্রোশের কারণ, ললিতা দেবী। আপনার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা হওয়াটা বোধহয় জয়ন্তবাবুর পছন্দ নয়।’
শ্রীমন্ত ও ললিতা দু’জনেই এ কথায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। কিন্তু জয়ন্ত একেবারে জ্বলে উঠল। উগ্র কর্কশ স্বরে বললে—’আমাকে গ্রেপ্তার করবার জন্যে এ সব অবান্তর কথার বোধহয় কোনো প্রয়োজন নেই। কীসের জোরে আমায় গ্রেপ্তার করছেন, সে পরোয়ানাটা এখন দেখতে পারি?’
‘পরোয়ানার দরকার হবে না।’—সোম কঠিন স্বরে জবাব দিলেন। ‘পরের বাড়ি চুরি করতে এসে হাতে হাতে আপনি ধরা পড়েছেন। সেই অভিযোগেই আপাতত—আপনাকে গ্রেপ্তার করছি।’
‘না।’ হঠাৎ পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে জয়ন্ত হিংস্র ভাবে গর্জন করে উঠল—’সে সুযোগ আপনাকে দিচ্ছি না। কোনোরকম চালাকির চেষ্টা কেউ করবেন না। যান, একদিকে সরে যান।’
জয়ন্তর এই চালের জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। পিস্তল উঁচিয়ে সকলকে একদিকে সরে যেতে বাধ্য করে ধীরে ধীরে সে দরজার দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল। একবার দরজা দিয়ে বেরুতে পারলে তাকে ধরা প্রায় অসম্ভব।
‘জয়ন্ত!’ ললিতাই হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। বাইরে থেকে একজন কনেস্টবল দরজার দিকে আসছে।
ললিতার চীৎকারে জয়ন্ত চমকে পিছন ফিরে তাকাতেই শ্রীমন্ত ও সোম তার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তারপর ধস্তাধস্তি খানিকটা হলেও পিস্তল কেড়ে নিয়ে জয়ন্তকে বেঁধে ফেলতে বেশিক্ষণ তাদের লাগল না।
‘আশা করি এবার ভালোয় ভালোয় থানায় যাবেন, জয়ন্তবাবু।’ সোম বেশ বিদ্রূপের সঙ্গেই বললেন—’আর গোলমাল করে কোনো লাভ নেই।’
জয়ন্তর হাত বাঁধা। চোখ দুটো শুধু তার জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে সে বললে—’সে উপদেশ না দিলেও চলবে। চলুন, কোথায় যেতে চান।’
সোম ও কনেস্টবল জয়ন্তকে নিয়ে চলে যাবার পর শ্রীমন্ত একটু বিব্রত ভাবে ললিতার পেছনে এসে দাঁড়াল।
‘ব্যাপারটা আমি কিন্তু এখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, ললিতা দেবী।’ সান্ত্বনার স্বরে সে বললে—’কোথায় যেন কী একটা খটকা লাগছে। তাই বলছি, আপনি এখন থেকেই হতাশ হবেন না।’
জয়ন্ত ধরা পড়ার পর থেকে ললিতা একটি জানলার ধারে দূরের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে ম্লান একটু হেসে সে বললে—’আমি হতাশ হব কেন? দোষী হয়েও জয়ন্তবাবু ছাড়া পান, এই আমি চাই বলে যদি মনে করে থাকেন, তাহলে আমায় ভুল বুঝেছেন।’
‘না, ভুল আমি বুঝিনি!’ শ্রীমন্তও বিষণ্ণ ভাবে একটু হেসে বললে—’চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’
সমস্ত রাস্তা দু’জনেই প্রায় নীরব। মাঝে মাঝে শ্রীমন্তকেই শুধু কুণ্ঠিত ভাবে দু’একটা নিজের কথা বলতে শোনা গেল।
ললিতাদের বাড়ির কাছে এসে সে বিদায় নিয়ে বললে—’আচ্ছা আমি এখন তাহলে যাই।’
ললিতা প্রতি—নমস্কার করে বললে—’ধন্যবাদ!’
শ্রীমন্ত যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ পাবার মতো কিছুই এখনো করতে পারিনি, ললিতা দেবী।’—আহত স্বরে সে জানালে—’তবে আপনাকে এতক্ষণ যা বলেছি, সে কথা ক’টি মনে রাখবেন! আমি আপনাদের সত্যিকার একজন বন্ধু, এই কথাটা বিশ্বাস করবেন, আর জানবেন, এ বাড়ির শেষ রহস্যের মীমাংসা আমি করবই।’
‘মীমাংসার কি এখনো কিছু বাকি আছে মনে করেন!’—ললিতা ক্লান্ত ভাবে একটু হাসল।
‘থাকতেও তো পারে!’—শ্রীমন্ত নিজের সংশয়টা বেশ স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশ করলে, তারপর ‘আজ রাত্রেই একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব’ বলে দ্রুত পদে বেরিয়ে চলে গেল।
সতেরো
সন্ধে পর্যন্ত মামাবাবুর বিছানার ধারে কাটিয়ে ললিতা কিছুক্ষণের জন্যে নমিতাকে সেখানে বসিয়ে একটু মুখ—হাত ধুতে এসেছিল।
স্নানের ঘর থেকে জামাকাপড় ছেড়ে বেরুতে না বেরুতেই নমিতা সেখানে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এল—’দিদি, দিদি, শিগগির এসো।’
‘কেন! কী, হয়েছে কী?’ ললিতা সভয়ে জিজ্ঞাসা করলে।
‘মামাবাবুর আবার জ্ঞান হয়েছে। মিঃ সোমকে খুঁজছেন।’—নমিতা হাঁপাতে হাঁপাতে জানালে।
দুই বোনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মামাবাবুর ঘরে ছুটে গেল। সত্যিই তিনি বিছানার ওপর উঠে বসেছেন।
‘ওকি মামাবাবু, তুমি উঠে বসেছ কেন?’—ললিতা মামাবাবুকে গিয়ে ধরল।
ললিতাকে দেখে মামাবাবু অস্থির হয়ে উঠলেন—’মিঃ সোমকে এখুনি একবার খবর দেতো ললিতা। এখুনি দেওয়া দরকার।’
‘আচ্ছা, খবর দিচ্ছি। কিন্তু তুমি অত কথা বোলো না, ডাক্তারের বারণ আছে।’—নমিতাকে মামাবাবুকে ধরতে ইঙ্গিত করে কাছে টিপয়—এর ওপর থেকে ঘুমের ওষুধের একটা বড়ি নিয়ে ললিতা আবার বললে—’আচ্ছা, এই ওষুধটা খেয়ে নাও তো।’
সামান্য দু’একবার যে জ্ঞান হয়েছে, তার ভেতর আচ্ছন্ন ভাবে ওষুধ খাবার কথাটাই মামাবাবুর একটু মনে আছে। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে তিনি বললেন—’ওষুধ তো খাচ্ছি কিন্তু—’
ললিতা কিন্তু ছাড়বার পাত্রী নয়। ওষুধ মামাবাবুকে খেতেই হল। তারপর আবার তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন—’মিঃ সোমকে এখুনি কিন্তু না ডাকলে নয়—’
‘বলছি তো ডাকতে পাঠাচ্ছি। তুমি এখন একটু চুপ করে শোও দেখি!’ ললিতা একরকম জোর করে মামাবাবুকে শুইয়ে দিয়ে বললে—’তুমি যদি শান্ত হয়ে না ঘুমোও, আমি কিন্তু কোনো কথা শুনব না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, আমি ঘুমোচ্ছি।’ মামাবাবু অসহায় ভাবে অনুরোধ করলেন—’তুই কিন্তু এখুনি খবর পাঠা।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাঠাচ্ছি।’ বলে মামাবাবুকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই সে বেরিয়ে গেল।
রাত তখন বেশ গভীর হয়েছে। ওষুধের দরুন মামাবাবু অনেকক্ষণ হল অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। নমিতাকে খাইয়েদাইয়ে শুতে পাঠালেও ললিতা কিন্তু মামাবাবুর বিছানা ছেড়ে যেতে আর সাহস করেনি। পাশের একটি চেয়ারে বসে সে একটা বই পড়বার চেষ্টা করছিল। এমন সময় ভূতোর মা এসে ইশারায় তাকে ডাকল।
ভয়—ডরের ব্যাপার যে নয়, ভূতোর মার মুখ দেখেই তা বোঝা গেল। উঠে পড়ে বিছানা থেকে একটু দূরে গিয়ে ললিতা তাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে—’কী, হয়েছে কী!’
‘সেই ছবি—আঁকা বাবু এসেছেন! তোমায় একবার ডাকছেন!’—ভূতোর মা চুপি চুপি জানালে।
‘কে ডাকছেন? শ্রীমন্তবাবু?’—ললিতা জিজ্ঞাসা করলে।
ভূতোর মা প্রসন্ন মুখে মাথা নেড়ে জানালে, হ্যাঁ। শ্রীমন্তবাবুর ওপর তার একটু বিশেষ ভক্তি—শ্রদ্ধা আছে। না হলে আর কেউ এত রাত্রে বিরক্ত করতে এলে সে তার মুণ্ডপাত না করে ছাড়ত না।
‘এত রাত্রে!’ নিজের মনেই একবার বলে ভূতোর মাকে মামাবাবুর কাছে বসিয়ে ললিতা বেরিয়ে গেল।
ওপরের বসবার ঘরেই শ্রীমন্ত ললিতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল।
ললিতা ঢোকবার পর সে একটু সঙ্কুচিত ভাবে বললে—’আপনাকে এত রাত্রে একটু বিরক্ত করলাম, ললিতা দেবী। কিছু মনে করবেন না। আজই আপনাকে বলেছিলাম যে, এ—বাড়ির রহস্যের যা মূল তা নিজে আমি শেষ একবার খুঁজে দেখতে চাই। সেই জন্যেই এখন যাচ্ছি।’
‘এই এত রাত্রে আপনি একলা ওদিকে যাবেন!’—ললিতা বিস্ময় প্রকাশ করলে।
‘হ্যাঁ, একলা ছাড়া আর কাকে সঙ্গে নেব!’—শ্রীমন্ত একটু হাসল। ‘তা ছাড়া এখন আর ভয়ের কিছু তো না থাকবারই কথা।’
একটু চুপ করে থেকে শ্রীমন্ত বললে—’বিপদ যদি কিছু হয় আপনার আত্মরক্ষার জন্যে এই জিনিসটি দিয়ে যাচ্ছি।’
পকেট থেকে একটা ছোট পিস্তল বার করে সে ললিতার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
পিস্তলটা নিতে একটু দ্বিধা করে ললিতা বললে—’ও জিনিস কখনও ব্যবহার করিনি, ওর কিছু দরকারও হবে না।’
‘না হওয়ারই কথা! তবু কাছে রাখলে তো কোনো ক্ষতি নেই। দুপুরের মতো আমায় আবার সাহায্যও তো করতে পারেন।’ বলে একটু হেসে পিস্তলটা ললিতার হাতে দিয়ে শ্রীমন্ত বেরিয়ে গেল।
পিস্তলটা হাতে নিয়ে ললিতা অনেকক্ষণ সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বয়স তার এমন কিছু বেশি নয়। কিন্তু এরই মধ্যে সে যেন অত্যন্ত ক্লান্ত।
বাইরের বাগান ছাড়িয়ে পেছনের পোড়ো নাটমহলের জঙ্গলে শ্রীমন্ত তখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার এক হাতে একটি লণ্ঠন আর এক হাতে একটি শাবল। শাবলটা মাটিতে রেখে, সে লণ্ঠনটা জ্বেলে নিলে, তারপর শাবল ও লণ্ঠন নিয়ে ভাঙা ইটপাথরের ঢিবির ওপর দিয়ে ভগ্নস্তূপের একটি জায়গায় গিয়ে বসল।
শ্যাওলাধরা ভাঙা ইটপাথর চারিদিকে ছড়ানো। তারই ভেতর ছোট ছোট গাছের ঝোপ। এরকম জায়গায় শ্রীমন্ত যে অকারণ এসে বসেনি খানিক বাদেই তা বুঝতে পারা গেল। পকেট থেকে নকশার কাগজটা বার করে, সে লণ্ঠনের আলোয় ভালো করে একবার দেখে নিলে। তারপর সেটা পকেটে আবার ভরে রেখে সবলে শাবলটা দিয়ে ওপরের ইট—পাথরের রাবিশ ও জঙ্গল সাফ করতে লেগে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পরিশ্রম করবার পর জায়গাটা পরিষ্কার হতে সত্যিই একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। লোহার মতো মজবুত কাঠের দুটি বন্ধকরা দরজার পাল্লা। তার দুটি কড়াতে একটি মরচে ধরা তালা আঁটা।
মরচে ধরা হলেও শাবলের চাড় দিয়ে তালাটা ভাঙতে শ্রীমন্তকে বেশ একটু বেগ পেতে হল। কিন্তু তালা ভেঙে পাল্লা দুটো খোলবার পর মনে হল সমস্ত পরিশ্রম সার্থক।
সুড়ঙ্গের মতো একটি ধাপ—কাটা পথ নীচে নেমে গেছে।
লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে সে সন্তর্পণে সেই সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে লাগল। বিস্ময়ে উত্তেজনায় বুক তার তখন সবেগে আন্দোলিত হচ্ছে। বহুকালের বন্ধ করা জায়গা! একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধে প্রথমটা যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
বেশ কিছুটা সেই ভাবে নামবার পর নীচের গুপ্ত ঘরে সে গিয়ে পৌঁছল। গুপ্ত ঘরটি যাঁরই কীর্তি হোক, বেশ মজবুত করেই পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ঘরটি নেহাত ছোটও নয়। দুটি মোটা পাথরের থাম ওপরের ছাদটিকে ধরে রেখেছে।
লণ্ঠনটা নিয়ে প্রায় রুদ্ধ নিশ্বাসে শ্রীমন্ত ঘরের সমস্ত ঐশ্বর্য এক এক করে দেখে ফিরতে লাগল। বড়—ছোট নানা আকারের পুরোনো সিন্দুক ও বাক্স। কোনোটা লোহার, কোনোটা কাঠের। কতদিনের কত পাপের উপার্জন যে সেখানে সঞ্চিত হয়ে আছে, তা হিসেব করা কঠিন। ঘরের এক কোণে রাখা কয়েক বাক্স ডিনামাইটও তার দৃষ্টি এড়াল না।
তন্ময় হয়ে সমস্ত খুলে খুলে দেখতে দেখতে হঠাৎ শ্রীমন্তর হৃদপিণ্ডটা যেন বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল। যে সুড়ঙ্গ—সোপান দিয়ে সে নেমেছিল, তার দিকে পিছন ফিরে লণ্ঠনটা কাছেই রেখে, একটা বাক্সের তালা সে খুলে দেখছিল। হঠাৎ মনে হল পেছনে সেই সিঁড়িতে কার যেন সতর্ক ভাবে নেমে আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
ডালাটা বন্ধ করে বিদ্যুৎবেগে সে পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে ফিরে দাঁড়াল।
সেই গরিলা—মূর্তিই সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে দাঁড়িয়েছে।
ভয়ে বিস্ময়ে শ্রীমন্তর সমস্ত শরীর বুঝি প্রথমটা অবশ হয়ে গেছল। কিন্তু সে শুধু এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর গরিলা—মূর্তি তার দিকে আবার এগিয়ে আসবার চেষ্টা করতেই সে গুলি ছুড়ল।
কিন্তু গরিলা—মূর্তি শ্রীমন্তর চেয়েও তৎপর। পিস্তলের গুলি ছোটবার আগেই এক লাফে সে একটা থামের আড়ালে গিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছে দেখা গেল।
শ্রীমন্ত পর পর আরো দু’বারর গুলি ছুড়লে। কিন্তু সে গুলি থামে ও দেয়ালে লেগেই ব্যর্থ হল। প্রত্যেক বারই বিদ্যুৎগতিতে থামের আড়ালে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করলেও গরিলা মূর্তি এ ভাবে আর কতক্ষণ পালিয়ে বাঁচবে!
তাই অকারণে গুলি নষ্ট আর না করে, উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থেকে শ্রীমন্ত শুধু দাঁতে দাঁত চেপে বললে—’এখানে ঢোকবার সাহস তোমার হবে, অবশ্য ভাবিনি! তবু আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম।’
‘Were you really!’—হঠাৎ মেঝের ওপর ছড়ানো লম্বা কার্পেটটার ওপর বসে পড়ে গরিলা—মূর্তি তার মুখোশটা খুলে ফেলে উচ্চৈচ স্বরে হেসে উঠল!
‘তুমি!’—বিস্ময়ে শ্রীমন্তর মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বার হল না। বিস্মিত হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক কারণ মুখোশ খুলে সেই ভিখিরি সাহেবই সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে তখন হাসছে।
চট করে হাসি থামিয়ে ভিখিরি সাহেব বললে—‘Oh, you seem to be surprised! ঈস লিয়ে তৈয়ার নেহি থে?’
‘তবে রে শয়তান!’—ভিখিরি সাহেবের বিদ্রূপের হাসিতে শ্রীমন্ত যেন একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। থামের আড়ালে নয়, শত্রু এখন একেবারে তার নাগালের মধ্যে।
‘আজই তাহলে তোর শেষ!’ বলে সে গুলি ছোড়বার জন্যে পিস্তল নামাল।
পিস্তলের গুলি ঠিকই ছুটল, কিন্তু ভিখিরি সাহেবের দিকে নয়, একেবারে শূন্যে ছাদের গায়ে! শ্রীমন্ত পিস্তল নামাতে না নামাতেই ভিখিরি সাহেব মেঝের লম্বা কার্পেটটায় সবেগে টান দিয়েছে। শ্রীমন্ত সেই কার্পেটের ওপরই দাঁড়িয়ে ছিল। কার্পেটের টানে পা হড়কে সে মেঝের ওপর সজোরে চিত হয়ে পড়ে গেল। আর তার লক্ষ্যভ্রষ্ট পিস্তলের গুলিটা আগেই ছুটে গেল ওপর দিকে। সেই মুহূর্তেই হিংস্র বাঘের মতো ভিখিরি সাহেব তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
জানলার ধারে দাঁড়িয়ে প্রথম গুলির শব্দেই ললিতা চমকে উঠেছিল। পর পর আরো গুলির শব্দে সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।
শ্রীমন্তর একা পেছনের মহলে যাওয়াটা ঠিক পছন্দ না করলেও, সত্যিকার কোনো ভয় সেখানে এখনো আছে তার মনে হয়নি।
কিন্তু এ গুলির শব্দ তাহলে কীসের?—শ্রীমন্তবাবুকে কেউ কি সত্যিই আক্রমণ করেছে অতর্কিতে!
নিদারুণ অস্বস্তি ও উদ্বেগ নিয়ে সে জানলা থেকে ঘরের মাঝখানের টেবিলটার কাছে এসে দাঁড়াল। শ্রীমন্তর দেওয়া পিস্তলটা তারই ওপর পড়ে আছে।
দ্বিধা—দ্বন্দ্বেরও অন্ত নেই তার মনে। কী এখন তার করা উচিত? সামান্য একজন মেয়ে হয়ে, ওই পিস্তল নিয়েও কোন সাহসে সে ওই অন্ধকার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একলা যাবে! আর গিয়েও কি সাহায্য সে করতে পারে? সে তো জীবনে কখন পিস্তল ছোড়েনি।
সেই মুহূর্তে আবার গুলির শব্দ হতেই তার মন তৎক্ষণাৎ স্থির হয়ে গেল। কিছু পারুক বা না পারুক তাকে যেতেই হবে। অসহায় মেয়ে হওয়ার অজুহাতে চুপ করে বসে থাকতে সে পারবে না। পিস্তলটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল।
গায়ে বেশ ভালোরকম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শ্রীমন্ত ভিখিরি সাহেবের কাছে তখন কাবু হয়ে এসেছে। প্রথম মেঝের ওপর ধস্তাধস্তিতে শ্রীমন্তরই সুবিধা ছিল বেশি। তখনও তার হাতেই পিস্তল। কিন্তু পিস্তল ঠিকমতো ছোড়ার সুবিধে সে পেল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিখিরি সাহেব প্যাঁচে ফেলে শ্রীমন্তর হাত থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিলে। ভিখিরি সাহেব তখন শ্রীমন্তর বুকের ওপর চেপে বসেছে। প্রাণপণ শক্তিতে তাকে ঠেলে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীমন্ত যে ঘুঁষিটা মারল আর কেউ হলে তাতেই বোধহয় কাবার হয়ে যেত। কিন্তু ভিখিরি সাহেবের শরীর যেন ইস্পাত দিয়ে তৈরি। একেবারে ঘরের প্রান্তে ছিটকে পড়েও সে যেন স্প্রিং দেওয়া যন্ত্রের মতো লাফিয়ে ফিরে এসে ঘুষির পাল্টা জবাব যা দিলে শ্রীমন্ত তাতেই কাতরে লুটিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এ ধাক্কা হয়তো সে সামলে উঠত। কিন্তু ভিখিরি সাহেব তার আগেই ঘরের মেঝে থেকে একটা দড়ি তুলে নিয়ে তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললে। এরপর শ্রীমন্তর সব আস্ফালনই বৃথা। কোনো আশা আর নেই জেনে শেষ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। সামনের একটা সিন্দুকের ওপর এক পায়ের হাঁটু দিয়ে চেপে রেখে ভিখিরি সাহেব আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে তখন তাকে বাঁধছে।
‘এই ছোড়ো! ছোড় দো বলছি।’
এবার ভিখিরি সাহেবের চমকে ফিরে তাকাবার পালা। তার দিকে কম্পিত হাতে পিস্তল তুলে, ললিতা সুড়ঙ্গ—সোপানের তলায় দাঁড়িয়ে আছে।
ভিখিরি সাহেব ফিরে দাঁড়াতেই ললিতা তীক্ষ্ন স্বরে আবার বললে—’হাত তুলে দাঁড়াও।’
ভিখিরি সাহেবের এতক্ষণের হিংস্র চেহারা এক মুহূর্তে বদলে গিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
‘Ah! The brave little lady to the rescue ! লেকিন হামার একঠো বাত তো শুনিয়ে!’
‘কোনো কথা শুনতে চাই না।’—কোনো চালাকিতে ললিতা এখন ভুলবে না। কঠিন স্বরে সে আবার জিজ্ঞাসা করলে—’হাত তুলে দাঁড়াবে কি না?’
উত্তেজনায় পিস্তলটা তার হাতে কাঁপছে দেখা গেল।
‘আরে, আরে, সচমুচ গোলি মত করনা! এই আমি হাত তুলেছি।’ ভিখিরি সাহেব হাত তুলে দাঁড়াল। তারপর শ্রীমন্তকে তারই নাকের ওপর দিয়ে সরে যেতে দেখে তিক্ত স্বরে বললে—’আপনার হাত যা কাঁপতে আছে, যেমন—তেমন গোলি ছুটে গেলে সত্যনাশ হোয়ে যাবে। এ ঘরে ডিনামাইট যা আছে, একটা গোলি লাগলে আর কেউ বাঁচবে না। বিশোয়াস না হয়, শ্রীমন্তবাবুকেই পুছে লিন।’
শ্রীমন্ত ততক্ষণে ভিখিরি সাহেবের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে তার বাঁধন খুলে ফেলেছে। ছুড়ে ফেলা পিস্তলটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সে গর্জন করে উঠল—’কেউ বাঁচুক বা না বাঁচুক তোমার আর রক্ষা নেই। চলে এসো ললিতা।’
পিস্তল দেখিয়ে ভিখিরি সাহেবকে ঠেকিয়ে রেখে, দু’জনে পেছু হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ওঠবার পর শ্রীমন্ত সশব্দে ওপরের দরজার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলে।
‘ভেতর থেকে খুলতে পারবে না তো?’—ললিতার ভয় তখনো যায়নি।
ভারী একটা ভাঙা থাম ও কয়েকটা পাথর দরজাটার ওপর চাপা দিয়ে শ্রীমন্ত বললে—’না, সে ভয় নেই, কেউ এসে ওপর থেকে খুলে না দেওয়া পর্যন্ত বাছাধন ওইখানেই পচে মরবেন।’
‘বেশিক্ষণ ওখানে বন্ধ থাকলে সত্যিই মারা পড়বে!’ এবার ললিতার ভয়টা অন্য রকমের। ‘এখুনি পুলিশ ডেকে এনে ওকে ধরিয়ে দেওয়া দরকার।’
এ সময়ে ললিতার এ মমতায় হাসি পেলেও তার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে শ্রীমন্ত গম্ভীর ভাবে বললে—’হ্যাঁ, থানাতেই তো যাচ্ছি।’
দু’জনে নীচের হলঘরে পৌঁছোবার পর সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে ললিতা বললে—’আপনি তো এখন থানাতেই যাবেন। আমি তাহলে ওপরে যাচ্ছি।’
‘ওপরে যাচ্ছ!’ শ্রীমন্তকে যেমন বিস্মিত তেমনি একটু অপ্রসন্নও মনে হল। ‘তোমাকেও যে আমার সঙ্গে যেতে হবে ললিতা!’
‘আমাকে! আমাকে যেতে হবে কেন?’—ললিতা আপত্তি জানাল—’না, মামাবাবুকে ফেলে আর এখন আমি যেতে পারি না।’
‘তবু যেতেই যে হবে ললিতা।’—শ্রীমন্তর কণ্ঠস্বরটা কেমন অদ্ভুত শোনাল। ‘মামাবাবুকে চিরকালের মতো ফেলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে।’
‘এসব আপনি কি বলছেন!’—ললিতা সবিস্ময়ে শ্রীমন্তের দিকে তাকাল।
শ্রীমন্ত হঠাৎ চমকে ফিরে তাকাল। যে পথ দিয়ে পেছনের মহল থেকে তারা এসেছে, সেখানে কিসের যেন একটা শব্দ। ফিরে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছায়াও যেন সেখান থেকে সরে গেল মনে হল।
শ্রীমন্ত পিস্তল তুলে তৎক্ষণাৎ সেদিকে গুলি ছুড়লে।
সেই গুলির শব্দেই বুঝি মামাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। বিমূঢ় ভাবে তিনি উঠে বসলেন। কেউ কোথাও নেই। ললিতা—নমিতার নাম ধরে দু’বার তিনি ডাকলেন। তবু কারুর সাড়া নেই।
কতক্ষণ তিনি এ অবস্থায় কাটিয়েছেন কিছুই জানেন না। মাথাটা অত্যন্ত ভারী মনে হচ্ছে। তবু তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এরা সব গেল কোথায়? নীচে গুলির শব্দটা বা কিসের! হঠাৎ বুকটা তাঁর কেঁপে উঠল। ললিতা—নমিতার কোনো বিপদ হয়নি তো? না, শরীরের অবস্থা যেমনই হোক তাঁকে খোঁজ নিতে যেতেই হবে। শুধু মনের জোরে শক্ত হয়ে তিনি দেয়ালে টাঙানো বন্দুকটার কাছে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে নীচে আর একটা গুলির শব্দ শোনা গেছে।
অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে শ্রীমন্তই অবশ্য দ্বিতীয় গুলিটাও ছুড়েছিল।
‘এখানে দাঁড়াও ললিতা। নড়বার চেষ্টা করো না।’ বলে, তারপর সে দ্রুতপদে পেছনের মহলের রাস্তাটা দেখতে গেল। হঠাৎ কি যেন তার হয়েছে! ঠিক সুস্থ যে সে নয় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই!
শ্রীমন্ত কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে ফিরে আসার পর ললিতা বিরক্তির সঙ্গে সেই কথাই বললে—’আজকের সব ব্যাপারে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়। এত উত্তেজিত হবার কী হয়েছে?’
‘কী হয়েছে!’—শ্রীমন্তর সমস্ত মুখটা উত্তেজনাতেই বুঝি কেমন বিকৃত দেখাচ্ছে—’সমস্ত জীবনের চেষ্টা আজ আমার সফল হতে চলেছে। সামান্য কোনো ভুলে এখন আমি ভরাডুবি হতে দেব তুমি মনে করো! এসো!’
শ্রীমন্তের উত্তেজনার আতিশয্য খানিকটা হয়তো বোঝা যায়, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের রূঢ়তা ক্ষমা করা যায় না।
ললিতা কঠিন মুখে বললে—’না, আমি যাবো না।’
‘যাবে না!’—শ্রীমন্তর মুখ এবার সত্যিই হিংস্র হয়ে উঠল। ‘আমায় কি জয়ন্ত পেয়েছ যে তোমার ওই মেয়েলি ভ্রূকুটি দেখে পিছিয়ে যাব। তোমার মতো মেয়েকে দু’হাতে নিংড়ে শেষ করে দিতে আমার এতটুকু বাধবে না।’
সবলে ললিতার হাত ধরে টান দিয়ে সে আবার বললে—’এসো আমার সঙ্গে।’
শ্রীমন্ত কি সত্যিই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে? ললিতা সিঁড়ির রেলিংটা ধরে প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করলে। কিন্তু সে আসুরিক শক্তির কাছে সে পারবে কেন? শ্রীমন্ত তাকে সবলে হিঁচড়ে টেনে নির্মমভাবে বাইরের দরজার দিকে নিয়ে চলল।
‘দাঁড়াও।’
শ্রীমন্তকে সবিস্ময়ে দাঁড়াতে হল এবার। এতো মামাবাবুর কণ্ঠস্বর!
মামাবাবুই সিঁড়ির ওপর ধাপে এসে দাঁড়িয়েছেন। মাথায় এখনো তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাতের বন্দুকের ভার তিনি যেন বইতে পারছেন না।
তবু শ্রীমন্তর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন—’তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম। শয়তান! সেদিন বড় ফাঁকি আমায় দিয়েছিলে!’
উত্তর না দিয়ে শ্রীমন্ত শুধু তাঁকে লক্ষ্য করে পিস্তল তুললে।
‘পিস্তল ফেলে দিন শ্রীমন্তবাবু!’
শ্রীমন্তর পিস্তল ছোড়া আর হল না। চমকে ফিরে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, জয়ন্ত ও মিঃ সোম পেছনের মহলে যাবার পথের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। মিঃ সোমের রিভলভারের লক্ষ্য তারই ওপর নিবদ্ধ।
‘ফেলে দিন পিস্তল!’—জয়ন্ত আবার গর্জন করে উঠল। তারপর শ্রীমন্তকে তখনও দ্বিধা করতে দেখে সোমের সঙ্গে এগিয়ে এসে তার হাত থেকে পিস্তলটা সে কেড়ে নিল।
মামাবাবু ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছেন। শ্রীমন্তকে দেখিয়ে উত্তেজিত ভাবে তিনি বললেন—’এই সেই শয়তান, সেদিন আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমায় খুন করতে চেয়েছিল!—’
‘মিথ্যে কথা!’ বেকায়দায় পড়ে শ্রীমন্ত একেবারে মরিয়া হয়ে দিনকে রাত করবার চেষ্টা করে দেখলে। মামাবাবুর অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বললে—’সাংঘাতিক আঘাতে ওঁর মাথার ঠিক নেই। মানুষ চিনতে উনি ভুল করছেন।’
‘Is that so!’
সকলেই এবার অবাক হয়ে দেখলে, শ্রীমন্তর ঠিক পেছন দিকের হলঘরের আর এক দরজায় ভিখিরি সাহেব শ্রীমন্তর সেই বরখাস্ত করা লোককে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভিখিরি সাহেবের গলার স্বর শুধু নয়, তার চেহারা, ধরন—ধারণই এখন আলাদা। শক্তি ও নেতৃত্ব তার দাঁড়াবার ভঙ্গিতে পর্যন্ত পরিস্ফুট।
দৃঢ় পদক্ষেপে শ্রীমন্তর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে কঠিন স্বরে সে বললে—’ওঁর না হয় মাথার ঠিক নেই, তোমার তো আছে!’
তারপর পাশের লোকটিকে দেখিয়ে আবার অগ্রসর হতে হতে বলতে শুরু করলে—’দেখ দিকি এই লোকটিকে চিনতে পার কি না? মনে করে দেখ দিকি, এরই সাহায্যে ভয় দেখিয়ে এ—বাড়ি হানাবাড়ি করে তোলবার পর নিষ্কণ্টক হবার জন্যে একেই ফন্দি করে মারবার ব্যবস্থা করেছিলে কি না? মনে পড়ছে শ্রীমন্ত!’
শ্রীমন্তর সব শয়তানি এবার বুঝি শেষ। ভিখিরি সাহেব ও তার সঙ্গীর সামনে পেছুতে পেছুতে সে তখন হলের মাঝখানের টেবিলটার কাছে এসে আটকে গেছে। পালাবার কোনো পথই আর তার নেই।
কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক চালাকিতে সে পাশা ঘুরিয়ে দিলে।
টেবিলটির ওপরকার একটি উজ্জ্বল বড় বাতি থেকেই সমস্ত হলঘর আলোকিত।
আচমকা সেই টেবিলটা সে পেছনে হাত বাড়িয়ে উল্টে দিলে। বাতিটা মেঝের পড়ে ভেঙে চুরমার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত হলঘর একেবারে অন্ধকার।
সে অন্ধকারে তারপর একটা হুলুস্থুল বেধে গেল। কে কোথায় দেখাই যায় না। গুলি করতে গেলে নিজেদের গায়েই লাগে। এই বিশৃঙ্খলার সুযোগেই শ্রীমন্ত সকলকে ফাঁকি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে দোতলায় উঠে পালিয়ে গেল। যাবার আগে দোতলা থেকে একবার পিস্তল ছুড়ে সে যেন তার বিদায় সম্ভাষণ পরিহাস করে জানিয়ে দিলে। তার নিজেরটা জয়ন্ত কেড়ে নিলেও ললিতার পিস্তলটা তখনও তার কাছে যে ছিল কারুর জানবার কথা নয়।
কিন্তু অত সহজে তাকে ছাড়বার পাত্র এরা কেউ নয়। ললিতা ও মামাবাবু ছাড়া আর সকলে তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাকে অনুসরণ করলে।
পেছনের মহলের বিরাট ধ্বংসস্তূপ ও জঙ্গলের মধ্যে একটা লোকের বেমালুম কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকা মোটেই কঠিন নয়। খানিকক্ষণ পর্যন্ত শ্রীমন্তর সন্ধান তাই পাওয়া গেল না। কিন্তু বিপদে পড়লে শয়তানদেরও বুদ্ধিভ্রংশ হয়। দূরে ভিখিরি সাহেবের দলকে একটা খিলানের তলা দিয়ে বেরুতে দেখে হঠাৎ বিপন্ন বোধ করে সে নিজেই আগে গুলি ছুড়ে বসল।
তারপর যা শুরু হল তাকে ছোটখাটো যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। একটা ঝোপে ঢাকা পাথুরে ঢিবির আড়ালে শ্রীমন্ত ও অন্যদিকে সেই খিলানের তলায় সোম, জয়ন্ত ও ভিখিরি সাহেবের দল। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে রাত্রির অন্ধকার যেন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে অনেকক্ষণ চলতে পারত, কিন্তু শ্রীমন্তরই গুলি আগে গেল ফুরিয়ে! নিরুপায় হয়ে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আবার সে একদিকে সরে পড়ল।
এবার বুঝি তাকে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
যে দিকে সে গেছে মনে হয়েছিল, ভিখিরি সাহেব আর সকলের সঙ্গে সে দিকে অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে গেল।
কিন্তু কোথাও তার কোনো চিহ্ন নেই।
‘ওই, ওই যে!’ জয়ন্ত হঠাৎ উত্তেজিত ভাবে দূরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখালে। সত্যিই দূরে শ্রীমন্তকে ছুটে পালাতে দেখা গেল।
কিন্তু দোতলার যে ভাঙা বারান্দায় তারা দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে নেমে তাকে ধরা এখন অসম্ভব।
শ্রীমন্তর ভাড়াটে গুন্ডাই এ সমস্যার সমাধান করে দিলে। এতক্ষণ সে নীরবে সকলের পিছু পিছু এসেছে। এবার এগিয়ে এসে ভাঙা দেয়ালে জড়ানো লম্বা একটা গাছের ঝুরি অমানুষিক শক্তিতে আলগা করে নিয়ে সে এক নিমেষে শূন্য পথে প্রচণ্ড এক দোল খেয়ে বেরিয়ে গেল।
উৎসাহিত হয়ে অন্য সকলেও নীচে নামবার পথে এবার ছুটল।
শ্রীমন্তর লোভই বুঝি তার কাল।
সকলের চোখে দ্বিতীয়বারও সে ধুলো দিতে পেরেছিল। কিন্তু নাটমহলের গুপ্তগৃহের ওপরই তখনও তার লক্ষ্য। সেখান থেকে সামান্য কিছু সরিয়ে নিয়ে পালাতে পারলেও তার যথেষ্ট লাভ।
কিন্তু সে আশা তার পূর্ণ হবার নয়। হঠাৎ পেছনে একটা প্রবল শব্দ শুনে সে চমকে ফিরে দাঁড়াল।
‘না, শ্রীমন্তবাবু!’ শ্রীমন্তর সেই ভাড়াটে গুন্ডাই গাছের ঝুরিতে ঝুলে এসে তার সামনে লাফিয়ে পড়েছে। হিংস্র শ্বাপদের মতো অগ্রসর হতে হতে সে গর্জন করে উঠল—’সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে তুমি পালাতে পার, কিন্তু আমার হাত থেকে নয়। আজ আর তোমার নিস্তার নেই।’
সভয়ে পেছুতে পেছুতে শ্রীমন্ত তখন গুপ্তগৃহের সুড়ঙ্গ—মুখে গিয়ে পৌঁছেছে। সামনে তার যমদূত আর ওদিকে ভিখিরি সাহেবের সঙ্গে সোম ও জয়ন্ত ততক্ষণে অন্য পথ দিয়ে সেখানে উপস্থিত।
পিস্তলটা তাদের দিকে তুলে সে শেষবার ভয় দেখাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা।
‘ও পিস্তল কী দেখাচ্ছে!’ লোকটার পৈশাচিক অট্টহাসি শোনা গেল—’ওতে আর গুলি নেই, তা জানি।’
‘খবরদার বলছি!’ শ্রীমন্ত যেন আতঙ্কে, উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে গেছে—’আর এক পা কেউ এগিয়েছ কি, একটি প্রাণীও এখানে রক্ষা পাবে না।’
মরিয়া হয়ে সে সুড়ঙ্গ—সোপান দিয়েই নীচে নেমে গেল।
‘তার আগে তোমায় কে রক্ষা করে তাই দেখি!’—বলে শ্রীমন্তর ভাড়াটে গুন্ডাও তাকে অনুসরণ করলে।
সোম তাদের পেছনে যাচ্ছিল। ভিখিরি সাহেব তাকে বাধা দিয়ে বললে—’থাক, তোমায় আর যেতে হবে না। ওদের নিজেদের শয়তানির শোধবোধ ওরা নিজেরাই করুক।’
জয়ন্ত ও সোমকে নিয়ে ভিখিরি সাহেব দূরে সরে গেল।
নীচে গুপ্তগৃহে তখন দুই শয়তানের মরণ—সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
নিরুপায় হয়ে শ্রীমন্ত তার দুষমনের দিকে গুলিহীন পিস্তলটাই প্রথম ছুড়ে মেরেছিল। কিন্তু সে আঘাতে কপালটা গভীরভাবে কেটে লোকটার সমস্ত মুখ রক্তাক্ত হওয়ার সঙ্গে যেন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে এসে সে শ্রীমন্তর টুঁটি সবলে চেপে ধরলে। শ্রীমন্তর সত্যিই আর নিস্তার নেই। দম বন্ধ হয়ে তার সমস্ত মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে প্রাণপণ শক্তিতে দুশমনের পেটে প্রচণ্ড একটা হাঁটুর গুতো দিয়ে সে নিজেকে কোনোরকমে শেষ মুহূর্তে মুক্ত করে নিলে।
দুশমন কাবু হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সে শুধু ক্ষণিকের জন্যে। পরমুহূর্তেই মূর্তিমান মৃত্যুর মতো সে দ্বিগুণ আক্রোশে আবার এগিয়ে গেল।
কিন্তু শ্রীমন্ত উন্মাদের মতো ঘরের লণ্ঠনটা দু’হাতে তখন তুলে ধরেছে।
‘সাবধান বিরিঞ্চি! এখনো বলছি সাবধান!’—শ্রীমন্ত চিৎকার করে শাসিয়ে উঠল। ‘মরতে হলে আমি একা মরব না। সত্যি সত্যি এ—ঘর আমি উড়িয়ে দেব।’
‘হ্যাঁ, তাই দাও, দেখি!’—চরম আক্রোশে ও হিংসায় বিরিঞ্চিও উন্মাদ হয়ে গেছে।
দু’হাতে বাতিটা তুলে ধরে বিরিঞ্চির সামনে পেছুতে পেছুতে কাতর ভাবে যেন আর্তনাদ করে উঠে, শ্রীমন্ত তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলে—’শোনো বিরিঞ্চি, আমার কথা শোনো! একটু থামো। এ—ঘরে যা কিছু আছে, সব কিছুর ভাগ আমি তোমায় দেব—এই সব হিরে, মুক্তো, টাকা, মোহর সব কিছুর বখরা…!’
‘হ্যাঁ, বখরা আগেও দেবে বলেছিলে।’ সমস্ত প্রলোভনের ওপরে বিরিঞ্চির এখন শুধু এক অটল সঙ্কল্প। অমোঘ নিয়তির মতো এগিয়ে যেতে যেতে সে বললে—’সে কথা আমি ভুলিনি। তারপর লুকিয়ে আমাকেই সাবাড় করবার ব্যবস্থা করেছিলে, বেইমান!’
পেছুতে পেছুতে শ্রীমন্ত একটা থামের গায়ে তখন বাধা পেয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। চোখ—মুখের নিদারুণ আতঙ্কের সঙ্গে তার গলার করুণ কাকুতি এবার শোনা গেল—’সত্যি বলছি, এবার আমি বেইমানি করব না। তুমি যা চাও তাই তোমায় দেব, শুধু আমায় বাঁচতে দাও, শুধু এদের হাত থেকে আমায় পালাতে দাও…’
শ্রীমন্তর কথা আর শেষ হল না।
‘একেবারে দুনিয়া থেকেই তোমার পালাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ বলে, ক্ষিপ্ত দানবের মতো বিরিঞ্চি তার কণ্ঠনালি দুই হাতে চেপে ধরলে।
শ্রীমন্ত সামান্য একটু যোঝবার চেষ্টা করলে, তারপর মরিয়া হয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় হাতের লণ্ঠনটা সজোরে ডিনামাইটের বাক্সগুলোর ওপর ছুড়ে দিলে।
লণ্ঠন ভেঙে তেল ছড়িয়ে পড়ে কাঠের বাক্সগুলো প্রথম জ্বলে উঠল।
তারপর সমস্ত ঘর নিশ্চিহ্ন করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! ভূমিকম্পের মতো আশপাশের সমস্ত জায়গা সে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল। ভাঙা নাটমহলের সামান্য যে দু’একটা থাম ও দেয়াল খাড়া ছিল, সেগুলো সশব্দে তখন ধসে পড়ছে। তারই সঙ্গে মাটির তলা থেকে আগুনের হল্কা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলি বেরিয়ে সমস্ত জায়গাটা কিছুক্ষণ ছোটখাটো আগ্নেয়গিরির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠল।
শয়তানদের নিজেদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ও ভয়ঙ্কর পরিণামের নীরব সাক্ষীরূপে ভিখিরি সাহেবের সঙ্গে সোম ও জয়ন্ত তখন দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আঠারো
ওই দুর্যোগ দুর্ঘটনার মধ্যে সারারাত্রি নমিতার কীভাবে যে কেটেছে তার বর্ণনা বোধহয় নিষ্প্রয়োজন। গোলমাল ও গুলি—বারুদ বিস্ফোরণের শব্দে ভয়ে প্রায় আধমরা হবার পর দিদি ও মামাবাবু ফিরে এলে তাদের কাছে ছাড়াছাড়া ভাবে কয়েকটা কথা সে শুনেছে মাত্র। তাতে তার কৌতূহল মেটেনি।
সমস্ত রাত জাগবার পর ঘুমিয়ে পড়ে সকালের দিকে উঠতে তার একটু বেলা হয়ে গেছল। উঠে জামাকাপড় ছেড়ে কার কাছে ব্যাপারটা ভালো করে জানা যায় তারই সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে বেরুচ্ছে, এমন সময় নীচে হলঘরে মিঃ সোমকে ঢুকতে দেখে সে যেন হাতে স্বর্গ গেল।
‘শুনুন, শুনছেন!’—সে ওপর থেকেই চিৎকার করে উঠল।
সোম দাঁড়িয়ে পড়বার পর দ্রুত পদে নেমে এসে সে উত্তেজিতভাবে শুরু করলে—’বাবা! কাল রাত্রে কী সব কাণ্ডই হল। দিদি, মামাবাবু কেউ ওপরে নেই। আমি আর ভূতোর মা তো ভয়ে একেবারে কাঠ!’
নিজেদের অবস্থাটা বুঝিয়ে দিয়েই সে আসল প্রশ্ন করে বসল—’আচ্ছা, শ্রীমন্তবাবু যে অমন ভয়ানক লোক, আগে বুঝতে পেরেছিলেন?’
‘ঠিক কি আর পেরেছি!’ সোম হেসে বললেন—’তাহলে তো সব গোল চুকেই যেত!’
এ উত্তরে নমিতা সন্তুষ্ট হল না। মুখটা করুণ করে বললে—’আমি কিন্তু কিছুই এখনো বুঝতে পারছি না!’
সোম আবার হেসে বললেন—’আচ্ছা আমার সঙ্গে আসুন। মিঃ রুদ্রর কাছেই সব কথা শুনে বুঝতে পারবেন।’
‘মিঃ রুদ্র আবার কে?’—নমিতা অবাক।
‘আসুন না আমার সঙ্গে—’ বলে, সোম নমিতাকে নিয়ে পাশের একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল।
সে ঘরে মামাবাবু তখন একলা বসে আছেন। একটা কিছু বৈঠকের ব্যবস্থা যে সেখানে হয়েছে, টেবিল—চেয়ার সাজাবার ধরনেই তা বোঝা গেল।
ওপর থেকে নেমে হল দিয়ে ললিতা সেই ঘরেই যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে জয়ন্ত তাকে ডাকল। ‘একটু দাঁড়াও ললিতা!’
ললিতা দাঁড়াল বটে, কিন্তু নেহাত যেন অনিচ্ছায়, জয়ন্তর দিকে মুখটা পর্যন্ত না ফিরিয়ে। জয়ন্ত কাছে এসে কিন্তু হাসিমুখেই বললে—’আমার সম্বন্ধে ধারণাটা এখন তোমার বদলেছে কি?’
‘না, বদলাবে কেন?’—ললিতার মুখ একেবারে গম্ভীর।
‘এখানো বদলায়নি!’—জয়ন্ত বেশ বিস্মিত ও বিচলিত।
ললিতা তবু যেন নির্বিকারভাবেই জবাব দিলে—’না, বদলাবার কিছু তো হয়নি।’
জয়ন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠল—’তার মানে! তুমি কি বলতে চাও যে…’
হঠাৎ চাপা কাশির শব্দে কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে জয়ন্ত পেছনে তাকাল। ফিটফাট সাহেবী পোশাক পরা একজন ভদ্রলোক সকৌতুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে হাসছেন। চেহারা—পোশাকের আশ্চর্য পরিবর্তনে প্রথমে একটু চমকে গেলেও দু’জনেই ভদ্রলোককে চিনল। তিনি যে কখন এসে তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছেন, তারা লক্ষই করেনি।
ভদ্রলোক এবার তাদের কাছে এগিয়ে এসে জয়ন্তকে উদ্দেশ করে আবার বললেন—’মাপ করবেন, একটু অনধিকার চর্চা করছি। ললিতা দেবীর ধারণাটা কী, তা না জেনে বদলাবার জন্যে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ধারণাটা বরাবরই ভালো এমনও তো হতে পারে।’
এ ব্যাখ্যাটা জয়ন্তর মাথায় আসেনি।
‘তাই কি ললিতা?’—সে তৎক্ষণাৎ উৎসুকভাবে প্রশ্ন করলে। কিন্তু ললিতা অত সহজে ধরা দিতে প্রস্তুত নয়। সংক্ষেপে শুধু ‘জানি না।’ বলে, সে চলে গেল।
‘আমি কিন্তু ঠিক জানি।’—ভদ্রলোক গম্ভীর ভাবে জয়ন্তকে আশ্বাস দিলেন। ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। জানবেন, আমার এ গোয়েন্দাগিরিও নির্ভুল।’
হেসে সস্নেহে জয়ন্তর কাঁধে হাত দিয়ে তিনি তাকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন। পাশের ঘরে মামাবাবুর ও মিঃ সোমের সঙ্গে ললিতা ও নমিতা তখন বসে আছে।
ভদ্রলোককে জয়ন্তর সঙ্গে ঢুকতে দেখেই মিঃ সোম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সেলাম জানালেন।
নমিতা তাই দেখে একেবারে অবাক।
‘ও কি! কাকে ‘স্যালুট’ করছেন!’—সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলে।
‘কি যা তা বকছিস!’—ললিতা তাড়াতাড়ি তাকে বুঝিয়ে দিলে। ‘উনিই তো ডিটেকটিভ অফিসার মিঃ রুদ্র।’
‘উনি!’—নমিতা একেবারে হতভম্ব।
তার হতভম্ব হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। ভিখিরি সাহেবের আসল চেহারা যে এই, একথা বিশ্বাস করাই শক্ত। মিঃ রুদ্র নমিতার দিকে চেয়ে হেসে বললেন—’এ ডিটেকটিভ নমিতার ঠিক পছন্দ নয় মনে হচ্ছে।’
নমিতা লজ্জা পেয়ে বললে—’যাঃ, তা কেন?’
সকলে হেসে ওঠার পর মামাবাবু সঙ্কুচিত ভাবে বললেন—’সত্যি, না জেনে আপনার সঙ্গে কত খারাপ ব্যবহার করেছি…’
‘ভাগ্যিস করেছেন!’ মিঃ রুদ্র মামাবাবুকে আর শেষ করতে দিলেন না। হেসে বললেন—’আগে থাকতে জানতে পারলে তো আমার সমস্ত কাজই মাটি।’
‘আচ্ছা, একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না।’ নমিতা আর ধৈর্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলে—’গরিলা যে সাজত, সে তো শ্রীমন্তবাবুর লোক! তাহলে প্রথম দিন সে শ্রীমন্তবাবুকেই মারতে গেছল কেন?’
‘সেটা একটা লোক দেখানো ফাঁকি, সকলকে ভুল বোঝাবার জন্যে!’ নমিতাকে বুঝিয়ে দিয়ে মিঃ রুদ্র সকলকে বসতে অনুরোধ করলেন। তারপর নিজে একটা চেয়ারে বসে আবার শুরু করলেন—’ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এ—বাড়ির রহস্যের সঙ্গে আপনারা সকলেই জড়িত ছিলেন। তাই ব্যাপারটা সঠিক ভাবে জানবার কৌতূহল আপনাদের পক্ষে স্বাভাবিক। এখানকার কাজ আমার শেষ হয়েছে, কিন্তু আপনাদের কাছে বিদায় নেবার আগে এ রহস্যের সমস্ত জট ছাড়িয়ে সব পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত মনে করে আজকের এ বৈঠকের ব্যবস্থা আমি আপনাদের করতে বলেছিলাম।’
একটু থেমে তিনি আবার বললেন—’মোটামুটি ব্যাপারটা আপনারা সবাই এখন নিশ্চয় বুঝেছেন। এ বাড়িতে চোরাই মণিমুক্তোর কারবার যিনি করতেন সেই শশীশেখরবাবুর দুটি প্রধান সহায় ছিল। তার একজন এখানে খুন হয়েছে, আর দ্বিতীয়জন হল শ্রীমন্ত। গুপ্তধনের লোভে শ্রীমন্তই নিজে গরিলা সেজে প্রথম শশীশেখরকে হত্যা করে। কিন্তু গুপ্তধন খুঁজে বার করবার আগেই পুলিশের ভয়ে তাকে কিছুদিন গা ঢাকা দিতে হয়। এ—বাড়ি হাতছাড়া হলে কিন্তু তার সব আশায় ছাই পড়বে। তাই ভোল পাল্টে শিল্পী সেজে এখানে ফিরে এসে আস্তানা গাড়বার পর আরেকজনের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে সে এ—বাড়িকে হানাবাড়ি করে তোলবার ব্যবস্থা করে। তার ভাড়াটে গুন্ডা বিরিঞ্চিকে সে নিজের বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে রাখেনি। রেখেছিল, এ—বাড়ির ধারেকাছে কেউ এলে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার জন্যে, সে নিজে নির্বিঘ্নে গুপ্তধনের সন্ধান যাতে করতে পারে।
‘জয়ন্ত ভয় পেয়ে তারই কাছে এসে ওঠায় আর তার ওপর মামাবাবুরা নিরুপায় হয়ে হঠাৎ এ—বাড়ি কিনে নেওয়ায় তার অবশ্য অত্যন্ত অসুবিধে হয়। তা সত্ত্বেও মামাবাবুদের তাড়াবার ব্যবস্থা সে প্রায় করেই এনেছিল, এমন সময় শশীশেখরের আর এক সাকরেদ হঠাৎ এ—বাড়িতে এসে উদয় হওয়ায় সে দারুণ মুশকিলে পড়ে। আমরা না জানলেও দু’জনেই তারা দু’জনকে দেখে চিনেছিল। গোপনে আলাপ করবার ছুতোয় শ্রীমন্ত তারপর তার সঙ্গীকে বাগানে নিয়ে গিয়ে খুন করে। খুনের ছোরাটা সে টেনে খুলে নিয়ে যাবারই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাড়াতাড়িতে বেকায়দায় তার হাতের একটা আঙুল তাতে কেটে যায়। বাড়ি কিনতে যে এসেছিল তাকে দেখে জয়ন্ত ঠিকই সন্দেহ করেছিল যে, লোকটার মতলব সম্পূর্ণ অলাদা। একটা বিশ্রী কিছু ঘটতে পারে অনুমান করে সে সত্যিই তখন কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছিল। তার পায়ের শব্দ পেয়ে শ্রীমন্ত ছোরাটা নেবার চেষ্টা আর না করে তখন পালিয়ে যায়। অন্ধকারে তাকে ধরতে গিয়ে পড়ে যাওয়ায় জয়ন্তর হাতটা যথার্থই কেটে গিয়েছিল। হাত কাটার দিক দিয়ে জয়ন্ত ও শ্রীমন্ত দুজনেই তখন আমাদের সন্দেহের পাত্র। তাদের পরীক্ষা করবার জন্যে আমি নিজেও দুটো আঙুল কাটার ভান করে বেঁধে রাখি।’
‘একটা ব্যাপার আমি কিন্তু এখনো বুঝতে পারিনি স্যার।’—সোম নিজের সংশয়টা প্রকাশ না করে পারলেন না। ‘খুনের ব্যাপারটা যখন ঘটে প্রায় সেই সময়ে আমি শ্রীমন্তর বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। তখন ভেতর থেকে তার বেহালার বাজনা আমি স্পষ্ট শুনেছি।’
জয়ন্ত সায় দিয়ে বলে, ‘বেহালার বাজনা আমিও প্রথম দিন শুনেছিলাম। তার পরে বেহালা দেখেওছি।’
মিঃ রুদ্র হেসে বললেন—’সেটাও তার একটা কারসাজি। যেমন তার ছবি আঁকা, তেমনি তার বেহালা বাজানো। দুটোর কোনোটাই সে জানে না। ভালো করে লক্ষ করলেই বুঝতেন যে, ছবিগুলো সে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে রেখেছিল মাত্র। আর তার বেহালার বাজনা যা শুনেছেন তা তার ঘরে লুকোনো, automatic গ্রামোফোন রেকর্ডের। ঠিক ধরতে না পারলেও তার ওপরও আমার গোড়া থেকে নজর ছিল। গোপনে তার বাড়ির সব কিছু সন্ধান তাই নিয়ে রেখেছিলাম।’
‘কিন্তু মামাবাবুকে তার হঠাৎ ওভাবে মারবার চেষ্টা করবার কারণ কী?’—জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে।
‘কারণ মামাবাবু নিজে! উনি দৈবাৎ সেই চোরা কুলুঙ্গি থেকে শশীশেখরের গোপন নকশাটা না পেয়ে গেলে শ্রীমন্তর পক্ষেও গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব ছিল। মামাবাবু আবার ডাইনির কোলে—ই পো সমর্পণ করে বসলেন! সেই নকশার জোরে রাত্রে সে যখন গুপ্তধনের জায়গা খুঁজে বার করেছে, মামাবাবু তখন হঠাৎ সেইখানেই গিয়ে হাজির। নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে মামাবাবুকে শেষ করে দেওয়া ছাড়া তার আর তখন অন্য উপায় ছিল না।’
‘মামাবাবুকে মারার কারণ না হয় বুঝলাম’, ললিতা এবার বললে—’কিন্তু যাকে গরিলা সাজিয়ে সে সকলকে ভয় দেখাত সেই বিরিঞ্চি তো তার নিজের লোক। তাকেও সে মারবার ফন্দি করেছিল কেন?’
‘শয়তানদের দস্তুরই ওই!’ বলে, মিঃ রুদ্র একটু হাসলেন, ‘কাউকে তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারে না। বিরিঞ্চিকে দিয়ে কাজ যা করাবার তখন সে করিয়ে নিয়েছে। বিরিঞ্চি নিজেও আসলে যে এক খুনে বদমাশ, শ্রীমন্তর চেয়ে ভালো করে কেউ তা জানত না। কখন যে বিরিঞ্চি বিগড়ে গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে এই তখন সদাই তার ভয়। সে ভয়ের কারণও ছিল।’
‘শ্রীমন্তর বাড়িতে বিরিঞ্চিকে আমরা যেদিন দেখি সেদিনই তো তার শ্রীমন্তর ওপর চড়া মেজাজ দেখেছিলাম।’—মামাবাবু ঘটনাটা স্মরণ করে বললেন।
‘না।’—মিঃ রুদ্র মামাবাবুর ভুলটা ভেঙে দিয়ে বললেন—’সেদিনকার চড়া মেজাজটা ভাণ। সেদিন সে তার নিয়ম মতো লুকিয়ে শ্রীমন্তর কাছে হুকুম নিতে গেছল। হঠাৎ নমিতা ও ললিতা তাকে দেখে ফেলবে সে বা শ্রীমন্ত ভাবতে পারেনি। ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্যে শ্রীমন্ত মিছিমিছি তাকে বরখাস্ত করা পাহারাদার হিসাবে ধমকাবার অভিনয় করে। মনে করে দেখলে বুঝতে পারবেন, বাকি মাইনের ছুতোটা শ্রীমন্ত নিজে থেকে বিরিঞ্চিকে ধরিয়ে দেয়। বিরিঞ্চি সত্যি করে বিগড়ে যেতে শুরু করে তারপর। অবশ্য আমার উস্কানিও তার পেছনে কিছু ছিল। শ্রীমন্ত গোড়া থেকেই আমায় একটু সন্দেহ করত। বিরিঞ্চির সঙ্গে গোপনে আমায় আলাপ করতে দেখে তার সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। বিরিঞ্চিকে শেষ করে দেবার মতলব তখনই তার মাথায় আসে। বিরিঞ্চিকে সে বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। সে সময়ে টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে রাত্রে একবার এ—বাড়িতে হানা দিতে আসতে রাজি করাতে পারবে বুঝেই শ্রীমন্ত সোমকে তার সঙ্গে পাহারায় থাকবার জন্যে অনুরোধ করে। সোমের কাছে ব্যাপারটা শুনে আমি অবশ্য তখনই ওদের সাবধান করে দিই। সোম ও জয়ন্ত ঠিক সময়ে একটু বাধা দেবার ব্যবস্থা না করলে শ্রীমন্তর লক্ষ্য সেদিন ব্যর্থ হত না। লোকটা সে রাত্রে সত্যিই মারা পড়ত।’
মামাবাবু এবার বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—’জয়ন্ত তাহলে আপনার পরিচয় তখনই জানত।’
‘হ্যাঁ’, মিঃ রুদ্র জয়ন্তর দিকে চেয়ে হাসলেন। ‘এ ব্যাপারের কিছু আগেই ওকে সব জানিয়েছিলাম। ওকে দলে না নিলে আমাদের আসল কাজই তো উদ্ধার হত না।’
একবার জয়ন্ত আর একবার মিঃ রুদ্র—র দিকে অবাক হয়ে চেয়ে ললিতা এবার বলে উঠল—’তাহলে সেদিনকার সেই—’
কথাটা তাকে শেষ করতে হল না। মিঃ রুদ্র হেসে বললেন—’হ্যাঁ, গ্রেপ্তারের ব্যাপারটা একেবারে ফাঁকি। ইঁদারার ধারে শ্রীমন্তকে বেঁধে রাখা থেকে তার বাড়িতে গিয়ে জয়ন্তকে ধরা পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটা শুধু সাজানো নাটক। যে পিস্তলের গুলি শুনে ললিতা শ্রীমন্তকে উদ্ধার করতে যায় সেটা আসলে সোমকে ডাকবার একটা সংকেত। জয়ন্তর ওপর যে কোনো ছুতোয় পিস্তলটা ছুড়ে জানিয়ে দেওয়ার এই নির্দেশ ছিল।
‘কিন্তু জয়ন্তকে এভাবে গ্রেপ্তার করবার উদ্দেশ্য?’—মামাবাবু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘উদ্দেশ্য, জয়ন্ত গ্রেপ্তার হলে নিজেকে নিশ্চিন্ত নিষ্কণ্টক মনে করে শ্রীমন্ত যাতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’
‘আপনি কিন্তু একলা ওই গুপ্ত ভাঁড়ারে গিয়ে বড় বেশি বিপদ ঘাড়ে নিয়েছিলেন স্যার!’—সশ্রদ্ধভাবে বললেও সোমের গলার স্বরে একটু বিক্ষোভই প্রকাশ পেল।
‘তা নিয়েছিলাম বটে।’ মিঃ রুদ্র সোমের কথাটা মেনে নিয়ে বললেন—’কিন্তু সে শুধু শ্রীমন্ত যাতে নিজের আসল রূপ প্রকাশ করে ফেলে ধরা দেয় সেই জন্যে। ললিতা দেবী আচমকা ওখানে উদয় হয়ে আমাদের মতলব একটু ভেস্তে দেবার যোগাড় করেছিলেন বটে, কিন্তু আমরা তখন সব কিছুর জন্যেই প্রস্তুত ছিলাম।’
একটু থেমে তিনি এবার হেসে জয়ন্ত ও সোমকে বললেন—’তা ছাড়া তোমাদের তৈরি রেখেছিলাম কি অমনি! যে ভাবে পাথর চাপা দিয়ে আমায় বন্ধ করে গেছল তোমরা এসে তখুনি না উদ্ধার করলে তো দম বন্ধ হয়ে মারা যেতাম। শ্রীমন্তকে সন্দিগ্ধ করে ভয় পাইয়ে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করবার ব্যবস্থাটা ঠিকই ছকে রেখেছিলাম শুধু সমাপ্তিটা এমন হবে আগে ভাবিনি। যাক যা হয়েছে ভালোই বলতে হবে।’
‘আমি তাহলে ঠিক ধরেছিলাম।’—নমিতা এবার উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল—’কেমন দিদি, আমি বলেছিলাম কী না যে, ডিটেকটিভ গল্পের সব বদমায়েশদের দাড়ি থাকে! আমার কথা ঠিক হল কী না!’
ললিতা হাসি চেপে মিঃ রুদ্র—র দিকে দেখিয়ে বললে—’দাড়ি কিন্তু ওঁরও ছিল।’
‘ওঁর তো নকল দাড়ি!’—নমিতা হার মানতে প্রস্তুত নয়।
‘তা বটে!’—মিঃ রুদ্র হেসে উঠলেন। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর হবার ভান করে বললেন—’কিন্তু দাড়ির মতো আমার সবটাই নকল নয়!’
সেই ভিখিরি সাহেবের ভঙ্গিতে হঠাৎ নমিতার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তিনি বললেন— ‘Remember, I can foretell the future! দাঁড়াও! What do I see!’
একবার ললিতা ও একবার জয়ন্তর দিকে চেয়ে তিনি বললেন—‘I see–—a marriage ceremony–এ মোকানমে জরুর একঠো সাদি হোগা—জলদি হোগা!’
ললিতা ও জয়ন্ত সলজ্জভাবে মাথা নীচু করল।
‘আচ্ছা চলি, Good luck to you all.’ বলে, মিঃ রুদ্র হাসিমুখে নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
—