হাদীস সংরক্ষণ

হাদীস সংরক্ষণ

ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য এক চিরন্তন জীবন- ব্যবস্থা। এইজন্য উহার প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ কুরআন মজীদের হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার সংরক্ষণকারী।

[সূরা আল-হিজর, আয়াত- ৯।]

বস্তুত আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদ নাযিল করার সঙ্গে সঙ্গে উহার পূর্ণ সংরক্ষণের সার্বিক ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করিয়াছেন। জিবরাঈলের মারফতে রাসূলে করীমের নিকট কুরআন নাযিল হইয়াছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইয়াছেন। অতঃপর ইহাকে চিরতরে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে দুইটি উপায় অবলম্বিত হইয়াছে। একদিকে সাহাবায়ে কিরাম কুরআন শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন। স্মরণ শক্তির মণিকোঠায় ইহার প্রতিটি শব্দ ও অক্ষর চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া লইয়াছেন।

[সূরা আল-আনকাবূত, ৪৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় শাহ আবদুল কাদির লিখিত আলোচনা, **************** পৃষ্ঠা ১২৪।]

ফলে উহার একটি বিন্দুও বিলুপ্ত বা বিকৃত হইতে পারে নাই। এই উপায়ে সংরক্ষণে লাভের দিক দিয়াও কুরআন মজীদ আসামানী গ্রন্হাবলীর ইতিহাসে অতুলনীয় জিনিস, দুনিয়ার অপর কোন গ্রন্হই মুখস্থ করিয়া রাখাকে এক বিরাট সওয়াবের কাজ বলিয়া বিশ্বাস করেন। এই কারণে কুরআন মজীদ মুখস্থ করার রীতি আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে। এমন কি, গ্রন্হাকারে লিপিবদ্ধ কুরআন যদি আজ বিলুপ্তও হইয়া যায়, তবুও হাফেজদের স্মৃতিপটে রক্ষিত কুরআন মজীদ তাহার স্থান দখল করিতে পারিবে। পুনরায় কুরআনকে লিখিতরূপ দান করা কিছুমাত্র অসুবিধার ব্যাপার হইবে না। ইহা যে কুরআন মজীদের এক মু’জিযা তাহাতে সন্দেহ নাই।

অপরদিকে কুরআন নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (ﷺ) সর্বক্ষণ নিযুক্ত ওহী-লেখকদের দ্বারা তাহা লিখাইয়া লইয়াছেন। হযরত বরা ইবনে আজিব (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি ইহার জ্বলন্ত প্রমাণঃ

******************************************************

নিষ্ক্রিয় মু’মিন লোক ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী লোক কখনো সমান হইতে পার না- এই আয়াত যখন নাযিল হইল, তখন নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ যায়দকে ডাকিয়া দাও এবং তাহাকে দোয়াত, তখতি ইত্যাদি লইয়া আসিতে বলিও। তিনি (যায়দ) যখন আসিলেন, তখন নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ এই আয়াতটি লিখ……………।

[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৪৬।]

এইভাবে সমস্ত কুরআন মজীদ নবী করীম (ﷺ) এর জীবদ্দশায়ই নির্দিষ্ট লেখকের দ্বারা লিখিত হয়। প্রায় চল্লিশ জন সাহাবী কুরআন মজীদ লিখিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন।

[***********] প্রায় ছাব্বিশ জন সাহাবী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে প্রখ্যাত। হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত, হযরত আবদুল্লাহ ইবন সায়াদ, হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম, হযরত খালিদ ইবন সায়ীদ, হযরত আমর ইবনুল আ’স, হযরত মুয়াবিয়া ইবন আবূ সুফিয়ান, হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) প্রমুখ তাহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

[তাবাকাতে ইবন সায়াদ, তারীখ-ই তাবারী, ***************************************]

এই উভয়বিধ উপায় অবলম্বিত হওয়ার ফলে কুরআন মজীদ সর্বপ্রকার বিকৃতিও বিলুপ্তির হাত হইতে চিরকালের তরে রক্ষা পাইয়াছে।

কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবল কুরআন মজীদকে রক্ষা করাই দ্বীন ইসলাম রক্ষা ও স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই কারণে আমরা দেখিতেছি, কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা হাদীস সংরক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসে আমাদের সামনে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, কুরআন সংরক্ষণের জন্য প্রধানত দুইটি বাহ্যিক উপায় অবলম্বিত হইয়াছে, রাসূলের সুন্নাত তথা হাদীসও প্রধানত ঠিক সেই দুইটি উপায়ের সাহায্যেই সুরক্ষিত হইয়াছে। আর তাহা হইতেছে আল্লাহ তা’আলার কায়েম করা স্বাভাবিক ব্যবস্থা এবং মানুষের মানবিক প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনা। এই পর্যায়ে বিস্তারিত ও ঐতিহাসিক তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক আলোচনা পেশ করার জন্য আমরা এখানে চেষ্টা করিব।

স্বাভাবিক ব্যবস্থা

হাদীস সংরক্ষণের স্বাভাবিক ব্যবস্থা যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করিয়াছে বলিয়া মনে হয়। প্রথম, তদানিীন্তন আরবদের স্বাভাবিক স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতা ও প্রাখর্য। দ্বিতীয়, সাহাবায়ে কিরামের জ্ঞান-পিপাসা, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানানুশীলনের অপূর্ব তিতিক্ষা এবং তৃতীয়, ইসলামী আদর্শ ও জ্ঞান বিস্তারের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ। এই তিনটি বিষয়েরই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

আরব জাতির স্মরণশক্তি

তদানীন্তন আরব জাতির স্মরণশক্তি বস্তুতই এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। কুরআন এবং হাদীসের সংরক্ষণে ইহার যথেষ্ট অবদান রহিয়াছে। কুরআন মজীদ ইহাকে একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বরং এই কুরআন সুস্পষ্ট আয়াত সমষ্টি, ইহা জ্ঞানপ্রাপ্ত লোকদের মানসপটে সুরক্ষিত।

[সূরা আল-আনকাবুত, ৪৯ আয়াত।]

এই আয়াতে সেকালের মুসলিম জ্ঞানী লোকদের স্মরণশক্তির দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত রহিয়াছে এবং কুরআন মজিদ যে তাহাদের মানসপটে স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল, তাহাও ব্যক্ত করা হইয়াছে। আল্লামা বায়াযাবী এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অর্থাৎ তারা কুরআনক এমনভাবে হিফয করিয়া রাখিতেন ও উহার সংরক্ষণ করিতেন যে, কেহই উহাকে বিকৃত বা রদবদল করিতে পারিত না।

[তাফসীরে বায়যাবী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯।]

ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, তদানীন্তন আরব সমাজের লোকদের স্মরণশক্তি অসাধারণরূপে প্রখর ছিল, কোন কিছু স্মরণ করিয়া রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাহাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কে ইবন আবদুল বির লিখিত এই ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

আরব জাতি স্বভাবতই স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল এবং উহা ছিল তাহাদের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য।

******************************************************

তাহারা স্বাভাবিকভাবেই স্মরণশক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিত।

[****************]

******************************************************

এই কথা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত যে, আরব জাতি মুখস্থ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি ও প্রতিভার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। তাহাদের এক একজন লোক যে কাহারো দীর্ঘ কবিতা একবার শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া ফেলিতে ও স্মরণ রাখিতে সক্ষম হইত।

[***************]

হযরত ইবন আব্বাস (রা) উমর ইবন আবূ রাবিয়ানামক প্রসিদ্ধ আরব কবির এক দীর্ঘ কবিতা একবার মাত্র শ্রসণ করিয়া সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন।

[***************] রাসূলের সাহাবিগণও খালেস আরব জাতির লোক ছিলেন। তারা প্রথমে না কিছু লিখিতে পারিতেন, না পারিতেন কোন লিখিত জিনিস পাছ করিতে। ফলে তাঁহাদের সকলকেই কেবল স্মরণশক্তির উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকিতে হইত। জাহিলিয়াতের যুগে তারা তাঁহাদের দীর্ঘ বংশতালিকা, পূর্বপুরুষদের অপূর্ব প্রশংসা ও গুণ-গরিমার কথা সবিস্তারে মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে যখন বংশ-গৌরবের প্রতিযোগিতা হইত, তখন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অতীত বংশ গৌরব ও স্তুতি গাঁথা একটানা মুখস্থ বলিয়া যাইতেন। তাঁহাদের প্রায় প্রত্যেকেই স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতার কারণে নিজ নিজ বংশের ভাষ্যকার বা মুখপাত্র ছিলেন।

আল্লাহ তা’আলা স্বাভাবিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন এই আরব জাতিকেই হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নবুয়্যাত ও প্রচরিত বাণীর সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। প্রখর স্মরণশক্তিসম্পন্ন এইসব হৃদয়কে কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস মুখস্থ রাখার জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত করিয়াছিলেন।

[***************************]

ঠিক এই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিগণ নবী করীম (ﷺ)- এর মুখে তাহা শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া লইতে পারিতেন। এইভাবে পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করিয়ালওয়া এবং রাখা তাহাদের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ব্যাপার ছিল না।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদাহ ইবন দায়ামহ দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ এই জাতিকে স্মরণশক্তির এমন প্রতভা দান করিয়াছেন, যাহা কোন জাতিকেই দান করা হয় নাই। ইহা এক বিশেষত্ব, যাহা কেবল তাহাদিগকেই দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা এমন এক সম্মান ও মর্যাদা যাহা দ্বারা শুধু তাহাদিগকেই সম্মানিত করিয়াছেন।

[যুরকানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৫।]ৱ

হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিপুল সংখ্যাক হাদীসের হাফেজ ছিলেন। কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলীফা মারওয়ান ইবন হিকামের মনে এই সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবূ হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন হযরত আবূ হুরায়রাকে কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আবূ হুরায়রা (রা) তখন কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইয়া দেন। মারওয়ানের নির্দেশ মুতাবিক পর্দার অন্তরালে বসিয়া হাদীসসমূহ লিখিয়া লওয়া হয়। বৎসরাধিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহই শোনাইবার জন্য হযরত আবূ হুরায়রাকে অনুরোধ করা হইলে তিনি সেই হাদীসসূহই এমনভাবে মুখস্থ শোনাইয়াদেন যে, পূর্বের শোনানো হাদীসের সহিত ইহার কোনই পার্থক্য হয় না। ইহা হইতে হযরত আবূ হুরায়রার স্মরণশক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হয়।

[কিতাবুল কুনী, ইমাম বুখারীকৃত, পৃষ্ঠা ৩৩।]

প্রসিদ্ধ হাদীস-সংকলক ইমাম ইবন শিহাব জুহরীও ছিলেন অসাধারণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিও একবার এক পরীক্ষার সম্মখীন হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তদানীন্তন বাদশাহ হিশাম তাঁহার পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক হাদীস লিখিয়া দিতে তাঁহাকে অনুরোধ করেন। জুহরী তখনি চারশত হাদীস লিখাইয়া দেন। দীর্ঘদিন পর সেই হাদীসসমূহ পুনরায় লিখাইয়া দেওয়ার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়া তিনি আবার তাহা লিখিইয়া দেন। বাদশাহ এই উভয়বারে লিখিত হাদীসসমূহের তুলনামূলক পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পান যেঃ

******************************************************

এই দ্বিতীয়বারে সেই হাদীসসমূহের একটি অক্ষরও বাদ পড়িয়া যায় নাই।

[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০১।]

ইহা যেম ইমাম জুহরীর অপরিসীম স্মৃতিশক্তির বাস্তব প্রমাণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ইবনে শিহাব জুহরী বলিতেনঃ

******************************************************

আমি যখনি ‘বকী’ বাজারের নিকট যাতায়াত করিতাম, তখন আমার কর্ণদ্বয় এই ভয়ে বন্ধ করিয়া লইতাম যে, উহাতে কোন প্রকার অশ্লীল কথা যেন প্রবেশ করিতে না পারে। কেননা, আল্লাহর শপথ, আমার কর্ণে কোন কথা প্রবেশ করিলে আমি তাহা কখনো ভুলিয়া যাই না।

[******************]

তিনি আরো বলেনঃ

******************************************************

আমি আমার খাতা বইতে হাদীস বা অন্য যাহা কিছু লিখিয়াছি, তাহই মুখস্থ করিয়াছি।

[**************]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ইমাম শা’বী স্বীয় স্মরণশক্তি প্রখরতার পরিচয় ও বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি কখনো কোন খাতা হইতে কোন হাদীস লিখি নাই এবং কখনো কাহারো নিকট হইতে কোন হাদীস একাধিকবার শ্রবণ করার প্রয়োজন বোধ করি নাই।

[***************]

ইমাম অকী’ও অনুরূপ একজন আসামন্য স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

তাঁহার মত হাদীস হিফযকারী লোক আমি আর দেখি নাই।

[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

অপর এক মুহাদ্দিস তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

‘অকী’র স্মরণশক্তি ছিল প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য।

[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস কাতাদাহর স্মরণশক্তিও ছিল অতুলনীয়। তাঁহার এই ঐতিহাসিক স্মরণ শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসকার হাফিজ যাহবীর নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে। তিনি বলেনঃ

******************************************************

কাতাদাহ ছিলেন বসরাবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যে কথাই শুনিতেন, তাহাই স্রমণ করিয়ালইতেন। হযরত জাবিরের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ তাঁহার সম্মুখে একবার পাঠ করা হইলে তিনি তাহা মুখস্থ করিয়া ফেলেন।

[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬।]

ইয়াহইয়া ইবনে কাতান বলেনঃ আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসন্পন্ন লোক দেখি নাই। তাঁহার ত্রিশ হাজার হাদীস মুখস্থ ছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

‘আমি যাহা কিছু একবার মুখস্থ করিয়াছে তাহা কখনই ভুলিয়া যাই নাই’।

[তাযকিয়াতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা।]

সুফিয়ান ইবন উয়াইনার সাত সহস্র হাদীস কন্ঠস্থ ছিল এবং এজন্য তিনি কোন কিতাব রাখিতেন না।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বলেনঃ রাজধানী বাগদাদে মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র কুরআন সম্পর্কেই দশ হাজার হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। বস্তুত স্মরণশক্তির দিক দিয়া তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

কাযী আবূ বকর ইসফাহানী মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন।

ইমাম বুখারীর উস্তাদ মুহাদ্দিস ইসহাক ইবন রাহওয়া-এর স্মরণশক্তি অতিশয় তীক্ষ্ণ ছিল। অসংখ্য হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার শিক্ষার্থীদিগকে তিনি মুখস্থ কয়েক সহস্র হাদীস লিখিয়াই দিয়াছিলেন, ইহাতে তিনি একবারও কিতাব দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। তিনি নিজেই বলিতেনঃ ‘সত্তর সহস্র হাদীস আমার চোখের সম্মুখে সব সময় ভাসমান থাকে’।

মুহাদ্দিস আবু জুরয়া তাঁহার সম্পকের্ক বলিতেনঃ

তাঁহার (ইবন রাহওয়ার) মত স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক একজন দেখি নাই।

[****************]

তদানীন্তন শাসনকর্তা আমীর আবদুল্লাহ তাঁহার স্মরণশক্তির বিস্ময়কর পরিচয় পাইয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি অনেক বিষয় মুখস্থ করিয়া রাখিতে পারেন তাহা জানি, কিন্তু আপনার এই স্মরণশক্তির পরিচয় পাইয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইতেছি।

[কিতাবুল-কুনী, ইমাম বুখারী কৃত, পৃষ্ঠা ৩৩]

পরবর্তী যুগের হাদীসবিদ ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তিও কোন অংশে কম উল্লেখযোগ্য নয়। নওয়াব সিদ্দীক হাসান আবূ বকর ইবন আবূ ইতাব হইতে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম বুখারী বাল্যাবস্থায়ই সত্তর হাজার হাদীস সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন।

[************]

তাঁহার সম্পর্কে আরো উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বর্ণিত আছে, তিনি একবার মাত্র কিতাব দেখিয়া তাহা সবই মুখস্থ করিয়া লইতেন।

[*************]

মুহাম্মদ ইবন আবূ হাতেম বলিয়াছেনঃ দুইজন লোক আমার নিকট বলিয়াছেন যে, আমরা একত্রে হাদীস শ্রবণ করিতাম, ইমাম বুখারী তখন আমাদের মধ্যে বালক বয়সের ছিলেন। আমরা যাহা শুনিতাম তাহা সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইতাম; কিন্তু ইমাম বুখারী কিছুই লিখিতেন না। একদিন তাঁহাকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ তোমরা আমার প্রতি বড় অবিচার করিলে। আচ্ছা, তোমরা কি লিখিয়াছ তাহাই আমাকে শোনাও। অতঃপর আমাদের লিখিত পনেরো হাজারেরও অধিক হাদীস তাঁহাকে দেখাইলাম।

******************************************************

অতপর তিনি তাঁহার স্মরণশক্তিতে রক্ষিত এই সব হাদীসই মুখস্থ পড়িয়া শোনাইলেন। এমনকি তাঁহার মুখস্থ পাঠ শুনিয়া আমাদের লিখিত কিতাবগুলিকে সংশোধন করিয়া লইলাম।

[*****************]

ইমাম বুখারী সম্পর্কে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বাগদাদ আগমন করিলে মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন ও আলাদা আলাদাভাবে মোট একশতটি হাদীস তাঁহার সম্মুখে এমনভাবে পেশ করিলেন যে, উহার প্রত্যেকটির সনদ উল্টাপাল্টা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটির সনদ অপরটির সহিত জুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারীর মতামত জানিতে চাহিলে তিনি এই হাদীসসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি হাদীসকে সঠিকভাবে উল্লেখ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তারা উহাকে যেভাবে উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই ভূল ছিল এবং কোন হাদীসের সনদ কোনটি-কোনটি নয়, তাহাও তিনি অকাট্যভাবে প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তি দর্শনে সকলেই গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেন।

******************************************************

তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তির কথা তারা স্বীকার করিলেন এবং এই ব্যাপারে তাঁহার বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সকলেই বিশ্বাস করিলেন।

[*************]

এই সব ঘটনা হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, এই যুগের মুসলিম মনীষীদের স্মরণশক্তি স্বাভাবত অত্যন্ত তীক্ষ্ন ও প্রখর ছিল। সাহাবাদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও মুহাদ্দিসীনের যুগ পর্যন্ত ইহার কোন ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। সেকালের আরবদের মধ্যেও যেমন এই বিস্ময়কর স্মরণশক্তি বর্তমান ছিল, অনারব মুসলিমদের মধ্যেও তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। বস্তুত মুসলিম উম্মতের প্রতি ইহা ছিল আল্লাত তা’আলার এক অপরিসীম ও মহামূল্য অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ ছিল বলিয়াই কুরআন এবং হাদীস ইসলামের এই ভিত্তিদ্বয় যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইতে ও সুরক্ষিত থাকিতে পারিয়াছে।

এই যুগের এই বৈশিষ্ট্যের একটি জীবতাত্ত্বিক তাৎপর্যও রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা মানবদেহে যতগুলি শক্তি ও সামর্থ্য দান করিয়াছেন, তন্মধ্যে কোন একটির ব্যবহার না হইলে কিংবা কোন একটি অঙ্গ অকেজো হইয়া পড়িলে অপরচির শক্তি বৃদ্ধি পায়। যাহার একটিমাত্র হাত, তাহার সে হাতে দুই হাতের শক্তি সঞ্চিত হয়। অন্ধ ও দৃষ্টিহীন ব্যক্তির আন্দাজ অনুমান ও অনুভূতির শক্তি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলামানদের ব্যাপারে ইহার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। একালে সাধারণভাবে লেখাপড়ার বেশী প্রচলন ছিল না। মানুষ লেখনীশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশী করিত। ফলে এ্ই যুগে স্মরণশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশি করিত। ফলে এই যুগে স্মরণশক্তির বিস্ময়কর বিকাল পরিলক্ষিত হয়।কুরআন ও হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রাথমিক উপায় হিসাবে ইহা খুবই গুরত্বপূর্ণ স্থান দখল করিয়াছে।

হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য রাসূলের নির্দেশ

হযরত রাসূলে করীম (ﷺ)-এর জীবনব্যাপী কথা ও কাজের মাধ্যমেই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার রূপায়িত হইয়া উঠিয়াছে। এই কারণে তাঁহার যাবতীয় কথা ও কাজ মুসলিম সমাজের নিকট মহামূল্য সম্পদ। সাহাবায়ে কিরাম রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রত্যেকটি কথা মনোনিবেশ সহকারে শ্রবণ করিতেন এবং তাঁহার প্রত্যেকটি কাজ ও গতিবিধি সূক্ষ্ণ ও সন্ধানী দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিতেন। ফলে রাসূলে করীমের কথা ও কাজ সাহাবাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সঞ্চিত ও সঞ্জীবিত হয়।

কিন্তু এই ব্যাপারে কেবল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক সংরক্ষণের উপরই সম্পূণূ নির্ভর করা হয় নাই। নবী করীম (ﷺ) নিজেও এই জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন।

নবী করীম (ﷺ) সাহাবায়ে কিরামকে ইসলাম সম্পর্কিত যাবতীয় কথা, আদেশ-নিষেধ ও উপদেশাবলী মনোনিবেশ সহকারে শ্রবণ করিতে যেমন বলিয়াছেন, উহাকে স্মরণ রাখিতে ও অন্য লোকদের পর্যন্ত উহাকে যথাযথভাবে পৌঁছাইয়া দিতেও তেমনি আদেশ করিয়াছেন। তিনি সাহাবাদের সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেনঃ
 

******************************************************

আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে চিরসবুজ চিরতাজা করিয়া রাখিবেন, যে আমার নিকট হইতে কোন কিছু শুনিতে পাইল ও তাহা অন্য লোকের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছাইয়া দিল। কেননা পরে যাহার নিকট উহা পৌঁছিয়াছে সে প্রয়াশই প্রথম শ্রোতার তুলনায় উহাকে অধিক হিফাযত করিয়া রাখিতে সক্ষম হইয়াছে।

[তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯০ (১৯৪০ সনের দিল্লী সংস্করণ) ইবন মাজা, ***************** দারেমী, আবুদ্দারদা হইতে বর্ণিত মুস্তাদরাক, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৭।]

হযরত আবুদল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এ হাদীসটি অন্যভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসটির ভাষা এইরূপঃ

******************************************************

আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে আলোকোদ্ভাসিত করিয়া দিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া তাহা স্মরণ করিয়া লইল, উহাকে পূর্ণ হিফাযত করিল এবং অপরের নিকট উহা পৌঁছাইয়া দিল। অনেক জ্ঞান বহনকারী লোকই এমন ব্যক্তির নিকট উহা পৌঁছাইয়া দেয়, যে তাহার অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ও বিজ্ঞ।

[শাফেয়ী ও বায়হাকী।]

এই সঙ্গে হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটির ভাষাও লক্ষণীয়। তিনি বলেনঃ নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ তাহার জীবন উজ্জ্বল করিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া উহাকে মুখস্থ করিল ও উহাকে সঠিকরূপে স্মরণ রাখিল এবং উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছাইল যে তাহা শুনিতে পায় নাই।……………।

[******************* তিরমিযী।]

আবদুল কায়স গোত্রের এক প্রতিনিধি দল রাসূল করীম (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাহাদিগকে ইসলামের মূল বিষয়াদি সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষাদান করেন এবং তাহাদিগকে বলেনঃ

******************************************************

এই কথাগুলি তোমরা পুরাপুরি স্মরণ করিয়া রাখ, উহাকে পূর্ণরূপে সংরক্ষণ কর এবং তোমাদের পশ্চাতে যাহারা রহিয়াছে তাহাদিগকে এই বিষয়ে অবহিত কর।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, ১৯ পৃষ্ঠা।]

সাহাবায়ে কিরামের ভবিষ্যতের দায়িত্ব ও সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলে করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আজ তোমরা (আমার নিকট দ্বীনের কথা) শুনিতেছ, তোমাদের নিকট হইতেও তাহা শোনা হইবে (অন্য লোকেরা শুনিবে), আর তোমাদের নিকট হইতে যাহারা শুনিবে তাহাদের নিকট হইতেও (এই কথা) শোনা হইবে।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৫, হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত।]

অপর একটি হাদীসে নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসলিম উম্মতের দ্বীন’ সম্পর্কে চল্লিশটি হাদীস যে ব্যক্তি মুখস্থ করিবে, সংরক্ষণ করিবে, আল্লাহ তা’আলা তাহাকে একজন ফিকাহবিদ বানাইয়া দিবেন এবং আমি কিয়ামতেন দিন তাহার জন্য শাফাআতাকরী ও সাক্ষী হইব।

[মিশকাতুল মাসাবীহ, পৃষ্ঠা ৩৬, হযরত আবুদ্দারদা বর্ণিত।]

নবী করীম (ﷺ)-এর হাদীস সংরক্ষণ সম্পর্কিত এই নির্দেশাবলী ও উপদেশ বাণীর ফলে তদানীন্তন মুসলিম সমাজের প্রায় এক লক্ষ ব্যক্তিই রাসূলের মুখের বাণী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করিয়াছেন, মুখস্থ রাখিয়াছেন ও স্মৃতিপটে এমনভাবে জাগরূপ করিয়া রাখিয়াছেন যে, সাধারণত তারা কখন তাহা ভুলিয়া যান নাই। এই ব্যাপারে তাঁহাদের স্বভাবজাত স্মরণশক্তি তাঁহাদের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছেন। তদুপরি রাসূলের এই আদেশাবলী উহাকে অধিকতর জোরদার করিয়া তুলিয়াছে। রাসূল (ﷺ) যখনই একটি কথা বলিতেন, উপস্থিত সাহাবিগণ তাহা কণ্ঠস্থ করিতে শুরু করিতেন, যেন ভুলিয়া না যান। হযরত সামুরা ইবেন জুবদুব (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের যামানায় আমি বালক ছিলাম এবং তখনই আমি রাসূলের কথা মুখস্থ করিতাম।

[মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠা ১০ নববীসহ।]

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমরা রাসূলের হাদীস মুখস্থ করিতাম, রাসূলের নিকট হইতে এইভাবে হাদীস মুখস্থ করা হইত।

[মুসলিম শরীফ, প্রথম খণ্ড, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠা ১০ নববীসহ।]

মক্কা বিজয়ের পরের দিন নবী করীম (ﷺ) মুজাহিদীনের সামনে যে ভাষণ প্রদান করেন, তাহার শেষভাগে তিনি বলেনঃ

******************************************************

উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের নিকট এই কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। বিদায় হজ্জ্বের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষভাগে রাসূলে করীম (ﷺ) উদাত্ত কণ্ঠে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের পর্যন্ত আমার এই কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। কেননা যাহাদের নিকট ইহা পৌঁছানো হইবে, তাহাদের অনেকেই আজিকার শ্রোতাদের অপেক্ষা অধিক হাদীস হিফাযতকারী হইতে পার।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

বুখারী শরীফে কথাটি এই ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

উপস্থিত লোকেরা অনুপস্থিত লোকদের পর্যন্ত এ কথাগুলি পৌঁছাইয়া দেয়। কেননা উপস্থিত লোক হয়ত ইহা এমন এক ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবে, যে উহা তাহার অপেক্ষা বেশী হিফাজাত করিয়া রাখিতে সক্ষম হইবে।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬।]

ইবন আউনের সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির শেষাংশ নিম্নরূপঃ

******************************************************

এমন হইতে পারে যে,আমার কথা স্মরণ করিয়া রাখার ব্যাপারে অনুপস্থিত ব্যক্তি উপস্থিত ব্যক্তি উপস্থিত ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক সক্ষম হইবে।

[**************]

নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট হইতে একটি আয়াত হইলেও তাহা অবশ্য বর্ণনা কর।

[বুখারী শরীফ, মিশকাত, কিতাবুল ইলম……।]

মাযহারী ও মুল্লা আলী আল-কারী ইহার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার হাদীসসমূহ খুব অল্প পরিমাণ হইলেও প্রচার কর।

[***********************]

নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনিতে চাহিবে। যখন তাহারা তোমাদের নিকট এই উদ্দেশ্যে আসিবে, তখন তোমরা যেন তাহাদের প্রতি অনুগ্রহশীল হও এবং তাহাদের নিকট আমার হাদীস বর্ণনা কর।

[মুসনাদে আহমাদ, মালিক ইবনে আনাস বর্ণিত। *****************]

তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা ইলম শিক্ষা কর ও উহা লোকদিগকে শিক্ষা দাও। তোমরা ফারায়েয বা মিরাসী আইন শিক্ষা কর ও অন্যান্য লোকদিগকেও তাহা শিক্ষা দাও। তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং উহা লোকদিগকে শিক্ষা দাও। কেননা আমাকে একদিন চলিয়া যাইতে হইবে।

[দারেমী শরীফ, পৃষ্ঠা ৪০]

একবার নবী করীম (ﷺ) দোয়া করিয়া বলিতেছিলেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ আমার খলীফাগণকে রহমত কর।

সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করিলেন।

******************************************************

হে রাসূল, আপনার খলীফা কাহারা?

উত্তরে নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ

******************************************************

যাহারা আমার হাদীসসমূহ বর্ণনা করে ও তাহা লোকদিগকে শিক্ষা দেয় )তাহারাই আমার খলীফা)।

[মুকাদ্দামায়ে দারেমী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫।]

নবী করীম (ﷺ) আরে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

দ্বীন সম্পর্কিত কোন বিষয়ে কাহাকেও যদি কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় এবং সে তাহা গোপন রাখে-প্রকাশ না করে, তবে কিয়ামতের দিন তাহাকে জাহান্নমের আগুনের লাগাম পরাইয়া দেওয়া হইবে।

[মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজা-************]

এইসব নীতিগত কথা ছাড়াও নবী করীম (ﷺ) তাঁহার বিশেষ বিশেষ কাজ সম্পর্কে অপরাপর লোকগিদকে ওয়াকিফহাল করিবার জন্য উপস্থিত সাহাবিগণকে জোরালোভাবে তাগিদ করিতেন।

নিম্নোক্ত হাদীস হইতে এই কথার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ইয়াসার বলেনঃ একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) আমাকে ফজর ‘উদয়’ হইয়া যাওয়ার পর নামায পড়িতে দেখিতে পান। তখন ইবনে উমর আমাকে বলিলেনঃ

******************************************************

আমরা এইভাবে একদিন নামায পড়িতেছিলাম। এমন সময় নবী করীম (ﷺ) আমাদের নিকট আসিলেন। তখন বলিলেনঃ তোমাদের যাহারা এইখানে উপস্থিত আছ তাহারা যেন অনুপস্থিত লোকদের নিকট আমার এই কথা পৌঁছাইয়া দেয় যে, ফজর হওয়ার পর দুই সিজদা ব্যতীত অন্য কোন নামায পড়া জায়েয নয়।

[মুসনাদে আহমদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪।]

মালিক ইবনুল হুয়ায়রিস (রা) বলেনঃ আমরা কিছু সংখ্যক যুবক ও সমবয়স্ক লোক রাসূলে করীম (ﷺ)-এর দরবারে বিশ দিন ও রাত্র অবস্থান করার পর বাড়ি প্রত্যাবর্তন করার ইচ্ছা প্রকাল করিলাম। তখন তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা তোমদের ঘরের লোকদের নিকট ফিরিয়া যাও, তাহাদের সহিতই বসবাস করিত থাক, তাহাদিগকে (দ্বীন ইসলাম) শিক্ষা দাও এবং তাহা যথাযথ পালন করার জন্য আদেশ কর।

[এই সময় রাসূল (ﷺ) কতকগুলি কাজের উল্লেখ করেন, যাহা আমি স্মরণ করিয়া লইলাম] এবংআমাকে তোমরা যেইভবে নামায পড়িতে দেখিয়াছ, ঠিক সেইভাবেই নামায পড়িও।

[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৭৬]

এই হাদীস হইতে জানা যায় যে, দূর-দূরান্তর হইতে নও-মুসলিমগণ রাসূল (ﷺ)- এর দরবারে ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে আগমন করিতেন। রাসূল (ﷺ) তাঁহাদিগকে ইসলামী আদর্শ ও শরীয়াত শিক্ষা দিতেন। তাহারা যাহা কিছু শুনিতে ও জানিতে পাইত তাহা স্মরণ রাখার জন্য এবং ফিরিয়া গিয়া নিজ নিজ এলাকার লোকদিগকে তাহা শিক্ষাদান ও প্রচার করার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ করিতেন।

এভাবে রাসূল (ﷺ)- এর স্পষ্ট ও নীতিগত আদেশ-নির্দেশের ফলে দূর দূর অঞ্চলে অবস্থিত মুসলিমদের নিকট রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস তীব্র গতিতে পৌঁছিয়া যায় এবং তৎকালীন প্রায় সকল মুসলমানই নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস জানিতে পারে। হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচার লাভের ইহাই ছিল প্রাথমিক ও স্বাভাবিক পন্হা।

পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও শিক্ষাদান

সাহাবায়ে কিরাম নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়া অবসর সময় সুযোগ ও প্রয়োজনমত একত্র হইয়া বসিতেন এবং পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনায় লিপ্ত হইতেন। কোন কোন সময় হাদীস আলোচনার জন্য সাহাবাগণ নিজেদের মধ্যে বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করিতেন। এই ধরনের বৈঠক সাধারণত মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হইলেও কখনো কখনো সাহাবীদের বাড়িতেও অনুরূপ বৈঠক বসিত। এই বৈঠকসমূহে রাসূলে করীমের কথা, কাজ ও উপদেশাবলী সম্পর্কে প্রকাশ্য আলোচনা হইত। প্রধান প্রধান সাহাবিগণই এইসব বৈঠকে যোগদান করিতেন। পূর্বৈ কাহারো কোন বিষয়ে অজ্ঞতা থাকিলে এইসব বৈঠকের আলোচনা হইতে নির্ভরযোগ্যভাবে ও বিশ্বস্তসূত্রে তারা সেই বিষয়ে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হইতে পারিতেন। কাহারো কোন বিষয়ে সন্দেহ থাকিলে তাহাও এই আলোচনার ফলে তিরোহিত হইয়া যাইত। এই ধরণের আলোচনা সভা-অনুষ্ঠান সম্পর্কে এখানে আমারা কয়েকটি প্রামাণ্য বিবরণ পেশ করিতেছিঃ

১. হযরত আনাম (রা) বলেনঃ

আমরা রাসূল (ﷺ)- এর নিকট হাদীস শ্রবণ করিতাম. তিনি যখন মজলিস হইতে উঠিয়াচলিয়া যাইতেন, তখন আমরা বসিয়া শ্রুত হাদীসসমূহ পরস্পর পুনরাবৃত্তি করিতাম, চর্চা করিতাম, পর্যালোচনা করিতাম। আমাদের এক একজন করিয়াসবকয়টি হাদীস মুখস্থ শোনাইয়া দিত। এই ধরনের প্রায় বৈঠক হইতে আমরা যখন উঠিয়া যাইতাম, তখন আমাদের প্রত্যেকের সবকিছু মুখস্থ হইয়া যাইত।

[**********]

২. আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বলেনঃ

একদিন নবী করীম (ﷺ) তাঁহার কোন এক হুজরা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং মসজিদে দুইটি জনসমাবেশ দেখিতে পাইলেন। একটিতে সমবেত লোকেরা কুরআন পাঠ করিতেছিল ও আল্লাহর নিকট দোয়া প্রার্থনা করিতে মগ্ন ছিল। আর অপরটির লোকেরা (হাদীস) শিক্ষা করিতেছিল ও শিক্ষা দান করিতেছিল। নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ এই উভয় সমাবেশের লোকই কল্যাণের কাজ করিতেছে। ইহারা (একদল লোক) কুরআন পাঠ করিতেছে ও আল্লাহকে ডাকিতেছেঃ আল্লাহ চাহিলে তিনি তাহাদিগকে প্রার্থিত জিনিস দান করিবেন, আর না চাহিলে দিবেন না। আর অপর দলের লোক জ্ঞান ও হাদীস শিক্ষা করিতেছে ও শিক্ষা দিতেছে। ********************* এবং আমি শিক্ষক হিসাবেই প্রেরিত হইয়াছি। আবদুল্লাহ ইবন আমর বলেনঃ ‘অতঃপর তিনি তাহাদের সহিতই বসিয়া গেলেন।

[**********************]

ইলম চর্চায় নিযুক্ত লোকগণ যে রাসূলের হাদীস, কাজ-কর্ম ও উহার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করিতে ও উপস্থিত লোকদিগকে তাহা শিক্ষা দিতেছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। নবী করীম (ﷺ)-এর জীবদ্দশায়ই এই ধরনের বৈঠক বসিত ও রাসূল (ﷺ) নিজে তাহাতে যোগদান করিতেন, লোকদিগকে ইলম হাদীস শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ দান করিতেন, তাহা উপরিউক্ত দীর্ঘ বর্ণনা হইতে অকাট্যরূপে প্রমাণিত হইতেছে।

৩. হযরত মু’আবিয়া বর্ণিত নিম্নোক্ত ঘটনা হইতে উপরের কথার আরো প্রমাণ মেলে। তিনি বলিয়াছেন৬

******************************************************

আমি একদিন নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি মসজিদে প্রবেশ করিয়া একদল লোককে উপবিষ্ট দেখিতে পাইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তোমরা কিসের জন্য বসিয়া আছ? তাহারা বলিলঃ আমরা ফরয নামায পড়িয়াছি, তাহার পর বসিয়া আল্লাহর কিতাব ও তাঁহার নবীর সুন্নাত সম্পর্কে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করিতেছি।

[মুস্তাদরাক-হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৪।]

হাদীস মুখস্থ করার পর উহা যাহাতে ভুলিয়া না যান, সাহাবায়ে কিরাম সেইদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। এইজন্য অনেক সাহাবী নিজস্বভাবেই হাদীস চর্চা ও আবৃত্তি করিতে থাকিতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে তাহা প্রমাণিত হয়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাত্রক তিন ভাগে ভাগ করিয়া লই। এক ভাগ রাত্র আামি ঘুমাই, এক ভাগ ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করি, এক ভাগে আমি রাসূলের হাদীস স্মরণ ও মুখস্থ করিতে থাকি।

[মুসনাদে দারেমী, *****************]

এই প্রসঙ্গে ‘আসহাবে সুফফা’র কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। বিশেষত হাদীসের প্রথম উৎপত্তিক্ষেত ও ধারক হিসাবে হাদীসের ইতিহাসে আসহাবে সুফফার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

সাধারণভাবে সকল সাহাবীই রাসূলের সাহচর্যে অধিক সময় অতিবাহিত করিতে চেষ্টা করিতেন। কিন্তু ‘সুফফার অধিবাসিগণ দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই রাসূলের দরবারে পড়িয়া থাকিতেন। মসজিদে নববীর সম্মুখস্থ চত্তরই ছিল তাঁহাদের আবাসস্থল। ইহাদের কোন ঘর-সংসার ছিল না, আয়-উপার্জনের তেমন কোন প্রয়োজনও ছিল না। তাই অন্যান্য সাহাবাদের তুলনায় তারা যে রাসূলের সাহচর্যে সর্বাধিক সময় ব্যয় করিতে পারিতেন, তাহাতে সন্দেহ থাকিতে পারে না।

ফলে মসজিদে নববী কার্যত একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হইয়াছিল। স্বয়ং নবী করীম (ﷺ) ছিলেন ইহার প্রধান অধ্যক্ষ আর প্রায় সকল সাহাবীই ছিলেন এখানকার শিক্ষার্থী। রাসূলের নির্দেশক্রমে বড় বড় সাহাবিগণ বিশেষ বিশেষ বিষয়ে শিক্ষাদানের কাজও করিতেন।

সুফফার বসবাসকারী সাহাবীদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে সে সংখ্যা যে কিছুমাত্র নগণ্য ছিল না, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইবন আবদুল বার কর্তৃক এক কবীলা সম্পর্কে প্রদত্ত বর্ণনা হইতে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপকতা সমন্ধে ধারণা করা যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তামীম প্রতিনিধি দলে সত্তর কি আশি জন লোক ছিল। তাহারা ইসলাম কবুল করিয়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। এই সময়ে তাহারা কুরআন ও দ্বীন-ইসলাম শিক্ষা করিতেছিল।

[**************]

মোটকথা আসহাবে সুফফার সাহাবিগণ দিন ও রাত্র রাসূলের সন্নিকটে থাকিয়াতাঁহার মুখ-নিঃসৃত বাণীসমূহ, তাঁহার কার্যাবলী, কর্মতৎপরতা, গতিবিধি ও চিন্তা-প্রবণতা এবং তাঁহার নিকট অনুমোদনপ্রাপ্ত কথা ও কাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ও বিশেষ সতর্কতা সহকারে শ্রবণ, পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবণ করিতেন। কোন একটি কথা- একটি সামান্য বিষয়ও – যাহাতে তাঁহাদের অজ্ঞতা থাকিয়া না যায়, সেজন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করিতেন।

[****************]

বস্তুত রাসূলের করীম (ﷺ)-এর দরবারে নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপস্থিত থাকিতে পারা ছিল সাহাবিগণের নিকট সর্বাধিক কার্ম। এই পর্যায়ে হযরত সলীত (রা)- এর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। রাসূলে করীম (ﷺ) তাহাকে একখণ্ড জমি চাষাবাদের জন্য দিয়াছিলেন। তিনি উহার চাষাবাদের কাজে বাহিরে চলিয়া যাইতেন এবং আবার ফিরিয়া আসিতেন। তখন তিনি তখন তিনি অন্যান্য সাহাবীর নিকট শুনিতে পাইতেন যে, তাঁহার অনুপস্থিতিতে কুরআনের অমুক অমুক আয়াত নাযিল হইয়াছে এবং রাসূলে করীম (ﷺ) এই এই কথা বলিয়াছেন। তখন তাহার মনে বিশেষ দুঃখ ও বঞ্চনার জ্বালা অনুভূত হইত। তিনি রাসূলে করীম (ﷺ)-এর নিকট গিয়া বলিলেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আমাকে যে ভুমিখণ্ড দান করিয়াছেন, উহা ফিরাইয়া নিন। কেননা উহার কারণেই আমাকে দরবারে উপস্থিত থাকার পরম সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত থাকিতে হয়। ইহা আমি চাই না, ইহার কোন প্রয়োজনই আমার নাই।

******************************************************

কোন সাহাবী যদি বিশেষ কারণে কোন দিন দরবারে উপস্থি হইতে না পারিতেন, তাহা হইলে তিনি অপর যে লোক সেই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন, তাহার নিকট হইতে সব কথা জানিয়া লইতেন। হযরত উমর (রা) তাঁহার আনসারী ভাই ও প্রতিবেশী হযরত উতবান মালিকের সহিত এই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হইয়াছিলেন যে, তাঁহাদের কেহ কোন দিন রাসূল (ﷺ)- এর দরবারে উপস্থি হইতে না পারিলে অপরজন তাঁহাকে সেই দিনের যাবতীয় বিষয়ে অবহিত করিবেন। হযরত উমরের ভাষায়ঃ

******************************************************

আমি যখন রাসূল (ﷺ)- এর দরবারে যাইতাম, তখন সেই দিনের ওহী ও অন্যান্য বিষয়ক খবর তাহাকে পৌছাইয়া দিতাম আর তিনি যখন যাইতেন তখন তিনিও এইরূপ করিতেন।

[**************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন। তিনি দরবারে নববী হইতে কোন দিন বা কোন সময় অনুপস্থিত থাকিলে সেই সময়ে রাসূলে করীম (ﷺ) যেসব কথা বলিয়াছেন, যেসব কাজ করিয়াছেন এবং যেসব কথা ও কাজের অনুমোদন দান করিয়াছেন তাহা জানিবার জন্য সেই সময়ে যেসব সাহাবী উপস্থিত ছিলেন তাঁহাদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইতেন।

[**************] কোন হাদীস বা অপর কোন বিষয়ে তাঁহার অজানা থাকিলে তিনি স্বয়ং নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া সকল অজ্ঞতা ও শোবাহ-সন্দেহ দূর করিয়া লইতেন।

[***************]

একবার লায়স বংশীয় এক ব্যক্তি হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে বলিল, নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কেবল সমান পরিামণে ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় করিও না।

[বুখারী শরীফ, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৯১।]

এই কথাটি হযরত ইবন উমরের অজানা ছিল। তিনি তখনই আবূ সাঈদ খুদরীর নিকট উপস্থি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আপনি রাসূল (ﷺ)- এর নিকট হইতে এই কি হাদীস বর্ণনা করিতেছেন?

সাহাবায়ে কিরাম (রা) নিজেরাও কুরআন হাদীস শিক্ষাদানের জন্য নিজ নিজ এলাকায় অনুরূপ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিয়াছিলেন। নবী করীম (ﷺ)- এর জীবদ্দশায়ই মদীনা শহরে নয়টি মসজিদ তৈরী হইয়াছিল। তাহাতে যেমন পাঁচ ওয়াক্ত জামা’আতের সহিত নামায পড়া হইত তেমনি প্রত্যেকটিতে দ্বীন-ইসলাম শিক্ষাদনেরও ব্যবস্থা ছিল।

[******************] আবদুল কায়স গোত্রের আগত প্রতিনিধি দল এই স্বীকৃতিসহ নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আনসারগণ আমাদিগকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত শিক্ষা দিতেছিলেন।

[***********]

ফরহাম ইবন মালিক (রা) ইয়ামেন হইতে ইসলামের শিক্ষা লাভের জন্য মদীনায় আগমন করেন। তাঁহার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবন সায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ইয়ামেন হইতে আগমন করেন এবং কুরআন, ইসলামের ফরযসময়হ ও শরীয়াতের বিধান শিক্ষা করেন।

[*********]

এই প্রসঙ্গে হযরত আবূ হুরায়ারা কর্তৃক উক্ত নিম্নোক্ত কথাটিও উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যে নিয়মিনভাবে রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকিতাম তাহা সাহাবাদের ভাল করিয়াই জানা ছিল। এই জন্য তারা রাসূলে করীম (ﷺ)- এর হাদীস সম্পর্কে আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন ও জানিয়া লইতেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত উমর, উসমান, আলী, তালহা ও যুবায়র প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।

[***************]

মদীনার বিভিন্ন অঞ্চলে সাহাবাগণ কর্তৃক স্থাপিত দ্বীন-শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ সাধারণত দিনের বেলায়ই শিক্ষাদান করা হইত। সেই কারণে অনেক শ্রমজীবী ও বিভিন্ন পেশা-পালনকারী লোক ইহাতে শরীক হইতে ও ইলম হাসিল করার সুযোগ পাইতেন না। এইজন্য তারা নৈশ বিদ্যালয় ধরনের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিতে বাধ্য হন। এইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাত্রির অন্ধকার যখন তাঁহাদিগকে ঢাকিয়া ফেলিত, তখন তারা মদীনায় অবস্থিত তাঁহাদের শিক্ষকদের নিকট চলিয়া যাইতেন। এবং সেখানে তারা সকালবেলা পর্যন্ত পড়াশোনার কাজে মশগুল হইয়া থাকিতেন।

[************]

বলা বাহুল্য, এইসব কেন্দ্রে কুরআনে সঙ্গে সঙ্গে হাদীসেরও শিক্ষাদান করা হইত। ঠিক এই কারণেই অনেক সাহাবী রাসূলের নিকট হইতে বর্ণনা না করিয়া অপর কোন সাহাবীর সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আনাম ইবন মালিক (রা)- এর নিম্নলিখিত উক্তি হইতে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমরা তোমাদের নিকট যেসব হাদীস বর্ণনা করি, তাহার সবই আমরা সরাসরি রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই। বরং আমাদের (সাহাবীদের ) লোকেরা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৫।]

হযরত বরা ইবন আজিব (রা) তাঁহার বর্ণিত হাদীসসমূহের মর্যাদা সম্পর্কে বলিতে গিয়া যে কথাটি বলিয়াছেন, তাহা হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সব হাদীসই আমরা রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই বরং আমাদের সঙ্গী-সাথিগণও আমাদিগকে রাসূলের হাদীস শোনাইতেন। কেননা উট পালনের কাজ ও ব্যস্ততা আমাদিগকে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হইতে দিত না।

[তাবকাতে ইবন সাদ ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৩; মুসতাদরাক, ১ম খণ্ড, পৃষ্টা ৯৫।]

‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্হে এই কথাটির ভাষা নিম্নরূপঃ******************************************************

আমরা সব হাদীসই রাসূলের নিকট হইতে শুনি নাই, বরং আমাদরে সঙ্গিগণ আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতন। আর আমরা উট চড়াইবার কাজে ব্যস্ত থাকিতাম।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬]

এই দীর্ঘ প্রমাণমূলক আলোচনা হইতে একথাই প্রমাণিত হয় যে, যেসব সাহাবী নবী করীম (ﷺ)- এর নিকট হইতে হাদীস শুনিতে পাইতেন, তারা অপরাপর সাহাবীদের নিকট তাহা পৌঁছাইতেন এবং যাঁহারা সরাসরি রাসূরে নিকট হইতে হাদীস শ্রবণের সুযোগ পাইনত না, তারা অপর যেসব সাহাবী তাহা শুনিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতে শুনিয়া লইতেন। এইভাবে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রতেকটি হাদীস তাঁহার জীবদ্দশায়ই প্রায় সমস্ত সাহাবী পর্যন্ত গিয়াছিল।

হাদীসেন বাস্তব অনুসরণ

সাহাবায়ে কিরাম (রা) নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীস কেবল মুখস্থ রাখিয়া ও বৈঠকসমূহে উহার মৌখিক প্রচার ও পর্যালোচনা করিয়াই ক্ষান্ত থাকিতেন না। সেই সঙ্গে তারা উহাকে বাস্তবে রূপায়িত করিতেও যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। নবী করীম (ﷺ) যখন কোন আকীদা ও নিছক তত্ত্বমূলক কথা বলিয়াছেন,তখন সাহাবায়ে কিরাম তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন, মনে-মগজে উহাকে দৃঢ়ভাবে আসীন করিয়া লইয়াছেন এবং সেই অনুযায়ী নিজ নিজ আকীদা ও বিশ্বাস গড়িয়া তুলিয়াছেন। আর যখন কোন আদেশ-নিষেধমূলক উক্তি করিয়াছেন, কোন কাজ করার আদেশ বা কোন কাজ করিতেন নিষেধ করিয়াছেন, কোন শাসনতান্ত্রিক ফরমান জারী করিয়াছেন, তখন সাহাবায়ি কিরাম (রা) সঙ্গে সঙ্গে উহাকে কাজে পরিণত করিয়াছেন। উহাকে যতক্ষণ নিজেদের নৈমত্তিক অভ্যাসে পরিণত করা না গিয়াছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা উহার চর্চা ও অভ্যাস করিতে চেষ্টার একবিন্দু ক্রিট করেন নাই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমাদের কেহ যখন দশটি আয়াত শিক্ষালাভ করিত, তখন উহার অর্থ ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম করা ও তদনুযায়ী আমল করার পূর্বে সে আর কিছু শিখিবার জন্য অগ্রসর হইত না।

[*************]

ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সাহাবায়ে কিরাম নবী করীম (ﷺ)- এর নিকট হইতে যাহা কিছু শিক্ষালাভ করিতেন, তাহা তারা প্রথমে আমলে আনিবার জন্যই সর্বপ্রযত্নে চেষ্টা করিতেন। ফলে রাসূলের প্রত্যেকটি কথা, আদেশ ও ফরমান সাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক অনতিবিলম্বে কার্যকর ও বাস্তবায়িত হইত।

নবী করীম (ﷺ)- এর নিম্নলিখিত ধরনের অসংখ্য আদেশবাণী হইতেও এই কথারই প্রমাল মেলে যে, ইসলামের মৌলিক আইন-কানুন সাহাবাদের বাস্তব জীবনে রূপায়িত করিয়া তোলার দিকে নবী করীম (ﷺ) নিজে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। মুসলিমগণ ব্যক্তিগত জীবনে তাঁহার নির্দেশ মানিয়া চলে কিনা সেদিকে তিনি কড়া নজর রাখিতেন। ইসলামরে ব্যবহারিক আচার-আচরণ ও অনুসরণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইত। ইসলামী আকীদা ও আইন মুসলমানদের অভ্যাসে ও স্বভাবে পরিণত করার জন্য বিশেষ যত্ন লওয়া হইত। দৃষ্টান্তস্বরূপ রাসূলের অসংখ্য আদেশমূলক বাণীর মধ্য হইতে এখানে দুইটি বাণীর উল্লেখ করা যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়িতে দেখ, ঠিক সেইভাবেই নামায পড়।

[সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৭৬।]

হজ্জ উদযাপন সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) বিদায় হজ্জের ভাষণে ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমার নিকট হইতে হজ্জ উদযাপনের নিয়ম-কানুন গ্রহণ কর।

[

[(ক). ******************* মুসলিম শরীফে কথাটি এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

তোমরা যেন তোমাদের হ্জ্জ উদযাপনের নিয়মাবলী গ্রহণ কর-জানিয়া লও।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

রাসূলের উক্ত কথার ভাবার্থ এই যে, আমার হজ্জ উদযাপনে আমি যেসব কথা, কাজ ও আল্লাহ সম্পর্কিত বিষয়াদি প্রয়োগ করিয়াছি, তাহা্ হজ্জের অনুষ্ঠান ও পরিচয়। তোমাদের জন্যও সেই নিয়ম ও অনুষ্ঠানাদি নির্দিষ্ঠ। অতএব তোমরা উহা আমার নিকট হইতে গ্রহণ কর, কবুল কর। উহা জানিয়া মুখস্থ করিয়া উহা সংরক্ষণ কর, তদনুযায়ী আমল কর, উহা অন্যন্য লোককেও শিক্ষা দাও। ইমাম নববী বলেনঃ হজ্জের অনুষ্ঠানাদি ও নিয়ম প্রণালীর ব্যাপারে ইহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি ও উৎস। ইহা ঠিক ‘আমাকে যেমন নামায পড়িতে দেখ, তোমরা্ও সেইরূপ পড়’- এই রকমই একটি হুকুম।]]

এই ফরমানদ্বয় হইতে প্রথম প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদে নাময, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগীর সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকিলেও এইসবের বিস্তারিত নিয়ম- কানুন তাহাতে উল্লেখ করা হয় নাই। অতএব তাহা কুরআন-বাহক বিশ্বনবীর নিকট হইতেই গ্রহণ করিতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি কাজের নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্য রাসূল (ﷺ) নিজে সেই কাজ করিয়া লোকদের সম্মুখে বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করিতেন; কিভাবে কাজ করিতে হইবে, তাহা তিনি নিজে কাজ করিয়া দেখাইয়া দিতেন।

শুধু ইহাই নহে, ইবাদনের কাজে কাহারো কোন ভূল-ক্রটি পরিলক্ষিত হইলে রাসূলে করীম (ﷺ) তাহা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনও করিয়া দিতেন, ভূল ধরিয়া দিয়া তাহা শোধরাইবার জন্যও তাকীদ দিতেন। একদিন তিনি মসজিদে নববীতে একজন সাহাবীর নামায পড়া লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, তাঁহার নামায ঠিক নিয়মে হইতেছে না। নামায সমাপ্ত করিয়া তিনি যখন রাসূলের নিকট আসিলেন, তখন তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তুমি ফিরিয়া যাও, আবার নামায পড়, কেননা তুমি নামায পড় নাই।

অর্থাৎ তোমার নামায পড়া হয় নাই, যেভাবে নামায পড়িতে হয় সেভাবে পড় নাই। অতএব পুনরায় নামায পড়। এইভাবে তিন অথবা চারবার নামায পড়িলেও যখন তাঁহার নামায ঠিক নিয়মে সম্পন্ন হইল না, তখন নবী করীম (ﷺ) নিজে বাস্তবভাবে নামায পড়ার নিয়ম-কানুন সবিস্তারে শিক্ষা দিলেন।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০।]

এইভাবে সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূলের সম্মুখে ও সংস্পর্শে থাকিয়া ইসলামের আদর্শিক, নীতিগত ও বাস্তব শিক্ষা এবং ট্রেনিং লাভ করিতেন। কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের নিকট হইতে উহা তারাই সর্বপ্রথম শুনিতে পাইতেন। কুরআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা ও বাস্তব রূপ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) কিছু ইরশাদ করিলে তাহা সর্বপ্রথম তাঁহাদেরই কর্ণগোচর হইত।

অপরদিকে সাহাবয়ে কিরাম (রা) নিজেরাও রাসূলের যাবতীয় কাজ-কর্ম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করিতে থাকিতেন, মন ও মগজ দ্বারা তাহা অনুধাবন করিতে চেষ্টা করিতেন। নিম্নোক্ত হাদীস কয়টি ইহার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ

(ক) কিছু সংখ্যক লোক হযরত খাব্বার ইবনুল ইরত (রা)-কে জিজ্ঞাসা করিলঃ রাসূলে করীম (ﷺ) জুহরের নামাযে কুরআন পাঠ করিতেন কি? হযরত খাব্বাব বলিলেন, ‘হ্যা’। তখন তাহারা বলিলঃ

******************************************************

নামাযে রাসূলের কুরআন পাঠ করাকে আপনারা পিছনে থাকিয়া কিভাবে জানিতে পারিতেন?

উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তাহার শ্মশ্রুর নড়াচড়া দেখিয়াই আমরা ইহা জানিতে ও বুঝিতে পারিতাম।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫; আবু দাউদঃ কিতাবুস সালাত, ১ম খণ্ড, মুস্তাদরাক হাকে, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৯।]

(খ) হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেনঃ নবী করীম (ﷺ) জুহর ও আসরের নামাযে কতক্ষন দাঁড়াইয়া থাকিতেন, তাহা আমরা অনুমান করিয়া দেখিতাম। দেখিতাম, তিনি প্রথম দুই রাকা’আতে তিন আয়াত কুরআন পারে সমান সময় এবং শেষ দুই রাকা’আতে উহার অর্ধেক পরিমাণ সময় দণ্ডায়মান থাকিতেন।

[মুসলিম শরীফঃ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫; আবূ দাউদ, কিতাবুস সালাত, ১ম খণ্ড।]

সাহাবায়ে কিরাম যে রাসূলের আমল দেখিয়াতদনুযায়ী কাজ করিতেন, তাহা নিম্নোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

এক ব্যক্তি হযরত উমর (রা)- কে বলিলেনঃ ‘আমরা কুরআন মজীদে কেবল ভয়কালীন নামাযে (********) ও নিজ বাড়িতে অবস্থানকালীন নামাযের উল্লেখ দেখিতে পাই; কিন্তু সফরকালীন নামাযের কোন উল্লেখ কুরআন মজীদে পাই না। ইহার কারণ কি? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ

আমরা দ্বীন সম্পর্কে কিছুই জানিতান না। এইরূপ অবস্থায় আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-কে রাসূল করিয়া পাঠাইলেন; কাজেই এখন আমরা তাঁহাকে যেভাবে দ্বীনের কাজ করিতে দেখি, ঠিক সেইভাবেই উহা পালন করি।

[মুসনাদে আহমদঃ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫।]

পূর্বোল্লিখিত হাদীসত্রয় হইতে নিম্নলিখিত কথাগুলি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়ঃ

(ক) দ্বীন সম্পর্কে কাজকমূ রাসূল নিজে যেভাবে করিতেন, সাহাবায়ে কিরামও তাহা ঠিক সেইভাবেই করিতেন; সাহাবায়ে কিরাম রাসূলের ক্থা ও কাজ উভয়েরই হুবহু অনুকরণ করিতেন এবং এইরূপ করিলেই দ্বীন পালিত হইল বলিয়া মনে করিতেন।

(গ) রাসূলে করীম (ﷺ) দ্বীনের কোন কাজ কিভাবে করিতেন তাহা লক্ষ্য করা ও অনুসরণ করার জন্য রাসূলে করীম (ﷺ) নিজেও সাহাবিগণকে তাকীদ করিতেন এবং সাহাবায়ে কিরামও নিজেদের দ্বীন পালনের গরযে তাহা পূরণ করিতেন। কেননা দ্বীন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় ছিল রাসূলের কথা গ্রহণ ও অনুধাবন এবং তাঁহার কাজকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও হাতে কলমে তাঁহার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করা।

বস্তুত ইসলামের বিস্তারিত ও খুটিঁনাটি নিয়ম-কানুন জানার জন্য ইসলামের প্রথম সমাজ সাহাবায়ে কিরাম অপরিসীম চেষ্টা ও অনুসন্ধিৎসা চালাইতেন। কুরআনী মূলনীতিসমূহের বুনিয়াদে ইসলামের বিস্তারিত ব্যবস্থা এইভাবে রচিত হইয়াছে।

সাহাবায়ে কিরাম (রা) এমন সব কাজেও রাসূলের হুবহু অনুসরণ করিয়া চলিতেন, যাহাতে রাসূলকে অনুস্মরণ করিয়া চলা শরীয়াত অনুযায়ী অপরিহার্যভাবে প্রয়োজন নহে। নবী করীম (ﷺ) একবার কেবলমাত্র একখানি চাদর পরিধান করিয়া নামায পড়িয়াছিলেন। প্রসিদ্দ সাহাবী হযরত জাবির একদিন তাহাই করিলেন। তাঁহার ছাত্রগণ তাহা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ ‘আপনার নিকট অতিরিক্ত চাদর থাকা সত্ত্বেও আপনি নামাযের সময় উহা ব্যবহার করিলেন না কেন? উত্তরে তিনি বলিলেন, ‘নবী করীম (ﷺ) কর্তৃক এইরূপ রুখসত দেওয়া হইয়াছে বলিয়াই আমি এইরূপ করিলাম, যেন তোমরা এই সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হইতে পার’।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৮।]

হযরত বরা ইবনে আযিব (রা) নামাযের প্রত্যেকটি কাজে রাসূলের সহিত সাদৃশ্য স্থাপনের জন্যে প্রণপণে চেষ্টা করিতেন। একদিন তিনি পরিবারবর্গের লোকদিগকে একত্র করিয়া বলিলেনঃ ‘নবী করীম (ﷺ) যেভাবে ওযু করিতেন ও নামায পড়িতেন, তাহা আজ আমি তোমাদিগকে দেখাইব। অতঃপর তিনি ওযু করিয়া জুহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামায জামা’আতের সহিত আদায় করিলেন ও প্রত্যেক কাজই নবীর অনুকরণে সম্পন্ন করিলেন। রাসূল (ﷺ) কিভাবে রুকূ সিজদা করিতেন, তাহাও তিনি করিয়া দেখাইলেন’।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৮ ও৩০৩।]

হযরত আনাস (রা) দশ বৎসর পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর খিদমত করিয়াছেন। রাসূল (ﷺ)- কে যখন যেভাবে যে কাজ করিতে দেখিয়াছেন, তিনি সমগ্র জীবন সেই কাজ ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিয়াছেন। তাঁহার নামায পড়ার ধরন ও পদ্ধতি দেখিয়া হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিতেনঃ ‘ইবনে উম্মে সলীম (আনাস) অপেক্ষা রাসূলের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যশীল নামায পড়িতে আর কাহাকেও দেখি নাই’। আইনুত্তামার নামক স্থানের বাহিরের ময়দানে তিনি একদা উষ্ট্রের পৃষ্ঠে আরোহী অবস্থায় নামায পড়িতেছিলেন। উষ্ট্র কেবলামুখী দাঁড়ানো ছিল না। ইহা দেখিয়া সাথিগণ আশ্চর্যান্বিত হইয়া ইহার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘নবী করীম (ﷺ)-কে এইরূপ নামায পড়িতে না দেখিলে আমি কখনই এইরূপ পড়িতাম না’। আর একদিন তিনি একখানা কাপড়ের এক দিক পরিধান করিয়া ও অপর দিক গায়ে জড়াইয়া নামায পড়িলেন। নিকটেই একখানা চাদর পড়িয়াছিল। নামায পড়া শেষ হইলে ইবরাহীম ইবন রাবীয়া (তাবেয়ী) ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে হযরত আানস (রা) বলিলেনঃ ‘আমি নবী করীম (ﷺ)-কে ঠিক এইরূপেই নামায পড়িতে দেখিয়াছি’।ফরয কাজ ছাড়া ওয়াজিব ও সুন্নাতের ব্যাপারেও তিনি নবী করীমের হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ করিতেন। নবী করীম (ﷺ)- এর মহান পবিত্র জীবন, জীবনের প্রত্যেকটি কাজ ও পদক্ষেপ ছিল তাঁহার এবং তাঁহার ন্যায় সহস্র লক্ষ সাহাবীর নিকট হিদায়াতের উজ্জ্বলতম আলোকস্তম্ভ।

বস্তুত সাহাবীদের এইরূপ অনুসরণের মাধ্যমেই রাসূলের প্রত্যেকটি কথা ও কাজ এবং কাজের বিবরণ চিরদিনের জন্য সুরক্ষিত রহিয়াছে, রাসূলের তৈরী করা সমাজ তাহা কোন দিনই ভুলিয়া যাইতে পারে নাই। রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের ইহা এক অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন

সাহাবায়ে কিরাম (রা) ইসলাম সম্পর্কে রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শিক্ষালাভ করিতেন, কুরআন ও হাদীসের যে জ্ঞান সম্পদই তারা আহরণ করিতেন, তাহা তারা কেবল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ও কুক্ষিগত করিয়ারাখিতেন না; বরং একটি মৌলিক ও নৈতিক দায়িত্ব হিসাবেই তাহা জনগণের মধ্যে রাসূলের দরবার ও তাঁহার নিত্য সাহচর্য হইতে দূরে অবস্থিত মুসলিমদের মধ্যে প্রচার করিতে নিরন্তর ব্যস্থ হইয়া থাকিতেন। ইহা তাঁহাদের একটি প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য ছিল। আর প্রকৃতপক্ষে ই দায়িত্ব পালনের জন্যই আল্লাহ তা’আলা নবী করীম (ﷺ)-এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মতকে গঠন করিয়াছিলেন। মুসলিম জাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াকুরআন মজীদ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

এইভাবেই আমি তোমাদিগকে মধ্যম পন্হানুসারী উম্মত বানাইয়াছি, যেন তোমরা জনগনের পথপ্রদর্শক হও এবং রাসূল হইবে তোমাদের পথ প্রদর্শনকারী।

[সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৪৩।]

কুরআনের এই ঘোষণা অনুযায়ী সাহাবায়ে কিরাম (রা) সত্যের বাস্তব প্রতীকরূপে নিজেদের জীবন ও চরিত্র গড়িয়া তোলার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকেও সত্য পথ প্রদর্শন এবং সত্যের দিকে আহবান জানাইবার দায়িত্ব ও কর্তব্য মর্মে অনুভব করিতেন। এই ব্যাপারে তারা কোন প্রকার বাধ্য বা কষ্ট ও ক্লান্তিকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করিতেন না।কোন আঘাতই তাঁহাদিগকে এই পথ হইতে বিরত রাখিতে পারিত না। উপরন্তু দ্বীনের কোন কথা জানিতে পারিলে তাহা গোপন রাখিয়া অপর লোকদের নিকট তাহা প্রকাশ না করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাওয়াকে তারা মারাত্মক অপরাধ বলিয়া মনে করিতেন। কেননা তারা কুরআনের নিম্নোক্ত ঘোষনার কারণে এই দিক দিয়া অন্যন্ত ভীত, শংকিত ও সন্ত্রস্ত হইয়া থাকিতেন। আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যে সুস্পষ্ট বিধান নাযিল করিয়াছি, জনগনের জন্য হিদায়াতের যে বাণী প্রেরণ করিয়াছে এবং আমি যাহার ব্যাখ্যাও কিতাবের মধ্যে করিয়া দিয়াছি, তাহার পর উহা যাহারা গোপন করিয়া রাখিবে, তাঁহাদের উপর আল্লাহ এবং সমস্ত অভিশাপ বর্ষণকারীরা অভিশাপ বর্ষণ করেন।

[সূরা-আল- বাকারা, আয়াত ১৫৯]

এই কঠোর সতর্কবাণী শ্রবণের পর কোন সাহাবীই দ্বীন সম্পর্কিত একটি ছোট্র কথাও গোপন করিয়া রাখার মত দুঃসাহস করিতে পারেন না। কোন সাহাবীকে ইসলামের কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহার জ্ঞানমত তাহার জওয়াব দেওয়া কর্তব্য মনে করিতেন। কেননা নবী করীমের নিম্নোক্ত বাণী তাঁহাদের স্মরণ ছিলঃ

******************************************************

কেহ কোন জ্ঞানে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হইলেও তাহা সে গোপন করিলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাহাকে আগুনের লাগাম পরাইয়া দিবেন।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০১।]

সেই কারণে একথা জোর করিয়াই বলা যাইতে পারে যে, নবী করীম (ﷺ) যে ইসলামী সমাজ গঠন করিয়াছিলেন, তাহা সামগ্রিকভাবে কুরআন হাদীস প্রচারের একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত কাজ করিতেছিল। হৃৎপিণ্ড হইতে রক্ত উৎসারিত হইয়া সমগ্র দেহে-দেহের প্রতিটি ক্ষুদ্র-বৃহৎঅঙ্গে যেমন স্থায়ী ও স্বয়ংক্রিয় ধমনীর মাধ্যমে সঞ্চালিত ও প্রবাহিত হয়, ইসলামে হাদীস সম্পদও নবী করীমের নিকট হইতে উৎসারিত হইয়া প্রতিটি মুসলিমের অক্লান্ত চেষ্টা ও তৎপরতার ফলে মানব সমাজের দূরবর্তী কেন্দ্রসমূহে পৌঁছিয়াছে।

ইসলাম প্রচারের এই ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ছাড়াও নবী করীম (ﷺ)- এর জীবদ্দশায় সরকারী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও হাদীস প্রচারিত হইয়াছে। কেননা নবী করীম (ﷺ) বিভিন্ন স্থানে ও দেশে ইসলাম প্রচারকার্যে ব্যক্তি ও দল প্রেরণ করিয়াছেন। এ পর্যায়ে আমরা কয়েকটি প্রসিদ্ধ ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

হযরত আবূ ইমাম বাহেলী (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (ﷺ) আমাকে আমার নিজ কবীলা ও এলাকার লোকদের প্রতি তাহাদিগকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দান ও তাহাদের সম্মুখে ইসলামী শরীয়াতের বিধান পেশ করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছেন।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১।]

নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমতে একদল আনসার অবস্থান করিতেন। তারা দিনের বেলা পানি বহন করিতেন, কাষ্ঠ সংগ্রহ করিতেন এবং তাহা বিক্রয় করিয়া সুফফার অধিবাসীদের জন্য খাদ্য ক্রয় করিতেন। আর রাত্রিবেলা কুরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করিতেন। একবার কয়েজন মুনাফিক একত্র হইয়া রাসূলের নিকট বলিলঃ

******************************************************

আমাদিগকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদান করিবে এমন কিছু লোক আমাদের সহিত পাঠাইয়া দিন।

নবী করীম (ﷺ) এই উদ্দেশ্যে উপরিউক্ত লোকদের মধ্য হইতে সত্তর জন লোককে তাহাদের সহিত প্রেরণ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পথের মাঝখানেই মুনাফিকরা তাঁহাদের উপর আকস্মিক আক্রমন চালায় ও তাঁহাদিগকে শহীদ করিয়া দেয়।

[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৯। ********************]

হিজরতের প্রাক্কালে হযরত আবূ যর গিফারী (রা) নবী করীম (ﷺ)- এর নিকট মক্কা শরীফে ইসলাম কবুল করেন। নবী করীম (ﷺ) তাঁহাকে বলিলেনঃ

******************************************************

আমাকে খেজুরের দেশে চলিয়া যাইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আমি মনে করি উহা ‘ইয়াসরিব’ বা মদীনা ছাড়া অন্য কোন দেশ হইবে না। এখন তুমি কি আমার পক্ষ হইতে তোমার নিজ গোত্র ও এলাকার লোকদিগকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কাজ করিতে পারিবে?

আবূ যর গিফারী (রা) সানন্দে এই দায়িত্ব কবুল করিলেন ও নিজ দেশে পৌঁছিয়া লোকদিগকে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তিনি রাসূলে করীম (ﷺ)- এর নিকট হইতে ইসলামের যেসব কথা জানিয়া লইয়াছিলেন, তাহা তাঁহার কবীলা ও দেশের লোকদের নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলেন। ফলে বহু লোক ইসলাম কবুল করেন।

[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৭৬।******************]

অনুরূপভাবে কায়স ইবনে নাশিয়া আসলামী (রা) ইসলাম কবুল করার পর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি নিজ গোত্র ও এলাকার লোকদিগকে বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

হে বনু সুলাইমের লোকেরা ! আমি রোমান ও পারসিক জাতির সাহিত্য আরব কবিদের কবিতা, কুহানদের কাহিনী এবং হেমইয়ারের কাব্য শুনিয়াছি। কিন্তু মুহাম্মদের কালামের সহিত উহার কোনই তুলনা হইতে পারে না- উহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারার জিনিস। অতএব, তোমরা মুহাম্মদের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে আমার অনুসরণ কর।

[***************]

হযরত আমর ইবনে হাজম (রা) কে নবী করীম (ﷺ) নাজরান গোত্রের প্রতি প্রেরণ করিয়াছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে-

******************************************************

তিনি তাহাদিগকে দ্বীন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানদান করিবেন ও কুরআন শিক্ষা দিবেন।

[*************]

হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা) কে নবী করীম (ﷺ) ইয়ামেনে পাঠাইয়াছিলেনঃ

******************************************************

ইয়ামেন ও হাজরা মাউতের অধিবাসীদের শিক্ষক হিসাবে।

[******************]

‘কারবা’ ও ‘আদল’ নামরে দুইটি গোত্র হিজরতের তৃতীয় বৎসরে ইসলাম কবুল করিলে নবী করীম (ﷺ) তাহাদের জন্য ছয়জন শিক্ষক প্রেরণ করিলেনঃ

******************************************************

‘নবী করীম (ﷺ) আদল ও কাররা’ নামক গোত্রদ্বয়ের প্রতি দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান দান, কুরআন ও ইসলামী শরীয়াতের বিধান শিক্ষাদানের জন্য ছয়জন শিক্ষক প্রেরণ করেন। তারা হইলেনঃ মারসাদ ইবন আবী মারসাদ, আসেম ইবন সাবেত, হাবীব ইবন আদী, খালেদ ইবনুল বুকায়ার, যায়দ ইবন দাসনা এবং আবদুল্লাহ ইবন তারেক (রা)।

[*******************]

মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র আরব জাহান ইসলাম কবুল করার জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠে। তখন লোকেরা নিজ নিজ কবীলা সর্দারদেরকে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট পাঠাইতে শুরু করে। তাহারা ইসলাম কবুল করিয়া নিজ নিজ কবীলা ও এলাকার লোকদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে এবং তাহাদিগকে ইসলামের দাওয়াত দেয় ও ইসলামী জ্ঞান-কুরআন হাদীস প্রচার করে।

[**************

এতদ্ব্যতীত বহু সংখ্যক সাহাবীকে নবী করীম (ﷺ) ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন।

[**********************] তখন ইহাদের মাধ্যমে যেমন কুরআন মজীদ ও উহার ভাষ্য হিসাবে রাসূলের হাদীসও বিপুলভাবে প্রচার লাভ করিয়াছে।

নবী করীম (ﷺ) যেসব সাহাবীকে ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছেন, তারা শাসনকার্য সম্পাদনের জন্য কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও অন্যতম ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। এই প্রসংগে হযরত মু’আয ইবন জাবাল (রা)- এর সাথে তাঁহাকে ইয়ামেনের গভর্নর নিযুক্ত করিয়া পাঠাইবার সময়ে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা বিশেষভাবে স্মরণীয়। নবী করীম (ﷺ) জিজ্ঞাসা করিলেনঃ তুমি কিসের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করিবে? মু’আয বলিলেন, কুরআনের ভিত্তিতে। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি সম্পর্কে কুরআনে যদি কিছু না পাওয়া যায়, তখন? মু’আয বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূলের সুন্নাতের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করিব।

এই আলোচনার শেষভাগে রাসূলে করীম (ﷺ) অতিশয় সন্তোষ সহকারে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করিলেন এবং হযরত মু’আযের বক্ষস্থলে হাত রাখিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

যে আল্লাহ তাঁহার রাসূলের প্রেরিত ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসূলের সন্তোষমূলক কাজ ও নীতি নির্ধারণ করার তওফীক দিয়াছেন, তাঁহারই প্রশংসা।

[************************]

এই প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্রই রাসূলের প্রেরিত লোকদের চেষ্টা ও যত্নে রাসূলের জীবদ্দশায়ই হাদীস পৌছিয়াছে। সর্বত্র উহার চর্চা শুরু হইয়া গিয়াছে।ইহার ফলে দূর-দূরান্তরে অবস্থিত মুসলিমগণ কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের হাদীসের সহিত সম্যক পরিচয় লাভ করিতে সমর্থ হয়।

সাহাবীদের হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদান

ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পাল ব্যাপারে দেশে দেশে সাহাবিগণের মাধ্যমে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস ও প্রচারিত হইয়াছে। এই পর্যায়ে আমরা সাহাবিগণের বিশেষভাবে হাদীস প্রচার সংক্রান্ত সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করিব।

কিন্তু সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে ‘সাহাবী’ কাহাকে বলে; কে সাহাবী, কে নয়; এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক আলোচনা এইখানে পেশ করা আবশ্যক।

ইমাম বুখারী ও আহমদ ইবন হাম্বল প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের মত এই যেঃ

******************************************************

যিনি রাসূল (ﷺ)-কে দেখিতে পাইয়াছেন, তাঁহার মধ্যে পার্থক্যবোধ বর্তমান ছিল, তাঁহার প্রতি ঈমানদার এবং ইসলামের উপরই তাঁহার জীবনাবসান ঘটিয়াছে, তিনিই সাহাবী। রাসূলের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ-বৈঠক দীর্ঘ হউক কি সংক্ষিপ্ত হইয়া থাকুক, তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করুন আর নাই করুন, তাঁহার সহিত মিলিয়া যুদ্ধ করুন আর না-ই করুন তিনিই সাহাবীরূপে গণ্য হইবেন।

[*********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার সহীহ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

যে মুসলমান রাসূলের সংস্পশ লাভ করিয়াছে কিংবা যে মুসলমান তাঁহাকে দেখিয়াছে, সে-ই রাসূলের সাহাবী।

[************]

আবুল মুযাফফর আস সাময়ানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস বিজ্ঞানিগণ এমন সকল লোককেই সাহাবী বলেন, যাঁহারা রাসূলের নিকট হইতে একটি হাদীস বা একটি কথাও বর্ণনা করিয়াছেন।

[**************]

আল্লাহ নিজেই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সাহাবীদের প্রশংসা ও পরিচয় দান করিয়াছেন। এক জায়গায় অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত ও অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁহার সঙ্গের লোক (সাহাবী)-গণ কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; তারা পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহ ও ভালবাসাসম্পন্ন। তুমি তাহাদিগকে সব সময় রুকূ ও সিজদা দানকারী-বিনীত ও আল্লাহর সম্মুখে অবনত দেখিতে পাইবে। তাহারা সব সময়ই আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোয় লাভের অভিলাষী। তাঁহাদের কপালদেশে সিজদার চিহ্ন অংকিত রহিয়াছে।

[সূরা আল-ফাতহ, ২৯ আয়াত।]

অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

আল্লাহ এই মু’মিন (সাহাবী-দের প্রতি বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছেন- যখন তাহারা বৃক্ষের নীচে বসিয়া (হে নবী) তোমার হাতে বায়’আত করিতেছিল। অতঃপর তাহাদের দিলের কথা আল্লাহ তা’আলা জানিতে পারিলেন।

[ঐ, ১৮ আয়াত।]

সহীহ হাদীসেও সাহাবীদের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা উদ্ধৃত হইয়াছে।

একটি হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা আমার সাহাবীকে গালাগাল করিও না। কেননা যাঁহার হস্তে আমার প্রাণ- সেই আল্লাহর শপথ, তোমাদের কেহ যদি ওহুদ পর্বত সমান স্বর্ণও দান করে, তবুও সে একজন সাহাবীর সমান বা তাহার অর্ধেক মর্যাদাও পাইতে পারিবে না।

[মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১০, বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮।]

বস্তুত এই সাহাবিগণের আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা ও অসীম-অতুলনীয় আত্মত্যাগের ফলে একদিকে যেমন ইসলাম প্রচার হইয়াছে অপরদিকে ঠিক তেমনি রাসূলে করীম (ﷺ)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পূর্ণ মাত্রায় সুরক্ষিতও রহিয়াছে। সাহাবিগণই কুরআন-হাদীসের জ্ঞান রাসূলের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন, সেই সঙ্গে দুনিয়ার দিকে দিকে উহার অমিয়ধারা প্রবাহিত করিয়া বিশ্ববাসীকে চিরধন্য করার ব্যবস্থাও করিয়াছেন।

কাজেই হাদীসের প্রথম গ্রাহক, বাহক ও প্রচারক হওয়ার কারণে সাহাবিগণ বিশ্ব মুসলিমের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই।

বস্তুত হাদীস শিক্ষাকরা, সংরক্ষণ ও মুখস্থ করা এবং উহার প্রচার ও শিক্ষাদান সম্পর্কে রাসূলে করীম (ﷺ)- এর নির্দেশ পাইয়া সাহাবিগণ নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিতে পারেন নাই। বরং তারা নিজেরা যেমন হাদীসের প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন, নিজেরা উহার শিক্ষালাভও করিয়াছেন, মুখস্থ করিয়াছেন, অনরূপভাবে হাদীস অনভিজ্ঞ লোকদের পর্যন্ত তাহা পৌঁছাইবার, তাহাদিগকেও হাদীস শিক্ষায় পূর্ণ শিক্ষিত করিয়া তুলিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন। নবী করীম (ﷺ)- এর জীবদ্দশায় তো বটেই, তাঁহার ইন্তেকালের পরও তারা কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস প্রচারে ও হাদীসের শিক্ষাদনে বিন্দুমাত্র গাফিলতি করেন নাই। হযরতের ইন্তেকালের পর সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রের দিকে দিকে এবং দূরবর্তী বহু অমুসলিম দেশে তারা ছড়াইয়া পড়েন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে ও পরিমণ্ডলে হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। এইখানে কয়েকজন বিশিষ্টি সাহাবীর হাদীস প্রচার এবং শিক্ষাদানের ঐতিহাসিক ও প্রামাণ্য বিবরণ পেশ করিতেছিঃ

১ হযরত আবূ ইদরীস খাওলানী (রা) বলেনঃ আমি হিমস শহরের মসজিদে অনুষ্ঠিত এক মজলিসে শরীক হইলাম। ইহাতে ৩২ জন সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। এখানে সমষ্টিগতভাবে হাদীসের চর্চা ও শিক্ষাদান করা হইতেছিল। একজন সাহাবী হাদীস বর্ণনা সমাপ্ত করিলে ইহার পর দ্বিতীয়জন হাদীস বর্ণনা শুরু করিতেন।

[মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৮।]

২. নসর ইবন আসেমুল লাইসী বলেনঃ আমি কুফা শহরের জামে মসজিদে একটি জনসমাবেশ দেখিতে পাইলাম। সকল লোক নির্বাক ও নিশ্চল হইয়া এক ব্যক্তির দিকে গভীর অভিনিবেশ ও অধীর আগ্রহ সহকারে উম্মুখ ও নিস্পলক দৃষ্টিকে তাকাইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, ইনি প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত হুযায়ফা ইবন ইয়ামান (রা) এবং তিনি হাদীসের শিক্ষা দান করিতেছেন।

[মুসনাদে আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৬।]

৩. উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা) মদীনায় হাদীস শিক্ষা দানের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহার নিকট এক সংগে শিক্ষার্থী লোকের সংখ্যা দুইশতেরও অধিক ছিল। তন্মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন মহিলা। হযরত আবু মুসা আশ’আরী, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আমর ইবনুল আস প্রমুখ শদ্ধাভাজন সাহাবী তাঁহার দরসে হাদীসের মজলিসে নিমিত শরীক হইতেন।

[তাযকিরাতুল হুফফায যাহবী, হযরত আবূ দারদা প্রসংগ।]

৪. কফা নগরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নিয়মিতভাবে হাদীসের দরস দিতেন। তাঁহার দরসে অন্যূন্য চারি সহস্র ছাত্রশ্রোতা সমবেত হইত।

[আসরারুল আনওয়ার প্রন্হ দ্রঃ।]

৫. হযরত আবুদ্দরদা (রা)

[এই সাহাবীর নাম হইল উয়াইমির ইবন যায়দ, পৃষ্ঠা ৩২।] দামেশকে বসবাস করিতেন। তিনি যখন মসজিদে হাদীসের দরস দিতে উপস্থিত হইতেন, তখন তাঁহার সম্মুখে এত বিপুল সংখ্যক শ্রোতার সমাবেশ হইত যে, তাহাদের মাঝে তাঁহাকে মনে হইত যেন শাহানশাহ্ বসিয়া আছেন।

[তাযকিরাতুল হুফফায, আবু দারদার প্রসঙ্গ।]

‘তাযকিরাতুল হুফফায কিতাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, হযরত আবুদ্দারদার দরসের মজলিসে অন্তত ষোলশত ছাত্র রীতিমত যোগদান করিত।

৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইলমে হাদীসের মহাসমুদ্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা তিনি কেবলম্রাত নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নাই, উহা দ্বারা তিনি সহস্র লক্ষ মুসলিমের জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্ত করিতেন। ফলে তাঁহার দ্বারা হাদীসের ব্যাপক প্রচার সাধিত হয়। তিনি নবী করীম (ﷺ)- এর ইন্তেকালের পর ষাট বৎসরেরও অধিককাল জীবিত ছিলেন (মৃঃ৭৪ হিঃ)। এই দীর্ঘ জীবনে হাদীসের শিক্ষাদান ও প্রচার সাধনই ছিল তাঁহার প্রধান কাজ।

[*****************] এই কারণে তিনি কোন চাকরি পর্যন্ত গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাহাতে এই মহান কাজ ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হইত।

তিনি মদীনা শরীফে স্থায়ীভাবে দরসে হাদীসের মজলিস অনুষ্ঠান করিতেন। বিশেষত হজ্জের সময় যখন বিপুল সংখ্যক মসলমান মদীনায় সমবেত হইতেন, তখন তিনি তাঁহাদের নিকট হাদীস পেশ করিতেন। ইহার ফলে মুসলিম জাহানের দুরতম কেন্দ্র পর্যন্ত রাসূলের হাদীস অতি সহজেই পৌঁছিয়া যাইত।

[উসদুল গাবাহ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৮।]এতদ্ব্যতীত লোকদের ঘরে ঘরে পৌঁছিয়াও তিনি হাদীসের প্রচার করিতেন। ইয়াযীদ ইবন মুয়াবিয়ার শাসনামলে তিনি আবদুল্লাহ ইবন মুতীর ঘরে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার জন্য বিছানা ও শয্যা ঠিক করিতে বলা হইলে হযরত আবদুল্লাহ ইব উমর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমার ঘরে বসিবার জন্য আসি নাই, শুধু একটি হাদীস শুনাইবার উদ্দেশ্যে আসিয়াছি। হাদীসটি আমি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে শুনিয়াছিলাম।

অতঃপর তিনি বলিলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি আমীরর তথা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য হইতে বিরত থাকে, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে এমন অবস্থায় উপস্থিত হইবে যে, তাহার সে কৈফয়ত দেওয়ার কিছুই থাকিবে না। আর যে লোক আমীরের নিকট বায়আত না করিয়া মরিবে, তাহার জাহিলিয়াতের মৃত্যু ঘটিবে।

[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২৮। মুসনাদে আহমদ ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৫৪।]

৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) কথায় কথায় হাদীস প্রচার করিতেন ও লোকদিগকে হাদীসের শিক্ষাদান করিতেন। আলী ইবন আবদুর রহমান বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) আমাকে নামাযের মধ্যে পাথরকুচি লইয়া খেলা করিতে দেখিলেন। আমি নামায শেষ করিলে তিনি আমাকে এইরূপ করিতে নিষেধ করিলেন এবং বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল (ﷺ) যেইরূপ সুন্দরভাবে নামায পড়িতেন, তুমিও সেইভাবেই নামায পড়।

রাসূল (ﷺ) কিভাবে নামায পড়িতেন জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

রাসূল (ﷺ) যখন নামাযে বসিতেন, তখন ডান হাত ডান রানের উপর রাখিতেন, এবং সবগুলি অংগুলি বন্ধ করিয়া লইতেন, এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির পাশের অংগুলি দ্বারা ইশারা করিতেন। আর বাম হাত বাম রানের উপর স্থাপন করিতেন।

[মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, পৃঃ ৫৩ (তরজমা সহ)]

বহু দিন পর্যন্ত একটি বিশেষ হাদীস বর্ণনা না করায় সাহাবীদের মনে ভয় জাগ্রত হইত যে, ইহা বর্ণনা না করিলে ও উহাকে গোপন করিয়া রাখিলে গুনাহ করা হইবে। অতএব উহা আর গোপন রাখা যায় না। তখনই তিনি তাহা লোকদের নিকট বর্ণনা করিতেন। হযরত উসমান (রা) সম্পর্কে নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে ইহার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়ঃ

******************************************************

হযরত উসমান (রা) যখন অযূ করিলেন, তখন বলিলেনঃ আমি তোমাদের নিকট নিশ্চয়ই একটি হাদীস বর্ণনা করিব। অবশ্য যদি একটি আয়াত না থাকিত, তাহা হইলে আমি তাহা তোমাদিগকে কিছুতেই বলিতাম না। আমি শুনিয়াছি, নবী করীম (ﷺ) বলিতেছিলেনঃ কোন ব্যক্তি যদি অযূ করে, তাহার অযূ সর্বাঙ্গ সুন্দর করিয়া সম্পন্ন করে এবং নামায আদায় করে, তবে তাহার ও নামাযের মধ্যে যত গুনাহ হইবে, তাহা সব মাফ করিয়া দেওয়া হইবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নামায সম্পন্ন করিতে থাকিবে। হাদীসের বর্ণনাকারী উত্তরে বলেনঃ সে আয়াতটি হইল এইঃ ‘নিশ্চয়ই যাহারা আমার নাযিল করা কথাকে গোপন করে……………..’।

[সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮।

উদ্বৃত আয়াতটিকে হযরত উসমান (রা)- এর হাদীস গোপন করায় গুনাহ হওয়া সম্পর্কে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা হএত এইকথা প্রমাণিত হয় যে, তিনি ওইসব সাহাবায়ে কিরাম হাদীসকে ‘আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ কথা মনে করিতেন। অন্যথায় এই আয়াত যুক্তি হিসাবে পেশ করা এবং আয়াতে উল্লিখিত গুনাহ ও শাস্তির ভায়ে বহু দিনের বর্ণনা না করা হাদীসকে বর্ণনা করা এবং এই কথা বলা যে, এই আয়াত না থাকিলে আমি কিছুতেই এই হাদীস বর্ণনা করিতাম না-ইহার কোনই তাৎপর্য থাকিতে পারে না।]

মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকা অবস্থায়ও সাহাবায়ে কিরাম (রা) প্রয়োজনবশত রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনা করিতেন। হাসান বসরী বলেন৬ হযরত মাম্বকাল মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন সেখানে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ উপস্থিত হইলেন। এই সময় হযরত মাম্বকাল বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমাকে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট হইতে শ্রুত একটি হাদীস শুনাইব। তিনি বলিয়াছেনঃ আল্লাহ যে বান্দকে জনগণের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব দিবেন, সে যদি তাহাদিগকে সদুপদেশ দিয়া ও তাহাদের কল্যাণবোধ করিয়া তাহাদের হিফাজত না করে, তবে সে বেহেশতের সুগন্ধিটুকুও পাইবে না।

[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৫৮।]

হযরত আবূ আয়্যূব আনসারী (রা) মৃত্যূশয্যায় শায়িত থাকা অবস্থায় হাদীস প্রচারের দায়িত্বানুভূতিতে কম্পিত হইয়াছিলেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি এমন দুইটি হাদীস বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, যাহা তিনি পূর্বে কখনও বর্ণনা করেন নাই। তাঁহার ইন্তেকালের পর সাধারণ ঘোষনার মাধ্যমে হাদীস দুইটিকে মুসলিম জনগণের নিকট পৌঁছানো হয়।

[মুসনাদে আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৪।]

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সম্পর্কেও এই ধরনের একটি ঘটনা ইবনে আবী শায়বাহ কর্তৃক উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন; তখন তিনি উপস্থিত লোকদের বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা আমাকে উঠাইয়া বসাইয়া দাও, কেননা রাসূল করীম (ﷺ)-এর রক্ষিত এক আমানত আমার নিকট সংরক্ষিত রহিয়াছে, আমি তাহা তোমাদের নিকট পৌঁছাইতে চাই।

অতঃপর তাঁহাকে বসাইয়া দেওয়া হইলে তিনি বর্ণনা করিলেনঃ

******************************************************

তোমাদের কেহ যেন তাহার নামাযেন মধ্যে এদিক-ওদিক না তাকায়। যদি কেহ তাকায়-ই তবে যেন ফরয নামায ছাড়া অন্য নামাযে করা হয়।

[তাফসীরে রুহুল-মাআনী, ১৮ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩।]

আবুল আলীয়া তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমরা বসরা শহরে রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসের বর্ণনা লোকদের নিকট শুনিতে পাইতাম; কিন্তু আমরা তাহাতে কিছুম্রাত সন্তুষ্ট বা পরিতৃপ্ত হইতে পারিতাম না, যতক্ষণ মদীনায় গমন করিয়া উহা তাঁহাদের নিজেদের মুখ হইতে শুনিয়া না লইতাম।

[মুসনাদে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৪।]

বস্তুত মুসলিম জাহানের বিভিন্ন কেন্দ্র হইতে ইসলামী ইলম, হাদীস ও কুরআন শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে অসংখ্য মুসলমান সাহাবায়ে কিরামরে খিদমতে উপস্থিত হইত। তারা তাহাদিগকে সমাদরে ও সোৎসাহে গ্রহণ করিতেন এবং তাহাদের নিকট হাদসী পেশ কিরতনে। বিশেষত হযরত আবু হুরায়রা (রা) ও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত হইয়াছে যে, তাঁহাদের দরবার হাদীস শিক্ষাথীদের বিপুল ভীড় জমিয়া যাইত। কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হইলে তাহার জওয়াব পাইতে যথেষ্ট বিলম্ব হইত।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯২; তিরমিযী আওয়াবুল ইলম।]

হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাঁহার পুত্র আলী এবং দাস ইকরামাকে হযরত আবূ সাঈদ খুদরীর নিকট হাদীস শ্রবণের জন্য পাঠাইলেন। তারা যখন পৌঁছিল, তখন তিনি বাগানে ছিলেন। তাহাদিগকে দেখিয়া তিনি তাহাদের নিকট আসিয়া বসিলেন এবং হাদীস (বর্ণনা করিয়া) শুনাইলেন।

[ঐ]

৮. হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) ইলমে হাদীসের প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। সমগ্র জীবনই তিনি হাদীস শিক্ষাদানের পরিমণ্ডলে অতিবাহিত করেন। রাসূলে করীম (ﷺ)-এর অপরাপর সাহাবিগণ যখন নানা যুদ্ধে ব্যস্ত হইয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বসরার জামে মসজিদে রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস প্রচার ও শিক্ষাদানের কাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হইয়াছিলেন। তাঁহার হাদীস বয়ানের মজলিসে মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা ও সিরিয়া হইতে বিপুল সংখ্যক লোক উপস্থিত থাকিত। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের অন্যতম। তাঁহার বর্ণিত ৮০ টি হাদীস সহীহ বুখারী শরীফে, ৭০ টি হাদীস সহীহ মুসলিম শরীফে এবং ‌১২৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে স্থান পাইয়াছে।

৯. হযরত উবায় ইবন কাম্বব (রা) হাদীসে বিশেষ ব্যুৎপত্তি রাখিতেন, যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে যাহারা অধিক সংখ্যক হাদীস শুনিয়াছেন, হযরত উবায় তাঁহাদের একজন।

[তাযকিয়াতুল হুফফাজ-উবায় প্রসঙ্গ।] হাদীস প্রচারক বহু সাহাবীকেই প্রথমে তাঁহার নিকট শাগরেদী করিতে হইয়াছেন।

১০. মদীনার শাসনকর্তা আমর ইবন সাঈদ মক্কায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়রের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিতেছিলেন, তকন হযরত আবু শুরায়হ (রা) তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

হে আমীর ! আমাকে অনুমকি দিন, আমি আপনাকে রাসূল (ﷺ)-এর একটি হাদীস শুনাইব, যাহা তিনি মক্কা বিজয়ের পরের দিন দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন-আমার দুই কর্ণ তাহা শ্রবণ করিয়াছে, আমার অন্তঃকরণ তাহা হিফাজত ও মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে এবং তিনি যখন কথা বলিয়াছিলেন, তখন তাঁহাকে আমার এই দুই চক্ষু দেখিতেছিল। অতঃপর মক্কার হেরেম হওয়ার ও অন্যান্য কথা সম্বলিত একটি হাদীস শুনাইয়া দেন।

[বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা২১।]

হযরত আবূ শুরায়হার কথা হইতে প্রথমত এই জানা যায় যে, তিনি হাদীস পূর্ণমাত্রায় মুখস্থ ও হিফাজত করিয়া রখিয়াছিলন এবং দ্বিতীয়ত তিনি হাদীস বর্ণনার দায়িত্ব পালনে সবসময়ই প্রস্তুত থাকিতেন।

হযরত জাবির ইবনে আদুল্লাহ (রা)- ও মসজিদে নববীতে বসিয়া রীতিমত হাদীসের দরস দিতেন। আল্লামা সুয়ুতি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মসজিদে নববীতেই হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহর একটি শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। সেখানে লোকেরা একত্র হইয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করিত।

[*************]

সাহাবায়ে কিরাম (রা) লোকদিগকে হাদীসের কেবল মৌখিক শিক্ষাদান করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না, বরং হাদীস যাহাতে লোকেরা মুখস্থ করে এবং উহাকে তাহারা নিজেদের স্মৃতিপটে চিরদিনের তরে মুদ্রিত ও সুরক্ষিত রাখিতে পারে, সেইজন্য ও তাহারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেন ও বিশেষ যত্ন লইতেন। হাদীস মুখস্থ করা সম্পর্কে সাহাবীদের নিজস্ব প্রচেষ্টার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব যে, সাহাবিগণের নিকট যাহারা হাদীস শিক্ষার্থে আসিতেন- তাঁহাদিগকে হাদীস মুখস্থ করাইবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেন।

ইসলামের এই প্রথম যুগে মুসলমানগণ তাহাদের ছোট ছেলেমেয়েকে যেমন কুরআন মুখস্থ করার উদ্দেশ্যে বিশেষ বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করিতেন, অনুরূপভাবে হাদীস শিক্ষাকেন্দ্রে নিজেদের সন্তান-সন্ততিদিগকে প্রেরণ করিতেন। এতদ্ব্যতীত লোকদিগকে তারা হাদীস মুখস্থ করিবার জন্য বিশেষ তাকীদ করিতেন- সেইজন্য নানাভাবে উপদেশ দিতেন।

আবু নজরা নামক তাবেয়ী হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে বলিলেনঃ

******************************************************

আমরা আপনার নিকট হইতে যাহা শ্রবণ করি তাহা কি আমরা লিখিয়া লইব না?

ইহার জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

তোমাদের নবী করীম (ﷺ) আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন, আমরা তাহা মুখস্থ করিয়া স্মরণ রাখিতাম, অতএব তোমরাও আমাদের ন্যায় হাদীস মুখস্থ কর।

[********************]

হাদীসের হর-হামেশা চর্চা করার এবং সেইজন্য উৎসাহ দানের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম বিন্দুমাত্র ক্রটি করিতন না। তাবেয়ী যুগের ইলমে হাদীসের ইমাম ইকরামার উস্তাদে হাদীস হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাহাকে কিভাবে হাদীস শিক্ষা দিয়াছেন, তাহার বিবরণ দান প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ

******************************************************

ইবন আব্বাস আমাকে কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের জন্য আমার পায়ে বেড়ি পরইয়া দিতেন।

[তাযকিরাতুল হুফফায, যাহবী, পৃষ্ঠা ৯০।]

হযরত আলী (রা) বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা খুব বেশী করিয়া হাদীস চর্চা করিতে থাক, তাহা না করিলে তোমাদের এই ইলম (হাদীস-জ্ঞান) বিলিন হইয়া যাইবে।

[**************]

সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) বলিতেনঃ তোমরা পারস্পরিক হাদীস পর্যালোচনা ও চর্চা কর, কেননা কেবল চর্চা ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই উহার সংরক্ষণ করা সম্ভব।

[****************]

সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা সব সময় হাদীস চর্চা ও স্মরণ করিতে থাক।

তাবেয়ী আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লাও তাঁহার হাদীসের ছাত্রদিগকে প্রায়ই বলিতেনঃ

******************************************************

অর্জিত হাদীস-জ্ঞান বারবার চর্চা, স্মরণ ও আবৃত্তির মাধ্যমেই জীবন্ত ও সংরক্ষিত থাকিতে পারে। অতএব তোমরা সকলে হাদীসের চর্চা, স্মরণ ও আবৃত্তি করিতে থাক।

[**************]

অপর একটি বর্ণনায় এই কথাটি নিম্নরূপ বলা হইয়াছেঃ

হাদীস পারস্পরিক স্মরণ ও চর্চা কর, কেননা এইরূপ স্মরণ ও চর্চার মাধ্যমেই হাদীস জীবন্ত থাকিবে।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

এই সম্পর্কে হযরত ইবন আব্বাস (রা)-এর নিম্নলিখিত কথা অধিকতর স্পষ্ট। তিনি তাঁহার ছাত্রদের লক্ষ্য করিয়া বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা এই হাদীস পরস্পর মিলিত হইয়া চর্চা কর। তাহা হইলে ইহা তোমাদের নিকট হইতে বিলুপ্ত হইবে না। কেননা এই হাদীস কুরআন মজীদের ন্যায় সুসংবদ্ধ, সংকলিত ও সংরক্ষিত নয়। এই কারণে তোমরা ইহার ব্যাপক চর্চা না করিলে ইহা তোমাদের নিকট হইতে বিলীন হইয়া যাইবে।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৭।]

হযরত ইবন আব্বাসের নিম্নোক্ত বানীও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

তোমরা যখন আমাদের নিকট হইতে কোন হাদীস শুনিতে পাও তখন তোরা পারস্পরিক উহার চর্চা কর।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

হযরত ইবন উমর (রা) তাঁহার ছাত্রদিগকে তাকীদ করিয়া বলিতেনঃ

******************************************************

তোমাদের কেহ যখন অপর লোকের নিকট হাদীস বর্ণনার ইচ্ছা করে, তখন যেন সে অবশ্যই উহা তিন তিনবার আবৃত্তি করিয়া লয়।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৮।]

উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনা হইতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) যেমন নিজেরা হাদীস মুখস্থ রাখিতে ও উহার ব্যাপক প্রচার করিতে চেষ্টা করিতেন অনুরূপভাবে তাবেয়ী যুগের যে সব লোক তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষা করিতেন তাহাদিগকে উহা মুখস্থ করিয়া রাখিতে, উহার চর্চা করিতে ও পরবর্তী লোকদিগকে উহার শিক্ষাদান করিতে বিশেষভাবে তাকীদ করিতেন।

হাদীস বর্ণনায় সতর্কতা

নবী করীম (ﷺ) তাঁহার হাদীস প্রচার ও অপর লোকদের নিকট উহা বর্ণনা করার সুস্পষ্ট নির্দেম দিয়াছেন। কিন্তু এই প্রচার ও বর্ণনাকে তিনি অবাধ, স্বাধীন ও নিরংকুশ করিয়া দেন নাই। বরং তিনি হাদীস বর্ণনা ও প্রচারের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতাবলম্বনের জন্য অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাকীদ করিয়াছেন এবং তাঁহার নামে কোন মিথ্যা মনগড়া ও অসম্পূর্ণ কথা বর্ণনা ও প্রচার করিতে তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। এখানে এই প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর কয়েকটি বাণী উল্লেখ করা যাইতেছে।

হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন তাহার আশ্রয় জাহান্নামে খুজিঁয়া লয়।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলিবে, সে যেন জাহান্নাম তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।

হযরত মুগীরা ইবন শু’বা বলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমার সম্পর্কে কোন প্রকার মিথ্যা কথা বলা অন্য কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা বলার সমান নয়। কাজেই আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা ইচ্ছা করিয়া বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।

[এই সব কয়টি হাদীস সহীহ মুসলিম ****************************১ম খণ্ড, ৭ম পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত।]

বিভিন্ন সাহাবীর সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে উল্লিখিত তিনটি হাদীসেরই মূল প্রতিপাদ্য কথা একই এবং তাহা এই যে, রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে বা তাঁহার নামে কোনরূপ মিথ্যা কথা বলা কিংবা নিজের মনগড়া কথা রাসূলের নামে ও তাঁহার কথা বলিয়া চালাইয়া দেওয়া অত্যন্ত গুনাহের কাজ। নবী করীম (ﷺ) এইরূপ কাজ সম্পর্কে কঠোর নিষেধবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। হযরত মুগীরা (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে জানা যায় যে, রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা অপর কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলার সমান নয়। কেননা রাসূল ও রাসূলের কথা আল্লাহ ও আল্লাহর কালামরে পরে পরেই ইসলামী শরীয়াতের সনদ ও জ্ঞান-উৎস। কাজেই এইখানে কোনরূপ মিথ্যার অনুপ্রবেশ হইলে গোটা শরীয়াতের ভিত্তিই দুর্বল ও অবিশ্বাস্য হইয়া পড়ে। আর ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তি দুর্বল হইলে অতঃপর মানুষের মুক্তির কোন পথই আর উন্মুক্ত থাকে না। ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী গ্রন্হে এই হাদীসটি সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

এই হাদীসটি বিশুদ্ধতা ও সনদ শক্তির অকাট্যতার দিক দিয়া চূড়ান্ত ও অনস্বীকার্য। মুহাদ্দিসীনের এক বিরাট জামা’আত এই হাদীসটিকে ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।

[*****************]

ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালীর পিতা শায়খ আবূ মুহাম্মদ আল-জুয়াইনী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ) সম্পর্কে যে লোক ইচ্ছা করিয়া মিথ্যা বলিবে, সে কাফির হইয়া যাইবে।

[ঐ]

বস্তুত হাদীস বর্ণনা সম্পর্কে রাসূলে করীমের এইসব কঠোর সাবধান বাণীর কারণে সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূল সম্পর্কে কোন কথা বলিতে অত্যন্ত ভয় পাইতেন, বলিতে গেলে অতিমাত্রায় সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করিতেন এবং প্রত্যেকেই নিজের জানা ও বহুবার শোনা কথাকে অপর সাহাবীর নিকট পুনরায় শুনিয়া উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করিয়া লইতেন। ভূল হইলে তাহা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করিয়া লইতেও একবিন্দু ক্রটি করিতেন না। এমনটি রাসূল সম্পর্কে কোন মিথ্যা বলা হইয়া যাওয়ার আশংকায় অনেক সংখ্যক সাহাবীই হাদীস বণনা করিতে সাহস পাইতেন না। আর যখন বর্ণনা করিতেন, তখন তারা ভয়ে থর থর করিয়া কাপিতেঁন। অত্যন্ত দায়িত্ব ও চেতনাবোধ সহকারে প্রত্যেকটি হাদীস ও হাদীসের প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করিতেন।

এই কারনে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও বর্ণনা পরম্পরা শৃঙ্খলের ধারাবাহিকতা অটুট ও অবিচ্ছিন্ন না হইলে কখনই কোন হাদীস কবুল করিতেন না। পরবর্তীকালের হাদীস সংগ্রহকারীদের নিকট নিম্নোক্ত নীতি সর্ববাদ সম্মতরূপে গৃহীতি হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল সম্পর্কে একটি হাদীসও কাহারো ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলা প্রমাণ হইয়া গেলে সে ফাসিক সাব্যস্ত হইবে, তাহার বর্ণিত সমস্ত হাদীসই প্রত্যাহৃত হইবে এবং উহার কোনটিকেই শরীয়াতের দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না।

[************ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮।]

হাদীস বর্ণনায় সতর্কতাবল’ন সম্পর্কে এই নীতিমূলক আলোচনার পর সাহাবায়ে কিরামের জীবনের কতিপয় বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করিয়া এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করা আবশ্যক। আমরা এখানে কয়েকজন সাহাবীর কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

১। হযরত যুবায়র (রা) আদৌ কোন হাদীস বর্ণনা করিতেন না। একদিন হযরত আবদুল্লাহ (রা) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি অন্যান্য সাহাবীদের মত হাদীস বর্ণনা করেন না কেন? তিনি বলিলেনঃ রাসূলের সাথে আমার যদিও বিশেষ সম্পর্ক ছিল, তবুও যেহেতু আমি রাসূলের নিকট শুনিয়াছি, তিনি বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার ঠিকানা বানাইয়া লয়। (এই ভয়ে হাদীস বর্ণনা করি না।)

[আবূ দাউদ, কিতাবুল ইলম **********************]

২। বহু সংখ্যক সাহাবী একাদিক্রমে অনেক বৎসর পর্যন্ত ***************- ‘রাসূল (ﷺ) বলিয়াছেন’ এইরূপ উক্তি করিতেন না। ইমাম শা’বী বলেনঃ আমি এক বৎসর পর্যন্ত হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমরের নিকট অবস্থান করিয়াছি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন হাদীস বর্ণনা করেন নাই। হযরত সায়ের ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি হযরত তালহা ইবন আবদুল্লাহ হযরত সায়াদ, হযরত মিকদাদ ও আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)- এর সংস্পর্শে বহুদিন অবস্থান করিয়াছি; কিন্তু কাহাকেও কোন হাদীস বর্ণনা করিতে দেখি নাই। তাবে হযরত তালহা কেবলমাত্র উহুদ যুদ্ধের দিন সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করিতেন।

[সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল জিহাদ, পৃষ্ঠা ৩৯৬।]

৩। হযরত সায়ের ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি মদীনা হইতে মক্কা পর্যন্ত হযরত সায়াদ ইবনে মালিক (রা)- এর সহিত একত্রে সফর করিয়াছি; কিন্তু এই দীর্ঘ পথের মধ্যে তাঁহার মুখ হইতে একটি হাদীসও শুনিতে পই নাই।

[সুনানে ইবনে মাজাহ***************************]

৪। অনেক লোক সাহাবায়ে কিরামরে নিকট হাদীস শ্রবণের ইচ্ছা প্রকাল করিতেন, কিন্তু অনেক সময় তারা হাদীসি বর্ণনা করিতে অস্বীকার করিয়া বসিতেন। একবার কিছু লোক হযরত যায়দ ইবন আরকাম (রা) কে বলিলেনঃ আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করুন- হাদীস বর্ণনা করিয়া আমাদিগকে শোনান। ইহার উত্তরে তিনি বলিলেনঃ আমরা বৃদ্ধ হইয়াছি, ভুলিয়া গিয়াছি; হাদীস বর্ণনা করা বড়ই কঠিন কাজ।

৫। হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) কে একবার হাদীস বর্ণনা করিতে বলা হইলে তিনি জওয়াবে শুধু বলিলেন ‘ইনশা আল্লাহ’।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৪৬।]

অর্থাৎ তিনি হাদীস বর্ণনার দায়িত্ব এড়াইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন। (আর অনেক সাহাবীরই এইরূপ রীত ছিল।)। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের এই বানী-‘আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা বলিতে ইচ্ছা করিবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়’–আমাকে তোমাদের নিকট অধিক হাদীস বর্ণনা করিতে নিষেধ করে।

[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]

ইহার অর্থ এই নয় যে, তিনি আদ্য কখনো হাদীস বর্ণনা করিতেন না। হাদীস বর্ণনা করিতেন; কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি যারপরনাই সতর্কতা অবলম্বন করিতেন।

[****************] তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত আনাস (রা) হাদীস বয়ান কারা সময় অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িতেন- তাঁহার অন্তর কাঁপিয়া উঠিত। এই কারণে তিনি হাদীস বর্ণনা করার পর বলিতেনঃ রাসূলে করীম (ﷺ) এইরূপ বলিয়াছেন কিংবা ঠিক যেরূপ তিনি বলিয়াছেন।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪০।]

যে সব হাদীসের মর্মোদ্ধারে ভূল হওয়ার আশংকা থাকিত, তাহা হযরত আনাস (রা) আদৌ বর্ণনা করিতেন না। এতদ্ব্যতীত রাসূলের নিকট হইতে সরাসরি শ্রুত হাদীসের মধ্যেও পার্থক্য করিতেন।

[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪০।]

৬। হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) হাদীস বয়ান করিতেন, কিন্তু এই কাজে তিনি অপরিসীম সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি যদিও রাসূলের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং জীবনের বেশীর ভাগ সময় তিনি রাসূলের সংস্পর্শেই অতিবাহিত করিতেন; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি রাসূলের খুব বেশী হাদীস বর্ণনা করেন নাই। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৬৪ টি।

[****************]

৭। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইলমে হাদীসে বিরাট দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও হাদীস বয়ান করিয়াছেনঃ সাহাবীদের সমাজে হাদীস বয়ান করার ব্যাপারে হযরত ইবন উমর (রা) অপেক্ষা অধিক সতর্ক আর কেহ ছিলেন না। তিনি হাদীস কম বেশি করিয়া বর্ণনা করাকেও ভয় করিতেন।

[তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪।]

আবু জাফর তাবেয়ীও এই কথারই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬১।]

সায়ীদ তাঁহার পিতার জবানীতে বলিয়াছেনঃ হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইবন উমর অপেক্ষা অধিক সতর্ক আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।

[*********************]

বস্তুত এই সতর্কতাবলম্বনের কারণেই তিনি সাধারণত হাদীস বর্ণনা করিতে রাযী হইতেন না।

[***************]

৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা)-ও খুব কম এবং কদাচিৎ হাদীস বর্ণনা করিতেন। তিনি রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে মিথ্যা বলা সম্পর্কিত হাদীস সম্মুখে রাখিয়াই এই নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিছু সংখ্যক লোক একবার তাঁহাকে বলেনঃ আপনাকে খুব কম হাদীস বর্ণনা করিতে দেখিতেছি, অথচ অমুক অমুক সাহাবী এবং হযরত ইবন মাসউদ (রা) যথেষ্ট সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেন। অন্য কথায় রাসূলের সংস্পর্শে আপনার বিশিষ্ট স্থান থাকা সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনায় আপনি এতদূর পশ্চাদপদ কেন? ইহার জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

শোন, ইসলাম কবুল করার পর আমি কখনো রাসূল (ﷺ)- এর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অবস্থান করি নাই। কিন্তু আমি রাসূল (ﷺ) কে বলিতে শুনিয়াছিঃ আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় করিয়া লয়।

[মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা (উর্দূঅনবাদ), পৃষ্ঠা ৭৩, বুখারীশরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১। বুখারীর বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদের নামের উল্লেখ নাই; কিন্তু ইবন মাজা’হর রেওয়ায়েতে তাঁহার উল্লেখ আছে।(****************) এবং ইসমাঈলীর বর্ণনা ********** ‘যখন হইতে আমি ইসলাম কবুল করিয়াছি’ কথাটির উল্লেখ আছে, বুখারীতে তাহা নাই।]
 

বস্তুত এই ভয়ই ছিল তাঁহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার একমাত্র কারণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *