হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়

হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়

পূর্বের আলোচনা হইতে পাঠকদের নিকট একথা সুস্পষ্ট হইয়াছে যে, তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীসের চর্চা, প্রচার, সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ অধিকতর উন্নতি, বিকাশ সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। ইহার এক একটি বিভাগ স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ এই শতকে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার দিকে পূর্বের তুলনায় অনেক ব্যাপক ভিত্তিতে মনোনিবেশ করিয়াছেন। হাদীস সংগ্রহকারিগণ হাদীসের সন্ধানে মুসলিম জাহানের প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পর্যটন করিয়াছেন, প্রত্যেকটি স্থানে উপস্থিত হইয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করিয়াছেন। সংগ্রহীত হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলিত করিয়া বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বৃহদাকারের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।

এই শমতকে মুসলিম সমাজে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যাহার ফলে হাদীস-বিজ্ঞান নামে স্বতন্ত্র এক জ্ঞান বিভাগের উদ্ভাবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হইয়া পড়ে। হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহার নাম হইতেছে ******************** ‘হাদীস পর্যালোচনা ও সামালোচনা বিজ্ঞান’। হাদীস পর্যালোচনা ও সমালোচনা বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করার জন্য উপরোক্ত পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক।

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজ

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজক এক কথায় বহুবিধ ইসলাম বিরোধী ভাবধারা ও ফিতনা-ফাসাদে জর্জরিত বলিয়া অভিহিত করিতে হয়। খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম সময় হইতেই ইসলামের উপর মুহুর্মুহু যে প্রচণ্ড আঘাত আসিতে থাকে, উহাকে সামরিক পরিভাষায় ‘বহিরাক্রমণ’ বলা যাইতে পারে। বিশেষত হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা)-এর সময়কালীন আঘাতসমূহকে এই পর্যায়ে গণ্য করা যায়। কিন্তু ইসলাম এই সকল বহিরাক্রমণকে উহার অন্তর্নিহিত প্রবণ শক্তি ও দৃঢ়তার বলে প্রতিহত করিয়া দেয়। পরবর্তীকালে ইসলামী খিলাফতকে চূর্ণ করিয়া দিয়া জাহিলিয়াতের সর্বপ্লাবী সয়লাবে ইসলামের নাম-নিশানা পর্যণ্ত ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু সাহাবা-উত্তরকালে একনিষ্ঠ তাবেয়ীনের অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনা ও অভিনিবেশের ফরে ইসলাম উহার আদর্শিক বুনিয়াদকে মজবুত ও অটল করিয়া রাখিতে সমর্থ হয়। ইসলামের দুশমনগণ বহিরাক্রমণের আঘাতে উহাকে খতম করিতে ব্যর্থ হইয়া উহার অভ্যন্তর হইতে গোপন ষড়যন্ত্রের সাহায্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। এই পর্যায়ে ইসলামের দুশমনগণ ইসলামের নামে এমন সব চিন্তু, মত, আকীদা ও বিশ্বাস সর্বসাধারণ মুসলমানের মধ্যে অবলীলাক্রমে প্রচার করিতে থাকে, যাহার ফলে তৈলহীন প্রদীপের মত ভিতর হইতেই নিঃশেষে ইসলামের চির নির্বাণ লাভের উপক্রম হয়।

মুসলিম সমাজে এই পর্যায়ে যেসব বাতিল চিন্তা ও মতবাদের উদ্ভব হয়, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম হইতেছে বল্গাহীন বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল প্রবণতা। বুদ্ধির কষ্টিপাথরে ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস পর্যন্ত ওজন ও যাচাই করা শুরু হয়। যাহা মানুষের সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ বুদ্ধি ও বিবেকের তুলাদন্ডে উত্তীর্ণ হয় না, তাহা প্রত্যাখ্যাত হইতে থাকে। ইহাতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক আকীদা- যাহার উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত – পরিত্যক্ত হইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃত হইতে থাকে।

ইহার পর কুরআন ‘মখলূক’ (সৃষ্ট) কি ‘গায়র মখলূক’ (অসৃষ্ট কাদীম) এই পর্যায়ে মুসলিম সমাকে আলোচনা ও বিতর্কের এক প্রচণ্ড তাণ্ডবের সৃষ্টি হয়। ফলে কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশসমূহ নিষ্ঠা সহকারে পালন করিয়া চলার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়, মানুষ এই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর বিতর্কে পড়িয়া বিভ্রান্ত ও গোমরাহ হইতে শুরু করে।

আব্বাসী যুগের শেষভাগে মুসলিম সমাজে নাস্তিকতাবাদ একটি আকীদা ও বিশ্বাস হিসাবে প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। এই সময়কার নাস্তিকতাবাদগণ প্রকাশ্যভাবে নিজেদেরকে মুসলিম বলিয়া দাবি জানাইত বটে; কিন্তু ভিতরে তাহারা গোটা ‘দ্বীন’কেই সম্পূর্ণরূফে অস্বীকার করিয়া চলিত। এই যুগের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রীক গ্রন্হাবলী আরবী ভাষায় অনুদিত হয় এবং মুসিলম সমাজে ইহা ব্যাপকভাবে পঠিত ও চর্চা হইতে শুরু হয়। ফলে নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মহীনতার চিন্তা এক বিজ্ঞানসম্মত মত হিসাবেই জনগণের নিকট গৃহীত হইতে থাকে।

প্রাচীনকালে অমূলক কিসসা-কাহিনীও এই সময় মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। স্বকপোলকল্পিত কাহিনীতে রঙ-চঙ লাগাইয়া জনগনের নিকট অধিকতর আকর্ষনীয় করিয়া তুলিবার জন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করা হয়। উহাকে হাদীসের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী রূপ দিতে ও রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতেও দ্বিধাবোধ করা হইত না। ফলে কুরআন ও রাসূলের হাদীস হইতে সাধারণ মুসলমানের দৃষ্টি ফিরিয়া উহার বিপরীত দিকেই সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ হয়। বস্তুত এই সকল ব্যাপারই ছিল ইসলামের পক্ষে মারাত্মক ফিতনা এবং হাদীস জালকরণের ব্যাপক প্রবণতাই এই ফিতনার বাস্তব রূপ।

উল্লিখিত ফিতনাসমূহের প্রত্যেকটি পর্যায়ে বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, রাসূলের হাদীস হইতে সমর্থন গ্রহণের জন্য দূরন্ত চেষ্টা চালানো হইয়াছে। কিন্তু রাসূলের প্রকৃত হাদীসসমূহে যখন উহার একটির প্রতিও একবিন্দু সমর্থন পাওয়া যায় নাই, তখন তাহারা সকলেই- এই ফিতনাসমূহের প্রায় সকল ধারকই- নিজস্বভাবে কথা রচনা করিয়া রাসূলের নামে হাদীস বর্ণনাসূত্র (সনদ) জুড়িয়া দেওয়া হয় এবং উহাকে এমনভাবে পেশ করা হইতে থাকে, যেন সকলেই উহাকে রাসূলের মুখ নিঃসৃত বাণী বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লয়- অন্তত এই দিক দিয়া সন্দেহ করার কোন প্রকাশ্য কারণ না থাকে। ঠিক এই অবস্থায় প্রত্যেকটি হাদীস সমালোচনার কষ্টিপাথরে ওজন ও যাচাই করিয়া লওয়ার অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয় এবং হাদীস নামে বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাকে যাচাই পরীক্ষা করিয়া কোনচি প্রকৃতপক্ষে রাসূলের বাণী ও কোনটি নয়, তাহা নির্ধারণ করার জন্য কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য উপায় পদ্ধতি হিসেবে হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞান পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।

[******************** গ্রন্হের ৩৬১ পৃষ্ঠা হইতে ৩৪২ পর্যন্ত আলোচনা ছায়া অবলম্বনে।] ইহার ফলে ইসলামকে খতম করার এই ভিতরের দিক হইতে আসা আক্রমণও শেষ পর্যন্ত চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সহজেই চিন্তা করা যায়, এই সময় যদি হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করার দিকে উক্ত রূপ গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য আরোপ করা না হইত, তাহা হইলে মিথ্যা হাদীসের স্তূপ মুসলিম মানসকে সর্বাত্মকভাবে আচ্ছন্ন ও পূর্ণমাত্রায় গোমরাহ করিয়া ফেলিত, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই। উপরিউল্লিখিত প্রত্যেকটি ফিতনার সময় যখনই মুসলিমদের দৃষ্টি কুরআন হাদীস হইতে ভিন্নদিকে ফিরিয়া যাইতে শুরু করিয়াছে, তখনি সমাজে এমন সব মহান ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে, যাঁহারা প্রবল শক্তিতে হাদীস হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন, পুঞ্জীভূত আবর্জনা দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রকৃত হাদীসে রাসূলকে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং মুসলিম মানসলোককে রাসূলের প্রকৃত হাদীসরে অম্লান আলো বিকিরণে সমুদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছেন। এই ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যে ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়োজিত হইয়াছে, তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।

খিলাফতে রাশেদার পরে উমাইয়া বংশের লোক উমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা নির্বাচিত হইয়া হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য যে ব্যাপক ব্যবস্থা সরকারী পর্যায়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে এ কথা পুনরায় ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা গৃহীত না হইলে রাসূলে করীমের বিপুল সংখ্যক দুনিয়ার বুক হইতে বিলীন হইয়া যাইত।

বনু আব্বাসীয়দের সময়েও যখন হাদীসের উপর সমূহ বিপদের ঘনঘটা সমাচ্ছন্ন হইয়া আসিয়াছিল তখনো একজন খলীফা (আসলে বাদশাহ) হাদীস সংরক্ষণ ও উহার সঠিক প্রচারে উদ্যোগী হন। তিনি হইতেছেন আল-মুতাওয়াককিল আলাল্লাহ (২৩২ হিঃ)। তিনি স্বভাবতই সুন্নাতে রাসূলের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই মুসলিম জাহানের সর্বত্র হাদীস সংরক্ষণ ও উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ পাঠাইলেন। এই সময়কার শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ আবূ বকর ইবনে শায়বা জামে রাসাফা’য় হাদীস শিক্ষাদান শুরু করেন। ফলে তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষার জন্য মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে প্রায় ত্রিশ সহস্র ব্যক্তি সমবেত হয়, অপর দিকে তাঁহারই সহোদর উসমান ইবনে আবূ বকর জামে আল মনসুর এ হাদীস অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁহার সম্মুখেও অনুরূপ সংখ্যক হাদীস শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়।

হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণের প্রতি আল-মুতাওয়াককিলের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিয়া সমস্ত মুসলিম জনতার দিল আল্লাহর নিকট তাঁহার জন্য আকুল প্রার্থনায় উচ্ছাসিত হইয়া উঠে; তাঁহার প্রশংসা তাহারা বাকমুখর হইয়া উঠে, সকলেই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধ ও সম্মান প্রদর্শন করিতে থাকে। এমনকি এই সময় জনগনের নিম্নোক্ত কথাটি একটি সাধারণ উক্তিতে পরিণত হয়ঃ

******************************************************

খলীফা তো মাত্র তিনজনঃ মুরতাদগণকে দমন ও হত্যা করার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর, জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করণে উমর ইবনে আবদুল আযীয এবং হাদীস ও সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন এবং বাতিল পন্হীদের দমন ও ধ্বংস সাধনে আল মুতাওয়াককিল।

[********************]

অপরদিকে হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও বাছাই-ছাঁটাইর পর সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরণের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই শতকের অপূর্ব গুরুত্ব, মর্যাদা এবং ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হইয়াছে। এই বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্য যে প্রতিভা ও দক্ষতা অপরিহার্য ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহে তাহাতে ভূষিত হইয়াছে কয়েকজন ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তারা হইতেছেন ছয়খানি সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ- প্রণেতা- ছয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদঃ

১. ইমাম বুখারী, ২. ইমাম মুসলিম, ৩. ইমাম নাসায়ী, ৪. ইমাম তিরমিযী, ৫. ইমাম আবূ দাউদ এবং ৬. ইমাম ইবনে মাজাহ। তাঁহাদের প্রত্যেকের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ জ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক একটি বিস্ময়।

এখানে আমরা প্রথমে এক একজন হাদীসবিদের জীবনালেখ্য সংক্ষেপে আলোচনা করিব এবং পরে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের বিস্তারিত পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে পেশ করিব। এই আলোচনা হইতে এই শতকে হাদীসের চরম পর্যায়ের উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ সম্ভব হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *